0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in






৩৬

অল্পবয়সী যে মহিলাটি টেবিলে বসেছিল, সে ফাইনহালসের দিকে মুখ তুলে তাকাল। ফাইনহালস লক্ষ্য করল যে ওই মহিলার হাতের আঙুলগুলো ভারি সুন্দর, সরু সরু এবং মাটিতে থেবড়ে বসে মেঝের ভাঙা টালির উপর দিয়ে যে বাচ্চাটা নিজের খেলনাগাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, তার হাতও অমন সাদাটে, সরু সরু। ছোট ঘরটার মধ্যে কেমন যেন ভ্যাপসা ধোঁয়া ধোঁয়া তেলমশলা মেশানো রান্নার গন্ধ। দেওয়ালে চার দিকে রান্নার কড়াই, বাসনপত্র ঝোলানো, সাজানো।

যে বয়স্ক পুরুষটি ঘরের জানালার কাছে একটা চেয়ারে বসে বাইরে উঠোনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, ঘরের দু’ জন মহিলাই মুখ ফিরিয়ে এবার তার দিকে তাকালো। সেই মানুষটি একটা চেয়ারের দিকে আঙুল দেখিয়ে ফাইনহালসকে বললেন, ‘প্লিজ বসুন!’

ফাইনহালস বয়স্ক মহিলার পাশের চেয়ারে বসে। সে বলতে থাকে… ‘আমার নাম ফাইনহালস। আমার বাড়ি ভাইডেসহাইমে। আমি বাড়ি ফিরছিলাম…’

দু’ জন মহিলা পরস্পরের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। বয়স্ক পুরুষটি নড়েচড়ে বসে।

তাকে উজ্জীবিত দেখায়… -‘ফাইনহালস… ভাইডেসহাইম থেকে… ইয়াকব ফাইনহালসের ছেলে নাকি?’

-‘হ্যাঁ,… কিন্তু ভাইডেসহাইমের খবরাখবর কী?’

বয়স্ক মানুষটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে একগুচ্ছ মেঘের মত ধোঁয়া ছাড়েন পাইপ থেকে… ‘খারাপ নয়। ওরা ঠিকঠাকই আছে। আসলে ওরা অপেক্ষা করছে যাতে আমেরিকানরা এসে ওদের জায়গাটার দখল নেয়। কিন্তু আমেরিকানরা ওই জায়গাটা অবধি যাচ্ছেই না। ওরা এখানে এসে তিন সপ্তাহ ধরে বসে আছে। ভাইডেসহাইম পর্যন্ত আর দু’ কিলোমিটার মাত্র; কিন্তু ওই অবধি গেল না ওরা। শুনেছি ওখানে জার্মানরাও নেই। ফলে ওইটা এখন নেই মানুষের বেওয়ারিশ জমি। কারুর মাথাব্যথা নেই… এই অবস্থাটা অবশ্য বেশিদিন চলতে পারে না।

‘মাঝেমধ্যে শুনতে পাচ্ছি জার্মানরা গুলিগোলা ছুঁড়ছে…’ অল্পবয়সী মহিলাটি বলে ওঠে… ‘কিন্তু খুবই কম শোনা যায়।’

‘হ্যাঁ, শুনতে পাবেন।’ বলে বৃদ্ধ মানুষকে ফাইনহালসের দিকে আগ্রহভরে তাকায়… ‘এখন আপনি কোত্থেকে এলেন?’

‘ওই দিকে, আমরা অপেক্ষা করছিলাম তিন সপ্তাহ ধরে… যে আমেরিকানরা আসবে’

‘রাস্তার ওই পারে?’

‘নাহ, আরেকটু দক্ষিণে- গ্রিনজ্‌হাইমের কাছে।’

‘আচ্ছা, গ্রিন্‌জহাইম। সেখান থেকে এলেন এখন?’

‘হ্যাঁ, রাতে ওইখানেই ছিলাম।’

‘তারপর সেখানে সিভিলিয়ানের পোশাক পরে নিলেন?’

ফাইনহালস মাথা নাড়ে… ‘নাহ, সাধারণ পোশাক আগেই পরেছিলাম। ওরা এখন প্রচুর সৈনিককে ছাঁটাই করছে।’

বয়স্ক মানুষকে শান্তভাবে হাসেন। অল্পবয়সী মহিলার দিকে তাকান… ‘শুনছ, ট্রুড… ওরা নাকি প্রচুর সৈনিককে এখন ছাঁটাই করছে। ওহ, শুনে এখন আর কী বা করবে? হাসবে…’

অল্পবয়সী মহিলাটির আলু ছাড়ান হয়ে গেছে। সে আলুগুলোকে ঘরের কোণে বেসিনে কলের নিচে একটা ঝাঁঝরিযুক্ত পাত্রের মধ্যে মধ্যে রেখেছে। কল খুলে ক্লান্ত হাতে আলুগুলো ধুতে লাগল সে। বয়স্ক মহিলাটি ফাইনহালসের হাত স্পর্শ করল…

‘সত্যিই এখন অনেক মানুষকে ছাঁটাই করছে?’

‘অনেক’ বলে ফাইনহালস… ‘কোনো কোনো ইউনিটে শুনেছি সবাইকে ছাঁটাই করেছে… বাকিরা গিয়ে সব রুর উপত্যকায় জড়ো হচ্ছে। কিন্তু আমি রুরে যাইনি।’

অল্পবয়সী মহিলাটি বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। নিঃশব্দে কাঁদছে সে। সরু কাঁধদুটো কান্নার দমকে কেঁপে উঠছে।

‘নাকি কাঁদবে…’ জানালায় বসে থাকা বয়স্ক পুরুষটি বলে ওঠেন… ‘হাসবে না কাঁদবে!’ ফাইনহালসের দিকে একবার তাকিয়ে আবার হাতের তামাকের পাইপ দিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অল্পবয়সী মহিলার দিকে নির্দেশ করে বলে ওঠে… ‘তোমার স্বামী চলে গেল… আমার ছেলেটা!’ মহিলা ধীরে ধীরে সাবধানে আলুগুলো ধুতে থাকে এবং কাঁদতে থাকে… ‘হাঙ্গেরিতে, গেল বার হেমন্তের পাতা ঝরার সময়ে’ বলে ওঠেন বয়স্ক লোকটি।

‘গ্রীষ্মে, হেমন্তে নয়’… ফাইনহালসের পাশে বসে থাকা বয়স্ক মহিলাটি বলে ওঠেন, ‘ওকে ছেড়ে দেবে শুনেছিলাম, বেশ কয়েক বার ছাড়বার কথা হয়েছিল। ওর তো শরীরটা একেবারেই ভালো ছিল না, খুব কষ্ট করে চালাচ্ছিল। কিন্তু ওকে কিছুতেই ওরা ছাড়ছিল না। ওর উপরে ক্যান্টিনের দায়িত্ব ছিল যে।’ তিনি মাথা নাড়েন, আর অল্পবয়সী মহিলার দিকে তাকান। সে সাবধানে ধোয়া আলুগুলোকে একটা পরিষ্কার কেটলির মধ্যে রেখে বেশ কিছুটা জল ঢালে। সে এখনও কাঁদছে, নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। চুলার উপরে কেটলিটা বসিয়ে এককোণে যায় সে। পোশাকের পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে।

ফাইনহালস বুঝতে পারে যে তার মুখটা ধীরে ধীরে ঝুলে পড়ছে। সে ফিঙ্কের সম্বন্ধে ভাবে না খুব একটা। মাঝেমধ্যে মনে পড়ে মুহূর্তটা। কিন্তু এই মুহূর্তে সে তীব্রভাবে ভাবছে। মনে মনে ভাবতে ভাবতে ওই মুহূর্তগুলো সে আরও পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছে। এতটা পরিষ্কার যখন বাস্তবে ঘটনাটা ঘটেছিল, তখনও হয়তো সে দেখেনি। সেই প্রচণ্ড ভারি স্যুটকেসের মধ্যে হঠাৎ গ্রেনেডের ফুলকি এসে পড়ল, স্যুটকেসের ঢাকনাটা উড়ে গেল, চারদিকে ফোয়ারার মত ওয়াইন ছিটকে পড়ল, উফফ, কাচের ভাঙা টুকরো ছড়াতে লাগল চারদিকে; ফিঙ্কের চেহারাটা যে এত ছোটখাট, সেটা সে খেয়াল করেনি যতক্ষণ না তার শরীরের বিরাট রক্তাক্ত ক্ষতের উপর হাত রেখে পরক্ষণেই সে তার হাতটা সরিয়ে নিয়েছিল…

বাচ্চাটা মেঝের উপরে বসে খেলছিল। ফাইনহালস একদৃষ্টে বাচ্চাটার দিকেই তাকিয়েছিল। মেঝেতে যে জায়গাটাতে টালিটা ভেঙে গেছে, বাচ্চাটা ঠিক সেই জায়গাটা ঘিরে খেলনা গাড়িটা চালিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট জ্বালানি কাঠের টুকরো ওই গাড়িটায় বোঝাই করছে, নামিয়ে রাখছে, আবার বোঝাই করছে। হাতের আঙুলগুলো সূক্ষ্ম, সরু, সরু এবং তার মায়ের মতই ধীরে ধীরে ক্লান্ত ভঙ্গিতে সাবধানী আঙুলের নড়াচড়া শিশুটির। বাচ্চাটির মা এখন টেবিলে এসে বসেছে, মুখের অর্ধেকটা ঢেকে রুমাল দিয়ে চেপে আছে। ফাইনহালসের দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল। একবার মনে হল যে সে বলে ফিঙ্কের মৃত্যুর ঘটনাটা তার চোখের সামনে ঘটেছিল। কিন্তু সে দ্রুত মুখটা বন্ধ করে মাথা নামিয়ে বসে। তারপর চিন্তা করে যে পরে না হয় বলবে। বৃদ্ধ মানুষটিকে বলবে। কিন্তু এখন নয়…

যাই হোক, ফিঙ্ক হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে কী ভাবে হাঙ্গেরিতে গিয়ে পৌঁছালো, সেটা নিয়ে মনে হয় ওদের এখন আর সেরকম কোনো মাথা ব্যথা নেই।

বয়স্ক মহিলাটি আবার তার হাতে স্পর্শ করে… ‘আপনার কী হয়েছে? কিছু খাবেন? শরীর ঠিক আছে তো?’

‘না, আমি ঠিক আছি।’ বলে ওঠে ফাইনহালস, ‘অনেক ধন্যবাদ!’ বয়স্ক মহিলাটির তীব্র দৃষ্টির সামনে তাঁর অস্বস্তি হয়, ‘সত্যিই কিছু খাব না। অনেক ধন্যবাদ!’

‘এক গ্লাস ওয়াইন’ জানলার কাছ থেকে বৃদ্ধ মানুষটি প্রশ্ন করে, ‘কিম্বা শ্নাপ?’

‘হ্যাঁ’ বলে ফাইনহালস, ‘এক গ্লাস শ্নাপ খেতে পারি।’

‘ট্রুড’ ডাকেন বৃদ্ধ মানুষটি, ‘এই ভদ্রলোককে একটা শ্নাপ দাও।’

অল্পবয়সী মহিলাটি টেবিল থেকে উঠে পাশের ঘরে যায়।

‘আসলে আমরা খুব ছোট জায়গায় থাকতে বাধ্য হচ্ছি এখন’… বয়স্ক মানুষটি বলেন ফাইনহালসকে।

‘শুধু রান্নাঘর আর খাবার ঘর’… বলেন বয়স্ক মহিলাটি… ‘তবে ওরা বলছে যে শীগগির বেরিয়ে যাবে এখান থেকে। সঙ্গে অনেক ট্যাঙ্ক আছে। তাছাড়া বন্দিদেরও এই জায়গাটা থেকে অন্যত্র চালান করবে শুনছি।’

- ‘এই বাড়িতে কোনো বন্দি আছে?’

--‘হ্যাঁ’… উত্তর দেন বয়স্ক পুরুষটি… ‘বড় হলঘরে যুদ্ধবন্দিরা আছে। শুধু উচ্চপদস্থ অফিসারদের এখানে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এমনকি এদের মধ্যে একজন জেনারালও আছেন। জিজ্ঞাসাবাদ হয়ে গেলে, এরা চলে যাবে। দেখুন ওদিকে!’

ফাইনহালস জানালায় গিয়ে দাঁড়ায়। বয়স্ক মানুষটি দ্বিতীয় উঠোনের সামনে যেখানে রক্ষীরা পাহারা দিচ্ছে, সেই জায়গাটা ছাড়িয়ে মূল প্রবেশপথের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। ছোট হলঘরটা পেঁচানো কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রাখা।

‘ওই যে, লক্ষ্য করুন’ বলেন বয়স্ক মানুষটি… ‘একজনকে নিয়ে আসা হচ্ছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।’



(চলবে)

0 comments: