0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















২৬

১৯৩৩ সালে ফিল্স্কাইট অবশেষে ব্যাঙ্কের কাজ ছেড়ে সম্পূর্ণভাবে যুবদলের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করে। সাংগীতিক গবেষণার কাজও চলতে থাকে তার। তার লেখালেখি অন্য অনেক সঙ্গীত বিভাগে প্রশংসিত হতে থাকে। বেশ কিছু বিশেষ জার্নালে অল্প স্বল্প সম্পাদনার পরে ছাপা হয় তার পেপার। যদিও সে অচিরেই যুব দলের অঞ্চলপ্রধান হয়ে গিয়েছিল, যদিও সেই অঞ্চলের নাৎসি ঝটিকা বাহিনী এবং সুরক্ষাদলের ভার ছিল তারই কাঁধে, তবুও সঙ্গীত ছিল তার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। সমবেত সঙ্গীত পরিচালনা করতে তার খুব ভালো লাগত। সমবেত পুরুষ কণ্ঠের দল অথবা পুরুষ, মহিলা মেশানো কোনো দল পরিচালনা করতে তার জুড়ি ছিল না। নাৎসি ঝটিকা বাহিনীর যে মূল দল, অর্থাৎ মড়ার খুলি বাহিনী১ র ভিতরে ঢুকবার অনেক চেষ্টা ছিল তার, কিন্তু সে কিছুতেই সফল হচ্ছিল না। দু’ দু বার তার আবেদন অগ্রাহ্য হয়েছিল, সম্ভবত তার কালো চুল এবং ছোটখাট শারীরিক গড়নের জন্য।

কেউ জানে না যে সে নিজের বাড়িতে প্রবল খেদের সঙ্গে বহুবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখত। তার নিজেরও মনে হয়েছে যে শারীরিক ত্রুটির ব্যাপারটা অগ্রাহ্য করা যায়না তার ক্ষেত্রে। যে জাতকে সে পাগলের মত পছন্দ করে, পুজো করে, সেই জাতের প্রতিনিধি লোহেনগ্রিনের২ মত আর্যসুলভ চেহারা একেবারেই নয় তার। তবে অবশেষে তার তৃতীয় আবেদন গ্রাহ্য হল। কারণ, সে বিভিন্ন দলের সংগঠনের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে দারুণ দারুণ সুপারিশ পেশ করেছিল। যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায়, তার সঙ্গীতপ্রতিভার কারণেই তাকে ভুগতে হল। একবারও ফ্রন্টে পাঠানো হয়নি তাকে। বরঞ্চ বিভিন্ন পাঠক্রমের শিক্ষানবিশ এবং তার পরে কোথাও কোথাও শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হত তাকে। সব শেষে শিক্ষকদের শিক্ষক হিসেবে পাঠানো হতে লাগল। এছাড়া নাৎসি সুরক্ষাদলের গানের ক্লাসের দায়িত্ব ছিল তার উপরেই। সেখানকার গানের দলে তার পরিচালনায় তেরোটা আলাদা দেশের মানুষ আঠেরোটা আলাদা ভাষায় গান গেয়েছে। শুধু তাই নয়, বিখ্যাত তানহয়সার দলের অংশ হিসেবেও গেয়ে এসেছিল তার পরিচালিত দলটি। সে প্রথম শ্রেণির ওয়ার মেরিট ক্রস সম্মান পেয়েছিল, যা সেনাবাহিনীতে খুবই বিরল এক সম্মান; তবে সেটাও কুড়ি বার বিভিন্ন পাঠক্রমে কাজ করবার পরে যখন তাকে ফ্রন্টে পাঠানো হল, তারো বেশ কিছু পরেকার কথা।

জার্মানির ছোট একটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের দায়িত্বে পাঠানো হয়েছিল তাকে ১৯৪৩ সালে। অবশেষে ১৯৪৪ সালে সে হাঙ্গেরির একটা ঘেটোতে যায় কম্যান্ডার হিসেবে। পরে রাশিয়ান বাহিনী এগিয়ে এসেছিল বলে, এই ঘেটো সম্পূর্ণ সরিয়ে ফাঁকা করবার দায়িত্ব ছিল তার উপরে। এখন উত্তরের এই ছোট ক্যাম্পের দায়িত্ব তার ঘাড়ে। সমস্ত অর্ডার ঠিক ভাবে সম্পন্ন করাটাই তার একমাত্র উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তবে কাজের মধ্যেও সব যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গীতপ্রতিভা আবিষ্কার করবার ঝোঁকটা তাকে পেয়ে বসেছিল। ইহুদীদের মধ্যে এই গুণটা তাকে বিস্মিত করেছিল। সে নবাগত বন্দিদের গানের অডিশন নিতে শুরু করেছিল। শূন্য থেকে দশ, এই ক্রমে গ্রেড দিত সে এই অডিশনে। খুব কম বন্দিরা শূন্য গ্রেড পেত। যারা পেত, তারা সঙ্গে সঙ্গে ক্যাম্পের গানের দলে ঢুকে যেত, এবং যারা দশে নেমে যেত, তাদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দু’ দিনের বেশি ছিল না।

যখনই ক্যাম্প ফাঁকা করবার প্রয়োজন হত, সে এমনভাবে সেটা করত, যাতে কক্ষনো তার গানের দলে গায়ক গায়িকার কমতি না পড়ে। ভালো গায়ক গায়িকারা সব সময় তার দল আলো করে থাকত। যেকোনো প্রতিযোগিতা সে জিতে আসতে পারত এই দল নিয়ে। এই দলের জন্য সে গর্বিত ছিল। এমজিভি কনকর্ডিয়া কম্পানিতে থাকাকালীন যেমন খেটেখুটে দলটা তৈরি করেছিল সে, এবারও কম পরিশ্রম হয়নি তার। তবে এক্ষেত্রে শ্রোতা বলতে ছিল শুধু ক্যাম্পের মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত বন্দিগণ এবং প্রহরীরা। তবে উপরমহলের অর্ডারের গুরুত্ব তার কাছে সঙ্গীতের চেয়েও বেশি। এদিকে সম্প্রতি তার উপরে অনেক অর্ডার ছিল। ফলে তার গানের দলটা ক্রমেই ছোট আর দুর্বল হয়ে যাচ্ছিল।

হাঙ্গেরির ঘেটো এবং ক্যাম্পগুলো সব ফাঁকা করে দিয়েছিল সে। এর আগে সে বড় ক্যাম্পে অনেকসময় পাঠিয়ে দিত ইহুদীদের। এদিকে এই ছোট ক্যাম্পে কোনো রেল যোগাযোগ নেই। ফলে সবাইকে এই ক্যাম্পেই মেরে দিয়ে ক্যাম্প ফাঁকা করতে হচ্ছে। তবে এখনও অনেক কম্যান্ডো আছে এই ক্যাম্পে। যারা ভালো গান গায়, এখনও কম্যান্ডোরা তাদের রক্ষা করে চলেছে। কারণ ফিলস্কাইট খুনোখুনি একদম পছন্দ করেনা। সে নিজে হাতে কোনোদিন কাউকে খুন করেনি, সেটা অবশ্য তার আফসোসের কারণ। সে পারে না। যদিও সে সব অর্ডার অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। নিজে হাতে সব অর্ডার পালন করা জরুরি নয়। সেগুলো ঠিকঠাক পালন হল কি না, সেটা দেখলেই চলবে।

ফিলসকাইট জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে বিশাল সবুজ ফার্নিচার ভ্যানটা খোলা হবে এখনই। পেছনে আরও দুটো ট্রাক এসে দাঁড়িয়েছে। একজন এসে সবুজ ভ্যানের চালকের কেবিনে উঠে গেল। ক্যাম্পের চিফ ব্লাউয়ের্ত আরও পাঁচজনকে নিয়ে এসেছেন ট্রাকগুলোর দরজাটা খুলবার জন্য। বিশাল সবুজ ট্রাকের পিছনের গদি আঁটা দরজাটা ধীরে ধীরে খোলা হল। ভেতরের মানুষগুলো আর্তনাদ করে উঠলো। হঠাৎ সূর্যের আলো এসে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। তীব্র চিৎকার করছে মানুষগুলো। কেউ কেউ ছিটকে বেরিয়ে এল ভ্যানের বাইরে। ব্লাউয়ের্ত তাদের লাইন করে দাঁড় করাচ্ছে। লাইনের শুরুতে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ কোট পরা কালোচুলের এক মহিলা। আধময়লা পোশাক। হয়তো কোটের ভিতরে পোশাক ছিঁড়ে গেছে, তাই উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে একহাতে কোটটার সামনের দিক আঁকড়ে আছে আব্রুরক্ষা করবার জন্য। আরেক হাতে ধরে আছে বারো তের বছরের একটা মেয়ের হাত। এই দুজনের সঙ্গে কোনো মালপত্র নেই।

যে মানুষগুলো বেরিয়ে এসেছে, তাদের নাম ডাকার জন্য খোলা মাঠের মধ্যে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফিলসকাইট নিঃশব্দে তাদের গুণতে শুরু করল। নানা বয়সের, নানা চেহারার, নানা পোশাকের নারী, পুরুষ, শিশু মিলিয়ে মোট একষট্টি জন। সবাই বেরিয়ে আসেনি ওই ভ্যান থেকে। মনে হয় ছয় জন ভেতরেই মরে গিয়েছে। সবুজ ভ্যানটা ধীরে ধীরে গিয়ে শ্মশানের চুল্লিঘরের সামনে দাঁড়াল। ফিলসকাইট মাথা নাড়ল পরিতৃপ্তির সঙ্গে। সব কাজ ঘড়ির কাঁটার মত এগোচ্ছে। ছ’টা লাশ ভ্যান থেকে বের করে ব্যারাকের ভিতরে টেনে নিয়ে যাওয়া হল। ট্রাক থেকে বের করা সব মালপত্র গেটে প্রহরীদের কেবিনের সামনে স্তুপ করে রাখা আছে। সবুজ ট্রাকের পেছনে যে আরও দুটো ট্রাক দাঁড়িয়েছিল, সেগুলোর দরজা খোলা হল। মানুষ, মালপত্র সব নামানো হতে লাগল।

মাঠের মধ্যে পাঁচটা সারিতে মানুষগুলোকে দাঁড় করানো হতে লাগল। সবগুলো সারি ভরে উঠছে, লম্বা হচ্ছে ক্রমাগত। ফিলসকাইট সারিগুলো গুণতে লাগল এবার। ঊনত্রিশ জন করে আছে একেকটা সারিতে।

ব্লাউয়ের্ত হাতে একটা মেগাফোন নিয়ে বলে যাচ্ছে।

-‘সবাই শুনবেন। আপনারা এখন একটা ট্রানজিট ক্যাম্পে আছেন। খুব কম সময় আপনারা এখানে থাকবেন। এক একজন করে আপনাদের নাম ডাকা হবে, ফাইলে এন্ট্রি হবে। তারপর আপনারা ক্যাম্প কম্যান্ডান্টের কাছে যাবেন। আপনাদের পরীক্ষা করা হবে। তারপর আপনাদের সবাইকে স্নান করতে হবে। মাথায় নোংরা, উকুন এসব পরিষ্কার করা হবে। তারপর আপনাদের গরম কফি দেওয়া হবে। কেউ বাধা দেবার চেষ্টা করলে সঙ্গে সঙ্গে তাকে গুলি করা হবে।’ ব্লাউয়ের্ত ইশারায় নজরমিনারগুলির দিকে দেখায়, যেখান থেকে এই মাঠের দিকে মেশিনগান তাক করা আছে। এছাড়া তার নিজের পিছনেও পাঁচজন দাঁড়িয়ে আছে, সবার হাতেই মেশিনগান।

ফিলসকাইট অস্থিরভাবে জানালার সামনে থেকে সরে আসে। সে বেশ কিছু ব্লন্‌ড ইহুদীদের দেখতে পেয়েছে। হ্যাঁ, হাঙ্গেরিতে প্রচুর সোনালি চুলের ইহুদী আছে। কালো চুলের ইহুদীগুলো তবু একরকম, কিন্তু ব্লন্‌ড ইহুদিদের দু চোখে দেখতে পারেনা ফিলসকাইট। তাছাড়া একদম নর্ডিক জাতের মত আর্যসুলভ চেহারার ইহুদীদের নমুনাও সে কম দেখেনি। সে সবুজ কোট পরা সেই প্রথম মহিলাকে নাম নথিভুক্ত করবার পরে ব্যারাকে তার সামনে এসে দাঁড়াতে দেখল। সে তার হাতের কাছে পিস্তলটা সেফটি ক্যাচ খুলে গুছিয়ে রাখল। কয়েক মিনিটের মধ্যেই এই মহিলা তার সামনে গান গাইবে।

ইলোনা গত দশ ঘণ্টা ধরে ভয়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু ভয় তার ধারে কাছে ঘেঁষতে পারেনি। গত দশ ঘণ্টা ধরে অনেক কিছু দেখে যাচ্ছে সে, খিদে, তেষ্টা, বিরক্তি, আতঙ্ক, দমবন্ধ করা পরিস্থিতি ইত্যাদি। তারপর একটু আগে যখন সূর্যের আলো এসে চোখে ধাক্কা দিল, কয়েক মিনিট ধরে অদ্ভুত ভালো লাগা এসে তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল—কিন্তু ভয় আসেনি। সে একাই কি তবে ভয়ের জন্য বৃথা অপেক্ষা করছে?

গত দশ ঘণ্টা ধরে একটা ভীতিপ্রদ অবস্থার মধ্যে রয়েছে সে। বহুবার সে শুনেছে এরকম পরিস্থিতির কথা। সেই শোনা কথাগুলো আরও বেশি ভয়ঙ্কর ছিল। কিন্তু সে নিজে যখন এরকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে ঢুকে গিয়েছে, তার আর ততখানি ভয় করছে না। তার একটাই ইচ্ছে আছে এখন। যদি সে কিছুক্ষণের জন্য একা থাকতে পারে, তাহলে সে একটু প্রার্থনা করবে। এতদিন অবধি তার জীবন ঠিকঠাক চলেছে। পরিকল্পনা মাফিক চলেছে। কিছু পরিকল্পনা ভুল হয়ে গেলেও জীবনে তার খেদ ছিল না কোনো। তবে সে ভেবেছিল যে সে রেহাই পেয়ে যাবে। ধরা পড়ে যাবে, ভাবেনি। এখন ধরা যখন পড়েই গেছে, তাহলে… আর… আর বড়জোর আধঘণ্টার মধ্যেই সে মারা যাবে।
(চলবে)

0 comments: