গল্প - আর্যা ভট্টাচার্য
Posted in গল্পপড়াশোনা তো কবেই শেষ। আজ প্রায় দু’বছর হলো কমলিকা সেবন্তীর সঙ্গে একই স্কুলে পড়াচ্ছে।
আহা, হলই বা মন্টেসারি স্কুল, কিন্তু একটা নামী স্কুল তো।
আর সেবন্তী হলই বা সায়েন্সের স্টুডেন্ট তা বলে লিটারেচার জানবে না?
মাত্র কালকেই বাড়ি ফেরার সময় গল্প করতে করতে কমলিকা জানতে পেরেছে যে, সেবন্তী ওয়াদারিং হাইটস পড়েনি!
কমলিকা আর সেবন্তী দুজনেই স্কুল থেকে ফেরার পথে মেট্রো ধরে।
কমলিকা রাসবিহারী তে নেমে বালিগঞ্জের অটো ধরে আর সেবন্তী তারপরে রবীন্দ্রসরোবরে নেমে যায়।
চারুমার্কেটের খুব কাছেই ওর বাড়ি। তাই বাকি রাস্তা টা হেঁটেই চলে যায়।
তবে এ সব কিছু তেমন ইম্পর্টেন্ট নয়। আসল ইম্পর্টেন্ট কথা হল সেবন্তী ওয়াদারিং হাইটস পড়েনি! ওহ্ মাই গড!!
সেবন্তীর সঙ্গে আজ মেট্রোয় বসে ফেরার সময়ে , স্কুল জীবনের হার্টথ্রব নিয়ে কথা হচ্ছিল।
কমলিকা তো ভীষণ উত্তেজিত টিত হয়ে জানিয়েছিল যে স্কুল জীবন থেকে আজ পর্যন্ত তার ওয়ান এন্ড ওনলি হার্টথ্রব হচ্ছে হিথক্লিফ।
আর তখনই একটা আশ্চর্য বোকা বোকা লস্ট মুখ করে সেবন্তী জিগ্গেস করেছিল, ‘ হিথক্লিফ কে রে ? তোর স্কুলের কোনো ছেলে? এংলোইন্ডিয়ান ?”
“মাআআআআনে? হিথক্লিফ আমার স্কুলের ছেলে ? !! তুই ওয়াদারিং হাইটস পড়িসনি ?”
বিস্ময় তখন কমলিকার চোখ দুটো দুটাকার রসগোল্লার মতো বড় বড় হয়ে প্রায় ঠিকরে বেরিয়ে আসে আরকি!
সেবন্তী হিথক্লিফকে চেনে না! ওয়াদারিং হাইটস পড়েনি! জাস্ট ভাবা যায়!
পৃথিবীতে এমন একজন মানুষ আজও আছে যে শিক্ষিত তার উপর কমলিকার বন্ধু অথচ হিথক্লিফের কথা জানেনা। এ যেন পৃথিবীর নবম আশ্চর্য !
আর এই খবর জানার পরে কমলিকা তো একবারে থ! কিছুক্ষণের জন্য তার মুখ থেকে পুরো বাক্যি হরে গেছিল। কোনো কথাই বলতে পারেনি।
বিস্ময়ের উপর বিস্ময়!
সেবন্তী যে শুধু ওয়াদারিং হাইটস পড়েনি তাই নয়, ক্লাসিকস প্রায় কিছুই পড়েনি।…কী কান্ড!
তা সে যাক গে; সে ওর যা ভালো লাগে করুক। তা বলে ওয়াদারিং হাইটস!
কমলিকার সব থেকে প্রিয় বই! সে যে কতো বার পড়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।
প্রথম পড়েছিল যখন তখন ক্লাস সেভেন। তিনদিন ঘুমোতে পারেনি। লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছিল। উফফ! কী কষ্ট! কী কষ্ট!
সেই থেকে হিথক্লিফ তার ইটারনাল ক্রাশ।
আর তার প্রিয় বন্ধু সেবন্তী, হিথক্লিফের সঙ্গে তার পরিচয় হবেনা! এটা হতে পারেনা।
সেবন্তীকে কমলিকা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে ‘ শোন, কালকেই আমি বইটা তোকে এনে দেবো। একবার পড়ে দ্যাখ। পুরো পাগল হয়ে যাবি-
অনেক দিন বাদে আবার ওয়াদারিং হাইটস নিয়ে আমি গল্প করতে পারবো। আমার অন্য বন্ধুদের তো কবেই ওয়াদারিং হাইটস পড়া হয়ে গেছে,
এখন আর কেউ হিথক্লিফকে নিয়ে কথা বলতে উৎসাহী নয়।“
বলতে বলতে কমলিকার মুখটা কেমন যেন একটু মিইয়ে আসে।
পরমুহূর্তেই প্রবল উৎসাহে উজ্জ্বল চকচকে চোখে সেবন্তীর দিকে তাকিয়ে বলে, “কাল ই বইটা নিয়ে আসবো। ঠিক আছে?”
ওর এতো উত্তেজনা দেখে সেবন্তীও নেচে উঠেছিল। ‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ নিয়ে আসিস। বইটা শেষ করার পর দারুণ গল্প জমবে। ‘
সে না হয় হ'লো, কিন্তু বইটা গেল কোথায়?
বাড়ি ফিরে থেকে নিজের ঘরের সব জায়গা আতিঁপাঁতি করে দেখছে, তাও পাচ্ছেনা।
ঠিক সময় বুঝেই দরকারী জিনিসগুলো যে কোথায় যায়!
লেহ! এটা কী! ক্লাস সেভেনের ইংরেজি টেক্সট? এখানে কি করছে আজও?
একটু মজা পেয়ে, একটু অবাক হয়ে বইটার পাতা ওল্টাতেই, একটা চিরকূটের মতো হলদেটে হয়ে যাওয়া কাগজ তার পায়ের কাছে পড়লো।
খানিকটা কৌতুহল বশেই কাগজ টা হাতে তুলে নিল কমলিকা। এটা তো হিমাচল প্রদেশ ট্যুরিজমের হোটেলের একটা বিলের ছেঁড়া টুকরো!
আর তার পেছনে এটা কি লেখা ! একটা নাম্বার মনে হচ্ছে।
আরে! এটা তাকে দেওয়া সাংলার সেই বেয়ারার ফোন নাম্বার। তাই না?
কী যেন নাম ছিল?... হাঁ, রাজ। মা বলতো,’রাজ বেয়ারা ‘।… এতো দিন ধরে নম্বরটা রয়ে গেছে!
কী আশ্চর্য ব্যাপার!
অবশ্য ঠিক রাজের নয়, ওটা সাংলা ট্যুরিস্ট লজের নম্বর।
কাগজটার দিকে তাকিয়ে, নিমেষে কমলিকার মন ক্লাস সেভেনের সেই পুজোর ছুটিতে পৌঁছে গেল।
শিমলা থেকে কল্পা ঘুরে তারা সবে তখন সাংলায় পৌঁছেছে।
বাবা চেক ইনে গেছে, কমলিকা আর মা গাড়ি থেকে নেমে একটু হাত, পা ছড়াচ্ছে।
আর তখনই রাজবেয়ারার যেন ‘আবির্ভাব’।… হ্যাঁ, ঠিক তেমনই মনে হয়েছিল।
বেয়ারা হলে কী হবে? কী সুন্দর দেখতে!... এতো সুন্দর লোক কমলিকা এর আগে কখনো দেখেনি!
মায়ের সংগে সেও কিছু পুরনো হিন্দি সিনেমা দেখেছে, সেখানে একজন নায়ককে সে দেখেছে। নামটাও মনে আছে, উমম…শশীকাপুর। এই বেয়ারাটাও পুরো শশীকাপুর।
নাহ, তার থেকেও বেটার। কারন এই ‘রাজ বেয়ারা’র মধ্যে একটা অদ্ভুত রাগেডনেস আছে। যেটা শশীকাপুরের মধ্যে নেই।
সোনালী চুল ; নিক কার্টারের মতো মাঝখানে সিঁথি করে আঁচড়ানো, লম্বাটে মুখ আর কমলিকার থেকে কঅত্তটা লম্বা।
উঁহু শশীকাপুর নয়।… ঠিক যেন মাইকেল শ্যুমাখার!
তাছাড়া কী চমৎকার স্বভাব।… কী সুন্দর এটিকেট। এতো দিন সব বেয়ারারা তাকে বাচ্চি বলতো।
কিন্তু রাজ লাগেজ নেবার সময় তাকে বাচ্চি বলেনি। বলেছিল… ‘আইয়ে মেডাম’।
সে যে কী আনন্দ! সে কথা মনে পড়ে এখনো তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
সেই মুহূর্ত থেকেই, মানে চোখাচোখি হওয়া এবং মেডাম বলার পর থেকেই রাজবেয়ারার সংগে তার মনেমনে বেশ ভাব জমে উঠেছিল।
আর ওকে দেখামাত্রই কীভাবে যেন কমলিকার মনে ওর প্রতি হালকা একটা অনুরাগ অনুরাগ ভাবও জন্মে গেছিলো।
রাজ বেয়ারাও যে সেটা বুঝতে পারেনি তা নয়।
সেটা বুঝতে পেরেই তো প্রায় ফিদা।আর চোখাচোখি হলেই ব্লাশ করছিল।
সোলমেট কথাটা কমলিকা আগে বন্ধুদের মুখেই শুনেছিল।
আর ওয়াদারিং হাইটস পড়ার পর সে শিওর হয়েছিল যে হিথক্লিফই তার সোলমেট।
অন্য আর কেউ হতেই পারে না।
কিন্তু রাজ বেয়ারাকে দেখার মুহূর্ত থেকে কমলিকার পুরো জগৎ একেবারে পাল্টে গেছিল।যাকে বলে 'টপসি টারভি' হয়ে যাওয়া।
এই তো তার আসল হিথক্লিফ। তার সোলমেট। আর কোনোদিন কেউ তার সোলমেট হতেই পারবেনা ।
সাংলায় পৌঁছতে পৌঁছতে তাদের প্রায় বিকেল হয়ে গিয়েছিল। তবে তখনও প্রচুর দিনের আলো ।
তাই লাগেজ রেখে বাবা বলেছিল, “ সন্ধে হতে দেরি আছে। চলো, চারপাশটা দেখে আসা যাক”
একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে , মা বাবার সঙ্গে বেরোবার সময় কমলিকা দ্যাখে, একটা গাছের নিচে রাজ উবু হয়ে বসে তাদের ড্রাইভারের সঙ্গে গল্প করছে।
তাদের দেখে ড্রাইভার আর রাজ দুজনেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো ।
কেন কে জানে!
“ যত্তসব অদ্ভুত! আমরা কি টিচার যে উঠে দাঁড়াতে হবে? “ মনে মনে ভেবেছিল কমলিকা।
তারপর একটু পিছিয়ে গিয়ে রাজের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হেসেছিল। রাজ ও হেসেছিল। মা বাবা এমনকি ড্রাইভারেরও চোখ এড়িয়ে।
হিথক্লিফ নির্ঘাৎ ক্যাথারিনের দিকে তাকিয়ে সবার চোখ এড়িয়ে এ ভাবেই হাসতো। বুকের মধ্যে যেন কী একটা হচ্ছে;… জীবনে এই প্রথম বার!
রাস্তায় বেড়িয়ে কিছুটা হাঁটার পরে কিছুক্ষণের জন্য রাজের কথা তার মাথা থেকে বিলকুল বেরিয়ে গেছিল।
সাংলা জায়গাটা সত্যিই সুন্দর! চারপাশে পাহাড়। বরফ ও আছে। তবে এ সময়ে অল্প। নীচ দিয়ে কী সুন্দর নীল রঙের একটা নদী বয়ে চলেছে।
সাদা ফ্যানা তার সর্বাঙ্গে। সেই নদীর পাড়ে কয়েকটা তাঁবু। ইশ! ওখানে যদি থাকা যেতো!
ওহ, নো…তাহলে তো রাজের সংগে দ্যাখাই হতোনা। ভাগ্যিস ওখানে তারা থাকছেনা।
চারপাশটা দেখে, ঘুরে ফিরে, তাদের ফিরতে প্রায় সন্ধে সাতটা বেজে গেল।
এবং তখন তারা সকলেই বেজায় ক্লান্ত।
একটু টানা ঘুম খুব দরকার। কাল আবার সকাল সকাল বেরোনো আছে। মা তাই বলেছিল আর্লি ডিনার করে নেবে।
কিন্তু তখনই একটা মুশকিল হলো।
ওই হোটেলে ডিনারের জন্য কোন রুম সার্ভিস নেই। ডিনারটা ডাইনিং রুমে গিয়েই করতে হবে। সে রকম ই নিয়ম। রুম সারভিস হবেনা।
কিন্তু মা এতোটা জার্নি করে, তারপর পাহাড়ি রাস্তায় আপ এন্ড ডাউন করে খুব ক্লান্ত।তার উপর যা ঠান্ডা! মা হাত মুখ ধুয়ে তাই তাড়াতাড়ি এসে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়েছে।
এমতাবস্থায় কম্বলের আরাম থেকে বেরিয়ে, ড্রেস আপ করে ডাইনিং রুমে যেতে মা নিতান্ত নারাজ।
এদিকে মা র রিকোয়েস্ট, অভিমান কিছুই বাবাকে নিয়ম ভেংগে রুম সার্ভিসের জন্য ম্যানেজারের হাতেপায়ে ধরাতে রাজী করাতে পারলো না ।
মা তখন ঘোষণা করে দিল, “নিকুচি করেছে। আজ রাতে আমি খাবোইনা।“
ঠিক সেই সময় , মা বাবার আদরের ‘পুটুস ‘অর্থাৎ কমলিকা ঘরের জানলা দিয়ে দেখে রাজ বাগান দিয়ে যাচ্ছে।
আর সময় নষ্ট না করে মাকে ‘ একটু বাগানে যাচ্ছি ‘ বলেই বাগানের দিকে দে ছুট।
পেছন থেকে মায়ের গলায়, “সাবধানে… এই মেয়ে…. নতুন জায়গা… ‘ আরও কী কী সব ভেসে আসতে লাগলো, কমলিকার ঠিক মতো কানেও গেলো না।
ছুটে বাগানে গিয়ে দেখে রাজ চলে যায়নি। বাগানে ওই ঠান্ডায় খালি গায়ে এক্সেরসাইজ করছে। উ: কী মাসেল!
হিথক্লিফ যখন কাঠ কাটতো , ওকেও নিশ্চয়ই এরকমই লাগতো।
কমলিকার চোখ যেন আর সরেইনা।
কমলিকাকে দেখে ব্যায়াম থামিয়ে রাজ হিন্দিতে, জিজ্ঞেস করলো ‘ কিছু লাগবে মেডাম?’
“রাজ! মায়ের শরীর টা ভালো নেই , আমাদের ডিনারটা আজ ঘরে দিতে পারবে?”-বলতে গিয়ে তো কমলিকা লজ্জায় লাল টাল হয়ে একশা;
নাহ কমলিকা একা নয়, আবছা আলোয় ঠাওর করে দেখলে বেশ বোঝা যায়, রাজের মুখে আর হাসিতেও লালিমার আভাস।
“জী মেমসাব। আমি ঘরে গিয়ে অর্ডার নিয়ে আসছি”
রাজ বেয়ারা যখন রুমের দিকে যেতে শুরু করেছে তখনই পেছন থেকে কমলিকা বলে ওঠে,
‘ আমাকে মেমসাব বলবেনা। আমার ডাক নাম পুটুস।আর ভালো নাম কমলিকা।
আমরা এখন বন্ধু। তুমি আমাকে নাম ধরে, পুটুস বলেই ডেকো।বাড়ির সবাই আর পাড়ার বন্ধুরাও তাই বলে।
এই যেমন আমি তোমাকে ডাকলাম।
‘রাজ’ বলেই তো ডাকলাম। তাইনা ?
তাহলে আমি তোমাকে রাজ বলব আর তুমি আমাকে বলবে 'পুটুস'। কেমন?”
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে রাজ হনহন করে তাদের রুমের দিকে চলে গিয়েছিল।
আর বাগানে একা দাঁড়িয়ে তারাভরা আকাশের দিকে মুখ তুলে ‘ ইয়েএএএ’ বলে পুটুস চেঁচিয়ে উঠেছিল।
সে পেয়ে গেছে তার রিয়েল লাইফ হিথক্লিফকে।
পরের পুরোটা দিন তাদের ঘুরে বেড়াতেই কেটে গিয়েছিল। ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধে।
মা, বাবা ক্লান্ত হয়ে ফিরে যখন বিশ্রাম করছে তখন কমলিকা আস্তে আস্তে বাগানে এসে একটা গার্ডেন চেয়ার টেনে নিয়ে বসেছিল।
যদি রাজকে দেখা যায়। কিন্তু না। কোথাও রাজকে দেখা যাচ্ছেনা।
রাজকে দেখা গেল সেই রাত্রে। তাদের জন্য স্পেশালি রুম সার্ভিস দিয়ে যাবে বলে ডিনারের অর্ডার নিতে এসেছে।
আর এবার নিজে থেকেই। ডাকতেও হয়নি।
'পুটুস'কে ভালোবাসে বলেই না।
কমলিকার আনন্দে পুরো নেচে উঠতে ইচ্ছে করছিল।
কিন্তু মা বিয়িং মা, তখনই জিজ্ঞেস করে বসলো, “ তোমার এতো অল্প বয়স, পড়াশোনা করো না? “
মা র এই স্বভাবটা খুব খারাপ। স্কুলে টিচার আছো থাকোনা। তা না, সারা বিশ্বের ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করার যেন ব্রত নিয়েছে।
বাড়িতে পড়িয়ে পড়িয়ে আর জ্ঞান দিয়ে দিয়ে কমলিকার লাইফ হেল করছে, আর এখন রাজকে ধরেছে।
উত্তরে অবশ্য রাজ খুব পোলাইট ভাবেই জানিয়েছিলো, সে টেন অবধি পড়েছে কিন্তু তারপর ওর বাবা অসুস্থ হয়ে পরায় ওকেই কাজ করতে হচ্ছে।
বাড়িতে মা, বাবা, ভাই বোন আছে, দাদু আছে, কাজ না করলে সকলে খাবে কি?
“ তা হলেও, প্রাইভেটে পড়াশুনো চালিয়ে যাও।“ মায়ের নাছোড়বান্দা জ্ঞানদান।
“ জী মেমসাব, কোশিশ করেংগে”বলে লাজুক ভাবে কমলিকার দিকে একটা চোরা চাহনি দিয়ে রাজ ডিনার আনতে চলে গেছিল।
মা তাও এ বিষয় ছাড়বেনা।
এবার বাবার দিকে তাকিয়ে ভাষন, “ কতোই বা বয়স ছেলেটার বলো? বছর আঠেরো উনিশ ম্যাক্সিমাম।
এই বয়সে পড়াশুনো করলে তবেই না ভালো কিছু করতে পারবে।
এদের দ্যাখো, কোনো উচ্চাশাই নেই। আশ্চর্য! “
বাবা যথারীতি নির্বাক।
কিন্তু মা র জন্য কমলিকার তো নাক কাটা গেল!
কিন্তু মা সে কথা বুঝলে তো।
কিন্তু না, সেখানেই শেষ নয়।
পুটুসকে ভালোবেসে রাজ নিয়ম ভেংগে রুমে ডিনার দিয়ে গেল, আর বাবা কি করলো?
ওকে মাত্র পঞ্চাশটা টাকা টিপস দিলো!!
মাত্র পঞ্চাশ!
আরে বাবা এটা পুটুসের প্রেস্টিজের প্রশ্ন। দিলে যদি, অন্তত পাঁচশো… না পাঁচশো না… এক হাজার টাকা দাও। ছি:।
আর রাজকে দ্যাখো, কতো সভ্য! ‘থ্যানকু’ বলে চুপচাপ টাকাটা নিয়ে চলে গেল।
‘ শেখো, ওর কাছ থেকে কিছু শেখো’ মনে মনে বলতে লাগলো পুটুস।
কমলিকার মনে আছে সেদিন রাতে উত্তেজনায় প্রায় ঘুম ই হয়নি তার।
পরদিন ভোর হতেই ঘর থেকে বেড়িয়ে বারান্দায় চেয়ারে গিয়ে বসেছিলো ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে। রাজকে দেখবে বলে।
হ্যাঁ, ওই তো রাজ। বেড টি নিয়ে একটা রুমের দিকে গেল।
কমলিকাও তাড়াতাড়ি সোয়েটারের উপর চাদর ভালো ভাবে জড়িয়ে নিয়ে বাগানে নেমে দাঁড়ালো।
“ কিছু লাগবে? “
গলা শুনে কমলিকা দ্যাখে রাজ কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
“ চা দেব? “
বাড়িতে কমলিকা চা পায়না। সকালে দুধ বরাদ্দ।
“ পুটুস! চুপচাপ দুধটা খেয়ে নাও”…মায়ের হেঁড়ে গলা কমলিকার কানে যেন বেজে উঠলো।… এখানেও।
কিন্তু এখানে তো আর মা দাঁড়িয়ে নেই, তাই রাজের সামনে বড়োদের মতো মুখ করে বললো, “ হ্যাঁ, খাবো।
তুমিও তোমার চা আনো। এসো, দুজনে বাগানে এক সাথে বসে চা খাই”।
মনে মনে ভাবে ঠিক সিনেমার মতন।
“ না, মেডা..”
“ পুটুস… পুটুস বলো”
“ হাঁ, ওহী..কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে বসে চা খেতে পারবোনা। গেস্টের সঙ্গে বসে চা খাবার পারমিশন নেই আমাদের”
“ তাহলে থাক। আমিও খবোনা” উদাস হয়ে বলেছিল পুটুস।…
সেদিন ছিল তাদের ছিটকুল যাবার প্ল্যান।
শেষ দুপুরে ছিটকুল থেকে ফেরার পরে পুটুস তাল ধরেছিল আপেল বাগান দেখবে। বাগানের ভেতরে গিয়ে।
কিন্তু মা, বাবা তখন এক পাও হাঁটতে নারাজ।
সুযোগ বুঝে পুটুস নিরীহ মুখ করে বলেছিল, “ রাজ আমাকে নিয়ে যাবে কিনা জিজ্ঞেস করব মা?”
তার মনে অবশ্য তখন আশা আশংকার লাড্ডু ফুটছে।
‘হে ভগবান! মা যেন রাজি হয়ে যায়। আর রাজ ও।‘ রাজ তাকে আশেপাশের আপেল বাগান দেখাতে নিয়ে গেলে কী মজাটাই না হবে!
মা অবশ্য একটু আপত্তি করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বাবা তার দলে ছিল সব সময়ের মতোই।
তখনও মাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলেছিল, “ আহা যাকনা। এই তো বয়েস। ঘুরবে, ফিরবে, প্রকৃতিকে একটু চিনবে…আর এখানকার স্টাফ খুবই রিলায়েবল।
তুমি নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করো। আমিও একটু গড়িয়ে নিই… আর পুটুস বেশি দূরে যাসনা যেন।‘
বাবা নিজেই রিসেপশনে ফোন করে রাজকে ডেকে পাঠিয়েছিল।
রাজ রুমে এলে বাবা রাজকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ তোমার কি এখন এখানে কোনো কাজ আছে রাজ? না থাকলে ওকে কাছাকাছির কিছু আপেল বাগান দেখিয়ে আনতে পারবে?
বেশী দূরে যেওনা যেন । ঠিক আছে? “
রাজ ও বাধ্য ছেলের মতো মাথা নেড়ে কমলিকার পেছন পেছন বেড়িয়ে এসেছিলো।
আপেল বাগান দ্যাখা, যাতায়াতের পথে রাজের সংগে গল্প করা.…কী যে ভালো কেটেছিল সেই সময়টা!
রাজ গাছ থেকে আপেল পেড়ে কমলিকাকে একটা দিয়েছিল, নিজেও একটা নিয়েছিলো। কী মিষ্টি ছিল যে সেই আপেল!
আর একটা উপরি পাওনা হয়েছিল কমলিকার। কামরু ফোর্ট দেখা।
হোটেলে ফিরে তাদের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কমলিকা জিজ্ঞেস করেছিল, “ তুমি কলকাতায় যাওনা? গেলে দেখা হতো। “
মাথা নেড়ে না বলেছিল রাজ।
“ তোমরা কি কাল সকালে চেক আউট করবে?” দু:খী দু:খী মুখে 'পুটুসে'র চোখের দিকে কেমন একটা করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল রাজ।
“ হ্যাঁ। তোমার ফোন আছে? তাহলে নাম্বারটা দাও। কলকাতা গিয়ে ফোন করবো।“ তখন কমলিকা প্রায় কাঁদো কাঁদো।
“ নেহি পুটুস। আমার বাড়িতে ফোন নেই। “ আর ঠিক সেই সময় হোটেলের ম্যানেজার না কে যেন ডাইনিং রুম থেকে রাজকে চেঁচিয়ে ডেকেছিল।
‘আমি যাই। কাল চলে যাবার আগে রিসেপশনে গিয়ে একবার দেখা কোরো’ বলেই রাজ দৌড়ে চলে গেছিল।
আর কমলিকাও চোখের জল মুছতে মুছতে ঘরে ফিরে এসেছিল।
তখনও মা বাবা ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে।
পরদিন বেলা এগারোটা নাগাদ মা বাবা যখন লাগেজ নিয়ে ব্যস্ত, সেই ফাঁকে কমলিকা একবার টুক করে রিসেপশনে চলে গিয়েছিল।
আর রাজ এসে সাংলা ট্যুরিস্ট লজের একটা ছেঁড়া পাতায় এই ফোন নম্বরটা লিখে দিয়ে বলেছিল,
“ এটা ট্যুরিস্ট লজের নম্বর। তুমি এখানে ফোন কোরো পুটুস। এরা আমাকে ডেকে দেবে। আমি বলে রাখবো “
আর তখনই মা র বাজখাঁই চিৎকার শোনা গেল, “ পুটুস, পুটুস… এই মেয়েটাকে নিয়ে আর…”
দেন এন্ড দেয়ার 'পুটুস' দে ছুট।
ছুটতে ছুটতেই শিমলা থেকে কেনা তার নবলব্ধ ব্যাগের ভিতরে তাড়াতাড়ি কাগজখানা ভরে নিয়ে ছিল।
রাজের কথা স্কুলে সে তার বেস্ট ফ্রেন্ড শ্বেতা ছাড়া আর কাউকে বলেনি।
শ্বেতার সঙ্গেই স্কুল থেকে ফেরার পথে সে একদিন নয়, দুদিন নয়, গুনে গুনে তিনদিন স্কুলের কাছের পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে রাজের সেই ফোন নাম্বারে ফোন করেছিল।
কিন্তু প্রত্যেক বার সেই এক উত্তর –‘ দিস নাম্বার ডাস নট এক্সিস্ট…এই নম্বরটির অস্তিত্ব নেই ‘
রাজ তার সঙ্গে এ রকম করতে পারলো! মিথ্যে নম্বর দিলো! ট্রেইটার..কতো রাত যে সে এই ভেবে কমলিকা কেঁদে কাটিয়েছে!
তারপর বন্ধুবান্ধব, পড়াশুনোর চাপ, নতুন ক্রাশ- কখন যেন রাজের কথা সে ভুলেও গেল।
আজ এতোদিন পরে আবার সাংলা ট্যুরিস্ট লজের ছেঁড়া কাগজে লেখা নম্বরটা তার হাতে উঠে এলো! কী যেন ছিল নাম্বারটা? দেখিতো…
ভালো করে ফোন নাম্বারটা দেখে হো হো করে হেসে ওঠে কমলিকা।
আররে, ফোন হবে কি করে! শুধু তো নাম্বার। এস টি ডি কোডটা তো দেওয়াই নেই। লাইন পাবে কি ভাবে!
হাসতে হাসতেই কাগজের টুকরোটাকে পাকিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো কমলিকা। এখনই কাজের মাসি আসবে ঝাঁট দিতে।
আবার কী মনে করে কাগজটা মাটি থেকে তুলে, হাত দিয়ে চেপে চেপে টানটান করে, তারপর সুন্দর করে ভাঁজ করে, শিমলায় কেনা সেই ব্যাগটা,
যার মধ্যে তার ছোটবেলার প্রেশাস পুতুল, কার্ড সব ভরে রেখেছে, সেখানেই রাজের হাতে সাংলা ট্যুরিস্ট লজের নাম্বার লেখা কাগজটাকেও রেখে দিলো কমলিকা।
0 comments: