0

বিশেষ ক্রোড়পত্র - শতবর্ষে সত্যজিৎ

Posted in

 


সম্পাদকীয়

১৯৭২ সালে সত্যজিৎ রায় শান্তিনিকেতনে তাঁর শিল্পশিক্ষক বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে তৈরি করেছিলেন ‘দ্য ইনার আই’ নামে একটি তথ্যচিত্র। এই ঘটনার প্রায় তিন দশক আগে তিনি মায়ের ইচ্ছায় গিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে। রবীন্দ্রনাথ তখনও রয়েছেন। সেই রবীন্দ্রনাথ, যিনি ছিলেন তাঁর পিতামহ এবং পিতৃদেবের পরম সুহৃদ। সেই যাওয়া তাঁর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলো। এর আগে দেশজ শিল্প সম্পর্কে কোনও স্বচ্ছ ধারণা তাঁর ছিলো না। পরবর্তীকালে আমরা যে ভুবনব্যাপী প্রতিভার উন্মেষ দেখবো, তার সলতেতে অগ্নিসংযোগটি ঘটে গিয়েছিলো তখনই। আর এরপরের উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটি ঘটলো আরও দশ বছর পর যখন বিজ্ঞাপন সংস্থা ‘ডি জে কেমার’-এর হয়ে সত্যজিৎ গেলেন লন্ডন। তাঁর সেই অস্থায়ী প্রবাসপর্বে তিনি দেখলেন প্রায় একশোটি ছবি, যার মধ্যে একটি ছিলো ভিত্তরিও দি সিকার ‘দ্য বাইসাইকেল থিভস্‌’। সত্যজিৎ রায় এক বহুমুখী বিরল প্রতিভা, যাঁর সৃষ্টির প্রতিটি স্তর ছুঁয়ে গিয়েছিলো অনন্যতার আলাদা আলাদা মাত্রা, কিন্তু একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ ছাপিয়ে গিয়েছিলেন তাঁরই অন্যান্য সকল কীর্তি। গল্প বলার সহজাত ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছিলেন তিনি। তার সঙ্গে মিশেছিলো তাঁর তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির সুবাদে মনুষ্য সম্পর্কের আনাচে-কানাচে পৌঁছে যাওয়ার অনায়াস ক্ষমতা, তাকে কাটাছেঁড়া করতে পারার প্রয়োজনীয় নিঃস্পৃহ নির্মমতা। ফলত জন্ম নিল ‘পথেরপাঁচালী’, ‘অপরাজিত’ এবং ‘অপুর সংসার’। মানবিক সম্পর্কের তিনটি আশ্চর্য দলিল। সারা বিশ্ব সম্ভ্রমের দৃষ্টি নিয়ে তাকালো আমাদের দিকে। পরবর্তী চারটি দশক জুড়ে তাঁর মরমী ক্যামেরা আর মেধাদীপ্ত লেখনী প্রজন্মের বেড়াজাল উধাও করে দিলো। ‘মানিক-দ্যুতি’ আবিষ্ট করে রাখলো আমাদের। আজ তাঁর জন্ম শতবর্ষে আমাদের নতশির নিবেদন এই ক্রোড়পত্র।

সূচিপত্র

১। মনসিজ মজুমদার - শিল্পী সত্যজিৎ
২। গৌতম ঘোষ - শতবর্ষে সত্যজিৎ ভাবনা
৩। কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত - সত্যজিৎ, শতবর্ষ ও বিজ্ঞাপনের পানমশলা
৪। নির্মল ধর
৫। রাজু রামন
৬। শুভা দাশ মল্লিক
৭। অমিতাভ আকাশ নাগ
৮। প্রীতিলতা কয়াল



শিল্পী সত্যজিৎ

মনসিজ মজুমদার

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আমার ‘পরিচয়’ সুদূর ছেলেবেলা থেকে। সে সময়ে তাঁর সবচেয়ে বড়ো পরিচয় ছিলো তিনি সুকুমার রায়ের ছেলে আর তিনি সুন্দর ছবি আঁকেন। সুকুমার রায়ের ‘আবোলতাবোল’-এর কবিতা তখন আমাদের মুখস্ত। মুখে মুখে ফিরতো “হ্যাঁরে হ্যাঁরে তুই নাকি কাল, সাদাকে বলেছিলি লাল?/তোদের বাড়ির বেড়ালগুলো, শুনেছি নাকি বেজায় হুলো?....কেন রে ব্যাটা ইস্টুপিড, ঠেঙিয়ে তোকে করব ঢিট”; বা “শিবঠাকুরের আপন দেশে আইন কানুন সর্বনেশে।” ঠিক সেই সময়েই সিগনেট বুকশপ সুকুমার রায়ের চারটি অনবদ্য বইয়ের চারটি অনবদ্য সচিত্র সুশোভন সংস্করণ প্রকাশ করলেন আর আমাদের হাতে পৌঁছে গেলো প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। কী করে পৌঁছলো সেকথা এখানে অবান্তর, আসল কথা বইগুলো, হ-য-ব-র-ল, ঝালাপালা, পাগলা দাশু আর বলা বাহুল্য, আবোলতাবোল। সে যে কী এক পরম অবাক করা জিনিস পেয়ে গেলাম আমরা তা বলে বোঝানো যাবে না! প্রতিটি বই ঝকঝকে ছাপা বাঁধাই, মলাটে রঙীন ছবি, পাতায় পাতায় ছবির ছড়াছড়ি। আমরা ছিলাম ছোটো তিন ভাই, প্রত্যেকে একটা করে বই পেলাম আর একটা বই ছিলো সকলের। আমার ভাগে পড়েছিলো পাগলা দাশু, মলাটে দুষ্টু-মিষ্টি দাশু পাগলার ছবি। আমি ছেলেবেলায় ছবির পোকা ছিলাম। ছবিও আঁকতাম। মোটা তুলির কালো আঁচড়ে এলোমেলো চুল, আড়চোখে তাকিয়ে-থাকা দৃষ্টিতে খেয়ালিপনা আর দুষ্টুমি ভরা। বাহাত্তর বছর পরে, সেই আশ্চর্য বই ছেলেবেলার দিনগুলোর মতোই হারিয়ে গেছে। কিন্তু দাশু পাগলার সেই মজার মুখ আমার আজো মনে আছে। কারণ, সেই দাশুপাগলার ছবির আমি আমার রঙের বাক্সের রঙ উজাড় করে কপি করেছিলাম। আর ঠিক সেইজন্যেই জানার ইচ্ছে হয়েছিলো ছবি এঁকে ছিলেন কে? চারটে বইতেই, সম্ভবত পিছনের মলাটে, লেখাছিলো—“ছবি এঁকেছেন সুকুমার রায়ের পুত্র সত্যজিৎ রায়।” তখন তিনি বছর তিরিশের তরুণ যুবা। আমি বালক কিশোর হলেও শিল্পীদের খোঁজ খবর রাখতাম। আমাদের বাড়িতে ছিলো একসেল্ফ-বোঝাই প্রবাসী, ভারতবর্ষ, প্রবর্তক, পরিচয় ইত্যাদি পত্রিকার পুরনো সংখ্যার বাঁধানো কপি। প্রবাসী পত্রিকায় প্রতি মাসেই থাকতো অবনীন্দ্রনাথ এবং নন্দলাল, রামকিঙ্কর, বিনোদবিহারী, অসিত হালদার প্রমুখ শান্তিনিকেতনের শিল্পীদের সদ্য আঁকা ছবি বা মাদ্রাজ আর্ট কলেজে অধ্যক্ষ দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরীর ছবির রঙীন আর্টপ্লেট। সে ছবিরও কিছু কিছু নকল করার চেষ্টা করতাম। সবচেয়ে ভালো লাগতো বিচিত্রায় প্রকাশিত মনীষীদের ছবি। আর সেই বয়সেই বাবা আমার ছবি সম্পর্কে আগ্রহ দেখে দাদাকে বলতেন আমাকে যাদুঘরে একাডেমি অভ ফাইন আর্টস আয়োজিত অল ইন্ডিয়া আর্টস এগজবিশন-এ নিয়ে যেতে। (তখনও একাডেমির নিজের বাড়ি হয়নি, লেডি রাণু ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে এই এগজিবিশন করতেন)। আমার সেই দশ বছর বয়সের প্রিয় শিল্পীদের মধ্যে সত্যজিতের ছবি কোথাও দেখতে পেতাম না! পরের চার-পাঁচ বছর সত্যজিৎকে ভুলেই গেলাম বলা চলে। এই সময় হাতে এল আম আঁটির ভেঁপু , সিগনেট প্রেসেরই বই, বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী’র কিশোর পাঠ্য সংস্করণ। মলাট, সচিত্রণ এবং বইয়ের ডিজাইনও সত্যজিতের।

সেই দশ বছর বয়সের পর ভুলে-যাওয়া সত্যজিতের দেখা পেলাম আবার যখন আমি কলেজে প্রথম বছরের ছাত্র। আর সত্যজিৎকে নিয়ে তখন কাগজে পত্রে বিরাট হইচই, যা কদাচিৎ কখনও কোনও শিল্পীকে নিয়ে হয়। আসলে সত্যজিৎ তখন শিল্পী নয়, তিনি তখন চলচ্চিত্র শিল্পী। পথের পাঁচালী যখন প্রথম মুক্তি পেলো কলকাতায় তখন তার সংবাদ, ভালো, মন্দ, উচ্ছসিত সব মন্তব্যই ছিলো সব কাগজের ভেতরে সিনেমার পাতায়। কিন্তু পরের বছর কানে যখন সেই ফিল্ম ‘দি বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’ পুরষ্কার পেলো তখন সমস্ত ভারতের সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় চলচ্চিত্র শিল্পীর নাম ও তাঁর অসামান্য শিল্পকৃতির কথা প্রচারিত হ’ল (এখানে ‘শিল্পী’ ‘শিল্পকৃতি’ কথাগুলি ব্যবহার করছি কেবল এই নিবন্ধের বিষয় শিল্পী সত্যজিৎ বলেই নয়। সত্যজিৎ নিজেই চলচ্চিত্রকে আর্ট অর্থে শিল্প এবং পরিচালককে শিল্পী এবং চলচ্চিত্র নির্মাণকে শিল্প সৃষ্টি বলে উল্লেখ করেছেন তাঁর ‘বাস্তবের পথে চলচ্চিত্র’ প্রবন্ধে।)। আমি অবশ্য পথের পাঁচালী কানে পুরষ্কার পাওয়ার আগেই বসুশ্রী সিনেমা হলে দেখেছিলাম। কারণ, আমাদের এক আত্মীয়তুল্য দাদা আগেই দেখে এসে বলেছিলেনঃ A lyric on celluloid। আমার জানা নেই এটা তাঁর কোটেশন ছিলো, না স্বরচিত মন্তব্য ছিলো। এছাড়াও আমাদের স্কুলের বাংলার মাস্টারমশাই আমাকে বলেছিলেন পথের পাঁচালী দেখতে।

ঠিক তখন না হলেও ক্রমশ যতই সাহিত্য ও শিল্পকলার সঙ্গে পরিচয় ঘনিষ্ঠ হয়েছে ততই বুঝেছি প্রত্যেক শিল্পী, বিশেষ করে বহুমুখী প্রতিভার শিল্পী, হয় তাঁর নিজের সৃষ্টি-মাধ্যম নিয়েই জীবন শুরু করেন, পরে নানা মাধ্যমে প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেও, কোনও একটি বিশেষ মাধ্যমই তাঁর সৃষ্টি ক্ষমতার পরিচিতি নির্মাণ করে। সত্যজিৎ কেবল ছবি-আঁকার প্রতিভা নিয়ে জন্মাননি। উপেন্দ্রকিশোরর পৌত্র এবং সুকুমারের পুত্র, তিনি বংশ সূত্রেই পেয়েছিলেন কলা ও সাহিত্য প্রতিভা, বিশেষ করে কিশোরসাহিত্যে তাঁর স্বচ্ছন্দ অধিকার। কিন্তু তাহলেও প্রশ্ন থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথও এক বিশাল বহুমুখী কবি প্রতিভা এবং সাহিত্যের সব শাখায় অসামান্য সৃষ্টি-স্বাক্ষর রাখার পরেও তিনি ছবি এঁকেছেন এবং ভারতীয় চিত্রকলায় আধুনিকতাবাদের সূচনায় তিনি যে এক নম্বর শিল্পী তা অস্বীকার যায় না।

সত্যজিৎ যখন শান্তি নিকেতনে গেলেন চিত্রকলা শিখতে— এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন—তিনি চিত্রশিল্পী হতে চাননি, তিনি গিয়েছিলেন কমার্শিয়াল আর্ট শিখতে। কিন্তু কেন চিত্রশিল্পী হতে চাননি? কেন কমার্শিয়াল আর্ট শিখতে চেয়েছিলেন?

দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর তত জটিল নয়। জীবিকার তাগিদে তাঁকে এমন কিছু শিখতে হবে যাতে তাঁর সৃষ্টিপ্রতিভার নিরন্তর স্ফূরণের অনুকূল চাকরি তিনি পেতে পারেন। সেসময় এমন চাকরি একটিই পাওয়া যেত এবং এখনও বোধ হয় তাই। না, স্কুলে কলা শিক্ষকের চাকরি নয়! মেধাবী তরুণদের পছন্দসই চাকরি খুব সুলভ না হলেও একেবারে দুর্লভ ছিলো না। সৃজন প্রতিভার তরুণদের সুযোগ খুবই সীমিত ছিলো, বিশেষ করে যাঁরা সত্যজিতের মতো এমন চাকরি খুঁজতেন যাতে সৃষ্টি প্রতিভার কর্ষণ ও প্রয়োগের প্রয়োজন হয়। নিছক অর্থার্জনে প্রতিভার অপমৃত্যূ তাঁরা চাইতেন না। সত্যজিৎ সেই সুযোগ পেলেন একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায়। (সেই সময় তরুণ শিল্পী-সাহিত্যিকেরা বিজ্ঞাপন সংস্থায় চাকরি পেতেন তাঁদের প্রতিভার জোরে।) সেখানে তিনি ছিলেন শিল্পী অন্নদা মুন্সীর সহকর্মী। প্রথম যে সংস্থায় চাকরি পেলেন সত্যজিৎ সেখানে বিজ্ঞাপনের কপি লিখতেন এক তরুণ কবি যাঁর পদ্যের সেই বিখ্যাত লাইনঃ “ফুল ফুটুক না ফুটক, আজ বসন্ত” একসময় কোনও সাহিত্যপ্রেমী যুবার অজানা ছিলো না, কবির নাম জানুক বা না জানুক।

এই সংস্থায় থাকার সময় সত্যজিতের সৃষ্টি প্রতিভার ক্রমান্বয় স্ফূরণ হয়, বিশেষ করে বিজ্ঞাপন শিল্পকলায়। তাঁর আশ্চর্য দক্ষতা দেখা যায় ডিজাইন আর ক্যালিগ্র্যাফিতে। বাংলা বইয়ের মলাটের ডিজাইন, এক বা দুই রঙের, আর বইয়ের বা ম্যগাজিনের শিরোনামের অক্ষর লিপি সবকিছুতে, বলা যায়, এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন। শুধু এক্ষণ পত্রিকার মলাটের দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। প্রতি সংখ্যায় ‘এক্ষণ’ নামটার নতুন নতুন অক্ষরলিপি দিয়ে তিনি অসাধারণ প্রচ্ছদ ডিজাইন করেছেন। তার চেয়েও অসামান্য কাজ ছিলো তাঁর নিজের ফিল্মের পোস্টার। পোস্টারে ফিল্মের নামের চেহারা দেখলেই বোঝা যেত পোস্টার শিল্পী আর ফিল্মের পরিচালক সত্যজিৎকে। কিন্তু প্রথম প্রশ্নঃ কেন তিনি চিত্রশিল্পী হতে চাননি? তার একটি উত্তর সহজেই অনুমেয় কারণ আগেই বলেছি তরুণ সত্যজিতের অর্থার্জন করে নিজের পায়ে দাঁড়ানো। সেদিক থেকে চিত্রশিল্পীর ভবিষ্যত ছিলো অন্ধকার! সত্যজিতের চিত্রশিল্পী বন্ধু পরিতোষ সেন তাঁর যে অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন, তার উল্লেখ এখানে প্রাসঙ্গিক। ম্যাট্রিক পাশ করে পিতৃহীন পরিতোষ পরিবারের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও পকেটে মাত্র দশ টাকা নিয়ে মাদ্রাজে গিয়ে সেখানকার আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন তাঁর প্রিয় শিল্পী অধ্যক্ষ দেবীপ্রসাদ রায় চৌধুরীর কাছে কলাশিক্ষার জন্যে। যখন শিক্ষা শেষে মাদ্রাজ থেকে বাড়ি ফিরলেন, তখন তাঁর অগ্রজ তাঁকে ব্যঙ্গ করে বললেন, যাও, ছবি এঁকে এক পয়সা রোজগার করে দেখাও। কিন্তু চিত্রশিল্পী হতে চাইলে তিনি কী ছবি আঁকবেন। সদ্য তরুণ সত্যজিৎ যখন নিজের কলাপ্রতিভা ও সাহিত্যপ্রতিভা সম্বন্ধে সচেতন হচ্ছেন, সচেতন হচ্ছেন যে, যে সৃষ্টি প্রতিভা তাঁর পরিবার সূত্রে তিনি পেয়েছেন তা এক মহৎ ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার। এদিকে কলাশিল্পে তখন এক বড়ো রকমের বিবর্তন ঘটে গেছে। রেনেশাঁর আধুনিকতা বাতিল হয়ে বিশশতকী আধুনিকতাবাদের সূচনা হয়েছে। আধুনিকতার মতো সর্বব্যাপী না হলেও শিল্পসাহিত্য—বিশেষ করে কলাশিল্প হয়ে উঠলো আধুনিকতাবাদের প্রত্যক্ষ লীলাক্ষেত্র। সূচনা হয়েছিলো বিশশতকের প্রথমেই, পিকাসোর সেই বিখ্যাত ছবি, লে দামোয়াজেল আভিনিওঁ, যাতে কনটেন্টের চেয়ে ফর্মের দাপট বেশি বা ফর্মই কনটেন্ট— সাহিত্য-সম্পর্কহীন স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম, যাতে আখ্যান বা ন্যারেটিভের কোনও স্থান নেই। তরুণ সত্যজিৎ তখন তাঁর প্রতিভা বিকাশের অনুকূল জীবন- জীবিকার ভাবনায় তাড়িত এবং তাঁর সৃষ্টি প্রতিভা বিকাশের যে পথ বেছে ছিলেন তা ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্যের পথ, যে ঐতিহ্য, আগেই বলেছি তিনি পেয়েছিলেন পারিবারিক সুত্রে। তিনি যে চিত্রকলা ও সাহিত্যসৃষ্টির চর্চা করবেন তা যে সেই ঐতিহ্যেরই অনুগামী হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এখানে আধুনিকতা এবং আধুনিকতাবাদের মধ্যে তফাৎ কী, তা আলোচনা করা জরুরী। ঐ দুটি শব্দ, দুটি ইংরেজি শব্দের বঙ্গানুবাদঃ Modernity ও Modernism. মূল শব্দ দুটি ফরাসীঃ Modernité ও Modernisme এবং উচ্চারণও প্রায় ইংরেজি শব্দ দুটির মতো, যথাক্রমে, মদার্নিতি ও মদার্নিসম। আধুনিক সভ্যতার জন্ম ইউরোপে, পনেরো শতকে ইতালীতে প্রাচীন গ্রিস ও রোমের শিল্প সাহিত্য দর্শন সবকিছুর নতুন করে’ পঠন-পাঠন শুরু হয়। ফলে সভ্যতা সংস্কৃতির এক নবসূচনা ঘটে, সেই সাংস্কৃতিক বিপ্লব ইতিহাসে Renaissance বা নবজাগরণ নামে চিহ্নিত। মধ্যযুগের জীবনচর্চা, দৃষ্টিভঙ্গী, মূল্যবোধ সবকিছুতে ইহ জীবনের চেয়ে মরণোত্তর জীবনের (life hereafter) গুরুত্ব ছিলো বেশি, জীবন আবর্তিত হতো ঈশ্বর আর ধর্মকে কেন্দ্র করে। নবজাগরণের বিপ্লব নিয়ে এল মানবতাবাদের যুগ— যে যুগের বাণী, আমাদের এক কবির ভাষায়ঃ “সবার ওপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।” রেনেসাঁস আধুনিকতার ক্রমবিকাশ হয়েছে পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে। যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান বিপ্লব, প্রকৃতি ও জড় জগৎ সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা, মানুষের পার্থিব জীবন বাস্তবতার মূল্যায়ন, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তি স্বাধীনতার স্বীকৃতি, সমাজ ও রাষ্ট্র সংগঠনে নতুন ভাবনা, ইত্যাদি নানা লক্ষণে আধুনিকতা সমৃদ্ধ হয়েছে। শিল্পে সাহিত্যে আধুনিকতার বহু বিচিত্র প্রকাশ ঘটেছে, দৃশ্য জগতের ছবি এঁকেছেন শিল্পীরা, প্রত্যক্ষ জীবনের কথা নিয়ে লেখা হয়েছে কথা সাহিত্য। শিল্প ও সাহিত্যে আধুনিকতার প্রধানতম লক্ষণঃ সুনির্দিষ্ট বিষয়(content), বিষয়ের বাস্তবিকতা (Realism), সুগঠিতবিন্যাস(composition), ছবিতে বাস্তবানুগ অবয়ব(form) এবং শিল্পী বা লেখকের শৈলী-স্বাতন্ত্র্য(stylistic individuality).

বিশশতকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় প্রগতির অভিঘাতে আধুনিকতা আরও সংহত হয়েছে। বিশ শতকের আধুনিকতম শিল্প মাধ্যম জন্ম নিয়েছে—ফোটোগ্রাফি ও সিনেমা এবং দুটোই মূলত দৃশ্য জগৎ হুবহু নকল করার যান্ত্রিক মাধ্যম মাত্র, যা একমাত্র শিল্পীর হাতে শিল্প মাধ্যম হয়ে ওঠে। সত্যজিতের প্রতিভার সর্বোত্তম বিকাশ ঘটলো এই আধুনিকতম শিল্প মাধ্যমেই। মনে রাখতে হবে সত্যজিৎকে বলা হয় আমাদের শেষ রেনেসাঁস ম্যান। তা কেবল তাঁর বহুমুখী প্রতিভা ছিলো বলে নয়। বেঙ্গল রেনেসাঁস বা ইউরোপীয় রেনেসাঁস হোক, তিনি ছিলেন রেনেসাঁস প্রবর্তিত যুক্তিবাদী মানবতাবাদী আধুনিকতাপন্থী। বলা যেতে পারে সত্যজিৎ ছিলেন ইউরোপীয় রেনেসাঁস থেকে বেঙ্গল রেনেসাঁস পর্যন্ত বিবর্তিত যে আধুনিকতার ঐতিহ্য তাতেই আশ্রিত আধুনিকতাপন্থী। তাঁর ট্র্যাডিশনালিস্ট পরিচয়ের দৃষ্টান্ত তিনি যে দুটি শিল্প মাধ্যমে সোনার ফসল ফলিয়েছিলেন সেই সাহিত্য ও সিনেমা, বিশেষ করে, সেইসব অনবদ্য চলচ্চিত্র, যা তাঁকে বিশ্বখ্যাতি এনে দিয়েছিলো, তা সবই ঐতিহ্য-আশ্রিত আধুনিকতায় চিহ্নিত। বিজ্ঞাপন বা কমার্শিয়াল কাজের বাইরে তিনি যে ছবি এঁকেছেন তা তাঁর গল্প-উপন্যাসের সচিত্রণ। কমিউনিস্ট নেতা বিমান বসু কোথাও বলেছেন তিনি তাঁর মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে সত্যজিতের আঁকা বেশ কয়েকটি ছবি দেখেছিলেন (এই মাস্টারমশাই ছিলেন সত্যজিতের কাকা, সুনির্মল রায়)। ছবিগুলি সম্বন্ধে আর কিছু জানা যায় না। তবে সেসব ছবিতে বৈপ্লবিক কিছু ছিলো না তা অনুমান করা যায়। সত্যজিৎ যে ঐতিহ্যপন্থী আধুনিক ছিলেন তার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন তাঁর চলচ্চিত্র, যা তাঁকে বিশ্বখ্যাতি এনে দিয়েছিলো এবং সিনেমাই সেই আর্ট ফর্ম বা শিল্প মাধ্যম যাতে তাঁর সৃষ্টি প্রতিভা পূর্ণতায় প্রকাশ পেয়েছে— তাঁর সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্র ও চলচ্চিত্র কলার এক অনন্য সম্মিলন ঘটেছিলো। এবং তিনি যে গল্প লেখা ও ছবি আঁকার মতোই ছবি করাতে ও রেনেসাঁস আধুনিকতার ট্র্যাডিশনকেই মেনে চলেছিলেন, তার কথাই মৃণাল সেন বলেছেনঃ ট্র্যাডিশনাস্টরা অসাধারণ ছবি করতে পারতেন, করেওছেন সারা পৃথিবী জুড়ে, আমাদের দেশে তার সেরা উদাহারণ মানিক বাবু নিজেই। কিন্তু লিনিয়ার বা রৈখিক ভঙ্গিতেই যে একমাত্র ছবি করতে হবে এমন কোনও কথা নেই। ট্র্যাডিশনের বাইরে গিয়ে নিয়ম ভেঙ্গে নন-লিনিয়ার ভঙ্গিতেও ভালো ছবি করা যায়। চিত্রকলা, সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক— সমস্ত আর্ট ফর্মেরই নান্দনিক নিয়ম অবিরত বিবর্তনের চাপে বদলে গেছে। অতএব ফিল্মও যে বদলাবে তাতে আশ্চর্য কী। (আনন্দলোক,২মে,১৯৯৮} কিন্তু ১৯৬৯ সালে দেশ বিনোদন সংখ্যায় প্রকাশিত চলচ্চিত্রের ভাষাঃ একাল ও সেকাল নামের প্রবন্ধে সত্যজিৎ চলচ্চিত্রের আদি থেকে অধুনাতম বিবর্তন নিয়ে সুদীর্ঘ ইতিবাচক আলোচনা করেছেন। সিনেমার সূচনা থেকে নির্বাক,সবাক, নবতরঙ্গ বা নিউ ওয়েভ পর্যন্ত সব ছবি এবং লুমিয়ের, গ্রিফিথ, চ্যাপলিন, বাস্টার কীটন, আইজেনস্টাইন, রেনোয়া কুরোসাওয়া, ওজু, ত্রুফো, গোদার, ডিসিকা, বার্গম্যান, আন্তোনিওনি, পাসোলিনি, বুনুয়েল, প্রমুখ বিখ্যাত চলচ্চিত্র শিল্পীদের প্রত্যেকের ছবির চিত্রভাষা নির্মাণ ও বৈশিষ্ট্যের যেমন সপ্রশংস আলোচনা করেছেন, তেমনি মৃণাল সেনের মতো লক্ষ্য করেছেন সাহিত্য শিল্প, সঙ্গীত “অবিরত বিবর্তনের চাপে বদলে” যায়, পূর্ণতা পায় এবং পরিণত অবস্থায় “[চলচ্চিত্রের] কোনও ভাষা চিরকালের মতো টিকে থাকতে পারেনা” তবে শুরুতেই মন্তব্য করেছেনঃ “আজ ষে নতুন ভঙ্গিটা সিনেমায় লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সেটা অনেক সময়েই মনে হচ্ছে আস্ফালনের ভঙ্গি; তাতে চমক লাগানোর প্রয়াসটা বেশ স্পষ্ট।” তিনি বলেননি ষাটের দশকে কোন ছবি দেখে তাঁর তার মনে হয়েছে। হয়তো সত্যজিতের এই উক্তিতে তাঁর ঐতিহ্যের প্রতি অবিচল আনুগত্যের ইঙ্গিত আছে। আর একটি মন্তব্য তিনি ঐ প্রবন্ধেই করেছেন যা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সেটা সিনেমায় গল্পের ভূমিকা প্রসঙ্গে। চলচ্চিত্রের ব্যবসায়িক সাফল্যের প্রয়োজনেঃ

সিনেমার গল্পতে… জটিলতার প্রশ্রয় না দেওয়াই রেওয়াজ ছিলো।… ব্যবসায়িকভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত শিল্পকলা দর্শকদের সুসংবদ্ধ প্লট ও সহজবোধ্য সরল চরিত্রের পথেই নিয়ে যেত।… ছবির যে ভাষাও প্রকৃতি, তার জন্যে চিত্রনির্মাতাদের দায়িত্বের সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের দায়িত্বের কথাটাও মনে রাখা দরকার। দর্শক কী বোঝে, কী চায়, কীসে খুশি— এ প্রশ্নগুলো কোনও চিত্র নির্মাতাই উপেক্ষা করতে পারেন না। দর্শক চায় নিটোল প্লট সংবলিত কাহিনি…

এই মন্ত্যবের প্রায় তিন দশক পরে একটি সাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ বলছেনঃ

গল্প বলার যে ধারা আছে চলচ্চিত্রে, তা কখনও হারাবে না। সারা পৃথিবীর দর্শকরা সিনেমায় একটা গল্প চান। এমন একটা গল্প যার শুরু থাকবে, একটা শেষ থাকবে। আমার ছবিতেও আমি এই গল্প বলার ধারাটা বজায় রাখতে চেয়েছি। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আমি কিন্তু মূলত এক গল্প- বলিয়েই, আ স্টোরি-টেলার। (আনন্দলোক, ঐ)

সত্যজিতকে মৃণাল সেন যে ট্র্যাডিশনালিস্ট বলেছিলেন, তা সত্যজিৎ অজ্ঞাতসারে মেনে নিয়েছেন ওপরের উদ্ধৃতিতে। শুধু তাই নয় মৃণাল সত্যজিতের ফিল্মে যে রৈখিকতার (linearity) অভিযোগ করেছেন, তার যেন সমর্থন পাওয়া যায় তিনি যখন তাঁর চলচ্চিত্রে সবসময়ে একটা গল্প বলেন এবং সে গল্পের একটা শুরুও একটা শেষ থাকবে— একথাও যখন জানান। সত্যজিতের ঐতিহ্য-আনুগত্য, সাহিত্য চলচ্চিত্রে জীবন বাস্তবতার ছবি আঁকা এবং গল্প-বলা— এসবের মধ্যেই নিহিত আছে। যদিও এক্ষণ পত্রিকায় (শারদীয়, ১৩৮২) প্রকাশিত হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতীয় শিল্পকলার অধ্যাপক পৃথ্বীশ নিয়োগী আর সত্যজিতের যে শিল্প বিষয়ে আলাপ হয়েছিলো তা থেকে জানা যায় ছবি না আঁকলেও তিনি সমকালীন শিল্পকলা সম্বন্ধে আগ্রহী ও ওয়াকিবহাল ছিলেন। কিন্তু সমকালীন শিল্পকলায় যে বক্তব্য বা কনটেন্টের চেয়ে আঙ্গিকের বা ফর্মের প্রাধান্য, তা তিনি আঙ্গিক সর্বস্বতা মনে করতেন। রেনোয়া ছিলেন তাঁর অন্যতম প্রিয় পরিচালক, কারণ “রেনোয়া মোটেই আঙ্গিকসর্বস্ব পরিচালকদের দলভুক্ত নন।” তবু প্রশ্ন তোলা যায় তিনি তাঁর মতো ছবি আঁকেননি কেন? এই প্রশ্নের নির্দিষ্ট কোনও উত্তর নেই। তবে মনে রাখতে হবে বহুমুখী প্রতিভার শিল্পী এমন আর্ট ফর্মে কাজ করতে চাইবেন যাতে তাঁর বিভিন্নমুখী প্রতিভা একই অভিমুখে সক্রিয় হয়। সিনেমা ছিলো তাঁর কাছে এমনই এক কম্পোজিট শিল্প মাধ্যম, যাতে নানা আর্ট ফর্মের সম্মিলন ঘটে। একটি ফিল্ম নির্মাণে সত্যজিৎ সাহিত্য-সঙ্গীত-চিত্রনাট্য, চিত্রকলা-দৃশ্যপরিল্পনা-ফোটোগ্র্যাফি, A to Z সবকিছুতেই নিজের বিভিন্নমুখী প্রতিভার প্রয়োগের সুযোগ পেতেন। ফলে একটি কোনও আর্টে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে চাননি। আমরা বলতেই পারি রবীন্দ্রনাথ পারলেন কী করে? রবীন্দ্রনাথ পেরেছিলেন, কারণ, তিনি সারা জীবন সাহিত্য সাধনায় নানা কাজে, যখন নিজের প্রতিভার সম্পূর্ণ ও সার্থক প্রয়োগে সৃষ্টির আনন্দের পাত্র অতি পূরণ করেছেন তখন ছবি এঁকেছেন এবং সাহিত্যের নানা শাখায় তিনি যা করেননি, সেটাই করেছেন ছবির ভাষায় আত্মপ্রকাশ করে। যে আলোয় আলোয় মুক্তি পেয়েছিলেন বিশেষ করে, কবিতায় আর গানে, তার পুনরাবৃত্তি করেননি তাঁর ছবিতে। ছবিতে তিনি এঁকেছেন তাঁর অবচেতনে নিহিত সারাজীবনের জমে থাকা দুঃখ-বেদনা বা সভ্যতার সঙ্কটে মানুষে বিশ্বাস হারানোর গভীর আর্তি এক অন্ধকার আর সংশয়ের আলো-আঁধারের প্রতিকৃতি। সত্যজিৎ তাঁর সৃষ্টিকর্মে— কি সাহিত্যে, কি চলচ্চিত্রে— তাঁর সকল প্রতিভা, সকল বক্তব্য, আত্মপ্রকাশের সকল মাধ্যম নিঃশেষ করার আগেই, তাঁর শেষ শয্যায় আশ্রয় নেবার দিন ঘনিয়ে এল।

লেখক পরিচিতি - অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। লেখক। শিল্প সমালোচক

**********************************

শতবর্ষে সত্যজিৎ ভাবনা

গৌতম ঘোষ

বিখ্যাত ইংরেজ কবি ও প্রাবন্ধিক টি.এস.এলিয়ট ট্র্যাডিশন এ্যন্ড ইন্ডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট শীর্ষক রচনায় সৃষ্টিশীলতার এক গুরুত্বপূর্ণ দিকে আলোকপাত করেছিলেন।
সত্যজিৎ রায়ের মতন এক বহুমুখী প্রতিভাকে নিয়ে আলোচনায় উপরুক্ত প্রবন্ধ বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। সত্যজিৎ জন্মেছিলেন বঙ্গীয় নবজাগরণের আলোয় উদ্ভাসিত এক পরিবারে। পারিবারিক পরম্পরা ও পরিবেশ অবশ্যই অনুকূল ছিলো তাঁর বড়ো হওয়ার পর্বে। কিন্তু প্রতিভা তো শুধুমাত্র বংশপ্রবাহে বিচ্ছুরিত হয় না, তাকে আবাদ করতে হয়। সৃষ্টিশীলতার ক্ষেত্রে সত্যজিতের প্রস্তুতিপর্ব ছিলো অসাধারণ। একজন মেধাবী ছাত্রের মতো মনসংযোগ করে শিখেছিলেন সঙ্গীত, চিত্রকলা, সাহিত্য, বিজ্ঞান ও সিনেমা। যেহেতু সিনেমার সঙ্গে সবকটি শিল্প মাধ্যমের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগাযোগ আছে সেহেতু সত্যজিতের সিনেমাযাত্রা ছিলো অনায়াস ও অনাবিল। অথচ নতুন কিছু শেখার তাগিদ ছিলো জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। অসম্ভব শব্দটা ওঁর ডিক্সনারিতে ছিলো না। শিখে, জেনে, অধ্যয়ন করে সৃষ্টিশীল কাজকে সম্ভব করতে হবে।
সত্যজিতের পরিবার বিজ্ঞান ও শিল্পের মেলবন্ধনের সন্ধানে লিপ্ত ছিলেন। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরি সন্দেশ পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন সেই উদ্দেশ্য নিয়েই। কিশোর কিশোরীদের সংস্কারমুক্ত একটা সজীব
মনের সন্ধান দিয়েছিলো এই প্রকাশনা। উপেন্দ্রকিশোরের পরে সুকুমার রায় সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। অনেকদিন পত্রিকা বন্ধ থাকার পরে সত্যজিৎ রায় ও কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় নবরূপে আবার সন্দেশ প্রকাশ করেন ষাট দশকের গোড়ায়।
আজকের ভোগবাদী সমাজে যেখানে শিক্ষা প্রায় পণ্যে পরিণত হয়েছে, কচিকাঁচাদের মন সুলভ আকর্ষণে লালায়িত হচ্ছে দিনরাত ধরে তখন সন্দেশের প্রচেষ্টার কথা ভেবে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে।
যাই হোক, আমাদের সবার প্রিয় সত্যজিৎ রায় একেবারে প্রস্তুত হয়ে মাঠে নেমেছিলেন। ফলে সৃষ্টিশীল যা কিছুতে উনি হাত দিয়েছেন সেখানেই একটা স্বতন্ত্র রুচিশীল অভিব্যক্তিরপরিচয় রেখে গেছেন।

সত্যজিৎ রায়ের উপর তথ্যচিত্র নির্মাণকালে আমার সৌভাগ্য হয়েছিলো তাঁর বিখ্যাত খেরোর খাতা বা জাবেদা খাতাগুলো দেখার, বোঝার ও শুটিং করার। বিজয়া রায় ও সন্দীপ, মানিকদার লেখাপড়ার ঘরটা আমার কাজের জন্যে খুলে দিয়েছিলেন। সত্যজিৎকে নতুন করে চেনার সুযোগের জন্যে ওঁদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ। পথের পাঁচালীর খেরোর খাতা ছিলো না। শুরু হয় অপরাজিত থেকে শেষ হয় আগন্তুকে। খাতাগুলো একেকটা ছোটোখাটো ওয়ার্কস্টেশনের মতো। ফ্রেম-আঁকা শটের পর শট সাজানো চিত্রনাট্য তো আছেই। এছাড়াও আরও কত কি! সেটের স্কেচ, প্রপ লিস্ট, পোষাক-পরিচ্ছদের ডিজাইন, ছবির লোগো, কোথাও আবার থিম মিউজিকের একটা ফ্রেজ। কোনও একটি খাতায়... সম্ভবত সদগতি, একজন পরিণত বয়সের মানুষ দেবনাগরী লিপিতে স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ লেখা অভ্যেস করছেন! খাতার শেষের দিকে দেবনাগরীতে একটা পুরো দৃশ্য লেখা। আয়ত্ত না করে ছাড়বো না— এই ছিলো সত্যজিতের শেখার ইচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন পর্বে অন্তরের অন্তরতম অনুভূতির লিখিত প্রকাশ। অতি স্বল্প পরিসরে। যেমন একটি নদীতটের লাইন ড্রয়িং-এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সিলিউট একটা আকৃতি। তলায় লেখা।। এখন তোমাকে চাই।। আবার কোনও একটি খাতায় লেখা,।। জানি না।। বা ।। আমি জানি না।। জানার ও শেখার কি প্রবল হাহাকার করা আর্তি। সত্যজিৎ এক অপার বিস্ময়।

লেখক পরিচিতি - চলচ্চিত্রকার

************************************


সত্যজিৎ, শতবর্ষ ও বিজ্ঞাপনের পানমশলা

কৃষ্ণপ্রিয় দাশগুপ্ত


এক দুজে কে লিয়ে।।

গণশত্রু কিন্তু আবারও ফিরে এসেছে! মহানগর জুড়ে জাঁকিয়ে বসেছে তার মারণ থাবা। না কোনও দেবী এর প্রতি প্রণত হয়ে এই মৃত্যুদূতের হাত থেকে রক্ষা পারবেন না। ক্রমেই দেশ থেকে দেশান্তরে এই অতিমারি তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে। এই রোগ কিন্তু কোনও আ গ ন্তু ক নয়। গতবছরই এই ভাইরাসের অভিযান থমকে দিয়েছিলো আমদের জনজীবন। লকডাউনে ঘরে-বাইরে করার উপায় ছিলো না। গৃহবন্দী থমকে যাওয়া সময়ে তখন পিকু-র ডায়েরি লেখাই একমাত্র কাজ ছিলো। সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো অর্থনৈতিক অগ্রগতি। নিমেষেই বেমালুম ভ্যানিশ হয়ে গিয়েছিলো জন-অরণ্য। ব্যস্ত শহর যেন নিঃঝুম অরণ্যের দিনরাত্রি। রাজপথে অবলীলায় পশুদের পদচারণায় ঠিক যেন নেমে এসেছিলো চিড়িয়াখানা। পায়ে হেঁটে নীড়ে ফেরার মিছিলে সামিল হয়েছিলো লক্ষ অপুর সংসার। এই অশনিসঙ্কেতকে চিনতে শিখুন। জানি হয়তো বলবেন ভ্যাকসিনের পরশপাথর আপনি পেয়ে গিয়েছেন। তার মানে ফের আক্রান্ত হবেন না এমন নয়। মনে রাখবেন এই ভাইরাস আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। বেঁচে থাকতে গেলে এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে অপরাজিত থাকতে হবে। আসুন মাস্ক আর স্যানিটাইজারে অসুখের ন্যূনতম সম্ভাবনার সদগতি করি। জীবনে যদি সত্যিই নিজেকে নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চান সচেতন থাকুন অন্যকেও সচেতন করুন। ভাইরাসের জলসাঘর কিন্তু জনসমাগম হয় এমন স্থান। তাই অযথা ভিড় এড়িয়ে চলুন। অযথা যদি ভিড় বাড়তে থাকে হীরক রাজার দেশে আবার নেমে আসতে পারে লকডাউনের খাড়া, তখন কিন্তু গুপী গাইন বাঘা বাইন-এর মতো ভূতের বর কাজে লাগবে না। মাস্ক ছাড়া ভিড় বাসে ট্রেনে নিজেকে খতরো কা খিলাড়ি ভাবতে যাবেন না, অদৃষ্টে কিন্তু অনেক বড়ো SHATARANJ KI KHILARI বসে আছেন, তাঁর এক চালেই কিস্তিমাত হতে পারে জীবন। এখানে নিজেকে প্রমাণের বিষয় নয়, চাই কাপুরুষ ও মহাপুরুষ নিয়ম মেনে চলার সদিচ্ছা। চলুন খুঁজে ফিরি সেই পথের পাঁচালী, যেখানে এই মারন রোগের সমাপ্তি ঘটবে।

ওপরের এই হুবহু উদ্ধৃতি আসলে একটা বিজ্ঞাপনের বয়ান। বিজ্ঞাপন দিয়েছে Unlimited Options এবং এটা ছাপা হয়েছে ‘বিচিত্রপত্র’ পত্রিকার ‘মে-জুলাই ২০২১’ সংখ্যায়। এই সংখ্যা ‘সত্যজিৎ ১০০।’ সম্পাদকীয়তে সৌরদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘করোনার আঘাত আর ভোটের ব্যাঘাত সামলেও যে বাঙালীরা নানাভাবে সত্যজিৎ শতবর্ষ পালন করছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেই কাজে এই বিচিত্রপত্রই বা বাদ যাবে কেন!’

বাদ যায়নি বিচিত্রপত্র। আর তাতেই ‘সত্যজিৎ ১০০’ প্রকাশ পেয়েছে। এবং এই করোনাকালে সত্যজিৎ বন্দনায় মেওন করোনায়িত সত্যজিৎ নির্মাণ হাজির হয়েছে Unlimited Options-এর বিজ্ঞাপন মারফত। বিচিত্রপত্রের চারের পাতায় রয়েছে উদ্ধৃত বয়ান। বিজ্ঞাপনের ট্যাগলাইন—

শতবর্ষ থেকে সহস্রাব্দ অমর সৃজন
-- প্রণাম হে মহাত্মন --

বহুবছর আগে কমল হাসান এবং নায়িকার নাম মনে নেই— এই দুজনের অভিনীত ‘এক দুজে কে লিয়ে’ ছবিতে একটা গান শুনেছিলাম, বলিউডের বিখ্যাত বেশ কতকগুলো হিন্দি ছবির নাম নিয়ে সেই গানটা তৈরি হয়েছিলো। অনেকে বলেন এইরকম গানগুলো নাকি বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। Unlimited Options-এর বিজ্ঞাপন দেখে সেই গানটার কথা মনে পড়লো। এই বিজ্ঞাপনটাও তেমনই করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের মারাত্মক সময়ে ‘সত্যজিৎ ১০০’ মারফত একটা সতর্কীকরণ ও সচেতনতা নিবেদন। ভালো।

এই করোনার টাইমে গোটা মে মাসটাই মাঠে মারা গেলো। এ মাসের ২-এ সত্যজিৎ, ৫-এ কার্ল মার্ক্স, ৭ বা ৮ বা ৯-এ রবীন্দ্রনাথ। বাঙালির উৎসব-মোচ্ছবের ক্যালেন্ডারে এইদিনগুলো খুবই উল্লেখযোগ্য। এইসব পালাপার্বণের জন্য দু-এক সেট জামাকাপড় তৈরি থাকে, দু-তিন মাসের রিহার্সালও থাকে। এখন সবই ভার্চুয়ালই। যতটুকু হয়, তাও আবার করোনাবিধি মেনে অথবা অনলাইনে কিংবা এইরকম পত্র-পত্রিকা মারফত। তবু তো হয়! আসুন, এবার Unlimited Options-এর সেই বিজ্ঞাপনের ছবিটা দেখা যাক—

পাইপ থেকে পাঁচালী।।

এখন চতুর্দিকে সত্যজিৎ ১০০ চলছে। অনেকগুলো পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। সবগুলোই সত্যজিৎ ১০০। বিভিন্ন লেখা, স্মৃতিচারণা, ছবি, অপ্রকাশিত চিঠি, সাক্ষাৎকার, ইংরেজি সাক্ষাৎকারের তর্জমা ইত্যাদিতে সুবাসিত হয়ে সংখ্যাগুলো বাজারময় ঘুরঘুর করছে করোনা ভাইরাসের মতো। ‘বিচিত্রপত্র’ সম্পাদকীয়তে লিখেছে ‘বার্থ-ডে কেকের মতো পরিবেশিত।’ এইসব সংখ্যায় সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে যেসব বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে, তা-ই আমার এই নিবন্ধে পরিবেশিত হচ্ছে। তা যে কেকের মতো সুমিষ্ট না করলার মতো তিক্ত, পাঠকের ওপর সেই স্বাদ নির্ণয়ের ভার রইলো। আমি এখানে কেবল পরিবেশক মাত্র। তবে মুখশুদ্ধি ধরনের খানিক টীকা-টিপ্পনী সহ।

শুরু করেছি ‘বিচিত্রপত্র’ দিয়ে। আগে এই পত্রে প্রকাশিত বিজ্ঞাপনগুলো পরপর দেখে নেওয়া যাক।

১।



















২।



















৩।




















৪।













পরীক্ষার ফল নিয়ে চিন্তাভাবনা বিষয়ে উপদেশাবলী এই বিজ্ঞাপনের মূল বক্তব্য। বিজ্ঞাপনদাতা’২৭ বছর ধরে লক্ষ্য লক্ষ্য ছাত্র ছাত্রীর ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর।’ ‘লক্ষ্য লক্ষ্য’ বানানটা লক্ষণীয়। ‘জন্মশতবর্ষ উপলক্ষ্যে’ বিজ্ঞাপনদাতা, ‘লক্ষ্য লক্ষ্য ছাত্র ছাত্রীর ভবিষ্যৎ’ গড়ে দিচ্ছে। স্নেহের দেবযানীকে মাণিকদা ‘আত্মবিশ্বাস’-এর কথা বলেছিলেন। সেই বিশ্বাসে ভর করেই ’২৭ বছর ধরে’ বিজ্ঞাপনদাতা নিরলস কাজ করে চলেছে। চলেছে। চলেছে। সত্যজিৎ একাই ১০০।

আমরা ‘বিচিত্রপত্র’-এর বিজ্ঞাপন দেখছি।

৫।










৬।













৭।



















What an advertising man! সত্যিই তাই। যাচ্ছি পরের বিজ্ঞাপনে।

৮।














৯।














সত্যজিৎ রায় Akira Kurosawa-এর ভালো বন্ধু ছিলেন বলে শোনা যায়। কথাটা একদিক থেকে সত্যি। সত্যজিতের সিনেমা না দেখলে দর্শনের অনেকটাই অদেখা থেকে যায়।


১০।



















আগরওয়াল পাইপ অ্যান্ড ফিটিংস আশীর্বাদ কোম্পানির প্লাস্টিকের দ্রব্যসামগ্রীর বিজ্ঞাপনে সত্যজিৎ রায়কে quote করেছে। কেন এই উদ্ধৃতি সেই প্রসঙ্গে আগরওয়াল লিখেছে, তারা সত্যজিৎ রায়ের দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং আরও উন্নত মানের পণ্য মারফত সুপিরিয়র পরিষেবা ছড়িয়ে দিতে চায়। যা কি না, ‘universal in nature’। এখানে পথের পাঁচালী আর আশীর্বাদ কোম্পানির পাইপ এক হয়ে যায়। বিজ্ঞাপনে সত্যজিৎকে উদ্ধৃত করে এই যে একটা সমার্থ শব্দ তৈরি হলো, পথের পাঁচালী আর পাইপ-এর, জন্মশতবর্ষে এও এক বড়ো প্রাপ্তি। সবই ইউনিভার্সাল রিলেশন। ‘বিচিত্রপত্র’ বিজ্ঞাপনেই আছি। এবার দেখুন পরের বিজ্ঞাপন।

১১।



















১২।



















এই বিজ্ঞাপনটা ‘বিচিত্রপত্র’-র ব্যাক কভারে আছে। সত্যজিতের লেখা আনন্দ পাব্লিশার্সের বই। যেখান থেকে এতগুলো বিজ্ঞাপন নেওয়া হলো, সেই ‘বিচিত্রপত্র’-এর প্রচ্ছদের ছবিটা দেখছি এখন—



















আহারে বাহারে সত্যজিৎ।।

শতবর্ষে সত্যজিৎ রায় সবাইকেই অনুপ্রাণিত করেছেন। যেমন পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা, আগরওয়ালের পাইপ, আমূল সবাই-ই উদ্দীপিত। শ্রদ্ধা জানিয়ে Amul Bangla টুইট করেছে—

শতবর্ষে সত্যজিৎ রায়। তাঁর ছবিতে বা লেখায় খাওয়াদাওয়া বরাবরই বেশ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা করে নিয়েছে। সত্যজিতের কাজে খাওয়ার অনুষঙ্গ নিয়ে আমূলের বিশেষ নিবেদন ‘আহারে বাহারে সত্যজিৎ’।

Amul Bangla সত্যজিতের শতবর্ষে ‘আহারে বাহারে সত্যজিৎ’ মারফত যে বিজ্ঞাপনী টুইট সামনে এনেছে, তার কয়েকটা পরপর দেখা যাক।















































































































নিতান্তই সংকলকের ভুমিকায় আছি। যতটুকু সামান্য যা যা দেখছি ‘সত্যজিৎ ১০০’ নিয়ে, তাই এখানে সাজিয়ে দিচ্ছি। বাজারে গিয়ে সংবাদপত্র বিক্রেতার কাছে খান পাঁচেক ‘সত্যজিৎ ১০০’ দেখতে পেয়ে কিনে এনেছি। ‘বিচিত্রপত্র’ তার মধ্যে একটা। বাকিগুলো হলো মাসিক কৃত্তিবাস, দেশ, কিশোর ভারতী এবং আনন্দমেলা। এখানে বিজ্ঞপন কী আছে এবার দেখবো। আমার কিঞ্চিৎ বিজ্ঞাপনপ্রীতি আছে। সেই প্রীতিবশতই দেখতে পাই, শুনতে পাই ছোটোবেলায় কলোনির অলিতে গলিতে ভেসে বেড়ানো সেই চালু প্রবাদ— ‘যার মনে যা, চোরের মনে বোঁচকা।’ পাইপ কোম্পানি থেকে আমূল সকলেই নিজের মতো করে সত্যজিৎকে আবিষ্কার করেছে। পত্রিকার গুরুগম্ভীর প্রবন্ধের পাতার মাঝে মাঝে এইরকম বিজ্ঞাপনগুলো হারিয়েই থাকে। খুঁজে দেখলে এও এক পরশপাথর। যে ক’খানা ‘সত্যজিৎ ১০০’ পত্রিকা কিনেছি, এবার তার প্রচ্ছদের ছবি দেখা যাক। এও একপ্রকার বিজ্ঞাপন।









































































শেষ সন্দেশ।।

‘কিশোর ভারতী’ পত্রিকায় দুটো বিজ্ঞাপন আছে। একটা ব্যাক কভারে আর একটা পত্রিকার শেষের পাতায়। প্রথমে ব্যাক কভারের বিজ্ঞাপনটা দেখা যাক—




















শেষের পাতায় রয়েছে পত্রভারতীর বিজ্ঞাপন। সেই বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে দুটো বইয়ের কথা। ‘সত্যজিৎ রায়ের শতবর্ষে পত্রভারতীর শ্রদ্ধার্ঘ্য।’ এবার বিজ্ঞাপনটা দেখি—




















দেশ পত্রিকার ‘সত্যজিৎ ১০০’-তে সত্যজিৎকে নিয়ে কোনও বিজ্ঞাপন নেই। পত্রিকার সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে, ‘তাঁর জন্মশতবর্ষ এমন সময় সমাগত, সে বড়ো নির্মম সময় কঠিন সময়। পরিপার্শ্ব সেকথা অহরহ জানান দিচ্ছে। জীবন-মৃত্যুর মাঝামাঝি সেই অসম্ভব দোদুল্যমানতা এই বুঝি বা পতনের সমূহ আশঙ্কা, তার মধ্যে থেকেও তাই এইক্ষণে সত্যজিৎ-চর্চা থমকে থাকেনি।’ থমকে যে থাকেনি তারই নিদর্শন হিসেবে গুটিকয়েক ‘সত্যজিৎ ১০০’ আপনাদের দেখালাম।

‘আনন্দমেলা’ পত্রিকার সত্যজিৎ সংখ্যাতেও আনন্দ পাবলিশার্সের একটা বিজ্ঞাপন ছাড়া আর কিছু নেই। তবে এই বিজ্ঞাপনটায় প্রকাশনা সংস্থার সত্যজিৎ লিখিত সব বইয়ের হদিশ আছে। দেখা যাক—



















‘আনন্দমেলা’-র বিজ্ঞাপন দেখলাম। হাতে রইলো ‘মাসিক কৃত্তিবাস’। এই পত্রিকার ‘সত্যজিৎ ১০০’ সংখ্যার ব্যাক কভারে, পত্রিকার প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রতিভাস’-এর সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে প্রকাশিত সব বইয়ের বিজ্ঞাপন রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘সত্যজিৎ রায়ের ১০০ বছর পূর্তিতে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।’ এবার বিজ্ঞাপনটা দেখুন।

এই হলো যা বিজ্ঞাপন দেখেছি তার হিসেব। জন্মশতবর্ষে সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে বাঙালি যতটা উৎসব আনন্দ করবে বলে ভেবেছিলো তা করে উঠতে পারলো না করোনার কারণে। দ্বিতীয়ত, ২রা মে ২০২১, জন্মশতবর্ষের এই দিনে এ রাজ্যে বিধানসভা ভোটের ফল প্রকাশিত হয়েছিলো। ভোটের ফল জন্মদিন পালনের চেয়ে বড়ো। তারপর এবারের ভোটে বিজেপি যেভাবে ‘সুনার বাংলা’ গড়ার লক্ষ্যে ঝাঁপিয়ে ছিলো, ফলে ভোটের ফলাফল নিয়ে আগ্রহ ছিলো তুঙ্গে। তাই সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ অনাড়ম্বরভাবেই কেটে গেলো। প্রাপ্তি কেবল এই খানকয়েক পত্রিকা, যা আমি সংগ্রহ করতে পেরেছি। সেখান থেকেই বিজ্ঞাপনগুলো সাজিয়ে দিলাম। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন আমার বিবেচ্য। নইলে বলতাম প্রচণ্ড ভারি ওজনদার বেশ কিছু লেখাও এই অবসরে ছাপা হয়েছে। সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে কত মানুষ কতরকমভাবে কতকিছু বোঝেন, তার একটা ধারাপাত খেয়াল করা গেছে। সত্যজিতের যাবতীয় শিল্পকর্মের চুলচেরা বিশ্লেষণের স্ব স্ব নিবন্ধে লেখকেরা জানিয়েছেন বহুবিধ দুর্মূল্য কথা। তাতে যেমন অকপট অসহায়তা আছে, তেমনই সমগোত্রীয় বা সমমানের আত্মশ্লাঘা আছে। এসব ভালো ব্যাপার। মানবজীবনে এসব কাজে লাগে। তাছাড়া বাঙালির তো এসব ভালোই লাগে। তবে সত্যজিৎ রায় যে একটা বিজ্ঞাপনসংস্থায় ভিসুয়ালাইজার হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন এবং তিনি যে বিজ্ঞাপনকে কী চোখে দেখে, কোন মানে উন্নীত করেছিলেন তা এই যেসব বিজ্ঞাপনগুলো দেখলাম সেখান থেকে অনুধাবন করা যাবে না। যেমন ভারি ভারি লেখাগুলো পড়ে সত্যজিতের ছবিগুলো সম্পর্কে কোনও ধারণায় পৌঁছনো যায় না। সবই যেন গোলকধাম রহস্য। এ রহস্য ভেদ করতে আরেকজন সত্যজিৎ রায়কেই দরকার। বাঙালিকে তিনি যেভাবে বুঝেছেন এবং তা বিশ্ববাসীকে বুঝিয়েছেন, এ কম্ম নেহাৎ তাঁরই সাজে। তাই জন্মশতবর্ষে তাঁকেই খুঁজছি।

লেখা শেষ হয়ে গেছে। হাতে আছে আরও একটা বিজ্ঞাপন। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে পাওয়া। তবে বিজ্ঞাপনের উপলক্ষ্য জন্মশতবর্ষ নয়। মৃত্যুদিন। দেখুন—



















সকলই তোমারি ইচ্ছা!

শতবর্ষে সত্যজিৎকে আমার শ্রদ্ধা নিবেদন।

লেখক পরিচিতি - সাংবাদিক। গবেষক। লেখক।

*******************************


সত্যজিৎ ১০০

সত্যজিৎ বাবা কি জয়!

নির্মল ধর


১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট যদি বাংলা সিনেমার নবজন্মের দিন হয়, তাহলে ১৯২০ সালের ২রা মে তারিখটা হচ্ছে সেই নবজন্মদাতার জন্মদিন! বাংলা সিনেমা যাঁর হাত ধরে এখনও পর্যন্ত এগিয়ে চলেছে। সত্যজিৎ রায়ের চিত্র ভাবনাকে ডিঙিয়ে যাওয়ার কোনও দীর্ঘ চেহারার মানুষ এখনও চোখে পড়ছে না। শুধু চিত্র ভাবনা বলছি কেন, তাঁর মতো গভীর সমাজ সচেতনতা, দলীয় রাজনীতির বাইরে দাঁড়িয়ে সোচ্চার-এ স্পষ্টভাবে রাজনীতির উচ্চারণ, জীবনকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অনুকরণীয় ভঙ্গি, এখন আর দেখছি কোথায়! আজকের অনেকেই হয়তো বলবেন, পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটেই আপনারা প্রবীণরা আনন্দ পান। নতুনদের মধ্যে কোনও প্রতিভা দেখতে পাননা! ছবির কারিগরি কৌশল বদলে যাচ্ছে, সমাজের কাঠামো ভেতর থেকে ঘুন ধরে গেছে, রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা এখন জীবনকে বিষময় করে তুলছে, এই কঠিন সময়ে আবার একজন সত্যজিৎকে কি সত্যিই দরকার? হ্যাঁ, দরকার, শিরদাঁড়া সোজা রেখে বজ্র গম্ভীর স্বরে যিনি সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার হিম্মত রাখবেন! কই, এখন এমন একজনও কি কলকাতার ফিল্ম মহলে আছেন, যিনি আজকের অসহনীয় সত্যটাকে সেলুলয়েডে তুলে আনতে পারেন? নেই, দুর্ভাগ্য আমাদের, তাই সত্যজিৎ রায়ের জন্ম শতবার্ষিকীতে দাঁড়িয়ে গভীর হতাশার স্বরে বলতে হচ্ছে— সত্যজিৎ তাঁর কোনও যোগ্য উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারলেন না। দায়টা তাঁর নয়, আমাদের। শুরু হয়েছিলো বাংলা সাহিত্যের এক ক্লাসিক রচনা বিভূতিভূষণের “পথের পাঁচালী” দিয়ে। ছবিটি শুধু বাংলা সিনেমার প্রকৃতি চরিত্র চেহারাই বদলে দেয়নি, বিশ্ব সিনেমার চিরকালীন ক্লাসিক হয়ে আছে এখনও। তাঁর নাতিদীর্ঘ ফিল্ম জীবন ছিলো সাফল্যের ফলেফুলে ভরা। জীবনের শেষ ছবি “আগন্তুক” তিনি বানিয়েছিলেন শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে। কিন্তু তাঁর সেই শেষ সৃষ্টিও ছিলো জীবনের অন্যাতম সেরা কাজ। জীবন সায়াহ্নে তিনি তাঁর সারা জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ চেতনা, বোধ ও শিক্ষা দিয়ে আজকের তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালির অহংবোধের এক বিরাশি সিক্কার চপেটাঘাত করে গেছেন। মানুষের নীচতা, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্বার্থপরতার মুখে এক প্রকার ঝামা ঘষে দিয়েছিলেন। হ্যাঁ, “আগন্তুক” তাঁর সিনেমাটিক ভাবনায় নতুন কোনও দিগন্ত খুলে দেয়নি ঠিকই, কিন্তু একজন প্রাজ্ঞ দার্শনিকের ভূমিকা নিয়ে তিনি প্রধান চরিত্রের মাধ্যমে যে আন্তর্জাতিক দর্শন এবং শিক্ষিত গর্বিত বাঙালির “Kupmandukatar” মুখোশটি ছিঁড়ে দিলেন, সেটাও নব্য বাঙালির কাছে এক নবজাগরণের চাইতে কিছু কম নয়। মাঝখানের বিশটা বছরে সত্যজিৎ তাঁর একার চওড়া কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন বাংলা সিনেমাকে প্রপ্তমনস্ক করে তোলার প্রায় একক দায়িত্ব।

অবশ্যই তিনি সতীর্থ হিসেবে পেয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন নামের দুজন বলিষ্ঠ শিল্পীকে, মাঝে মধ্যে রাজেন তরফদার, হারিদাধন দাশগুপ্ত, পূর্ণেন্দু পত্রী-র মতো আরো জনাকয় মানুষ এসেছিলেন পাশে। কিন্তু বাংলা ছবির “ভাগীরাথ” ছিলেন তিনিই, একমেবাদ্বিতীয়ম। গ্রাম্যজীবনের পাঁচালী দিয়ে যাত্রা শুরু করে তিনি নাগরিক জীবনেও প্রবেশ করেছেন। কলকাতা শহরকে নিয়ে তাঁর তিনটি ছবি­­— প্রথম “মহানগর”, এক মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্ন ও আশাভঙ্গের কথা বলে ঠিকই, কিন্তু স্বামী স্ত্রী দুজনেই চাকরি হারিয়েও বলে ওঠে “এত বড়ো শহরে আমাদের একজনেরও একটি কিছু জুটবে না!” সেই আশা ও স্বপ্নের ভাঙচুর দেখি কয়েক বছর পর তাঁর কলকাতা ট্রিলজি— প্রতিদ্বন্দ্বী, অরণ্যের দিনরাত্রি এবং সীমাবদ্ধ ছবিগুলোয়। কলকাতা শহর তখন নকশালকবারি আন্দোলন মুখরিত, অন্যদিকে বেকারত্বের মিছিল। শিক্ষিত যুবসমাজের কাছে কোনও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নেই, দিশেহারা সব্বাই। যাঁরা ভাগ্যবান, তাঁদেরও টিকে থাকতে হচ্ছে নানান অমানবিক কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে। প্রাত্যহিক জীবনে দুর্নীতির ঘুন বাসা বাঁধতে শুরু করেছে, সুস্থ জীবন মানুষকে বেঁচে থাকার Guarantee দিতে পারছেনা। এরমধ্যেও সত্যজিৎ দেখিয়েছেন স্বাভাবিক জীবনে উত্তরণের পথ(প্রতিদ্বন্দ্বীর নায়ক শহরের বিষময় পরিবেশ থেকে পালিয়ে বালুরঘাটের নিস্তরঙ্গ জীবনে হারানো পাখির ডাক আবার শুনতে পেয়েছে। আর “সীমাবদ্ধ”-র নায়ক একটা অনৈতিক কাজের জন্য অনুশোচনায় বিদীর্ণ হয়েছে। কিন্তু “অরণ্যের দিনরাত্রি”-র তরুণের দল কোনওরকম অপরাধবোধ বা অনুশোচনার তোয়াক্কাই করেনি। সত্তর আশির দশকের এটাই ছিলো শহুরে জীবনচিত্র। আবার তিনি যখন নারী পুরুষের বা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভাঙ্গার কথা বলেছেন, সেখানে রবীন্দ্রনাথের কাছে হাত পেতে ও একান্ত নিজস্ব ফিল্মি ভাষায় ও ভাবনায় “চারুলতা”-কে নিজের সেরা সৃষ্টি করে তুলেছেন। ছবি থেকে ছবিতে তিনি বিষয়ে যেমন নতুনত্বের খোঁজে, তেমনি সিনেমার ভাষাতেও, সিনেমার আঙ্গিকেও পরীক্ষার দুঃসাহিকতার পরিচয় রেখে গিয়েছেন যা আজকের দিনেও দুর্লভ। বরং বলতে পারি তাঁর দেখানো ও শেখানো পথেই এখনও চলছেন সব্বাই। সত্যজিৎকে ডিঙিয়ে যাবার সাহস কেউ দেখাতে পারছে না। বরং বলে থাকেন— উনি আমাদের মাথায় থাকুন, ওঁকে শ্রদ্ধা করি, প্রণাম জানাই, কিন্তু ওঁর মতো ছবি করার ক্ষমতা আমাদের নেই!” এটা যাঁরা স্বীকার করছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি সিনেমা বানানো তো এখন সকলের কাছে নিছক ব্যবসা, বাড়ি-গাড়ি বিলাসিতা উপার্জনের পথ। অন্য পাঁচটা ব্যবসার মতো। কোনও শিল্প সৃজন বা সামাজিক দ্দায়িত্ব নয়। সত্যজিতের সব ছবিই যে বাণিজ্য সফল হয়েছে তেমন দাবি তিনি নিজেও কখনো করেননি, প্রযোজকরা তো ননই। মৃণাল সেন এবং ঋত্বিক ঘটকের ক্ষেত্রেও একই মন্তব্য। কিন্তু তাঁরা কখনো পিছিয়ে আসেননি। প্রান্তিক-দলিত মানুষের ওপর উচ্চবর্ণের অবিচার অত্যাচার নিয়ে সত্যজিৎ করেছিলেন “সদগতি”-র মতো বিস্ফোরক ছবি, তাও আবার সরকারি দূরদর্শনের টাকায়। আজ কারও অমন সাহস দেখাবার মুরোদ আছে কি? সকলেই তটস্থ চাটুকারিতা আর পদলেহন করায়। ইতিহাসের পাতায় হাত দিয়েছেন যখন তিনি, তৈরি হয়েছে “শতরঞ্জ কি খিলাড়ি”-র মতো এক দলিল! অযোধ্যা হাত ছাড়া হওয়ার কাহিনীর সঙ্গে তিনি কেমন মসৃণভাবে জুড়ে দিয়েছেন দুই দাবাপ্রিয় সরকারি শাসনযন্ত্রের খুঁটিকে। বাদশাহী বিলাসিতায় মগ্ন তাঁরা, এদিকে দেশে ঢুকে পড়ছে বণিকের দল রাজদণ্ড হতে। ব্যাঙ্গের তীরটি তিনি সোজাসুজি দেখিয়েছেন। সিনেমার গ্ল্যামার ধোয়া নায়ক অরিন্দমকে নিয়ে তাঁর এক manusi মুখকেই অনাবৃত করেছেন। “মহাপুরুষ” ছবিতে বাজারি ভন্ড সাধু সন্তদেরও একহাত নিতে ছাড়েননি। তবে প্রথমদিককার ছবি “দেবী”-তে প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের কাহিনী আশ্রয় করে ধর্মীয় গোঁড়ামির মূলে কুঠারাঘাত করতেও পিছু হঠেননি। কোন ছবি ছেড়ে কোন ছবির কথা আর বলবো! “গণশত্রু” তাঁর ফিল্ম জীবনের দুর্বলতম ছবি হয়েও বক্তব্যের ভারে নিশ্চিত বেশ ওজনদার। এখানেও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি জিতিয়ে দিয়েছেন যুক্তি-বুদ্ধি ও বিজ্ঞানকে। তাঁর “শাখা প্রশাখা” এখনও যে কতটা সমসাময়িক ভাবলে অবাক হতে হয়। সংসারিক বৃত্তের মধ্যে দাঁড়িয়েও তিনি পেশাদারি জীবনে সমঝোতা, সাদা কালো টাকার খেলা নিয়ে কি তীক্ষ্ণ কষাঘাতই না করেছিলেন উচ্চমধ্যবিত্ত সমাজকে। আর ঠিক তার বিপরীতে রেখেছিলেন মেজো ছেলে সৌমিত্রর চরিত্রটি, সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে বটে, কিন্তু সাদা-কালো, ভালো-মন্দের ফারাকটা উপলব্ধি করে, যেটা বাড়ির স্বাভাবিক মানুষগুলো করেনা। একজন সামাজিক দায়বদ্ধ পরিচালকের কাজই তো এমনভাবে দর্শকদের সচেতন করা। তিনি ফিল্ম নিয়ে বিপ্লব বা সমাজ কো বদল ডালোর কাজে তো আর নামেননি। তাছাড়া সত্যি বলতে কি সিনেমা কবে কোন দেশে সমাজকে বদলে দিতে পেরেছে, বিপ্লব এনে দিয়েছে। ছবি যেটা পারে তা হলো জনসাধারণকে সচেতন করে তোলায়, পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করায়। সত্যজিৎ আমৃত্যু সেই কাজটি নিজের বিশ্বাস, নিজের সাধ্যমতো করেছেন।

শুধু সিনেমা নয়, তাঁর লেখা কিশোর সাহিত্য “ফেলুদা সিরিজ, বা প্রফেসর শঙ্কুর কাহিনী আজও বেস্ট সেলার। তাঁরই তৈরি দুটি মিউজিক্যাল ছবি “গুপী বাঘা”, “হীরক রাজার দেশে” এখনও বাংলা সিনেমায় দুটি হীরক খন্ড বিশেষ।

বাংলা সংস্কৃতি জগতে রবীন্দ্রনাথের পর এমন বহুমুখী প্রতিভার দেখা আমরা এখনও পাইনি। ফিল্ম বানানো তো বটেই, কলমে, তুলিতেও তিনি অনবদ্য শিল্পের সম্ভার রেখে গিয়েছেন। খুদে পাঠকদের কাছে তিনি এখনও প্রিয়তম লেখক। ক্যালিগ্রাফি নিয়েও তাঁর অন্বেষণের অন্ত ছিলোনা। তিনি “রে ফন্ট” তৈরিও করেছিলেন, কিন্তু ফিনিশিং টাচটুকু আর দেবার সময় পাননি। অকালেই চলে গেলেন। আজ জন্মশতবর্ষের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে বিনম্র প্রণাম জানানো ছাড়া আর কিইবা করতে পারি আমরা! কারণ, আমরা এখন মেরুদন্ড হারিয়েছি, বিশ্বাস, বোধ জলাঞ্জলি দিয়েছি। জীবনকে এখন ভুবনায়ানের নিক্তিতে ওজন করি, পার্থিব লাভ-ক্ষতি ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্যই নেই আমাদের। শিল্প সৃজন? আগে নিজের ব্যাঙ্ক ব্যালান্স ঠিকঠাক করাটাই যে কোনও পেশার প্রাথমিক উদ্দেশ্য। শিল্প কি আমাকে গাড়ি-বাড়ি ও আরামের-বিশ্রামের Guarantee দেবে?! যদি সেটা না হয়, তাহলে “আমি কিতা করতাম রে!”

তাই সত্যজিৎ জন্মশতবার্ষিকীর প্রতিজ্ঞা হোক “সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রনাথের মতো “ঠাকুর” হয়ে দেয়ালে শোভা পান, বছর বছর ২রা মে তাঁর ছবিতে মালা চড়িয়ে পুজোর ভান করি, সম্মান জানানোর খেলায় মাতি। বছরের বাকি সময়টা নিজেদের ধান্দায় ব্যস্ত থাকাই চালাকি ও বুদ্ধিমানের কাজ। বছরে একবার “সত্যজিৎ বাবাকি জয়!” শ্লোগান তুলতে পারলেই হলো!

লেখক পরিচিতি - সাংবাদিক

********************************


Recollections from the Past

Raju Raman

2 May 2021 turned out to be a very significant day in more senses than one. Apart from being the birth centenary date of the most revered and most celebrated Bengali filmmaker till date, the day also got coined, albeit in jest, by some creative minds in the WhatsApp university as ‘Ray Diwas’, in anticipation of the political outcome of the just concluded 8-phase assembly elections in Bengal, swinging precariously between the numbers of exit polls of all hues.

A centenary year of such a towering personality is indeed a very significant milestone. Hence, the irresistible compulsion of organisations and creative individuals to ‘do something’ and be part of the celebrations is quite understandable. But then, what can one say or write about such a genius that has not been said or written somewhere before. One could easily fall into the trap of the ‘Reuse-Recycle’ mode. I shall therefore restrict myself to some random first-hand impressions.

When Pather Panchali won laurels at Cannes in 1956, I was all of five years old, without any clue of what those adulatory headlines in The Statesman (that was the newspaper that most families subscribed to those days) and all the hue and cry was about. Teenage and puberty gave way to instincts of a different kind and one got attracted, I dare even say addicted, to mainstream Hindi films, not only because of the glamour but also because of the songs. My first glimpse of the great man, if my memory serves me right, was on 25 March 1969, on the occasion of the formal inauguration of the built-on second floor auditorium of Max Mueller Bhavan in its new premises at 8 Ballygunge Circular Road. A tall figure was ushered to the front row and seated beside the chief guest for the evening, Nirad C. Chaudhury. Through whispers and murmurs in the hall I came to know that it was Satyajit Ray. I was already a student of Jadavpur University by then and had the opportunity to catch up with the Apu Trilogy and Charulata, albeit through some atrocious projection in the Gandhi Bhavan auditorium of the university. Nevertheless, the kind of down to earth approach and treatment of these films appealed to me and I got curious about some of this other films. When Pratidwandi released in cinema halls in the early seventies in the aftermath of all the political turmoil in the campus and at a time when we were on the threshold of graduation, it struck an indelible chord. The film was talking about us. The fascination for the man and his works became total. In due course I caught up with all his earlier films, including the documentaries and short films. Motivated by the film society movement, which I gradually got sucked into, which gave me exposure to the works of quite a few stalwarts of world cinema, I learned to appreciate even more Ray’s complete mastery over all aspect of the medium. This was further accentuated by the fact that all his works were firmly entrenched in the roots of his own culture, thus giving him the much needed comfort zone of manoeuvring and bringing out the authenticity of the various situations and characterisations.

When one considers the entire oeuvre of such a creative personality, I suppose one has one’s own favourites. Images from certain films keep reappearing in my mind, beckoning me to revisit them multiple times, even try to read between the frames to discover something new, which might have eluded one’s attention in previous viewings. Charulata still remains one of my most favourite films, each frame so meticulously worked out, the trans-creation from Rabindranath’s novel so effectively essayed in celluloid. Hailing from an extremely orthodox Tamil Brahmin family myself and having involuntarily and unquestioningly imbibed all the customary robotic religious rituals, Devi sowed the initial seeds of rebellion in me against mindless deification, a malady that our society seems to be perpetually possessed with. Time and again, I have admired with awe the powerful manner in which Ray has portrayed the various female characters in his films, like in the Apu Trilogy, Mahanagar, Charulata, Aranyer Din Ratri, Nayak, Ghare Baire and Devi. His handling of his child artistes, e.g. in Pather Panchali, Piku, Two and Hirak Rajar Deshe leave an indelible mark.

In the mid-seventies of the last century, when I started working as Programme Officer of the Goethe-Institut, Max Mueller Bhavan Calcutta, I made the acquaintance of a very affable gentleman by the name of Ajoy Kumar Dey, who later became Ajoy-da, a close associate and dear friend. He was then the General Secretary of the Federation of Film Societies of India and Satyajit Ray its President since inception in 1959. In due course Ajoy-da became my passport to 1/1 Bishop Lefroy Road for any official collaboration request or an odd interview for some film society journal. However, as I realised much later, Ajoy-da made it sound much more complicated than it actually was. He would call Nirmal Acharya, a close confidant of Manik-da (as Ray was addressed) and seek an appointment. Sometimes this used to take days, even weeks. It is only very recently that I have come across the term ‘firewall’ in the context of computers. In retrospect, I realise that such a firewall existed even in those days around celebrities, often created and installed by ‘well-wishers’ without the knowledge of the concerned person.

The film festival bug bit me true and hard for the first time in 1980 when I accompanied Ajoy-da and other film society friends to the International Film Festival of India in Bangalore. One watched 5-6 films on an average every day, also attending some discussions and press conferences. At one such press conference addressed by Satyajit Ray, who was a special guest of the Festival, I asked him for his opinion on Werner Herzog’s Nosferatu being screened at the festival vis-à-vis the silent classic version of F W Murnau made in 1922. He clearly said that Herzog’s version lacked the raw power of Murnau’s black and white silent version. Thereafter attending film festivals with film society friends became an annual affair at different venues in the country. In 1985, with Ajoy-da and me as Joint Convenors, we organised SHORTS-1, the first ever Short Film Festival in this part of the country. Needless to say, Satyajit Ray was the Patron and lent us tremendous support in procuring films from the country and abroad, which was not easy at all, as those days films were still on celluloid and used to come in bulky and heavy reels.

Sometime in the mid-1980s the telephone operator at Max Mueller Bhavan put a call through to me saying she did not quite understand who was on the line. I took the call. Lo and behold, it was Satyajit Ray on the line. He had come to know that we were showing an opera version of Mozart’s Magic Flute. He very much wanted to see it, but the scheduled timing did not suit him. I suggested that we could arrange a separate screening for him at his convenience. He came and enjoyed the opera with a childish thrill. As there was no one else in the room except him, me and the U-matic cassette operator, every now and then he broke into whistling the known tunes along with gay abandon. It lasted almost three hours. It was quite an experience watching him so engrossed in watching the opera.

In the year 1988 I was catapulted to the post of all-India General Secretary of the Federation of Film Societies of India with Satyajit Ray still continuing as President. For the next two terms till 1992 I had ample opportunities to visit 1/1 Bishop Lefroy Road, either to procure the President’s signature on important papers or to seek his advice and instructions in matters of the organisation. At the outset I asked him how to go about setting up a meeting with him. He answered in a matter of fact baritone: “Just give me a call. I usually answer the phone myself. And I shall give you a time.” What? That simple! No firewall! I learned another facet of the great man. I took the liberty of directly dialling 47 8747 whenever required. The few times that I visited his place during that time, he would almost always answer the doorbell himself, be extremely affable and to the point during the discussion and escort me back to the door when I was leaving. The traits of a perfect gentleman ingrained in him probably since his formative years.

This piece would be incomplete without an anecdote to underscore the greatness of the person. The year was 1990. I was part of the regional panel for selection of films from the Eastern Region for the Indian Panorama. The panel had the likes of Bhaben Saikia (Chairman), Amitava Chowdhury, Dr Subhendu Chatterjee, Arup Guha Thakurta, Saikat Bhattacharya et al. Ray’s Ganashatru was one of the entries. It was a foregone conclusion that it would be selected, although the Chairman requested Subhendu Chatterjee to step out, as he was acting in the film. At the end I made a stupid remark that this perhaps did not rise to the heights of his other films. Little did I know that I had made a faux pas. A few days later I had visited Ray’s house for something. Kironmoy Raha was also present. I was flipping through the Frontline magazine which carried a cover story on Ray. Suddenly the baritone boomed: “Tomar na ki Ganashatru bhalo laagi ni?” I froze to immobility. After a few seconds that seemed like eternity, I mustered enough courage to mumble: “Manik-da, the end consumer will certainly compare a product with earlier products from the same source.” There were a few seconds of unending silence till he uttered just one word: “Perhaps.” We never talked about it thereafter.

The last time I met him was on Christmas Eve in the year 1991. Ajoy-da and I along with other film society activists Rabin Banerjee, S P (Bapi) Lahiri and S P Ganguly had gone across to his place to congratulate him on the announcement of the Oscar to be bestowed on him. He was still quite weak after a stint in hospital and could not talk very much.

On 23 April 1992, Ajoy-da, a filmmaker friend Ruchir Joshi and I were discussing films at Olympia on Park Street. After returning home we got the news on television that Satyajit Ray has passed away at Belle Vue Nursing Home. Next day his body was laid out at Nandan for people to pay their last respects. I went there, stood in silence for a few minutes and accompanied the cortege procession to the crematorium as one among a multitude of others. Thereafter, I walked back home along Rash Behari Avenue. Despite the noise of the traffic and the people around, I was immersed in my own thoughts. Images of the few encounters with the great man as well as a few scenes from some his films kept flashing through my mind. They still do, once in a while.

লেখক পরিচিতি - ম্যাক্স মূল্যের ভবন কলকাতার প্রাক্তন প্রোগ্রাম অফিসার। চলচ্চিত্র আন্দোলনের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের সম্পর্ক।

*******************************


অপু এবং অন্যান্যরা​

সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে শিশু চরিত্র​

শুভা দাশ মল্লিক 

সত্যজিৎ রায় তাঁর জীবদ্দশায় নির্মাণ করেছিলেন আঠাশটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র, পাঁচটি তথ্যচিত্র, দুটি স্বল্প
দৈর্ঘ্যের ছবি এবং একটি টেলিভিশনের জন্য ছবি। তাঁর এই ভাণ্ডারে ডুব দিলে আমরা বহু শিশু চরিত্রের দর্শন পাবো। তাদের কেউ কেউ ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় আছে, কেউ আছে গৌণ অথচ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আবার কেউ কেউ আছে নগন্য ভূমিকায়। শিশু চরিত্র একেবারেই নেই, এরকম ছবির সংখ্যা সাকুল্যে পনেরোটি। এই পনেরোটি ছবির মধ্যে অবশ্য সব থেকে উল্লেখযোগ্য শিশুদের জন্য নির্মিত বাংলার সবথেকে জনপ্রিয় ছবি গুপি গাইন বাঘা বাইন। অথচ সত্যজিতের জীবনের প্রথম নয়টি ছবি শিশু চরিত্রের উপস্থিতিতে উদ্ভাসিত এবং প্রত্যেকটি ছবিতে শিশুদের ভূমিকা, তা সে যত ছোটোই হোক, অনবদ্য, অবিস্মরণীয়। শিশু অভিনেতাদের রূপোলি পর্দায় উপস্থিতি মনে গভীর দাগ কেটে যায়।

সত্যজিতের আগে ​মুখ্য​ভূমিকায় শিশু চরিত্র আমরা অত্যন্ত জনপ্রিয় কিছু হিন্দি ছবিতেও পেয়েছি। রাজ কাপুরের আওয়ারা এবং বিমল রায়ের দো বিঘা জমীন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু এই দুটি ছবিতেই শিশু যেন ঠিক শিশু নয়, সে যেন অত্যন্ত দায়িত্ববান একটি খুদে পুরুষ। তার চলন-বলন, মুখের বুলি— সবই যেন পরিচালকের থেকে ধার করা। সেই কারণে আমরা আওয়ারাতে শশী কাপুরের থেকে রাজ কাপুরকে বেশি মনে রাখি আর দো বিঘা জমীনে শিশু অভিনেতার থেকে বলরাজ সাহনিকে বেশি মনে রাখি। কিন্তু একই
কথা কি আমরা ভিত্তোরি ও দেসিকার বাই-সাইকেল থিয়েভস-এর ক্ষেত্রে বলতে পারি? সত্যজিৎ রায় বিলেত গিয়ে এই ছবিটি গোটা ত্রিশবার দেখেছিলেন। সুতরাং শিশু চরিত্রটির অভিনয় এবং তার স্ক্রিন প্রেজেন্স যে তাঁর মননে প্রবেশ করবে, তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করবে এবং ভবিষ্যতে তাঁর নিজের ছবিতে নানাভাবে প্রকাশ পাবে, এ ​তো আশা করা যেতেই পারে।​

সত্যজিৎ রায় ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে চালচিত্র নির্মাণের বেশ কিছু নূতন দিগন্ত খুলে দিয়েছেন। শিশু চরিত্রের নির্মাণ এবং উপস্থাপনা তাদের মধ্যে একটি। এই ব্যাপারে শুধু দেসিকাই যে তাঁর উপর প্রভাব বিস্তার করেছেন তা নয়। আর একজনের প্রভাব এখানে অনস্বীকার্য এবং তিনি হলেন স্বয়ং বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিভূতিভূষণের সঙ্গে সত্যজিতের প্রথম পরিচয় হয় যখন শ্রী অন্নদা মুন্সী ওনাকে পথের পাঁচালি পড়তে বলেন। 

সিগনেট প্রেস তখন পথের পাঁচালীর ছোটো সংস্করণ আম আঁটির ভেঁপু প্রকাশ করার কথা চিন্তা করছেন। সত্যজিৎকে নির্বাচন করা হয় বইটির অলঙ্করণ এবং ছবি আঁকার জন্য। আম আঁটির ভেঁপু থেকে পথের পাঁচালী চলচ্চিত্র— এই সুদীর্ঘ সময় তিনি পথের পাঁচালীর সঙ্গে সহবাস করেন এবং লেখকের ধারণা, সত্যজিতের ছবির অতি পরিচিত বৈশিষ্ট্যগুলি উনি ​পথের পাঁচালী উপন্যাস থেকেই শোষণ করেন। এই বৈশিষ্ট্যগুলি হলো হিউম্যানিসম বা জীবনের প্রতিমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, অ্যাটেনশন টু ডিটেলস বা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দৃশ্যমান জগৎকে ফুটিয়ে তোলা, রিয়ালিজম বা বাস্তবধর্মী উপস্থাপনা এবং সবশেষে শিশু মনস্তত্বের বিষয়ে একটি গভীর অন্তর্দৃষ্টি। ​Pather Panchali defined Satyajit Ray in many ways for the rest of his career. চলচ্চিত্র নির্মাতা সত্যজিৎ রায় গড়ে ওঠেন পথের পাঁচালির হাত ধরে। ​অপু হয়ে ওঠে সত্যজিতের চিরসঙ্গী, সত্যজিতের আত্মারই এক বিকল্প প্রকাশ।
একথা অনেকেরই জানা যে মনের মতন অপুকে খুঁজে পেতে সত্যজিৎ রায়কে বহু সময় ও শ্রম ব্যায় করতে হয়েছিলো। শেষে একদিন প্রতিবেশীর ছাদে সত্যজিৎ পত্নী বিজয়া সুবীর ব্যানার্জীকে খেলতে দেখেন এবং ছয় বছরের বালকের নিষ্পাপ মুখশ্রী দেখে ওনার মনে হয়, এই তো সাক্ষাৎ অপু। কিন্তু শুটিংয়ের সময়ে দেখা গেলো সুবীর একটু আড়ষ্ট। সংলাপ বলার ব্যাপারে তেমন সাবলীল নয়। সেই জন্য আমরা পথের পাঁচালী ছবিতে বিভূতিভূষণের অপুর রিনরিনে কণ্ঠ প্রায় শুনিই না। কিন্তু তাসত্ত্বেও অপুর উপস্থিতি সারা ছবি জুড়ে। সেই যে দূর্গা চাদরের ফাঁক দিয়ে অপুর চোখ খুলে দিলো, তারপর থেকে সব দৃশ্যেই অপু। অপুর চোখ দিয়েই আমরা রেলগাড়ি দেখি, যাত্রা দেখি, দুর্গাকে মার খেতে দেখি। সত্যজিৎ মূল উপন্যাস থেকে বাছাই করা ঘটনা নিজের মতন করে সাজিয়ে নিয়েছেন যাতে ছবির পর্দায় ঘটনার অন্তর্হিত নাটকীয় আভাসগুলি জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠে।

দুর্গার মৃত্যুর পর অপু হঠৎ বড়ো হয়ে যায়। এই পরিবর্তনটি সত্যজিৎ কয়েকটি ছোটো ছোটো দৃশ্যে বুঝিয়ে দিয়েছেন। অপু নিজের চুল নিজে আঁচড়ায় কারণ সিঁথি কেটে চুল আচঁড়ে দেবার লোক আর নেই। তার থেকেও বড়ো কথা, তেলের শিশি তুলে তেল আনতে যাবার সময়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে দেখে যে মেঘ করেছে। তখন ফিরে এসে আবার ছাতাটা নিয়ে যায়। এ যেন বাই-সাইকেল থিয়েভেস-এর সেই দৃশ্যের প্রতিফলন যেখানে ব্রুনো যেতে যেতে ফিরে এসে ঘরের জানলাটা বন্ধ করে দেয় যাতে তার শিশু ভগিনীর ঠান্ডা না লেগে যায়। ঠিক তেমনি ছবির শেষে মজা পুকুরে দুর্গার চুরি করা মালা ফেলে দেবার দৃশ্য একাধারে ইঙ্গিত করে দুর্গার প্রতি অপুর গভীর ভালোবাসা এবং তার পরিবারের জীবনে একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি।

পথের পাঁচালী ছবিতে কিন্তু সুবীর ব্যানার্জী ওরফে অপু একমাত্র শিশু অভিনেতা নয়। করুণা ব্যানার্জীর কন্যা রুমকি ছোটো দুর্গার ভূমিকায় অনবদ্য। গতবছর একটি সাক্ষাৎকারে উনি প্রায় সত্তর বছর আগেকার শুটিংয়ের অভিজ্ঞতার স্মৃতি রোমন্থন করেছেন। রুমকিকে ছবিতে দেখা যায় উঠোন ঝাঁড় দিতে, কলসির থেকে বেড়াল ছানা বার করতে, বাঁশ বনে খেলে বেড়াতে। এসবই শহুরে রুমকিকে শিখতে হয়েছিলো তার ভূমিকাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য। ছোটো দুর্গাকে আমরা শেষবারের মতন দেখি অপুর জন্মমুহূর্তে। দূর্গা এবং ইন্দির ঠাকুরণ আঁতুড় ঘরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে সদ্যজাত অপুকে দর্শন করে। দুজনেই খুশিতে ফোকলা হাসি হাসে। ইন্দির তাঁর ছেঁড়া শাড়ির খুঁটে আনন্দ অশ্রু মোছেন। পরিচালক সত্যজিৎ এই দৃশ্য দু’জনকে বুঝিয়ে দিলেন। ওমা! শুটিং করতে গিয়ে দেখা গেলো কোথায় কী? আঁতুড় ঘরের মেঝেতে তো এক ষণ্ডামার্কা কালো চেহারার পুরুষ শুয়ে আছে। চোখে তার ক্যামেরা এদের দু’জনের দিকে তাক করা। অপুকে যেন দেখছে, কল্পনা করে নিয়ে তাদেরকে অভিনয়টি করতে হলো।

আর একটি দৃশ্যে ইন্দির ঠাকুরণ হাপুসহুপুস করে দুধ-ভাত-কলা খাচ্ছেন আর পেছনে বসে দূর্গা লোলুপ দৃষ্টিতে দেখছে। রুমকির মনে পড়লো, লম্বা সত্যজিৎ হাঁটু গেড়ে তার পাশে বসে বললেন, তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঢোক গিলতে পারবে? বলে নিজে ঢোক গিলে দেখিয়ে দিলেন। রুমকি কিন্তু কিছুতেই ঢোক গিলতে পারলো না। তখন তাকে একটা ছেঁড়া শাড়ির পাড় দেওয়া হলো আর বলা হলো যে সে যেন ইন্দির ঠাকুরণের খাওয়া দেখতে দেখতে পাড়টি আঙুলে পাকাতে থাকে।

এইভাবেই সত্যজিৎ ছোটোদের নিয়ে অবিস্মরণীয় কিছু মুহূর্ত সৃষ্টি করেছেন। এইসব দৃশ্য আজও আমরা বারংবার দেখি এবং উপভোগ করি। অপরাজিততে মুমূর্ষু পিতার জন্য গঙ্গা জল নিয়ে যাবার পথে অপুর দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে ব্যায়াম বীরের মুগুর ভাঁজা দেখা, রবীন্দ্রনাথ তথ্যচিত্রে শিশু রবির জোড়াসাঁকোর অলিন্দে একা একা ঘোরা বা ডালহৌসি এ পাহাড়ের পাদদেশে বসে পিতা দেবেন্দ্রনাথকে গান শোনানো, কাঞ্চনজঙ্ঘা ছবির শেষে নেপালি ছেলেটির চকোলেট খেতে খেতে ক্যামেরার দিকে সোজা তাকিয়ে গান গাওয়া, মহানগর ছবিতে হঠাৎ ভোম্বলের মুখ তুলে প্রশ্ন করা, “কে যাবে চিড়িয়াখানায়?”— এগুলি সবই হৃদয়স্পর্শী এবং স্মরণীয় মুহূর্ত।


সত্যজিতের ছবিতে শিশু চরিত্ররা বয়সে না বালক হতে পারে, কিন্তু তারা চৌকোশ, চোখ কান খোলা এবং তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে সক্ষম। অপরাজিততে অপু সিদ্ধান্ত নেয় যে সে স্কুলে পড়বে। তার এই সিদ্ধান্ত শুনে তার মা যখন সংশয় প্রকাশ করেন যে কীভাবে স্কুলের মাইনে জোগাড় হবে, অপু মায়ের কোলে মাথা রেখে সরল অথচ গভীর ব্যঞ্জনাময় একটি প্রশ্ন করে, “তোমার পয়সা নেই মা? পয়সা নেই তোমার?” পরশ পাথর ছবিতে প্রতিবেশী ছেলেটিই আবিষ্কার করে, কুড়িয়ে পাওয়া গোল পাথরটি কোনও সাধারণ পাথর নয়। এই পাথরের ছোঁয়ায় জং ধরা লোহা সোনাটা সোনার জৌলুস আসে। পোস্টমাস্টার ছবিতে রতনের বুদ্ধি যেন তার বাবুর থেকে বেশি পরিপক্ক। সে তার বাবুকে সেবা করতে পারে, গ্রামের পাগলকে বসে রাখতে পারে আবার তার বাবু যখন তাকে ফেলে কলকাতায় ফিরে যায়, তখন মনের কষ্ট মনেই চেপে রাখতে পারে।

এ তো শিশু চরিত্রের মধ্যে দুটি চরিত্র বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। প্রথমজন অপুর পুত্র কাজল এবং দ্বিতীয়জন সত্যজিতের শেষ ছবিতে সাত্যকি। কাজল এতগুলি শিশুর মধ্যে সবচেয়ে ছোটো অভিনেতা। অপুর সংসার শুটিংয়ের সময়ে তার বয়স মাত্র চার। এই ছোট্ট অভিনেতাটিকে একটি অতি জটিল চরিত্রের ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়েছিলো। মাতৃহীন, অবহেলিত কাজল জানে যে তার একটি বাবা আছে। বাবাকে সে কোনওদিনও দেখেনি, কিন্তু সে মনে মনে স্বপ্ন দেখে যে বাবা নামক বস্তুটি তার এই অবহেলিত, ভবিষ্যৎহীন জীবনের বৃত্তের বাইরে একটি বিকল্প। সেইজন্যই তো সে গ্রামের যে লোকটি তাকে তিরস্কার করে, তাকে সদর্পে বলতে পারে, “তোমার মুন্ডু ভেঙে দেবে আমার বাবা। কলকাতায় থাকে।”

তিরস্কার কর্তা এক রত্তি ছেলের কথা শুনে স্বগতোক্তি করতে করতে হাঁটা দেয়, “পাঁচ বছর হয়ে গেলো বাবার টিকিটি দেখা নেই। সেই বাবার ভয়ে আমরা মাটিতে সেঁধিয়ে যাই আরকি। বাবা! ভারী বাবা!!”

এই কথা শুনে কাজলের স্বগতোক্তি, “বাবাদের বুঝি টিকি হয়?”

চার শব্দের ছোট্ট এই বাক্যটি দর্শককে বলে দেয় যে কাজলের বাবা সম্বন্ধে ধারণা নিতান্তই ধোঁয়াটে। সেই কাজল যখন একদিন দিবানিদ্রা থেকে উঠে আকস্মিকভাবে বাবার মুখোমুখি হয়, তার কী প্রতিক্রিয়া হয়? তার তো খুশি হওয়ার কথা। তবে সে কেন এক দৌড়ে পালিয়ে যায়? সে কেন বাবাকে পাথর ছুঁড়ে মারতে অগ্রসর হয়? সে কেন বাবার দেওয়া উপহার প্রত্যাখ্যান করে— বাবা তাকে দাদুর মারের হাত থেকে বাঁচানোর পরেও? অপুর এই প্রতিক্রিয়া কি বাবার প্রতি অভিমান এত দিন তাকে ভুলে থাকার জন্য? নাকি এই রক্ত মাংসের ‘বাবার’ সঙ্গে তার কল্পনার বাবার কোনওই মিল নেই বলে? এ এক জটিল মনস্তাত্বিক পরিস্থিতির অভূতপূর্ব বহিঃপ্রকাশ, যা কিনা ভারতীয় চলচ্চিত্রে আগে কখনও ঘটতে দেখা যায়নি। অপুর সংসার ছবিটিতে এধরণের অভূতপূর্ব বহিঃপ্রকাশ অন্যত্রও ঘটতে দেখা গেছে। অপু-অপর্ণা কলকাতাতে অপুর বাড়িতে পদার্পণ করার পর, অপুর ঘর জানালার ছেঁড়া পর্দা দেখে অপর্ণার চোখে জল আসে। তার এই দুঃখ কি তার নিজের প্রতি করুণায় না অপুর দীনহীন অবস্থার প্রতি করুনায়? অপর্ণার মৃত্যু সংবাদ শুনে অপুর তার শ্যালককে থাপ্পড় মারে— এই ধরণের প্রতিক্রিয়ার ভারতীয় চলচ্চিত্রে কোনও পূর্ব উদাহরণ নেই।

সেইরকমই একটি অভূতপূর্ব দৃশ্য অপুর সংসারের শেষ দৃশ্যে অপু এবং কাজলের মধ্যে কথোপকথন। অপুকে চলে যেতে দেখে কাজল দূর থেকে তার পিছু নেয়, ছোট্ট মন দিয়ে সে বুঝতে পারে যে নিরানন্দ, অবহেলিত জীবনের থেকে বেরোনোর শেষ সুযোগ সে খোয়াতে বসেছে। অপু কাজলের উপস্থিতি আঁচ করতে পেরে ঘুরে দাঁড়িয়ে কাজলকে জিজ্ঞাসা করে, “কী হয়েছে কাজল? কিছু বলবে?”

অর্থাৎ কিনা কাজলকে সে গন্ডির বাইরে বেরোনোর আর একটা সুযোগ করে দেয়। কাজল যখন জিজ্ঞাসা করে, “তুমি কে?”, অপুর সাহস হয় না বলার ‘আমি তোমার বাবা।’ সে বলে, “আমি তোমার বন্ধু।” এবং সে আশ্বাস দেয় যে সে কাজলকে তার বাবার কাছে নিয়ে যাবে এবং বাবা তাকে বকবে না, দাদুকে নালিশ করে দেবে না। এই প্রতিশ্রুতির ফলে পিতা-পুত্র মিলিত হয়। কাজলের দাদু দূর থেকে দেখে তৃপ্তির হাসি হাসেন।

তবে কি ছবির হ্যাপি এন্ডিং-এর পিছনে এক ফাঁকি লুকিয়ে রইলো? নাকি দুজনেই জানে সত্যি কি। কাজল তার রক্ত মাংসের বাবাকে কল্পনার বাবার আসনে না বসিয়ে আপাততঃ তার বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করলো। আবার জটিল মনস্তত্ত্ব এবং তার অনবদ্য বহিঃপ্রকাশ।

আরেকটি শিশু চরিত্রের বিষয়ে দু’কথা না বললেই নয়। এ হলো আগন্তুক ছবির সাত্যকি, যার বাবা-মাকে আগন্তুক মামা মনমোহন এক কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছিলেন। আগন্তুক ছোটোদের ছবি নয়। কিন্তু আট-নয় বছরের সাত্যকি ছবির শুরু থেকেই প্রায় প্রতি ফ্রেমে উপস্থিত। তাকে আমরা দেখি তার বাবা-মার কথোপকথন শুনে মজা পেয়ে ফিকফিক করে হাসতে। সে অচিরেই আগন্তুক দাদুর সঙ্গে ভাব জমিয়ে নেয় এবং দাদুর ভাণ্ডারে দেশ-বিদেশের মুদ্রা, মুখোশ ইত্যাদি দেখে মুগ্ধ হয়। এক সময়ে সে বলে বসে, “আমি কিন্তু আমার বন্ধুদের বলে দিয়েছি। সকলকে নয়, কয়েকজনকে। আমাদের বাড়িতে একজন আসবেন, সে আমার ছোটোদাদু হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। তারা কিন্তু তোমাকে আজকে দেখতে আসবে।”

ছবির শেষের দিকে সাত্যকি আবার বলে, “আমি কিন্তু জেনে গেছি। তুমি কে।”

মনমোহন জিজ্ঞাসা করেন, “কে?"

সাত্যকি জবাব দেয়, “দাদু”

মনমোহনের পাল্টা প্রশ্ন, কী করে জানলে? আর কেউ তো জানেনা”

সাত্যকি একটু ভেবে জবাব দেয়, “ম্যাজিক”

মনমোহনের ভূমিকায় উৎপল দত্তকে সত্যজিৎ বলেছিলেন যে আগন্তুক ছবিতে মনমোহন হলেন সত্যজিতেরই অপরাত্মা বা Alter ego. সত্যজিৎ তাঁর সমস্ত জীবন দর্শন মনমোহনের মাধ্যমে দর্শককে জানিয়েছেন। এতটাই তিনি মনমোহনের সঙ্গে একাত্ম যে একটি দৃশ্যে নিজের কণ্ঠ ও মনমোহনকে ধার দিয়েছেন।

আমরা বলতে পারি মনমোহন অপুরই আর একরূপ। অপু সত্যজিতের ছবিতে একটি Recurring motif. অপু চরিত্রটি বিভিন্ন নামে, বিভিন্ন স্থানে এবং কালে সত্যজিতের ছবিতে বারবার ফিরে এসেছে। মনমোহন অপুরই শেষ অবতার। ছবির শেষ দৃশ্যে মনমোহন সাত্যকির বাবা-মাকে বিদায় জানিয়ে ট্যাক্সিতে ওঠেন। আর হয়তো কোনওদিনও দেখা হবে না। দর্শকের কাছেও অপুর শেষ বিদায়। সাত্যকি জিজ্ঞাসা করে, “তুমি আর কোনওদিনও আসবেনা?”

মনমোহন উত্তর দেন, “এবার তুমি আসবে আমার কাছে। আর কোন জিনিষটা কখনও হবে না কথা দিয়েছো?”

সাত্যকির জবাব, “কূপমণ্ডূক”

এ যেন প্রবীণ অপু পরবর্তী প্রজন্মের অপুকে ব্যাটন হস্তান্তর করে দিলেন ছুট। সত্যজিৎ ও তাঁর শেষ ছবিতে নতুন যুগের অপুর আবির্ভাব ঘটিয়ে তবেই বিদায় নিলেন। এই অপুকে লালন-পোষণ করা এখন দর্শকের দায়। অপুই সত্যজিতের জগতের প্রাণভোমরা। অপুবিহীন পৃথিবী যেন প্রাণহীন এক খোলসমাত্র।

লেখক পরিচিতি - চলচ্চিত্র বিষয়ক অধ্যাপক এবং নির্মাতা

*******************************


অনভিনয়ের অভিনয়: সত্যজিতের ছবি

অমিতাভ আকাশ নাগ

সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি ‘পথেরপাঁচালী’তে দর্শক আবিষ্ট হলেন চলচ্চিত্র মাধ্যমের নব উদ্ভাসে। চিত্রকল্পের অসাধারণত্বে, কাহিনী বিন্যাসের চমকিত অভিনবত্বে এবং সর্বোপরি অভিনয়শৈলী তুলনা রহিত স্বাভাবিকত্বে ‘পথেরপাঁচালী’ এখনও মুগ্ধ করে রাখে। ‘পথেরপাঁচালী’র আগেও বাংলা সিনেমায় চিত্তাকর্ষক নট ছিলেন, উন্নত, মনোমুগ্ধকর অভিনয়ও অপ্রতুল নয়। কিন্তু প্রথম ছবিতেই, মূলত অপেশাদার অভিনেতা নিয়েও সত্যজিৎ এমন এক স্বাভাবিক অভিনয়ের ধরন স্থির করলেন, যেখানে প্রবীণ ও নবীন অভিনেতারা একই ছন্দে তরঙ্গায়িত হলেন। ‘অপু চিত্র ত্রয়ী’-তে আগাগোড়াই অভিনয় সামঞ্জস্যের উদাহরণ পরিলক্ষিত হয়। ‘অপরাজিত’র পর ‘জলসাঘর’ এবং ‘পরশপাথর’ দুটি ছবিতেই সত্যজিৎ মূল চরিত্রে নেন যথাক্রমে ছবি বিশ্বাস এবং তুলসী চক্রবর্তীকে, যাঁরা পেশাদার ও প্রথিতযশা। মূলত দুটি ছবিতে এই দুই অভিনেতাকে মাথায় রেখেই সত্যজিৎ চিত্রনাট্য লেখেন। যেমন ম্যাটিনি আইডল উত্তমকুমারকে মাথায় রেখেই লেখেন ‘নায়ক’ ছবির চিত্রনাট্য। অথচ প্রথম ছবির দু’দশকের ওপরে একসাক্ষাৎকারে সত্যজিৎ অনাবশ্যক রূঢ়তায় বলেন—

I envy Bergman’s stock company. In Bengal, or even for that matter, we don’t have professionals of that calibre, no one like Bibi Anderson or a Liv Ullmann. They are brilliant virtuoso performers and Bergman can devise parts for them, where they can show the subtlest of emotions and the strongest outburst of passion.১

সর্বভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে সত্যজিতের এই উক্তি বিভ্রম সৃষ্টি করে বইকি, কারণ তাঁর সিনেমার আঙ্গিকে চোখ রাখলে কখনওই তঁর বক্তব্যকে সর্বাঙ্গীণ সঠিক মনে হয় না। বার্গম্যান, কুরোশাওয়া বা হিচককের ছবিতে প্রায়শই দৃশ্যমান যে উত্তুঙ্গ ইমোশন এবং ঘটনার উত্থান-পতন (কিংবা মানসিক অবস্থানের), তার সঙ্গে সংগতি রেখেই তাঁদের ছবিতে অভিনেতাদের উচ্চকিত, শরীর-নিয়োজিত অভিনয় করতে হয়। ব্রাহ্ম দর্শনের ভাবাবেগ অনুসারী সত্যজিতের পক্ষে কোনও বিষয়ে হয়তো উদগ্র, উচ্ছ্বসিত প্রকাশের সম্ভবনাই কমছিলো। হাতে গোনা কয়েকটা চলচ্চিত্র মূহূর্ত বাদ দিলে সত্যজিতের ক্যামেরা তাই খুব কম সময়েই অবিনেতৃর মুখকে চূড়ান্ত ক্লোজ-আপে ধরতে চায়, ক্যামেরার নান্দনিক ধীর চলন-বর্জন করে ছুটে যায় অভিনেতার মুখশ্রীতে (‘অপুরসংসার’-এ শ্যালক মুরারির কাছ থেকে অপর্ণার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ক্যামেরা অপুর মুখের দিকে এগিয়ে যাওয়া একটি বিরল উদাহরণ মাত্র) কিংবা যুক্ত হয় এক নির্মোহ ভায়োলেন্সের উপস্থাপনায় (‘পথের পাঁচালী’তে সর্বজয়ার দূর্গাকে প্রহারের দৃশ্য)। না হলে ‘অভিযান’-এর মারামারির দৃশ্যে কেন সত্যজিৎ এতটা আড়ষ্ট, দ্বিধান্বিত, প্রায় হাস্যকর? অতএব এটা ভাবলে অত্যুক্তি হবে না— যে অর্থে বার্গম্যান, সে অর্থে সত্যজিৎ মানুষের মুখের নীচে, ত্বকের নীচের জ্যান্ত প্রাণীটিকে কখনওই মাইক্রো-রূপে প্রকাশ করতে চাননি। তিনি নিরাপদ দূরত্বে তাকে দেখে গিয়েছেন তাদের ম্যাক্রো অভিব্যক্তিকে।

সত্যজিতের অভিনেতাদের মধ্যে সাধারণভাবে দেখা যায় যে দুটো বিভাজন আছে। একদল আছেন, যেমন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, মমতা শঙ্কর এবং অন্যান্য যাঁরা বলেছেন সত্যজিতের অভিনয় নিজে করে দেখিয়ে দেওয়ার কথা। তাঁদের মতে সংশ্লিষ্ট অভিনেতা যদি দেখিয়ে দেওয়া অভিনয়কে অন্ধ অনুকরণ করেন তাহলে সম্পূর্ণ সফল অনুকরণ না হলেও তা এক উচ্চ পর্যায়ের অভিনয় নিদর্শন হয়ে থাকবে। এর বিপ্রতীপে আছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্য্যায় বা শাবানা আজমির মতো কেউ কেউ, যাঁরা বারংবার সত্যজিতের ছবিতে পাওয়া অভিনয় স্বাধীনতার কথা জানিয়েছেন। ওম পুরী ‘Sadgati’ ছবির অভিজ্ঞতা থেকে পরিষ্কার বলেন যে, সত্যজিৎ সবসময়ই প্রস্তুত থাকলেও অভিনেতার নিজস্ব ধারণাকে গ্রহণযোগ্য মনে হলে তিনি তা মেনে নিতেন। ‘Shatranj ke Khilari’-র অনুষঙ্গে শাবানা আজমি জানান—

With Sanjeev Kumar, I found he was very particular and told him exactly what he wanted. With Saeed and me, he left it to us and gave us the independence to do the scenes the way we liked.২

এই দুই মেরুর মধ্যে দাঁড়িয়ে ১৯৬৬ সালে করা সত্যজিতের একটি উক্তির দিকে তাকালে হয়তো তাঁর অবস্থানটা কিছুটা পরিস্ফুট হবে—

I do not think it is important to discuss a part thoroughly with an actor, but if he so whishes, I have no fetish against obliging him. Sometimes, with a minimum of guidance, an actor provides me with exactly what I want. Sometimes I have to try and impose a precise manner, using the actor almost as a puppet.৩

এই সূত্র থেকেই বুঝতে হবে সত্যজিতের ছবির অভিনয়ের গুরুত্বের দিকগুলো। সত্যজিতের প্রথমদিকের অধিকাংশ ছবিতেই আমরা দেখতে পাই অপেশাদার, আনকোরা নতুন অভিনেতারা প্রাধান্য পেয়েছেন। তাঁর ছবিতে আত্মপ্রকাশ করে প্রসিদ্ধ হয়েছেন এমন অভিনেতার সংখ্যাও কম নয়। পরবর্তীকালে তাঁদেরই বারংবার নিয়োগ করায় সত্যজিতের ছবিতে যে টেমপ্লেট তা অক্ষুন্ন থেকেছে। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, দীপঙ্কর দে, ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ উদাহরণ। এর সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে বেশ কিছু পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতাদেরও আমরা একাধিক সত্যজিতের ছবিতে দেখতে পাই। যেহেতু তাঁর ছবি অধিকাংশেই সমষ্টির গল্প না হয়ে মূলত ব্যক্তির আখ্যান, অতএব মুখ্য চরিত্রে তিনি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করতেন তাঁর প্রিয় অভিনেতাদের। এবং ক্যামিয়ো চরিত্রে পার্শ্ব অভিনেতাদের। বার্গম্যানের মতো কিংবা সিনেমার ইতিহাসে অন্যন্য অনেক নামকরা পরিচালকের মতোই সত্যজিতের নিজস্ব টিমেই বিশ্বাসী ছিলেন। সেই টিমে অভিনেতারা ছাড়াও ছিলেন অন্যকলাকুশলীরাও। তা সত্ত্বেও মাথায় রাখতে হবে যে, চরিত্রানুগ চরিত্রায়ণের উদ্দেশ্যে সত্যজিৎ কখনও সমঝোতা করেননি। যখনই মনে হয়েছে যে তাঁর ‘টিম’-এর অভিনেতাদের দিয়ে কোনও বিশেষ চরিত্র ফুটে উঠবেনা, তখনই বেছে নিয়েছেন আনকোরা নতুন কোনও অভিনেতাকে কিংবা টিমের বাইরের কোনও পেশাদার অভিনেতাকে। সেই কারণেই তাঁর সর্বাধিক প্রিয় অভিনেতা হয়েও সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এ গুপীর চরিত্র চেয়েও পাননি— নবাগত তপেন সুযোগ পেয়েছিলেন, অথবা ‘আগুন্তুক’-এ বিশেষ ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মুখ্য চরিত্র সৌমিত্রের বদলে পান উৎপল দত্ত।

পেশাদার এবং অপেশাদার অভিনেতাদের একসঙ্গে নিয়ে সত্যজিৎ কীভাবে তবে একটা সুষম অভিনয়ের ধারা পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম ছিলেন? সত্যজিতের ছবিতে অভিনয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য এই, যেখানে সংলাপ থাকে, সেখানে তা প্রায়শই কোনও একটা ব্যবহারিক কাজ করার সঙ্গে ওতপ্রোতোভাবে যুক্ত হয়। অর্থাৎ, ক্যামেরার দিকে সোজাসুজি বা ত্যারচা তাকিয়ে সংলাপ আওড়ে কোনওরকমে একটা শটকে উতরে দেওয়ার যে অভিনয়ের ধারা ’৫০ বা তার আগে থেকে বাংলা চলচ্চিত্রে প্রবলভাবেই ছিলো, সত্যজিৎ সেই দর্শনকেই আমূলে পাল্টে ফেললেন। উত্তমকুমার কিংবা ছবি বিশ্বাসের মতো শক্তিশালী, পেশাদার অভিনেতাদের অভিনয় ও সত্যজিতের ছবিতে অতএব বদলে গেলো অনেকটাই। ‘নায়ক’-এ আমরা তাই এক অন্য উত্তম কুমারকে পেলাম, যেখানে চরিত্র সিনেমার নায়ক হলেও অধিকাংশ সময় তার অবধারিত চার্মকেই পুঁজি করতে চাওয়া হয়নি। বরঞ্চ চরিত্রকে পূর্ণতা দেওয়ার প্রয়াস আমরা দেখি জুতো পরতে পরতে, কিংবা খাবার খেতে খেতে উত্তমকুমারের সংলাপ। আর সেই কারণেই কামু মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী মলির চরিত্রাভিনেত্রী সুস্মিতা মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়ে কিংবা প্রভাবশালী আধিকারিক হরেন বোসের চরিত্রে রণজিৎ সেনের মতো অপেশাদার অভিনেতাদের অভিনয়ও কোথাও যেন উত্তমের অরিন্দম-অভিনয়ের সঙ্গে একসূত্রে গ্রন্থিত হয়ে যায়।

এই ব্যবহারিক অভিনয়কে সার্থক করতে অবশ্যম্ভাবীভাবে ক্যামেরাকে বড়োজোর মিডশট-এ ধরতে হয় অভিনেতাদের। পূর্বে উল্লেখিত সত্যজিতের নির্বিবাদী ক্যামেরা মানসের সঙ্গে অভিনয়কে শুধুমাত্র সংলাপ বলার প্রক্রিয়ায় আটকে না রেখে তার ব্যবহারিক নান্দনিক দিকটিকে ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্রতিষ্ঠা করার জন্যই কি তবে সত্যজিতের ছবিতে এত কম ক্লোজ-আপ? এবং, এই স্বাভাবিক ব্যবহারকে অভিনয়ে ফুটিয়ে তোলার প্রয়োজনেই হয়তো অনেক অভিনেতাই নিয়ে আসতে পারেন এমন উপাদান, যা সেই চরিত্রের উপযোগী এবং তা সচরাচর সত্যজিতের অনুমোদন পায়। এই বিষয়টিকে আরও বিশ্লেষণ করলে এটা হয়তো বলাই যায়, যে সব চরিত্রে সত্যজিৎ অভিনেতাকে নিজের, ইচ্ছে মতন করার বিষয়ে কম উদার, সেই চরিত্রগুলো অবধারিতভাবে তৎকালীন কনটেম্পোরারি, শহুরে মধ্যবিত্ত চরিত্র নয়। তাই ‘অপুর সংসার’-এ অপুর জন্য তখন-যুবক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে, ‘নায়ক’-এ অরিন্দমরূপী ম্যাটিনি আইডল উত্তমকুমারকে, ‘প্রতিদ্বন্দী’র সিদ্ধার্থরূপী তরুণ ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়কে কিংবা ‘সীমাবদ্ধ’র শ্যামলেন্দুরূপী কর্পোরেট চাকুরিজীবী বরুণ চন্দকে সত্যজিৎ যতটা স্বাধীনতা দিয়েছিলেন, স্বভাবতই সেটা তিনি দিতে পারেননি ‘Shatranj ke Khilari’-তে সঞ্জীবকুমারকে, কিংবা ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-তে আদিবাসী চরিত্রে সিমি গারেয়ালকে।

সত্যজিতের এই অভিনয়ের অভিনয় ধারাকে পুষ্ট করে মূলত দুটি বিষয়— ছবির কাহিনীর চমকহীনতা, যা কোনও একক অভিনয় মুহূর্তকে আলাদা করে বিশেষিত করতে পারেন এবং দুই, ‘অভিনয়’-এর পরিবর্তে ‘বিহেভ’ করার এই ব্যবহারিক পদ্ধতিকে সফল করতে অধিকাংশক্ষেত্রেই বাস্তবানুগ মেক-আপ এবং সেট ডিজাইন। এমনকি ‘নায়ক’-এও মেকআপহীন তা নিঃসন্দেহে উত্তমকুমারকে সাহায্য করেছিলো চরিত্রের গভীরে ঢুকতে, অভিনয় করাটা আর ব্যাহিক ক্রিয়া থাকে না তখন। এই নিরাভরণ অভিগমন সন্দেহাতীতভাবে অন্তর্মুখী আর সেখানেই লুকিয়ে আছে সত্যজিতের ছবির বিভিন্ন অভিনেতার অভিনয়ের সামগ্রিক সাম্যের রহস্য।

সত্যজিৎ-চলচ্চিত্র বিশ্বে শিশুদের অভিনয়ও খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আলাদা করে দেখার দাবি রাখে। বাংলা তথা ভারতীয় ছবিতেই সাধারণভাবে শিশু-অভিনয় অত্যন্ত দুর্বল, সাদামাটা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যথেষ্ট ন্যাকা। এখানেও সত্যজিতের তুরুপের তাস অভিনয় না করে নিজের আচরণ অনুযায়ী অভিব্যক্তি প্রকাশ করা। এর সঙ্গে অবধারিত যুক্ত হয় শিশুদের নিয়ে অভিনয় করানোর সময় সত্যজিতের ঈষার্ণীয় ধৈর্য, তাদের মতো করে, তাদের ভাষার কথোপকথন করতে পারা। তাঁর ছবির সমস্ত শিশুশিল্পীই বারংবার জানিয়েছেন, কীভাবে তাঁরা অত্যন্ত নির্ভার আন্দন্দে ‘অভিনয়’ করতে পেরেছেন। শিশুদের মুখে লম্বা চওড়া সংলাপ বসিয়ে কিংবা অহেতুক মোলোড্রামা দিয়ে বাজিমাত করতে চাননি পরিচালক। এই যে এক নবাগত, নবীন শিল্পীকে তাঁর মর্যাদা প্রদান করা, সম্ভবত সেই আনন্দের উদ্ভাসেই সে খুলে ফেলতে পারে বদ্ধ জানালা, উচ্চ কিতনা হয়েও সিদ্ধ করে এক বাস্তবধর্মী, সরল অভিনয় রীতি। প্রাপ্তবয়স্ক, নবাগত অভিনেতাকেও এই ‘স্পেস’ দেওয়াটা সত্যজিৎ যেভাবে বুঝতেন, তাতে তাঁর অভিনেতাদের আর কোনও দুশ্চিন্তাই থাকতো না। তাঁরা গভীর বিশ্বাসে নির্ভর করতেন পরিচালকের উপর। পরিচালক-অভিনেতার সহজ, তরল, বিশ্বস্ত সম্পর্কের বিন্যাস খুব সঠিকাভবেই সত্যজিতের ছবিতে বিদ্যমান। এখানেই তাঁর মূল পার্থক্য ঋত্বিক ঘটক এবং মৃণাল সেনের সঙ্গে। প্রথমজন অভিনেতার সামান্যতম বিচ্যুতিতে ক্ষমাহীন, দ্বিতীয়জন অভিনেতার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ হলেও স্ক্রিপ্টের বিষয়ে অনেকসময়েই উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে অচিন্তিত।

১৯৬৮ সালে ১৫তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে প্রথমবার শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের জন্য পুরস্কার প্রদানের রীতি চালু করা হয়। নাম ছিলো ‘ভরতপুরস্কার’ (শ্রেষ্ঠঅভিনেতা) এবং ‘উর্বশীপুরস্কার’ (শ্রেষ্ঠঅভিনেত্রী)। প্রথম প্রাপক উত্তমকুমার এই পুরস্কার যৌথভাবে পান ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ এবং ‘চিড়িয়াখানা’ – এই দুটি ছবির জন্য। ১৯৬৮ থেকে ১৯৯২ অব্দি সত্যজিতের চলচ্চিত্রে ভিক্টর ব্যানার্জী একবার শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব চরিত্রের জন্য পুরস্কার পান ‘ঘরেবাইরে’ ছবিতে (১৯৮৪ সালে ৩২তম জাতীয় পুরস্কারে) এবং সত্যজিতের প্রয়াণের পর ১৯৯২-এ ‘আগন্তুক’-এর জন্য মমতা শঙ্কর পান ‘স্পেশাল জুরি অ্যাওয়ার্ড’। একথা যদি ধরেও নিই যে, সত্যজিতের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ ছবি এবং তার ভিতরের উল্লেখযোগ্য অভিনয় ১৯৬৮-র পূর্বেকার যখন শ্রেষ্ঠ অভিনয়ের পুরস্কারটাই বহাল ছিলো না, তা সত্ত্বেও কলকাতা চিত্রত্রয়ীর তিননায়ক, ফেলুদা, ‘অশনিসংকেত’-এর গঙ্গাচরণ প্রমুখ চরিত্রের কেউই জাতীয় পুরস্কারের যোগ্য হলেন না কেন— এ প্রশ্ন জাগে। অর্থাৎ, এই যে উন্নত অভিনয় শৈলীর জয়গান করছি আমরা এতক্ষণ, কেন তবে স্বীকৃত হলো না? এর কারণ হয়তো এই যে সত্যজিৎ বাংলা তথা ভারতীয় ছবিতে স্বাভাবিক, অনুচ্চকিত অভিনয়ের যে ধারা চালু করলেন তা এতটাই বাস্তবানুগ যে অভিনয় বলে প্রায়শই চোখে পড়ে না। একটা উন্নত অর্কেস্ট্রার মতো যেন, যেখানে আলাদা করে কেউ কানে না বেজেও তাদের সংকলিত সমন্বয় এক সুর মুর্চ্ছনা তৈরি করতে সক্ষম হয়। পাশ্চাত্যের এই দলগত সংগীতের বিপ্রতীপে ভারতীয় ঘরানায় একক বাদ্যযন্ত্র এবং বাদ্যযন্ত্রী সাধারণত প্রাধান্য পেয়ে এসেছেন। অতএব, আমাদের মানসিকতায় সমষ্টির তুলনায় এককের বিচ্ছুরণ যে মান্যতা পাবে, সেটা অনস্বীকার্য। হয়তো সেই যুক্তিতেই সত্যজিতের অভিনেতারা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে চিরকাল ব্রাত্যই থেকে গেলেন, যদিও সত্যজিতের ছবি, বিভিন্ন আঙ্গিক মেলালে, ভারতীয় চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে সর্বাধিক পুরস্কৃত।

জাতীয় পুরস্কার না পেলেও সত্যজিতের ছবির সামগ্রিক অভিনয় সুষমা আপামার চলচ্চিত্রপ্রেমীকে আজীবন মুগ্ধ রেখেছে— তার সরল, সুন্দর, আড়ম্বরহীন উপস্থাপনায়, তার তারকা না হয়ে ‘মানুষ’ হয়ে থেকে যাওয়ার নিরন্তর তাগিদে।

তথ্যসূত্র :

১. Satyajit Ray Interview with Sasthi Brata, 20 August 1978, Reprint IFSON special Ray Number (August 1992) p. 35
২. Shabana Azmi Interview with Deepa Gaholt, Screen, 20 March, 1992, p. 26
৩. Satyajit Ray, “Some aspects of my craft’, “Our films their films,” Orinet Longman Private Limited, 2006, p. 66
[পুনর্মুদ্রণ]

লেখক পরিচিতি - চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখক

*******************************


‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ : একটি পপুলার ফিকশন ও বাংলা গোয়েন্দা সিনেমা

প্রীতিলতা কয়াল


প্রাককথন

‘শয়তান সিং!’...

…‘আর লুকিয়ে কোনও লাভ নেই। আমি জানি তুমি কোথায় আছো!’— আবার চিৎকার করে উঠলো ছেলেটি।...

…এবার লালমোহন বাবুর খসখসে চাপা গলা শোনা গেলো। শয়তান সিং হচ্ছে অত্রুর নন্দীর লেখা পাঁচখানা বইয়ের ভিলেন মশাই— রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজ।’...

‘আমি আসছি তোমার কাছে!’— আবার চিৎকার এল— ‘তুমি আত্মসমর্পণের জন্য প্রস্তুত হও।’...

ছেলেটি হঠাৎ পাঁচিল থেকে নেমে উধাও। ভাবছি এবার কী নাটক দেখবো কে জানে, এমন সময় হঠাৎ দেখি একটা বাঁশ হলদে বাড়ির পাঁচিলের উপর দিয়ে বেরিয়ে সামনের লালবাড়ির ছাতের দিকে এগিয়ে গিয়ে দুই বাড়ির মাঝখানে একটা ব্রিজ তৈরি করলো।... এবার যেটা ঘটলো তাতে আমাদের সকলেরই ঘাম ছুটে গেলো। ছেলেটি পাঁচিল থেকে নেমে খপ করে বাঁশটা ধরে শূন্যে ঝুলে পড়লো।...

‘এক...দুই...তিন...চার...’

উল্টো দিকের ছাত থেকে শয়তান সিং গুনতে শুরু করেছে, আর এ ছেলে বাঁশ ধরে ঝুলতে ঝুলতে এগোচ্ছে।

‘ছয়…সাত…আট…ন—য়!’

নয় গোনার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি উল্টোদিকে পৌঁছে গিয়ে কার্নিশে পা ফেলেই বাঁশেরই উপর ভর করে পাঁচিল টপকে লাল বাড়ির ছাতে নেমে গেলো। তারপর শোনা গেলো একটা অচেনা গলায় এক বিকট চিৎকার, আর সেইসঙ্গে প্রথম ছেলেটির এক অদ্ভুত হাসি।”১

সত্যজিৎ রায়ের (১৯২১-১৯৯২) “জয় বাবা ফেলুনাথ’ গল্পের একটা শিশু চরিত্র রুক্মিণী কুমার ওরফে রুকু ‘বর্ন অ্যাক্টর’-এর মতো এভাবেই খেলে বন্ধু সূরযের সঙ্গে। শিশু মনে পপুলার ফিকশনের এত প্রভাব দেখে লালমোহনবাবু বলে ওঠেন, ‘সর্বনাশ... এ যে অক্রুর নন্দীর বই মুখস্থ করে ফেলেছে মশাই!’

সত্যিই, শিশু মনে এ প্রভাব কতটা সুদূর প্রসারী, তা আমরা বুঝতে পারি যখন দেখি সুকুমার সেনও তাঁর ‘ক্রাইম কাহিনীর কালক্রান্তি’ লিখতে গিয়ে বলছেন—

‘মনের আনন্দে ছিনু দিন পরে দিন
শিশুকাল থেকে ডিটেকটিভ-গল্প পড়ে।
অবশেষে বৃদ্ধকালে হইনু দৃষ্টিহীন,
হাতের মুড়ির ঠোঙা উড়ে গেলো ঝড়ে।
তবুও ঘোচেনি সেই আনন্দের ঘোর,
তাইতো কাটিনু এই স্মৃতির জাবর।।’২



সত্যজিৎ রায় যার মধ্যে দিয়ে এই অদ্ভূত প্রভাবের কথা বলেছেন, তাও আদতে একটা পপুলার ফিকশন। এমনকি তিনি যখন এই গল্পের বইটির প্রচ্ছদ আঁকছেন, সেখানেও দেখছি রুকুর ওপর অত্রুর নন্দীর এই রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের প্রভাবের প্রকাশ। দুই বাড়ির ছাদের মাঝখানে একটা বাঁশ দিয়ে ব্রিজ করা আর সেখান থেকে রুকু ঝুলছে। এখন প্রশ্ন, প্রচ্ছদ নিয়ে অত্যন্ত সচেতন সত্যজিৎ রায় কাহিনীর এই বিশেষ অংশটিকে নিয়েই প্রচ্ছদ অঙ্কন করলেন কেন? সিনেমায় কিন্তু এমন দৃশ্য ছিলো না, অবশ্য শুটিং-এর ক্ষেত্রে তা খানিক বিপজ্জনক বটে। কিন্তু আমরা এটুকু বুঝি, শিশু মনে পপুলার ফিকশনের প্রভাব সত্যজিৎ খুব সচেতনভাবেই বুঝতেন। এখন একটা গল্প তার পাঠককে যতটা প্রভাবিত করে, সিনেমা কি তার দর্শককে তার থেকে বেশিও প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত করে না? সত্যজিৎ এই প্রভাব নিয়েও সচেতন ছিলেন বৈকি! গল্পের ক্ষেত্রে আমরা দেখছি, সূরযলাল মেঘরাজ গল্পের শেষে সত্যি শয়তান সিং হিসেবে চিত্রিত হচ্ছে। অর্থাৎ, রুকুরই সমবয়সী একটা ছেলে, সে কিনা ভিলেন! সিনেমায় তা দেখানো কতটা স্বাস্থ্যকর হবে বা শিশুমনে তার প্রভাবই বা কেমন পড়বে এইসব সাতপাঁচ ভাবনাতেই কি সত্যজিৎ সিনেমা থেকে সূরযলাল চরিত্রটাকেই বাদ দিয়েছিলেন?

কাহিনী সত্যজিতের, চিত্রনাট্য সত্যজিতের, সিনেমা পরিচালনাও সত্যজিতের। একজন ব্যক্তিই নিজের লেখাকে সম্পূর্ণ ভেঙেচুড়ে, ভোল পাল্টে সিনেমার রূপ দিলেন, একটা স্বতন্ত্র পপুলার ডিটেকটিভ ফিকশন থেকে তৈরি করলেন স্বতন্ত্র বাংলা গোয়েন্দা সিনেমা।



বই বনাম ‘বই’

খুব অদ্ভূতভাবে বাঙালি বরাবরই সিনেমাকে ‘বই’ বলে। সত্যজিৎ রায় নিজেই বলছেন, ‘ফিল্মের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘বই’ কথাটা বাঙালিদের মধ্যে যে কী করে চালু হলো এটা আমার কাছে একটা রহস্য। ‘বই’-এর বদলে ছবি’ বলতে আপত্তি কী?’৩ যাইহোক, বাঙালি সেইসঙ্গে এও বলে যে ভালো বই লেখা হচ্ছে না বলেই নাকি ভালো সিনেমাও হচ্ছে না। ভালো বই লেখা হচ্ছে না বলে ভালো ছবি আঁকা হচ্ছে না বা ভালো গান লেখা হচ্ছে না, এই আক্ষেপ কিন্তু বাঙালির নেই। সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা এক-একটা স্বতন্ত্র শিল্প মাধ্যম। বয়সে অর্বাচীন সিনেমার কপালে সেই আর্ট-ফর্মের তকমাটি যেই জুড়ে দেওয়া হলো, তখনই কত কথা, কত বিতর্ক! এ বিতর্ক অনেকদিন ধরেই চলে আসছে। এবং প্রচলিত বদ্ধমূল ধারণা, সিনেমা অনেক বেশি সাহিত্য নির্ভর বা সাহিত্য কিছু দান না করলে সিনেমার ঝুলিতে আর বিশেষ কিছুই
অবশিষ্ট থাকবে না। বিশ্বের প্রথম যে ছবি লোক ডেকে দেখানো হয় তার বিষয়বস্তু একটা ট্রেন এসে প্লাটফর্মে দাঁড়াচ্ছে। তার কিছু পরেই ছবিতে গল্প বলা শুরু হয়। আর এই গল্প বলা থেকেই সিনেমার ভাষা একটা বিশেষ চেহারা নিতে শুরু করে। কিন্তু আদিকাল থেকেই বাংলাছবির একটা সাহিত্য-নির্ভরতা ছিলোই। আজকের তুলনায় অনেক বেশি প্রকাশিত উপন্যাস বা ছোটো গল্পকে কেন্দ্র করেই বাংলা ছবি তৈরি হতো। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যে সমস্যাটা দেখা যেত তা হলো, উপন্যাসকে চলচ্চিত্রায়িত করতে গিয়ে সিনেমা তার নিজের ভাষাটাই হারিয়ে ফেলতো। ফলে সিনেমাগুলো ক্যামেরায় তোলা উপন্যাস হয়ে যেত। সাহিত্যের ভাষা আর সিনেমার ভাষা যে আলাদা তা আর মাথায় থাকতো না। সাহিত্য বলতে আমাদের সাহিত্যভাব বুঝতে হবে যা কিনা একটা আইডেন্টিফিকেশন, যেটা ছাড়া চলচ্চিত্র বানানো আদতে অর্থহীন। সাহিত্যের সঙ্গে সিনেমার এই যে এতদিনের একটা সম্পর্কের ধারণা, তাতে একটা মস্তবড় ওলোটপালট ঘটে গেলো যখন বিংশ শতাব্দীর পাঁচের দশকে এসে আমরা সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ পেলাম। একে আমরা ঠিক ‘চলচ্চিত্রায়িত উপন্যাস’ বলে চেনাতে পারলাম না।৪ লন্ডনে বাই-সাইকেল থিভস দেখার পর নিওরিয়েলিজমের নিয়মকায়দায় ‘পথেরপাঁচালী’ তৈরি করেছিলেন তিনি। সত্যজিৎ রায় নিজেই বলছেন—

“ভালো ছবি কাকে বলে? ভালো গল্প মানেই কি ভালো ছবি? অনেককেই এমন কথা বলতে শুনেছি।... আসলে কাহিনীমাত্রেরই দুইদিক আছে— এক হলো তার বক্তব্য, আর এক হলো তার ভাষা। এই দুয়ে মিলে তার গল্প। গল্পের আর্ট এই বলার ভঙ্গিতে। ভালো গল্প বলার দোষে নষ্ট হয়ে যায়, সামান্য কাহিনী বলার গুণে শিল্পমণ্ডিত হয়ে ওঠে। চলচ্চিত্র শিল্পও তার ভাষায়, তার বিন্যাস কৌশলে। যেখানে ভাষা দুর্বল, সেখানে গল্প ভালো হলেও ছবি শিল্প সাফল্য লাভ করতে অক্ষম। চলচ্চিত্রের এই ভাষা ছবির ভাষা। পরিচালককে এই ভাষা জানতে হবে, এর ব্যাকরণ তাঁকে আয়ত্ত করতে হবে।”৫

সত্যজিৎ রায় পরিচালক হিসেবে সেই ভাষাও ব্যাকরণ দুইই আয়ত্ত করেছিলেন। ফলে একটা কাহিনীর চরিত্র সিনেমায় গিয়ে কেমন রূপ নেবে তার বিচার তিনি খুব সচেতনভাবেই করেছিলেন। এমনকি সেটা নিজের কাহিনীর ক্ষেত্রেও। তাঁর মধ্যে এই সাহিত্যিক সত্ত্বা অর্থাৎ বই-লিখিয়েও পরিচালক সত্ত্বা অর্থাৎ ‘বই’-করিয়ে দুইই খুব স্পষ্ট এবং স্বতন্ত্র।

“The Bengali middle classes may respectthe film-maker Satyajit Ray but they lovethe popular-fiction writer Ray...In response to the respect and the love, Ray partitioned his self into two neatcompartments.”৬


সাহিত্য-চিত্রনাট্য-সিনেমা

সত্যজিৎ রায় মনে করতেন কোনও গল্প বা উপন্যাসে এমন কিছু উপাদান থাকে যার একটা নির্দিষ্ট ‘অ্যাপিল’ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে মূল উপাদান এক থাকলেও চিত্রনাট্য মূল রচনার সমালোচনা হয়ে উঠতেই পারে। ফলে চিত্রনাট্যে থিমের কিছুটা অদলবদল ঘটা অস্বাভাবিক নয়। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ তাঁর নিজের লেখা কাহিনি। ১৯৭৫-এ ‘দেশ’ পুজো সংখ্যায় বেরোয়। ১৯৭৬-এ পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। লেখা থেকে ছবি হওয়ার পথে চিত্রনাট্যের প্রথম খসড়াটি তিনি শুরু করেন ২১শে জানুয়ারি ১৯৭৮। এবং ১৯৭৯-তে চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়। ফেলুদা চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (১৯৩৫-বর্তমান), তোপসে চরিত্রে সিদ্ধার্থ চ্যাটার্জি, জটায়ু চরিত্রে সন্তোষ দত্ত (১৯২৫-১৯৮৮), মগনলালের চরিত্রে উৎপল দত্ত (১৯২৯-১৯৯৩) অভিনয় করেন। এই কাহিনিকে যখন তিনি সিনেমায় নিলেন, নিজেই কেটে ছেঁটে বাদ দিলেন কতকিছু। আপাদমস্তক বদলে দিয়ে লিখলেন চিত্রনাট্য। তিনি মনে করতেন নির্বাক যুগের তুলনায় সবাকযুগের চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রননাট্য অনেক বেশি অপরিহার্য। চিত্রনাট্য সম্পর্কে তিনি বলছেন—

“চিত্রনাট্যে সাধারণতঃ নিম্নলিখিত উপাদানগুলি থাকে— ১. নির্বাচিত কাহিনিকে কীভাবে অঙ্কেও দৃশ্যে ভাগ করা হইবে তাহার ইঙ্গিত। ২. দৃশ্যগুলি কীভাবে বিভিন্ন দূরত্বে অবস্থিত ক্যামেরার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ হইতে গৃহীত হইবে তাহার ইঙ্গিত। ৩. দৃশ্যপটের বর্ণনা। ৪. পাত্র-পাত্রীর ক্রিয়াকলাপের বর্ণনা। ৫. পাত্র-পাত্রীরসংলাপ। ৬. নেপথ্যে ব্যবহার্য বিশেষ বিশেষ ধ্বনি ও সঙ্গীতের ইঙ্গিত। ৭. দৃশ্য দৃশ্যান্তরে যাইবার বিশেষ প্রণালীর ইঙ্গিত।

চিত্রনাট্যের সহিত নাটকের আপাতসাদৃশ্য লক্ষণীয়। মূল প্রভেদ এই যে নাটকের রস বহুলাংশে ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব। কারণ তারা প্রধানত সংলাপেই পরিস্ফুট। কিন্তু চলচ্চিত্রের রস মূলত তাহার চিত্রভাষায় নিহিত। সঙ্গীতের মতোই চলচ্চিত্রের রস অন্য কোনও ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়।

কাহিনি বিন্যাস, চরিত্র উদ্ভাবন ও সংলাপ রচনা এই তিনেরই প্রয়োজন হেতু চিত্রনাট্য রচনার দায়িত্ব অনেক সময়েই সাহিত্যিক বা নাট্যকারের উপর ন্যস্ত হয়। কিন্তু চলচ্চিত্রের প্রকৃত উৎকর্ষ নির্ভর করে তাহারই উপর যিনি এই সাহিত্য ভাষাকে চিত্রভাষায় অনূদিত করেন— অর্থাৎ চিত্র পরিচালক।”৭

এখন সাহিত্যিক সত্যজিতের সাহিত্য ভাষাকে চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ চিত্র ভাষায় অনূদিত করতে গিয়ে বড়োসড় বেশ কয়েকটা পরিবর্তন এনেছেন। আসলে আমাদের বুঝতে হবে, পাঠকের সঙ্গে সাহিত্যের যে সংযোগ, সিনেমার সঙ্গে দর্শকের সেই সংযোগ অনেক বেশি প্রত্যক্ষও সরাসরি। ফলে সেকারণেই এবং শুটিং-এর সুবিধার কথা মাথায় রেখেই এই বিপুল পরিবর্তনগুলো এসেছিলো। আমরা তার কয়েকটা উদাহরণ দেখে নেব—

এক. গল্প শুরু হচ্ছে কলকাতায় ফেলু মিত্তিরের বাড়িতে যেখানে জটায়ু বারাণসীতে মছলি-বাবার আবির্ভাবের খবর পেয়ে। ফেলুদাকে কাশী যাওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে প্রলুব্ধ করছেন। কিন্তু সিনেমা শুরু
হচ্ছে একদম ঘটনার অকুস্থলে, খোদ কাশীতেই। উমানাথ ঘোষালের বাড়িতে শশীবাবু ঠাকুর তৈরি করছেন আর রুকু তাঁকে হাজারো প্রশ্ন করছে। গল্পে ফেলুদা, তোপসে আর জটায়ু কাশীতে পৌঁছে ক্যালকাটা লজে উঠলে হোটেলের ম্যানেজার নিরঞ্জনবাবু বলেন যে ঐ হোটেলের ঐ ঘরেই গত মার্চ মাসে বিশ্বশ্রী গুণময় বাগচী থেকে গেছেন। কিন্তু সিনেমায় আমরা বিশ্বশ্রীকে ফেলুদাদের সঙ্গেই থাকতে দেখি। সত্যজিৎ রায় আসলে এই সাহিত্যে বাঙালিয়ানাকে খুব সুন্দরভাবে ধরতে চেয়েছেন। স্থান হিসেবে কাশীকে বেছে নেওয়া হচ্ছে যেখানে দেড় লাখ বাঙালির বাস। সত্যজিৎ রায় নিজেই বলছেন—


“কাশীতে সবসময়ই এত বাংলা কথা শোনা যায়, রাস্তার দেয়ালে আর দোকানের গায়ে এত বাংলা হরফ দেখা যায়, যে এক এক সময় মনে হয় বুঝি বাংলাদেশের কোনও শহরে এসে পড়েছি।”৮

ওরা কাশীতে গিয়ে একটা পুরনো বাঙালি হোটেলে গিয়ে উঠছে। কাশীতে বাঙালির দুর্গোৎসব চিত্রিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে চিত্রিত হচ্ছে বাঙালির শরীরচর্চা। এবং সিনেমায় তা আরও অনেক বেশি করে চিত্রিত হচ্ছে। উনিশ-বিশ শতক জুড়ে বাঙালির শরীরচর্চার একটা উজ্জ্বল ইতিহাস ছিলোই। ১৯১০ সালে চারজন মল্লবীরের দল লন্ডনে বিশ্বজয় করতে গিয়েছিলেন, তাদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন একজন বাঙালি— শরৎকুমার মিত্র। আসলে বাঙালি সেদিন চেয়েছিলো ব্রিটিশরাজের ওপর অন্তত একটা ব্যাপারে বাঙালি আধিপত্য কায়েম করুক। বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন—

“যে জাতির উদ্যম, ঐক্য এবং অধ্যবসায় আছে, তাহাদের শারীরিক বল যেমন হউক কেন, তাহাদের বাহুবল আছে। এই চারিটি বাঙ্গালীর কোনওকালে নাই, এজন্য বাঙ্গালীর বাহুবল নাই।”৯


কিন্তু বাঙালির বাহুবল ছিলো। এবং এককালে বাঙালিরাও মনে করতো যে, তাঁদের বডি হচ্ছে ওয়ার্ক অফ আর্ট। এটা মন্দির। আর মাশলগুলো তার মধ্যে সব কারুকার্য। শরীরচর্চা করতেন এইরকম বহু বাঙালির নাম আমরা পেয়েছি। গোবর গুহ (১৮৯২-১৯৭২), ভীম ভবানী (১৮৯০-১৯২২), ফণীন্দ্র কৃষ্ণগুপ্ত (১৮৮৩-১৯৫২), মনোতোষ রায় (১৯১৬-২০০৫), মনোহর আইচ (১৯১২-২০১৬) প্রমুখ। এই মনোতোষ রায়ই ছিলেন এশিয়া তথা ভারতের প্রথম বিশ্বশ্রী। তাঁরই ছেলে মলয় রায় ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এ গুণময় বাগচীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। এমনকি বাঙালি মেয়েদের শরীরচর্চাও প্রবাসে বাঙালিদের শরীরচর্চাও ছিলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ সুকুমার রায়ের ‘ষষ্ঠীচরণ’ ও নিছক কাল্পনিক নয় আর বাঙালি শুধুই ভেতো বাঙালি নয়। সে শরীরচর্চা করেও বিশ্বশ্রীর মর্যাদায় উন্নীত হতে পারে। গুণময় বাগচী তেমনই একজন বাঙালি বডি বিল্ডার। সিনেমায় গুণময় বাগচীকে দেখানোর আগেই তাঁর সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। দেওয়ালে একটা গুল ওয়ার্কার ঝুলছে। তাঁর টেবিলে রাখা জিনিসপত্র দেখে লালমোহনবাবু মন্তব্য করছেন, ‘সৌখিন লোক মশাই।’ এই সৌখিনতার ধারণাই আমাদের পরবর্তীতে বাগচীর এই বক্তব্যের যাথার্থ বুঝিয়ে দেয়, ‘আর্ট’। সিনেমার কাহিনি একটা গণেশ মূর্তিকে নিয়ে যেটা কিনা একটা ‘ওয়ার্ক অফ আর্ট’। আবার গুণময় বাগচীর শরীরও একটা ‘ওয়ার্ক অফ আর্ট। এই দুই ‘ওয়ার্ক অফ আর্ট’-কেই কী অদ্ভূতভাবে মিলিয়ে দিলেন সত্যজিৎ। বেঙ্গলি ক্লাবে শরীরচর্চার প্রদর্শনীর আগেই গুণময় বাগচী চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলে ফেলুদা যখন বলেন, ‘বিশ্বনাথের মন্দির তো সবাই দেখে কাশীতে, বিশ্বশ্রীর মন্দির আরক’জন দেখেন বলুন!’ তখন আমরা বুঝি যে বাঙালির এই শরীরচর্চাকে কতটা গুরুত্ব দিতেন সত্যজিৎ।

দুই. এবার আসি মছলি বাবার প্রসঙ্গে। গল্পে হোটেলের ম্যানেজার নিরঞ্জনবাবু মছলিবাবার নাম দিয়েছিলেন আবলুস বাবা। তোপসে পরে মছলি বাবার গায়ের এমন মিশকালো রং দেখে নিরঞ্জনবাবুর নামকরণ দক্ষতাকে সাধুবাদই দিয়েছিলো। কিন্তু সিনেমায় এই প্রসঙ্গ নেই, মছলিবাবার গায়ের রং কালো-ও নয়। বরং মছলি বাবার হাতে একটা উলকি রয়েছে। গল্পের মতো সিনেমাতেও মছলি বাবা ‘একব্ৰহ্ম, একসূর্য, একচন্দ্র’ বলে চিৎকার করছিলেন কিন্তু এখানে একটি লক্ষ্য করার মতো বিষয় হলো দশ অবতার বলার সময়, তিনি প্রথম অবতার মৎস্য না বলে শেষ অবতার মৎস্য বলে, নিজেকেই চিহ্নিত করলেন (এই প্রসঙ্গ আমরা চিত্রনাট্যতেও পাইনি)। যে কিনা নিজেকে একটা অবতার হিসেবে চিহ্নিত করছে, সেই শেষে গিয়ে ক্রিমিনালদের মধ্যে একজন হিসেবে চিত্রিত হচ্ছে। অর্থাৎ এক তো ধর্মের ভন্ডামি আর দুই হলো সেই ভন্ডামিকে ঘিরে ‘ক্রীম অফ কাশী’ বা সমাজের উচ্চবর্গীয় এলিট মানুষদের ঘোরাফেরা— এইসবই গল্পের থেকে খুব স্পষ্ট করে সিনেমায় ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন সত্যজিৎ রায়। তিনি এই বিষয়টি বরাবরই সচেতন ছিলেন। একলহমায় অবতার থেকে ক্রিমিনাল বানিয়ে দিতে তিনি এতটুকু দ্বিধা করেননি। ‘মহাপুরুষ’ সিনেমাতেও আমরা তা দেখেছি

তিন. গল্পে ঘুড়ির সাহায্যে রুকু তার বন্ধুকে মেসেজ পাঠালে ফেলুদা জটায়ুকে বলে, ‘শিশুমনের উপর
আপনাদের বইয়ের কী প্রভাবতার স্পষ্ট নিদর্শন এটা।’১০ আসলে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর গোটা কাহিনিটাই তৈরি হচ্ছে একটা শিশুমনে বিভিন্ন রহস্য-রোমাঞ্চ সিরিজের প্রভাবকে কেন্দ্র করে। আর তার পিছনে রয়েছে কখনও ক্যাপ্টেন স্পার্ক, কখনও শয়তান সিং, কখনও ডাকু গণ্ডারিয়া আবার কখনও কঙ্গোর গঙ্গোরিলা। কখনও ঘুড়ির সাহায্যে মেসেজ পাঠানো আবার কখনও সিংহের হাঁ-করা মুখের মধ্যে গণেশ মূর্তি লুকিয়ে রাখা। পুরো ব্যাপারটাই রুকু আয়ত্ত করেছে রহস্য—রোমাঞ্চ সিরিজ পড়ে। ফেলু মিত্তিরকেও তাই শেষ পর্যন্ত বলতে হয়, ‘আফসোস হচ্ছে!... এতটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা উচিত ছিলো না আপনাদের সিরিজটাকে।’১১ এই সিরিজের এই প্রভাব ছাড়া কাহিনিটাই দাঁড়াতো না।

চার. সিনেমার ক্ষেত্রে গল্পের সূরযলাল মেঘরাজ যে কিনা রুকুর একমাত্র বন্ধু, মগনলাল মেঘরাজের ছেলে এবং কাহিনির অন্যতম ভিলেন, সেই চরিত্রটাকেই বাদ দেওয়ায় এই চিত্রনাট্যে বেশখানিকটা পরিবর্তন ঘটে যায়। গল্পে সিংহের হাঁ-করা মুখের ভেতর খুদে-নায়ক’ রুকুর গণেশ-মূর্তি লুকিয়ে রাখার খবর সূরযই মগনলালকে দিয়েছিলো, তারপর মগনলাল তার বিরাট চক্রান্তটি খাড়া করেছিলো। সে রাত-দিন নদীতে ঘোষাল বাড়ির ঠাকুর বিসর্জন হওয়ার সময়, নদীতে যে ধুন্ধুমার কাণ্ডটি ঘটেছিলো সেখানেও সূরযের একটা বড়ো ভূমিকা ছিলো। তাই গল্পের শেষে মছলিবাবার ছদ্মবেশে ফেলুদা সূর্যকে বগলদাবা করে তুলে নিয়ে এসে পুলিশের হাতে দিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু সিনেমায় মূল ক্রিমিনাল মগনলাল। এখানে ক্রাইমের দায় ও দায়িত্ব পুরোটাই তার। বিকাশ সিংহকে গল্পে যত বড়ো ক্রিমিনাল হিসেবে দেখানো হয়েছিলো, সিনেমায় আর তা হয়না। তাকে একটা মামুলি চরিত্র হিসেবেই দেখানো হয়, যাকে দেখে দর্শকের মনে দয়ারই উদ্রেক হয়। সে শশীবাবুকে খুনও করে না সিনেমায়। গল্পে তিনি শশীবাবুকে ধাওয়া করেন। যাবার পথে শ্রীধর ভ্যারাইটি স্টোর্স থেকে একটি ছোরা কেনেন। তাই দিয়ে গণেশ মহল্লার অন্ধকার গলিতে শশীবাবুকে নির্মমভাবে হত্যা করেন; তারপর হরিশচন্দ্র ঘাটে গিয়ে রক্তাক্ত ছুরিটা গঙ্গায়...।’১২ কিন্তু সিনেমায় শশীবাবুকে মগনলালের লোকই হত্যা করে। এবং বিকাশবাবু যখন খুন করেনি বলে বারবার বলতে থাকে, ফেলুদা বলে, ‘সেটা না বললেও চলতো। ও জিনিস আপনার দ্বারা হতোনা।’

সবশেষে যেটা দেখি তা হলো, গল্পে পুরো কাহিনিটাই লেখা হয়েছে এই আসল ‘ওয়ার্ক অফ আর্ট বা গণেশের আড়াই ইঞ্চি লম্বা সোনার মূর্তিকে নিয়ে যার মাথায় একটা বনস্পতি হিরে বসানো। কিন্তু সিনেমায় আসল মূর্তিটা ছিলো ব্যাঙ্কে। বরং তার একটা প্রতি মূর্তি নিয়েই ঘটনার এত ঘনঘটা।













পপুলার ডিটেকটিভ ফিকশন ও বাংলা গোয়েন্দা সিনেমা

সাহিত্য থেকে সিনেমা তৈরি সত্যজিৎ রায় অনেকই করেছেন। কিন্তু ‘সোনারকেল্লা (১৯৭৪) ও ‘জয়বাবা ফেলুনাথ’ (১৯৭৯) তাঁর এই দুটো কাজ বাকি সব কাজের থেকে স্বতন্ত্র। কারণ প্রথমত, একমাত্র না হলেও এই দুটোই তাঁর নিজের লেখাকাহিনি। দ্বিতীয়ত, এই দুটোর Genre বাকিগুলোর থেকে আলাদা। সাহিত্য হিসেবে পপুলার ডিটেকটিভ ফিকশন এবং সিনেমা হিসেবে বাংলা গোয়েন্দা সিনেমা। আমাদের প্রথমে এই দুটোর ইতিহাস ও তাত্ত্বিক কাঠামোটা একটু বুঝে নিতে হবে, তবেই আমাদের কাছে পরিষ্কার হবে যে কেন সত্যজিতের বাকি কাজগুলোর থেকে ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর একটা আলাদা ও বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সুকুমার সেন বলেছেন, ‘বিশেষজ্ঞ পণ্ডিতেরা যে ডিটেকটিভ গল্পটিকে সবচেয়ে প্রাচীন মনে করেন তা প্রাচীনতম বৈদিক গল্পের চেয়েও প্রায় হাজার দুই বছরের পুরানো।’ যাইহোক, মোটামুটিভাবে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধেই এই ক্রাইম-কাহিনির জাঁকজমক দেখা যায়। অগাথা ক্রিস্টিদের হাত ধরে ইংল্যান্ডকে কেন্দ্র করে ‘Whodunit structure’ (Classical detective story structure)-এর জন্ম। পূর্ববর্তীকালে, এডগার অ্যালেনপো, আর্থার কোনান ডয়েল— এঁদের সময়ে ডিটেকটিভ স্টোরিরই প্রচলন ছিলো বেশি। অর্থাৎ ফর্মটা ছিলো গল্প, উপন্যাস নয়। ১৯২০-এর দশক থেকেই মূলত এই উপন্যাসের ফর্মে গোয়েন্দাকাহিনি উপস্থাপিত হতে শুরু করলো যখন থেকে রিয়েলিস্ট নভেল’ তার আপাদমস্তক পরিবর্তন ঘটিয়েছিলো। স্লাভজজিজেক বলছেন—

'In the 20's, however, the detective story quickly disappears as a genre and is replaced by the classic form of the ‘logic and deduction' detective novel’.১৩

এবং তারপর—

...The 1920s and 1930s marked the golden age in crime and detective writing for young readers.’১৪

কিন্তু আমেরিকার ক্ষেত্রে গোয়েন্দা কাহিনির লেখকরা ‘Whodunit structure’-এর বদলে নতুন স্ট্রাকচার নিয়ে এলেন। যেহেতু মূলত ‘পাল্পম্যাগাজিন’-এর হাত ধরেই আমেরিকান গোয়েন্দা কাহিনির উত্থান তাই এই কাহিনিগুলো ‘পাল্পফিকশন’ নামেই পরিচিত। সত্যজিৎ রায় এই ‘পাল্পফিকশন’ দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত ছিলেন। তাঁর ফেলুদাকে নিয়ে লেখা গোয়েন্দা-কাহিনিগুলোর প্রচ্ছদেও এই ‘পাল্পফিকশন'-এর প্রচ্ছদের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। বাংলায় প্রথম মৌলিক ডিটেকটিভ গল্প-কাহিনি ধারাবাহিকভাবে লিখেছিলেন পাঁচকড়ি দে। পরবর্তীকালে কোনান ডয়েলের অনুসরণে ব্যোমকেশ চরিত্র সৃষ্টি করেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। পরে আমরা ফেলুদাকে পাই। সুকুমার সেন বলেছিলেন, ‘ডিটেকটিভ-কাহিনি এমন এক তরফা নয়, তা দো-তরফ— যেন দাবা বোড়ে খেলা। ডিটেকটিভ বুদ্ধি খেলাচ্ছে অপরাধীকে মাত করতে, আর অপরাধী বুদ্ধি খাটাচ্ছে ডিটেকটিভের চাল এড়িয়ে চলতে।’১৫ ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর ক্ষেত্রেও আমরা একথা হাড়েহাড়ে টের পাই যখন তোপসে বলে, ‘ফেলুদার জীবনে সবচেয়ে ধুরন্ধর ও সাংঘাতিক প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে তাকে এই বেনারসেই লড়তে হয়েছিলো।’১৬

এবার আসি গোয়েন্দা সিনেমায়।

“The detective genre appeared in the fiction of the mid-nineteenth century as a response to the fear arising from urbanisation, industrialization, and the working class and it continues into the twenty-first century in various form of popular culture in the samevein...It was only with the coming of sound in the late 1920s that the classical detective story could flourish on screen because of the elaborate plots that defined the genre." that defined the genre.”১৭

ক্রাইম-কাহিনির ‘visual pleasure’-এর ভাবনাই গোয়েন্দা সিনেমার জন্ম দিয়েছিলো। পরবর্তীকালে দেশে-বিদেশে বহু গোয়েন্দা সিনেমা হয়েছে। বাংলাতে সত্যজিৎ ‘সোনারকেল্লা’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’ ছাড়াও ব্যোমকেশকে নিয়ে ‘চিড়িয়াখানা’ (১৯৬৭) করেছিলেন। তবে তাঁর আগেও বেশ কিছু গোয়েন্দা সিনেমা হয়েছে। যেমন-- ‘কালোছায়া’ (১৯৪৮), ‘হানাবাড়ি’ (১৯৫২), ‘চুপিচুপিআসে’ (১৯৬০) ইত্যাদি। প্রেমেন্দ্র মিত্র সেক্ষেত্রে একটা উল্লেখযোগ্য নাম। তবে আমরা সে বিস্তারিত ইতিহাসে যাচ্ছি না। কিন্তু আমাদের এই বিষয়টা ভুললে চলবে না—



“...detective film may have much in common with the cycles of the genre that have proceeded them—

Sharing conventions, character types, and narrative structure. Neverthless, the themes they express, the social concerns with they engage, and the narrative and stylistic variations they present are distinctly the product of our specific social moment.”১৮

এই বিষয়টি সত্যজিৎ রায় খুব ভালো করেই অনুধাবন করেছিলেন। আর করেছিলেন বলেই তিনি তাঁর পপুলার ডিটেকটিভ ফিকশন থেকে বাংলা গোয়েন্দা সিনেমায় এই রূপান্তরগুলো ঘটিয়েছিলেন এবং চিত্রায়িত করেছিলেন তাঁর ‘সোশ্যালকনসার্ন’-গুলোকে।



শেষকথন

আইজেন স্টাইন বলেছিলেন, “সর্ব শিল্পের সমন্বয়ে চলচ্চিত্র নিজের ভাষায় কথা বলে, এমনকী চিৎকার করে ওঠে।’ সত্যজিৎ রায় ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-কে সাহিত্য থেকে সিনেমায়, একটা পপুলার ডিটেকটিভ ফিকশন থেকে বাংলা গোয়েন্দা সিনেমায় এতটাই যথার্থ রূপায়ণ করেছিলেন যে এই সিনেমা দর্শকের সঙ্গে তার নিজের ভাষাতেই সংযোগ স্থাপন করে নিয়েছিলো। কিন্তু এই যে আমরা সিনেমার সাহিত্য-নির্ভরতা নিয়ে এত বিতর্ক করি, তা শুধু এই বিতর্কের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়। যে জনগণের জন্য এই সাহিত্য বা এই সিনেমা সৃষ্টি হয়, তা এই জনগণের জন্যই ‘পপুলার ফিকশন’ বা ‘পপুলার সিনেমা’ হয়ে ওঠে। সাহিত্য সাহিত্যের জায়গায় থাকে, সিনেমা সিনেমার জায়গায়, আর জনগণ থাকে উৎসাহে-উত্তেজনায়-কৌতুহলে...

“স্লোগান হলো, শ্যুটিং দেখতে দিতে হবে! ইনকিলাব জিন্দাবাদ! আরও কাছে এলে পর পাঁচিলের উপর দিয়ে সড়কির ডগা দেখা গেলো। পরে বেরোল সেগুলো সড়কি নয়, খেত থেকে খান পঞ্চাশেক আখ উপড়ে নিয়ে সেগুলো কাঁধে নিয়ে আসছে। তারা এসেই পাঁচিলের বাইরে যত আমগাছ ছিলো সবকটার জুতসই ডালগুলো দখল করে ফেললো। অবাক হয়ে দেখলাম যে ছেলের ভিড়ে গাছের পাতাই আর দেখা যাচ্ছে না। আমরা এই অবস্থাতেই কাজ শুরু করে দিলাম, কারণ একবার তাদের নামতে বলার পরক্ষণেই কলোনি জুড়ে ইষ্টক বর্ষণ শুরু হয়েছিলো। ঘণ্টাখানেক কাজের পর হঠাৎ একটা মড়মড় শব্দ শোনা গেলো, এবং তারপরেই ঝুপঝাপ, আর সঙ্গেসঙ্গে আর্তনাদ! একটা গাছের ডাল ভেঙে সাতটা ছেলে মাটিতে পড়েছে, তার মধ্যে সাতটা ছেলেই গুরুতরভাবে জখম।... কিন্তু আশ্চর্য এই যে এমন একটা দুর্যোগের পরও দলের কারুরই শুটিং দেখার উৎসাহ কমলো না, এবং একটি ছেলেও গাছ থেকে নামলো না।.. এমনও দেখেছি যে মাঝবয়সী ভদ্রমহিলাদের কাঁধে চড়িয়ে গাছে তুলে দিচ্ছে এইস বছেলেরা। মহিলারাও এই সুবৰ্ণ সুযোগ পেয়ে পরম আহ্লাদে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাছের ডালে বসে কাটিয়ে দিচ্ছেন।”১৯

‘জয় বাবা ফেলুনাথ’-এর শুটিং করতে গিয়ে এমনই অভিজ্ঞতা হয়েছিলো সত্যজিৎ রায়ের। সত্যিই, কি অদ্ভূত এই জন উৎসাহ! একেই বলে সিনেমা!

তথ্যসূত্র

১। রায়, সত্যজিৎ। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬, পৃ. ১৫-১৭।
২। সেন, সুকুমার। ‘ক্রাইম কাহিনি কালক্রান্তি’, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ডিসেম্বর, ১৯৮৮।
৩। রায়, সত্যজিৎ। ফেলুদার সঙ্গে কাশীতে। ‘একেই বলে শুটিং’, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৯৭৯, পৃ. ৫১
৪। মজুমদার, তরুণ। সাহিত্য বনাম সিনেমা। বেতার জগৎ- সেরা প্রবন্ধ সংকলন, কলকাতা, মিত্র ঘোষ পাব্লিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, ১৪০৬। পৃ. ১০২-১২৪
৫। রায়, সত্যজিৎ। বাংলা চলচ্চিত্রে আর্টের দিক’, বিষয় : চলচ্চিত্র, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, পৃ. ৪৪
৬। Nandy, Ashis. Satyajit Ray's secret guide to Exquisite murders :Creativity, social criticism, and the partitioning of the self, SavageFreud, New Delhi, Oxford University Press, 1995, pp 251.
৭। রায়, সত্যজিৎ। “চিত্রনাট্য, শিল্পসপ্তম’, পথের পাঁচালী সংখ্যা, বর্ষ ১৯৫০। পৃ ১৭-১৮।
৮। রায়, সত্যজিৎ। ফেলুদার সঙ্গে কাশীতে।, ঐ, পৃ. ৪৯-৫০
৯। চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিমচন্দ্র। “বাঙ্গালির বাহুবল”, বিবিধপ্রবন্ধ, কলকাতা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, পৃ. ৮৯।
১০। রায়, সত্যজিৎ। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ঐ, পৃ. ৬৩।
১১। ঐ, পৃ. ৬৮।
১২। ঐ, পৃ. ৯৪।
১৩। Zizek, Slavoj. "How real is Reality”, Looking Awry : An Introduction toJacques Lacan through the Popular Culture, Cambridge, The MIT Press,1991, pp 48
১৪। Routledge, Christopher. "Crime and Detective Literature for YoungReaders”.A Companion to Crime Fiction, edited by Charles J. Rezepka andLee Horsely, United Kingdom, Willey Blackwell, 2010, pp 328.
১৫। সেন, সুকুমার। “ভূমিকা: ব্যোমকেশউপন্যাস”, শরদিন্দু অমনিবাস (প্রথমখণ্ড), সম্পা:প্রতুলগুপ্ত, কলকাতা, আনন্দ, ১৯৭০, পৃ ১১-১৬।
১৬। রায়, সত্যজিৎ। ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’, ঐ, পৃ. ৯
১৭। Gates, Philippa. “Criminal Investigation on Film”, Ibid, pp 345
১৮। ibid, pp 344-345.
১৯। রায়, সত্যজিৎ। ফেলুদার সঙ্গে কাশীতে। ‘একেই বলে শুটিং’, পৃ. ৬০-৬১

চিত্রঋণ- অন্তর্জাল-সূত্রে প্রাপ্ত।

লেখক পরিচিতি - ছাত্রী

0 comments: