undefined
undefined
undefined
গল্প - হিন্দোল ভট্টাচার্য
Posted in গল্প‘ কুটির’।
গোলাপী প্রাচীরের গায়ে বর্গাকার এক ফালি মার্বেলে লেখা ‘কুটির’। নীচে অমলেন্দু রায়, চিত্রা রায়, কৌশিক রায়, মেঘা রায় এবং সিমলি। মার্বেলটা একটু নোংরা হয়ে গেছে। মার্বেলের পাশেই লোহার গেট। খুললেই ক্যাঁচ করে আওয়াজ হয়। কেউ আসছে, তা বেশ ভাল করেই বোঝা যায়। আর তার পরেই শুরু হয় সিমলির ডাকাডাকি। মাত্র দুতলা এই বাড়িটার একতলায় থাকেন অমলেন্দু বাবু এবং চিত্রা , তাঁর স্ত্রী। দুজনেই ষাটোর্ধ্ব। আর দোতলায় থাকেন কৌশিক, তাঁর স্ত্রী মেঘা। সন্তান হয়নি। তাঁদের একটি ল্যাব্রাডর আছে। সদ্য তরুণী। নাম সিমলি। এমন বাড়ি তো কলকাতা শহরে অনেকই থাকে। বিশেষ করে এই প্রান্তিক স্টেশনের কাছের এলাকাগুলোয়। তাহলে, আর সে প্রসঙ্গে কথা বলা কেন? প্রথম কারণ এ অঞ্চলে এমন আর একটি মাত্র বাড়িই পড়ে আছে। বাকি সব আবাসন। নতুন নতুন আবাসন। এই গোলাপী বাড়িটার দিকে পাশের সব লম্বা লম্বা আবাসন জিরাফের মতো তাকিয়ে থাকে। মাঝেমাঝে বড়িটাকে প্রাগৈতিহাসিক প্রাণী বলেও মনে হয়। খোপ কাটা কাটা অট্টালিকা চারিদিকে। আর তার মাঝে একটা বামনের মতো দোতলা বাড়ি।
ব্যাপারটা এরকম নয়, যে আবাসনের প্রোমোটাররা আর এলাকার রাজনৈতিক মদতপুষ্ট গুন্ডারা বাড়িটা থেকে লোক তাড়িয়ে বাড়িটাকে ভেঙে আবাসন কমপ্লেক্স করে তুলতে চায়নি। মুশকিল অন্য। জানা গেছে এই বাড়ি যখন হয়নি, তখন এই জমির নীচে খুন করে গুম করে দেওয়া হয়েছিল কিছু নকশাল ছেলেকে। সে সব নিয়ে পরে কেউ তদন্ত না করলেও, এলাকায় চায়ের দোকান থেকে শুরু করে বাজারের আনাজ বিক্রি করে পাঁচু, সে পর্যন্ত বলে দেবে ‘কুটির’-এর কাহিনি। জমিটা গৃহপ্রবেশের উপযুক্তই নয়। অভিরাজ কনট্রাকটর একবার চেষ্টা যে করেনি জমিটা থেকে মিথ উড়িয়ে দেওয়ার, তা নয়। জমি যদি এত অশুভ, তাহলে অমলেন্দুবাবু কীভাবে থাকছেন, জমিতে একটা মন্দির করে দেওয়া হবে, যজ্ঞ কর হবে ইত্যাদি নানা কিছু ছিল তার ঝুলিতে।
কিন্তু মিথের শক্তি, কাহিনির শক্তি, যুক্তির থেকে বেশি। একবার লোকমুখে যদি মিথ ঘুরতে থাকে, তাহলে তা আগুনের চেয়েও বেশি দ্রুত ছড়ায়। মানুষের স্বপ্নের মধ্যে ঢুকে যায়। অবচেতনে ঢুকে যায়। যেমন, অমলেন্দুবাবুর বাড়ির সামনের চায়ের দোকানটার বাবিন। সে, এই চায়ের দোকানের মধ্যেই থাকে ছোট খুপড়িতে। একদিন সকালে তাকে পুকুরের ধারে বসে থাকতে দেখে, লোকজন ঘিরে ধরে। মাথার চুল উস্কোখুস্কো। সারারাত ঘুম হয়নি এমন চোখ মুখ। অনেক প্রশ্ন করার পর, হাউহাউ করে কেঁদে উঠল বাবিন। ‘আমাকে অন্য একটা জায়গা দাও, আমি এখানে দোকান করব না’ বলে কাঁদতে থাকে। তার পর জানা যায়, রাতে খুটখুট শব্দ শুনে তার ঘুম ভেঙে যায়। ঘর থেকে দেখে চায়ের দোকানে চারজন দাড়িওলা ফিসফিস করে কীসব বলছে। ‘চোর চোর ‘ বলতে বলতে দোকানে ঢুকতেই চোখের সামনে সেই চারজন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। বাবিনের চায়ের দোকান আর শেষ পর্যন্ত অমলেন্দুবাবুর বাড়ির সামনে যে থাকে না, তার কারণ এই চারজন ভূত। বাবিনের পর, আরও অনেকেই এই চার ভূতের দেখা পায়, কখনও পাড়ার ক্লাবঘরের সামনে, এলাকার থানার উল্টোদিকে আবার অমলেন্দুবাবুর ছাদে। কিন্তু সুখের কথা হল এই যে, অমলেন্দুবাবু আর তার পরিবার, মায় কুকুরটা পর্যন্ত এই চারজনের অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারে না। অবশ্য এই চারজনের ভূতের গল্পের প্রতি তাঁরা উপকৃতই ছিলেন। কারণ এই গল্পটা ক্রমশ প্রায় গোটা শহরতলিতেই ছড়িয়ে যায়। তার পর পুলিশ সূত্রে কারা জেন জানতে পারে, চারজন নকশাল খুনের ঘটনা। একদিন দুপুরে এপিডিআর-এর লোকজন পর্যন্ত আসে আর তার কদিন পর অমলেন্দু বাবুর বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে একটি শহিদবেদী তৈরি হয়। তাতে লেখা থাকে ‘চারজন অপরিচিত যুবক, যারা স্বপ্ন দেখেছিল এক অন্য পৃথিবীর’। সাধারণত এইসব শহিদ বেদীর গায়ে লোকে বসে আড্ডা মারে। কিন্তু, সামনেই অমলেন্দু বাবুর বাড়ি এবং জমি ও জমির নীচে চারজনের কঙ্কালের কথা মনে রেখে আর কেউ সেই ঝুঁকি নিতে সাহস করে না।
প্রাক্তন অধ্যাপক অমলেন্দুবাবু মনে মনে নকশাল হলেও, সপ্তপদী দেখতে ভালবাসেন। রক্ত খুন হত্যা এসব সহ্য করতে পারেন না। মাংস খাওয়াও ছেড়ে দিয়েছেন। কৃষ্ণ তাঁর আরাধ্য দেবতা। বলতে গেলে, মনে মনে বেশ ভক্ত এই মানুষটি ছিলেন বাংলার অধ্যাপক। স্ত্রীও ছিলেন শিক্ষিকা। ছেলে ও ছেলের বউ তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী। এই বাড়িটা নিয়ে তাঁদের নিজেদের মধ্যেও যে খুব শান্তির পরিস্থিতি তাও নয়। কারণ ছেলে ও ছেলের বউ চায় আধুনিক এক ঝাঁ-চকচকে ফ্ল্যাট। প্রোমোটারদের থেকে লোভনীয় প্রস্তাবে সাড়া দিতে অন্তত তাদের কোনও সমস্যা নেই। অমলেন্দুবাবুর স্ত্রীরও নেই। শুধু অমলেন্দুবাবু এই বাড়ি ছাড়তে চান না, কারণ আর কিছুই না,বাড়িটাকে তিনি ভালবাসেন। তাঁর মনে হয়, বাড়িটা জীবিত। বাড়িটা কথা বলে, তারও দুঃখ আছে,আনন্দ আছে, সেও চোখের জল ফেলে, এমনকি স্বপ্নও দেখে। এ হেন অবামপন্থী অনুভূতিমালায় বিরক্ত হয় সকলেই। এমনকি দুবেলা ঠাকুরপুজো করা স্ত্রী চিত্রাও বলে, অমলেন্দুবাবুর মাথাটা নিশ্চয় খারাপ হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে যখন প্রোমোটারদের দৌরাত্ম্য কমতে শুরু করল, তখন সবাই একটু বেশ অবাক হলেও, খুব একটা আশ্চর্য হয়নি, কারণ ততদিনে ভূতের গল্পটা তাঁরাও শুনে ফেলেছিলেন। তাঁরাও শুনেছিলেন এ বাড়ির নীচে জমিতে পোঁতা আছে চারজন যুবকের লাশ। এও শুনেছিলেন, এ বাড়ি যে জমিতে, সেখানেই তাদের খুন করা হয়েছিল।
কিন্তু তাঁরা খুব একটা ভয় পাননি। আর গল্পটাও শুরু হয়েছিল এর পর থেকেই।
২
কলিংবেল শুনেই সিমলি নীচে নেমে যায় আর প্রবল চিৎকার শুরু করে। ওকে চেন দিয়ে আটকে মেঘা দরজা খুলে দ্যাখে বেশ লম্বা একজন দাঁড়িয়ে। দাড়ি গোঁফ হীন। কেভিন স্প্যাসির মতো দেখতে অনেকটা।
আমি সুশান্ত রায়, লালবাজার। গোয়েন্দা বিভাগ।
ডিটেকটিভ?
হ্যাঁ। একটু কথা বলতে চাই।
মেঘা একটু দেখতে চাইছিল আর কেউ এসেছেন কিনা, কিন্তু তা দেখে সুশান্ত বললেন, “ আর কেউ আসেনি। আমিই এসেছি।‘
-হ্যাঁ আসুন, আসুন।
গরগর করতে থাকে সিমলি।
ড্রইংরুমে নিয়ে আসে মেঘা।
-একটু বসুন। আমি বাড়ির লোকেদের ডাকছি।
-হ্যাঁ।
ভদ্রলোক দাঁড়িয়েই থাকেন। ঘরটা ভাল করে দেখতে থাকেন।
মেঘা উপর উঠে সব বলার পর, কৌশিক জিজ্ঞেস করে, সানগ্লাস পরেনি?
-না।
মেঘা দ্রুত নীচে নেমে যায়।
সকলে নীচে আসা ও আলাপের পর চা সহযোগে ভদ্রলোক কথা শুরু করেন
‘ আসলে আমি এসেছি একটা রিউমার শুনে। তা হল, আপনাদের জমির নীচে নাকি পোঁতা আছে চারজন নকশালের লাশ। এটা সত্যি?’
‘ তা তো বলতে পারব না’, বলল কৌশিক।
‘ মানুষ কত গল্পই না বানায়’, বললেন অমলেন্দু।
‘ তাহলে গল্পটা মিথ্যে?’ জিজ্ঞেস করলেন সুশান্ত।
‘ জানি না’ বললেন অমলেন্দু।
‘ দেখুন, ( একটু থেমে আবার শুরু করলেন সুশান্ত), গল্পটা মিথ্যে, এ কথা প্রচার করলে, কালকেই প্রোমোটাররা আপনাদের বাড়িতে হানা দেবে। আর যদি বলি, গল্পটা সত্যি, তাহলে ইনভেস্টিগেশন হবে। খোঁড়াখুঁড়ি হবে। তো, আপনাদের একটু ভোগান্তি আছে। কিন্তু কোনটা চান? প্রোমোটার আসুক, না পুলিশ?’
‘ আপনারা একটা ভূতের গল্পে বিশ্বাস করে পুলিশ নিয়ে আসবেন তদন্তে?’
‘ দেখুন এই ভূত যদি জমিদারবাড়ির হত, বা এলাকার মস্তানের বা রাজনৈতিক নেতার বা আগুনে পুড়ে যাওয়া তরুণীর, তাহলে আসতাম না। কিন্তু এই ভূত চারজন নকশালের। যারা চায়ের দোকানে ফিসফিস করে ষড়যন্ত্র করছে, আবার তাদের কেউ দেখলেই মিলিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগে তো থানার সামনেও তাদের দেখা গেছে রাত নটার পর। থানায় ঢুকেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। তার মানে ভয়ের।‘
‘ আপনাদের আবার কীসের ভয়ের?
‘ নকশাল যদি ভূত হয়েও যায়, তাহলেও তারা রাষ্ট্রের পক্ষে বিপদজনক’।
‘ আপনারা তাহলে এখন ভূত ধরবেন?’ বলল কৌশিক।
‘ হ্যাঁ, নকশালগুলোকে ধরতেই হবে। কোনও না কোনও সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটিয়ে দেওয়ার আগেই।‘
‘ এখন তো ওরা মরে গেছে, এখন ওরা করবেটা কী?’
‘ আরে, এখনই তো অনেক বেশি ড্যামেজ করতে পারে। নকশাল বলে কথা। ওই বুড়ো মানবাধিকার কর্মীকে কী করলাম দেখেছেন? লোকটা রাইস টিউব ছাড়া খেতেও পারত না, মোটা পাওয়ারের চশমা ছাড়া দেখতেও পারত না। কিন্তু আমরা ওকে ছাড়িনি। খেতেও দিইনি, দেখতেও দিইনি। মরে গেছে। বেঁচে থাকলেই ড্যামেজ করত’।
ওহ উনি! বয়স তো ৮৭। কীই বা করতেন!’
আমি জানি, আপনি একটু নকশাল মাইন্ডেড। আরবান নকশাল, তাই না অমলেন্দুবাবু?’
অমলেন্দুবাবু চুপ করেই থাকলেন।
জানি, জানি। এসব দিকে যাবেন না। ধর্ম টর্ম নিয়েই থাকুন না। অত বন্দুকের দিকে যাবেন কেন? বাগান করুন। ঘর গোছান। অধ্যাপক মানুষ। বয়স তো হল।‘
‘সে তো বুঝলাম, কিন্তু আপনারা কি মেঝে খুঁড়ে...
‘ না, বাড়িটা ভাঙতে হবে।
‘ কী? বাড়ি ভাঙলে আমরা যাব কোথায়?
‘আরে বুঝতে পারছেন না, আপনাদের বাড়িতে চারজন নকশাল ভূত বাস করে। এ বাড়ি কি রাখা যায়?’
‘তাহলে আমরা যাব কোথায়’?
‘ কেন? আমরা আপনাদের সবচেয়ে ভাল হাউসিং কমপ্লেক্সের সবচেয়ে সেরা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সেখানে শিফট করে যান আর এ বাড়ি ভুলে যান। আমরা জমির দামও দিয়ে দেব আপনাদের। বাড়ির দামও। কিন্তু বাড়ি ভাঙব আমরা। জমিও খুঁড়ব। চারজন নকশাল ভূত! ভাবতে পারছেন? ঘিরে ফেলতে হবে স্নাইপার দিয়ে।‘
‘ কিন্তু স্নাইপার কি ভূত মারতে পারে?’
‘ না, কিন্তু সকলে দেখবে আমাদের স্নাইপাররা ঘিরে ধরেছে আপনাদের বাড়িকে। মানে ভূতেদের। নকশালদের। এতে, মানুষের মন থেকে তাদের প্রতি ভয় মুছে যাবে’।
‘ ভয়টা কাকে? ভূতকে না নকশালকে?’ বলল কৌশিক।
সুশান্ত একটু চুপ করে রইলেন। তার পর সোফায় বসে পা-টা তুলে দিলেন আরেক পায়ে।
মুচকি হেসে বললেন, ‘ দেখুন, ভাইরাসকে যেমন ভয় পেতে হবে, তেমন ভয় পেতে হবে ভাইরাসের হোস্টকেও। কিন্তু এখানে, নকশাল হল ভাইরাস। আর হোস্ট হল ভূত। ভয় তো ভাইরাসকে নিয়েই বেশি। তাই না?’৪
‘ তাহলে মোদ্দা কথা হচ্ছে’, কথার মধ্যে ঢুকে পড়ল কৌশিক, ‘ আমাদের বাড়ি ভাঙা হবে। কিন্তু কোর্ট অর্ডার আছে কি?’
‘ দেখুন, কোর্ট অর্ডার পেতে হলে আগে আমাদের কেস করতে হবে আপনাদের বিরুদ্ধে। সন্ত্রাসবাদীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য। তখন কেসটা জটিল হয়ে যাবে। রাষ্ট্রদ্রোহীতার কেস। চারজনেই বিপদে পড়বেন ভূতেদের জন্য। তার চেয়ে ফ্ল্যাট দিচ্ছি, রেসপেক্ট দিচ্ছি,প্যাকিং শিফটিং সব আমরাই করে দেব। এটা যুদ্ধক্ষেত্র। এই জমিটা, যার উপরে আপনাদের বাড়ি। এটা মনে রাখুন।‘
উঠে পড়লেন সুশান্ত। ‘ আজ যাচ্ছি। কাল আসব আবার। কী করবেন ঠিক করুন। কিন্তু আমাদের এই বাড়িটা মানে এই জমিটা চাই। জমির নীচে হাড়গোড় যা আছে, সব চাই।‘
সুশান্ত চলে যাওয়ার পরে একমাত্র সিমলি ছাড়া কেউই ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। বাইরে বেশ কড়া রোদ উঠেছে।এই অদ্ভুত পরিস্থিতিতে কেউ খুশি হয়ে উঠবে না দুঃখ পাবে , তার চেয়েও বড় কথা ছিল, ভূতের পেছনে একটা দেশের গোয়েন্দারা ছুটছে তার কারণ কয়েকজন ভূতকে তারা ভয় পাচ্ছে।
এই কথাটা মনের মধ্যে এমন ভাবে চেপে বসল, যে, আস্তে আস্তে অমলেন্দু ও বাকি তিনজনের মধ্যেও ভূতের ভয় দানা বাঁধতে শুরু করল। সে আরেক গপ্পো। সাসপেন্স এবং থ্রিলার।
শুধু এটুকু বলা যায়, সিমলি মাঝেমাঝেই আকাশের দিকে চেয়ে কাঁদছিল এবং চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। কৌশিকরা সিমলিকে অনুসরণ করেও কাউকেই খুঁজে পাচ্ছিল না। তবে কি ওই চার জনই ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের চারপাশে?
‘ আমরা কি সুশান্তবাবুর কথা মতো বাড়িটা ছেড়ে চলে যেতে পারি না?’ জিজ্ঞেস করল মেঘা।
‘বাবাকে বলেছি। মাও বারবার বলছে চলে যাবে। ওরা যা খুশি করুক। রকেট লঞ্চার ছাড়ুক। ট্যাঙ্ক নিয়ে আসুক। মেশিনগান চালাক। পরমাণু বোমা ফেলুক। আমাদের কী? আমরা তো ঝকঝকে একটা ফ্ল্যাট পাচ্ছি। টাকাও পাচ্ছি। আর এই রোজকার টেনশনের হাত থেকে মুক্তিও বটে। দুনিয়াটা বদলে গেছে। আর ওই বিপ্লবের রাস্তায় কেউ হাঁটছে না।‘
‘বাবা কী বলছে?’
‘ বাবা বলছে বাড়িটা আমাদের শেল্টার।‘
‘আরে শেল্টার তো পাচ্ছি’।
বাবা মানতে চাইছে না। বলছে শেল্টারের নাম করে আমাদের জেলে পাঠান হচ্ছে।
‘আমাদের কি কেউ গ্রেফতার করছে নাকি? তুমি অফিস যাচ্ছ, আমি অফিস যাচ্ছি। বাবা যেখানে খুশি যাচ্ছে। মাও। আমাদের বাড়িতে যে খুশি আসতে পারে। আমরা যেখানে খুশি যেতে পারি। আমরা কোথায় বন্দি?’
কৌশিক এ কথার উত্তর না দিয়ে বাইরের বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে দিল।
৩
‘ তাহলে তোমরা কি ঠিক করছ?’ অমলেন্দু বললেন সন্ধ্যাবেলায় ড্রয়িংরুমে চা খেতে খেতে।
‘ আমরা চাই চলে যেতে। ওরা ভাল প্যাকেজ দেবে। সবার ভালই হবে।‘ কৌশিক বলল।
‘ হ্যাঁ হ্যাঁ, এত ঝামেলা...’ বিরক্তি লুকোতে পারলেন না চিত্রা।
‘ হুম।‘ বললেন অমলেন্দু।
‘ ঠিক আছে, তাই জানিয়ে দাও। তবে...’
‘তবে কি?’ চিত্রা একটু রাগত স্বরেই জিজ্ঞেস করলেন।
‘ আমি যাব না’।
‘এই কথাটার মানে কী? ‘ চিত্রা বেশ উত্তেজিত,’ চিন্টু, তোর বাবাকে বোঝা, এই বয়সে এসে আর এত জেদ ভাল না’।
‘ আমার কোন বয়সে ছিল বলতে পার? কোনও বয়সেই তো আমার জেদ বজায় রাখিনি। তোমরা যা চেয়েছ, তা-ই হয়েছে। সেই তরুণ বয়সে, যখন সত্যিই আমিও নেমেছিলাম একটা কিছু পাল্টাব ভেবে, সরে এসেছিলাম তো। কবিতা লেখাও ছেড়ে দিয়েছিলাম। চাকরি করেছি। পড়িয়েছি। টাকা জমিয়েছি। টিপিকাল মধ্যবিত্ত বাবাদের মতো। আজ কি আমি একটু ওদের পাশে থাকতে পারি না?’
‘ ওদের পাশে মানে?’ অবাক মেঘা।
‘তুমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছ? ভূত ওরা। ভূত। আদৌ আছে কিনা আমরা জানি না। ছায়া ধরার মতো করে দেশের গোয়েন্দাবাহিনী শুনেছে নকশাল, চলে আসছে। কাকে ধরবে জানে না। ওদের হাতে পাওয়ার আছে, উইপন আছে, প্ল্যানিং আছে, আইন আছে, অর্ডার আছে। গোটা মেশিনারি। আর তুমি যাদের বাঁচাতে চাইছ, তাদের শরীরটা পর্যন্ত নেই।‘ উত্তেজিত অবস্থায় বলল কৌশিক।
‘হ্যাঁ, তো?’ বললেন অমলেন্দু।
‘ হ্যাঁ, মানে, একদিকে গোটা রাষ্ট্র, আর অন্যদিকে একটা কনসেপ্ট। ভূত তো একটা কনসেপ্ট। বিপ্লবের মতোই একটা কনসেপ্ট। তার মাঝে তুমি। একা। কী করবে?’
‘আমি শেল্টার দেব’। অমলেন্দু বললেন।
৪
সুশান্ত শুনেই ব্যবস্থা করে দিলেন শিফটিং-এর। তার বিশদে না গিয়েও বলা যায়, রাষ্ট্র যতটা সুষ্ঠুভাবে কাজটা করল, তাতে কৌশিক মেঘা আর চিত্রা বেশ তৃপ্ত। ইংরিজিতে যাকে বলে স্যাটিসফ্যায়েড। কিন্তু অমলেন্দুকে নড়ান গেল না। সুশান্ত শুধু বললেন, ‘আপনারা যান। আমরা দেখছি। অমলেন্দুবাবুর কোনও ক্ষতি হবে না। তেমন কথাই বলে রেখেছি। আমরা ঠিক সময়মতো তাঁকে আপনাদের বাড়ি নিয়ে আসব।‘
ফাঁকা বাড়ির মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর মানুষেরা জানে, অনেকসময়, নিজেকেই ঘরের মধ্যে অন্য একটা মানুষ বলে মনে হয়।নিজের পায়ের শব্দে চমক লাগে। নিজেরই ফিসফিস করে বলা বা বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো মনে হয় অন্য কারোর কণ্ঠস্বর। অমলেন্দুবাবু যখন দেখলেন, তাঁকে ছাড়াই সব জিনিসপত্র নিয়ে চলে গেল চিত্রা, কৌশিক ও মেঘা, তখন তাঁর মনে একটা আদিম আনন্দও যে জেগে উঠল না তা নয়। আবার অনেকদিন পর মায়ের কথা মনে হল অমলেন্দুর। যার মা নেই, তার কেউ নেই। গলার কাছে কী এক কষ্ট জেন দলা পাকিয়ে আছে। মায়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে অমলেন্দুর। এই শূন্য ফাঁকা ঘরে কিছু বাসনপত্র আর গ্যাস ছাড়া কিছু নেই। চাল, আলু আর ডিম রয়েছে। সামান্য একটু চা। আর তাঁর ওষুধ। খুব একটা কিছু তো তাঁর এমনিতেও প্রয়োজন ছিল না জীবনে। মানুষ এক এক করে প্রয়োজন বাড়ায়। অন্যের প্রয়োজন তাঁর নিজের জীবনের প্রয়োজনও হয়ে ওঠে। আস্তে আস্তে ঘর ছেড়ে বাড়ির বাইরে পা রাখলেন অমলেন্দু। জমিতে করা ছোট্ট বাগানটা আজ বেশ খুশি মনে হচ্ছে। বেশ কয়েকটি গাছে ফুল ধরেছে। চন্দ্রমল্লিকা, বেল, জবা। রোদ পড়েছে ফুলগাছগুলোর উপর। ওই তো লংকাগাছে নতুন কয়েকটি লংকাও ধরেছে। এই জমি তো অনুর্বর হতে পারে না। কারণ এই জমির নীচে পোঁতা আছে চারজন নকশালের লাশ। বাগানের একটা চেয়ারে বসে সিগারেট ধরালেন অমলেন্দুবাবু। মাটির দিকে তাকালেন। ফুলগাছগুলির দিকে তাকালেন। রাষ্ট্র কি তবে ফুলগাছগুলিকেও ভয় পাবে? কারণ এই ফুলগাছগুলির ভিতরে তো বয়ে যাচ্ছে সেই সব পুঁতে দেওয়া মানুষের জীবনরস, দেহরস। পৃথিবীতে কোনও কিছুই তো আর সম্পূর্ণ ভাবে লুপ্ত হয়ে যায় না। আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে। শরীরের প্রতিটি কোষ, এই মাটি জল হাওয়ায় ঘোরে। রূপ বদলায়। কিন্তু মন বদলায় কি? প্রতিটি জমির নীচে কারোর না কারো ইতিহাস পোঁতা আছে। আর ইতিহাস মানেই তা সুখের নয়। ইতিহাস মানেই তার হাজারো কাহিনি। কাহিনির মধ্যে থেকে কোন কাহিনিকে ধরবে ইতিহাস হিসেবে , তা নির্ভর করছে তুমি কি ধরতে চাও তার উপর।
অমলেন্দুবাবু যখন এই সব ভাবছেন তখন লাউডস্পিকারে শোনা যাচ্ছে সুশান্তর গলা—“ অমলেন্দুবাবু, আমরা জানি আপনি চারজন অত্যন্ত বিপজ্জনক ভূতকে আশ্রয় দিয়েছেন। এমনি ভূত হলে, আমরা আসতাম না। কিন্তু এই চার ভূত নকশাল। এরা ক্ষতি করতে চায়। তাই আমরা চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরেছি আপনাদের বাড়ি। আপনি এই চারজনকে বাঁচাতে পারবেন না। তাই বেরিয়ে আসুন। আমরা আপনার বাড়ি, জমি , ঘিরে রাখব। ঠিক দশ গুনব, তার মধ্যে বেরিয়ে আসুন। আপনাকে নিরাপদে আপনার পরিবারের কাছে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের।‘
অমলেন্দুবাবু চেয়ার ছেড়ে উঠলেন না।
ওদিকে সুশান্ত কাউন্টডাউন শুরু করেছেন দশ নয় আট সাত...
অমলেন্দুবাবুর মাথায় তখন ভিড় করে আসছে মায়ের মুখ, প্রশান্তর মুখ, যাকে বরানগর থেকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ, ভিড় করে আসছে ডলি চ্যাটার্জি, যাকে একটা সময় ভালবাসত তরুণ অমলেন্দু। সেদিন রাতে যুক্তফ্রন্টের পুলিশ কাউকেই ছাড়েনি। রাষ্ট্র কাউকেই ছাড়ে না, সে রাষ্ট্র যার শাসনেই চলুক না কেন। ওদিকে ছয় পাঁচ চার শুনতে শুনতেই অমলেন্দু উঠে পঞ্চমুখী জবার ফুলটা হাতে নিয়ে তাকালেন তার দিকে। কী অদ্ভুত ফুল! এমন সুন্দর ভাবে ফুটে আছে, যেন কতকাল দেখা হয়নি। এক কিশোরীর স্বপ্ন দেখা মুখের মতো সুন্দর। তার দিকেই তাকিয়ে রয়েছে অমলেন্দু। এই ফুলে কি মায়ের মুখ থাকতে পারে? থাকতে পারে ডলির মুখ?
তিন দুই এক...
কাউন্টডাউন তো একদিন শেষ হবেই। অমলেন্দুবাবুর প্রচণ্ড হাসি পেল। এমন এক হাসি, যা তিনি কোনওদিন হাসতে পারেননি।
অমলেন্দুবাবুকে ধরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর বাহ্যজ্ঞান ছিল না বললেই চলে। একদিকে যখন বুলডোজার এসে ভাঙছে তাঁর বাড়ি, ঘিরে ধরেছে মেশিনগান ধারী সিআরপিএফ, অন্যদিকে প্রিজন ভ্যানের মধ্যে হাসিতে লুটিয়ে পড়ছেন অমলেন্দুবাবু।
এই হাসি নাকি তার পরেও থামেনি। লোকে বলে ভূতে ধরেছে। কেউ বলে, বুড়ো বয়সে নাকি লোকটা নকশাল হয়ে গেছে। আসল সত্য কেউই জানে না।
0 comments: