0

প্রবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in

 

সমর সেন (১৯১৬-৮৭)

[আমি জানি কবি সমর সেন বা তাঁর কবিতা নিয়ে লেখার যোগ্যতা আমার নেই। কাজেই আমি সে চেষ্টা না করে বলবো ষাটের দশকের শেষে সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা আমরা, মানে ওই শেখর, অমলজ্যোতি, দেবু, মনোজ ও আমি, কীভাবে সমর সেনকে জেনেছি সেই কথা।

স্মৃতি অনেক সময় ধোঁকা দেয়, কেউ তথ্যে ভুল ধরিয়ে দিলে কৃতজ্ঞ থাকবো।]


সমর সেন যে কবিও বটেন সেটা জেনেছি অনেক পরে। আমরা, বাংলা স্কুলে ইংরেজি শেখা ছেলের দল বাড়ির বড়োদের টেবিলে হুমায়ুন কবীরের ‘নাউ’ পত্রিকার পাতা ওল্টাই বেশ সম্ভ্রমের সঙ্গে। সেখানে তখন বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের মেলা জমেছে। উৎপল দত্ত লিখছেন রফিকুল ইসলাম নাম নিয়ে। অশোক মিত্র বোধহয় ইপিডব্লিউর মত এ এম নিক নিয়েই লিখছেন। সম্পাদক সমর সেন সবার মধ্যমণি, ফিল্ডের ম্যাগনেট।

আমরা শুনতাম উনি নাকি কলকাতা ইউনি’র ইংরেজিতে এম.এ., এবং ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। শুনেছি দাদু দীনেশ চন্দ্র সেনের (অধ্যাপক এবং ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র সংকলক) সঙ্গে বন্ধুর ছিলো দোস্তানা সম্পর্ক। গায়ের কটা রঙ এবং অল্পবয়েসে ইংরেজি ভাষায় অমন দখল দেখে দাদু ডাকতেন— অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। এবং ইউনিতে টপার হওয়ার পর দাদুকে অক্সফোর্ড পাঠানোর প্রতিশ্রুতি মনে করিয়ে দেওয়ায় দাদু মাথা চুলকে বলেছিলেন— আদ্দেকটা আমি দিচ্ছি, বাকি আদ্দেক শ্বশুরের থেকে নিস।

সমর নাকি বলেছিলেন— পুরুষাঙ্গ বাঁধা রেখে বিলেত যাব না।

ওঁর বাবা অধ্যাপক অরুণ সেন নাকি নিজের পরিচয় দিতেন— এক প্রতিভাশালী পিতার আটপৌরে পুত্র এবং প্রতিভাশালী পুত্রের আটপৌরে পিতা হিসেবে। এই বাগবাজারী পরিবারটিই অদ্ভূত।

স্বয়ং সমর সেন পরে “বাবু বৃত্তান্ত” বইয়ে লিখেছেন ওঁর ‘বাগবাজারী বখামি’র গল্প। বেশ কয়েকটি সন্তানের পর আবার আরেকটি কন্যা জন্মালে বিমর্ষ ন’কাকা যখন এসব ভগবানের হাত বলে আফশোস করছেন, তখন সমর ভালোমানুষি মুখ করে জিগান— ভগবানের হাত এত ছোটো?

হ্যাঁ, উনি বিলেত-টিলেত না গিয়ে দাদু ও বাবার মতো অধ্যাপনা করেছেন এবং সাংবাদিকতা করেছেন প্রথমে স্টেটসম্যানে, পরে হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডে। আমার বাবা-কাকাদের সময় থেকে ইংরেজি পত্রিকা বলতে একটিই ছিলো— দি স্টেটসম্যান। তার এডিটোরিয়ালে সমর সেন? ধক আছে মাইরি!

ওঁর ইংরেজি নিয়ে আরও একটা গল্প প্রচলিত ছিলো। একজন নামকরা লেখকের নাকি অভ্যাস ছিলো লেখা— ‘মে অর মে নট’। তাতে সমর মুচকি হেসে বলেছিলেন— ওর স্কুলটা বোধহয় ভালো ছিলো না। ‘মে’ শব্দটার মধ্যেই যে ‘মে নট’ লুকিয়ে আছে তা ধরতে পারেনি।

ব্যস, আমাদের শ্রদ্ধা আকাশ ছুঁলো।

মাঝখানে কয়েকবছর মস্কো গিয়ে রুশী সাহিত্যের দারুণ সব অনুবাদ করেছিলেন।

তবে সত্যি কথা বলতে কি, সমর সেনের যে লেখাগুলো প্রথমে পড়েছি তা হল রুশী সাহিত্যের বাংলা অনুবাদ। স্কুলেই হাতে এসেছিলো টলস্টয়ের নির্বাচিত ছোটো গল্পের সংকলন। মস্কোর বিদেশী ভাষা সাহিত্য প্রকাশনালয় থেকে সমর সেনের অনুবাদে।

তাতে প্রথম গল্পটি ছিলো ‘দুই হুসার’। তার অভিঘাতে সারারাত ঘুম হয়নি। এখনও কানে বাজে কম্যান্ডারের নির্দেশে দুই সারি সৈন্যের মাঝখান দিয়ে হুমড়ি খেয়ে মার খেতে খেতে এগিয়ে চলা সৈন্যের মার্জনা ভিক্ষাঃ “দয়া করো, দয়া করো ভাইসব!”

এদিকে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনে দিল্লির প্ররোচনায়, যে অল্প মতের সরকার রাইটার্সে বসলো, তার পান্ডা হলেন নাউ পত্রিকার মালিক হুমায়ুন কবীর। মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল ঘোষ।

তখন রোজ লাঠি, গুলি, রোজ মিছিল। আমরা স্লোগান দিচ্ছি— “ঘোষ-কবীরের আসল নাম, বেইমান শয়তান।”

একদিন কি হৈচৈ! সমর সেন ওই কবীরের নাউ থেকে রিজাইন করেছেন, বেশ করেছেন। বাসে ট্রামে হাতে হাতে লিফলেট ঘুরছে— সমর সেন তাঁর পুরনো সাথীদের নিয়ে একটি নতুন ইংরেজি সাপ্তাহিক বের করবেন— “ফ্রন্টিয়ার।” ব্যস, সমস্ত গ্রাহক চলে এল নাউ ছেড়ে ফ্রন্টিয়ারে। কয়েকমাস টিমটিম করে চলে ‘নাউ’ বন্ধ হয়ে গেলো।

ফ্রন্টিয়ার কলেবরে বেড়ে চললো। তাতে থাকতো রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, ভারত ও বিশ্বের সমসাময়িক অর্থনীতি নিয়ে ওজনদার লেখা, সাহিত্য, নাটক এবং সিনেমা নিয়ে গতানুগতিকতার বাইরে অন্য স্বাদের লেখা। ছাপা হতো নিউজপ্রিন্টে, দাম আট আনা।

কিন্তু অনেকে খেয়াল করলেন সমর সেন যেন নকশাল আন্দোলনের দিকে টেনে লিখছেন। কিছু কিছু বন্ধু সরে যেতে লাগলেন।

আবার মূর্তি ভাঙার প্রশ্নে উনি বন্ধু সাংবাদিক সরোজ দত্তকেও (শশাংক) ছেড়ে কথা বলেননি। খতম অভিযানের প্রশ্নেও ওঁর নিঃশর্ত সমর্থন ছিলো না বলেই মনে পড়ছে।

এমন সময় জানলাম উনি কবিও বটেন, হ্যাঁ, চল্লিশের দশকের একজন বিশিষ্ট কবি! বুদ্ধদেব বসুর কবিতা পত্রিকার সম্পাদনাতেও নাকি কিছুদিন হাত লাগিয়েছিলেন। বিশ্বাস হচ্ছিলো না। কেন? আজকে হয়তো ছেলেমানুষি মনে হবে।

খবরে প্রকাশ আমেরিকার “কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রীডম” সংস্থা সি আই এ’র টাকায় চলে। এদের আন্তর্জাতিক মুখপত্র ‘এনকাউন্টার’এর সম্পাদক পদত্যাগ করলেন। এই সংস্থার ভারতের মুখপত্রের নাম কোয়েস্ট। তাতে সম্পাদনায় ছিলেন, যতদূর অম্লান দত্ত, আবু সয়ীদ আইয়ুব এবং বুদ্ধদেব বসু।

বামপন্থীরা দাবি তুললেন— এঁরাও পদত্যাগ করুন। এঁদের তাতে বয়ে গেলো। ইউনিভার্সিটিতে অম্লান দত্ত ক্লাস নিতে আসলে দেখতে পেতেন ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লেখা “সি আই এ’র দালাল।” উনি মুচকি হেসে ডাস্টার দিয়ে মুছতে মুছতে বলতেন— ক্লাসের বাইরে এমন জায়গায় লেখো যাতে লেখাটা অনেকদিন ধরে টিকে থাকে।

সেই বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে সমর সেন? হতে পারে না। বাজি ধরলাম এক প্যাকেট চার্মিনার।

কি আত্মপ্রত্যয়! তখন তো আমরা একটা চার্মিনার তিনজনে ভাগাভাগি করে খাই। দোকানে চার্মিনার পাঁচ পয়সায় দু’টো দেয়, পানামা চাইলে একটা।

গড়িয়া কলেজের সামনে রাস্তার ওপারে ‘পোঁদে গরম ঠেক’— মানে রোদে পোড়া কাঠের বেঞ্চ, চাটাইয়ের বেড়া, পাখার বালাই নেই— সেখানে শেখর ও আমার বন্ধু ঢাকুরিয়ার দেবু নিয়ে এল বুদ্ধদেব বসুর সম্পাদনায় প্রকাশিত “আধুনিক বাংলা কবিতা।”

তাতে সুকান্তের মাত্র দুটো ছোটো কবিতা? “একটি মোরগের কাহিনী” আর “হে মহাজীবন।”

আমি রেগে কাঁই।

তাতো হবেই। বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন না যে সুকান্ত কবি হতে পারতো, কিন্তু রাজনীতি করতে গিয়ে হয়ে উঠতে পারেনি। আর উনি নিজে কী ছাতার কবিতা লেখেন? “বক্ষ তব ঢাকিয়া দিনু চুম্বনের চাপে” বা “চর্ম সাথে চর্মের ঘর্ষণ, একমাত্র সুখ যাহাদের, তাহারা কি বুঝিবে প্রেমের”— ছ্যাঃ!

অথচ সমর সেনের ছ’টা কবিতা।

তবে দীনেশ দাসের ‘কাস্তে’ আছে। সুভাষ মুখোর আছে কয়েকটি। মঙ্গলাচরণ চট্টো, চঞ্চল চট্টো, অজিত দত্ত। অবশ্য জীবনানন্দ দাশের ঘ্যামা “রাত্রি,” “আট বছর আগের একদিন,” “বনলতা সেন,” “ঘড়ির দুইটি কালো হাত,” “অধ্যাপক” সবই আছে।

কিন্তু তখন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিং-এর দেয়ালে বড়ো বড়ো করে লেখা হচ্ছে “বাংলা কবিতার জগত থেকে ‘বনলতা সেনী বিবর্ণতা’ মুছে যাক।”

কিন্তু সমর সেন এসব কী লিখেছেন?

“তুমি কি আসবে আমাদের মধ্যবিত্ত রক্তে
দিগন্তে দুরন্ত মেঘের মতো!
কিংবা আমাদের ম্লান জীবনে তুমি কি আসবে,
হে ক্লান্ত উর্বশী,
চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে যেমন বিষণ্ণমুখে উর্বর মেয়েরা আসে—” (উর্বশী)

অথবা,

“হে প্রেমের দেবতা, ঘুম যে আসে না, সিগারেট টানি;
আর শহরের রাস্তায় কখনও প্রাণপণে দেখি
ফিরিঙ্গি মেয়ের উদ্ধত নরম বুক।” (একটি বেকার প্রেমিক)


এটা কি কোনও কমিউনিস্ট কবির লেখা হতে পারে? কমিউনিস্ট কবি তো লিখবে এরকমঃ

“জাপ-পুষ্পকে জ্বলে ক্যান্টন, জ্বলে হ্যাঙচাও,
কমরেড, আজ বজ্রকঠিন বন্ধুতা চাও?
লাল নিশানের নীচে উল্লাসী মুক্তির ডাক,
রাইফেল আজ শত্রুপাতের সম্মান পাক।” (সুভাষ মুখোপাধ্যায়)।

সমর সেন কী বিপ্লব যে, আমাদের নিয়তি সেটা মানেন না? যাচ্চলে!

কিন্তু দেবু আঙুল রাখে আগের কবিতাটির শেষ প্যারায়ঃ

“আর মদির মধ্যরাত্রে মাঝে মাঝে বলি
মৃত্যুহীন প্রেম থেকে মুক্তি দাও,
পৃথিবীতে নতুন পৃথিবী আনো
হানো ইস্পাতের মতো উদ্যত দিন।
কলতলায় ক্লান্ত কোলাহলে
সকালে ঘুম ভাঙে
আর সমস্তক্ষণ রক্তে জ্বলে
বণিক-সভ্যতার শূন্য মরুভূমি।”

আমি দেখাইঃ

“তোমার ক্লান্ত ঊরুতে একদিন এসেছিলো
কামনার বিশাল ইশারা!
ট্যাঁকেতে টাকা নেই,
রঙিন গণিকার দিন হলো শেষ,
আজ জীবনের কুঁজ দেখি তোমার গর্ভে,
সেইদিন লুপ্ত হোক, যেদিন পুরুষ পৃথিবীতে আসে।” (ঘরে বাইরে)

আমার সঙ্গে ধরতাই দিয়ে শেখর দেখায়ঃ

“কাঁচা ডিম খেয়ে প্রতিদিন দুপুরে ঘুম,
নারী ধর্ষণের ইতিহাস
পেস্তাচেরা চোখ মেলে প্রতিদিন পড়া
দৈনিক পত্রিকায়।”

দেবু হার মানে না, একই কবিতার শেষের দিকে ইশারা করেঃ

“তবু জানি, কালের গলিত গর্ভ থেকে বিপ্লবের ধাত্রী
যুগে যুগে নতুন জন্ম আনে।
তবু জানি,
জটিল অন্ধকার একদিন জীর্ণ হবে চূর্ণ হবে ভস্ম হবে
আকাশগঙ্গা আবার পৃথিবীতে নামবে।

ততদিন
ততদিন নারীধর্ষণের ইতিহাস
পেস্তাচেরা চোখ মেলে শেষহীন পড়া
অন্ধকূপে স্তব্ধ ইঁদুরের মতো
ততদিন গর্ভের ঘুমন্ত তপোবনে
বণিকের মাণদন্ডের পিঙ্গল প্রহার।” (ঘরে বাইরে)।

উমম, বুঝলাম। তা উনি আজকাল কেমন কবিতা লিখছেন? নিশ্চয়ই বদলেছেন স্টাইল বা বাগভঙ্গী?

নাঃ, উনি কবিতা লেখাই ছেড়ে দিয়েছেন।

সেকী? কবে? দু’দশক আগে? কেন কিছু শুনেছিস?

ওঁর মতে ওসব কিছু হয়টয়নি, তাই।

কি অনেস্ট দেখেছিস? বেশ করেছেন, আজ যখন সার্ত্রের মতো লেখক ও দার্শনিক প্যারিসের ব্যারিকেডে ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তখন ওইসব ন্যাকা ন্যাকা ঘ্যানঘেনে জিনিস পোষায়?

আমরা কবি সমর সেনকে ভুলে সাংবাদিক সমর সেন, গদ্যলেখক সমর সেনে মেতে উঠি। বলাবলি করি— জানিস, সমর সেনের বন্ধু অমুক, ফ্রন্টিয়ারে নিয়মিত লেখেন; উনি না মূল জার্মান ভাষায় ‘দাস ক্যাপিটাল’ পড়েছেন!

কিন্তু দেবুকে কবিতার বইটা ফেরত দেওয়া হয়না। ঘর-বাড়ি ছেড়েছি, কিন্তু এয়ারব্যাগের মধ্যে রয়েছে “আধুনিক বাংলা কবিতা।”

টের পাই, আমার নাড়ুগোপাল শরীর ভেঙে পড়ছে, কাশির সঙ্গে রক্ত উঠছে। লুকিয়ে ফেলি, কিন্তু চার্মিনার ছাড়তে পারিনা। সঙ্গীরা বিরক্ত হয়। তোর কাজে উৎসাহ নেই ক্যান? যেখানে যেতে বলা হয়েছিলো যাস নাই ক্যান?

রাত্তিরে লুকিয়ে বইটা খুলিঃ

“বর্তমানে মুক্তকচ্ছ, ভবিষ্যৎ হোঁচটে ভরা
মাঝে মাঝে মনে হয়,
দুর্মুখ পৃথিবীকে পিছনে রেখে
তোমাকে নিয়ে কোথাও স’রে পড়ি।” (নিরালা)।

আরে, এ তো আমার কথা! আমিও তো মুক্তকচ্ছ, আর ভবিষ্যৎ? নাঃ, ‘১৯৭৫ সালের মধ্যে ভারত মুক্ত হবে’ বা ‘বাংলার বিস্তীর্ণ সমতল দিয়ে গণফৌজ মার্চ করবে’ গোছের আপ্তবাক্যে বিশ্বাস হারিয়েছি, কাউকে বলতে পারিনে।

আমার যে আজকাল পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। সত্যি, চারপাশের পৃথিবী বড়ো দুর্মুখ। কমরেডরা ভাবে আমি আলসে, ফাঁকিবাজ, শেলটারে বসে বসে খেতে চাই। একটা কাউকে কনভিন্স করতে পারিনা। নো নতুন রিক্রুট!

আমার উর্বশী জানিয়েছে যে আমার মতো পড়াশোনা/ ক্যারিয়ার ছেড়ে খালি রাজনীতি করা ছেলের কোনও ভবিষ্যৎ নেই।

কাজেই

“শেয়াল-সংকুল কোনও নির্জন গ্রামে
কুঁড়েঘর বাধি;
গোরুর দুধ, পোষা মুরগির ডিম, খেতের ধান,
রাত্রে কানপেতে শোনা বাঁশবনে মশার গান” (নিরালা)

এসব স্বপ্নই থেকে যাবে। উর্বশী তার অংশীদার হবে? পাগল না কংগ্রেস?

তবু স্বপ্ন দেখি, হ্যাঁ, কমরেডদের শেলটারে বসে, জেগে জেগে।

“স্বপ্নের মতো চোখ, সুন্দর শুভ্র বুক,
রক্তিম ঠোঁট যেন শরীরের প্রথম প্রেম,
আর সমস্ত দেহে কামনার নির্ভীক আভাস,
আমাদের কলুষিত দেহে,
আমাদের দুর্বল ভীরু অন্তরে
সে উজ্বল বাসনা যেন তীক্ষ্ণ প্রহার।” (একটি মেয়ে)

আমার ঠেক ভবানীপুরে। চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে গিয়ে আউটডোরে লাইন দিয়ে অপেক্ষা করা মহিলাদের মন দিয়ে দেখি— মাথার মধ্যে যে ঘুরছে সমর সেনের “হে ক্লান্ত উর্বশী, চিত্তরঞ্জন সেবাসদনে যেমন বিষণ্ণমুখে উর্বর মেয়েরা আসে।”

ক্রমশঃ বুঝতে পারি উর্বশী আমার ধরাছোঁয়ার মধ্যে নেই।

ভালোই হয়েছে।

এলে আমার মধ্যবিত্ত ময়লা হাতের ছোঁয়ায় খুব তাড়াতাড়ি বিষণ্ণমুখে হাসপাতালে লাইন দেওয়া উর্বর মেয়ে হয়ে যেত। ভালোই হয়েছে।

কিন্তু এই রোম্যন্টিকতা খানখান হয়ে যায়। এখন যে শহর কোলকাতার আবহাওয়া পাল্টে গেছে। মৃত্যু এখন উৎসব। গলিগলিতে লাশ পড়ছে। শ্মশানে চালিতে শোয়ানো বডির লাইন। কাঠকয়লা দিয়ে পাশের দেয়ালে লিখে দিচ্ছি— ‘ভুলছি না, ভুলবো না।’ দেয়ালে দেয়ালে লেখা হচ্ছে “রক্তঝরা পথই তো বিপ্লবের পথ।”

“কিন্তু দুর্দিন এল, কি দুর্দিন এল!
মেঘে মেঘে অন্ধকার, ঝড়বৃষ্টি, বিদ্যুৎহুঙ্কার,
এ কী আকাশ,
ভয়াল ভবিতব্যতায় ঘোর আকাশের
শাক্ত গোধূলিতে
ভয়ঙ্কর মন্দিরে দিগম্বরী কালী,
শবাসনে তান্ত্রিকেরা স্তব্ধ,
দিনের ভাগাড়ে নামে রাত্রের শকুন।

নষ্টনীড় পাখি কাঁদে আমাদের গ্রামে
রক্তমাখা হাড় দেখি সাজানো বাগানে।” (নষ্টনীড়)

এই কবিতটি কবে লেখা হয়েছিলো? চল্লিশের দশকে? সত্যি?

নাঃ; কাশির ধমকে ভলভলিয়ে রক্ত উঠছে। আর না, আমি বাঁচতে চাই। কমরেডদের ওপরে বোঝা হবো না। ভালো করে খাবার জোটে না, আমার চিকিৎসার দায় ওদের নয়। চিকিৎসা করাতে হবে, মরলে চলবে না। ফিরে যাই, ছত্তিসগড়ের ভিলাইয়ে পিতার ছত্রছায়ায় নতুন শেল্টার। ব্যাগে থাকে কবিতার বইটি।

ফ্রন্টিয়ার পত্রিকা ব্যান। সমর সেনের হাতে কাজ নেই, অন্নচিন্তা চমৎকারা।

প্রতি সন্ধ্যায় ঘরে বন্ধু এবং ভক্তদের আড্ডা জমে। স্ত্রী সুলেখা সবাইকে পরিবেশন করেন এক কাপ চা ও দুটি থিন এরারুট বিস্কুট। ভক্তেরা কখনও কখনও নিয়ে আসেন রামের বোতল। একজন সিনিয়র পুলিশ অফিসার তাঁর গুণগ্রাহী। সবাই চলে গেলে চুপি চুপি খবর দেন যে ওনার নাম লালবাজারে পুলিশের খাতায় উঠেছে, উনি যেন একটু সাবধানে থাকেন।

সমর তাকে ওঁর বাড়িতে আসতে নিষেধ করেন।

দুঃখিত ভদ্রলোক অন্যদের বলেন— আমি তো ওনার ভালোর জন্যেই বলেছিলাম।

কয়েকবছর কেটে গেছে। আমি সেরে উঠছি। স্থানীয় কলেজে ভর্তি হয়েছি। এমার্জেন্সি এল এবং দু’বছরে চলেও গেলো। বাংলাদেশ স্বাধীন।

বঙ্গে বাম সরকার। বৈঠকখানা বাজারের গলিতে মট লেনে ফের শুরু হয়েছে ফ্রন্টিয়ার; সমর সেন কলম ধরেছেন। কিন্তু গ্রাহক কই? এক দশকে বদলে গেছে একটা প্রজন্ম। গোটা দেশ এখন রক্তপাতহীন ভোটের নিঃশব্দ বিপ্লবে আস্থাবান। জেল থেকে ছাড়া পাওয়া নকশাল নেতারা এই ভোট দিয়ে ইন্দিরা-সঞ্জয়ের এমার্জেন্সিকে হারিয়ে দেওয়ার ঘটনাকে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’ বলে। (১৯৭৭ সালে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত অসীম চট্টোপাধ্যায়ের খোলা চিঠি যা কংগ্রেসের নেতা কৃষ্ণকান্তের সৌজন্যে জেল থেকে বাইরে এসেছিলো)।

তাঁর প্রাক্তন সঙ্গীরা? সেইসব দিকপাল কিংবদন্তীরা? সবাই বাম সরকারের সমর্থনে, সবাই নতুন জমানায় প্রতিষ্ঠিত। অশোক মিত্র মন্ত্রী হয়েছেন। উৎপলের থিয়েটার রমরমিয়ে চলছে। আই সি এস অশোক সেন কেন্দ্রীয় সরকারের নামজাদা আমলা।

সমর সেন নিঃসঙ্গ, সমর সেন অভিমানী। নকশাল আন্দোলনের সমালোচনা করেন, কিন্তু নিন্দা করতে নারাজ। এ এক চাঁদ সদাগর। আপোষ করবেন না।

নাতনী পূর্ণিমার লেখায় পাই, মহাশ্বেতা দিদা আসতেন মাঝেমাঝে। বলতেন— গুরু লড়ে যাও, তোমার জন্যে বডি ফেলে দেবো।

ফ্রন্টিয়ারের পাতার সংখ্যা কমে। বিক্রি কমে। হাল ধরেন নতুন প্রজন্মের তিমির বসু। আমি বিলাসপুরে বুকপোস্টে আনাই দু’বছর। ভাষার সৌকর্ষে বক্তব্যের ধারে এবং পর্যবেক্ষণের গভীরতায় তখনও ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস এবং দি হিন্দুকে (আমার দুটো প্রিয় কাগজ) পাঁচ গোল দিতে পারে। কিন্তু পাতার সংখ্যা কমে আসছে। লেখকেরাও। কবেই সাপ্তাহিক থেকে পাক্ষিক হয়ে গেছে।

সমর সেন চলে গেলেন একাত্তর বছর বয়েসে। এই পৃথিবীর জন্যে এক বুক অভিমান নিয়ে। গতকাল রাতে সদ্য সত্তর পেরোনো আমি আবার নিয়ে বসি সমর সেনের কবিতা।

আজ ভাবি, সত্যিই কি আকাশগঙ্গা নামবে পৃথিবীতে? ভারতবর্ষে? কোনওদিন?

“ততদিন নারীধর্ষণের ইতিহাস
পেস্তাচেরা চোখ মেলে শেষহীন পড়া
অন্ধকূপে স্তব্ধ ইঁদুরের মতো
ততদিন গর্ভের ঘুমন্ত তপোবনে
বণিকের মাণদন্ডের পিঙ্গল প্রহার।” (ঘরে বাইরে)।

চোখ কচলে ভাবি— এই কবিতাটি কবে লেখা হয়েছিলো? আজ থেকে পঁচাত্তর বছর আগে? নাকি গতবছর, অক্টোবর মাসে তাঁর জন্মদিনে?

0 comments: