ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(৭)
মিসেস লোবো মানুষটি ছোট্টখাট্টো আর খুব অমায়িক। সাগরিকার জন্মের আগে থেকেই বাবা - মা এখানে এসে উঠত বলে আজও তিনি মা'এর অন্যতম অন্তরঙ্গ সহচরী। মিসেস লোবো নামটা শুনলে এ্যাংলো ইন্ডিয়ান মনে হলেও উনি কিন্তু দেশী খ্রীষ্টান। ইংরেজির চেয়ে নিজের মাতৃভাষা ওড়িয়া আর হিন্দীটা তো ভাল বলেনই তারসঙ্গে বাংলাটাও ভালোই বোঝেন।সাগরিকাকে উনি খুব ভালবাসেন, একদম মা এর মতোই।আজ মিসেস লোবোর ঘরে দুপুরের খাওয়াদাওয়ার ডাক পড়েছিল। ওঁর সহচরীটি দারুণ অড়হর ডাল যাকে ওরা 'দালি' বলে থাকে তার সাথে ইয়াব্বড় পাবদা মাছের সর্ষেবাটা, ভাত, আলুশিম্ব ভাজি আর টকদই এইসব রান্না করেছিল। ওড়িয়াদের রান্নার হাত এমনিতেই ভাল। কাজেই খাওয়া দাওয়াটা বেশ জমিয়েই হল। ওই সহকারী মেয়েটি কিন্তু এসব না খেয়ে 'পোকাল ভাত' বলে পান্তাভাতের মত ভাত দিয়ে খেল আর এইসব রান্নাবান্না একটা টিফিনকৌটো করে নিয়ে গেল ওর বাড়িতে বর আর বাচ্চাদের জন্য।
সাগরিকার কাছে এই আপ্যায়ন নতুন নয়। বরং বাবা থাকতে আরো হৈ হৈ করে এখানে ওদের পিকনিক হত। দাদা জেলে থাকাকালীন সময় থেকে ওদের সেই আনন্দের দিনগুলো কেমন যেন আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে এসেছিল। আসলে বাবা খুব শকড্ হয়েছিল দাদার রাজনৈতিক পরিণতিতে। প্রথম প্রথম ছাত্র রাজনীতি নিয়ে বাবা-ছেলের মধ্যে বেশ একটা উপভোগ্য তর্কাতর্কি হত। অথচ পরে একদিন সেটাই একটা কুশ্রী বাদানুবাদে গড়িয়ে গেল। অবাক কান্ড, মা সেদিন কিন্তু দাদার বদলে বাবার পাশেই ছিল সর্বক্ষণ। বাবা-মার ওপরে দাদা রাগ দেখিয়ে পরদিনই বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। এর একমাস পরে একটা পোস্টকার্ড আসে জলপাইগুড়ি থেকে। নর্থবেঙ্গলের চা বাগানে আর শ্রমিক আন্দোলনে ততদিনে আষ্ঠেপৃষ্ঠে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে।
বাবা বোধহয় জানত, দাদার সঙ্গে আর কখনো স্বাভাবিক ব্যবহার করতে পারবে না। ভিতরে গুমরে গুমরে বাবা যে দাদাকে মিস্ করত সেটা সাগরিকা ঠিকই টের পেত। তবে বাকি জীবনে বিশেষত সাগরিকার জীবনকে স্বাভাবিক ছন্দে রাখতে তিনজনের এই বেড়াতে আসাটা বাবা কখনো বন্ধ করেনি। তাই মনে হয় এই সমুদ্রের অনন্ত বিছানায় বাবা যেন আজও ঘুমিয়ে রয়েছে। বেলাভূমি ধরে হাঁটতে গেলে সাগরিকা টের পায় সে যেন বাবার সাথে আজও পায়ে পায়ে হেঁটে চলেছে।
******
সেদিন সকাল থেকেই একটা নতুন ইতিহাসের সূচনা হল নকশালবাড়ি থেকে। জায়গাটার ভৌগলিক অবস্থান বিপ্লবী কার্যকলাপের পক্ষে উপযুক্ত বলে চারুবাবু আগেই অনুমোদন করেছেন। এর উত্তরে দার্জিলিং পাহাড়, দক্ষিণে বিহার আর পূর্বদিকে ইস্ট পাকিস্তান। আবার পশ্চিমে মেচ নদী পার করলে নেপাল সীমান্ত। দরকার পড়লে গা ঢাকা দেওয়া যাবে সহজেই। প্রায় তিনশ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রায় প্রস্তুত। সমুদ্র আর প্রভাকর দুজনেই এখন এইসব কাজে জঙ্গল সাঁওতাল আর কানু সান্যাল নামে দুই প্রভাবশালী কমরেডদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খাটছে। এদের প্রায়সই মিটিঙ করতে হচ্ছে পুলিশের চোখ এড়িয়ে। ফাঁসিদেওয়া, লাটাগুড়ি, হাসিমারা আর নকশালবাড়িকে কেন্দ্র করেই চলছে খাদ্যমজুত ও কমিউন তৈরীর কাজ। বিপ্লব চলাকালীন রসদের অভাব যাতে না হয় সে বিষয়ে চারুবাবু স্বয়ং চিন্তিত। কৃষকসমিতি ঠিক করেছে তাদের দখল করা এলাকায় পুলিশের গাড়ি ঢুকতে দেওয়া হবেনা। সমুদ্র আর সুভাষ সোরেন গ্রামে ঢোকার রাস্তায় কাঁচের বোতল টুকরো টুকরো করে ছড়িয়ে রাখল। সিবং ছেত্রী নামের এক অতি উৎসাহী যুবা বড় বড় পেরেক এনে আবার তার ওপর মুঠো মুঠো করে ছড়িয়ে দিল।
কিন্তু বেলা বাড়তেই কাটিয়াজোত গামী সড়কে পুলিশের সাথে কৃষকসমিতির লোকেদের একটা ঝামেলা বেঁধে গেল। এলাকায় পুলিশ ঢুকেছে শুনে কৃষকেরা দা,টাঙি এসব সঙ্গে করে মিছিল করে ওদের বাধা দিতে এল। কোনওরকম আলাপআলোচনার বদলে পুলিশের কাছ থেকে পরিবর্তে ধেয়ে এল ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট। এই মিছিলের সামনে ছিল রমণী ও শিশুরা। পুলিশের নির্বিচারে চালানো গুলিতে শয়ে শয়ে মানুষ মুহূর্তে শহীদ হয়ে গেল। আটজন রমণীর মধ্যে দ্রাউদ্রাউ নামের এক মেচ রমণীর পিঠে তার শিশু সন্তানটিও বাঁধা ছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রের কলঙ্কের দাগ মেখে সেও তার মা'এর সাথে বুক পেতে লুটিয়ে পড়ল। প্রসাদুজোতের যে জায়গাটায় এই আকস্মিক সংঘর্ষটা হল সমুদ্ররা সেখানে সঙ্গে সঙ্গে ইঁট আর ঘাস দিয়ে একটা শহীদ বেদী বানিয়ে প্রতিবাদ ধর্নায় বসল। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশবাহিনী আবার সেটা ভেঙে দিতে গিয়ে এবার গুলির বদলে তুমুল লাঠিচার্জ করে বসল। গন্ডোগোল যখন একেবারে তুঙ্গে ভীড়ের মধ্যে থেকে সমুদ্রের মাথায় হঠাৎ একটা লাঠির ঘা এসে পড়ল। ব্ল্যাক আউট হতে হতে সমুদ্র যেন শুনতে পাচ্ছিল অসংখ্য নারীপুরুষ সমস্বরে চিৎকার করে বলছে -
'শহীদের রক্ত হবে না তো ব্যর্থ...'
********
গুড়িয়াম্মার কাছে নাচের তালিম নিতে বেশ লাগে। কোন ছোটবেলায় গুড়িয়াম্মাকে ওর বাবা মা মন্দিরে দান করে দিয়েছিল। সেই থেকে বড়া মঞ্চাম্মার কাছেই ও মানুষ। নাচ ও গানে গুড়িয়াম্মার অসাধারণ সহজাত প্রতিভা। ভগবান কেবল পুরুষের শরীরে একজন নারীকে বন্দী করেই যেটুকু যা ভুল করে ফেলেছেন। নয়তো চিকনকোমল গুড়িয়াম্মার জন্য দেশবিদেশের রাজপুত্তুররা দল বেঁধে আসত।
গুড়িয়াম্মা খন্ডগিরির কাছে এক আশ্রমে এই প্রাচীন নৃত্যশৈলীটি শিখেছে। এই নৃত্যে ত্রিভঙ্গি (মাথা, বুক ও শ্রোণীর স্বতন্ত্র সঞ্চালনা) র সাথে আবার চৌকা (মৌলিক চতুষ্কৌণিক ভঙ্গিমা) সবমিলিয়ে নৃত্যরীতিটিকে অনন্য এক উপাচারে পরিণত করেছে। প্রথমে মঙ্গলাচরণে জগন্নাথ প্রণামের পর দেবদেবীর স্তবগানবাচক একটি শ্লোক গাওয়া হয়, যার অর্থ উপস্থাপনা করা হয় সমগ্র নৃত্যের মাধ্যমে। এই মঙ্গলাচরণে সবাই আগে ভূমিপ্রণাম করে। মাতা বসুমতীর কাছে তাকে পদদলিত করার জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করে। এছাড়া করা হয় ত্রিখণ্ডী প্রণাম বা তিন অঙ্গের প্রণাম। এই প্রণামে মস্তক দ্বারা ঈশ্বরকে, মুখাগ্র দ্বারা গুরুদের এবং বক্ষাগ্র দ্বারা দর্শকদের প্রণাম করা হয়। এছাড়াও একটি বিশেষ নৃত্যশৈলী যা নটরাজ শিবের বটুকভৈরব রূপটিকে উদ্দেশ্য করে নিবেদন করা হয আগামী দু'মাস এইটুকু নৃত্যশিক্ষা চলবে সব মেয়েদের। এই পর্যায় অবধি রপ্ত করার কয়েকদিনের মধ্যেই পল্লবী চর্চা অর্থাৎ একটি বিশুদ্ধ নৃত্যশৈলী যা কোনো একটি রাগকে চক্ষুসঞ্চালন, দেহভঙ্গিমা ও জটিল পদচালনা দ্বারা ফুটিয়ে তুলতে পারে তার শিক্ষা শুরু হবে।
******
এখানে ওকে সকলে মঞ্জিমা বলে ডাকছে। নতুন এক জীবনের সাথে নতুন নাম আগের মত অতটা খারাপ লাগছে না। তবে অম্বাপল্লী গ্রাম যেখানে ও জন্মেছে, বেড়ে উঠেছে তেরো বছর অবধি সেই জায়গার কথা মনে পড়লে, এমনকি খেলার সঙ্গীসাথীদের কথা মনে পড়লেও খুব কান্না পায় এখনো। আর সবচেয়ে বেশী মনে পড়ে ওর বাবা'র কথা। বাবার সাথে ধনুযাত্রা' র মেলা দেখতে এসেছিল সেদিন। হঠাৎ সেখানে হুড়মুড় করে তুর্কি সেনার দল এসে ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছিল। হঠাৎ ও টের পেল বাবা কে আর ভীড়ের মধ্যে ও দেখতে পাচ্ছে না। তারপর হঠাৎ মাথায় একটা জোরালো লাঠির বাড়ি...আর কিছু মনে নেই। বাবার সাথে বোধহয় আর কখনোই দেখা হবে না ওর! বাবা ও নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছে যে ও আর বেঁচে নেই...।
সেদিনের পর থেকে যা যা এখনো ওর জীবনে ঘটেছে তা সবই নতুন ঘটনা। মঞ্জিমার আগের জীবনের সাথে যেন তার কোনও মিলই নেই।
0 comments: