প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রাজা মুখোপাধ্যায়
Posted in প্রচ্ছদ নিবন্ধতখন কিশোর-বয়স। নাটক করার পাশাপাশি মন চলে যাচ্ছে নাট্যচর্চারই হাত-ধরাধরি করে থাকা সংস্কৃতির অন্যান্য শাখায়। যার একটি অবশ্যই কবিতা। আর অন্যটি গদ্য। কেমন সেই গদ্যের চেহারা আর কেনই বা সেই অমোঘ আকর্ষণ? সেই সময়টা বাংলা সাহিত্যে গদ্য রচনার ক্ষেত্রে এক মহা-গুরুত্বপূর্ণ যুগ। একই সময় ভাগ করে লিখে যাচ্ছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সত্যজিৎ রায়, সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, রমাপদ চৌধুরী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী, আশাপূর্ণা দেবী, প্রতিভা বসু, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, মতি নন্দী, নারায়ণ সান্যাল, প্রফুল্ল রায় এবং শঙ্খ ঘোষ। এই ব্যাপ্তি কল্পনা করা যায়? এত রূপ, রস, গন্ধ একইসঙ্গে বহমান! আবার পাশাপাশি আমরা জারিত হচ্ছি অন্যতর এক গদ্যে – অলোকরঞ্জনীয়। সেন্ট পলস্ ক্যাথিড্রাল প্রাঙ্গনে তাঁর অনুবাদ-নাট্য ‘আন্তিগোনে’ অভিনীত হচ্ছে।
এই সময়ে ঘন ঘন যেতাম শর্মিলাদির বাড়ি। শর্মিলা বসু। বাংলা সাহিত্যের কৃতি ছাত্রী, অধ্যাপিকা এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে শঙ্খ ঘোষের ছাত্রী। শর্মিলাদি সমকালীন বাংলা গদ্য নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে টেনে আনলো সুনীল আর সমরেশের গদ্যশৈলীর তুল্যমূল্য বিচার। বলল, ‘সমরেশের গদ্য ধার ও ভার বহনে সমানভাবে সক্ষম আর সুনীল? তিনি লেখেন আশ্চর্য ধারালো এক লেখনীতে, যার তুলনা মেলা ভার।’ এমন সরল অথচ অসাধারণ বিশ্লেষণ, যা ভুলতে পারিনি এতদিন পরও। কিন্তু কী ভাবতো শর্মিলাদি তাদের প্রিয় ‘স্যর’ শঙ্খ ঘোষ প্রসঙ্গে। শোনা হয়নি কখনও। শঙ্খ ঘোষ একজন যাদুকরী সৃজনশিল্পী। তিনি কি কবি না গদ্যকার? নাকি আমাদের বোধের গভীরতম বিন্দু ছুঁয়ে থাকা সেই চিন্তক এবং সর্বোপরি অভিভাবক? আশ্চর্য! লিখতে গিয়ে বুঝতে পারিনি নিজের অজান্তেই কখন এই অভিভাবক শব্দটি লিখে ফেললাম। কিন্তু তাঁকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হলেই কবি অভিধাটি বসে যায় তাঁর নামের আগে। এটি যথার্থ কিনা সে প্রশ্নের উত্তর জটিল এবং বিবিধ। তাঁর গদ্য সংকলন দুটি খণ্ড হাতে নিয়ে বসলে কিন্তু খেয়াল থাকে না এর রচয়িতা আসলে কে – সামান্য অগ্রসর হলেই অবশ্য একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে যায় তা হলো এই গদ্যভাষা আসলে একজন কবির – এও এক নির্মেদ, ছন্দোবদ্ধ কাব্যভাষা। এই ছন্দ ভোরের শিশিরের মতো। তাকে স্পর্শ করে চমকিত হতে হয়। কম বয়সে বন্ধুসঙ্গে এই ভাবিকথক ঠিক করেছিলেন কখনও বিবাহ করবেন না। ‘বইয়ের ঘর’ নিবন্ধমালার মধ্যে ‘চরিত্র তৈরির ফন্দি’তে তিনি লেখেন, ‘পরে, চব্বিশ বছর হতে-না-হতেই শপথটা ভেঙে ফেললাম যখন, আকাশেরই একটু আপত্তি হয়তো-বা হয়েছিল, কেননা ফাল্গুনের সেই বসন্তদিনটা হঠাৎ ছত্রখান হয়ে গেল ঘোর শিলাবৃষ্টিতে!’ এই লাইনগুলি কি বিশুদ্ধ কবিতা নয়? তাহলে বিষয়টা আমরা কীভাবে দেখবো? যিনি ‘বিশুদ্ধ গদ্যকার’ তিনি কি লিখতে পারেন এমন গদ্য? এক্ষেত্রে কাব্যভাষা আর গদ্যভাষার মাঝখানে কাল্পনিক যে রেখাটি সাধারণত থাকে বলে আমরা অনুমান করি, তা কি খুব অস্পষ্ট আর সদা-পরিবর্তনশীল নয়? সাধারণত সার্থক কবিতার পরতে পরতে যেমন লুকিয়ে থাকে নানান জটিল ইঙ্গিত, রহস্যময় উদ্ভাস, একই সঙ্গে একাধিক দিগন্ত উন্মোচন করে, আমাদের মুখোমুখি হতে হয় মহাকালের, শঙ্খ ঘোষের বিপুল গদ্যসম্ভার কি তাই নয়?
তাঁর গদ্যজগতের আনাচে-কানাচে রসাস্বাদন করতে গিয়ে (মূল্যায়ন শব্দটি স্পর্ধার হতো!) দেখছি এ অতি দুরূহ কর্ম। কারণ এ তো শুধু পাঠ নয়, এ এক উত্তরণ। হৃদয়তন্তু দিয়ে অতি যত্নে লালিত কিছু মূল্যবোধ, একটা যাপিত সময়ের ইতিহাস – সম্পর্ক যার একটা বড়ো উপাদান। তাঁর গদ্যসংগ্রহের পর্ব–বিন্যাস সামান্য মনোযোগ দিয়ে দেখলেই এই মন্তব্যের প্রাসঙ্গিকতা স্পষ্ট হবে। প্রথম খণ্ডটির (যার নাম ‘স্মৃতিলেখা’) তিনটি ভাগ – ‘বইয়ের ঘর’, ‘এখন সব অলীক’ আর ‘ইছামতীর মশা’ আর দ্বিতীয় খণ্ডটি (‘লেখালেখি’) সাজানো হয়েছে ‘কবিতার মুহূর্ত’, ‘ঘুমিয়ে পড়া অ্যালবাম’, ‘জার্নাল’ আর ‘সময়ের জলছবি’ শিরোনামে চারটি বিভাগ দিয়ে। একেকটি পর্বের বিষয় একেকভাবে আবর্তিত হয়েছে; কিন্তু সচেতনভাবে কালানুক্রম মানা হয়নি। কোথাও তা আশৈশব যেসব বই পড়েছেন তিনি, তার মধ্যেও যেগুলি নানা কারণে স্মৃতিতে প্রোথিত রয়েছে, তার একটি খণ্ডচিত্র, কোথাও তা ভ্রমণ কাহিনী, কোথাও ডাইরি লেখার ভঙ্গীতে লিখে রেখেছেন ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই বলে যে ‘ছোটো হালকা অলস অসংলগ্ন গদ্য যাঁরা একেবারেই পড়তে পারেন না, এ-বই তাঁদের জন্য নয়’। আবার সময়ের জলছবি নামে যে অংশটি রয়েছে, তার সূচনায় লিখছেন, ‘নানারকমের মানুষ দেখেছি সংস্কৃতির জগতে, কাউকে দূর থেকে, কাউকে-বা অল্প কাছের থেকেও। সেসব দেখা নিয়ে জানা নিয়ে অথবা তাঁদের কাজ নিয়ে টুকরো টুকরো কয়েকটা কথা লিখেছি নানা সময়ে’ – এই লেখাগুলিতে তিনি যেন দর্শকের ভূমিকায়, সামনে দেখছেন একটি মানুষকে, একটি বিশেষ মানুষ, যাঁকে তিনি সম্ভ্রমের চোখে দেখেন, অন্য গ্রহের অধিবাসী বলে মনে করেন, তাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ, সেই সাক্ষাৎকার কেমন যেন একটু সরে এসে নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন, যেন তাঁরই আরেক সত্তা তাঁর সেই স্বপ্নের মানুষটির সঙ্গে দেখা করতে গেছে আর তিনি একটু দূরত্ব থেকে তা লক্ষ্য করছেন। এমন কি কবির কল্পনা ছাড়া সম্ভব? ধরা যাক বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে তাঁর প্রথম মুখোমুখি হওয়ার দিনটির কথা। লিখছেন, ‘সে ছিল এক বসন্তদিনের বিকেল। আমির আলি অ্যাভেন্যু দিয়ে এগিয়ে চলেছে ট্রাম’ – এক্ষেত্রে লক্ষণীয় এই যে সাক্ষাৎকারের আগে এ এক প্রস্তাবনা যেন, যেন পাপড়ির মতো খুলে যাচ্ছে ২০২ রাসবিহারী অ্যাভেন্যু-এর যাত্রাপথ। শেষমেশ সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন যখন, তাঁর মনে পড়ছে ‘তিথিডোর' এর লাইনগুলি – ভাবছেন অমন একজন স্রষ্টা তাঁকে দেখা দেবেন তো? পরমুহূর্তেই, বুদ্ধদেব স্বয়ং যখন দরজা খুলে দাঁড়ালেন, নিজের সেই সময়ের অনুভূতি তিনি যেভাবে বর্ণনা করছেন, মনে হবে, তিনিই যেন সিঁড়ির এক কোণে দাঁড়িয়ে নিজেকেই বুদ্ধদেবের সঙ্গে সেদিনের সংক্ষিপ্ত বাক্যালাপ করতে দেখছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে প্রথম দেখা-হওয়াও এমনই নাটকীয়। এইভাবে টুকরো টুকরো নানারঙা ছবির এক কোলাজ ফুটে ওঠে একটি আশ্চর্য ক্যানভাসে। অপূর্ব এক হিরন্ময় গদ্যে তিনি পাতার পর পাতা জুড়ে লিখে যেতে থাকেন সেইসব মানুষজনের কথা, যাঁরা আদর্শগতভাবে ভিন্ন মেরুর হয়েও মৌলিক, মানবিক মূল্যবোধের প্রশ্নে অনায়াস সহাবস্থানে আস্থাবান ছিলেন। যেমন আবু সয়ীদ আয়ুব এবং হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। এই দুজন যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছিলেন ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’র প্রথম সংস্করণ। এ প্রসঙ্গে শঙ্খবাবু লিখছেন ‘১৯৪৮-৫০ পর্বের মার্ক্সিস্ট বিশ্লেষণে রবীন্দ্রনাথকে যে প্রায় অস্পৃশ্য করে তুলবার আয়োজন চলছিল কোনও কোনও মহলে, সে বিষয়ে কী ভাবেন আকৈশোর রবীন্দ্রসাহিত্যে মগ্ন আমাদের হীরেন মুখার্জি’। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য এই ‘আমাদের’ শব্দের ব্যবহার। কারণ, গহন আত্মীয়তায় পরিপূর্ণ এই ভাষাশিল্পী বলছেন, ‘এই আমাদের শব্দটাই ছিল একটা চিহ্ন। যেসব মানুষের সঙ্গে তিল-পরিমাণ আলাপ-পরিচয়ও নেই, অনেক দূর থেকে তাঁদেরও আমরা ভেবে নিতে পারতাম আমাদের , ভাবতে পারতাম আপনজন, যদি তাঁদের জীবনদৃষ্টির সঙ্গে কোনও সাযুজ্যের বোধ হতো’।
একবার এক সাহিত্যসভায় তাঁরই সমসময়ের এক কবিকে বলতে শুনেছিলাম, ‘কবিতা হলো চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা’। শুনে চমকিত হয়েছিলাম। ‘চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকা?’ কী বোঝাতে চেয়েছিলেন সেই কবি? তাঁর মন্তব্যের সূত্র ধরে অনেক কথাই সেদিন বলেছিলেন, কিন্তু এখন আর তা সঠিকভাবে মনে নেই – একটা ব্যাখ্যা স্পষ্টভাবে মনে আছে। তা হলো কবির কাজ কিছু ইঙ্গিত তৈরি করা, একটা প্রেক্ষাপট রচনা করা, বাকি কাজ পাঠকের! তাহলে গদ্য রচয়িতার ভূমিকা কী? শঙ্খবাবুর না-পড়া গদ্যগুলি, যা পড়তে গিয়ে আর পড়া লেখাগুলির মধ্যে আবারও নিমজ্জিত হয়ে উপলব্ধি করতে চেয়েছি সেদিনের সেই মন্তব্যের সারবত্তা।
রচনাগুলির সময়কাল বিশাল – এই সময়ের মধ্যে বদলে গেছে অনেক কিছু, ভাঙচুর হয়ে গেছে তাঁর প্রজন্মের মূল্যবোধগুলি – অনিবার্যভাবে বাঁক নিয়েছে এই শিল্পীর সৃজন ভাষাও। কিন্তু একটি অদৃশ্য সুতো জুড়ে রেখেছে লেখাগুলি, তা হলো তাঁর জীবনকে একটা নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা। আর তাকে আবিষ্কার করতে গেলে বারবার পড়া দরকার তাঁকে। আর প্রতিবার পড়ার মধ্যে থেকে উঠে আসেন একেকজন শঙ্খ ঘোষ চেতনার আলাদা আলাদা স্তর থেকে, শিহরণ জাগে শরীরে – শেষ পর্যন্ত তাঁরা আবার মিলেও যান একটিই বিন্দুতে – তিনি সেই মানুষটি, যিনি আগাগোড়া অধিকাংশ সময় আগলে রেখেছেন তাঁর আজন্ম-পালিত মনটিকে। যার গঠন হয়েছিলো একধরণের পারিবারিক পরিমণ্ডলে, যা এখন বিরল শুধু নয়, অভাবনীয়। এক বৃহৎ, একান্নবর্তী পরিবার, নিজস্ব পরিবারের গণ্ডী ছাড়িয়েও অনেকদূর পর্যন্ত যার বিস্তৃতি, প্রচলিত আত্মীয়তার সংজ্ঞায় যা বেমানান। কোনও একটি বিশেষ গ্রন্থ নিয়ে যখন লিখছেন, সেই রচনা শুধু নয়, রচয়িতাও যেন তাঁর পরমাত্মীয়। ‘বইয়ের ঘর’ সংকলনের অন্তর্গত ‘কার বই কোথায়’ রচনাটির এক জায়গায় তিনি জীবনানন্দের ‘ঝরা পালক’ নিয়ে লিখছেন। অকস্মাৎ লিখলেন, ‘হাফ-টাইটেলে বড়ো হরফে ছাপা বইয়ের নামটির উপরে ঘন কালো অক্ষরের হাতের লেখায় দেখছি আরো কয়েকটি শব্দঃ অচিন্ত্যকে/জীবনানন্দ’। এই আপাতসাধারণ লাইনদুটির মধ্যে লুকিয়েছিল একটি প্রেক্ষাপট। প্রেসিডেন্সি কলেজের সামনের ফুটপাথে খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি বইটি। পরে সেটি ওলটাতে গিয়ে জানতে পেরেছিলেন যে তা এক বন্ধুর অন্যজনকে উপহার দেওয়া বই। আর তখনই তাঁর মনে হয় এ বই ফিরিয়ে দেওয়া উচিত অচিন্ত্যকুমারকে। শেষ অবধি তা আর যদিও হয়ে ওঠেনি কিন্তু তাঁর সেই বন্ধু-কবির মতোই তিনি চৌকাঠে দাঁড়িয়ে দেখেছেন দুদিককে আর তাঁর গদ্যরচনার সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়েছেন নানান ইঙ্গিত।
ইঙ্গিতময়তা যদি এই রচনাগুলির এক প্রধান দিক হয়, আরেকটি দিক, যার উল্লেখ করতেই হবে, তা হচ্ছে তীক্ষ্ণ রসবোধ – বিপুল লেখালেখির মধ্যে যা অবিচ্ছেদ্য। ‘বইয়ের ঘর’- এর মধ্যেই আরেকটি লেখা ‘প্রথমেরও প্রথম’, যেখানে তিনি কবি অজিত দত্তের সঙ্গে কোনও বইয়ের প্রথম সংস্করণ নিয়ে আলোচনা করছেন। অজিত দত্ত যেখানে গর্বিতভাবে তাঁর সংগ্রহে ১৮৭৮ সালে রবীন্দ্রনাথের প্রথম ছাপা বই ‘কবিকাহিনী’ থাকার কথা ঘোষণা করছেন। বলছেন ‘প্রথম তো কী হয়েছে? তাতেই কি বইয়ের মহিমা খুব বেড়ে গেল?’ বলে ‘ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে জানলার পাশে কাঠের আলমারির পাল্লা খুলে দু-আঙুলে বার করে আনলেন সে বই, খাটের ওপর ছুঁড়ে দিলেন আমার দিকে, আমার শরীর তখন অসাড়।’ পরবর্তী মুহূর্তেই তিনি জিগ্যেস করছেন অজিত দত্তকে, ‘বার করবো নাকি দশ টাকা?’ সহজাত এমন হাস্যরসের অজস্র নমুনা ছড়িয়ে আছে পাতায় পাতায়, দুটি খণ্ড জুড়েই।
পঞ্চাশের দশকটা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নক্ষত্র-খচিত। একই দশকে এতজন বিশাল মাপের সাহিত্য প্রতিভার আবির্ভাব সম্ভবত আগে পরে ঘটেনি। বিশেষত, কবিতার ক্ষেত্রে। আর এই কবিদের প্রত্যেকেই ছিলেন গদ্যরচনার জন্য বিশিষ্ট, বিষয় এবং শৈলীর কারণে। আরেকটি অন্তর্লীন বিষয় এঁদের মধ্যে রচনা করেছিল এক সেতু, যার নাম বন্ধুত্ব আর তা নিয়ে তৈরি হয়েছিলো শব্দবন্ধ (নাকি বন্ধুবন্ধ?) – শক্তি-সুনীল, শঙ্খ-অলোকরঞ্জন। শঙ্খবাবু তাঁর ‘আমার বন্ধু অলোকরঞ্জন’ রচনায় বর্ণনা করেছেন তাঁদের একসঙ্গে দীর্ঘ পথ-চলা, যার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় সম্পূর্ণ বিপরীত গড়নের দুই মেধাবী মানুষের আমৃত্যু সখ্যতার কারণগুলি। তাঁদের জীবনের শেষ প্রায় পঞ্চাশ বছর এঁরা বাস করেছেন দুটি পৃথক সৃষ্টিশীল পরিসরে, তা সত্ত্বেও এতটুকু ফিকে হয়নি সেই সম্পর্কের রঙ, ঈর্ষা করার মতো ছিল তাঁদের বোঝাপড়া। তাঁদের প্রকাশভঙ্গী যদিও ছিল দুই ভিন্ন মেরুর। একজন মুখর, অন্যজন প্রায় নির্বাক। কিন্তু দুজনেরই লেখনী ছিল নিরলস আর একে অপরের প্রতি চরম শ্রদ্ধাশীল। তাই একজন লেখেন, ‘যে-কোনো সমাবেশে অলোক সমুদ্যত, মুখর, বিচ্ছ্যুরিত; আমি পলাতক, নীরব, নিস্প্রভ’। আর অন্যজন লিখছেন, ‘প্রতীক্ষাই কি শরীরের ভিতর সত্তা, সত্তার ভিতর শরীর নয়? আসল কথা, আমি যে শুধু কোনো ঘটনার ভিতর নেই তা নয়, কোনো অনবচ্ছিন্ন আইডেনটিটি সূত্রেও গ্রথিত নই। আমি জানি না আমার বাঁচার তাৎপর্য, যার নাম ভালোবাসা, কোথাও, এমনকি আপনার কাছেও, পৌঁছবে কি না।’
গত এক বছরেরও বেশি সময় জুড়ে আমাদের গ্রাস করে ফেলেছে এক অজানা মহামারীর মারণ- ছায়া। এরই মধ্যে দুই মহাদেশে দুজন তাঁদের যাবতীয় মঙ্গলাকাঙ্খা দিয়ে ঘিরে ছিলেন আমাদের। মাত্র মাস ছয়েকের ব্যবধানে প্রথমে প্রিয় সুহৃদ অলোকরঞ্জন পরে সেই ভয়াল ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শঙ্খ ঘোষ ছেড়ে গেলেন আমাদের এমন একটা সময়ে যখন সমবেতভাবে তাঁরই কবিতার লাইন ‘আমরাও তবে এইভাবে/এ-মুহূর্তে মরে যাব না কি?/আমাদের পথ নেই আর/আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’, উচ্চারণ করার ক্ষণ সমাগত।
ভালো লাগলো।
ReplyDelete