Next
Previous
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in



















তৃতীয় পর্ব

হিন্দোশিয়া থেকে ফিরে এসে পানু রায় ভাবছিলেন কী করে একটু অর্থপূর্ণ ভাবে সময় কাটানো যায়। সহজাত বুদ্ধির সদ্ব্যবহার করে যদি কিছু মানুষের উপকার করা যায় আর সঙ্গে সঙ্গে কিছু রোজগার হয় তাহলে মন্দ কী? তাছাড়া দেশে বিদেশে মানুষকে চেনা এবং বোঝার অর্জিত অভিজ্ঞতাও তো কম নয়। সুন্দরী আর জগাই এর কোনও কাজ নেই। ওরা দু’জনেই সৎ, পরিশ্রমী এবং বুদ্ধিমান। ওদেরও কাজে লাগানো যেতে পারে এই নতুন উদ্যোগে। ওনার নিজের জন্যও যেমন সুন্দরী এবং জগাই এর জন্যও তেমন শারীরিক এবং মানসিক পরিশ্রমের খুবই প্রয়োজন। আর বেশিদিন কেবল খেয়ে আর ঘুমিয়ে কাটালে শরীর এবং মাথা দু’টোই ভোঁতা হয়ে যাবে। তাই কাউকে কিছু বলার আগে একদিন সুন্দরী আর জগাইকে ডেকে নিজের পরিকল্পনার কথা জানালেন পানু রায়। জানালেন যে উনি একটি উপদেষ্টা সংস্থা চালু করতে চান। এই সংস্থার মূল কাজ হবে বিপন্ন মানুষদের সাহায্য করা বা সঠিক পরামর্শ দেওয়া এবং অবশ্যই অর্থের বিনিময়ে। মূল পরামর্শদাতার কাজ করবেন তিনি নিজে এবং তাকে সহযোগিতা করবে সুন্দরী এবং জগাই। অফিসের ভিতরের কাজ করবে সুন্দরী এবং বাইরের কাজ করবে জগাই। তবে প্রয়োজনে বা ক্ষেত্রবিশেষে এর ব্যতিক্রম হতে পারে। অর্জিত অর্থ পূর্বনির্দিষ্ট অনুপাতে তিনজনের মধ্যে ভাগ হবে। সব শুনে জগাই বলল,’ দাদু, অত হিসেব নিকেশ আমাদের বোঝবার দরকার নেই। তুমি যখন যা বলবে আমরা তখন তা করবো। আমাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে নিও আর ভুলভ্রান্তি হলে ক্ষমা করে দিও। তবে চেষ্টার ত্রুটি হবে না সে তুমি খুব ভালোভাবেই জানো। তোমার সঙ্গে টাকার কোনও হিসেব করতে পারব না। সব তুমি রেখ। দরকার হলে চেয়ে নেব। তুমি আমাদের বাবা, মা, দাদু সবকিছু। পানু রায় বললেন,’ তোদের কথা মানছি। তোরা ছাড়া আমার আর কে আছে? তবে ব্যবসার একটা নিয়ম থাকা দরকার। সেই নিয়মেই ব্যবসা চলা উচিৎ। না হলে, ব্যবসা টিকে থাকবে না।‘জগাই আর সুন্দরী চুপ করে রইল।

পরেরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর সকলকে ডেকে নিজের পরিকল্পনার কথা জানালেন পানু রায়। সবাই মহা উৎসাহে হৈ হৈ করে উঠল। পচা, কেস্ট, মাধাই সবাই বলে উঠলো,’ দাদু, আমরাও আছি তোমাদের সঙ্গে। দরকার পড়লে শুধু একবার ডেকো।‘ মাধাই বলল,’ দাদু, তোমাকে একটা জরুরি খবর দিই।‘ পানু রায় বললেন,’ কী খবর?’ সকলে উৎসুক হয়ে মাধাই এর দিকে তাকিয়ে রইল। মাধাই বলল,’ কেলো দারোগার পদন্নোতি হয়ে বারৌনিতে পুলিশ প্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছে গত সপ্তাহে। আজই পেলাম খবরটা।‘ খবরটা শুনে চুপ করে রইল সবাই। শুধু পচা চিৎকার করে উঠলো ,’ দাদু, খেলা জমে যাবে।‘ ঘরভর্তি সবাই হেসে উঠলো হো হো করে।

দেখতে দেখতে নতুন সংস্থার কাজকর্ম শুরু হয়ে প্রায় দেড় বছর কেটে গেল। বেশ কয়েকটা ছোট ছোট সমস্যার দ্রুত সমাধান করে দিলেন পানু রায়। অবশ্যই সুন্দরী এবং জগাই এর সহযোগিতা ছাড়া যে এই কাজগুলো করা যেত না সেকথা বারবার বলেন পানু রায়। ঘটনাচক্রে বেশ কয়েকবার কেলো দারোগার মুখোমুখিও হতে হয়েছে। হেনস্তার একশেষ হয় লোকটা প্রতিবার। মুখে কিছু না বললেও পানু রায়ের ওপর বেশ চটে থাকে সবসময়। কথাবার্তায় আভাসে ইঙ্গিতে বুঝিয়েও দেয়। সুযোগ পেলে সুদে আসলে তুলে নেবার অপেক্ষায় থাকে সবসময়।

সেদিন সকালে অফিসে একটা মোটা আইনের বইয়ে ডুবে ছিলেন পানু রায়।খেয়াল করেননি অনেকক্ষণ ধরে দরজার সামনে অপেক্ষা করছে সুন্দরী। সুন্দরীও ইচ্ছে করেই পানু রায়ের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে চায়নি। বেশ কিছুক্ষণ পরে বই থেকে মুখ তুলে সামনে সুন্দরীকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,’ সুন্দরী, কিছু বলবে?’ সুন্দরী বলল,’ একজন অবিবাহিতা মহিলা যিনি একজন অবিবাহিত পুরুষের সঙ্গে বসবাস করেন তার আইনগত অবস্থান কী?’ পানু রায় ভুরু কুঁচকে বললেন,’ আইনগত কোনও বিশেষ অবস্থান নেই। কিন্তু হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞাসা করছো কেন?’

-কারণ জনৈকা রেবা কৈরালা বাইরে অপেক্ষা করছেন এবং বলছেন তিনি নাকি কৃষ্ণকালীর সঙ্গে থাকেন।

-কৃষ্ণকালী চৌধুরী –মানে যাঁর সম্পত্তির আইনি সমস্যাটা আমরা কিছুদিন আগে মেটালাম? কিন্তু কৃষ্ণকালী অবিবাহিত বলছ কেন?

- আরে না না, ওনার কথা বলছি না। আমি ওনার ছেলের কথা বলছি।

-তাই বলো। আমি ভাবলাম তোমার হঠাৎ মাথার গোলমাল হল নাকি?

-না, মাথা ঠিক আছে। কিন্তু ঐ বাবা আর ছেলের নাম আমি কিছুতেই মনে রাখতে পারিনা। সবসময়ে কেমন যেন গুলিয়ে যায়।

-শোন বাবার নাম কৃষ্ণকালী আর ছেলের নাম কালীকৃষ্ণ। গুলিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কৃষ্ণকালী মানে বাবা বিবাহিত এ নিয়ে কোনও সংশয় তোমার নেই নিশ্চয়ই। ছেলে কালীকৃষ্ণ অবিবাহিত। বাবা ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ের সন্ধান করছিলেন বলেই শুনেছি। এখন তো দেখছি গল্প অন্য। যাই হোক তোমার যদি নাম মনে রাখতে অসুবিধে হয় তাহলে বাবাকে বড়কালী আর ছেলেকে ছোটকালী বলে আপাতত চালাও।

-সেটাই সুবিধেজনক হবে। ঠিক আছে।

- সুন্দরী, আমার যতদূর মনে আছে ছোটকালী পুরনো গাড়ির ব্যবসা করে। মাধাই এর সঙ্গে যোগাযোগ আছে বলে জানি। কিন্তু রেবা কৈরালার কী সমস্যা?

-সমস্যাটা রেবা কৈরালার ব্যক্তিগত। ওনার মনে হয় ছোটকালীর সঙ্গে ওনার সম্পর্কের ব্যাপারটা বললে তুমি ওর সমস্যাটা শুনতে আগ্রহী হবে।

-বুঝলাম, কিন্তু সমস্যাটা কী?

-রেবা কৈরালার কাঠমান্ডুতে একটা ক্যাসিনো আছে। আমার মনে হয় সমস্যাটা ক্যাসিনো সংক্রান্ত।

-সুন্দরী, ছাব্বিশের ওপর এক হাজার টাকা বাজি ধর।

হিন্দোশিয়ায় ঘন্টার পর ঘন্টা ক্যাসিনোতে কাটিয়েছে ওরা সবাই। সুন্দরী অদৃশ্য সংখ্যাচাকা ঘুরিয়ে একেবারে ধারে অদৃশ্য রৌপ্যগোলক ছেড়ে দিল। পানু রায় এবং সুন্দরী দু’জনেই ঠিক যেমন সত্যিকারের খেলার সময় সবাই চাকার দিকে তাকিয়ে থাকে তেমনি তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। দেখলে মনে হবে সত্যিই যেন খেলছে ওরা। স্তব্ধতা ভেঙে সুন্দরী বলে উঠল,’ দুঃখিত,দাদু। তিন এ থেমেছে চাকা।‘ পানু রায় হেসে বললেন,’ হতভাগ্য আমি পরাজিতের দলে।‘

-আর রেবা কৈরালা?

- চল, বড়কালীকে ফোন করে জানা যাক এই মহিলার আসল পরিচয়। তার আগে বল মহিলার বয়স কত?

-তেইশ-চব্বিশ হবে?

-ফর্সা না শ্যামবর্ণ?

-ফর্সা

-শঙ্খিনী না পদ্মিনী?

-শঙ্খিনী।

-কটিদেশ?

-ক্ষীণ।

-মুখমন্ডল?

-সত্যিই সুন্দরী! দাদু, তুমি পারোও বটে।

-সুন্দরী, জলে নামার আগে বড়কালীকে স্মরণ করা যাক।

-হ্যালো, কৃষ্ণকালী চৌধুরী আছেন? ওনাকে বলুন আমি সুন্দরী, পানু রায়ের অফিস থেকে বলছি। উনি আমাকে চেনেন। হ্যাঁ,সুন্দরী, পানু রায়ের অফিস থেকে।একটু তাড়াতাড়ি করবেন প্লিস। খুব জরুরি দরকার।

সুন্দরী কিছুক্ষণ ধরে রইল। ইশারায় পানু রায়কে বোঝাল ওদিকে কোনও আওয়াজ নেই। কিছুক্ষণ পরে- কী বললেন, দেশের বাইরে? কোথায় গেছেন? কোন নাম্বারে ওনাকে পাওয়া যেতে পারে?

আবার একটু থেমে- ও আচ্ছা, তাহলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ হলে দয়া করে বলবেন আমাকে ফোন করার জন্য। আমার নাম্বার উনি জানেন। খুব দরকার। অবশ্যই বলবেন প্লিস। অনেক ধন্যবাদ।

ফোন রেখে সুন্দরী বলল,’ এলিনা, বড়কালীর সেক্রেটারি। বড়কালী দেশের বাইরে এবং তার ফোন নাম্বার কাউকে দিতে নিষেধ করেছেন বড়কালী।‘

পানু রায় অবাক হয়ে বললেন,’ এলিনা? মনীষার কী হল? ওহো, মনীষার তো বিয়ে হয়ে গেছে।‘

সুন্দরী বলল,’ অনেকদিন আগে। বছরখানেক তো হবেই।‘

-বল কী? এক বছর হয়ে গেল?

-একটা কফি মেসিন আর একটা ইনডাকশন হিটার দেওয়া হয়েছিল। বিল বার করলেই সঠিক তারিখ পর্যন্ত জানা হয়ে যাবে।

- না না, ওসব বাদ দাও। তার মানে কৃষ্ণকালীর সঙ্গে আমরা কোনও কাজ করিনি ঐ নতুন সেক্রেটারি আসার পর অর্থাৎ এক বছর হয়ে গেল আমাদের কৃষ্ণকালীর সঙ্গে যোগাযোগ নেই।

-মনে হয় আমাদের চুক্তিরও শেষদিন পার হয়ে গেছে। বড়কালী এখন আমাদের ক্লায়েন্ট নয়।

-কী আর করা যাবে? আমার মনে হয় এবার রেবা কৈরালার সঙ্গে কথা বলা যাক। শোনা যাক ওনার কী বলার আছে। ওনাকে ভিতরে নিয়ে এস সুন্দরী।

সুন্দরী উঠে যায় এবং কিছুক্ষণ পরে রেবাকে নিয়ে ফিরে আসে। পানু রায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, ’রেবাদেবী, ইনিই পানু রায়।‘ রেবা কৈরালা, ফর্সা সুন্দরী আস্তে আস্তে পানু রায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। পানু রায় হাত বাড়িয়ে দেন। পানু রায়ের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে,’ আমার সৌভাগ্য, মিঃ রায়।‘ রেবা কৈরালার প্রতিটি পদক্ষেপ এতটাই ধীরস্থির যে সহজেই পানু রায় বুঝলেন যে এই মহিলা আপাদমস্তক পেশাদার। তবে কেন জানি পানু রায়ের মনে হল এই মহিলার পা দু’টি শরীরের তুলনায় একটু বেশি লম্বা। তবে তাতে মহিলার সৌন্দর্য বেড়েছে বই কমেনি। পানু রায় চেয়ারের দিকে হাত দেখিয়ে বসতে বললেন রেবাকে।

-আপনার কথা শোনার আগে আপনাকে জানিয়ে রাখি যে আমি প্রায় একবছর আগে কৃষ্ণকালী চৌধুরীকে আইনি পরামর্শ দেবার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ ছিলাম। কৃষ্ণকালী একজন প্রখর বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী সেইজন্য সম্ভাব্য বিপদ এড়িয়েই উনি সবসময় কাজ করতেন। আইনি পরামর্শ নেবার প্রয়োজন ওনার খুব একটা পড়তো না। যদিও এখন আমরা চুক্তিবদ্ধ নই তবুও ওনাকে সঠিক পরামর্শ দেওয়া এবং সম্ভাব্য বিপদের হাত থেকে ওনাকে রক্ষা করা আমার কর্তব্য বলে মনে করি। সর্বোপরি উনি ব্যক্তিগতভাবে আমার একজন ভালো বন্ধু।

রেবা সোজা হয়ে একটা পায়ের ওপর আর একটা পা তুলে হেলান দিয়ে বসে বলল,’ ঠিক সেই কারণেই আমি আপনার কাছে এসেছি।‘

পানু রায় বললেন,’ আর একটা কথা বলে রাখি আপনাকে যে কোনও ব্যাপারে পরামর্শ দেবার আগে আমি সমস্ত ব্যাপারটা কৃষ্ণকালীকে জানাব এবং আমার কোনও পরামর্শ বা কাজ যে তার বিরুদ্ধে যাবে না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে তবেই কাজে হাত দেব। আশা করি সে ব্যাপারে আপনার কোনও আপত্তি নেই। ‘

-শুধু যে আপত্তি নেই তাই নয় আমি এখানে এসেছি যেহেতু আপনি ওনার আইনি পরামর্শদাতা এবং আমি চাই আপনি ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

-ঠিক আছে। এই কথাই রইল। এবার বলুন কী বলতে চান।

-নেপালে আমি উত্তরাধিকারসূত্রে একটি সম্পত্তির মালিকানা পেয়েছি।

-কী ধরণের সম্পত্তি?

-একটি ছোট হোটেল এবং ক্যাসিনো।

-নেপালের কয়েকটি ক্যাসিনো সত্যিই বিশাল এবং পৃথিবীবিখ্যাত।

-না না, সেরকম কিছু নয়। এটি আপাতত ছোট কিন্তু যে জায়গায় এটি অবস্থিত সেটি ভীষণ সুন্দর।প্রয়োজনে এটি বাড়াবার জন্য চারিদিকে প্রচুর জায়গা রয়েছে।

-এই সম্পত্তির কতটা অংশ আপনি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন? পুরোটা?

-না। এই সম্পত্তিটি একটি ছোট কোম্পানির। আমার বাবা ঐ কোম্পানির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমার ভাগে চল্লিশ শতাংশ আর বাকি ষাট শতাংশ চারজনের মধ্যে ভাগ হবে।

-আপনার বাবা কবে গত হয়েছেন?

প্রশ্নটা শুনে রেবার মুখটা কঠিন হয়ে উঠলো। রেবা ততোধিক কঠিনভাবেই উত্তর দিল,’ ছ’মাস আগে। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।‘

পানু রায় বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,’ খুন?’

-হ্যাঁ, হয়ত খবরের কাগজে পড়েছেন।

-আপনার বাবা কি প্রসাদ কৈরালা?

-আপনি ঠিক বলেছেন। আমি প্রসাদ কৈরালার একমাত্র সন্তান।

-আমি যতদূর জানি এই হত্যারহস্যের আজও কোনও সমাধান হয়নি।

-মিঃ রায়, কোনও হত্যারহস্যেরই সমাধান নিজে নিজে হয়না।

-দেখুন, এটা যদি আপনার কাছে কোনও অস্বস্তিকর বিষয় হয় তাহলে এই নিয়ে আলোচনার দরকার নেই।

-না না, সেরকম কিছু নয়।জীবনে অনেক কিছুই অস্বস্তিকর ঘটে । আমি আপনার কাছে আসার আগে নিজের অনুভূতি প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছি।

-ঠিক আছে। বলুন এই সম্বন্ধে আপনার কী বলার আছে।

-আমার মা মারা যায় যখন আমার বয়স চার বছর। তখনই নাকি শুরু হয় সাতবছরের দুর্ভাগ্যচক্র। অন্তত আমার বাবা তাই বিশ্বাস করত। বাবা সাঙ্ঘাতিকরকম কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল। আমার মনে হয় সব জুয়াড়িরা ঐরকমই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়। আস্তে আস্তে বাবা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং আর্থিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করে। বাবার হাতে তখন না ছিল কোনও টাকা আর না ছিল কোনও কাজ।বাধ্য হয়ে বাবা একটা বেআইনি শুঁড়িখানায় কাজ শুরু করে। কিছুদিন বাদে ঐ শুঁড়িখানার মালিক মারা যায়। বাবা তখন নিজেই শুঁড়িখানাটা চালাতে থাকে। মালিকটার কোনও ছেলে মেয়ে ছিলনা বা থাকলেও কেউ এসে বাবার কাছ থেকে মালিকানা দাবি করেনি। তারপর অনেকদিন বাদে যখন শুঁড়িখানা আইনসিদ্ধ ব্যবসার অন্তর্গত হল তখন বাবা ওটাকে ছোটখাট সুন্দর একটা হোটেল হিসেবে গড়ে তুলল। আমি বাবার দুর্ভাগ্যের গল্প বলে আপনাদের সময়ের অপচয় করছি না তো?

-একেবারেই নয়। আপনি বলুন।

-বাবা পরবর্তীকালে প্রভূত অর্থের অধিকারী হয়। বাবার জুয়ার নেশা ছিল। সৌভাগ্যক্রমে জুয়া থেকেও বাবা অনেক টাকা রোজগার করে। বাবা যে কেবল বেআইনি ব্যবসার ব্যাপারেই উৎসাহী ছিল তা কিন্তু নয়। তবুও শুঁড়িখানার ব্যবসাটা বাবা চালাতেই থাকল। জুয়া আর টাকা ওড়াবার নেশা ছিল বাবার রক্তে। আর সকলের মত জুয়াড়িদের মধ্যে অনেক ভাল গুণও থাকে।জুয়াড়িরা হেরে গিয়েও নিজেদের আবেগ সংবরণ করতে জানে। সর্বস্বান্ত হয়েও তারা নিজেদের আচরণে কথায় তা প্রকাশিত হতে দেয়না। কিন্তু জুয়াড়িরা তাদের পরিবার পুত্র-কন্যাদের সময় দিতে পারে না কারণ জুয়া খেলা হয় রাত্রে। সুতরাং আমিও আমার বাবাকে খুব একটা কাছে পাইনি। বাবা আমাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বড় বড় বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিত। জুয়াড়ির মেয়ের পক্ষে বোর্ডিং স্কুলে ঢোকা সহজসাধ্য ছিল না। তাই বাবা শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারী হিসাবে পরিচয় দিত। শেয়ারবাজারের জুয়া খেলা সমাজের চোখে অন্যায় নয় কিন্তু জুয়ার টেবিলে মাঝরাতে জুয়াখেলা সমাজের কাছে একেবারেই গ্রহনযোগ্য নয়। বাবা কোনওদিন আমাকে ছোট বা মাঝারি মাপের বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করতে চাইত না। আর আমার পক্ষেও ঐসব বড়লোকদের নাকউঁচু ছেলে মেয়েদের সঙ্গে ওঠাবসা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ত। তারপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কী ভাবে কে জানে বাবার আসল পরিচয় জানাজানি হয়ে যেত আর আমাকে স্কুল ছাড়তে হত। আমিও বাবার কিছু গুণ রপ্ত করেছিলাম। আমার মুখচোখে আমার অনুভূতির কোনও প্রকাশ হতনা। বন্ধুত্বের কোনওরকম তোয়াক্কা করতাম না আমি কারণ আমি বড়লোক হবার ভাণ করতে পারতাম না। এমনি করে স্কুলের পড়া শেষ করে আমি নিজে রোজগারের পথ খুঁজতে আরম্ভ করলাম। পেশাদারি মডেলিং এর কাজ করে বেশ কিছু পয়সা উপার্জন হল আমার। ইতিমধ্যে বাবা কাঠমান্ডুতে চলে গিয়ে কয়েকজন মিলে একটা কোম্পানি বানিয়ে একটা সম্পত্তি কিনে সেখানে একটা মাঝারি মাপের হোটেল বানিয়ে আমাকে কাঠমান্ডুতে চলে আসতে বলল। কিন্তু আমি যা ভেবেছিলাম তা হলো না। বাবা সারারাত বাইরে থাকতো। সকালে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ত। দুপুর তিনটের সময় ঘুম থেকে উঠতো। আবার সন্ধ্যে হতে না হতেই বেরিয়ে যেত। ইতিমধ্যে সম্পত্তির দাম বাড়তে থাকল। দেখলাম আমাদের হোটেলের পাশের বড় জমিটা কিনল একদল লোক। তারা আমাদের হোটেলটা কিনতে চাইল। শুনলাম ঐ জমিদু’টো একত্র করে ওরা নাকি সুইমিং পুল, নাইট ক্লাব সমেত বিশাল পাঁচতারা হোটেল বানাবে। বাবা বিক্রি করতে রাজি ছিল কিন্তু দামে পোষাচ্ছিল না। খবর পাওয়া গেল যারা জমিটা কিনতে চাইছে তারা প্রভাবশালী সমাজবিরোধী। বাবা তাদের কাছে অনেক দাম চেয়ে বসল। ওরা ক্ষেপে গেল। নানারকম ভাবে বাবাকে ভয় দেখাতে শুরু করল।বাবা ওদের পাত্তা না দিয়ে একটা বিশাল অঙ্কের টাকা চেয়ে চেপে বসে রইল। ওটাই ছিল বাবার দিক থেকে মারাত্মক রকমের ভুল।

পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন’ ওরাই কি আপনার বাবাকে খুন করেছিল?’

রেবা বলল,’ আমি জানিনা।কেউ জানে না। বাবা খুন হয়েছিল এবং তাতে অন্য বিনিয়োগকারী যারা ছিল মানে বাবার পার্টনারেরা ভয় পেয়ে গেল। তারা যে কোনও দামে তাদের অংশ বিক্রী করে দিতে রাজি ছিল। কিন্তু বাবার মৃত্যুতে ঐ লোকগুলোর কোনও লাভ হল না।

-তারপর কী হল?

-আমি উত্তরাধিকারসূত্রে চল্লিশ শতাংশ পেলাম।বাকি ষাট শতাংশ রইল অন্য চারজন পার্টনারের কাছে, প্রত্যেকের পনের শতাংশ। আমার কাছে যখন বাবার মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছলো আমি একেবারে ভেঙে পড়লাম। প্রথম ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই একজন লোক মালিকানা অর্জন করার পদ্ধতি শুরু করে দিল।বাকি চারজনের মধ্যে তিনজন ঐ লোকগুলো যা দাম দেবার প্রস্তাব দিয়েছিল তাতেই রাজি হয়ে গেল। বাবার মৃত্যুর আগে থেকেই আমার কালীকৃষ্ণের সঙ্গে আলাপ ছিল এবং মাঝেমাঝেই আমাদের যোগাযোগ হত।

সুন্দরী জিজ্ঞাসা করল,’ ছোটকালী?’ রেবা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল,’ কিছু বললেন?’ পানু রায় বললেন,’না, না। কিছু নয়। আপনি বলুন।

রেবা বলতে থাকল,’ আমি কালীকৃষ্ণের বাবার মধ্যে বিশেষ কিছু দেখতাম। উনি ঠিক আর পাঁচজনের মত নয়। বাবার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই উনি আমার সঙ্গে দেখা করে জানতে চাইলেন এই ব্যাপারে আমি কী জানি। আমি যা জানি বললাম। কালীকৃষ্ণের বাবা আমার আগেই আন্দাজ করেছিলেন যে অন্য পার্টনারেরা যা দাম পাবে তাতেই তাদের অংশ বিক্রী করে দেবে। তিনি ঐ অদৃশ্য বিনিয়োগকারীকে হারিয়ে দেবার জন্য বেশি দাম দিতে চাইলেন কিন্তু ততক্ষণে তিনজন অংশীদার তাদের অংশ বিক্রী করে দিয়েছে। কালীকৃষ্ণের বাবা চতুর্থজনের কাছ থেকে পনের শতাংশ কিনে নিলেন। এখন পরিস্থিতি এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। কালীকৃষ্ণের বাবা অর্থাৎ কৃষ্ণকালীবাবুর কাছে পনের শতাংশ এবং আমার কাছে চল্লিশ শতাংশ। এখন নতুন একদল লোক পুরো একশ শতাংশ কেনার চেষ্টা করছে।

পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ আপনি কী করতে চান?’

রেবা বলল,’ আমি বিক্রী করতে চাই। কিন্তু আমি চাইনা এরা বাবাকে খুন করে সস্তায় আমার অংশ কিনে নিক।বাবার জীবন গেছে। আমি চাইনা এই লোকগুলো বাবার মৃত্যুর কোনও সুযোগ নিক এবং লাভবান হোক।‘

পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ আর কিছু বলবেন?’

রেবা বলল,’ হ্যাঁ, আরও একটা বিষয় বলার আছে।‘

-বলুন

-একজন লোক যাকে আমি পাখিবাবু বলে উল্লেখ করব সে এই শহরে আছে। বলা বাহুল্য পাখিবাবু ওনার আসল নাম নয়। আমি জানিনা পাখিবাবু ঐ নতুন দলটার প্রতিনিধি কি না কিন্তু আমি পাখিবাবুকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। যখন আমি কাঠমান্ডুতে মডেলিং করতাম তখন থেকেই চিনি। আমি এটুকু জানতাম যে বাবার মৃত্যুর পরে পরেই যখন অন্য তিনজন পার্টনার চরম আতঙ্কিত অবস্থায় ছিল তখন একজন লোক নগদ টাকার বিনিময়ে তাদের অংশ লিখিয়ে নিয়ে চলে যায়। তাকে তারপর আর কেউ দেখেনি। আমি কয়েকদিন আগে পর্যন্ত এটাই জানতাম। এখন জানলাম পাখিবাবু ঐ অংশগুলো নিজের নামে সরকারি খাতায় নথিবদ্ধ করতে চায় এবং দু’দিন আগে আমাকে ফোন করে বলে যে সে আমার এবং কৃষ্ণকালীবাবুর অংশ কিনে নিতে আগ্রহী এবং আমাকে কাল রাত্রি ৮-৩০এ তার সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ জানিয়েছে।

-আপনি কী করতে চান?

-আমি কৃষ্ণকালীবাবুর সঙ্গে দেখা করে জানতে চাই তিনি রাজি আছেন কি না। আমি চাই উনি এবং আমি একসঙ্গে বিক্রী করি তা না হলে আমার অংশ আগে কিনে নিলে নিয়ন্ত্রণ পাখিবাবুর হাতে চলে যাবে এবং সে ক্ষেত্রে কৃষ্ণকালীবাবুর অনেক লোকসান হয়ে যাবে। আমি কৃষ্ণকালীবাবুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু উনি দেশের বাইরে।ওনার সেক্রেটারি আমাকে সহ্য করতে পারে না এবং আমাকে কোনওরকম ভাবেই সহযোগিতা করছে না।

-ওনার ছেলে কালীকৃষ্ণ কী বলছে? সে কি জানে তার বাবা কোথায়?

-কালীকৃষ্ণ শহরে নেই। ফোন পাওয়া যাচ্ছে না।

-আমার মনে হয় কৃষ্ণকালী ঐ লোকটার সঙ্গে আপনার দেখা করার ব্যাপারটা পছন্দ করবেন না। উনি সম্ভবত চাইবেন আমি পাখিবাবুর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করি।

-আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার কাছে এটা আমরা বাবার সম্মানের ব্যাপার। আমি সেইখানে শুরু করতে চাই যেখানে আমার বাবা শেষ করে গেছে।

-আপনি চান আপনার বাবার খুনী ধরা পরুক?

-অবশ্যই, এবং সেটাই আপনার কাছে আসার অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

- বলুন সে ব্যাপারে যা যা বলতে চান।

-আপনি আমার চেয়ে ভাল জানেন যে এই ধরণের জমিজমাসংক্রান্ত খুনখারাপির ব্যাপারে পুলিশ অনেক বড় বড় কথা বলে। সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে এই শহরের শান্তিরক্ষাকারীরা যে এইসব গন্ডগোল একদম সহ্য করবে না সে কথা সকলকে জানায় এবং প্রতিশ্রুতি দেয় যে কয়েকদিনের মধ্যেই খুনের তদন্তের নিষ্পত্তি হবে এবং খুনী উপযুক্ত শাস্তি পাবে। কিন্তু আজ অবধি আমি একটাও খুনের তদন্ত শেষ হতে দেখিনি । একবার শুধু হয়েছিল যেখানে একটা ভুল লোককে খুনী বলে ধরে আনা হয়েছিল।

- তাহলে আপনি আমার কাছ থেকে কী চান?

-আমার অংশীদারত্ব বিক্রীর কাজটা শেষ হলে আমি চাই আপনি আমার বাবার খুনে ব্যাপারটা দেখুন। আমি চাই আপনি কিছু সূত্র বের করে সেটা পুলিশের হাতে দিন যাতে বাকি কাজটা তারা করতে পারে। সূত্রের সন্ধান এবং ব্যাখ্যা করার কাজটা পুলিশের দ্বারা হবে না। ওটা যদি দয়া করে আপনি করেন।

-গোয়েন্দা এবং পুলিশের মধ্যে সমন্বয়সাধনের জন্য একজন আইনি পরামর্শদাতার কোনও প্রয়োজন নেই। পুলিশ যাতে খুনের তদন্তের নিষ্পত্তি করতে পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্য আমাকে নিয়োগ করার কোনও প্রয়োজন নেই।

-কিন্তু পুলিশ নিজে নিজে আজ অবধি কী করতে পেরেছে?

-আমি জানি না।

-কেউ জানে না।

-আপনি কি মনে করেন যে আপনার পরিচিত এই পাখিবাবু আপনার বাবার খুনের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে?

-থাকতেই পারে এবং তার সম্ভাবনা প্রবল।

-সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় আপনি নিজে কথা না বলে কৃষ্ণকালীকে এ ব্যাপারে কথা বলতে দিন।

-আপনি হয়ত জানেন না যখন কৃষ্ণকালীবাবু ওনার পনের শতাংশ কেনেন তখন ভেবেছিলেন আমি ওনার পুত্রবধূ হব এবং আমাদের বিবাহের উপহার হিসাবে এই পনের শতাংশ উনি আমাকে দেবেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পালটে গেছে।

-আপনার সঙ্গে আমি কী করে যোগাযোগ করতে পারব?

-আপনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না। আমি আপনার সঙ্গে কাল সকাল দশটায় যোগাযোগ করতে পারি?

পানু রায় একবার সুন্দরীর দিকে তাকালেন। বললেন,’ ঠিক আছে। কাল সকাল দশটায়।‘

রেবা সুন্দরীকে জিজ্ঞাসা করল,’আমি কি পিছনে বেরোবার দরজা দিয়ে বেরুবো?’

পানু রায় বললেন, ‘হ্যাঁ’। রেবা দরজা খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে পানু রায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’ কাল কথা হবে। এরমধ্যে দয়া করে যদি কৃষ্ণকালীবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন তাহলে ভীষণ উপকার হয়।‘রেবা কৈরালা বেরিয়ে গেল।দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

পানু রায় বললেন,’ সুন্দরী, আমার মনে হয় না এই মহিলার সঙ্গে জুয়া খেলা ঠিক হবে।‘

সুন্দরী মুচকি হেসে বলল,’দাদু, এতক্ষণ কী খেলছিলে তাহলে?’

পানু রায় বললেন,’ জানি না। আমার মনে হয় এখন আমার বড়কালীর নতুন সেক্রেটারির কাছে যাওয়া উচিৎ। দেখি কোনও নতুন খবর পাওয়া যায় কি না?

সুন্দরী বলল,’ দাদু, রেবা যদি নিজের অংশ বিক্রী করে দেয় এবং তাতে যদি বড়কালী রাজি হয়ে যায় তাহলে কি তুমি ঐ খুনের ব্যাপারটায় মধ্যস্থতা করতে রাজি হবে?

-আমি জানি না, সুন্দরী। সবটাই নির্ভর করবে পরিস্থিতির ওপর। তবে আমার মনে হয়না সে ব্যাপারে আমাকে ওর খুব একটা দরকার লাগবে।

-দাদু, আমার কিন্তু ব্যাপারটা সুবিধের মনে হচ্ছে না। আমার কেমন যেন বারবার মনে হচ্ছে এই ব্যাপারটায় তোমার না জড়ানোই ভাল।

পানু রায় হেসে বললেন,’ এখনই এত দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। আপাতত এলিনা রাইএর সঙ্গে দেখা করে নতুন কিছু জানতে পারি কি না দেখি। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।‘
0

গল্প - গান্ধর্বিকা ভট্টাচার্য

Posted in




















“মা!মা!”

গলার আওয়াজ না মেলাতেই হৈমন্তী মালিনীর ঘরে ঢুকে পড়ল। তারপর গটগট করে হেঁটে গিয়ে জানলার পর্দা সরিয়ে দিল।

“কি ফার্স্ট ক্লাস রোদ উঠেছে দেখ!”

মালিনী চশমা ছাড়াই বাইরের নীল আকাশ আর বরফের পাহাড়ের অবয়ব দেখতে পেল।

“আজ আমরা রিচুয়ালটা সেরে ফেলি? আবার কবে এরকম ওয়েদার পাব কে জানে?”

মালিনী বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর মাঝে নাকের ওপরটা চেপে ধরল। এত সকাল সকাল ওর চিন্তা করতে কষ্ট হয়।

“কারা কারা আছেন এখন?”

হৈমন্তী গড়গড় করে বলে গেল,

“এভারেস্টে সোনিয়া চৌধুরী আছেন, কাল চেক আউট করবেন। তিস্তায় অভিষেক ব্যানার্জি আর ওনার ওয়াইফ – অনুজা। মংপু আর রডোডেনড্রন খালি আছে। কাঞ্চনজঙ্ঘায় মিস্টার শ্রীনিবাসন উঠেছেন।”

“ওই পেইন্টার ভদ্রলোক? এসে গেছেন?”

“হ্যাঁ, কাল চেক ইন করেছেন। তোমাকে বললাম তো!”

মালিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এতদিন অবধি সে-ই কৃষ্ণচূড়া লজের সব ব্যবস্থাপনা করে এসেছে, কোনদিন একটা ছোট ভুলও হয়নি, কিন্তু আজকাল সবকিছুর কেমন খেই হারিয়ে যাচ্ছে। যেন বহুবার বাজিয়ে তানপুরার তার ক্ষয়ে গেছে।

“ঠিক আছে, আজকেই করে ফেলা যাক,” বলে মালিনী বিছানা থেকে উঠে পড়ল। “পেমাকে বল আমাকে এক কাপ চা দিয়ে যেতে। আর আজ আমি ঘরেই ব্রেকফাস্ট করব।”

“কেন মা?” হৈমন্তী ভুরু কুঁচকে এগিয়ে এল, “তোমার শরীর ভালো নেই?”

“না সেরকম কিছু নয়। বয়স হচ্ছে তো।”

হৈমন্তী আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

কৃষ্ণচূড়া লজের বেডরুমগুলো দোতলায়, লবি আর খাবার ঘর এক তলায়। মেনু নির্দিষ্ট থাকলেও, আগে থেকে বলে রাখলে অতিথিদের পছন্দের খাবারও তৈরী করা হয়। আগে মালিনী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করত। এখন সেই ভারটা হৈমন্তী নিয়েছে। গেস্টদের ব্রেকফাস্ট শেষ হয়ে এলে হৈমন্তী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

“অনেকদিন পরে এত সুন্দর রোদ উঠেছে। তাই আজ আমরা এই কৃষ্ণচূড়া লজের একটা ট্রাডিশন সেরে ফেলব।”

অতিথিরা সন্তর্পণে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। কৃষ্ণচূড়া লজের ট্রাডিশন? কি করতে বলবে রে বাবা?

“বাইরের যে কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখেছেন, যার নামে আমাদের এই লজের নাম, ওর নীচে আমরা গেস্টদের সঙ্গে একদিন পিকনিক করি,” হৈমন্তী মিষ্টি হেসে বলল। “আজ যেহেতু রোদ আছে, চলুন ওখানেই চা-কফি আর আড্ডা হয়ে যাক।”

ঘরের মধ্যে আটকে থাকা নিঃশ্বাস এবার ছাড়া পেল।

“হ্যাঁ হ্যাঁ, এতো দারুণ প্রস্তাব,” অভিষেক সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। “আউটডোর যখন, আশা করি স্মোকিং এ কারুর আপত্তি নেই।”

সোনিয়াকে দেখে মনে হল তার ধূমপানে যথেষ্ট আপত্তি আছে, কিন্তু গণতন্ত্রে সংখ্যালঘুর কথা কে-ই বা শুনেছে? সবাই মিলে হইহই করে গাছের দিকে রওনা দিল।

কৃষ্ণচূড়া গাছটা লজের ডানদিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে একটা কাঠের টেবিল আর বেঞ্চ। নীচে পাহাড়ের ঢালে পাইনের বন, আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা ঝকঝক করে। সবাই বেঞ্চের ওপর পছন্দসই জায়গা বেছে বসে পড়ল। একটু পরে মালিনীও এসে সবার সঙ্গে যোগ দিল।

“এই হাইটে সাধারণত কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখতে পাওয়া যায় না, তাই না?” অনুজা মালিনীকে জিজ্ঞেস করল।

মালিনী ক্লান্ত হাসি হাসল। প্রায় প্রত্যেকটা পিকনিকে এই কথাটা ওঠে। উত্তরটা মালিনীর মুখস্থ হয়ে গেছে।

“একদম ঠিক। আশেপাশে তাকিয়ে দেখুন, শুধু দেবদারু আর রডোডেন্ড্রনের জঙ্গল। আসলে আমার স্বামীকে একজন এই গাছের একটা ডাল গিফট করেছিলেন। আমার স্বামীও এমনিই, প্রায় অবহেলা করেই ডালটা পুঁতে দিয়েছিলেন। সবাই ভেবেছিল, দু'দিন পরে হয়তো আপনেই মরে যাবে। ওমা, কিছুদিন পরে দেখা গেল ডালটা একটু বড় হয়েছে। আমাদের কিন্তু এতে কোন কৃতিত্ব ছিল না! না গোড়ায় জল দিয়েছি, না পাখির হাত থেকে বাঁচিয়েছি, না কিছু। শুধু শুধু, বিনা যত্নেই গাছটা বড় হতে লাগল। এই এত বড় হয়েছে। কিন্তু মজার কথা হল, আজ অবধি একটাও ফুল ফোটেনি।”

“সেকি? ফুল ফুটল না কেন?”

মালিনী কাঁধ ঝাঁকাল।

“সেটা একটা রহস্য। আমার মনে হয়, হয়তো এখানকার জল হাওয়ার কারণে।”

“দ্যাট ইজ সো ইন্টারেস্টিং!” সোনিয়া সাদা লোমের শালটা ভালো করে জড়িয়ে নিল। এমনিতে তেমন ঠান্ডা না থাকলেও গাছের তলায় বেশ একটা হিমেল ভাব আছে। “ভেরি মিস্টিরিয়াস!”

“চা, না কফি, কোনটা আনাব?” হৈমন্তী কৃষ্ণচূড়ার ইতিকথায় যতি টানল।

“দার্জিলিংএর এত কাছে এসে কফি কে খাবে?” অনুজা নাক কুঁচকে বলল, “আমার জন্য দার্জিলিং টি! নো মিল্ক, নো সুগার।”

বাকিরাও চায়েই সম্মতি দিল। হৈমন্তী লজের দিকে রওনা দিল।

“বাই দ্য ওয়ে, আজ আমাদের মধ্যে একজন সেলেব্রিটি উপস্থিত আছেন,” মালিনী শ্রীনিবাসনের দিকে নির্দেশ করলেন, “ইনি স্বনামধন্য চিত্রকর মিস্টার এম শ্রীনিবাসন!”

“ও মা!” অনুজা হাঁ হয়ে গেছে। “আমি কাল থেকে ভাবছি আপনাকে কেন চেনা চেনা লাগছে!”

“আমি দেখেই চিনতে পেরেছিলাম,” সোনিয়া হাসতে হাসতে বলল, “কিন্তু বুঝতে পারিনি আপনি পরিচয় দিতে চান কি না।”

“এখন যখন পরিচয় হয়েই গেল, আপনি আমাদের জন্য কিছু আঁকুন না!” অভিষেক সিগারেটে একটা লম্বা টান দিল।

অনুজা ওর হাঁটুতে হাল্কা করে চাপড় মারল।

“ওরকমভাবে বলে দিলেই কি এঁকে ফেলা যায় নাকি? আর্টিস্টের মনের ভেতর থেকে সাড়া আসতে হবে। তাই না, শ্রীনিবাসন বাবু?”

“আমি শুনেছি, একজন বড় অভিনেত্রী অনেকবার শ্রীনিবাসন বাবুকে তাঁর বরের ছবি আঁকতে অনুরোধ করেছিলেন,” সোনিয়া জুতো খুলে বেঞ্চে পা মুড়ে বসল। “কিন্তু শ্রীনিবাসন বাবু কিছুতেই রাজি হন নি।”

“কেন?” অভিষেক ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল। “টার্মসে পোষায় নি?”

শ্রীনিবাসন মৃদু হাসল।

“উনি যেমন ছবি চেয়েছিলেন, তেমন আঁকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।“”

অনুজার চোখ গোল হয়ে গেল। “কোন কুরুচিকর ছবি?”

“নো নো,” শ্রীনিবাসন মাথা নাড়ল, “সেরকম না। উনি ছবিতে ওঁর বরের চোখে ওঁর প্রতি যে ভালোবাসা দেখতে চেয়েছিলেন, আমি সেটা দেখতে পাইনি। ওঁর স্বামী সেই ভালোবাসা অন্য কোথাও খুঁজছিলেন। সেরকম ছবি আঁকলে উনি খুশী হতেন না।”

“তার মানে, আপনি আঁকার মাধ্যমে মানুষের সত্যিটা বের করে আনেন?”

“…সেরকম কিছু বলতে পারেন।”

“নাউ কাম অন, শ্রীনিবাসন বাবু,” অভিষেক সিগারেটটা বুটের নীচে থেঁতলে দিল। “এবার আমার প্রচণ্ড আগ্রহ হচ্ছে। আপনাকে আমাদের ছবি আঁকতেই হবে! আমি দেখতে চাই আপনি আমাদের মধ্যে কি দেখতে পাচ্ছেন।”

হৈমন্তী ফিরে এসেছে। সে-ও অভিষেকের সঙ্গে গলা মেলাল।

“হ্যাঁ, প্লিজ! একটা ছবি আপনাকে আঁকতেই হবে! আমরা খুব সম্মানিত হব। ছবিটা বাঁধিয়ে লবিতে রেখে দেব!”

“ওকে, ওকে!” শ্রীনিবাসন হেসে উঠল। “আমি চেষ্টা করছি। কিন্তু দুটো কথা আমি আগে থেকে বলে রাখছি। সাবধান বাণীও বলতে পারেন। এক, আমি যে সত্যটা দেখতে পাচ্ছি শুধু সেটাই আঁকব। আর দুই, ছবিটা আঁকার পর আমাদের মধ্যে থেকে কোন একজন হারিয়ে যাবেন।”

গাছের নীচে যেন মুহূর্তে বিদ্যুৎ খেলে গেল। সবাই সোজা হয়ে বসল। সোনিয়া একটু শিউরে উঠল।

“হারিয়ে যাব, মানে?”

“হারিয়ে যাব মানে লস্ট,” অভিষেক অস্বস্তি ঢাকার জন্য হেসে উঠল। “খুঁজে পাওয়া যাবে না।”

“লস্ট মানে আমি জানি,” সোনিয়া ঠান্ডা চোখে অভিষেক দিকে তাকাল। “কিন্তু হারিয়ে যাওয়া মানে তন্ময় হয়ে যাওয়া, বা নিজেকে ভুলে যাওয়াও তো হয়। এক্ষেত্রে উনি কোনটা বলছেন তাই জানতে চাইছিলাম।”

শ্রীনিবাসনের হাসি মুছে গেল, “সেটা যে হারিয়ে যাবে, সে বুঝতে পারবে। অন্য কেউ বুঝবে না।”

অভিষেক, অনুজা আর সোনিয়া পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল। মালিনী অন্যমনস্ক। যেন কোন কথা শুনতেই পায়নি।

“সাউন্ডস লাইক ফান,” হৈমন্তী হাততালি দিয়ে উঠল। “আপনাকে কোন আঁকার সরঞ্জাম দিতে হবে?”

“একটা কাগজ আর পেনসিল হলেই চলবে।”

কয়েক মিনিটের মধ্যেই সরঞ্জাম যোগাড় হয়ে গেল। সেই সঙ্গে চা-ও এসে গেল। শ্রীনিবাসন কাজে লেগে গেল।

“আমাদের কি পোজ দিয়ে বসতে হবে?” অভিষেক পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে জিজ্ঞেস করল।

“না, আপনারা যেমন খুশী থাকুন। আমার যা দেখার ছিল, দেখা হয়ে গেছে।”

“অলরাইট দেন।”

অভিষেক চায়ের কাপ হাতে খাদের দিকে এগিয়ে গেল। সামনে গভীর, নীল আকাশ - যেন কোন দূর অতীতে রঙ করা হয়েছিল। সেই রঙ আর বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। পাহাড়ের টাটকা হাওয়া। চোখ ঝলসানো বরফের পাহাড়।

“কি সুন্দর, না?”

অভিষেক খেয়ালই করেনি কখন অনুজা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

“হুঁ।”

“আচ্ছা, ওই অভিনেত্রীর মতো যদি আমিও তোমার ছবি আঁকতে বলি, তাহলে তোমার চোখে উনি কি দেখবেন?”

“শ্রীনিবাসন?” অভিষেক আবার সিগারেট ধরাল, “ওর কথায় তুমি বিশ্বাস কর নাকি? মানুষের ভেতরের সত্যিটা টেনে বের করে আনে…ওসব গিমিক শুধু। কারুর সত্যিটা জেনে ফেলা অত সোজা নয়।”

“তবু যদি তর্কের খাতিরে বলি-”

অভিষেক জঙ্গলের দিকে ঘুরে দাঁড়াল।

“ওসব বোকা বোকা তর্কের কোন মানে হয় না।”

অনুজা আনমনে চায়ের কাপটা দু'হাতের পাতায় জড়িয়ে ধরল - যেন ধোঁয়া হয়ে পালিয়ে যাওয়া উত্তাপটুকু ধরে রাখতে চাইছে। সোনিয়া একটা কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে আছে। হৈমন্তী গিয়ে ওর পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল।

“প্রথম সোলো ট্রিপ কেমন লাগছে?”

সোনিয়া হেসে উঠল।

“আপনারা ওয়েবসাইট পড়েন? আমি তো ভাবলাম বোধহয় ওগুলো স্ট্যান্ডার্ড ফিল আপ করতে হয়!”

“না, না। আমরা গেস্টদের সব অনুরোধ খুব মন দিয়ে পড়ি, এবং যতদূর সম্ভব ব্যবস্থা করার চেষ্টা করি। আমার মা তো প্রত্যেক গেস্টের রুচি অনুযায়ী ঘর আর ভিউও ঠিক করে। যেমন, আপনি নিরিবিলি আর শান্তি চেয়েছিলেন বলে কোণার ঘরটা আপনার জন্য রেখেছিলাম।”

সোনিয়ার হাসিতে অপরাধবোধের ছায়া পড়ল।

“বর, বাচ্চা, চাকরি, সব সামলে নাস্তানাবুদ হয়ে যাচ্ছিলাম। তাই আমার বর বলল, একটা সোলো ট্রিপ করে এস।”

“একদম ঠিক করেছেন।”

সোনিয়া চার ধারে নজর ঘোরাল।

“এই লজটা আপনি আর আপনার মা চালান?”

হৈমন্তী কাঁধ ঝাঁকাল।

“এই মুহূর্তে তাই। আসলে এটা আমার ঠাকুরদার বাড়ি। মা যখন বিয়ে করে এল, তখন ঠিক করল বাড়িটা মেরামত করে একটা গেস্ট হাউস বানাবে। একদম ঘরোয়া ব্যবস্থা। বাড়ির একদিকে আমরা থাকব, আর অন্য দিকে কয়েকজন গেস্ট। ওই সময়ে কিন্তু হোমস্টের আইডিয়াটাই ছিল না! মা আর বাবা মিলে একটা নতুন জিনিস শুরু করল। তারপর আমার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন বাবা মারা যায়। সেই থেকে মা একাই বিজনেস চালিয়েছে। ইদানিং আমি আর আমার বরও জয়েন করেছি। ও এখন একটা কাজে কোলকাতা গেছে। আপনি আর ক'দিন থাকলে আলাপ করাতাম।”

“এরকম নির্জন একটা জায়গায় আপনারা দু'জন শুধু থাকতেন? ভয় করত না?”

“দু'জন না। আমি দার্জিলিঙে হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছি। তারপর দিল্লিতে। মা একাই থাকত। কিন্তু বাহাদুর, পেমা, তেনজিং – ওরা সবাই মায়ের বিশ্বস্ত। বাবাকেও এখানে সবাই খুব ভালোবাসত। যদি বিজনেসের কথা বলেন তাহলে মা একাই পুরোটা দাঁড় করিয়েছে। আমি গল্প শুনেছি, যে বাবা যখন মারা গেছে সেই মাসেও কুক থেকে মালী, একজনেরও মাইনে বাদ পড়েনি।”

“আমাদের আর্টিস্ট বাবু কি করছেন?” অভিষেকের গলা ভেসে এল। “কিছু আঁকতে পারছেন, নাকি রণে ভঙ্গ দিয়েছেন?”

সবার দৃষ্টি কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে চলে গেল। কিন্তু শ্রীনিবাসন কই? বেঞ্চ খালি। শুধু টেবিলের ওপর কাগজটা পাথর চাপা দেওয়া রয়েছে। আবার সেই নৈঃশব্দ্য নেমে এল। অবিশ্বাস সত্বেও সবাই ভয়ে ভয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখল, কেউ নিখোঁজ হয়ে গেল কি না। না, গুনতি ঠিক আছে। অভিষেক গলা খাঁকারি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে পাথর সরিয়ে কাগজটা তুলে নিল। তারপর হোহো করে হেসে উঠল।

“আচ্ছা বুর্বক বানালো লোকটা…হেঃ হেঃ হেঃ!”

সাহস পেয়ে বাকিরাও টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।

***

দুপুরে সবাই লাঞ্চ খেতে গেলে মালিনী দু'হাতে কাগজটা তুলে নিল। যে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় সবাই বসে চা খাচ্ছিল শ্রীনিবাসন সেই গাছটার ছবি এঁকেছে। শুধু নীচের টেবিল আর বেঞ্চটা নেই। তার বদলে আছে ফুল – গাছটার ডালে ডালে ফুলের ছড়াছড়ি। নীচেও গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল পড়ে আছে।

পাহাড়ের দিক থেকে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া ছুটে এসে মালিনীর চোখ বন্ধ করে দিল। এক মুহূর্তর জন্য। চোখ খুলে সে চমকে উঠল।

আকাশে আগুন লেগে গেছে!

না, আগুন নয়। সারি সারি কৃষ্ণচূড়া গাছের বন। লাল শিখার চেয়েও উজ্জ্বল, জ্বলন্ত, অশান্ত…ঠান্ডা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে, তারপর তুমুল আবেগে ডাল থেকে ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে স্তূপাকার হচ্ছে। কোথায় এই কৃষ্ণচূড়ার বন? এ তো আজকের নয়…কত যুগ, কত শতাব্দী আগের গাছ এরা? যেন চিরকাল পৃথিবীর বুকে এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।

মালিনী দেখতে পেল কৃষ্ণচূড়ার বন পেরিয়ে দূরে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে, তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মালিনী সেদিকে এগিয়ে গেল।

“শ্রীনিবাসন?”

শ্রীনিবাসন উত্তরে শুধুই মুচকি হাসল।

“আপনি জানতেন, আমিই এই ছবির ভেতর হারিয়ে যাব?”

শ্রীনিবাসন মাথা নেড়ে 'না' বলল।

“আমার ছবি শুধু একটা আমন্ত্রণ। কে সাড়া দেবে আমি নিজেও জানিনা। কিন্তু যখন আমার ভেতর থেকে আমন্ত্রণ আসে, আমি জানি কেউ না কেউ সাড়া দেবেই।”

গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে হাওয়ার শব্দ ভেসে আসছে। গভীর, আরো গভীর…সমুদ্রের গর্জনের মতো…

“অন্য কোথাও গিয়ে বসা যাক?”

“নিশ্চয়ই,” শ্রীনিবাসন মাথার পেছন চুলকে বললেন, “কিন্তু কোনদিকে যাব?”

“মানে? এটা আপনার বাগান নয়?”

“একেবারেই না। আমি শুধু আসার পথটা তৈরী করেছি। বাগানটা সম্পূর্ণ আপনার,” শ্রীনিবাসন এদিক ওদিক তাকাল, “আপনি তো আগেও এই বাগানে এসেছেন।”

মাথার ভেতরের এক অন্ধকার কোণায় উড়তে থাকা প্রজাপতির মতো অনুভূতিটা এতক্ষণে মালিনী চিনতে পারল। সত্যিই তো! এই বাগানে তো সে আগেও এসেছে। ওই তো, ওই রাস্তাটা দিয়ে কিছুদূর গেলেই ফুলের বাগান। কিন্তু তখন তো কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি ছিল না।

শেষ কবে সে এই বাগানে এসেছিল?

বিস্মৃতির পর্দা ঠেলে একটা ছবি ভেসে উঠল।

“তুমি চলে গেছ বলে হৈমন্তী আর আগের মতো হাসে না, কথা বলে না। তোমার মা পাপাইয়ের বাড়ি থাকতে চলে যাচ্ছেন। আমি কাউকে খুশী করতে পারছি না…”

চোখের জলের মতো ঝরে পড়া ফুলের বনকে পেছনে ফেলে মালিনী এগিয়ে চলল। সমুদ্রের গর্জন বন্ধ হয়ে হাওয়া শান্ত হয়ে এল। বাগানের এই দিকটা মালিনীর সবচেয়ে প্রিয়। দুই ধারে গুচ্ছ গুচ্ছ লাল গোলাপ ফুটে আছে। তার সঙ্গে আছে হলুদ গাঁদা, সাদা জুঁইফুল, চন্দ্রমল্লিকা…দূর থেকে জলের শব্দ আসছে। মালিনী জানে, ওখানে একটা শ্বেত পাথরের ফোয়ারা আছে, আর একটা বসার জায়গা।

“আপনি অনেক দায়িত্ব নিয়েছেন…”

শ্রীনিবাসনের কথায় মালিনী চোখের তারায় প্রশ্ন এঁকে ঘুরে তাকাল।

“আপনার স্বামী মারা যাওয়ার পরে হৈমন্তীর দায়িত্ব, সংসারের দায়িত্ব, কৃষ্ণচূড়া লজের দায়িত্ব – সবকিছু আপনার ওপর এসে পড়েছিল। শক্ত থাকা ছাড়া আপনার কোন উপায় ছিল না। তাই একমাত্র এই বাগানে এসে আপনি নিজের দুঃখ উজাড় করে দিতে পেরেছিলেন। একমাত্র এখানেই, যখন আপনি সম্পূর্ণ একা ছিলেন।”

মালিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাথরের সীটে বসে পড়ল।

“আমার স্বামী…রজত…ও তখন সবে চলে গেছে। আমাদের জীবনের সব থেকে দুঃখের সময় ছিল সেটা। সেই শেষবারের মতো এই বাগানে এসেছিলাম।”

“উনি খুব স্পেশাল মানুষ ছিলেন?” শ্রীনিবাসনও বসে পড়ল।

“ওর মতো মানুষ আমি দেখিনি। ওর কাছে সাহায্য চাইতে এসে কেউ খালি হাতে ফিরে যায়নি। কত লোককে যে টাকা ধার দিয়েছে…আমরা যখন কৃষ্ণচূড়া লজ খুললাম, যে চাকরি চাইতে এসেছে ও তাকেই কাজে রেখেছে। এতজনের মাইনে দিতে টানাটানি হবে জেনেও। অনেকে ওর এই স্বভাবের সুযোগও নিয়েছে। আমি ওকে বলতাম, এই যে তুমি অমুককে এত টাকা ধার দিচ্ছ, ও কিন্তু জীবনে ফেরত দেবে না। রজত বলত, না দিক। ওর কাজটা তো হয়ে যাবে। রজত বোকা ছিল না, ও জানত পৃথিবীতে সৎ, অসৎ, দু'রকম মানুষই আছে। তা জেনেও, মানুষের মনের অন্ধকার দিকটা বুঝেও, ও সকলের উপকার করত।”

শ্রীনিবাসন অল্প হাসল।

“সত্যি অসাধারণ মানুষ ছিলেন।”

মালিনী মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইল।

“আমি সময় থাকতে সেকথা বুঝতে পারিনি। রজতের স্বভাবের জন্য দিন দিন ওর সঙ্গে সংসার করা আমার পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠছিল। শেষে…” মালিনী ঢোঁক গিলল, “শেষে আমি ভাবতে শুরু করলাম, যদি কৃষ্ণচূড়া লজের দায়িত্ব আমি একা সামলাই তাহলে কত বেশী টাকা বাঁচবে, আমরা কত ভালোভাবে থাকব, হৈমন্তী কত ভালো স্কুলে পড়তে পারবে…রজত যেদিন চলে গেল সেদিনও এই কথাই ভেবেছি…”

মালিনী শ্রীনিবাসনের দিকে তাকাল, যেন ভর্ৎসনা শোনার আশায়। কিন্তু শ্রীনিবাসন কিছু না বলে মালিনীর দিকে তাকিয়ে রইল।

“সেদিন আমরা সবজি কিনতে বেরিয়েছিলাম,” মালিনী একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল। “কাছাকাছি একটা বাজার বসে, তাই পায়ে হেঁটেই গেছিলাম। ফেরার সময়ে একটা গাড়ি ব্রেক ফেল করে সোজা আমার দিকে ছুটে এল। ভয়ে বা বিস্ময়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। পা অচল হয়ে গেল। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম গাড়িটা আমার দিকে ছুটে আসছে।” বরফ হয়ে জমে থাকা কান্নার একটা ফোঁটা মালিনীর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। “যখন সম্বিৎ ফিরল, দেখলাম আমি রাস্তার এক ধারে পড়ে আছি। আর রজতের রক্তাক্ত শরীর রাস্তায় লুটোচ্ছে। আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার আগে, আমাকে বাঁচানোর আগে রজত একবারও নিজের জীবনের কথা ভাবেনি!”

মালিনী আকাশের দিকে তাকাল। আকাশটা যেন দিন দিন আরো দূর হয়ে ওর নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

“অন্যের জীবন চুরি করে বেঁচে থাকার গ্লানি – এ এক ভয়ংকর বোঝা। সারা জীবন ধরে এই বোঝা টেনে টেনে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। এখন আমার সকালে চোখ খুলতেও ইচ্ছে করে না। জানেন, সেদিন যদি রজতের বদলে আমি মরে যেতাম, রজতের জীবনের গতি পালটাত না। কারণ ও শুধু দিতেই শিখেছিল, কারুর থেকে নিতে শেখেনি। তাই ওর নিজের মতো করে বাঁচার জন্য সেভাবে কাউকে প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু আমরা যারা ওর থেকে নিতে অভ্যস্ত ছিলাম – প্রতিদিন, খেয়ালও না করে নিয়েই যেতাম, আমাদের জীবন ওকে ছাড়া চৌচির হয়ে গেল। আমি যদি রজতের জীবন চুরি করে না নিতাম, সেদিন যদি রজতের বদলে আমি মরে যেতাম – তাহলে? এই প্রশ্নটা আমি সবার চোখে দেখেছি। এমনকি হৈমন্তীরও…”

মালিনী কথাটা শেষ করল না। হয়তো শেষ করার মতো কোন কথা বাকি ছিল না। কোথাও একটা পাখি একটানা ডেকে চলেছে। গোলাপ ফুলের ওপর একটা ভ্রমর ঘুরপাক খাচ্ছে। মালিনী দু'হাতে নিজের রগ টিপে ধরল।

শ্রীনিবাসন মৃদু গলা খাঁকারি দিল।

“কিন্তু সেদিন আপনাকে না বাঁচাতে পারলে আপনার স্বামী কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতেন? তিনি কি সারা জীবন অপরাধবোধে ভুগতেন না?”

“সেটাই হওয়া উচিৎ ছিল। রজতের বদলে বেঁচে থাকার জন্য আমি মনে মনে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি, এমনকি রজতের কাছেও। কিন্তু ক্ষমা আমার কপালেই নেই। আমি যে এতবার ভেবেছি – কোনভাবে যদি কৃষ্ণচূড়া লজের দায়িত্ব আমার একার হাতে চলে আসে – সেটা কি রজতের মৃত্যু কামনা করাই ছিল না? তারপর রজতের মৃত্যুতে আমি কোন অধিকারে ক্ষমা চাইতাম, বা চোখের জল ফেলতাম? সেটা কি শঠতা ছাড়া কিছু নয়?”

“তাই আপনি মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে শুধু নিজের কর্তব্য করে গেছেন। কৃষ্ণচূড়া লজ দাঁড় করিয়েছেন, মেয়েকে ভালো স্কুল কলেজে পড়িয়েছেন, বিয়ে দিয়েছেন, শাশুড়ীকে নিয়মিত টাকা পাঠিয়েছেন – নিজের সবটুকু দিয়ে আপনার স্বামীর অভাব পূরণ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কেউ দেখেনি আপনি সেটা করতে গিয়ে নিজের ওপর কতটা অত্যাচার করেছেন – সম্ভবত আপনি নিজেও বোঝেননি…যে আপনি ক্লান্ত, খুব ক্লান্ত।”

শ্রীনিবাসনের কথাগুলো তুলোর মতো মালিনীকে জড়িয়ে নিতে লাগল। মালিনী ঢুলে পড়ল। যেন কতদিনের জমা ক্লান্তি ওকে ঘিরে ধরেছে। আর এক মিনিটও চোখ খুলে রাখতে পারছে না।

“আমি যা করেছি সেটা আমার ন্যায্য প্রায়শ্চিত্ত।”

“প্রায়শ্চিত্তরও শেষ থাকে। আপনার স্বামী নিজের জীবনের পরিবর্তে আপনাকে যে উপহার দিয়েছেন, আপনি তাকে শাস্তি বানিয়ে নিলেন…” শ্রীনিবাসন উঠে পড়ল। “এই বাগানটা ক্লান্ত, একাকী মানুষের জন্য তৈরী। ঘুম পেলে আপনি এখানে ঘুমতে পারেন। কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না।”

“ঘুমব? সত্যি ঘুমব? কতক্ষণ ঘুমতে পারব?”

“যতক্ষণ না কেউ আপনাকে ডাকতে আসে।”

***

“মা! মা!”

হৈমন্তী উদ্বিগ্ন হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল।

“বেডরুম মে দেখা হ্যায়?” পেমা কোমরে দু'হাত রাখল। গেস্টদের ডিনার হয়ে গেছে। এবার তার বাড়ি যাওয়ার সময়।

“হ্যাঁ, দেখে এলাম তো। এতক্ষণ তো তাই ভাবছিলাম, যে মা হয়তো ঘুমচ্ছে। এখন গিয়ে দেখলাম ঘর খালি। সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম, বলল মা-কে দুপুরের পর আর দেখেনি।”

“উস পের কে নীচে তো নেহি?”

“পের? কৃষ্ণচূড়ার নীচে? যেখানে চা খাচ্ছিলাম?”

বলতে বলতে হৈমন্তী সেদিকে পা বাড়াল। লন্ঠনের আবছায়া আলোয় বেঞ্চটা ফাঁকা বলেই মনে হচ্ছে কিন্তু…

“মা!”

হৈমন্তী ডাক দিতেই যেন শূন্য থেকে মালিনীর অবয়ব ফুটে উঠল। হৈমন্তী এক ছুটে বেঞ্চের কাছে চলে গেল। কাছ থেকে মা-কে দেখে ভারী মমতা হল ওর। বাচ্চার মতো বেঞ্চে বসে টেবিলের ওপর মাথা রেখে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সামনে শ্রীনিবাসনের ছবিটা রাখা।

“মা! উঠে পড়! রাত হয়ে গেছে তো!”

হৈমন্তীর ডাকে মালিনী উঠে চোখ কচলাতে লাগল। ওর মাথা থেকে একটা কৃষ্ণচূড়ার ফুল পড়ে গেল।

কৃষ্ণচূড়ার ফুল? এখানে?

হৈমন্তী চমকে ওপর দিকে তাকাতেই ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।

আকাশ ভর্তি তারা, আর তার নীচে, কাল অবধি একটাও ফুল না ফোটা কৃষ্ণচূড়া গাছের প্রত্যেকটা ডাল থেকে আগুনের মতো লাল ফুল থোকা থোকা ঝুলে আছে।
0

গল্প - বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়

Posted in







আমি তাকে ডাকি নি।সে যখন বলল, আমি আজ আসব,আপত্তি করিনি। ভালো কথা।আসতে চাইছে আসুক। আমাদের বাড়ি শহর থেকে একটু দূরে। ট্রেনে করে একটা স্টেশনে এসে ১ নং প্ল্যাটফর্মে নামতে হবে। পাশেই অটোস্ট্যান্ড।তারপর অটো। তারপর বেশ কিছুটা হাঁটা... তারপর একটা চালু মিষ্টির দোকান। আমাদের বাড়ির নাম বললে ঠিক দেখিয়ে দেবে। বাগানওলা বাড়ি। চিনতে অসুবিধে হবার কথা নয়।
এই লোকটাকে আমি ভালো করে চিনি না। কেবল নামে চিনি। ছবিতে মানুষকে কতটা চেনা যায়? আজকাল অনেকেই নকল ছবি লাগায়। তাছাড়া অপরিচিত মানুষকে বাড়ি গিয়ে চিনতে হবে? কে জানে?
ওর একটি কবিতা পড়ে আমার ভালো লেগেছিল। কবিতাটি ছিল তার প্রেমিকার জন্মদিন নিয়ে। কবিতার নামও 'প্রেমিকার জন্মদিন'। তার মধ্যে একটা লাইনে এসে আমি ছিটকে যাই।

লাইনটা হলো: তিস্তার চরের মতো দীর্ঘ বাল্যকাল।
আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম।
তারপর আমার প্রতিক্রিয়া জানাই।
এই কবিতার শেষ লাইন ছিল এই রকম।
আমন্ত্রিত লোকটিও জানেনা সে আগন্তক কিনা। দারুণ না?
সেই থেকে ওর কবিতা পড়ি। পড়তেই থাকি।ও রাতদিন কবিতা লেখে। মূলত সনেট। কিছু দীর্ঘ কবিতা, গানের লিরিক এসবও লেখে।
আমি নিজে কবিতা লিখতে পারি না। কিন্তু ভালো কবিতা পড়তে ভালবাসি। আগে গল্প লেখার চেষ্টা করতাম। এখন মাঝে মাঝে অনুবাদ করি। কিন্তু ঠিক হয়ে ওঠেনা। অণুগল্প মাঝে মধ্যে লিখি।
এই লোকটার সঙ্গে যোগাযোগ হতো ফেসবুকের মাধ্যমে। একদিন ও বন্ধুত্ব প্রস্তাব পাঠালো।এক সপ্তাহ পর আমরা বন্ধু হলাম।ও বলল: এত তাড়াতাড়ি?
আমি উত্তর দিইনি। কারণ আমার সময় লাগে। এটাই আমার স্বভাব। যদিও কিছু মানুষ ভাবে এটা আমার একটা সচেতন স্ট্রাটেজি।
যাই হোক ফেসবুক থেকে মেসেঞ্জার, পরে ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে ওর সঙ্গে যোগাযোগ হলো। কোনো ব্যক্তিগত কথাবার্তা নয় শুধু লেখা চালাচালির সম্পর্ক।

আমার গল্প পড়ে ও বলল , ভালো হয়নি। আরও ছোট করে লিখে দেখুন।আর অনুবাদগুলো ঠিক জমছে না। তবে মেঘাকে নিয়ে আমার লেখা একটা অণুগল্প ওর ভালো লেগেছে বলল।যে এত ভালো কবিতা লেখে তার প্রশংসা পেতে কার না ভালো লাগে?
তবু সে তো ঠিক বন্ধু নয়। আগন্তকই বলা যায়। তবে আসতে চাইছে যখন আসুক।এর আগে কোনো সত্যিকারের কবিকে সামনে থেকে দেখেছি বলে মনে পড়েনা।

মুশকিল হলো ও আজ আসবে বলে লিখেছে। কিন্তু আজকেই বাড়িতে কেউ নেই। ফাঁকা বাড়ি। আমি কুঁড়ে এবং অপারগ একজন মানুষ। কিচ্ছু পারিনা। এখন আর আমন্ত্রণ বাতিল করার সময় বা সুযোগ কোনোটাই নেই।
অগত্যা কাজে হাত লাগালাম।চার পিস টোস্ট বানালাম। এটা পারি। দুটো মুরগির ডিম সহ পেঁয়াজকুচি,টোম্যাটো ও চিলি সস দিয়ে ওমলেট বানালাম। চানাচুর ও বিস্কুট ছিল। ভেজিটেবল চপ আনিয়ে নিলাম। ফ্রিজে গুড়ের পায়েস আছে। কফি বানিয়ে নিতে পারব।
এইবার নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করা যায়।

একদিন এই লোকটাকে আমার দেখা দরকার ছিল। ওকি সত্যিকারের মানুষ না একজন অলৌকিক কবি?ওর কবিতা পড়লে গা শিরশির করে।কেন?

এখনও আসছে না তাই নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলি :যদি দ্যাখো,জানলার শিক দিয়ে গলা বাড়িয়ে অবয়বহীন কোনো আগন্তুক তোমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,ভয় পেয়োনা। তোমার সবচেয়ে প্রিয় বইটার ওপর একবার হাত রাখো।
কোনো প্রিয়জনের দিকে ভুলেও তাকিও না,দীর্ঘশ্বাস যেন তাকে স্পর্শ না করতে পারে।

ভুলে যাও আজকের দিনে কী হয়েছিল বা কী হয়নি।আকাশি রঙের বুশশার্ট,খয়েরি ট্রাউজার্স আর
কালো রোদচশমা পরে বেরিয়ে এসো আগন্তুকের পিছু পিছু।তাকিয়ে দ্যাখো, বসন্ত কি মহা সমারোহে ফুটে উঠেছে চারপাশে। অথচ দ্যাখো এ বিচিত্র পৃথিবী তোমার পদছাপ নিতে অপারগ।
দুএকটি রাস্তার কুকুর চিৎকার করে এগিয়ে এসেও কী জাদুবলে থমকে যাবে।

দেখতে পাবে তোমার আসন্ন বই ও পুরনো ফোটোগ্রাফের ওপর কয়েকটি বাসি ফুল আর শত্রুদের হাহাকার পড়ে আছে। শুধু তোমার সেই প্রিয় বইটা শেলফে নেই। হারিয়ে গেছে না চুরি হয়েছে কেউ খোঁজ করেনি।
আলির কবিতা পড়ে আমার যা হয়েছিল লেখার চেষ্টা করলাম।আলি কবি আসবে বলেও আসেনি। আমার ভুল হয়েছিল।আলি কোথাও আসেনা।সে একজন আগন্তক এবং আমার কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী।
কিন্তু আমার প্রিয় বইটা শেলফ থেকে কোথায় হারিয়ে গেল? যেটা ছাড়া আমি এক লাইনও লিখতে পারি না।
সেই বইচোরকে আমি চিনিনা। আপনি চেনেন?
0

কবিতা - রঞ্জন ঘোষ দস্তিদার

Posted in




















শূন্যতা তুই কোথায় ছিলি বল?
কোথায় ছিলি সেইক্ষণের ও আগে
দূর অতীতে প্রথম শুরুর দিনে
কার গর্ভে সম্ভাবনা হয়ে
আমি যেমন ছিলাম মায়ের সাথে।

এমনি দিনে আলো দেখার পরে
তোরই মতন শুধু বেড়ে চলা
অধরাকে ধরার চেষ্টা করা।
যতই ধরি "অধরা" ঠিক থাকে
সময় যেমন সদাই আগে আগে।

শূন্যতা তোর ব্যাপ্তি কতদূর ?
অন্তহীন ওই রেখাটির মাঝে ?
নাকি, অতি বাদে অসীম যতদূর ?
এখন আমি আরও কাছাকাছি
মাঝে থেকেও হাত বাড়িয়ে আছি ।

বোধ, কথা, আর গান, কান্না শেষে
আলো আঁধার যে সীমানায় মেশে,
যে কালের ঘোড়া ছুটত আগে আগে
তাকে এবার আনব আমার বশে
অসীম শূন্যে সেই সীমাতে এসে।
0

কবিতা - আশীষ কুমার বিশ্বাস

Posted in




















মৃতদেহ ফেলে রেখে
যাচ্ছি ছুটে অন্য দেশে
মারছি সেথায় আরও মানুষ
অন্য ভাবে , অন্য বেশে ।

মৃত্যু যেন খোলামকুচি
করছি বেশ কচুকাটা
জাত পাতের দোহাই দিয়ে
সাজছি আমি আচ্ছা বেটা !

উত্তরণের এই জগতে
অন্ধকার ডাকছি মনে
বিশ্ব জুড়ে যুদ্ধ মানব
হুঙ্কার দেয় ক্ষণে ক্ষণে ।

প্রিয়জনের ছিন্ন দেহ
ছড়িয়ে পড়ছে ভিন্ন ভিন্ন
জেহাদীরা করছে উল্লাস
উগ্রপন্থী বলছে ধন্য ।

বুদ্ধ , যিশু , শ্রীচৈতন্য
লুপ্ত জরথ্রুস্ট , লুপ্ত মহাম্মদ
এই ভাবেই চলতে থাকলে
ঘনিয়ে আসবে বিরাট বিপদ ।
0

কবিতা - অমিতাভ মুখার্জী

Posted in




















ঘনাদা তুমি চুপ করে আছো
তোমার মনে শান্তি অটুট থাকে
চক্রব্যূহে অভিমন্যুর মৃত্যুর পরেও
শান্তির স্মারক লিপি লেখা আছে
তোমারই আচরণে

অভিমন্যুর মৃত্যুতে
ওরা সন্ধ্যা আরতির মন্ত্র পড়তে থাকে
ওঁ, নারায়ণ যা হবে এবং তাই হয়েছে

ঘনাদা তোমার চুপ করে
বসে থাকা উচিত
ওই শামিয়ানার নিচে
যে শান্তি ধরে রাখা আছে
তাইই থাকুক ওইখানে

যা নিজের কাছে ঠিক মনে হয়নি
তুমি এতদিনে তা নিয়ে বলতে পারোনি
বা কিছু করে দেখাতে পারোনি

এখন তুমি প্রশ্ন তুলেছো
ওদের আনুগত্য দেখে
যোদ্ধার মতো

এখন আর মানতে না পেরে
তুমি বিড়বিড় করে বলছো
ওহে তোমরা থামো
তোমাদের অন্য গাল জিভকে
চেপে ধরেছে

ঘনাদা ওদের দেওয়া নেওয়ার
কাগজটা একটা সাদা কাগজে ঠেকেছে
স্ক্যালপেলটা সামনে রাখো
কাটতে থাকো ওদের দেওয়া নেওয়াকে

ঘনাদা তোমার শান্তিপ্রিয়ের গর্বটা
গিলে ফেলো
তারা কখনই
তোমাকে খারাপ বলবে না
তারা পছন্দ করে না ওই তোমার গর্বকে
ওরা তোমাকে ছেড়ে দেবে না

তুমি ওদেরকে চা-বিস্কুট খাইয়ে
বার করে দাওনি, বসতে দিয়েছিলে

ঘনাদা
তোমার নামে
তোমার সম্পর্কে
সত্তর হাজারের বেশী মিথ্যে
কথা বলছে ওরা

চক্রব্যূহে অভিমন্যুর যাওয়ার সময়
ওকেও শুনতে হয়েছে একই
মিথ্যে কথা
তারা গুণতে ভুল করেনি
বা কখনো বিরতিও নেয়নি

তারা যে তালিকা তৈরি করেছিল
এক এক করে ওদের
সম্বন্ধে যে খবর যোগাড় করেছিল
তুমি তা ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছো

ঘনাদা স্ক্যালপেলটা হাতে তুলে নাও

তোমার কাছ থেকে তারা অনেক
কথা শুনেছে
আর তোমার কথা শুনতে চায় না
তোমার গানও আর গাইতে চায় না

অবশেষে
ঘনাদা তুমি গিলেছো শান্তির গর্ব
যুদ্ধে যাওয়ার জন্য তুমি মনে মনে
তৈরি হয়েছো অভিমন্যুর মতো

তোমার হাতে অভিমন্যুর অস্ত্রগুলো
তুলে দিয়েছে
আর অনেক কিছু বাকি আছে ঘনাদা

শান্তির গর্ব ছেড়ে
এই যুদ্ধে তুমি যাবে
চক্রব্যূহে থেকে বেরিয়ে আসতে হবেই
ঘনাদা তুমি দাঁড়িয়ে উঠো।
0

কবিতা - সব্যসাচী রায়

Posted in




















২৬ নম্বর গলির খুন

লাল, লাল, লাল—
পায়ের কাছে ঝুলে
বাদামি, বাদামি, বাদামি
অন্ধকার চামড়া।

মাথা কাত?
চোখের ইশারা?
একটি দৃষ্টি, এক বিনিময়—
না?

হুঁশ! রাত।
রাতপাখি ডাকে।

লাল, লাল, লাল—
ছিটকে পড়ে
বাদামি, বাদামি, বাদামি
অন্ধকার চামড়ায়।


বিপরীত যুক্তি

ফিকে আকাশের নিচে জন্ম— প্রকৃতির রসিকতার উত্তরাধিকার। রক্তের ভেতর মিশে থাকে মিষ্টি বিষ,
পতনশীল পাতারা অক্ষরে গাঁথে ভাঙা কবিতা। শকুনের মতো তীক্ষ্ণ ডানা মেলে উড়ি, পরিত্যক্ত হতে হতে বংশলতিকা হারিয়ে ফেলে। বৃক্ষহীন স্বপ্নের বনে হারিয়ে যাই প্রতিধ্বনির ভেতর, প্রতিটি কান্না যেন এক বিষাক্ত ইতিহাস- অপূর্ণতার রক্ত। একটি ছেঁড়া আত্মার পাশে লেখা টীকা: কফির দাগে মোড়ানো প্রান্তে লিখি গান, সিনেমার সংলাপ, পরিত্যক্ত স্বপ্ন। ডায়েরিটা ব্যর্থ মীম? একদিন ভাবতাম শব্দে পূর্ণ হবে শূন্যতা— ওটাকে আঁকড়ে ধরা ছিল ঝড়ে উড়তে থাকা কাগজের মতো। এখন প্রতিটি কমা টেনে নেয় ভুলে যাওয়া, অর্ধেক স্মৃতির দিকে। একটা বাজারের তালিকা, হয়ে যায় নৈরাজ্যের অঙ্গীকার, আশার শেষ টুকরো উড়ছে তার ফাঁকে ফাঁকে। একবার মধ্যরাতে বসে ছিলাম— নিজের হাতের লেখায় হারিয়ে যেতে যেতে বুঝলাম, বিশ্ব আসলে পরোয়া করে না।


ম্লান ছায়ার প্রাসাদ

একদিন আয়নার রাজ্য গড়েছিলাম,
তারারাও ভেঙে পড়েছিল সেখানে—
ভুলে যাওয়া প্রতিশ্রুতির মতো।
সিংহাসন ছিল বাঁকা হাসি,
নিয়ন চাঁদের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছায়া।
কলামগুলো ছিল পুরাণের গল্প,
যা ভেঙে পড়ে, একটা ব্যর্থ স্বপ্নের মতো।
গৌরব এখানে কেবলই বিদ্রূপের প্রতিচ্ছবি,
নক্ষত্রেরা কপালে বসে ঠাট্টা করে।

একদিন নিজেই নিজের রাজ্য ছিলাম—
শুধু জানতে পারিনি, আমার মুকুটটাই ছিল একটা ব্যঙ্গ।


পরমাণু তিমি

একটা সংবাদ শিরোনাম দেখলাম,
যেন খারাপ স্বপ্নের মতো—
পরমাণুর তিমিরা সাঁতার কাটছে বিশৃঙ্খলার গভীরে।
আমরা বেঁচে আছি ধার করা সময়ের ওপর,
ভাগ্যের ছেঁড়া পাতায় লিখিত একটা ছোট ভুল।
ক্ষমতার জাদুকরেরা তাদের কারসাজি চালিয়ে যাচ্ছে,
একটা সার্কাস,
যেখানে বড় বড় কথারা ভেঙে পড়ে,
রাতের মীম হয়ে যায়।
একটা সস্তা বিয়ার চুমুক দিই, মাথা নাড়াই,
ভাবি


অচেনা মুখ: অস্থিরতার আয়না

জানো না তুমিই লক্ষ্যবিন্দু
নিঃসঙ্গ এক ছায়া দাঁড়িয়ে থাকে
শীতের বাতাসে কাঁপে চোখের পাতা
মুহূর্তটা পুরোটাই আমাদের
একটা খেলা, কিছুটা লোভ
আর শরীরের বোবা কৌতূহল
ভোর হতেই হয়তো শেষ হবে
কারণ শরীর প্রেম বোঝে না
প্রত্যেক স্পর্শের সহযাত্রী হতে পারে ভালোবাসা?
0

ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

Posted in






প্লাম চাটনি

বেশ কয়েকটা পাকা প্লাম, সাত আটটা খেজুর, এক মুঠো কিশমিশ, সামান‍্য তেল, শুকনো লঙ্কা, সর্ষে, মৌরী, মেথি, একচিমটে নুন, স্বাদ অনুযায়ী চিনি।

বীজ বাদ দিয়ে, প্লাম টুকরো করে নিতে হবে। সামান‍্য তেল গরম করে, শুকনো লঙ্কা, সর্ষে, মৌরী, মেথি ফোড়ন দিয়ে কেটে রাখা প্লামগুলি দিয়ে এক চিমটি নুন দিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে সেদ্ধ হতে দিতে হবে। প্রয়োজনে সামান‍্য জল দেওয়া যেতে পারে। আঁচ কমিয়ে, ঢাকা দিয়ে রান্না করলে প্লাম থেকেই প্রয়োজনীয় জল বেরিয়ে আসবে। প্লাম বেশ নরম হয়ে এলে পর, কেটে ধুয়ে রাখা খেজুর আর কিশমিশ দিয়ে রান্না করতে হবে। এরপর একটু চেখে দেখে নিয়ে যদি চিনি দিতে ইচ্ছে হয় দেওয়া যেতে পারে। তবে, প্লাম, খেজুর আর কিশমিশ মিলে বেশ সুন্দর টকমিষ্টি স্বাদ হয়ে যায়, চিনি ছাড়াই।

সামান‍্য ভাজা মশলার গুঁড়ো বা শুধু মৌরী গুঁড়ো ছড়িয়ে নেওয়া যেতে পারে। গরম কমে গেলে শেষ পাতে পরিবেশন।


0

সম্পাদকীয়

Posted in



































এক সম্রাট মাটির তলায় ঘুমিয়ে ছিলেন অনেক শতাব্দী জুড়ে। তাঁর সময়ে তিনি বিতর্কিত। মৃত্যুর বহু বছর পর আবার তাঁর রাজত্বে ঘটে যাওয়া কর্মকাণ্ড আতশকাচের তলায়।

এই ঘটনাক্রম আমাদের খুব চেনা। এসবের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ঘটনাবলী এই উপমহাদেশের বাসিন্দাদের প্রজন্মসঙ্গী। পরাধীনত্বের তকমা ঘুচিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু দ্বিজাতি তত্ত্বের 'সফল' প্রয়োগ জন্ম দিয়েছিল দুটি ভিন্ন রাষ্ট্রের। সেই বিষবৃক্ষটি রোপণে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের অনেকেই ছিলেন স্বাধীনতার জন্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সেনানী।

'সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।' স্বাধীনতার প্রায় আশি বছর অতিক্রান্ত। এখনও আমরা অর্জন করতে পারিনি সেই কাঙ্খিত পরিণতিবোধ, যা আমাদের জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনের দিকে অনেকটাই এগিয়ে দিতে পারত। কোনও একটি চলচ্চিত্র বা সাহিত্যকর্ম এখনও আমাদের আবেগকে এতটাই বিপথগামী করতে পারে, যার মূল্য দিতে হয় আমজনতাকে। এমন উদাহরণ ভুরিভুরি।

সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ছবির কিছু দৃশ্য হঠাৎই যেন ঘুমন্ত বারুদের স্তূপে অগ্নিসংযোগ করল। অশান্তির আঁচ লাগল এমন অনেক মানুষের গায়ে, ইতিহাসের ওই পর্বের সঙ্গে সুদূরতম যোগাযোগও যাঁদের নেই। যাঁরা সঠিকভাবে জানেনও না ঠিক কী ঘটেছিল। আর যাঁরা আগুন লাগালেন তাঁরা? তাঁরা ইতিহাসের এমন গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি সম্পর্কে কতটা অবগত আছেন? পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের দূরভিসন্ধি থেকে যে মন্তব্যগুলি করছেন, সেগুলি আরও কতবড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে, তা কি মুহূর্তের জন্যও ভেবে দেখেছেন? তাঁরা সম্ভবত ভুলে গেছেন যে 'ইতিহাস' শব্দটির সত্যতা নিহিত আছে এটির অপরিবর্তনশীল রূপের মধ্যেই। ভালো বা মন্দ, সেটি যেমন, সেভাবেই তাকে গ্রহণ করতে হয়। যা প্রকৃত শিক্ষা আর পরিণতিবোধের পরিচায়ক।

সুস্থ থাকুন। সতর্ক থাকুন।

শুভেচ্ছা নিরন্তর।
1

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - স্মৃতিকণা সামন্ত

Posted in








আকাশে সেদিন জল টসটস মেঘ। সরোবরের জল মেঘের ছায়ায় গভীর কালো। পদ্মবনে নীল আলো ফেলে ভোর আসছে। মহাদেব ডুব দিলেন। পরপর তিনটি। ভোরের সূর্যের দিকে তাকিয়ে প্রথম অঞ্জলিটি ঢেলে দিলেন জলে। মেঘমন্দ্র স্বরে গুড়গুড় গমগম করে উঠল চারপাশ। আকাশে কড়াৎ কড় বাজ, রুদ্রবীণায় বেজে উঠল ভৈরবী সুর। তাঁর মেঘের মত জটায় উথালপাথাল পদ্মবন, দিশেহারা ভ্রমরের দল। চুলে লেগে রইল কয়েকটি বৃন্তচ্যুত পদ্মকলি। মহাদেব ফুলগুলি নিয়ে এলেন দেবী পার্বতীর পুজোঘরে। দেবী তখন ধ্যানমগ্না। হেমবর্ণ আলো এসে পড়েছে তাঁর মুখে। কপালে জ্বল জ্বল করছে কুমকুমের ফোঁটা। ভোর হচ্ছে চরাচর জুড়ে। দেবী ফুলের সাজিটি টেনে নিলেন। উঠে এল ফুটফুটে এক মেয়ে। কে তুমি!

"মনসা, শঙ্কর নন্দিনী।"

বিষে ভরে গেল আকাশ পাতাল।ঝিকিয়ে উঠল কাল নাগিনীর ফণা। দেবীর মনের বিষে অধিষ্ঠান হল বিষের দেবী, সাপের দেবী মনসার।

মনসা জন্মের এ গল্প বিহারের। এই গল্পই একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাঙালির মনসামঙ্গলে। কিন্তু এমন এক সর্পদেবীর জন্ম নিছক মহাদেবের ফুলের সাজিতে হয়না। দেবী জন্মাতে থাকেন মনে মনে, তলে তলে। হাজার হাজার বছরের মানুষী স্রোতের গভীরে। মনসার উৎস খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হয় সময়ের পথে হাজার হাজার মাইল। পৃথিবীর তখন সদ্য কৈশোর। মানুষের দল চলে যাচ্ছে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে । "আ কন্টিনিউয়াস মুভমেন্ট অফ হিউম্যান রেসেস" তখন জল জমিনের খোঁজে। আদি অস্ট্রালয়েড, অ্যালপো দিনারীয়, নর্ডিক কত না গোষ্ঠী, দলকে দল ছড়িয়ে পড়েছে পারস্য,ইরান, ইউরোপ, এশিয়ার মাঠে মাঠে।

কত তো মানুষ এসেছে গেছে, ধুলোর পায়ে পায়ে...

ভারতবর্ষে আর্যরা এসেছিল আলাদা আলাদা দুটি বড় দলে বেশ কিছু সময়ের আগে পরে। তারও অনেক আগে এসে গেছে তুরানি মানুষ। তুরানি মানুষ ছড়িয়ে গেছে সারা পৃথিবীতেই। সঙ্গে নিয়ে গেছে তাদের জীবন , যাপন। মিশে গেছে সে দেশের ছায়ায় মায়ায়।

ঐতিহাসিক ফার্গুসন বলছেন পৃথিবীজোড়া সর্পপূজার চল হয়েছে তুরানিদের থেকেই। যেখানে যেখানে তারা পা রেখেছে সেইসব দেশেই পাওয়া গেছে জ্যান্ত সাপের পুজো করার রীতি। সেই কবে টোটেম জমানা থেকেই পশু পুজোর চল মানুষের পাড়ায় পাড়ায়। কুমির, বাঁদর, হাতি, কচ্ছপ, ভাল্লুক, বাঘ আরও কত কী । কিন্তু সাপ? দেশে দেশে সাপ ছিল শয়তানের ভূমিকায়। শয়তান থেকে দেবত্বে উঠে আসার এই রাস্তাটা সহজ ছিল খুব?

বেদে বা বেদের পরে মহাভারত কিম্বা প্রথমদিকের পুরাণগুলোতে কোথাও সর্পপূজার কথা নেই। তারও পরে বিভিন্ন উপপুরাণ , দেবী ভাগবত, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ইত্যাদিতে সাপের দেবী হিসেবে মনসার নাম পাওয়া যায়। জায়গায় জায়গায় সাপের ঘর। গুহার ভেতর দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছে কারা? কাদের ঘরে ঘরে বিষের আড়ৎ? খুঁজতে খুঁজতে পায়ে পায়ে চষে ফেলতে হয় দীনদুনিয়ার আদাড়বাদাড়–ব্যাবিলন থেকে রোম, ইংল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়া। ব্যাবিলনীয়,আসিরিয়, সুমেরীয়দের ঘরে ঘরে সাপের বেদী। বেদীতে নাগ দেবতার চাষ। মিশরের স্থাপত্যে সাপ ছিল বড় পবিত্র । মনে পড়ে সেই আলেকজান্ডারের কথা? তার বাবা ফিলিপ নিজে রাজ্যে বলে বেড়ালেন আলেকজান্ডারের বাবা নাকি কোন এক সাপ।

যেদিন খান্ডব বন পুড়িয়ে বনভোজন করছিলেন কৃষ্ণ,অর্জুন সেদিন সেই দাউদাউ বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল তক্ষক নাগ–জোড়হাত, নত মস্তক। আগুনে না পুড়িয়ে তাকে সপরিবার বন ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দিল কৃষ্ণ। চিরঋণী হয়ে রইল নাগ। যেদিন মহাভারত লেখা হচ্ছিল সেদিন নাগ শব্দের ব্যবহার সাপ অর্থে করা হতনা। নাগ ছিল সম্ভবতঃ সাপ টোটেমের এক উপজাতি। কশ্যপ মুনির স্ত্রী কদ্রু নাগদের আদিমাতা। বাসুকি, অনন্ত, শেষ নানান বিখ্যাত নাগের দলে মেয়েটি অজ্ঞাতনামা, জরৎকারু। জরৎকারুর বিয়ে হয়ে গেল জরৎকারু মুনির সাথে, কুটির আলো করে সন্তান জন্ম হল। আস্তিক। এতদিনে একটা বলার মতো পরিচয় পেল মেয়েটি "আস্তিকস্য মুনির্মতা"! কিন্তু তারপর? তারপর মেয়েটি হারিয়ে গেল অন্ধকারে। স্বামী পরিত্যক্তা, ভাই বাসুকির সাম্রাজ্যে মেয়েটি বেঁচে রইল নামহীন খ্যাতিহীন অস্তিত্বের মতো।

খান্ডব বন থেকে বেঁচে ফেরা তক্ষক নাগের রাজ্য দেখতে দেখতে তক্ষশিলা। আবারও ফার্গুসন বললেন, এই তক্ষশীলা আদতে এক নাগরাজ্য। তথাগত বুদ্ধ তখন ছড়িয়ে যাচ্ছেন জলে। পাহাড় ছাড়িয়ে, গিরিপথ পেরিয়ে দূরে, আরো দূরে। বোধিবৃক্ষের বেদীটিতে তখন পুণ্য আয়োজন। সাঁচি আর অমরাবতীর স্তূপের গায়ে গায়ে সেইসব বৃক্ষপূজা, চক্রপূজার স্মৃতি। পাঁচমাথাওয়ালা নাগের ছবি ফিরে এসেছে বারে বারে। হিন্দু পুরুষ, নারী ছাড়াও যাদের পোশাকআশাক খানিক আলাদা, যারা চেহারায় ঠিক আর্যসুলভ নয়, বরং তারও আগের সময়ের লোকজনের মতো তাদের ফার্গুসন বললেন তক্ষক কিম্বা দস্যু। তারা থাকে অরণ্যের আড়ালে, গাছের ছায়ায়। শহর থেকে দূরে তাদের ঘর। ঘরের ভেতর সাপের ঝাঁপি, সদর দুয়ারে আগুন মশাল। দেশের রাজা যায় দস্যু সন্দর্শনে ।

আগুন আর সাপের উপাসনা আসলেই সূর্য উপাসনার প্রতীক কিনা সে কথা বলবেন পণ্ডিত। কিন্তু ঋকবেদে দশম মণ্ডলের সর্পরাজ্ঞী সূক্তে বাক বিজ্ঞানের আলোচনায়, এবং তৃতীয় মণ্ডলের ঋষি বিশ্বামিত্র সূর্যরশ্মির ভেতরের কাঁপনের প্রকৃতিকে নাম দিয়েছেন "সসর্পরী বাক" ।

বাক সেই শুদ্ধতম প্রকাশের একক যার আলোয় আলোময় হয়ে ওঠে মানুষের নৈর্ব্যক্তিক আত্মা । আর সাপের কামড়ে চিকিৎসা এমন এক বিদ্যা যার নামে অথর্ব বেদে আলাদা এক শাখাই তৈরি হয়ে যায় ধীরে ধীরে। সেইসব প্রাচীন দিনে যখন ঠান্ডা দেশের মানুষ আর্যরা ধীরে ধীরে পরিচিত হচ্ছে ভারতের উষ্ণ জলবায়ু আর সাপের বিভিন্ন প্রজাতির সাথে, ততই সাপ হয়ে উঠছে এক ভয়ানক অস্তিত্ব। মহাভারতে ঘৃতাচি নামের শূদ্র মেয়েটি ছিল সর্পবেদে বিশারদ। এই ঘৃতাচীই মনসার প্রথম প্রতিচ্ছবি। বাগদেবী সরস্বতীর হাতে প্রথমদিকে ছিল বীণা আর সাপ। আভিজাত আর্যরা পরে অনার্যদের সাপকে সরিয়ে বেদ দিয়েছে সরস্বতীর হাতে। সেকালে বেদ বিশারদ হতে হলে সর্পবেদের জ্ঞান থাকা ছিল প্রথম শর্ত।

গাঙ্গুরের জলে কলার মান্দাস ভাসাল যে একলা মেয়েটি,ভেসে গেল ঠিকানাহীন নিরুদ্দেশ সেই কি কবির হৃদয়ে গান হয়ে উঠল না কি সেই মানুষটি যে শত বিপণ্নতার প্রেক্ষাপটেও নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল সে হঠাৎ অন্ধকার ঠেলে সব মানুষের হয়ে গান গেয়ে উঠল?

কাব্য আসলে হাঁটাপথ বেয়ে জীবনেরই কথা বলে। বাংলার নিজস্ব সাহিত্যচর্চার একেবারে প্রথম ধাপটিতেই লেখা মঙ্গলকাব্য-কথা। এ সেই সেদিনের কথা যেদিন জলাজঙ্গলে ঢাকা বাংলার কালো মানুষগুলো আর্য-ভারতের কাছে ব্রাত্য ছিল,জীবন বয়ে যেত তিরতিরে স্রোতে নিজস্ব ধারায়,মানুষ বাঁচত মাটির ছন্দে।

আবহাওয়ার নিয়মেই এ জায়গা সাপের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। সেই কোন আদিম সময় থেকে অরণ্যচারী মানুষ ভয় পেতে শিখেছে এই সরীসৃপটিকে,ধীরে ধীরে তার উপরই আরোপ করেছে দেবত্ব, পুজো করেছে,দয়া প্রার্থনা করেছে।

মনসা,বাংলার সর্পদেবী। ইতিহাসের ধুলো সরিয়ে এই দেবীর যাত্রাপথ খুঁজবো আমরা।

সেই কোন ভুলে যাওয়া অতীতে ইউফ্রেটিস নদীর ধারে থাকত তুরানী উপজাতি,তারা ছিল সর্প উপাসক। একসময় তারা এদেশের পশ্চিমসীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ল সিন্ধুনদের তীরে,ঘর বানাল,চাষ করল সঙ্গে আনল তাদের উপাস্যকেও। এরাই দ্রাবিড়দের আদিপুরুষ। সিন্ধুনদের তীরে হরপ্পা আর মহেঞ্জদরোতে এদেরই সর্প দেবতার মূর্তি পাওয়া গেছে। এখনো বালুচিস্তানে ব্রুহাই ভাষী দ্রাবিড়রা রয়েছে। ভারত ছাড়া আরো যে যে দেশে তারা গেছে যেমন গ্রিস স্ক্যান্ডানেভিয়া ইত্যাদি জায়গাতেও সর্পপূজার প্রথা এরাই বয়ে নিয়ে গেছে।

এই তুরানী দ্রাবিড়রাই পরে আর্যদের কাছে হেরে গিয়ে সরে যায় দাক্ষিণাত্যের দিকে। বাকিরা চলে যায় পূর্বদিকে আসাম ,ত্রিপুরা,বাংলায়।সেখানে কখনো অস্ট্রালয়েড কখনো বা মোঙ্গলদের সাথে মিশে তৈরি হতে থাকে এক মিশ্র জাতির।

আজকের মনসা আসলে দ্রাবিড় বৌদ্ধ আর ব্রাহ্মণ্য তিন ধারার মিশেলে পাওয়া এক দেবী। বৌদ্ধ মহাযানদের তন্ত্রমতে জাঙ্গুলি নামে এক দেবী পাওয়া যায়। তিনি শুক্লবর্ণ,শুক্ল অলঙ্কার শোভিতা,বীণাবাদিনী,কোথাও বা ময়ূরপালক হাতে লেখনীর প্রতীক হিসেবে। সেই হিসাবে সরস্বতীর সাথে মিল প্রচুর। এঁরই একহাতে সাপ।

যজুর্বেদে সঙ্গীতের মতো সর্পবিদ্যারও কথা বলা আছে। আবার সরস্বতীকে বলা হয়েছে বিষনাশিনীও। অথর্ববেদে সর্পবেদ আর সর্পবিদ্যা নামে দুই শাস্ত্রের কথাও আছে। তাহলে বলাই যায় এই জাঙ্গুলিতারা আর সরস্বতী প্রায় একই।

আর্য সমাজে স্ত্রীদেবতার পুজোর চল ছিলনা। কিন্তু চন্ডী, কালি ইত্যাদি লৌকিক দেবীর মত মনসারও পৌরাণিক পরিচিতি পাবার কারণ মনে হয় এ দেশের প্রবল সংস্কারের প্রভাব,সাথে সর্পভীতি। শীতের দেশে সাপের উপস্থিতি কম,তুলনায় ভারতের উষ্ণ ভেজা আবহাওয়া সাপের পক্ষে অনুকূল এবং তার ছাপ পড়ে সমাজ ও লোকাচারেও।

তবুও খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর আগে সর্পদেবী হিসাবে মনসার গুরুত্ব সেভাবে পৌরাণিক সাহিত্যে জায়গা পায়নি। প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ এবং দেবীভাগবতে।কাজেই ইতিহাসের নিয়মে হয়ত তারও বেশকিছু আগে প্রায় দশম একাদশ শতাব্দীতে মনসাপূজা আর্য সমাজেও চালু ছিল।

পাশাপাশি দক্ষিণাত্যে মুদমা, মঞ্চাম্মা ইত্যাদি নামের সর্পদেবীর খোঁজ পাওয়া যায়।মঞ্চাম্মা এক ধরনের সাপ। তাতে দেবত্ব আরোপ করে পুজো করেন দুএকটি আদিবাসী গোষ্ঠী। মুদমা মূর্তি মহীশুরে ব্যাপক হারে পাওয়া গেছে মন্দির ভাস্কর্যেও। বাংলার বর্তমান মনসা সম্ভবতঃ পৌরাণিক দেবী সরস্বতী,জাঙ্গুলিতারা ও মুদমার মিলিত রূপ।

প্রাচীন মনসামূর্তির নমুনা হিসেবে পাওয়া গেছে বীরভূমের পাইকোড়ে, সেন বংশের প্রথম রাজা বিজয়সেনের তৈরি মূর্তিটি।সেন রাজারা দক্ষিণাত্য থেকেই এখানে এসে রাজত্ব করেছিলেন। সেক্ষেত্রে রাজার সাথে দক্ষিণভারতীয় বিশ্বাস ও লোকাচার বাংলায় আসাই স্বাভাবিক,এবং তা সহজেই মিশেও গেছে বাংলার দ্রাবিড় সংস্কারের সাথে। সমাজতাত্বিকের ধারণা যদি কোনো সংস্কার বা প্রথা অন্য সমাজে গিয়ে সহজেই মিশে যেতে পারে তবে বুঝতে হবে সেই প্রথা ওই সমাজেও প্রচ্ছন্নভাবে বহমান ছিল। এক্ষেত্রেও আদতে দুই দ্রাবিড় সংস্কৃতির মূলগত বনিবনা সহজেই হয়েছে এবং সর্পদেবীর পূজা বাংলায় হাজার বছরেরও প্রাচীন সংস্কার বলেই প্রমাণ হয়।

'মনসা' নামের উৎপত্তি কিন্তু সঠিক বলা মুশকিল। মহাভারত বলছে জরৎকারু কাশ্যপের মানসকন্যা,শিবের শিষ্যা। বাসুকির বোন। চতুর্বেদ বিশারদ।জরৎকারু মুনির স্ত্রী। অস্তিকের মাতা। আস্তিকের কৃতিত্ব হল জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞের সময় নাগকুলকে রক্ষা করা।

মনে করা হয় অনার্য মনসা চরিত্রে আভিজাত্য যোগের উদ্দেশ্যই মনসা এবং জরৎকারু এক ও অভিন্ন করে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে পরবর্তী সময়ে,যদিও মহাভারতে মনসা নামের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়না এবং জরৎকারু চরিত্রেও দেবত্ব আরোপিত হয়নি।

আবার অন্যদলের পন্ডিতরা বলছেন মনচা আম্মা―> মনসা মা উৎপত্তি হতে পারে। দক্ষিণী ভাষায় চ এর উচ্চারণ প্রায় স এর মতো। তবে এমতও স্থিরভাবে বলা মুশকিল। চেংমুড় হল তেলেগু ভাষায় ফনীমনসা গাছ। ফনীমনসা গাছের নিচেই মনসাপুজো হয় বাংলায়। চাঁদ সদাগর মনসাকে বলেছেন চেংমুড়ী কানী। অথচ চেংমুড়ী শব্দের কিন্তু কোনো বাংলা প্রয়োগ নেই। তাহলে এমনও ভাবা যেতে পারে এটি আদতে দক্ষিণী শব্দ।

পাণিনি বা অমরকোষে মনসা শব্দের উল্লেখ নেই,কাজেই বলাই যায় যে আদতে এটি কোনো অনার্য শব্দ সংস্কৃত ভাষার প্রভাবে রূপান্তরিত হয়ে এই নাম এসেছে।

এইসব জটিল বিবর্তনের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ঢুকে পড়ব মঙ্গলকাব্যের যুগে। পন্ডিতেরা বলছেন মনসামঙ্গল কাব্যের জন্ম মোটামুটি দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতাব্দী এবং তার অন্ততঃ দেড়শ বা দুশ বছরের আগে মনসাপুজোর রীতি চালু হয়।

সেসময় মনসা বন্দনার গান ছোট ছোট পালায় গাওয়া হত,কোনো লিখিত রূপ ছিলনা।

খন্ডে খণ্ডে ছড়িয়ে থাকা এইসব গান ও গল্প পরম্পরাকে একসময় পুঁথিবদ্ধ করলেন কোনো কবি,সেদিন থেকেই মনসামঙ্গল কাব্যের যাত্রা শুরু।

যদিও দ্বাদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত সমস্ত লেখকই তাঁদের রচনাকে মনসা পাঁচালী নামেই পরিচয় দিয়েছেন। প্রথম কবি হিসেবে নাম পাওয়া যায় কানা হরিদত্তের।তারপর একেএকে বিজয়গুপ্ত,নারায়ণ দেব,ষষ্ঠীধর,বিপ্রদাস,দ্বিজবংশীদাস কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ এবং আরো অনেকেই লেখেন এই মনসাপাঁচালী।

এইসব গল্পের অভিনবত্ব তেমন হয়তো নেই, এবং অনেকখানিই পুরাণের গল্পনির্ভর হলেও যা নিজস্ব তা হল চাঁদ সদাগরের গল্প। এ গল্পের হদিস নেই পুরাণে। চাঁদ আসলে মঙ্গলকাব্যের নিজস্ব চরিত্র।

এ গল্পও সেই সময়ের যখন ব্রাহ্মণ্য মাহাত্ম্য ভারী করে তোলেনি মানুষের বিশ্বাস ও লোকাচার। সমস্ত গল্পের কোথাও ব্রাহ্মণ চরিত্রের হদিস নেই।

চরিত্রের নামকরণ খেয়াল করলেও তা স্পষ্ট। চাঁদ, সোনেকা, বেহুলা, লখিন্দর , সাহো, হরিসাধু এসবই অনার্য নাম।

সমাজের মাথা তখন বণিকগোষ্ঠী। ধনী বণিক চাঁদ সমাজপতি। এ গল্পে দেব চরিত্রের চেয়ে মানবচরিত্রই প্রাধান্য পেয়েছে,মাহাত্ম্যও মানুষেরই। দেবচরিত্র নেহাতই পূজার ভিক্ষাপ্রার্থী,তাই নিয়েই গল্পের অলিগলি।

মঙ্গলকাব্য হিসাবে মনসামঙ্গলের জনপ্রিয়তার কারণও বুঝি তাই। এ মানুষের নিত্যকার সুখদুঃখ চাওয়া পাওয়ার গল্প। সোনেকার চরিত্রটি যে কোনো মাঝবয়সী মহিলার রোজনামচা।ইতিহাসের হিসাবে সেসময় বাংলায় এসেছে মুসলমান শাসক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিড়ম্বনায় মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে চারিত্রিক আদর্শ। চাঁদ সেই আদর্শের প্রতীক। তুলনায় ব্যতিক্রমী বেহুলা। বঙ্গনারীর তুলনায় সে অনেকবেশী স্বাধীনচেতা, সাবলীল ও সাহসী। স্বর্গের সভায় তার নৃত্য প্রদর্শনের নমুনাও বাংলার সমাজে বিরল। এই নৃত্যবিদ্যা দক্ষিণের মন্দিরে সুপ্রচলিত। দেবদাসী সেই প্রথার নাম। সে হিসাবে অনেকে এই গল্পকে দক্ষিণের গল্প বলেও মনে করেন। তবে কি এই গল্পের চরিত্রেরা বাস্তবে কোথাও ছিল?

দুই বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ,বিহার আসাম ত্রিপুরায় চাঁদের বাড়ি,লখিন্দরের বাসর,নেতি ধোপানীর ঘাট ইত্যাদির লোকপ্রবাদ চালু রয়েছে। অনেকে বলেন বিহারের চম্পাই নামের জায়গাই চাঁদ সদাগরের চম্পকনগরী। সোনেকা, মানিকো, সাহো এইসব নামের সাথে ওই অঞ্চলের নামকরণরীতিরও মিল পাওয়ায় পন্ডিতেরা মনে করছেন বিহারই হল মনসামঙ্গলের গল্পের উৎসস্থল। বাসর ঘরে নববধূর বৈধব্যের গল্প হয়ত সত্যি,তেমনই সত্যি হয়ত চাঁদ সদাগরের মতো ব্যক্তিত্ব। সমাজের উঁচুতলায় থাকা সর্বজনমান্য শৈব মানুষটির কাছে পুজো পেলে যে এক লৌকিকদেবীর সামাজিক প্রতিষ্ঠা হয় এও সত্যি।

সাহিত্য হিসাবে মনসামঙ্গল খুব উঁচুদরের কদর পায়নি কখনও। মুকুন্দরাম কিংবা ভারচন্দ্রের মতো কবির পরশ পায়নি এইসব লেখা। তা সত্বেও বাংলা বিহার আসামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রায় একই গল্প অবিকৃত ভাবে স্বীকৃত হয়েছে দেখেও একথা মনে হওয়া স্বাভাবিক গল্পটির কাহিনী সত্যতা না থাকলে এমন ব্যাপক স্বীকৃতি সম্ভব ছিলনা। আর এসব টুকরো সত্যি ঘিরেই হয়ত কবিকল্পনা গল্প তৈরি করে যা কালক্রমে হয়ে ওঠে মঙ্গলকাব্য।

এতদূর পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন হাঁফিয়ে উঠবে পাঠকের মন,তখন যাবার আগে টুক করে বলে যাই এ কাব্য কেন মঙ্গলকাব্য।

মঙ্গল মানে সুর করে গাওয়া গান। মঙ্গল মানে দেবতার আশীর্বাদ কামনায় প্রার্থনা। আবার এই গান মঙ্গলবার শুরু হয়ে একসপ্তাহ পরে আরেক মঙ্গলবার শেষ হয়,যদিও মনসামঙ্গল ব্যতিক্রম। এই গান সারা শ্রাবণমাস জুড়ে গাওয়া হয়। একে ভাসানের গানও বলে।

সমস্ত মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে মনসামঙ্গলই সবচেয়ে বেশী প্রচার পেয়েছে। তার কারণ বোধহয় চরিত্রগুলির বাস্তব চিত্রায়ন। সাধারণের সুখদুখের সাথে চরিত্রগুলিকে মিলিয়ে দেবার দক্ষতা,তাই মনসামঙ্গল বাঙ্গালীর প্রাণের কথা হয়ে থেকেছে বহু শত বছর। আজও সেই স্রোত বহমান।

ফিরতি পথে বিকেল ফুরানো আলোয় হয়ত আজও কানে ভেসে আসবে লখিন্দরের করুণ আর্তনাদ.....


"ওঠো ওঠো ওহে প্রিয়া কত নিদ্রা যাও।

কালনাগে খাইল মোরে চক্ষু মেলি চাও।।

তুমি হেন অভাগিনী নাহি ক্ষিতিতলে।

অকারণে রাঁড়ি হইলা খন্ড ব্রত ফলে।।

কত খন্ড তপ তুমি কৈলা গুরুতর।

সে কারণে তোমা ছাড়ি যায় লখিন্দর।।

মাও সোনকা মোর মৃত্যু কথা শুনি।

অগ্নিকুন্ড করি মাও ত্যজিব পরাণি।।

আমার মরনে মায় বড় পাবে তাপ।

পুত্রশোকে মাও মোর সাগরে দিবে ঝাঁপ।

......."

গুনগুনিয়ে উঠবে সুর,পাক খাবে বাংলার মাঠেঘাটে, জমিতে, হাওরে....

আমরা হেঁটে যাব হাজার বছরের পথ অবিরাম।
0

প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার

Posted in







অনেক কিছুই ইতিহাসকে বয়ে বেড়ায়। এমনকি নিজের মনের কথা বলতে না পারা গাছেরাও। ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে কোনো কোনো গাছও। সেই গাছ নানাভাবে ব্যক্ত করে থাকে ইতিহাসের কোনও এক করুণ অধ্যায়ের কথা। সেও পরবর্তী প্রজন্মকে জানাতে চায় বহু বছর আগে ঘটে যাওয়া কোনও এক কালো দিনের কথা। অতীতে ঘটে যাওয়া এক হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে উত্তরপ্রদেশের ফতেহপুর জেলার মুঘল রোডে অবস্থিত ‘বাওয়ানী ইমলি’ নামক একটি বিখ্যাত তেঁতুল গাছ। বর্তমানে অবশ্য তা ভারতের শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। ফতেহপুর জেলার বিন্ডকি মহকুমার খাজুয়া শহরের কাছে বিন্ডকি তহশিল সদর দপ্তর থেকে তিন কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত স্মৃতিস্তম্ভরূপী এই গাছ বহন করে চলেছে ১৮৫৮ সালের ২৮ শে এপ্রিলে ঘটে যাওয়া ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক রক্তক্ষয়ী অধ্যায়কে। এই তেঁতুল গাছেই ইংরেজরা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিয়েছিল ৫৩ জন বিপ্লবীকে! এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মর্মান্তিক ঘটনা আজও আমাদের আলোচনার বাইরে থেকে গেছে।

১০ই মে, ১৮৫৭ সালে বাংলার ব্যারাকপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে সিপাহী মঙ্গল পান্ডের ফাঁসির পর যখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই হিসেবে ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ শুরু হয় তখন বিদ্রোহের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হয় মঙ্গল পান্ডের জন্মভূমি উত্তরপ্রদেশেও। উত্তরপ্রদেশের ফতেহপুরে বিপ্লবীরা ঠাকুর যোধা সিং-এর নেতৃত্বে বিদ্রোহের দিকে পা বাড়ায়। এমনকি যোধা সিং-এর সহকারী ছিলেন ফতেহপুরের ডেপুটি কালেক্টর হিকমত উল্লাহ খান। যোধা সিং ও তাঁর নেতৃত্বে থাকা বিপ্লবীরা প্রথমে ফতেহপুর আদালত ও কোষাগার নিজেদের দখলে নেয়। আসলে, যোধা সিং আটাইয়ার মনে অনেকদিন ধরেই স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের আগুন জ্বলছিল। তাঁর মনে সেই আগুন জ্বালাতে সহায়ক ছিলেন সিপাহী বিদ্রোহের আরেক বিপ্লবী তাঁতিয়া টোপি। মাতৃভূমি ভারতবর্ষকে বিদেশি ইংরেজদের হাত থেকে স্বাধীন করার জন্য এই দুই মহারথী পাণ্ডু নদীর তীরে ব্রিটিশদের সাথে সংঘর্ষে জড়ান। মুখোমুখি যুদ্ধের পর ইংরেজ সৈন্যরা মাঠ ছেড়ে পালায়। এই দুই বীর কানপুরে তাঁদের পতাকা উত্তোলন করে। যোধা সিং আটাইয়ার মনের সেই স্বাধীনতার জন্য আগুন এতেও নিভল না। ১৮৫৭ সালের ২৭শে অক্টোবর, মাহমুদপুর গ্রামে যখন একজন ইংরেজ ইন্সপেক্টর ও একজন সৈনিক একটি বাড়িতে ছিলেন তখন তিনি তাঁদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারেন। ভুললে চলবে না যে তখনও দেশে সিপাহী বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে। এরপর ওই একই বছরের ৭ই ডিসেম্বর তিনি গঙ্গাপার রাণীপুর পুলিশ চৌকিতে হামলা চালান ও একদল ইংরেজ সৈন্যকে হত্যা করেন। আওয়াধ এবং বুন্দেলখণ্ডের বিপ্লবীদের তিনি সংগঠিত করে ফতেহপুর দখল করেন। পরিবহনের জন্য বিপ্লবীরা খাজুহাকে তাঁদের কেন্দ্র করে তুলেছিলেন। কর্নেল পওয়েল প্রয়াগ থেকে কানপুর যাচ্ছিলেন। সেই সময় একজন বেইমান সর্দার বা প্রধানের খবরে সেই কর্নেল সাহেব সেই স্থানে জড়ো হওয়া বিপ্লবী বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। কর্ণেল পওয়েল চেয়েছিলেন যোধা সিং-এর শক্ত ঘাঁটি ভাঙতে। কিন্তু, যোধা সিং-এর অব্যর্থ পরিকল্পনায় তা হয়ে ওঠেনি। যোধা সিং গেরিলা যুদ্ধ পদ্ধতির মাধ্যমে কর্ণেল পওয়েলকে হত্যা করেন।

কর্নেল পওয়েলের হত্যার পর ব্রিটিশরা কর্নেল নেইলের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর একটি নতুন দল পাঠায় যোধা সিং ও তাঁর নেতৃত্বে থাকা সমস্ত বিপ্লবীদের শায়েস্তা করার জন্য। কর্নেল নেইলের হাতে বিপ্লবীরা ভারী ক্ষতির মুখে পড়েন, তবুও যোধা সিং-এর মনোবল একটুও কমল না। তিনি ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বড় রকমের যুদ্ধের জন্য নতুন সামরিক সংগঠন করেন আর তার জন্য অস্ত্র সংগ্রহের পাশাপাশি তহবিল সংগ্রহের পরিকল্পনাও করেন। এইসব কাজের জন্য ছদ্মবেশে যাত্রা শুরু করেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, বিপ্লবীরাও যেমন ছিলেন যাঁরা নিজেদের দেশ তথা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতেও প্রস্তুত ছিলেন ঠিক তেমনি কিছু বিশ্বাসঘাতকরাও ছিল যারা বিপ্লবীদের সমস্ত পরিকল্পনা বিদেশি শাসক ইংরেজদের কাছে ফাঁস করে বিপ্লবীদের ধরিয়ে দিয়ে বিপ্লব আন্দোলন তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনকে রোধ করত। হয়তো দাসত্ব বা পশুত্ব এই বিশ্বাসঘাতকদের প্রিয় ছিল। আসলে এই বিশ্বাসঘাতকরা প্রকৃত মানুষের সন্তান ছিল না। অর্গাল নরেশের সাথে আলোচনা করার পর যখন যোধা সিং আটাইয়া খাজুহাতে ফিরে আসেন তখন বিশ্বাসঘাতকেরা এই বৈঠকের খবর ব্রিটিশদের দিয়ে দেয়। ঘোড়হা গ্রামের কাছে ব্রিটিশের সেনাবাহিনী তাঁকে ঘিরে ফেলে। অল্প সংগ্রামের পর, যোধা সিং ও তাঁর ৫১ জন সহ বিপ্লবীগণ ব্রিটিশের হাতে বন্দি হন। অর্থাৎ, আমরা দেখলাম যে, ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ তথা সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে যোধা সিং আটাইয়ার নেতৃত্বে বিপ্লবী তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের দল ব্রিটিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে প্রথমদিকে সফলভাবেই বিজিত হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তাঁদের সেই বিজয়ের আনন্দ ক্ষণস্থায়ী ছিল। নিজেদের জাতির মধ্যে থাকা বিশ্বাসঘাতকদের সাহায্যে ব্রিটিশরা এই বিপ্লবীর দলকে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছিল।

২৮ এপ্রিল, ১৮৫৮। ভারতীয় সিপাহী বিদ্রোহ তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক ‘কালো দিবস’। উত্তরপ্রদেশে ফতেহপুর জেলায় অবস্থিত মুঘল রোডের তেঁতুল গাছে যোধা সিং আটাইয়া ও তাঁর ৫১ জন সঙ্গী এবং গৌতম ক্ষত্রিয়— অর্থাৎ মোট ৫৩ জনকে ব্রিটিশ বাহিনী ফাঁসিতে ঝোলায়। তবে এখানেই ব্রিটিশ বাহিনীর নিষ্ঠুরতা থামেনি। তারা গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে ঘোষণা করে যে, “যদি কেউ গাছ থেকে মৃতদেহ নামায় তাহলে তাকেও এই একইভাবে এই তেঁতুল গাছে ফাঁসি দেওয়া হবে।” গ্রামবাসীরা ব্রিটিশ বাহিনীর এই হুমকিতে বেশ ভয় পেয়ে যায়। তারা আর সাহস করেনি মৃতদেহগুলোকে গাছ থেকে নামাতে। দীর্ঘ ৩৭ দিন ধরে মৃতদেহগুলো গাছে ঝুলতে থাকে। শকুনের দল সেই মৃতদেহগুলোকে ছিঁড়ে খেতে থাকে। গ্রামবাসীরা কিছুই করতে পারছিল না। অবশেষে, ওই বছরের জুন মাসে, মহারাজ ভবন সিং তাঁর সহকর্মী সহ আসেন এবং মৃতদেহগুলোকে গাছ থেকে নামিয়ে এনে সেগুলোর দাহ বা সৎকারের ব্যবস্থা করেন। পরে সাহসী বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে সে বাওয়ানী ইমলি গাছটিকে ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

বিন্ডকি ও খাজুহার মাঝে অবস্থিত সেই অভিশপ্ত তেঁতুল গাছটি আজ বাওয়ানী ইমলি বা বাওয়ানী তেঁতুল গাছ হিসেবে এক শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। এই স্মৃতিস্তম্ভটি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আত্মত্যাগের প্রতীক। এমনকি, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী অধ্যায়গুলোর মধ্যে অন্যতম হয়ে আছে ১৮৫৮ সালে ২৮ এপ্রিলের দিনটি। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর এই পঞ্চাশের অধিক স্বাধীনতা সংগ্রামীকে প্রকাশ্যে তেঁতুল গাছে ফাঁসি দেওয়ার মতো নৃশংস ঘটনা আজও অনেকের কাছে অজানা। এমনকি যাঁরা ইতিহাস ও রাজনীতি নিয়ে চর্চা বা পড়াশোনা করেন বা পড়ান তাঁদের অনেকেই হয়তো এই ঐতিহাসিক নৃশংস ঘটনার কথা তেমন জানেন না। ইতিহাসের এক অন্ধকারতম দিনটির সাক্ষী সেই তেঁতুল গাছটি আজও দাঁড়িয়ে আছে সেই কালো ইতিহাসকে ধরে রেখে। স্থানীয়রা বিশ্বাস করে যে, সেইদিনের নৃশংস ঘটনায় সেই তেঁতুল গাছটিও নিদারুণ কষ্ট পেয়েছে আর তাই সেই গণহত্যার পরে গাছটির বৃদ্ধিও বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ, ইতিহাসের কালো দিনের সাক্ষী এক গাছও হয়। সেও প্রকৃত মানুষের মতো অনুভব করতে পারে নৃশংস ঘটনায় মানুষকে হারানোর হাহাকার ও ব্যথা। আর কালো ইতিহাসকে ধরে রাখতে কিংবা বোঝাতে সেও আর বাড়তে চায় না। হয়তো এই গাছের মতো ইতিহাসও থমকে থাকে মানব সমাজে ঘটা কোনও এক নৃশংস ঘটনায়!