0
undefined undefined undefined

সম্পাদকীয়

Posted in








একেক জন মানুষ থাকেন, যাঁর জন্য সময় থমকে দাঁড়ায়। হাত ধরতে চায় তাঁর। সেই মানুষটির কিন্তু অপেক্ষা করার সময় নেই। তিনি সদা ব্যস্ত। সমকাল কোন মাপকাঠিতে তাঁর দৈর্ঘ্য- প্রস্থ জরিপ করবে, সে নিয়ে কণামাত্র শিরঃপীড়া নেই তাঁর।

তাই আপন খেয়ালে তিনি মগ্ন। সাহিত্যানুরাগী ও গবেষকদের কথা ভেবে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি শুরু করলেন অভিনব একটি সংগ্রহশালা এবং গবেষণাকেন্দ্র। বিষয় লিটল ম্যাগাজিন। সাহিত্যচর্চার যে নিবিড়, ঋদ্ধ ধারাটি আমাদের সবিশেষ গর্বের কারণ, তার আঁতুড়ঘর ছাড়া আর কীইবা বলা যায় লিটল ম্যাগাজিনকে? আর সেই ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারকে যিনি ধ্যানজ্ঞান করে তোলেন, কীভাবে অভিহিত করব আমরা তাঁকে? তথাকথিত এইসব বিশ্লেষণ আর স্বীকৃতির তোয়াক্কা করেননি তিনি।

সন্দীপ দত্ত। আত্মপ্রচারবিমুখ, সদা হাস্যময় এই মানুষটির এই একলা পথচলা থেমে গেলো সম্প্রতি। রেখে গেলেন নানা ভাষার লক্ষাধিক পত্র পত্রিকা ও বইয়ের এক আশ্চর্য সম্ভার। তাঁর অন্তিম যাত্রায় স্বতস্ফূর্তভাবে সামিল হওয়া অগণন মুখচ্ছবি একথা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করলো এখনও সব মূল্যবোধ আর যাবতীয় ভালোবাসার মৃত্যু হয়নি।

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।
শুভেচ্ছা নিরন্তর












0 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in





ভারসাম্যই সৃষ্টির প্রাথমিক শর্ত। বিশ্বের প্রতিটি কণা ও শক্তি সেই নির্দিষ্ট ভারসাম্যে বাঁধা। তার এতটুকু চ্যুতি হলে সৃষ্টি থাকেনা। ভারসাম্য এবং পরিপূর্ণতা। প্রকৃষ্টরূপে প্রস্ফুটিত প্রকৃতি সৃষ্টিরসের ধারক ও বাহক। অন্তর্জগত ও বহির্জগৎ একই। শুধু প্রকাশের তারতম্য। আর অনুভূতির তারতম্য। কারণ অন্তর্জগতে এক বিশুদ্ধ অস্তিত্ব, মধুঋতুর যে প্রেমজ অস্তিত্ব তা ধরা পড়ে অনির্বচনীয় ভাবে। সেই রসের পথিক যাঁরা তাঁরা আমাদের চোখে সহজে ধরা দেন না। ‘মনের মানুষ’ এর প্রেমে নিজের মধ্যে নিজেই ডুবে থাকেন। এই দুর্লভ প্রেম আমাদের অনুভূতির বাইরে। কারণ আমাদের রসের পথে আর একজনকে চাই। এক নয়, দুই থাকলে তবে আস্বাদন। আর এমন হবেনাই বা কেন? এই বিশ্বপ্রকৃতিই যে সেই মায়া সৃষ্টি করে। সে এমন মায়া সৃষ্টি করে যে বসন্ত নামের এই ঋতুতে মানবমনের গহীন ভালোলাগা আর ভালোবাসার উৎসমুখ থেকে নির্ঝরিণীর মতো প্রবাহিত হয় মধুর ফল্গুধারা। পৃথিবীর মানব মানবী অন্তহীন কাল ধরে এই ঋতুর আগমনের প্রতীক্ষা করে। মনে পড়ে জ্যোৎস্নারাতে কুঞ্জবনে এক বিখ্যাত কবি তাঁর নাট্যকাব্যে নরনারীর এমন প্রেমকাব্যে পরীদের দিয়ে জাদু রসের ফোঁটা ছুঁইয়েছিলেন ঘুমন্ত নায়ক নায়িকাদের চোখে। ফলস্বরূপ, গাধার মুখোশে ঢাকা যুবকের প্রতিও নারীটি প্রবল প্রেম অনুভব করেছেন। পরীর জাদুই হোক, বা অন্তরের প্রেমের বাসনাই হোক, প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। মিডসামার নাইট’স ড্রিম এর বহুতর রূপকার্থ থাকতে পারে, কিন্তু একথা সত্য যে বসন্তের মলয়ানিল, জ্যোৎস্নার মধুর স্পর্শ, প্রেমিক প্রেমিকাকে বাহ্য রূপের আড়ালে এমন অন্য অনুভবে পৌঁছে দিয়েছিল। ওই জাদু রস আসলে প্রকৃতির মধু। মধু ঋতুর মধু। বসন্ত এমনই অঘটন ঘটাতে পারে।

প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে রাজারা দুটি ঋতুকে দিগবিজয় মৃগয়া ও প্রমোদের জন্য নির্বাচন করেছেন। একটি শরৎ অন্যটি বসন্ত। তবে যুদ্ধ পরিকল্পনা চলত শরতেই। বসন্ত প্রমোদের কাল। তখন যুদ্ধ নয়, সন্ধি। কেতুন হতে ভুনাগ রাজার রানি হোরি খেলতে ডেকেছিলেন পাঠান রাজাকে। রাজা সেই প্রস্তাবে কোনো লড়াইয়ের পূর্বাভাস পাননি। কারণ এদেশে তখন উৎসবের কাল। প্রেমের ঋতু। চারিদিকে প্রকৃতির মধ্যে মিলনের আহবান, সৃষ্টির আহবান। প্রস্ফুটিত পুষ্পে ভ্রমরের গুনগুনানি। পরাগমিলনের জন্য উৎসুক প্রতিটি ফুল।

এত আয়োজন সত্ত্বেও আমরা রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে অন্য সুর শুনতে পাই।

“বসন্তকালে আমরা বহির্জগৎ উপভোগ করি। উপভোগের সমস্ত উপাদান আছে, কেবল একটি পাইতেছি না। উপভোগের একটা মহা অসম্পূর্ণতা দেখিতে পাইতেছি। সেইজন্য আর কিছুই ভালো লাগিতেছে না। এতদিন আমার সুখ ঘুমাইয়াছিল। আমার প্রিয়তম ছিলনা। আমার আর কোনো সুখের উপকরণও ছিলনা। কিন্তু জ্যোৎস্না বাতাস ও সুগন্ধে মিলিয়া ষড়যন্ত্র করিয়া আমার সুখকে জাগাইয়া তুলিল। সে জাগিয়া দেখিল তাহার দারুণ অভাব বিদ্যমান। সে কাঁদিতে লাগিল। এই রোদনই বসন্তের বিরহ”।

এই যে অজানা এক কারণে বিরহ, এত সুখের উপাদানের মধ্যেও কী যেন নেই, এই প্রকৃতপক্ষে বসন্তের আগমনের গূঢ় উদ্দেশ্য।

একটু গভীরে যাওয়া যাক। প্রকৃতির এমন সজ্জা কেন?

একটি চিরন্তন কাহিনীর কথা হোক। রাজ্য জুড়ে বসন্তোৎসব। ফুলের আভরণে সজ্জিত নরনারী কুঙ্কুম চন্দন হিঙ্গুলের আল্পনায় সজ্জিত হয়ে চলেছেন উৎসবকুঞ্জে। এমনই তো ছবি আঁকা আছে কালিদাসের কাব্যে, বৈষ্ণব কবির কল্পনার পদাবলীতে! সেখানে নৃত্য গীতে আসবে আসঙ্গে পৃথিবীর প্রাচীন লীলাখেলায় মেতে উঠবে যুবক যুবতী। বন্ধনহীন প্রেমের উৎসব। প্রমোদের আনন্দ কোলাহলে মুখর হয়ে উঠেছে উৎসব প্রাঙ্গণ। কিন্তু এই কূলপ্লাবী মধুধারার মধ্যে নিঃশব্দ পদচারনায় এসে পড়েছে বসন্ত মহামারী। নগরীর বাইরে, প্রাকারের একধারে, অন্ধকারে ফেলে রেখে আসা হয়েছে এককালের নগরশ্রেষ্ঠা নটীকে। রাজনর্তকী বাসবদত্তা। সারা অঙ্গে রোগের কালিমা। মারণ রোগ। সেও তো বসন্ত! দেখতে পাই, ধীর পায়ে কাছে এসে রোগসন্তপ্ত মাথাটি কোলে তুলে নিচ্ছেন এক নবীন সন্ন্যাসী। সেই সন্ন্যাসী, যার রূপে মুগ্ধ নটী মাত্র কয়েকটি বসন্ত আগে নিজের কুঞ্জে তাঁকে আহবান করেছিলেন। সন্ন্যাসী তাকে প্রকৃত কালের জন্য অপেক্ষা করতে বলেছিলেন। এখন করুণায় সিক্ত তাঁর দুটি আয়ত নয়ন রোগিণীর ব্যাধির গ্লানি যেন দেহ থেকে মুছে নিচ্ছে। দুটি অতি আকাঙ্ক্ষিত প্রিয় হাতের সেবায় সুস্থ বোধ করছেন বাসবদত্তা। মনে ভাবছেন কোনটি সত্য? কোনটি তাঁর পরম প্রাপ্তি? ইন্দ্রিয়ের উৎসবে মেতে ওঠা? নাকি অতীন্দ্রিয় এই প্রেম যা তাঁকে আপ্লুত করেছে অন্তরে বাইরে? একি অদ্ভুত দোলাচল! প্রিয়তম পরমাকাঙ্খিত জনকে পেয়েছেন মনের আলোয় অরূপের ঘরে। অবশেষে এক প্রভাতে ব্যাধিমুক্ত নটী অনুভব করেন, বসন্ত কোনও প্রমোদঋতু নয়, বসন্ত মহামারী নয়, বসন্ত সেই কাল, যখন উৎসবকে ছাপিয়ে দেহকে ছাপিয়ে দেহাতীত অনির্বচনীয় আনন্দে স্থিত হওয়া যায়। বেদ যাকে বলছে মধুবিদ্যা।

অরূপরতনেও এমন দেহাতীত প্রেমের কথাই বলেছেন কবি। বাইরের আলো নিভে গেলে অন্তরের আলোয় পরম প্রেমাস্পদকে দেখে নিতে হবে। রূপের ঘরে তালা পড়বে। অরূপে মিলবে ‘মনের মানুষ’।

প্রাচীন সাহিত্যে বসন্তের একটি সুন্দর চিত্র আঁকা আছে।

ওঁ মধু বাতা ঋতায়তে মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ।
মাধ্বীর্নঃ সন্তোষধীঃ।
মধু নক্তম উতোষসো মধুমৎ পার্থিব রজঃ।
মধুমান্নো বনস্পতির্মধুমাং অস্তু সূর্যঃ। ওঁ।

(ঋকবেদ, নবম-মণ্ডল, মধুমতী সুক্ত)

বাতাসে মধু, নদী জলাশয় সাগরে মধুর ধারা, ঊষা ও রাত্রি মধুময়, পৃথিবীর ধূলিকণা মধুময়, বনস্পতিসকল মধুমান, সূর্যের কিরণসকল মধুবর্ষী। আর এই মধুময় পরিবেশ আমাদের পরম সন্তোষ দান করে। এটিকে বেদবর্ণিত মধুবিদ্যার বাহ্যপ্রভাব বলা চলে। অন্তরে মধুবিদ্যা যার লাভ হবে তিনিই প্রকৃতিকে বা বহির্জগতকে এমন মধুময় দেখবেন। তাঁর অন্তরের মধু বাইরে লিপ্ত হয়েছে। এই রহস্যের কারণেই উপনিষদকে রহস্যবিদ্যা বলা হয়েছে। আর একটু এগিয়ে দেখা যাক।

এই মধুময় সন্তোষের অনুভব একমাত্র মানুষেরই হয়। কারণ মানুষ প্রকৃতির অপূর্ব সৃষ্টি। মানুষের মাথা নাকি তার সর্বশ্রেষ্ঠ রত্নাগার। সোনার খনি। আর তাই, হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ বাহ্য জগতে ও অন্তর জগতেও সেই সোনার খনি থেকে সমানে সোনা উৎপন্ন করতে চেয়েছে। এই যে নানা শাস্ত্র নানা বিদ্যা শিল্পকলা সঙ্গীত সব কিছুর মূখ্য উদ্দেশ্য সেই সোনা, বা সেই বিশুদ্ধ অস্তিত্বকে ধারণা করা। মানব ইতিহাসে যত জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাস আমরা দেখতে পাই সে সবই সেই পরম ধনের সন্ধান। অক্ষয় অব্যয় এক নিত্য চেতন অস্তিত্বের সন্ধান। বেদে একে বলেছে হিরণ্ময় কোষস্থ ব্রহ্ম। ব্রহ্ম সেই নিত্য চেতনা। হিরণ্ময় কোষ সেই কোষ যা সেই পরম চেতনাকে ধারণ করতে পারে।

এ নিয়ে মানুষের গবেষণার অন্ত নেই। কোন সে শর্ত যা পূরণ হলে হিরণ্ময় কোষ বিকশিত হয়? ঋষি বলছেন, যখন একটি মানুষ তাঁর পূর্ণ যৌবনে উপনীত হন (চব্বিশ বছর আট মাস সেই সঠিক বয়স), তাঁর দেহের একটি মাত্র কোষও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়না, ঠিক তখনই তাঁর দেহস্থ প্রাণশক্তি, যা দেহকে আলেখ লতার মতন জড়িয়ে থাকে, তা দেহ থেকে নিঃসৃত হয়ে সহস্রার পদ্মে (মস্তিষ্কে) সংকলিত হয়, তখন তাঁর হিরণ্ময় কোষ পূর্ণ বিকশিত হয়।

উপনিষদ বলছে, সত্যের মুখ হিরণ্ময় পাত্রের দ্বারা আবৃত। সেই হিরণ্ময় পাত্রের অপসারণ হলেই পরম জ্ঞান। সত্য সূর্যের আলোয় সেই আবরণ অপসারিত হয়। নতুন কোষের জন্ম হয়। এই যে একটিমাত্র শর্তের উল্লেখ করছেন উপনিষদ, একটি পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত মানবদেহ, যার একটি কোষও নষ্ট হয়নি, সেটিই প্রকৃতির দান। বাহ্য প্রকৃতিতে এই দান আমরা প্রত্যক্ষ করি একটি বিশেষ সময়। সেটি বসন্ত কাল। বসন্তের প্রধান বৈশিষ্ট্য সূর্যের অধিক সময়ের উপস্থিতি। সূর্যের কিরণপাতে প্রকৃতির ভাঁড়ারে উদ্ভিদ বেশি সময় ধরে খাদ্য প্রস্তুত করতে পারে। সেই বর্ধিত চাহিদার কথা মাথায় রেখে নতুন নতুন পাতা গজিয়ে ওঠে। নানা ফুলে গাছ ভরে ওঠে। ফুলে ফুলে পাখি প্রজাপতি ও মৌমাছি ভিড় করে। কারণ, এক অজ্ঞাত রহস্যে ফুলের রেণু মধুতে পরিণত হয়। এই যে প্রকৃতি নামক রসায়নাগারে জীবনদায়ী মাধুর্যের সৃষ্টি হয় তাইই বসন্তের দান।

এ নিবন্ধে আমরা অন্তরপ্রকৃতিতে বসন্তের আগমন নিয়ে বরং দু’চার কথা লিখি। কারণ, এই যে জগত, তা আসলে আমাদের অন্তরজগতেরই প্রতিফলন মাত্র। আয়নায় মুখ দেখার মতো। তাই দেখা যাক, অন্তরজগতে যৌবনদূত বসন্ত কিসের দ্যোতক।

যে বিশেষ বয়সের কথা উল্লেখ হয়েছে সেই বয়সে একটি তরুণ শরীর সমস্ত দেহ দিয়ে আনন্দ আস্বাদন করার ক্ষমতা রাখে। সেই মধু সে কিভাবে আস্বাদন করে? সংসারে নরনারীর মিলনজনিত যে আনন্দ অত্যন্ত প্রাকৃতজনও জানে, সেও যৌবনের ধর্ম, বার্ধক্যের নয়, কারণ শরীর জীর্ণ, আবার কৈশোরেরও নয়, কারণ শরীর পূর্ণত্বপ্রাপ্ত নয়। মহামানব বলছেন, পাঁচ বছরের বালক রমণের আনন্দ কি, জানে না। (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত)। তাহলে এই যে প্রাণশক্তির সংকলন একটি আনন্দের জন্ম দেয়, তা ধারণা ও অনুভব করতে একটি পূর্ণবিকশিত দেহ চাই। নতমুখী কমল যেমন সূর্যের প্রথম কিরণের স্পর্শেই উর্দ্ধমুখী হয়, ঠিক তেমনই অন্তরসূর্য উদিত হলে হৃৎকমল প্রস্ফুটিত হয়।

ছান্দোগ্য উপনিষদে মধুবিদ্যা নামক অধ্যায়ে এই শ্লোকটি পাই।

ওঁ অসৌ বা আদিত্যো দেবমধু তস্য দ্যৌরেব তিরশ্চীনবংশ’ন্তরিক্ষমপূপো মরীচয়ঃ পুত্রাঃ।

শ্লোকটির শব্দার্থঃ ওই আদিত্য দেবগণের মধু। বক্র বংশদণ্ডের মতো দ্যুলোক ওই মধুর অবলম্বন। অন্তরিক্ষ তার মধুচক্র। আর সূর্যকিরণ সমূহ থেকে জাত জলই মক্ষিকাশাবক।

অদ্ভুত শ্লোকটির মধ্যে একটি রূপক নিহিত। উপনিষদ যেহেতু রহস্যবিদ্যা, তাই এর দুটি দিক থাকে। জগত বা ম্যাক্রোকজম এবং অন্তর বা মাইক্রোকজম। প্রথমে জাগতিক অর্থ বিচার করা যাক।

অসৌ বৈ আদিত্যঃ – সূর্য। বাইরের সূর্য, যা আকাশে দেখি, যা আমাদের সকল শক্তির উৎস, প্রাণের কারণ। আকাশের ওই সূর্য সকলকার বাইরের চৈতন্য স্বরূপ – “তমসো মা জ্যোতির্গময়”।

দেবমধু – সর্বজনপ্রিয়। মানুষ। মানুষই দেব।

তস্য – তার, অর্থাৎ আকাশের সূর্যের অবলম্বন কি? বক্র বংশদণ্ডের চিত্রকল্প অপরূপ! দিকচক্রবালকে কি এমনই দেখায়না? যেন একটি নরম বাঁশকে নোয়ানো হয়েছে। এটিই দ্যৌঃ।

অন্তরিক্ষ – সেই দ্যৌ-এর অবলম্বন।

মরীচয়ঃ – সূর্যের রশ্মিসমূহ।

অপূপঃ – এটি উপমা। মানসচক্ষে কেমন দেখতে লাগবে তার আভাস।

পুত্রাঃ – সূর্যকিরণসম্ভূত জল।

ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্বে বা বাইরে এর অর্থ এই, যে, আকাশের সূর্য মানবজগতের মধু বা চৈতন্যস্বরূপ। কারণ সূর্যের উদয়ে তমোনাশ হয়ে জ্ঞানের উদয় হয়। অন্তরিক্ষ মধুচক্র বা মৌচাক। অর্থাৎ সূর্যের রশ্মি অন্তরিক্ষরূপ মধুচক্রে সঞ্চিত হয়। তারপর সেই রশ্মিসমূহ যেন মধুর ধারার মতোই পৃথিবীতে বর্ষিত হয়।

দেহতত্ত্বে এর অর্থ কি? দেখে নিই—

মস্তিষ্কে সেরিব্রামে যে গ্লায়াল কোষগুলি আছে সেগুলিকে সম্মিলিতভাবে একটি ফুলের মতো দেখা যায়। মানুষের প্রাণের মোট চারটি অবস্থা। জাগ্রত স্বপ্ন সুষুপ্তি ও তুরীয়। এই চার অবস্থার যে কোনো দুটিতে সেরিব্রাম বা সহস্রারে সূর্য দেখতে পাওয়া যায়। সে অন্তর সূর্যের দহন নেই, আছে স্নিগ্ধ জ্যোতি। “রামচন্দ্র যখন সভায় এলেন তখন সভাস্থ সকলের হৃৎপদ্ম প্রস্ফুটিত হল” – কথামৃত। এখানে রামচন্দ্র সেই অন্তর সূর্যের প্রতীক। মহামানব বলছেন – রামের জ্যোতিতে সভাস্থ লোকের হৃৎপদ্ম প্রস্ফুটিত হল, কিন্তু তারা পুড়ে গেলনা কেন? কারণ এ জ্যোতি স্নিগ্ধ। এ জ্যোতি চেতনাকে প্রেমে লিপ্ত করে, তাই এর মাধুর্য।

অন্তর সূর্যের অবলম্বন মানুষের চতুর্থ প্রাণচৈতন্য, তথা তুরীয়। যাকে নির্গুণ বলা হয়। নির্গুণ, কারণ তা আমাদের জ্ঞানের আলোয় নেই। এই নির্গুণ, যা আমাদের দেহেই, তা থেকে অবতরণ হচ্ছে অন্তরিক্ষে। সূর্যের কিরণসমূহ এখানে চৈতন্যের আলো। তাকে মধু বলা হয়েছে। কেন? কারণ এই চৈতন্য শুধু জ্ঞান নয়, প্রেমও দান করে। “যাকে দেখবিনি তাকে ভালোবাসবি কি করে?”

এই যে নিজেকে জানা, এর মধ্যে মধুর কী? কেনই বা এর ফলে জগত মধুমতী মনে হবে? কারণ, ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না’। এই শাশ্বত নিত্যকার যে স্বরূপ, যে ‘বৃহৎ আমি’ তাকেই আমি ‘মনের মানুষ’ বলি। ইন্দ্রিয়ের দ্বার রুদ্ধ হলে সকল রস ‘মধু’তে পরিণত হয়ে আমাকে সেই ‘বৃহৎ আমি’র প্রেমে আবদ্ধ করে। এই স্বর্গীয় প্রেমের আভাস দেখা যায় মহামানবের জীবনে। নিরালম্ব সেই প্রেমে মত্ত শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। তাঁরা চিরবসন্তের দেশের মানুষ। তাঁদের প্রেমাস্পদ তাঁদের অন্তরে সদা বিরাজিত।

বৃহদারণ্যক উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের পঞ্চম ব্রাহ্মণে দেখছি পৃথিবী, জল, অগ্নি, বায়ু, আদিত্য, দিকসকল, চন্দ্র, বিদ্যুৎ, মেঘ, ধর্ম, সত্য, আদি প্রত্যেককেই ‘মধু’ বলা হয়েছে। অবশেষে মানুষকেই ‘মধু’ বলা হয়েছে। সত্যিই ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’।

উপনিষদ ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব ও দেহতত্ত্ব দুটি দিক থেকেই ‘মধু’ অর্থে চৈতন্য ও প্রাণকে নির্দেশ করেছেন।

মধুর স্বাদ মিষ্টি। মধু বলবর্ধক সর্বরোগহর। ঠিক তেমনই অন্তরে ‘চৈতন্য’রূপ ‘মধু’পাত হলে, আত্মজ্ঞান লাভ হলে, জগত মধুময় মনে হয়। আকাশ বাতাস বৃক্ষ নদী সব মধুময় মনে হয়।

এই যে মধুময় অনুভব, এ যেকালে হয় সেটিই বসন্ত। উন্মুখ পুষ্প প্রস্ফুটিত ও বিকশিত হবার অপেক্ষায়। সূর্যের অমল কিরণ স্নিগ্ধ। গ্রীষ্মের দাবদাহ নেই, নেই শীতের হিমপ্রবাহ। আছে সুন্দর আবহাওয়া। আছে অমল কিরণে উদ্ভাসিত প্রাণের উৎসব। আছে নিজেকে জানার মধ্যে দিয়ে জগতকে নতুন চোখে দেখার অভূতপূর্ব অনুভব। নব নব প্রেমে এ জীবনকে ভালো লাগার, ভালোবাসার উৎসব। নবীন সন্ন্যাসীর অপরূপ মুখখানি তখন ইন্দ্রিয়ের অতীত এক প্রেমের অনুভব আনে। তা ক্রমে তাঁকে ছাপিয়ে জগতে ছড়িয়ে পড়ে। হরিণশিশুর চঞ্চলতাও তখন মধুর লাগে। আসলে ছোঁয়া লেগেছে অন্তরে। পরম এক পুরুষের ছোঁয়া। যিনি সূর্যের মতন সদা বিরাজমান। যার অমল কিরণ আমাকে অন্তর থেকে দীপ্ত করেছে। দেহ থাক আর নাই থাক, অস্তিত্ব জুড়ে তিনি আছেন, এই অনুভব। এই মধু ঋতুতে অন্তরের বীণায় যার সুর বাজে

“ওহে সুন্দর মম গৃহে আজি পরমোৎসব রাতি
রেখেছি কনক মন্দিরে কমলাসন পাতি।”

তিনিই অনুভব করেন, হৃৎকমলে সোনার আসন পাতা। দেহ থেকে উত্থিত হয়ে আমার পরমাস্পদ, আমার প্রাণ আজ আসবেন মিলনোৎসবে। এইই প্রকৃত মিলন।

মধু হোক পৃথ্বী মধু হোক সাগর, মধুময় হোক মানবহৃদয়।

[মার্চ ২০২১, জাগ্রত বিবেক]

0 comments:

1
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in




















যদি কোনও বইয়ের পাতা ওল্টালেই চোখে পড়ে বইটিকে রেকো করেছেন আমাদের দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের নামকরা উজ্বল সব জ্যোতিষ্কের দল তাহলে আমার মত হরিদাস পাল পাঠকের হাল যে কী হয়!

যেমন ধরুন, দেশের প্রধান বিচারপতি রমন্না, দলিত তাত্ত্বিক কাঞ্চা ইলাইয়া, অভিনেতা সুহাসিনী মুলে ও নাসিরুদ্দিন শাহ, গায়ক এবং প্রতিবাদী চরিত্র টি এম কৃষ্ণ, জনস্বাস্থ্য কর্মী ডঃ শ্রীনাথ রেড্ডি, সম্পাদক রামমনোহর রেড্ডি, কংগ্রেসের সাংসদ জয়রাম রমেশ, সাফাই কর্মচারি আন্দোলনের সর্বপরিচিত মুখ বেজওয়াড়া উইলসন, এবং মনমোহন সিংয়ের প্রাক্তন মিডিয়া উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ সঞ্জয় বারু।

এই তারকা মণ্ডলীর মাঝে চোখে পড়বে দুটো নাম শংকরাইয়া ও বচাম্মা—অন্ধ্রের ছোট্ট গাঁয়ের দুই কৃষিশ্রমিক ও সংগঠক ,যাদের সাদা কালো ছবি বইয়ের মাঝে রয়েছে।

বইয়ের নাম “ল্যান্ড গানস্‌ কাস্ট ওম্যান”—ঘোষিত ভাবে জনৈক পথ হারানো বিপ্লবীর স্মৃতিচারণ। লেখিকা গীতা রামস্বামী।

এইটুকু দেখে যদি বইটি বন্ধ করে তাকে তুলে রাখেন তো মস্ত ভুল করবেন। এটি একেবারেই নানা প্রাক্তন বিপ্লবীর দাম্ভিক আত্মগর্বী ফাঁপানো ফোলানো কাহিনী নয়, যেখানে তিনি কোন ভুল করেন নি। শুধু জনগণ তাঁকে বুঝতে ভুল করে ছেড়ে গেছে।

বরং এটি এক বিনম্র নারীর অন্তরঙ্গ আলাপন, যিনি হাতড়ে হাতড়ে পথ খুঁজে নেন। যাঁর কাহিনীতে সাফল্যের চেয়ে বিফলতার খতিয়ান বেশি। যিনি অকপটে নিজের ভুল স্বীকার করেন এবং জীবনের একটি বাঁকে এসে মনে করেন এবার ঘরে ফেরার সময়।

না, এটা ঠিক পরাজয়ের সালতামামি নয়। কারণ, এঁর মূল সংগ্রাম রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে নয়। বরং নিজের ভেতরের সংস্কারের এবং চারপাশের পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে। এছাড়া জাতপাতের বিরুদ্ধে, উনি টের পান যে পিতৃতন্ত্র এবং জাতপাতের মূল দর্শন একই।

বোধহয় একটু ভুল বললাম। ওই লড়াই তাঁকে টেনে নিয়ে গেল ভুমিহীন দলিত মানুষদের আঙিনায় এবং দেখলেন যে সবচেয়ে অবহেলিত এবং পীড়িত মানুষেরা অধিকাংশই দলিত সম্প্রদায়ের। আবার তাদের জমির অধিকারের জন্য মাথা উঁচু করে কথা বলতে গিয়ে মুখোমুখি হতে হল ল্যান্ড রেভিনিউ বিভাগ, পুলিশ এবং আদালতের। অর্থাৎ রাষ্ট্রশক্তির।

কিন্তু ওঁর পথচলার ভূগোল অসাধারণ। নারীবাদ, নক্সালবাদ, আম্বেদকরপন্থা এবং ভূমিহীনদের জমির অধিকারের জন্য আইনি এবং অহিংস পথে আন্দোলন। ছোট ছোট সাফল্যের উদাহরণ কম নয়। গোড়ার দিকে এমার্জেন্সির সময় আত্মগোপন করেছেন, ধরা পড়েছেন।

নকশালদের সর্বভারতীয় নেতাকে খুব কাছ থেকে দেখে, তাঁর নারীদের প্রতি তাচ্ছিল্য এবং সাধারণ ক্যাডারদের প্রতি একনায়কসুলভ আচরণে গীতার মোহমুক্তি ঘটে।

এরপর দিল্লির কাছে গাজিয়াবাদের দলিত বস্তিতে থেকে ওদের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব নেওয়া, কয়েক বছর পরে অন্ধ্রে ফিরে গিয়ে শহরের শান্ত অ্যাকাডেমিক জীবনের হাতছানি এড়িয়ে জীবনসঙ্গীর সঙ্গে অন্ধ্রের প্রান্তিক গাঁয়ে গিয়ে কৃষিশ্রমিকদের মজুরি আন্দোলনের সংগঠন গড়া, জমিদারদের সরকারি ও দেবোত্তর জমি গাপ করার তথ্য বের করে সরকারি আইন অনুযায়ী তা ভূমিহীনদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার লড়াই। বছরের পর বছর। একটা কাগজের টুকরো নিয়ে রোদ্দুরে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকা, পুলিশের ভয় দেখানো, বারবার গ্রেফতার, সম্মানহানির ও প্রাণনাশের বাস্তবিক ভয়।

একটা সময় ক্লান্তি, ঘরে ফিরে আসা। তারপর হায়দ্রাবাদ বুক ট্রাস্ট খুলে সুলভ মূল্যে তেলুগুতে বিশ্বসাহিত্য এবং দলিত সাহিত্যের প্রায় চারশ’ বই প্রকাশ । এর মধ্যে জীবনসাথী সিরিল রেড্ডিকে দুরারোগ্য অসুখে হারিয়ে ফেলা।

ওঁদের অনুবাদের তালিকায় আছেন অ্যালেক্স হ্যালে থেকে মহাশ্বেতা দেবী। নিজে বেশ কিছু বই তেলুগু থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন।

সবমিলিয়ে এই বই পড়া একটি ফ্যাসিনেটিং এক্সপিরিয়েন্স।

লেখালেখি এবং অধ্যাপনার জগতে ফিরে এসে উনি আরও বই আগে লিখেছিলেন।

উনি যুক্তভাবে লিখেছেন “টেকিং চার্জ অফ আওয়ার বডিজ”(২০০৫), সম্পাদনা করেছেন “দ্য অক্সফোর্ড ইন্ডিয়া অফ তেলুগু দলিত রাইটিং” (২০১৬)।


একটু গোড়ায় আসি।

জন্মেছিলেন তামিল ব্রাহ্মণ পরিবারে। বাবা সরকারি আধিকারিক। তিন মেয়ে, চাইছিলেন ছোট মেয়েকে ছেলের মত করে মানুষ করতে। চেয়েছিলেন উচ্চশিক্ষা দিতে। তাই ওকে পড়তে পাঠালেন ওসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। এখানেই ভুল হল।

সত্তরের দশকের হায়দ্রাবাদের ওসমানিয়া আর আজকের দিল্লির জে এন ইউ একেবারে তুল্যমূল্য।

ছোটবেলা থেকে কী এবং কেন প্রশ্ন করা গীতার গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারের অন্ধকূপে দম আটকিয়ে আসছিল। অকপটে লিখেছেন যে তখন পাশ্চাত্ত্যে ব্রা জ্বালিয়ে দেওয়া ছিল বিদ্রোহের পরিচায়ক, আমাদের বাড়ির সংস্কৃতিতে ব্রা পরাই ছিল বিদ্রোহ।

কারণ মা এবং ঠাকুমা ওদের তিনবোনকে শিক্ষা দিতেন –ব্রা পরে ছেনালরা। বুক ঢাকতে হয় ঘরে সেলাই করা কাপড়ের টুকরো দিয়ে। চোদ্দ বছরের মেয়েটি এ নিয়ে প্রশ্ন করত, বিদ্রোহ করত। আর মজেছিল অংকের দুনিয়ায়।

ওসমানিয়া ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে তার আত্মার মুক্তি হল। মেয়ে বলে নিজেকে গুটিয়ে রাখার বদলে সে গর্বিত হতে শিখল। পড়াশুনায় মেরিট লিস্টে ছিল। বন্ধুবান্ধব এবং ক্যাম্পাসের বিতর্ক এবং সাহিত্য তাকে ধীরে ধীরে চেনাল বর্ণব্যবস্থাকে, তার বর্বর রূপকে। বাড়ির শিক্ষার বা সংস্কারের থেকে একেবারে আলাদা।

ইউনিভার্সিটির প্রগতিবাদী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন জর্জ রেড্ডি, ছাত্র নেতা। বিজেপি গুণ্ডার আক্রমণে নিহত হলেন। তার ফলশ্রুতিতে ক্যাম্পাসে আন্দোলন আরও মজবুত হল। জর্জের ভাই সিরিল (পরে নামকরা মানবাধিকার আইনজীবি) এবং কয়েকজন মিলে গড়ে তুললেন নতুন সংগঠন।

অন্ধ্রে তখন নকশাল আন্দোলনের জোয়ার এসেছে। এঁরা সবাই যুক্ত হলেন চারু মজুমদারের মূল এম-এল পার্টিতে নয়, বরং অন্ধ্রের সিপিএম থেকে সদ্য বেরিয়ে আসা চন্দ্রপুল্লা রেড্ডির দলে। পার্টি সেলে বিয়ে করলেন সিরিল রেড্ডিকে, খুব একটা কিছু নয়া ভেবেই।

বাড়িতে খবর যাওয়ায় মায়ের অসুখের মিথ্যে খবর দিয়ে গীতাকে ডেকে এনে ঘরে বন্দী করে তালা লাগিয়ে দেওয়া হল। দিনে দু’বার খাবারের থালা ভেতরে যেত।

দিদিরা কোন সাহায্য করল না। বাবা-মা ডাক্তারকে বল্লেন—নকশালরা ওর ব্রেন ওয়াশ করেছে।

ফলে মানসিক হাসপাতালে অনেকবার ইলেক্ট্রিক শক দেওয়া হল। এর ক্ষতিকর ফল পরবর্তী জীবনে টের পেয়েছেন। পরে পরিণত বয়সে বাবা-মা এবং বিবাহিত দিদিদের সঙ্গে যোগাযোগ পারিবারিক অনুষ্ঠানে যাওয়া সব হল, কিন্তু ভাঙা সম্পর্ক আর জোড়া লাগল না।

কমরেডদের সহায়তায় শঠে শাঠ্যং করে বাড়ির জেলখানা থেকে মুক্ত হলেন। গীতাকে আর পায় কে!

কিন্তু তখন ইন্দিরা গান্ধীর এমার্জেন্সি! এনকাউন্টারে মারা যাচ্ছে সাথীরা। চারদিকে পালাও ! পালাও!

আর স্পয়লার দেব না।

তবু কয়েকটা কথা।

তাঁর প্রথম জীবনে গ্রামে কৃষিশ্রমিক ও দলিতদের মধ্যে থাকার অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছিলেন যে অন্ধ্রের গ্রামাঞ্চলে সবচেয়ে বড় জমির মালিক ও বর্বর অত্যাচারী হলো রেড্ডিরা। কিন্তু কয়েক দশক ধরে ওখানকার ক্ষমতা দখল করে মসনদে বসে থাকা সবাই রেড্ডি, কংগ্রেস হোক কি বিজেপি।

পুলিশ, রেভিনিউ, আদালত সর্বত্র রেড্ডিদের প্রতাপ এবং এঁরা অধিকাংশই বৈবাহিক সূত্রে আত্মীয়।

এই জাল ভেদ করে গরীবের জন্যে লড়াই কত কঠিন। অনায়াসে লুকোছাপা না করে নাম নিয়ে বলেন ইউনিভার্সিটি দিনের আর এস এসের এক আদর্শাবাদী তরুণের কথা, যে পরিণত বয়সে ক্ষমতাশালী জমিদার হল। তিনিও এক রেড্ডি বটেন। এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের ডাকসাইটে মন্ত্রী।

হঠাৎ তিনি খেয়াল করলেন যে তাঁর জীবনসঙ্গী এবং লড়াইয়ের সাথী সিরিলও রেড্ডি! অনেক বন্ধুবান্ধব এবং ঘনিষ্ঠরাও তাই।

দ্বিতীয়, বাইরের থেকে গরীবের লড়াই লড়তে যাওয়া গীতা রামস্বামীর মত আদর্শবাদীরা অনেক সময় বিশুদ্ধ বইয়ের ফর্মূলা থেকে অনেক ভুল নির্দেশ দেয়—মেরে ফেল, কেটে ফেল গোছের। কিন্তু গরীবেরা জানে, ওদের ওখানে থাকতে হবে। পুরনো বন্ধন এমন ভাবে ছিঁড়ে ফেলা যায় না।

তারা প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে এই মেয়েটির কথা শোনে। কিন্তু দূরগামী সিদ্ধান্ত নেয় প্র্যাক্টিক্যাল অভিজ্ঞতা থেকে, যা অনেক সময় মধ্যপন্থার মত দেখায়।

পরে বোঝা যায় ওরাই ঠিক ছিল।

বইটি পড়লে বুঝতে পারি জীবন ঠিক জয়-পরাজয়ের ব্যালান্স শীট নয়, বরং পথ চলাটাই আসল। পথের বাঁকে যে কত বিস্ময় লুকিয়ে থাকে, কত নাম না জানা ফুল গোপনে ফোটে। এই পথের পাঁচালীর শেষ বাক্যটিতে ভৈরবীর সুর বাজে—“ After all this time, after a quarter of a century, there was still so much love. Only love”.


গীতা রামস্বামী আমার বয়েসী। এই ৪২৬ পাতার বইটি ওঁর নিজেকে আয়নায় দেখার মতন।

বইটি প্রকাশ করেছেন হায়দ্রাবাদের নবায়ন , পাওয়া যাচ্ছে হার্ড কভার এডিশনে, দাম ৫৯৯ টাকা।

1 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - দিলীপ মজুমদার

Posted in




















১৯৪৮ সালের ৩০ জানু্য়ারি দিল্লির আলবুকার্ক রোডের ঘনশ্যাম দাস বিড়লার বাড়ির বাগানে বিকালের প্রার্থনাসভায় গান্ধীজিকে গুলি করে হত্যা করেন নাথুরাম গডসে । হত্যার পরে তিনি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করেন নি । হত্যার ব্যাপারকে অস্বীকারও করেন নি । নেথুরাম গ্রেপ্তার হন । তারপরে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁর ভাই গোপাল গডসে ,নারায়ণ আপ্তে ও বিষ্ণু কারকারেকে ।

১৮৪৮ সালের ৮ নভেম্বর বিচারালয়ে নাথুরাম এক দীর্ঘ জবানবন্দি দেন । চিফ পাবলিক প্রসিকিউটার জবানবন্দি দেবার ব্যাপারে আপত্তি করলেও বিচারপতি জবানবন্দি দেবার সম্মতি দেন । নাথুরামের জবানবন্দিটি দীর্ঘ , মোট ১৫০ টি অনুচ্ছেদে বিভক্ত । তখন বহু প্রকাশক পুস্তিকাকারে জবানবন্দিটি প্রকাশ করতে আগ্রহী ছিলেন । কিন্তু ভারত সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হবার আশঙ্কায় এটি নিষিদ্ধ করেন । ৫০ বছর নিষিদ্ধ থাকার করে ১৯৮৩ সালে মুম্বাই হাইকোর্ট রায় দেন , ‘ঐতিহাসিক গবেষণার কোনও বিষয়কে ভারতীয় আইনের ১৫৩ ধারার অপব্যবহার করে আটকে রাখা যায় না । ’ এই রায়ের পরে ১৯৯২ সালে জবানবন্দিটি বুকলেটের আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ।

গান্ধীজির মতো এক লোকমান্য নেতাকে হত্যা করা অতীব নিন্দনীয় বিষয় । কিন্তু শুধু এই হত্যাকে সামনে রেখে নাথুরাম সম্বন্ধে যে সমালোচনা করা হয় , জবানবন্দির আলোকে তার পুনর্বিচার প্রয়োজন । আবার এই জবানবন্দির আলোকে বিচার করা দরকার নাথুরামকে শহিদ বানানোর যে চেষ্টা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি করে চলেছে , তার যৌক্তিকতা । প্রথমে গান্ধী সম্পর্কে নাথুরামের মনোভাব বিচার করা যাক । নাথুরাম বলেছেন , ‘ব্যক্তিগতভাবে গান্ধীজির সঙ্গে আমার কোন শত্রুতা ছিল না ’ ( অনু. ১১৮) । গান্ধীজি যে দেশের জন্য কষ্ট স্বীকার করেছেন , সে কথা বেশ স্পষ্টভাবে বলেছেন গডসে , ‘দেশের জন্য গান্ধীজি যা করেছেন , তার প্রতি সম্মান জানিয়ে আমি তাঁর কাছে প্রণত হই , প্রণত হই ব্যক্তি গান্ধীজির জন্য এবং তাঁর দেশসেবার জন্য ’ (অনু. ১৩৯ ) । তিনি বলেছেন , ‘ তাঁকে গুলি করার আগে আমি তাঁর মঙ্গল কামনা করেছি , শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছি ’( অনু. ১৩৯ ) । ‘প্রিয় রামদাসভাই’ সম্বোধন করে তিনি গান্ধীপুত্রকে চিঠিতে লেখেন , ‘আমার হাতে আপনার শ্রদ্ধেয় পিতার মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য আপনি এবং আপনার আত্মীয় পরিজন যে কষ্ট পেয়েছেন, একজন মানুষ হিসেবে বলতে পারি , তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না । ’

গান্ধীহত্যা চোরাগোপ্তা কোন আক্রমণ নয় । তার পরিণাম সম্বন্ধে সচেতন ছিলেন নাথুরাম । ১৩৫ নং অনুচ্ছেদে তিনি বলেছেন , ‘মানুষের কাছ থেকে ঘৃণা ছাড়া আমার আর কিছুই প্রাপ্য থাকবে না এবং আমার প্রাণের চেয়ে বেশি মূল্যবান সম্মান আমি হারাব । ’ নাথুরামের এই বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে যে পুলিশ বা বিচারব্যবস্থার শাস্তির চেয়ে বড় শাস্তির কথা , যার নাম জনবিচ্ছিন্নতা , যার ফলে প্রাণের চেয়ে মূল্যবান সম্মান হারাতে হবে । যিনি বলেছেন গান্ধীর প্রতি তাঁর কোন ব্যক্তিবিদ্বেষ ছিল না , তিনি কেন হত্যা করলেন তাহলে ? সে কথা নাথুরাম তাঁর জবানবন্দিতে একাধিকবার অত্যন্ত সুস্পষ্টভাষায় বলেছেন , “তাঁর কর্মপদ্ধতি ও অনুসৃত নীতির প্রসঙ্গে আমার যে তীব্র অনীহা এবং অসম্মতি রয়েছে তা গোপন করতে চাই না । ‘বিভেদ আনো-শাসন করো’র যে নীতি ব্রিটিশ শক্তি অনুসরণ করত , গান্ধীজি সেই নীতিকেই সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদন করেছেন । ভারতবর্ষের বিভাজন প্রক্রিয়ায় গান্ধীজি সাহায্য করেছেন ” ( অনু. ৬৮ ) । নাথুরামের দৃষ্টিতে এটা গান্ধীর ‘আদর্শের অধঃপতন’ । ‘অধঃপতন’ শব্দটি কেন প্রয়োগ করলেন নাথুরাম ? তাহলে কি তিনি বলতে চেয়েছেন যে আদর্শ গান্ধীর ছিল , তা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন তিনি ? নাথুরাম বলেছেন গান্ধীজি তাঁর কর্মপন্থা কার্যকর করতে গিয়ে হাতুড়ে ডাক্তারের সর্বরোগহর ওষুধের মতো যে সব নীতি ও আদর্শের কথা বলতেন , তা সমূহ ক্ষতিসাধন করেছে দেশের ও দশের । এর উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি মোপলা বিদ্রোহ , খিলাফৎ , আফগান-আমির চক্রান্ত , আর্যসমাজের উপর আক্রমণ , সিন্ধুর বিযুক্তিকরণ, কংগ্রেস থেকে লিগের বিদা্য় , ভারত বিভাজনের জন্য ক্রিপস প্রস্তাব গ্রহণ , সুরাবর্দীর পৃষ্ঠপোষকতা , দেশাই-লিয়াকৎ চুক্তি , ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান, পাকিস্তান সম্বন্ধে দ্ব্যর্থবোধক বিবৃতি ইত্যাদি ঘটনার উল্লেখ করেছেন । গান্ধী সম্পর্কে তাঁর আরেকটি মারাত্মক অভিযোগ , ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে খিলাফতের সঙ্গে যুক্ত করে তিনি স্বেচ্ছায় ধর্মকে রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন ’ ( অনু. ৭০ক ) । গান্ধীকে তিনি হত্যা করেন এই ভাবনায় যে গান্ধীর অবর্তমানে ‘ভারতীয় রাজনীতি হয়ে উঠবে অনেক বাস্তববোধসম্পন্ন , প্রতিরোধী , সামরিক শক্তিতে বলবান ’ ( অনু. ১৩৫) ।

হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি যে নাথুরামকে শহিদ বানাতে চায় এ কথা আমরা সংবাদ মাধ্যম থেকে জানতে পারি । হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক জবানবন্দির আলোকে বিচার করা যাক । ২৬ নং অনিচ্ছেদে তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন তাঁর জন্ম এক হিন্দুধর্মনিষ্ঠ পরিবারে । হিন্দুধর্ম , হিন্দু ইতিহাস তিনি ভালোবেসেছিলেন । কিন্তু পরবর্তীকালে ‘বেদে সব আছে’ বলে হিন্দুত্বের যে আস্ফালন , তা তাঁর জবানবন্দিতে আমরা দেখতে পাই না । হিন্দু সংগঠনে যোগ দেবার কথা স্বীকার করেছেন তিনি । কিন্তু সেই সঙ্গে বীর সাভারকর ও শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর সঙ্গে তাঁর মতভেদের কথাও তিনি পরিষ্কারভাবেই বলেছেন । প্রমাণ ৩৪, ৩৫ , ৩৭ , ৪১ , ৪২, ৪৭ নং অনুচ্ছেদ । তিনি যে সাভারকরের ‘হাতের পুতুল’ নন সে কথা তুলে ধরেছেন বাদীপক্ষের কাছে ; আবার বলেছেন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী হিন্দু মহাসভার সভাপতি হবার পরে ‘তাঁর কংগ্রেসের হাতের পুতুলে পরিণত হতে দেরি হল না । ’ তিনি গান্ধীজির ও মুসলিম লিগের কার্যকলাপের প্রতিরোধ করার জন্য যে কর্মপন্থা গ্রহণ করেছিলেন ‘তার নেতৃত্ব দেওয়াতো দূরের কথা , শুধুমাত্র সমর্থনের জন্য ওদের ( সাভারকর ও শ্যামাপ্রসাদ ) আমন্ত্রণ জানানো সম্ভব নয় ’ ( অনু. ৩৫ ) । দিল্লিতে গান্ধীর প্রার্থনাসভায় বিক্ষোভ দেখানোর জন্য সাভারকর নাথুরামকে তিরস্কার করেছিলেন বলে তিনি উল্লেখ করেছেন । ভারতভাগের সিদ্ধান্তচূড়ান্ত হবার পর সাভারকর ও হিন্দু মহাসভার প্রথম সারির নেতারা পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন , ‘ একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্র যে সরকারের হাতে যাক না কেন , তাকে আমরা কখনও কোন দলের সরকার বা কংগ্রেস সরকার হিসেবে গণ্য করব না । পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার জন্য আমরা দুঃখ প্রকাশ করব ঠিকই , কিন্তু নবজাত স্বাধীন ভারতবর্ষের সরকার হিসেবে ওই সরকারকে মান্য করাই হবে আমাদের কর্তব্য । …. হিন্দু মহাসভার সভ্যরা যদি ভারত রাষ্ট্রের প্রতি কোন ধ্বংসাত্মক মনোভাব নেয় , তাহলে দেশের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে , আর তার ফলে গোটা ভারতবর্ষকে পাকিস্তানে পরিণত করার নীতিহীন গোপন অভিসন্ধিই সাফল্য পাবে ’ (অনু. ৩৮)

তাহলে নাথুরাম কি ধর্মোন্মাদ মানুষ ? ২৬ নং অনুচ্ছেদে তিনি বলেছেন যে হিন্দুত্ব বিষয়ে গর্বিত হলেও ‘বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি নিজেকে কোন রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গোঁড়ামির শৃঙ্খলে আবদ্ধ না রেখে স্বাধীন চিন্তার প্রবণতা গড়ে তুলে শুরু করলাম । সেইজন্য আমি আমার জন্মসূত্রে প্রাপ্ত জাতিভেদপ্রথা ও অস্পৃশ্যতা বিলোপের জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করেছি ’ ( অনু. ২৬ ) । ‘রাজনৈতিক বা ধর্মীয় গোঁড়ামির শৃঙ্খল’ এবং ‘স্বাধীন চিন্তার প্রবণতা’ শব্দগুলি লক্ষ্য করার মতো । শুধু তাই নয় , ৫১ নং অনুচ্ছেদে তিনি বলেছেন যে দেশের জনজীবনে ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক প্রভাব পরিহার করা দরকার , বলেছেন ‘নির্বাচনের ক্ষেত্রে , তা আইনসভার ভিতরে কিংবা বাহিরে এবং মন্ত্রীসভা ভাঙা কিংবা গড়ার ক্ষেত্রেও এই একই নীতি অনুসরণ করা হবে । যৌথ নির্বাচনরীতি এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতিকে তাই বরাবর যুক্তিসিদ্ধ হিসেবে মেনে এসেছি । ’

নাথুরামের জবানবন্দিতে মুসলমানদের প্রতি কোন জাতিবিদ্বেষ প্রকাশ পায় নি । হিন্দুদের প্রতি অত্যাচারের কথা আছে , হায়দ্রাবাদ ও কলকাতায় দাঙ্গায় হিন্দুদের প্রাণহানির কথা আছে ; কিন্তু এ সবের জন্য তিনি জাতি হিসেবে মুসলমানদের দায়ী করেন নি , দায়ী করেছেন নিজাম ও তাঁর মন্ত্রীদের, মুসলমান রাজাদের , সুরাবর্দী ও জিন্নার মতো রাজনৈতিক নেতাদের । ৫৪ নং অনুচ্ছেদে তাঁর তাৎপর্যপূর্ণ উক্তি : ‘ মুসলিম লিগ মুসলমান সমাজের গোঁড়ামি ও অশিক্ষাকে ভালোভাবেই কাজে লাগাতে পেরেছে । ’

গান্ধীহত্যা যে সুপরিকল্পিত কোন ষড়যন্ত্র নয় সে কথা বলতে গিয়ে নাথুরাম বলেছেন , ‘ এই মামলায় আমার সঙ্গে আরও কয়েকজনকে ষড়যন্ত্রকারী সাব্যস্ত করে অভিযুক্ত করা হয়েছে । আমি আগেই বলেছি , আমি যা করে্ছি তাতে আমার কোন সহযোগী ছিল না এবং এ কাজের দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে আমার । আমার সঙ্গে যদি এঁদের অভিযুক্ত না করা হত , তাহলে আমি হয়তো কোন আইনজীবী নিয়োগ করতাম না । ’ তাহলে , প্রকাশ্য দিবালোকে গান্ধীকে হত্যা করে এবং আত্মরক্ষার চেষ্টা না করে নাথুরাম আসলে কি করতে চেয়েছিলেন ? ১৪৯ নং অনুচ্ছেদে সে প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন তিনি , ‘এটাই সত্য যে আমি প্রকাশ্য দিবালোকে তিন-চারশো মানুষের সামনে গান্ধীজিকে গুলি করেছি ( বোমা নয় , গুলি ) । আমি পালিয়ে যাবার কোন চেষ্টা করি নি । আসলে আমার মনে পালিয়ে যাবার কোন চিন্তাই ছিল না । আমি নিজেকে গুলি করার চেষ্টাও করি নি । সে ইচ্ছা আমার ছিল না । কারণ আমি চেয়েছিলাম খোলা আদালতে সর্বসমক্ষে আমার চিন্তা-ভাবনা মানুষকে জানাতে । ’ নাথুরাম গডসের ‘চিন্তা-ভাবনা’র ধর্মনিরপেক্ষ ,ঐতিহাসিক পর্যালোচনা এখনও অপেক্ষিত ।

মতামত লেখকের নিজস্ব । লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক ।

0 comments:

1
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - প্রদোষ ভট্টাচার্য্য

Posted in





















১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে এইচ জি ওয়েলস সাহেব Pall Mall Budget নামক পত্রিকায় ‘The Flowering of the Strange Orchid’ নামে একটি বিচিত্র ছোট গল্প প্রকাশ করেন। গল্পের কেন্দ্রে ছাপ্পান্ন বছরের অকৃতদার Winter Wedderburn, যাঁর আক্ষেপ হলো যে তাঁর জীবনে কৌতূহলোদ্দীপক কিছু কখনো ঘটেনিঃ তিনি শৈশবে কখনও দুর্ঘটনায় পড়েন নি, তিনি কখনও প্রেমে পড়েন নি, তাঁর বিয়েও হয়নি। অথচ, তাঁর পরিচিত – এবং অপরিচিত – সবারই জীবন কত বৈচিত্রপূর্ণ! যেমন, ছত্রিশ বছরের অর্কিড-সংগ্রাহক Batten, যার সংগ্রহ ওয়েডারবার্ন কিনতে সেদিন লন্ডন যাচ্ছেন। ব্যাটেন ছিল দুবার বিবাহিত, একবার তার বিবাহবিচ্ছেদও হয়েছিল, চারবার ম্যালেরিয়া হয়েছিল, একবার তার ঠ্যাং ভেঙেছিল, সে এক মালয়দেশের অধিবাসীকে মেরে ফেলেছিল, একবার সে বিষাক্ত তীরের শিকার হয়েছিল। অবশেষে জোঁকেদের পাল্লায় পড়ে তার মৃত্যু হয় – এই একটি ঘটনাই যা ওয়েডেরবার্নের কাছে তেমন interesting নয়!

একগুচ্ছ বিভিন্ন রকমের ফুলের সঙ্গে একটি, ওয়েডেরবার্নের জ্ঞাতি বোন এবং তাঁর বাড়ির তত্ত্বাবধায়িকার ভাষায় ‘মাকড়সার মতো দেখতে’, অর্কিড, কিনে ওয়েডেরবার্ন বাড়ি ফেরেন, এবং তাঁর উৎফুল্ল মন বলতে থাকে যে তাঁর কেনা ফুলগুলির মধ্যে অন্তত কয়েকটি অসাধারণ কিছু হবে। বেচারী ব্যাটেনকে নাকি মৃত পাওয়া গিয়েছিল তার আন্দামান আর ‘Indies’ থেকে আমদানি অর্কিডগুলোর একটির ওপরে । তার কয়েকদিন ধরে শরীর খারাপ যাচ্ছিল, এবং আন্দাজ করা হয় যে সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিল। তার দেহে ছিল না এক ফোঁটা রক্ত – মনে করা হয়েছিল জোঁকেরা সব শুষে নিয়েছিল!

ওয়েডেরবার্নের কেনা বেশীর ভাগ ফুলগুলোই শুকিয়ে গেল, শুধু অর্কিডটা বড় হতে লাগলো। তার কুঁড়িগুলো, ওয়েডেরবার্নের বোনের ভাষায়, কেমন যেন সাদা-সাদা আঙুলের মতো দেখতে – যেন ফুলটা দর্শককে ধরতে চাইছে! ওয়েডেরবার্ন স্বীকার করে যে অন্য কোন অর্কিডে সে এই আঙুলের মতো বায়বীয় মূলিকা দেখে নি।

অর্কিডের পাতাগুলো সবুজ আর এই সবুজের মাঝে লাল লাল ফোঁটা! একদিন সে প্রস্ফুটিত হলো, আর অর্কিড-হাউস ভরে গেল খুব মিষ্টি একটা গন্ধে। গন্ধের জোরে জ্ঞান হারালেন ওয়েডেরবার্ন!

বিকেল সাড়ে-চারটেয় চায়ের টেবিলে তাঁর অনুপস্থিতিতে বিরক্ত হয়ে তাঁর বোন অর্কিড-হাউসে গিয়ে দেখেন চিত হয়ে অর্কিডটির নিচে পড়ে আছেন তাঁর ভাই। অর্কিডের মূলিকাগুলো লেগে রয়েছে তাঁর থুতনি, ঘাড় আর হাতে! তাঁর মুখে লাগা রক্ত!

মিষ্টি গন্ধে বোনের শরীর টলতে লাগল। তিনি কোনমতে একটা ফুলের টব দিয়ে অর্কিড-হাউসের একটা জানলা ভেঙে ভাইয়ের দেহ টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে এলেন। অর্কিডের শুঁড়গুলো তখনও ওয়েডেরবার্নের দেহে আটকে। বোন এক এক করে সেগুলো টেনে ওয়েডেরবার্নের শরীর থেকে ছাড়ালেন। তাঁদের মালী জানলা ভাঙার আওয়াজ শুনে সেখানে এসে পড়ায় বোন তাঁকে বললেন জল আনতে আর পারিবারিক চিকিৎসককে খবর দিতে।

ওয়েডেরবার্নের অনেকটা রক্তক্ষয় হয়েছিল, কিন্তু আর গুরুতর কিছু হয় নি।

পরের দিন খোলা, ঠাণ্ডা হাওয়ায় অর্কিডটা কালো হয়ে শুকিয়ে যেতে লাগল।

ওয়েডেরবার্ন কিন্তু বেশ উৎফুল্ল। অবশেষে তাঁর জীবনে এক বিচিত্র অ্যাডভেঞ্চার ঘটে গেছে!


১৮৯৪-এর পর ১৯৬২ সাল। ইংরেজী পল মল বাজেট পত্রিকার জায়গায় বাংলা সন্দেশ। অর্কিডের মালিক ব্যাটেন তার সংগ্রহের ‘হাতে’ পটল তুলেছিলেন। উদ্ভিদবিজ্ঞানী কান্তিবাবু বহাল তবিয়তে আছেন। তিনি যে কীটখোর গাছপালা সংগ্রহ করেন এটাও গল্পের কথক পরিমল তার বন্ধু অভিজিতের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছে। কান্তিবাবু তাঁর গ্রীন হাউস সমেত বাস করেন কলকাতার উপকণ্ঠে বারাসাতে। ওয়েডেরবার্নও লন্ডনে গিয়ে বিভিন্ন রকম ফুলের গাছ ইত্যাদি কিনতেন, অতএব তাঁর অর্কিড-হাউসও মূল শহরের মধ্যে নয়। কান্তিবাবু পরিমলকে তার বন্দুক নিয়ে বারাসাতে আসতে বলছেন। কারণ তাঁর সংগ্রহে Venus Fly Trap ছাড়া প্রায় বিশ রকম মাংসাশী উদ্ভিদ আছে – যাদের মধ্যে রয়েছে গল্পটি যার নামে, সেটিঃ মধ্য আমেরিকার নিকারাগুয়া হ্রদের কাছে জঙ্গল থেকে আনা ‘সপ্তপাশ’ বা ‘সেপ্টোপাস’। এই গাছ খায় পোকা নয়, অনেক বড় বড় প্রাণী, যেমন বাঁদর, আর্মাডিলো প্রভৃতি। বারাসাতে আসার পর প্রথমে ইঁদুর, তারপর চাপা পড়া কুকুর-বেড়াল, তারপর মুরগী, পাঁঠা খেয়ে সেপ্টোপাস একদিন তার শুঁড় দিয়ে জাপটে ধরে কান্তিবাবুর চাকর প্রয়াগের একটা হাত! কান্তিবাবু শুঁড়ে সজোরে লাঠি মেরে প্রয়াগকে ছাড়িয়ে আনেন, কিন্তু ততক্ষণে সেপ্টোপাস তার হাতের খানিকটা মাংস খুবলে খেয়ে নিয়েছে। এরপর কান্তিবাবু গাছটাকে বিষ মেশানো খাবার দিয়ে মারবার চেষ্টা করেন। সে খাবার শুঁড়ে নিয়েই সেপ্টোপাস তা ফেলে দেয়। অতএব কান্তিবাবু পরিমলকে ডেকেছেন, তার বন্দুকের গুলি দিয়ে গাছটা মারাবেন বলে। আর যেহেতু পরিমলের গাড়ি নেই তাই তার সঙ্গে এসেছে তার গাড়িওয়ালা বন্ধু অভিজিৎ, যে আবার সঙ্গে করে এনেছে তার কুকুর বাদশাকে।

গল্পের শীর্ষবিন্দুতে মারণ গাছ শিকারকে আকর্ষণ করতে উগ্র গন্ধ ছড়ায়, যা পরিমলকে মনে করায় টনসিল অপারেশনের সময় ব্যবহৃত চেতনানাশক ক্লোরোফর্মের কথা (ওয়েডেরবার্ন তাঁর অর্কিডের ছাড়া গন্ধে সংজ্ঞা হারিয়েছিলেন, এবং তাঁর বোনের প্রায় সেই একই অবস্থা হতে যাচ্ছিল!) বাদশা তাঁর বগলস ছিঁড়ে ছুটে যায় সেপ্টোপাসের ঘরে এবং সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত হয়। তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে গাছের শুঁড়ের শিকার হয় বাদশার মালিক অভিজিৎও। শেষে পরিমলের বন্দুকের গুলিতে গাছের ‘মাথা’ থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছোটে আর গাছ অভিজিৎকে ছেড়ে দিয়ে নেতিয়ে পড়ে।

বাদশাকে বাঁচানো যায় নি। অভিজিতের পাঁজরের দুটি হাড় ভেঙেছিল।

আলোচনা

বোঝাই যাচ্ছে যে ওয়েলসের ছোট্ট গল্পটির বিন্যাস ঘটিয়েছেন সত্যজিৎ রায়, তাঁদের পত্রিকার কলেবরের কথা মনে রেখে।

এখানে প্রশ্ন হলো, এই যে বাড়তি উপাদানগুলিঃ গাছ মারতে দুজন মানুষের উপস্থিতি, তাদের একজনের সঙ্গে আবার কুকুর, প্রথমে পশু এবং তারপর মানুষের ওপর গাছের আক্রমণ, কুকুরের মৃত্যু – এসব কি এর আগে ওয়েলসের গল্পটির বাংলা রূপান্তরে কখনও আসে নি?


সুমিত গঙ্গোপাধ্যায় ও দীপ্তজিৎ মিশ্র প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৯২৫ সালে কোন এক পত্রিকায় এবং ১৯৪০ সালে শংকর সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত কোন এক সংকলনে, প্রকাশিত হয় হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘পিশাচ’ গল্পটি।

[১ মেন্দ্রকুমার রায়, বিমল-কুমার সমগ্র (৩) (দেব সাহিত্য কুটীর প্রাঃ লিঃ, কলকাতাঃ ২০২৩), ‘পরিশিষ্ট ২ – বিমল-কুমার গ্রন্থপঞ্জী’, পৃঃ ৩১০। ‘পিশাচ’ পাওয়া যাবে সমগ্রে-র ২য় খণ্ডে, ২৪৩-২৪৮ পৃষ্ঠায়, এবং এশিয়া পাবলিশিং-এর হেমেন্দ্রকুমার রায় রচনাবলী-র ১৪শ খণ্ডে (কলকাতাঃ ১৯৯৬)। ৯৭-১২৮ পৃষ্ঠায় ছায়াকায়ার মায়াপুরে সংকলনের ১০৫-১১০ পাতায়।]

এবার পাশাপাশি রাখব হেমেন্দ্রকুমারের গল্পটি আর ১৯৬২ সালে সন্দেশ-এ প্রকাশিত সত্যজিৎ রায়ের ‘সেপ্টোপাসের খিদে’। দুটি গল্পের কেন্দ্রেই আছে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কলকাতার উপকণ্ঠে আনা – ‘পিশাচ’-এ টালিগঞ্জ-রিজেন্ট পার্ক অঞ্চলে, আর ‘সেপ্টোপাসের খিদে’-তে বারাসাতে – আমিষভুক অর্কিড। এবার আসি চরিত্রগুলির প্রসঙ্গেঃ

‘পিশাচ’                                                                                         ‘সেপ্টোপাসের খিদে’

উদ্ভিদবিজ্ঞানী রামময়বাবু                                                             উদ্ভিদবিজ্ঞানী কান্তিবাবু

বিমল                                                                                              গল্পের কথক পরিমল

কুমার                                                                                              পরিমলের সহপাঠী অভিজিৎ


‘পিশাচ’-এ বিমল-কুমারের দুই ছায়াসঙ্গী রামহরি, এবং বিশেষ করে বাঘা, অনুপস্থিত। ‘সেপ্টোপাসের খিদে’তে অভিজিতের কুকুরপ্রীতি এবং বারাসাতে যাবার সময় সঙ্গে সঙ্গে করে তার ‘বেজায় তেজিয়ান’ রামপুর হাউন্ড বাদশাকে নিয়ে আসা কাকে মনে করায়? ‘পিশাচ’-এ রামময়বাবুর বাগানে কীটপতঙ্গ, মানুষ, এবং, বিমল-কুমার সেই বাড়ীতে আস্তানা গাড়ার পর, একটি বেড়ালের অপমৃত্যু ঘটেছে। বেড়ালের জায়গায় সেপ্টোপাসের মারণ আক্রমণে প্রাণ দিয়েছে বাদশা। হেমেন্দ্রকুমার রায় রচিত মান্ধাতার মুল্লুকে-র কথা মনে পড়ছে কি? সেখানে বিচিত্র আততায়ীর হাতে প্রাণ দিয়েছিল বাঘা। বাদশাকে রক্ষা করতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছে অভিজিৎ । কুমারও আক্রান্ত হচ্ছে রামময়বাবুর অর্কিডের শুঁড়ের দ্বারা, যদিও কুমার মারাত্মকভাবে আহত হবার আগেই বিমলের গুলিবৃষ্টিতে ফুলসমেত অর্কিডটি দু-খানা হয়ে ভেঙে পড়ছে। পরিমলের গুলিতে সেপ্টোপাসের মাথা থেকে লাল রক্তের ফোয়ারা উঠছে আর তার শুঁড়গুলি অভিজিতকে মুক্তি দিচ্ছে, অবশ্য তার পাঁজরের দুটি হাড় ভেঙে দেবার পর। কুমারের সর্বাঙ্গ শুধু ফোড়ার মতো টাটিয়ে উঠেছিল।



গল্পগুলির পার্থক্য তাদের ‘রস’-এ।


মূল কাহিনিতে দুটি প্রধান চরিত্র একে অপরের বিপরীত লিঙ্গের, এবং রক্ষাকর্ত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ যিনি হচ্ছেন তিনি Wedderburn-এর উদ্ভিদ নিয়ে সখের প্রতি খুব একটা সহানুভূতিশীল নন। শেষ অবধি মারাত্মক ভাবে আহত হবার আগেই তিনি Wedderburn-কে রক্ষা করতে সক্ষম হচ্ছেন। কাহিনিটির রস প্রধানত black comedy-র। Wedderburn-এর আক্ষেপ ছিল যে তাঁর জীবনে চমকপ্রদ কিছু ঘটে না। গল্পের শেষে রক্তশোষক অর্কিডের ‘হাত’ থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি তৃপ্ত এবং খুশী। অবশেষে তাঁর ভাগ্যে জুটেছে এক বিচিত্র অ্যাডভেঞ্চার!


হেমেন্দ্রকুমার গল্পের নামকরণে ইচ্ছাকৃতভাবেই পাঠককে বিভ্রান্ত করার জন্য অতিপ্রাকৃতের ইঙ্গিত রেখেছেন। রামময়বাবুর অকস্মাৎ হৃদরোগে মৃত্যুর আগে তাঁর বাগানে প্রথম অপঘাত মৃত্যু ঘটে তাঁর উড়ে বেয়ারার। তার দেহকে যেন অনেকগুলি শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হয়েছিল, এবং তার গলাতেও ছিল ফাঁসের দাগ। সর্বোপরি, তার শরীর থেকে কেউ যেন সমস্ত রস ও রক্ত নিংড়ে বার করে নিয়েছিল। প্রসঙ্গত, কান্তিবাবুর চাকর প্রয়াগকেও সেপ্টোপাস আক্রমণ করে তার ডান হাতের খানিকটা মাংস খুবলে খেয়ে নেবে। রামময়বাবুর বাগানে দ্বিতীয় যে মানুষের মৃত্যু ঘটে সে ছিল এক দাগী চোর, সে রাতে চুরির উদ্দেশ্যেই বাগানে ঢুকেছিল, এবং তার শরীরও ছিল রস বা রক্ত শূন্য। এরপর ঐ বাগানে পাওয়া যেত মরা ইঁদুর, ছুঁচো, প্যাঁচা, বাদুড়, আর চামচিকে। লক্ষ্যণীয় যে তাদের শরীরেও রক্ত বা রস থাকত না, এবং তারা সকলেই নিশাচর প্রাণী! এরপর স্বাভাবিকভাবেই রামময়বাবুর হৃদরোগে মৃত্যুকেও অলৌকিক বলে রটনা করা হয়। রহস্যের সমাধান ঘটে গল্পের একেবারে শেষে, যেখানে কুমারকে অর্কিডের শুঁয়ো থেকে মুক্ত করার পর বিমল জীবজন্তুর রক্তপায়ী অর্কিডের কথা তোলে। তখন অবধি পাঠকের মনে হবে কোন নিশাচরী অতিপ্রাকৃত বিভীষিকার কথা!

[২ রচনাবলী ১৩শ খণ্ড (এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতাঃ ১৯৯২) ১৬১-২৫৯।]

সেপ্টোপাস এবং তার সগোত্রীয় উদ্ভিদদের স্বভাব আরম্ভ থেকেই পরিমল এবং পাঠকদের জানিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে কোন element of surprise বা বিস্ময়ের উপাদান নেই, যা আছে তা হলো নির্ভেজাল horror বা ভয়াবহতা। পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি প্রয়াগের ওপর সেপ্টোপাসের আক্রমণ বা কাহিনির শীর্ষবিন্দুতে বাদশা এবং অভিজিতের যে দশা হচ্ছে, সেদিকে। হেমেন্দ্রকুমারের সময়ে যেহেতু আমিষাশী উদ্ভিদের কথা ছিল অপেক্ষাকৃত অল্পশ্রুত, তাই তিনি তাঁর ‘পিশাচ’-কে রহস্যের আবরণেই প্রথমে উপস্থাপিত করেছেন।


এবং শেষ কথা, ওয়েলস সাহেবের উৎস-কাহিনিতে কিন্তু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন মাত্র একজন – অর্কিডের প্রথম মালিক। দ্বিতীয় জন মারাত্মক কিছু হবার আগেই রক্ষা পেয়েছেন এবং পুরো ব্যাপারটা নিয়ে বেশ তৃপ্তি অনুভব করেছেন। কেন তা আগেই আলোচিত হয়েছে। ‘পিশাচ’ এবং ‘সেপ্টোপাসের খিদে’-তে মালিক উদ্ভিদটির দ্বারা আক্রান্ত হন নি। হেমেন্দ্রকুমারের রামময়বাবু মারা গেছেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে, আর কান্তিবাবু আক্রান্তই হন নি। আক্রান্তের সংখ্যা, মানুষ, কীটপতঙ্গ আর বেড়াল মিলে হেমেন্দ্রকুমারে অনেকজন, সতজিতের গল্পে মোট তিনজন – দুজন মানুষ ও একটি কুকুর। দুটি বাংলা রূপান্তরেই কোন নারী চরিত্র নেই, মূল কাহিনিতে কিন্তু আছে, এবং তাঁর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ তিনিই মূল চরিত্রকে আমিষাশী উদ্ভিদের ফলার হওয়া থেকে রক্ষা করছেন। মানে, বিমল বা পরিমলের উৎস চরিত্র একজন অনাম্নী মহিলা, যিনি সম্পর্কে কেন্দ্রীয় চরিত্রের জ্ঞাতি বোন!




উপসংহার


কল্পবিশ্ব ওয়েবপত্রিকার ৬ষ্ঠ বর্ষ ২য় সংখ্যায় (শারদীয়া ১৪২৮) এবং তাঁর আগে উক্ত পত্রিকার ৬ষ্ঠ বর্ষ ১ম সংখ্যায় ওয়েলস সাহেবের বাংলা সাহিত্য ও চলচ্চিত্র জগতে উপস্থিতি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছিলাম। সে দুটি প্রবন্ধই পরে কল্পবিশ্ব প্রকাশনা সংস্থা সংকলিত করেছেন আমার হেমেন্দ্রকুমার রায়ঃ এক পথিকৃতের কীর্তিকাহিনি (কল্পবিশ্ব পাবলিকেশন্স, কলকাতাঃ ২০২২) বইটিতে। তখন ওয়েলসের এই ছোট গল্পটির কথা জানা ছিল না। এটি গোচরে আনার জন্য আমি শ্রীমতী প্রধন্যা মিত্রের কাছে ঋণী। এবার ওয়েলসের বাংলায় আরো একটি উপস্থিতি পাওয়া গেল, দু’জন লেখকের মাধ্যমে।


দুজনের কেউই সরাসরি অনুবাদ বা অনুকরণ করেন নি। এবং দুটি রূপান্তরের প্রধান সাহিত্যরস ওয়েলসের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ইংরাজী পরিভাষা ব্যবহার করে বলা যায়, ওয়েলস লিখেছেন একাধারে whimsical এবং black comedy। হেমেন্দ্রকুমারের ‘পিশাচ’ আসবে ‘supernatural explained’-এর আওতায়, যেখানে আপাত অতিপ্রাকৃত ঘটনাসমূহ শেষ অবধি দেখা গেছে হয় মনুষ্যসৃষ্ট – ইংরেজী সাহিত্যে যার দুটি বিখ্যাত উদাহরণ Mrs Ann Radcliffe-এর The Mysteries of Udolpho (১৭৯৪) এবং শার্লক হোমস-স্রষ্টা কোনান ডয়েলের The Hound of the Baskervilles (ধারাবাহিক ১৯০১-১৯০২, বই আকারে ১৯০২) – অথবা বিজ্ঞানভিত্তিক, যেমন ‘পিশাচ’। সত্যজিৎ রায় কোন রহস্যের আবরণ রাখার প্রয়াসই করেন নি, আগেই বলা হয়েছে, তাঁর লক্ষ্য ছিল horror বা ভয়াবহতা উৎপাদন, যা তিনি এরপর করবেন পুরোপুরি অতিপ্রাকৃত ঘটনার মাধ্যমে ‘খগম’ গল্পটিতে।


তাই, বাংলা রূপান্তরদুটিকে, বিদেশী অনুপ্রেরণা সত্ত্বেও, সফল সাহিত্যকর্মের অভিধা দিতে অন্তত বর্তমান প্রবন্ধকারের কোন দ্বিধা নেই। আর ‘পিশাচ’ থেকে ‘সেপ্টোপাসের খিদে’-র মধ্যে যে বিভিন্ন motif-এর ধারাবাহিকতা দেখা গেছে, তাতে বাংলা শিশু ও কিশোর সাহিত্যের পরম্পরারও একটা রেখাচিত্র পাওয়া যায়।

1 comments:

0
undefined undefined undefined

অমৃত সদন - শামিম আহমেদ

Posted in





















নির্দিষ্ট সময়ে সভার কাজ আরম্ভ হল। একলব্যের কাকা রজতধনু জঙ্গলের নানা সমস্যার কথা বলতে লাগলেন। দূরে যে নদী বয়ে যায়, সেখানে আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। এমনকি জঙ্গলের কোথাও কোথাও বাইরের লোক আসে, নোংরা করে চলে যায়। সামনাসামনি হলে একদিন মুখের উপর জবাব দেবেন, কিন্তু পাচ্ছেন না, তক্কে তক্কে আছেন!

হিরণ্যধনু বললেন, আমাদের সমাজ তো নগরের মতো নয়। এখানে গাছ, পাহাড়, জঙ্গল, পশুপাখি আমাদের নিজস্ব ধন। তাদের ক্ষতি মানে আমাদের কষ্ট। বাইরের লোকের সেই বিবেচনা নেই, বিশেষ করে নগর থেকে যারা আসে। জানি না, কতদূর এই জলাজঙ্গলপর্বত আর পশুদের রক্ষা করতে পারব আমরা! জঙ্গলে মানুষের বাস করাই উচিত নয়, তাতে জানোয়ারদের ভারি অসুবিধা হয়। কিন্তু আমাদের উপায় নেই। এককালে আমাদের পূর্বপুরুষ হস্তিনানগরে ছিল, এক রকম বাধ্য হয়ে চলে এসেছিল তারা। তার পর এই জঙ্গল।

অঙ্গার বাবা এইবার মুখ খোলেন, কেন চলে এসেছিলাম সেই সব কথা ছেলেছোকরাদের বলা দরকার রাজা!

রাজা বলেন, হ্যাঁ, সে সব কথা পরে বলব; আজকের সভায় নয়।

অঙ্গার পিতা কিরিটিভূষণ পুনরায় বলেন, কিন্তু বলতে তোমাকে হবেই। হস্তিনার বাজারে যখন আমরা যাই শুকনো ডালপালা, ফলমূলের বদলে একটু কাপড়, মশলাপাতি আর সুগন্ধ আনতে, ওরা এমন ভাবে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে যে মনে হয় আমরা বুঝি মানুষ না!

একলব্যের মা জাম্ববতী বলেন, তা মানুষ হবে কী প্রকারে! ওদের মতো যদি আগুনে সেঁকা কাপড় না পরে তুমি বাঘছাল পরো, তবে তো গা থেকে বদবু বের হবে। তোমাকে হয়তো বাঘ ভাবে হস্তিনার লোকেরা!

বলেই খিলখিল করে হাসতে থাকেন জাম্ববতী।

কিরিটিভূষণও হাসতে থাকেন। হাসতে হাসতেই জবাব দেন জাম্ববতীর কথার, বাঘছাল নিয়ে কিছু বোলো না গো দিদি, স্বয়ং বাবা মহাদেবের বসন।

জাম্ববতী দুই হাত তুলে নমস্কার করেন। তাঁর দেখাদেখি সভার প্রত্যেকে বাবা মহাদেবের উদ্দেশে প্রণতি জানায়। একলব্য ভাবে, সে যে হস্তিনায় গিয়ে গুরু দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করবে, সে নিয়ে এই বার কথা হওয়া উচিত।

হিরণ্যধনু নিজেই তুললেন সেই প্রসঙ্গ, রাজকুমার একলব্য চাইছিল যে সে হস্তিনায় গিয়ে গুরু দ্রোণের কাছে ধনুর্বিদ্যা শিখতে যাবে। এই ব্যাপারে প্রত্যেকের মতামত শুনে রাখা ভাল।

অঙ্গাগ্রণী এই বার মুখ খোলে, হস্তিনা হল গিয়ে নগর, আর আমরা থাকি বনে। নগরে কি বনবাসীর থাকা শোভা পায়! আমার বাপু এই ব্যাপারে মত নেই।

অঙ্গার এক বন্ধু শ্রী মুখ টিপে হাসছিল। রাজা তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুই কিছু বলবি মা?

শ্রী হাসি থামিয়ে বলে, যাক না! কিন্তু সেখানে গিয়ে ও খাবে কী, থাকবে কোথায়?

রাজা ভেবে দেখলেন, কথাটা মন্দ বলেনি শ্রী। এই সমস্যার কথা তো তাঁর মাথায় আসেনি।

বাঁকা নামের এক ছোকরা নগরে কাঠ দিতে যায়, সে বলে—কেন, আমরা রাত হলে তো নগরের বাইরে একটি ছাউনিতে থাকি, সেখানেই থাকবে একলব্য। এ আর এমনকি!

শ্রী জিজ্ঞাসা করে, খাবে কী?

বাঁকা বলে, ফলমূল। তাছাড়া, হস্তিনায় অনেক শূদ্র বাস করে নগরের বাইরে। তাদের কারও বাড়িতে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করলেই হল।

রাজা হিরণ্যধনু বলেন, সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমাদের আত্মীয়স্বজন কিছু রয়েছেন সেখানে। আমি ভাবছি অন্য কথা।

একলব্য প্রশ্ন করে, কী কথা বাবা?

রাজা বলেন, তোমাকে দ্রোণ শিষ্য হিসাবে গ্রহণ করবেন না।

বাঁকা বলে, না না নেবে। সূত অধিরথের ছেলেকে নিয়েছে আর নিষাদ রাজার ছেলে রাজকুমারকে নেবে না!

গ্রামবুড়ো চাদর থেকে মুখ বের করে বললেন, একলব্য ক্ষত্রিয়সন্তান—ও শূরসেনের তৃতীয় পুত্র দেবশ্রবার জ্যেষ্ঠ পুত্র। একলব্যের পিসির নাম পৃথা ওরফে কুন্তী, তিনি রাজা পাণ্ডুর বিধবা পত্নী। থাকেন হস্তিনায়।

একলব্য বলেন, না। আমার পিতা হিরণ্যধনু, আমরা জাতিতে নিষাদ।

গ্রামবুড়ো বলেন, তাহলে তোকে নেবে না, যাস নে বাপ!

রাজা হিরণ্যধনু রায় দিলেন, একলব্য যাবে হস্তিনানগরে। দেখা যাক, ভীষ্ম তাকে দ্রোণের কাছে অস্ত্রশিক্ষার অনুমতি দেয় কিনা!

পরদিন সব কিছু গোছগাছ করে নিয়ে একলব্য বেরলো হস্তিনানগরের দিকে, প্রথমে যেতে হবে অনেকটা পশ্চিমে, তার পর উত্তরে হপ্তা খানেকের রাস্তা। ঘোড়ার পিঠে চেপে যাওয়াই মনস্থ করল সে। হাতি বেশ মন্থর প্রাণী। অনেকটা খাবার, আর প্রচুর তীর ধনুক সঙ্গে নিল সে। প্রথমে হস্তিনানগরের বাজারে গিয়ে সে তীর ধনুক বেচবে, তার পর খোঁজখবর নিয়ে যাবে আচার্য দ্রোণের কাছে। এই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে প্রথমে তাকে মহানদী পার হয়ে যেতে হবে চেদি রাজ্যে। সেই সব পথ জেনে নিয়েছে একলব্য।

মহানদী পার হলেই তার গা ছমছম করে। ঘোড়া সমেত এই নদী পেরনো খুব সহজ নয়। এই জলধারাই নিষাদরাজ্যের প্রাণরেখা। পানের জল থেকে মাছ ধরা সব হয় এই নদীকে কেন্দ্র করে। নদী পার হয়ে অনেকটা পথ এগিয়ে গেল একলব্য, তেজি অশ্বের পিঠে চড়ে। নিজের খাবার, ঘোড়ার খাবার সব নেওয়া সম্ভব নয়। ঘোড়া তবু ঘাস খেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু শুধু ঘাসে ঘোড়া তেজিয়ান থাকে না। তাকে ছোলা গুড় খাওয়াতে হয়, দিতে হয় ধেনো মদও। সে সব কোথায় পাবে একলব্য? প্রায় তিন দিন তিন রাত কখনও কখনও চলে, কখনও বিশ্রাম নিয়ে তারা—একলব্য ও ঘোড়াটি পৌঁছলো চেদি রাজ্যে। এখানে রাজত্ব করেন শিশুপাল। তিনি বৃষ্ণিবংশীয় রাজা, পিতা হিরণ্যধনুর বন্ধু মানুষ।

রাজার আতিথ্যে কোনও ত্রুটি ছিল না। কয়েক দিন বেশ আরামে ও আয়াসে কাটিয়ে ঘোড়া বদলে নিয়ে এই বার উত্তরে যাওয়ার পরিকল্পনা করল একলব্য।

শিশুপাল বললেন, কোনও দরকার ছিল না হস্তিনায় যাওয়া। পূর্ব দেশে তীরন্দাজের আকাল পড়েছে নাকি হে যে তুমি ছুটছো উত্তর পানে? আমার রাজ্যেই আছেন অনেক বড় রুস্তম, তারা তোমাকে তীর ধনুক থেকে শুরু করে গদা সব শিখিয়ে দেবে। তাছাড়া, তোমার পিতা হিরণ্যধনু তো মস্ত তীরন্দাজ! রাজা জরাসন্ধ তো এমনি এমনি তাকে সেনানায়ক করেনি!

একলব্য বলে, আমাকে আচার্য দ্রোণের নামখানিই বড্ড টানছে হে পিতৃবন্ধু! শুনেছি তিনি সমগ্র ধনুর্বিদ্যা লাভ করেছেন মহর্ষি পরশুরামের কাছে।

“আমিও শুনেছি। কিন্তু ও সব হল ইন্দ্রজাল। আসল ক্ষমতা হল লাঠি। অতিসামীপ্যের জন্য। অনতিদূর থেকে তীরধনুক। অতিদূরের জন্য আগ্নেয়াস্ত্র। সব শিখতে পারবে এই চেদি রাজ্যে। এ হল লাঠির রাজা উপরিচর বসুর দেশ।”

“সে কাহিনি শুনতে ইচ্ছা করি।”

শিশুপাল বললেন, বলছি সেই উপাখ্যান। তোমার পিতা হিরণ্য নিশ্চয় এতদিনে তোমাকে বলেছেন যে তোমার পিতা ও আমার মাতা ভাইবোন?

“কই না তো! তবে শুনেছি, আমি নাকি শূরসেনের পুত্র দেবশ্রবার ঔরসে জন্মেছি। ব্যস, এইটুকুই!”

“ঠিক শুনেছো বৎস! আমার মাতা শ্রুতশ্রবা দেবশ্রবার দিদি। তুমি আমার বন্ধুপুত্র হলেও আসলে তুমি আমার মামাতো ভাই!”

একলব্য বলে, এসব আমার মাথায় ঢুকছে না পিতৃব্য!

“শোনো। শূরসেনের দশ পুত্র আর পাঁচ কন্যা। পুত্রদের মধ্যে সবার বড় বসুদেব, তার পর দেবভাগ, দেবশ্রবা, আনক, সৃঞ্জয়, শ্যামক, কঙ্ক, শমীক, বৎসক ও বৃক। শূরসেনের পাঁচ কন্যা—পৃথা, শ্রুতদেবা, শ্রুতকীর্তি, শ্রুতশ্রবা ও রাজাধিদেবী। হস্তিনা গেলে পৃথা মানে আমার মাসি আর তোমার পিসির সঙ্গে সাক্ষাৎ কোরো।”

একলব্যের মাথায় ঘুরছে অস্ত্রশিক্ষার কথা। তিনি এই সব আত্মীয়তার কূটকচালি শুনতে চান না। শিশুপালকে একলব্য জানালেন, আগামীকাল ভোরে হস্তিনার উদ্দেশে রওনা দেবেন তিনি। আজ রাতে উপরিচর বসুর লাঠি বা দণ্ডের কাহিনি শুনে নিতে চান।

শিশুপাল শুরু করেন কাহিনি।

0 comments:

0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















২৭

ইলোনার কপাল ভালো যে তাকে প্রথমে ডাকা হয়েছে। সে জানে যে এখানে স্নানঘর বলতে আসলে ঠিক কী বোঝানো হয়। বড় জোর দশ মিনিটের ছটফটানি সহ্য করতে হয়। তবে সেই সময়ের এত কাছাকাছি দাঁড়িয়েও তার এতটুকু ভয় করছে না। এখানে আসবার পথে গাড়িতে তাকে অনেককিছু সহ্য করতে হয়েছে। সেইসব ব্যাপারগুলো নিঃসন্দেহে তাকে ব্যক্তিগতভাবে ধাক্কা দিয়েছে, কিন্তু অন্তরের অন্তস্থল অবধি পৌঁছাতে পারেনি। গাড়ির ভেতরে অন্ধকারে কেউ একজন তাকে ধর্ষণ করবার চেষ্টা করছিল। তার লালসার গন্ধ সে অন্ধকারেও বুঝতে পেরেছিল, অথচ এখন এই আলোর মধ্যে এসে সেই লোকটাকে চিনবার সমস্ত চেষ্টা বৃথা হল। কেউ একজন আবার তাকে ওই লোকটার হাত থেকে বাঁচিয়েছিল। একটা বুড়ো লোক বাঁচিয়েছে তাকে। সেই বুড়ো পরে তাকে অন্ধকারে ফিসফিস করে বলছিল যে শুধুমাত্র একটা ট্রাউজারের জন্য বুড়োকে গ্রেফতার করা হয়েছে, যেটা সে এক অফিসারের কাছ থেকে কিনেছিল। অন্ধকার থেকে আলোতে এসে ইলোনা তার এই রক্ষাকর্তা বুড়োকেও চিনতে পারেনি।

একটা লোক তার বুকে হাত দিচ্ছিল, পোশাক ছিঁড়ে দিয়েছিল, পেছনে ঘাড়ের কাছে কামড়ে দিচ্ছিল--- কিন্তু সৌভাগ্যবশত আরেকটা লোক তাকে সরিয়ে এনেছিল ওই লোকটার কাছ থেকে। ইলোনার হাতে যে কেকের টুকরোর প্যাকেটটা ছিল, সেটা কোথায় যেন ছিটকে গিয়েছিল। ইলোনার হাতে তো ওই একটা জিনিসই ছিল। আর কোনো মালপত্র কিচ্ছুটি ছিল না তার সঙ্গে। অন্ধকারে গাড়ির মেঝেতে হাতড়ে হাতড়ে ওই কেকের টুকরোটা ধুলোয় আর ক্রিমে মাখামাখি একটা পিণ্ড হিসেবে খুঁজে পেয়েছিল সে। সে মারিয়ার সঙ্গে ভাগাভাগি করে ওই কেকটা খেয়েছিল। কিছুটা কেক তার কোটের পকেটের মধ্যে চাপে গুঁড়িয়ে গিয়েছিল। কয়েক ঘণ্টা পরে তার মনে হয়েছিল যে কেকটার স্বাদ অসামান্য। নিজের পকেট থেকে চেঁছে নোংরা কেকের দলা বের করে সে নিজে আর বাচ্চা মেয়েটা ভাগাভাগি করে খেয়েছিল।

ট্রাকের ভিতরে নিঃশব্দে কেউ কেউ হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যা করেছিল। অদ্ভুত ভাবে হাঁপাচ্ছিল, গোঙাচ্ছিল ওরা জীবন বেরিয়ে যাবার মুহূর্তে। ওদের পাশে বসে থাকা লোকজন রক্তের মধ্যে পিছলে গিয়ে পাগলের মত আর্তনাদ করে উঠেছিল। কিন্তু প্রহরী এসে গাড়ির দরজায়, দেওয়ালে ধাক্কা দেবার পরে সবাই চুপ করে গিয়েছিল। ওই ধাক্কার শব্দটা ভয়ঙ্কর ছিল। মনে হচ্ছিল প্রহরীরা কেউ মানুষ নয়। অনেকক্ষণ ধরে ওরা কোনো মানুষের সংসর্গ পায়নি। মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল ধরে ওরা যে অপেক্ষার মধ্যে রয়েছে, সেটা এখনই শেষ হবে। ইলোনাও অপেক্ষা করছিল। ভয়ের জন্য, মৃত্যুর জন্য। অর্থহীন মনে হচ্ছিল তার তখন সবকিছু। এক সৈন্যের সঙ্গে কিছুটা সুন্দর সময় কাটাচ্ছিল, কেন তার থেকে বিচ্ছিন্ন হল সে? সেই সৈন্যকে খুব ভালো লাগছিল তার, অথচ তার পুরো নামটাও ঠিকঠাক জানা হল না। কতগুলো সম্পূর্ণ অর্থহীন ঘটনা ঘটে চলেছে তাকে ঘিরে। সেই সৈন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাবা মায়ের ফ্ল্যাটে দৌড়ে গেল সে তখন, অথচ গিয়ে দেখল ঘরগুলো ফাঁকা। ফাঁকা ঘরে একা মারিয়া, বাচ্চা মেয়েটা, তার বোনের মেয়ে রয়েছে। একা বাচ্চাটা ভীত সন্ত্রস্ত, উদ্ভ্রান্ত বসে আছে। স্কুল থেকে ফিরে বাচ্চাটা দেখছে যে ঘরে কেউ নেই। ঘরে বাবা মা, দাদু, দিদা কেউ নেই… কেউ না। প্রতিবেশীরা বলছে যে ওদের দুপুরবেলায় তুলে নিয়ে গেছে। এখন ঘেটোতে গিয়ে ওদের খোঁজাখুঁজি করা সম্পূর্ণ অর্থহীন। ওরা তবুও ঘেটোতে গিয়েছিল চুল কাটার দোকানটার পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকে। ফাঁকা রাস্তার মধ্যে ঘোরাঘুরি করতে করতে ওরা দেখেছিল ওই ট্রাকটা দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাকটা তখনই ছাড়বে। ট্রাকটা ওদের ছাড়েনি। ওরাও ভাবছিল যে যদি ওই গাড়িতে ওদের কোনো আত্মীয় থাকে! কিন্তু ওই গাড়িতে একটাও চেনা লোক ছিলনা। ইলোনার অদ্ভুত লাগছিল এটা ভেবে যে প্রতিবেশীরা কেউ ওকে স্কুলে গিয়ে সতর্ক করেনি! মারিয়াকেও কেউ কিছু বলেনি। তবে বলেও বা কী লাভ হত? ধরা পড়তেই হত… আজ অথবা কাল। গাড়িতে কেউ একজন ওর ঠোঁটে একটা জ্বলন্ত সিগারেট বসিয়ে দিয়েছিল। পরে খেয়াল করেছিল সে যে ওই বুড়োটাই, যাকে ট্রাউজারের জন্য গ্রেফতার করা হয়েছে, সে ওকে সিগারেট দিয়েছিল। ইলোনা জীবনে এই প্রথম সিগারেট খেল। তার বেশ ভালো লাগছিল। শরীরটা অনেকটা ঝরঝরে লাগছিল।

সে তার উপকারী লোকটির নাম জানে না। কেউ তাদের নিজেদের পরিচয় দেয়নি। এমনকি হাঁপাতে থাকা, লালসার আক্রান্ত লোকটি, যে তাকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়েছিল, সেও নয়। দেশলাই কাঠি জ্বালাবার পরে ওই একটুখানি আলোতে সবগুলো মুখ একই রকম দেখাচ্ছিল। সবগুলো মুখ ভয়ে, ঘৃণায় বিকৃত হয়ে ছিল। কিন্তু এক কোণে বসে ইলোনা অনেকটা সময় পেয়েছিল প্রার্থনার জন্য। কনভেন্ট থেকেই তার সমস্ত ধর্মীয় স্তোত্র, সব প্রার্থনার গান একেবারে ঠোঁটস্থ ছিল। গাড়ির মধ্যে অন্ধকারে বসে এটা ভেবেই ইলোনার ভালো লাগছিল যে এসব গান তার জানা। প্রার্থনার ফলে তার মন এক শান্ত স্থির আনন্দে পরিপূর্ণ ছিল। সে বিশেষ কোনো ইচ্ছাপূরণের জন্য প্রার্থনা করছিল না। কোনো বিপদ থেকে বেঁচে যাবার জন্য, কিম্বা অতি শীঘ্র যন্ত্রণাবিহীন মৃত্যুর জন্য, কিম্বা নিজের প্রাণভিক্ষার জন্য সে প্রার্থনা করছিল না। সে সম্পূর্ণ অহেতুকী ভক্তিতে হয়তো স্মরণ করছিল ঈশ্বরের নাম। এক কোণে ট্রাকের গদি আঁটা দরজাটাতে ঠেসান দিয়ে বসে সে প্রার্থনা করছিল। সে খুশি ছিল এটা ভেবে যে তার পেছনে আর কেউ নেই। পেছনের দিকে শুধুই গদি আঁটা দরজা। এই ট্রাকগুলোর দরজায় গদি আঁটা থাকে যাতে পথে যানের ঝাঁকুনিতে গুঁতো লেগে আসবাবপত্রের কোনো ক্ষতি না হয়। এই ফার্নিচার ট্রাকে প্রধানত আসবাব বহন করা হয়। সে প্রথমে বাকি লোকজনের দিকে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল। হয়ত সে ক্লান্ত হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে যাচ্ছিল। হয়ত তার শরীরের স্পর্শে কারো মনে, শরীরে লালসা জেগে উঠেছিল। প্রথমে সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল ওই লোকটির স্পর্শে, ধর্ষণের চেষ্টায়। তার মনে হচ্ছিল যে এসব অর্থহীন কাণ্ড কেন ঘটছে তাকে ঘিরে? অবশ্য পরে উপকারী লোকটি তাকে ছাড়িয়ে আনবার পরে সে আশ্বস্ত হয়েছিল। সে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। গদি আঁটা দরজায় পিঠ দিয়ে বসে প্রার্থনা করতে শুরু করেছিল সে।

মারিয়াকে শক্ত করে ধরে বসেছিল সে। একটু আশ্বস্ত হয়েছিল সে বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়বার পরে। যথাযথ ভক্তির সঙ্গে প্রার্থনা করতে বসেছিল সে। কিন্তু সফল হল না; অদ্ভুতভাবে ভক্তির বদলে সম্পূর্ণ নিরাসক্ত এক ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে যেতে থাকল সে। তার জীবনটা এমন হবে সে ভাবেনি কোনো দিন। তেইশ বছরের জীবনে এতকিছু ঘটে গেল? রাজ্যের স্নাতক পরীক্ষায় পাশ করে সে সন্ন্যাসিনী হবার জন্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের আশ্রমে যোগদান করে। আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব সবাই খুব হতাশ হলেও তার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিল। সে এক বছর ছিল কনভেন্টে। সেই সময়টা ভারি সুন্দর ছিল। যদি সে সেখানেই থেকে যেত, এতদিনে নিঃসন্দেহে আর্জেন্টিনার কোনো কনভেন্ট স্কুলের সিস্টার হয়ে যেতে পারত। কিন্তু আশ্রমজীবনে এক বছর থাকবার পরেও সংসার করবার ইচ্ছেটা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি; নিজের স্বামী, সন্তান এসব নিয়ে একটা সুখের সংসার চেয়েছিল সে। ফলে আবার কনভেন্ট ছেড়ে ফিরে এসেছিল সে বাইরের জগতে।

সে এক সফল শিক্ষিকা হতে পেরেছিল। এই ব্যাপারটা সে খুব উপভোগ করত। জার্মান ভাষা এবং সঙ্গীত, এই দুই বিষয় নিয়ে বাচ্চাদের পঠনপাঠন বিষয়ে তার ভারি আগ্রহ ছিল। বাচ্চাদের সমবেত সঙ্গীতের কয়ার নিয়ে তার অনেকখানি আবেগ কাজ করত। এই ব্যাপারটা তাকে বিশেষ আনন্দ দিত। স্কুলে বাচ্চাদের নিয়ে একটা গানের দল তৈরি করে ফেলেছিল সে। উৎসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করত এই দলটা। ল্যাটিন ভাষার স্তোত্রগান, যেগুলো শিশুরা গাইত, অর্থ না বুঝেই গাইত। অথচ একটা অদ্ভুত আধ্যাত্মিক স্বর্গীয় পরিবেশ সৃষ্টি হত, কারণ শিশুরা নিজেদের মনের বিশুদ্ধ আনন্দ প্রকাশ করত সঙ্গীতের মাধ্যমে। জীবন সবসময় ভারি সুন্দর ছিল তার কাছে। শুধু মাঝেমধ্যে সংসার এবং সন্তানের কামনায় তার মনে কিছু খেদ জেগে উঠত। তার খেদ ছিল, কারণ সংসার পাতবার যোগ্য কোনো পুরুষ সে খুঁজে পায়নি। তার কাছাকাছি অনেক পুরুষ এসেছিল, কেউ কেউ তাকে চুম্বনও করেছিল। কিন্তু ভালবাসা, প্রেম এরকম ধরণের বেশ একটা অদ্ভুত চমক, অনন্য অনুভূতির জন্য তার যে অপেক্ষা ছিল, সেটা পূর্ণ হয়নি। তবে সেই যে সৈন্যটির সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তার, যার নামটা অবধি ঠিকঠাক জানা হল না, তার সঙ্গে বেশ একটা ব্যাপার তৈরি হচ্ছিল। কী হত তার সঙ্গে? প্রেম? হ্যাঁ, হতেই পারত। সেই সৈন্যটা যখন ম্যাপের সামনে দাঁড়িয়ে ছোট ছোট পতাকা লাগানো পিনগুলো গেঁথে দিচ্ছিল, তার পাশে দাঁড়িয়ে ভারি ভালো লাগছিল তার। সে বুঝতে পেরেছিল যে সৈন্যটিও তার প্রেমে পড়েছে। দু দিন ধরে বেশ কয়েক ঘণ্টা করে আলাপ করতে, আড্ডা দিতে আসছিল সে তার ঘরে। তার ভালই লাগছিল। যদিও সৈন্যের ইউনিফর্ম দেখে একটু ভীতিও ছিল তার। তবে হঠাৎ সেদিন, যখন সৈন্যটি গম্ভীর আর ব্যথাকাতর মুখে দাঁড়িয়ে ছিল ম্যাপটার সামনে, হাতড়ে হাতড়ে দেখছিল যুদ্ধের জমি, তখন সে বুঝতে পেরেছিল যে সৈন্যটিও আসলে এই যুদ্ধটা একেবারে পছন্দ করে না। আনন্দে তার গান গেয়ে উঠতে ইচ্ছে করছিল। হয়ত সেই সৈন্যটির এখন মনেও নেই তার কথা, তবে সেই সৈন্যটিই একমাত্র পুরুষ, যাকে সে চুম্বনের উত্তরে প্রতিচুম্বন দিয়েছিল।

ব্যারাকে ধীরে ধীরে উঠে যায় ইলোনা, মারিয়াকে সঙ্গে নিয়ে। সে চমকে ওঠে যখন এক সৈন্য বন্দুকের নল দিয়ে তার পাঁজরে খোঁচা দিয়ে বলে ওঠে, ‘জলদি চলো! জলদি!’ সে চলার গতি বাড়ায়। ঘরের ভিতরে তিনজন লোক বসে আছে তিনটে টেবিলে। ওদের সামনে গোছা গোছা কার্ড সাজানো আছে। সিগারেট বাক্সের ঢাকনার মত সাইজ হবে কার্ডগুলোর।

ওকে প্রথম টেবিলের সামনে দাঁড় করানো হল, মারিয়াকে দ্বিতীয় টেবিলের সামনে আর তৃতীয় টেবিলের সামনে ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক পরা একটা বুড়ো লোককে দাঁড় করানো হল। বুড়োটা ওর দিকে চেয়ে হালকা হাসল। সেও হাসল। হয়তো এই লোকটাই তার উপকারী মানুষ ছিল গাড়িতে। নাম, পেশা, বয়স সব জানাতে হল ওদের। বয়সের জবাবে সে বলে উঠল ‘তেইশ বছর’; মনে মনে ভাবল সে, ‘কত আর? বড়জোর আধ ঘণ্টা… তার পরেই চিরমুক্তি!’ সে অবাক হয়ে যাচ্ছিল এটা দেখে যে এই মৃত্যুর কারবারি লোকজন কী নিশ্চিন্তে, কত আরামে এখানে বসে রয়েছে। সব কাজ যান্ত্রিকভাবে, ঘড়ির কাঁটা ধরে হয়ে চলেছে। তবে লোকজন একটু বিরক্ত, অধৈর্য। তবে যে কোনো কেরানির কাজ যতটা বিরক্তির সঙ্গে মানুষ করে, ততটাই বিরক্তি এদের। বেশিও না, কমও না। নিরাসক্ত যান্ত্রিক ভঙ্গিতে এরা এদের দায়িত্ব পালন করে চলেছে।

এই ঘরে সেরকম কিছুই ঘটল না তার সঙ্গে। সে এখনও ভয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। সে যেদিন কনভেন্ট থেকে বাইরের জগতে ফিরে এসেছিল, সেদিনও তার মনে এক অদ্ভুত ভয় ছিল। যখন সে নিজের স্যুটকেস আর টাকার বটুয়াটা ঘামে ভেজা আঙুলে আঁকড়ে কনভেন্ট থেকে বেরিয়ে রাস্তায় গাড়িতে উঠেছিল, বাইরের জগতটাকে দেখে ভয় পাচ্ছিল সে। যে জগতে সে ফিরতে চায়… সংসার, স্বামী, সন্তান সবকিছু চায় এই জগতটার কাছে, সেই জগতটাকে তার সেদিন ভারি অদ্ভুত, বিশ্রী মনে হয়েছিল। যদিও তার চাহিদাগুলো কনভেন্টে থাকলে পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়, তবুও এই জগতে ফিরে এসে রাস্তায় গাড়িতে উঠবার মুহূর্তেও সে অত্যন্ত ভীত এবং নিজের এই ভীতির কারণে একইসঙ্গে লজ্জিত বোধ করছিল।

দ্বিতীয় ব্যারাকে লাইনে গিয়ে সে খুঁজছিল যে চেনা পরিচিত কেউ আছে কি না! কাউকে পেল না সে। ব্যারাকের সিঁড়িতে উঠবার সময় প্রহরী আবার অধৈর্যভাবে তাকে তাড়া দিতে লাগল। সে সিঁড়ি দিয়ে উঠে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করছিল ভেতরে ঢুকবার আগে। সে ঢুকবার সময় মারিয়াকে সঙ্গে নিয়েই ঢুকতে যাচ্ছিল। সেটাই ভুল হল। সে দ্বিতীয়বার চমকে উঠল যখন প্রহরী এসে মারিয়াকে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে গেল। মারিয়া ছাড়তে চাইছিল না। মারিয়ার চুল ধরে টেনে দিল। ইলোনা মারিয়ার চিৎকার শুনতে পেল। সে নিজের কার্ড হাতে নিয়ে ব্যরাকের ঘরে ঢুকল। সেখানে একটাই লোক বসে আছে। পরনে অফিসারের ইউনিফর্ম। লোকটার বুকে খুব সুন্দর একটা রূপোলী ক্রুশ আকৃতির মেডেল আঁটা আছে। মুখটা যেন ব্যথায় কাতর, ফ্যাকাসে। লোকটা যখন মুখ তুলে তার দিকে তাকাল, ভারি চোয়াল দেখে সে চমকে উঠল। মুখের আকারটাই অদ্ভুত হয়ে গিয়েছে ওরকম ভারি চোয়ালের জন্য। লোকটা নিঃশব্দে তার কার্ডটা নেবার জন্য হাত বাড়াল। সে কার্ড দিল। তার এখনও ভয় করছে না। লোকটা কার্ডটা দেখল। তারপর ঠাণ্ডা স্বরে বলে উঠল, ‘একটা গান শোনান!’

‘যা খুশি’… একটু অধৈর্য হয়ে বলে উঠল লোকটা… ‘যা মনে হয় গেয়ে ফেলুন!’ ইলোনা তার দিকে তাকিয়ে মুখ খুললো। সে সন্তদের প্রার্থনা গাইতে শুরু করল, যেটা সে কিছুদিন আগেই তুলেছে বাচ্চাদের শেখাবে বলে। সে লোকটির দিকে তাকাল একবার গাইতে গাইতে। হঠাৎ সে বুঝতে পারল যে ভয়ের স্বরূপ কেমন হতে পারে। তার গান শুনতে শুনতে লোকটার মুখ অদ্ভুতভাবে বেঁকে উঠছিল। বদলে যাচ্ছিল লোকটার মুখের রেখাগুলো যেন এক বিচিত্র তাড়সে। সে সুন্দর ভাবে গেয়ে যাচ্ছিল। সে বুঝতেও পারেনি যে গাইতে গাইতে তার মুখে এক প্রশান্তির হাসি খেলে যাচ্ছে। যদিও অদ্ভুত একটা ভয় পাক খেয়ে যাচ্ছে তার শরীরে। তার কণ্ঠ রুদ্ধ করে দিতে চাইছে ভয়ের দমক, কিন্তু সে হার মানছে না। গেয়ে যাচ্ছে। ব্যারাকের বাইরে মানুষের কথাবার্তা, গুঞ্জন সব থেমে গেছে তার গান শুরু হবার পরে।

ফিলসকাইট অপলক চেয়ে আছে। সুন্দরী এক মহিলা, কী অপূর্ব গাইছে! ফিলসকাইটের জীবনে কোনো দিন কোনো মেয়ে আসেনি। কঠোর ব্রহ্মচর্যে তার জীবন কেটে গেল প্রায়। সে যখন একা থাকে, আয়নার সামনে একা দাঁড়িয়ে রেওয়াজ করে সে। যে গুণ তার চিরকালের জন্য অধরা থেকে গেল, সেই সব বিরল গুণের সমাহার সে আজ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। মহান সৌন্দর্য, জাতিগত উৎকর্ষ, এসবের সঙ্গে আরও একটা জিনিস আছে এই মহিলার মধ্যে, যেটা তাকে প্রস্তরবৎ স্থাণু করে দিয়েছে। কী সেই গুণ? ধর্মবিশ্বাস? ভক্তিভাব? সে বুঝতে পারছে না কী একটা অদ্ভুত দরদ আছে কণ্ঠস্বরে, যেটা আর পাঁচটা স্তোত্রগায়নের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই গান যে গাইছে মহিলা, এই মুহূর্ত কি সত্য? নাকি সে স্বপ্ন দেখছে? অথচ মহিলা ভয়ে কাঁপছে, সেটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ওই মহিলার দু চোখে ঠিক কোন অনুভূতি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে? ভালবাসা? নাকি ভালবাসার মত কিছু একটা?

‘ফিলি… রিডেমপ্‌টর মুনডি, ডিউস১…’ গাইছে ওই মহিলা। সে কোনোদিন কোনো মহিলাকে এই গান এত সুন্দরভাবে গাইতে শোনেনি। ‘স্পিরিটুস সাংক্‌টে, ডিউস২…’ মহিলার কণ্ঠস্বর বলিষ্ঠ, উষ্ণ এবং অদ্ভুত পরিষ্কার। এখন নিশ্চয়ই গাইবে ‘সাংক্‌টা ট্রিনিটুস, ইউনুস ডিউস৩’… হ্যাঁ গেয়ে উঠল… ‘‘সাংক্টা ট্রিনিটুস…’ তাজ্জব ব্যাপার! ইহুদীদের মধ্যে ক্যাথলিক হয়? ফিলসকাইটের মনে হল সে এখনই উন্মাদ হয়ে যাবে!

ফিলসকাইট দৌড়ে গেল জানালার কাছে। এক ধাক্কায় পুরো জানালাটা খুলে দিল। বাইরে দাঁড়িয়ে সবাই গান শুনছে। কেউ এক চুল নড়ছে না। ফিলসকাইট বুঝতে পারল তার শরীরে একটা অদ্ভুত ঝাঁকুনি খেলে যাচ্ছে। সে এখনই বেঁকে যাবে কষ্টে। চিৎকার করতে ইচ্ছে করল তার, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হল না। কর্কশ, প্রায় নিঃশব্দ একটা ফিসফিসে শব্দ বেরচ্ছে তার কণ্ঠ থেকে। সে একটাও কথা বলতে পারছে না। বাইরে কারো নিঃশ্বাসের শব্দটুকুও পাওয়া যাচ্ছে না। মহিলা গেয়ে যাচ্ছে… ‘সাংক্‌টা ডেই জেনিট্রিক্স৪…’

ফিলসকাইটের হাত কাঁপতে লাগল… কাঁপা হাতে সে তুলে নিল পিস্তলটা। ঘুরে দাঁড়াল একবার। অন্ধের মত সে গুলি করল মহিলাকে। মহিলা পড়ে গিয়ে আর্তনাদ করছে। থেমে গেছে তার গান। থেমে গেছে সেই সংগীতময় কণ্ঠ। হ্যাঁ, আবার ফিলসকাইট নিজের কণ্ঠস্বর ফিরে পেয়েছে ওই মহিলার গান থেমে যাবার পরে। ‘মেরে ফেলো সবাইকে’… চেঁচিয়ে ওঠে সে… ‘ব্যারাকের বাইরে যারা আছে, কয়ারে যারা আছে… সব্বাই… সব্বাইকে শেষ করো’… বলতে বলতে পিস্তলের পুরো ম্যাগাজিন সে খালি করে দেয় ওই মহিলার শরীরে।

ইলোনার শরীর মাটিতে লুটিয়ে পড়ে আছে। সব ভয় শেষ হয়েছে তার। ব্যারাকের বাইরে শুরু হয়েছে হত্যালীলা।

(চলবে)

-------------------------------------------

১. লাতিন স্তোত্র, পদের অর্থ… হে ঈশ্বরের পুত্র, জগতের পরিত্রাতা।
২. লাতিন স্তোত্র, পদের অর্থ… হে ঈশ্বর, পবিত্র আত্মা।
৩. লাতিন স্তোত্র, পদের অর্থ… পবিত্র ত্রয়ী সন্ত মিলে গিয়ে এক ঈশ্বর।
৪. লাতিন স্তোত্র, পদের অর্থ… ঈশ্বরের মাতা, পবিত্র দেবী।

0 comments:

0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















( ২)

হাঁটতে হাঁটতে গোলকপতি একটু হাঁপিয়ে যাওয়ায় একটি অতিপ্রাচীন ঘোড়ানিমগাছের তলায় এসে দু'দন্ড বসল। এখানকার শীতলমাতৃময়ী ছায়াচরাচরটি আজ ওকে মনে পড়িয়ে দিচ্ছিল যে মহামহোপাধ‍্যায় শ্রী সর্বজ্ঞ শাস্ত্রীর কাছে ছেলেবেলায় ও একটি বর্ণবহুল প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথিতে দেখেছিল যেখানে ওদের পূর্বপুরুষ পরম ভট্টারক মহারাজাধিরাজ পরম সৌগত "মধুসেন” ১১৯৪ শকাব্দে (১২৭২ খ্ৰী: ) এই বিক্রমপুরে এসে আধিপত্য করতেন বলে উল্লেখ আছে। সেখানে এও কথিত আছে যে উনি তুরস্ক দস‍্যুদের বারংবার পরাজিত করেছিলেন।

যে কুলীনকূলতিলক লক্ষ্মণ সেন একদা মুসলমান দস‍্যুদের ছলনায় পরাজিত ও ভগ্নহৃদয়ে অতিবৃদ্ধ বয়সে লক্ষ্মণাবতী থেকে পূর্বদেশে পালিয়ে আসেন সেই তূরস্কবাসী দস‍্যুদের প্রতাপকে যে ওঁর পরবর্তী প্রজন্ম ক্রমাগত পরাজিত করে নিজেদের পদতলে রাখতে সমর্থ হয়েছিল, সে তো আর কম গৌরব নয়। বহুদিনের পরে উত্তরকালে এই সেন রাজবংশের রাজা হিসেবে যে সুর সেন, সূর্য সেন,নারায়ণ সেন প্রমুখের রাজকীয় উপস্থিতি কালের গর্ভে আজ বিলুপ্ত হলেও তা আজ এত দূর্ভাগ‍্যের দিনেও ওর রক্তধারায় এখনও বইছে।

....

এতদিন যে বিজয় গর্বে গোলকপতি এই কূলগৌরবের বহুকথিত শ্রুতাখ‍্যানসমূহ এবং মাতার কাছে সে পিতৃদত্ত একটি রক্তমুখী নীলকান্ত মণি শোভিত মণিবন্ধ দেখেছে শৈশবকাল থেকে তা একদা ওর পিতৃদেব মন্মহারাজ স্বয়ং কোনও এক মধুক্ষরা মুহূর্তে ওর মাতাকে একদা উপহার দিয়েছিলেন বলে সেটা আজও দরিদ্রের সংসারে রয়ে গেছে। এইটুকুই তো ওর পিতৃধন। একটি মাস পূর্বে নদীতীরে মাতার চিতাগ্নির সাথে সাথে বংশমর্যাদার সামান‍্য স্বীকৃতিটিও কালের দরবারে ইদানীং অসহায়ের মত হারিয়ে গেছে বলে ও এসব ভুলতেই চাইছে।

....

আসলে ওর মনের ভিতর মহল থেকে ক্রমাগত একটি ডাক থেকে থেকেই বেজে উঠছে যা এই অনর্থক অপমানের কূলগৌরবটিকে পরিত‍্যাগ করে এক অন‍্য ভবিষ‍্যনিধির আহ্বানে পা বাড়াতে ওকে ক্রমাগত প্ররোচিত করছে।

...

তাই এসব বিষয় সংক্রান্ত সমস্ত দ্বিধা আজ গোলকপতি স্বয়ং একটু একটু করে ফেলে দিয়ে একটি নতুন এবং অন‍্য সমারোহের পথে সে হাঁটতে চলেছে তা স্থিরকরণের অনিশ্চয়তা আর তার মনোজগতে আর নেই।

....

গোলকপতি অবশ‍্য অনেক পরে জেনেছে যে ওদের পূর্বপুরুষ রাজাধিরাজ লক্ষ্মণ সেন ছিলেন আসলে বৈষ্ণব মতবাদের কঠোর অনুসারী। তিনি সেসময় 'পরমবৈষ্ণব' বা 'পরম নরসিংহ' উপাধি ধারণ করেন। যদিও তাঁর ধর্মমতের পরিবর্তনটি সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় না। মূলতঃ তাঁর শাসনকালের শেষ দিকে অবশ্য নিজেই রাজকার্য পরিচালনায় অশক্ত হয়ে পড়েন বলে আসল জনশ্রুতি। পরবর্তীকালে বিক্রমপুরে তাঁর পলায়ন ও রাজধানী স্থানান্তরের ইতিহাসটি লোকমুখে আজকাল বহুল প্রচলিত। ' দানসাগর' আর ' অদ্ভূতসাগর' এর স্রষ্টার এ এক মর্মান্তিক পরিণতি! যদিও এটাও অনস্বীকার্য যে তাঁর মৃত‍্যু সেদিন পাঠান সুলতান ইলতুৎমিসের শাহী ফৌজকেই গৌড়ের অবিসংবাদিত রক্ষাকর্তা হিসাবে বঙ্গদেশের ইতিহাস মেনে নিয়েছে।

....

ইতিহাসের পালাবদল প্রতিটি প্রজন্মান্তরে একবার বদলে গেলেও তার শিকড়ের টানটি অন্তত চিরকালীন। সেন রাজাদের রাজবংশ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম দিকের মধ্যযুগীয় একটি হিন্দু রাজবংশ হিসাবেই বিখ‍্যাত ছিল, যার সুনাম বঙ্গদেশের মাটীতেও একাদশ ও দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত একদা বজায় ছিল।

আজ সে সব প্রাচীন ইতিহাস গৌড়-বঙ্গের আকাশে বাতাসে কান পাতলে শোনা যাবেনা। এমনকি ৯০০ শতকেরও পূর্বে তখন বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক পাল রাজাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে করতেই একদিন গোলকপতির এই বীরাচারী পূর্বজরা মিলে প্রতিষ্ঠিত পাল রাজাদেরকে পরাজিত করে প্রখ‍্যাত শশাঙ্কদেব শাসিত গৌড়ের মাটিতে সেদিন সেন বংশের তরবারিকে প্রোথিত করেন।

সেন বংশের জয়পতাকা সেদিন বঙ্গোপসাগরের উপকুল থেকে উত্তরভারত(কনৌজ) পর্যন্ত উড্ডীয়মান ছিল। তবে পরস্পরবিরোধীতা ও গোপন ষড়যন্ত্রের বীজটিও তাঁরা আবার নতুন করে গৌড়ের মাটীতে বপন করে গেলেন।

সেন রাজাদের আদি বাসস্থান যা উৎসগতভাবে ছিল দক্ষিণ ভারতের বাকাটক সাম্রাজ্যের কর্ণাটকে তার প্রচ্ছায়া এবার এসে পড়ল নদীমাতৃক পূর্ব ভারতের এই দেশাঞ্চলটিতেও।

....

ব্রাহ্মণ‍্য গৌরবের পরে কয়েকটি প্রজন্ম সেদিন ক্ষত্রিয়বাচক পেশা রাজধর্মকে সেদিন বেছে নেওয়ায় নিজেদেরকে " ব্রহ্মক্ষত্রিয় " নামে তাদের আত্মপরিচয়দানের কথা সেসময়ের বহু শিলালিপিতে উল্লেখিত আছে বলে গোলকপতি তা শুনে উল্লসিত হয়ে উঠত। যে অধার্মিক পাল বংশীয় নৃপতি মদনপালকে সমূলে সরিয়ে দিয়ে সেন বংশের বঙ্গালে পদার্পণ ও প্রতিষ্ঠার কাহিনিটি যেন তার রক্তধারায় আলোড়ন তুলত।

সে বুঝতে পারত যে তার ধমনীতেও বইছে কূলীনকূলসর্বস্ব রাজাধিরাজ খ‍্যাতনামা স্বয়ং বল্লাল সেনের রক্তধারা।

0 comments:

0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in





















ভুখ হরতাল

আমার ভাগ্যে বোধহয় নির্ঝঞ্ঝাটে পড়াশুনো করা নেই। দিনের বেলা পড়তে বসলেই বন্ধুরা বলবে—লেখাপড়া করে যে, গাড়িচাপা পড়ে সে!

আমিও হেসে খাতাপত্তর বালিশের পাশে রেখে ঝাঁকের কই ঝাঁকে মিশে যাই। পড়তে বসি সেই রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পর। ঘরের সবাই আলো নেভাতে বললে বারান্দায় গিয়ে একটা ছোট সতরঞ্চি মত বিছিয়ে পড়ায় ডুবে যাই। আমার ইকনমিক্সের বইটার নাম ধনবিজ্ঞান। লেখক ডক্টর সত্যেন্দ্রনাথ সেন লণ্ডন থেকে ধনবিজ্ঞানে বিএসসি অনার্স!

সায়েন্সের বন্ধুরা যতই সাবজেক্টের নাম নিয়ে হাসাহাসি করুক, আমিও ওদের গর্বের সঙ্গে বলি—কিস্যু জানিস না, সাহেবদের দেশে--মানে অ্যাডাম স্মিথ, রিকার্ডো আর ম্যালথাসের দেশে ইকনমিক্সে সায়েন্সের ডিগ্রি দেয়, এই দেখ।

ওরা ভাল করে দেখে মাথা নাড়ে—দূর! ওটা ছাপার ভুল হবে।

কোন ফচকে ছড়া কাটেঃ

ওহে পোদো গুণধন,

তোমার ধোনের দিকে মন।

এমন সব বিরক্তিকর মেঘলা কুয়াশা ঘেরা দিনে হঠাৎ মহা ক্যাচাল।

সেই ক্লাস এইটের বখা ছেলের দল!

বিকেলে খেলেটেলে তেরোটা কলের কলতলায় (আমাদের লব্জতে ‘তেরো কলের পার্ক’) যখন সবাই হাত-পায়ের কাদা ধুচ্ছিল তখন সুদীপ বলে গোঁফের আভাস দেখা দেওয়া ছেলেটা আমাদের নরমসরম সোমেশ দত্তের ইলাস্টিক দেওয়া খেলার প্যান্ট সবার সামনে একটানে খুলে দেয়।

সোমেশ ওকে এক চড় মারে কিন্তু সুদীপ যথেষ্ট গুণ্ডা। ওকে মাটিতে ফেলে দিয়ে লাথি মারে। সোমেশ কাঁদতে কাঁদতে এসে আমাদের পুরো ঘটনাটা সবিস্তারে বলে। এমনকি নীচু ক্লাসের ক’জন প্রত্যক্ষদর্শীকেও ডেকে আনে যারা তখন সুদীপের মারের ভয়ে বাধা দেয় নি।

আমরা গুরু অমিয়দার দিকে তাকাই।

গুরু হিমশীতল গলায় বলে—সুদীপকে ডেকে আন, বল আমি ডেকেছি।

সুদীপ এসে টের পায় হাওয়া গরম। আমরা সবাই হাজির এবং আমাদের চোখে মুখে হিংস্র ভাব, বদলা চাই!

গুরুর সামনে সোমেশ পুরো ঘটনাটা আদ্যোপান্ত বলে। সুদীপ মিইয়ে যায়।

মিনমিন করে বলে—সোমেশ মিথ্যে কথা বলছে।

--ও, সোমেশ মিথ্যে বলছে আর তুমি সত্যবাদী যুধিষ্ঠির? লাগা ওকে দুটো থাপ্পড়! সোমেশ, তোকে বলছি।

সোমেশ জড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

--কীরে, আমরা তো তোকে ওর মতন প্যান্ট খুলে দিতে বলছি না। কিন্তু ও সিনিয়রদের গায়ে হাত তুলেছে! মার দুটো থাপ্পড়।

সোমেশ এগিয়ে গিয়ে নরম নরম হাতে আলতো করে দুটো চড় লাগায়। সে দেখে আমি হেসে ফেলি। এবার গুরুর রাগ চড়ে যায়।

নিজে সুদীপকে ঠাস ঠাস করে দুটো চড় কষায় এবং বলে –এবার যা!

কিন্তু ও চলে যাবার জন্যে পেছন ফিরতেই ওর পাছায় টেনে এক লাথ! সুদীপ ছিটকে বারান্দায় গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে।

ও উঠে দাঁড়ায়, ঠোঁটের কাছে কেট গিয়ে একটু রক্ত বেরিয়েছে।

পরের দিন মেজো মহারাজ গুরু অমিয়দাকে সাসপেন্ড করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। গুরু কোলকাতা ফিরে গেল। যাবার আগে আমাদের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসল, কিন্তু কিছু বলল না।

এই ঘটনা শ্রীমান পোদোর বুকের ভিতর সঞ্চিত বারুদে কী ভাবে যেন পলিতায় অগ্নিসংযোগের কাজ করে। সে রাত্রের খাওয়াদাওয়ার পরে তাহার গ্রুপের গোপন বৈঠক ডাকে। সেখানে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় যে গুরু শ্রীশ্রী অমিয়দার সাস্পেনশন প্রত্যাহার এবং গুণ্ডা অমিতেশের বিচারের দাবিতে পরের দিন সকাল হইতে ভুখ হরতাল।

সকালে দশম শ্রেণীর কেহ প্রাতরাশ গ্রহণ করিতে গেল না, ড্রিলের মাঠেও নয়। কিন্তু কুড়ি জন ছেলে যখন দ্বিপ্রহরের ভোজনকে অবহেলা করিয়া এবং ক্লাসে না যাইয়া ঘরের বারান্দায় বসিয়া সদ্য রিলীজ হওয়া হিন্দি কমেডি সিনেমা ‘জোহর অ্যান্ড মেহমুদ ইন গোয়া’র হিট সং গাহিতে লাগিল তখন কর্তৃপক্ষের টনক নড়িল।

মহারাজেরা কেহ আসিলেন না। কিন্তু তাঁহাদের নির্দেশে দুইজন ব্রহ্মচারী, বীরেশদা তাঁহাদের অগ্রগণ্য , অনশনরত আশ্রমবালকদের খবর নিতে আসিলেন, তাঁহাদের পিছনে ক্লাস এইটের ওয়ার্ডেন রণজিৎদা।

--কী হইয়াছে? কেন এরূপ করিতেছ? এমত অভব্য আচরণ কি তোমাদের শোভা পায়? আমাদের আশ্রমের ইতিহাসে কখনও কেহ অশিক্ষিত মজুরের দলের মত অনশন করে নাই।

হাঁসের পালের থেকে প্যাঁকপেঁকিয়ে গলা তুলল ‘আগলি ডাকলিং’ শ্রীমান পোদো।

-- আগে কি কখনও একটা ছেলে অসভ্যতা করলে কিছু না শুনে সিনিয়র ছেলেকে একতরফা সাসপেন্ড করা হয়েছে?

ওরা গোলগোল চোখ করে শুনলেন এবং ফিরে গেলেন।

দু’ঘন্টা পরে শুধু বীরেশদা এলেন।

ওনাকে অভ্যর্থনা করা হল মহম্মদ রফির হিন্দি গান গেয়েঃ

“ দো দিওয়ানে দিলকে, চলে হ্যায় দোনো মিলকে,

চলে হ্যায়, চলে হ্যায়, চলে হ্যায় শ্বশুরাল”।

--আচ্ছা, ভেবে দেখ তোরা না খেয়ে থাকলে আমরা কি খেতে পারি? তোরা কী চাস? কী হলে ওই অনশনটন ভুলে খেতে আসবি? বড় মহারাজ রান্নাঘরের ঠাকুরদের বলে দিয়েছেন—ক্লাস টেনের কোন ছেলে খেতে চাইলে যা চায় সেটা বেড়ে দিতে।

--এসব কায়দা করে কিছু লাভ হবে না বীরেশদা। আগে আপনারা অমিয়দার সাসপেনশন তুলে নিন। আমরাও অনশন তুলে নেব। তারপর সুদীপ এবং সোমেশকে এবং যারা তখন ঘটনাটা দেখেছে তাদের ডেকে সব শুনে আপনারা বিচার করুন। তখন যা বলবেন মেনে নেব।

--শোন, বড় মহারাজ কথা দিয়েছেন যে তোদের দুটো দাবিই মেনে নেওয়া হবে। আগে খেয়ে নে। তারপর তোদের আলোচনায় ডাকবেন।

--কাকে কথা দিয়েছেন? আমাদের অফিসে ডেকে সবার সামনে উনি কথা দিন আর অমিয়দার সাসপেনশন তুলে নিয়ে ওর বাবাকে ফোন করে বলুন –কাল ওকে আশ্রমে পৌঁছে দিতে, ব্যস।

--তোরা আমাদের অবিশ্বাস করছিস?

--কাউকেই অবিশ্বাস করছি না তো। কিন্তু আমাদের শর্ত আপনাকে জানিয়ে দিলাম। গিয়ে বড় মহারাজকে বলুন।

ওরা ফিরে যান, কিন্তু আমাদের ভুখ হরতালের খবরটা স্কুলের ছেলেদের মাধ্যমে সমস্ত টিচারদের কাছে, মায় যে টিচাররা আশ্রমবাসী তাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। হঠাৎ ‘সমর্থন’ আসতে থাকে। হোস্টেলের টিচাররা গোপনে আমাদের দু’জন প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে “পূর্ণ সমর্থন” জানিয়ে বলেন ভয় না পেতে। আরও বলেন যে চুপিচুপি খেতে চাইলে ওঁরা খাবার আনিয়ে দেবেন।

অনশনরত বালকের দল খুব খুশি। কিন্তু এবার অনশনের নেতৃত্ব কেমন করে যেন প্রদ্যুম্ন ওরফে পোদোর ঘাড়ে চেপেছে। ব্যস, পোদো বার খেয়ে ক্ষুদিরাম হয়ে গেল।

ও গম্ভীর মুখ করে গুরুর অনুকরণে দু’বার গলা খাঁকারি দিয়ে গলার আওয়াজ মোটা করে বলল—“ ব্রহ্মিষ্ঠের চরণে প্রণিপাত। আমার মাত্র গোধনে প্রয়োজন ছিল”।

এ আবার কী!

--এটা জনকসভায় যাজ্ঞবল্ক্যের ডায়লগ। জনক বললেন -যিনি ব্রহ্মিষ্ঠ অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞানী, তিনি এই সোনার পাতে শিং মোড়া একহাজার গাভী নিয়ে যান। তখন যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর এক শিষ্যকে আদেশ করলেন – যা রে! ওই গরুগুলোকে পাঁচন বাড়ি লাগিয়ে আমার আশ্রমে নিয়ে যা।

তখন এক ঋষি কুপিত হয়ে বললেন—তিষ্ঠ! যাজ্ঞবল্ক্য, তুমি নিজেকে ব্রহ্মজ্ঞ মনে কর নাকি? বলি কবে থেকে?

তখন জবাবে উনি ওপরের ডায়লগ ঝেড়েছিলেন। তারপর কী হইয়াছিল জানে শ্যামলাল। একে একে সবাই, মায় গার্গী বলে এক মহিলা বিদুষী সবাই যাজ্ঞবল্ক্যের কাছে হার মানলেন।

--এসব কোথায় লেকা আচে?

--বৃহপদারণ্যক উপনিষদে।

--তুই উপনিষদ পড়েছিস? শালা পোদো, খাবার সময় গীতাপাঠের পারমিশন পেয়েছিলি বলে উপনিষদ নিয়ে ফালতু গুল মারবি? যত্ত আলফাল ফাণ্ডা।

এবার বিপ্লব মুখ খোলে।

--এর জন্যে মূল উপনিষদ পড়ার দরকার হয় না। এটা ক্লাস নাইনের ধর্মক্লাসের যে বইটা ছিল—“উপনিষদের নির্বাচিত গল্প”, তাতেই আছে।

আমি অবাক। বিপ্লব আমার সাপোর্টে মুখ খুলেছে! ও কি আশা করে আমাদের সম্পর্ক ফের আগের মত হয়ে যাবে?

কিন্তু খেঁকিয়ে উঠেছে প্রশান্ত—এঃ , শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল! শালুক চিনেছেন গোপাল ঠাকুর। আব্বে, কোন শাস্তরে কী লেখা আছে জেনে আমাদের এখন কী লাভ? কাজের কথা বল। স্যারেরা বলছেন লুকিয়ে খেয়ে নিতে, ওঁরা খাবার সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব নিচ্ছেন। দু’দিন ধরে না খেয়ে আছি। আমি বাবা, স্যারের কথা মেনে চলার পক্ষে, পেটে ছুঁচোয় ডন মারছে।

তোরা কী বলিস?

রমেন বলে—আগে পোদোর কথা শোনা যাক। এখন ওই লীডার। পেট খারাপের ব্যামো আর বিচ্ছিরি পাদে, কিন্তু ওই লীডার।

সবাই আমার দিকে তাকিয়ে।

আমি প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকাই, এক এক করে।

--শোন, স্যারেরা সমর্থন দিচ্ছেন , ভাল কথা। এর মানে বড় ও মেজো মহারাজের তুঘলকি ব্যবহারে ওনারা অসন্তুষ্ট, ক্ষুব্দ। হয়ত ওনাদেরও কোন পুরনো ইস্যু রয়েছে, যা আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের জোর হল নৈতিকতা। আমরা যদি লুকিয়ে খাবার খাই, তাহলে স্বামীজিরা ঠিক জেনে যাবেন। কে জানে, স্যারেরদের মধ্যেই কেউ মহারাজের স্পাই কি না!

আমাদের নিজেদের লক্ষ্য ভুলে গেলে চলবে না। যতক্ষণ আমাদের গুরু অমিয়দার সাসপেনশন বহাল রয়েছে ততক্ষণ আমরা খাবার খাব না, ব্যস।

সুদীপের বিচার ও শাস্তি এজেন্ডার দু’নম্বর। ওটা নেগোশিয়েবল। কিন্তু অমিয়দা আগে ফিরে আসুক। তারপর ওই লীডার হবে, আমার কাজ শেষ।

যাজ্ঞবল্ক্যের গল্পটা রেলিভ্যান্ট। আমাদের নিজেদের লক্ষ্যের ব্যাপারে ক্লিয়ার থাকতে হবে।

কিন্তু আমি কোন ডিক্টেটর নই। সবাই মিলে যেটা ঠিক হবে, সেটাই মেনে চলব।

সবাই চুপ।

প্রশান্ত মুখ খুলল।

--নাঃ পোদো শালা ঠিক বলেছে, এক্কেবারে লীডারের মত। হ্যাঁরে পোদো, তুই কি বড় হয়ে ইলেকশনে দাঁড়াবি?

রমেন হেসে ফেলে।

--ভাগ শালা, ও কোন দুঃখে ওসব হবে। ও হবে কোন একটা আলাদা মিশনের মহারাজ। খুব গীতা-উপনিষদের ফাণ্ডা ঝাড়ে না? ঘাবড়াস না পোদো, এই বাংলা বাজারে দশটা-পাঁচটা চাকরি করার চেয়ে গেরুয়া পরে সন্ন্যাসি হবি--দু’বেলা খাবারের চিন্তা থাকবে না।

--হ্যাঁ হ্যাঁ, ভাত-কাপড়-বিছানা সব গ্যারান্টি। কত লোক তোকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করবে। তুই আশীর্বাদ দিবি। তোর আশীর্বাদে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া মিটে যাবে। যার বিয়ের দশ বছর পরেও কোলে বাচ্চা আসে নি, তোর আশীর্বাদে সব হবে।

বিয়ে করে সংসার করতে গেলে কত ঝামেলা। বছর বছর চ্যাঁ-ভ্যাঁ, পুজোর শাড়ি , বাচ্চাদের বাবা স্যুট। গয়না গড়িয়ে দাও, পুরীতে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে নিয়ে যাও। কত বায়নাক্কা ! তার চেয়ে সন্ন্যাসী হওয়া ভাল।

হো-হো-হা-হা-হি- হি!

এবার রমেন গান ধরে—জানেওয়ালে জরা হোঁশিয়ার, ইহাঁকে হম হ্যায় রাজকুমার।

এরপর সমবেত কণ্ঠে –লাল ছড়ি, ময়দান খড়ি, ক্যা খুব লড়ি, ক্যা খুব লড়ি।

কেউ কেউ শাম্মী কাপুরের ব্যর্থ অনুকরণ করে। আমরা সবাই নাচতে থাকি।

কেউ খেয়াল করি নি যে অনেকক্ষণ ধরে বৃহস্পতি দাস একপাশে দাঁড়িয়ে আমাদের বাঁদর নাচ দেখছে, এবং কিছু বলছে।

প্রায় ছ’ফিট লম্বা কুচকুচে কালো বৃহস্পতি আমাদের আশ্রমের জমাদার। নালা-নর্দমা সাফ করে। কিন্তু ওর পরনে্র স্যাণ্ডো গেঞ্জি এবং হাফপ্যান্ট ধবধবে সাদা। এসেছে বিহার থেকে, ভাঙা ভাঙা বাংলা বলে। ওর ঘরে গিয়ে দেখেছি বিছানার চাদর তেমনই পরিষ্কার।

আমাদের বলেছিল যে ওদের গাঁয়ে ওরা অছুত, অস্পৃশ্য; তাই গাঁয়ের সীমানার বাইরে ধাঙড় বস্তিতে ওদের ঘর।

ওসব নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথা নেই। আমরা স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্য, উনি জাতপাত ছোয়াছুঁয়ি এসবের থোড়াই কেয়ার করতেন। ঠাকুর নিজে ব্রাহ্মণ হয়ে ধনী কামারনীর রাঁধা ডাল খেতেন তো।

এর ফলে এমন দোস্তি হল যে একদিন ওয়ার্ডেন রণজিৎদা ক্লাস কামাই করা রমেনকে খুঁজতে খুঁজতে আবিষ্কার করলেন মেথর বৃহস্পতির বিছানায়। গাঢ় ঘুমে তলিয়ে আছে রমেন।ভর দুপুরে কপালে মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম, আর হাতে একটা জ্বলন্ত সিগ্রেট, তখনও ছ্যাঁকা লাগে নি।

রণজিৎদা জানতে পারেন নি যে ওনার বিছানায় গুরুর ফেলা অ্যাসিডটা ছিল পায়খানা পরিষ্কার করার সালফিউরিক। প্রশান্ত বৃহস্পতির ঘর থেকেই জোগাড় করেছিল।

সে যাক গে, এখন বৃহস্পতি কিছু একটা বলার জন্যে হাঁসফাঁস করছে, আমাদের ইশারা করছে নাচ থামাতে।

ও বলল যে বড় মহারাজ অনশন করা সব ছাত্রের গার্জেনদের তলব করেছেন। যাদের বাড়ি বাঁকুড়া, পুরুলিয়া বা বর্ধমানে তাদের ট্রাংককলে খবর দিয়েছেন। আর দূরের লোকজনকে টেলিগ্রাম করেছেন।

দু’জন গার্জেন এরমধ্যেই এসে অফিসে বসে আছেন। বিশুর ও অনিন্দ্যের বাবা। বৃহস্পতিকে বড় মহারাজ আদেশ করেছেন ওই দু’জনকে ডেকে অফিসে নিয়ে যেতে।

সবাই আমার দিকে তাকায়। আমি নিরুত্তর। এই চালের কাটান কিসে সেই মন্তর আমার জানা নেই। সেই মুহুর্তে বুঝে যাই যে আমি লীডার নই। আমার মধ্যে সেই মেটেরিয়াল নেই। আবেগের মাথায় চলি—গ্যাস বেলুনের মতো।

হ্যাঁ, গুরুর মধ্যে ছিল। কিন্তু ও তো ময়দানে নেই। অতঃ কিম্‌?

অপেক্ষা করে দেখতে হবে কোথাকার জল কোথায় গড়ায়।

বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না।

ফিরে এল বিশু ও অনিন্দ্য, চোখের জল মুছতে মুছতে।

একটু একটু করে যা বলল তাতে বুঝলাম মহারাজ গার্জেনদের ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। আসল ঘটনা না বলে জানিয়েছেন যে ক্লাস টেনে এসব করলে বাচ্চাদের পরকাল তো গেছেই ইহকালও ঝরঝরে।

মিশন থেকে রাস্টিকেট হলে কোথাও অ্যাডমিশন হবে না। ক্যারিয়ার মায়ের ভোগে গেল!

ওরা আসল ঘটনার কথা বলতে যেতেই গার্জেনরা এক ধমকে থামিয়ে দিয়েছেন। স্বামীজির কাছে পা’ ধরে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছেন। মহারাজ ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে ক্ষমা করে দিয়েছেন। বাবারা লিখে দিয়েছেন যে ওনাদের বাচ্চা আর এমন অবাধ্যতা করবে না।

ওরা ফিরে আসার আগে মেজো মহারাজ উঁচু আওয়াজে বললেন –আপনার বাচ্চা নিষ্পাপ। কিন্তু তিনটে ছেলে এখানকার আবহাওয়া দুষিত করছে—অমিয়, প্রদ্যুম্ন আর প্রশান্ত।

পালের গোদাকে আমরা সাসপেন্ড করেছি, তাই পরের জন সবাইকে উস্কানি দিচ্ছে। ছেলেকে বলুন প্রদ্যুম্নের সঙ্গে না মিশতে।

দুটো কথা বুঝতে পারলাম।

এক, আমার বাড়িতেও টেলিগ্রাম গেছে। তিনচার দিনের মধ্যে আমার বাবাও এসে পড়ল বলে। আমার বাবা এক্স-মিলিটারি ম্যান, আমার জন্মের আগে ১৯৪৮ সালে কাশ্মীরের যুদ্ধে লড়েছিল। এখন ভিলাই স্টিল প্ল্যাণ্টের ইঞ্জিনিয়ার বটে, কিন্তু মেজাজ সেই মিলিটারি মার্কা। আমার দুই কাকা আড়ালে ওনার নাম দিয়েছে –তারাস বুলবা, গোগোলের রাশিয়ান বইয়ের কসাক জেনারেল।

টেলিগ্রাম পেয়ে ছুটি নিয়ে এলে কী হবে ভেবেই আমার জ্বর আসার জোগাড়।

দুই, আমার আশ্রমবাস উঠল বলে!

হ্যাঁ, বলা বাহুল্য ভুখ হরতাল দ্বিতীয় দিনেই ভেঙে গেছল। সবার বাবা এসে ছেলেদের আচ্ছা করে কড়কে দিলেন। কেউ কেউ তো মারতেই উঠেছিলেন। একজন বললেন—তোরা ছাত্র, না কারখানার মজুর? ভেবে বল্‌।

আর আমাদের গুরু অমিয়দার সাসপেনশন উঠে গেল। ও ফিরে এল মনমরা হয়ে। কিন্তু আমাদের ঘরে ঢুকেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমাদের গুরুর চোখে জল দেখলাম, প্রথমবার।

রাত্তিরে গুরুকে চুপি চুপি বললাম- বুদ্ধি দাও। বাবা এলে বাড়ি নিয়ে গিয়ে ঠ্যাঙাবে, হয়ত ছাড়িয়ে নিয়ে আরও কড়া শাসনের কোন হস্টেলে ভর্তি করে দেবে। কী করি?

--রাত্তিরে খেয়ে দেয়ে ভাল করে ঘুমো। দু’দিন খাসনি, শুধু আমার জন্যে? আমার সম্মানের জন্যে!

কাল সকালে একটা রাস্তা বের করব।

পরের দিন সকাল। রোববার। জলখাবার খাওয়া হয়ে গেছে। আমার আর তর সইছে না।

--শোন, পোদো। তুই আমাকে একবার মুজতবা আলীর লেখা থেকে অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে পড়াশুনো ছেড়ে দেওয়া, তারপর শান্তিনিকেতনে ভর্তি হওয়ার গল্প শুনিয়েছিলি না?

--হ্যাঁ, কিন্তু সে তো -----

গুরু আমাকে হাত তুলে থামায়। বলে সেই সময় উনি মজা করে একটা কমেন্ট করেছিলেন না?

--হ্যাঁ, খেটেখুটে পরীক্ষা পাশ করার চেয়ে পরীক্ষা না দেওয়ার সম্মান বড় হয়ে গেল বা ওইরকম কিছু একটা।

--জাস্ট দ্য থিং! তোকেও তাই করতে হবে।

--মানে?

--ডিফেন্স নয় অফেন্স। তোর নামে কমপ্লেন হওয়ার আগেই তুই তারাস বুলবার কাছে, থুড়ি মেশোমশায়ের কাছে কমপ্লেইন করে দে।

ফিসফিস ফিসফিস ফিসফিস!

গুরু আশুতোষ দেবের বেঙ্গলি টু ইংলিশ ডিকশনারি খুলে বসেছে।

অতঃপর গুরু কর্তৃক আদেশিত হইয়া আশ্রমবালক শ্রীপ্রদ্যুম্ন তাহার পিতৃদেবকে ইনল্যান্ড লেটারে নিম্নরূপ পত্র পাঠাইলঃ

“বাবা, আমি আশ্রমে থাকতে চাই না। এখানে খুব “হোমোসেক্সুয়ালিটি” হয়”।

(চলবে)

0 comments: