প্রবন্ধ - অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়
Posted in প্রবন্ধপ্রতি বছর নিয়ম করে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস পালন করা হয় দেশ জুড়ে, এই শহরেও। মিছিল, মিটিং, সেমিনার করে পাড়ায় পাড়ায় লোকেদের মন থেকে অপবিজ্ঞান আর কুসংস্কার নিয়ে ধারণা দূর করতে নানা প্রোগ্রাম নেওয়া হয়। কিন্তু সমাজে লোকেদের মন থেকে কুসংস্কার দূর তো হলই না বরং দিনে দিনে তা আরও ঊর্দ্ধমুখী। বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেই কি মনে গেঁথে থাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন কুসংস্কার দূর হয়? সমাজের দিকে তাকালেই দেখা যায় বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও ধর্মীয় পুজো, আচার এবং নানা সংস্কারের সাথে ওতোপ্রোত যুক্ত। শুধু তাই নয়, বেশিরভাগ বিজ্ঞানী, ডাক্তার এবং গবেষকও সংস্কারমুক্ত নন। নিজের এই অযৌক্তিক ব্যর্থতাকে ‘ব্যক্তিগত’ বলে আপোষ করেন।
যুক্তিসম্মত যে কোনো জ্ঞানই তো বিজ্ঞান আর তা সাহিত্যও হতে পারে। প্রাণী আর প্রকৃতি, এদের নিয়েই তো যত শিক্ষা। যে শিক্ষা মানবহিতকর তাই তো প্রকৃত শিক্ষা। হিউম্যানিটিজ শব্দের অর্থ মানবিকীবিদ্যা যা শিক্ষার প্রাথমিক রূপ দর্শন। প্রকৃতি ও মানুষের সমাজ থেকে উঠে আসছে। কেউ ভাষায় অলঙ্কারস্বরূপ তাকে বর্ণনা করছে, কেউ আবার তার সত্যাসত্য প্রমাণ করছে। এর থেকেই কলা ও বিজ্ঞান বিভাগ। এখনও কিন্তু এই দুটো বিভাগেই যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা হয়।
আমরা শিক্ষা গ্রহণ করি সমাজ থেকে আর কিছুটা ব্যক্তিগত ভাবে যাকে বলে ঠেকে শেখা, অভিজ্ঞতা থেকে অথবা ভাবতে ভাবতে নতুন কিছু উদ্ভাবন। মানুষের বিবর্তনিক ইতিহাসের যুক্তিটা মাথায় ঢুকিয়ে দিলে চার্লস ডারউইন সাহেব মান্যতা পান। জন্মান্তরের ভূতটা মাথা থেকে নামতে সাহায্য করে। মানুষকে শিক্ষিত করতে গেলে তাকে ভাবার, যুক্তি তৈরির সুযোগ করে দিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যটাই তো যুক্তি বা লজিক তৈরির ক্ষমতা বাড়ানোর জন্যে, শুধুমাত্র গিলিয়ে দেবার জন্যে নয়।
এই যুক্তি কাজ করছে সেই প্রথম মানব (হোমো হ্যাবিলিস) থেকে যারা বালি, মাটি ও পাথরের মধ্যে দেখল পাথর ছুঁড়লে সবচেয়ে বেশি দূর যায় এবং তা দিয়ে আত্মরক্ষা আবার শিকারও করা যায়। বিজ্ঞানের সূত্রপাত সেই যুক্তি থেকেই। আর পাথরকে ঘষে অস্ত্র তৈরি হল তার প্রথম প্রযুক্তি। সেই থেকে মস্তিষ্কের ক্রম বিবর্তন, এবং দর্শন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমোন্নতি। যুক্তিবাদী মন মানুষের জন্মগত।
বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের দ্বন্দ্ব প্রাচীন। যা ধরে রাখে তাই ধর্ম। প্রকৃতি প্রতিটা প্রাণিকে ধরে রাখে সেটা প্রকৃতির ধর্ম। মানুষ প্রকৃতি আর তার প্রাণিজগতকে ধরে রাখলে সেটা মানুষের ধর্ম। আদি মানবের যুথবদ্ধ থাকার উপলব্ধি সংস্কৃতির প্রথম অধ্যায়। সেই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক মানুষ। বিচিত্র ভৌগোলিক অঞ্চলে মানুষের বেঁচে থাকার সংস্কৃতি হল ভিন্ন। আধুনিক মানুষের সভ্যতা সেভাবেই গড়ে উঠেছিল বিভিন্ন নদীর অববাহিকায় নিজ নিজ ধর্মে। কিছু চতুর লোক এই ধর্মকে ব্যবহার করে সমাজকে শাসন করতে শুরু করল, সংস্কৃতি হল প্রধান অস্ত্র। আদানপ্রদানের বদলে সংস্কৃতির আত্তীকরণ বিশেষ আকার ধারণ করল। ধর্ম আর সংস্কৃতিকে মিলিয়ে দিয়ে মানুষের মধ্যে বিভেদের বীজ বপন করা হয়ে গেল। ব্যবহারিক সংস্কৃতির কিছু সংস্কারে পরিণত হয়। সংস্কার যতক্ষণ মানুষের হিতের জন্যে সেটা গ্রহণযোগ্য, নইলে তা কু-সংস্কার। সংস্কৃতি নদীর মত সদা বহমান, সময়ের সাথে পরিবেশের সাথে বদলিয়ে যায় কিন্তু যে সংস্কার স্থবির হয়ে যায় তা সমাজে ক্ষতি করে, কু-সংস্কার।
জন্মের পর জ্ঞান হওয়া থেকেই মানুষ সামাজিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকে প্রথমে পারিবারিক আবহাওয়ায় ও পরে বাইরের সমাজে। পরিবার যদি কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয় তাহলে সংসারে বিভিন্ন ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমে তার প্রভাব শিশু মনে পড়তে বাধ্য। কুসংস্কার মানুষের মনকে দুর্বল করে আবার দুর্বল মনে কুসংস্কার বাসা বাঁধে। আজ যে বিজ্ঞানী সে তো শিশু থেকেই ওই সংস্কারাচ্ছন্ন পারিবারিক ও সামাজিক শিক্ষার মধ্যেই বেড়ে উঠেছে ফলে তার মধ্যে সেই মনোভাব চেপে বসে আছে। এইবার সে যখন বড় হয়ে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে শুরু করল তখন আর পাঁচটা বিষয়ের মত সে যুক্তি দিয়ে বোঝার পরিবর্তে মুখস্থ করে কারণ তার উদ্দেশ্য গবেষণা বা চাকরি। বিজ্ঞান পড়াটা তার কাছে একটা ভবিষ্যতের উন্নতির স্প্রিংবোর্ড, নিজের মনকে বিজ্ঞানে আত্মস্থ করার জন্যে নয়। তাই বিজ্ঞানী হলেই সংস্কারমুক্ত হয় না। আজকাল পৌরাণিক গল্পের কিছু ঘটনাকে বিজ্ঞানের মোড়কে বাজারে চালানোর রাজনৈতিক চেষ্টা চলছে। স্কুল-কলেজে বৈদিক বিজ্ঞান চালু করায় সরকারি মান্যতা বিজ্ঞানের জায়গায় অপবিজ্ঞানের প্রাধান্য বাড়াতে সাহায্য করছে।
অদূরদর্শী মানুষ তার ভাবী অনিশ্চিত জীবনের আশঙ্কায় দুর্বল, নির্ভরতা-প্রবণ, যুক্তিহীন। বিশ্বাসের জন্ম সেখানেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নতি প্রকৃতির অনির্দিষ্ট ও অনিশ্চয়তার জট ধীরে ধীরে খুলছে।বিজ্ঞানকে যুক্তি দিয়ে আত্মস্থ করতে না পারলে বিজ্ঞান-গবেষক বা বিজ্ঞানমনস্ক চাকুরীজীবী হওয়া যায় কিন্তু যুক্তিকে ব্যবহারিক কাজে লাগানোর মত বিজ্ঞানী তৈরি হয় না। এর জন্যে চাই আত্মশক্তি। অবশ্য আত্মশক্তি থাকলে বিজ্ঞানী না হয়েও যুক্তিবাদী মন হতে পারে। ব্যক্তিগত শিক্ষাই আত্মশক্তি তৈরিতে সাহায্য করে যেখানে নিজস্ব মতামত দ্বারা প্রচলিত ধারাকে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব। এই জন্যেই রামমোহন বা বিদ্যাসাগর বিজ্ঞানী না হয়েও সংস্কারমুক্ত ‘মানুষ’ হয়েছিলেন। বিশ্বাস নয়, যুক্তি যা বহমান। সেটাই বিজ্ঞান, শিক্ষার কোনো স্বতন্ত্র শাখা নয়। এই আত্মশক্তি যার মধ্যে নেই সে বড় বিজ্ঞানী হয়েও সংস্কারমুক্ত হতে পারে না আবার চেষ্টা করে প্রাথমিককালে সংস্কারমুক্ত জীবন কাটালেও সেটা আপাত, সুযোগমত দুর্বল মনে সংস্কার আচ্ছন্ন করবেই। তখন অসহায়ের মত নিজেকে সমর্পন করে। মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পাতা রয়েছে ভুবন জুড়ে, একমাত্র আত্মবিশ্বাসে নির্ভর করে যুক্তি দিয়ে সেই জাল কেটে বেরনো সম্ভব। শুধুমাত্র বিজ্ঞান দিবস পালন আর বক্তৃতায় যুগ যুগ ধরে মানুষের মনে প্রোথিত গভীর বিশ্বাস দূর করা সম্ভব নয়, নিজের নিত্য ব্যবহারিক জীবনযাপন দিয়ে উদাহরণ হয়ে উঠতে হবে। আপনি আচরি ধর্ম।
বাহ্। খুব বাস্তব কথা লিখেছিস। "নিজের নিত্য ব্যবহারিক জীবনযাপন দিয়ে উদাহরণ হয়ে উঠতে হবে।" খাঁটি কথা।
ReplyDelete