গল্প - আর্যা ভট্টাচার্য
Posted in গল্প“এত ভালোবাসি তোমাকে  তাও তোমার  সন্দেহ  যায় না?  কেমন মেয়েছেলে  গো তুমি? “
“ দেখি কতদিন  থাকে এই ভালোবাসা “, মন্টু  হাত  বাড়িয়ে  জড়িয়ে  ধরতেই ফোঁস  করে ওঠে ঝুমা।
“এই তো সেদিন  দেখলাম বৌয়ের সঙ্গে  সিনেমা দেখতে  যাচ্ছ। অথচ  বউয়ের সঙ্গে  নাকি  ভাব নেই ; বউ নাকি  তোমার  দজ্জাল।
আর তাছাড়া  নন্টে আর রেখা তো আকাশ থেকে  টপকে পড়েনি।“  ঝাঁজিয়ে উঠে  ঠোঁট  বেঁকিয়ে  বলে  ঝুমা
“ আরে ছাড়তো  ওসব মান্ধাতা আমলের  গল্প”
এই এক দোষ  ঝুমার । বড্ড এককথা ঘ্যান ঘ্যান করে।
“, আমাদের কথা বলো সোনা ” -ঝুমার কানের কাছে  নাক ঘষে বলেছে কি বলেনি, ঠিক  সেই  সময়  আড়চোখে  মন্টু একটা  পুলিশকে  আসতে দেখল। ব্যাস,    লেকের ঝোপে ঠ্যাসান দিয়ে  বসে থাকা  মন্টু, যেন  কিছু খেয়ালই  করেনি এমন মুখ করে দাঁড়িয়ে  উঠে  প্যান্টের ধুলো  ঝাড়তে ঝাড়তে  ঝুমাকে বলে, “একটু হাঁটি চলো'
“আমাদের কি কথা ? “
মন্টুর আহ্লাদীর উত্তরে ঝুমার পালটা প্রশ্ন।
“কেন  তুমি কি  পেল্যান পালটেছো নাকি?
“ তুমি ভাবলে  কি করে ঝুমাসোনা আমি পেলান পালটাবো ! তুম মেরী জান হো, জাহান হো…”
“ আর তুম জিন্দা শায়তান হো”, বলে খিলখিলিয়ে  হেসে ওঠে ঝুমা।
তারপর মন্টুর গালে একটা  টোকা দিয়ে  বলে, “পুরো  সারুক খান। আমার নিজের   সারুক খান”
আনন্দে  খি খি করে  হেসে ঝুমার  কাঁধটা আবেগের আতিশয্যে  জড়িয়ে ধরে  মন্টু।
আহ্লাদে দুজনেই  গলে জল।
কিন্তু  সময়  চলে  যাচ্ছে।  কাজে কাজেই রং পিরিতি ছেড়ে কাজের কথায়  আসে মন্টু।
“ বাজে কথা অনেক  হয়েছে,  এবার  কাজের কথাটা ভালো করে  মাথায়  বসিয়ে নাও বেবি” ;  হালদার  স্যারের ছেলে  ওর লাভারকে যেমন ভাবে  বলে, সেটাকে পুরো  নকল করে  এখানে লাগিয়ে দেয় মন্টু।
“ শোনো, যেমন  কথা আছে,  আমি রাত  বারোটা সাড়ে বারোটা নাগাদ  চলে     আসবো। ম্যাক্সিমাম একটা।  ঠিক আছে ?    তুমি তোমার  ঘরের  দরজাটা  খালি ভেজিয়ে রেখো। আর দেখো তোমার নিকম্মা ঘাটের মড়া বরটা  যেন  ঘুমিয়ে  থাকে। তোমার তো আর এন্ডি গেন্ডির ঝামেলা  নেই। তোমার বুড়ো  বর, ওই পরেশ জ্যাঠাকে এভড করতে পারলেই  কেল্লা ফতে।  সালা,  সব  ঝামেলা  খতম। “
“কিন্তু  আমরা  যাবো  কোথায় সেটা তো এখনো  বললেনা। পরেশ বুড়ো  কিন্তু  ছেড়ে  দেবার পাত্র নয়। পারটির লোকজন  ডেকে সাতখান করবে। তুমি  তার বউ নিয়ে  ভাগছো,  আর সে কি ছেড়ে  দেবে নাকি? “
“ ভাবছি  ধানবাদে চলে  যাব আমরা।  ওখানেই  ঘর বসাবো।“
“আর তোমার  কাম কাজ?”
“ ড্রাইভারের কাজের কখনো  অভাব হয়না,  বুঝলে সোনা?”,   ড্রাইভারির গর্বে  মটমট  করতে করতে বলে মন্টু।
তারপর  আহ্লাদীর আশা আজ তেমন  পুরণ না হওয়ায়, শেষ  চেষ্টা  হিসেবে  ঝুমাকে জড়ানোর একটা  ব্যর্থ প্রয়াস নিয়ে  বলে,
“ মেরি জান ঝুমা, এখন  তুমি মুখ না ছুটিয়ে মুখ খুলে আমাকে একখানা মিষ্টি  কিসি  দাও দেখি”
মন্টুর আবদারে কান না দিয়ে  ঝুমা  কি একটা  ভাবতে  ভাবতে  বলে  ,  “ আর তোমার  বউ?  “
আশাহত  মন্টু ঝুমাকে  মুখ ভেংচে  বলে,  “  আর তোমার কাজের বাড়ির  খেঁচি বউদি? তার কি হবে?”
“ তা দিয়ে  আমার কি?   মালদার ফেমিলি, টাকা  ফেললে লোকের অভাব?  আর লোক না পেলে  মরুক খেটে। দেখুক কত ধানে কত চাল। অফিস থেকে  বাড়ি ফিরেই  খালি ক্যাটর ক্যাটর। দাদার অবশ্য  একটু অসুবিধে হবে।  দাদা অফিস  থেকে  ফিরলে আমাকেই তো চা টুকুও করে দিতে হয়। চাকরি  করা সুন্দরী  দেমাকি  বউটাকেও দিতে হয়। সে তো  নড়েও বসেনা।
এই,  তুমি  হটাৎ কাজের বাড়ির  বউদির  কথা  বললে কেন ? নোলা জেগেছে  বুঝি? … যাও না যাও, জুতোর  বাড়ি  খেয়ে এসো।.. হআআরামী শালা”
“ আহা রাগ করো কেন..যতই  যা হোক  তোমার  মতো তো নয়। ও তো  আমি  রেগে গিয়ে বললাম।  বউয়ের  কথা বলে  তুমি আমার  মেজাজ খাট্টা করে দিলে না? তাই। যাক গে,  ছাড়ো ওসব  কথা। কাজের কথায়  এসো।  পরেশ জ্যাঠার টাকা পয়সা  যতটা  পারো হাতিয়ে নিয়ে  তুমি একদম  রেডি  থেকো। রাত একটা  নাগাদ  জগা ওর ট্যাক্সি করে আমাকে  নিয়ে আসবে। আর হ্যাঁ,  এই যে  এই ট্যাবলেটটা নাও। বুড়োকে কায়দা করে খাইয়ে দিও । “
“কি ওষুধ  এটা?”, মন্টুর দিকে চোখ  সরু করে জিজ্ঞেস করে  ঝুমা।
“ বিষের বড়ি। হয়েছে  তো?..  উ: এই মেয়েছেলেটার সন্দেহবাতিক আর যায়না। ঘুমের ওষুধ রে বাপু,  ঘুমের ওষুধ  আর কিছু  নয়.; বাপরে  বাপ”, -রেগে গিয়ে  প্রায়  চেঁচিয়ে  ওঠে  মন্টু।
“ ঠিক  আছে, ঠিক আছে,  সময়ে চলে  এসো”
প্রায় নটা হয়ে  গেছে,  লেক থেকে বেরিয়ে  মন্টু আর ঝুমা যে যার বাড়ির  দিকে  চলে যায়।
রাত ঠিক  সাড়ে বারোটা। মন্টু ঝুমাকে নিয়ে  পালাবে বলে  হাজির। জগা ট্যাক্সি নিয়ে  ঝুমার বাড়ির  সামনে  দাঁড়িয়ে।  গাড়িতে স্টার্ট দেওয়াই আছে।। গলি দিয়ে এসে  মন্টু আর ঝুমা সবে গাড়িতে  উঠে  বসেছে আর তখনই “ধর, ধর পালালো  পালালো “ আওয়াজ। কি করে যেন জেনে গিয়ে  বস্তির  কয়েকটা মুশকো ব্যাটাছেলে  আর মেয়েছেলে প্রাণপণে  ছুটে  আসছে।  আর তাদের পিছনে চেঁচাতে চেঁচাতে হোঁচট  খেতে খেতে  ঘুমের জ্বালায় মাতালের মতন  টলমল  করতে  করতে আসছে ঝুমার বর পরেশ।
এই দেখে জগা স্যাট করে ফুল  স্পিডে গাড়ি  ছেড়ে  দিয়ে বেড়িয়ে যেতে  গেল।  আর রাতের রাস্তায় “ ধর, ধর ওদের,   পালাতে দিসনা কিছুতেই “ বলে পরেশ  আর্ত চিৎকার করতে  লাগলো।
“ এই, এ রকম  গোঁ গোঁ করছো কেন? বাজে স্বপ্ন  দেখেছো নাকি?.. এই পিউ!”
শুভ্রর ঝাঁকানিতে ঘুম ভেঙে   বিস্ফারিত চোখে ধড়মড় করে  বিছানায়  উঠে  বসে  পিউ। ঘরে এসি চলছে  তাও পিউ একেবারে  ঘেমে নেয়ে একশা হয়ে গেছে । বুকের ভেতরটায়  সাংঘাতিক   কষ্ট  হচ্ছে।  গলা শুকিয়ে কাঠ।
কোনো  রকমে হাত বাড়িয়ে  বেড সাইড টেবিল  থেকে  জলের  গ্লাসটা  নিয়ে  এক নিশ্বাসে  সবটা জল খেয়ে ফেলে পিউ। তারপর  খানিক  ধাতস্থ হয়ে  শুভ্রের  দিকে  মুখ ফিরিয়ে  বলে
“জানো এইমাত্র কী আতংককর একটা  স্বপ্ন  দেখলাম।
দেখলাম, আমাদের  কাজের মেয়ে ঝুমা তিনতলার মিস্টার  হালদারদের ড্রাইভার  মন্টুর সঙ্গে  কলকাতা ছেড়ে,  আমাদের বাড়ির  কাজ ছেড়ে  পালিয়ে  যাচ্ছে। “
এইটুকু  বলেই পিউ আবার প্রবলভাবে  হাঁপাতে থাকে।
“ উ: কী শুরু  করেছো বলোতো! একটু ঘুমোতে  তো দেবে।  ফর গডস সেক, ঘুম ভাঙিয়ে এখন  তুমি আর স্বপ্ন  পুরাণ  নিয়ে বসোনা। “
ঘুমে জড়ানো  বিরক্ত  স্বর শুভ্রর।
শুভ্রের  কথায় বিন্দুমাত্র  পাত্তা না দিয়ে  উত্তেজিত  ভাবে দশটাকার রসগোল্লার মতো  চোখ  করে পিউ ঝাঁঝিয়ে  ওঠে,
“ তোমার  তো অফিস  ছাড়া  মাথায়  কিছুই  থাকেনা।   ডিনারের সময় বললাম না, কাল  আমি বাড়ি  ফিরতে  না ফিরতেই পুপে কে আমার কোলে ধরিয়ে দিয়ে, “ আজ একটা  খুব  দরকারী  কাজ আছে বউদি; আমাকে আজ একঘন্টা  আগেই ছুটি  দিতে হবে।  “
বলেই নেকিশ্বরী চটি ফটফটিয়ে বেড়িয়ে গেল।  আর সাজের কী বাহার! '
'সে তো  মাঝে  মাঝেই  তারাতাড়ি  চলে যায় । তুমি আর হেজিওনা তো। একটু ঘুমোতে দাও,  প্লিজ “ জড়ানো  আধা ঘুমন্ত গলায় কোন  রকমে বলে শুভ্র।
“ বাকি  কাহিনী তুমি  তো শুনলেই না।
আরও  আছে।
ওর হাবভাব দেখে  আমার কেমন  একটা  সন্দেহ  হলো।
ঘরের আলো  নিভিয়ে  জানলা দিয়ে  উঁকি  মেরে দেখি, গ্যারাজের পিছনের হালকা  অন্ধকার মতো  জায়গাটায় ঝুমা সুন্দরী  আর হালদারদের ড্রাইভার  মন্টু হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে  ফিসফিস  করছে। কথাগুলো  ন্যাচারালি  শুনতে পাইনি।   কিন্তু  মনে হল বোধহয়  চুমাচাটি করছিল।“
“ বেশ করছিল।  পরকীয়া কি কারুর একচেটিয়া  নাকি?.. এই পিউ  তুমি  আমাকে  ঘুমাতে  দেবে কিনা? .. চুপ  করো প্লিজ.. প্লিইইইজ। আর শোনো, স্বপ্ন  স্বপ্নই।  সত্যি  নয়।“
“ঠাকুমা  বলতো ভোরের স্বপ্ন  সত্যি হয়। আর স্বপ্নটা তো আমি ভোরেই দেখলাম।  শুভ্র! এই ভোরের স্বপ্নটা যদি সত্যি হয়? ঝুমা যদি মন্টুর সঙ্গে সত্যি পালিয়ে  গিয়ে  থাকে? আজ থেকে  যদি  আর না আসে?  আমি কী করবো!  আজ আমাকে তো অফিস  যেতেই হবে।  ক্লায়েন্ট মিট আছে। হে ভগবান !  ঝুমা যেন কাজ ছেড়ে   পালিয়ে  না যায়।যেন  আসে”
ভয়ে আতংকে প্রায়  নীল হয়ে  কাঁপতে কাঁপতে  ফুঁপিয়ে  ওঠে পিউ।
আর ঠিক  তখনই  সিচুয়েশনটা রিয়ালাইজ করে শুভ্রও আতংকে  কেঁপে উঠলো।
শুভ্রর মনে হল এইমাত্র  তার মাথায়  যেন একটা  সাত মণি  হাতুড়ি  এসে পড়লো।
আররে, সর্বনাশ !  কাল তো অফিসের কয়েকজন,  যাঁরা  ইম্পর্ট্যান্ট  তাঁদের  মিট করতে নতুন  জি এম আসছেন।  আর সেই মিট করার গ্রুপে বহু প্রতিকুলতা ট্যাকল করে এবং  অনেকের চক্ষুশূল  হয়ে,  তাদের হিংসা জ্বলা বুকের  উপর দিয়ে  বিজয় রথ চালিয়ে,  অনেক  বদ দুয়া মাথায়  নিয়েও সে নিজের নাম ঢোকাতে পেরেছে।
এখন  ঝুমা না এলে  পুপেকে দেখবে কে?  কার কাছে  থাকবে পুপে!  এদিকে  সকাল আটটার মধ্যে  শুভ পিউ দুজনকেই  অফিসে যাবার জন্য  বেরিয়ে  যেতে হবে।  এতো  তাড়াতাড়ি  কোন  অল্টারনেটিভ ব্যবস্থা করা,  জাস্ট ইম্পসিবল।
পিউয়ের ও ক্লায়েন্ট  মিট আছে।
খেয়েছে  রে, আজ দুজনের মধ্যে  একজনের  চাকরি  তো যাবেই।
পিউ কি আর দান ছাড়বে?  তবে কি শুভ্র কেই?...
শুভ্রর ঘুম টুম ততক্ষণে  মাথায়  উঠেছে।  জ্যা মুক্ত  ধনুকের মতো লাফ দিয়ে এবার  সে বিছানার উপর উঠে  বসলো। পিউয়ের  পাশেই।
বিস্ফারিত  দুই চোখ,  খাড়া খাড়া চুল, ভয়ে সাদা মুখ, যেন  ভয়ংকর  কোন  হরার ফিল্ম দেখেছে,  অথবা  একপাল ভুত ই দেখে উঠেছে ।
ভয়ংকর  এক একটা  মুহূর্ত।  ঘড়ির  টিক টিক টিক টিক।
ওই যা:  ভোর হয়ে  গেলো।
ভয়ে আতংকে  অস্থির  বাক্যি হরে যাওয়া আই.আই.টির দুই আই.টি পাশাপাশি  বসে থাকে।
নিশ্চল।
একই চিন্তা  দুজনের  মাথায় ।  ঝুমা না এলে হয় তাদের চাকরি  যাবে,  না হলে তুমুল ঝগড়ার পরে বিয়েটা শেষ  হয়ে  যাবে। পাক্কা ডিভোর্স।
এ হবেই হবে।
আর মাত্র  আধঘন্টার অপেক্ষা।  সরু সুতোর উপর দিয়ে হাঁটা এই আধঘন্টা।
কান খাড়া করে কলিংবেল বাজার প্রার্থনায় কাঠ হয়ে বসে থাকে দুটি  আতংকিত  প্রাণী,  শুধুমাত্র  ঝুমার আসার অপেক্ষায়। আশা আশংকার দোলাচলে  দুলছে তাদের  পৃথিবী।
পিউ আর শুভ্র   হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ' আয় খুকু আয়' গানের    সুরে মনে  মনে  বলতে থাকে , “ আয়  ঝুমা  আয়…আয় ঝুমা আয়…।।










 
