1

গল্প - অর্ঘ্য ঘোষ

Posted in

 

‘ইচ্ছার বিরুদ্ধে কখনও গোমাংস খেতে বলবে না তো?’
‘না না, আমি ‘আপ রুচি খানা’তে বিশ্বাসী।’
‘কলমা পড়ে নমাজে যেতে হবে না তো?’
‘প্রশ্নই ওঠে না। আমি মনে করি সবার নিজস্ব ধর্মাচরণের অধিকার থাকা উচিত।’
‘একের পর এক বিয়ে করে হারাম বানানোর অভিপ্রায় নেই তো?’
‘তওবা তওবা, আমরা কেউ নবাব–বাদশাহদের উত্তরসূরী নই।’
এমন ধারা চোখা চোখা আরও বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে গলদঘর্ম অবস্থা হয়েছিলো ইনসানের। শ্রুতিকে প্রোপোজ করার পর বিয়ের আগে ওইসব প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তাকে।

এক কট্টরপন্থী মুসলিম পরিবারের একমাত্র ছেলে ইনসান। বাবা রওসন ইকবাল হাজী মানুষ। পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ না পড়ে দিন যায় না তাঁর। মা হোসেনুর বিবিও স্বামীর অনুগামিনী। অমন একটি কট্টরপন্থী পরিবারের সন্তান হয়েও ইনসানের ধর্মের গোঁড়ামি নেই। মসজিদ-ইদগাহে খুব একটা দেখা যায় না তাকে। মহরমের শোভাযাত্রাতেও সচরাচর দেখা মেলে না। ব্লেড দিয়ে বুক চিঁড়ে রক্ত বের করা আর বুকে চাপড়ানোর নামে শোকপালনের অনুষ্ঠানটিকে তার কেমন যেন লোক দেখানো মনে হয়। কারণ যারা মহরমে ওইভাবে বুকের রক্ত নষ্ট করে তাদের অধিকংশকেই প্রয়োজনের সময় রক্ত দিয়ে মুমূর্ষ মানুষের পাশে দাঁড়াতে দেখা যায় না। সেইজন্য ধর্মের নামে গোঁড়ামি থেকে দূরে থাকে ইনসান। তাই নিয়ে রওশন আর হোসেনুরকে পাড়া প্রতিবেশীদের কাছে কম কথা শুনতে হয় না। তাঁরা ছেলেকে ধর্মপথে ফেরানোর জন্য সদুপোদেশ দেন। ইনসান কানে তোলে না। মাকে হেসে বলে, ‘ধর্মপথে নেই মানে কি অধর্ম করে বেড়াই? আর যদি করিই তাহলে তোমার আর আব্বার পুণ্যফলে সেই পাপ আমার স্খালন হয়ে যাবে।’

হোসেনুর আর কিছু বলতে পারেন না। কারণ নমাজ-রোজা না করলেও ইনসানের নামে কেউ বদনাম করতে পারে না। মানুষের বিপদে-আপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে হাসপাতালে রক্ত দিতে ছোটাই হোক কিম্বা বান বন্যায় চাঁদা তুলে নিরন্ন মানুষের খাবার যোগানোই হোক, সবেতেই দেখা মেলে তার। ওইসব করার জন্য তাদের একটি দল রয়েছে। সে তার নিজস্ব জগত নিয়েই থাকে। নিজস্ব জগত বলতে পড়াশোনার পাশাপাশি নাট্যচর্চা। ‘অন্তরঙ্গ’ নামে একটি নাটকের দল রয়েছে তাদের। ধর্মাচরণে আগ্রহ না থাকলেও দূর্গাপুজো, সরস্বতীপুজোর পাশাপাশি ঈদ, মহরমেও নাটক মঞ্চস্থ করে তারা। তাতে ছেলেদের পাশাপাশি হিন্দু- মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মেয়েরাও অংশ নেয়। নাটক করতে গিয়েই শ্রুতির সঙ্গে আলাপ।

বছর পাঁচেক আগের কথা। সেবারে এস.এস.সি দিয়ে বাংলার শিক্ষক হিসাবে শান্তিপুর হাইস্কুলে যোগ দেয় ইনসান। পরের বছর কাটোয়া থেকে ইংরাজীর শিক্ষক হিসাবে আসে শ্রুতি চট্টোপাধ্যায়। শ্রুতি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। সেই হিসাবে তার নাচ-গানেরও তালিম রয়েছে। সেই বছরই ছিলো স্কুলের রজতজয়ন্তীবর্ষ। সেই উপলক্ষ্যে বছরভর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। ইনসানের নাট্যচর্চা আর শ্রুতির নাচ-গানের পারর্দশিতার কথা শোনার পর ছাত্রছাত্রীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের তালিম দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাদের। সেইসব অনুষ্ঠানের তালিম দেওয়ার পাশাপাশি শ্রূতির নাট্যরূপ দেওয়া রোমিও জুলিয়েট নাটিকাও পরিবেশন করে দু্’জনে। পরবর্তীকালে ইনসানদের নাট্যদলেও যোগ দেন শ্রুতি। সেই সুবাদেই কাছাকাছি আসা। তারপরই একদিন হঠাৎ শ্রুতিকে প্রেম প্রস্তাব দিয়ে বসে ইনসান। শ্রুতির বুকের ভিতরে জলপ্রপাত বইতে শুরু করে। পরক্ষণেই উবে যায় সব উচ্ছ্বাস। নিজেকে গুটিয়ে নেয় সে, ‘আমার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়।’

কিছুটা রূঢভাবেই প্রত্যাখান করে কোয়ার্টারে দিকে পা বাড়ায় শ্রুতি। ইনসান হতবাক হয়ে যায়। ওই ব্যবহারের সঙ্গে কিছুতেই শ্রুতিকে মেলাতে পারে না। তার মনে হয় জাতিগত কারণেই হয়তো তাকে প্রেমিক হিসাবে মেনে নিতে পারছে না শ্রুতি। সেটা হতেই পারে, শুধু শ্রুতি কেন বেশিরভাগ মেয়েই পারবে না। কিন্তু বন্ধুত্বটা তো থাকতেই পারে। সেটা সে হারাতে চায় না। তার মনে হয় শ্রুতি অপমানিত বোধ করে ওইভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে চলে গেলো। সে মনে মনে ঠিক করে প্রস্তাব ফিরিয়ে নিয়ে ক্ষমা চেয়ে নেবে। সেই কথা ভেবে শ্রুতির কোয়ার্টার যায়। অনুতপ্ত গলায় বলে, ‘ঠিক আছে আমি আমার প্রস্তাব ফিরিয়ে নিচ্ছি। আমায় ক্ষমা করো। আসলে আমি ভেবেছিলাম তুমি সংস্কৃতি মনস্ক মেয়ে। ধর্মের বেড়াটা মাথা তুলে দাঁড়াবে না।’
‘ঠিকই ভেবেছিলে। জাত-ধর্মের বিভেদ আমার কাছে কোনও ব্যাপার নয়।’
‘তাহলে আমি কি তোমার যোগ্য নই।’
‘তাও নয়, তোমার মতো উদারচেতা ছেলেকে জীবনসঙ্গী হিসাবে পাওয়া শুধু আমার কেন অনেক মেয়ের কাছেই ভাগ্যের ব্যাপার। তাসত্ত্বেও আমার পক্ষে তোমার প্রস্তাবে সাড়া দেওয়া সম্ভব নয়।’
‘কিন্তু কেন সম্ভব নয়?’
‘তুমি আমার কতটুকু জানো? সবটা জানলে তুমিই পিছিয়ে যাবে।’
‘আমি তোমাকে যতটুকু জেনেছি সেটাই যথেষ্ট। তার বেশি কিছু জানার দরকার নেই।’
‘তোমার দরকার না থাকলেও আমার যে জানানোটা কর্তব্য।’
‘বেশ, তুমি কী বলতে চাও বলো।’
বলতে গিয়েও থমকায় শ্রুতি। কিছুক্ষণ পর বিষন্ন গলায় বলে, ‘আমি ক্যানসারের পেশেন্ট, কতদিন বাঁচবো তার ঠিক নেই। কয়েকটা দিনের জন্য শুধু শুধু ভালোবাসার বন্ধনে জড়াতে চাই না। তুমি কি এরপরে আর আমাকে ভালোবাসতে পারবে?’

গলা বুজে আসে শ্রুতির। খুব বিষণ্ণ দেখায় তাকে। ইনসানের বুকটাও কেঁপে ওঠে। সহসা কিছু বলতে পারে না। পরক্ষণেই সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছেড়ে ফেলে, ‘সব জেনেও তোমাকে চাই। আমি ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবো।’
শ্রুতি ম্লান হাসে, ‘তুমিও জানো আমিও জানি ওসব গল্প উপন্যাসেই হয়। পাগলামি কোরো না, তুমি আরও অনেক ভালো মেয়ে পাবে।’
সেদিন ফিরিয়ে দিলেও ইনসানকে মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না শ্রুতি। ভালোবাসা পেতে খুব লোভ হয় তার। সেদিনের পর থেকে ইনসানের ভালোবাসাও আর তীব্রতর হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত তার প্রস্তাবে সম্মতি জানতে হয় শ্রুতিকে।

কিন্তু তাদের ঘনিষ্ঠতা অনেকের গাত্রদাহের কারণ হয়ে ওঠে। দুটি ভিন্ন সম্প্রদায়ের যুবক-যুবতীর প্রণয় তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। তাদের মধ্যে অনেকেই আবার মনে মনে শ্রুতির প্রণয়াকাংঙ্খী ছিলো। অমন একটি সুন্দরী চাকুরী রতা মেয়ের ভালোবাসা ভিন্ন সম্প্রদায়ের একটি ছেলের পাওয়াটা সহ্য হয় না তাদের। বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক জলঘোলা হয়। গ্রামবাসীদের একাংশ প্রধান শিক্ষকের কাছে বিহিত চান। প্রধান শিক্ষক মৃত্যুঞ্জয় সেন দু’জনকে ডেকে পাঠিয়ে কড়া ভাষায় ভর্তসনা করেন, ‘আপনারা কী শুরু করেছেন বলুন দেখি? স্কুলটাকে বৃন্দাবন পেয়েছেন নাকি? শুনুন, মাস্টারি করতে এসেছেন মাস্টারি করুন। কোনওরকম বেল্লেলাপনা করা চলবে না। আমার স্কুলের বদনাম আমি বরদাস্ত করবো না।’
প্রধানশিক্ষকের কথায় দু’জনেই খুব অপমানিত বোধ করে। তবুও ইনসান বিনয়ী হয়ে বলে, ‘স্যার, ওইভাবে বলছেন কেন? স্কুলের বদনাম হয় এমন কাজ তো আমরা করিনি। আমরা একে অন্যকে ভালোবাসি। কিছুদিন পরেই আমরা বিয়ে করবো।’
‘কি— কি বললেন? বিয়ে করবেন?’
প্রধান শিক্ষক যেন নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারেন না।
‘কেন স্যার আমরা দু’জনেই অ্যাডাল্ট, বিয়ে করতে পারি না?’
‘যা বললেন বললেন, ভুলেও ওই কাজটি করতে যাবেন না? তাহলে আগুন জ্বলে যাবে। তখন স্কুল বাঁচাতে আমাকেও কিন্তু অন্যরকম ভাবতে হবে।’

হুমকি দিয়ে কার্যত ঘর থেকে বের করে দেন প্রধানশিক্ষক। ঝড়ের পূর্বাভাস পায় তারা। ইনসান বলে, ‘কী করবে এবার?’
‘কী আবার করবো? এতদিন যা করছিলাম তাই করবো। কেন তুমি কি ভয় পাচ্ছো।’
‘আমি আমার জন্য ভয় পাই না। কিন্তু তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।’
‘কিচ্ছু হবে না দেখো। আমরা তো কোনও অপরাধ করছি না। তাই কেউ আমাদের কিছু করতে পারবে না।’
তারপরেই গুনগুনিয়ে ওঠে, “বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা।”
ইনসানও গলা মেলায়। প্রধানশিক্ষকের হুমকিতে তাদের মনের মধ্যে যে সংশয় তৈরি হয়েছিলো রবীন্দ্রনাথের গানে তার দূর হয়ে যায়।

তাদের নিবৃত্ত করতে না পেরে জনমানসে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তাঁর আঁচ স্কুলে এসেও পড়ে। স্কুলের অন্যান্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা তাদের এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। স্কুলে কার্যত একঘরে হয়ে পড়ে তারা। খবর যায় শ্রুতির বাড়িতে। একদিন তার বাবা আর দাদা এসে হাজির হন কোয়ার্টারে। তাঁরা প্রথমে বুঝিয়ে সুঝিয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বাবা বলেন, ‘কেন তুই একটা ভিন্ন সম্প্রদায়ের ছেলের সঙ্গে মেলামেশা করছিস?’
‘আমি ওকে ভালোবাসি।’ বাবা কিছু বলার আগেই সপাটে শ্রুতির গালে একটা চড় কষিয়ে দেন দাদা। শ্রুতি একটাও কথা বলে না। তার চোখ ছলছল করে ওঠে। বাবা নরম গলায় ফের বোঝানোর চেষ্টা করেন, ‘দেশে কি আর ছেলের অভাব রয়েছে? তুই চাকরি করিস, স্বজাতির কত ভালো ছেলে তোকে বিয়ে করতে এগিয়ে আসবে।’
‘কিন্তু তাদের বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। ইনসানকে ছাড়া আমি কাউকে বিয়ে করতে পারবো না।’ ধীর অথচ শান্ত গলায় বলে শ্রুতি।
‘ওই ছেলেটাই তোর আপন হয়ে গেলো? আমরা তোকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছি। বহু কষ্ট করে মানুষ করেছি। তার কি কোনও মুল্য নেই তোর কাছে?’
খুব দোটানায় পড়ে শ্রুতি। কাকে ছেড়ে কাকে রাখবে সে? দুটোই তো তার দুই পাঁজর। বাবা-দাদাকে শান্ত করার চেষ্টা করে, ‘বাবা, ইনসান খুব ভালো ছেলে। তোমরা আলাপ করে দেখো, ওকে তোমাদের খুব ভালো লাগবে।’
‘থামো, মনে রেখো আমরা নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ। তোমার দুর্মতি হয়েছে তাই একটা বিধর্মী ছেলেই আজ তোমার কাছে বড়ো হয়ে উঠেছে। কিন্তু আমাদের একটা মানসম্মান আছে। ঠিক আছে থাকো তাকে নিয়ে। আমরা আর তোমার মুখ দেখতে চাই না। জানবো আমাদের মেয়ে মরে গিয়েছে।’
শ্রুতি করুণ গলায় বলে, ‘বাবা আমি তো মরেই যাবো। পৃথিবীতে আর ক’দিন থাকবো? খুব বেশিদিন তোমার অসম্মান সহ্য করতে হবে না। ততদিন আমার মুখ চেয়ে—।’
‘তোমার মুখ চেয়ে কী? মেনে নেবো? আমার আরও ছেলে মেয়ে আছে। তুমি একটা বিধর্মী ছেলের সঙ্গে বেরিয়ে গেলে তাদের আর ভালো ঘরে বিয়ে হবে?’
শ্রুতিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রেগেমেগে কোয়ার্টার ছেড়ে বেরিয়ে যান তাঁরা। শ্রুতির দু’চোখ জলে ভরে যায়। সব শুনে ইনসান তাকে সান্ত্বনা দেয়, ‘কেঁদো না। দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।’

কিন্তু কিছুই ঠিক হয় না। পরিবারের লোকদের দিয়ে শ্রুতিকে বোঝানোর চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর হাওয়ায় তাদের দু’জন খুনের হুমকি ভাসিয়ে দেওয়া হয়ে। অশ্লীল টিকাটিপ্পনী চলতে থাকে। তারা গ্রাহ্য করে না। শেষমেষ অবৈধ সম্পর্কের জেরে স্কুলের পরিবেশ নষ্ট করার অভিযোগে দু’জনকে শোকজের চিঠি ধরায় স্কুল কর্তৃপক্ষ। সেই চিঠি পেয়েই তারা বোঝে আর দেরি করা সম্ভব নয়। অবৈধ সম্পর্কের বদনামটা মুছে ফেলে স্কুল কর্তৃপক্ষের নাকে ঝামা ঘষে দেওয়ার সময় এসেছে। সেই কথা ভেবে পরদিন কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে রেজিস্ট্রি ম্যারেজ করে আসে তারা। ম্যারেজ সার্টিফিকেট সহ সম্পর্কের বৈধতার দাবি করে শোকজের জবাব দেয়।

দু’জনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এবারে সব বিতর্কের অবসান হবে ভেবে নেয় তারা। কিন্তু অচিরেই ভুল ভাঙে। ক্ষোভের আগুনে যেন ঘৃতহুতি পড়ে। তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করার দাবিতে স্কুলগেটে লাগাতর ধর্না বিক্ষোভ শুরু করে দেয় গ্রামবাসীরা। দিনের পর দিন স্কুলে ঢুকতে দেওয়া হয় না তাদের।

শ্রুতিকে নিয়ে নিজের গ্রামেও ঢুকতে পারে না ইনসান। গ্রামবাসীরা দাবি তোলেন, কোর্টের বিয়ে নাজায়েজ। শ্রুতিকে মৌলানার কাছে কলমা পড়িয়ে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করতে হবে। ইনসান সেই চাপের কাছে নতিস্বীকার করে না। তাই কিছু কিছু ঘনিষ্ট বন্ধু ছাড়া একে একে সবাই মুখ ফিরিয়ে নেয়। শ্রুতিকেও স্কুল কোয়ার্টার ছাড়তে হয়। তাকে নিয়ে শহরের একটি হোটেলে আশ্রয় নেয় আশ্রয় নেয় ইনসান। সেখানেও ধাওয়া করে বিক্ষোভকার। তাদের প্রাণ সংশয় দেখা দেয়। বন্ধুরাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত দিন কয়েক কোথাও বেরিয়ে আসার পরামর্শ দেয়। কথাটা তাদেরও যুক্তিযুক্ত মনে হয়। হোটেল ছেড়ে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে তারা।

বিভিন্ন জায়গা ঘোরার পর শ্রুতি তাজমহল দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করে। ইনসানও না করতে পারে না। জ্যোৎস্না রাতে তাজমহলের শোভায় অভিভূত হয়ে যায় শ্রুতি। ইনসানের কোলে মাথা রেখে আবদারের গলায় বলে, ‘আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে তুমিও একটা ছোট্ট তাজমহল গড়ো বেশ।’
তার মুখে হাত চাপা দেয় ইনসান, ‘কেন অমন কথা বলছো শ্রুতি? আমার কষ্ট হয় না বুঝি?’
তার গলা ধরে আসে। শ্রুতি বলে, ‘বেশ আর বলবো না। কিন্তু আমাদের ধর্মে স্বামীর কোলে মাথা রেখে মৃত্যু বড়ো পুণ্যের বলে মনে করা।’
‘কেন মৃত্যুর কথা ভাবছো? মরবো বলে তো জগত সংসার তুচ্ছ করে ভালোবাসিনি। আমার ভালোবাসা দিয়ে আমি তোমাকে বাঁচিয়ে রাখবো সোনা।’
চাঁদের আলোয় তখন ভেসে যাচ্ছে চরাচর। শ্রুতির মুখের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে ইনসান। ঘোর লাগা গলায় শ্রুতি জিজ্ঞেস করে, ‘এই কী দেখছো অমন করে?’
ইনসান কোনও জবাব দেয় না। তার ঠোঁট নেমে আসে শ্রুতির ঠোঁটে।

মাসখানেক পর ফিরে আসে তারা। তাদের ফিরে আসার খবর ছড়িয়ে পড়তেই ফের স্কুল গেটে বিক্ষোভ সংঘটিত যায়। সেই খবর পেয়ে এসে পৌঁছোন দৈনিক ‘জনজাগরণ’ পত্রিকার সাংবাদিক তন্ময় রায়। তিনি ইনসানদের পাশে দাঁড়ান। বিষয়টি নিয়ে খবর প্রকাশ করেন। তাতে হিতেবিপরীত হয়। বিক্ষোভকারী খেপে ওঠে। তারা দু’জনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়ার নিদান ঘোষণা করে। তন্ময়ও দিনের পর দিন সংবাদ প্রকাশ করে পুলিশ প্রশাসনকে নাড়িয়ে দেন। পুলিশ প্রশাসনের নিস্ক্রিয়তায় শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষজন বিরূপ সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠেন। শেষপর্যন্ত পুলিশ প্রশাসন কড়া ভূমিকা নিতে বাধ্য হয়। নিরাপত্তা দিয়ে দু’জনকে স্কুলে ফেরায় তারা। বিক্ষোভকারীরা পিছু হঠলেও গ্রামে তাদের ঠাঁয় হয় না। অগত্যা গ্রামের বাইরে হাতে গোনা কিছু অনুগামীর সহযোগিতায় বাড়ি করে উঠে যেতে হয় তাদের।

সেখানেই মনের মতো করে ঘরগৃহস্থালি সাজিয়ে নেয় শ্রুতি। তার ঠাকুর ঘরে দেবদেবীর পাশপাশি ঝোলে মক্কা-মদিনার ছবি। রামায়ণ মহাভারতের পাশে ঠাঁই পায় কোরান। দু’জনে এক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাতাবরণ গড়ে তোলে কিন্তু বেশিদিন সেই সুখ তাদের স্থায়ী হয় না। মাস সাতেকের মধ্যেই শ্রুতির অসুস্থতা বেড়ে যায়। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে ইনসান। ডাক্তারেরা গোপনে তাকে জানিয়ে দেন আর কিছু করার নেই। বাড়ি নিয়ে গিয়ে আনন্দে রাখুন। যা খেতে যায় খাওয়ান। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে ইনসান। ডাক্তারবাবু তার কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘বি স্টেডি ইয়াংম্যান। এটাই আমাদের নিয়তি। বড়ো অসহায় ভাবে প্রিয়জনের চলে যাওয়া প্রত্যক্ষ করতে হয়।’

সেই সার সত্যটা কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারে না ইনসান। শ্রুতিকে সে ভেলোর নিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় শুরু করে। শ্রুতি তাকে নিরস্ত করে, ‘আমার শেষ সময় হয়ে এসেছে। তুমি আমাকে নিয়ে আর টানাটানি কোরো না। হয়তো মরণকালে তোমার মুখটুকুও দেখতে পাবো না। তার চেয়ে যে ক’টা দিন আছি আমাকে তোমার কাছে থাকতে দাও। তোমার কোলে মাথা রেখে মরতে দাও।’
ডাক্তার, অনুগামীরাও তাকে সেই পরামর্শই দেয়। সেইদিন থেকেই ছুটি নিয়ে সর্বক্ষণ শ্রুতির পাশে থাকে ইনসান। ক্রমশ শ্রুতির জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে আসে। একদিন শেষ সময় উপস্থিত হয়েছে বুঝতে পারে শ্রুতি। সেদিন স্বামীকে অনুনয় করে, ‘আজ আমাকে রাতের পৃথিবী, তারা ভরা আকাশ দেখাবে? পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ কতদিন পাইনি আমি।’
তার আকুতি নাড়িয়ে দেয় ইনসানকে। সেও বুঝে যায় আজই শ্রুতির শেষদিন। তার কান্না পায়, কিন্তু শ্রতির কথা ভেবে কাঁদতে পারে না। শ্রুতির কথা মতো ছাদে বিছানা তৈরি করে। বিছানাময় ছড়িয়ে দেয় ফুল আর আতর। ধূপদানিতে ধুপবাতি আর দীপাধারে দীপ জ্বালিয়ে। ফুলশয্যার রাতের মতো শ্রুতিকে পাঁজাকোলা করে ছাদে নিয়ে এসে ফুলের বিছানায় শুইয়ে দেয়। কোলে তুলে নেয় তার মাথা।
জ্যোৎস্নালোকে শ্রুতির রোগ জর্জ্জর মুখের দিকে চেয়ে থাকে অপলক। শ্রুতি তার হাত ধরে বলে, ‘তোমাকে তো কিছুই দিয়ে যেতে পারলাম না। তুমি আবার বিয়ে করো। না হলে আমি মরেও শান্তি পাবো না।’
আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না ইনসান। কান্নায় ভেঙে পড়ে। ধরা গলায় বলে, ‘তুমি অমন করে বোলো না। আমি সইতে পারছি না। তোমার কাছে যা পেয়েছি তা আমার সারাজীবনের স্মৃতির সঞ্চয় হয়ে থাকবে।’
বলতে বলতে তার চোখ ভিজে যায়। শ্রুতি তার চোখ মুছিয়ে দিতে গিয়ে নিজেও কেঁদে ফেলে। আবদারের গলায় বলে, ‘একটা গান শোনাও না গো।’
ইনসান অনুচ্চ গলায় গেয়ে ওঠে রবি ঠাকুরের গান— “তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম, নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম—।”
গান গাইতে গাইতে ফের চোখের জলে ভাসে ইনসান। তাকে ভোলাতে রুগ্ন গলাতে শ্রুতি গেয়ে ওঠে তার প্রিয় নজরুল সঙ্গীত—
“আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়
মনে পড়ে মোরে প্রিয় ও ও
চাঁদ হয়ে রব আকাশের ও গায়
বাতায়নে খুলে দিও—।”

গানে-গল্পে রাত ভোর হয়ে আসে। দীপাধারের প্রদীপ নিভু নিভু হয়ে পড়ে। শ্রুতির জীবন প্রদীপও দ্রুত নিষ্প্রভ হয়ে আসে। তার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়ায়। জল গড়ায় ইনসানের চোখেও। ক্ষীণ গলায় শ্রুতি বলে, ‘আমার জন্য যখন মন কেমন করবে আকাশের দিকে চেয়ে থেকো তাহলে আমাকে দেখতে পাবে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি আর জন্মেও যেন তোমাকেই জীবন সাথী রূপে পাই। দাও এবার আমায় আসতে অনুমতি দাও।’
ইনসান শ্রুতির মুখের কাছে নামিয়ে আনে তার মুখ। পরম মমতায় একের পর এক কপাল, দু’চোখের পাতায় চুম্বন রেখা আঁকে। শেষে ঠোঁটে ঠোঁট মেলাতেই শ্রুতির দু’চোখ পরম প্রশান্তিতে বুজে আসে। তার ঘাড় নেতিয়ে পড়ে ইনসানের কোলে। মনে হয় যেন ওই চুম্বনটুকুর জন্যই সে প্রতীক্ষায় ছিলো। স্ত্রীর মাথা কোলে নিয়ে নীরবে অশ্রুপাত করে চলে ইনসান।

শ্রুতির দেহ সৎকার নিয়েও নানা বিতর্ক দেখা দেয়। ইনসান সব বিতর্কে জল ঢেলে দিয়ে অনুগামীদের সহায়তায় নিজের বাড়ির অদুরেই তার সমাধি দেয়। নির্মাণ করে সমাধিমন্দির। সেখানেই কচিকাঁচাদের জন্য খোলে নাট্যচর্চাকেন্দ্র ‘শ্রুতিমহল’। বাড়ির লোকেরা ফের তার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। কিন্তু সব উপেক্ষা করে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সে নাট্যচর্চাকেন্দ্রে পুরোপুরি মনোনিবেশ করে। কলকাকলিতে ভরে থাকে শ্রুতিমহল। তাদের নিয়েই ভুলে থাকে ইনসান। রাতের আকাশে শ্রুতিকে খোঁজে সে। তার কানে ভেসে আসে—
 “আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙ্গে যায়
মনে পড়ে মোরে প্রিয় ও ও
চাঁদ হয়ে রব আকাশের ও গায়
বাতায়নে খুলে দিও—।”

1 comment: