প্রবন্ধ - ইন্দ্রনীল মজুমদার
Posted in প্রবন্ধ১৮৩৯ সাল। বছর ছয়েক হল সমাজ সংস্কারক দেশের 'প্রথম আধুনিক পুরুষ' হিসেবে সম্মানিত রাজা রামমোহন রায় প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর আদর্শ থেকে গেছে আর সেই আদর্শের দ্বারা প্রভাবিত বা অনুপ্রাণিত হয়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর স্থাপন করেন 'তত্ত্ববোধিনী সভা'। এই সভার মূল উদ্দেশ্য ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচার হলেও আধুনিক শিক্ষাপ্রণালী, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনার দ্বার খোলা থাকত সভায়। এই সভা থেকেই দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ও ব্যবস্থাপনায় বিখ্যাত ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রথম 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা' প্রকাশিত হয় ১৮৪৩ সালে ১৬ই আগস্ট। এই পত্রিকার সম্পাদক হলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। এই পত্রিকা হল ব্রাহ্মসমাজের তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপত্র। এই পত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মধর্মের প্রচার এবং তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্যদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা। এই পত্রিকায় সে যুগের দিকপালেরা নিয়মিত লিখতেন যাঁদের মধ্যে ছিলেন অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজনারায়ণ বসু, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার লেখকগণ ও পৃষ্ঠপোষক সকলেই ছিলেন সংস্কারপন্থী আর লেখকদের লেখার মাধ্যমেই সে যুগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত হয় এক নবযুগ। যদিও পত্রিকার মুখ্য উদ্দেশ্য বেদান্ত-প্রতিপাদ্য ব্রহ্মবিদ্যার প্রচার করা হলেও, এই পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকে সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্ম, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ব্যবস্থা বা সমাজতত্ত্ব সহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর মূল্যবান ও আকর্ষণীয় লেখা। এই পত্রিকায় বিভিন্ন লেখার মাধ্যমে বাঙালি পাঠককে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়া হতো। একই সঙ্গে রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য জাতিকে প্রস্তুত করে তুলতে নিজেদের উন্নয়ন ও আত্মগঠনের প্রেরণা জাগানো লেখাও এই পত্রিকায় প্রকাশিত হতো। এইভাবে তৎকালীন নবজাগরণের সময় বাংলার সংস্কৃতি ও সভ্যতার উন্নতিতে এই পত্রিকা বিশেষ অবদান রেখেছিল। ব্রাহ্মধর্ম আন্দোলনের প্রচারে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পূর্ববঙ্গে এ পত্রিকার মাধ্যমেই ব্রাহ্মধর্মের প্রসার ঘটে। পত্রিকাটি পড়ে ব্রজসুন্দর মিত্র অনুপ্রাণিত হয়ে ঢাকায় ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। সীমিত যোগাযোগ ও কর্মীর অভাব সত্ত্বেও ব্রাহ্মসমাজের কাজে পত্রিকাটি অন্যতম সহায়ক হয়ে ওঠে।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোর মান নিরূপণ করার জন্য এশিয়াটিক সোসাইটির আদর্শ অনুসরণ করে গ্রন্থাধ্যক্ষ কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির সভ্য ছিলেন পাঁচ স্বনামধন্য ব্যক্তি— ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, আনন্দমোহন বসু, রাজনারায়ণ বসু এবং বিদ্যাসাগরের বন্ধু প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী। বাংলাপিডিয়া থেকে জানতে পারি যে, তত্ত্ববোধিনীতে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলো নির্বাচিত হতো পেপার কমিটির মনোনয়নের মাধ্যমে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজনারায়ণ বসু, আনন্দকৃষ্ণ বসু, শ্রীধর ন্যায়রত্ন, আনন্দচন্দ্র বেদান্তবাগীশ, প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী, রাধাপ্রসাদ রায়, শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায়, অক্ষয়কুমার দত্ত প্রমুখ ছিলেন সেই পেপার কমিটির সদস্যগণ। এখানে উল্লেখ্য যে, কমিটির অন্যতম সদস্য রাধাপ্রসাদ রায় ছিলেন রাজা রামমোহন রায়ের পুত্র আর এই রাধাপ্রসাদ পত্রিকাকে একটি মুদ্রণযন্ত্র দান করেছিলেন।
উনবিংশ শতাব্দীতে সাংগঠনিকভাবে বিজ্ঞান প্রচার ও প্রসারের কাজে অগ্রণী ভূমিকা নেন অক্ষয়কুমার দত্ত। তাঁর হাত ধরেই যেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রাণ প্রতিষ্ঠালাভ করে।
১৮৪০ সালে তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন।তত্ত্ববোধিনী পাঠশালায় পড়াশোনার জন্য তত্ত্ববোধিনী সভার উদ্যোগে তাঁর প্রথম বই 'ভূগোল' প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৪১ সালে। এই বইটিকে বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম বিজ্ঞানের বই হিসেবে ধরা হয়। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার মাধ্যমে তিনি বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান প্রবন্ধ রচনার এক নতুন দিগন্ত ও আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। বিজ্ঞানের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য শাখা যেমন পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ের প্রচুর প্রবন্ধ তিনি রচনা করেন। তাঁর প্রবন্ধগুলো সাধারণ মানুষের কাছে মৌলিক বিজ্ঞানের বিষয়গুলো জানা ও শেখার এক সহায়ক হয়ে উঠেছিল। দেবেন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা শুধু ধর্মচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক। কিন্তু অক্ষয়কুমার চাইতেন এতে বিজ্ঞানভিত্তিক ও যুক্তিনির্ভর আলোচনা অন্তর্ভুক্ত হোক। শেষ পর্যন্ত অক্ষয়কুমার দত্তের ভাবনাই প্রাধান্য পায়। তাঁর সম্পাদনায় বিজ্ঞান ও যুক্তিসমৃদ্ধ লেখাগুলো প্রকাশিত হওয়ায় বাংলা সংবাদপত্রের মর্যাদা বাড়ে। পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত অনেক বুদ্ধিজীবী আগে বাংলা পত্রিকাকে তুচ্ছ করলেও, তত্ত্ববোধিনীর বিষয়বস্তুর গভীরতা ও মান তাঁদেরও আকৃষ্ট করে।
অক্ষয়কুমার দত্তের মতো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বিজ্ঞান প্রচার ও প্রসারের কাজে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্ত ও পত্রিকার তথা সভার গ্রন্থাধ্যক্ষ কমিটির অন্যতম সদস্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর— দুজনেই ধর্মচিন্তা প্রসারের বিরোধিতার মাধ্যমে নিজেদের বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয় দিয়েছিলেন। অক্ষয়কুমারের মতোই বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর ছিলেন এই বাংলায় অন্যতম পথপ্রদর্শক। তাঁর লেখা 'বোধোদয়' ও 'জীবনচরিত' নামে বিজ্ঞানের দুই আকর গ্রন্থ পড়লে ও তাঁর 'ভূগোল খগোল বর্ণনম' সহ বিভিন্ন লেখা পড়লেই তাঁর বিজ্ঞানচর্চার গভীরতা টের পাওয়া যায়। তৎকালীন সময়ে বাল্যবিবাহ রদ ও বিধবার পুনর্বিবাহ প্রচলনের মাধ্যমে তিনি তাঁর বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক সংস্কারকের মানসিকতা প্রকাশ করেছিলেন। বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখির অনুবাদ করেছিলেন বিদ্যাসাগর। অক্ষয়কুমার দত্তের কিছু রচনার সংস্কার ও সংশোধন করে গিয়েছিলেন নিয়মিতভাবে। তত্ত্ববোধিনী সভার বেশ কিছু প্রকাশনা সম্পাদনা করেছিলেন বিদ্যাসাগর। এই যেমন, পশ্বাবলী পত্রিকার দ্বিতীয় সংস্করণের প্রথম অংশে প্রকাশিত অক্ষয়কুমার দত্তের প্রবন্ধগুলো। তাঁর তত্ত্বাবধানে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে অক্ষয়কুমার দত্তের দর্শন ও বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা 'বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার'। এই লেখাটির প্রথম ভাগ বইয়ের আকারে প্রকাশিত হয় ১৮৫২ সালে ও দ্বিতীয় ভাগ প্রকাশিত হয় ১৮৫৩ সালে।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার লেখকদের বিজ্ঞানের লেখা লিখতে শুধু উৎসাহ দিতেন না এমনকি লেখালেখির ব্যাপারে মূল্যবান পরামর্শও দিতেন। তিনি বাংলা ভাষায় পাটিগণিত ও বীজগণিতের বই লিখতে লেখকদের উৎসাহ ও পরামর্শ দিতেন যেমনটা দিয়েছিলেন বাংলা ভাষায় গণিতের বই রচনার পথিকৃৎ প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারীকে বাংলায় বীজগণিতের বই লেখার ব্যাপারে। প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী প্রথম পাটিগণিত ও বীজগণিতের বই লিখেছিলেন। পাটিগণিত বইয়ে শব্দ সংকলনের ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের করা অনেক সাহায্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন আর এই বীজগণিত বইয়েও তিনি বিদ্যাসাগরের কথা লিখেছেন ও তাঁর প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। বিদ্যাসাগর মশাই উৎসাহ ও প্রেরণা জুগিয়েছেন অনেক গণিত তথা বিজ্ঞান লেখককে বাংলায় গণিতের বই লেখার জন্য যাঁদের মধ্যে রয়েছেন গণিত বিজ্ঞান গ্রন্থের লেখক জয়গোপাল গোস্বামী, পাটিগণিতাংকুর বইয়ের লেখক ভূবনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, গণিতাংকুর বইয়ের লেখক চন্দ্রকান্ত শর্মা, পাটিগণিত বইয়ের লেখক কালীপ্রসন্ন গঙ্গোপাধ্যায় সহ অনেকেই। দুঃখের বিষয় এই যে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'পরমকারুণিক'
ঈশ্বর-ধারণার সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় তত্ত্ববোধিনী সভার গ্রন্থাধ্যক্ষ কমিটি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন বিদ্যাসাগর। আবার, অক্ষয়কুমারের উৎসাহদাতা ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, যাঁর কাছ থেকে ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলনে শরিক হন। তাঁর যুক্তিবাদী মন ধর্মের নানা মতবাদকে প্রশ্ন করতে শিখিয়েছিল। তিনিও ধর্ম ও দর্শনের পরস্পরবিরোধী তত্ত্বের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিলেন আর যার ফলে ১৮৫৫ সালে ব্রাহ্ম ধর্ম ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ত্যাগ করেন। তত্ত্ববোধিনী সভা ত্যাগ করার পর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা ও বাংলায় বিজ্ঞানের লেখার জন্য উৎসাহ যেমন থেমে যায়নি ঠিক তেমনি অক্ষয়কুমার দত্ত ও রচনা করে গেছেন বাংলায় বিজ্ঞানের নানা লেখা ও বই। ১৮৫৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর লেখা বিজ্ঞানের বই 'পদার্থবিদ্যা'। এক সময় সভার প্রতিষ্ঠাতা দেবেন্দ্রনাথের ধর্মমতের পরিবর্তন ঘটে এবং তাঁর সঙ্গে সভার পরিচালকদের অনেক বিষয়ে মতানৈক্য হয় আর এই মতানৈক্যর ফলে ১৮৫৯ সালের মে মাসে তত্ত্ববোধিনী সভা উঠে যায়। এর সঙ্গে পেপার কমিটিও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা পরিচালনা ও বই প্রকাশনার দায়িত্ব পড়ে কলকাতা ব্রাহ্মসমাজের ওপর। অক্ষয়কুমার দত্তের পরে বিভিন্ন সময়ে পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন নবীনচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অযোধ্যানাথ পাকড়াশী, হেমচন্দ্র বিদ্যারত্ন, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ এই তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা ১৯৩২ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে৷
অক্ষয়কুমার দত্ত ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর—দুজনেই ছিলেন আদ্যন্ত বিজ্ঞানপ্রেমী ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। এ'বছর বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথপ্রদর্শক এই দুই নমস্য ব্যক্তির ২০৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে দুজনের প্রতি রইলো সশ্রদ্ধ প্রণাম আর সেই সাথে স্মরণ করি ১৮২ বছর আগের এই বাংলায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোর দিশারী 'তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা'-কে।
তথ্যসূত্রঃ–
বাংলাপিডিয়া,
উইকিপিডিয়া (বাংলা ও ইংরেজি),
বিদ্যাসাগরের বিজ্ঞান ভাবনা– ড. রবীন্দ্রনাথ পাত্র, অক্ষর পাবশিকেশনস্, ত্রিপুরা।