0

গল্প - জাকিয়া শিমু

Posted in






পর পর পাঁচদিন ঠিক একইসময়ে অজানা নম্বর থেকে ফোন কলটা আসে, আজও ঘড়ি ধরে বসে আছি এবং ঠিক বারটা ন’মিনিটের মাথায় ফোনটা মন্দিরের ঘণ্টার মতো কাঙ্ক্ষিতশব্দে বেজে উঠল! আমি সাধারণত অজানা নাম্বারের ফোন ধরি না,উপরন্ত কাছের কেউ না হলে, কাজের সময়ে ফোনালাপে যারপরানই বিরক্ত হই। ফোনকলে নিজদেশের কোড নম্বর নির্দেশ করে। পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির কারণে কোড নির্দেশিত সেদেশে এখন মাঝরাত আর আমার এখানে ভরদুপুর। আমি একটু ভেবেচিন্তে চলি,মূখ্যত আমাকে চলতে হয়। যারদরুন অকালে কপালে গুটিকয় ভাঁজও পড়ে গেছে, ভাঁজের নিচে হালকা পেতলরঙের ঠাণ্ডা চোখদুটো আলগোছে বন্ধ করে ফোনের বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বসি- ফোনটা আসলে কার ! ধরব কি,ধরব না, এমনতর দোটানা-মন নিয়ে নয়, বলতে গেলে বুঝেসুঝে কপালের ভাঁজে দ্বিগুণ বিরক্তি টেনে গলায় যথাসম্ভব গাম্ভীর্য নিয়ে ফোনটা ধরি। এপাশ থেকে ফোনটা ধরতে; ওপ্রান্তের ভার ভার,কতোকাল না-শোনা কিন্তু প্রতিক্ষণের কাঙ্ক্ষিত গলায়, নিজের নামটা শুনে আচমকা শরীরটা হিমশীতল বরফখণ্ডের মতো জমে যায়! হৃদপিণ্ডে আঁচড় কেটে যাওয়া মানুষটার কণ্ঠস্বরে,নিজের বর্তমানকে ছুড়ে ফেলে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শিহরণে চৌদ্দ বছরের বালিকার মতো ভেতর ভেতর লাফিয়ে উঠি। ফোনের ওপ্রান্তের প্রশ্নের উত্তরে বহুকথা কথারঝুলিতে উপচে-পড়া জমা থাকলেও এমুহূর্তে আমার কণ্ঠ স্থির স্থানু হয়ে আছে, যেন জাঁতিকলে কেউ তা চেপে ধরে আছে !

এরপর থেকে আমি তুমুল হারে বদলে যেতে শুরু করি- আমার রোজকার কাজকর্ম সম্পূর্ণ ভিন্নবলয়ে আবর্তিত হতে থাকে। সকালে আড়মোড়া ভেঙ্গে কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ির নিয়মিত-অভ্যাসটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে হুরমুড়িয়ে বিছানা ছেড়ে, ঝটপট সকালের কাজ গুছিয়ে অফিসে চলে আসি। আমি সাধারণত সকালের কফিটা আয়েশ করে অফিসবন্ধুদের সাথে গল্পেরঝাঁপি মেলে উপভোগ্যে অভ্যস্ত কিন্তু কফিকাপের ঝনঝনানিতে এখন আর মন বসে না। অথচ এই দু’দিন আগেও কাজের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডাটা না হলে কাজে মন ফেরানো মুশকিল ছিল। এসব আর কোন কিছুই আমাকে টানে না শুধু ফোন কলটার জন্য অবরুদ্ধ উচ্ছ্বাস নিয়ে দুপুর অবধি তীব্র তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো অপেক্ষায় থাকি। অফিসের কাজ গোঁজামেলে কোনমতে করি বটে,ক্ষণে ক্ষণে ঘড়ির কাটায় অস্থির চোখযুগল আটকে থাকে। মিনিট কাটতে সময় নেয় যেন ঘণ্টা পেরিয়ে,মনে হয় বারোটা বাজতে আজকাল দীর্ঘ সময় কেটে যায়। পয়ত্রিশ বছর বয়সী এই আমি আচমকা চৌদ্দ বছরের প্রথমপ্রেমে-পড়া খুকির মতো ছটফট করি। একটা সময় পর ফোনটা ঠিক সময়ে বেজে উঠে। আলাপের ঘোরে মধ্যাহ্ন বিরতি কোন নিমিষে কেটে যায়,টের পাই না কিন্তু কথা যে সব অ-বলাই থেকে যায় ! রাতজাগা-সময়ে গুছিয়ে রাখা কথাগুলো শেষপর্যন্ত আগামিকালের জন্যে পড়ে থাকে। আমরা এই দীর্ঘসময়ে যদিও আমাদের কাছে খুব অল্পসময় মনে হয়, কতো কি কথা বলি, যার কোন অর্থ নেই কিংবা বেশ অর্থবহ অন্তত আমাদের কাছে তো তাই মনে হয়! আমরা আমাদের আজন্ম লালিত স্বপ্নের আত্নহননের দহনের দিনযাপনের গল্প করি। সময়ের ব্যবধান ভুলে একলহমায় অতীতদিনে ফিরে যাই। সময়ের ঘণ্টা বেজে উঠলে ফোনটা ছাড়তে হয়। পরের দিন আবার আগের দিনের গল্পের বাকি অংশ ধরে কথা শুরু করব প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই বটে আসলে সেসব কথা মনেমুড়িয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গে আলাপ চলে আসে। এভাবে প্রতিদিনের গল্পগুলো পুঁতিরমালার মতো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।

আমাদের সম্পর্কটা আদিতে কী ছিল ! এখনই বা তার কী নাম হবে ! উত্তর পাওয়া দুষ্কর হলেও বলতে দ্বিধা নেই এমন সুন্দর পরিচ্ছন্ন সম্পর্ক জগতে খুব কমই হয়। তবে সম্পর্কটা বোঝা ভারি মুশকিল, অনেকটা দিঘির কালোজলে হারিয়ে যাওয়া নাকছাবির মতো- পরখ করে দেখলে ঝকমকিয়ে উঠে, হাত বাড়ালে কাদাজলে লুকিয়ে পড়ে, এমন বুক ধড়ফড় ধুঁয়াশাঘেরা’ একটা সম্পর্ক। আমাদের নিজেদের মধ্যে প্রথম পরিচয়ের শুরুটা পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেছি, সঠিক করে কারোরই মনে নেই। আমরা একই স্কুলে পড়তাম,যদিও দু’জনের শ্রেণি ছিল- দুই ক্লাস উপর-নিচ। পড়াশুনায় আমরা স্কুলের সেরা ছিলাম। সে সুবাদে হাজারো মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলাম আমরা। আর তাতে ওটুকু কচিবয়সেও শীতের সকালের কুয়াশার মতো অহমের একটা চাদরে আমরা জড়িয়ে গিয়েছিলাম। কেন্দ্রীয় মানুষগুলো সাধারনের মতো হতে নেই, এমন বোধে আসক্ত ছিলাম এবং তালঠোকা কায়দায় অচিরেই কলার থোরের আবরণের ন্যায় একটি গাম্ভীর্যের ভাঁজ পড়ে আমাদের ব্যক্তিত্বজুড়ে। তবে আমাদের মনের জানালা খোলাউন্মুক্ত ছিল, তাতে কোন আবরণ স্পর্শ করতে পারেনি যা আমাদের অস্বীকার করার উপায় ছিল না। একই স্কুলে পড়তাম তাই দেখা হবার সুযোগ ছিল, দেখা হতোও বটে। আমরা কেউ কারো সাথে সহজভাবে মিশতে অভ্যস্ত ছিলাম না, অথচ আমাদের মন চাইত নিজেদের মধ্যে একঝোঁক কথাবার্তার বিনিময় হউক। সেটা অবশ্য মনের কথা, আজ পর্যন্ত কেউ তা কথার ছলেও প্রকাশ করিনি তবে হলফ করে বলা যায়, আমরা খুব চাইতাম আমাদের একটা সম্পর্ক হউক। আজকে এতদিন পরও কী আমরা সেরকম কিছু চাইনা ! তবে সেসময়ে কথা যে একেবারেই হত না, তা কিন্তু নয়। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একত্রে আমাদের দফতরি কাজ করার নিয়ম ছিল। যতটুকু মুখে না বললেই নয় ততটুকু চালিয়ে নেওয়ায় অভ্যস্ত ছিলাম। যদিও অব্যক্ত কথাগুলো পাশাপাশি বোঝাপড়ায়, ব্যক্তকথার চেয়ে হাজারগুণ বেশি বলা হয়ে যেত, চোখে চোখ না রেখেও মনেরচোখে একে অপরকে দেখেছি শত সহস্র বার।

একটা সময় পর মানুষটা স্কুলগণ্ডি পেড়িয়ে শহরের নামকরা কলেজে চলে যায়। তখন থেকে আমি আমার ভেতরের ভিন্ন এবং সম্পূর্ণ নতুন এক জগতের মুখোমুখি হই। আমার অতলস্পর্শী মনের আকাশে দিকশূন্য চিল ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়, খাঁ খাঁ করে মনের জমিন। বুকের গভীরের অচিনবোধ এই আমাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ হিসেবে আমাকে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমি জীবনের প্রথম কারো জন্য এমন নির্লজ্জ যদিও বিষয়টা আমি ব্যতীত কেউ জানতে পারে না, বেপরোয়া হয়ে পড়ি। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে দ্বিপ্রহরের ঢলে পড়া চাঁদের আলোতে পুকুরঘাটে চুপচাপ বসে থাকি। পুকুরের বুক থেকে ছুটে আসা বিরহী জলতরঙ্গের আলোকচ্ছটা আমাকে উদাস করে তোলে। জোসনা-ঝরা নারিকেল শাখে মৃদু কম্পনে আমি আমাকে হারিয়ে ফেলি! কতশত ভাবনার অনুরণে আমি বুঁদ হয়ে বসে থাকি। রাত্রগুলো নির্ঘুমে কেটে যায়, চোখের চারপাশে শ্বেতভল্লুকের মতো আঁধার কালো রেখা পড়ে। দিনগুলো কাটে রথেরচাকার মতো ঢিলেঢুলে, টেনে হেঁচড়ে। পড়াশুনায় মন নেই এমনকী দৈনন্দিন আটপৌরে কাজগুলোও করতে ব্যর্থ হয়ে পড়ি। সে-বয়সে এমন পরিবর্তনে আমার পরিবারও ভিন্ন চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠে। ডা. রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ হলে জীন-ভূতের আছর ছাড়াতে দোয়া-কবজে নিস্তার খোঁজে।

একসময় আমার অবশ্য চৈতন্য ফেরে এবং নিজের সাথে বোঝাপড়ায় বসি। সহজে সত্যতা ধরতেও পারি- আমাদের একসাথে, একপথে পাশাপাশি চলার প্রতিজ্ঞা ছিল না কোনোকালে, দ্বিধাম্বিত ছিলাম,ভালোবাসার খুঁটির জোর যদিও আমাদের মধ্যে ছিল তাও যে অত্যন্ত নড়বড়ে ছিল! পরিচয়ের শুরু থেকে আমরা সমান্তরালে হেঁটেছি, কেউ কাউকে যেন একফোঁটা ছাড় দিইনি। কলারমোচার মতো খোলস ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে আমাদের বড়ো বেশি দ্বিধা কিংবা নত হয়ে যাওয়ার প্রবণতা ছিল! নিজের সাথে নিজমনের তর্কের সময়টাও বিমর্ষময় হয়ে উঠে, কিছু অদেখা দীর্ঘশ্বাস সঙ্গোপনে বুকের গভীরে জমা হয়ে থাকলেও সে অবস্থা একটা সময় পরে মোটামুটি কাটিয়ে ওঠি। তারপর সময় মিলিয়ে যেতে- ধীরেসুস্থে স্মৃতির দেয়ালে ছায়া পড়ে, অবশস্মৃতিগুলো অনুভূতির চৌকাঠ পেড়িয়ে শূন্যতায় মিশে যায় তবে মুছে যেতে পারে না চিরতরে। সেসবের কিছুটা আঁচ হলেও ধূসররঙের অস্তিত্ব হয়ে হৃদপিণ্ডে লেপটে থাকে পাকাপোক্তভাবে। মনের গভীরে পুড়ে যাওয়া সেই প্রথম-প্রেমের অপূর্ণ স্বপ্নের কষ্টটা আমাদের বয়ে নিতে হয়েছে এতকাল।

এরপর প্রায় সাত বছর পর তার সাথে আমার আবার দেখা হয়-কোন এক ভাদ্রমাসের ভ্যাপসা গুমোট লাগা ধূসর সন্ধ্যাবেলায়, ঢাকার নীলক্ষেতের বইবাজারের খুপরিঘরগুলোর পাশে। সময়টা ঠিক এখনো মনে আছে, আমি বার বার আকশের দিকে তাকাচ্ছিলাম- কারণ আকাশজুড়ে তখন সীসারঙা মেঘেরা দাপাদাপি করছিল এবং ক্রমেই তা দুধেলগাভির ওলানের মতো ভারী হয়ে আসছিল, যে কোনো সময় টুপ করে ঝরে পড়ে বলে। সেরকম একটা অস্থির সময়ে আমি আমার হলের বন্ধু, মিলার সাথে প্রায় ঘণ্টা দুই নীলক্ষেতে সস্তাদরে প্রয়োজনীয় বই দরকষাকষিতে কিনে হলে ফিরতে রিকসার খোঁজে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশের হাঁকাহাঁকি ঠেলাঠেলি, রিকশার অতিরিক্ত টুংটাং আওয়াজ, গাড়ি বাসের অযাচিত বেহুদা হর্নের শব্দকে পাশ কাটিয়ে বুকচিরে বসে যাওয়া মানুষটার গম্ভীরকণ্ঠে উচ্চারিত আমার নামটা সেসব অযাচিত শব্দ ছেদ করে আমার কানে আসে লাগে। ভেবেছিলাম অবচেতন মনের কাণ্ড হবে হয়তো,তারপরও কেমন একটা লজ্জাবনত চোখে ভিড়ের ভেতর হন্যে হয়ে পেছন ঘুরে তাকে তালাশ করি। সে সুযোগে মানুষটা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি পাশ ফিরতে চমকে উঠি এবং মুহূর্তে নিজেকে ঝিনুকের শক্ত খোলসটার মতো একটা আব্রুবেড়ায় আচ্ছন্ন করে ফেলি! লোকটা নিজেও বোধকরি আমার মতো অচেনা একটা বোধে বাধা পড়ে ভেতরকার উচ্ছ্বাস প্রাণপণে চেপে রেখে কিছুটা সময় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। যেন আমাদের বাড়ি ফেরার বড্ড তাড়া,কোন বাহনের খোঁজে আমাদের এভাবে পাশাপাশি অচেনা কারো মতো দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল!

তবে দু’চারটা বাক্য বিনিময় যে হল না, তা কিন্তু নয়। কেমন আছি, জানতে চাওয়া হল- যদিও তার লাজুক কিংবা দ্বিধাম্বিত চোখজোড়া হাজার কথার জ্বালায় মরে যাচ্ছিল, চোখেরভাষা মনেরমানুষের কাছে গোপন করা যায় না। আমার মনেরশরীর তখন পুরোপুরি সম্মোহিত ছিল,ওটুকু উত্তর বের হতে সমস্ত শরীর নিংড়ে তীব্র আবেগের স্রোত বইছিল এমনহারে যে শেষপর্যন্ত কণ্ঠ ভেদে একটি অস্ফুট শব্দ বের হতেও ব্যর্থ হয় তবে বাধ্যমেয়ের মতো মাথা দুলিয়েছি। ততক্ষণে আকাশ ফুটু হয়ে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে। আমরা চারপাশের প্রচণ্ড ভিড়বাট্টা কাটিয়ে বলাকা সিনেমা হলের পাশে ছোট্ট এক ঘড়ি-ঘরে ঢুকে পড়ি। মিলা কথাপটু মেয়ে। লোকটার সাথে নানান বিষয়ে, অনবরত কথা বলেই যাচ্ছে, আমি নিরব হয়ে শুনছি। মানুষটা উচ্চশিক্ষা নিতে সামনের মাসে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।

ভাদ্র মাসের বৃষ্টি, খানেকক্ষণ ক্ষান্ত দেয়, আবার ঝুরঝুরিয়ে নামে। আকাশের ভাবসাব ভালো নয়,জোরেসোরে ডলক নামবে বলে। আমরা রিকসা নিয়ে যে যার পথে ফিরে যাই। এবারও আমাদের মনের গভীরে তোলা কাপড়ের মতো জমিয়ে রাখা কথাগুলো অদৃশ্য দেয়ালের ওপাশটায় চাপা পড়ে গেল! আমার বুকটা নিংড়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসল, চোখে নীরবজল। রিকসার পেছনের ছোট্ট জানালা দিয়ে বিপরীত পথে চলে যাওয়া রিকসার দিকে চোখ রাখি, লোকটা জগতসংসারের সমস্ত মায়া দু’চোখে ভরে আমাদের রিকসার দিকে চেয়ে আছে। ও-চাহনি হাজার না-বলা কথা, এক মুহূর্তে বলে গেল যেন!

এরপর আমাদের আর দেখা কিংবা যোগাযোগের সুযোগ হয় না। আমরা হেলায়ফেলায় আমাদের হারিয়ে ফেলি। তবে আমাকে আবার সেই পূর্বের অসুখে জেঁকে ধরে, সেই চৌদ্দ বছর বয়সের নির্জন সময়ের উদভ্রান্ত কল্পনারা মনের মাঝে নতুন করে আবার জেগে উঠে। আমি পাতলা কাঁচের মতো ঝুরঝুরিয়ে ভেঙ্গে পড়ি, তার শেষমুহূর্তের সেই মায়াদৃষ্টি আমাকে বিস্তর নাড়িয়ে, ভেঙ্গেচূরে আমার মধ্যে রীতিমত একটা অবর্ণনীয়-বিষাদের জনপদ তৈরি করে দিয়ে যায়। আমি সেই নিঃসঙ্গ পথে অসীম বিষণ্ণতায় একাকী পথে হাঁটি। রাতগুলো জেগে জেগে ভোর হয়, চোখেরকোণে প্রথমপ্রেমে পড়া খুকির মতো বেদনার্ত অভিমান জমে উঠে। উদ্ভট ছেলেমানুষী গ্রাস করে আমাকে। এত বড় শহর তাকে আমি কোথায় খুঁজে পাই ! রিকশা নিয়ে একা একা শহরের এপ্রান্ত অপ্রান্ত ঘুরি। ভরদুপুরে আনমনে বলাকা সিনেমা হলের পাঁশে সেই ঘড়িরদোকানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি। কতশত লোক পারাপার হয়, কিন্তু সেই মানুষটা এপথে আর ফিরে আসে না ! নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানগুলোতে তাকে খোঁজার ছলে অযথা বই হাতিয়ে যাই। একসময় নগরে সন্ধ্যা নামে, আমি ঘরে ফিরি, শহর ঘুমিয়ে পড়ে আমি মাথার উপর খানিক ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের সাথে পাগলের প্রলাপ বকি।

সময়, গভীর-ক্ষত সারিয়ে দিতে পারে- কথাটা আদতে সত্য নয় তবে জীবনের আটপৌরে অভ্যস্ততার সাথে মিলিয়ে দিয়ে সাময়িক কষ্ট প্রশমনে তার ভূমিকা মানতেই হয়। সেসূত্রে আমার হাহাকাররা অভ্যাসের সাথে তেলজলের মিশ্রনের মতো অমিশ্রিত অদৃশ্যমান এককুণ্ডলীর তৈরি করে এবং আমি অসহনীয় সেই বাঁধন ছিঁড়ে একসময়ে আবার বের হয়ে আসি তবে হৃদয় খুঁড়ে তৈরি হওয়া ক্ষতের আঁচড়গুলো একান্ত হয়ে আমার বুকে রয়ে যায় ঠিকই। পড়াশুনা শেষ করি এবং বিদেশে পাড়ি জমাই। বিদেশে এসে পড়াশুনা করে ভাল চাকুরীও জুটে যায়। সংসার,চাকুরী সবকিছু নিয়ে ভালোমন্দে দিনগুলো কেটে গেলেও একান্ত নিভৃতে ছলে-কৌশলে মনেরগভীরে বেড়ে ওঠা দগদগে ক্ষতের সেই অস্তিত্ব আমার মনের চৌকাঠে আছড়ে পরে নিয়ম করে।

এতকাল পরে আবার ফোনের ওপ্রান্ত থেকে, মানুষটা আমাকে শূন্যে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আমরা কেউ কারো কাছে আজও কিছু খোলাসা করে চাই না। আমাদের চাইবার কিছু নাই হয়তো,কিংবা আসলে আমরা বুঝে উঠতে পারি না। অপক্ক বয়সের কথাগুলো আজও অযথা বলে যাওয়ার বৃথা চেষ্টা করি। স্মৃতিগুলো, যদিও দু’জনের মনে গভীর চিহ্ন এঁকে দেওয়ার মতো কোন স্মৃতি আমাদের নেই তারপরও খুব প্রিয় কোন কাঁচের পাত্র ভেঙ্গে গেলে যত্ন করে টুকরোগুলো একত্র করার চেষ্টা চলে প্রাণপণে সেরূপে আমরা আমাদের হারানো অতীতের আবছায়া-খুঁটিনাটি স্মৃতিগুলো বড় আক্ষেপে হাতড়ে চলি। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি আমার মতো সেও, সঠিক সময়ে না বলা কথার আক্ষেপে চৈত্রের খরতাপে খড়মাঠের মতো দাহ্য হচ্ছে। মাঝে অনেক বছর চলে গেছে তারপরও মানুষটার সেসময়ের অতিসাধারণ আটপৌরেস্মৃতি মনে রাখার ক্ষমতায় চমকে উঠি, এমনকি আমার ভেতরের লুকায়িত অনুভূতিগুলোও তাকে ছুঁয়ে দিয়েছিল যা আমার কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়।

ফোনের অপরপ্রান্তের কথা মুগ্ধ হয়ে শুনি। আজ কথাপ্রসঙ্গে তিনি এমন একটা ঘটনা তুলে আনলেন যা কিনা এতদিন আমার মনেরতলায় চাপা পড়েছিল,সে যেই বলতে শুরু করল অমনি যেন সচিত্র সেসব রঙিন পর্দায় দেখতে শুরু করলাম। মানুষটা স্কুল শেষে কলেজে ভর্তি হয়েছে সেসময়ের কথা। সে তুখড় মুখস্থবিদের মতো সেদিনটির কথা বলে যায়-

সেদিন শরতের সেই মধ্যাহ্নবেলায় শারদ নীলে বুঁদ হয়ে ছিল আকাশ, যেন নীল শাড়িরআঁচল উড়ে গিয়ে আকাশে ভেলা হয়ে ভাসছে। আমি চোখ বন্ধ করি,হুবহু সেই দিনে ফিরে যাই। আকাশনীলের ছায়া পড়েছিল ঝিলের জলে- আমি তাজ্জব বনে যাই! আসলেই তাই, সেদিনের আকাশ-জমিন সর্বত্র নীলের মেলা বসেছিল যেন। লাল সাদা শাপলা নীল জলে মনের সুখে ভাসছে। রঙিন প্রজাপতি আর ঘাসফড়িংদের মেলা জুড়ে বসেছিল ঝিলের পরে। সবে বর্ষা বিদায় নিয়েছে তারপরও তার রেশটুকু রয়ে গিয়েছিল প্রকৃতি জুড়ে-বাতাসে ভেজা ভেজা গন্ধ। নীলাকাশের বুক জুড়ে শরতের আহ্লাদি মেঘ,সূর্যকে ক্ষণে ক্ষণে আড়াল করতে ব্যস্ত। রোদহীন সেই নরম প্রকৃতির আঁচ নিতে আমরা বন্ধুরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে নৌকো চড়ে ঝিলে বেড়াতে যাই। আমাদের পরনে ছিল নীল-সাদা স্কুল ড্রেস। মানুষটি সেপথ ধরে নৌকো নিয়ে শহর থেকে বাড়ি ফিরছিল। আমি দূর থেকে দেখেছিলাম বটে যদিও সে তার স্বভাব মতো আমাদের দিকে ফিরেও চায়নি। না তাকিয়েও এত বিস্তর দেখা যায়, তার মুখে এতদিন পরে না শুনলে হয়তো বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। সেদিন থেকে মানুষটার নাকি নীলরঙটা পছন্দের তালিকায় প্রথম হয়ে রয়ে গেছে!

রং নিয়ে অবশ্য আমারও একটি গোপনকথা আছে, কৌশলে লুকিয়েছি। কিন্তু আমাকে বোকা বনে দিয়ে নীলরঙ আঁকড়ে ধরা মানুষটি হুহু করে হেসে উঠে,পরক্ষণে আমার হলুদ-রঙের রহস্য জানতে চায়, আমি ফোনের এপ্রান্ত থেকে লজ্জায় হাওয়ায় নড়ে-ওঠা লালরঙটা জবার মতো দোলে ওঠি।

আমাদের স্কুলে মাঝে মধ্যে উপস্থিত যুক্তিতর্কের আয়োজন করা হত। সেরকম এক আয়োজনের বিষয় ছিল- হলুদ বনাম সবুজ। বিষয় নিজেদের ইচ্ছেয় নয়, আধুলি ছুঁড়ে যাদের ভাগ্যে যে বিষয় পড়বে তা নিয়ে বিতর্ক হবে। আমাদের দল সবুজের পক্ষে, বিপক্ষ দলে মানুষটির অবস্থান। তুমুল বিতর্ক চলছে। হলুদ রং’ বিষয় হিসেবে কঠিন বটে, সহজে উপযুক্ত ব্যাখ্যা খোঁজে পাওয়া মুশকিল। তারপরও সে জ্ঞানের গভীরতায় বিষয়কে খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে তোলে। তার উপস্থাপন ছিল চমৎকার উপভোগ্য, আমি বিপক্ষদলে থেকেও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার বক্তব্য শুনছিলাম। সবুজ’ আমাদের দলের রং, বিষয় হিসেবে হলুদের চেয়ে সহজ বটে। আমি শুরুতেই আমাদের দেশের পতাকা, সবুজ ফসলের মাঠ এসবে সবার নজর ফেরাই। আমার মতো আমার দলের বাকিরাও সহজেই বিভিন্ন সহজ ব্যাখ্যায় বিতর্ক চালিয়ে নেয়। আমরা জিতে যাই। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আমার পছন্দের রং’টা শুধু বদলে যায়। হলুদ রং আমার অপছন্দের তালিকার প্রথম দিকে ছিল। প্রিয় রং’ সাদার জায়গা খুব সহজে হলুদ এসে দখল করে নিল। এরপর থেকে আমি হলুদ রং ছাড়া অন্য কোন রং চোখে দেখি না, আমার যাবতীয় বিষয়ে হলুদের ছড়াছড়ি। বিষয়টা বেশ গোপনীয় হলেও মানুষটার নজর এড়াতে পারেনি। ৪ এভাবে ফোনে এমনসব গল্পে আমাদের সময় খুব ভাল কাটতে লাগল।

যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজলভ্যতায় যোগাযোগ এখন চোখ-নাকের দূরত্বে। ইচ্ছে করলে সেকেন্ডের ভেতর প্রিয় মানুষকে দেখা যায়, কথা বলা যায় তবে পৃথিবীর গতির কারণে একপাশে দিন, অন্যপাশে রাত। আমার বিপরীত প্রান্তে থাকা খুব কাছের এক স্কুল বন্ধু মাঝরাতে ফোনে আমাকে খোঁজে, যার শব্দে আমি গভীর ঘুম থেকে একলাফে জেগে উঠি। খানিকক্ষণ লাগে দম ফিরে পেতে- বুকের ধরফড়ানি কাটিয়ে ফোনটা কানের কাছে নিতে-ওপাশের উচ্ছ্বাস আমার বাকি রাতের ঘুম কেড়ে নেয় একনিমিষে। যার সাথে একসময়ে একদিন দেখা না হলে মনখারাপের তাড়সে ছটফট করতাম সে কিনা এত বছর পরে এই রাতদুপুরে ! বন্ধুর বিয়ে হয়ে যায় কিশোরীবেলায়, তার সাথে আর দেখা হওয়ার সুযোগ হয়নি। আমাদের জমানো শত গল্প ঝুড়ি ভরে যেন উপচে পড়ছে, আমরা এই মাঝরাতে সমানতালে কথা বলেই যাচ্ছি ! বন্ধুরবাড়ি আমাদের পাশেরগাঁয়ে কাজেই ছেলেবেলার বন্ধুদের খোঁজখবরে তার কোঁচড় ভর্তি হয়ে আছে। রাত শেষ হয় কিন্তু আমাদের গল্পের ডালা মেলে আরও জোরেশোরে। গল্পে -গল্পে প্রসঙ্গের নড়চড়ে, আমার প্রিয় মানুষটির কথা চলে আসে। আমার ভালোলাগার বিষয়টি আমার এই বন্ধু জানত। বন্ধুর গাঁয়ে মানুষটার গ্রামেরবাড়ি এবং এরা পরস্পর লতায় পাতায় জড়ানো ধরনের আত্নীয়ও বটে। তার প্রসঙ্গ উঠতেই আমার বন্ধু ফোনের ওপাশে ডুকরে কেঁদে উঠে! এপ্রান্তে আমি বিস্মিত হয়ে তার কান্নার কারণ জানতে উন্মূখ হয়ে থাকি। একসময় বন্ধু নিজেকে সামলে নিয়ে জানায়-

গত তিন বছর আগে রোড এক্সিডেন্টে আমার ভালোবাসার মানুষটি মারা গেছেন !

0 comments: