0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






জীবন থেকে হারিয়ে যায় অনেক কিছুই l কালের নিয়মে l তবুও কখনো কখনো মনে হয় কিছু কিছু ঐতিহ্য ধরে রাখার দায় আমাদের ও ছিল l বাঙালী সত্যিই আত্মঘাতী l নাহলে কলকাতার অন্যতম গর্ব পেশাদার রঙ্গমঞ্চ গুলো এভাবে শেষ হয়ে যায় ! গ্রে স্ট্রীট আর কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটের সংযোগে দাঁড়িয়ে থাকা স্টার থিয়েটার l পঞ্চাশের দশক থেকে স্টারের খ্যাতি আকাশ ছুঁতে থাকে l সেই সময়ে স্টারের সত্বাধিকারী সলিল কুমার মিত্র স্টার কে ঢেলে সাজান l প্রথম ঘূর্ণায়মান মঞ্চ তৈরি হয় l উত্তম কুমার সারা জীবনে একটি মাত্র কমার্শিয়াল নাটক করেছিলেন l সেটি হলো শ্যামলী l মূক এক তরুণীর ভূমিকায় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় l নাটকটি ১৯৫৩ সালের ১৫ই অক্টোবর মুক্তি পায় ও প্রথম দফায় ৪৮৪টি অভিনয় হয় ১৯৫৫ সালের ১৩ই নভেম্বর পর্যন্ত l শ্যামলী থেকেই পেশাদার রঙ্গমঞ্চে বৃহস্পতি শনি রবি ও ছুটির দিন শোয়ের চল শুরু হয় l এই প্রথা পাবলিক থিয়েটারের অবলুপ্তি পর্যন্ত বহাল ছিল l শ্যামলী থেকে যে খ্যাতি ও অর্থপ্রাপ্তি ঘটে তাইতে উত্সাহিত হয়ে সলিল মিত্র আবার স্টারের সংস্কার শুরু করেন l প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহ স্টার l সেই সময়ে এই সংস্কারের জন্যে পাঁচ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল l কতদুর ভালবাসা থাকলে এ সম্ভব হয় তা দৈনিক বসুমতীতে উচ্ছসিত ভাষায় প্রকাশ পেয়েছিল l এ হেন স্টার থিয়েটার নানা মঞ্চসফল প্রযোজনার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে পরবর্তী দশকে l নীহার রঞ্জন গুপ্তের কাহিনী অবলম্বনে তাপসী নাটক মঞ্চস্থ হয় ১৯৬৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি l এই নাটকে নায়ক দীপকের ভূমিকায় ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় l অত্যন্ত সফল হয় এই নাটক ও l কত পরে ১৯৭৯\৮০ নাগাদ কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে সৌমিত্র নিজের পরিচালনায় করেন নামজীবন l ততদিনে তাঁর চিন্তা ভাবনায় মহান পরিচালক সত্যজিত রায়ের ছাপ সুস্পষ্ট l নাটকের ডিটেলিং দেখলে মনে হতে বাধ্য l অদ্ভুত ভাবে সেসময়ে কারো মনে হয়নি যে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে সস্তা হালকা শিল্প রচিত হয় l তৃপ্তি মিত্র প্রথম নায়িকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন সেতু নাটকে l বিশ্বরূপা তে l গ্রুপ থিয়েটারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুখ হয়েছিলেন তিনি l সেতু তেও তাঁর অভিনয় অসামান্য l সেতু বিশ্বরূপায় আর অঙ্গার মিনার্ভায l এই দুটি নাটকে আলোকসম্পাতে ছিলেন তাপস সেন l কী অসাধারণ সাধনা ছিল যে তাঁর l

স্টার থিয়েটারের গৌরবের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে l ১৮৮৮ সালের ২৫শে মে নসীরাম নাটক দিয়ে স্টারের যাত্রা শুরু l স্বয়ং গিরিশচন্দ্র এই নাটকটি নসীরাম ছদ্মনামে রচনা করেন l প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই স্টারেই স্বামী বিবেকানন্দ ভগিনী নিবেদিতাকে একটি অনুষ্ঠানে পরিচয় করিয়ে দেন সুধী সমাজে l সাধারণ রন্গালযের প্রতিষ্ঠা কাল ১৮৭২ l তার মাত্র ষোল বছরের মাথায় স্টার শুরু করে তার জীবন l প্রথম থেকেই স্টারের ভাগ্যে বৃহস্পতি l ১৯৩৮ সাল থেকে প্রায় তেত্রিশ বছর এই রঙ্গমঞ্চের দায়িত্বে ছিলেন সলিল কুমার মিত্র l এই সুদীর্ঘ তেত্রিশ বছরে স্টারে কত যে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে তা বলার নয় l এইসব নাটকের কুশীলবরা জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছিলেন l সলিল কুমার মিত্র প্রথম কর্মীদের জন্যে প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু করেন l স্টারের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে থিয়েটারের প্রতি অকুণ্ঠ দরদ নিয়ে পরিচালক, কতৃপক্ষ, শিল্পী ও কলাকুশলীরা সফল ও শিল্প গরিমায় উজ্জ্বল নাটক একাদিক্রমে উপহার দিয়ে গেছেন l তাই বড় রকমের বিপর্যয় স্টারের ভাগ্যে জোটেনি l কিন্তু হঠাতই সলিল মিত্র স্টারের দায়িত্ব রঞ্জিত পিকচার্স এর হাতে তুলে দেন l কারণ সম্পূর্ণ অজ্ঞাত l দিনটা ছিল ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের ৩১শে মার্চ l রঞ্জিতমল কাংকারিযা হন নতুন মালিক l বলা যায় স্টারের সৌভাগ্য লক্ষ্মী সেদিনই বিদায়ের লগ্ন স্থির করে ফেলেন l ধীরে ধীরে মানের অবনতি ঘটতে থাকে l নাট্যকার দেবনারায়ন গুপ্তের শেষ নাটক জনপদবধু অভিনীত হয় ১৯৭৩ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর। পারিবারিক উপভোগ্য কাহিনীর নাট্যকার হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ১৯৭৪ থেকে রঞ্জিতমল নিজেই সব দায়িত্ব নিয়ে ভাড়া করা লোক দিয়ে নিজের নামে নাটক রচনা, নির্দেশনার সব কাজ করাতেন। ১৯৮০ থেকে নাটকের মানের অবনতি ঘটতে থাকে। ১৯৮৭তে টগরী নাটক দিয়ে রঞ্জিতমলের অধ্যায় শেষ হয়। ১৯৯১তে যখন স্টারে আগুন লাগে তখন স্টার ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি ওখানে ঘটক বিদায় নাটক করছিলেন। ১৯৭৪, ওই সময়ে মাত্র দশ কি এগারো হব, দেখেছিলাম পরিচয় বলে একটি নাটক l শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় ও শমিতা বিশ্বাস ছিলেন মুখ্য ভূমিকায় l অভিনয় ভালো হলেও বড়দের মুখে শুনেছি নাটক রসোত্তীর্ণ হয়নি l বিশেষ সেই সময়ে উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটার, অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়ের নান্দীকার একের পর এক মননশীল নাটক মঞ্চস্থ করে চলেছে l তখনও নাটক দেখার অনুমতি জোটেনি l তবু রবিবার বা ছুটির দিনে সকালে স্টারে অফিস রিক্রিয়েশন ক্লাবের নাটক বৈকুন্ঠের উইল দেখেছিলাম l সরযু দেবী ছিলেন নাটকে l তিনি নাট্যজনের এতই শ্রদ্ধার পাত্রী ছিলেন যে শিল্পীরা তাঁকে সরযু মা বলে ডাকতেন l আমাদের খেলাধুলার জন্যে কাছাকাছি গোয়াবাগান পার্ক ছাড়া মাঠ ছিলনা l নানারকম নেশাভাঙ জনিত দুষ্কর্ম চলত বলে সেখানে যাওয়া মানা l ফলে স্টারের পেছনে স্টার লেন, রাজাবাগান, ক্ষুদিরাম বোস রোড এইসব এলাকায় ছোটাছুটি করে খেলতাম l বড় রাস্তায় যেতাম না l তবুও থিয়েটার আরম্ভ আর ভাঙার সময় স্টারের আশেপাশে যাওয়া বারণ ছিল l ভিড়ে হারিয়ে যেতে পারি এমন আশঙ্কা ছিল হয়ত l স্টারের গায়ে গ্রে স্ট্রীট ঘেঁষে একটা আতর আর জর্দার দোকান ছিল l ছেলেবেলায় সেইটি ছিল প্রবল আকর্ষণ l দোকানের সামনে ফুটপাতে দাঁড়ালে সুবাসে মাথা ঝিমঝিম করত l একটা বিষয় লক্ষণীয় যে স্টারে কখনই ক্যাবারে গার্ল দিয়ে তথাকথিত বস্ত্রবিপ্লব ঘটিয়ে বাজার ধরার চেষ্টা হয়নি। মানের অবনতি সত্বেও সুস্থ রুচির নাটক উপস্থাপনার চেষ্টা হত।



এখানে একটু বলা প্রয়োজন যে সে সময়ে কিভাবে এইসব থিয়েটার গুলো চালানো হত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হলমালিকের থেকে লিজে বা ভাড়ায় কেউ হল নিয়ে পরিচালনার দায়িত্বে থাকতেন। তিনিই থিয়েটার কোম্পানির কর্ণধার। থিয়েটারে অভিনেতা অভিনেত্রীরা বাঁধা মাইনেতে কাজ করতেন। বহু সময়ে কর্ণধার নাটক পরিচালনার দায়িত্বেও থাকতেন। নাট্যকারকে শো পিছু রয়্যালটি দেওয়া হত। কোনও কোনও সময়ে নাট্যকারকে মাইনে দিয়ে রাখার ঘটনাও ঘটেছে। পরিচালক তাই নানাপ্রকারে সফল ও জনমোহিনী নাটক মঞ্চস্থ করতে চেষ্টা করতেন। বিভিন্ন সময়ে দেখা যায় যে কুশীলবদের জমকালো পোশাক, অনর্থক নাচ গান, বা মঞ্চে মায়াজাল, ইংরেজিতে যাকে বলে ইল্যুশন, সৃষ্টি করে দর্শকের চিত্তজয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এসব সমালোচিত হয়েছে বারবার। কারণ এসবই মূল নাটক ও অভিনয় থেকে দর্শকমনের একাগ্রতা হরন করে। উদাহরনে বলা চলে অঙ্গার নাটকের শেষ দৃশ্যটি। দৃশ্যটি বড়ই ট্র্যাজিক। কয়লাখনির খাদের মধ্যে কয়েকজন কর্মী আটকে পড়েছে। এদিকে হু হু করে জল বাড়ছে খাদে। অবশেষে এই জলের মধ্যে ডুবে তাদের মৃত্যু হোল। দৃশ্যটি তাপস সেন অদ্ভুত নৈপুণ্যে নির্মাণ করেন। মঞ্চের ভেতর খাদের জল বাড়ার দৃশ্য এত অপূর্ব হয়েছিল যে হল হাততালিতে ফেটে পড়ত। মাঝ থেকে যে মর্মান্তিক দৃশ্যে মানুষ মরছে সেই ট্র্যাজেডি কেউ অনুভব করতনা। সব ছাপিয়ে তাপস সেনের আলোর কারসাজি মুগ্ধ করত দর্শককে। বলা ভালো স্বয়ং নাট্যাচার্য শিশির কুমার মঞ্চে ইল্যুশনের পক্ষপাতী ছিলেন না। সুতরাং আধুনিক নাটকের আঙ্গিক ও প্রয়োগ নিয়ে যত কথাই হোক না কেন এসবে পেশাদার রঙ্গমঞ্চের ভুমিকা যে অনস্বীকার্য তা স্বীকার করে নেওয়াই ভালো। এই যে থিয়েটার, এর দর্শক কারা ছিলেন, জানলে এখনকার প্রযোজকরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন। এখন যখন হলে দর্শক টানার হাজার চেষ্টা করেও হাউসফুল বোর্ড ঝোলানো প্রায় মিথ তখন থিয়েটার পাড়ায় দিনের পর দিন হলগুলোতে হাউসফুল বোর্ড ঝুলত। অগ্রিম কাউন্টারেই টিকিট নিঃশেষ হয়ে যেত। শুধু যে কলকাতার লোকজন বা কাছাকাছি মফস্বলের লোক আসত নাটক দেখতে তা মোটেই নয়। অনেক দূর থেকেও মানুষ আসত নাটক দেখতে। পুজোর কেনাকাটার সঙ্গে নাটক দেখা অবিচ্ছেদ্য ছিল। নিজের পরিবারেও দেখেছি বার্ষিক ছুটিতে আসা দূরাগত আত্মীয় স্বজন ভ্রমণসুচীতে নাটক দেখা ও রেখেছেন। নামী শিল্পী, অনবদ্য অভিনয়, অপূর্ব আলোক সম্পাত, নাটকের আবেদন ইত্যাদি ইত্যাদি খবরের কাগজ বাহিত হয়ে শুধু মফস্বল নয়, দূর প্রবাসেও ছড়িয়ে পড়ত। ফলশ্রুতি এই বিপুল দর্শক সমাগম। একেবারে শুরুর দিকে সম্পন্ন গ্রামীন ভদ্রলোকেরাও আসতেন। হোটেলে থেকে থিয়েটার আর কালীঘাট ঘুরে যেতেন। ক্রমশ গণ্ডী সংকুচিত হতে থাকে। অবশ্য সত্তরের দশক পর্যন্ত এই ঢল অব্যাহত ছিল। তবে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে বিপুল মুনাফার চিত্র কখনই ধরা পড়েনি। অনেক আগে দর্শক টানতে নাটক নামান হত পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে। যাতে তার জাঁকজমকে মানুষ আকৃষ্ট হয়। হতও হয়ত। তবে নাটক নামাতে যে পরিমাণ ব্যয় হত, সেট পোশাক ইত্যাদি জনিত, তার খুব স্বল্প অংশই উঠে আসত। মাঝে কিছু ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু তা কখনই সামগ্রিক চিত্র নয়। স্টারের পর আলোচনায় রাখলাম মিনার্ভাকে। যদিও এই অতীতচারিতা বিভিন্ন দিকে ছুটে যাচ্ছে বারবার, কিন্তু তা খানিকটা স্বেচ্ছাকৃত। সামগ্রিক ছবি ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস মাত্র। ১৮৯৩ সালে ৬নং বিডন স্ট্রীটের গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রেক্ষাগৃহ নিশ্চিন্হ হয়ে গেলে প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের দৌহিত্র নগেন্দ্রভূষণ মুখোপাধ্যায় ওই জমির ওপর মিনার্ভা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। ২৮শে জানুয়ারী সেকশপীয়ারের ম্যাকবেথের মঞ্চরুপ নিয়ে গিরিশচন্দ্র মিনার্ভার দ্বারোদঘাটন করেন। এরপর ৫ই ফেব্রুয়ারী মুকুল মঞ্জুরা, ২৫শে মার্চ আবু হসেন, ও ২৩শে ডিসেম্বর জনা, প্রভৃতি বিখ্যাত নাটকগুলি অভিনীত হয়। এরপর ১৮৯৫ সালের গিরিশচন্দ্র আবার (আগে স্টারে অভিনীত) প্রফুল্ল নাটকটি নঞ্চস্থ করেন। নাটকে তিনি যোগেশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁর অভিনয় এতই অনবদ্য হয়েছিল যে নট-নাট্যকার অপরেশচন্দ্র তাঁর রঙ্গালয়ে ত্রিশ বছর বইতে লিখেছেন, - গিরিশের যোগেশের পাশে অমৃতলালের (স্টারে অমৃতলাল যোগেশ সাজতেন) যোগেশ হীনপ্রভ হইয়া পড়িল। মনে হইল একজন যথার্থ যোগেশ, আর একজন যোগেশ সাজিয়াছেন। এরপরই ১৮৯৬ সালের ২৩শে মার্চ গিরিশ মিনার্ভার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করেন। এই সময়ে অর্ধেন্দুশেখর মিনার্ভার দায়িত্ব নেন। এরপর গিরিশচন্দ্র আবার এক বছরের জন্য মিনার্ভায় ফেরেন। মিনার্ভার ইতিহাস বড়ই উথাল পাথাল। অনেকগুলি নাটক কিন্তু এই অস্থির সময়ের মধ্যেও অভিনীত হয়। ১৯০৪ সালে অমরেন্দ্রনাথ দত্ত মিনার্ভার দায়িত্ব দেন বন্ধু চুনীলাল দেবকে। এরপর মিনার্ভার লিজ হস্তান্তরিত হয় মনোমোহন গোস্বামীর হাতে। এত কিছুর মাঝেই মিনার্ভায় গিরিশচন্দ্রের বলিদান ও সিরাজউদৌলা, দ্বিজেন্দ্রলালের রাণা প্রতাপ সিংহ নাটক মঞ্চস্থ হয়। অথচ দেখতে পাচ্ছি যে এর মাঝে হাইকোর্ট নিযুক্ত মিনার্ভার রিসিভার শেলী ব্যানার্জি মিনার্ভা নিলামে দিলেন। গিরিশচন্দ্রের বুদ্ধিতে মনোমোহনবাবু ষাট হাজার টাকায় থিয়েটারটি কিনে নেন। এরপর নানা মালিকানা, অংশীদারি পরিচালনার চক্রে পড়ে অবশেষে ১৯২২ সালে মিনার্ভা আরও একবার ভীষণ আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায়। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে এভাবে পুড়ে যাওয়া কোনও নতুন ট্রেন্ড নয়। আজ যখন স্টার রংমহল, বিশ্বরুপা আগুনে পুড়ে তাদের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিচ্ছে তখন আমাদের মতন কিছু স্পর্শকাতর, অতীতবিলাসী বাঙালি ভাবছি এ কী হোল! এমন করে অস্তিত্বের বিলুপ্তি! আরও কিছু বছর পরে তো সমসাময়িক প্রজন্ম জানতেই পারবেনা যে পেশাদার রঙ্গমঞ্চ বলে কিছু ছিল আর বেশ কিছু মানুষ সেই সব রঙ্গমঞ্চে কী অদ্ভুত ভালবাসায় দারিদ্র ভুলে, অপমান ভুলে দিনের পর দিন ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। নাটকের ইতিহাস। শুধু মনে হয় আর একটু সচেতনতা দরকার ছিল বোধ হয়। যাই হোক তবু মিনার্ভা চলতে থাকে। ১৯৫১ সালেও দেখতে পাই শরৎচন্দ্রের চন্দ্রনাথ অভিনীত হয়। এই নাটকের প্রধান তিনটি ভূমিকায় অহীন্দ্র চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস ও সরযূ দেবী অভিনয় করেন। ১৯৫৩ সালে মিনার্ভার দুঃসময়ে রাসবিহারী সরকার এসে দাঁড়ান মিনার্ভার পাশে। থিয়েটার হলটি ভাড়া নিয়ে মঞ্চস্থ করেন ঝিন্দের বন্দী। নাটকটি অসাধারণ জনপ্রিয় হয়। অনেকেই মনে করেন এই নাটক নাটকের ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন। পঞ্চাশের দশকে বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠীও এখানে নাটক করেছেন। রক্তকরবী মঞ্চস্থ হয়। তবে ব্যবসায়িক থিয়েটারের সঙ্গে পাল্লা না দিতে পেরে ছেড়ে দিতে হয় এই মঞ্চ। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটার মিনার্ভাতে নাটক করে। শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে, উৎপল দত্তের অধিনায়কত্বে লিটল থিয়েটার মিনার্ভায় নিয়মিত অভিনয় শুরু করে। ১৯৫৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর প্রথম অভিনীত হয় অঙ্গার। পণ্ডিত রবিশঙ্কর সুর সংযোজনায়। আর তাপস সেনের সেই ঐন্দ্রজালিক আলোকসম্পাত। অত্যন্ত জনপ্রিয়তার সঙ্গে অঙ্গার দু বছর ধরে চলে। এরপর আসে ফেরারী ফৌজ। এতেও তাপস সেন স্বীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। বলা যেতে পারে লিটল থিয়েটারের আগমনে মিনার্ভা আবার প্রাণ ফিরে পায়। উৎপল দত্ত পরপর অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম, সেকস্পীয়ারের চারশ বছরের জন্মোৎসব উপলক্ষে A Midsummer Night’s Dream অবলম্বনে চৈতালি রাতের স্বপ্ন, ওথেলো, জুলিয়াস সীজার, প্রভৃতি নাটক উপহার দিতে থাকেন। অবশেষে জাহাজের নাবিক বিদ্রোহের পটভূমিকায় কল্লোল মঞ্চস্থ হয়। নাটকের নির্মাণেও বিপ্লব ঘটে যায়। এখানে বরং উৎপল দত্ত সম্বন্ধে দু চার কথা বলে নেওয়া যাক। কী বলেছিলেন তিনি যখন কল্লোল বিরূপ সমালোচনায় বিদ্ধ হয়? বলছেন – কলকাতার দৈনিক পত্রিকাগুলোর নাট্যসমালোচকবৃন্দ থিয়েটার নাটক বা অন্য কলাবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞানের জন্য বিশেষ পরিচিত নন। কিন্তু তারা বরাবরই তাদের প্রভুদের সেবাদাসত্বে সমর্পিতপ্রাণ বিশ্বস্ত সৈনিক। এরাই কল্লোল নাটকের সমালোচনার নামে যেমন খুশি কাল্পনিক গুঁতোগুঁতি শুরু করেছেন। চীনাদের বিরুদ্ধে প্রবল জাতিগত বিদ্বেষের কারণে আমরা কল্লোল নাটকে এদের ঢুকতে দিইনি। কিন্তু এদের প্রভুদের নির্দেশে এরা টিকিট কেটে ঢুকলেন এবং সমালোচনার নামে ইতিহাসের অজ্ঞাত সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে দুঃসাহস দেখালেন। (Towards a revolutionary theatre) . এমন কড়া সমালোচনা স্বয়ং নির্দেশক করছেন এ একমাত্র উৎপল দত্তের সিগনেচার উবাচ। এই আধুনিকতায় দাঁড়িয়েও কিন্তু এই বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব পূর্বসূরিদের প্রতি তাঁর চরম শ্রদ্ধা রেখে গেছেন। ভিত তৈরি নাহলে যে কিছুই হতনা। দেখা যাক তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদনের ভঙ্গীটি। “এটা অনস্বীকার্য যে নবাব বাদশাদের দরবারে যেমন রাগসঙ্গীতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুশীলন হত বা উচ্চতম স্তরের শেরেশায়েরি হত, সেটা এইসব নয়া ব্যবসায়ীদের বিশৃঙ্খল মাতাল আসরে সম্ভব ছিলনা। কিন্তু এইসব আসরে জনতার প্রবেশাধিকার ছিল। যা বাদশার দরবারে জীবনে কখনও হবার আশা ছিলনা। এভাবে শিল্পের গনতন্ত্রীকরন হল, এবং এটি বুর্জোয়াদের আঘাতে সৃষ্ট। এভাবে কাব্য সঙ্গীত অভিনয়ের বৃহৎ এক দর্শকগোষ্ঠী তৈরি নাহলে বাংলা থিয়েটারের জন্মই হতনা। গিরিশবাবুরা সাহস করে টিকিট বেঁচে নাটক করার কথা ভাবতেই পারতেন না। দর্শকদের চাহিদা মেটাতে গিয়েই পেশাদার নাট্যশালার সৃষ্টি হয় সারা দুনিয়ায়। এবং রাজা রাজড়াদের একচেটিয়া অধিকার ভেঙে নাটক ও সঙ্গীতকে আপামর জনতার নাগালের মধ্যে আনে বুর্জোয়ারাই” (আশার ছলনে ভুলি)। তবে এই সাধারণ জনের কাছে তুলে ধরা সত্বেও নাটকের কলাকে যে বরেন্যজন চেষ্টা করে গেছেন উচ্চতর শিল্পে উন্নীত করতে সেও তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেছেন যখন তিনি গিরিশচন্দ্রের মঞ্চসজ্জা নিয়ে বলছেন – গিরিশবাবু অবশ্যই মঞ্চকৌশলের ক্ষেত্রে নতুন যুগের প্রবর্তক। ধরা যাক তাঁর কমলে কামিনী নাটক। সমুদ্রযাত্রার দৃশ্যে মঞ্চ জোড়া বিশাল তরণীতে শ্রীমন্ত সওদাগর ও নাবিকরা। পিছনে দৃশ্যপটটা সচল। সামুদ্রিক ঝড়ও দেখানো হয়েছিল মঞ্চে। গিরিশের প্রায় সব নাটকেই মঞ্চ কৌশলের সচেতন উপস্থিতি আমরা লক্ষ করি। শঙ্করাচার্য চলেছেন আর নদীর স্রোত তাঁকে অনুসরণ করছে, বা জনা নাটকে অকস্মাৎ গাছে আগুন জ্বলে ওঠা এবং দেখতে দেখতে পত্রপুষ্পহীন দগ্ধ বৃক্ষকাণ্ডের দাঁড়িয়ে থাকা – এ সবে শুধু মঞ্চনিপুণ গিরিশকে পাইনা, পাই কবি গিরিশচন্দ্রকে (আশার ছলনে ভুলি)। অথচ এই মানুষটিই নিজের অনুপম প্রয়োগের কৌশল বলতে গিয়ে বলছেন – থিয়েটার এবং দর্শক পেলে আমি যবনিকা বাদ দেব। তারপরে বাদ দেব উইংস বর্ডার প্রভৃতি। তারপর হটাবো সীন জাতীয় জিনিস। মেঝেটাকে নানা আকারের বেদী দিয়ে ভরে দেব। এলোমেলো শ্রমিক এদিক ওদিক সিঁড়ি দিয়ে ... অভিনেতা যাতে চলতে গেলেই সিঁড়ি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। ঝড় বোঝাতে ব্যবহার করব ক্রেস এর আঁকা কালো রেখা কাঁটা পর্দা বা ব্রেশট বর্ণিত বিদ্যুৎ আঁকা পর্দা। জল বোঝাতে ব্যবহার করব নীল পোশাক পরা জনা কুড়ি নর্তকী। আগুন বোঝাতে হয়ত উদয়শংকর প্রচলিত কিছু লাল রিবন নাড়াবো। বৃষ্টি বোঝাতে ছাতা খুলে ধরব। যুদ্ধ বোঝাতে পর্দা আর বেদীগুলো নাড়াবো ভীমবেগে (চায়ের ধোঁয়া)। এই উত্তরণ অনুশীলন যোগ্য। মিনার্ভা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে এই তথ্য উদ্গীরনে আমার ব্যক্তিগত আবেগ নিঃসন্দেহে কাজ করেছে। নাত্যশিল্পের একশ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে মিনার্ভায় পা রেখেছেন প্রতিটি যুগের প্রায় প্রতিটি কিংবদন্তী নাট্যব্যক্তিত্ব। মিনার্ভার জীবনযুদ্ধ যতই প্রবল হয়েছে ততই সফল হয়েছে সেখানে প্রতিভার বিকাশ। আর শেষ পর্যন্ত উৎপল দত্তের আবির্ভাবে মিনার্ভা মুছে দিয়েছে পেশাদার নাটক ও গণনাট্যের বিভাজন। বড় অদ্ভুত এই বিভাজন। শেষকথা তাত্বিকেরা বলবেন, আমার সীমাবদ্ধ বোধে মনে হয় কমার্শিয়াল থিয়েটার রুজির জন্য, মুনাফার জন্য শিল্পের শর্তের সঙ্গে কোথাও একটা আপস করে, যেটা গ্রুপ থিয়েটার করেনা। যদিও বর্তমানে এ ধরনের আলোচনাই চলেনা। শিল্প মানোত্তীর্ণ কিনা বলার সময়ে বন্ধুদের মধ্যে এধরনের উক্তি করে বড়ই বিপদে পড়েছি। হয়ত ব্যাখ্যা দিয়েছি যে এ শিল্প মেধা বা মননের কাছে আবেদন রাখেনি, এর আবেদন নিতান্তই জৈব। তখন দেখেছি সেই ছোট আলোচনা সভাতেও বিরুদ্ধ মত উঠে এসেছে। শিল্প শিল্পই। তার ভালো খারাপ হতে পারেনা। শিল্প সমাজ জীবনের প্রেক্ষাপট। সমাজ যদি আদর্শহীনতা ও অবক্ষয়ের শিকার হয় তবে শিল্পে তার প্রভাব পড়বেই। এখন আমিও এ প্রসঙ্গে সহমত।



কথায় বলে ধান ভানতে শিবের গীত! সেইরকম রঙ্গমঞ্চের ধ্বংসের ইতিহাস বলতে গিয়ে নাট্যজগতের মানুষজনের কথা এসে যায়। এসে যায় তাঁদের কথা যারা নাটকের ইতিহাসে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। সেটা স্বাভাবিক। কারণ নাটক ছাড়া নাট্যশালার কিবা অস্তিত্ব! শুরু করা যাক আরও একটি ঐতিহ্যশালী রঙ্গমঞ্চের কথা। রঙমহল থিয়েটার। স্টারের ফুটপাত ধরে কলেজ স্ট্রিট মুখো হাঁটতে শুরু করলে কিছুটা গেলে একই দিকে পড়বে রঙমহল থিয়েটার। ১৯৩১ সালের ১৭ই বৈশাখ ৬৫/১ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে এই নাট্যশালার উদ্বোধন হয়। একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলি, নাট্যাচার্য শিশির কুমার এর কিছুদিন আগেই দলবল নিয়ে আমেরিকা সফরে যান। এখন যারা নাটক করেন আশা করি আশা করি তাঁরা সকলেই এ বিষয়টি অবগত আছেন। পূর্বসূরিদের কাছে আমাদের যে কত ঋণ! রঙমহল উদ্বোধন করেন নট-নাট্যকার অপরেশচন্দ্র লাহিড়ী। এই সময়ে শিশির কুমার ও সতু সেন আমেরিকা থেকে সদ্য ফিরেছেন। সতু সেনকে তাপস সেনের পূর্বসূরি বলা চলে। তিনি তখন অসামান্য দক্ষতায় শিল্প নির্দেশনা ও আলোক সম্পাতের কাজ করছেন। ১৯৩১ সালে নাট্যনিকেতনে অভিনীত ঝড়ের রাতে নাটকে সতু সেনের এই অদ্ভুত আলো ও মঞ্চ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। শ্রীযোগেশ চৌধুরীর পরিচালনায় রঙমহলে প্রথম শ্রীশ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া নাটক মঞ্চস্থ হয়। তারপর ১৯৩৩ সালে শিশিরকুমার মহানিশা নাটকের পরিচালনার দায়িত্বে। মঞ্চ ও আলো সতু সেন। সতু সেন প্রথম এই থিয়েটারে ঘূর্ণায়মান মঞ্চ তৈরি করেন। সে সময়ের নিরিখে এই কাজ একান্তই বৈপ্লবিক। তখন এত টেকনোলজির উন্নতি হয়নি। এই নাটকটিও নাটকের ইতিহাসে এক মাইলস্টোন। ১৯৩১ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত রঙমহলে বিভিন্ন বিখ্যাত পরিচালক ও নটনটীদের নিয়ে বহু সার্থক নাটক মঞ্চস্থ হয়। যোগেশচন্দ্র চৌধুরীর নাট্যরূপে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিটেকটিভ, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের স্বামি স্ত্রী ও তটিনী বিচার, বিধায়ক ভট্টাচার্যের মেঘমুক্তি, মাটির ঘর, বিশবছর আগে, প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের রত্নদীপ-নাটক বিধায়ক ভট্টাচার্য, প্রভৃতি মঞ্চস্থ হয়। এরপর রঙমহলের দরজা বন্ধ হয়। আবার জুন মাসে যামিনী মিত্র দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কে নিয়ে রঙমহলের দরজা খোলেন। বিধায়ক ভট্টাচার্যের রক্তের ডাক, তুমি ও আমি মঞ্চস্থ হয়। কিন্তু যামিনী মিত্র দায়িত্ব ছেড়ে দেন। ১৯৪২ থেকে ৪৭ এর মধ্যে রঙমহলে অভিনীত অনেক নাটকের মধ্যে রামের সুমতি, সন্তান, বাংলার প্রতাপ, রাজপথ, এবং সেই তিমিরে রঙমহলের আর্থিক সাফল্য এনে দেয়। অহীন্দ্র চৌধুরী, জহর গাঙ্গুলি, নিরমলেন্দু লাহিড়ী, সন্তোষ সিংহ, মিহির ভট্টাচার্য, রানীবালা, সুহাসিনী, প্রমুখ বিশিষ্ট অভিনেতা অভিনেত্রী তখন রঙমহলের সাথে যুক্ত। কিন্তু অভিনেতা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন রঙমহলের লেসী রূপে যথেষ্ট দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করলেও তাঁর বেহিসেবী খরচে বিপুল ঋণভারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরী তখন নিজের উদ্যোগে একের পর এক নাটক নামান। রিজিয়া ও মেবারপতন দারুন সফল হয় তবুও শরৎচন্দ্র সম্পূর্ণ ঋণমুক্ত হতে পারলেন না। কোর্টের আদেশে তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হন ও তাঁকে থিয়েটারের কর্তৃত্ব ছাড়তে হয়। সীতানাথ মুখোপাধ্যায় এরপর রঙমহলের ভার নেন। তাঁর আমলে দেবনারায়ন গুপ্তের নাট্যরূপে নিষ্কৃতি নাটক উল্লেখযোগ্য। অভিনয় হয় ১৯৫০ সালের ২রা অক্টোবর। এই নাটকের আর্থিক সাফল্য রঙমহলে স্বচ্ছলতা এনে দিলেও মামলা পিছু ছাড়েনা। ১৯৫৪ সালে জিতেন বসু ও বিঠল ভাই মানসাটা থিয়েটারের লেসী হন। সেই বছরে নভেম্বরে ডঃ নীহাররঞ্জন গুপ্তের উল্কা মঞ্চস্থ হয়। অত্যন্ত জনপ্রিয় নাটকটি প্রায় দু বছর ধরে চলে। এরপর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরিচালনায় তারাশঙ্করের কবি। একটা কথা লক্ষ্য কড়া যাচ্ছে যে সেসময়ে বিখ্যাত কথাসাহিত্য থেকে নাটক করার চল ছিল। ১৯৬২ সালে রঙমহলের লেসীদের তরফে কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় যে হল ভাড়া দেওয়া হবে। এমনকি গুজব ওঠে যে এটি সিনেমা হলে রূপান্তরিত হবে। স্বভাবতই নাটকের শিল্পী ও কলাকুশলীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁদেরই অক্লান্ত পরিশ্রমে এতগুলি সফল নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। তাঁরা ডঃ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রের কাছে এব্যাপারে আবেদন জানালে তিনি মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে বিষয়টি জানান। তাঁর মধ্যস্থতায় শেষপর্যন্ত ঠিক হয় লেসীরা অতঃপর শুধু কলাকুশলীদের বেতন দেবেন। নাটকের টিকিট বিক্রির অ্যাঁয় থেকে শিল্পীরা হলভাড়া দেবেন লেসীদের, আর অবশিষ্ট আয় নিজেদের মধ্যে বেতন হিসেবে ভাগ করে নেবেন। নতুন ব্যবস্থায় শিল্পীদের পক্ষে সরযূ দেবী ও জহর রায় এই দায়িত্ব গ্রহন করেন। অর্থাৎ শিল্পীরা নিজেদের রুজি ও নাটক বাঁচাতে লেসীদের এই দাবী শিরোধার্য করার ঝুঁকি নেন। অন্যথায় হল হাতছাড়া হওয়া আটকানো যেতনা। এঁদের প্রথম নাটক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শ হিন্দু হোটেল। ১৯৬২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি প্রথম অভিনয়। ১৯৬২ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে এই শিল্পীগোষ্ঠী বারোটি নতুন নাটক মঞ্চস্থ করে। এর মধ্যে বিধায়ক ভট্টাচার্যের অতএব, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের নহবত, সুনীল চক্রবর্তীর আমি মন্ত্রী হব, মনোজ মিত্রের বাবাবদল উল্লেখযোগ্য। এরপর ও জহর রায় মৃত্যুকাল পর্যন্ত রঙমহলের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯৭৭ সালের ১লা অগাস্ট পরলোকগমন করেন। বর্তমানে এই থিয়েটার হল আর নেই। এখানে এখন সিগনাম এরিস্ট্রো বলে একটি শপিং মলের নির্মাণ জারি। ২০০১ সালে হলে আগুন লাগে। এর আগে হলটি বিয়েবাড়ি ও প্রদর্শনী উপলক্ষে ভাড়া দেওয়া হচ্ছিল। তদন্তে প্রকাশ যে একটি শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন লাগে। যদিও স্যাবোট্যাজ এর তত্বওঅনেকে সামনে এনেছেন। এতকালে নিশ্চয় সেই হলের পরিবর্তে নতুন দোকানবাড়িটির কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। শুধু এক সময়ের বাংলার সংস্কৃতির পীঠ এই মঞ্চগুলো আর নেই। রঙমহলের জীবনযাত্রা মাত্র সত্তর বছরেই শেষ হয়ে গেল। খুব আশ্চর্য লাগে যখন দেখি অন্য দেশে ঐতিহ্যপূর্ণ কোনও ভবন, যা সেখানকার সংস্কৃতিকে বা ইতিহাসকে কোনও না কোনোভাবে ধনী করেছে, তার সংরক্ষণে সরকার, সাধারণ মানুষ, ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর এক সাথে হাতে হাত রেখে কাজ করে চলেছে, সেখানে আমাদের চোখের সামনে সংস্কৃতির ইতিহাস, মানচিত্র সব ধ্বংস হয়ে চলেছে, আমাদের কিছু ভ্রূক্ষেপ নেই। আধুনিক অর্থনীতির গড্ডালিকাতে এক একটি ভোগায়তন জন্মেই চলেছে। যেন আমাদের শুধু চোখ ধাঁধানো পোশাক গয়না জুতো চাই, আসবাবে ঠাসা কামরা চাই, আর পেটে ঢোকানোর জন্য সুখাদ্য চাই। এছাড়া আর কোনও ক্ষুধা নেই, থাকতেই পারেনা।

যে চারটে প্রধান রঙ্গমঞ্চের কথা বলব বলে লেখা শুরু করেছিলাম তার মধ্যে শেষ হোল বিশ্বরুপা। যে নাট্যনিকেতন মঞ্চে ঝড়ের রাতে নাটকে সতু সেন ঝড় তোলেন সেই মঞ্চ শিশির কুমার লিজ নেন ১৯৪২ সালে। নামকরণ হয় শ্রীরঙ্গম। তার আগে ১৯৩২ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে সেখানে ষোলটি নাটক সেখানে অভিনীত হয়। নাট্যনিকেতনের শেষ নাটক তারাশঙ্করের কালিন্দী। তারপরই শ্রীরঙ্গম। সূচনাকাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত অভিনীত নাটকগুলি হোল, মাইকেল, বিপ্রদাস, বিন্দুর ছেলে, ও দুঃখীর ইমান। প্রতিটি নাটকেই প্রায় নাট্যাচার্যর অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর ছিল। শুধু বিন্দুর ছেলে নাটকে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি অভিনয় করেননি। কিন্তু দারুন ছিল পরিচালনা। ১৯৪৬ এর পর নাট্যাচার্য আর্থিক লাভালাভকে তুচ্ছ করে পরীক্ষামূলক ভাবে কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ করেন। এর মধ্যে দুঃখীর ইমান ও পরিচয় নাটক দুটি উল্লেখযোগ্য। শিশির কুমারের নটজীবনের শেষ ঐতিহাসিক নাটক তখত ই তাউস। এই নাটকে জাহান্দার শাহ্‌র ভুমিকায় তাঁকে মানুষ মনে রেখেছে। বলিষ্ঠ মঞ্চায়ন। দুঃখের কথা হোল পরীক্ষামূলক নাটকের প্রযোজনার ফলে তাঁকে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হোল। ১৯৫৩ সালে প্রশ্ন নাটক মঞ্চস্থ হয়। অহীন্দ্র চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস, জহর গাঙ্গুলি, সরযূ দেবী, প্রমুখের প্রবল চেষ্টায়ও নাট্যাচার্য শ্রীরঙ্গমকে ধরে রাখতে পারলেননা। ১৯৫৬ সালে সরকার ব্রাদার্সের হাতে শ্রীরঙ্গমের মালিকানা হস্তান্তর হয়ে যায় এবং তাঁরা হলটিকে নতুন করে ঢেলে সাজান। তাঁদের প্রযোজিত প্রথম নাটক তারাশঙ্করের আরোগ্য নিকেতন। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয়। এখানে উল্লেখের প্রয়োজন আছে যে, নাট্যাচার্য শিশির কুমারের মূল্যায়ন কথাটার অনেক ভার। আমার মত অর্বাচীনের এই ধৃষ্টতা অমার্জনীয়। বরং শ্রদ্ধায় দুটো কথা নিবেদন কড়া যাক। পরবর্তী কালে যারা অপেশাদার রঙ্গমঞ্চেও নাটক নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন, নাটককে একটি জনমোহিনী শিল্পমাধ্যম থেকে মননশীল চারুশিল্পে উত্তরণ ঘটিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই নাট্যাচার্যের কাছে কোনও না কোনোভাবে ঋণী। ১৯৫৭ সালের ৬ই বৈশাখ মঞ্চস্থ হয় বিধায়ক ভট্টাচার্যের নাটক ক্ষুধা। বিশ্বরুপার দ্বিতীয় নাটক। এই নাটক অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। পরপর অসামান্য সব নাটক নামতে থাকে। এরপরই নামে সেতু। এই নাটকে তৃপ্তি মিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আবার তাপস সেনের সেই দারুন আলোকসম্পাত। মঞ্চের ওপর চলন্ত রেলগাড়ির ইঞ্জিনের আলো বিস্ময়কর রকমের জীবন্ত হয়ে উঠত। একটানা চলার ক্ষেত্রে সেতু রেকর্ড সৃষ্টি করে। ১৯৬৭/৬৮ সাল পর্যন্ত সরকারদের তত্ত্বাবধানে পরপর রঙ্গিনী, এক পেয়ালা কফি, আগন্তুক ইত্যাদি নাটক চলে। আগন্তুক ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রায় দুবছর ধরে চলে। উপরোক্ত শেষ তিনটে নাটকে থিয়েটার সেন্টারের শিল্পীরা অভিনয় করেন। পরিচালনা তরুন রায়ের। বিশ্বরুপায় এরপর রাসবিহারী সরকার সরাসরি পরিচালনায় আসেন। তাঁর প্রথম সফল নাটক বিমল মিত্রের কাহিনী অবলম্বনে বেগম মেরী বিশ্বাস। এখনও যারা স্মৃতিচারণ করতে পারেন সেইরকম প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে তুলে ধরছি এক উদ্ধৃতি। ইনি অন্য কেউ নন, স্বয়ং বিধায়ক ভট্টাচার্যের কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীবিমোচন ভট্টাচার্য। সেতু নাটক চলাকালীন তাঁর অভিজ্ঞতাও কিছুটা ধরা পড়ে।

“কি এমন ছিল পেশাদারী মঞ্চে ? মহিলা অভিনেত্রীদের ছোটরা ডাকতেন মা বলে ,প্রভা মা , আঙ্গুর মা , ইন্দু মা , সরজু মা । আমার নিজের দেখা সেই অন্তরঙ্গ পরিবেশ । এটা পাল্টিয়ে গেল যখন তৃপ্তি মিত্র এলেন সেতু নাটকে অভিনয় করতে। ম্যাডাম ডাক চালু হল ।নতুন নাটক যখন পড়া হত আগের নাটকের সবাই গোল হয়ে বসতেন । নাটক পড়া হয়ে গেলে পরিচালক বলে দিতেন কোন চরিত্রের জন্যে কাকে ভাবা হয়েছে । দেখা যেত কেউ কেউ বাদ পড়েছেন । থিয়েটার এর টাকাটাই তাঁদের স্থায়ি রোজগার ছিল । ফলে বেকার হয়ে যাবার ভয়ে নাট্যকারের কাছে ছুটতেন তাঁরা ।নাট্যকার লিখেও দিতেন কোন ছোট চরিত্র। ব্যাস , অন্তত এক দু বছরের জন্যে নিশ্চিন্ত হতেন তাঁরা”।

রাসবিহারী সরকারের পরিচালনায় শঙ্করের চৌরঙ্গী বিশ্বরুপার আর এক মাইলস্টোন। এ নাটকে প্রথম মঞ্চে ক্যাবারে দেখানো হয়। মিস সেফালি ছিলেন সেই নৃত্যশিল্পী। গল্পের প্রয়োজনে হোটেলে এই নাচের দৃশ্যের অভিনয় হত। এর জন্য চৌরঙ্গীর গায়ে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তকমা লাগে। সে সময়ের কিছু স্মৃতির উল্লেখ করি। বিশ্বরুপা ছিল গ্রে স্ট্রিট থেকে শুরু হওয়া ক্ষুদিরাম বোস রোডের শেষ মাথায়। আমাদের খেলার এলাকায় পড়ে। খেলতে খেলতে কখনও চলে গেছি। ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুযোগে মাঝে মাঝেই গ্রিনরুমে ঢুকে পড়তাম। বলা বাহুল্য শো শুরুর বেশ আগে। তখন মেক আপ চলছে। মনে পড়ে তরুন কুমার তাঁর বিরাট ভুঁড়ি নিয়ে বসে মেক আপ নিতেন। আমি কখনও তাঁর ভুরিতে খোঁচা দিয়ে দেখতে চেয়েছি ওটা সত্যিই ভুঁড়ি, নাকি বানানো। ছোট বেলায় হাটেবাজারে ছবিতে সেই পেট থেকে কলের মতন জল পড়ার দৃশ্য মনে করে ভাবতাম এত বড় ভুঁড়িতে জল না হয়ে যায়না। উনিও স্নেহপূর্ণ প্রশ্রয়ে কখনও কিছু বলেননি। বরং টুকরো টুকরো কথায় গল্প চালিয়ে যেতেন। বাবার বিশেষ বন্ধু ছিলেন অজয় গাঙ্গুলি। তিনিই বরং দেখতে পেলে পাঠিয়ে দিতেন। যাও এখান থেকে। এটা বড়দের জায়গা। তখন প্রাপ্তবয়স্কদের নাটক চলছে। একদিন বাবা কটা সংলাপ লেখা কাগজ হাতে দিয়ে বললেন যা বুড়োদা কে দিয়ে আয়। কিসের সংলাপ আর মনে নেই। তো সেই কাগজের তাড়া নিয়ে গিয়েছি ওঁকে দিতে। উনি বললেন তাই তো তুই এলি তোকে কি দেখাই? বলে মুখের পেশি স্থির রেখে একটা কানকে অদ্ভুত ভাবে নাড়াতে লাগলেন। আমি অবাক। খুব চেষ্টা করলাম নিজেও, যদি পারি। অবশ্যই হলনা। উনি কাছে বসিয়ে বললেন আমি তো বুড়ো, আমার মতন বুড়ো হ তখন পারবি। ছোট বেলা থেকে কত কানমলা খেয়েছি, তাইতেই কান লুজ হয়ে গেছে। আমি কি জানি কি খেয়ালে হঠাৎ বলে বসলাম তোমার দাদাকে একদিন দেখাবে? তাঁর সে কি হাসি! বললেন তুইও আমার দাদাকে দেখতে চাস? এই জন্মালি যে রে! তখন ধারণাই ছিলনা যে এঁরা সেলিব্রিটি। তাঁদের ব্যবহারে তা কখনও প্রকাশ পেতনা।

মানিকতলা খালের পাশে আর একটি মঞ্চ ছিল। নাম কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ। ১৯৫৩ সালে তৈরি মঞ্চতি ১৯৫৭ সালে নট নাট্যকার মহেন্দ্র গুপ্ত এই মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন। তাঁর পরিচালনায় রাজা রামপাল ও শাপমুক্তি নাটক মঞ্চস্থ হয়। ১৯৬৬ সালে নান্দিক গোষ্ঠী বিধায়ক ভট্টাচার্য রচিত এন্টনি কবিয়াল মঞ্চস্থ করেন। বলা চলে এই নাটকের হাত ধরেই কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ নাট্যামোদীদের কাছে পরিচিতি লাভ করে। নাটকে অভিনয় করেন এন্টনির ভূমিকায় সবিতাব্রত দত্ত, সৌদামিনী কেতকী দত্ত ও ভোলা ময়রা জহর গাঙ্গুলি। গান এ নাটকের বিশেষ সম্পদ। আড়াই বছর চলেছিল নাটকটি। এরপর নটী বিনোদিনী, মুখোশের আড়ালে, দয়াল অপেরা ইত্যাদি নাটক মঞ্চস্থ হয়। ১৯৭২ সালে হরিদাস স্যান্যাল এই মঞ্চ ভাড়া নেন। জরাসন্ধের মল্লিকা মঞ্চস্থ হয়। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নামভূমিকায়। তাঁর মর্মস্পর্শী অভিনয় যারা দেখেছেন কখনও ভোলেননি। এই নাটকের একটি দৃশ্যের কথা বলি। জ্ঞানেশ মুখার্জি বাবা। তিনি একটি চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। তাঁর ছেলে অনুপ কুমার। বেকার। ছেলের ক্রিকেট খেলার ঝোঁক। তার হাতে একটা ক্রিকেট ব্যাট। সে দাঁড়িয়ে আছে বাবার চেয়ারের পেছনে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে শ্যাডো প্র্যাকটিস করে চলেছে। বাবা একটি একটি করে প্রশ্ন করে চলেছেন আর ছেলে প্র্যাকটিস করতে করতে তার উত্তর দিচ্ছে। ক্রমশ প্রশ্ন তীক্ষ্ণ হচ্ছে। বেকার ছেলে। সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হাতের ব্যাট থামছেনা অথচ বডি ল্যাংগুয়েজে যন্ত্রণা ফুটে উঠছে। ভোলবার নয় সে দৃশ্য। বহুদিন চরিত্রটির জন্যে মনে কষ্ট পোষা ছিল। এর বেশ ক বছর পর সৌমিত্র করেন নামজীবন। প্রায় এই সময়েই প্রতাপ মঞ্চে অসীম চক্রবর্তী পরিচালিত সুবোধ ঘোষের বারবধূ মঞ্চস্থ হয়। কেতকী দত্ত ছিলেন মুখ্য ভূমিকায়। এ নাটকটিও প্রাপ্তবয়স্ক তকমাধারী ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে অসীম চক্রবর্তী নাটকে প্রথম পাশ্চাত্য ভাবধারায় অণুপ্রানিত বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে সেই সব নাটক সেসময়ে দর্শক আনুকুল্য পায়নি। তিনি যখন বারবধূ করেন তখন সুবোধ ঘোষের এই গল্পটিকে ভুলে মানুষ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এই নাটক দেখতে ভিড় জমায়। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে অপসংস্কৃতির অভিযোগে নাটকটি বন্ধ করে।

১৯৭০ সালে রাজা রাজকিশন স্ট্রিটে রঙ্গনা নামে আর একটি মঞ্চ স্থাপিত হয়। অহীন্দ্র চৌধুরী মঞ্চের নামকরণ করেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন। এই মঞ্চে নান্দীকার গোষ্ঠী নিয়মিত অভিনয় করতেন। এঁদের প্রথম নাটক তিন পয়সার পালা। তারপর পরপর নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র, মঞ্জুরী আমের মঞ্জুরী, শের আফগান, নটী বিনোদিনী মঞ্চস্থ হয়। নিতান্ত বালিকা বয়স। তবুও এই সব নাটকের কিছু কিছু দৃশ্য মনে পড়ে। মনে পড়ে তিন পয়সার পালায় গান - চেষ্টা করলে হাঙরেরও মুখ দেখতে পাবে। মনে পড়ে নটী বিনোদিনীতে মঞ্চের এক কোণে চেয়ারে গুরমুখ রূপী রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বসে, আর অপর প্রান্ত থেকে ঠমকে ঠমকে আসছেন বিনোদিনী কেয়া। মনে পড়ে মঞ্জুরী আমের মঞ্জুরীর সেই মনোলগ। কিন্তু বড় অস্পষ্ট। আজ আর অজিতেশ নেই। সেই সব স্বাদ ফিরিয়ে দেবার কেউ নেই। যখন সাংস্কৃতিক মুখ হিসেবে উৎপল দত্ত ও শম্ভু মিত্র কলকাতার রঙ্গমঞ্চে রাজত্ব করছেন তখন লালমাটির দেশ থেকে ঝড়ো হাওয়ার মত অজিতেশ এলেন।

হয়ত সস্তা নাটক হত, পারিবারিক নাটক হত, আবার মননশীল নাটক ও হত, কিন্তু সব শেষে সৃষ্টিশীল কিছু মানুষ থিয়েটার ভালোবেসে কয়েক দশক কলকাতার রঙ্গমঞ্চ মাতিয়ে রেখেছিলেন। এভাবেই স্বল্পস্থায়ী জীবনকাল নিয়ে পেশাদার বঙ্গরঙ্গমঞ্চের শেষঅঙ্ক দেখতে হোল কলকাতার মানুষকে। এ দুঃখ কোথায় রাখি!

ঋণ স্বীকার – বিমোচন ভট্টাচার্য।

বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস – দর্শন চৌধুরী

একশো বছরের নাট্য প্রসঙ্গ – দেবনারায়ন গুপ্ত।

উৎপল দত্তের কিছু রচনা, বিভিন্ন বই থেকে নেওয়া।

[নবাবী বইমেলা সংখ্যা ২০১৮]

0 comments: