1

গল্প - সৌমিত্র চৌধুরী

Posted in

 

খুব বদমাশ ছিলাম। বদমাশ কথাটা কি ঠিক হলো! জানি না। তবে অনেকেই বলে, পিন্টুটা আসলে একটা বদমাশ। বদমায়েশি করে অন্যের দাঁত মুখ ফাটিয়ে দিয়েছি, এমন ঘটনা খুব বেশি নেই। তবুও আছে কিছু। মোদ্দা কথা, ভালো ছেলে ছিলাম না। অন্যকে আক্রমণ করেছি। বেকায়দায় ফেলে দিয়ে গলা ফাটিয়ে হেসেছি। আর বেশিরভাগ আক্রমণের টার্গেট ছিলো বাড়ির লোকই। বাইরের লোককে যে একদম টার্গেট করিনি তা নয়।

এতদূর বলে একটু থামলাম। ডাক্তার শান্ত মুখে তাকালেন আমার দিকে। আমি জানি না কি বলছি! ভিতর থেকে কে যেন কথা বলে চলেছে।

তারপর? বাইরের লোককে টার্গেট করেছিলেন তো!

করেছিলাম তবে ঝাড় খেয়েছি খুব। যেমন নান্টুদার কেসটা। ভালো ক্রিকেট খেলতো। আমার বলে ছক্কা মারলো দু’বার। পরের বলটা আমি সোজা ওর মাথা লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিলাম। তখন পাড়ার মাঠে হেলমেট কেউ পরতো না। অল্পের জন্য মাথায় লাগেনি নান্টুদার। লাগলো নাকে। গলগল করে রক্ত। ব্যাস, পাড়ার মাঠ! লোকজনের নান্টুদাকে ঘিরে হা-হুতাশ। সেবা শুশ্রূষা চললো অনেকক্ষণ। ডাক্তার এসে ওষুধপত্র দিয়ে নান্টুদাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো। সেসব মিটতেই আমার উপর আড়ং ধোলাই শুরু হলো। বড়দের হাতে গণ পিটুনি খেলাম।

আরেক দিন পণ্ডিত স্যারকে ঢিল মারলাম। বিকেল বেলা আমাদের বাড়ির কাছে ছাত্রী পড়াতে আসে। ছাদ থেকে একটা ইটের টুকরো নিয়ে লোকটার টাকে টিপ করলাম। মোক্ষম হিট। টাক ফেটে রক্ত পড়েছিলো কিনা জানি না। তবে ‘উঃ মাগো’ বলে চেঁচিয়ে উঠেছিলো। আমি পাঁচিলের ধার থেকে সরে এসে খুব হেসেছিলাম। মানুষটার উপর রাগ ছিলো তো খুব!

কেন, রাগ ছিলো কেন?

পড়াতেন শব্দরূপ ধাতুরূপ। মাথায় ঢুকতো না। একদিন টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছিলাম। আচমকা এগিয়ে এসে ঠক করে মাথায় গাঁট্টা মারলো। কান ধরে বললো, ‘হতভাগা তোর দ্বারা কিস্‌সু হইবো না।’

ব্যাস, আমার রাগ চড়ে গেলো। এমনিতে গোলগাল লোকটার পড়ানো বোরিং লাগতো। তার উপরআমাকে গাল? কান ধরবে? রাগে জ্বলতে লাগলো শরীর। জবাব দিতে হবে। তক্কে তক্কে থাকতাম। সুযোগ পেয়েই ঝট করে সেদিন ঝেরে দিলাম। আমার হাত থেকে বুলেটের মতো ছুটে গেলো ইঞ্চি খানেকের একটা ঢিল। লাগলো মাথার পিছনে। খুব আনন্দ হয়েছিলো। তবে... মানুষটা এ নিয়ে কোনও হৈ চৈ করেনি। ভেবেছিলাম এদিক ওদিক গিয়ে হয়তো কাঁদুনি গাইবে। কিন্তু কিচ্ছু করেনি। তবে দিন সাতেক পরে অদ্ভুত ঘটনা। পণ্ডিত স্যারের পাড়ার বিশু বক্সার একদিন আমাকে ধরে মিশন ঘাটের কাঠের মিলের পেছনে টেনে নিয়ে গেলো। বললো, ‘শয়তানি করছিস শালা। পেছন থেকে ঢিল মারা। দেখ...।’ বলেই আমার চোয়ালে একটা পাঞ্চ। চোখে সর্ষে ফুল দেখছি তখন। মাথা বনবন করছে। তার মধ্যেই দিলো পেটে একটা জ্যাব।

তারপর?

রাস্তায় পড়ে গেলাম। মার খেয়ে ছটফট করতে করতে বুঝে গেলাম, মাস্তান হবার মুরোদ নেই আমার। তাহলে হিরো হবো কী করে? অন্য লোক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখবে না আমাকে? বাড়ির খোলা ছাদে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম। একটু পরেই উত্তর এসে গেলো। মাথায় বুদ্ধি ছিলো তো খুব।

কী করলেন তারপর?

টার্গেট করলাম সেজদাকে। পড়াশুনায় ভালো। পড়ার ঘরে বড়ো টেবিলের এক কোণে ঘাড় গুঁজে বই পড়তো। আমার দেখে ভালো লাগতো না। দিনরাত শুধু পড়বে? সেদিন সকাল আটটা-নটা। গরমকাল। মাথার উপর পাখা নেই। খুব মন দিয়ে ঘামতে ঘামতে কেমস্ট্রি পড়ছিলো। শব্দ করে পড়তো ও। বারবার একটা শব্দ কানে এসে বাজছিলো, ‘গ্রিগনার্ড রিএজেন্ট, গ্রিগনার্ড রিএজেন্ট’। শুনতে শুনতে মাথাটা গরম হয়ে গেলো।

ডাক্তার বিড়বিড় করলেন। স্যাডিস্টিক পারসোন্যালিটি ট্রেট। তারপর বলুন। সেজদাকে ঘুষি মারলেন?

না মারিনি। ওর পাশে আরেকটা চেয়ারে বসে বড়ো করে একটা হাঁই তুললাম। তারপর একটা গান ধরলাম। ‘মায় কালে হায় তো কেয়া হুয়া দিল বালে হ্যাঁয়।’ সেজদা গানটান করে না। শুধু বই পড়ে। সামনেই কোনও একটা বড়ো পরীক্ষা ওর। বুঝতে পারছি আমার গানে ডিস্টার্বড হচ্ছে সেজদা। রাগে গনগন করছে ওর মুখ। কিছু বলতে পারছে না। বললেই আমি হল্লা জুড়ে দেবো, ‘মা এই বাড়িতে কি একটু গান করতে পারবো না?’

ব্যাস, মা ছুটে এসে সেজদার পড়ার বারোটা বাজিয়ে ছাড়বে। বাবা বাইরের ঘরে মক্কেল আর সাক্ষী নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সবসময়ই নাকি ভারী ভারী কেস করে বাবা। বাবাও কিছু বলতে আসবে না। তাই সেজদা সব বুঝে কিচ্ছু বললো না। সামনে পরীক্ষা তো! বই খাতা নিয়ে ছাদে উঠে গেলো। জাম গাছের ছায়া পড়তো ছাদের পশ্চিম দিকটাতে। ওখানেই রোদের মধ্যে পড়া শুরু করলো। রোদের তাপে সেজদার ফর্সা মুখটা লাল। দেখে যা আনন্দ হয়েছিলো! তবে সেজদার পিছনে বেশি লাগতে পারিনি। লোকটা ভিতরে ভিতরে ছিলো খুব স্ট্রং। বেশি বিরক্ত করলে বা চিৎকার-ফিৎকার করে বাড়ি থেকে ভাগিয়ে দিলেও অন্য বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে বই খুলবে। সেজদাকে ছেড়ে অন্য টার্গেট খুঁজতে লাগলাম। বড়ো বাড়ি। আমি সবার ছোটো। মাথার উপর অনেক দাদা দিদি। বাড়িতে মানুষ তো অনেক। টার্গেটের অভাব হয় না কখনও।

এবার টার্গেট করলাম বাবাকে। তার আগে বড়দা মেজদাকে টার্গেট করেছি। দিদিদের কাঁদিয়ে ছেড়েছি। তবে সেগুলো ছিলো ছোটো টার্গেট। এবার শক্ত টার্গেট। ডাকসাইটে উকিল। নিজের বাবা। বুদ্ধি করে এগোতে হবে।

বাবা লোকটা দিনরাত খাটে। সংসারের জন্য পয়সা রোজকার করে। গণ্যিমান্যি লোক। উকিল হিসাবে শহরে খুব নামডাক। সবাই মান্য করে। এরকম একটা লোককে টার্গেট করলে মন্দ হয় না। আমি ক’দিন ধরেই ভাবছি। একদিন সুযোগ পেয়ে গেলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠিনি তখন। বাবা ভোর বেলা ঘুম থেকে উঠে দূরের মাঠে চক্কর দিয়ে এসে আমাকে ডাকলেন।

আমি চোখ খুলছিনা। বাবার গলা, ‘পিন্টু উঠে পড়। দেরি করিস না। ইংরেজি বইটা নিয়ে আমার কাছে চলে আয়।’

আমার আর চোখ খোলে না। জানি তো, কয়েক মিনিট পেরিয়ে গেলেই বাবার ঘরে মক্কেলের ডাকাডাকি শুরু হবে। তাই হলো। টাকার গন্ধে বাবা আমাকে ছেড়ে মক্কেল নিয়ে পড়লো। মক্কেল বিদায় করে বাজার থেকে মাছ-টাছ এনে খেতে বসেছেন বাবা। বাইরে চড়া রোদ তখন। কিন্তু আমার ঘর অন্ধকার। চোখ তখনও বন্ধ। ক্লাশ সেভেন। পড়ায় মন নেই। স্কুলে যেতে ইচ্ছে করে না। বিছানায় মটকা মেরে পড়ে আছি। ‘উঃ,আঃ’ চিৎকার ছুড়তে লাগলাম, ‘পেট ব্যাথা, খুব পেট ব্যাথা।’

ব্যাস, আমার কায়দা খেটে গেলো। মা শশব্যস্ত হয়ে ছুটে এল। তারপর বাবার কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান। ‘ছেলেটার দিকে একটু তাকাও। ইশ্‌ শুকিয়ে গেছে একদম। রমেশবাবুর ছেলে তো অ্যাপ্যেন্ডিক্স ফেটে মরেই গেলো। পেট ব্যথা নেগলেক্ট করা...। এই আমি বলে দিলাম...।’

বাবা গম্ভীর মুখে একবার বললেন, ‘ভারী কেস আছে একটা। ডিসট্রিক্ট জাজ দশটাতেই এজলাশে চলে আসেন। আমি বিকেলে ফিরেই নির্মল ডাক্তারকে ডাকছি।’

‘তাই যেন হয়, আমি বলে দিলাম।’ মায়ের গলায় তোলা-উনুনের গনগনে আঁচ। আমি চোখ পিটপিট করে দরজার বাইরে বাবার মুখটা দেখলাম। কেমন একটা অসহায় ভাব। মুখে কথা নেই। জানেই তো মুখ খুললে ঝামটা খেতে হবে। ‘কত বড়ো কেস তোমার জানা আছে। শহরে আর উকিল নেই যেন!’ শেষ পাতে আমড়ার চাটনি না খেয়েই নিঃশব্দে কাঁচুমাচু মুখে বাবা উঠে পড়লেন। ঐ মুখটা দেখে ভিতরে ভিতরে হাসছিলাম আমি। খুব আনন্দ হচ্ছিলো। বিপক্ষের প্লেয়ারদের কাটিয়ে একা গোলে বল ঢুকিয়ে দেবার আনন্দ।

তারপর কী হলো? বিকেলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন বাবা?

আরে না না। আমি কি কাঁচা খেলোয়াড়? বিকেলে বাবা ফিরবার আগেই আমি হাওয়া। পরদিন আবার একই কায়দা। আমার ঘুম ভাঙে না। মাঝে মাঝে দাঁত খিঁচিয়ে চিৎকার করি, ‘ওঃ এই বাড়িতে কেউ দেখে না আমাকে।’

মা ঘ্যান ঘ্যান করে বাবার কোর্টে যাওয়া প্রায় আটকে দিলো। বাড়ি কাঁপিয়ে চিৎকার করতে লাগলো, ‘ছেলেটা যেন আমার একলার...। এখনই হাসপাতালে না নিয়ে গেলে এই তোমার কি আমার একদিন।’

কী আর করা। মেজদাকে ডাকলেন বাবা। হাতে অনেকগুলো টাকা গুঁজে দিয়ে বললেন, ‘শোনো বিজু। পিন্টুকে হাসপাতালে দেখিয়ে নিয়ে এসো।’ মেজদা আমতা-আমতা করে একটু আপত্তি করেলেও নিয়ে গেলো আমাকে। ডাক্তার দেখে টেকে আমার পেট টিপে মেজদার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ননী বাবু উকিলের ছেলে তুমি? শোনো, ভাইকে মাংস ভাত খাইয়ে আবার আমার কাছে নিয়ে এসো।’

তারপর? ভরপেট মাংস ভাত খাওয়া আমার শান্ত মুখ। মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ডাক্তার বললেন, ‘পেট ভরে খেয়েছো তো?’ আমি মাথা নাড়তেই ডাক্তারের গলায় বাজখাই চিৎকার, ‘বদমাশ ছেলে। মাংস ভাত সাঁটিয়ে এসে বলছো পেট ব্যথা। মারবো থাপ্পর। যাও বাড়ি গিয়ে পড়াশোনা করো।’

বুঝলাম হাসপাতালের সার্জেন, এমারজেন্সি ডাক্তার ধরে ফেলেছে আমার চালাকি। এই ডাক্তার দিয়ে চলবে না। বাড়ি গিয়ে মায়ের কাছে চিৎকার। মা, ‘সার্জেন কী বুঝবে? লোকটা তো হাড্ডি-গুড্ডির ডাক্তার। মেডিসিনের ডাক্তার দেখাতে হবে...।’

আমি একটু থামলাম। আজ এত বকবক করছি কেন? কেউ কি আমাকে কিছু খাইয়ে দিলো? আমার সামনে বসা লোকটি ভাঙা ভাঙা বাংলায় বললো, ‘আপনি আছেন ব্যাঙ্গালোরে। আমার প্রাইভেট ক্লিনিকে। আমি ডাক্তার পদ্মনাভ।’

আমি এখানে এলাম কী করে?

আপনার দাদা প্রফেসর মজুমদার গতকাল ভর্তি করিয়ে দিয়েছেন।

বুঝলাম। আমার মেজদা। এক নম্বরের ভোঁদাই ছিলো, জানেন।

তাই নাকি! আপনার মেজদা কিন্তু খুব ভালোবাসেন আপনাকে।

বললেই মানবো? বড়দা মেজদা সেজদা কেউ ভালোবাসে না। সারাদিন ওদের মুখে শুধু টাকা টাকা টাকা। সবকটা শালা পাগল।

আপনার বাবা?

উইক পারসোন্যালিটি। মাথায় কোনও বাস্তব বুদ্ধি ছিলো না। দু’হাতে শুধু কামিয়ে গেলো লোকটা। রাখতে পারলো কিছু?

আপনার মা তো খুব ভালো ছিলেন?

ভালো না ছাই। খিটখিটে মেজাজ। শুধু চেঁচামেচি করতো।

আপনার কোনও প্রেমিকা ছিলো না? কোনও বান্ধবী!

বান্ধবী! প্রেমিকা? আমি শহরের নাম্বার ওয়ান। আমার সাথে মিশবার মতো কেউ ছিলো নাকি?

বুঝলাম।

কী বুঝলেন?

বুঝলাম আপনি শহরের এক নম্বর।

আচ্ছা ডাক্তার, আপনি কি কিছু খাইয়ে দিয়েছেন আমাকে। এত বকছি কেন?

বকুন। বকুন। কথা বলা ভালো।

কী বলবো?

সেই যে সার্জেনের হাতে থাপ্পর খেলেন।

হ্যাঁ। তারপর থেকেই চলতে লাগলো। আজ এই ডাক্তার, কাল সেই স্পেশালিষ্ট। স্কুলে ফেল করতে করতে উঠছিলাম। দাদা-দিদিদের কাছে পড়া বুঝতে যাই। মেজদা পড়ে ফিজিক্সে অনার্স। ওর কাছে কেমেস্ট্রি বুঝতে যাই। মেজদা রেফার করে সেজদার কাছে। উত্তর তৈরি থাকে মুখে। বলি, ‘দূর সেজদা নিজে ভালো, কিন্তু বোঝাতে পারে না।’

মেজদা জ্ঞানী বুদ্ধের মতো হাসে। আবার সেজদার কাছে বুঝতে যাই লেন্স। লোকটা ছবি আঁকতে জানে না। বই দেখে বোঝায়। মাথা খারাপ হয়ে যায় আমার। বাবা ডাকলেও ইংরাজি বই নিয়ে সামনে যাই না। সেজদির কাছে যাই। সংস্কৃতে স্পেশাল অনার্স পড়ে। খুব সরল সেজদি। চোখ বড়ো বড়ো কর বলে, ‘ও মা, আমি পড়াবো ইংরাজি! দু’লাইন লিখলেও বাবাকে দেখিয়ে নিই।’

পড়াশোনা প্রায় ছেড়েই দিলাম। আজ মাথা ব্যাথা, কাল পেট খারাপ। এসব চলতে লাগলো। ছোটো শহর বড়ো শহরের ডাক্তাররা আমাকে দেখতে দেখতে হাল ছেড়ে দিলো। ততদিনে শিখে গেছি অনেক রোগ বৃত্তান্ত। ম্যানিক ডিপ্রেশন। অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার। অ্যান্টি সোশ্যাল সিনড্রোম। বাবাকে বলি, দাদাদের বলি ‘আমাকে দিল্লি ব্যাঙ্গালোরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাও।’ বাবা তাই করালেন। তারপর একসময় ফেড আপ। তাবিচ কবজ করাতে লাগলেন। উন্নতির কোনও দিশা নেই। তবে দাদাদের উন্নতি হচ্ছে খুব। বড়ো বড়ো চাকরি পেয়ে শহরের বাইরে চলে যাচ্ছে। দিদিদের বিয়ে হয়ে গেলো এক এক করে। তারপর একদিন বাবা শয্যাশায়ী। বয়স হয়েছিলো তো! দু’দিন ভুগে দুম করে বাবা মরে গেলো। ডাক্তাররা বললো, মাইল্ড অ্যান্ড রিপিটেড স্ট্রোক।

বাবার মৃত্যুতে শোকে বিদ্ধস্ত পরিবার। আমিও শোক পালন করলাম সবার সাথে। হবিষ্যি খেলাম। মাথা নেড়া করলাম। সত্যি কথা বলছি, ভিতরে কোনও দুঃখ হয়নি আমার। নিজের মতো আমি আছি। খাইদাই আর দিন রাত টো-টো। মাঝে মাঝে স্কুলে যাই আবার ভালো না লাগলে বাড়ি চলে আসি। বই-খাতা নিয়ে পড়তে বসার ধাত আমার নেই। তবে পরীক্ষার হলে যাই। পাশ-ফেল নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। দেখতে দেখতে পড়াশোনা না করেও কেমন করে যেন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে গেলাম।

তারপর?

শুরু হলো অন্য খেলা। কলেজে ভর্তি হলাম। ক্লাস করি না। একবার বলি সায়েন্স পড়বো। কিছুদিন পরে আর্টস। দাদারা বিরক্ত হয়। আমাকে নিয়ে ওদের মধ্যে অনেক মতভেদ। আমি তাড়িয়ে তাড়িয়ে ওদের বাকবিতণ্ডা শুনি। আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু আমি, ভাবলেই আনন্দ। অনেক যুক্তি-তর্কের পর বড়দা, মেজদা কিম্বা সেজদা আমাকে ভর্তি করে দেয় অন্য কলেজে। বুঝতে পারি এ বাড়ির সবাই দিগগজ। সায়েন্স আর্টস জানা লোক অনেক। চিন্তা করলাম কমার্স পড়বো। ঐ লাইনে পা মারায়নি কেউ। অগত্যা সেটাই করে দিলো দাদারা।

কমার্স নিয়ে ভর্তি হলাম। অ্যাকাউন্টেন্সির মোটা মোটা বই কিনলাম। কিন্তু পড়ি না। কখন ঘুমাই কখন উঠি, কেউ জানে না। রাঁধুনি রান্না করে যায়। আমি খাই, কখনও খাই না। তিনজন লোক আমার দেখা শোনা করে। রান্নার একজন, বাসন মাজার আরেক লোক আর আমাকে ঠিকমতো ওষুধ খাওয়ানোর লোক। ওরা অনেক সময় বাড়ি তালাবন্ধ দেখে ফিরে যায়। আমি আমার মতো আছি। শহর জুড়ে লোকজন জেনে গেছে দাদারা আমাকে দেখে না। দাদারা ভালো ছিলো আগে। বিয়ের পরেই বিগড়ে গেলো দাদারা। নইলে মায়ের মৃত্যুর পরেই আমাকে একলা ফেলে পালায়?

আমি একলা এত বড়ো বাড়িতে। মাঝে মাঝে ডাক্তার দেখিয়ে কোনও দাদা বা বৌদি ওষুধ কিনে দেয়। আমি ইচ্ছে হলে খাই। ডাক্তাররা আমার রোগ ধরতে পারে না। তাই ভালো করবার প্রশ্নই নেই। সেজদা মাঝে মাঝে বলে, ‘আরে রোগ থাকলে তো ডাক্তাররা সারাবেন।’

এক গাদা রোগ নিয়ে আমি শুয়ে থাকি। ইচ্ছে হলে নদীর ধারে ঘুরে বেড়াই। দাদার বন্ধুদের কাছে টাকা চাই। ওরা জানে তো আমাকে দাদারা দেখে না। আমি নিজের অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকি।

আজকেও অন্ধকার। মাঝে মাঝে চিৎকার করছি, ‘মা এই বাড়িতে আমাকে কেউ একটু দেখে না।’ আমার কথায় কেউ সাড়া দেয় না। দেবে কী করে। মা তো মারা গেছে গত বছর। দাদারা সব বাইরে। আমি একা এই বাড়িতে।

আপনি বিয়ে করেননি কেন?

বিয়ে? আমার যোগ্য মেয়ে পেলে তো! বড়দা একবার খুব গুছিয়ে বিয়ের কথা বলতে এসেছিলো। ‘এবার তুই বিয়ে কর পিন্টু’, গলায় মাখন মাখিয়ে কথা বলছিলো দাদা। ‘বৌ খুঁজে আনবো আমরা। মাসে মাসে টাকা পাঠাবো। তুই শুধু একটু ভালোভাবে থাক।’

বড়দার কথাতে অন্য দাদারা একমত। বৌদিরা একসাথে হৈ হৈ করে উঠলো। কিন্তু আমি আক্রমণকরে বসলাম দাদাকে। আসলে আক্রান্ত মানুষের মুখটা কেমন চুপসে গিয়ে আঁটি হয়ে যায়। আমারদেখতে খুব ভালো লাগে। গণ্যি-মান্যি সফল একটা মানুষের মুখ জুড়ে কেমন একটা অসহায় ভাব। দাদার প্রস্তাবের উত্তরে আমি বললাম, ‘তার চেয়ে দাদা, তুই আরেকটা বিয়ে কর।’ কথাটা কানে ঢুকতেই দাদার ভরাট মুখটা কেমন চুপসে গেলো। আসলে প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর দাদা বেসামাল হয়ে গিয়েছিলো। দ্বিতীয় আরেকটা বিয়ে করে সামলে নিয়েছে তখন। আমি জানি আমার কথাটা কতটা আঘাত করবে দাদাকে। আঘাত করতে দাঁতে আলপিন ফুটিয়ে দেবার মতো মোক্ষম কাজটা করলাম। দেখলাম সাত সকালেই দাদার মুখে বিকেলের মরা আলো।

বুঝলাম, স্যাডিস্টিক পারসন্যালিটি ট্রেট। আর কিছু অসুবিধার কথা বলুন।

অসুবিধা কিছু নেই।

আপনি সবসময় ঘোরের মধ্যে থাকেন, তাই না!

থাকি। মহাপুরুষ-শয়তান-বদমাশ সবাই শালা ঘোরের মধ্যে থাকে। আমি থাকলেই দোষ!

না না দোষ কেন হবে? আপনি ঠিক বলেছেন পিন্টু বাবু। তবে আমি একটা বিষয় বুঝতে পারি না।

কী বিষয়?

মানুষের মধ্যে কে পাগল আর কে সুস্থ?

এটা বোঝেন না! যে মার খেয়ে হজম করে নেয় সে সুস্থ। হজম করতে না পারলেই সে পাগল।

আপনি দারুণ বললেন পিন্টু বাবু।

ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর গলার স্বর উঁচুতে তুলে বললাম, আমি দারুণই বলি। গান জানি। বক্সিং জানি। ক্যারাটে চাম্পিয়ান ছিলাম। স্কুলের টিমে ফুটবল খেলেছি। আমি শহরের নাম্বার ওয়ান। বুঝলেন। এটা লোকে মানতে পারে না। তখনই মাথাটা ঝট করে গরম হয়ে যায়।

ডাক্তার পদ্মনাভ মাথা নাড়লেন। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। দাড়ি-গোঁফ কামানো পরিষ্কার মুখ। মাথায় কোঁকড়ানো কাঁচা-পাকা চুল। বুড়োটে মার্কা কালো একটা চশমা চোখে। নীল রঙের জিন্সের প্যান্ট। উপরে সস্তা সাদা জামা। তার উপর কোঁচকানো সাদা অ্যাপ্রন। মুখে কোনও আভিজাত্য নেই। একটা ফেকলু ফেকলু ভাব। এই লোকটা আমার রোগ সারাবে?

ডাক্তার পদ্মনাভ মিনমিন করে বললেন, ‘পিন্টু বাবু, আপনাকে কী ওষুধ দিই বলুন তো?’

শালা তুমি ডাক্তার আর আমাকে জিজ্ঞেস করছো? রাগে খিঁচিয়ে উঠে বললাম, ‘কাল রাত্তিরে কী খাইয়েছো আমাকে? সব কথা টেনে বের করে নিলে?’ রাগ হলেও তেমন উত্তেজিত হতে পারলাম না। ওষুধের প্রভাব হয়তো। জিভ টেনে আসছে। জড়ানো গলায় ধীরে ধীরে বললাম, ডাক্তার সব ওষুধই তো খেলাম। ভালো হলাম কৈ?

ডাক্তার পদ্মনাভের মুখে কথা নেই। বোকা বোকা চাউনি। মনে হয় কিছু একটা ভাবছে। ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম, আমার নাকি পারসন্যালিটি ডিসঅর্ডার! অনেক ওষুধ তো গিললাম। অ্যাংক্সাইটি ডিসঅর্ডার, ম্যানিক ডিপ্রেসন কিছুই তো বাদ গেলো না।

আরও ওষুধ খান।

কী খাবো? লিথিয়াম গ্রুপ পেট খারাপ করে দেয়। অ্যান্টি ডিপ্রেশন্ট গিললেই হাত-পা থরথর করে। কি যে করি!

ঠিক আছে পিন্টু বাবু, ওষুধের কথা এখন থাক।

থাকবে কেন? আপনি কি আমার রোগটা ধরতে পারছেন না?

ডাক্তার মাথা নেড়ে বললেন, সত্যিই ধরতে পারছি না। বুঝিয়ে বলুন তো ঠিক কোনখানে আপনার রোগ।

হাতি ঘোড়া গেলো তল, মশা বলে কত জল। আমি মনে মনে বললাম। আমার ঠোঁটের ফাঁক গলে হাসি ছড়িয়ে পড়লো। সব কথা বলতে যাবো কেন? ভাবছি শুধু। বিয়াল্লিশ বছর বয়সে কত কী দেখলাম। সবাই কত বদলে গেলো। দাদা-দিদির ছেলে মেয়েরা সেদিন জন্মে ইংল্যান্ড আমেরিকা চলে গেলো। আমি শুধু থেকে গেলাম আগের মতো। একদম পাথর।

কী ভাবছেন পিন্টু বাবু? ডাক্তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন। আমি উত্তর দিলাম না। মনে মনে বললাম, ডাক্তার আমার অসুখটা ডিটেক্ট করো। দেখি হিম্মত!

ডাক্তার মুচকি হেসে বললেন, যা বলছিলাম। ওষুধের কথা আজ থাক। আপনি যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ান। লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়াশুনা করুন। জিমে গিয়ে ব্যায়াম করুন। আর আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে রুগী দেখতে যাবেন।

কী করবো আপনার সাথে? কপালে ভাঁজ পড়লো আমার। মালটা পাগল না ডাক্তার?

রোগী দেখতে যাবেন। ডাক্তারের সোজাসাপ্টা উত্তর।

রাগলো না। শান্ত মুখ। নরম স্বরে আবার বললো, আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে রোগী দেখবেন। ক্রিটিকাল কেসগুলো নিয়ে আপনার সাথে ডিসকাস করবো।

আমি দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললাম, আমি কেন করতে যাব? এটা আমার কাজ?

ডাক্তার বিনয়ী স্বরে মধু ঢেলে বললেন, আপনাকে খুব দরকার। কত অভিজ্ঞ আপনি! এই ক্লিনিকের নাম্বার ওয়ান হিসাবে থাকুন।

শালা ইয়ার্কি মারছে নাকি? পদ্মনাভ লোকটাকে বুঝতে পারছি না। ফিচেল না বদমাশ? ডাক্তার না পাগল! যাই হোক, অ্যান্টি সাইকোটিক ড্রাগ খাওয়াতে হবে। মনে হচ্ছে লোকটারও সেই রোগ। পারসোন্যালিটি ডিসঅর্ডার।

1 comment:

  1. আপনাদের ধন্যবাদ জানাই।

    ReplyDelete