আকাশে সেদিন জল টসটস মেঘ। সরোবরের জল মেঘের ছায়ায় গভীর কালো। পদ্মবনে নীল আলো ফেলে ভোর আসছে। মহাদেব ডুব দিলেন। পরপর তিনটি। ভোরের সূর্যের দিকে তাকিয়ে প্রথম অঞ্জলিটি ঢেলে দিলেন জলে। মেঘমন্দ্র স্বরে গুড়গুড় গমগম করে উঠল চারপাশ। আকাশে কড়াৎ কড় বাজ, রুদ্রবীণায় বেজে উঠল ভৈরবী সুর। তাঁর মেঘের মত জটায় উথালপাথাল পদ্মবন, দিশেহারা ভ্রমরের দল। চুলে লেগে রইল কয়েকটি বৃন্তচ্যুত পদ্মকলি। মহাদেব ফুলগুলি নিয়ে এলেন দেবী পার্বতীর পুজোঘরে। দেবী তখন ধ্যানমগ্না। হেমবর্ণ আলো এসে পড়েছে তাঁর মুখে। কপালে জ্বল জ্বল করছে কুমকুমের ফোঁটা। ভোর হচ্ছে চরাচর জুড়ে। দেবী ফুলের সাজিটি টেনে নিলেন। উঠে এল ফুটফুটে এক মেয়ে। কে তুমি!
"মনসা, শঙ্কর নন্দিনী।"
বিষে ভরে গেল আকাশ পাতাল।ঝিকিয়ে উঠল কাল নাগিনীর ফণা। দেবীর মনের বিষে অধিষ্ঠান হল বিষের দেবী, সাপের দেবী মনসার।
মনসা জন্মের এ গল্প বিহারের। এই গল্পই একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বাঙালির মনসামঙ্গলে। কিন্তু এমন এক সর্পদেবীর জন্ম নিছক মহাদেবের ফুলের সাজিতে হয়না। দেবী জন্মাতে থাকেন মনে মনে, তলে তলে। হাজার হাজার বছরের মানুষী স্রোতের গভীরে। মনসার উৎস খুঁজতে পিছিয়ে যেতে হয় সময়ের পথে হাজার হাজার মাইল। পৃথিবীর তখন সদ্য কৈশোর। মানুষের দল চলে যাচ্ছে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে । "আ কন্টিনিউয়াস মুভমেন্ট অফ হিউম্যান রেসেস" তখন জল জমিনের খোঁজে। আদি অস্ট্রালয়েড, অ্যালপো দিনারীয়, নর্ডিক কত না গোষ্ঠী, দলকে দল ছড়িয়ে পড়েছে পারস্য,ইরান, ইউরোপ, এশিয়ার মাঠে মাঠে।
কত তো মানুষ এসেছে গেছে, ধুলোর পায়ে পায়ে...
ভারতবর্ষে আর্যরা এসেছিল আলাদা আলাদা দুটি বড় দলে বেশ কিছু সময়ের আগে পরে। তারও অনেক আগে এসে গেছে তুরানি মানুষ। তুরানি মানুষ ছড়িয়ে গেছে সারা পৃথিবীতেই। সঙ্গে নিয়ে গেছে তাদের জীবন , যাপন। মিশে গেছে সে দেশের ছায়ায় মায়ায়।
ঐতিহাসিক ফার্গুসন বলছেন পৃথিবীজোড়া সর্পপূজার চল হয়েছে তুরানিদের থেকেই। যেখানে যেখানে তারা পা রেখেছে সেইসব দেশেই পাওয়া গেছে জ্যান্ত সাপের পুজো করার রীতি। সেই কবে টোটেম জমানা থেকেই পশু পুজোর চল মানুষের পাড়ায় পাড়ায়। কুমির, বাঁদর, হাতি, কচ্ছপ, ভাল্লুক, বাঘ আরও কত কী । কিন্তু সাপ? দেশে দেশে সাপ ছিল শয়তানের ভূমিকায়। শয়তান থেকে দেবত্বে উঠে আসার এই রাস্তাটা সহজ ছিল খুব?
বেদে বা বেদের পরে মহাভারত কিম্বা প্রথমদিকের পুরাণগুলোতে কোথাও সর্পপূজার কথা নেই। তারও পরে বিভিন্ন উপপুরাণ , দেবী ভাগবত, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ইত্যাদিতে সাপের দেবী হিসেবে মনসার নাম পাওয়া যায়। জায়গায় জায়গায় সাপের ঘর। গুহার ভেতর দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছে কারা? কাদের ঘরে ঘরে বিষের আড়ৎ? খুঁজতে খুঁজতে পায়ে পায়ে চষে ফেলতে হয় দীনদুনিয়ার আদাড়বাদাড়–ব্যাবিলন থেকে রোম, ইংল্যান্ড থেকে অস্ট্রেলিয়া। ব্যাবিলনীয়,আসিরিয়, সুমেরীয়দের ঘরে ঘরে সাপের বেদী। বেদীতে নাগ দেবতার চাষ। মিশরের স্থাপত্যে সাপ ছিল বড় পবিত্র । মনে পড়ে সেই আলেকজান্ডারের কথা? তার বাবা ফিলিপ নিজে রাজ্যে বলে বেড়ালেন আলেকজান্ডারের বাবা নাকি কোন এক সাপ।
যেদিন খান্ডব বন পুড়িয়ে বনভোজন করছিলেন কৃষ্ণ,অর্জুন সেদিন সেই দাউদাউ বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল তক্ষক নাগ–জোড়হাত, নত মস্তক। আগুনে না পুড়িয়ে তাকে সপরিবার বন ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি দিল কৃষ্ণ। চিরঋণী হয়ে রইল নাগ। যেদিন মহাভারত লেখা হচ্ছিল সেদিন নাগ শব্দের ব্যবহার সাপ অর্থে করা হতনা। নাগ ছিল সম্ভবতঃ সাপ টোটেমের এক উপজাতি। কশ্যপ মুনির স্ত্রী কদ্রু নাগদের আদিমাতা। বাসুকি, অনন্ত, শেষ নানান বিখ্যাত নাগের দলে মেয়েটি অজ্ঞাতনামা, জরৎকারু। জরৎকারুর বিয়ে হয়ে গেল জরৎকারু মুনির সাথে, কুটির আলো করে সন্তান জন্ম হল। আস্তিক। এতদিনে একটা বলার মতো পরিচয় পেল মেয়েটি "আস্তিকস্য মুনির্মতা"! কিন্তু তারপর? তারপর মেয়েটি হারিয়ে গেল অন্ধকারে। স্বামী পরিত্যক্তা, ভাই বাসুকির সাম্রাজ্যে মেয়েটি বেঁচে রইল নামহীন খ্যাতিহীন অস্তিত্বের মতো।
খান্ডব বন থেকে বেঁচে ফেরা তক্ষক নাগের রাজ্য দেখতে দেখতে তক্ষশিলা। আবারও ফার্গুসন বললেন, এই তক্ষশীলা আদতে এক নাগরাজ্য। তথাগত বুদ্ধ তখন ছড়িয়ে যাচ্ছেন জলে। পাহাড় ছাড়িয়ে, গিরিপথ পেরিয়ে দূরে, আরো দূরে। বোধিবৃক্ষের বেদীটিতে তখন পুণ্য আয়োজন। সাঁচি আর অমরাবতীর স্তূপের গায়ে গায়ে সেইসব বৃক্ষপূজা, চক্রপূজার স্মৃতি। পাঁচমাথাওয়ালা নাগের ছবি ফিরে এসেছে বারে বারে। হিন্দু পুরুষ, নারী ছাড়াও যাদের পোশাকআশাক খানিক আলাদা, যারা চেহারায় ঠিক আর্যসুলভ নয়, বরং তারও আগের সময়ের লোকজনের মতো তাদের ফার্গুসন বললেন তক্ষক কিম্বা দস্যু। তারা থাকে অরণ্যের আড়ালে, গাছের ছায়ায়। শহর থেকে দূরে তাদের ঘর। ঘরের ভেতর সাপের ঝাঁপি, সদর দুয়ারে আগুন মশাল। দেশের রাজা যায় দস্যু সন্দর্শনে ।
আগুন আর সাপের উপাসনা আসলেই সূর্য উপাসনার প্রতীক কিনা সে কথা বলবেন পণ্ডিত। কিন্তু ঋকবেদে দশম মণ্ডলের সর্পরাজ্ঞী সূক্তে বাক বিজ্ঞানের আলোচনায়, এবং তৃতীয় মণ্ডলের ঋষি বিশ্বামিত্র সূর্যরশ্মির ভেতরের কাঁপনের প্রকৃতিকে নাম দিয়েছেন "সসর্পরী বাক" ।
বাক সেই শুদ্ধতম প্রকাশের একক যার আলোয় আলোময় হয়ে ওঠে মানুষের নৈর্ব্যক্তিক আত্মা । আর সাপের কামড়ে চিকিৎসা এমন এক বিদ্যা যার নামে অথর্ব বেদে আলাদা এক শাখাই তৈরি হয়ে যায় ধীরে ধীরে। সেইসব প্রাচীন দিনে যখন ঠান্ডা দেশের মানুষ আর্যরা ধীরে ধীরে পরিচিত হচ্ছে ভারতের উষ্ণ জলবায়ু আর সাপের বিভিন্ন প্রজাতির সাথে, ততই সাপ হয়ে উঠছে এক ভয়ানক অস্তিত্ব। মহাভারতে ঘৃতাচি নামের শূদ্র মেয়েটি ছিল সর্পবেদে বিশারদ। এই ঘৃতাচীই মনসার প্রথম প্রতিচ্ছবি। বাগদেবী সরস্বতীর হাতে প্রথমদিকে ছিল বীণা আর সাপ। আভিজাত আর্যরা পরে অনার্যদের সাপকে সরিয়ে বেদ দিয়েছে সরস্বতীর হাতে। সেকালে বেদ বিশারদ হতে হলে সর্পবেদের জ্ঞান থাকা ছিল প্রথম শর্ত।
গাঙ্গুরের জলে কলার মান্দাস ভাসাল যে একলা মেয়েটি,ভেসে গেল ঠিকানাহীন নিরুদ্দেশ সেই কি কবির হৃদয়ে গান হয়ে উঠল না কি সেই মানুষটি যে শত বিপণ্নতার প্রেক্ষাপটেও নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল সে হঠাৎ অন্ধকার ঠেলে সব মানুষের হয়ে গান গেয়ে উঠল?
কাব্য আসলে হাঁটাপথ বেয়ে জীবনেরই কথা বলে। বাংলার নিজস্ব সাহিত্যচর্চার একেবারে প্রথম ধাপটিতেই লেখা মঙ্গলকাব্য-কথা। এ সেই সেদিনের কথা যেদিন জলাজঙ্গলে ঢাকা বাংলার কালো মানুষগুলো আর্য-ভারতের কাছে ব্রাত্য ছিল,জীবন বয়ে যেত তিরতিরে স্রোতে নিজস্ব ধারায়,মানুষ বাঁচত মাটির ছন্দে।
আবহাওয়ার নিয়মেই এ জায়গা সাপের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র। সেই কোন আদিম সময় থেকে অরণ্যচারী মানুষ ভয় পেতে শিখেছে এই সরীসৃপটিকে,ধীরে ধীরে তার উপরই আরোপ করেছে দেবত্ব, পুজো করেছে,দয়া প্রার্থনা করেছে।
মনসা,বাংলার সর্পদেবী। ইতিহাসের ধুলো সরিয়ে এই দেবীর যাত্রাপথ খুঁজবো আমরা।
সেই কোন ভুলে যাওয়া অতীতে ইউফ্রেটিস নদীর ধারে থাকত তুরানী উপজাতি,তারা ছিল সর্প উপাসক। একসময় তারা এদেশের পশ্চিমসীমান্ত পেরিয়ে ঢুকে পড়ল সিন্ধুনদের তীরে,ঘর বানাল,চাষ করল সঙ্গে আনল তাদের উপাস্যকেও। এরাই দ্রাবিড়দের আদিপুরুষ। সিন্ধুনদের তীরে হরপ্পা আর মহেঞ্জদরোতে এদেরই সর্প দেবতার মূর্তি পাওয়া গেছে। এখনো বালুচিস্তানে ব্রুহাই ভাষী দ্রাবিড়রা রয়েছে। ভারত ছাড়া আরো যে যে দেশে তারা গেছে যেমন গ্রিস স্ক্যান্ডানেভিয়া ইত্যাদি জায়গাতেও সর্পপূজার প্রথা এরাই বয়ে নিয়ে গেছে।
এই তুরানী দ্রাবিড়রাই পরে আর্যদের কাছে হেরে গিয়ে সরে যায় দাক্ষিণাত্যের দিকে। বাকিরা চলে যায় পূর্বদিকে আসাম ,ত্রিপুরা,বাংলায়।সেখানে কখনো অস্ট্রালয়েড কখনো বা মোঙ্গলদের সাথে মিশে তৈরি হতে থাকে এক মিশ্র জাতির।
আজকের মনসা আসলে দ্রাবিড় বৌদ্ধ আর ব্রাহ্মণ্য তিন ধারার মিশেলে পাওয়া এক দেবী। বৌদ্ধ মহাযানদের তন্ত্রমতে জাঙ্গুলি নামে এক দেবী পাওয়া যায়। তিনি শুক্লবর্ণ,শুক্ল অলঙ্কার শোভিতা,বীণাবাদিনী,কোথাও বা ময়ূরপালক হাতে লেখনীর প্রতীক হিসেবে। সেই হিসাবে সরস্বতীর সাথে মিল প্রচুর। এঁরই একহাতে সাপ।
যজুর্বেদে সঙ্গীতের মতো সর্পবিদ্যারও কথা বলা আছে। আবার সরস্বতীকে বলা হয়েছে বিষনাশিনীও। অথর্ববেদে সর্পবেদ আর সর্পবিদ্যা নামে দুই শাস্ত্রের কথাও আছে। তাহলে বলাই যায় এই জাঙ্গুলিতারা আর সরস্বতী প্রায় একই।
আর্য সমাজে স্ত্রীদেবতার পুজোর চল ছিলনা। কিন্তু চন্ডী, কালি ইত্যাদি লৌকিক দেবীর মত মনসারও পৌরাণিক পরিচিতি পাবার কারণ মনে হয় এ দেশের প্রবল সংস্কারের প্রভাব,সাথে সর্পভীতি। শীতের দেশে সাপের উপস্থিতি কম,তুলনায় ভারতের উষ্ণ ভেজা আবহাওয়া সাপের পক্ষে অনুকূল এবং তার ছাপ পড়ে সমাজ ও লোকাচারেও।
তবুও খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর আগে সর্পদেবী হিসাবে মনসার গুরুত্ব সেভাবে পৌরাণিক সাহিত্যে জায়গা পায়নি। প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় পদ্মপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ এবং দেবীভাগবতে।কাজেই ইতিহাসের নিয়মে হয়ত তারও বেশকিছু আগে প্রায় দশম একাদশ শতাব্দীতে মনসাপূজা আর্য সমাজেও চালু ছিল।
পাশাপাশি দক্ষিণাত্যে মুদমা, মঞ্চাম্মা ইত্যাদি নামের সর্পদেবীর খোঁজ পাওয়া যায়।মঞ্চাম্মা এক ধরনের সাপ। তাতে দেবত্ব আরোপ করে পুজো করেন দুএকটি আদিবাসী গোষ্ঠী। মুদমা মূর্তি মহীশুরে ব্যাপক হারে পাওয়া গেছে মন্দির ভাস্কর্যেও। বাংলার বর্তমান মনসা সম্ভবতঃ পৌরাণিক দেবী সরস্বতী,জাঙ্গুলিতারা ও মুদমার মিলিত রূপ।
প্রাচীন মনসামূর্তির নমুনা হিসেবে পাওয়া গেছে বীরভূমের পাইকোড়ে, সেন বংশের প্রথম রাজা বিজয়সেনের তৈরি মূর্তিটি।সেন রাজারা দক্ষিণাত্য থেকেই এখানে এসে রাজত্ব করেছিলেন। সেক্ষেত্রে রাজার সাথে দক্ষিণভারতীয় বিশ্বাস ও লোকাচার বাংলায় আসাই স্বাভাবিক,এবং তা সহজেই মিশেও গেছে বাংলার দ্রাবিড় সংস্কারের সাথে। সমাজতাত্বিকের ধারণা যদি কোনো সংস্কার বা প্রথা অন্য সমাজে গিয়ে সহজেই মিশে যেতে পারে তবে বুঝতে হবে সেই প্রথা ওই সমাজেও প্রচ্ছন্নভাবে বহমান ছিল। এক্ষেত্রেও আদতে দুই দ্রাবিড় সংস্কৃতির মূলগত বনিবনা সহজেই হয়েছে এবং সর্পদেবীর পূজা বাংলায় হাজার বছরেরও প্রাচীন সংস্কার বলেই প্রমাণ হয়।
'মনসা' নামের উৎপত্তি কিন্তু সঠিক বলা মুশকিল। মহাভারত বলছে জরৎকারু কাশ্যপের মানসকন্যা,শিবের শিষ্যা। বাসুকির বোন। চতুর্বেদ বিশারদ।জরৎকারু মুনির স্ত্রী। অস্তিকের মাতা। আস্তিকের কৃতিত্ব হল জন্মেজয়ের সর্পযজ্ঞের সময় নাগকুলকে রক্ষা করা।
মনে করা হয় অনার্য মনসা চরিত্রে আভিজাত্য যোগের উদ্দেশ্যই মনসা এবং জরৎকারু এক ও অভিন্ন করে দেখানোর চেষ্টা হয়েছে পরবর্তী সময়ে,যদিও মহাভারতে মনসা নামের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়না এবং জরৎকারু চরিত্রেও দেবত্ব আরোপিত হয়নি।
আবার অন্যদলের পন্ডিতরা বলছেন মনচা আম্মা―> মনসা মা উৎপত্তি হতে পারে। দক্ষিণী ভাষায় চ এর উচ্চারণ প্রায় স এর মতো। তবে এমতও স্থিরভাবে বলা মুশকিল। চেংমুড় হল তেলেগু ভাষায় ফনীমনসা গাছ। ফনীমনসা গাছের নিচেই মনসাপুজো হয় বাংলায়। চাঁদ সদাগর মনসাকে বলেছেন চেংমুড়ী কানী। অথচ চেংমুড়ী শব্দের কিন্তু কোনো বাংলা প্রয়োগ নেই। তাহলে এমনও ভাবা যেতে পারে এটি আদতে দক্ষিণী শব্দ।
পাণিনি বা অমরকোষে মনসা শব্দের উল্লেখ নেই,কাজেই বলাই যায় যে আদতে এটি কোনো অনার্য শব্দ সংস্কৃত ভাষার প্রভাবে রূপান্তরিত হয়ে এই নাম এসেছে।
এইসব জটিল বিবর্তনের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা ঢুকে পড়ব মঙ্গলকাব্যের যুগে। পন্ডিতেরা বলছেন মনসামঙ্গল কাব্যের জন্ম মোটামুটি দ্বাদশ বা ত্রয়োদশ শতাব্দী এবং তার অন্ততঃ দেড়শ বা দুশ বছরের আগে মনসাপুজোর রীতি চালু হয়।
সেসময় মনসা বন্দনার গান ছোট ছোট পালায় গাওয়া হত,কোনো লিখিত রূপ ছিলনা।
খন্ডে খণ্ডে ছড়িয়ে থাকা এইসব গান ও গল্প পরম্পরাকে একসময় পুঁথিবদ্ধ করলেন কোনো কবি,সেদিন থেকেই মনসামঙ্গল কাব্যের যাত্রা শুরু।
যদিও দ্বাদশ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত সমস্ত লেখকই তাঁদের রচনাকে মনসা পাঁচালী নামেই পরিচয় দিয়েছেন। প্রথম কবি হিসেবে নাম পাওয়া যায় কানা হরিদত্তের।তারপর একেএকে বিজয়গুপ্ত,নারায়ণ দেব,ষষ্ঠীধর,বিপ্রদাস,দ্বিজবংশীদাস কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ এবং আরো অনেকেই লেখেন এই মনসাপাঁচালী।
এইসব গল্পের অভিনবত্ব তেমন হয়তো নেই, এবং অনেকখানিই পুরাণের গল্পনির্ভর হলেও যা নিজস্ব তা হল চাঁদ সদাগরের গল্প। এ গল্পের হদিস নেই পুরাণে। চাঁদ আসলে মঙ্গলকাব্যের নিজস্ব চরিত্র।
এ গল্পও সেই সময়ের যখন ব্রাহ্মণ্য মাহাত্ম্য ভারী করে তোলেনি মানুষের বিশ্বাস ও লোকাচার। সমস্ত গল্পের কোথাও ব্রাহ্মণ চরিত্রের হদিস নেই।
চরিত্রের নামকরণ খেয়াল করলেও তা স্পষ্ট। চাঁদ, সোনেকা, বেহুলা, লখিন্দর , সাহো, হরিসাধু এসবই অনার্য নাম।
সমাজের মাথা তখন বণিকগোষ্ঠী। ধনী বণিক চাঁদ সমাজপতি। এ গল্পে দেব চরিত্রের চেয়ে মানবচরিত্রই প্রাধান্য পেয়েছে,মাহাত্ম্যও মানুষেরই। দেবচরিত্র নেহাতই পূজার ভিক্ষাপ্রার্থী,তাই নিয়েই গল্পের অলিগলি।
মঙ্গলকাব্য হিসাবে মনসামঙ্গলের জনপ্রিয়তার কারণও বুঝি তাই। এ মানুষের নিত্যকার সুখদুঃখ চাওয়া পাওয়ার গল্প। সোনেকার চরিত্রটি যে কোনো মাঝবয়সী মহিলার রোজনামচা।ইতিহাসের হিসাবে সেসময় বাংলায় এসেছে মুসলমান শাসক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিড়ম্বনায় মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে চারিত্রিক আদর্শ। চাঁদ সেই আদর্শের প্রতীক। তুলনায় ব্যতিক্রমী বেহুলা। বঙ্গনারীর তুলনায় সে অনেকবেশী স্বাধীনচেতা, সাবলীল ও সাহসী। স্বর্গের সভায় তার নৃত্য প্রদর্শনের নমুনাও বাংলার সমাজে বিরল। এই নৃত্যবিদ্যা দক্ষিণের মন্দিরে সুপ্রচলিত। দেবদাসী সেই প্রথার নাম। সে হিসাবে অনেকে এই গল্পকে দক্ষিণের গল্প বলেও মনে করেন। তবে কি এই গল্পের চরিত্রেরা বাস্তবে কোথাও ছিল?
দুই বাংলার বিভিন্ন জায়গায় ,বিহার আসাম ত্রিপুরায় চাঁদের বাড়ি,লখিন্দরের বাসর,নেতি ধোপানীর ঘাট ইত্যাদির লোকপ্রবাদ চালু রয়েছে। অনেকে বলেন বিহারের চম্পাই নামের জায়গাই চাঁদ সদাগরের চম্পকনগরী। সোনেকা, মানিকো, সাহো এইসব নামের সাথে ওই অঞ্চলের নামকরণরীতিরও মিল পাওয়ায় পন্ডিতেরা মনে করছেন বিহারই হল মনসামঙ্গলের গল্পের উৎসস্থল। বাসর ঘরে নববধূর বৈধব্যের গল্প হয়ত সত্যি,তেমনই সত্যি হয়ত চাঁদ সদাগরের মতো ব্যক্তিত্ব। সমাজের উঁচুতলায় থাকা সর্বজনমান্য শৈব মানুষটির কাছে পুজো পেলে যে এক লৌকিকদেবীর সামাজিক প্রতিষ্ঠা হয় এও সত্যি।
সাহিত্য হিসাবে মনসামঙ্গল খুব উঁচুদরের কদর পায়নি কখনও। মুকুন্দরাম কিংবা ভারচন্দ্রের মতো কবির পরশ পায়নি এইসব লেখা। তা সত্বেও বাংলা বিহার আসামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রায় একই গল্প অবিকৃত ভাবে স্বীকৃত হয়েছে দেখেও একথা মনে হওয়া স্বাভাবিক গল্পটির কাহিনী সত্যতা না থাকলে এমন ব্যাপক স্বীকৃতি সম্ভব ছিলনা। আর এসব টুকরো সত্যি ঘিরেই হয়ত কবিকল্পনা গল্প তৈরি করে যা কালক্রমে হয়ে ওঠে মঙ্গলকাব্য।
এতদূর পায়ে পায়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন হাঁফিয়ে উঠবে পাঠকের মন,তখন যাবার আগে টুক করে বলে যাই এ কাব্য কেন মঙ্গলকাব্য।
মঙ্গল মানে সুর করে গাওয়া গান। মঙ্গল মানে দেবতার আশীর্বাদ কামনায় প্রার্থনা। আবার এই গান মঙ্গলবার শুরু হয়ে একসপ্তাহ পরে আরেক মঙ্গলবার শেষ হয়,যদিও মনসামঙ্গল ব্যতিক্রম। এই গান সারা শ্রাবণমাস জুড়ে গাওয়া হয়। একে ভাসানের গানও বলে।
সমস্ত মঙ্গলকাব্যগুলির মধ্যে মনসামঙ্গলই সবচেয়ে বেশী প্রচার পেয়েছে। তার কারণ বোধহয় চরিত্রগুলির বাস্তব চিত্রায়ন। সাধারণের সুখদুখের সাথে চরিত্রগুলিকে মিলিয়ে দেবার দক্ষতা,তাই মনসামঙ্গল বাঙ্গালীর প্রাণের কথা হয়ে থেকেছে বহু শত বছর। আজও সেই স্রোত বহমান।
ফিরতি পথে বিকেল ফুরানো আলোয় হয়ত আজও কানে ভেসে আসবে লখিন্দরের করুণ আর্তনাদ.....
"ওঠো ওঠো ওহে প্রিয়া কত নিদ্রা যাও।
কালনাগে খাইল মোরে চক্ষু মেলি চাও।।
তুমি হেন অভাগিনী নাহি ক্ষিতিতলে।
অকারণে রাঁড়ি হইলা খন্ড ব্রত ফলে।।
কত খন্ড তপ তুমি কৈলা গুরুতর।
সে কারণে তোমা ছাড়ি যায় লখিন্দর।।
মাও সোনকা মোর মৃত্যু কথা শুনি।
অগ্নিকুন্ড করি মাও ত্যজিব পরাণি।।
আমার মরনে মায় বড় পাবে তাপ।
পুত্রশোকে মাও মোর সাগরে দিবে ঝাঁপ।
......."
গুনগুনিয়ে উঠবে সুর,পাক খাবে বাংলার মাঠেঘাটে, জমিতে, হাওরে....
আমরা হেঁটে যাব হাজার বছরের পথ অবিরাম।
0 comments: