0

প্রবন্ধ - দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য

Posted in






রোরো নদীর জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই বালক। জল থাকলে পাথরও থাকে, তাই সে চেয়ে দেখছে এদিক ওদিক। আরে, ওই তো পাথর! এদিকে বুক পকেট থেকে তার উঁকি দেয় পালক। পালক মানেই তো পাখি! পাখির ভিতর নারী। আর পাথরে ঘুমোয় এক জখম পুরুষ। সেই মেয়েকে একা ছলছলে জলে ঠেলে দিতে সাহস হয় না তার। যায় যদি, হাতে হাত ধরে যাক। তাহলে তো তার এক সঙ্গীর প্রয়োজন। চলো পুরুষ, জল-আগুনের সঙ্গী হও, এই বলে সে পাথরে পালকটুকু জড়িয়ে ছুঁড়ে দেবে ভাবে। আরও ভাবে, সে নিজেই তবে কি সেই পাথর? তার বুকেও কি লুকিয়ে আছে কোনো সাতরাঙা পালকের পাখি? ... এইখানে এসে আমাদের একবার দু'চোখ বুজে ফেলতে হয়। খুলে নিয়ে দেখি, সেই বালক কোত্থাও নেই। আছে কি সেই রোরো নদীও? আর সেই পালকের মতো নরম এক নারী :

'রোরো নদীর ধার থেকে ঐ একটি বালক/ কুড়িয়ে পেয়েছিল রঙিন বুকের পালক/এবং একটি পাথর পেয়ে, সেই পালকে/ জড়িয়ে,ছুঁড়ে দিয়েছিল এপার থেকে/ পালক কি আর একাকিনী ওপার যাবে?'

বোর্খেসের 'সারকুলার রুইনস' গল্পটা মনে পড়ে তোমার? সেই যে... একটা লোক ভাবত দিনরাত শুধু স্বপ্ন দেখবে, সেই স্বপ্নই হবে তার ইচ্ছেপুরণের চাবিকাঠি। সেই স্বপ্নগুলোই তার আসল জীবন আড়াল করা প্রকৃত জীবন। নানান ব্যর্থ চেষ্টার পরে একদিন হঠাৎ স্বপ্নের সঙ্গে তার একরকম সমঝোতা হয়ে যায়। স্বপ্নের কামারশালার আগুনে আর আঘাতে সত্যি সত্যিই তারপর সে এক ইচ্ছামানুষ হয়ে উঠল! হৃৎপিন্ড থেকে চোখের পাতা অবধি সমস্ত কিছুতে :

'এবার বসন্তকালে বৃষ্টি হল স্বপ্নের ভিতর/ স্বপ্নের ভিতর হল বজ্রপাত'

'গভীরতা পড়ে থাকে, উপরে লাফায় তারই জল/ রমণীর সাজ আর স্বরূপের বিরোধের মতো/ এবং স্বপ্নের মতো মুহূর্তকে আক্রমণ করে, ফসফরাস, শাদা সিঁড়ি...'

স্বপ্নের ভিতর নিজেকে গড়ে নিতে নিতে সারাজীবন যিনি একটিমাত্র কবিতাই লিখে গেছেন, তাঁর নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কবিতার লাইনগুলোর আড়ালে মনের এক সাতমহলা বাড়ি মুখ ডুবিয়ে থাকে। যেন একটা পুকুরের মধ্যে ডুব দিয়ে আর ভেসে না ওঠার খেলা, যতক্ষণ ডুবে থাকা যায় ততক্ষণ যা দেখা-জানা হল, তাই দিয়েই কবিতা লেখা! তাই বোধহয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থেই আমরা 'পাতাল থেকে ডাকছি' শিরোনামের একটি কবিতা পেয়ে যাই! পাতাল থেকে ডাকছি --- প্রকাশ্যের প্রকাশ নয়, গহন আজানার রহস্যময় উন্মোচন! আমাদের কল্পনা আর চেতনার দুয়ারেই তাঁর কবিতা কড়া নাড়ুক, এ-যেন তাঁরই চাওয়া।

দু'টুকরো হয়ে বাহির-ভিতরে ছড়িয়ে প'ড়ে, নিজেই নিজের ছায়া হয়ে, দর্শক এবং শ্রোতা হয়ে, নারী এবং পুরুষ হয়ে, স্বপ্নাবিষ্ট বালক এবং আশ্চর্য জাদুকর হয়ে, তারই মতো ইজের গুটিয়ে এক সম্মোহিত মিছিলের পায়ে পা মেলায় তাঁর কবিতা। সঙ্গে থাকেন তাঁর পথভোলা ঈশ্বর।তাঁকে ডাকলে তিনি বালক কবির হাত ধরে চৌরঙ্গীর ছটফটে ব্যস্ত মোড় পার করে দেবেন। কখনো ঘুম থেকে জেগে ওঠার আকুতি -- সে-জেগে ওঠাও বোধহয় আরও এক স্বপ্নচুড়োর দিকে ঢলে পড়া --- কখনো ঘুমেই চিরসমর্পণ :

'সেগুনমঞ্জরী হাতে ধাক্কা দাও, জাগাও আমাকে/আমি আছি বিষঘুমে, জাগাও আমাকে/...জাগাও আমাকে তুমি গাছের মতন/ দীর্ঘদেহী গাছ, ঐ গাছের মতন/ পাতায় পাতায় জাগবে অরণ্যকুহেলি/...আমাকে জাগাও তুমি হলুদের মাঠে/ চঞ্চল হরিণ এসে সম্মুখে তাকাবে/...আমাকে জাগাও তুমি সেই পদ্মবনে/যেখানে ছোবল দেবে সাপে সর্বক্ষণ ... শুধু জাগরণ চাই, বারেক জীবন!' (অংশ)

'কেউ কি কখনো জাগে? নিভন্ত ঘুমন্ত রোরো নদী,/ স্বপ্নের ভিতরে চলে জলোচ্ছল, জলোচ্ছল; বেগে/ ঘুমের নিজস্ব এক প্রাপণীয় অন্ধকার আছে।'

তাঁর সম্বন্ধে শুধু এইটুকু বলা যায়, যে তাঁর আছে এক তীব্র হাতছানির মালিকানা -- স্বপ্নমঞ্জরির ঘ্রাণ তাঁর সারা পথে। বাইরের থেকে কথা তুলে নিয়ে, বাইরের কথা বলতে গিয়ে, হয়তো নকশাল আন্দোলনের ভয়াবহ দিনগুলোর কথাই সেইসব --- টানে-টোনে মনে ভর দেওয়াই শক্তির স্বভাবজাত। যা দেখছি তাই যেন শেষ কথা নয়, তার একটা 'ভিতর' আছে, একটা মনের-দেখার দিক আছে! সেইজন্যেই হয়তো তাঁর কবিতায় 'ভিতর' কথাটির এতবার যাতায়াত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পুতুল নাচের ইতিকথায়' শশী ডাক্তার কুসুমকে কী বলেছিলেন, মনে পড়ে তোমার? -- ' শরীর! শরীর! তোমার কি মন নাই কুসুম?'

' "হ্যান্ডস আপ্" ---হাত তুলে ধরো --- যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ তোমাকে তুলে নিয়ে যায়/ কালো গাড়ির ভিতরে আবার কালো গাড়ি, তার ভিতরে আবার কালো গাড়ি/ সারবন্দি জানলা, দরজা, গোরস্থান --- ওলোটপালোট কঙ্কাল / কঙ্কালের ভিতরে শাদা ঘুণ, ঘুণের ভিতরে জীবন, জীবনের ভিতরে মৃত্যু --- সুতরাং / মৃত্যুর ভিতরে মৃত্যু/ আর কিছু নয়!'

রহস্যময়তার জন্যেই তো কবিতার কাছে যায় মানুষ! যা কিছু জানার বাইরে --- প্রেম, মৃত্যু, শরীরের অগুন্তি আগুনশিখা -- সে-সব ছুঁয়ে দেখতেই কবিতার কাছে যাওয়া। সেখানে নারীও 'কালবেলা'-র 'মাধবীলতা'র মতো মনোময়, প্রতিদিনের নারী সে নয়! সে তবে কে? মধুলোভী কোনো সোনার অলীক ভ্রমর! তাকে নিয়ে একা একাই খেলার ভিতরে ঢুকে যান কবি, যেখানে আর কেউ কোত্থাও নেই। তাকে দূর থেকে গোপন দৃষ্টিজ্বরে পুড়িয়ে দিতে চেয়ে থাকেন শুধু। তাকে পাবার-হারাবার অভিঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে শেষ অবধি ভেঙে পড়েন:

'আমি সোনার একটা মাছি খুন করেছি রাতদুপুরে/...খুন করে নীল ভালোবাসায় চমকপ্রদ জড়িয়ে গেলাম।।' (অংশ)

'এই খেলাটি একলা আমার, খেলব -- যেন তার কপালের/ কাঁচপোকাটি তেমনি থাকে, চারদিকে জল, খন্দ-খানা/ কেশ করেছি আবোল-তাবোল, চুম্বনে ঐ দগ্ধ গালের/ আধখানা খাই, আধ্লা রাখি --- বুক ভরে বাস হাস্নুহানার/ এই খেলাটি একলা আমার, তোর সেখানে খেলতে মানা।' (অংশ)

'কী তুমুল বৃষ্টি হল শান্তিনিকেতনে... / ডুবে গেল কাশ ফুল, ভেসে গেল ঝরা শিউলি তলা। /... কাঁকর লেগেছে স্তনে, মাথা ভর্তি কাঁকরের ফুল,/ দুহাতে সরাই সব, তোমার স্বপ্নের মতো দেহ ---/ বাহু গন্ধে নুন জল, যতক্ষণ মেঘ থাকে ভালো।'

'আমার রমণী শুয়ে, দুই পাশে দুটি মাছরাঙা / আমার সর্বস্ব আজ ভাঙা/ আমার সর্বস্ব আজ ভাঙা।/ হাত পা ও বুকের পাঁজর / চারিদিকে অক্ষর অক্ষর/ চারিদিকে অক্ষর/...আর কিছু নেই!'

মিলনশেষের এক ক্লান্ত আলুথালু নারীর চারিদিকে এত অক্ষর

0 comments: