0

সম্পাদকীয়

Posted in





'

অস্মিতা'। বাতাসে কান পাতলেই এখন এই শব্দটি শোনা যাচ্ছে। অবশ্যই এর আগে 'বাঙালি' যোগ হলে তবেই তৈরি হচ্ছে প্রার্থিত সেই দ্যোতনা, যার প্রভাবে আপাতত পশ্চিম বাংলা তথা ভারতের রাজনীতি সরগরম।

প্রতিবেশী একটি রাজ্যে নাকি সরকারী ফর্মে মাতৃভাষা বাংলা লেখা হলে, তাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে বাংলাদেশী বলে। ভারতের অন্যত্রও ছবিটি প্রায় একইরকম। বাংলায় কথা বলে বিপাকে পড়েছেন, এমন ঘটনার কথা প্রায় রোজই গোচরে আসছে।

বিষয়টি, বলাই বাহুল্য, গভীর শঙ্কা উদ্রেককারী। একটু তলিয়ে ভাবলে একথা বুঝতে অসুবিধা হয় না পরিকল্পিত এই ঐকতানটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। কিন্তু কী সেই উদ্দেশ্য, যা নিয়ে রাজনীতির কারবারীরা ময়দানে নেমে পড়েছেন, 'বাঙালি অস্মিতা' রক্ষা করার জন্য? রাস্তাঘাটে অভাবনীয় খারাপ বাংলায় (যেমন ধরা যাক, শহরের দীর্ঘতম উড়ালপথটির অনেক জায়গাতেই সাবধানবাণী দেখা যায়, সামনে তীব্র বাঁক, গাড়ি আস্তে চালান! কোন ইংরেজি প্রতিশব্দের বাংলা এখানে তীব্র, তা সহজেই অনুমেয়) লেখাগুলি যখন চোখে পড়ে, তখন কি এই অস্মিতা বিপন্ন হয় না? বা কোনও ব্যাংকে গিয়ে পরিষেবা পাওয়ার জন্য যখন শরণাপন্ন হতে হয় হিন্দি বা ইংরেজির? তখন?

আসলে এক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হচ্ছে চিরাচরিত সেই নীতি। কৌশলী প্রচার। ক্ষমতায় টিকে থাকতে গেলে, যার প্রয়োজন অসীম। সরকার বা বিরোধীপক্ষ - দুই গোষ্ঠীর লক্ষ্য একটিই। প্রচারেও তাই খুব রকমফের নেই। পরিধেয়ের রং দিয়েই মূলত চিনে নিতে হবে বক্তা কোন পক্ষের। ব্যবহারিক অন্যান্য সমস্ত লক্ষণই অতি সাদৃশ্যপূর্ণ। 'বাঙালি অস্মিতা' কেন, এই জাতিটির সম্পূর্ণ বিলুপ্তি ঘটলেও নেতানেত্রীবর্গের কিছু এসে যাবে না।

সুস্থ থাকুন। সচেতন থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান।

0 comments:

0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in



















মুখবন্ধ

আমাদের দেশে এখন ইতিহাসের পাতা থেকে নতুন নায়ক তৈরির খেলা চলছে। ঠারেঠোরে প্রতিদিন বোঝানো হচ্ছে যে আমাদের দেশ ভারতবর্ষ হিন্দোস্তাঁ বা হিন্দুস্তান নয়, আসল নাম হিন্দুস্থান—যেখানে হিন্দুদের নিবাস। অন্যেরা, বিশেষ করে মুসলমানেরা বাইরে থেকে আসা আক্রমণকারী।

এর জন্য দরকার ইতিহাসের পাতা থেকে নতুন নতুন নায়ক খুঁজে বার করা এবং সেই প্রক্রিয়ায় তাদের মেটামরফোসিস করে হিন্দুত্বের জন্য সমর্পিত প্রাণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আর এই কাজটি করতে গেলে ইতিহাসের তথ্যকে বিকৃত করতে হবে।

যেমন শিবাজী, রাণা সঙ্গা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস থেকে আমাদের নেতাজী সুভাষচন্দ্র এবং সাভারকর।

বর্তমান নিবন্ধের প্রথম ভাগে পশ্চিম ও উত্তর ভারতে শিবাজীর মিথ এবং ভাবমূর্তি নিয়ে কিছু কথা বলা হবে। তারজন্যে তথ্যসূত্র মহারাষ্ট্রের কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনের প্রমুখ লেখক গোবিন্দ পানসরের চটি বইটি “ হু ওয়াজ শিবাজী”?

তারপরে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকারের দুটি বই থেকে শিবাজী এবং শম্ভাজীর সময়, সংগ্রাম এবং প্রশাসন নিয়ে আলোচনা হবে।

এখানে বলা দরকার সামাজিক কার্যকর্তা এবং লেখক গোবিন্দ পানসরে ২০১৫ সালে সাম্প্রদায়িক গুন্ডার আক্রমণে নিহত হয়েছেন। তাঁর মারাঠি ভাষায় লেখা শিবাজীর জীবনী বেশ জনপ্রিয়।

প্রথম ভাগ

গোবিন্দ পানসরের বক্তব্য নীচে দেয়া হল।

শিবাজী কি ঈশ্বরের অবতার?

অনেকের বিশ্বাস যে শিবাজী শিবের অবতার, কেউ বলেন বিষ্ণুর অবতার। সত্যি কথা, আমাদের দেশে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপরে দেবত্ব আরোপ করতে বেশি সময় লাগে না। ফলে তাদের নিয়ে অনেক অলৌকিক ক্ষমতার গল্প তৈরি হয়। যেমন, শিবাজীর নাকি অদৃশ্য হওয়ার এবং নভচর হওয়ার ক্ষমতা ছিল।

শিবাজী নিঃসন্দেহে একজন সাহসী ও কুশলী যোদ্ধা এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শাসক ছিলেন। তিনি অবতার নয়, বরং নীতিবোধ সম্পন্ন বড় মাপের মানুষ ছিলেন। তবে শিবাজীকে অবতার বানালে অনেক সুবিধে ।

যদি বলি—শিবাজীর মত হও। চাষিদের ফসল লুঠে নিও না। ধর্ষকদের আড়াল কোর না। নিজের ধর্মকে ভালবাস, কিন্তু অন্যের ধর্মকে ঘৃণা কর না।

ব্যস, অমনি শোনা যাবে—উনি তো ঈশ্বরের অবতার, আমরা হলাম সাধারণ মানুষ। আমরা কি করে ওনার মত আচরণ করব?

শিবাজী প্রজা ও চাষিদের পক্ষ নিয়েছিলেন। তাঁর কর নির্ধারণ পদ্ধতি এবং সম্রাট ঔরংজেবকে লেখা চিঠি এর প্রমাণ। কিন্তু শিবাজীর আজকালকার নকল ভক্তের দল?

ওরা শিবাজীর নাম নেয় অন্যদের ভয় দেখাতে। আমাদের বুঝতে হবে ইতিহাসের শিবাজীকে; চিনে নিতে হবে ওঁর সত্যিকারের অনুগামী ও নকল ভক্তদের।

শিবাজী এবং ভবানী তরবারি

শিবাজীর সাফল্যের চাবিকাঠি কী? এটা কি সত্যি যে উনি মা ভবানীর বরে প্রাপ্ত তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধে জেতেন, তাই বিজয়ী হতেন? মহারাষ্ট্রের জনৈক মুখ্যমন্ত্রী লন্ডনের রাষ্ট্রীয় সংগ্রহালয় থেকে শিবাজীর ওই তরবারি ফেরত আনার প্রতিজ্ঞা করে একসময় ভাল ফুটেজ খেয়েছিলেন।

গবেষকরা দেখিয়ছেন যে শিবাজীর তরবারিটি আসলে পর্তুগালে তৈরি হয়েছিল। সে যুগে ইউরোপে বিভিন্ন সংকর ধাতুর থেকে অস্ত্র ঢালাই করে তলোয়ার তৈরির শিল্পকলা বেশ উন্নত হয়েছিল। ওই তলোয়ারটি পর্তুগীজদের সঙ্গে গোয়ায় পৌঁছে যায়, সেখান থেকে মারাঠি সন্তদের হাত ঘুরে শিবাজীর কাছে যায়। সাতারা শহরের মিউজিয়ামে একটি তলোয়ার আছে। অনেকে বলে ওটাই নাকি শিবাজীর ভবানী তলোয়ার। এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু যে কেউ কাছে গিয়ে তলোয়ারটি ভাল করে দেখুন। তাতে পর্তুগীজ ভাষায় খোদাই করা কিছু শব্দ চোখে পড়বেই।

মহান ব্যক্তিদের ট্র্যাজেডি

ইতিহাসের নায়কদের কপালে ভোগান্তি আছে। বেঁচে থাকতে কেউ তাঁর কথা শোনে না । ক্ষমতাসীন লোকেরা তাঁদের আদর্শের বিরোধ করে, কাজ করতে দেয় না। বরং জনমানসে তাঁদের ছাপ মুছে ফেলার এমনকি প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তারা সবসময় সফল হয় না। কারণ, সাধারণ মানুষ জীবিতকালে তাঁদের স্বীকার করে এবং মৃত্যুর পর তাঁদের ভাবধারায় দীক্ষিত হয়ে কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যায়।

কিন্তু ক্ষমতার পীঠাসীন লোকেরা খুব চালাক। তারা যাঁর জীবিতকালে বিরোধিতা করে তাঁদেরই মৃত্যুর পর পুজো করতে শুরু করে। খালি একটা চালাকি করে। তাঁদের ক্ষমতার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের পক্ষে বলা কথাগুলো ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিয়ে ভাবাদর্শকে জল মিশিয়ে পানসে করে দেয়। ওরা সতর্ক থাকে যাতে মহামানবের বিদ্রোহের কন্ঠস্বর নিপীড়িতের কানে পৌঁছতে না পারে। তারা সত্যের সঙ্গে অসত্য মিশিয়ে এক নতুন এবং জালি ইতিহাস রচনা করে।

সন্ত ধ্যানেশ্বর (১২৭৫-৯৬) পরম্পরাগত জ্ঞানভান্ডারকে সংস্কৃত থেকে মুক্ত করে প্রাকৃত ভাষায় নিয়ে এলেন যাতে তা সাধারণের বোধগম্য হয়। অভিজাতকুল তাঁকে শাস্তি দিল সমাজে বহিষ্কার করে, তাঁর সহোদর ভাইদের ‘সন্ন্যাসীর সন্তান’ বলে বদনাম করে। ধ্যানেশ্বর অল্প বয়সে ‘সঞ্জীবন সমাধি’ নিলেন, অর্থাৎ জ্যান্তে মাটিতে পুঁতে দেওয়া!

তাঁর মৃত্যুর পর ওরাই জুটে গেল দিনরাত ওঁর বন্দনাগীত গাইতে, বলল ইতিহাসে এমন কেউ হয়নি, হবেও না।

সন্ত তুকারামকে (১৬০৮-৪৯) সইতে হল মাম্বাজীর অত্যাচার। তাঁর রচিত ‘অভঙ্গ’ ও ‘গাথা’ ইন্দ্রায়নী নদীতে ফেলে দেওয়া হল। তাঁর মৃত্যু আজও রহস্যাবৃত। রটিয়ে দেওয়া হল তাঁর শরীর ও আত্মা সোজা বৈকুন্ঠে পৌঁছে গেছে!

দেখা গেল যে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়ার পরও তাঁর ‘অভঙ্গ’ জনতার কন্ঠে ও স্মৃতিতে বেঁচে রয়েছে। মাম্বাজীর উত্তরাধিকারীরা নিরুপায় হয়ে তাঁর গীতে মিশিয়ে দিল নিজেদের রচনা এবং সেই ভেজাল গীতকে তুকারামের ভজন বলে গাইতে লাগল।

বেশিদূর যাওয়ার দরকার নেই। মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পর অনেক পাড়ায় মিঠাই ও ঘি বিতরণ করা হয়েছিল। হত্যার ষড়যন্ত্রে যাঁরা সামিল ছিল তাঁদের কয়েকজনের ফাঁসি হল, বাকিরা ফাঁক গলে বেরিয়ে গেল। ইদানীং কালে বলা হয় যে ‘ও তো এক পাগলের কাণ্ড!’ তাই কি? নাথুরাম গডসে তো আজও প্রতিবছর শহীদের সম্মান দিয়ে স্মরণ করা হয়।

গান্ধীজিকে শেষ করার উত্তম উপায় হল তাঁর আদর্শকে বাদ দিয়ে তাঁর ভক্ত সাজা।

শিবাজীও ব্যতিক্রম ন’ন।

শিবাজী এবং ব্রাহ্মণসমাজ

শিবাজীকে যেসব অভিধায় ভূষিত করা হয় তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত হয় ‘গো-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ বা গরু ও ব্রাহ্মণের রক্ষাকর্তা উপাধিটি।

কিন্তু শিবাজীর লেখা সব চিঠিপত্র—পরীক্ষা করে বিশেষজ্ঞ দিয়ে প্রমাণিত—আজ সহজলভ্য। কোথাও উনি নিজেকে ‘গো-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ বলেননি। তাঁর সমকালীন কেউই তাঁকে ওই অভিধায় সম্বোধিত করেন নি। বরং প্রত্যেকটি চিঠিতে উনি নিজেকে বলেছেন ‘ক্ষত্রিয় কুলবতংশ শ্রী রাজা শিব ছত্রপতি’।

শিবাজীকে নিয়ে প্রচূর কাজ করেছেন বৈভব এম পুরন্দরে। উনি বলেছেন যে “শিব চরিত্র সাধন” (খণ্ড ৫, আর্টিকল ৫৩৪ ও ৫৩৭) পড়লে দেখা যাবে যে শিবাজী নিজেকে ‘গো-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ বলতেন!

কিন্তু বিদ্বান গবেষক টি এস শেজওয়লকার ওই সাক্ষ্য পরীক্ষা করে বলেছেন—বাজে কথা! শিবাজী কোথাও নিজেকে এসব বলেননি। আর্টিকল ৫৩৭ এ ওই শব্দটি একেবারে নেই। আর ৫৩৪ এ একজন ব্রাহ্মণ চিঠি লিখে শিবাজীকে ‘গো-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক’ বলে সম্বোধন করেছেন, শিবাজী কদাপি নন। রাজার কাছে ভিক্ষাপ্রার্থী ব্রাহ্মণ রাজাকে এভাবে বলবে এতে আশ্চর্যের কি আছে?

গ্র্যান্ট ডাফের বই ‘দ্য হিস্ট্রি অফ মারাঠাজ’ এ দেখা যায় শিবাজী গোধন, রায়ত ও স্ত্রীলোকদের থেকে লুন্ঠনের বিরুদ্ধে নিজের সৈন্যদের কড়া করে নিষেধ করেছিলেন। শিবাজীর রাজত্বে ব্রাহ্মণদের কোন বিশেষ অধিকার বা ছাড় ছিল না। একটি চিঠিতে দেখা যাচ্ছে যে শিবাজী এক দোষী ব্রাহ্মণের বিষয়ে বলছেন –অপরাধী শাস্তি পাবে, ব্রাহ্মণ বলে কোন আলাদা নিয়ম হবে না। তাহলে ‘গো-রায়ত-স্ত্রী’ প্রতিপালক কীভাবে হঠাৎ ‘গো-ব্রাহ্মণ প্রতিপালক হয়ে গেল? ‘রায়ত’ বা প্রজার জায়গায় ‘ব্রাহ্মণ’ বসানো হল? বুঝতে রকেট সায়েন্স লাগে না।

সমস্ত ব্রাহ্মণ শিবাজীর পক্ষে ছিল না। কিছু ব্রাহ্মণ ঔরংজেবের সেনাপতি মির্জা রাজা জয়সিংহের বিজয় এবং শিবাজীর পরাজয় কামনায় ‘কোল চণ্ডী যজ্ঞ’ করেছিল। হিন্দুধর্ম এবং গো-ব্রাহ্মণের প্রতিপালক শিবাজীর পরাজয় কামনায় যজ্ঞ!

শিবাজীর ‘ছত্রপতি’ হওয়ার বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ সমাজ

অনেক ব্রাহ্মণ শিবাজীর অভিষেকের বিরুদ্ধে ছিলেন। কেন? বর্ণাশ্রম সংস্কারের হিসেবে এটা নাকি শুধু ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের অধিকার।

শিবাজী কি ক্ষত্রিয়? সন্দেহ আছে। আর হলেই বা কি! ওঁর নিয়ম মেনে উপনয়ন হয়নি। বিয়েটাও ঠিক বিধি মেনে হয়নি। তাহলে রাজা হবেন কী করে? খচ্চা আছে না? কেউ বললেন –নন্দবংশের পর ক্ষত্রিয় শেষ! (নন্দন্তম্‌ ক্ষত্রিয় কুলম্‌)। কেউ বললেন—পরশুরাম তাঁর কুঠারে ধরার বুক থেকে সমস্ত ক্ষত্রিয়দের শেষ করে দিয়েছিলেন। তাহলে কোন ক্ষত্রিয় কী করে সিংহাসনে বসতে পারে?

মহারাষ্ট্রের কোন ব্রাহ্মণ শিবাজীর অভিষেকে পৌরোহিত্যে রাজি হল না। শেষে বারাণসী থেকে গঙ্গা ভট্টকে এনে বৈদিক রীতিতে অভিষেক সম্পন্ন হল।

কিন্তু শিবাজীর ‘স্বরাজ্য’ মন্ত্রীসভায় সাথী ছিলেন অনেক ব্রাহ্মণ। কেউ সেনাপতি, কেউ প্রশাসক। যেমন পুণের দায়িত্বে থাকা দাদাজী কোণ্ডদেব, পেশোয়া মোরপন্ত পিঙ্গলে, আন্নাজী দত্তো এবং দত্তাজী ত্র্যম্বক। শিবাজীর আগ্রা থেকে গোপনে পালিয়ে আসায় সাহায্য করেছিলেন চারজন ব্রাহ্মণ।

আসলে শিবাজীর অভিষেকে ব্রাহ্মণদের আপত্তির কোন ব্যক্তিগত কারণ ছিল না। হিন্দুধর্মের মৌলবাদী ব্যখ্যায় মনুস্মৃতি অনুযায়ী কোন শূদ্র রাজ্যাভিষেকের অধিকারী নয়, কারণ সে জন্মেছে প্রজাপতি ব্রহ্মার পাদদেশ থেকে। শেষে শিবাজীকে চুয়াল্লিশ বছর বয়সে গঙ্গা ভট্টের পৌরোহিত্যে উপবীত গ্রহণ করলে এবং বৈদিক রীতিতে স্ত্রীকে পুনর্বিবাহ করলে তবে অভিষেক সম্পন্ন হল।

শিবাজী অন্য সমস্ত ইতিহাস-পুরুষদের মত তাঁর সময়ের ফসল। নিঃসন্দেহে উনিও তাঁর কালখণ্ডের সংস্কারে আবদ্ধ ছিলেন।

শিবাজী কি শূদ্র ছিলেন?

এ নিয়ে বিতর্ক আজও অব্যাহত। শিবাজীর সমসাময়িক উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ ও অভিজাত বংশীয় ৯৬টি মারাঠা পরিবার তাঁকে শূদ্র ভাবত; তাঁর ‘রাজা’ উপাধি জুড়ে চিঠিতে দস্তখত করায় আপত্তি করত। তাঁরা নিজেদের ‘পাতিল’ পদবী লিখত। জাবালীর রাজা চন্দ্ররাও মোরে উপরোক্ত কারণে শিবাজীকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করেছিল।

তাঁর পদবী ছিল ভোঁসলে। আজও জাতটাত মেনে সম্বন্ধ করে বিয়ে করার সময় পাতিলরা ভোঁসলেদের ‘নিম্নবর্ণ’ ভাবে।

সমাজ সংস্কারক মহাত্মা জ্যোতিবা ফুলে ( তাঁর ‘গোলামগিরি’ বইটা পড়ে দেখার মত) শিবাজীর বন্দনায় একটি গাথা রচনা করেছিলেন। তাতে উনি শিবাজীকে ‘কুলওয়াড়ি ভুষণ’ বলেছেন। ব্যালাডের শেষে ভণিতায় বলছেনঃ ‘ জ্যোতিরাও ফুলে গায় -হে শূদ্র-সন্তান’!

ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকারের মতে ভোঁসলেরা এবং শিবাজী দলিত ছিলেন, ক্ষত্রিয় নন।

তবে এ নিয়ে বিতর্ক আছে। আজকের অনেক ঐতিহাসিক শিবাজীকে রাজপুতানা থেকে আগত রাজপুত বংশাবতংস হিসেবে দেখাতে চান। তবে শিবাজীর বংশের জাত নিয়ে বিতর্ক আজ অনেকটাই অপ্রাসংগিক ।

শিবাজীর কৃষক সাথীরা

শিবাজীর ‘স্বরাজ’ পরিকল্পনায় এবং তার প্রয়োগে কারা শিবাজীর পাশে ছিল? কারা লড়াই করেছিল? ইতিহাস সাক্ষী -অধিকাংশই নিম্নবর্ণের গরীব চাষির দল। তাঁর সৈন্যবাহিনীর মেরুদন্ড ছিল ‘মাওলা’ কৃষকেরা।

শিব এবং জীব মহালা ছিল জাতে নাপিত। ওরা ওঁকে পানহালা দুর্গ থেকে পালাতে সাহায্য করেছিল। আফজল খাঁকে বাঘনখ দিয়ে হত্যার সময় শিবাজীর সঙ্গে ছিল জীব মহালা শংখপাল। শিবাজীর গুপ্তচর বিভাগের প্রধান ছিল বাহিরজী নায়েক- - অস্পৃশ্য রামোশী সম্প্রদায়ের। ‘সভাসদ বাখার’ গ্রন্থ বলছে শিবাজীর ঐতিহাসিক মিশনে কিছু ব্যক্তিবিশেষ নয়, নীচুতলার গোটা সম্প্রদায় যুক্ত হয়েছিল।

ওঁর নৌবাহিনীর প্রধান ছিল একজন মুসলমান। অধিকাংশ নাবিক এবং নৌসেনারা এসেছিল কোলি, সংখোলি, ভান্ডারি ও মুসলমান সম্প্রদায় থেকে। এইভাবে শিবাজী তাঁর ‘স্বরাজ্যে’ যথাস্থিতি ভেঙে দিলেন। এই কারণেই উচ্চবর্ণ ও অভিজাত কুলের সামন্তেরা গোড়ায় ওঁর বশ্যতা স্বীকার করেনি বা পক্ষে দাঁড়ায়নি। কারণ তারা চাইছিল সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে।

শিবাজীঃ ধর্মপরিবর্তন, কুসংস্কার ইত্যাদি

শিবাজী হিন্দু ছিলেন, কিন্তু ‘অসহিষ্ণু হিন্দু’ নন। সে যুগে নিজের ধর্ম ছেড়ে মুসলমান হলে ‘নিধনং শ্রেয়ঃ’, ফিরে আসার পথ নেই। শিবাজীর পরবর্তী পেশোয়া শাসকেরা ওই গোঁড়া হিন্দুত্বের পথই বেছে নিয়েছিলেন। পেশোয়া বাজীরাওএর স্ত্রী মস্তানী ছিলেন মুসলমান। তাই বাজীরাও নিজের ছেলে শমসের বাহাদুরকে চেষ্টা করেও হিন্দুসমাজে ফিরিয়ে আনতে পারলেন না।

অথচ শিবাজীর সময়ে বাজাজি নিম্বলকর ও নেতাজি পালকর ইসলাম গ্রহণ করে দশ বছর মুসলমান রইলেন। তারপর ফিরে ইসলাম ছেড়ে ফিরে এলেন হিন্দুসমাজে।শিবাজী নিজের মেয়েকে বিয়ে দিলেন বাজাজী নিম্বলকরের ছেলের সঙ্গে। ছেলেটাকে খৎনা করার জন্য ‘কাটোয়া’ বলা হত।

নেতাজি পালকর মুসলমান হয়ে আফগানিস্থানে আট বছর কাটিয়ে দেশে ফিরলেন। তারপর শিবাজীর উপস্থিতে ফের হিন্দুসমাজে যুক্ত হলেন।

শিবাজী অস্পৃশ্য মাহার (বাবাসাহেব আম্বেদকর একজন মাহার) দলপতিকে কেল্লার কম্যান্ডার বানিয়েছিলেন। অথচ পরবর্তী পেশোয়া রাজত্বে ‘মাহার’দের কোমরে ঝাঁটা বেঁধে পথে চলতে হত, যাতে রাস্তা আপনাআপনি সাফ হয়ে যায়!

শিবাজী প্রচলিত কুসংস্কারে বিশ্বাসী ছিলেন না। তখন বলা হত যে কোন শিশু যদি মায়ের পেট থেকে উপুড় হয়ে জন্মায় তাহলে সেটা পরিবারের জন্যে অশুভ। শিবাজীর ছেলে রাজারাম এভাবেই উলটো হয়ে জন্মাল। সবাই আতংকিত।

শিবাজী হেসে বললেন—উলটো হয়ে জন্মেছে? এ ছেলে ভবিষ্যতে মোগল সাম্রাজ্যকে উলটে দেবে!


দ্বিতীয় ভাগ

শিবাজীর হিন্দুরাষ্ট্রঃ ইতিহাসবিদ আচার্য যদুনাথ সরকারের চোখে

যাঁরা আজ ধর্মের সাদাকালো বিভাজনের ভিত্তিতে ভারত ইতিহাসের পুনর্লিখনে ব্যস্ত, তাঁরা দুই বাঙালী ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার এবং রমেশ চন্দ্র মজুমদারের নাম শুনলেই দণ্ডবত হন।

মনে হয় তাঁরা যদুনাথ সরকারকে মন দিয়ে পড়েন নি।

আচার্য যদুনাথ সরকার সেই সময়ের হিসেবে রীতিমত ডিসিপ্লিন্ড ইতিহাসবিদ। উনি সমস্ত উপলব্ধ তথ্যের প্রাসংগিকতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা সমসাময়িক অন্য তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখে তাকে তাঁর গবেষণার অন্তর্ভুক্ত করেন।

বর্তমান প্রবন্ধটি ডঃ সরকারের শিবাজীকে নিয়ে একশ’ বছর আগে প্রকাশিত দু’টি বইয়ের-- Shivaji and his Times (১৯১৯) এবং The House of Shivaji--ভিত্তিতে লেখা। এখানে বর্তমান প্রাবন্ধিকের নিজস্ব মতামত না দিয়ে আচার্য যদুনাথের বক্তব্য উদ্ধৃত করে নির্ণয়ের ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

যদুনাথ তাঁর Shivaji and his Times এর প্রথম সংস্করণের (১৯১৯) ভূমিকায় বলেছেন ক্যাপ্টেন গ্রান্ট ডাফের তিন খন্ডে মারাঠাদের ইতিহাসে সমস্ত তথ্য আন- ক্রিটিক্যালি নেয়া হয়েছে। গ্রান্টের তথ্যসূত্র শিবাজীর মৃত্যুর ১০৮ বছর পরে লেখা বিবরণ এবং জন্মের ১৮৩ বছর পরে রচিত ‘চিটনিস বাখার’ লোকগাথা যা বাগাড়ম্বর এবং মিথ্যা বিবরণে পূর্ণ।

যদুনাথ নির্ভর করেছেন এবং প্রাথমিকতা দিয়েছেন শিবাজীর সমসাময়িক লেখাপত্র, দলিল এবং ফার্সি, ওলন্দাজ ও বৃটিশ ডকুমেন্টসকে।

উনি লক্ষ্য করেছেন কীভাবে শিবাজীকে নিয়ে মিথ এবং গালগল্পের নির্মাণ দ্রুত বেড়ে উঠেছে, এমনকি বিংশ শতাব্দীতে এই উদ্দেশ্যে জাল দস্তাবেজও তৈরি হচ্ছে। (পৃঃ ৭, ভুমিকা)।

যদুনাথ তাই যেসব তথ্যপ্রমাণের সত্যতা প্রশ্নাতীত সেগুলি লিপিবদ্ধ করেছেন এবং অন্য সম্ভাবনাগুলোর সত্যতা খুঁটিয়ে দেখেছেন। (ঐ)

বর্তমান নিবন্ধে শিবাজীর অংশটিতে প্রথম বই Shivaji and his Times (১৯১৯) থেকে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। শম্ভাজীর রাজত্ব অংশের সব উদ্ধৃতি দ্বিতীয় বই The House of Shivaji থেকে নেয়া।

যদুনাথের শিবাজী চর্চার প্রেক্ষিতঃ

সপ্তদশ শতাব্দীর দাক্ষিণাত্যের জটিল ইতিহাসে মারাঠারা অন্যতম গ্রন্থি মাত্র, একমাত্র নয়। তাই শিবাজীর উদ্ভবকে বুঝতে হলে মোঘল সাম্রাজ্য, বিজাপুর এবং গোলকোণ্ডার আভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে বিশদ বুঝতে হবে। তাই ওঁর বইটি শুধু শিবাজীর জীবনী নয়। (ঐ)

একই সঙ্গে যদুনাথ দেখিয়েছেন যে লড়াইটা মূলতঃ ক্ষমতা পাওয়া এবং ধরে রাখা নিয়ে, অর্থাৎ হিন্দু বনাম মোগল এমন সাদাকালো নয়। ধর্মীয় উপাদান নিশ্চয়ই ক্রিয়াশীল, কিন্তু সর্বোপরি নয়। যেমন, মোগল সম্রাট ঔরঙজেবের প্রধান সেনাপতি ছিলেন হিন্দু রাজা জয় সিং, পরে যশবন্ত সিং। মারাঠাদের এবং মোগলদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বিজাপুরের সুলতানের সেনাপতির নাম ভেঙ্কটাদ্রি মুরারী! (পৃঃ ৩৬৪) আর রাণা রাজ সিং সম্রাট ঔরংজেবের সঙ্গে সখ্যতা করে নিজের রাজ্যে দিব্যি ছিলেন।

শিবাজী কাজী হায়দারকে তাঁর সচিব নিযুক্ত করেছিলেন। তাঁর প্রধান নৌ সেনাপতি ছিলেন সিদ্দি মিসরি নামের আবিসিনিয়ান মুসলমান।

আবার শিবাজীর বড় ছেলে শম্ভাজী শিবাজীর বিরুদ্ধে মোগল সেনাপতি দিলীর খাঁ’র সঙ্গে যোগ দিলেন। সম্রাট ঔরঙজেব তৎক্ষণাৎ শম্ভাজীকে সাতহাজারী মনসবদার করে তাঁকে একটি হাতি উপঢৌকন পাঠিয়ে দেন। শম্ভাজী মোগল বাহিনীর সঙ্গে গিয়ে শিবাজীর ভুপালগড় দুর্গ তছনছ করেন। এক বছর পরে আবার পিতার কাছে ফিরে আসেন।

শিবাজীর মোগল বশ্যতা এবং বিদ্রোহঃ ঘটনা পরম্পরা

শিবাজী নিজে পুরন্দর দুর্গের যুদ্ধে মোগল সেনাপতি জয় সিংহের কাছে পরাজিত হয়ে শর্ত মেনে মোগল পক্ষে যোগ দিয়ে বড় ছেলে শম্ভাজী এবং কিছু নজরানা নিয়ে ঔরংজেবের দরবারে হাজির হন। কিন্তু অপেক্ষাকৃত সম্মান না পেয়ে দরবার ছেড়ে চলে আসেন, এবং কিছুদিন পরে প্রাণদণ্ডের আশংকায় পালিয়ে বিজাপুরে চলে আসেন। সেই বিদ্রোহের শুরু। মোগলদের বিরুদ্ধে অনেকবার বিজাপুরের সুলতানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।

শিবাজীকে লেখা মোগল সম্রাট ঔরংজেবের চিঠিগুলো এ বিষয়ে কিছু ধারণা বদলে দেবে।

২২ এপ্রিল ১৬৫৭ ঔরংজেবের শিবাজীকে লেখা চিঠি—উনি বিজাপুরের যে দুর্গগুলো শিবাজীর অধীনে রয়েছে তার দায়িত্বভার শিবাজীর প্রার্থনা অনুযায়ী তাঁকে অর্পণ করা হল। পৃঃ ৯৪

২০ এপ্রিল, ১৬৫৮ –তোমার অপরাধ গম্ভীর। তবু এবারের মত মাফ করলাম। কারণ, তুমি এখন থেকে আমার অনুগত থাকার কথা দিয়েছ। পৃঃ ৯৭

একবছর পরে। সব শত্রুকে হারিয়ে সিংহাসনে বসেছি। তুমিও আনন্দ কর এবং সিংহাসনের প্রতি অনুগত থাক। তবে তোমার অভিলাষ পূর্ণ হবে। শায়েস্তা খাঁকে দাক্ষিণাত্যের সুবেদার নিযুক্ত করা হয়েছে। তুমি তার অধীনে কাজ করতে থাক। পৃঃ ৯৮

কিন্তু শিবাজী সে বান্দাই নন। উনি শায়েস্তা খাঁ কে অগ্রাহ্য করে সুরাত এবং আরও কিছু সম্পন্ন নগর লুঠ করলেন। ওনার গেরিলা আক্রমণে শাহী ফৌজ ব্যতিব্যস্ত। তখন ঔরঙ্গজেব এই ‘পাহাড়ী ইঁদুরকে” ধরতে রাজা জয় সিংকে দাক্ষিণাত্যে পাঠালেন। শিবাজী ১২ জুন ১৯৬৫ তারিখে পুণেতে জয় সিংহের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন।

তার আগে জয় সিং কড়া করে চিঠি দিলে শিবাজী দুটো প্রস্তাব রাখলেনঃ

১ শিবাজী আত্মসমর্পণ করতে রাজি, যদি তাঁর প্রাণ এবং সমস্ত সম্পত্তি নিরাপদ থাকবে –এমন গ্যারান্টি দেয়া হয়।

নইলে,

২ শিবাজী নিজের কিছু এলাকা বিজাপুরের সুলতানকে দিয়ে তাঁর সঙ্গে সন্ধি করে দুজনে মিলে মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবেন। পৃঃ ১০৬

শিবাজী এলে জয় সিং শর্ত রাখলেনঃ হয় শিবাজী তাঁর অধীন সমস্ত দুর্গ মোগলদের হস্তান্তর করুন এবং আগ্রায় গিয়ে সম্রাটের কাছে মাফি চান তাহলে উদার হৃদয় সম্রাট মাফ করতে পারেন। নয় শিবাজী নিরাপদে নিজের জায়গায় ফিরে যান।

শিবাজী বললেন—আমি এখন মোগল সাম্রাজ্যের অধীনতা স্বীকার করে তার জন্যে সেবা প্রদান করতে এসেছি। তাই আমার যত দুর্গ স্বতঃ মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।

মাঝরাত পর্য্যন্ত দরাদরির পর ঠিক হল শিবাজীর ছোট বড় মিলিয়ে ২৩ টি কেল্লা মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে। আর রাজগড় সমেত ১২টি ছোট বড় কেল্লা শিবাজীর অধীনে থাকবে। তবে শর্ত হল শিবাজীকে তার কাজকর্মে মোগল সাম্রাজ্যের বশ্যতা ও আনুগত্য দেখাতে হবে।

শিবাজী বললেন—আমার আর বাদশাহের সামনে যাওয়ার মত মুখ নেই। তাই আনুগত্যের প্রমাণ হিসেবে আমার ছেলেকে (শম্ভাজী) আগ্রায় পাঠাচ্ছি। তাকে যেন, আপনার কথামত, পাঁচ হাজারী মনসবদার করে দেয়া হয়। (পৃঃ ১০৮ এবং ১০৯ )

১৩ জুন, ১৬৬৫ নাগাদ মোগল সেনাপতি মির্জা জয় সিং এবং রাজা শিবাজীর মধ্যে পুরন্দর দুর্গের সন্ধি সাক্ষরিত হল।

যদুনাথ বলছেন—এই সন্ধিটা যেন দুই ডাকাতের মধ্যে লুঠের মালের বাঁটোয়ারা! বিজাপুর সাম্রাজ্যকে (আদিল শাহ) ভাগাভাগির চক্রান্ত। তবে এটা স্পষ্ট –কোথাও শিবাজীকে বিজাপুর এলাকায় চৌথ আদায় করার অধিকার দেয়া হয় নি বা দাক্ষিণাত্যের ভাইসরয় করার আশ্বাস দেয়া হয় নি—যদিও এসব সভাসদ ৩৮ এ বলা আছে। যদুনাথের মতে এধরণের আশ্বাসনের দাবি অসম্ভব মনে হয়। পৃঃ ১২১

শিবাজীর ঔরঙ্গজেবকে লেখা বশ্যতা স্বীকার করে পত্র লিখলেন, জুন ১৬৬৫ (পৃঃ ১২২)।

সম্রাট ঔরঙ্গজেবের থেকে ফরমান (লিখিত সম্মতি) এলে শিবাজী আনন্দের সঙ্গে জয় সিং এর শিবিরে ২৭ সেপ্টেম্বর ১৬৬৫ তারিখে এলেন।

ডিসেম্বর ১৬৬৫ নাগাদ চল্লিশ হাজার মোগল সৈন্য জয় সিং এর নেতৃত্বে বিজাপুর আক্রমণ করে। তাঁর সঙ্গে যুক্ত হয় শিবাজীর সাত হাজার পদাতিক এবং দুই হাজার অশ্বারোহী। পৃঃ ১১৮

ঔরঙ্গজেব শিবাজীকে রত্নখচিত ছোরা উপহার দিলেন। পৃঃ ১৩১


ঔরঙ্গজেব সকাশে আগ্রায় শিবাজীঃ ইতিহাসের মোড়

১২ মে, ১৬৬৬। শিবাজী দেওয়ান -ই-খাসে সম্রাটের সামনে উপস্থিত হয়ে ১০০০ মোহর এবং ২০০০ টাকা নজরানা এবং ৫০০০ উপহার হিসেবে দিলেন। পুত্র শম্ভাজী দিলেন ৫০০ মোহর, ১০০০ টাকা নজরানা এবং ২০০০ টাকা নিসার। সেদিন সম্রাটের জন্মদিন। প্রধান মন্ত্রী জাফর খান এবং প্রধান সেনাপতি জয় সিং কে খেলাত দেয়া হল, আর কাউকে নয়।

শিবাজী অসন্তুষ্ট। সম্রাট জানতে চাইলেন শিবাজীর কীসের অসুবিধে হচ্ছে?

উনি কুমার সিংকে বললেন—আমাকে যথোচিত মর্যাদা দেয়া হয় নি। এতক্ষণ সম্রাটের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে! আমার মনসবদারি চাই না। আমি চললাম, আমার মাথা কেটে ফেললেও আর সম্রাটের দরবারে হাজির হচ্ছি না। এই শেষ।

ঔরংজেব জানতে পেরে তিন অমাত্যকে পাঠালেন—এই খেলাত শিবাকে দাও এবং বুঝিয়ে সুজিয়ে শান্ত করে আমার দরবারে নিয়ে এস।

শিবাজী ফিরলেন না। দরবারে বিরোধী অমাত্যের দল বলতে লাগল—এত বড় বেয়াদপি! তবু সম্রাট সহ্য করছেন! (পৃঃ ১৩৫)

১৫ মে পর্য্যন্ত শিবাজী দরবারে গেলেন না, জ্বর হয়েছে। তবে নিজের ছেলে শম্ভাজীকে পাঠিয়ে দিলেন। সম্রাট শম্ভাজীকে একটি শিরোপা, রত্নখচিত ছোরা এবং মুক্তোর মালা উপহার দিলেন। পৃঃ ১৩৭।

রাজা জয়সিং এর বিরোধীরা—যেমন রাজা যশবন্ত সিং প্রধান উজির জাফর খান এবং বেগম সাহিবা সম্রাটের কান ভাঙাতে লাগলেন। জয় সিং এর আশকারায় শিবা আপনাকে অপমান করল।

ঔরংজেব শিবাজীকে কোতল করার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু জয় সিং পুত্র কুমার রাম সিং জানতে পেরে আমিন খানকে বললেন—আগে আমাকে মারুন।

তখন বলা হল যদি রাম সিং জামিন হয় যে শিবাজী আগ্রা ছেড়ে যাবেন না তাহলে তাঁর প্রাণ রক্ষা হবে। রামসিং শিবাজীকে দিয়ে তাঁর ঘরে শিবের মাথায় হাত রেখে শপথ করালেন এবং তারপর জামিন দস্তাবেজে দস্তখত করে মোহর লাগালেন। পৃঃ ১৩৯

কিন্তু ১৭ অগাস্ট, ১৬৬৬ তারিখে শিবাজী তাঁর ছেলে শম্ভাজীকে নিয়ে ফলের ঝুড়িতে লুকিয়ে আগ্রার গৃহবন্দী অবস্থা থেকে পালিয়ে গেলেন। মোগল বাহিনী অনেক পরে টের পেয়ে তাড়া করেও ধরতে পারেনি। এটা মোগল সম্রাটের পক্ষে অত্যন্ত লজ্জাজনক হার।

কিন্তু তারপরেও শিবাজী ও ঔরংজেবের মধ্যে শাসক ও বিদ্রোহী সম্পর্ক হয় নি। বরং ঔরংজেব কূটনীতির মাধ্যমে শিবাজীর আনুগত্যের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

৬ মে ১৬৬৭।

সম্রাট একজন বার্তাবাহকের মাধ্যমে শিবাজীকে খবর পাঠালেন যে তাঁর অপরাধ ক্ষমা করা হয়েছে, শিবাজীর ছেলেকে মনসবদার পদে উন্নীত করা হয়েছে এবং শিবাজী চাইলে বিজাপুর সাম্রাজ্যের যে কোন কিলা নিজের দখলে রাখতে পারেন; নইলে নিজের জায়গায় থাকুন, কিন্তু শাহজাদা মুয়াজ্জিমের প্রশাসনিক নির্দেশ মেনে চলুন। পৃঃ ১৫৩

শিবাজীকে লেখা ঔরংজেব নিযুক্ত দাক্ষিণাত্যের শাসক শাহজাদা মুয়াজ্জমের চিঠি, তারিখ ৯ মার্চ, ১৬৬৮

রাজা শিবাজী! আমি মহামহিমকে আপনার আনুগত্য এবং নিষ্ঠার কথা জানিয়েছিলাম। উনি খুশি হয়ে আপনাকে “রাজা” উপাধি দিয়েছেন—যেমনটি আপনি চাইছিলেন। আশা করি, সম্রাটের এই অনুগ্রহের প্রতিদান স্বরূপ আপনি আগের থেকে আরও বেশি করে সাম্রাজ্যের সেবায় আত্মনিয়োগ করবেন। তাহলে মোগল দরবারে আপনার সম্মান ও প্রতিপত্তি বাড়তেই থাকবে। পৃঃ ১৫৬

কিন্তু শিবাজী ক্রমশঃ মোগল সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক নির্দেশ মানার চাইতে দাক্ষিণাত্যে নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুললেন।

শিবাজীর রাজ্যাভিষেক হয় ৬ জুন ১৬৭৪, পৃঃ ১৭৫

শিবাজীর সরকার পরিচালনা, সংগঠন এবং নীতি

শিবাজীর সৈন্যরা কৃষকদের থেকে “চৌথ” আদায় করত। অর্থাৎ জমির খাজনার এক চতুর্থাংশ। আচার্য যদুনাথের মতে এটা একধরণের র‍্যানসম, কারণ এটার বদলে মারাঠা সৈন্যরা প্রজাদের রক্ষার বা শাসনের কোন দায়িত্ব নিত না। (p. 407)

শিবাজীর সময়ে মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে ইংরেজ ব্যাবসায়ী, হিন্দু বানিয়া, ভারতীয় মুসলিম, আরব বণিক এবং পার্শী বণিকদের ওয়াইসাতি কেল্লায় বন্দী করে যন্ত্রণা দেয়া হত এবং পেটানো হত। (পৃঃ ৩৮৫)।

শিবাজীর ক্ষমতাধীন এলাকায় ছিল ২৪০ কেল্লা যার মধ্যে ৭৯ ছিল মহীশূর এবং মাদ্রাজে অবস্থিত। শিবাজীর আয় ছিল কাগজপত্রে ৯ কোটি টাকা। বাস্তবে আদায় হত আরও কম। কখনও এক দশমাংশ, অর্থাৎ ৯০ লক্ষ টাকা। (পৃঃ ৪০৮)।

শিবাজীর সৈন্যবল গোড়ার দিকে ছিল কুড়ি হাজার, এর মধ্যে সাতশো ছিল মুসলমান। শেষ জীবনে তাঁর সৈন্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় দুই লাখ। তবে মাওলে সম্প্রদায়ের (দলিত জাতি) পদাতিক ছিল এক লক্ষ(পৃঃ ৪০৯)।

তাঁর রাজ্যে বিচার হত সংস্কৃত আইনের বই (স্মৃতিশাস্ত্র অনুসারে), পৃঃ ৪১১।

শিবাজীর আট জন সদস্যের মন্ত্রীসভায় উনিই ছিলেন সর্বেসর্বা। শাস্ত্রীয় ব্যাপারে উনি পেশোয়া নির্ভর ছিলেন, নিজে নাক গলাতেন না। আচার্য যদুনাথের মতে তার কারণ উনি ছিলেন নিরক্ষর এবং জাতে ছোট, (ঐ)

প্রধান সেনাপতি ছাড়া সবাই ব্রাহ্মণ।

শিবাজীর যুদ্ধকালীন নিয়মঃ (পৃঃ ৪১৭)

বর্ষার তিনমাস সৈন্যেরা শিবিরে থাকবে। বিজয়া দশমীর দিন থেকে লুন্ঠনে বেরোবে। এভাবেই ওদের খরচা তোলা হবে এবং বাড়তি দ্রব্য ওরা সরকারের খাজানায় জমা করবে।


কোন সৈন্য সঙ্গে নারী, দাস অথবা শিশুদের নিয়ে যেতে পারবে না। আদেশ না মানলে মুন্ডচ্ছেদ করা হবে।


শুধু পুরুষদের বন্দী করা হবে, মহিলা এবং শিশুদের নয়।


গাভী লুট করা যাবে না, কিন্তু বলদ কেবল গাড়ি টানতে ব্যবহার করা যাবে।


ব্রাহ্মণদের উপর অত্যাচার করা চলবে না। (মনুস্মৃতিও তাই বলে)।


কোন সৈনিক যুদ্ধে গেলে মহিলাদের সঙ্গে কদাচার করবে না।


যুদ্ধে যাওয়ার সময় সৈনিক কী কী জিনিস সঙ্গে নিয়ে যাবে তার অনুমোদিত সূচী আছে।


ফিরে আসার পর সবার শরীরের তল্লাসি হবে। আগের সূচীর বেশি কিছু পাওয়া গেলে তার মাইনে থেকে কাটা যাবে। কিছু লুকিয়ে ধরা পড়লে তাকে বন্দী করে শাস্তি দেয়া হবে।

কর আদায় ও কৃষি (পৃঃ ৪১৮)

নতুন কৃষককে বীজ এবং হাল-বলদের জন্য ঋণ দেয়া হবে যা দুই বা চার বার্ষিক কিস্তিতে আদায় করা হবে।


জমির মাপ নিয়ে খাজনা নির্ধারণ হবে এবং সেই খাজনা ফসল ওঠার সময় আদায় হবে।


শিবাজী সরকার এবং কৃষকদের মধ্যে মধ্যসত্ত্বভোগী সমাপ্ত করে দিলেন। কোন জমিদার, দেশমুখ বা দেশাইয়ের চাষিদের উপর হুকুম চালানোর রাজনৈতিক অধিকার থাকবে না।

শিবাজীর ধার্মিক নীতি (পৃঃ ৪২১)

“ Shivaji’s religious policy was very liberal. He respected the holy places of all creeds in his raids and made endowments for Hindu temples and Muslim Saint’s tombs and mosques alike. He not only granted pensions to Brahmin scholars versed in the Vedas, astronomers and anchorites but also built hermitages and provided subsistence at his own cost for the holy men of Islam, notably Baba Yaqut of Kelshi”.

শিবাজীর আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন স্বামী রামদাস। কিন্তু তিনি তাঁর আধ্যাত্মিক গুরু ছিলেন, রাজনৈতিক গুরু নয়। তিনি শিবাজীর হিন্দুধর্ম রাজ্য স্থাপনের প্রেরণা ছিলেন বলে যে জনশ্রুতি আছে তার পক্ষে কোন স্পষ্ট সন্দেহাতীত প্রমাণ নেই। (পৃঃ ৪২২)।

রবীন্দ্রনাথের “বসিয়া প্রভাতকালে সেতারার দুর্গভালে—“ কবিতাটি পরবর্তী কালের জনশ্রুতি নির্ভর, কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।


শিবাজীর শাসনের নীতিগুলো বাস্তবে কতখানি মানা হত?

শিবাজী সর্বত্রগামী এবং সবজায়গায় একই সঙ্গে উপস্থিত হতে পারেন না। কাজেই তাঁর সৈন্যরা অনেক সময় লুট করে আনা সম্পদ সরকারে হিসেবমত জমা দিত না। মারাঠা ফৌজ চলে গেলে ছুটকো লুঠেরা আসত। “পিণ্ডারী”দের অত্যাচার এইরকম মারাঠা ফৌজের ‘লজিক্যাল করোলারি’। (পৃঃ ৪২৩)।

শিবাজী তাঁর সৈন্যদের নিয়মিত লুটপাটের অভ্যেসকে সুরাতের গভর্নরের কাছে এভাবে ‘উচিত’ ঠাউরেছিলেনঃ

“তোমাদের মুঘল সম্রাট আমাদের বাধ্য করেছেন নিজের এলাকায় আত্মরক্ষার জন্য সৈন্যবাহিনী রাখতে। তাহলে তাদের জন্য নাগরিকেরা কর দেবে না”?

আচার্য যদুনাথের ভাষায় “Such a plea must have been true at the beginning of his career, and in relation to Mughal territories only, but cannot explain his raids into Bijapur and Golkonda, Canara and Tanjore. It fails altogether as a defence of the foreign policies of the Peshwas”. P. 423

শিবাজীর সময়ে মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে ইংরেজ ব্যাবসায়ী, হিন্দু বানিয়া, ভারতীয় মুসলিম, আরব বণিক এবং পার্শী বণিকদের ওয়াইসাতি কেল্লায় বন্দী করে যন্ত্রণা দেয়া হত এবং পেটানো হত। (পৃঃ ৩৮৫)।

শিবাজীকে নিয়ে যদুনাথের উপলব্ধিঃ

১ রাজা হওয়ার অভিষেকের পর মাত্র ছ’বছর জীবিত ছিলেন। এর মধ্যেই নিজের অধীন অঞ্চলে প্রজাদের শান্তি ও সুরক্ষা দিতে পেরেছিলেন যা সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য।

২ নারীর সম্মান। সবচেয়ে সুন্দরী বন্দীকেও মাতৃ সম্বোধন করতেন। যুদ্ধে বন্দী সাবিত্রী বাঈয়ের অসম্মান করায় নিজের এক সেনাপতির দুই চোখ উপড়ে নিয়েছিলেন।

৩ তাঁর বাহিনীতে অনেক মুসলমান সেনানায়ক ছিল। নিজের ফৌজকে কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন কোন মুসলিম ধর্মগুরুর আশ্রম লুন্ঠিত না হয়। যুদ্ধে কোন কোরান পাওয়া গেলে সেগুলো সসম্মানে মুসলমানদের ফেরত দেয়া হত । পৃঃ ৮১

জন্মেছিলেন হয়ে একজন ছোটখাট জাগিরদারের ছেলে, কিন্তু হলেন বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তি ও সামর্থ্যের মোকাবিলায় অদম্য। ঔরঙ্গজেব হতাশ! কী করে একের পর এক সেনাপতিরা ব্যর্থ হচ্ছেন।ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে তাঁর দরবার ও পরিবার ছিল হিন্দুদের ঘুরে দাঁড়ানোর কেন্দ্র।(!)

শিবাজীর শাসনপদ্ধতি কতটুকু অভিনব?

যদুনাথ বলছেন---শিবাজীর রাষ্ট্রনীতি এবং প্রশাসন পদ্ধতি খুব একটা অভিনব কিছু নয়। পৃঃ ৪২৭

মনুস্মৃতি অনুসারে রাজার উচিত শরতকাল এলে প্রতিবেশি রাজ্য দখল করতে রাজ্যবিস্তারে বেরিয়ে পরা। হিন্দুরাজাদের শরত কালে রাজ্যের সীমানা বাড়াতে যুদ্ধ করা রেওয়াজ ছিল।

পরবর্তী কালে উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতের মুসলিম শাসকদেরও অনুরূপ আচরণ করতে দেখা গেছে। কিন্তু এই রাজ্যবিস্তারকে ওরা ওদের ধর্মীয় অনুশাসনের নামে উচিত ঠাওরাতো।

কুরানের নীতি অনুযায়ী কোন মুসলিম দেশ এবং বিধর্মী প্রতিবেশি দেশের মধ্যে শান্তি বজায় রাখা তখনই সম্ভব যখন ওরা ইসলাম গ্রহণ করে। কেবল তখনই ওরা মুসলিম সাম্রাজ্যের আশ্রয়ে শান্তিতে বাস করবে।

শিবাজীর পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে একজন কুরান মেনে চলা রাজার নীতির এত বেশি মিল যে শিবাজীর সভাসদ কৃষ্ণাজী অনন্তের লেখা শিবাজীর জীবনী এবং বিজাপুর সাম্রাজ্যের ফার্সিতে লেখা সরকারি ইতিহাস –দুটোতেই প্রতিবেশী রাজ্যে নিয়মিত হামলা করা্র রাজনৈতিক আদর্শের জন্যে একটাই শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে—‘মুল্ক-গিরি’!

কিন্তু একটা স্পষ্ট তফাত আছে, অন্ততঃ তত্ত্বগত ভাবে।

একজন গোঁড়া মুসলিম রাজা তাঁর বিজয় যাত্রার পথে যত মুসলিম রাজ্য পড়বে তাদের ছাড় দেবেন। অন্ততঃ স্বধর্মীর রক্তে মাটি ভেজাবেন না।

কিন্তু শিবাজী এবং তাঁর পরবর্তী পেশোয়ারা কেউই পড়শি হিন্দু বা মুসলমান রাজ্যকে কোন ছাড় দেন নি। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশিষে লুঠ করেছেন। এবং ধনী হিন্দুদেরও মুসলিম ধনীদের মতই নির্মম ভাবে নিংড়ে নিয়েছেন।

আরেকটা ব্যাপার ছিল।

মুসলিম রাজারা পড়শি রাজ্য দখল করে ধর্ম পরিবর্তন করার পর সেটা তাদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যেত। এবং নাগরিকেরা প্রাথমিক রক্তক্ষয়ের পর বাকি অংশের মতই শান্তি পেত।

কিন্তু শিবাজীর মারাঠা ফৌজের লক্ষ্য রাজ্যবিস্তার নয়, শুধু নিয়মিত লুঠ। তাঁর দরবারের অমাত্যদের দ্বারা লিখিত ইতিহাস—সভাসদ বাখার ২৯নং-অনুযায়ী শিবাজীর নিজের কথায় “ The Maratha forces should feed themselves at the expense of foreign countries for eight months every year, and levy blackmail—” ( পৃঃ ৪২৮)

শিবাজীর সময়ে মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে ইংরেজ ব্যবসায়ী, হিন্দু বানিয়া, ভারতীয় মুসলিম, আরব বণিক এবং পার্শী বণিকদের ওয়াইসাতি কেল্লায় বন্দী করে যন্ত্রণা দেয়া হত এবং পেটানো হত। (পৃঃ ৩৮৫)।


আচার্য যদুনাথের মূল্যাংকনঃ

“ Thus, Shivaji’s power was exactly similar in origin and theory to the power of the Muslim states in India and elsewhere, and he only differed from them in the use of that power. Universal toleration and equal justice and protection were the distinctive features of the permanently occupied portion of the Swaraj, as we have shown elsewhere” (p. 429).

শিবাজীর উদার ধার্মিক মনোভাবের প্রমাণ হিসেবে জিজিয়া কর চাপানো নিয়ে ঔরংজেবকে লেখা দীর্ঘ চিঠির কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হল। মূল ফার্সি থেকে ইংরেজি অনুবাদ করেছেন যদুনাথ সরকার।

“ মহামহিম বিবেচনা করে দেখুন, সাম্রাজ্যের ভিত গেড়েছেন জালালুদ্দিন আকবর পাদশাহ। তিনি ৫২ চান্দ্র বছর পর্য্যন্ত পূর্ণ বিক্রমে রাজত্ব করে গেছেন। উনি সমস্ত ধার্মিক সম্প্রদায়ের জন্যে——সর্বধর্মসমন্বয়ের প্রশংসনীয় নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর উদার-হৃদয়ের লক্ষ্য ছিল সমস্ত মানুষের আদর এবং সুরক্ষা। তাই তিনি “জগতগুরু” নামে (বিশ্বের আধ্যাত্মিক গুরু) প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন।

“তারপর সম্রাট জাহাঙ্গীর ২২ বছর---- এবং সম্রাট শাহজাহান ৩২ বছর---- বিশ্ববাসীর মাথার উপরে ছাতা ধরেছিলেন। তাঁদের শাসনকালে অনেক রাজ্য বশ্যতা স্বীকার করে। এখানে জাঁহাপনা আপনি তাঁদের ঠিকমত অনুসরণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

“তাঁদেরও জিজিয়া কর বসানোর ক্ষমতা ছিল, কিন্তু তাঁরা ধার্মিক গোঁড়ামিকে হৃদয়ে স্থান দেননি। কারণ তাঁরা ঈশ্বরের সৃষ্ট সমস্ত মানুষকে , ছোট বা বড়, বৈচিত্র্যময় ধর্মমত এবং রুচির উদাহরণ হিসেবে দেখতেন। (পৃঃ ৩৬৮)

“কিন্তু আপনার রাজত্বে অনেকগুলো দুর্গ আপনার হাতছাড়া হয়েছে, আরও হবে। কারণ। বাকিগুলো বিধ্বস্ত না করে আমি থামবো না। আপনার কৃষকেরা দারিদ্র্যের শিকার। খাজনা আগের তুলনায় এক-দশমাংশ আদায় হচ্ছে। আপনার রাজত্বে বণিকেরা নালিশ করছে। মুসলিমরা কাঁদছে, হিন্দুরা অত্যাচারিত। অধিকাংশ মানুষ রাত্রে রুটি খেতে পায় না, সকালে উঠে নিজের গালে চড় মারে। এর উপর আপনি জিজিয়া কর চাপিয়ে দিলেন কী ভেবে?

(পৃঃ ৩৬৯)

“আপনি কি সত্যিই কুরানে আস্থা রাখেন? তাহলে বই খুলে দেখুন –ওখানে সব মানুষের ঈশ্বরের কথা বলা হয়েহে, খালি মুসলমানের ঈশ্বরের নয়।মসজিদের আজান এবং মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি—সব একই ঈশ্বরের উদ্দেশে ধ্বনিত হয়। তাই কোন এক ধর্মের আচরণকে একমাত্র ভেবে গোঁড়ামি করা মানে পবিত্র কিতাবকে অগ্রাহ্য করা। (পৃঃ ৩৭০)

আর জিজিয়া কর রাজনৈতিক চোখে দেখলে অন্যায় এবং ভারতে নতুন আবিষ্কার। যদি মনে করেন ধর্মের খাতির প্রজাদের উৎপীড়ন করা এবং হিন্দুদের ভয় দেখানো সঠিক নীতি তাহলে বলব, আগে রাণা রাজসিংহের থেকে জিজিয়া আদায় করুন। উনিই তো হিন্দুদের প্রধান!

তারপর দেখবেন, আমিও জিজিয়া দেব’খন”।

শেষ পাতেঃ

দেখা যাচ্ছে আচার্য যদুনাথের সাক্ষ্য অনুযায়ী শিবাজীর সময়েই একজন “বিশ্বগুরু” হয়েছিলেন। মোগল সম্রাট আকবর! আর ওই খেতাবটি দিয়েছিলেন হিন্দুকুলতিলক শিবাজী স্বয়ং!

শিবাজীর জীবনের শেষভাগ

বেলগাঁও জেলার ছোট্ট একটি গ্রাম বেলওয়াড়ির মালিক ছিলেন বিধবা সাবিত্রী বাঈ। তিনি শিবাজীর সেনার রসদবাহী গাড়ি লুট করেন। অবিলম্বে তাঁর ছোট মাটির দুর্গটি ঘিরে ফেলা হয়। কিন্তু তিনি বীরত্বের সঙ্গে ২৭ দিন লড়াই করে বন্দী হন। এই ঘটনায় শিবাজীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয় বলে আচার্য যদুনাথের ধারণা। (পৃঃ ৩৫৪)

শিবাজীর এক নায়ক সাখুজী গায়কোয়াড় সাবিত্রী বাঈয়ের মর্যাদাহানি করেন। জানতে পেরে শিবাজী সাখুজীর দুটো চোখ উপড়ে নেন এবং তাকে মানাউলি গ্রামে বন্দী করে রাখেন।(ঐ)

মধ্য ও পূর্ব কর্ণাটকের অনেকখানি শিবাজী দখল করেছিলেন।

শিবনের দুর্গ দখল করতে আসা শিবাজীর একটি সৈন্যদলকে কিলাদার আবদুল আজিজ খান পর্যুদস্ত করে বন্দীদের ফেরত পাঠিয়ে সংগে একটি মেসেজ পাঠান—যদ্দিন আমি এই দুর্গের কিলাদার, ততদিন তুমি শিবনের দুর্গ দখল করতে পারবে না।

শিবাজীর দাক্ষিণাত্য অভিযানের খরচ বহন করেছিলেন কুতুব শাহ, একদল সৈন্য এবং গোলন্দাজ বাহিনীও পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু লুঠের ভাগ বা কোন দুর্গ তিনি পেলেন না। টাকাও ফেরত নয়। সন্ধি ভেঙে গেল। (পৃঃ ৩৬০)

And now the Maratha plot to capture Bijapur by treachery destroyed the last trace of patience in the Golkonda king. (ibid).

কিন্তু নতুন বিজাপুরী শাসক সিদ্ধি মাসুদ শিবাজীকে পত্র লিখে বললেন—আমরা প্রতিবেশি। আমরা দুজনেই এই অঞ্চলের কল্যাণ চাই। তাই মুঘলদের বিরুদ্ধে আমাদের এক হতে হবে। (পৃঃ ৩৬১)

দেখা যাচ্ছে শিবাজীর মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম আদৌ হিন্দু বনাম মুসলমানের সাদা-কালো লড়াই নয়। অনেক বাঁকবদল এবং কূটনৈতিক সমঝোতার সাক্ষ্য ইতিহাসে রয়েছে। শিবাজীর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসীন বড়ছেলে শম্ভাজীর আচার-আচরণ থেকে ব্যাপারটি আরও স্পষ্ট হবে।

শম্ভাজীকে নিয়ে আচার্য যদুনাথের মন্তব্য

“শিবাজীর জ্যেষ্ঠপুত্র শম্ভাজী হলেন তাঁর প্রৌঢ় বয়সের অভিশাপ। উনিশ বছরের যুবকটি হিংস্র, লোভী, অস্থিরমতি, নির্বুদ্ধি এবং তাঁর মধ্যে নৈতিকতার ছিঁটেফোঁটাও নেই। এক বিবাহিত ব্রাহ্মণ যুবতীর সঙ্গে বলাতকারের দোষে শিবাজী তাকে পানহালা দুর্গে আটকে রাখেন। কিন্তু সে তার পত্নী যেসুবাঈ এবং কয়েকজন সঙ্গীকে নিয়ে পালিয়ে গিয়ে দিলীর খাঁয়ের সঙ্গে যোগ দেয়” । শিবাজী তাকে ধরতে সৈন্য পাঠাচ্ছিলেন কিন্তু দেরি হয়ে গেছল। শম্ভাজী তার পিতার বিরুদ্ধে মোঘল সেনাপতির সঙ্গে যোগ দিতে চায় এই মর্মে দিলীর খাঁকে পত্র পাঠিয়েছিলেন। তখন আহ্লাদে আটখানা দিলীর নিজে কিছু সৈন্য নিয়ে শম্ভাজীকে সুরক্ষা দিয়ে নিজের কেল্লায় নিয়ে আসেন। ( পৃঃ ৩৬২)

দিলীর চিঠি লিখে সম্রাটকে এই সংবাদ জানিয়ে দিলে শম্ভাজীকে সাতহাজারী মনসবদার করা হয় এবং একটি হাতি উপঢৌকন দেয়া হয় (নভেম্বর, ১৬৭৮)। তারপর দিলীর খাঁ এবং শম্ভাজী বিজাপুর আক্রমণের তোড়জোড় করেন।

সিদ্দি মাসুদ শিবাজীর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলে যে ফৌজ আসে তাদের লক্ষ্য স্পষ্টতঃ সাহায্যের বদলে বিজাপুর কব্জা করা। মাসুদ ফৌজকে দুর্গের বাইরে থাকতে বললে সন্ধি ভেঙে যায় এবং শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা ফৌজ বিজাপুরের আসেপাশে লুটতরাজ শুরু করে এবং ধনী বানিয়াদের বন্ধক বানিয়ে মুক্তিপণ চায়।

ইতিমধ্যে দিলীর খানের ফৌজ আক্রমণ করলে মারাঠা ফৌজ সরে পড়ে। মারাঠাদের বিরুদ্ধে বিজাপুরের সেনাপতির নাম ভেঙ্কটাদ্রি মুরারী! (৩৬৪)

এপ্রিল ১৬৭৯ নাগাদ দিলীর খানের ফৌজ শম্ভাজীর সহায়তায় ভুপালগড় অধিকার করে। সেখানে শিবাজী বহুবছর ধরে তাঁর সম্পদ এবং ধনরত্ন সঞ্চিত করে রেখেছিলেন। দিলীর খান লুটতরাজের পর ভুপালগড়ের কেল্লা ধ্বংস করে।

কিন্তু দিলীর খানের বিজাপুর অভিযান ব্যর্থ হয়। সিদ্দি মাসুদের সঙ্গে সন্ধি না হওয়ায় দিলীর খাঁ এবং শম্ভাজীর সম্মিলিত ফৌজ ১৪ নভেম্বর, ১৬৭৯ তারিখে শিবাজীর মিরাজ-পানহালা দুর্গ আক্রমণের অভিলাষে এগিয়ে যান। শম্ভাজী গর্ব করে বলছিলেন—যে উনি সহজেই তাঁর নিজস্ব মারাঠা অনুগামীদের নিয়ে পানহালা দুর্গ অধিকার করতে পারবেন। তাতে মুঘল সাম্রাজ্যের এই এলাকায় বিস্তার সহজ হবে, আর মিরাজের ছোট ছোট সেনানায়কদের এক মোগল এজেন্ট ইতিমধ্যেই কিনে নিয়েছে।(পৃঃ ৩৭৩)

কিন্তু এই বাহিনী প্রথমে বিজাপুর সংলগ্ন এলাকায়, যেমন বাহমনহালি, মাখনপুর আর জলগেরি দখলের সময় নৃশংস অত্যাচার এবং লুটপাট ও ধংসলীলা চালিয়ে গেল। তারপর টিকোটা নামক সমৃদ্ধ জনপদে পৌঁছে গেল যেখানে ধনী বণিকেরা সপরিবারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যখন ইখলাস খানের অগ্রণী বাহিনী ওখানে পৌঁছে গেল তখন হিন্দু তথা মুসলিম পরিবারের মেয়েরা তাদের বাচ্চাকে নিয়ে নিজেদের আঙিনার কুয়োর মধ্যে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করল। সম্পূর্ণ গ্রাম বিধ্বস্ত হল। হিন্দু এবং মুসলিম মিলিয়ে প্রায় ৩০০০ পুরুষকে বন্দী করে দাস বাজারে বিক্রি করে দেয়া হল।

এরপর বন্দীসমেত বাহিনী এগিয়ে চলল বিজাপুরের দিকে। আথনী জনপদ বিধ্বস্ত করে তার বাজার পুড়িয়ে দেয়া হল। এখানে সব নিবাসীরা হিন্দু। দিলীর ওদের বন্দী করে বিক্রি করে দিতে চাইলেন। তখন মোঘল এবং মারাঠাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দিল।

শম্ভাজীর আপত্তি শোনা হল না। উনি দিলীর খাঁর বিষয়ে ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হচ্ছিলেন। ২১ নভেম্বর আথনী ছেড়ে আইনাপুরের দিকে যাবার সময় দিলীর খবর পেলেন শম্ভাজী পালিয়ে বিজাপুরের দিকে চলে যাচ্ছেন।

নভেম্বর ১৬৭৮ নাগাদ শম্ভাজী মোঘল বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন। তখন থেকেই শিবাজীর চরেরা তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করছিল এবং গোপনে নানাভাবে বোঝাচ্ছিল যে উনি কাজটা ঠিক করেন নি। মারাঠা দলে (শিবাজীর সঙ্গে) ফিরে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত।

এমনকি, ওঁর শ্যালক মহাদাজী নিম্বলকর, তখনও মুঘল বাহিনীর দলে, শম্ভাজীকে তিরষ্কার করেছিলেন। কিন্তু শম্ভাজী এমন যে সেটা দিলীর খাঁকে জানিয়ে দিলেন। ফলে নিম্বলকরকে শাস্তিস্বরূপ ক’দিন বন্দী হয়ে থাকতে হয়।

শম্ভাজী ২০ নভেম্বর ১৬৭৯ নাগাদ তাঁর স্ত্রী এবং দশজন অনুচরকে নিয়ে গোপনে বিজাপুর রওনা দিয়ে সেখানের দুর্গের অধিপতি সিদ্দি মাসুদের আশ্রয় গ্রহণ করেন। দিলীর জানতে পেরে ২৮ নভেম্বর একজন দূত পাঠান যাতে মাসুদ প্রচূর উপঢৌকন নিয়ে শম্ভাজীকে দিলীরের হাতে তুলে দেয়। শম্ভাজী ভেতর থেকে টের পেয়ে ওখান থেকে পালিয়ে শিবাজীর শরণে এসে পানহালা দুর্গে আশ্রয় নিলেন। (পৃঃ ৩৭৫)

এইভাবে শম্ভাজীর পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ এবং মুঘল বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার এক বছর ব্যাপী অধ্যায় শেষ হল। *সভাসদ ৯৩ (শিবাজীর পার্ষদদের রেকর্ড) অনুসারে শম্ভাজীকে ভেতর থেকে খবর দিয়ে পালাতে সাহায্য করেছিলেন দিলীর স্বয়ং। যদুনাথ বলছেন—এটা একটু অবিশ্বাস্য।

মনে হয়, উনি ঠিক বলেছেন। বিজাপুর কেল্লার ভেতর থেকেই শম্ভাজী খবর পেয়েছিলেন। কিলাদার সিদ্দি মাসুদ শিবাজীর অনুরক্ত এবং দিলীর খাঁর দুশমন ছিলেন।

নভেম্বর ১৯৭৯ এর গোড়ায় শিবাজীর ফৌজ দিলীর খাঁয়ের হাতে দু’বার পর্যুদস্ত হয়। শিবাজী তখন পানহালা দুর্গ রক্ষার জন্য অন্য অনেক দুর্গ থেকে সৈন্য এবং কামান পানহালায় নিয়ে আসেন। মারাঠা সৈন্যের মধ্যে সংশয় ছিল, কারণ শিবাজীর পুত্র শম্ভাজী মুঘল বাহিনীর শিবিরে।

২ ডিসেম্বর ১৬৭৯ শম্ভাজী পানহালা দুর্গে শিবাজীর সঙ্গে মিলিত হলে উনি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। বিশাল মারাঠা বাহিনী খান্দেশ, বেরার এবং বালাঘাট অঞ্চলে দাপিয়ে বেড়াল ও বণিকদের লুঠে নিল। তারপর ৬ ডিসেম্বর ১৬৭৯ ঔরঙ্গাবাদের কাছে জালনায় পৌঁছল।

সেখানে একজন বিখ্যাত সুফী সন্ত ছিলেন—সৈয়দ জান মহম্মদ। শিবাজী কোন ধর্মের সন্তদের আশ্রমে হামলা পছন্দ করতেন না। তাই জালনা জনপদের অধিকাংশ ধনী পরিবার ওনার আশ্রম ও বাগানবাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু মারাঠা ফৌজের অগ্রণী বাহিনীটি ওনার আশ্রমে হামলা করে, ওনার অনুরোধ উপেক্ষা করে অন্যদের সঙ্গে ওনাকেও আহত করে।

জনশ্রুতি—ওনার অভিশাপের ফলেই শিবাজী এই ঘটনার পাঁচ মাসের মধ্যে মারা যান।তার আগে অনেক ক্ষয়ক্ষতি সয়ে শিবাজী মুঘলদের বেড়াজাল কেটে পানহালা দুর্গে এসে ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে বড় ছেলে শম্ভাজীর সঙ্গে মিলিত হলেন।

শিবাজীর শেষ জীবন

শিবাজীর বয়েস হয়েছে। শরীর ভাল নয়। বিদ্রোহী বড় ছেলে মাত্র পিতার কাছে ফিরে এসেছে বটে, কিন্তু তাকে কতখানি ভরসা করা যায়? সে কি মারাঠা সাম্রজ্যের যোগ্য উত্তরাধিকারী ?

আচার্য যদুনাথের ভাষায়ঃ

“The character of his eldest son filled Shiva with gloomiest anticipations about the future. A profligate, capricious and cruel youth, devoid of every spark of honour patriotism and religious fervour, could not be left sole master of Maharashtra”.

“But a born judge of character like Shivaji soon perceived that his sermons were falling on deaf years”. (p. 381)

এদিকে শিবাজীর হারেমে ষড়যন্ত্রের বিষ। শিবাজী একটা ভুল করেছিলেন। আগের তিন পত্নী এবং দুই পুত্রসন্তান থাকা সত্ত্বেও ৪৭ বছর বয়সে আরও তিন অল্প বয়েসি কন্যাকে বিয়ে করলেন। শম্ভাজীর মা গত হয়েছেন। রাজারামের মা সয়া বাঈ স্বামীর মন পাওয়ার জন্যে নানারকম টোটকার প্রয়োগ শুরু করলেন।

অবশেষে জ্বর এবং আমাশায় বারোদিন ভুগে শিবাজী ৫ এপ্রিল, ১৬৮০ সালে প্রাণত্যাগ করলেন। বয়েস ৫৩ পুরো হয় নি। মৃত্যুর একটা সম্ভাব্য কারণ (মুসলিম সন্তের অভিশাপের কথা একটি মত) সয়াবাঈ নাকি বিষ দিয়েছিলেন যাতে শম্ভাজী নয়, রাজারাম সিংহাসনে বসেন।

শম্ভাজী ক্ষমতা লাভের পর সয়াবাঈকে উপরোক্ত অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেন। আচার্য যদুনাথের মতে ওটা অজুহাত, পথের কাঁটা সরানো আসল উদ্দেশ্য। (পৃঃ ৩৮৩)।


শিবাজী তাঁর অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে সুরাত ধ্বস্ত করেছিলেন ১৬৬৪ সালে। তখন ঔরংজেবের নির্দেশে কিলার মাটির দেয়াল ভেঙে ইঁটের গাঁথনি দেয়া হয়। কিন্তু ১৬৭০ সালে শিবাজী ফের সুরাতকে লুঠে নেন।

কার্তোজি গুজর বা প্রতাপ রাও (উপাধি) তাঁর ফরমানে ওই দুটো আক্রমণের উল্লেখ করেছেন।

তারপর শিবাজীর সেনাপতি প্রতাপ রাও গুজর ১৬৭২-৭৩ সালে এইরকম ফরমান জারি করলেনঃ

শোন শোন হে যত কানুনগো, বণিক, মহাজন, ইংরেজ, ফরাসী এবং ওলন্দাজ কুঠিয়াল ও সমস্ত সুরাতবাসী!

গত এক বছরে সুরাত বন্দরে যত পণ্য কেনাবেচা হয়েছে তার সঠিক হিসাব দাও। শিবাজী মহারাজ ওই বিক্রিবাট্টার জন্য দেয় শুল্কের এক-চতুর্থাংশ ‘চৌথ’ ধার্য করেছেন যা তাঁর বীর সেনাবাহিনীর জন্যে দিতে হবে। আদায়ের দায়িত্ব উনি আমাকে দিয়েছেন। ওনার সেই আদেশ অনুসারে আমি এই লিখিত নির্দেশ জারী করছি যে ভাল চাও তো আমার পাঠানো গোমস্তাদের হাতে তোমরা ঠিকমত হিসেব বুঝিয়ে দাও, এতে রাজ্যেরই মঙ্গল।

নইলে আমার ফৌজ তোমাদের ঘরবাড়ি ধুলিসাৎ করে দেবে। জনপদের কোন চিহ্ন থাকবে না। আমাদের ক্রোধের থেকে একটা লোকও রক্ষা পাবে না।

যদি ভাব সম্রাটের সাহায্য নিয়ে রেহাই পাবে তাহলে মস্ত ভুল করবে। এর আগে আমরা দু’দুবার হামলা করেছি। তাতে উনি কী করলেন? পৃঃ ১৫৭-৫৮

প্রতাপ রাওয়ের চিঠির উত্তরে সুরাতের কুঠিয়ালদের বক্তব্যঃ

শোন হে অল্পবুদ্ধি প্রতাপ রাও এবং তার মারাঠি ব্রাহ্মণের দল তথা বর্গিবাহিনী!

চিঠিটা মাত্র কদিন আগে আমাদের হাতে এসেছে।

ওহে পাজি অত্যাচারী!

আমাদের সম্রাটের অনুগত রাজা জয় সিং সহজেই তোমাদের শিবার গলায় দড়ি দিয়ে আগ্রায় সম্রাটের পদচুম্বন করিয়েছে। এমনকি বিজাপুর ও এবং হায়দ্রাবাদের শাসকেরা—শাহজী যাদের দরবারে সামান্য সেবক ছিলেন—সম্রাটের কাছে মাথা নুইয়ে বছরের পর বছর নিয়মিত কর দিয়ে নিজেদের মানসম্মান রক্ষা করে চলেছেন।

তুমি আমাদের সম্রাটের প্রতাপের কতটুকু জান? এই অপমানজনক উক্তির জন্যে তোমার জিভ কেটে ফেলা হবে। সুরাত এখন আর গর্তে লুকনো ইঁদুরদের স্থান নয়। এখানে এখন সিংহ বিচরণ করে। শাহজাদা আসছেন সত্তর হাজারের বিরাট ফৌজ নিয়ে। লুকিয়ে পড়, নইলে শকুন ও চিলের খাদ্য হবে। পৃঃ ১৬০

এর উত্তরে ১৬৭২ সালে প্রতাপ রাও ইখলাস খানের নেতৃত্বে আসা মোগল ফৌজকে কচুকাটা করেন এবং ইখলাস খানকে বন্দী করেন। কিন্তু বিজাপুরী ফৌজের সঙ্গে এক দুঃসাহসিক হামলায় জড়িয়ে প্রতাপ রাও জানুয়ারি ১৬৭৪ সালে নিহত হন। পৃঃ ১৬১

১৬৮০ সালে শিবাজীর মৃত্যু হলে শম্ভাজী ক্ষমতায় এসে শিবাজীর সঞ্চিত ধনরত্ন এবং অন্য সম্পদের পরীক্ষা করে একটি সুচী তৈরি করেন। পৃঃ ১৬৭

তাতে অস্ত্রশস্ত্র, ফসলের ভান্ডার, অলংকার, পশুধন এবং পুরুষ (১০০০) ও নারী(৬০০) দাস দাসী সব নথিবদ্ধ হয়েছে। পৃঃ ১৭২

১৬৮১ সালে ঔরংজেবের চতুর্থ সন্তান মহম্মদ আকবর রাজপুতানার কিছু অংশ দখলের চেষ্টায় বার বার পরাজিত হয়ে শেষে দুর্গাদাস রাঠোরের সঙ্গে সহমত হলেন যে মুঘল সাম্রাজ্য বাঁচানোর একমাত্র উপায় – ঔরংজেবের গোঁড়া হিন্দুবিরোধী হামলা বন্ধ করা এবং তার জন্যে তাঁকে পরাজিত করে দিল্লি দখল করা।

এই ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ায় উনি প্রাণ নিয়ে পালিয়ে দুর্গাদাস রাঠোর এবং মারাঠা রাজ্যের রাজা শম্ভাজীর শরণাপন্ন হলেন। বেশ কয়েক বছর শম্ভাজীর সঙ্গে থেকে সম্রাটের গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধে রইলেন। কিন্তু শেষে ব্যর্থ হয়ে পারস্যে নির্বাসিত জীবন যাপন করে ওখানেই মারা গেলেন। পৃঃ ১৭৯

১১ মে, ১৬৮১ তে শম্ভাজীকে লেখা চিঠিতে উনি প্রস্তাব দিলেন যে পিতা ঔরংজেবকে গদিচ্যুত করতে পারলে আকবর হবেন মুঘল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর এবং শম্ভাজী হবেন দাক্ষিণাত্যের রাজা। পৃঃ ১৮২

২০ মে ১৬৮১ তে দ্বিতীয় পত্র পাঠালেন। নভেম্বর ১৬৮২ সালে শম্ভাজী অম্বরের রাজা রাম সিংকে চিঠি লিখে বললেন হিন্দুবিরোধী দুষ্ট সম্রাটকে শেষ করতে হবে।

আসুন আমরা এক হই! ও হিন্দুদের ভেবেছেটা কী!

আপনার পিতা রাজা জয় সিং ঔরংজেবকে দিল্লির সিংহাসনে বসিয়েছিলেন। আপনিও শাহজাদা আকবরকে দিল্লির সিংহাসনে বসিয়ে খ্যাতিমান হোন। আমরা, দুর্গাদাস রাঠোর সবাই আপনার সঙ্গে আছি। তাই শাহজাদা আকবরকে কয়েকবছর ধরে আমার কাছে আশ্রয় দিয়েছি। পৃঃ ১৮৫, ৮৬, ৮৭।

শম্ভাজী এবং মোগল সাম্রাজ্য

শম্ভাজীর রাজত্ব ছিল নয় বছর (মে ১৬৮০—ফেব্রুয়ারি ১৬৮৯)।

মারাঠি তথ্যসূত্র বলতে একমাত্র চিটনিস বাখার—যা ১৮১০ সালে লেখা এবং একেবারেই নির্ভরযোগ্য নয়। পৃঃ ১৯৩

কিন্তু ইংরেজি, ফরাসি ও পর্তুগীজ দস্তাবেজএর সাহায্যে অনেকখানি ফাঁক ফোকর ভরাট করা সম্ভব হয়েছে। এর কারণ দুটো।

এক, এগুলো শম্ভাজীর সমসাময়িক। দুই, এগুলোতে স্থান কাল তারিখ নাম ইত্যাদি খুঁটিনাটি স্পষ্ট করে দেয়া, ফলে ক্রস চেক করতে সুবিধে। পৃঃ ১৯৩

ইংরেজ ডেসপ্যাচগুলো থেকেঃ

২৭ এপ্রিল ১৬৮০ শম্ভাজী শাসন ক্ষমতা নিয়ে নিজেকে রাজা ঘোষণা করেছেন। তাঁর পিতার সময়ের যত সুবেদার, হাবিলদার –সবাইকে ডেকে নিয়ে কাউকে কাউকে বন্দী করেছেন, কিছু লোককে বরখাস্ত করেছেন। বাকিরা আগের ভূমিকায়।

৩০ জুন, ১৬৮০ আন্নাজী পণ্ডিত শেকলে বাঁধা। মোরো পণ্ডিত এখনও ওনার বিশ্বাসভাজন।

অক্টোবর-নভেম্বর ১৬৮০। ব্রাহ্মণেরা শম্ভাজীকে শত্রু ঘোষণা করেছেন। শম্ভাজী জনার্দন পণ্ডিতের মত সম্মানীয় এবং রাজা শিবাজীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী জনার্দন পন্ডিতকে বন্দী করেছেন। আরও অনেক বড় বড় আধিকারিককে বন্দী করেছেন। জানুয়ারী ১০ , ১৬৮১ নাগাদ জিঞ্জিতে অশান্তি। রাজা শম্ভাজী কিলাদারকে আদেশ দিয়েছেন প্রদেশের রাজ্যপালকে বন্দী করতে।

পোঙ্গল উৎসবে যোগ দিতে জিঞ্জি এসে রাজ্যপাল সহজেই বন্দী হলেন। পৃঃ ১৯৮

৩০ অগাস্ট ১৬৮১

শম্ভাজী অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন। কিছু ব্রাহ্মণ যেমন আন্নাজী পন্ডিত, কেশো পণ্ডিত, প্রহ্লাদ পণ্ডিত ওনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র রচে ছিল। একটি মাছ রান্না করা পদে বিষ মেশানো ছিল। একজন বালক জানতে পেরে আগেভাগে সতর্ক করে দেয়। তিনি ওই খাবার খানিকটা একটি কুকুর এবং একজন ভৃত্যকে খেতে দেন। দুজনেই মারা যায়। ষড়যন্ত্রকারীরা বন্দী হয়। পৃঃ ২০০

১২ অক্টোবর, ১৬৮১ শম্ভাজী আটজন ষড়যন্ত্রকারীকে হাতির পায়ের তলায় পিষে মারার আদেশ দেন এবং বুরহান পুর গিয়ে আকবরের সঙ্গে মিলিত হয়ে দিল্লি অভিযানের প্রস্তুতি করতে থাকেন। শম্ভাজীর ইচ্ছেয় সৎভাই রাজারামের মা সয়া বাঈকে বিষ দিয়ে হত্যা করা হয়।

১৩ নভেম্বর ১৬৮১ শম্ভাজী বুরহানপুরে আকবরের সঙ্গে মিলিত হলেন। পৃঃ ২০২


ডিসেম্বর ১৬৮১ ফাদার মার্টিনের ডায়েরি থেকেঃ

রাজা শম্ভাজী ব্রাহ্মণদের হত্যা করার ধারা অব্যাহত রেখেছেন। ওঁর সন্দেহ ব্রাহ্মণেরা ওর নাবালক ভাইকে জেল থেকে বের করে এনে মারাঠা সাম্রাজ্যের ক্ষমতায় বসাতে চায় , এভাবে চোদ্দ জন ব্রাহ্মণকে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়েছে। দেখার বিষয়, যেদিন উনি বেশি সুরাপান করেন সেদিনই ব্রাহ্মণদের প্রতি তাঁর সঞ্চিত ঘৃণা বাইরে প্রকাশ পায়। আর উনি যাকে ইচ্ছে তার গর্দান নেবার আদেশ দেন। পৃঃ ২০২

শম্ভাজীর পতন শুরুঃ

নভেম্বর ১৬৮৩ শম্ভাজী যেভাবে তাঁর পিতার সময়ের সচিব ব্রাহ্মণদের সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্য্যবহার করছেন এটা ওনার পতন ডেকে আনবে। ব্রাহ্মণেরা ভোলে না আর ওরা হিন্দু রাজাদের পরামর্শদাতা হয়ে থাকতে অভ্যস্ত।

মে ১৬৮৫ ।

শম্ভুজী রাজার বাড়াবাড়ি, ক্রুরতা, তাঁর অনেক আধিকারিককে ষড়যন্ত্রে প্রেরিত করছে। অনেককে প্রাণদণ্ড দেয়া হয়েছে। দুজন দেশাই গোয়ায় পালিয়ে গেছে। রাজা চাইছেন ওদের আত্মসমর্পণ, কিন্তু ভাইসরয় রাজি নন। মনে হচ্ছে দুটো নেশনের মধ্যে (পর্তুগীজ মারাঠা?) যুদ্ধ ঘনিয়ে এল। পৃঃ ২০৩

শম্ভাজী রাজার হিংসা , ক্রুরতা, লাম্পট্য তাঁকে প্রজাদের মধ্যে অপ্রিয় করে তুলেছে।ফলে কিছু নেতৃস্থানীয় ব্রাহ্মণ তাঁকে হত্যা করানোর জন্য মোগল সাম্রাজ্যের সেনাপতিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গোপনে শম্ভাজীর অবস্থান সম্পর্কে খবর পাঠাচ্ছেন। নিজেরা হাত নোংরা করতে চান না। এবার তাঁরা শম্ভাজীকে পরিকল্পনা মাফিক শিকারে পাঠালেন। সেখানে শম্ভাজী চারদিকে মোঘল সৈন্যের ঘেরাবন্দীর ফাঁদে পড়লেন। সম্রাটের নির্দেশে তাঁর ছিন্নশির বেশ কয়েকটি জনপদে এবং নগরে সবার সামনে প্রদর্শিত হল। পৃঃ ২০৪

শম্ভাজী রাজার এলাকায় ব্যবসা করা মুশকিল। রাজা থেকে তাঁর মন্ত্রী এবং সাধারণ কর্মচারি –সবাই ঘুষ চায়। পৃঃ ২০৬


২ এপ্রিল ১৬৮৫।

থানা এবং চাউল থেকে যে তাঁতিরা আসত তারা আর আসছে না। এটা হয়েছে শম্ভাজী রাজা চাউল কেল্লা অবরোধ করার পর থেকে। সেখানে ৬০০ তাঁতি পরিবার ছিল। চারশ এখানে কোন ভবিষ্যত নেই মনে করে আগেই অন্যত্র চলে গেছল। যারা রইল তাদের মধ্যে ১৫০ পরিবার মৃত, রয়েছে বাকি ৫০। পৃঃ ২০৬

শম্ভাজী কীভাবে ধরা পড়লেন

ঔরংজেব মারাঠাদের থেকে পানহালা দুর্গ ছিনিয়ে নিতে বিজাপুর থেকে মুকারব খানকে পাঠালেন তিনি প্রথমে শম্ভাজীর খবরাখবর পেতে গুপ্তচর নিযুক্ত করলেন। বিশ্বস্ত সূত্রে খবর এল শম্ভাজী সিরকে পরিবারের (সৎমায়ের আত্মীয়) সঙ্গে সম্পত্তির ঝগড়া মেটাতে রায়গড় থেকে খেলনা দুর্গে গিয়েছিলেন। এখন কাজ সম্পুর্ণ করে সঙ্গমেশ্বর গিয়েছেন। সেখানে তাঁর বন্ধু এবং মন্ত্রী কবি কৈলাশ রম্য প্রাসাদ এবং প্রমোদ উদ্যান নির্মাণ করেছেন। রাজা ওখানে গিয়ে আমোদপ্রমোদে মেতে আছেন।

খান গুটিকয় বিশ্বস্ত সঙ্গী নিয়ে কোলহাপুর থেকে ৪৫ কোশ দূরের সঙ্গমেশ্বরের জন্য রওনা হলেন। তিনি সাধারণ পথ ছেড়ে দুর্গম রাস্তা ধরে এগোলেন।

রাজা শম্ভাজীর চর খবর নিয়ে এল—মোগলেরা এখানকার খবর পেয়েছে। ওরা আসছে, শীগগিরই হামলা করবে।

কিন্তু মদমত্ত রাজা চেঁচিয়ে উঠলেন—তোমরা কি পাগল হলে? কোন মোগল এখানে আসতে পারে না।

তারপর ইশারা করলেন ওদের গর্দান নিতে। পৃঃ ২০৮

হামলা হল। চার-পাঁচ হাজার বর্শাধারী মারাঠা ফৌজ প্রতিরোধ করল। কিন্তু কবি কৈলাশ তিরবিদ্ধ হতেই ওরা রণে ভঙ্গ দিল।

শম্ভাজী এবং কবি কৈলাশ তাঁর প্রাসাদের গোপন কক্ষে লুকিয়ে রইলেন। কিন্তু চরদের থেকে সঠিক খবর পেয়ে সেনাপতি মুকারব খানের পুত্র ইখলাশ খান প্রাসাদ ঘেরাও করে সার্চ করে ওদের দুজনকে পেয়ে চুল ধরে বাইরে টেনে আনলেন। শম্ভাজীর পঁচিশ জন সেনা নায়ক সপরিবারে বন্দী হলেন।

ঔরংজেব তখন আখলুজে শিবির লাগিয়েছেন। তাঁর নির্দেশে বন্দী শম্ভাজীকে হাতে পায়ে শেকল পরিয়ে সেখানে নিয়ে যাওয়া হল। কোন স্থানীয় জাগিরদার বা ক্ষত্রপ মাঝপথে হামলা করে শম্ভাজীকে ছিনিয়ে নিতে চেষ্টা করল না। পৃঃ ২০৯

১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৬৮৯ ঔরংজেবের বাহিনী বাহাদুরগড়ে পৌঁছলে বন্দী শম্ভাজীকে দরবারে পেশ করা হল।

ঔরংজেব আদেশ করলেন এই দুই জনকে (শম্ভাজী এবং কবি কৈলাশ) ভাঁড়ের পোশাক পরিয়ে এখান থেকে চার মাইল পর্যন্ত যত জনপদ রয়েছে সেখানে সর্বসাধারণের সামনে ঘুরিয়ে আনা হোক। এদের উটের পিঠে চড়িয়ে কাড়া নাকাড়া শিঙা বাজিয়ে এমন তামাশা করা হোক যাতে কাফিরেরা নিরাশ হয় এবং মুসলিমেরা উৎসাহিত হয়।

এইভাবে অপমানিত করে দরবারে পেশ করার পর সম্রাট আদেশ দিলেন যে একে শাস্তি দেয়ার জন্যে নিয়ে যাওয়া হোক।

শম্ভাজী দু’বার সম্রাটের সহৃদয়তাকে উপেক্ষা করে পালিয়ে গেছলেন। একবার পিতা শিবাজীর সঙ্গে, আর একবার দিলীর খাঁর আশ্রয় থেকে। তাই সেরাত্রেই তাঁর দুটো চোখ উপড়ে নেয়া হল। পরের দিন কবি কৈলাশের জিভ কেটে ফেলা হল। ১১ মার্চ ১৬৮৯ তারিখে শম্ভাজী এবং কবি কৈলাস –দুজনেরই বধ্যভূমিতে গর্দান গেল।

গুজরাতের পাটন নগরের নাগর ব্রাহ্মণ ঈশ্বরদাসের ফার্সিতে লেখা বই থেকেঃ

দু’দিন পরে সম্রাট রহুল্লা খানকে আদেশ দিলেন –যাও, শম্ভাজীকে জিজ্ঞেস কর—ওর সব ধনসম্পত্তি কোথায় লুকিয়ে রেখেছে। আর আমার ওমরাহদের মধ্যে কে কে ওর সঙ্গে গোপনে চিঠি চালাচালি করত?

শম্ভাজী বুঝতে পেরেছিলেন তাঁর অন্তিমকাল উপস্থিত। তিনি সম্রাটের বাপান্ত করে ছাড়লেন। খান ফিরে গিয়ে সাহস করে সবটা বলে নি। কিন্তু যতটুকু বলেছে তাই যথেষ্ট। সম্রাট বললেন ওর দু’চোখ গেলে দাও।

তাই করা হল।

সেদিন থেকে গর্বিত রাজা খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলেন। রক্ষীদের শত অনুরোধেও টললেন না। এভাবে কয়েকটা দিন কাটল।

সম্রাটের কাছে খবর পৌঁহল। তাঁর নির্দেশে বধ্যভূমিতে নিয়ে গিয়ে শম্ভাজীর শরীরের একেকটা অঙ্গ টুকরো করা হল তারপর ছিন্নশির ঔরঙ্গাবাদ থেকে বুরহানপুর পর্য্যন্ত জনসাধারণকে দেখানো হল। তারপর দিল্লি নিয়ে নগরের দ্বারে টাঙানো হল। পৃঃ ২১১

শেষপাতে

যদুনাথ সরকারের গবেষণায় বোম্বাইয়াদেখা যাচ্ছে দুটো দিক।

এক, বোম্বাইয়া সিনেমায় যাই দেখানো হোক, ঔরংজেব শিবাজী এবং শম্ভাজীকে ইসলাম কবুল করতে বলেন নি। নিজের সেনাপতি জয় সিং এবং যশবন্ত সিং বা মেবারের রাণা রাজ সিং—কাউকেই মুসলমান হতে চাপ দেয়া হয় নি। মোগল সম্রাট চাইছিলেন প্রশাসনিক আনুগত্য, বশ্যতা এবং সম্পদের ভাগ।

শম্ভাজীকে চাপ দেয়া হয় শিবাজীর রত্নভাণ্ডারের খোঁজ দেয়ার জন্যে।

দুই, শিবাজী প্রবলপ্রতাপ মোগল সাম্রাজ্যের গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধেছিলেন, দাক্ষিণাত্যের বড় অংশ, মহারাষ্ট্র, মাদ্রাজ ও মহীশূরের বেশ বড় অংশ দখল করে নিজের সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু সমগ্র ভারত জুড়ে এক হিন্দু ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা কখনই তাঁর পরিকল্পনায় ছিল না।

=============================================================================

0 comments:

0

প্রবন্ধ - সব্যসাচী রায়

Posted in




















২০ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে ২১শ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত ভারত ও বহুজাতিক কর্পোরেশন (এমএনসি)–এর সম্পর্ক মর্মান্তিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। প্রাথমিকত উপনিবেশিক প্রয়োজন দ্বারা পরিচালিত এবং পরবর্তীতে সার্বভৌম অর্থনৈতিক নীতির দ্বারা পরিচালিত, ভারতের বৈশ্বিক পুঁজির সঙ্গে সম্পৃক্ততা কখনো স্বাগত, কখনো সংরক্ষণবাদ, তারপর মুক্তিবাদ এবং সাম্প্রতিককালে সূক্ষ্ম সন্দেহের মধ্যে দোলাচ্ছল করেছে। এই প্রবন্ধে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে তুলনা এবং বৈপরীত্যের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করব—কীভাবে ভারতের এমএনসির প্রতি নীতি গঠিত হয়েছে, সহযোগিতা বা দ্বন্দ্বের কারণগুলি কী ছিল, এবং এর জাতীয় উন্নয়ন ও কর্পোরেট কৌশলের উপর প্রভাব কী কী।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: সাম্রাজ্যবাদী শুরু ও স্বাধীনতার পর সতর্কতা

ব্রিটিশ রাজের সময়ে ভারতের অর্থনীতি বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদের অংশ ছিল। প্রধানত ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় এমএনসিগুলো চাষ, রেল ও খনন শিল্প পরিচালনা করত। কর্পোরেট বিনিয়োগ ছিল বেশিরভাগই শোষণমূলক: লাভ বিদেশে স্থানান্তরিত হত, স্থানীয় অবকাঠামো বা দক্ষতা বিকাশে পুনরায় বিনিয়োগের তুলনায় অনেক বেশি লাভ উত্তোলন হত, যা এক অসম উন্নয়নের চিত্র রেখে গিয়েছিল।

১৯৪৭ সালের স্বাধীনতার পর ভারত মিশ্র-অর্থনীতির মডেল গ্রহণ করে। দেশটি আমদানিপূরণ শিল্পায়নের মাধ্যমে স্বনির্ভরতার পথে হাঁটায়। ১৯৫৬ সালের শিল্পনীতি প্রস্তাবে “কোর”, “জরুরি” ও “বেসরকারি” খাত নির্ধারণ করা হয়। কোর ও ভারী শিল্প রাষ্ট্রের দায়িত্বে রাখা হয়, বেসরকারি (বহুজাতিকসহ) বিনিয়োগ কঠোর নিয়ন্ত্রণের আওতায় আসে। লাইসেন্স, কোটা ও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এমএনসির প্রবেশ কঠিন করেছিল। ১৯৬০ এর দশকে ভারতের বৈদেশিক সরাসরি বিনিয়োগ (এফডিআই) মোট জিডিপির মাত্র ০.০৪% ছিল, যা বৈদেশিক পুঁজির উপর নির্ভরতা কমিয়ে দেশের আর্থিক সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার নীতি প্রতিফলিত করেছিল।

সংরক্ষণবাদ বনাম বাস্তববাদ

২০ শতাব্দীর সংরক্ষণবাদ:

লাইসেন্স রাজ: এমএনসিগুলোকে বহু দপ্তর থেকে অনুমতি নিতে হত; দীর্ঘবিচারের কারণ সময়সীমা লংঘিত হতো এবং প্রতি খাতে সর্বোচ্চ ২০% বৈদেশিক মালিকানা সীমা বড় বিনিয়োগকে বিঘ্নিত করেছিল।

ঘরোয়া উদ্যোগের প্রাধান্য: সরকারি ক্রয়নীতি ও প্রকল্পে ঘরোয়া প্রতিষ্ঠানের অগ্রাধিকার প্রযুক্তি স্থানান্তর ও বিশ্ব বাজারে সংযুক্তি বন্ধ করে দেয়।

ফলাফল: স্বনির্ভরতা হালকা ভারী শিল্প গড়ে তুললেও অদক্ষতা, কম উৎপাদনশীলতা ও প্রযুক্তিগত স্থবিরতা বাড়ায়।

উদারীকরণ (১৯৯১ থেকে) ও প্রারম্ভিক ২১শ শতাব্দীর বাস্তববাদ:

অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে ভারত লাইসেন্স রাজ ভেঙে ফেলে, এফডিআই সীমা শিথিল করে এবং টেলিকম, ব্যাংকিং, অটোমোবাইল খাত উন্মুক্ত করে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (এসইজেড) ও কর-ছাড় প্রণোদনা দিয়ে রপ্তানিমুখী এমএনসিদের আকৃষ্ট করা হয়—স্যামসাং, হোন্ডা, কোকা-কোলা–এর মতো প্রতিষ্ঠান বড় কারখানা স্থাপন করে। ফলাফলস্বরূপ প্রযুক্তি বিস্তৃতি, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ও পরিষেবা ও উৎপাদন খাতে কর্মসংস্থান দ্রুত বৃদ্ধি পায়; এফডিআই প্রবাহ ১৯৯০ সালে প্রায় ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০০৮ সালে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও ওপর গিয়ে পৌঁছায়।

তুলনামূলক বিশ্লেষণ: সহযোগিতা ও দ্বন্দ্বের চালক

সম্পৃক্ততার অনুপ্রেরণা:

২০ শতাব্দীতে ভারত রক্ষণশীল ছিল, ক্ষয়িষ্ণু দেশীয় শিল্পকে রক্ষায় এমএনসিদের প্রতিযোগিতা থেকে সংরক্ষণ করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল।

২১ শতাব্দীতে গুরুত্ব পড়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নে; ভারতে বিনিয়োগের মাধ্যমে খেলার গ্যাপ পূরণ ও উদ্ভাবন ত্বরান্বিত করা হয়েছে।

নিয়ন্ত্রক কাঠামো:

১৯৯১ পূর্ববর্তী কঠোর নিয়ন্ত্রণ: জটিল লাইসেন্স ও বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা এমএনসিদের উচ্চ প্রবেশব্যয় চাপিয়ে দেয়।

ক্রমাগত উদারীকরণ: উদারীকরণে বৈদেশিক মালিকানা সীমা (অনেক ক্ষেত্রে ১০০% স্বয়ংক্রিয় অনুমোদন) বাড়ানো, ই-ফার্ম পদ্ধতিতে প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও পক্ষপাতহীন বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়।

অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব:

২০ শতাব্দীতে: সীমিত এমএনসি উপস্থিতিতে প্রযুক্তি গ্রহণ ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে ধীরগতি ছিল; তথাপি ঘরোয়া স্টিল, ঔষধ ও অটোমোবাইল শিল্প গড়ে ওঠে।

২১ শতাব্দীতে: এমএনসি–গুলি পুঁজি, ব্যবস্থাপনার দক্ষতা ও বৈশ্বিক সরবরাহশৃঙ্খল যোগান নিয়ে আসে; তবে জমি অধিগ্রহণ, শ্রমনীতি ও ক্ষুদ্র উদ্যোগের স্থানচ্যুতি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়।

রাজনৈতিক ও জনমত:

রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদ: স্বাধীনতার পর ভারত এমএনসিদেরকে সন্দেহের চোখে দেখে, তাঁদের উপনিবেশিক শোষণের সাথে যুক্ত করে।

আধুনিক দ্বৈতমনা: একদিকে যারা এমএনসিদের প্রসারকে সাধুবাদ জানায়, অন্যদিকে কিছুজন লভ্যাংশ প্রত্যাগত, পরিবেশগত ক্ষতি ও সামাজিক অসমতা নিয়ে সমালোচনা করে।

সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উভয় পক্ষের কথাবার্তা উসকে দেওয়া হচ্ছে। এনজিও ও কর্মী সংগঠনগুলি এমএনসি প্রকল্পের বৃহৎ জমি অধিগ্রহণে স্থানীয় সম্প্রদায়ের উৎখাত এবং পরিবেশের অবনতি তুলে ধরে ভাইরাল প্রচার করে। বিপণন মণ্ডলী এবং গবেষণা সংস্থাগুলি বলছেন—এই সমালোচনা লক্ষ লক্ষ সরাসরি ও পরোক্ষ কর্মসংস্থান এবং অবকাঠামো, স্বাস্থ্যসেবা ও ডিজিটাল সংযোগে এমএনসিদের অবদানের কথা ভুলে যায়। এছাড়া নির্বাচনেও নানা রাজ্যের নীতি এই কর্পোরেট বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা হয়ে উঠেছে—বৃদ্ধি ও ন্যায়ের মধ্যে সূক্ষ্ম সমন্বয়কারী নীতি প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট।

একবিংশ শতকে সম্পর্কের পতন না পুনর্বিন্যাস?

সাম্প্রতিক মন্দা ও নীতিগত প্রতিক্রিয়া

নীতিগত অনিশ্চয়তা: ই-কমার্স, তথ্য সংরক্ষণ, ও ডিজিটাল ট্যাক্স সংক্রান্ত হঠাৎ পরিবর্তিত নীতিমালা বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির (এমএনসি) আস্থা টলিয়ে দিয়েছে (যেমন: ফ্ল্যাশ সেল নিষেধাজ্ঞা বা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ভোটাধিকার সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতা)।

ভূ-রাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস: আমেরিকা-চীন প্রযুক্তি দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে, ভারত এখন বৈশ্বিক বিনিয়োগ আকর্ষণ ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার মাঝে ভারসাম্য রাখতে বাধ্য, যার প্রেক্ষিতে ২০২০ সালে চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধকরণসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

এই অনিশ্চিত পরিবেশে বহু বহুজাতিক সংস্থা আপাতত "ঘটনার-মোড়-ঘোরার-অপেক্ষায়-থাকা" মনোভাব নিয়েছে, নীতিগত অবস্থা স্থিতিশীল না হওয়া পর্যন্ত বড় বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত স্থগিত রেখেছে। একাধিক আন্তর্জাতিক সিইও মন্তব্য করেছেন, তথ্য সার্বভৌমত্ব ও ডিজিটাল কর সংক্রান্ত অনির্দিষ্টতা দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের রিটার্ন হিসাবকে কঠিন করে তুলছে, ফলে কর্পোরেট স্তরে ঝুঁকিবিমুখতা বেড়েছে। পাশাপাশি, ভারতের কৌশলগত স্বয়ংসম্পূর্ণতার অভিমুখ বিদেশি সরবরাহ শৃঙ্খল ও নিরাপত্তা নিরীক্ষা আরও কঠোর করেছে, অনুমোদন প্রক্রিয়া মন্থর হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কিছু সংস্থা তাদের অভ্যন্তরীণ পরিচালন কাঠামো পুনর্বিন্যাস করছে, ভারত-কেন্দ্রিক নীতিমালা বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করছে, এবং স্থানীয় অংশীদারিত্ব বাড়িয়ে ভারতের প্রতি প্রতিশ্রুতি দেখাতে চাইছে। এসব অভিযোজনের লক্ষ্য—কর্পোরেট স্বার্থ সংরক্ষণ এবং ভারতের পরিবর্তিত নীতিগত অগ্রাধিকারের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো।

কর্পোরেট প্রতিক্রিয়া

কিছু সংস্থা “চায়না-প্লাস-ওয়ান” কৌশল গ্রহণ করে ভারতে উৎপাদন ও ডেটা সেন্টারে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। অনেকেই নতুন প্রকল্প স্থগিত রেখেছে অথবা আরও স্বচ্ছ নীতিগত পরিবেশের দাবি জানিয়েছে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও অনিশ্চয়তা তুলে ধরে। অনেক সংস্থাই এখন তাদের ভারতে উপস্থিতি পুনর্মূল্যায়ন করছে—স্থানীয় অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে, ঝুঁকি ও লাভ ভাগ করে নেওয়ার যৌথ উদ্যোগে যাচ্ছে। তারা সম্মতি টিম গঠন করছে, নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে, এবং ভারতে কেন্দ্রিক পরামর্শদাতা বোর্ড তৈরি করছে যাতে নীতিগত পরিবর্তন আগাম আঁচ করা যায়। কেউ কেউ তাদের লক্ষ্য স্থানান্তর করছে টিয়ার-২ ও টিয়ার-৩ শহরের দিকে, যেখানে জমি, শ্রম ও লজিস্টিক তুলনায় স্থিতিশীল হলেও বাজার ছোট। শিল্প সংগঠনগুলিও এক্ষেত্রে সক্রিয়, তারা এক-জানালার অনুমোদন ব্যবস্থা চালুর দাবিতে রাউন্ডটেবিল আলোচনা ও শ্বেতপত্র তৈরি করছে। আশা—হঠাৎ আদেশ নয়, বরং ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে টেকসই ও মসৃণ বৃদ্ধির পথ সুগম হবে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

ডিজিটাল অর্থনীতি: সফটওয়্যার ও ফিনটেক ক্ষেত্রে ভারতীয় ইউনিকর্নগুলির উত্থান পশ্চিমা কর্পোরেশনদের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে পারস্পরিক উদ্ভাবনী সহযোগিতার পথ তৈরি করছে।

নির্বাচিত অংশগ্রহণ: "আত্মনির্ভর ভারত" উদ্যোগ এক ধরনের স্বনির্ভরতার দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে, তবে তা সেমিকন্ডাক্টর, পরিকাঠামো এবং নবায়নযোগ্য শক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে MNC-দের স্বাগত জানায়—শর্ত, তারা যেন ঘরোয়া সক্ষমতা গঠনে অবদান রাখে।

এই প্রেক্ষিতে বহু এমএনসি স্থানীয় গবেষণা ও উন্নয়ন কেন্দ্রে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে, ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলির সঙ্গে দক্ষতা উন্নয়ন চুক্তি করছে, এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে দেশীয় সরবরাহকারীদের শক্তিশালী করছে। তারা “মেক ইন ইন্ডিয়া” গাইডলাইনের আওতায় কারখানা তৈরি করছে, যাতে ধীরে ধীরে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ও সরবরাহ শৃঙ্খল স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত হয়। রাজ্য সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পও শুরু হচ্ছে, যেখানে প্রকৌশলী ও কারিগরি কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনবল তৈরি হচ্ছে। চুক্তিতে দেশীয় কনটেন্ট শর্ত জুড়ে দিয়ে এবং ভোকেশনাল ট্রেনিং সেন্টারে বিনিয়োগ করে, এই সংস্থাগুলি দেখাচ্ছে—ভারতের কৌশলগত খাতে অংশগ্রহণ শুধু লাভজনকই নয়, বরং রূপান্তরমূলক, কারণ তারা দীর্ঘমেয়াদি জাতীয় লক্ষ্যে সহায়ক টেকসই ইকোসিস্টেম তৈরি করে।

উপসংহার

ভারত ও বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলির সম্পর্কের গতি এক শতকের মধ্যে সন্দেহপ্রসূত সংরক্ষণবাদ থেকে উদার মুক্তবাজার এবং বর্তমানে শর্তসাপেক্ষ জটিল সহযোগিতায় পৌঁছেছে। বিশ শতকের প্রথমার্ধে বিদেশি বিনিয়োগের প্রতি অবিশ্বাস ও কঠোর নিয়ন্ত্রণ দেশীয় সংস্থাগুলিকে সুরক্ষা দিলেও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে রুদ্ধ করে রেখেছিল। ১৯৯১ পরবর্তী যুগে উন্মুক্ত নীতিমালা বিদেশি পুঁজির সদ্ব্যবহার ঘটিয়েছে, প্রবৃদ্ধি ঘটিয়েছে, এবং ভারতকে বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত করেছে। তবে সাম্প্রতিক নীতিগত দোলাচল এবং দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে একটি পুনর্বিন্যাস জরুরি হয়ে উঠেছে—একটি ভারসাম্য যেখানে উন্মুক্ততা ও কৌশলগত স্বনির্ভরতা যুগপৎ চলবে। শেষপর্যন্ত, ভারতের অভিজ্ঞতা দেখায়—বহুজাতিকদের সঙ্গে সফল সহযোগিতা শুধু নীতিগত উদারতার উপর নির্ভর করে না, বরং সুসংহত ও পূর্বানুমেয় নীতিমালারও প্রয়োজন, যা বিদেশি বিনিয়োগকে জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যগুলির সঙ্গে সংযুক্ত করতে সক্ষম।


তথ্যসূত্র

Brandl, K., Moore, E., Meyer, C., & Doh, J. (2021). The impact of multinational enterprises on community informal institutions and rural poverty. Journal of International Business Studies. https://doi.org/10.1057/s41267-020-00400-3

Goswami, S. (2019). Land acquisition and involuntary displacement: A study of changing state-society relations. European Researcher. Series A, 10(3), 148–155. https://www.researchgate.net/publication/336382820_Land_Acquisition_and_Involuntary_Displacement_A_Study_of_Changing_State_Society_Relations

JLL India. (2025, February 13). India's warehousing boom: Tier II-III cities drive 100M sq. ft. Retrieved from https://www.jll.co.in/en/newsroom/indias-warehousing-boom-tier-ii-iii-cities-drive-100m-sq-ft

Lane, P. R., & Milesi-Ferretti, G. M. (2011). India's financial globalisation. IMF Working Paper No. 11/7, International Monetary Fund. Retrieved from https://www.elibrary.imf.org/view/journals/001/2011/007/article-A001-en.xml

Palit, A. (2008). India's foreign investment policy: Achievements and inadequacies. Institut Français des Relations Internationales (Ifri). https://www.ifri.org/sites/default/files/migrated_files/documents/atoms/files/av18palitfinal.pdf

Sahoo, P., Nataraj, G., & Dash, R. K. (2014). Foreign Direct Investment in South Asia: Policy, Impact, Determinants and Challenges (26th ed., p. 41). Springer.

0 comments:

0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in



















ঋত্বিক ঘটক একজন প্রবাদপ্রতিম চলচ্চিত্র পরিচালক। চলচ্চিত্র জগতে পরিচালক, সহকারী পরিচালক ছাড়াও চিত্রনাট্যকার ও অভিনেতা রূপেও কাজ করেছেন তিনি। দেশবিভাজন ট্রিলজি নামে পরিচিত ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’ এবং ‘সুবর্ণরেখা’ এই তিনটি ছবি চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তাঁর সেরা কাজ রূপে বিবেচনা করা হয়। সত্যজিৎ রায় ও মৃণাল সেনের সমসাময়িক এবং সমান্তরাল চলচ্চিত্র নির্দেশক হয়েও তিনি ছিলেন স্বতন্ত্র। ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্র বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন, ৫০টির কাছাকাছি প্রবন্ধ ও নিবন্ধ লিখেছেন। অপরদিকে নাট্য জগতেও নির্দেশক, নাট্যকার এবং অভিনেতা সব রূপে সমান স্বাচ্ছন্দ্যে বিরাজ করেছেন তিনি। শিল্পের নানা মাধ্যমে বারবার ফিরে এসেছে সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশা, চাওয়া পাওয়া, তৎকালীন সমাজে নারীদের অবস্থা, দেশভাগের নির্মমতার খণ্ডচিত্র, প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বামপন্থী প্রতিবাদী ভাবাবেগ। শিল্পের নানা ক্ষেত্রে সাবলীলভাবে বিচরণকারী এই মানুষটিকে তাই ১৯৭০ সালে ভারত সরকার শিল্পকলা বিভাগে পদ্মশ্রী সম্মান প্রদান করে।

৪ নভেম্বর ১৯২৫ সালে অবিভক্ত বাংলার ঢাকাতে জন্ম হয় ঋত্বিক ঘটকের। তিনি ও তাঁর যমজ বোন প্রতীতিদেবী ছিলেন বাবা সুরেশচন্দ্র ঘটক ও মা ইন্দুবালা দেবীর নয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। সংস্কৃতের কৃতী ছাত্র সুরেশচন্দ্র পেশাগত জীবনে উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মচারী (ম্যাজিস্ট্রেট) ছিলেন। ঋত্বিকের বড় দাদা মণীশ ঘটক ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক, কল্লোলযুগের সুপরিচিত ঔপন্যাসিক ও কবি ও তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম মুখ, যাঁর কন্যা মহাশ্বেতা দেবী বাংলা সাহিত্যের রত্ন। আবার তাঁর আরেক দাদা আশিষচন্দ্র ঘটকের নাতি পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় এখনকার সময়ের স্বনামধন্য অভিনেতা, চিত্রপরিচালক ও চিত্রনাট্যকার। সক্রিয় বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মী সাধনা রায়চৌধুরীর ভাগ্নী সুরমা দেবীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ঋত্বিক ঘটক। তাঁদের তিন সন্তান ঋতবান, সংহিতা ও শুচিস্মিতা ঘটক। চিত্রপরিচালক ঋতবান ‘ঋত্বিক মেমোরিয়াল ট্রাস্টে’র সঙ্গে যুক্ত এবং ঋত্বিকের অসমাপ্ত তথ্যচিত্র ‘রামকিংকর’ সম্পূর্ণ করেছেন ও ‘অসমাপ্ত ঋত্বিক’ নামক একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। পাশাপাশি বাবার প্রথম দিকের কাজ ‘বগলার বঙ্গদর্শন’, ‘রঙের গোলাম’-এর মত ছবি পুনরূদ্ধার করেছেন। তাঁর বড় মেয়ে সংহিতাও তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন।

ঋত্বিকের প্রাথমিক পড়াশোনার সূচনা হয় ময়মনসিংহের মিশন স্কুলে। এরপর দাদা মণীশ ঘটক তাঁকে কলকাতার বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি করে দেন। এই সময়েই ঋত্বিকের নাটকে হাতেখড়ি। ঋত্বিকের প্রথম দিকের নাট্য অভিনয় ‘চন্দ্রগুপ্ত।’ (১৯৩৬)। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের এই নাটকে ঋত্বিক চাণক্যের ভূমিকায় অভিনয় করতেন রিচি-রোড, ম্যাডক্স স্কোয়ারে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হলে, রাজশাহী ফিরেও নাটক থেকে সরে যাননি। এরপর ১৯৪২ সালে ঋত্বিক ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশ করেন। বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১৯৪৮ সালে বি.এ. পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তি হন। তবে লেখালেখি ও নাট্য চর্চার নেশায় এম.এ.-র পাঠ অসমাপ্তই থেকে যায় তাঁর।

কলকাতায় এসে স্কুলে পড়াশোনার সময় থেকেই প্রেমের কবিতার মধ্যে দিয়ে লেখালেখির সূচনা হয় তাঁর। ১৯৪৭-এ ‘গল্পভারতী’তে তাঁর লেখা প্রথম গল্প ছাপা হয়। এরপর ‘দেশ’ ‘অগ্রণী’ ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় তাঁর গল্প। ১৯৪৭ সালেই নিজস্ব কাগজ ‘অভিধারা’ প্রকাশ করা শুরু করেন ঋত্বিক। চোখ, কমরেড, গাছ, আকাশগঙ্গা ইত্যাদি তাঁর লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গল্প। বাংলা বিভাজন দুই বাংলার বিক্ষুব্ধ সময়ের চিত্র, প্রেম, সামাজিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ছিল তাঁর লেখার মূল বিষয়। তাঁর কম বয়সের কাঁচা হাতের লেখা পড়ে নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় তাঁকে একজন ‘শক্তিমান নবীন লেখক ‘বলে আখ্যা দিয়েছেন।

গল্প লিখতে লিখতে একসময় তাঁর মনে হয় ‘‘গল্পটা inadequate’’। ফলত নাটকের জগতে তাঁর প্রবেশ। প্রথমে রবীন্দ্রনাথের নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে শুরু করেন নাট্যজীবন। এরপর ধীরে ধীরে গণনাট্যের সঙ্গে পরিচয় হয়। ১৯৪৮ সালে ‘বহুরূপী’ ‘নবান্ন’ নাটকের শো করে। শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় তাতেও অভিনয় করলেন ঋত্বিক। এইসময়ে লিখলেন প্রথম নাটক ‘কালো সায়র’। ‘নবান্ন’ নাটকে সাফল্যের পরে ১৯৪৯-এ গণনাট্যের নতুন নাটক ‘ঢেউ’তে বৃদ্ধ কৃষকের ভূমিকায় নিজেই অভিনয় করলেন। ১৯৫১ সালে যুক্ত হন ভারতীয় গণনাট্য মঞ্চের (Indian People’s Theatre Academy-IPTA) সঙ্গে। ১৯৫২ সালে নিজের লেখা ‘দলিল’ নাটকটি নিয়ে তিনি ১৯৫৩ সালে পাড়ি দেন বোম্বেতে–গণনাট্যের কনফারেন্সে। নাটকটির পরিচালক ও প্রধান অভিনেতা ছিলেন ঋত্বিক নিজেই। এই নাটকটি ঐ প্রর্দশনীতে প্রথম হয়। এছাড়া ১৯৫৫-তে তাঁর লেখা ও নির্দেশনাতে ‘সাঁকো’ খুবই প্রশংসা পায়। অভিনেতা ঋত্বিকের পরের নাটক বিজন ভট্টাচার্যের নির্দেশনায় দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ। ‘জাগরণ’-এর জিন্না থেকে ‘বিসর্জন’-এর রঘুপতি, ‘ঢেউ’-এর বৃদ্ধ কৃষক, ‘নীলদর্পণ’-এ তাঁর অভিনয়, তাঁর নির্দেশনা মাতিয়ে তুলেছিল আপামর নাটকপ্রেমী বাঙালিকে।

নাটক করতে করতেই তাঁর মনে হয়, কয়েক হাজার নয়, লক্ষ মানুষের কাছে যেতে হবে। তখন সহ-পরিচালকরূপে নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ (১৯৫০) এর মাধ্যমে তাঁর চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ। এরপর ‘বেদেনী’ (১৯৫১) চিত্রনাট্যকার রূপে ‘মধুমতী’ ইত্যাদি নানা ছবি করেছেন।

নির্দেশক ঋত্বিকের আটটি পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছবি ছিল — নাগরিক (১৯৫২), অযান্ত্রিক (১৯৫৮), বাড়ী থেকে পালিয়ে (১৯৫৮), মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১), সুবর্ণরেখা (১৯৬২) তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩) এবং যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪)। এর মধ্যে সুবর্ণরেখা ১৯৬৫ সালে আর নাগরিক ১৯৭৭ সালে মুক্তি পায়। সাধারণ মানুষ, তাঁদের জীবনের দৈনিক সংগ্রাম, দেশভাগের যন্ত্রণা বারবার ফিরে আসে তাঁর ছবিতে। ছবিকে তিনি শিল্প নয় বরং সমাজের, নিজের ভাবনা, প্রতিবাদ, আবেগ, দাবী প্রকাশ করার মাধ্যম রূপে বিবেচনা করতেন। এছাড়া ইন্দিরা গান্ধী, পুরুলিয়ার ছৌ, ভয়, বিহার, আমার লেনিন ইত্যাদি বিবিধ বিষয় নিয়ে তিনি স্বল্পদৈর্ঘ্যের তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেন।

১৯৬৬ সালে পুণের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গে অধ্যাপক রূপে যুক্ত হন। সেখানে তাঁর সমসাময়িক উল্লেখযোগ্য ছাত্র ছিলেন মণি কৌল (Mani Kaul), সুভাষ ঘাই (Subhas Ghai ), কুমার সাহানি (Kumar Sahani), বিধুবিনোদ চোপড়া (VidhuVinod Chopra), আদূর গোপালকৃষ্ণন (Adoor Gopalakrishnan) প্রমুখরা। কিন্তু সেখানকার শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনেও বেশী দিন টিকে থাকতে পারেনি তাঁর শিল্পী মন। কিন্তু চলচ্চিত্র বিষয়ক তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধগুলি আজও নানা চলচ্চিত্র বিষয়ক ছাত্র ও গবেষকের কাছে মূল্যবান নথি বলে গণ্য।

১৯৬৯ সালে, জীবনের শেষবেলায়, গোবরা মানসিক হাসপাতালেই লিখে ফেলেন ‘সেই মেয়ে’। নিজের নির্দেশনায় সে নাটক অভিনয় করালেন হাসপাতালের রোগী ও কর্মী-চিকিৎসকদের দিয়ে। জীবনে যখনই গল্প লিখতে লিখতে, ছবি করতে করতে অস্থির হয়েছেন নাটকই সেই খরার দিনে তাঁর বক্তব্য প্রকাশের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। বার বার ভাঙা দেশ, জীবন আর কলোনির গল্প ফিরে এসেছে মঞ্চের সংলাপে। তাঁর বন্ধুরাই বলছেন, ‘হি ওয়াজ নেভার সিনসিয়ার টু দ্য থিয়েটার’, কিন্তু, শেষ পর্যন্ত গণনাট্য আন্দোলনের ইতিহাসে ঋত্বিক এক স্থায়ী আসনের দাবিদার হয়ে রয়ে গেছেন। তাই শোভা সেন তাঁকে যথার্থই বলছেন, ‘নাট্য-আন্দোলনের হোতা বা পুরোহিত!’

চলচ্চিত্রের জন্য সত্যজিৎ রায়ের মতো জীবদ্দশায় বাণিজ্যিক বা আন্তর্জাতিক সাফল্যের মুখ সেভাবে দেখেননি ঋত্বিক ঘটক। ১৯৫৭ সালে ‘মুসাফির’ ছবি তৃতীয় সেরা কাহিনী চিত্র (feature film) হিসেবে জাতীয় পুরস্কার মঞ্চে সার্টিফিকেট অব মেরিট অ্যাওয়ার্ডে (Certificate of Merit Award) ভূষিত হয়। ১৯৫৮-তে হিন্দি ছবি ‘মধুমতী’ ফিল্ম ফেয়ারের জন্য সেরা গল্পরূপে মনোনয়ন পায়। ১৯৭০ সালে ‘হীরের প্রজাপতি’ সেরা শিশু চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় পুরস্কারে প্রধানমন্ত্রীর স্বর্ণপদক লাভ করে। ১৯৭৪-এ ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ ছবির গল্প জাতীয় পুরস্কার মঞ্চে রজত কমল পুরস্কার পায়। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর জন্য বাংলাদেশ সিনে জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন তাঁকে সেরা নির্দেশক পুরস্কারে ভূষিত করে। ২০০৭ সালে এই ছবি ‘ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটে’র একটি সমালোচক দলের দ্বারা নির্মিত বাংলাদেশের সেরা দশটি চলচ্চিত্রের তালিকায় শীর্ষস্থান লাভ করে। ১৯৯৮ সালে এশীয় পত্রিকা সিনেমায়ারের তৈরী সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকাতে ‘সুবর্ণরেখা’ ১১তম স্থান পায়। আন্তর্জাতিক স্তরে এই সাফল্য দেখে তাই তাঁর স্ত্রী সুরমা ঘটক স্মৃতিচারণে আক্ষেপ হয়ে বারবার ফিরে এসেছিল শেষ জীবনে তাঁর বলে যাওয়া কটা কথা — “লক্ষ্মী , টাকাটা তো থাকবে না, কাজটাই থাকবে। তুমি দেখো আমার মৃত্যুর পর সবাই আমাকে বুঝতে পারবে।”

দীর্ঘদিন ব্যাপী হতাশা ও অত্যাধিক মদ্যপানের ফলে ১৯৭৬ সালে ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় ঋত্বিক ঘটকের মৃত্যু হয়। তাঁর কথা তাঁর মৃত্যুর পরে সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। সত্যি ব্যতিক্রমী চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক।

0 comments: