কবিতা - আশীষ কুমার বিশ্বাস
Posted in কবিতানদী ভাসা খড়-কুটো
কবিতার খুঁটি
এ ভাবেই সাজিয়েছি
কবিতার গুঁটি ।
নাই তার ভরসা
ভেসে ভেসে চলে
এ কবিতা জীবনের
অন্য কথা বলে ।
অভাব অনটন আছে
আয় করার পথ খোঁজে
বাঁধা আছে পদে পদে
অপরাধে মাথা গোঁজে ।
মায়ের প্রবল অসুখ
বাবার বেতন নেই
দিদির বিয়ের বয়স
মন তাই সুখে নেই !
ভাইয়ের স্কুল আছে
বোনের পড়া নেই
বেটি বাঁচাও , বেটি পড়াও
তাঁতে আর তাড়া নেই ।
সুখের কথা ভাবি নাকো
দুঃখে দিন যাপন
দুঃখেই কবিতা লিখি
এ ভাবেই উদযাপন ।
কবিতা - অমিতাভ মুখার্জী
Posted in কবিতাসত্যি করে বলছি
তোমাকে আমি দীপিকা
বলে ডাকিনি
তোমাকে হলফ করেছি
আমি আর দীপিকার সাথে একই
ফ্লাইটে বিজনেস ট্রিপে আর যাব না
তোমাকে আগেই বলেছি
আমি যখন ভুট্টার ক্ষেতে ঘুরে বেড়াই
সূর্যের আলোয় যে মুখ বারবার
ভেসে আসে, সে ত’ দীপিকারই
তুমি জানতে আমি চোখ
রেখেছিলাম ঐ রাঙা মেয়েটির দিকে
সে কেউ নয়, সেই চোখ দীপিকারই
তোমার বারংবার বারণ শোনার পর
আমি বলিছি
আমি দীপিকাকেই চুম্বন করেছি
তোমাকে এটা বলতে ভুলে গেছি
প্রতি রাতে যে তারা গুলোর আলো
খসে পড়ে তাদের ত্বকে
তাদের সবাইয়ের ত্বক দীপিকারই ত্বক
তুমি এত রাগ করে থেকো না
আমার চোখে সব লুকোনো
ভালোবাসা দীপিকার চোখেরই
আমি যেদিন শীতের সকালে
ব্রেকফাস্ট টেবিলে তোমার নাম ভুলে
দীপিকা বলে ডেকেছিলাম
তুমি তাকিয়ে ছিলে আমার দিকে
কিছু বলে ওঠোনি
তুমি মাধুরী সেদিন আমায় কিছুই বলনি
শুধু তাকিয়ে ছিলে
আমি তোমার চোখে গোপনে চোখ রেখেছিলাম
সত্যি বলছি সেও দীপিকারই
আজ সন্ধ্যেতে ডিনার শেষে
পোর্ট ওয়াইন নিয়ে মাধুরী
তোমার সাথে যে গল্প হয়েছে
তা বেশীর ভাগ দীপিকাকে নিয়ে
তোমাকে কথা দিয়েছি
দীপিকাকে নিয়ে
আর কিছু বলবো না ২০২৪-এ
মাধুরী আছ, যেমন ছিলে
বছর বছর আমার দীপিকা
পালটে যায়
এবার নতুন কোনো দীপিকা
কিছু মনে করো না—সহজ হয়
সহজ ভাবে নাও
গোপন তারা গুলোর আলো
খসে পড়ে তাদের ত্বকে
আর দীপিকার নাম লেখা নেই
হয়ত বা অন্য কেউ
হয়ত বা সেই দীপিকা
আবার দীপিকাই হয়ে।
কবিতা - সব্যসাচী রায়
Posted in কবিতাআজকে আকাশ ঘুড়ি আর ওয়াইফাই সিগনালের সেলাই।
হোলির কথা মনে পড়ে, রং মাফ করে, যতক্ষণ না বৃষ্টি আসে।
চায়ের দোকানে কেউ বলে, "ভারত তো আমেরিকা, সাবটাইটেল দেওয়া।"
সবাই হাসে, যেন সত্যি। হয়তো তা-ই।
এখানে, বলিউডের স্ক্রিপ্ট নিজেকে পাল্টায়: হিরো আগেই মরে যায়,
ভিলেন একটি স্টার্টআপ চালায়, আর কোরাস গায় ভাঙা কোডে।
স্বপ্নগুলো আবার বিগড়ে গেছে। গঙ্গার জল উল্টো দিকে বইছে,
গরু আর ক্রিকেট ব্যাট ভাসিয়ে নিচ্ছে, ব্যর্থতার রেখাচিত্র আঁকছে।
ট্রেনে বাড়ি ফেরার পথে গুগলে সার্চ দিই "বিশ্বাস পুনর্জীবিত করার উপায়"
উত্তরে পাই ডালের রেসিপি। বিদ্রূপের স্বাদ বেশ বাড়ির মতো।
ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী
Posted in ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকেইলিশ পোলাও
ইলিশ মাছের রাউন্ড পিস। একটু মোটা করে কাটা। নুন মাখিয়ে রাখতে হবে। কালিজিরা চাল ধুয়ে জল ঝরিয়ে, চাল শুকিয়ে গেলে তাতে নুন ও ঘি মাখিয়ে রাখতে হবে। অন্তত আধঘণ্টা রাখতে পারলে ভালো।
এবার, সামান্য হলুদ, প্যাপরিকা, সামান্য গরম মশলা গুঁড়ো, চিনি, নারকোলের দুধ দিয়ে গুলে একটা মশলা তৈরী করে নিতে হবে। তেল গরম করে দুটো কাঁচালঙ্কা চিরে তাতে দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে ওই গোলা মশলাটা কষাতে বসাতে হবে। মশলার কাঁচা গন্ধ চলে গেলে মাছের টুকরোগুলো দিয়ে এপিঠ ওপিঠ করে প্যান আঁচ থেকে সরিয়ে রাখতে হবে, কিন্তু মাছ প্যানেই থাকবে।
আরেকটা প্যান বসিয়ে তাতে আবার তেল দিয়ে কাজু ভেজে তুলে রাখতে হবে। আর আবারও দুটো চেরা কাঁচালঙ্কা দিয়ে চালটা ভাজতে হবে। পুটপুট করতে শুরু করলে বোঝা যাবে হয়ে গেছে, তখন উষ্ণ গরম জল ঢালতে হবে। যতোটা চাল, তার দ্বিগুণ জল। জল ফুটে উঠে, একটু টেনে এলে, মাছের টুকরোগুলোকে,ভাত দুইপাশে সরিয়ে, বসিয়ে দিতে হবে। তারপর ওপর দিয়ে মাছের মশলা সব দিয়ে আঁচ একেবারে কমিয়ে ঢাকা দিয়ে রান্না করতে হবে। কটা কিশমিশ দিতে হবে।
নামনোর সময়ে খুব সাবধান, মাছ ভেঙ্গে না যায়। সামান্য কাজু আর কিশমিশ দেওয়া একেবারেই ঐচ্ছিক।
কালিজিরার বদলে গোবিন্দভোগ, চিনিগুড়া বা বাসমতী চালও ব্যবহার করা যায়। প্যাপরিকার পরিবর্তে লাল লঙ্কার গুঁড়ো দেওয়া যায়, সেক্ষেত্রে ঝালটা কিন্তু বেশী না হয়ে যায় খেয়াল রাখতে হবে।
ছবিতে পুজোর ভোগে নিবেদন করা, ইলিশ পোলাও।
সম্পাদকীয়
Posted in সম্পাদকীয়বাতাসে আবার সেই পরিচিত বাৎসরিক উৎসবের ছোঁয়া। বইমেলা দোরগোড়ায়। এবারের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল অনেক দেরিতে। পরিস্থিতি অনুকূল ছিল না। একটি ভয়াবহ অপরাধের আবহ আমাদের চিন্তন করে দিয়েছিল অবশ। উত্তাল হয়ে উঠেছিল এই নাগরিক সমাজ। সেই সূত্রে সদ্য যখন কোনও একজনের শনাক্তকরণ আর সাজা ঘোষণা হল, আমাদের বিবেকের পরিশুদ্ধি হল কি? অপরাধ প্রবণতার বাস মানুষের মনের গভীরতম বিন্দুতে। অনেক ক্ষেত্রে আদিম এজাতীয় প্রবণতা জিনগত। সভ্যতার আলো, তা সে যত জোরালোই হোক না কেন, এখনও পৌঁছয়নি নিকষতম সেই স্থানে।
এই মুহূর্তে দাঁড়িয়েও জোর গলায় নিজেদের সভ্য বলতে পারি কি? সম্প্রতি এক বিখ্যাত ব্যক্তির ওপর আততায়ী হামলা নিয়েও দেখা গেল রাজনৈতিক চাপানউতোর। অপরাধ এবং তার প্রেক্ষাপট কার্যত হয়ে পড়ল গৌণ।
বইয়েরই সম্ভবত একমাত্র সেই শক্তি রয়েছে, যা আমাদের ভাবনাকে করতে পারে যুক্তি আর ন্যায়সঙ্গত। দিতে পারে সৃজনশীল ডানা এবং অবশ্যই শুশ্রূষা করতে পারে রুগ্ন মনের। অপরাধের আঁতুড়ঘর যা।
সুস্থ থাকুন। সৃজনী থাকুন।
শুভেচ্ছা অফুরান।
প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধগরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?
--সুকান্ত
একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’র ডেটা বলছে ২০২১ সালে আমাদের গোটা দেশে বিভিন্ন ঘটনায় খুন হয়েছে ২৯,২৭২ জন। অথচ, ‘বেপরোয়া গাড়ি চালানো’য় মারা পড়েছে ৪৩, ৪৯৯ জন। তাহলে যারা বেপরোয়া গাড়ি চালায় তারা সবচেয়ে বড় খুনি? কারা চালায় অমন ভাবে গাড়ি? গতির নেশায় মাতাল হয়ে!
এদের কাছে আছে বুঝি মস্ত হাওয়াগাড়ি?
আছেই তো, মার্সিডিজ, পোর্শে, বিএমডব্লিউ,? কাদের আছে? যারা কোটি টাকার গাড়ি কিনতে পারে, জন্মদিনে নাতিকে অমন গাড়ি উপহার দিতে পারে।
তারপর সেই গর্বিত নাতি বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে গাড়িতে বসে আর হাওয়াগাড়ি উড়ে চলে হাওয়ার বেগে, দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে। পথচারীরা ঝড়ের সামনে শুকনো পাতার মত উড়ে যায়। আর ‘চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন’-- কেউ শোনে না।
চালকের কখনও মনে হয়-- ‘অজস্র মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম’। সে গাড়ি থামায়, তবে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে। উদ্দেশ্য একটাই অপরাধ থুড়ি দুর্ঘটনার সাক্ষ্য মুছে ফেলা। নেমপ্লেট বদলে দেয়া, রক্তের দাগ ধোয়া, ড্রাইভার বদলে নেয়া।
কিন্তু পিষে দেয়া মানুষগুলো? যাদের সময়মত হাসপাতালে নিয়ে গেলে কিছুটা বাঁচার সম্ভাবনা ছিল? না, এরা হাওয়াগাড়ি থামিয়ে সেই লোকগুলোকে তোলে না। তাহলে যে দুর্ঘটনার দায় নিতে হবে! আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। বাজারে বদনাম হবে।
ব্যাপারটা বোধহয় আর একটু অন্যরকম।
আসলে এদের হয়তো কোন দোষ নেই। দোষ তাদের যারা গাড়ির সামনে এসে গেছল। হাওয়াগাড়ি তো হাওয়ার বেগেই চলবে।
তবুও সুর্য এখনও পূবে ওঠে, পশ্চিমে ডোবে।
তাই কিছু কেস খবর হয়। কিছু কেসে পুলিশ আসে, গ্রেফতার করে। জামিন হয়, মামলা চলে। মোটা টাকার অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। তারপর সবাই ভুলে যায়। ভোলে না নিহতদের পরিবার। ওরা ভগবানকে ডাকে আর আশা করে-- একদিন ন্যায়ের দণ্ড নামিয়া আসিবে।
দুর্ঘটনার ডিফেন্স
কেস খেলে এসবের জন্য বাঁধা ডিফেন্স আছে।
এক, আমি চালাচ্ছিলাম না, আমার ড্রাইভার চালাচ্ছিল।
--তাহলে ড্রাইভার জেলে যাবে। আমার অর্থদণ্ড হবে, ড্রাইভারের পরিবারকে মোটা টাকা দেয়া হবে। ওরা মুখ বুজে মেনে নেবে। একেবারে বজ্রসেন-উত্তীয় কেস!
দুই, আমি চালাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু মদটা একটু বেশি গিলেছিলাম। চোখে আবছা দেখছিলাম। কাউকে চাপা দিয়েছি? আমার কিচ্ছু মনে নেই।
--এটা ভাল ডিফেন্স। সঙ্গে সঙ্গে আইন অনুযায়ী অপরাধের মাত্রা কমে যায়। কেসটা ধারা অনিচ্ছাকৃত নরহত্যা থেকে অসাবধানে মদ খেয়ে চালিয়ে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, অর্থাৎ ধারা ৩০৪ থেকে ৩০৪এ হয়ে যায়।
আহা, বেচারি! ভালমানুষ। একটু নেশা হয়ে গেলে কী করবে? ও খুনি নয়।
ফলে দু’বছরের জেল এবং মোটা অর্থদণ্ড। অথবা প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে শুধু অর্থদণ্ড। কেউ জিজ্ঞেস করবে না-- এই অবস্থায় কেন গাড়ি চালিয়েছিলে বা তোমার কাজের পুরো দায়িত্ব কেন তুমি বইবে না?
তিন, আমি পূর্ণবয়স্ক নই। ১৮ পূর্ণ হতে এখনও চার দিন বাকি! আমার বিচার প্রাপ্তবয়স্কদের আইনে হবে না, জুভেনাইল বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের আইনে হবে।
--এই কেসে গার্জেনদের দু’বছরের জেল এবং মোটা অর্থদণ্ড হবে। গাড়িটির লাইসেন্স একবছরের জন্য বাতিল। আর আদরে বাঁদর হওয়া কুলতিলক যাবেন সংশোধনাগারে ,মানসিক কাউন্সেলিং এর জন্য—সেটা তার নিজের মাসির বাড়িও হতে পারে। আর তাকে কয়েকমাস বা এক বছর কমিউনিটি সার্ভিস করতে হবে।
সেটা কী জিনিস কেউ জানে না। কোন আইনে বলা নেই। সেটা কি মন্দিরে করসেবা? হাসপাতালে কাউন্টারে বসা? নাকি এক লক্ষ বার রামনাম লেখা? শুধু বিচারক জানেন। কিন্তু আদরে বাঁদর ছেলের কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের জন্য কোন ধনীর দু’বছরের জেল হয়েছে শুনেছেন কখনও? আমি তো শুনি নি। শুনলে বলবেন তো!
চেনা গল্পঃ চেনা ছক
১
রাজধানী দিল্লি; এপ্রিল ২০১৬। মার্কেটিং পেশার সিদ্ধার্থ শর্মা (৩২) কাজের শেষে বাড়ি ফেরার পথে নর্থ দিল্লির সিভিল লাইন্স এলাকায় একটি মার্সিডিজের নীচে পিষে গেলেন। যে ছেলেটি বাবার গাড়ি চালাচ্ছিল তার বয়েস ১৭ বছর ৩৬১ দিন। অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক হতে মাত্র চার দিন বাকি।
ছেলেটির লাইসেন্স ছিল না। পুলিশের রেকর্ড বলছে সে এর আগেও তিন বার ট্রাফিক আইন ভেঙে ফাইন দিয়েছে। তদন্তে দেখা যাচ্ছে যে ও ট্রাফিক পুলিশের কাছে তিনবারই ‘মিথ্যে’ তথ্য দিয়েছিল। ছেলেটির পরিবার তাদের বাড়ির ড্রাইভারকে থানায় পাঠিয়ে দিল –যাও, গিয়ে বল যে তুমিই তখন গাড়িটা চালাচ্ছিলে।
সিসিটিভির ফুটেজ, চাকার দাগ এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে পুলিস বোঝে যে ছেলেটি সেদিন সন্ধ্যায় ট্রাফিক রুলে স্বীকৃত গতির চেয়ে বেশি স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছিল।
পুলিস বলে নতুন আইন অনুযায়ী অপরাধীকে নাবালক নয়, প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিচার করা হোক। কিন্তু জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট (২০১৫) অনুসারে সেটা সম্ভব যদি নাবালকের করা কাজটি ‘জঘন্য’ (heinous) অপরাধের শ্রেণীতে আসে। তাহলে শাস্তি - অন্ততঃ সাত বছরের জেল।
জুভেনাইল বোর্ড সব দেখেশুনে তার সাত পৃষ্ঠার রায়ে বলল—এই ছেলেটির বিচার প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেই হোক। ও যে কাজটা করেছে তার সম্ভাব্য ফলাফল সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। সে মানসিক এবং শারীরিক , দু’দিক থেকেই, এমন অপরাধ করতে সক্ষম।
ফেব্রুয়ারি ২০১৯শে দিল্লির এক দায়রা আদালত ওই মতেই সায় দিল। কিন্তু দিল্লি হাইকোর্ট এই রায় খারিজ করে দিলে নিহতের বোন শিল্পা শর্মা সুপ্রীম কোর্টে আপিল করে ।
সুপ্রীম কোর্টের মহামান্য বেঞ্চ (জাস্টিস দীপক গুপ্তা এবং অনিরুদ্ধ বোস) হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে মামলা খারিজ করলেন।
ওনাদের মতে ধারা পেনাল কোডের ৩০৪ লাগিয়ে মামলা দায়ের হয়েছে। অর্থাৎ নরহত্যার অপরাধ, কিন্তু মার্ডার বা খুন নয়। এটা ‘জঘন্য’ (heinous) অপরাধের শ্রেণীতে আসে না। তাই ছেলেটিকে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ (জুভেনাইল) মেনে বিচার করতে হবে।
কেন আসে না?
কারণ, অপরাধ যদি ‘জঘন্য’ হয় তাতে ‘ন্যূনতম’ এবং ‘অধিকতম’ দুই শাস্তিরই উল্লেখ থাকে। কিন্তু এই ধারাতে শাস্তি হিসেবে খালি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা আছে। ‘ন্যূনতম’ কোন শাস্তির কথা বলা নেই। অর্থাৎ এই অপরাধ ‘জঘন্য’ শ্রেণীর নয়। অতএব, অভিযুক্তের বিচার জুভেনাইল কোড হিসেবেই হবে, পেনাল কোডে নয়।
বেশ, কিন্তু জুভেনাইল অ্যাক্টের ধারা ২(৩৩) বলছে ‘জঘন্য’ অপরাধ সেটাই যাতে পেনাল কোডে কম-সে-কম সাত বছরের জেল বলা রয়েছে। কিন্তু এতে সাত বছরের বেশি শাস্তি আছে, সাতবছরের কম বা কম-সে-কম কোনও শাস্তি নেই।
জাস্টিস গুপ্তা এটাও বললেন যে খারাপ লাগলেও আমাদের আইন মেলে চলতে হবে। মানছি আইনে ‘ফাঁক’ আছে। কিন্তু আইনে সংশোধন তো সংসদের কাজ, আমাদের নয়। যেখানে আইনের দু’রকম ব্যাখ্যা সম্ভব, সেখানে যে ব্যাখ্যয় নাবালকের জন্য ‘লাভ’ সেটাই মানতে হবে।
জুভেনাইল অ্যাক্টে ছেলেটির শাস্তি হতে পারে—গ্রুপ কাউন্সেলিং, কমিউনিটি সার্ভিস অথবা অর্থদণ্ড!
অভিযুক্ত আর একটা অতিরিক্ত দিনও গরাদের পেছনে কাটাবে না।
বিদ্বান ন্যায়াধীশদের ‘জঘন্য’ অপরাধের সংজ্ঞা নিয়ে এমন ব্যাখ্যায় আমার মত সাধারণ নাগরিক বুঝভম্বুল হয়ে যায়।
২
না, এসব নতুন কোন ঘটনা নয়, অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। তাই তো এত নিয়মকানুন, মোটর ভেহিকল অ্যাক্ট (১৯৮৮), তার সংশোধনী (২০১৯) এবং ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে লোককে আহত করা, নিহত করা, ইচ্ছে করে চাপা দিয়ে মেরে ফেলা ইত্যাদি হয়েছে।
কিন্তু তাতে কি মূল ছবিটা কিছু বদলেছে?
এখন আমরা তিনটে ঘটনা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।
২.১ দিল্লির লোধী কলোনি, ১০ জানুয়ারি, ১৯৯৯
একটি বি এম ডব্লিউ গাড়ি তিনজন পুলিস অফিসার সমেত ছ’জনকে পিষে দিল। ঘটনাটি এরকমঃ
ভারতের নৌবাহনীর প্রাক্তন অ্যাডমিরাল নন্দার নাতি সঞ্জীব নন্দা গুড়গাঁওয়ে রাতভোর পার্টি করার পর তাঁর দুই বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বি এম ডব্লিউ গাড়িটি চালিয়ে দিল্লি ফিরছিলেন। প্রচণ্ড গতিতে চলার কারণে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লোধী কলোনির পুলিশ চেকপোস্টের ভেতরে ঢুকে পড়ে। দু’জন পুলিশ এবং অন্য দুই পথচারি সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আরেকজন পুলিশ ও অন্য এক পথচারি হাসপাতালে মারা যায়। সপ্তম শিকার বেঁচে ওঠেন।
গাড়িটি একটু এগিয়ে থামে, ওঁরা টের পান যে চাকার নীচে লোক। তাঁরা চটপট গলফ লিংকের একটি বাড়িতে গাড়িটি দাঁড় করিয়ে বাড়ির চৌকিদারও ড্রাইভারকে নির্দেশ দেন গাড়ির বনেট ও বাম্পার পরিষ্কার করে ফেলতে।
ওই দুজনকেও পুলিশ সাক্ষ্য-প্রমাণ লোপাট করার অভিযোগে আদালতে পেশ করে।
ক’দিন পরে ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী এসে নিজের সাক্ষ্য দেয়। পুলিশ তিনবন্ধুর বিরুদ্ধে ‘culpable homicide not amounting to murder’এর মামলা রুজু করে।
(মানুষ মরতে পারে জেনেও কিছু করা এবং তার ফলে কারও মৃত্যু= culpable homicide বা নরহত্য্যা। কিন্তু যে নরহত্যা কাউকে মারার উদ্দেশে আগে থেকে ভেবে করা হয় সেটা খুন বা মার্ডার।
১৯৯৯ সালের বিচারে তিনজনই অভিযুক্তই ছাড়া পেয়ে যায়। কিন্তু এ’নিয়ে ফের বিচারের দাবি ওঠে।
২০০৮ সালের পুনর্বিচারে দিল্লির সেশন কোর্ট ২ সেপ্টেম্বর এদের দোষী সাব্যস্ত করে এবং দু’বছরের জেল হয়। এনডিটিভি’র স্টিং অপারেশনে ধরা পড়ে ডিফেন্স ল’ইয়ার সাক্ষীদের মোটা টাকা অফার করছে, আদালত তাদের চার মাসের জন্য লাইসেন্স রদ করে। বলা হয় যে গাড়ির গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১৪০ কিলোমিটার ।
কিন্তু অভিযুক্তরা সুপ্রীম কোর্টে আপীল করলে সর্বোচ্চ আদালত ৩ আগস্ট ২০১২ তারিখে এদের দু’বছর জেলে বিচার চলাকালীন জেলে কেটেছে বলে মুক্তির আদেশ দেয়। এছাড়া ৫০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড এবং দু’বছর কমিউনিটি সার্ভিস করার নির্দেশ দেয়।
২.২ কানপুরের কিশোর, সাতমাসের মধ্যে দু’বার লোককে গাড়িচাপা দেয়া!
গত বছর অক্টোবর মাসে কানপুর শহরের এক ১৫ বছরের কিশোর বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে গঙ্গা ব্যারেজের উপর সাগর নিষাদ এবং আশিস রাম চরণ নামের দুই ব্যক্তিকে মেরে ফেলে। সাত মাসও যায়নি ছেলেটি আবার ওইভাবে বাবার গাড়ি চালিয়ে চারজনকে গুরুতর আহত করেছে। ওই কিশোর কানপুর শহরের একজন নামজাদা ডাক্তারের সন্তান।
পুলিশ কমিশনারের বক্তব্যঃ ওরা বাবা সমানভাবে দোষী। কেন উনি নাবালক ছেলেকে গাড়ি চালাতে দিয়েছেন! তায় দু’জনকে মেরে ফেলার পর আবার!
ছেলেটিকে আপাততঃ জুভেনাইল হোমে পাঠানো হয়েছে। তবে ছ’মাস আগের মামলাটির ধারা বদলে আরও কড়া করা হয়েছে—ধারা ৩০৪ এ (অসতর্কভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষ মারা) থেকে ধারা ৩০৪ (নরহত্যা , তবে খুন নয়)।
২.৩ পুণের কুখ্যাত পোর্শে গাড়ি চালিয়ে দু’জনকে মেরে ফেলার কেস!
এবছর ১৯ মে, শহর পুণে।
প্রোমোটর দাদু আদরের নাতি বেদান্ত আগরওয়ালকে ১৭ বছরের জন্মদিনে একটি পোর্শে গাড়ি (দাম এক কোটির কম নয়) উপহার দিয়েছেন। নাতির ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। সে বন্ধুদের নিয়ে সারারাত উদ্দাম পার্টি করে ভোরের দিকে প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি চালিয়ে পুণে শহরের কল্যাণী নগরে এক দু’চাকার বাহনকে ধাক্কা দেয়, দুজন আইটি প্রফেশনাল—অশ্বিনী কোস্টা এবং অনীশ অবধিয়া-- মারা যায়।
এক রাজনৈতিক নেতার হাসপাতালে ফোন এবং থানায় উপস্থিত হয়ে তদন্তকারীদের সঙ্গে কথার ফলে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের সুপারিশে ছেলেটি দুয়েক ঘণ্টায় জামিন পেয়ে যায়। তাকে শাস্তি হিসেবে বলা হয় যারবেদা ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে ১৫ দিন ডিউটি করতে এবং পথ সতর্কতা নিয়ে তিনশ’ শব্দের একটি রচনা লিখতে!
এরপর শুরু হয় কভার আপ! যাতে হাসপাতালের ডাক্তার থেকে পুলিশ প্রশাসন, জুভেনাইল বোর্ড, রাজনৈতিক নেতা –সবাই অপরাধী পরিবারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।
দেখা যায় তার রক্তের নমুনা বদলে তার মায়ের রক্ত দেয়া হয়েছে। তার রিয়েল এস্টেট প্রোমোটর দাদু ড্রাইভারকে ঘরে বন্ধ করে ধমকে বলেন—তুমি দোষ নিজের ঘাড়ে নাও; বল তুমিই চালাচ্ছিলে—আমার নাতি নয়।
পুলিশ বলছে ওকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেই বিচার করা হোক, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরার আগে একটি বারে বসে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মদ খাচ্ছে, বিল দিয়েছে ৪৮০০০ টাকা।
জনরোষের ফলে পুলিশ ওর দাদু, মা, বাবা সবাইকে গ্রেফতার করে। এখন সবাই হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন। আর ছেলেটিকে হাইকোর্ট বলেছে জুভেনাইল বোর্ডেরসংশোধনাগারে নয়, তার পিসির বাড়িতে পর্যবেক্ষণে রাখতে—এটাই নাকি আইনসম্মত উপায়!
সরকারপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করতে ইচ্ছুক নয়। তবু পুলিশ বলছে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আপিল করবে। করবে তো?
বেপরোয়া গাড়ি চালানো আর
নবী মুম্বাইয়ের ঘটনাঃ এক ১৭ বছরের কিশোর সাত সকালে বাবার গাড়ি চালিয়ে ৬০ বছরের এক মহিলাকে মেরে ফেলে। এখানে ছেলেটি অপ্রাপ্তবয়স্ক, এবং তার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই—তাই গাড়ির মালিকের শাস্তি হবে—তিনমাসের জেল এবং ১০০০ টাকা ফাইন। কিন্তু গাড়ির মালিক বাবা তো একমাস আগে মারা গিয়েছেন। তাহলে?
নয়ডার ঘটনাঃ
গত মে মাসের ঘটনা। প্রমোদ শর্মা সপরিবারে হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। গাড়ি চালাচ্ছিল তাঁর ১৭ বছরের ছেলে। গাড়িটি স্কুলগামী একটি মোটরবাইককে ধাক্কা দেয়। তাতে ১৫ বছরের অমন কুমার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। সঙ্গের বাকি দুই ছাত্র হাসপাতালে।
৩ ‘সমরথ কো নাহি দোষ গোঁসাই’!
৩.১ হেমা মালিনীঃ বিজেপি’র মথুরা’র সাংসদ এবং মুম্বাই সিনেমার মহাতারকা
রাজস্থানের হাইওয়ে। জুন মাসের শেষ। হর্ষ খান্ডেলওয়াল সপরিবার মারুতি অল্টো চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সামনে একটা মোড় ঘুরতে হবে। ফাঁকা রাস্তা, তিনি ইণ্ডিকেটর দিয়ে গাড়ি ঘোরালেন। হঠাৎ পেছন থেকে প্রচণ্ড গতিতে একটি মার্সিডিজ গাড়ি এসে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা মারল। খান্ডেলওয়াল এবং তাঁর পত্নী আহত হলেন। তাঁর ছ’বছরের ছেলেটির দুটো হাত দুটো পা ভাঙল। দু’বছরের বাচ্চা মেয়ে চিন্নি গুরুতর আহত।
মার্সিডিজ থেমে গেছে। আরোহী হেমা মালিনী সামান্য চোট পেয়েছিলেন। খান্ডেলওয়াল দম্পতি চাইছিলেন গুরুতর আহত বাচ্চা দুটোকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোক। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে হেমা’র কপালে সামান্য চোট লেগেছিল এবং ওঁরা অনুরোধে কর্ণপাত না করে মার্সিডিজ গাড়িটি ওখানেই ফেলে স্থানীয় বিজেপি নেতার গাড়িতে চড়ে ঝড়ের বেগে জয়পুর চলে গেলেন।
বাচ্চা মেয়েটি মারা গেল। বাকি সবাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হর্ষ খান্ডেলওয়ালের মতে মার্সিডিজের স্পীড ছিল ঘন্টায় ১৫০ কিলোমিটার। পরে ড্রাইভার গ্রেফতার হয় বেয়াড়া স্পীডে গাড়ি চালানোর অভিযোগে।
হেমা টুইট করে বললেন—সব দোষ বাচ্চা মেয়ের বাবার। ও যদি ট্রাফিক রুল ভেঙে মার্সিডিজের সামনে না আসত তাহলে বাচ্চাটি বেঁচে যেত।
হাসপাতাল থেকে মেয়ের বাবা জবাব দিলেন—আমি রুল ভাঙিনি, আপনার ড্রাইভারকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। আমার দু’ বছরের বাচ্চা মেয়ে বেঁচে যেত যদি আপনি আপনার গাড়িতে বাচ্চাটাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছে দিতেন।
না, ওঁরা হেমা মালিনীর থেকে কোন ক্ষতিপূরণ পান নি।
৩.২
‘বিগ বস’ সলমান খান এবং ফুটপাতে লোকচাপা
ঘটনার সংক্ষিপ্ত কালপঞ্জী
২৮/৯/২০০২
অভিনেতা সলমান খান মাঝরাতে ফুটপাথে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মানুষের উপর তাঁর টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি চড়িয়ে একজনকে মেরে ফেলার এবং চারজনকে ঘায়েল করার অভিযোগে গ্রেফতার হলেন।
অক্টোবর, ২০০২- কেস খেলেন পেনাল কোডের ধারা ৩০৪ (নরহত্যা, কিন্তু খুন নয়)।
অক্টোবর, ২০০৩- মুম্বাই হাইকোর্ট ধারা বদলে ৩০৪এ করে দিল, অর্থাৎ নরহত্যা নয়, শুধু বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা, যাতে মৃত্যু হয়েছে।
৬ মে, ২০১৫- মুম্বাইয়ের দায়রা আদালত মদ খেয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে শাস্তি দিল-- পাঁচ বছর জেল ।
সেদিনই মুম্বাই হাইকোর্ট অভিযুক্ত সলমানকে জামিন দিয়ে অন্তিম ফয়সালা পর্য্যন্ত শাস্তি স্থগিত করে দিল।
ডিসেম্বর, ২০১৫- মুম্বাই হাইকোর্ট প্রমাণের অভাবে সলমান খানকে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্তি দিল।
জুলাই ৫, ২০১৬—মহারাষ্ট্র সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আপিল করল। সেখানে ৮ বছর ধরে মামলা লম্বিত রয়েছে।
কিন্তু আসল তামাশা বুঝতে হলে নীচের টিপ্পনিগুলো দেখুন।
দুর্ঘটনার পর যখন জনমানস বিক্ষুব্দ তখন বলিউডি গায়ক অভিজিত ভট্টাচার্য মন্তব্য করলেন—ফুটপাথ কি শোবার জন্য?
আমার বিনীত প্রশ্নঃ ফুটপাথ কি গাড়ি চালানোর জন্য? তাও ফাঁকা রাস্তা ছেড়ে!
যুবক পুলিস কনস্টেবল রবীন্দ্র পাতিল সলমান খানের দেহরক্ষী নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনিই ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০০২ তারিখে জবানবন্দী দিয়েছিলেন যে গাড়ি চালাচ্ছিলেন সলমান নিজে, তাঁর ড্রাইভার নয়।
কিন্তু মহামান্য মুম্বাই হাইকোর্ট তাঁর সাক্ষ্যকে নির্ভরযোগ্য মানলেন না। কেননা, তিনি গোড়ায় সলমানের মদ্যপানের কথা বলেননি। তিনদিন পরে ১ অক্টোবর তারিখে বললেন যে মত্ত সলমানকে তিনি গাড়ি চালাতে বারবার নিষেধ করেছিলেন।
বলা হয়, পাতিলের উপর বয়ান বদলে দেবার প্রচণ্ড চাপ ছিল। শুনানিতে পাঁচবার অনুপস্থিত থাকায় আদালত তাঁর নামে ওয়ারেন্ট জারি করে। ডিউটিতে গরহাজির থাকায় পুলিশ বিভাগ প্রথমে সাস্পেন্ড, পরে ডিসমিস করে।
পত্নী ডিভোর্স দেয়, বাবা-মা অজ্ঞাত কারণে তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করে।
২০০৭ সালে তাঁকে রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়, তিনি তখন যক্ষ্মারোগে মরণাপন্ন। শেষে ৪ অক্টোবর, ২০০৭ তারিখে মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
তাঁর শেষ কথাঃ “আমি শেষ পর্য্যন্ত বয়ানে কোন পরিবর্তন করি নি। কিন্তু আমার ডিপার্টমেন্ট আমার সঙ্গে রইল না। আমি চাকরিতে ফেরত যেতে চাই, বাঁচতে চাই। একবার পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে চাই”।
রবীন্দ্র পাতিল ছিলেন ‘মুখ্য সাক্ষী’। অনেকের সন্দেহ, মূল শুনানির সময় তাঁকে জোর করে আটকে রাখা হয়েছিল যাতে তিনি আদালতে উপস্থিত হতে না পারেন।
সলমানের ড্রাইভারঃ বয়ান বদল
সলমানের ড্রাইভার অশোক সিং ১৩ বছর বাদে হঠাৎ বয়ান বদলে বললেন—গাড়ি নাকি তিনিই চালাচ্ছিলেন, সলমান নয়। আরও বললেন যে টায়ার ফেটে যাওয়ায় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফুটপাতে উঠে গেছল।
কিন্তু সরকারি পক্ষ জোর দিয়ে বলে—এটা ডাহা মিথ্যে। এস ইউ ভি গাড়ির টায়ার ওভাবে ফেটে যায় না।
তারপর অশোক সিংকে আদালতে মিথ্যে বলার জন্য গ্রেফতার করা হয়।
যাঁরা বেখেয়ালে গাড়ি চালানোর শিকারঃ
২৮ সেপ্টেম্বর,২০০২ এর রাতে ফুটপাতে শুয়েছিলেন পাঁচজন। গাড়ি রাস্তায় ওঠায় তৎক্ষণাৎ মারা পড়েন নুরুল্লা শরীফ। বাকি আহত চারজনের কারও কারও পা পিষে যায়। ওদের মতে সলমান চালকের আসন থেকে ডানদিকের দরজা দিয়ে নেমে আসেন।
সলমানের বক্তব্য অন্যদিকের দরজা নাকি জ্যাম হয়ে গেছল। সলমান মুক্তি পাওয়ায় ওঁরা কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলেন, পেয়েছেন বলে জানা যায় নি।
উপসংহার
আমরা নব্বইয়ের দশক থেকে বর্তমান বছর পর্য্যন্ত এতগুলো কেসের বিহঙ্গম দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করলাম। যা মনে হল—বড়মানুষের গাড়িতে সাধারণ মানুষ চাপা পড়লে কিছু আশা না করাই ভাল।
পুলিশের প্রাক্তন উচ্চপদের আমলা শ্রী কিরণ বেদীর টুইটারের বক্তব্যটি আপাতত শেষকথা বলেই মনে হয়।
“ ইফ ইউ আর এ ভিআইপি, সেলিব্রিটি, প্রিভিলেজড্, রিচ অ্যান্ড ইউ ক্যান অ্যাকসেস বেস্ট লীগ্যাল এইড, ইউ ক্যান অ্যাভয়েড জেল’।
প্রবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস
Posted in প্রবন্ধচক্র বলতেই মনে আসে ছোটবেলায় ঠাকুরঘরে দেখা ফটোফ্রেমে বিষ্ণু ভগবানের হাতে এক মারাত্মক অস্ত্রের কথা – সুদর্শন চক্র! কিংবা বিনয় মজুমদারের কবিতা – ‘ফিরে এসো চাকা’! কেউ কেউ কথায় কথায় বলে ফেলেন – লোকটার ভাগ্যচক্র খারাপ চলছে। স্কুলের খাতায় একটা শিওর-শট প্রশ্ন – মেঘবৃষ্টি কিংবা প্রকৃতির ঋতুচক্র বর্ণনা করো। মহাভারতের সেই দৃশ্য, বীর কর্ণর রথযাণের চক্র মৃত্তিকাতে নিমজ্জিত; অর্থাৎ রথের চাকা মাটিতে বসে গেছে – গাড়ী এগোচ্ছে না, মৃত্যু অবধারিত! অতএব দেখা যাচ্ছে ‘চক্র’ বিষয়টা একটা বিশাল ব্যাপার। তাই ‘চক্র’ নিয়ে লিখতে গেলে ধন্ধ লাগে, কি ভাবে লিখবো, কতটা লিখবো। তাই ভাবছি, ‘চক্র’ নিয়ে বলতে বসে এখানকার মূল আলোচনাটা যান্ত্রিক ‘চক্র’কেই নিয়ে হোক। অতএব, আলোচনা শুরু করা যাক গাড়ীর চাকাকে নিয়ে।
চাকার কথা
দৈনন্দিন জীবনে আমরা সবাই চাকার সঙ্গে পরিচিত। একটা বৃত্তাকার গোলাকৃতি বস্তু , যা তার কেন্দ্রের(Centre) চারদিকে ঘুরতে পারে। কিন্তু এই চাকা কি নিজে নিজেই ঘুরবে? না, তা হয় না। এই ঘোরানোর জন্যে চাই একটা শক্তি। গাড়ীর চাকাকে ঘোরানোর জন্যে তাই থাকে ইঞ্জিন। ইঞ্জিনের উৎপন্ন শক্তি কিছু যান্ত্রিক ব্যবস্থার (গীয়ার, লিঙ্ক ইত্যাদি) সাহায্যে চাকাটাকে ঘোরাতে পারে।
একটা গোলাকার গাছের-গুড়ি ঢালু সমতল রাস্তায় রেখে দাও, সেই গুড়িটা নিজের কেন্দ্র বা অক্ষের (Axis) চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে গড়িয়ে গড়িয়ে নীচের দিকে যাবে। এক্ষেত্রে গোলাকার জিনিষটাকে ঘূর্ণনে যে সাহায্য করলো, সেটা অভিকর্ষীয় বল (Gravitational Force)। গরুর গাড়ীর চাকা ঘুরছে, গাড়োয়ানের গাড়ী এগোচ্ছে, সেক্ষেত্রে কাজ করছে গরুর শরীরের পেশী শক্তি – যাকে আমরা বলতে পারি প্রানীর ভেতর থেকে উদ্ভুত একটা যান্ত্রিক শক্তি (Mechanical Energy)। গরুর গাড়ীর চাকার ক্ষেত্রে চাকা যে ঘুরছে , ( না-ঘুরে ঘষটাচ্ছে না) তার জন্যে জরুরী মাটি ও চাকার সংযোগস্থলে ক্রিয়াশীল একটা ঘর্ষণ-জনিত বল (Frictional Force)। মাটিতে বা রাস্তায় চাকাকে ঘোরাবার জন্যে এমন একটা ঘর্ষণ-জনিত বল সব সময়ে জরুরী। কখনো কি দেখেছো, একটা ট্রাকের চাকাগুলো নরম পিছলা কাদা মাটিতে ঘুরেই যাচ্ছে, মানে চাকা স্কীড করছে। এখানে মাটি নরম থাকার জন্যে চাকা ও রাস্তার সংযোগস্থলে ঘর্ষণ-জনিত বলটা কাজ করছে না। তাই চাকা ঘুরছে না, গাড়ী এগোচ্ছে না। সে এক হ্যাপা! চাকাগুলোর নীচে ইট রাখো, পাথরের নুড়ি ঢালো, নইলে কাঠের তক্তা রাখো। এবার হয়তো চাকা স্লীপ না করে গাড়ীটা এগিয়ে আসবে।
এই চাকার উদ্ভব বা আবিষ্কারের ইতিহাসটা কি? সে একটা জটিল প্রশ্ন! যেমন কেউ যদি জিজ্ঞেস করে মানব সভ্যতার জন্ম ও বিকাশের কালপঞ্জী বা ইতিহাসের কথা। তবে মনে করা হয় চাকার আবিষ্কার খ্রীষ্টের জন্মের দশ হাজার বছর আগেই (10000BC) হয়ে গেছিলো – যে যুগটাকে নিউলিথিক এজ বলা হয়। অন্যমত হিসেবে কেউ কেউ বলে থাকে খ্রীষ্টের জন্মের পাঁচ হাজার বছর আগেই (5000BC) মেসোপটেমিয়াতে প্রথম চাকার আবিষ্কার হয়।
কবে প্রথম চাকার আবিষ্কার হয়েছিলো, সে বিতর্কে যাবার দরকার নেই। বরং কল্পনায় দেখা যাক সেই আদিম মানুষগুলোকে, যাদের মাথায় প্রথম চাকার ধারণা এসেছিলো। একদিন সেই মানুষগুলো একটা ভারী গোল পাথরের চাই ঠেলতে চেষ্টা করছিলো , তারা সেটা করতে পারছিল না, পাথরটা এত ভারী যে সেটা এক অসম্ভব কাজ। তখন সেই মানুষগুলো নজর গেল সেরকমই আরেকটা গোলপাথরে, সেটা রাখা ছিল একটা খাড়া করে রাখা থালার মতো, বৃত্তীয় পাথরের পরিধিটা ছিলো জমি ছুঁয়ে। একটু ঠ্যালা দিতেই সেই পাথরটা অনায়াসে গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। পাথরটা নিজের কেন্দ্র বা অক্ষের চারপাশে কেমন সহজেই ঘুরে যাচ্ছে। তাকে ঠেলতে তেমন বেগ পেতে হচ্ছেনা। সেই হলো মানুষের বোধগম্য প্রথম চাকা!
কিংবা ধরা যাক, একটা বিশাল মোটা গাছের গুড়িকে লোকগুলো টেনে নিয়ে যেতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো; তখন কেউ বললো , এটাকে গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হোক। তখন দেখা গেলো টেনে নেয়ার বদলে গাছের গুড়িটাকে চাক্কার মতো ঠেলতেই সেটাকে অনেক সহজেই এগিয়ে নেয়া যাচ্ছে। ব্যাস, সেইসব প্রাচীন দিনগুলোতে এমনি ভাবেই চলে এলো চাকার ধারনা। হয়তো আদিম ইতিহাসে চাকাকে এমনি ভাবেই প্রথম আবিষ্কার করা হয়েছিলো। এরপরে নানা পরিবর্তন ও নানা পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সেদিনের সেই আবিষ্কার আজকের বর্তমান চাকার চেহারা নিয়েছে।
সেই সব মানুষগুলো যারা পাথর ঠুকে প্রথম আগুন জ্বালিয়েছিলো, কিংবা যারা গড়িয়ে দেয়া পাথরের চাকতির মধ্যে চাকার যান্ত্রিক সুবিধা আবিষ্কার করেছিলো, তাদের কোন সঠিক ইতিহাস নেই। তবুও এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় সভ্যতার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিল আগুন জ্বালানো । তার অনেক অনেক পরে সভ্যতার আরেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হোল চাকার ব্যবহার, যার যান্ত্রিক সুবিধাকে নিজেদের মতো করে কাজে লাগানো গেল।
বানরের চেহারা থেকে নানা পরিবর্তনের পর মানুষের আধুনিক চেহারা এসেছে; তেমনি চাকার প্রাচীন চেহারার সঙ্গে তার বর্তমান চেহারার প্রচুর তফাৎ। একদম প্রথম যুগে ঠেলা গাড়ি বা রথের চাকায় ব্যবহৃত হতো নিরেট (Solid) কাঠের চাকতি। এখনকার গরুর গাড়ীর চাকার মতো স্পোকয়ালা হালকা ডিজাইন তখন ছিল না। একটা নিরেট কাঠের চাকা ওজনে খুব ভারী, তার তুলনায় গরুর গাড়ীর কাঠের চাকা ওজনে অনেক হাল্কা। হালকা চাকাকে টানতে বলও(Force) কম লাগে।
কালে কালে বিকাশের ধারায় কাঠের চাকার জায়গা দখল করলো লোহার চাকা। লোহা বলতে তখন ঢালাই লোহার (কাষ্ট আয়রণ)ব্যবহার ছিল। এরপর এলো স্টীলের চাকা, যা তুলনামূলক হাল্কা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটা হাল্কা স্টীল নির্মিত সাইকেলের চাকা, সরু সরু স্টীলের স্পোক লাগিয়ে যেটাকে প্রয়োজনীয় ভাবে মজবুত করা হয়েছে। কোন কোন গাড়ীতে স্টীলের চাকা দেখা যায়, তার চারপাশে রাবারের আস্তরণ বা লাইনিং লাগানো। চলতে গেলে মসৃণ রাস্তায় চাকা যাতে স্লিপ না করে, গাড়ী যাতে বরাবর এগোয়। এরপরে দেখা গেলো মোটর কার বা ট্রাকের টায়ার, এতে হালকা স্টীলের রিম, মাঝে হাওয়া ভরা টিউব আর বাইরে রাবারের মজবুত টায়ার। চাকার নামে খুলে গেল বড় বড় টায়ার কোম্পানী – ডানলপ, এম-আর-এফ ইত্যাদি। আজকাল তো চারচাক্কার যে সব মোটরগাড়ীগুলো আসছে, সেগুলোতে আছে টিউবলেস টায়ার, মাঝে হাওয়া ভরার জন্যে আলাদা করে টিউবের দরকার নেই।
প্রযুক্তি কেমন পালটে যায়। এক জামানায় ঠেলা গাড়ীর চাকার অক্ষ(Axle) ফিট করা থাকতো বিনা বিয়ারিং-এ, একটা গর্তের মধ্যে। বিজ্ঞান এখন অনেক উন্নত, যে কোন চাকার সাথে এখন লাগানো থাকে বিয়ারিং, যাতে কম শক্তি খরচ করে, কম মেহনতে চাকাটাকে ঘোরানো যায়।
চক্রের বিভিন্ন ব্যবহার
এবারে দেখা যাক, চক্রকে আমরা কি কি ভাবে কাজে লাগাতে পারি। গাড়ির চাক্কা ছাড়াও যে যে সব ক্ষেত্রে চক্রের ব্যবহার দেখা যায়, সেগুলোকে এক এক করে উল্লেখ করা যাক।
I. কুমার-এর চাকা – মাটির ভার, গ্লাস বা পাত্র তৈরী করতে একে ব্যবহার করা হয়। জমির সমান্তরালে ঘুরতে থাকা চাকাটির ঘূর্ণনের সাহায্যে কুমার মাটির পাত্র তৈরী করে।
II. চৌবাচ্চা থেকে জল তোলবার সময় আমরা দেখেছি পুলির (Pulley) ব্যবহার। যেকোন ভারী জিনিষ তোলার জন্যে পুলি নামক চাকাটির ব্যবহার খুব সুবিধাজনক। যে কোন ক্রেনেও এই ধরনের পুলির ব্যবহার সব সময় দেখা যায়।
III. যাতায় শস্য পেশাই করা। সেখানেও ব্যবহৃত হচ্ছে দুটো পাথরের চাকা।
IV. পুরাণো দিনের ছবিতে দেখেছি সেচের জন্যে তৈরী হয়েছে বিরাট চক্র, তাতে বালতির মতো পাত্র (Bucket) পর পর লাগনো। এদিয়ে নদী থেকে জল তোলা হতো। চক্রটা ধীরে ধীরে ঘুরলে একদিকের বালতিতে যখন নদীর জল ভরতো, তখন অন্যদিকের বালতির ভরা জল জমিতে খালি হতো। এরকমই ছিল পুরোনো দিনের সেচ-ব্যবস্থা।
V. বর্তমান যুগ হচ্ছে মেশিনারীর যুগ। যেকোন মেশিন খুললেই যে সব যন্ত্রাংশ পাওয়া যাবে তাতে অনেক রকম কলকব্জার মধ্যে থাকে বিশেষ ভাবে ডিজাইন করা দাঁতয়ালা চাকা, যেগুলো ঘুরতে থাকে। এই গুলোকে বলা হয় গীয়ার – যা কিনা এক ধরণের চক্র।
VI. তাপ বিদ্যুত বা জল বিদ্যুত কেন্দ্রে টারবাইন ঘুরছে। এই টারবাইনের ভেতরে যেটা থাকে , সেটাও একধরনের ব্লেডয়ালা চাকা । এই টারবাইনের নিয়ন্ত্রিত ঘূর্ণনের ফল হিসেবেই বিদ্যুত তৈরী হয়।
VII. জাহাজ চলছে , বিমান উড়ছে। এখানেও আমরা দেখি ‘প্রপেলার’ নামক চক্রের ব্যবহার।
VIII. জল সরবরাহের জন্যে যেসব বড় বড় পাম্প থাকে, যা দিয়ে প্রেসারে জল পাঠানো যায়, সেসব পাম্পেও থাকে একধরনের ব্লেডয়ালা চক্র।
IX. নাগরদোলা – বাচ্চারা বড়োরা মেলার মাঠে নাগরদোলায় বসে চেঁচাচ্ছে। নাগরদোলার এই যে মজা, চক্র আবিষ্কৃত না হলে তা কি সম্ভব ছিলো?
X. ষ্টীয়ারিং হুইল – আমরা তো হামেশাই কার চালাই, গাড়ী চালানোর জন্যে সামনেই যে ষ্টীয়ারিংটা থাকে , সেটাও তো একটা চাকা।
XI. যে পায়ে-পঙ্গু মানুষটা নিজের হাতে হুইল-চেয়ারে এক যায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, লক্ষ করো, সেখানেও একাধিক চাকার ব্যবহার রয়েছে। মানুষটা যেটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হুইল-চেয়ারটাকে সামনে পেছনে করছে, সেখানেও একটা সরু স্টীলের চাকা বা ষ্টীয়ারিং , যেটা লোকটার হাতে, তার আসহায়তার অবলম্বন।
এমনিভাবেই খুঁজে নিলে দেখা যাবে চাকা বা চক্রের অজস্র ব্যবহার!
অন্যান্য কিছু চক্রের কথা
আমার ‘চক্র’ নিয়ে এই লেখা পড়ে এক তান্ত্রিকমশাই তো খুব ক্ষেপে গেলেন! আপনি ইঞ্জিনীয়ারের চোখ দিয়েই শুধু ব্যাপারগুলো দেখেছেন, আপনার চক্র নিয়ে আলোচনাটা শুধুমাত্রই মেশিন আর গতিতে সীমাবদ্ধ রাখছেন, কেন ? আপনি কি জানেন ভৈরবচক্র, কুন্ডলিনী চক্রের কথা? জানেন, মানবদেহে এসবের ব্যবহার ঈশ্বর নির্দিষ্ট!
আসলে তন্ত্র মন্ত্রের এই সব চক্রের ব্যপারে আমার কোন ধারণা নেই। আমি ঈশ্বর-বিশ্বাসী নই। তাই তান্ত্রিকমহোদয়ের ভৈরবচক্র, কুন্ডলিনী চক্রের উত্তর দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও মনে হয় লেখা শেষ করবার আগে চাকার যান্ত্রিক ব্যবহার ছাড়াও, আরো কিছু চক্রের কথা এখানে উল্লেখ করে দেয়া উচিত; যাতে পাঠকেরা এই নিবন্ধে আমার গতিবিদ্যা ও যান্ত্রিক সুবিধাবাদী লেকচারে ক্ষেপে না যায়।
বৃষ্টি চক্রের কথা তো আমরা জানি। জল-বাষ্প-মেঘ-বৃষ্টি-জল – এমনি ভাবেই তার ঘুরে ঘুরে আসা। জন্মচক্রের কথা বললেই মনে পড়ে জন্ম, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য – এও এক আশ্চর্যজনক চক্র , যার কোন কিছুকেই আমরা এজীবনে বাদ দিতে পারিনা। এবারে আসি মেয়েদের মাসিক চক্রের কথায় – ঘুরে ঘুরে কি এক নিয়মে মহিলারা যৌবনে ঋতুমতী হয়। আমাদের ভেতরে যে রক্ত সংবহন পদ্ধতি সেটাও তো একটা চক্রের নিয়মে চলে। প্রজাপতির জীবনচক্র যদি ধরি, তবে তো শুয়োপোকা – গুটি - ডানা মেলা পতঙ্গ – সব মিলিয়ে কি অদ্ভুত ভাবে চক্রবৎ এই প্রজাপতির জন্মকথা। আবহাওয়া আর ঋতুচক্রকে বাদ দেই কিভাবে – এই যে বছরে বছরে পালা করে ছ’টা ঋতু – গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্ত – এও এক অদ্ভুত চক্র, চাইলেই কি এর কোন কিছুকে আমাদের জীবন থেকে বাদ দেয়া যায়? আর সবচেয়ে আশ্চর্য হচ্ছে এই মহাকাশ, গ্রহমন্ডল। সেখানে চক্রবৎ গ্রহ , উপগ্রহ এসবের পরিক্রমা, জোয়ার ভাঁটা, পূর্ণিমা- অমাবস্যা। চক্রের অধীনে এমনি আরো কত যে বিস্ময়- এসব কিছু পরোপুরি জানতে আমাদের আরো অনেক সময় লেগে যাবে।
প্রবন্ধ - অম্লান রায় চৌধুরী
Posted in প্রবন্ধমনযোগের অর্থনীতি এক নতুন ধারণা। আমরা দেখেছি মনযোগ দিয়ে কাজ করলে কাজ ভালো হয় , ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে, এছাড়াও দেখেছি যে কাজের বাঁধা সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করা যায় , মনযোগের ফলে।
মার্কিন মনোবৈজ্ঞানিক সমিতির সংজ্ঞা অনুযায়ী "মনোযোগ হল এমন একটি মানসিক অবস্থা, যাতে সংজ্ঞানীয় সম্পদগুলি পরিবেশের অন্য সব দিক বাদ দিয়ে কিছু বিশেষ দিকের উপরে কেন্দ্রীভূত হয়।"
আরেকটি সংজ্ঞা অনুযায়ী "মনোযোগ হল কোনও বিশেষ তথ্যের উপরে কেন্দ্রীভূত মানসিক সংযোগ। তথ্য আমাদের চেতনায় আসে, আমরা বিশেষ কোনও তথ্যের প্রতি মনোযোগ দেই এবং এরপরে সিদ্ধান্ত নেই কোনও পদক্ষেপ নেব না কি নেব না।"
মনোযোগ একটি সীমিত সম্পদ। কেন দেখা যাক ।
বর্তমানে আধুনিক তথ্য যুগে এসে প্রায় সবার আন্তর্জাল তথা ইন্টারনেট সংযোগ থাকার সুবাদে বিপুল পরিমাণ ডিজিটাল বিষয়বস্তু (তথ্য, সাহিত্য, শিল্পকলা) তাৎক্ষণিকভাবে সুলভ এমনকি বিনামূল্য হয়ে পড়েছে।
কিন্তু মানুষের মনে তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষমতার কোনও পরিবর্তন হয়নি। প্রতিদিন সময়ের পরিমাণ এক মিনিটও বাড়েনি। ফলে তথ্য নয়, বরং মনোযোগ একটি সীমিতকারী নিয়ামকে পরিণত হয়েছে। প্রচুর তথ্য , মনযোগের সময় সীমিত – কাজেই টানাটানি ।
তাত্ত্বিকভাবে পরিমাপযোগ্য না হলেও কোনও একটি বিশেষ বিষয়ের উপরে মানুষ কতটুকু সময় মনোযোগ দান করে, তার উপর ভিত্তি করে মনোযোগের একটি মূল্যমান বের করা সম্ভব।
ইংরেজিতে "মনোযোগ দিয়ে পরিশোধ" (টু পে অ্যাটেনশন) নামক যে পদবন্ধটি আছে, তা থেকে বোঝা যায় মনোযোগ একটি সীমিত মানসিক সম্পদ, যার অর্থনৈতিক মূল্য আছে।
একটি বিষয়ে মনোযোগ দিলে অপর দিকে সেটি দেওয়া সম্ভব নয়।
সবার কাছে এখন এত বেশি তথ্য লভ্য হয়ে পড়েছে যে এর ফলে মনোযোগ ব্যবহার করে সবচেয়ে মূল্যবান তথ্যটি বের করে নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক খুঁটিনাটি বাদ দেওয়ার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
১৯৭১ সালেই মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ও নোবেল স্মারক পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ হার্বার্ট সাইমন ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে "একটি তথ্য-সমৃদ্ধ বিশ্বে তথ্যের প্রাচুর্যের ফলে অন্য কিছু ঘাটতির সৃষ্টি হবে, যা হল তথ্য যা কিছু ভোগ করে। তথ্য কী ভোগ করে, তা স্পষ্ট প্রতীয়মান: তথ্য তার গ্রাহকের মনোযোগ ভোগ করে।
সমসাময়িক তথ্য যুগে এসে পরিগণক যন্ত্র (কম্পিউটার), বুদ্ধিমান মুঠোফোন (স্মার্টফোন) ও আন্তর্জাল (ইন্টারনেট) সবার হাতের কাছে চলে আসায় তথ্য আর কোনও মূল্যবান সম্পদ নয়, বরং মানুষের মনোযোগ হল তার চেয়ে বেশি মূল্যবান। এ কারণে তথ্যপ্রযুক্তি দানব প্রতিষ্ঠানগুলি (যেমন গুগল, মেটা, অ্যাপল, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট) প্রায় বিনামূল্যে তাদের তথ্য সরবরাহ সেবাটি প্রদান করে থাকে। ব্যবহারকারীরা তাদের মনোযোগ দিয়ে (অর্থাৎ মোটা দাগে কতটুকু সময় তারা ঐ সব প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল মঞ্চে ব্যয় করছে) ঐসব প্রতিষ্ঠানকে লাভবান করে। ব্যবহারকারী যত বেশি সময় কোনও ওয়েবসাইটে বা আন্তর্জাল মঞ্চে ব্যয় করবে, তাকে কোনও কিছু ক্রয় করতে প্ররোচিত করা তত বেশি সহজ হয়ে উঠবে।
এ কারণে কোনও কোনও বিশ্লেষক ২১শ শতকের প্রথম দুই দশককে "তথ্য অর্থনীতি" না বলে "মনোযোগের অর্থনীতি" হিসেবে অভিহিত করেছেন।
গোল্ডহেবারের মতে ২০শ শতকের শেষে এসে উন্নত বিশ্বের শ্রমশক্তির একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ আর ভৌত পণ্য উৎপাদন, পরিবহন ও বিতরণের সাথে জড়িত নয়, বরং তারা তথ্যের কোনও না কোনও রূপ ব্যবস্থাপনা করে জীবিকা নির্বাহ করে।
এই নতুন অর্থনীতির নাম দেওয়া হয় "তথ্য অর্থনীতি"।
কিন্তু তার মতে এই উপাধিটি সঠিক নয়। অর্থনীতি হল কোনও সমাজ তার দুষ্প্রাপ্য সম্পদগুলি কীভাবে ব্যবহার করে, সে সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড। কিন্তু আধুনিক তথ্যযুগে এসে তথ্য কোনও দুষ্প্রাপ্য সম্পদ নয়, বরং তথ্য বাতাসের মত সর্বক্ষণ ও সর্বব্যাপী বিদ্যমান। অন্যদিকে আন্তর্জালে সত্যিকার অর্থে যে জিনিসটি দুষ্প্রাপ্য, তা হল মানুষের মনোযোগ। তাই স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাল জগতের অর্থনীতির মূল বিনিময় মুদ্রা হল মনোযোগ, তথ্য নয়।
নতুন আন্তর্জাল অর্থনীতিতে সেবাগ্রাহক বা ব্যবহারকারীর মনোযোগ যে অর্থের সমতুল্য, তার একটি উদাহরণ হল আন্তর্জাল ভিত্তিক সরাসরি সঙ্গীত পরিবেশনা মঞ্চ স্পটিফাইয়ের মূল্য পরিশোধ পদ্ধতি।
প্রাথমিকভাবে গ্রাহকেরা স্পটিফাইয়ের বিনামূল্যের একটি সংস্করণ ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু এর বিনিময়ে তাদেরকে গান শোনার ফাঁকে ফাঁকে বাধ্যতামূলকভাবে কিছুক্ষণ বিজ্ঞাপন শুনতে হয়, নইলে পরবর্তী গান শোনা যায় না।
এভাবে ব্যবহারকারীরা তাদের মনোযোগকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করে স্পটিফাইয়ের সেবার মূল্য পরিশোধ করেন।
কিন্তু স্পটিফাইয়ের দ্বিতীয় একটি সংস্করণে যদি ব্যবহারকারী অর্থের দ্বারা মাসিক একটি মূল্য পরিশোধ করেন, তাহলে তাকে আর কোনও বিজ্ঞাপন শুনতে হয় না।
এভাবে মনোযোগকে বিনিময়যোগ্য সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করে স্পটিফাই গ্রাহক ধরে রাখে ও ভবিষ্যত অর্থ-পরিশোধকারী গ্রাহক সৃষ্টি করে।
আমাদের কাছে পড়ে রইল কেবল নিজের বুদ্ধিমত্তা আর মনযোগ – সেটাকেই না হয় শান দেই – ধারালো করি , তথ্য তো আসবেই বিনামূল্যে।
প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস
Posted in প্রবন্ধসতীদাহ প্রথা হলো হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোনো সদ্য বিধবা নারীকে স্বামীর চিতায় সহমরণ বা আত্মাহুতি দিতে বাধ্য করার এক অমানুষিক ও অমানবিক প্রথা চালু ছিল হিন্দুধর্মালম্বীদের মধ্যে।
সতীদাহ প্রথা বিলোপর অন্যতম পূরোধা রাজা রামমোহন রায়। রাজা রামমোহন রায় ১৭৭২ সালের ২২ মে হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম রমাকান্ত রায় ও মাতার নাম তারিণী দেবী। সতীদাহ প্রথা বিলোপের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন রাজা রামমোহন রায়। কোন সময় সতীদাহ প্রথার উদ্ভব হয়, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় না। তবে খ্রিস্টপূর্ব চার শতকে দিগ্বীজয়ী সম্রাট আলেকজান্ডারের ভারত আগমনের বিবরণে সতীদাহ প্রথার সন্ধান মেলে।
তা ছাড়া পৌরাণিক কাহিনীগুলোয় এমন আত্মাহুতির অনেক উদাহরণ রয়েছে। ‘সতী’ শব্দটি এসেছে দেবী সতীর নাম থেকে। রাজা দক্ষের কন্যা ও দেবতা শিবের স্ত্রী সতী। রাজা দক্ষ সতীর সামনে শিবকে তিরস্কার করলে স্বামীর অপমান সহ্য করতে না পেতে তিনি আত্মাহুতি দেন। তা ছাড়া মহাভারতে পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রী স্বামীর সঙ্গে স্বেচ্ছায় সহমরণে গিয়েছিলেন। হিন্দু ধর্মের ধর্মগ্রন্থসমূহে সহমরণের এমন কিছু ঘটনার উল্লেখ পাওয়া গেলেও সতীদাহের আদেশ কোনো ধর্মগ্রন্থেই নেই। বরং বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে এমন অনেক নারী চরিত্র আছেন, যারা স্বামীর মৃত্যুর পরও বেঁচে ছিলেন। ধর্মগুরুরা এসব পৌরাণিক কাহিনী ব্যবহার করেছেন সতীদাহ প্রথার নামে নারী হত্যার ক্ষেত্র তৈরিতে। সতীদাহ প্রথা ছিল মূলত সামাজিক ও ধর্মীয় হত্যাকাণ্ড। মৃত ব্যক্তির সম্পত্তির দখল নিতে এবং পারিবারিক মানসম্মান নষ্ট হওয়ার ভয় থেকে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়রা সদ্য বিধবা হওয়া নারীকে জোর করে স্বামীর চিতায় পুড়িয়ে মারতেন। খ্রিস্টপূর্বকাল থেকেই ভারতে সতীদাহের মতো ঘটনা ঘটে আসছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭-এ আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময় পাঞ্জাবে সতীদাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। ‘রাজতরঙ্গিনী’তে আছে সতীর ঘটনা। বরাহমিহির সতীর গুণগান গেয়েছেন। মঙ্গলকাব্যে আছে সতীর উল্লেখ। মুলতান থেকে দিল্লি যাওয়ার পথে ইবনে বতুতা আমঝারিতে তিনজন মেয়েকে সতী হতে দেখে প্রায় অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন। আবার বার্নিয়েরের মতো কেউ কেউ সতী হওয়া থেকে কোনো কোনো মেয়েকে রক্ষা করেছেন। তার নজর এড়ায়নি যে প্রধানত ব্রাহ্মণরা হিন্দু মেয়েদের সতী হতে উৎসাহ দিত। সবাই স্বেচ্ছায় সতী হত না। কিন্তু একটা বিধবা মেয়ের আজীবন ভরণপোষণের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য অথবা তার সম্পত্তি হস্তগত করার জন্য জোর করে তাকে চিতায় উঠতে বাধ্য করা হত। স্বপন বসুর ‘বাংলায় নবচেতনার ইতিহাস’ বইতে পাই যে মেয়েরা সতী হলে কোনো কোনো ধনী পরিবার থেকে তখনকার সময় দুইশ টাকা অবধি সাম্মানিক জুটত। এই অর্থের লোভে ব্রাহ্মণরা মেয়েদের সতী হতে উৎসাহ দিত। স্বপন বসুর ‘সতী’ নামক বইতেই আছে একটি অল্পবয়সি মেয়ের স্বামী মারা যেতে সে সতী হবে বলে মনস্থির করল। আত্মীয়স্বজন বেজায় খুশি। চারিদিকে সাজ সাজ রব। চিতার আগুন জ্বলে উঠতেই মেয়েটির কাকা মেয়েটিকে ধরে চিতায় তুলে দিল। আগুনে ঝলসে মেয়েটি বাঁচবার জন্য চিতা থেকে লাফ দিল। শুরু হয়ে গেল হুড়োহুড়ি। চিতা থেকে পালালে চলবে না। সংকল্প যখন করেছে তাকে সহমরণে যেতেই হবে। আধপোড়া মেয়েটা প্রাণভয়ে ছুটে পালিয়ে একটা ঝোপের পিছনে আশ্রয় নিল। তার কাকা কিন্তু লোকজন সঙ্গে এনে তাকে ঠিক খুঁজে বের করে আবার জবরদস্তি করে চিতায় তুলে দিল।
পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে পুরো পরিবারের মান সম্মান বাড়িয়ে দিয়ে গেল মেয়েটি। ব্যাপক হারে বাংলায় সতীদাহ প্রথা চলছিল। এক তথ্য অনুযায়ী বাংলা বিভাগে ১৮১৫ সালে সতী হয়েছে ৩৭৮ জন (তার মধ্যে কলকাতা বিভাগে ২৫৩ জন), ১৮১৬ সালে সতী হয়েছে ৪৪২ জন (কলকাতা বিভাগে ২৮৯ জন); ১৮১৭ সালে সতীর সংখ্যা ৭০৭ জন (কলকাতায় ৪৪২ জন); ১৮১৮ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সিতে সতীর সংখ্যা ৮৩৯ জন (কলকাতা বিভাগে তার মধ্যে ৫৪৪ জন); ১৮১৯ সালে বাংলায় সতীর সংখ্যা ৬৫০ (কলকাতায় ৩৭০ জন); ১৮২০ সালে সর্বমোট ৫৯৭ জনের মধ্যে কলকাতায় সতীর সংখ্যা ৩৭০। তখন তো বাংলা প্রেসিডেন্সিতে কলকাতা বিভাগ ছাড়াও ঢাকা বিভাগ, মুর্শিদাবাদ বিভাগ, পাটনা বিভাগ, বেনারস বিভাগ ও বেরিলি বিভাগ ছিল। কিন্তু সতীদাহ সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছিল কলকাতা বিভাগে। পার্লামেন্টের পেপারের তথ্য অনুযায়ী সতীদাহে হিন্দুদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র বেনারসকেও পিছনে ফেলে দিয়েছে কলকাতা বিভাগ।
আবার কলকাতা বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সতীদাহ হয়েছে বর্ধমান, হুগলি, নদীয়া, কলকাতার উপকণ্ঠ ও জঙ্গলমহলে। ১৮১৯ সালের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী সতীদাহের সংখ্যা- বর্ধমান: ৭৫, হুগলি: ১১৫, নদিয়া: ৪৭, কলকাতা উপকণ্ঠ: ৫২, জঙ্গলমহল: ৩১, কটক/পুরী: ৩৩, যশোর: ১৬, মেদিনীপুর: ১৩ ও ২৪ পরগণা: ৩৯। হাউস অব কমন্সের নির্দেশে এই পরিসংখ্যান ১৮২৫ সালের ১ জুলাই লিখিত আকারে প্রকাশিত হয়।
কেরীর তালিকা অনুযায়ী ১৮০৩ সালে সতী হয় ২৭৫ জন। ১৮০৪ সালে ছয় মাসে ১১৬ জন। অদ্ভুত ব্যাপার শিক্ষার হার যেখানে একটু বেশি সেখানেই সতীদাহর ঘটনা বেশি। ১৮২৩-এ ৫৭৫ জন সতী হয়। ১৮২৬-এ ৬৩৯ জনের মধ্যে কলকাতায় ৩৬৮ জন। আবার এমন ঘটনাও দেখা যায় যে স্বামীর সঙ্গে একদিনও ঘর করেনি, সে স্বেচ্ছায় স্বামীর বুকের ওপর নিশ্চিন্তে মাথা দিয়ে ‘স্বর্গারোহন’ করেছে। মাঝে বৃষ্টি হয়ে চিতার আগুন নিভে সে আধপোড়া হয়ে শুয়ে আছে। তবু তার বিকার নেই। ধিকি ধিকি জ্বলতে জ্বলতে যখন আবার চিতায় আগুন জ্বালানো হল তার ভবলীলা সাঙ্গ হল।
বাংলায় সতী হওয়ার অনুষ্ঠানটিও ছিল অদ্ভুত। যে মেয়ে সতী হবে বলে মনস্থির করত সে স্নান করে নতুন কাপড় পরে পা আলতায় রাঙিয়ে একটি আমডাল নিয়ে শবের কাছে বসত। মাথার চুল বিছিয়ে দেওয়া হত। ছেলে বা নিকট আত্মীয় অনুষ্ঠানের সব জিনিস জড়ো করে চিতা প্রস্তুত করত। সে গায়ের গয়না খুলে সিঁদুরের টিপ পরে সাতবার চিতা প্রদক্ষিণ করে আঁচলে বাঁধা খই, কড়ি বা গয়না ছুড়ে ছুড়ে দিত উন্মত্ত জনতাকে। লোকে কাড়াকাড়ি করত ওগুলো পাওয়ার আশায়। তারপর বিচিত্র, গগনভেদী বাজনার মধ্য দিয়ে সে চিতায় উঠত। মেয়েদের চিতার সঙ্গে বুকে, কোমরে, পায়ে দড়ি দিয়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা হত যাতে তারা পালিয়ে না যায়। শুধু সহমরণ নয়, সমাজে তখন অনুমরণ, সহসমাধি, কতরকম প্রথা। স্বামীর সঙ্গে একসাথে পুড়ে মারা গেলে সহমরণ। স্বামীর মৃত্যুর সময় অনুপস্থিত থাকলে, অসুস্থ হলে বা গর্ভবতী হলে পরে স্বামীর ব্যবহৃত যে কোনো জিনিস যেমন লাঠি, চটি, থালা, বাঁধানো দাঁত, স্বামীর লেখা চিঠি ইত্যাদি নিয়ে চিতায় উঠত স্ত্রী। এটি হল ‘অনুমরণ’। যেমন ভোলা চামারের বউ উদাসীয়া। ভোলা মারা যাবার সাত বছর পরে সে ১৮২২ সালের ৫ মে ভোলার ব্যবহৃত থালা নিয়ে সতী হয়। কোঙ্কন অঞ্চলের মেয়েরা স্বামীর অনুরূপ এক চালের মূর্তি গড়ে অনুমৃতা হত।
এটি ‘পলাশবুদি’। মৃত ভাই-এর চিতায় বোনের আত্মাহুতি দেওয়ার ঘটনাও আছে। সেখানে বাবা নিজে একসঙ্গে পুত্র ও কন্যার চিতা সাজিয়ে অগ্নিসংযোগ করেছিল। ১৮১৮ সালের শেষদিকে চন্দননগরের এক তরুণী ভাবী স্বামীর চিতায় আত্মাহুতি দেয়। বিয়ের আগেরদিন ছেলেটি কলেরায় মারা যায়। মেয়েটি জোর করে সতী হয়। রক্ষিতারাও সতী হত। রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত সাধ্বী স্ত্রী সতী হবে না রক্ষিতা। সম্ভবত ১৮১৭ সালে সরকার আইন করে রক্ষিতাদের সহমৃতা হওয়ার ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করে। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা থেকে জানা যায়, ‘দিল্লির এক শেঠজি স্বর্গে গেছেন। শেঠজি কোটিপতি। ঘরে তার চার-চারটি স্ত্রী। দলে দলে খিদমদগার, হুঁকোবরদার। যমুনার ধারে কয়েকশ মণ চন্দনকাঠ দিয়ে তৈরি করা হল আকাশছোঁয়া চিতা। চিতায় শেঠজির সঙ্গে উঠলেন তার চারটি স্ত্রী। কিন্তু অমন মানী লোকের স্বর্গে গিয়ে চারটি স্ত্রীতেই কেবল কুলোবে কেন? এতএব ঝি-চাকরকেও স্বর্গে যেতে হল তার সঙ্গে। তামাক সাজবে কে- পা টিপে দেবে কে- হাওয়া করবে কে? সেইখানেই শেষ নয়। দুটো প্রকাণ্ড আরবি ঘোড়াকেও চিতায় চড়িয়ে দেওয়া হল। আবার ঘোড়া কেন? বা-রে নইলে শেঠজির মতো অমন দিকপাল লোক কীসে চড়ে স্বর্গের দেউড়িতে ঢুকবেন? এমনই ছিল সে যুগের কুসংস্কার। সেদিন রামমোহনের চোখ ফেটে জল এসেছিল লজ্জায় ও ক্ষোভে। সেদিন রাজা রামমোহন রায় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, এই ইতিহাস বদলাতে হবে। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানকে এক মন্ত্রে মিলিয়ে দিয়ে সারা ভারতবর্ষে একটি মহাজাতিকে গড়ে তুলতে হবে। আর সেই মিলনমন্ত্র আসবে এই দেশের উপনিষদ থেকেই। সেই সংকল্প বুকে নিয়েই চার বছর পরে রামমোহন রায় দেশে ফিরলেন।’ ১৮১২ সালে তার ভাই মারা যান, আর সেইসময় তার ভাইয়ের স্ত্রীকে চিতায় পুড়িয়ে মারা হয়। এই নির্মম দৃশ্য চোখে দেখে তিনি মেনে নিতে পারেননি।
এই ঘটনা তার মনে তীব্র প্রভাব ফেলে। আর তাই তিনি এই প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে এই প্রথার বিরুদ্ধে একটি বাংলা পুস্তক রচনা করেন। তখনকার দিনে যা হত সব শাস্ত্র মেনে হত। আর তাই তিনি মনুসংহিতা সহ বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে প্রমাণ করেন সতীদাহ প্রথা অন্যায়। এ ছাড়া তিনি সম্বাদ কৌমুদী সহ বিভিন্ন পত্রিকায় এ বিষয়ক লেখা প্রকাশ করতেন। এরপর নতুন গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিংক-এর কাছে একটি আবেদনপত্র দেন। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর ১৭ নম্বর রেগুলেটিং আইন পাস করে সতীদাহ প্রথা বন্ধ করেন। শত শত বছর ধরে চলে আসা নৃশংসতম সতীদাহ প্রথা মোগল সম্রাট শাহজাহান বিলোপ করতে গিয়েও ব্যর্থ হন। তবে কোনো সদ্য বিধবা নারীর শিশুসন্তান থাকলে তার সতীদাহ করার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু প্রত্যন্ত অঞ্চলে এমন অনেক সতীদাহের ঘটনা ঘটত, যা সম্রাট বা তার লোকজনের কানে পৌঁছাত না। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ভয়ে ইংরেজরাও এই প্রথার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে সাহস পাচ্ছিল না।
১৭৯৯ সালে খ্রিস্টান যাজক ও বাংলায় গদ্য পাঠ্যপুস্তকের প্রবর্তক উইলিয়াম কেরি এই প্রথা বন্ধের প্রয়াস নেন। গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির কাছে তিনি সতীদাহ বন্ধের আবেদন জানান। এরপর রামমোহন রায় ১৮১২ সালে সতীদাহবিরোধী সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন। তিনি ও তার লোকেরা বিভিন্নভাবে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে এই প্রথা শুধু অমানবিকই নয়, বরং তা শাস্ত্র ও আইনবিরুদ্ধ। ১৮২১ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘সহমরণ বিষয় প্রবর্ত্তক ও নিবর্ত্তকের সম্বাদ’ শিরোনামের ছোট একটি পুস্তিকা।
১৮২৮ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক বাংলার গভর্নর হয়ে আসেন। তিনি সতীদাহ প্রথার কথা আগে থেকেই জানতেন। লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণার জন্য আবেদন করেন। লর্ড বেন্টিঙ্ক রামমোহনের যুক্তি অনুভব করে আইনটি পাসে উদ্যোগী হন। ব্রিটিশ শাসনের ক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তিনি ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বর সতীদাহ প্রথাকে নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে আইন পাস করেন।
সতীদাহ প্রথা বিলোপর অন্যতম পূরোধা হিসাবে রাজা রামমোহন রায় নমস্য হয়ে থাকবেন চিরদিন।
ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত
Posted in ধারাবাহিক৩. শহীদুল জহিরের ছোটগল্প: বিষয় ও বৈচিত্র্যে
হৃদীবরেষু সুস্মি,
গত কয়েক মাস থেকেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে। গত ৭ জানুয়ারি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় আসেন। মাত্র সাত মাসেই ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন ঐকতানে অভাবনীয় পতন হয়েছে সেই সরকারের। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে বাংলাদেশের পদত্যাগী প্রধানমন্ত্রীর দেশত্যাগ ২০২১ সালের আফগানিস্তান পরিস্থিতি ও ২০২২ সালের শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনীয়। তখন গণ-আন্দোলনের মুখে আফগানিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি ও শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষে দেশত্যাগ করেছিলেন। তবে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিভিন্ন কারণে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ৫ আগষ্ট বিকেলের দিকে জনস্রোত গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে। সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় রাজধানীর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, আওয়ামী লীগের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়, শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত বাসভবন সুধা সদন, তেজগাঁওয়ে আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলা কার্যালয়, বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতার বাড়ি। হামলা হয় জাতীয় সংসদে, প্রধান বিচারপতির বাড়িতে। ছয় ঘণ্টার জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় বিমানবন্দরের কার্যক্রম। জেলায় জেলায় হামলা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও কার্যালয়ে। বিভিন্ন জায়গায় হামলা হয়েছে থানায়। ভাঙচুর করা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। বাংলাদেশের এই পরিস্থিতিতে খুব করে মনে পড়ছে একজনের কথা। আমি বিশ্বাস করি তিনি বেঁচে থাকলে এই সময়ের প্রেক্ষাপটে দারুন কিছু লেখা পড়ার সুযোগ ঘটতো, জানি এই বিষয়ে তুমিও একমত হবে। বস্তিজীবন থেকে যে গল্পধারার শুরু তা সমাজের নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে পেরিয়ে খুব উঁচুতে যেতে পারেনি। তাঁর গল্পে উচ্চবিত্ত চরিত্র খুবই কম, যেমন কম উচ্চশিক্ষিত বা এলিট শ্রেণির চরিত্র। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাই বলেছেন, “তাঁর তাবৎ গল্প থেকে একটি চারিত্র্যই উদ্ভাসিত হয়- সমাজের অন্ত্যেবাসী মানুষের জীবনযাপনের চিত্রণই তাঁর লক্ষ্য। বহির্জীবনই অনেকখানি, তারই মধ্য দিয়ে অন্তর্লোকে যাত্রা। এ বহির্জীবনের পটভূমি বাংলাদেশের, শুধু ঢাকা শহর নয়- ঢাকার বাইরেরও কোনো কোনো স্থান নির্বাচন করে নিয়েছেন এবং গভীর সততা ও নিবিষ্টতার সঙ্গে তার রূপায়ন ঘটিয়েছেন। আমি জানি এইটুকু পড়েই তুমি ঠিক বুঝতে পারছো আমি কার কথা লিখছি।
বাংলা ছোটগল্পের উত্তরাধিকারে ভিন্নধারার কথাশিল্পী শহীদুল জহির (১৯৫৩-২০০৮) এর কথাই বলছিলাম, যার আবির্ভাব জীবনানন্দ দাশের মতো শিল্পীসত্তায় নির্জনতাকে সঙ্গী করে । বাংলা ছোটগল্পের ভুবনে তিনি সংযোজন করেছেন অসামান্য কিছু গল্প। তাঁর গল্পের জীবনসংবেদী বিষয়, অভিনব আঙ্গিক, অন্তরঙ্গ চরিত্র- আর সবকিছু ছাপিয়ে আঞ্চলিক ভাষায় সমৃদ্ধ বিচিত্র বর্ণনাকৌশল বাংলা সাহিত্যে অভিনব সংযোজন। আবহমান সমাজকাঠামোর পুরনো গল্পগুলোই তিনি নতুন করে উপস্থাপন করেছেন, আর তাঁর অভূতপূর্ব উপস্থাপনভঙ্গির কারণে সেগুলো স্বাতন্ত্র্যমন্ডিত। তিনি বহির্বাস্তবকে গৌণ করে অন্তর্বাস্তবকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এই বাস্তব-অবাস্তবের খেলায় বাস্তব ধরা দিয়েছে তীব্রভাবে। জাদুর ঘোর লেগে গেলেও তা শেষ পর্যন্ত বাস্তবই থেকে গেছে। বাংলা সাহিত্যে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে এ ধারা শুরু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র হাত ঘুরে শহীদুল জহিরে এসে তা পুষ্ট হয়েছে এবং স্বকীয় বর্ণনাশৈলিতে পূর্বসূরীদের আড়াল করে তিনি উজ্জ্বল হয়ে আছেন, বলাই বাহুল্য। শহীদুল জহির অধিকাংশ সময় ঘটে যাওয়া গল্প লেখেন। সেই গল্পটা আবার তিনি নির্মাণ করেন সমষ্টির বয়ানে। অর্থাৎ মহল্লা বা ডাউনটাউনের লোকজন সেই গল্পের কথক। তিনি তাদের মুখে গল্পটা তুলে দিয়ে নিজে কিছুটা দূরে সরে যান। অনেকটা পাঠকের অবস্থানে অবস্থান করেন। ফলে তিনি গল্পে কথা বলার ধরন মিশিয়ে যে-কথন তৈরি করেন সেখানে আখ্যান বা অবয়ব বলে কিছু থাকে না। ঐতিহ্যগত নির্মাণশৈলীটা ভেঙে পড়ে। এজন্য তাঁকে উত্তরকাঠামোবাদী (Post-structuralist) হিসেবে আমরা ভাবতে পারি।
আজ্ছা, বাংলাদেশে তোমার যেসব আত্মীয় স্বজন আছেন, তাদের সাথে নিশ্চয় যোগাযোগ হয়েছে। ভালো আছেন তো তারা? দেশভাগের শিকার প্রজন্মের যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের জীবনে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। তাঁদের স্মৃতিতে আছে দেশভাগের বহু গল্প। ঠাকুরদার কাছে শুনেছি ১৯৪৭ সালের জুন মাসের আগেই দেশত্যাগ শুরু হয়ে গিয়েছিল। তখনো ভারত–পাকিস্তানের সীমান্ত ঘোষণা করা হয়নি। এর মধ্যেই মানুষ ‘নিরাপদ অঞ্চল’-এ অভিবাসন করছিলেন। দেশভাগের মতো নির্মম বাস্তবতার সামনে পূর্ব পাকিস্তান নতুন এক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। 'কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা'- পাকিস্তানিদের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় পূর্ব পাকিস্তান। তার পরম্পরায় শোষনের বিরুদ্ধে বাঙালি নতুন প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বলা যায়, এভাবেই দেশভাগ ভিন্ন এক আলো নিয়ে আসে বাঙালির জীবনে। আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকালে মনে হয় ধর্মীয় গোঁড়ামি প্রতিমূহুর্তে বাড়ছে, সঙ্গে বাড়ছে ভারত বিদ্বেষ সম্প্রীতি হারিয়ে যাবার কারণ হিসেবে আমার বারবার মনে হয় দেশভাগ পরবর্তী পূর্ববাংলার পরিবর্তিত সামাজিক অবস্থায় অভিজাত হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংকট মুখ্য। পূর্ববাংলার আর্থ-রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিপত্তিশীল ও নিয়ন্ত্রণকারী হিন্দু সম্প্রদায়ের অভিজাত বা উচ্চবর্ণ গোষ্ঠী নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে সকল ক্ষেত্রেই ছিল অনুপস্থিত। এর পাশাপাশি ছিল মনস্তাত্ত্বিক সংকট। তোমার কি মনে হয়? চল্লিশের দশকে প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান আন্দোলনের জোয়ারে সাময়িকভাবে হলেও ভেসে গিয়েছিল বাংলাদেশের দেশের মুসলিম জনগণ। তারা ভুল বুঝেছিল। কৃষক ভেবেছিলেন জমিদারি শোষণ থেকে মুক্তি পাবেন। মধ্যবিত্ত ভেবেছিল তাদের শ্রেণিগত উন্নতি হবে। দ্রুতই তাদের স্বপ্নভঙ্গ ঘটেছিল। পাকিস্তান আমলে ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু কাজে আসেনি। এখনো যারা মনে করে, মুসলমানিত্ব পরিচয়ের জন্য বাঙালিত্ব ঘুচিয়ে দিতে হবে, তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করে।
একটা জিনিস তুমি খেয়াল করেছো নিশ্চয় শহীদুল জহির ছাড়া বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে তাঁর আগে বা সমকালে জাদুবাস্তবতার দেখা পাওয়া যায়নি বা অন্য কারো লেখায় এ-প্রসঙ্গ অনুপস্থিত তা কিন্তু নয়। ষাটের দশকের কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এবং জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত সচেতনভাবেই গল্পে, উপন্যাসে এর প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। আবার জহিরের সহযাত্রী নাসরীন জাহানের একাধিক উপন্যাসেও এর বিন্যাস ভাষ্যরূপ পেয়েছে। কথাসাহিত্যে অভিনব গদ্যভঙ্গির চর্চা শহীদুল জহিরকে অনন্য করে তুলেছে। আঞ্চলিক কথ্য ভাষাভঙ্গির অনায়াস ব্যবহার তাঁর গদ্যশৈলীকে করে তুলেছে শক্তিশালী আর তার চরিত্রগুলোকে দান করেছে মাটিঘেঁষা শেকড়সন্ধানী অভিযাত্রা। বেশিরভাগ গল্পের চরিত্রগুলো তাঁর জন্মস্থান পুরান ঢাকা, কখনও পৈত্রিক নিবাস সিরাজগঞ্জ, পিতার কর্মস্থল ময়মনসিংহ বা সাতকানিয়ার ভাষায় কথা বলে। জাদুবাস্তবতার ধারণা আয়ত্ত করা প্রসঙ্গে তিনি নিজেই কয়েকটি সাক্ষাৎকারে মার্কেজের কাছে ঋণ স্বীকার করেছেন। গ্রাম, নগর, পাড়া-মহল্লা নির্বিশেষে তাঁর কথাসাহিত্যে জাদুবাস্তবতার যে-ভুবন গড়ে ওঠে, তা একান্তই এদেশীয় জনমানুষের প্রাত্যহিকতা ও শিকড়ঘেঁষা জীবনের স্বাদ, আবহ, গন্ধ ও সৌকর্যকে ধারণ করে বিচিত্র গল্পকথা, আখ্যান, গুজব ও কিংবদন্তিযোগে। উত্তরাধুনিক সাহিত্য-রচনার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে জহির জাদুবাস্তবতাকে গল্প ও উপন্যাসের আধার ও আধেয় – উভয় দিকের উৎকর্ষ সাধনের হাতিয়ার করে তুলেছেন।
শহীদুল জহিরের প্রথম গল্পগ্রন্থের রচনাকাল বিংশ শতাব্দীর সত্তরের দশক, প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘পারাপার’-এর গল্পগুলোতে মার্ক্সীয় দর্শনের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। রচনাকালের দিকে খেয়াল করলে দেখা যাবে বাংলাদেশ সদ্য স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীনতা পরবর্তী দেশকে তার নিজস্ব দেখা থেকেই তিনি সমাজে বঞ্চিতদের কথা বলতে চেয়েছেন, তাদের জীবনসংগ্রামের কথা এবং সেই সংগ্রামে জয়লাভের কথা বলতে চেয়েছেন। সমাজে বঞ্চিত, দলিত মথিত মানুষগুলোর মধ্যে একধরনের ঋজু দৃঢ়তা, প্রতিবাদ ও প্রত্যয় এই পর্বের গল্পে মুখ্য হয়ে ওঠে। লেখক নিজেই বলেছেন, ‘পারাপার বইটাই গরিব লোকদের নিয়া লেখা, শহরের গরিব, গ্রামের গরিব।’ তাই গল্পগুলোকে প্রতিবাদী চেতনার ফসল বলে মনে হয়।
তুমি তো জানই আমার ঠাকুরদা দেশভাগের সময় অসমে চলে আসেন। নওগাঁর শিয়ালমারীতে বিশাল সম্পত্তি বিনিময় করে এলেও সেই সুখ বেশিদিন টেকেনি। বাঙালি খেদাও আন্দোলনের সময় আবার আমার পরিবার উদ্বাস্ত্ত, সব ছেড়ে নতুন করে শুরু করেছিলেন ঠাকুরদা কোাচবিহারে। তোমার পরিবারকে নিশ্চয় এতবার উদ্বাস্তু হতে হয়নি। হিন্দু বাঙালীরা সব সময়েই মনে হয় উদ্বাস্তু তাদের কোন দেশ নেই। পঞ্জাবের দিকে দেখো। প্রথম প্রথম কাটাকাটি, খুনোখুনি যা হবার তা হয়ে গেছে। ওদিক থেকে ট্রেন ভর্তি মৃতদেহ এলে তার প্রত্যুত্তরে এদিক থেকেও ট্রেন ভর্তি শব গেছে। মাউন্টব্যাটেনের আমলেই ওদিক থেকে যারা চলে আসবার এসেছে, এদিক থেকে যারা যাবার, গেছে। কিন্তু বাংলার দিকে যে আগমন-নির্গমন কিছুতেই থামছে না।
শহীদুল জহিরের প্রথম গল্প ‘ভালোবাসা’(১৯৭৪) গল্পটিতে অন্যরকম এক ভালোবাসার রূপ দিয়েছেন জহির। বাবুপুরা বস্তি এলাকার গল্প। তুচ্ছ একটা ফুল দিয়ে যে মানুষের মনকে জয় করা যায়, তার সত্যিকার চিত্রাঙ্কন করেছেন তিনি ‘ভালোবাসা’ নামক গল্পে। বস্তিবাসী হাফিজদ্দি এবং তার স্ত্রী আবেদার প্রাত্যহিক নিস্তরঙ্গ জীবনে ক্ষণিকের জন্য ঢেউ তোলে হলুদ রঙের ডালিয়া ফুল। বস্তির মেয়েদের প্রায় সবাই কাছাকাছি কোনো বাড়িতে ঠিকা ঝিয়ের কাজ করে, পুরুষরা হয় ঠেলাগাড়ি ঠেলে বা দিনমজুর। ঝুপড়ির এক ঘরে ঠাসাঠাসি করে দিনাতিপাত করে। এমনি এক পরিবেশে হাফিজদ্দি ডালিয়া ফুল নিয়ে বাড়ি ফিরলে সবার মধ্যে ঔৎসুক্য তৈরি হয়। আর ‘আবেদার বুকের ভেতরটা কেঁপেছিল কী এক সুখে। হঠাৎ ঝরা বৃষ্টির পর পোড়া চরাচরের মতো আবেদার মনে হয় কী আরাম বৃষ্টির এই অনাবিল জলে ভেজায়।’ সমাজের অন্ত্যেবাসী মানুষদের জীবনে ভালোবাসার পেলব উৎস হয়ে দাঁড়ায় ফুলটি। তাই ‘তহুরা তো জানে না বাবা মাকে কী জাদু করে রেখে বাইরে গেছে।’লেখকের অসামান্য দৃষ্টিভঙ্গির কারণে ফুলটিই শেষ পর্যন্ত গল্প হয়ে দাঁড়ায়।
দ্বিতীয় গল্প ‘তোরাব শেখ’ (১৯৭৫) গল্পটি একটি চমৎকার আঙ্গিকের শক্তিশালী গল্প। বস্তিজীবনের প্রাত্যহিকতা, স্বপ্ন-বাস্তবতা আর জীবন সংগ্রামের গল্প। জহিরের গল্পে বিশ্লেষণ ও বর্ণনা প্রচুর। অনেক ক্ষেত্রে তিনি শব্দ নিয়ে এঁকেছেন চিত্র। কাহিনিকে আরো স্বাবলম্বী ও উদ্ভাসিত করতে এক ধরনের কাব্যময়তা তৈরি করেছেন। নিম্নবিত্ত মানুষের প্রতিদিনের দিনলিপি নিখুঁতভাবে দেখেছেন অথবা অনুভব করেছেন বলেই অনেক চিত্র অন্ধকারাচ্ছন্নের মধ্যেও তুলে ধরেছেন বলিষ্ঠভাবে। তোরাব সেখ, লতিকা, জমির, লালবানু প্রত্যেকেই অস্তিত্বসংগ্রামী। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে জীবনের ঘানি টেনে যাচ্ছে যারা তারা জেগে উঠলেই বদলে যাবে পৃথিবী, মার্কসীয় এ বিশ্বাসের প্রতিফলন এ গল্প। লেখকের জীবনদৃষ্টির ভিন্নতা, সাধারণ মানুষের প্রতি মমত্ব প্রকাশ পেয়েছে “পারাপার”(১৯৭৫) গল্পে।গণমানুষের নিয়তিতাড়িত জীবনধারার পরিবর্তনে শৈশব থেকে প্রাণান্ত চেষ্টার গল্প এটি। ছোট দুটি শিশু আবুল আর বশিরের জীবন সংগ্রাম, সমাজের উঁচুতলার মানুষদের নির্দয় আচরণ, এবং তাদের রোষানল থেকে মুক্তিপ্রত্যাশা গল্পটিকে অনন্য করেছে। সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য অত্যন্ত সহজ পরিসরে উঠে এসেছে। ওলি চরিত্রটির অবস্থান এই দুই শ্রেণির মাঝে।
সংস্কারাচ্ছন্ন গ্রামীণ জীবন, স্বাভাবিক অশ্লীলতা বা সাবলীলভাবে কোনো বাচ্চার জন্ম নিয়ে কথা তোলা গ্রামীণ আবহে সম্ভব। মানুষ সামাজিক বিষয়ে গালগল্পের ওপর নির্ভরশীল। গ্রামীণ সংস্কৃতির নিবিড় অবলোকন থেকে উঠে আসা এমনি একটি গল্প “মাটি ও মানুষের রং” (১৯৭৬)। গল্পটি পুরোদস্ত্তর মনস্তাত্ত্বিক, ধনী-গরিবের যে-তারতাম্য তার প্রকৃত একটা চিত্র শহীদুল জহির চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও দারিদ্রে্যর প্রতি যে-অবিচার করা হয়, অবিচার করা হয় শ্রেণিহীন মানুষের ওপর, তা রূপকের মধ্য দিয়ে শহীদুল জহির বলে গেছেন। আমাদের এই সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থাটা গড়ে উঠেছে ধনী-গরিবের বৈষম্যে। এখানে মানুষের আত্মীয়তা বা রক্তের সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই, মূল্য নেই মানবিকতার। তারপরও মানুষ স্বপ্ন দেখে। অভাব বা দারিদ্র্য স্বপ্নকে কোনোভাবে আটকাতে পারে না। “ঘেয়ো রোদের প্রার্থনা নিয়ে”(১৯৭৬) গল্পে সামাজিক পীড়ন, শোষণে পিষ্ট সহায়হীন অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষ নবাব। সে সমগোত্রের প্রতিহিংসার শিকারও বটে। নিজেকে বড় করতে না পেরে অন্যকে ছোট করে দেখানোর চিরন্তন মানবীয় হীন মনোবৃত্তি এস্থলে লক্ষ্যণীয়। নিম্ন শ্রেণির মানুষের তাই অপরের জীবন সম্পর্কে অহেতুক কৌতুহল। নিরীহ নবাবকে কোনোভাবেই শায়েস্তা করতে না পেরে ঘৃণ্য অপবাদ দিয়ে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করে। খেটে খাওয়া মানুষের জীবনে এটাও এক বিনোদন। শহীদুল জহিরের আঞ্চলিক ভাষার বিচিত্রবর্ণা মুকুটে ভিন্ন পালক যোগ করেছে এ গল্পে নবাবের মুখের ভাষা। তার প্রকৃত নাম আলফাজুদ্দিন আহম্মদ। পুরান ঢাকার চরিত্রে লেখক সতত যেসব নাম ব্যবহার করেছেন, এ নামটি সেগুলোর মধ্যে ব্যতিক্রম। তেমনি ব্যতিক্রম নবাব চরিত্রটি। অত্যন্ত প্রমিতভাষী নবাব চালচলনে এ সমাজে বেমানান। তাই তার প্রতি সবার অবিশ্বাস একসময় আক্রোশে পরিণত হয়।
জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর অনেকেরই এমন কিছু ‘বোধোদয়’ হয়, যা আরও আগে হলে জীবনটা হয়তো আরও সুন্দর হতে পারত। অনেকে হয়তো জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে এটা উপলব্ধি করেন। কিন্তু তাতে তো আর ফেলে আসা দিনগুলো সুন্দর করে তোলা যায় না! আমার পরিবারের যারা স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে গেছিলো তাদের প্রায়শ বলতে শুনি বাংলাদেশে ফেরাটা তাদের ভুল ছিল। তোমার আত্মীয়স্বজনও কি তাই বলে? আমরাই কি আদতে ভালো আছি? ভুলে গেলে চলবে না আমাদের এই সংস্কৃতির ভিত্তি বা উৎস ধর্ম নয়, বরং লোকায়ত চিন্তা ও ভাবাদর্শ, যা প্রজন্ম–পরম্পরায় চলে আসছে। সেই চর্যাপদের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত।
জহিরের গল্প-যাত্রাকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা চলে। ‘পারাপার’ এর পরবর্তী গল্পগ্রন্থের জন্য পাঠককে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৫ বছর। ‘পারাপার’ এর গল্পগুলো তাঁর ২১ থেকে ২৩ বছর বয়সেলেখা। 'পারাপার'-এর রিয়েলেস্টিক ধারার গল্প। পারাপারে জহির অনেক বেশি ট্র্যাডিশনাল, যেখানে গল্প একটি বক্তব্য বা অদেখা বিষয়কে সামনে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন তিনি। অন্যদিকে তার পরের গল্পগ্রন্থটি জাদুবাস্তবতার আখ্যান, ২য় গল্পগ্রন্থ ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ র ১ম গল্পটি লেখা তাঁর ৩৮ বছর বয়সে অর্ধাৎ তাঁর সাহিত্যমানস তখন আরও পরিণত। ততদিনে তাঁর উপন্যাস ‘জীবন এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা’ (১৯৮৮) এবং ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ (১৯৯৫) প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলো বাংলা উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার সফলতম প্রয়োগ বলে স্বীকৃত। ‘ডুমুরখেকো মানুষ ও অন্যান্য গল্প’ নিয়ে ২০০০ সালে তিনি যখন আবির্ভূত হলেন, তখন তার বাস্তব আর জাদুর জগৎ এক হয়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর গল্পের আঙ্গিক আর ভাষাশৈলী চলে এসেছে দৃষ্টিসীমার কেন্দ্রবিন্দুতে। তবে চরিত্রেরা রয়েছে পুরনো শ্রেণি-পেশার বা বর্গের। বেশিরভাগ গল্পে পুরান ঢাকার এমন একটি এলাকা বা মহল্লাকে বেছে নিলেন যেখানে জীবন সরলরৈখিক হলেও বৈচিত্র্যে ঠাসা। অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত এসব মানুষ কখনও আঁকড়ে থাকে তাদের চিরায়ত ধ্যান-ধারণায়, কখনও নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্যের সঙ্গে ‘ইন্দুর-বিলাই খেলা’ খেলে আবার কখনও নিজের অজান্তেই কোনো মহৎ কাজের অংশীদার হতে এগিয়ে আসে। ঘটনার পুনাবৃত্তি থাকলেও তাঁর আশ্চর্য বর্ণনকৌশলের কারণে পাঠকের মুগ্ধতা কাটে না।
‘আগারগাঁও কলোনিতে নয়নতারা ফুল কেন নেই’ (১৯৯১) এই গল্পে নয়নতারা ফুলগাছগুলো এ গল্পের চরিত্র হয়ে ওঠে। আবদুল করিম মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জড়িয়ে যায় বিশেষত্বহীন ফুল নয়নতারার সঙ্গে। ভূমিকম্পের সময় দুটো নয়নতারার টবকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে গিয়ে সে নিজেই চারতলা থেকে পড়ে মগজ থেঁতলে মারা যায় এবং পরবর্তীতে তার শোকে গাছগুলো আত্মহত্যা করতে থাকে।এমন একটি জাদুবাস্তবতার চিত্র তিনি এঁকেছেন যা একইসঙ্গে পাঠকের মোহগ্রস্ততা এবং ধন্দ তৈরি করে। এ গল্প থেকেই তিনি জড়িয়ে গেলেন জাদুর জগতে যা পরবর্তীতে আরও বিকশিত হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ ও ঢাকা শহরকে এক সূত্রে বেঁধেছেন ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’ (১৯৯২) গল্পে, ভূমিহীন অতিদরিদ্র আকালু ও তার স্ত্রী টেপি, রিকশাচালক চান্দু এবং তাদের সারল্যমাখা জীবনাচরণে। ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাকের অলৌকিক ভূমিকা, জাদুবাস্তবতাধর্মী আখ্যান ও ঘটনাংশ, অবিশ্বাস্য লোককথা ও গুজব, সর্বোপরি গল্পের ব্যাখ্যাতীত পরিসমাপ্তি। বহুদিন আগে ঢাকা শহর কাকশূন্য হওয়ার বৃত্তান্তকে ঘিরে এ-গল্পের ঘটনাবিন্যাসের সূত্রপাত। সেই ইতিবৃত্ত নির্মাণে বাস্তবতা ও রূপকথার অলৌকিক-অতিলৌকিক সমাবেশের মাধ্যমে পাঠককেও এক পরাবাস্তব জগতে লেখকের আহবান গল্পটির গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ।
শহীদুল জহিরের একটি ভিন্নধর্মী গল্প ‘ডুমুরখেকো মানুষ’ (১৯৯২)। গল্পে জনৈক মোহব্বত আলী পাড়ায় পাড়ায় জাদু দেখায় আর ডুমুর বিক্রি করে। প্রথমে ফ্রি দিয়ে যে ডুমুর বিক্রি শুরু হয় ক্রমেই তা অমূল্য হয়ে ওঠে। বেশি দামে বিক্রি করলেও মোহব্বত তার গ্রাহকদের বলে, মজা হলেও এই ডুমুর জুগিয়ে খাওয়া উচিত, যাতে শেষ জীবন পর্যন্ত চলে। ডুমুরকে যৌবনের প্রতীকও মনে হয়। কারণ বুড়ো ও বয়স্করা এই ফল বারবার খেতে আগ্রহ প্রকাশ করে। মোহব্বত ডুমুর বিক্রি করলেও ডুমুরের গাছ বিক্রি করতে রাজি হয় না। গাছ না পেয়ে মোহগ্রস্ত মানুষেরা জাদুকরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে এবং একসময় নিজেরাও মৃত্যুবরণ করে। জাদুকরের রহস্যময় হাসির মতোই লেখক রহস্যাবৃত করে রেখেছেন গল্পের শেষ অংশ। তাই গল্প শেষ করে পাঠককে ভাবতে হয় ‘এতক্ষণ যা কিছু ঘটেছে তা স্বপ্ন ছিল।’
নরনারীর হৃদয়াবেগ ও প্রেম নিয়ে শহীদুল জহির বিভিন্নভাবে নিরীক্ষা চালিয়েছেন এমনি একটি গল্প ‘এই সময়’ (১৯৯৩)। ‘কাঁটা’(১৯৯৫) গল্পে যুদ্ধের সময় সংখ্যালঘু সুবোধচন্দ্র ও স্বপ্নার প্রতি যদিও সবাই অসহায় মমতা অনুভব করে কিন্তু আপন অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে তাদেরকে হত্যা করতেও কুণ্ঠিত হয়নি তারা। যেখানে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে 'কুয়ো'র প্রসঙ্গটি। সুবোধ-স্বপ্না দম্পতির কুয়োতে ডুবে মরা বেশ সিম্বলিক। এখানে একটি ইতিহাস ভ্রমণের ব্যাপার আছে। এই কুয়োটি যে সাম্প্রদায়িকতার কূপ তা বুঝতে পাঠকের আর বাকি থাকে না। তাই গল্পে কুয়োটি বন্ধ করার জন্য এলাকাবাসীকে প্রাণান্তকর চেষ্টা করতে দেখা যায়, যা ইতিবাচক।
নকশাল আন্দোলন নিয়ে লেখা গল্প ‘ধুলোর দিনে ফেরা’ (১৯৯৭)। পাখির রূপকে লেখক নূরজাহান ও আবদুল ওয়াহিদের মনোবিশ্লেষণ করেছেন যা প্রেম সম্পর্কে পাঠকের উপলব্ধিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যায়। একই চরিত্র একই মহল্লা শহীদুল জহিরের গল্পে ঘুরে ফিরে এসেছে। কখনও মহল্লাও আবির্ভূত হয়েছে চরিত্র হিসেবে। এই পরিচিত গন্ডির মধ্যেও লেখক কখনও চিত্রিত করেছেন সামষ্টিক জীবনাচরণ, আবার কখনও ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা, একরৈখিকতা। এমনি একটি গল্প ‘চতুর্থমাত্রা’ (১৯৯৮)। এটিকে গল্প না বলে ‘একাঙ্কিকা’ বলা যায়।
‘হিন্দুস্থান কেবলমাত্র হিন্দুদের দেশ এবং মুসলমান, খ্রিস্টান ও অন্যান্য জাতি ভারতে বাস করছে আমাদের অতিথি হিসেবে। অতিথি হিসেবে যতদিন ইচ্ছে তারা এখানে বাস করতে পারে'—এমনটাই বলেছিলেন ১৯৩৩ খ্রি. পাঞ্জাবের বিখ্যাত আর্যসমাজপন্থী হিন্দু মহাসভার নেতা পরমানন্দ । আবার এমনই একটি সুর শোনা যায় লাহোরে ‘জামাত-ই-ইসলামী'-র প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আবদুল আলার কণ্ঠে। তিনি বলেন—‘মানুষের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা অপরিহার্য এবং তাহা ইসলাম ব্যতীত আর কিছুই নহে।' তাহলে পথ কোথায় ? এই উগ্রতা কোনো লক্ষ্যে কি পৌঁছে দেয় আমাদের? মৌলবাদ আসলে কী? সময় কী সাক্ষ্য দেয় এই মৌলবাদের প্রেক্ষিতে? আর সাধারণ মানুষের মনে কোন ভাবনা এসে জমে এই শব্দটিকে ঘিরে? ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি আর মৌলবাদ শব্দগুলো কি পরস্পরের হাত ধরে চলে? ধর্মনিরপেক্ষ দেশে এর ভূমিকাই বা কী? এটি সংহতি নাকি সংকীর্ণতা—কোন গন্তব্যে আমাদের পৌঁছে দেয়? এই উপমহাদেশে ইসলাম ধর্ম বিস্তার লাভ করেছিল তরবারির জোরে নয়, বরং সুফি মতবাদী ধর্ম প্রচারকদের দ্বারা। তাঁদের মতবাদের সঙ্গে এই দেশের শোষিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা তাদের সহজিয়া মতবাদের অনেক সামঞ্জস্য খুঁজে পেয়েছিল। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাবের অনেক আগেই যে বৌদ্ধধর্মের সহজিয়া মতবাদ ও বেদবিরোধী লোকায়ত দর্শন জনমনে গভীরভাবে স্থান করে নিয়েছিল, তার মানবিক দিক ছিল অনেক বেশি। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার সংকট শুরু হয় আশির দশক থেকে। উপমহাদেশজুড়ে মুসলিম মৌলবাদ এবং হিন্দু মৌলবাদ ক্যানসারের মতো বাড়ছে। শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারে বৌদ্ধ মৌলবাদও। মৌলবাদ আসলে ফ্যাসিবাদও। মৌলবাদীর কাছে ‘আমরা’ ছাড়া অন্যরা ‘অপর’। ‘অপরদের ওপর’ ‘আমাদের’ ধর্মের আলো চাপিয়ে দেওয়ার জন্য কোনো অপরাধই অপরাধ নয়। সব অত্যাচার করা বৈধ। ইউরোপের এনলাইটমেন্টের সময় থেকে পৃথিবীজুড়ে ‘অপরের’ ওপর অত্যাচারকে বৈধতা দেওয়া শুরু। উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং মৌলবাদের উত্থান নিয়ে যে কোনো মানবিক মানুষ উদ্বিগ্ন হবেন এটাই স্বাভাবিক। আমার নিরপেক্ষতার ভাাবনা তোমার ভাবনার সাথে হয়ত মিলে যাবে। কিন্তু এও জানি আমার তোমার ভাবনায় ডানা মেলে দেবে না ধর্মান্ধ পৃথিবী।
তৃতীয় এবং শেষ গল্পগ্রন্থ ‘ডলু নদীর হাওয়া ও অন্যান্য গল্প’ গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘কোথায় পাবো তারে’(১৯৯৯)। পুরান ঢাকায় সামষ্টিক শ্রেণিচরিত্রের মাঝে আবদুল করিমের প্রেমের বিষয়টি অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এবং তার ময়মনসিংহ বা ফুলবাড়িয়া যাওয়ার ঘটনায় মহল্লার সবাই আন্দোলিত হয়। ‘ভূতের গলির এই মহল্লার লোকদের দিন উত্তেজনায় ভরে যায়, হালায় প্রেম করে নিহি, তারা বলে-- ফলে মহল্লার লোকদের রাতের ঘুম বিঘিœত হয়, সারাদিনের কর্মক্লান্ত দেহে তারা বিছানায় জেগে থাকে।’ শহীদুল জহিরের গল্পের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যহলো একটি গল্পের মধ্যে আরেকটি গল্পের অন্তর্বয়ন। এমনি একটি গল্প ‘আমাদের বকুল’(২০০০)। আকালু বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়ি থেকে একটি গাভী পায়। পরবর্তীতে দেখা যায় তার স্ত্রী ফাতেমা আর গাভীটির সমান্তরাল জীবনাচরণ- একই সঙ্গে গর্ভধারণ, একই সঙ্গে জমজ বাচ্চা প্রসব এবং একই সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া সবই প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আঠারো বছরের তরুণ শহীদুল জহিরের সংবেদনশীল সত্তায় গভীর ক্ষত তৈরি করে মুক্তিযুদ্ধ। তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। সেই অতৃপ্তি বা হাহাকার থেকে মুক্তিযুদ্ধকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানাভাবে এনেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। তাঁর ‘মহল্লায় বান্দর, আবদুল হালিমের মা এবং আমরা’ (২০০০) গল্পে ভূতের গলির জনজীবনে যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখি -‘ভূতের গলিতেও অবধারিতরূপে একাত্তর সন নেমে আসে এবং আবদুল হালিম এই সময়ের পাকচক্রে ধরা পড়ে, আহা রে আবদুল হালিম, আহা রে আমার পোলা, বলে তার মা হয়তো নীরবে বিলাপ করে, মহল্লার লোকেরা এই কান্নার শব্দ শুনতে পায় অথবা পায় না।’ বানরের উৎপাতে অতিষ্ঠ ভূতের গলির মানুষ প্রথমদিকে কারও ভাতের হাঁড়ি বা হাতঘড়ি বা হরলিকস এর বয়াম হারানোর ঘটনায় অন্যকে দোষারোপ করতে থাকে এবং ঘটনাগুলো রহস্যময়ই থেকে যায়। ধীরে ধীরে বানর রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হলে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে।একই সমান্তরালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আবদুল হালিম আর ঝর্ণার প্রেম, যুদ্ধে পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে ঝর্ণার আকস্মিক মৃত্যু, আবদুল হালিমের যুদ্ধে যাওয়ার পথেই বুড়িগঙ্গার পানিতে ডুবে মৃত্যু এসবই লেখক বানরের গল্পের সঙ্গে বলে গিয়েছেন। ছেলের মৃত্যুর পর তার মা ছেলের তোষকের নিচে ঝর্ণার লাল সাটিনের ফিতা আবিষ্কার করেন এবং বহুবছর পর গৃহকর্মীর মেয়ে জবাকুসুমকে ফিতাটি দিয়ে চুল বেঁধে দেন ‘এবং তারপর সেদিন মহল্লায় লাল চুলের ফিতার ইতিহাস প্রকাশিত হয়।’ যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর পাশবিকতার পাশাপাশি বানরদের এই সামান্য চুরিকে লেখক মানবিকই বলতে চেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের জনজীবনে মানুষরূপী কিছু হায়েনার হিংস্রতার নৃশংসতার ভয়াবহতা লেখক শহীদুল জহির অত্যন্ত নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তুলে এনেছেন তাঁর গল্প উপন্যাসে। তাঁর ‘ইন্দুর বিলাই খেলা’ গল্পে যুদ্ধের সময় ভূতের গলিতে হানাদার-রাজাকারদের নিয়মিত হামলা, অগ্নিসংযোগ এবং সাধারণ মানুষের প্রাণ রক্ষার্থে পলায়নকে লেখক বলেছেন ‘ইন্দুর বিলাই খেলা’- ‘তারপর ভূতের গলিতে ৩০ মে রবিবার সকাল সাড়ে নয়টার সময় পাকিস্তানি মিলিটারি আসে। ... টিপু সুলতান রোডের মোড়ে ট্রাক থামার সঙ্গে সঙ্গে মহল্লায় খবর হয়ে যায়।... মহল্লার লোকেরা গাট্টি বোঁচকা মাথায় করে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে বলধা গার্ডেন এবং হরদেও গ্লাস ফ্যাক্টরির দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ভেগে যায়। মহল্লায় কোনো লোক না দেখে পাকিস্তানি মিলিটারি দলের নেতা লেফটেনান্ট শরিফ খেপে, সে বলে, কেয়া বাত হ্যায়, শালে লোগ সব ভাগ গিয়া? ... আবদুল গণি বলে, হালারা চুহা হ্যায়।... ইয়ে এক খেইল হ্যায়, ইন্দুর বিলাই খেইল হায়, চুহা বিল্লি হায়। তারপর মহল্লার চল্লিশটা বাড়ির ভেতর কেবল খতিজা বেগমদের ৩১ নম্বর বাড়িটা ছাড়া অন্য সব বাড়ি ২৭ অক্টোবর বুধবার পর্যন্ত মোট দুইবার করে পোড়ে।’ এই খেলা মহল্লায় বলবৎ থাকে যুদ্ধের পরও এবং স্বাধীন দেশে সন্ত্রাসীরা নিরীহ মানুষের সঙ্গে এই জীবনমরণ খেলায় লিপ্ত হয়। শিশুদের সাধারণ ‘লৌড়ালৌড়ি’ থেকে শুরু করে ডেঙ্গুজ্বর বা মানুষের জিম্মিদশা পর্যন্ত এই খেলায় প্রতিভাত হয়। লেখক এই খেলার মাধ্যমে ভিন্ন আঙ্গিকে একটি মহল্লায় তথা সমগ্র দেশে সাধারণ মানুষের অস্তিত্বের সংগ্রামকে পুননির্মাণের চেষ্টা করেছেন এবং সফল হয়েছেন। ‘প্রথম বয়ান’ (২০০২) গল্পে আবদুর রহমান শেপালি আকতারের প্রেম প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে অনেকটা খেয়ালের বশেই। পরবর্তীতে কৈশোরের সে প্রেম খুঁজে বেড়ায় সারাজীবন। শেপালি আকতার ‘দান দান তিনদান’ চেষ্টার পরও যখন আবদুর রহমানকে চম্পা ফুলের ডাল দিতে পারেনি তখন তার অভিমান হয় এবং পরিবারের বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে তার বিয়ে হয়ে যায় অন্যত্র। আবদুর রহমানের কাছে বিষয়টি গুরুত্বহীন হয়েই থাকে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে হানাদারদের হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য ভূতের গলির বাসিন্দারা জিঞ্জিরায় আশ্রয় নেয়। তখন কোনো এক রাতে তাদের দুজনের দেখা হয় এবং শেপালির মুখে চম্পাফুলের গল্প শুনে ‘আবদুর রহমানের মনে হয়তো দুঃখ জেগে ওঠে, অধিকারের ভেতরকার পাকা আম পঁচে গেলে যে দুঃখ হয়, সেই দুঃখ, সেই শোক’। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের একরাত্রি গল্পের নায়কের কথা। কৈশোরে সুরবালাকে হেলায় হারনোর পর উকিল রামলোচন রায়ের স্ত্রী হিসেবে যখন তাকে আবিষ্কার করে তখনই নায়কের আত্মপীড়ন শুরু হয়। এতকালের আত্মপ্রবঞ্চনার খতিয়ান নিয়ে ‘বানের জল’ থেকে বাঁচতে প্রলয়রাত্রে সুরবালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এবং কোনো কথা না বলে ফিরে যাওয়াকেই সে জীবনের পরম পাওয়া বলে মনে করে।
অনেক দীর্ঘ লিখে ফেলেছি, আসলে আরো কত কিছুই তো লেখার বাকী আছে। মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশটাকে নিজের বলেই জেনে এসেছি কিন্তু এই কদিনে এত বিষ বাষ্প ছড়িয়ে পড়েছে চেনা মানুষগুলোকেও ভীষণ অচেনা ঠেকছে। এত দ্বেষ এত ঘৃণা জমেছিল মানুষের মনে আগে বুঝিনি। আমি রাজনীতি বুঝিনা, ইনফেক্ট রাজনীতি বুঝতে চাইও না। চারদিনে কলকাতা দখল কিংবা সেভেন সিস্টার দখল করার গল্প শুনে কষ্ট পেলেও আমি মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাতে চাইনা। শুধু বলতে ইচ্ছে করে শহীদুল জহিরের প্রথম বয়ানের ভাষাতেই-‘ সুরবালা তোমার কী না হইতে পারিত’- এই বোধ আবদুর রহমানকে তাড়িয়ে বেড়ায় এবং বহুবছর পরেও ‘কেরোসিন বাত্তি খোঁজার ছলে’ তার বাল্যপ্রেমকেই খুঁজে বেড়ায়। কারণ “আবদুর রহমানের হয়তো এক শোক হয়। যে ঘটনা ঘটার সময় বোঝা যায় না, পরে বোঝা যায়, তার জন্য শোক করা ছাড়া আর গতি কী? ভূতের গলিতে আবদুর রহমান এই অবস্থায় পড়ে ‘চাপা খায়া থাকে’।
নিরন্তর ভালো থেকো। পরশু কয়েকদিনের জন্য পাহাড়ে যাবো আশা করি সেখান থেকে ফিরে এসে দেখবো তোমার চিঠি অপেক্ষা করছে নতুন কোন আলো নিয়ে।
ইতি-
বাসু
১৫ জানুয়ারি,২০২৫
বিঃদ্রঃ নতুন বছরে কি এখনো বই কেনো নতুন কি কি বই কিনলে জানিও। ফেব্রুয়ারি মাসে তো তোমার জন্মদিন, বুড়ি হয়ে যাচ্ছো সুস্মি! কেমন লাগছে? চিরনতুন বৃদ্ধাকে অগ্রীম জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক৬
বের্নহার্ডের বাবা মা এই অবিশ্বাসের ব্যাপারটা অনুভব করেছেন, কিন্তু বুঝতে পারছেন না যে সমাজে তাদের চেনা লোকজনেরা সবাই কেন ছেলেটাকে ঠিক নির্ভরযোগ্য বলে মনে করছে না। গোটা ব্যাপারটা তাদের রাগিয়ে দিয়েছিল। প্রথমে তারা নিজেদের আত্মীয়বন্ধুদের উপরে রেগে গিয়েছিলেন। কারণ এর ফলে তাঁদের অভিভাবকত্বের গরিমা ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। কিন্তু পরে তারা খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে পেরেছেন যে বের্নহার্ডের আচার আচরণের মধ্যে উদ্ভট কিছু জিনিস আছে এবং এটা বুঝতে পেরেই তারা শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন। বিশেষত বের্নহার্ডের মা, তিনি যথেষ্ট ভদ্র এবং বুদ্ধিমতী মহিলা, যিনি লক্ষ্য করেছেন যে বের্নহার্ড ক্রমশ তাঁর কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। তিনি ভেবেছিলেন যে তিনি বের্নহার্ডকে বেশ ভাল বুঝতে পারেন এবং ছেলের স্বভাবচরিত্র কতকটা তাঁরি মত হয়েছে। কিন্তু যত সময় গড়াচ্ছে, এটা বোঝা যাচ্ছে যে বের্নহার্ড একটু আলাদা রকমের আচরণ করছে। এটা বুঝতে পেরে বের্নহার্ডের মায়ের মনে প্রশ্ন জাগছে যে তবে কি ছেলে তাঁকে এড়িয়ে যেতে চাইছে আজকাল? ছেলে ঠিক কী করছে, সেটা তিনি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। তাঁর হৃদয় সব সময় বের্নহার্ডের জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকছে। ছেলের এভাবে দূরে সরে যাওয়াটা তিনি মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। ছেলের জন্য দু’ হাত বাড়িয়ে প্রস্তুত তিনি, অথচ মনে আশঙ্কা যে ছেলে আর ফিরে আসবে না আগের অবস্থানে। কোথাও কি একটা ভয় আর তিক্ততা তৈরি হয়ে যাচ্ছে? কেন? কোথায় সমস্যা? মায়ের কাছে এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। কেউ যদি এসব তাঁকে জিজ্ঞেস করে… তিনি উত্তর দিতে পারবেন না এবং তাঁর চোখ দিয়ে নীরবে অশ্রুপাত হতে থাকবে।
এদিকে আবার বের্নহার্ডের বাবা সঠিকভাবেই জানেন যে বের্নহার্ডের চরিত্রের সমস্যা ঠিক কোথায়। তাঁর মতে, বের্নহার্ড যথেষ্ট সপ্রতিভ এবং ভাল ছেলে; তবে বেশি স্বাধীনতা বের্নহার্ডের বিপদ ডেকে আনতে পারে। কারণ, সে সহজে অন্য মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে যায়। ফলে তাঁকে যথাশীঘ্র সম্ভব ক্ষতিকারক সঙ্গ থেকে বের করে নিয়ে আসা দরকার এবং ভবিষ্যতে যাতে তাঁর আচরণ বিপজ্জনক না হয়ে ওঠে, সেই দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। সেটা তেমন কিছু কঠিন কাজ নয় বের্নহার্ডের বাবার মতে। বের্নহার্ডের ঠাকুমাও ছেলের সঙ্গে এই ব্যাপারে সহমত হলেন। তারপর অবশ্য তিনি চলে গেলেন নিজের ঘরে, কারণ সময় প্রায় রাত বারোটা এবং বের্নহার্ডের বাবা বললেন যে তিনি বের্নহার্ডের জন্য অপেক্ষা করতে চান।
দু’টো বাজল। বের্নহার্ড ফেরেনি এখনও।
বের্নহার্ডের দু’ চোখ ভর্তি ঘুম। শরীরে ভীষণ ক্লান্তি। সে গের্টের বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এখন তাঁকে ডেকে ঘুম থেকে তুলে বাড়ি পাঠানো অসম্ভব ব্যাপার, ভাবছিল ইনেস। গের্ট যদি গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়।
বের্নহার্ডের খুব ভাল লাগছিল। ইনেস তাঁকে ঘুম থেকে তুলবার জন্য চুম্বন করছিল। শুধু তাই নয়, ঘুম থেকে উঠে যখন আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বের্শেন ফরাসি ভাষায় বিড়বিড় করছিল, তখন ইনেস তাঁর দুটো কান ধরে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে তাঁকে অন্তত আরও তিনবার চুমু খেয়েছিল। নিজেকে আদুরে খরগোশের মত মনে হচ্ছিল বের্শেনের। গের্ট নিজের বড় কোটের ভেতরে মালপত্র প্যাক করবার মত করে তাঁকে ঢুকিয়ে নিয়ে প্রায় টানতে টানতে একতলায় নামিয়েছিল। তারপর বের্শেন গাড়িতে আধঘুমন্ত অবস্থায় নিজেকে ইনেস আর গের্টের মাঝখানে বসে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করেছিল। খুব ভাল লাগছিল তাঁর; ইচ্ছে করছিল যেন প্রিয় বন্ধুদের সঙ্গে এই গাড়ির যাত্রাপথ অনেক দীর্ঘ হয়।
বের্নহার্ডের বাবা বাড়ির সামনে একটা গাড়ি থামার শব্দ পেয়েছিলেন। নিজের ঘরের দরজা খুলে ব্যাল্কনিতে দাঁড়িয়ে তিনি দেখতে পেলেন যে একতলার আলো জ্বলে উঠল এবং কয়েকজন ঢুকল। তিনি তাড়াতাড়ি ছায়ায় সরে গিয়ে নিচে কী হচ্ছে সেটা দেখতে লাগলেন। লম্বা একহারা চেহারাটা দেখে তিনি গের্টকে চিনতে পারলেন। গের্ট প্যাকেট খুলবার মত করে একটি ছেলেকে মোটা কোটের ভেতর থেকে বের করছে, সে নিঃসন্দেহে বের্নহার্ড। পাশে ইনেস দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর হাতে বের্নহার্ডের নিজের কোট। গের্ট তারপর বের্নহার্ডকে প্রায় টানতে টানতে একতলায় ঘরের সামনে এনে দাঁড় করালো। কাজটা করতে যথেষ্ট শক্তি প্রয়োজন। বের্নহার্ড তারপর ইনেসের হস্তচুম্বন করল। উত্তরে ইনেস বের্নহার্ডের মাথার চুলে আলতো টোকা দিল। তারপর বেশ জোরে জোরে বলে উঠল... ‘গের্ট, তুমি বের্শেনকে দোতলায় তুলে দিয়ে এসো। আমি বাইরে গাড়িতে অপেক্ষা করছি।’ তারপর বের্নহার্ডের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শুভরাত্রি বের্শেন! আগামীকাল ভাল ভাবে স্কুলের ক্লাস কোর।’
বের্নহার্ড, যাকে খুব ঘুমন্ত দেখাচ্ছে, সে ধীরে ধীরে গের্টের হাত ধরে এবং গের্টের কাঁধে মাথা রেখে উপরে উঠে এল।
বের্নহার্ডের বাবা কয়েক মুহূর্ত ইতস্তত করে, গের্ট এবং ইনেস কেউ তাঁকে দেখে ফেলবার আগে, যতটা নিঃশব্দে সম্ভব, সেইভাবে নিজের ঘরে ফিরে গেলেন।
বের্নহার্ডের সঙ্গে তাঁর বাবার কথোপকথন মোটেই সুখপ্রদ ছিল না। অবশ্য সেটাকে ঠিক কথোপকথন বলা চলে না। কারণ, বের্নহার্ড সেরকম কোনো কথাই বলেনি। এমনকি যে ক্ষেত্রে আপত্তি জানাবার প্রয়োজন ছিল, সে ক্ষেত্রেও বের্নহার্ডের বক্তব্য অনেকখানি ক্ষমাপ্রার্থনার মত শোনাচ্ছিল।
সেই মুহূর্তে বাবা মায়ের ভাবনা সম্পূর্ণ যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছিল তাঁর। কিন্তু সেই কারণে যে তাঁর মা এতখানি কষ্ট পেয়েছেন, সেটা শুনে সে ভারি আশ্চর্য হয়েছিল। সে এইভাবে ভেবে দেখেনি ব্যাপারটা। এ কথা, সে কথা বলতে বলতে তাঁর বাবা হঠাৎ প্রশ্ন করলেন যে ইনেস কখনও বের্নহার্ডকে চুম্বন করেছে কি না। বের্নহার্ড এই প্রশ্নে ভয়ানক ঘাবড়ে গেল। তাড়াতাড়ি বলে দিল যে না, সেরকম কিছু হয়নি। তাঁর মনে হয়েছিল সেটা বলাই সঠিক কাজ। তাঁর নিশ্চিত ধারণা ছিল যে নাহলে তাঁর বাবার ইনেস সম্বন্ধে খারাপ ধারণা হবে। তাছাড়া ইনেস তাঁকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঘুম থেকে তুলে বাড়িতে নিয়ে আসবার জন্যই চুমু খেয়েছিল সেদিন। নাহলে সাধারণ ভাবে এরকম কিছু ঘটে না। কিন্তু বাবা প্রচণ্ড ক্ষেপে গেলেন তাঁর জবাব শুনে এবং পরবর্তী প্রশ্নটা করতে তাঁর অনেকটা সময় লাগল। রাগত স্বরে বলে উঠলেন তিনি…
-‘তোমার লজ্জা করে না সারাক্ষণ মিছে কথা বলে যেতে?’
(চলবে)
Subscribe to:
Posts (Atom)
বিধিসম্মত বিজ্ঞপ্তি
দর্শকসংখ্যা
ঋতবাক পরিচালনায়
প্রধান উপদেষ্টা - নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী ও স্বপন দেব
উপদেষ্টামণ্ডলী – সুদিন চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ রায়, চিন্ময় গুহ, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, শুভ্র ভট্টাচার্য, পল্লববরন পাল
সম্পাদনা – সুস্মিতা বসু সিংহ
কার্যনির্বাহী সম্পাদনা – শিশির রায়, সৌম্য ব্যানার্জী
কারিগরী সহায়তা – সুমিত রঞ্জন দাস
উপদেষ্টামণ্ডলী – সুদিন চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ রায়, চিন্ময় গুহ, ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়, শুভ্র ভট্টাচার্য, পল্লববরন পাল
সম্পাদনা – সুস্মিতা বসু সিংহ
কার্যনির্বাহী সম্পাদনা – শিশির রায়, সৌম্য ব্যানার্জী
কারিগরী সহায়তা – সুমিত রঞ্জন দাস
ব্লগ সংরক্ষণাগার
-
▼
2025
(99)
-
▼
June
(16)
- সম্পাদকীয়
- প্রচ্ছদ নিবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস
- প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস
- প্রবন্ধ - শৌনক ঠাকুর
- পথে প্রান্তরে - রঞ্জন ঘোষ দস্তিদার
- ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত
- ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
- ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
- ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল
- গল্প - মনোজ কর
- গল্প - সুব্রত ঘোষ
- কবিতা - গৌতম দাস
- কবিতা - অমিতাভ মুখার্জী
- কবিতা - অঞ্জন বল
- কবিতা - অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়
- ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী
-
▼
June
(16)
জনপ্রিয় লেখাগুলি
পরবর্তী সংখ্যা প্রসঙ্গে
পরবর্তী সংখ্যা প্রকাশের সম্ভাব্য তারিখ ২১/০৭/২০২৫, লেখা পাঠান অভ্রতে টাইপ করে, লেখা সম্পূর্ণরূপে অপ্রকাশিত হওয়া চাই। লেখা পাঠানোর ঠিকানা - RRITOBAKB@gmail.com.