ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(১২)
গোলকপতির খুব ইচ্ছা করছিল যে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে এই অন্যায় সতীদাহ প্রথাটির তীব্র বিরোধিতা করে। কিন্তু একে সে বিদেশি তায় রাজবাড়ির দয়ায় সবেমাত্র কোনওমতে একটা জীবিকার উপায় হয়েছে, সেই অবস্থায় এরকম একটা গন্ডোগোলে জড়িয়ে পড়াটা মোটেও সুবিধের হবে না।
তার একবার মনে হল যে একছুটে মেয়েটিকে উদ্ধার করে নিয়ে কোথাও চলে গিয়ে আবার সংসারী হয়।
পরক্ষণেই তার আবার মনে হল যে নিজের জীবিকাই যেখানে অনিশ্চিত , সেখানে আর একজন জীবনসঙ্গিনীর যোগ্য হয়ে উঠতে গেলেও তার যেটুকু স্থৈর্য্য প্রয়োজন সেটা তার আজও ফিরে আসেনি।
ক'দিন হল রাতে চোখ বুজলেই ও দেখতে পাচ্ছে যে লক্ষ্মীমণির রোগক্লান্ত মুখের অতন্দ্র আঁখিপল্লবদুটি অস্ফূটে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে চাইছে আগামীকালের এক অবধারিত পটপরিবর্তনের ইঙ্গিতসহ পুনর্যাপনের প্রতিশ্রুতিটি।
কিন্তু সমস্যা হল যে এই নারীটি তার সম্পূর্ণ অপরিচিত। বৃদ্ধ স্বামীটির মৃত্যুর পূর্বে সে একজন অচেনা পুরুষের সাথে কূলত্যাগিনী হওয়ার সাহস সে কেন দেখাবে?
.....
হিন্দু রমণীদের কাছে পরপুরুষের কাছে ভ্রষ্টা হওয়ার চেয়ে অগ্নিস্নানে পূণ্যবতী হওয়াটাই তো এতকাল ধরে বাঞ্ছনীয় ও কাম্য হয়ে এসেছে! রাজপুত নারীদের সতী মাহাত্ম্য সম্পর্কিত সব কাহিনি তো এ দেশের গ্রামেগঞ্জেও ভাট মুখে বরাবর প্রচারিত হয়ে এসেছে তাই এ মেয়েটিকে উদ্ধারকর্মের ঈপ্সাটি যেন আকাশকুসুম সদৃশ ভিত্তিহীন বটে।
.........
দ্বারকানাথ এগিয়ে এসে সহাস্যবদনে রামমোহনের ভৃঙ্গারটি থেকে কয়েকটি আখরোট আর বাদাম তুলে নিয়ে বললেন,
" কাল অবধি সতীদাহের বিপক্ষে মাত্র সতের'জন বিশিষ্টের মুসাবিদা যোগাড় করা সম্ভবপর হইয়াছে। শুনিয়াছি পাথুরিয়াঘাটায় আমার জ্ঞাতিভ্রাতাদের এ বিষয়ে এখনো কিছু আপত্তি আছে।
তবে যেহেতু ভ্রাতৃবরের সদ্যজাত পুত্রটির অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানে কাল আমি নিজে উপস্থিত থাকব, তাই আমি আশা করি যে তোমাকে আরও দ্বাদশ সংখ্যক অভিজাত জমিদারের এ বিষয়ে সমর্থনটি স্বাক্ষরিত অবস্থায় এনে দিতেও সক্ষম হব। আবার যখন সপ্তাহান্তে আমি রাণীগঞ্জে দুটি কয়লাখনি ক্রয় করতে যাবো তখন নিকটের মানভূম অঞ্চলে গড় পঞ্চকোটের রাজাটির সহিত সাক্ষাৎ করে এই একই বিষয়ের প্রসঙ্গটি তুলে তাঁহার মতামতটিও জেনে আসব বলে মনস্থ করেছি।শুনছি এই জমিদারেরা বঙ্গালভাষী না হলেও বেশ সজ্জন প্রকৃতির। এই রাজারা বর্তমানে আদিবাসী অধ্যূষিত কাশীপুরে একটি সুরম্য চন্ডী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন ও দরিদ্র প্রজাদের নাকি সপ্তাহান্তে অন্ন-বস্ত্র-অর্থ সবই ওঁদের রাজভান্ডার থেকে সসম্মানে সেবাকর্মের নিমিত্তে দান করে থাকেন। "
....
রামমোহন এবার সপ্রশংস হাসিতে বন্ধুবরের দক্ষিণহস্তের করাঙ্গুলীগুলি নিজের বক্ষে খানিকক্ষণ চেপে ধরে রেখে বললেন,
" লাটসাহেব শর্ত দিচ্ছেন যে এই মুসাবিদাটি আরো পঞ্চদশ সংখ্যক বিশিষ্টজনের স্বাক্ষর সমণ্বিত হলেই উনি স্বয়ং শীতকালীন অধিবেশনে সতীদাহ বিরোধী বিষয়ক পত্রটি পুনরায় বিলাতে প্রেরণ করতে পারবেন।
তবে তুমি যদি নিজের উদ্যমে আজ অবধি যে কয়েকটি সহি সংগ্রহ হয়েছে তাহার সাথে আরো দ্বাদশজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সমর্থন সংগ্রহ করে আনতে পারো তাহলে আমিও নিজের উদ্যোগে তদুপরি আরও সপ্তসংখ্যকটি সমর্থনসূচক স্বাক্ষরের সংগ্রহকার্য্যটিও অবশ্যই সফল হয়ে লাটভবনে পুনরায় হিজ হাইনেস বেন্টিঙ্কের দরবারে যেতে পারব।
তবে যেহেতু আমি পৌত্তলিকতা বর্জন করেছি সেহেতু পাথুরিয়াঘাটাস্থিত উক্ত অনুষ্ঠানভবনে নিমন্ত্রণ পেয়েও এমতাবস্থায় অন্নগ্রহণ করতে পারব না বটে; তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে এখন তুমিও ক্রমে স্বয়ং কালান্তরের সরব তূর্যনিনাদটির যোগ্য হয়ে উঠছ ! আজ যে আমি সত্যি বড় সন্তুষ্ট হে বেরাদর ! "
অতঃপর এই দুই কালান্তরের সেনানায়ক উভয় উভয়কে একটি উষ্ণ ও দৃঢ় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন।
0 comments: