Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



















২২.১

শহরে চায়ের দোকান, কমিটি’র রুম, লাইব্রেরি এবং বিধানসভা যে দরকারে লাগে , গাঁয়ে রাস্তার পাশে
পুলিয়া বা কালভার্টের উপর ছোট সিমেন্ট- বাঁধানো বসার জায়গা একই কাজে আসে। অর্থাৎ,
লোকজন ওখানে বসে আড্ডা মারে। এখন রোববারের বেলা দশটা, রঙ্গনাথ এবং রূপ্পনবাবু একটি
পুলিয়ার উপর বসে রোদ পোহাচ্ছেন এবং বর্তমান সময়ের হালচাল দেখছেন।
বর্তমান সময়ের হালচাল—মানে অন্ধকারে দুই দৃঢ় স্তনের হাতে গরম ছোঁয়া। এ নিয়ে রঙ্গনাথই
প্রথম শুরু করল। ভেবেছিল সে রাতে যা ঘটেছিল সেটা কাউকে বলবে না। রূপ্পনের সঙ্গে ও কেবল
জেনারেল নলেজের কথা তুলেছিল আর এটাও জানতে চাইছিল যে মহল্লায় এমন কে কে আছে যারা
চাইলে কোন বক্ষবন্ধনী নির্মাতা কোম্পানির বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে ক্যালেন্ডারে ছবি হতে
পারে।

ও রূপ্পনের সঙ্গে এমন ভাবে আলাপ শুরু করল যেন ও নিজে ওই রকম কোম্পানির পাবলিসিটি
ম্যানেজার আর ওর মেয়েছেলে বা তাদের স্তন নিয়ে বেশি আগ্রহ নেই, শুধু বিজনেসের জন্য যতটুকু
দরকার, ব্যস্‌। রূপ্পন বাবু যখন এবিষয়ে একটু গভীর কথাবার্তা বলতে শুরু করলেন তো ওর অবস্থা
হল গভীর আলোচনা শুরু হলে সব ভারতীয় ছাত্রের মত উনিও এদিক সেদিক পাশ কাটানো শুরু করলেন।
উনি বিষয়টা বদলে মেয়েদের স্বাস্থ্যের দিকে টেনে নিয়ে গেলেন এবং ‘দ্য গ্রেট ব্রা-ম্যানুফ্যাকচারিং
কোম্পানী’র পাবলিসিটি ম্যানেজারের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ‘অখিল ভারতীয় নাগরিক স্বাস্থ্য
সংঘে’র প্রধান সম্পাদক হয়ে গেলেন। কিন্তু রুপ্পন বাবুর প্রশ্নমালা তাঁকে সেই পদেও টিকতে দিল
না। খানিকক্ষণ অন্ধকার, শীত, ভুত-প্রেত নিয়ে কথা বলতে বলতে রঙ্গনাথ হঠাৎ টের পেলেন যে
অনিচ্ছাসত্ত্বেও উনি রূপ্পনবাবুকে একটু একটু করে সেই রাতে যা ঘটেছিল তার পুরোটাই বলে
ফেলেছেন।
রূপ্পনবাবু মন দিয়ে শুনছিলেন। রঙ্গনাথের কথা শেষ হবার মুখে ওনার মনে হল যেন এক জ্বলন্ত
উনুনের উপর বসে আছেন। নিজের ভেতরে এক অদ্ভূত টেনশন এবং গরম ভাপ টের পাচ্ছেন। মেয়েছেলে
নিয়ে কথাবার্তা হলেই ওনার ভেতর এই রকম অনুভূতি হয়। ওনার বিশ্বাস যে ছাতে যে মেয়েটি এসেছিল
সে বেলা ছাড়া কেউ নয় আর যার কাছে ও আত্মসমর্পণ করতে চাইছিল সে নিঘঘাৎ রূপ্পনবাবু!
আমার প্রেমপত্র এবার খেল দেখাচ্ছে। বেলা ছটফট করছে। ভেবে ভেবে রূপ্পন নিজেই ছটফট করতে
লাগলেন। ইস্‌, ওই রাতে আমি কেন খোলা ছাতে ঘুমোতে যাই নি! এই আফশোসে রূপ্পনবাবুর গলায়
একটি সিনেমার গানের লাইন এসে গেল। কিন্তু এখন রঙ্গনাথের সামনে নিজেকে এক সমঝদার ব্যক্তি
দেখাতে হবে তাই উনি গম্ভীর হলেন। উনি চুপ করে আছেন দেখে রঙ্গনাথ ফের নিজের অভিজ্ঞতার
বর্ণনা শুরু করে দিলঃ “ও যে কখন এল, কখন গেল—বুঝতেই পারি নি। শুধু এটুকু মনে আছে যে ও এসে
আমার বুকের উপর ঝুঁকে—“।
রূপ্পন বাবু বিচক্ষণ ব্যক্তির মত বললেন-“হ্যাঁ, এমন হয়। কখনও কখনও এমন ভ্রম হয়। কে
এসেছিল জানা নেই, সত্যি এসেছিল কি—তাও নয়। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই। গেঁয়ো কারবার।
সবাই ভুত-প্রেত ভাববে। ক’জন বুঝবে? রঙ্গনাথ দাদা, তারচেয়ে মুখ খুলো না। হতে পারে তুমি স্বপ্ন
দেখছিলে, হতে পারে সত্যি ঘটেছিল”।

এই বিশ্লেষণে রঙ্গনাথের দুটো আপত্তি।
এক, রূপ্পন ওর অনুভবকে স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিতে চাইছেন।
দুই, উনি মেয়েটির জন্য পুংলিঙ্গের প্রয়োগ করছেন কেন?
তাই রঙ্গনাথ বলে উঠল, কোন ধোঁকা খাইনি। আমি জেগেই ছিলাম। ও এসে আমার খাটিয়ায় বসেছিল।
আমার উপর ঝুঁকে—“।
“ঠিক আছে, ঠিক আছে”। হাত নেড়ে কিছু কাল্পনিক মশা তাড়াতে তাড়াতে রূপ্পন বললেন, “ মেনে
নিলাম। সত্যিই কোন ব্যাটা এসেছিল। কিন্তু এ নিয়ে কাউকে কিছু বলার দরকার নেই”।
“কোন ব্যাটা এসেছিল!” রঙ্গনাথ চোখ বুঁজে একবার কোণার্কের সুর্-সুন্দরীদের চেহারা ধ্যান করল
আর মনে মনে অন্ততঃ কুড়িবার বলল,” ব্যাটা নয়, কোন বেটি এসেছিল। রূপ্পন বাবু, তুমি কখনও
‘ব্যাটা’ ছাড়া কিছু ভাবতে পার না”?
পরের দিন। বাদাম ফুরিয়ে যাওয়ায় রঙ্গনাথকে শিবপালগঞ্জের গলি গলি খুঁজে বেড়াতে হল। দু’চারটে
দোকান ছিল। সেখানে জিজ্ঞেস করায় একেকজনের থেকে যা যা শোনা গেলঃ
‘আজকাল বাদাম কে বেচে! খাওয়ার লোক কই? বাদাম খেয়ে হজম করা সোজা নাকি! বড় বড় পালোয়ান
হার মেনেছে। ফের বাদাম কে কিনবে? গম আর ছোলা আজকাল বাদামের দামে বিকোচ্ছে-- তাই যথেষ্ট।
আগে বদ্রী পালোয়ান খুব বাদাম খেত। তখন আমরাও দোকানে বাদাম রাখতাম। ও আজকাল বাদাম
ছেড়ে কেবল দুধ-ঘি খাচ্ছে। আর ওর ভাই রূপ্পন! সে খেঁকুড়ে মুখে চা-বিস্কুট সাঁটিয়ে বেঁচে আছে।
“ এখানে আর বাদাম-টাদাম পাওয়া যায় না। বলতে গেলে, বাদামের শুধু নামই রয়ে গেছে। ভাল জাতের
কাগজি বাদাম আর আসে কোথায়? পাওয়া গেলেও শহরের বাজারগুলোতেই শেষ। নতুন নতুন শেঠ
দোকানদার গজিয়ে উঠছে। ওরা আগেই কিনে নিয়ে লাড্ডু বানিয়ে বেচে। যতখুশি খাও আর নেদে বেড়াও।
“বাদাম কি কোন ভাল জিনিস? পেটকে ইঁটের মত বানিয়ে দেয়। বাদাম সবসময় কিসমিস-মনাক্কার
সঙ্গে খেতে হয়। মনাক্কা হল আসল জিনিস। দুর্বল পেটে পড়লে দাস্ত করায়, কিন্তু স্বাস্থ্যবানের
পেট হালকা হয়।
“মনাক্কা নেবে তো বল। দেখে নাও, এই হল আসল মনাক্কা। শিবপালগঞ্জ বলে পেয়ে যাচ্ছ, শহরের
বাজারে গেলে সারা দিন চক্কর কাটতে। এ জিনিস ওখানে পাওয়া অসম্ভব”।
ছাগলের নাদির মত মনাক্কা দেখে দেখে রঙ্গনাথের চৈতন্য হল যে গাঁয়ে কেনার মত আদর্শ বস্তু হল
যা রাষ্ট্রকবি মৈথিলীশরণ গুপ্ত অর্ধশতাব্দী আগে লিখে গেছেনঃ
“কাশীফল কুষ্মান্ড কহীঁ হ্যায়, কহীঁ লৌকিয়াঁ লটক রহী হ্যাঁয়”।
(কুমড়ো আর ফুটি দেখ রয়েছে কোথাও,
আর কোথাও ঝুলে আছে লম্বা লম্বা লাউ)।
শুনতে পেল শিবপালগঞ্জ থেকে দু’মাইল দূরে এক গাঁয়ে কিছু দোকান আছে যেখানে ভাল বাদাম পাওয়া
যেতে পারে। রঙ্গনাথ রওনা হয়ে গেল। রাস্তাটার অনেকখানি পাকদণ্ডী মত, তায় কোথাও কোথাও
পথের দু’পাশে বাবুল গাছের কাঁটাওলা ডাল পোঁতা। নালা আর বড় খাদ কাটা হয়েছে, আবার কোথাও উঁচু

করে আল বাঁধানো। বোঝাই যাচ্ছে যে চাষিরা চায় না একটা পাখিও বেড়ার ফাঁক দিয়ে গলে যাক। কিন্তু
মানুষ তো আজকাল চন্দ্রাভিযান , মঙ্গল অভিযানের দুঃসাহস করে। তারা এসব বিঘ্ন-বাধা অতিক্রম
করে কখনও ক্ষেতের কখনও নালার ভেতর দিয়ে রাস্তা বানিয়ে নিয়েছে।
একজন ভালোমানুষ ওদিকেই যাচ্ছেন। ব্যস, রঙ্গনাথ তাঁর পেছন পেছন চলতে লাগল। তিনি জানতে
চাইলেন –কাদের ঘরের ছেলে?
রঙ্গনাথ জবাব দিল—বৈদ্যজীর ভাগ্নে।
ভদ্রজন বিনয় দেখিয়ে বলল—আপনার নাম শুনেছি। আজ দেখা পেলাম। আপনি তো লেখাপড়ায় অনেক
দূর--বি এ এম এ পাশ।
রঙ্গনাথ বলল—রাস্তাটা বড্ড খারাপ। লোকে কেন যে বাবুলের কাঁটাওলা ডাল পুতে রেখেছে!
--এখানে দেখাশুনোর কেউ নেই। যার যা ইচ্ছে করছে। পথের মাঝখানে আল বানিয়ে দিচ্ছে, বাবুলের কাঁটা
পুঁতে দিচ্ছে। ।
--কেন, এখানে গ্রাম-পঞ্চায়েত আছে না?
--তা আছে। কোন কাজ করে না, শুধু জরিমানা লাগায়। আগের দিন হলে জমিদার ছিল, জুতোপেটা করত।
হিন্দুস্তান শালা ভেড়ার পাল। জুতো না খেলে শোধরায় না। জমিদারি উঠে গেছে, জুতোপেটা বন্ধ! এখন
দেখ, সরকারকে বাধ্য হয়ে জুতোপেটা করতে হচ্ছে। রোজ কোথাও না কোথাও লাঠি গুলি চালাতে হচ্ছে।
আর কী করবে? এরা সব লাথ খাওয়ার দেবতা, ভালো কথায় মানবে না।
জমিদারি উচ্ছেদ করে সরকার বাহাদুরও ঠেকে শিখেছেন—এ দেশ চালাতে আসল জিনিস হল জুতো!
রঙ্গনাথ—এটা কি কথা! জুতোপেটা করে কত লোককে আদবকায়দা শেখানো যায়?
কিন্তু ওই ভদ্রলোকের অভিমত হল –জুতোপেটা বন্ধ হওয়া ভুল। যতক্ষণ বদমাশের মাথায় একটা
চুলও বেঁচে থাকবে ততক্ষণ জুতো চলুক। ওনার খারাপ মুড দেখে রঙ্গনাথ চুপ করে গেল। খানিক দূর
চলার পর উনি প্রশ্ন করলেন—আচ্ছা, বিএর সম্মান বেশি, নাকি ওকালতের?
রঙ্গনাথ— কিসের ছোটবড়? দুটোই সমান।
--সে তো আমিও জানি। এই হতচ্ছাড়া দেশে ছোটবড় সব এখন এক হয়ে গেছে। কিন্তু আসলে কোনটা
বড়?
রঙ্গনাথ এড়াতে চেয়ে বলল—ওকালতি।
“তাহলেই বোঝ, আমার ছেলে একজন উকিল”।
--“উনি থাকেন কোথায়”?
উকিলের পিতা এবার দম্ভভরে বললেন—“উকিল কোথায় থাকে? এখানকার গাঁয়ে পড়ে থাকবে নাকি?
শহরে থাকছে, তিন বছর ধরে ওকালতি করছে”।
--তাহলে তো নিশ্চয়ই বড় উকিল হয়েছেন”!
--“বড় মানে? অনেক বড়। তোমাদের গ্রামের জোগনাথওয়া আছে না? যে জেলে গেছল? ওর পক্ষে কেস
লড়ছে। বৈদ্যজী এখানে অনেক চেষ্টা করেও কিছু করতে পারলেন না। দারোগা জামিন দিল না। কিন্তু
ছেলে এজলাসে দাঁড়িয়ে এককথায় জামিন করিয়ে দিল।
“বড়মানুষের মত হাত খোলা। ওকালতনামা আমিই ভরিয়ে ছিলাম। তক্ষুণি আমার হাতে পাঁচ টাকা ঠুঁসে
দিল”! রঙ্গনাথ উকিলের গর্বিত পিতাকে খুশি করতে বলল “ তাহলে নিশ্চয়ই ওঁর ভালো কামাই হচ্ছে”!
লোকটি চমকে উঠে পেছন ফিরে রঙ্গনাথকে ভালো করে দেখল “ভালো আর কি, ওই একরকম-- -- বলত
গেলে মোটামুটি চলে যাচ্ছে। তবে কামাচ্ছে তো তোমার মামাজী। কী দারুণ বৈঠকখানা বানিয়েছে!
“তেঁতুলে বীচির পুড়িয়া বানিয়ে কাউকে দিলেও এক টাকার কমে নয়। ওনার সময় ভাল যাচ্ছে”।
লোকটি হিংসেয় জ্বলে যাচ্ছে এবং সেটা লুকনোর চেষ্টা না করে বৈদ্যজীর নিন্দে করতে লাগল।
“দেখতে দেখতে কত বড় নেতা হয়ে গেছে। আগে অনেক সাদাসিদে ছিল। এখন মাটির উপরে যত, মাটির
নীচেও তত। ওঁর পেচ্ছাপে প্রদীপ জ্বলে”।
শেষে বলল, “দারোগা কিন্তু জোগনওয়ার মামলায় ওনাকে পাত্তা দেয় নি। বাঁদরের মত কাঠগড়ায় দাঁড়
করিয়ে জেলে পাঠিয়ে ছাড়ল”। তারপর ফিরে এল পুরনো প্রসঙ্গে—“আমার ছেলে জামিন না করালে
ব্যাটা এখন জেলারের বাচ্চাকএ কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াতো”।
--“আগামী শুনানি কবে”?
-- “জোগনাথের মামলার? মামলা চলছে অনারী মজরেটের এজলাসে। ও যখন চাইবে তখনই শুনানি হবে।
ছেলে আজকাল বাড়ি এসেছে। দু-চার দিনে শহরে ফিরে যাবে। তারপর কোনদিন শুনানির আদেশ বের করে
নেবে”।

ওরা যে পথ দিয়ে যাচ্ছিল সেখানকার জমি বেশ ঢালু আর ঝোপঝাড় কাঁটাগাছে ভরা। এছাড়া রয়েছে
কাশবন। এখন আর ‘ফুলে ফুলে সাদা’ নয়, শুকিয়ে শক্ত ডাল। চলতে গেলে পথিকের গায়ে খোঁচা লাগে।
এক জায়গায় কাশের শুকনো পাতা আর ডগা পাকদণ্ডী পথের দু’পাশ থেকে ঝুলছিল। রঙ্গনাথ ওগুলোকে
ঠেলে সরিয়ে এগিয়ে যেতে পারত, কিন্তু ওগুলো দু’হাতে চেপে ধরে এক মোটা গিঁট বেঁধে দিল। চলার পথ
খানিকটা সাফ হল। একটু এগিয়ে ফের ওইরকম কাশফুলের শুকনো ডাল, সেখানেও একই কায়দায় গিঁট
বেঁধে দিল।
উকিলের বাবা দাঁড়িয়ে পড়ে মন দিয়ে রঙ্গনাথের এই অদ্ভূত আচরণ দেখছিলেন। আরও একটা বড় গিঁট
বাঁধার পর জিজ্ঞেস করলেন—এটা কী হচ্ছে?
--কোনটা?
--এই যে একের পর এক গিঁট বাঁধছ?
--আচ্ছা, ওই গিঁট?

ভাবল একবার বুঝিয়ে বলে যে গিঁট বেঁধে দিলে এগুলো হাওয়ায় নুয়ে পথিকের রাস্তা আটকাবে না, আর
কিছু নয়। কিন্তু উকিলের বাপের চেহারা দেখে থমকে গেল। উনি উত্তেজিত হয়ে বিরাট কোন রহস্যের
গুপ্তকথা শোনার অপেক্ষায় রয়েছেন। রঙ্গনাথ ভাবল, ঠিক আছে, তাহলে তাই সই।
ও ফিসফিসিয়ে বলল, “কাউকে বলবেন না যেন! মামাজী আমাকে বলে দিয়েছেন—পথে একটা কাশবন
পড়বে। ওখানে শুকনো পাতা আর ডগা দেখলে গিঁট বেঁধে এগিয়ে যাবে। হনুমানজী প্রসন্ন হবেন”।
--আগে কখনও শুনিনি তো!
--‘আমিও শুনি নি’ , এই বলে রঙ্গনাথ এগিয়ে গেল। এখন ও আগে, উকিলের বাপ ওর পেছনে। তিনি
আবার ওকালতের মহিমা ব্যাখ্যান শুরু করলেন।
“এম এ , বি এ তে আছেটা কী? আমাদের সময় একটা ছড়া প্রচলিত ছিল, কী যেন, ধেত্তেরি, মনে পড়ছে
না। ও হ্যাঁ, ‘পাস হ্যায় মিডিল মুল্লু, ঘাস ছীলি আবে না’।
(মুল্লু এখন হল মিডল পাস,
কিন্তু ব্যাটা কাটতে নারে ঘাস!)
“এখন এটা বদলে দিচ্ছি “ বি এ ভয়ে পাস মুল্লু, ঘাস ছীলি আবে না”।
(মুল্লু এখন হল বি এ পাস,
কিন্তু আজও কাটতে নারে ঘাস)।
“আজকাল এমএ, বিএ তো একটাকা সের দরে বিকোচ্ছে। তোমার তো উকিল হওয়া উচিত ছিল। উকিল
হয়ে কাছারিতে টেবিল লাগিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসতে। যার মামা হলেন ‘গঁজহা’ (শিবপালগঞ্জের বাসিন্দে),
তায় বদ্যি এবং নেতা –তার আবার মোকদ্দমার অভাব! রোজ দশ-বিশটা মামলা তো তোমার মামাজীরই
চলতে থাকে”।
রঙ্গনাথ এমন পরামর্শের বিষয়ে কোন মতামত দিল না। তবে যেতে যেতে থেমে গিয়ে দুটো কাশফুলের
ডগায় তিন নম্বর গিঁট বেঁধে বলে উঠল—“জয় হনুমান কী”!
উকিলের বাপ এবার থেমে গেলেন। রঙ্গনাথের মুখ থেকে হনুমানের নাম বেরোতেই ওনার হাত কাশের
ডগায় পৌঁছে গেল। উনি গিঁট বাঁধতে ব্যস্ত হয়ে রঙ্গনাথকে বোঝাতে লাগলেন—“ভাবলাম, আমিও একটা
গিঁট বেঁধে দিই। এর জন্যে তো পয়সা লাগে না”।
রঙ্গনাথ গম্ভীর হয়ে বলল, “জয় হনুমানজী কী”!
উকিলের বাপ তক্ষুণি কাশের গিঁটকে প্রণাম করে বললেন--“জয় হনুমানজী কী”!

এক কেলটে মত মেয়েছেলে মাথায় একটা নোংরা পোঁটলা রেখে ওনার পেছন পেছন চলছিল। আগে ও
অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখেছিল। কিন্তু উনি গিঁট বাঁধতে ব্যস্ত হলে দু’জনের দূরত্ব অনেক কমে গেল।
বয়স হবে প্রায় পঁয়তাল্লিশ, কিন্তু মুখের চেহারায় বুড়ি বুড়ি ভাব। তবে আমাদের নজর ওর মুখের থেকে

নীচে নেমে এলে বোঝা যায় বেশ ভর-ভরন্ত খেত। ওর জামার দুটো বোতাম খোলা, কিন্তু ওর মুখের ভাব
মীরাবাঈয়ের মত তন্ময়। টের পায়নি যে ওর বুকের দুটো বোতাম কখন খুলে গেছে অথবা ওর জানা নেই
যে বোতাম খুলে যাওয়ায় কোন লাভ-লোকসান হতে পারে কিনা।
রঙ্গনাথ প্রথমে ওই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে নিল। ফের চোখ সরিয়ে উকিলের বাপকে দেখতে লাগল।
কিন্তু তিনি সেটা টের পেলেন না। কারণ, উনি তন্ময় হয়ে সেই দৃশ্য দেখছিলেন যা একবার দেখে
রঙ্গনাথ চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
মেয়েছেলেটি ছাগলের মত ম্যা-ম্যা করে বলল—কী করছ ভাইয়া?
জবাব রঙ্গনাথকে দিতে হল না। উকিলের বাপ চটপট বলে উঠলেন—দেখছ না? হনুমানজীর গিঁট বাঁধছি।
মেয়েছেলে এবার মাথার পূঁটলি মাটিতে নামিয়ে সবিনয়ে জানতে চাইল—আমি তো মেয়েছেলে। আমরা
করলে মানা আছে কি?
“ভগবানের দরবারে কি মেয়েছেলে, কি ব্যাটাছেলে—সব সমান”, উকিলের বাপের গলার স্বরে দৃঢ়
আত্মবিশ্বাসের ঝলক। যেন এক্ষুণি সোজাসুজি ভগবানের দরবারে হাজির হয়েছিলেন, ওখান থেকেই
ফিরছেন। মেয়েছেলেটি এবার দুটো হাত কাশবনের এক ঝাড়ে গুঁজে দিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে বলল, “জয়
বজরঙ্গবলী কী”!