Next
Previous
0

প্রবন্ধ - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in






কবিতায় জাদুবাস্তবতা এবং কবিতায় তার অবস্থান প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই কবিতা কি এবং কবিতা কাকে বলে তার ওপর আলোচনা করতে হয় ।
কবিতার ইংরেজি শব্দ poetry যা প্রাচীন গ্রীক শব্দ ποιεω ,Poetry শব্দটি Greek শব্দ poiesis থেকে এসেছে যার অর্থ হলো নির্মাণ বা তৈরি, যা শিল্পের একটি শাখা, এই শাখায় ভাষায় নান্দিক কবিতা মানুষের ভাষার বিশেষ কলা, যা সাধারণ গদ্যরীতি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
প্রকৃতপক্ষে, কবিতার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া বড়ই কঠিন ! বিশ্বসাহিত্যে খ্যাতিমান কবিরা বিভিন্নভাবে একে সংজ্ঞায়িত করেছেন। ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করেছেন ‘ প্রগাঢ় আবেগগুলোর স্বত:ফুর্ত উচ্ছ্বাস’ তাঁর মতে, কবিতা সব জ্ঞানের মূল্যবোধ, সৌন্দর্যের প্রকাশ। নিভৃতচারী নারী কবি এমিলি ডিকিনসন বলেন,'যদি আমি একটি বই পড়ি তবে তা আমার ঠান্ডা শরীর উষ্ণতায় ভরে উঠে, আমি জানি ওইটাই কবিতা ' ডিলান টমাস কবিতার সংজ্ঞা দেন এভাবে;'কবিতা, যা আমাকে হাসায় কিংবা কাঁদায় অথবা হাই তোলায়, যা পায়ের আঙুলের নখ শিহরিত হয়, যা আমার দিয়ে এটা কিংবা ওটা কিংবা কিছু করাতে চায়।' খ্যাতিমান ইংরেজ কবি কোলেরিজের মতে , শ্রেষ্ঠতম বিন্যাসের শব্দগুলোর বিন্যাসই কবিতা। কবিতায় মূল্যবোধ,সৌন্দর্য প্রকাশ করতে গেলে কবিতায় তন্ময়তা, সঙ্গীতের মন্ময়তা এবং একটা বাণী। তাছাড়া ছন্দময়তা তো অবশ্য থাকতে হবে।
ইংলিশ রেঁনেসার প্রাক্কালে জন মিলটন, ক্রিস্ট্রোফার মার্লো, শেক্সপিয়ার প্রমুখ কবিরা যে সমস্ত কাব্যিক নাটক রচনা করেন, যা চিরকালীন । ইংরেজি সাহিত্যের রোমান্টিক কালপর্বে গেটের “ফস্ট”,কোলেরিজের “ কুবলাই খান” এবং জন কিটসের
"Ode on a Grecian Urn." কাব্য অন্তরঙ্গ অনুষঙ্গে কাব্যানুরাগী মানুষকে বিমোহিত করে। জন কিটস বলেছেন ,"Beauty is truth. Truth, beauty.
That is all ye know on Earth and all ye need to know."
'সৌন্দর্য হচ্ছে সত্য, সত্য হচ্ছে সৌন্দর্য পৃথিবীতে তোমরা এ সব জান আর তোমাদের এ সব জানার প্রয়োজন।"
সত্য আর সৌন্দর্যের বহি:প্রকাশই কবিতা এটাই প্রকাশ পেয়েছে জন কিটসেই এই কবিতায় । কবিতা সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল। এবার আমাদের আলোচ্য বিষয় কবিতায় জাদুবাস্তবতা। আমরা দেখার চেষ্টা করবো জাদুবাস্তবতা আসলে কী?
জাদুবাস্তবতা হলো সাহিত্যের একটি ফর্মেট, নমুনা বা গঠন। ইংরেজিতে যাকে বলা হয় ম্যাজিক রিয়ালিজম। বর্তমান বিশ্বসাহিত্যের গল্প এবং উপন্যাসে যার প্রভাব লক্ষণীয় হলেও মূলত ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যিকরা একে বেড়ে উঠতে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। তারা এটি করেছে ইংরেজি সাহিত্য হতে নিজেদের আলাদা করতে। যা মূলত তাদের সাহিত্যের একটি আন্দোলন।
বিশ্বসাহিত্যে জাদুবাস্তবতার ব্যবহারে মার্কেজকে বলা যায় ’দ্যা ফাদার অফ ম্যাজিক রিয়ালিজম’। কেননা তিনি
তার গল্প এবং উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার যে ব্যবহার করেছেন তার ফলেই বিশ্বসাহিত্য তাকে সাদরে গ্রহণ করেছে।এছাড়া ইসাবেল এবং কার্পেন্তিয়ারও ছিলেন এ বিষয়ে সিদ্ধহস্ত। তবে জাদুবাস্তবতার ধারণাটির জন্মদাতা কোনো ল্যাটিন আমেরিকান সাহিত্যিক নয়। জার্মান চিত্রকলা বিষয়ক সমালোচক ফ্রাঞ্জ রোহ তার নবীন ইউরোপীয় চিত্রকলা বিষয়ক বইটিতে প্রথম জাদুবাস্তবতা শব্দের বিষয়বস্তু তুলে ধরেন। চিত্রকলায় যা ব্যবহার হত। পাঠকগণদের নিকট উদাহরণস্বরূপে বলা যায়, পাঠকগণ মোনালিসার হাসির সঠিক ব্যাখ্যা এ পর্যন্ত বিভিন্ন বিশারদগণ বিভিন্ন অর্থে বলেছে। যাকে জাদুবাস্তবতা বলা চলে।
জাদুবাস্তবতা সাহিত্যে প্রথম ব্যবহার করা হয় ১৯৫৫ সালে এঞ্জেল ফোর্স নামে স্পেনীশ উপন্যাসে। পরবর্তী সময়ে মার্কেজ, ইসাবেল, কার্পেন্তিয়ারা একে বিশ্বসভার আসরে স্থান করে নিতে সাহায্য করেন তাদের সৃষ্টির মাধ্যমে। যদি আমরা ১৭ শতক বা আঠার শতকের বিশ্বসাহিত্য নিয়ে কথা বলি, তাহলে দেখা যায়- ১৭২৬ সালে প্রকাশ হওয়া জনাথন সুইফটের উপন্যাস ‘গালিভার ট্রাভেলস’ এবং ১৮৪২ সালে প্রকাশিত হওয়া নিকোলাস গোগল এর উপন্যাস ‘নোজ’ এ জাদুবাস্তবতার ব্যবহার ছিল। কিন্তু তখন এর কোনো ধারণা ছিল না। এর ধারা প্রমাণ হয় যে, জাদুবাস্তবতা কোনো মৌলিক বিষয় নয়। লেখকের কল্পনা শক্তিই মূলত তার প্রকৃতরূপ। এছাড়া ওই সময়ের পরে ডিকেন্স, বালজাক আর কালভিনোর উপন্যাসেও জাদুবাস্তবতার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।
এরই ধারাবাহিকতায় কবিতায় জাদুবাস্তবতা ব্যবহারের চেষ্টা করছেন সাহিত্যিকরা। কিন্তু যা করা হচ্ছে তা কী জাদুবাস্তবতা হচ্ছে নাকি তা বিচার সাপেক্ষ? কেননা কোনো অবাস্তব ঘটনার অবতারণা, পৌরাণিক কাহিনি বা মিথ ইত্যাদি বিষয়কে জাদুবাস্তবতা বলা যায় না। জাদুবাস্তবতা সেটা যা বাস্তবতাকে বিশেষ কিছু শক্তিমত্তায় বা অলৌকিক রূপে প্রকাশ করা হবে। যাতে বাস্তবতার সাথে অদ্ভুত বা বিস্ময়কর কোনো বিষয়ের সংমিশ্রণ ঘটানো হয়। এই জাদুবাস্তবতা মূলত গড়ে ওঠে কাহিনিকে কেন্দ্র করে। যার জন্য গল্প বা উপন্যাসে এর প্রয়োগ হয়ে থাকে কবিতায়ও এটি ব্যবহার করা যায়। তবে তা সবার দ্বারা সম্ভব নয়। কেননা অদ্ভুত কোনো বিষয়ের অবতারণা করলেই সেটা জাদু বাস্তবতা হয় না। আর কবিতা তো কাহিনি নির্ভর না।বাংলা সাহিত্যে কেউ কেউ এটা ব্যবহার করতে গিয়ে এমন কিছু লিখে যে তাতে কবিতার কোনো মৌলক বিষয় বা মূলভাব থাকছে না। কবিতার যদি মূলভাবনাই না থাকে তাহলে ওই লেখার কি কোন মূল্য আছে? আমাদের মনে রাখা উচিত যে কবিতায় তার বিষয়বস্তু গুরুত্বপূর্ণ।
পাঠক কবিতার মাঝে একটি রহস্য খুঁজে পায় বা ঘোরের মাঝে আবর্তিত হয়, কীভাবে এটি সম্ভব? ঠিক এই বিষয়টিরই নাম দেয়া হয়েছে জাদুবাস্তবতা বা ম্যাজিক রিয়ালিজম। অর্থাৎ কবিতার রহস্যতাকেই কবিতায় জাদুবাস্তবতা বলা চলে।
জাদুবাস্তবতার আগে সাহিত্যে পরাবাস্তবতার অবতারণা করেছেন সাহিত্যিকরা। পরাবাস্তবতা হচ্ছে এমন এক ধরনের বাস্তবতা যার সঙ্গে চাক্ষুষ বাস্তবতার কোন মিল নেই। ইংরেজীতে সুররিয়েলিজম (surrealism) বলা হয়। বস্তুত চেতনার মূল ভিত্তি হলো অযুক্তি ও অবচেতন। ফ্রয়েডীয় মনস্তাত্ত্বিক ধারণা মিলানো যায় এখানে। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েডের ভাবনা- মানুষ অবচেতন মনে অনেক কিছুই করে বা ভাবে। তিনি বলেন- এ ভাবনা চেতন মনের চেয়ে অবচেতন মনেরই বেশি। পরাবাস্তবতা হচ্ছে মানুষের চেতনটা যখন শিথিল হয় তখন মানব মনে অবচেতন প্রভাব ফেলে। এটি হচ্ছে- কবির প্রতীক ও চিত্রকল্পসমূহের মধ্যে যোগসূত্র। মূলত সুইজারল্যান্ড থেকে উঠে আসা ‘ডাডাইজম’ এর পরবর্তী আন্দোলন হচ্ছে ‘সুররিয়েলিজম’ বা ‘পরাবাস্ততা’। এখন আবার তাকে জাদুবাস্তবতা বলছেন অনেকে। জাদুবাস্তবতাবাদ এবং পরাবাস্তবতাবাদ উভয়ই ১৯২০ সালের দিকে তাত্ত্বিক রূপ পায়। এবং প্রায় সমসাময়িক সময়েই এদের ইশতেহার রচিত হয়। সে সময়টা ১৯২৫ সালের দিকে ফ্রাঞ্জ রোহ জাদুবাস্তবতাবাদ এবং এর কিছুদিন আগেই আন্দ্রে ব্রেতঁ প্রকাশ করেন পরাবাস্তববাদের ইশতেহার। এখন যাকে জাদুবাস্তবতা বলছেন অনেকে।
মার্ক আর্নেস্টের সংজ্ঞা আমরা তুলে ধরতে পারি। সুররিয়েলিজমকে তিনি বলেছেন সুররিয়ালিস্টের লক্ষ্য হচ্ছে অবচেতনার বাস্তব চিত্র আঁকা নয় কিংবা অবচেতনার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে কল্পনার আলাদা এলাকা সৃষ্টি করাও নয়। এর লক্ষ্য হলো চেতন ও অবচেতন মনের সাথে বাইরের জগতের সব দৈহিক ও মনের বেড়া তুলে দেয়া। এই পরিপ্রেক্ষিত, আসলে পরাবাস্তবতাই জাদুবাস্তবতা। একারণে আমরা পরাবাস্তবতার কবিতাগুলোর। আলোকপাত করতে পারি।
ইতালিতে জন্মগ্রহণ করা ফ্রেঞ্চ আপোলিনিয়ার (১৮৮০-১৯১৮) সুররিয়েলিজম’ শব্দটি উল্লেখ করেন। তাঁর লেখা কবিতায় আদি-সুররিয়েলিজম কাব্যের নিদর্শন রয়েছে। ‘টাইরেসিয়াম-এর 'স্তন’ নাটকে প্রথম সুররিয়েলিজম প্রয়োগ করেন তিনি। পরে তা ইংরেজী ও জার্মান সাহিত্যেও এ ধারা সম্প্রসারণ হয়। ‘চাঁদের আলো’ কবিতায় তিনি পরাবাস্তবতাকে শিল্পরূপ দিয়েছেন এভাবে-
‘ক্রোধীর ঠোঁটে শ্রবণসুখকর চাঁদ
আর রাতের লোভার্ত নগর ও উদ্যান
মৌমাছির মতো নক্ষত্রদের ভ্রম হয়
এই আলোকময় মধুতে আঙুরবাগান আহত
আকাশ থেকে ঝরছে মধুর মধু
চাঁদের রশ্মি যেন মধুর ঝিকিমিকি
.হাওয়ায় গোলাপে মিশছে মধুর চন্দ্রিমা।’
বাঙলা সাহিত্যে অনেকে পরাবাস্তবতা, যা জাদুবাস্তবতার বেশ কিছু প্রয়োগ করেছেন। বর্তমানকালের প্রায় সব কবিই পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বা কাজী নজরুল কবিতা ও গানে সামান্য পরাবাস্তবতার উপাদান ব্যবহার করেছেন। যেমন ‘আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই, সেই পাহাড়ের ঝরনা আমি...।’ বিষ্ণু দে, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, শক্তি চট্টপাধ্যায়, সুনীল, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, মান্নান সৈয়দ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ কবিতায় পরাবাস্তবতা এনেছেন মাঝে মধ্যে।
আধুনিক বাংলা কবিতায় কবি বিষ্ণু দে তাঁর ‘ঊর্বশী ও আর্টেমিস’ কাব্যগ্রন্থে প্রথম সার্থক সুররিয়েলিজম বা পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেন। তবে পরাবাস্তবতার উপাদান সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। তাঁর ‘ঝরাপালক’, ‘বনলতা সেন’, ‘ধূসর পান্ডুলিপি’ কাব্যগ্রন্থে পরাবাস্তবতার ব্যবহার অনেক বেশি। তাঁকে ‘পরাবাস্তবতার কবি’ বলা হয়ে থাকে। পরাবাস্তবতার সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়ে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে তিনি জনপ্রিয় হয়েছেন পরাবাস্তবতার কয়েকটি উদাহরণ দিতে পারি নিচের কবিতায়।
‘জানতাম তোমার চোখে একদা জারুলের বন
ফেলেছে সম্পন্ন ছায়া, রাত্রির নদীর মতো শাড়ি
শরীরের চরে অন্ধকারে জাগিয়েছে অপরূপ’- (কোন এক পরিচিতাকে, শামসুর রাহমান)
‘অনেক আকাশ’ কবিতায় সৈয়দ আলী আহসান ধরা দিয়েছেন এভাবে-
‘... সোনার ঘাসের পাতা ঘুমের মতো
অজস্র পাতার ফাঁকে হৃদয়ের নদী হয় চাঁদ নেমে ঘাসে’- -------
আল মাহমুদ বেশ কয়েক জায়গায় পরাবাস্তবতার উপাদান ব্যবহার করেছেন। ‘নদীর ভেতরে নদী’ কবিতায় পরাবাস্তবতার একটু প্রয়োগ দেখি-
‘নদীর ভেতরে যেন উচ্চ এক নদী --------।
তিতাসের স্বচ্ছ জলে প্রক্ষালনে নেমেছে তিতাসই।
নিজের শাপলা লয়ে নেমে নদী নদীর ভেতরে
ঠাট্টা বা বিদ্রুপ নেই, শ্যেনচক্ষু, নেই চারণের বালি।’
মান্নান সৈয়দ বলতেন- সুররিয়েলিজমই হলো প্রকৃত বাস্তবতা। তিনিও কবিতায় সার্থক পরাবাস্তবতার প্রয়োগ করেছেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ ’(১৯৬৭)। এখানে সুররিয়েলিজমের সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। তিনি জীবনান্দ দাশ নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা লিখেছেন এবং গবেষণা করেছেন। আর এ কারণে জীবনান্দের প্রভাব কবির মনে। আরো কয়েকটি কবিতায়।যেমনঃ
১) ‘দেখেছি ঘাসের মেঝে ছিন্ন
লাল মুন্ডু নিয়ে খেলে বিনা অপব্যয়ে
সূর্য টেনে নিয়ে যাচ্ছে কালো রেলগাড়ি।’ (কবিতা, রাত্রপাত)
২) ‘জ্যোৎসনা হয় জল্লাদের ডিমের মতো জলহীন মুন্ডু
জোড়া-জোড়া চোখ
সাতটি আঙুলের ও একমুষ্টি হাত
রক্তকবরীর অন্ধকার
এবং একগুচ্ছ ভুল শিয়ালের সদ্যোমৃত যুবতীকে ঘিরে জ্বলজ্বলে চিৎকার’- ( জ্যোৎসনা কবিতায়)
৩) ‘একেকটি দিন একেকটি সবুজভুক সিংহ’ কবিতায়-
‘পরিবর্তনের ছাদ বিড়ালের মতো
অন্যমনস্ক হওয়ার সুযোগে পা টিপে-টিপে এগোল
বরফের মানুষ নাজেহাল ছোটো-ছোটো নুড়ির আওয়াজ ---- কবি জীবনানন্দ দাশের কয়েকটি কবিতার কিছু চরণ তুলে ধরলে তাঁর কবিতায় আমরা দেখতে পাই তিনি জাদুবাস্তবতার ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত। লক্ষ করুন------ তিনি পাঞ্জাবির পকেটে চাঁদের উঁকি দেয়া দেখতে পান-
‘দেখি তাঁর চুলে রাত্রি থেমে আছে
চোখে সবুজ প্রিজমের ভেতর থেকে লাফিয়ে পড়ে ফড়িং
... বেরিয়ে আসছে সান্ধ্যবেলার সবগুলো তারা
দেখি তার পাঞ্জাবির ঢোল পকেটে উঁকি দিচ্ছে চাঁদ।’
‘বনলতা সেন’ কবিতাগ্রন্থের ‘তুমি’ কবিতায় রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ কবিতা সম্বন্ধে যা বলেন তার মধ্যে কবিতার সংজ্ঞা অবশ্যই নিহিত আছে। ’
জীবনান্দ দাশ তাঁর বিপুল কবিতাসম্ভারে প্রেম ,প্রকৃতি রোমান্টসিজিমরে নিবিড় সমারোহ ! জাদুবাস্তবতাবাদ নামটি সাহিত্যতত্ত্বে বিংশ শতকীয় সংযোজন হলেও সাহিত্যে এর ব্যবহার বহুপ্রাচীন। ‘রামায়ণ’, ‘মহাভারত’ প্রভৃতি প্রাচীন মহাকাব্যগুলোকেও জাদুবাস্তবতার আলোকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। অনেক সাহিত্য সমালোচক বলেন---- জাদুবাস্তবতাবাদের সাথে অনেকের পরাবাস্তবতাবাদকে (Surrealism) মিলিয়ে ফেলেন, যদিও দু’টি ধারণায় খুবই কাছাকাছি, কিন্তু এক নয়। বলা যেতে পারে একটি গাছের দু’টি শাখা, জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় দু’টি ব্যাপারকেই খুব দক্ষতার সাথে ব্যবহার করেছেন । জীবনানন্দ অন্যান্য কবিতায় পরাবাস্তবতা ও জাদুবাস্তবতার অনেক অনেক উদাহরণ যথাস্থানে দেবো। আগেই বলা হয়েছে,কবিতায় জাদুবাস্তবতা সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে জাদুবাস্তবতা কাকে বলে। সত্যি কথা বলতে জাদুবাস্তবতার সংজ্ঞা দেওয়া বড়ই কঠিন। আমরা তুলে ধরবো বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য সমালোচকের উক্তি। বিভিন্ন ভাষার সাহিত্য সমালোচকরা জাদুবাস্তবতা বা Magical realism নানা সংজ্ঞা প্রদান করেছেন নানা ভাবে।
বিশ্বসাহিত্যের গল্প,উপন্যাস ও কবিতায় খ্যাতনামা লেখকদের রচনায়রিয়ালিজম, ক্রিটিক্যাল রিয়ালিজম, সোস্যালিস্ট রিয়ালিজম, সুররিয়ালিজম, স্ট্রাকচারালিজম, পোস্ট-স্ট্রাকচারালিজম, মডার্নিজম, পোস্টমডার্নিজম, পোস্ট কলোনিয়ালিজম, ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদুবাস্তবতা অনুষঙ্গ আমরা লক্ষ্য করি। আমাদের আলোচ্য বিষয় কবিতায় জাদুবাস্তবতা। জাদুবাস্তবতাকে তুলে ধরার শৈল্পিক রীতি হল জাদুবাস্তবতাবাদ। কবিতায় জাদুবাস্তবতা সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে আমাদেরকে জাদুবাস্তবতাবাদের বৈশিষ্টগুলোর উপর নজর দিতে হয়। স্বপ্ন ও কল্পনার মিশেলে অতিপ্রাকৃত, অলৌকিকত্ব, কল্প কাহিনী, রহস্যময়তা ইত্যাদি জাদুবাস্তবতাবাদে দেখা যায়।
সমকালীন বিশিষ্ট ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক ও সমালোচক-গবেষক ডেভিড লজের মতে, ‘নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্যে বাস্তবতা লক্ষণীয় হলেও অনেক সময় ঘটনার বাস্তব অনুষঙ্গের ভেতরে চমকপ্রদ ও বিস্ময়কর ঘটনাও ঘটে তখন তাকে জাদুবাস্তবতাবাদ আখ্যায়িত করা হয়,যার বিশেষ সংশিষ্টতা আছে লাতিন আমেরিকার কথাসাহিত্যিক ও ঔপন্যাসিক গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের লেখায়, এসম্বন্ধে আগেই আভাস দেওয়া হয়েছে। যদিও এর দেখা পাওয়া যায় অন্যান্য মহাদেশের লেখকদের গল্প-উপন্যাসে, যাঁদের মধ্যে আছেন গুন্টার গ্রাস, সালমান রুশদি এবং মিলান কুন্দেরা। এই লেখকদের প্রত্যেকেই নানান ঐতিহাসিক ঘটনার সহিংস আলোড়ন এবং ব্যক্তিগত জীবনেও নানান উত্থান-পতনের তীব্র সংক্ষোভের ভেতর দিয়ে গিয়েছেন, তাঁদের সেই অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে প্রকাশের জন্য বাস্তববাদ যথেষ্ট ধারণক্ষম নয় বলেই তাঁরা মনে করেছেন। Lodge,1992:114)
লজ আরো মনে করেন, ‘অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিমাণ ব্রিটিশ লেখকের মধ্যে এর প্রভাব রয়েছে এবং বাইরে থেকে এর আগমন ঘটলেও কয়েকজন একে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করেছেন; তাঁদের মধ্যে আছেন ফে ওয়েল্ডন, অ্যাঞ্জেলা কার্টার এবং জেনেটি উইন্টারসন। Lodge,1992:114) জাদুবাস্তবতাবাদ দৃষ্টান্ত হিসেবে মিলান কুন্দেরার ‘দ্যা বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’র একটা অংশ উপস্থাপন করেন। আমরা সেই অংশটিতে দেখি একদল নৃত্যরত মানুষ নাচতে নাচতে মাটি থেকে হাওয়ায় ভাসতে থাকে এবং ভাসতে ভাসতে আকাশে উড়ে যায়। জাদুবাস্তবতাবাদ একদিক থেকে মূলত এমন একটি রচনারীতি ও প্রকাশভঙ্গি যাতে অনেক বিষয়কে নতুন করে বর্ণনা করা হচ্ছে। এই রীতিটিকে প্রায়শই মিশিয়ে ফেলা হয় অতিপ্রাকৃত, উদ্ভট, আজগুবি ঘটনার সঙ্গে।
জাদুবাস্তবতার কথা আলোচনা করতে ডেভিড লজ যে প্রধান চারজন লেখক নাম উল্লেখ করেছেন তারা হচ্ছে: গাবরিয়াল গার্সিয়া মার্কেস গ্যুন্টার গ্রাস , , মিলান কুন্দেরা এবং সালমান রুশদি । জাপানের হারুকি মুরাকামিএর ’দ্য উইন্ড- আপ বার্ড ক্রেনিকেল ’ , রাশিয়ান লেখক মিখাইল বুলগাকভের ‘ দ্য মাস্টার এন্ড মারগারিটা’,চিলির ইসাবেলা আলেন্দের ‘ দ্য হাউস অফ দি স্পিরিট, আমেরিকান- আফ্রিকান লেখিকা টনি মরিশনের ‘ বিলাভেড’ এ magical realism বা.জাদুবাস্তবতা পুরোমাত্রায় বর্তমান।
উপন্যাসে জাদুবাস্তবতাবাদের পুরোধা গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস সম্বন্ধে না বললে সাহিত্যে জাদুবাস্তবতা সম্বন্ধে সম্যক জানা সম্ভব নয়। মূর্তিমান কলোম্বিয়ান লেখক গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ৮৭ বছর বয়সে মারা যান, কিন্তু তিনি তাঁর উপন্যাসগুলোতে উজ্জ্বল ভাবে আবিষ্কার করে গেছেন জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গে। তাঁর মাস্টারপিস‘ ওয়ান হান্ডের্ড ইয়ারস অফ সোলিচিউড ’ ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হয়, যার জন্য ১৯৮২ সালে নোবেল প্রাইজ লাভ করেন। তিনি নোবেল ভাষণে বলেন যে তিনি চেষ্টা করেছিলেন কেন জাদুবাস্তবতা লাতিন আমেরিকায় এতটা চমৎকার। তিনি বলেন,“ কবি ও ভিক্ষুক, সঙ্গীত শিল্পী ও ভবিষ্যত দ্রষ্ট্রা , যোদ্ধা ও বদমায়েস এবং সব প্রাণীর মাঝে উদ্দাম বাস্তবতা আছে,আমরা তার মাঝে সামান্য কল্পনার মেলবন্ধন ঘটিয়েছি-----’
জাদুবাস্তবতা প্রসঙ্গে আরো বলা যায়, জাদুবাস্তবতা একটা অনুষঙ্গ যাতে অপ্রাকৃত উপাদানের উপস্থিতি লক্ষ্যণীয়। প্রথম কালপর্বে কবি সাহিত্য ও চিত্রকরা সাহিত্য ও চিত্রকলায় শুধুমাত্র বাস্তববাদিকতাকে তুলে ধরতেন। সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশ শতকে ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকজন লেখকের লেখায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গের উপস্থিতি বিশেষ ভাবে উঠে আসে। Magical realism শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায় ফ্রাৎস রো(১৮৯০- ১৯৫৫) নামে একজন কলা সমালেচকের বইয়ে ১৯২৫ সালে। এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রের লক্ষ্য ছিল দৈনন্দিন জীবনের রহস্যজনক উপাদানগুলোকে মেলে ধরা। রো যদিও সাহিত্যের রচনা শৈলিতে Magical realism হিসাবে বলে মনে করেননি। তাঁর মতে এই শব্দটির ব্যবহারিক ভিত্তি ছিল রোজকার জীবনের চমকের সামনে মানুষের বিস্ময়েরই অভিব্যক্তি।
আমেরিকার প্রখ্যাত মহিলা কবি এমিলি ডিকিনসন( ১৮৩০- ১৮৮৬) কাব্য প্রতিভার কথা উপেক্ষিত থেকে গেছে। উনিশ শতকের এমিলির কবি জীবনের কালপর্বে বিশ্ব সাহিত্যের গদ্য ও পদ্যে জাদুবাস্তবতার কথা না উঠলেও কবি এমিলি ডিকিনসন তাঁর লেখা কবিতায় পরবর্তীকাল পর্বে সাহিত্য সমালোচকরা জাদুবাস্তবতা এর অনুষঙ্গ লক্ষ করেন। উনিশ শতকের উত্তর আমেরিকার প্রখ্যাত কবিদের মধ্যে অন্যতম মহিলা কবি এমিলি ডিকিনসন এর কাব্য প্রতিভার ওপর আলোকপাত করা যেতে পারে। এমিলি ডিকিনসন উত্তর আমেরিকার বিখ্যাত কবি, তাঁর জীবিতকালে ২০০০ এর অধিক কবিতা রচনা করলেও বেঁচে থাকাকালে তাঁর কবিতা তেমন প্রকাশিত হয় না।
এমিলি ডিকিনসনের কবিতাগুলো বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। তাঁর লেখা কবিতার অর্থ তাৎপর্যপূর্ণ এবং জাদুবাস্তবতায় বর্ণনামূলক কাব্যিক অনুষঙ্গে ভরপূর । তাঁর লেখা কবিতায় ধ্যানমগ্নতা, বিশ্বজনীনতা, প্রেম ভালবাসা ও প্রকৃতি বন্দনায় ঋদ্ধ। এমিলি ডিকিনসনের কাব্যপ্রতিভার স্বাক্ষর ছড়িয়ে আছে তাঁর অসংখ্য কবিতায় জাদুবাস্তবতা বা magical realism অনুষঙ্গে , যদিও গল্প উপন্যাসে জাদুবস্তবতা বা উপস্থিতি বিশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশ শতকে ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকজন গদ্য লেখকের লেখায় জাদুবাস্তবতার শব্দটির কথা শোনা যায়। পদ্য গদ্য না হলেও কোন কবির কবিতায় কাব্যিক অনুষঙ্গ সাথে সাথে তা বর্ণনামূলক যে হতে পারে, তা এমিলি ডিকিনসনের কবিতায় উঠে এসেছে। তাঁর অনেক কবিতায় magical realism বা জাদুবাস্তবতার উপস্থাপিত হয়েছে গদ্যের আঙ্গিকে। প্রসঙ্গক্রমে তাঁর সে ধরনের কবিতার দুটো স্তবক উদাহরণ হিসাবে তুলে ধরা যেতে পারে ।
THE CHARIOT.|
Because I could not stop for Death,
He kindly stopped for me;
The carriage held but just ourselves
And Immortality.
We slowly drove, he knew no haste,
And I had put away
My labor, and my leisure too,
For his civility.
My labor, and my leisure too,
For his civility
রথ
কারণ আমি মৃত্যুর জন্য থামতে পারলাম না,
সে আমার জন্য অনুগ্রহ করে থামল;
রথটি ছিল ঠিক আমাদের আর অমরত্বের কাছাকাছি।
আমরা ধীরে ধীরে চালিত হলাম, সে জানতো কোন তাড়াহুড়ো নেই,
আর আমি দূরে ছিলাম
আমার পরিশ্রম, আর আমার অবসরও,
তার সৌজনের জন্য। (প্রাবন্ধিকের অনুবাদ)
মূলত এক নজরে একে সহজ বলে মনে হতে পারে। মানুষ প্রায়ই ভুলে যায় বর্ণনার কথা যার মাঝে কবিতার অর্ন্তনিহিত ভাব উপস্থিত থাকে। সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখলে অনুধাবন করা যাবে এমিলি ডিকিনসন সময় নিয়েছিলেন একটা গল্প সৃষ্টিতে তাঁর THE CHARIOT কবিতায় । সম্ভবত এমনটা লেখায় এমিলি ডিকিনসনের ছিল একটা সুনির্দিষ্ট সাঙ্কেতিক উদ্দেশ । এই কবিতাটিতে তিনি সধমরপ ৎবধষরংস বা জাদুবাস্তবতার উপস্থাপন করেছেন সজ্ঞানে। আর একটি কবিতায় এমিলি ডিকিনশন কিভাবে magic realism বা জাদুবাস্তবতাকে উপস্থাপন করেছেন তা তাঁর magic realism কবিতায় দেখা যেতে পারে। আমরা এই কবিতার প্রথমাংশ এখানে উদ্ধৃত করে magic realism এর উপস্থিতি লক্ষ করার চেষ্টা করব।
PLAYMATES
God permits industrious angels
Afternoons to industrious.
I met one, -- forgot my school-mates,
All, for him, straightway.
God calls home the angels promptly
At the setting sun;
I missed mine. How dreary marbles,
After playing Crown!
ঈশ্বর অনুমতি দেন পরিশ্রমী দেবদূতদেরকে
বিকালগুলোতে পরিশ্রমী খেলা খেলতে।
আমি একজনের সঙ্গে মিলিত হলাম-ভুলে গেলাম আমার স্কুলের সহপাঠীদের,
সবাই, তার জন্য সোজাসুজি এল।
ঈশ্বর দেবদূতদেরকে দ্রুত
সূর্য অস্তমিত হবার সময় ফিরে আসার জন্য ডাকলেন;
আমি নিজেকে হারালাম। বিষণœ মার্বেলগুলো,
খেলায় বিজয়মুকুট লাভের পর। ( প্রাবন্ধিকের অনুবাদ)
আপনি দেখতে পাবেন এই কবিতাটিতে একটি শিশু, (যে হতে পারে একটা ছোট্ট মেয়ে) যার মুখ দিয়ে ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে। কবিতাটির প্রথম স্তবকের তৃতীয় লাইনে মেয়েটি ঘোষণা করে একজন দেবদূতের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা।
God calls home the angels promptly
At the setting sun;
I missed mine. How dreary marbles,
After playing Crown
আমরা এই পৃথিবীতে বসবাস করি আমাদের মত । এই পৃথিবীতে আমরা স্কুলে শিশু, তাদের মার্বেল এবং সূর্যের উদয় এবং অস্ত অবলোকন করি। একটি ছোট্ট মেয়ে দেবদূতদের সঙ্গে খেলা করে। এখানেই এমিলি ডিকিনসন জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ উপস্থাপন করেছেন বিশেষ নৈপুন্যে, একথা স্বীকার করতেই হবে।
এমিলি ডিকিনসনের কবিতায় বর্ণনামূলক অনুষঙ্গ বিশেষ ভাবে উঠে এসেছে তা দেখা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। My Life had stood – a Loaded Gun –এই কবিতায় এমিলি ডিকিনসন আগের দুটো কবিতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন । আমরা এখানে এই কবিতাটির অংশ তুলে ধরছি।
My Life had stood – a Loaded Gun –
In Corners – till a Day
The Owner passed – identified –
And carried Me away –
And now We roam in Sovereign Woods –
And now We hunt the Doe –
And every time I speak for Him –
The Mountains straight reply –
আমার জীবনটা দাঁড়িয়েছিল - গুলিভরা একটা বন্দুকের সামনে-
কোণগুলোতে- পুরো একটা দিন
আমাকে শনাক্ত করে মালিক আমাকে এখানে নিয়ে আসে -
এখন আমরা সার্বভৌম বনে বনে উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরছি-
আর এখন আমরা হরিণ শিকার করছি-
প্রত্যেবার আমি ঈশ্বরের সঙ্গে কথা বলি- পর্বত সোজাসুজি জবাব দেয়- ( প্রাবন্ধিকের অনুবাদ)
এমিলি ডিকিনসনের এই কবিতার কিছুটা ক্ষোভ আছে। বর্ণনায় উঠে এসেছে বন্দুকের কথা। এখানে তিনি অনুশোচনাহীনভাবে হরিণ হত্যা করে গর্ববোধের আভাস দিয়েছেন। বন্দুকের গুলির শব্দ পর্বতে পর্বতে প্রতিধ্বনিত হয়। দেবদূতদের সঙ্গে একটা শিশুর মিলিত হওয়া এবং একজন মহিলার মৃত্যুর তারিখের দিকে যাওয়ার মধ্যে এই কবিতার পার্থক্য আছে My Life had stood – a Loaded Gun কবিতাটিতে। এই কবিতাটির বর্ণনায় একজন অনুশোচনাহীন যৌনতা ও রিরংসা জারিত শয়তানের বিপথগামীতার কথা কবিতায় উঠে এসেছে। এটা এমিলির লেখা একটি অসাধারণ কবিতা। ঘেরাটোপে আবদ্ধ আগ্রাসনের শিকার মুক্তিকামী মহিলার মুখ দিয়ে এমিলি ডিকিনশন উৎপীড়নের কথা উপস্থাপন করেছেন। তিনি এই কবিতায় বন্দুক ও পুরুষ শিকারীর মধ্যে আক্ষরিক নয় এমন সম্পর্ক স্থাপন করেছেন কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা আধিপত্যবাদী এক মহিলাকে তুলে ধরেছেন।
এমিলি ডিকিনসনের অন্যান্য কবিতার মত এক কবিতাটিতে অনেক না বলা কথা , অব্যাখ্যাত বর্ণনার সমারোহ দেখতে পাওয়া যায়। কোথা থেকে বন্দুক আসে? কেন এটার মধ্যে বোধশক্তি আছে? সত্যি কথা বলতে এ কবিতায় অপ্রকৃত অনুষঙ্গে গল্প উঠে এসেছে। এ কথা নির্দ্ধিধায় বলা যায় এমিলি ডিকিনসনের কবিতায় ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম, ফ্যান্টাস্টিক অনুষঙ্গ সহ নানা ধরনের বিষয় উঠে এসেছে।
গত শতকের পৃথিবীর নানা ভাষার কবিরা তাদের কবিতায় ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম বা জাদুবস্তবতার অনুষঙ্গ উপস্থাপন করেছেন সচেতন ভাবে অরিজোনার কবি আলবার্তো আলভারো রিওস । আলবার্তো আলভারো রিওস এর জন্ম অরিজোনার নোগালসে ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫২ সালে। তিনি আগস্ট ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত অরিজোনার স্টেট পোয়েট হিসাবে বিবেচিত হন। দশটি কাব্য, তিনটি ছোটগল্প সংকলন ও একটি স্মৃতিকথা প্রকাশ পেয়েছে।তিনি তাঁর কবিতায় magic realism বা জাদুবাস্তবতাকে উপস্থাপন করেছেন সচেতন ভাবে। আলবার্তোর লেখা কবিতা Domingo Limon ,Nani,Teodoro Luna’s Two kisses ইত্যাদি কবিতায় জাদুবস্তবতা বিশেষ ভাবে দৃশ্যমান। জাদুবাস্তবতাবাদের পুরোধা গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেস এর জাদুবস্তবতার অনুষঙ্গকে আলবার্তো তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন।আমরা একটি কবিতার উদ্ধৃত দিতে পারি।
Teodoro Luna’s Two Kisses
Alberto Alvaro Rios
Mr. Teodoro Luna in his later years had taken to kissing
His wife
Not so much with his lips as with his brows.
This is not to say he put his forehead
Against her mouth--
Rather, he would lift his eyebrows, once, quickly:
Not so vigorously he might be confused with the villain
Famous in the theaters, but not so little as to be thought
A slight movement, one of accident. This way
He kissed her
Often and quietly, across tables and through doorways,
Sometimes in photographs, and so through the years themselves.
This was his passion, that only she might see.
He might feel some movement on her lips
Toward laughter.
থিওডোরো লুনার দুটো চুম্বন
আলবার্তো আলভারো রিওস
মি. থিওডোরো লুনা তার পরবতী বছরগুলোতে চুম্বন দিয়েছিলেন
তার পতœীকে
তেমনটা তার ওষ্ঠ আর ভ্রæদ্বয় দিয়ে নয়।
এটা বলি না তিনি তার কপাল রাখেন
তার মুখে-
বরং, তিনি তার ভ্রæদ্বয় উপরে তুলতেন,একবার,দ্রæততার সঙ্গে;
তেমনটা তেজদ্বীপ্ত ভাবে তিনি বিভ্রান্ত ছিলেন না
বিখ্যাত খিয়েটারের ভিলেনের দ্বারা,কিন্তু খুব সামান্য নয় তেমন ভাবনার
একটা অল্পস্বল্প গতি,একটা দুর্ঘটনা। এই ভাবে
তিনি তাকে চুমু দিয়েছিলেন
বারবার শান্তভাবে, টেবিল পেরিয়ে আর দ্বার দেশে,
মাঝমধ্যে ফটোগ্রাফে, এই ভাবে বছর রছর তারা নিজেরা
এটাই ছিল থিওডোরো লুনার উত্তেজনা, যা একমাত্র তার পত্নীই উপলব্ধি করেন।
তিনি অবশ্যই উপলব্ধি তার পত্নীর ওষ্ঠদ্বয়ে কিছুটা স্পন্দন
আর হাসি। (প্রাবন্ধিকের অনুবাদ)
বিশ শতকে আরো অনেক কবির কবিতায় ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম বা জাদুবস্তবতার উঠে এসেছে। এই সমস্ত কবিদের মাঝে
হাঙ্গেরিয়ান কবি জর্জ এসর্টিস (George Szirtes) অন্যতম। তিনি তাঁর কবিতায় ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম বা জাদুবস্তবতাকে উপস্থাপন করেন। কবি জর্জ এসর্টিস এর জন্ম হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে ১৯৪৮ সালে ২৯ নভেম্বর। তিনি মাত্র ৮ বছর বয়সে ১৯৫৬ সালে রিফুজি হিসাবে ইংল্যান্ডের লন্ডনে চলে আসেন পরিবারের সঙ্গে। তিনি ফাইন আর্টস নিয়ে লন্ডন ও লীডসে পড়াশোনা করেন। লীডসে পড়াশোনা কালে তিনি কবি মার্টিন বেলের সংস্পর্শে এসে কবিতা লেখায় সম্পৃক্ত হন। তিনি তাঁর কবিতায় ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজমকে তুলে ধরেছেন বিশেষ অনুষঙ্গে । মানুষের কল্পনাকে
জাদুবাস্তবতায় উপস্থাপন করেছেন তিনি তাঁঁর নিচের ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম কবিতায়।
Magic Realism
When she opened her hands the butterflies emerged
from her palms. This was the first chapter.
In the second she was speaking butterflies.
In the third her eyelids opened on butterflies.
Soon enough she would become a butterfly
since this was the story, the story behind the self
made of butterflies.
ম্যাজিক্যাল রিয়ালিজম
যখন মেয়েটি তার হাতদ’খানা খুলল তখনই প্রজাপতিগুলো নির্গত হল
তার হাতের তালু দুটোর মাঝ থেকে। এইটাই ছিল প্রথম অধ্যায়।
দ্বিতীয়ে মেয়েটি কথা বলছিল প্রজাপতিগুলো।
তৃতীয়ে তার চোখের পাতাদুটো প্রজাপতিগুলোর ওপর নিবদ্ধ হল।
সামান্য সময়ের মধ্যে মেয়েটি একটা প্রজাপতি হয়ে গেল
এ থেকে গল্পটিতে। ( প্রাবন্ধিকের অনুবাদ)হ
আমরা এখন বাংলা কবিতায় জাদুবস্তবতা সম্বন্ধে আলোচনা করার চেষ্টা করব। তার আগে হাজার বছরের ঐতিহ্যে বাংলা ভাষায় কবিতা ক্রমবিকাশের ধারায় নানা পরিক্রমা সম্বন্ধে কথা বলতে হয়। কবিতার রূপ-নির্মাণে কবিরা কবিতাকে সব সময়ই নিজের মতো করে গ্রহণ করেছেন। চর্যাপদ থেকে শুরু করে কবিতার যাত্রা পথ দীর্ঘতর। মাইকেল মধুসূদন দত্তের অমিতাক্ষর ছন্দ থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ও কাব্যের মধ্যে কবিতাকে অনেক চড়াইউৎরাই পার করতে হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্ত ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এই পঞ্চ কবি বাংলা কবিতাকে ঋদ্ধ করেছেন। পঞ্চকবি বাংলা কবিতা ও গানে ভগবতপ্রেম, মানবিক প্রেম, দেশপ্রেম ও বিদ্রোহের বহি:প্রকাশ ঘাটান। বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম পরাধীন ভারতবর্ষেও ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন তাঁর কবিতা ও গানে। পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনের জন্য তাঁর অগ্নিবীণার কবিতা ও গানে অবিভক্ত ভারতের আপামর জনগণ মুক্তির মন্ত্রে। তাদের কবিতায় তেমন ভাবে জাদুবাস্তবতা বিশেষ ভাবে লক্ষ করা যায় না। আমরা প্রথমে জীবনানন্দের কবিতা উপর আলোচনা করবো। তাঁর ‘সূর্যতামসী’তে আমরা দেখতে পাই মরণের - জীবনের কথা:‘কোথাও পাখির শব্দ শুনি;/কোনো দিকে সমুদ্রের সুর;/কোথাও ভোরের বেলা রয়ে গেছে - তবে।/অগণন মানুষের মৃত্যু হ'লে - অন্ধকারে জীবিত ও মৃতের হৃদয়/বিস্মিতের মতো চেয়ে আছে;এ কোন সিন্ধুর সুর:/মরণের - জীবনের?/এ কি ভোর? (সাতটি তারার তিমির)------ সত্যি কথা বলতে জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় নিজস্ব ঘরণায় উপস্থাপন করেছেন। এর মাঝে আমরা জাদুবাস্তবতা খুঁজে পাই।
তাঁর ‘সাতটি তারার তিমির’ কাব্যের ‘সপ্তক’কে আমরা জাদুবাস্তবতা খুঁজে পাই। ‘সপ্তক’কের কয়েক পঙ্তি আমরা এখানে তুলে ধরতে পারি:‘এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে; -/ জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা।/অনেক হয়েছে শোয়া;/- তারপর একদিন চ'লে গেছে/কোন দূর মেঘে।/অন্ধকার শেষ হ'লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে ----------- ’কবি যেন এখানে জাদুকরী মননের ফসল বপন করেছেন। পরের পঙ্তিগুলোতে জীবনানন্দ আরো জাদুকরী!
সরোজিনীর চলে গেলো অতদূর? ----/পাখিদেরমত পাখা বিনা?/হয়তো বা মৃত্তিকার জ্যামিতিক ঢেউ আজ? জ্যামিতির/ভূত বলে: আমি তো জানি না।/জাফরান - আলোকের বিশুষ্কতা সন্ধ্যার আকাশে আছে লেগে:/লুপ্ত বেড়ালের মত; শূন্য চাতুরির মূঢ হাসি নিয়ে জেগে।-----
বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের হাতেই তৈরি হলো এ ধরনের কবিতা। এর বৈশিষ্ট্য হলো, তা একাধারে বহির্বাস্তবতা অন্যদিকে মনোবাস্ততাকে ধারণ করে পাঠককে জাদুবাস্ততার মধ্যে নিয়ে যায়।আঙ্গিকের এই যে নিরীক্ষা, এটাই হলো জীবনানন্দের সেই নান্দনিকতা, যার মাধ্যমে বাংলা কবিতায় ঘটল বাঁকবদল।
জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় যে রূপকল্পের অবতারণা করেছেন তাকেই রবীন্দ্রনাথ তাকে বলেছেন ‘চিত্ররূপময়তা’। দার্শনিক মনন ও মনোবাস্তবতার জন্যও জীবনানন্দের কবিতা নান্দনিকতায় যেমন ঋদ্ধ। আমাদের জানা যে বাংলা কবিতায় পরাবাস্তবতার সূচনা ঘটে জীবনানন্দের হাতে, সেই সঙ্গে ম্যাজিক রিয়্যালিজম বা জাদুবাস্তবতা । জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন‎, আকাশলীনা, আট বছর আগে একদিন, আবার আসিব ফিরে, কার্তিক মাঠের চাঁদ, আমি যদি হতাম, আমি যদি হতাম, ক্যাম্পে, গোধূলিসন্ধির নৃত্য, নির্জন স্বাক্ষর, রূপসী বাংলা, লোকেন বোসের জার্নাল,আকাশলীনা,শঙ্খমালা,সুদর্শনা ইত্যাদি কবিতায় অবশ্যই জাদুবাস্তবতা আছে।
জীবনানন্দের ‘ ক্যাম্পে ’ কবিতায় ম্যাজিক রিয়্যালিজম বা জাদুবাস্তবতা আছে কিনা বোদ্ধা কবিতা পাঠক ও সমালোচকরাভেবে দেখবার চেষ্টা করবেন। এই কবিতাটি নিয়ে অশ্লীলতার অভিযোগে বিতর্কের ঝড় ওঠে। আমরা এখানে এই কবিতা থেকে উদ্ধৃত করতে পারি । ‘ ক্যাম্পে ’ ‘একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে/সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে/দাঁতের-নখের কথা ভুলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে অই/সুন্দরী গাছের নীচে জ্যোৎস্নায়!
মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে/হরিণেরা আসিতেছে।’/তাদের পেতেছি আমি টের/অনেক পায়ের শব্দ শোনা যায়,/ঘাইমৃগী ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়।/ঘুমাতে পারি না আর;/শুয়ে শুয়ে থেকে বন্দুকের শব্দ শুনি;-------------------------------কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার;/বনের ভিতরে আজ শিকারীবা আসিয়াছে,/আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেন,/এইখানে বিছানায় শুয়ে-শুয়ে/ঘুম আর আসেনাকো/বসন্তের রাতে।’
জীবনানন্দ দাশের এই কবিতায় জাদুবাস্তবতার আভাস ফুটে উঠেছে। ‘চারিপাশে বনের বিস্ময়,/চৈত্রের বাতাস,/জ্যোৎস্নার শরীরের স্বাদ যেন;/ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে;/কোথাও অনেক বনে যেইখানে জ্যোৎস্না আর নাই/পুরুষহরিণ সব শুনিতেছে শব্দ তার;/তাহারা পেতেছে টের,/আসিতেছে তার দিকে/।আজ এই বিস্ময়ের রাতে/তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে;/তাহাদের হৃদয়ের বোন/বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে জ্যোৎস্নায়/পিপাসার সান্তনায় আঘ্রাণে আস্বাদে;/
কবি নিজেই এই কবিতা সম্বন্ধে কী বলেছেন তা দেখার আগে এই কবিতার আরো কিছুটা দেখে নিতে পারি।
“আমার ক্যাম্পে কবিতাটি সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলা দরকার মনে করি। কবিতাটি যখন শেষ হয় তখন মনে হয়েছিল সহজ শব্দে শাদা ভাষায় লিখেছি বটে, কিন্তু তবুও কবিতাটি হয়তো অনেকে বুঝবে না। বাস্তবিকই ‘ক্যাম্পে’ কবিতাটির মানে অনেকের কাছে এতই দুর্বোধ্য রয়ে গেছে যে এ কবিতাটিকে তাঁরা নির্বিবাদে অশ্লীল বলে মনে করেছেন।
কিন্তু তবুও ক্যাম্পে কবি নিজেই এই কবিতা সম্বন্ধে কী বলেছেন তা দেখার আগে এই কবিতার আরো কিছুটা দেখে নিতে পারি। নয়। যদি কোনো একমাত্র স্থির নিষ্কম্প সুর এ কবিতাটিতে থেকে থাকে তবে তা জীবনের মানুষের কীট-ফড়িঙের সবার জীবনেরই নিঃসহায়তার সুর। সৃষ্টির হাতে আমরা ঢের নিঃসহায় ক্যাম্পে কবিতাটির ইঙ্গিত এই; এইমাত্র। কবিতাটির এই সুর শিকারী, শিকার, হিংসা এবং প্রলোভনে ভুলিয়ে যে হিংসা সফল-পৃথিবীর এই সব ব্যবহারে বিরক্ত তত নয়, বিষণœ যতখানি বিষণœ নিরাশ্রয়। ক্যাম্পে কবিতায় কবির মনে হয়েছে তবু যে স্থূল হরিণ শিকারীই শুধু প্রলোভনে ভুলিয়ে হিংসার আড়ম্বর জাঁকাচ্ছে না, সৃষ্টিই যেন তেমন এক শিকারী, আমাদের সকলের জীবন নিয়েই যেন তার সকল শিকার চলেছে; প্রেম-প্রাণ-স্বপ্নের একটা ওলটপালট ধ্বংসের নিরবচ্ছিন্ন আয়োজন যেন সবদিকে---”
জীবনানন্দ পুরুষ হরিণ ও মেয়ে হরিণের সঙ্গে মানব মানবীর অনুষঙ্গকে যে ভাবে উপস্থাপন করেছেন তাতে অবশ্য জাদুবাস্তবতার পরশ আছে। তিনি এই কবিতার শেষ স্তবকে নিজের হৃদয়ের কথা বলছেন এই ভাবে:
‘কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে/তাদের মতন নই আমিও কি?/কোনো এক বসন্তের রাতে/জীবনের কোনো এক বিস্ময়ের রাতে/আমারেও ডাকেনি কি কেউ এসে জ্যোৎস্নায় দখিনা বাতাসে./অই ঘাইহরিণীর মতো?/
আমার হৃদয় এক পুরুষহরিণ/পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে/চিতার চোখের ভয় চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে/
তোমারে কি চায় নাই ধরা দিতে?’
জীবনানন্দের ‘ লোকেন বোসের জর্নাল ’এক নস্টালজিক অনুষঙ্গের কবিতা।
সুজাতাকে ভালোবাসতাম আমি -/এখনো কি ভালোবাসি?/সেটা অবসরে ভাববার কথা,/অবসর তবু নেই;/তবু একদিন হেমন্ত কাল এলে অবকাশ পাওয়া যাবে/এখন শেলফে চার্বাক ফ্রয়েড প্লেটো পাভলভ ভাবে/সুজাতাকে আমি ভালোবাসি কি না।/পুরোনো চিঠির ফাইল কিছু আছে:/সুজাতা লিখেছে আমার কাছে,/বারো তেরো কুড়ি বছর আগের সে-সব কথা;/ফাইল নাড়া কি যে মিহি কেরানীর কাজ;/নাড়বো না আমি/নেড়ে কার কি লাভ;/মনে হয় অমিতা সেনের সাথে সুবলের ভাব,
সুবলেরই শুধু? অবশ্য আমি তাকে/মানে এই অমিতা বলছি যাকে -/কিন্তু কথাটা থাক;/কিন্তু তবুও -/আজকে হৃদয় পথিক নয়তো আর,/নারী যদি মৃগতৃষ্ণার মতো - তবে/এখন কি করে মন কারভান হবে।/প্রৌঢ় হৃদয়, তুমি/সেই সব -------------প্রেম নয় তবু প্রমেরই মতন শুধু।/অমিতা সেনকে সুবল কি ভালোবাসে?/অমিতা নিজে কি তাকে?/অবসর মতো কথা ----------------সুজাতা এখন ভুবনেশ্বরে;/অমিতা কি মিহিজামে?/বহুদিন থেকে ঠিকানা না জেনে ভালোই হয়েছে সবই।
একাধারে বহির্বাস্তবতা অন্যদিকে মনোবাস্ততাকে ধারণ করে পাঠককে জাদুবাস্ততার মধ্যে নিয়ে যায় ।
জীবনানন্দ দাশ, মাত্রাচেতনা, কবিতার কথা। জনপ্রিয় জননন্দিত কবি তিনি। অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাঙালির হৃদয়াসনে স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত। নারীকে ঘিরে ভাবনায় তো জাগে, ‘প্রেম ধীরে মুছে যায়, নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, / হয় নাকি?’ প্রেম মুছে যায়, কিন্তু সত্যিই কি মুছে যায়, এই যে টানাপড়েন, এই যে অনিশ্চয়তার বোধ, এটাই তো এখনকার পাঠককে আকর্ষণ করে। বনলতা সেন, কিংবা সুরঞ্জনা এভাবেই পাঠকের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে। সুরঞ্জনার সংস্পর্শেই নারীর প্রতি সমর্পণের সৌন্দর্যটা বিচ্ছুরিত হয় এভাবে, ‘আরো আলো : মানুষের তরে এক মানুষীর গভীর হৃদয়’। কিন্তু এই নারীকে ঘিরেই ঘনিয়ে ওঠে বেদনা : ‘আহা, ইহাদেরই কানে / অনেক ঐশ্বর্য ঢেলে চলে গেল যুবকের দল; / একবার নক্ষত্রের পানে চেয়েÑ একবার বেদনার পানে।’ তবে এতকিছুর পরেও কী মধুর জীবনানন্দের নারীভাবমূর্তি, ‘এই জীবনের সত্য তবু পেয়েছি এক তিল : / পদ্মপাতায় তোমার আমার মিল। / আকাশ নীল, পৃথিবী এই মিঠে, / রোদ ভেসেছে, ঢেঁকিতে পাড় পড়ে; / পদ্মপাতা জল নিয়ে তারÑ জল নিয়ে তার নড়ে; / পদ্মপত্রে জল ফুরিয়ে যায়।’ সময়চেতনাও তার কবিতায় স্পষ্ট।জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় বনলতা সেন, সরোজিনী, সুরঞ্জনা, সুচেতনা, সবিতা, সুদর্শনা প্রভৃতি নারীর নাম ব্যবহার করেছেন। তারা একই নারীর ভিন্ন ভিন্ন নাম, নাকি প্রকৃত অর্থেই তারা স্বতন্ত্র নারী ছিলেন- এ রহস্য আজো অনির্ণীত। বনলতা সেনকে নিয়ে রহস্য আরো গাঢ় অন্ধকার।
জীবনানন্দের কবিতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সব মহৎ কবিতারই আছে বহুমাত্রিকতা। ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য’ কবিতাটিকে ঘিরে যে বিতর্ক ঘনিয়ে উঠেছিল, সেই বিতর্ক থেকেই বোঝা যায় একটি মাত্র অর্থ নয়, বহুমাত্রিক অর্থারোপের দিকেও পাঠককে টেনে নেয় জীবনানন্দের কবিতা। কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখলেন, ‘জীবনানন্দ আমাদের কালের ইতিহাসের অতীত ও ভবিষ্যতের সন্ধিক্ষণকে যে প্রতীক-নৃত্যে ধরেছেন তারই নাম ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য।’ ‘গোধূলিসন্ধির নৃত্য-
দরদালানের ভি— পৃথিবীর শেষে/যেইখানে পড়ে আছে-শব্দহীনভাঙ্গা/সেইখানে উঁচু উঁচু হরীতকী গাছের পিছনে
হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোলরাঙা-/-------------সেইখানে যুথচারী কয়েকটি নারী/ঘনিষ্ঠ চাঁদের নিচে চোখ আর চুলের সংকেতে./মেধাবিনী; দেশ আর বিদেশের পুরুষেরা/যুদ্ধ আর বাণিজ্যের রক্তে আর উঠিবে না মেতে-----------------
জীবনানন্দ তাঁর এ কবিতে জাদুবাস্তবতাকে তুলে ধরেছন আপন চিন্তাচেতনায়। জীবনানন্দ দাশ কবিতায় এক নতুন ধারা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। সেক্ষেত্রে তাঁরা ‘হয়ে উঠেছিলেন নগরমনস্ক’। এই নগরমনস্কতায় তাঁরা শুধু নিজেদের নগরেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নগরযন্ত্রণাকে কবিতায় এনে নতুন এক ধারা নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। এ ধারাতেই পরবর্তী কয়েক দশক প্রবাহিত হয়েছে।
পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের কবিতায় গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতি সম্পূর্ণভাবে ধরা পড়েছে। বাংলার গ্রামীণ অনুষঙ্গ যিনি সম্পূর্ণভাবে কবিতায় ধারণ করেছেন, তিনি কবি ওমর আলী। এ ক্ষেত্রে ওমর আলী নিজস্ব স্বকীয়তায় উজ্জ্বল। ওমর আলী অন্যতম কবি যিনি গভীর মমতায় কবিতায় জাদুবাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। তাঁর সব কাব্যের কবি জাদুবাস্তবতাকে নিখাদ অনুষঙ্গে তুলে ধরেছেন । একই সাথে গ্রামের মানুষের আনন্দ-বেদনা, দুঃসহ জীবন যন্ত্রণাকে সূ²ভাবে দেখেছেন, দেশ-কাল, সমাজ-রাষ্ট্র-স্বাধীনতা, জৈবিকতা-প্রবৃত্তি নানা বিষয় উপজীব্য করেছেন কবিতায়। বেদনার্ত মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে তাদের দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা নিজের করে পাশে থেকেছেন। তাঁর প্রত্যেকটি কাব্যগ্রন্থই এর সত্যতা বহন করে। তাঁর কবিতার নামের প্রতি দৃষ্টি দিলে বোদ্ধা পাঠক সহজেই বুঝতে পারবে তাঁর কবিতার জাদুবাস্তবতাবাদকে। তাঁর কবিতার নামগুলো হল: ‘হৃদয় ছুঁয়ে আছে ঝড়’ ,‘এ দেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি’, ‘হৃদয় ছুঁয়ে আছে ঝড়’, ‘তোমাকে দেখলেই’, ‘ডাকছে সংসার’ ‘আমার ভেতর খুব ভাঙচুর হচ্ছে’, ‘ফেরার সময়’, ‘তেমাথার শেষে নদী’, ‘অরণ্যে একটি লোক’, ‘ছবি’, ‘স্বদেশে ফিরছি’,‘ যে তুমি আড়ালে’, ‘আমার ভেতর খুব ভাঙচুর হচ্ছে’, ‘গ্রামে ফিরে যাই’, ’অরণ্যে একটি লোক’,‘ তেমাথার শেষে নদী’, ‘আত্মার দিকে’, ‘নদী, নরকে বা স্বর্গে’, ‘এখনো তাকিয়ে আছি’, ‘নিঃশব্দ বাড়ী’, ‘ভালোবাসার প্রদীপ’‘লুবনা বেগম’, ’একটি গোলাপ’ ইত্যাদি ।
‘এদেশে শ্যামল রঙ রমণীর সুনাম শুনেছি/আইভি লতার মতো সে নাকি সরল, হাসি মাখা;/সে নাকি স্নানের পরে ভিজে চুল শুকোয় রোদ্দুরে,/রূপ তার এ দেশের মাটি দিয়ে যেন পটে আঁকা-------’ কবি ওমর আলী গ্রামের সহজ-সরলা নারীদের চিত্র একেছেন। ওমর আলী পাঠককে তার কবিতায় জাদুবাস্ততার মধ্যে নিয়ে যান গেছেন তার প্রমাণ মেলে এই ভাবে:
‘তার ললিত যৌবনের/ক্ষয় কিংবা নতি দেখতে শুরু করে/কিংবা অনেকেই যুবতী হতে হতে আর যুবতী হয় না।/কিংবা,/নগরকান্দার শাহানারা শুয়ে চিন্তার ওপরে মাথা রেখে/তেলমাখা বালিশেই আলুথালু জন্মের প্রথম ভ্রƒণগর্ভে ধরেছে,/অপরিষ্কৃত দেহে মৃত্তিকাগন্ধি তার শাড়িতে শস্যের ধুলো মেখে/কুণ্ঠিত জন্ম দিতে গিয়ে বুঝি কাঁঠালিয়ার দেলোয়ারা অকালে মরেছে------’ ওমর আলী তাঁর কবিতায় প্রেমও রোমান্টিকতার স্পর্শ গন্ধ বর্ণের উপস্থিত। তাঁর ওমর কবিতায় অনেক নারীর নাম ব্যবহৃত হয়েছে। তাদের রূপের বর্ণনা দিতে গিয়ে গ্রাম-বাংলার প্রকৃতিকেই ব্যবহার করেছেন। গ্রাম-বাংলার নানা উপকরণের সঙ্গে তাদের রূপের তুলনা করেছেন। হাসিনা, জিনিয়া হোসেন, সালেহা, শাহানারা প্রভৃতি নামের উলে¬খ রয়েছে। পুরাণাশ্রিত নায়িকার নামও আছে তাঁর কবিতায়। ওমর আলী যেসব নারীর নাম ব্যবহার করেছেন, তা গ্রামীণ মেয়েদেরই নাম।কিন্তু তাঁর কবিতায় যে একাধিক নারীর নাম উলে¬খ আছে, এগুলো একই নারীকে তিনি বিভিন্ন নামে উপস্থাপন করেছেন, নাকি কবির জীবনে এসব নারী স্বতন্ত্রভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁর প্রেমিক-মানসস্বরূপটি নির্ণীত হওয়া জরুরী। যে রহস্যটি রয়ে গেছে জীবনানন্দ দাশের ক্ষেত্রেও । ওমর আলীর কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ বর্তমান আছে। বাংলা কবিতায় কবি আল মামুদ ঋদ্ধতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি নিজেই এক স্বাক্ষাৎকারে বলেছিলেন , আমার কবিতা রহস্য সৃষ্টি না করে আসঙ্গলিপ্সার কথা বলে। কবি আল মামুদ বাংলা কবিতাকে নতুনমাত্রা দান করেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ‘ লোক লোকান্তর ’ ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল: ‘ সোনালী কাবিন’,‘ মায়াবী পর্দা’ দুলে ওঠো,’‘ দোয়েল ও দয়িতা’, দ্বিতীয় ভাঙ্গন’ ,‘ তুমি তৃষ্ণা তুমিই পিপাসার জল’,‘ তোমার রক্তে তোমার গন্ধ’, ইত্যাদি। তিনি তাঁর অনেক কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ বর্তমান আছে। এটা বোঝানোর জন্য তাঁর কবিতা অবশ্যই উদ্ধৃত করতে হবে।
‘সোনালী কাবিন ’ থেকে:‘ সোনার দিনার নেই কাবিন চেয়ো না হরিণী/যদি চাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি----- কবি আল মামুদ কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গের কথা না বললেও তাঁর উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার কথা বলেছেন এভাবে: ‘আমার উপন্যাসে জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ আছে। স্বপ্ন , অলৌকিক, অশরীরি অনেক বিষয়কে গল্প বা উপন্যাস করে তুলেছি। আমি যেটা দিয়ে বলাতে চেয়েছি, সেটাই হয়ে উঠেছে এটা আমার বিশ্বাস।’তিনি তাঁর কবিতা প্রসঙ্গে জাদুবাস্তবতার কথা না বললেও জাদুবাস্তবতাকে তিনি এড়িয়ে যেতে পারেননি। তিনি এক সাক্ষাৎকারে কী বলেছেন আমরা দেখতে পারি। কবি আল মামুদ বলেন,‘ আমার কবিতায় রয়েছে দেহজ প্রেমের আধুনিক রূপান্তর।------ আধুনিক সাহিত্য ্ এটাকেই আমি মনে করি, যেখানে হয়তো মিলও আছে, ছন্দও আছে, গন্ধও আছে, সব কিছু মিলিয়ে একটা স্থাবর বা অস্থাবর কিছু তৈরি হবে। একটা ম্যাজিক তৈরি হবে। ’ তাঁর কবিতায় নারী বিশেষ অনুষঙ্গে উঠেছে। তিনি নিজেই বলেছেন,‘ নারী তো একটা কাঠামো। কবি বিভিন্ন্ জায়গা থেকে নারীকে এনে সেই কাঠামোতে বসিয়ে দেয়। কারো হাত, কারো চোখ, কারো কেশ , করো বক্ষস্থল, কারো মুখ, পা, কারো কোমর ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় থেকে এনে কাঠামোতে জোড়া লাগিয়ে দেয়। আমি সেটাই করেছি।--------’ তাঁর কবিতায় আমরা দেখতে পাই: ‘নদীর সিকস্তি কোনো গ্রামাঞ্চলে মধ্যরাতে কেউ/যেমন শুনতে পেলে অকস্মাৎ জলের জোয়ার,/হাতড়ে তালাশ করে সঙ্গিনীকে, আছে কিনা সেও/যে নারী উন্মুক্ত করে তার ধন-ধান্যের দুয়ার----- ’দুই বাংলার অন্যান্য কবিদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ,অমিতাভ দাশগুপ্ত ,উৎপল কুমার বসু ,জয় গোস্বামী,নবারুন ভট্টাচার্য , নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী,পূর্ণেন্দু পত্রী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়. মল্লিকা সেনগুপ্ত, শঙ্খ ঘোষ, সুবোধ সরকার, সুভাষ মুখোপাধ্যায়,শামসুর রহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, মাকিদ হায়দার, রফিক আজাদ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল, শহীদ কাদরী, হুমায়ূন আজাদ,হেলাল হাফিজ প্রমুখের কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ আছে কিনা বোদ্ধা কবিতা পাঠক অনুসন্ধান করার চেষ্টা করবেন বলে আশা করি।
শামসুর রাহমান এর ‘পূর্বরাগ’ কবিতায় কী বলতে চেয়েছেন তা আমরা দেখতে পারি। এ কবিতায় জাদুবাস্তবাদতার অনুষঙ্গ
আছে কিনা বোদ্ধা কবিতা পাঠক যাচাই কওে দেখবেন।
জেনেছি কাকে চাই, কে এলে চোখে ফোটে
নিমেষে শরতের খুশির জ্যোতিকণা;
কাঁপি না ভয় আর দ্বিধার নেই দোলা
এবার তবে রাতে হাজার দীপ জ্বেলে
সাজাবো তার পথ যদি সে হেঁটে আসে।
যদি সে হেঁটে আসে, প্রাণের ছায়াপথ
ফুলের মতো ফুটে তারার মতো ফুটে
জ্বলবে সারারাত, ঝরবে সারারাত।
জেনেছি কাকে চাই, বলি না তার নাম
ভিড়ের ত্রিসীমায়া স্বপ্ন-ধ্বনি শুধু
হৃদয়ে বলে নাম, একটি মৃদু নাম।
সৈয়দ শামসুল হকের অন্যান্য কবিতায় জাদুবাস্তবাদতার অনুষঙ্গ বর্তমান আছে। আমরা তাঁর পরানের গহীর ভিতর-১১ কবিতায় জাদুবাস্তবাদতার অনুষঙ্গ এখানে তুলে ধরতে পারি।
জামার ভিতর থিকা যাদুমন্ত্রে বারায় ডাহুক,/চুলের ভিতর থিকা আকবর বাদশার মোহর,/মানুষ বেকুব চুপ,হাটবারে সকলে দেখুক/কেমন মোচড় দিয়া টাকা নিয়া যায় বাজিকর ৷/চক্ষের ভিতর থিকা সোহাগের পাখিরে উড়েও,/বুকের ভিতর থিকা পিরীতের পূর্ণিমার চান,/নিজেই তাজ্জব তুমি একদিকে যাইবার চাও/অথচ আরেক দিকে খুব জোরে দেয় কেউ টান৷/সে তোমার পাওনার এতটুকু পরোয়া করে না----------------------- ’
সৈয়দ আব্দুল মান্নান বাংলা কবিতায় ঋদ্ধতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর কবিতায়ও জাদুবাস্তবাদতার অনুষঙ্গ বর্তমান আছে তার প্রমাণ পাই তাঁর লেখা‘পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ ’কবিতায়:‘পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ ঝর্না থেকে নেমে এসেছিলো। /এখন, রহস্যময় জলে, খেলা করে অবিরল। /পদ্মায় গিয়েছে একটি-- মেঘনায়-যমুনায়-সুরমায়-- /আর-একটি গোপন ইচ্ছায়। পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ /ঝর্না থেকে নেমে এসে সাঁতরে চলে বিভিন্ন নদীতে। /পাঁচটি উজ্জ্বল মাছ জলের রহস্য ভেদ করে /এখন একাকী এক শব্দহীন সমুদ্রে চলেছে। ’
হেলাল হাফিজ এর কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ আমরা দেখতে পাই।
কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট !
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
'মালটি-কালার' কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়,জয় গোস্বামী ও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী তিনটি কবিতার কিছুটা তুলে ধরব। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ’কেউ কথা রাখেনি’ কবিতার এই অংশকে দেখতে পারি জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ আছে কিনা।
বুকের মধ্যে সুগন্ধি রুমাল রেখে বরুণা বলেছিল,
যেদিন আমায় সত্যিকারের ভালবাসবে
সেদিন আমার বুকেও এ-রকম আতরের গন্ধ হবে!
ভালওবাসার জন্য আমি হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়েছি
দুরন্ত ষাঁড়ের চোখে বেঁধেছি লাল কাপড়
বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে এনেছি ১০৮টা নীলপদ্ম
তবু কথা রাখে নি বরুণা , এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ
এখনো সে যে-কোনো নারী!
কেউ কথা রাখে নি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখে না!
জয় গোস্বামীর কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ আছে কিনা তা আমরা দেখতে পারি তাঁর ‘মেঘবালিকার জন্য রূপকথা ’ কবিতা থেকে। ‘আমি যখন ছোট ছিলাম/খেলতে যেতাম মেঘের দলে/একদিন এক মেঘবালিকা প্রশ্ন করলো কৌতুহলে/
‘এই ছেলেটা, /. নাম কি রে তোর?”/আমি বললাম,/. “ফুসমন্তর !”/মেঘবালিকা রেগেই আগুন,/“মিথ্যে কথা । নাম কি অমন হয় কখনো ?”/.আমি বললাম,/“নিশ্চয়ই হয় । আগে আমার গল্প শোনো ।”/সে বলল, “শুনবো না যা-./সেই তো রাণী, সেই তো রাজা/সেই তো একই ঢাল তলোয়ার/সেই তো একই রাজার কুমার পক্ষিরাজে শুনবো না আর ।/. ওসব বাজে ।”/আমি বললাম, “তোমার জন্য নতুন ক’রে লিখব তবে ।”/সে বলল, “সত্যি লিখবি ?/বেশ তাহলে
মস্ত করে লিখতে হবে।/মনে থাকবে ?----------“তুমি কি সেই ? মেঘবালিকা /তুমি কি সেই ?’/
জয় গোস্বামীর কবিতায় জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আছে। এই কবিতার শেষ স্তবকে অবশ্যই জাদুবাস্তবতা আমরা লক্ষ করতে পাই। ‘কেউ যায় না কোনদিনই/আজ সে কবি দেখতে পাচ্ছে/সেই দেশে সেই ঝরনাতলায়/এদিক-ওদিক ছুটে বেড়ায়/সোনায় মোড়া মেঘহরিণী/কিশোর বেলার সেই হরিণী ।’
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বাংলা কবিতায় স্বমহিমার প্রতিষ্ঠিত। তাঁর কবিতায় জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আমরা দেখতে পাাই। এখানে তাঁর ‘মাঠের সন্ধ্যা ’ কবিতায় দেখবো জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ।
‘অন্যমনে যেতে যেতে হঠাৎ যদি/মাঠের মধ্যে দাঁড়াই,/হঠাৎ যদি তাকাই পিছন দিকে,/হয়তো দেখতে পাওয়া যাবে /বিকেলবেলার নদীটিকে।/ও নদী, ও রহস্যময় নদী,/অন্ধকারে হারিয়ে যাসনে, একটু দাঁড়া;/এই যে একটু-একটু আলো, /এই যে ছায়া ফিকে-ফিকে,/এরই মধ্যে দেখে নেব সন্ধ্যাবেলার প্রথম তারাটিকে।/ও তারা, ও রহস্যময় তারা,/একটু আলো জ্বালিয়ে ধর, দেখে রাখি/আকাশী কোন্ বিণœতা ছড়িয়ে যায় দিকে-দিকে,/দেখে রাখি অন্ধকারে উড়ন্তওই ক্লান্ত পাখিটিকে।/ও পাখি, ও রহস্যময় পাখি।/হারিয়ে গেল আকাশ-মাটি, কান্না-পাওয়া/এ কী করুণ সন্ধ্যা! এ কোন্ হাওয়া লেগে/অন্ধকারে অদৃশ্য ওই নদীর দুঃখ হঠাৎ উঠল জেগে।/ও হাওয়া, ও রহস্যময় হাওয়া! ’
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর আরো অনেক কবিতায় জাদুবাস্তবতা উপস্থাপিত হয়েছে। পশ্চিম বাংলার ও বাংলাদেশের অনেক কবিতায়ই জাদুবাস্তবতা অনুষঙ্গ বর্তমান আছে। সীমাবদ্ধতার কারণে বক্ষ্যমান নিবন্ধ নির্দিষ্ট আয়তনের মধ্যে রাখতে হচ্ছে।
তবুও পরিশেষে বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি নির্মলেন্দু গুণ ‘ স্বয়ম্ভূ ঈশ্বর’ নামের কবিতায় জাদুবাস্তবতা খোঁজার চেষ্টা করবে।‘যতক্ষণ জেগে থাকি, দরোজাটা বন্ধ করি না।/কেবলই মনে হয় কেউ একজন আসবে।/আমার প্রত্যাশায় এমন একজন নারী আছে,/কোনো শিল্পী যাকে আঁকতে পারেনি।/লিওনার্দো দা ভিঞ্চি,আঁরি মাতিস,/পাবলো পিকাসো অথবা যামিনী রায়,/কেউ-ই আঁকতে পারে নি তাকে।/মারকন্যার উদাস দৃষ্টির মধ্যে মুহূর্তর জন্য/আমি তাকে মূর্ত হতে দেখেছিলাম খাজুরাহে।/ব্যর্থ শিল্পী, আমার বাবার আঁকা একটি জলরঙ/ছবির ভিতরে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম তার/পেছন ফিরে তাকানোর উদ্দীপক সলজ্জ ভঙ্গিটি।/যদিও আমি জানি যে, সে-ছবির মডেল ছিলেন/আমার সিক্তবসনা মাতা, আমার জননী।/এভাবেই কুড়িয়ে পাওয়া খন্ড দৃশ্যগুলোকে/মালার মতো গেঁথে যদি তাকে আঁকা যায়,/আমার মনে হয় না তাতেও খুব একটা লাভ হবে।/কেননা, শিল্পমাত্রই তো অনুকৃতি, বাস্তবের/অথচ আমি যার কথা ভাবি, যার জন্য/অন্ধকারের দুয়ার খুলে দিয়ে বসে থাকি অপেক্ষায়-/তাকে আমি কোনদিন বাইরে দেখিনি।/তাই কেমন করে বলি, তাকে কেমনতরো দেখায়?/সে তো গাছের ফুলের মতো নয়,/সে তো আকাশের বৃষ্টি ভেজা/সহজলভ্য চাঁদের মতো নয়।,/সে অন্যরকম। ভীষণ অন্যরকম।/তার যুগলস্তনের দুর্গে মাথা কোটে অরন্য-পর্বত।/তার উড়ন্ত ঊরুযুগে পদানত মেঘের উর্বশী।
প্রজননের সঙ্গে অসম্পৃক্ত তার গর্ভদেশ।/তার যুগলব্যাকুলবাহু পুরুকে আলিঙ্গনে জড়িয়ে/রাখা ছাড়া আর কোনো জাগতিক কর্তব্য শিখেনি।/আমি চাই সে আমার জাগরণের মধ্যে আসুক।
কারো কন্যারূপে নয়, কারো ভগ্নিরূপে নয়,/কারো বধূররূপে নয়, কারো মাতৃ রূপে নয়,/জগৎ-সংসারের সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে/সে আসুক, স্বয়ম্ভূ সুন্দর।
কবি নির্মলেন্দু গুণ এই কবিতায় নিচের অংশে তিনি তাঁর মন মননের সাহার্যে কল্পনার যা তুলে ধরেছেন তার মাঝে জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আছে।‘সে যখন সম্পূর্ণ নিরাভরণ, তখন যেমন/উলঙ্গতার আচ্ছাদনে সে চিরআবৃতা, তেমনি,/যখন সে কল্পনার অন্ধকারে ছায়াবৃতা;/তখনও আমার দৃষ্টির মধ্যে সে চির-নগ্ন।/আমি যাচ্ঞা করি সেই চির-নগ্নিকাকে।’কবিতায় পোস্ট মর্ডানিজম বা উত্তরাধুনিকতার সূত্রপাত করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন আশির কবিতা। এ দশকের বেশ কিছু কবিতায় নির্মিত হয়েছে নিজস্ব স্বপ্নের, কাঙ্খার। কবি খালেদ হোসাইনের ‘জলজ পাথর’ কবিতাটি আমরা এখানে তুলে ধরতে পারি। অজস্র স্বাক্ষর শেষে মৃত্যুকে যথার্থ মনে হয় গøাস বোতলের পাশে ছাইদানি, /একা মোমবাতি /উৎসব শেষ হলে সবকিছু ক্লান্তিকর লাগে /জলেরও আকাশ আছে পাতালের অযুক্তি আবেগ।
সত্তরের রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আবিদ আজাদ, ত্রিদিব দস্তিদার, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, নাসির আহমেদ, আবু হাসান শাহরিয়ার প্রমুখ এ আন্দোলনের অগ্রপথিক ছিলেন। পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ সত্তরের দশকের শেষদিক থেকে শুরু করে আশির পুরোটা সময়ে জুডয়েই বাংলাদেশের স্বৈরশাসন, অত্যাচার নিপীড়েনের বিষয়গুলোকে নথিভুক্ত করতে শুরু করেন আশির কবিরা কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে তাদের কবিতায় ঢুকে যায় পোস্টমর্ডানিজম বা উত্তরাধুনিকতার যার অন্যতম প্রধান কারণ লিটল ম্যাগাজিন চর্চা। অস্বীকার করার পথ নেই বাংলাদেশের কবিতার প্রথম আধুনিকতার সূচনালগ্নে লিটল ম্যাগাজিনের চর্চা বলবৎ ছিল এবং যার কারণে বাংলা কবিতা ক্রমাগত উৎকর্ষে পথে হেঁটেছে কিন্তু উত্তরাধুনিকতার নামে পশ্চিমা সংস্কৃতি আর সেই ঘরানার কবিতা চর্চা আশির দশকে পুরোপুরি শুরু হয়। আশির দশকে কবিদের মধ্যে সাজ্জাদ শরিফ, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, খোন্দকার আশরাফ হোসেন, রেজাউদ্দিন স্টালিন, ফকির ইলিয়াস,আবদুল হাই সিকদার, সুহিতা সুলতানা, মাসুদ খান, কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
তাদের অনেকের কবিতায়ই জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আছে।খোন্দকার আশরাফ হোসেনের কবিতায় জাদুবাস্তবতার পরশ পাই : তোমাকে দেখেছি অলিম্পাসের তুষারধবল /চূড়ার মহিমায়/ তুমি ধরে আছ দুই হাতে বজ্র আর অশনির চাবুক /তুমি সেমিলির ঘরে যখন স্বর্ণবৃষ্টি/হয়ে নেমেছিলে, অপার তৃষ্ণায় /তোমার প্রেমের দান ভেবে ঘরে নিয়ে- /ছিলাম আগুন। রোদ্দুরে নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি
সহস্র শতাব্দী দিয়ে নিজেকে গড়েছি
আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি।'
জাতিসত্তার কবি ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহাম্মদ নূরুল হূদার কবিতায় অবশ্য জাদুবাস্তবতা ছোঁয়া আছে। তিনি লিখেছেন-----
রোদ্দুরে নেয়েছি আর বৃষ্টিতে বেড়েছি
সহস্র শতাব্দী দিয়ে নিজেকে গড়েছি
আমরা তামাটে জাতি, আমরা এসেছি।'(


অনেক কবিই তাদের কবিতায় যা যা লিখেছেন তার মাঝে তাদের অজান্তেই জাদুর ছোঁয়া ফুটে উঠেছে। আমরা প্রসঙ্গক্রমে প্রবাসী সাহিত্যিক সালেহা চৌফুরীর বলতে পারি।তিনি মূলত অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক হলেও সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে‘ দলছুট শব্দরা’।তার একটি কবিতার এক অংশ----- ’বিন্দুর মাঝেসিন্দু আবিষ্কারের অভীপ্সায়’----- ‘ বালতিতে এক হাঁটুজল/ সেই দিকে চেয়ে/ সকালেরআলোতে ভাবছি সাগরের তল।’


ফকির ইলিয়াসের ‘ভরচৈত্রের ছায়াগ্রহণ’ কবিতায় জাদুবাস্তবতা লক্ষ করা যায়।
পথ্য হাতে চাঁদসুন্দরীরা-/হাত বুলায় মেঘের মাথায়। দীর্ঘজীবী হও/
রাতের শূন্যতা,/বলতে বলতে তারাগুলো হারিয়ে যায় জোনাক সংসারে/আগামী বসন্তে ভরচৈত্রের ছায়াগ্রহণ শেষ হলে/
যে পাখি দেশান্তরি হবে-/তার জন্য কয়েকটি পাপড়ি জমিয়ে রাখে সতীর্থরা/জমিয়ে রাখে কয়েকটি পাথর।
এখন আমরা নব্বইয়ের দশক কবিদের কবিতায় জাদুবাস্তবতা দেখার চেষ্টা করব। নব্বইয়ের দশকে মধ্যে উল্লেখযোগ্য দাউদ আল হাফিজ, আলফ্রেড খোকন, ওবায়েদ আকাশ, কুমার চক্রবর্তী, চঞ্চল আশরাফ, টোকন ঠাকুর, পাবলো শাহি, মজনু শাহ, মুজিব ইরম, শাহনাজ মুন্নী, সরকার আমিন, হেনরী স্বপন, কচি রেজা, কবির হুমায়ুন, কামরুজ্জামান কামু, তপন বাগচী, ব্রাত্য রাইসু, মতিন রায়হান, মাতিয়ার রাফায়েল, মারজুক রাসেল, মুজিব মেহদী, রণক মুহম্মদ রফিক, রহমান হেনরী, রিষিণ পরিমল, সাখাওয়াত টিপু, সৌমিত্র দেব প্রমুখ, তুষার গায়েন, সুনীল আচার্য প্রমুখ।
দাউদ আল হাফিজ নব্বইয়ের দশক কবিদের অন্যতম।দাউদ আল হাফিজের বাংলা কবিতার সবুজ মাঠে নব্বইয়ের দশক এ বিচরণ। তাঁর ‘পাতাঝরার গান এবং ঝরাপাতার সঙ্গীত’, ‘আলো, আরো আলো’ ও ‘জেরুজালেমে একদিন তিনহাজার বছর আগে’ কবিতাত্রয় ঋদ্ধতার স্বাক্ষর বহন করে। পরবর্তীতে তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘আনাবাস অথবা দ্বিধার গন্ধম’ । ‘ হঠাৎ বৃষ্টিতে’,‘নারী(রহস্য)’,‘ হাওয়াসম্বাদ’, ‘ অনঙ্গরঙ্গ’, ‘ অনাবাস’ ইত্যাদি কবিতায় জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আছে ।
তাঁর ‘হঠাৎ বৃষ্টিতে’ কবিতাটি এখানে উদ্ধৃত করতে পারি। রমণীর নগ্নহাত/বুকে মাখে বৃষ্টির তুমুল/ আদর। কটিতে যুবতীপ্রহর/ নীলিমায় বোনে অন্ধকার/মেঘনীল চুলের বাহার!’ তাঁর লেখা‘ হাওয়াসম্বাদ’ কবিতায় জাদুবাস্তবতা আছে কিনা তা দেখার দায়িত্ব বোদ্ধা পাঠক হাতে ছেড়ে দিলাম। ‘ হাওয়াসম্বাদ’-‘একটি কুমারী পাতা ছটফট কেবল কাঁপে/ আশরীর স্বপ্নশিহরণ/একটি
অনূঢ়া পাতা টলমল উচাটন হাওয়ায়/ অনঙ্গ-অঞ্জন চোখে/ একপাতা ছিন্নযোনি শান্ততপোধীর স্বপ্নে দেখে/ অনাঘাতা যোনি/একটি হলুদ পাতা শুধুই হু হু করে হুহু কাঁপে/ হিমেল হাওয়ায়--------’
কবি টোকন ঠাকুরও নব্বইয়ের দশকের কবি। তাঁর একটি কবিতা আমরা এখানে তুলে ধরলাম জাদুবাস্তবতার ছোঁয়া আছে কিনা দেখার চেষ্টা করব।
দেখি রাক্ষসের মুখ, পাই ডাইনির নিঃশ্বাস
আয়নার মধ্যে তাকিয়ে নিজেকে রাক্ষস মনে হলো!/
সঙ্গে সঙ্গে রাক্ষসের মানে, সংক্ষিপ্ত বাঙলা অভিধানে পাওয়া গেল- নরখাদক জাতি, নিশাচর,. কর্বূর, প্রাচীন অনার্যজাতি ইত্যাদিৃ যদিও, রাক্ষসের একটা অপ্রত্যাশিত ভয়ঙ্কর মুখচ্ছবি /আঁকা আছে মনুষ্যকুলের মনে।/ এটা জানি, কারণ এদ্দিন আমিও মানুষের রোল /প্লে করে এসেছি। এদ্দিন আমিও মানুষ ছিলাম।/
কিন্তু আজ! আজই, নাকি কয়েকদিন ধরেই, যখনই আয়নার/সামনে গিয়ে নিজেকে দাঁড়াই, বিলিভ ইট, আমার চোখেই ধর./পড়ে আমি একটা রাক্ষস! আমার সারামুখে ডাইনিদের/ মিহি-নিঃশ্বাসের আঁচে পৃথিবীগ্রহের মায়াময় ম্যাপ আঁকা হয়ে /চলেছে, মুখ বিভাজিত হয়ে পড়েছে---
কবি ও সাহিত্য সম্পাদক ওবায়েদ আকাশের কবিতায় আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গে জাদুবাস্ততাকে আমরা খুঁজে পাই। তাঁর ওবা
আঙুল কবিতার একটা অংশ এখানে তুলে ধরতে চাই।যেমন এক্ষুণি পালাল বৃষ্টিদৃশ্য, ফাঁকি দিয়ে/
তার পিঠভর্তি মেঘ, অনন্য আঙুলের ক্রাচ/দেখো, উড়ন্ত নীল, অসীমে--/বলেছি আগুনের ঘোড়া/আজ নমস্য বৃষ্টির দিনে পালাতে চেয়েছে--/আজ, উৎসব তাই--/আমরা বিস্তৃত অরণ্যের ঘুমে/আগুনের ঘোড়াগুলো উড়ে যেতে দেখি/
একুশ শতকের প্রথম দশকের কবিরা বাংলা কবিতায় নতুন মাত্রা দান করেন। প্রথম দশকের কবিদেও মধ্যে নাম থেকে অতনু তিয়াস, অবনি অনার্য, এহসান হাবীব, কাজী নাসির মামুন, তারেক আহসান, পিয়াস মজিদ,, মনির ইউসুফ, মাসুদ হাসান, রনি অধিকারী প্রমুখ। তাদের কারো কারো কবিতায় জাদুবাস্ততা উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। রনি অধিকারী একজন উদীয়মান কবি। তাঁর অনেক কবিতায়ই জাদুবাস্ততা ছোঁয়া আছে। উদাহরণ হিসাবে তাঁর লেখা রনি অধিকারী এই কবিতার কথা বলা যেতে পারে।
পথের মাঝেই পথ খুঁজে ফেরা
পথভোলা এক নির্মম রহস্য
যা ছুঁয়ে যায় হাজার রহস্যের কল্পতরু বীজ
এক-দুই-তিন এভাবে কেটেছে...
দিন-মাস-বছর- শতাব্দী।
আগুনের নদী হয়ে এভাবে জীবন
চলে বোধহয়!
অনিষ্ট সাধনে যেন বদ্ধ পরিকর
গুপ্ত হত্যাকারী মৃত্যুর উপহার সাজায়,
অতঃপর সমাধি।
কী এক অদ্ভুত মৃত্যু কুড়াতে কুড়াতে,
মৃত্যু কুড়ানি ছেলে... রহস্যময় হয়ে ওঠে,
সে এক সুন্দর সর্বনাশ!
মৃত্যু -সমাধি-শান্তি। শান্তি শান্তি
হত্যাকারী অনুশোচনায় থমকে দাঁড়ায়
দ্রাবিড় সভ্যতায়।আর আমি!
ভীরু ভালবাসায় ভৈরবীতে ভেসে
এসেছিলাম যেন নিদারুণ বেশে,
তখন অনুতাপের আগুনে পুড়ে
স্বর্গ হলো নিষিদ্ধ নগরী।
এভাবে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মগডাল উঠে
আচানক ভাবি -
মৃত্যুর মাঝেই যেন ফিরে আসে,
অনন্ত জীবন।
বাংলা কবিতায় জাদুবাস্তবতার অবস্থানের কথা বলতে হয় জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, কবি অচিন্ত্য সেনগুপ্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ওমর আলী, আল মামুদ, নির্মলেন্দু গুণ প্রমুখ কবিরা তাদের কবিতায় সচেতন কিংবা স্বভাবিক ভাবেই জাদুবাস্তবতাকে তুলে ধরেছেন। তরুণ প্রজন্মে অনেক কবিদের কবিতায় জাদুবাস্তবতা উপস্থাপন করে বাংলা কবিতায় নতুন মাত্রা দান করেছেন এবং করছেন। বারান্তরে তাদের কবিতায় জাদুবাস্তবতার অনুষঙ্গ উপস্থাপনে সচেষ্ট হবো বলে আশা করি।
0

প্রবন্ধ - হিন্দোল ভট্টাচার্য

Posted in





মৃত্যুর আগে মানুষের শেষ কিছু নি:শ্বাসের মতো যে লেখা লিখিত হয়, তাকে বোঝার চেষ্টা করি। বিড়বিড় বিড়বিড় করে প্রতিবাদ হয় না, আমি এ কথা মানি না।অসুন্দরের সামনে সুন্দরই হল প্রতিবাদ।নিষ্ঠুরতার সামনে প্রেম। ধর্ষণের সামনে আদর।
এ পৃথিবী খুব সুন্দর। তাকে যারা নরক বানিয়ে রেখেছে, তারা মৃত্যুকে জানে না। এক মুহূর্তে এই সমগ্র জগৎ থেকে তুমি হারিয়ে যাবে। এক মুহূর্তের মধ্যে তোমার গর্ব, অহঙ্কার, ইন্দ্রিয়সুখ, হিংসা, হিংসে, ক্ষমতা, লোভ হারিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবে তোমার খ্যাতি, যশ, চালাকি আর যুদ্ধগুলো।
মৃত্যুর আগে মানুষের শেষ কিছু নিঃশ্বাসের মতো, মৃতপ্রায় মানুষের বাঁচার আকুতির মতো আরও কয়েকদিন থেকে যাওয়া যাক।
মৃত দেহ পড়ে আছে। মানুষ মানুষকে অপমান করছে, হত্যা করছে। পড়ে আছে গাছের কাটা দেহ। মাটির উপর রক্ত। ধানগাছের গায়ে রক্ত, লোভ বমি করতে করতে মানুষ ভাবছে তারা মৃত্যুর চেয়েও দীর্ঘস্থায়ী।
সব ক্ষমতাই ক্ষণস্থায়ী। ক্ষণস্থায়ী সব দেশ। সব ধর্ম।
শূন্যতার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া এ জীবনের কিছুই থাকে না। ক্ষমতা, ইতিহাসের এক একটি মূর্খ অধ্যায় ছাড়া আর কিছু না।
আসল কথা হল মানুষের প্রতিরোধ। সংগ্রাম। যুদ্ধ।
গুহামানবের মতো, আসুন আদর করি আমরা একে অপরকে। মৃত্যুকে সামনে রেখে, আসুন, একটা গান গাওয়া যাক।ভালোবাসার গান।
মানুষ মানুষের হাত ধরে আছে,, এতেই প্রমাণিত, তুমি হেরে গেছ। এসো, হাত ধরো মানুষের। একবুক শ্বাস নাও। নক্ষত্রের দিকে তাকাও। গাছের দিকে তাকাও। রোদের দিকে তাকাও।
তুমি যত ভোগ করতে পারো, তার অনেক বেশি ত্যাগ করতে পারো বন্ধু।
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in
























ফ্লককে নিয়ে বের্নহার্ড বেশ কয়েকবার হাঁটতে গেছে। ফ্লকের গায়ের পশম আসলে সাদা। যদিও একেবারে ফুটফুটে সাদা রাখা বেশ ঝামেলার কাজ। উদাহরণস্বরূপ, আজ ফ্লকের গায়ের পশমের রঙ ছিটছিটে ধূসর। ইনেস সেই কারণে সবার কাছে ক্ষমা চাইল। বলল যে দুর্ভাগ্যবশত আজ সে ফ্লককে ভালোভাবে স্নান করাবার মত যথেষ্ট সময় পায়নি। তাছাড়া গৃহভৃত্য ফ্রান্‌জলও আজ আগে বেরিয়ে গেছে।

‘তোমার বন্ধু ফ্রান্‌জল’… গের্টকে বলে ইনেস… ‘তোমাকে শুভেচ্ছাসহ শ্রদ্ধা জানিয়েছে।’ গের্ট ফ্রান্‌জলকে বেশ পছন্দ করে। ফ্রান্‌জল সুপুরুষ, দীর্ঘদেহী, সোনালি চুল, বলিষ্ঠ গড়ন। দেখেই বোঝা যায় যে বের্নহার্ডের চেয়ে অনেক বেশি শক্তি ধরে সে, যদিও তার চেয়ে মোটে এক বছরের বড়।

গের্টের ফ্রান্‌জলকে নিয়ে বাড়াবাড়ির ব্যাপারটা ইনেস একেবারেই ভালো চোখে দেখে না। যদিও ফ্রান্‌জল সম্বন্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু, সে সবসময় বলে যে সে এটাই বুঝে উঠতে পারে না যে আসলে গের্ট তার বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা করতে আসে, নাকি ফ্রান্‌জলের সঙ্গে।

‘অন্তত ফ্লককে ফ্রান্‌জল তোমার চেয়ে ভালো ভাবে সামলে রাখতে পারে’… গের্ট বলে ইনেসকে, ‘ফ্রান্‌জলকে তোমার হিংসে করার কোনো কারণ নেই।’

কিন্তু কারণ যে আছে সেটা ইনেস একটুও না হেসে প্রকাশ করে। সে মনে করে গের্টের উপর তারই অধিকার। তাছাড়া গের্ট যে অকারণে ফ্রান্‌জলকে আহ্লাদ দিয়ে এবং সিগারেট দিয়ে বিগড়ে দিচ্ছে, সেটা তার একেবারেই অপছন্দ।

বের্নহার্ডের কাছে এই আলোচনাটা খুবই হাস্যকর বলে মনে হয়। যদিও ইনেসের কণ্ঠস্বর শুনে আবার তার মনে হয় যে বিষয়টা যথেষ্ট গুরুগম্ভীর হয়ে উঠছে। তার একটু অস্বস্তি হতে থাকে, যেটা কাটানোর জন্য সে ফ্লকের গায়ে হাত বোলাতে থাকে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ইনেস অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। এখন সে ‘বের্শেন, বের্শেন’ বলে আহ্লাদে বের্নহার্ডের গলা জড়িয়ে ধরে বসে আছে। কিছুটা ধারের দিকে সরে গিয়ে মাঝখানে তার বসার জন্য আরেকটু জায়গা করে দেয় ইনেস। সামনে এগিয়ে চলেছে তারা। শহর ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মাঠঘাট পেরিয়ে চলেছে। দিগন্তরেখার কাছে যে গাঢ় রেখাটা দেখা যাচ্ছে সেটা দূরের জঙ্গল। পথের ধারে বাচ্চাকাচ্চার দল তাদের গাড়িটা দেখে হাত নাড়ছে, হইহই করে ডাকাডাকি করছে। পথের ধুলো উড়ছে। বাইরের হাওয়ায় বের্নহার্ডের মনে হচ্ছে যে তার দম বন্ধ হয়ে যাবে এখনই।



গের্ট এবং ইনেস… এই দু’জনের মাঝখানে বসে থাকাটা যথেষ্ট কঠিন এবং ক্লান্তিকর। রীতিমত ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে বের্নহার্ডকে। তাদের বাক্যালাপে মধ্যস্থতা করতে হচ্ছে তাকে।

- ‘ইনেস… সামলাও একটু, ফ্লককে সামলাও। আমায় বিরক্ত করছে ফ্লক।’… গের্ট চিৎকার করে। গের্টের কথাগুলো আবার ইনেস শুনতে পাচ্ছে না হাওয়ায়।,

-‘বের্শেন, ও কী বলছে?’ ইনেস বের্নহার্ডকে জিজ্ঞেস করে। বের্নহার্ড ফ্লককে টেনে নিয়ে এসে তার দুই হাঁটুর মাঝে বন্দি করে রাখবার চেষ্টা করে। তারপর আবার ইনেস শুরু করে…

-‘গের্ট, তুমি গতকাল এলে না কেন? প্রফেসর তোমার খোঁজ করছিলেন। তিনি বললেন যে গত তিন সপ্তাহে নাকি তোমাকে একবারের জন্যেও ক্লাসে দেখেননি। তার সঙ্গে একবার অন্তত দেখা কোর তুমি; ভীষণ দরকার।’

-‘আমি একটা কথাও বুঝতে পারছি না।…গের্ট চেঁচিয়ে ওঠে।

-‘ভীষণ দরকার প্রফেসরের সঙ্গে দেখা করা…’বের্নহার্ড ইনেসের কথার পুনরাবৃত্তি করতে শুরু করে। কিন্তু বাক্য সম্পূর্ণ হবার আগেই গের্ট তাকে থামিয়ে দেয়…

-‘এই ‘দরকার’ শব্দটা শনিবারে একদম নিষিদ্ধ বের্শেন। তুমি আজ অনেকবার এই শব্দটা উচ্চারণ করে ফেলেছ।’



ওরা আজ অনেকদূর চলে যাচ্ছে শহর ছাড়িয়ে। একটা বড় লিনডেন গাছের নিচে বসে ওরা কফি খায়। বের্নহার্ড লক্ষ্য করে যে এর মধ্যেই পাঁচটা বেজে গেছে। আজকের ট্রেনটা সে আর ধরতে পারছে না।

-‘অসাধারণ’ গের্ট বলে ওঠে… ‘আজ তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে। বাড়ি যেতে হবে না। তুমি এখন ঠিক করে ফেলো কার সঙ্গে আজ শোবে? আমার সঙ্গে নাকি ইনেসের সঙ্গে? আমরা বৃদ্ধ দম্পতি সেজে এখন তোমার বাবা মা কে জানিয়ে দিচ্ছি ফোন করে যে তুমি আমাদের সঙ্গেই আছো।’



বের্শেন মরিয়া হয়ে উঠেছে বাড়ি ফিরবার জন্য। যদিও সে গের্টের সামনে সে কথা প্রকাশ করে না। কারণ, গের্ট এরকম কিছু শুনলেই হাসাহাসি, ইয়ার্কি শুরু করবে। তবে বের্নহার্ডের মুখচোখ দেখে সে প্রশ্ন করে…

-‘তোমার বাবা মা খুব রাগ করবেন বুঝি?’

-‘হ্যাঁ।’

-‘আমি ফোন করলেও রেগে যাবেন?’

-‘হ্যাঁ।’

-‘যাচ্ছেতাই ব্যাপার। তুমি তোমার বাবা মাকে একদম ঠিকঠাক শিক্ষা দিতে পারনি।’



কিন্তু ইনেস ঠিক করে যে এরকম অবস্থায় বের্নহার্ডকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে। ইনেস ব্যাপারটা এত সহজে সমাধান করে ফেলে যে কারোর আপত্তি করবার কিছু থাকে না।

ওদের পৌঁছাতে প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে যায়। বের্শেনের নরম চেহারার মা খুবই চিন্তিত ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে বের্নহার্ড মাঝপথে কোথাও হারিয়ে গেছে। কারণ যে ড্রাইভার স্টেশনে গিয়েছিল বের্নহার্ডকে আনতে, সে খালি গাড়ি নিয়ে ফিরে এসেছে অনেকক্ষণ।



বের্নহার্ডের বন্ধুরা একসঙ্গে রাতের খাবার খাবে এখন। বের্নহার্ডের ছোট বোন মনি রাতপোশাক পরেই বসবার ঘরে চলে এসেছিল দাদার বন্ধুদের দেখবে বলে। সে ভারি আশ্চর্য হল পুরোদস্তুর ‘এক ভদ্রলোক এবং এক ভদ্রমহিলা’ দেখে। গের্ট যখন তাকে কোলে নিয়ে নিজের হাঁটুর উপরে বসিয়ে রেখেছিল, তখন অচেনা লোকজন দেখে মনি কাঁদোকাঁদো মুখ করে বসেছিল। অবশেষে ফ্লককে দেখে তার সাহস আবার ফেরত এল। প্রথমে সে হাল্কা হাল্কা করে ফ্লকের ঘাড়ে মুখে হাত বোলাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল মনি ফ্লকের সঙ্গে খেলতে খেলতে মেঝেতে কার্পেটে লুটোপুটি খাচ্ছে এবং দুজনেরই গলা দিয়ে আহ্লাদের, খুশির শব্দ বেরিয়ে আসছে। তার মধ্যেই রাতের খাবারের জন্য ডাক পড়ল এবং বের্নহার্ডের বাবা তার কাজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বের্নহার্ড তার বন্ধুদের সঙ্গে বাবার আলাপ করিয়ে দিল। তবে তাকে খুবই অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল। সবাই বসবার ঘরের লাগোয়া খাবার ঘরে এল। টেবিলে দুটো রূপোর বাতিদান সাজানো আছে। দুটো পরিষ্কার ন্যাপকিন রাখা আছে অতিথিদের চেয়ারের সামনে। রাতের খাবার বের্নহার্ডের কাছে আজ খুব আহামরি কিছু মনে হচ্ছিল না। সে নিজের জায়গায় চুপচাপ বসে খেতে লাগল। মায়ের নানা প্রশ্নের জবাবে এক দুটো হুঁহাঁ করছিল। তার মা তার দিকে হাসিমুখে চেয়ে বসেছিলেন। কিন্তু সে অন্যমনস্কভাবে খাবার খেয়ে যাচ্ছিল। তার বাবা ইনেস এবং গের্টের সঙ্গে নানা কথাবার্তা বলছিলেন। তার মনে হল যে বাবার ইনেসের সঙ্গে কথা বলতে বেশ ভাল লাগছে। বাবা এমন এক দুটো কথা বলছেন, যেটা থেকে পরিষ্কার যে ইনেসের সুন্দর চেহারা নিঃসন্দেহে তার মনে ছাপ ফেলেছে। ইনেসের নরম বাদামী ব্লন্‌ড চুলের গুচ্ছ, যা তার সুন্দর মুখমণ্ডল ঘিরে রয়েছে, তা যেকোনো মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। তার ধূসর চোখে বুদ্ধিমত্তার ঝলক দেখে বোঝা যায় যে সে সবকিছু মন দিয়ে এবং হৃদয়বত্তা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে। তার হাসিও উজ্জ্বল, বন্ধুত্বপূর্ণ। সে কখনই খুব জোরে কথা বলে না। বরঞ্চ থেমে থেমে ধীরে সুস্থে উষ্ণতার স্পর্শ দিয়ে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করে। ইনেস এখন তার বাবার সঙ্গে লাল ওয়াইন এবং সাদা ওয়াইনের পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করছে। একই রকম দক্ষতা নিয়ে সে গের্টের সঙ্গে অটোমোবাইল নিয়ে অথবা বের্নহার্ডের সঙ্গে সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করতে পারে। কখনই এমন মনে হয় না যে মেয়েটার মধ্যে এতটুকু দেখানেপনা আছে, কিম্বা ভান করছে, কিম্বা এমন কিছু বলছে, যেটা অসহ্য এবং একঘেয়ে। ইনেসের এই ব্যাপারটাই বের্নহার্ডের খুব ভাল লাগে। আমাদের সবার মধ্যে ইনেস সেরা… খাবার খেতে খেতে ইনেসের দিকে তাকিয়ে এই কথাটা ভাবতে থাকে বের্নহার্ড।


(চলবে)                 

0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in




















১৬

মোষের গোয়াল। এখন ওখানে ছাই আর খড়ের সাহায্যে গোয়ালের ভিজে মেজে পরিষ্কার করা হচ্ছে। মোষের পেচ্ছাপের ঝাঁঝ ছাইগাদায় চাপা পড়লেই যে পরিষ্কার করছিল সে বুঝে যায় –হ্যাঁ, মেজে সাফ হয়েছে বটে। লোকটা ছাইয়ের উপর একটা লম্বা চওড়া চাটাই বিছিয়ে দিল। তার উপরে একটা ভয়ংকর জমকালো রঙের শতরঞ্জি , তার এক কোণে লেখা—ন্যায় পঞ্চায়েত, ভীখমখেড়া, অর্থাৎ ভীখমখেড়া গ্রাম-পঞ্চায়েতের বিচারসভা।

এবার লোকটা সতরঞ্চির মাঝাখানে একটা কাঠের সিন্দুক আর ময়লা থলে রাখল। তারপর বাইরের বাঁধানো চাতালে গিয়ে দু’বারের চেষ্টায় যতটা থুতু ফেলা যায় সেটা সেরে একটা বিড়ি ধরাল।

শিবপালগঞ্জ গ্রামসভাও এই ন্যায় পঞ্চায়েত, ভীখমখেড়ার অধীন। কুশহরপ্রসাদ এখানে ওর ছেলে ছোটে পালোয়ানের বিরুদ্ধে বাপকে ভালো মতন ঠ্যাঙানোর অভিযোগে মামলা ঠুকেছে। আজ তার তিন নম্বর শুনানি। প্রথম দুই দফায় কাজ বলতে এইটুকু হয়েছিল যে কুশহর এবং ছোটে পালোয়ান—বাদী এবং বিবাদী- হাজির ছিল। পঞ্চদের অনুপস্থিতিতে মামলার শুনানি হতে পারেনি।

চাতালে বসে বিড়ি-ফোঁকা লোকটা পঞ্চায়েতের চাপরাশি। বিড়ি শেষ করে আবার দুই দফা থুতু ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে নিজের মনে বলল—ওরা কোথায়? মরে গেছে নাকি?

তারপর কোন উত্তর না আসায় আরেকটা বিড়ি ধরিয়ে ফেলল।

একটু পরে দেখা গেল চারজন একসঙ্গে হেঁটে এদিকে আসছে। দু’জন বাপ আর ছেলে—কুশহরপ্রসাদ এবং ছোটে পালোয়ান। অন্য দুজন পঞ্চায়েত সদস্য বা পঞ্চ। কুশহরপ্রসাদের মাথায় দুটো আঘাতের হালকা চিহ্ন রয়েছে আর সেটাকে সবাইকে দেখানোর ইচ্ছেয় ও নেড়া মাথা হয়ে এসেছে। এখন মাথার উপর মরুভূমিতে আঘাতের দুটো দাগ বেশ স্পষ্ট।

ওরা এসে সতরঞ্চির উপর বসে পড়ল। কিন্তু ছোটে পালোয়ান ওখান থেকে বেরিয়ে খোলা আকাশের নীচে রোদ পোহাতে লেগে গেল। একজন পঞ্চ চাপরাশিকে জিজ্ঞেস করল—সরপঞ্চ (মোড়ল) এখনও আসেন নি?

“এখন কী করে আসবেন?”, চাপরাশি জবাব দিল,” শিবপালগঞ্জ গিয়েছিলেন। তহসীল অফিসে কোন কাজ ছিল। বোধহয় সেখানেই আটকে গেছেন”।

গ্যাঁজানো জমে উঠল। একজন পঞ্চ কুশহরকে জিজ্ঞেস করল—‘এখন তোমার চোট কেমন? ঘা’টা শুকিয়েছে মনে হচ্ছে’?

কুশহর খকখক করতে লাগল। তারপর মুখ ফুলিয়ে বলল—আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ? ওই যে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আমাদের শ্রবণকুমার! ওকেই শুধোও না!

ছোটে পালোয়ান নিজেকে শ্রবণকুমারের রোলে ভাবতে রাজি নয়। কাঁধে বাঁক নিয়ে তার থেকে বাবা-মাকে মুরগীর মত ঝুলিয়ে চলা অত্যন্ত লজ্জাজনক। এসব তো মজদূরের কাজ! ও রেগে গেল। বলল—‘এখানে শ্রবণকুমারের বাপও এক শ্রবণকুমার। ওকেই প্রশ্ন কর। আমাদের বংশে সব শালাই শ্রবণকুমার; শ্রবণকুমারের ঝাড়’!

এক পঞ্চ ওকে বাধা দিল। “গালাগালি করবে না ছোটে। এতে আদালতের অসম্মান হয়”।

ছোটে উত্তর দিল,” শালা কোন গালি নয়”।

এটা বলে ওএসে সতরঞ্চির উপর বসে পড়ল। হঠাৎ খেয়াল হল পঞ্চেরা রেগে যাচ্ছে। তখন ও মুচকি হেসে এমন ভাব করল যেন এতক্ষণ হাসিঠাট্টা চলছে। তাই ডায়লগ ঝাড়ল-“চৌদ্দটা বাচ্চার বাপ হয়েছি আর আমাকেই শেখাবে মেয়েমানুষ কী জিনিস! আমাকে বলছ সালে বলা মানে গালি দেয়া? আরে, এ’তো কথাবলার একটা ঢঙ। আমার কথাবলার কায়দাই হল সালে দিয়ে শুরু করা”।

একজন পঞ্চ আপত্তি করল-না, সালে বলা তো গালি দেয়া!

ছোটে পালোয়ান ফের হাসল, যেন ভালমানুষ সেজে পঞ্চায়েতের সহানুভূতি আদায় করবে। এবার বলল, “ গালি! আসল গালি তো শোননি পণ্ডিতজী! কানে ঢুকলে কলজে নড়ে উঠবে”।

বৈঠকে ঢুকেই সরপঞ্চের (পঞ্চায়েত প্রধান) মনে হল দেরি হওয়ার কারণটা সাথীদের জানিয়ে দেয়া দরকার। উনি গুনগুন স্বরে বলতে লাগলেন।

“চারদিকে দুর্নীতি! তহসীল অফিসে একটা দরখাস্ত দেয়ার ছিল। ভেবেছিলাম পেশকারের হাতে ধরিয়ে চলে আসব। কিন্তু ও বলল- তহসীলদারের সঙ্গে সওয়াল- জবাব শেষ করে যাও”।

একজন পঞ্চ এই কৈফিয়ত মন দিয়ে শোনেনি। সে একটু চড়া সুরে বলল—“তবুও অনেক দেরি হয়েছে। একটা বাজতে চলল। হিন্দুস্থানীদের এই একটা খারাপ অভ্যাস। ইংরেজরা এই ব্যাপারে থিক ছিল। সময়ের খেয়াল রাখত”।

সরপঞ্চ বেশ জোর দিয়ে বলল—“ঠিক আছে। তুমি তো হাজির হয়েছিলে। তুমি কোন ইংরেজের থেকে কম নাকি”?

এবার ওসতরঞ্চির মাঝখানে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে চাপরাশিকে বলল—“শুনানি শুরু করা যাক। হাঁক পাড়ো”।

চাপরাশি দেখেছে যে বাদী-বিবাদী দুই পক্ষই হাজির। তবু দুষ্টুমি করে আদালতের নকল করে উঁচু গলায় হাঁক দিল—‘কুসহর বনাম ছোটে, কেউ হা-আ -আ-আ--- জির’?

ছোটে খেঁকিয়ে উঠল—“হাজির তো বটেই! দেখতে পাওনি? চোখ নাকি জামার বোতাম”?

সরপঞ্চ প্রশ্ন করল-‘পঞ্চায়েত -মন্ত্রী আজও আসে নি”?

‘ওনার শালার ভায়রাভাইয়ের ঘরে আজ কোন অনুষ্ঠান আছে। উনি সেখানেই গেছেন। আমার বাড়িতে খবর পাঠিয়েছেন’। একজন পঞ্চ বা পঞ্চায়েত সদস্যের মন্তব্য।

“এই পঞ্চায়েত মন্ত্রীটিও না, একটি অকর্মার ধাড়ি,-- শিকারের সময় কুত্তার হাগা! প্রত্যেকবার কাজের সময় ফাঁকি। কোন ফাইলটা কোথায় রেখেছে—এটা কে বলবে? নিজে গেছেন নেমন্তন্ন খেতে, আমি রয়েছি ফাইল খুঁজতে”।

সরপঞ্চ রেগে গিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলেন। ছোটে পালোয়ান এসবে কান না দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। সরপঞ্চের অনুযোগ ফুরোয়নি।

-‘ওই ব্যাটা পঞ্চায়েত-সচিব গতবার যখন টাকাপয়সার তছরূপের দায়ে ফেঁসেছিল তখন দিনে চারবার আমার ঘরে আসত। এমন জুতো ঘষেছিল যে আমার দরজার সামনের ধূলো সাফ হয়ে গেছল। এখন এদিকে আসতে হলে এড়িয়ে যায়, অজুহাত খোঁজে। ব্যাটা খানদানী বদমাশ”স্ক

ছোটে পালোয়ান অন্যমনস্ক হয়ে চাতালের সামনের নিমগাছের দিকে তাকিয়েছিল। হঠাৎ কথা কানে যেতেই চমকে উঠে বলল—‘ সারপঞ্চজী, বদমাশ বললে কাকে’?

সরপঞ্চ চিড়বিড়িয়ে উঠলেন। “তোমার কেন খুজলি হচ্ছে? এতক্ষণ পঞ্চায়েত -সচিবের কথা হচ্ছি্ল। এবার তোমার বদমাইশির ফাইল খুলল বলে—দেখতে থাক”।

ছোটে উঠে পড়ল। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, ‘এখানে কোন মোকদ্দমা করা বেকার। সরপঞ্চ তো প্রথম থেকেই আমাকে বদমাশ ঠাউরে বসেছেন। ফয়সালা আর কী হবে’?

কুসহরপ্রসাদ এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। হঠাৎ উঠে পড়ে ছোটে পালোয়ানকে বলল—ঠিক আছে। এবার চল, যাওয়া যাক।

তারপর বোধহয় মনে পড়ল যে ছেলের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা ওই দায়ের করেছে। ঘাবড়ে গিয়ে ধপ করে বসে নিজের বোকামিকে ঢাকতে গিয়ে বলল—‘ যখন মামলা এখানে দায়ের হয়েছে, তখন পুরো শুনানি এখানেই হবে। সরপঞ্চজীই ফয়সলা করবেন’।

চাপরাশি চাতালে বসে ওখান থেকে সব দেখছিল। সে এবার বলে উঠল—‘ঠিক বলেছ কুসহর! কেউ বলল—আমার মা ফের বিয়ে করেছে। তো অন্যজন বলল—খারাপ কাজ। তখন ছেলে বলল—বিয়ে করে ফের তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে। অন্যজন বলল—আরও খারাপ।

এই হল বেত্তান্ত। তুমি যখন ছেলের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা শুরু করেই দিয়েছ তখন মাঝখানে দোনোমোনো করার কোন মানে নেই’।

কুসহর চাপরাশির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল যার অর্থ ফালতুলোকও যদি কাজের কথা বলে তখন পালটা জবাব দিতে নেই। তারপর ও ছোটে পালোয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল—‘বসে পড়। আজ মোকদ্দমা হয়েই যাক’।

ছোটে বলল—‘বাপু! তুমি তো দুমুখো সাপ। সামনে পেছনে দু’দিকেই চলতে থাক। এখানে আমাকে শুরুতেই ‘বদমাস’ বলে দিয়েছে। আগে আর কী শুনব? আমি চললাম’।

ও যাবার উপক্রম করতেই সরপঞ্চ হুংকার দিয়ে উঠল—‘এখান থেকে চলে গেলেই হল? এটা কী ইয়ার্কি হচ্ছে? গেলে হাতকড়ি লাগিয়ে টেনে আনব। ভালয় ভালয় বসে যাও। মোকদ্দমা হতে দাও’।

ছোটে পালোয়ান পাত্তা দিয়ে বলল,- এসব আমাকে শিখিও না। আমি তোমার এখানে মোকদ্দমায় রাজি নই। উঠে সোজা ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে যাব আর তোমার শুনানি আটকে দেবার জন্য আর্জি পেশ করব, আজকেই’।

এই পঞ্চায়েতি আদালতে একজন পঞ্চ ছিল যে রাষ্ট্রসংঘের সেই সব সদস্যদের মত, যারা মূল সমস্যা থেকে সরে গিয়ে বিশুদ্ধ নীতির কথা আওড়ায়। এই কায়দায় তারা বাস্তবিক কারও বিরোধ করে না, বদলে অন্যরাও এদের বিরোধিতা করে না। “জনগণ শান্তি চায়”, “আমাদের সভ্যতার ভিত্তি হল বিশ্বভ্রাতৃত্ব এবং ভালবাসা” গোছের কেতাবী বাকতাল্লা শুনে পাজির-পাঝাড়া দেশও সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। তাতে ওই রাজনীতিবিদের দম্ভ হয় –কেমন খাঁটি কথা বললাম!

তো আমাদের পঞ্চটিও ওইরকম ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে একটি খাঁটি কথা বলার চেষ্টা করলেন—‘ পালোয়ান, শোন। পঞ্চ হল পরমেশ্বর। এই ন্যায়ের আসনে বসে কেউ অন্যায় করতে পারেনা। মুখের ভাষা যাই বেরিয়ে থাক, কলম যখন চলবে তখন ন্যায়োচিত রায়ই বেরোবে। বসে পড়’।

এই নিরামিষ বাণী পালোয়ানকে বেশ প্রভাবিত করল। ধপ্‌ করে মেজেতে বসে বিড়বিড় করতে লাগল—‘আমি কি জানতাম যে পঞ্চদের কলম আসল, মুখের কথা নকল? কিন্তু তুমি যদি ন্যায়বিচারের ভরসা দাও তো আমি বসতে রাজি’।

পঞ্চ উবাচ,” হ্যাঁ, হ্যাঁ। ভরসা দিচ্ছি তো। তুমি এখানে দম লাগিয়ে মোকদ্দমা লড়ো, সারাজীবন লড়তে থাক; কিন্তু রায় তো কলম দিয়েই বেরোবে’।

কোন নাটক -নৌটংকী ছাড়াই এত সহজে সমস্যার সমাধান হবে-- এটা চাপরাশির ঠিক হজম হল না। সে বলে উঠল—“ কথাবার্তার কোন দাম নেই, পণ্ডিতজী? এটা কী বললেন? কথায় আছে না—মরদের বাত আর ঘোড়ার লাথ কখনও বিফল হয় না”।

সরপঞ্চ মনে মনে নিজের ভুল বুঝে অস্বস্তি বোধ করছিল। চাপরাশিকে ধমকে উঠল—‘কতবার বলেছি মুখটা বন্ধ রাখতে! তা না, সবসময় নিজের চরখা চালানো চাই। দেব নাকি একটা কষে’?

পঞ্চ –একে ছাড়ুন, ফাইল খুলুন।

ফাইল খোলা হল। সরপঞ্চ একজন পঞ্চকে বলল—পড়ুন, কুসহরের জবানবন্দী আসামীকে পড়ে শুনিয়ে দিন।

পঞ্চ ভদ্রলোক ফাইলটা এমন করে এদিক সেদিক উলটে পালটে দেখতে লাগল যেমন কোন হিন্দি জানা ব্যক্তি তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম লিপিতে লেখা দস্তাবেজ নেড়েচেড়ে আবার মাতৃভাষাতেই ফিরে আসে।

এবার ও একটা ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলল—“আপনি থাকতে আমি আর কী পড়ব? আপনিই পড়ে মোকদ্দমা শুরু করুন”।

ফাইল নয় তো যেন গরম পোড়া আলু! রাষ্ট্রসংঘ- ছাপ পঞ্চ ওটাকে নেড়েচেড়ে সরপঞ্চকে ফেরত করে দিল। সরপঞ্চ এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে অন্য পঞ্চের হাতে চালান করে দিল। দ্বিতীয় পঞ্চ ফাইলের এককোণায় একটা গোল সীলকে খুব মন দিয়ে দেখছিল। হঠাৎ ফাইল এক নম্বর পঞ্চকে ধরিয়ে দিল। এভাবে ফাইলটি কয়েক হাত ঘুরে উদ্ধার হয়ে গেল।

শেষে বাদী কুসহরপ্রসাদ বলল, ”সরপঞ্চজী, পঞ্চায়েত সচিব তো আজ আসেননি। আপনারা এই ফাইল নিয়ে লেখাপড়ার ঝামেলায় কতক্ষণ ফেঁসে থাকবেন? তারচেয়ে নতুন তারিখ দিয়ে দিন। মোকদ্দমা পরে হবে’খন”।

সরপঞ্চ বীরমূর্তি ধরলেন। “তুমি এসব কী বলছ কুসহর? যে সেপাই হয়ে বন্দুকের গুলি দেখে ঘাবড়ে যায় আর যে সরপঞ্চ হয়ে লেখাপড়ায়, তার তো---“।

ছোটে পালোয়ান হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙল, চটচট শব্দ শোনা গেল। তারপর চড়া স্বরে বলল—একঘন্টা ধরে তোমরা কেবল তিন-তেরো করে যাচ্ছ। মোকদ্দমা করবে, নাকি ছোলা ভাজতে থাকবে”?

এটা শোনামাত্র সরপঞ্চ মামলা শুরু করে দিল। ফাইলটা পড়ার ফের চেষ্টা করতে লাগল। একটা পাতা বের করে নিজের মুখের কাছে ধরল। ওর ঠোঁটের কোনায় থুতু জমল। চোখের কোনা কুঁচকে গেল। সেখানে কাকের পায়ের নকশা ফুটে উঠল। মনে হচ্ছে, এটা ওনার জীবনের দুর্লভ মুহুর্ত।

এবার ফাইল ওনার মুখের একেবারে সামনে। উনি একটা লম্বা শ্বাস টানলেন। তারপর ফাইলের একটা পাতাও না চিবিয়ে সবটুকু মেজেতে পটকে দিয়ে বললেন—“আমি কুসহরপ্রসাদের বক্তব্য পড়ে নিয়েছি। ওবলছে যে ওর ছেলে ছোটে ওকে অকারণ লাঠিপেটা করেছে। এটা ‘তাজিরাত হিন্দ’ (ইন্ডিয়ান পেনাল কোড) এর ধারা ৩২৩ এর নালিশ”।

ছোটে এমনভাবে বসে রয়েছে যেন মামলাটার সঙ্গে ওর কোন সম্বন্ধ নেই। সরপঞ্চের দুই ভুরুর মাঝে একটা পাতলা লাইন ফুটে উঠল। উনি প্রশ্ন করলেন, “বল কুসহর, ব্যাপারটা এই তো? আসামী ছোটে তোমাকে পিটিয়েছে”?

--“হ্যাঁ সরপঞ্চজী, হাজার লোকের সামনে মেরেছে। আমার হাড়-পাঁজরা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে”।

সরপঞ্চ গম্ভীর হলেন,” ভেবে কথা বল কুসহর। যদি হাড় ভেঙে গিয়ে থাকে তাহলে মামলা অনেক সঙ্গীন। ফের তোমাকে শহরের আদালতে যেতে হবে। এখানে শুধু ধারা ৩২৩ এর শুনানি হয়। ধারা ৩২৫ লাগলে শহরে গিয়ে কলের জল খাওয়া ছাড়া নিস্তার নেই”।

কুসহর কিছু ভেবে বলল, “আচ্ছা সরপঞ্চজী, আমার হাড়-পাঁজরা সত্যিই ভেঙেছে নাকি? ও তো একটা কথাবলার ভঙ্গী। তবে ও আমাকে খুব মেরেছে। খড়ের গাদায় লাঠিপেটা করার মতন। এই দেখুন, মাথায় এখনও ঘা’ রয়েছে। ও ব্যাটা আমার ছেলে নয়, দুশমন”!

একজন পঞ্চ চাটাইয়ের এক কোনা চেপে বসে চুপচাপ মালা জপছিল। কপালে শ্বেত তিলক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা! বয়সে প্রবীণ। দেখলে মনে হয় ইনি রাশিনক্ষত্র- তিথি -লগ্ন এসবের বিচারে পটু। পুরুতের কাজ করেন এবং বৈদ্যজীর ভূমিকায় চিকিৎসাও করেন। এবং এসব করে গ্রামীণ এলাকায় বেশ সুখে আছেন। শুধু তাই নয়, সুযোগ পেলে ওনার প্রতিভার জাদু শহুরে এলাকাতেও দেখাতে পারেন। ওখানে গিয়ে বড় বড় অফিসারের সাড়ে সাতি বা শনির দশা দূর করে এবং প্রমোশন বা বিলেত যাত্রা নিয়ে ভবিষ্যতবাণী করে ওদের থেকে মোটা দক্ষিণা এবং তার চেয়ে বড় সরকারী অনুদান বাগাতে পারেন।

কুসহরের মুখ থেকে যেই শুনলেন যে ছোটে ওর ছেলে নয়, দুশমন –অমনি ওনার মালা জপা থেমে গেল। ্মুখ থেকে বেরিয়ে এল—হে প্রভো!

ছোটে গলা খাঁকরে এই উক্তির সমর্থন করল। সরপঞ্চ বললেন—“ কী ব্যাপার! বড় কাশি উঠছে যে”?

পালোয়ান বলল, “আমার বাবা বিধবার মত কান্নাকাটি শুরু করেছে। ওর কথা আগে শুনে নাও। আমার কাশির হিসেব তারপরে কর”।

সরপঞ্চ কুসহরকে বললেন, “তোমার হাড়-টাড় ভাঙেনি তো? তাহলে মামলাটা ধারা ৩২৩ এর মোতাবেক হবে”।

একটু থেমে কথাটা দ্বিতীয়বার বললেন, “তাহলে মামলাটা ধারা ৩২৩ এরই হবে। লাঠি চলেছে, কোঁচ-বর্শা তো চলেনি? যদি চলে থাকে তো এখনই বলে দাও । তখন মামলাটা ৩২৫ হয়ে যাবে”।

এবার কুসহর গেল ঘাবড়ে। “না না সরপঞ্চজী, আমাদের কোঁচ-বর্শার কাজ নয়। সাতপুরুষ ধরে আমাদের বংশে শুধু লাঠিবাজীই হয়েছে”।

উনি বললেন—“ ঠিক। কুসহর, এবার বলো ছোটে তোমাকে মারল কেন”?

ছোটে বলল, “ও আর কি বলবে, আমিই বলছি”।

সরপঞ্চ মুচকি হাসলেন। “মোকদ্দমায় নম্বর হিসেবে চলতে হয় পালোয়ান। প্রথমে ফরিয়াদী, তারপর আসামী। ঘাবড়িও না, তোমার নম্বরও আসবে”।

--“কে ঘাবড়াচ্ছে! আর তুমিও ঘাবড়িও না। ভগবান চাইলে একদিন তোমার নম্বরও এসে যাবে”।

সরপঞ্চ এর জবাব না দিয়ে কুসহরকেই ফের জিজ্ঞেস করল,”তো বলে ফেল ভাই, ছোটে তোমাকে মারল কেন”?

--“কী আর বলব। কেন মারল? নতুন শিঙ-ওঠা বলদ কেন কাউকে গুঁতোয়—এটা কোন প্রশ্ন হল? নওজোয়ান, তায় পালোয়ান। গাঁয়ে কেউ সাহস করে এর সঙ্গে লড়তে যায় না। তো এর শরীর মসমস করে, হাত চুলকোয়। এসবের জ্বালায় আমার গায়েই হাত তুলল—“।

-“একদম ভুল। একহাতে তালি বাজে না। তুমিও কিছু-না-কিছু অবশ্য করে থাকবে”।

কুসহর গলার স্বর নরম করে বলল,”আমি কী করতে পারি সরপঞ্চজী? আমি কি ছোটের সঙ্গে কুস্তি লড়ব”?

সরপঞ্চজী মুখ বেঁকালেন। নীচের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে যেন খুব চিন্তা করছেন এমন ভঙ্গীতে বললেন, “তুমি এত সোজা নও কুসহর। এখানকার আদালত তোমাকে হাড়ে হাড়ে চেনে। আমি গোপনে চর লাগিয়ে আসল ঘটনা জেনে নিয়েছি। এই বয়সেও তোমার মেয়েবাজির সখ যায়নি। আমাকেই ঢপ দিচ্ছ মহারাজ? তুমিও কিছু কম নও”।

কুসহর বলল, “সরপঞ্চজী, আমাকে বাড়িতে লাঠিপেটা করল। আর এখানে তুমি কথার ঘায়ে মারছ , এটা কী রকম ন্যায়”?

মালা জপতে থাকা পঞ্চ সরপঞ্চকে বলল, “যা ঢাকা রয়েছে তা ঢাকা থাকুক প্রভো! আর তুমি বেশি খুঁচিও না কুসহর মহারাজ! তুমি ভারি মহাত্মা! সব জানা আছে”।

ইউএনও মার্কা সত্যবাদী পঞ্চ সরপঞ্চকে বলল, “মামলা চলুক। কুসহর যাই হোক, যেমনই হোক, আমাদের সামনে মামলাটা তো ৩২৩ ধারার। ওতেই লেগে থাকুন”।

কিন্তু সরপঞ্চের মাথায় মামলার গরম চড়ে গেছল। তেরিয়া হয়ে বলল, “তুমি কী জান কোথায় কী হচ্ছে? একটু আগে তহসীল অফিস থেকে ফিরছিলাম। পথে অনেকের সাথে কথা হল। শনিচরও ছিল। সবাই যা যা বলল, শুনে কান নোংরা হয়ে গেল। এই কুসহর কারও চেয়ে কম নয়। যতটুকু মাটির উপরে ততটাই মাটির নীচে। গ্রামের---“।

এই অপমান কুসহরকে ধ্বসিয়ে দিল। ও অসহায় ভাবে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। বয়সকালে ও খুব গরম মেজাজের ছিল, তবে সবটাই মারপিটের সময়ে। কায়দা-কানুনের সামনে ও সবসময় দীনহীন। এই সময় ও দশদিকেই হাতজোড় করতে লাগল। ওর চোখ থেকে দুঃখ ঝরে পড়ল বলে।

কিন্তু দুই পঞ্চ আর সরপঞ্চ আরামসে বসে চুপচাপ ওর কাহিল অবস্থা দেখে চলেছে। কুসহর এবার ধীরে ধীরে মাথা তুলে ছোটে পালোয়ানের দিকে তাকাল। আর ওদিকে দেখতেই ওর মুখ হাঁ হয়ে গেল।

ছোটের ভ্রু টেরা হয়েছে, ঠোঁট শক্ত করে চাপা। ও নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে উঠে সরপঞ্চকে বলল , “এই কথার পাঁচফোড়ন! টিকটিক করা বন্ধ কর। একটা কানের নীচে তড়াক্‌ করে দিলেই ফাইল-টাইল নিয়ে মাটির নীচে সেঁধিয়ে যাবে। দু’ঘন্টা ধরে দেখছি, আমার বাপকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হারামী বলা হচ্ছে। আমার বাপ হারামী হলে তোমার বাপ কী”?

বলতে বলতে ছোটে’র আওয়াজ গমগম করে উঠল। “আমি এখনও মরে যাইনি। যদি আসল বাপের হোস্‌ তো আমার বাপকে গালি দিয়ে দেখ”।

চারপাশে সন্নাটা! চাপরাশি ধীরে ধীরে চালের অন্য দিকে সরে গিয়ে বেড়ালের মত একলাফ দিয়ে লুকিয়ে পড়ল। সরপঞ্চ হতভম্ব। মালা জপতে ব্যস্ত পঞ্চ চোখ বুঁজে বলল—প্রভো!

ছোটে একইভাবে গর্জাতে লাগল।–“এ প্রভো! তোমার মালাটালা মুখে ঠুঁসে পেট দিয়ে বার করব। এই প্রভো-প্রভোওয়ালা তামাশা পিচ করে বেরিয়ে যাবে। তুমিও আমার বাপকে গালি দিচ্ছিলে”।

কুসহরের মুখে এবার বোল ফুটল,” এ ছোটুয়া! ঢের হয়েছে। এবার চুপ কর। আদালতের ব্যাপার। উল্টে মামলা হতে পারে”।

“তুমি এইসব ভেবে চুপ করে থাক বাপু। আমি সব জানি। কাল শহরে যাচ্ছি। আর এদের বিরুদ্ধে মামলা লাগিয়ে আসছি। ব্যাটারা ভরা সভাতে তোমাকে না জানি কী কী সব বলেছে! যদি এদের এক-একটাকে জেলের কোঠিতে চাক্কি না পেষাই, তো আমি তোমার পেচ্ছাপ থেকে পয়দা হইনি”।

এইসব বলতে বলতে ও কুসহরের হাত ধরল এবং একরকম হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে বাইরে নিয়ে গেল।

(চলবে)




0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(শেষপর্ব)

ঠিক ৫ বছর পরে

.........................

বর্ধমান রাজাদের অনুগ্রহে গোলকপতির পাকাপোক্ত জীবিকার ভিত্তিটি পোক্ত হয়ে গেছিল রানীমা বিষণকুমারীর বদান্যতায়। যদিও রানীমা এখন আর ইহলোকে নেই তবুও গোলকপতির কর্মদক্ষতা ও সততার সাথে বর্তমানের রাজা তিলকচাঁদেরও কোন বিরোধ হয়নি বলে সে এখনও টিকে আছে।

পুরনো ও বিশ্বাসী যে ক'জন রাজকর্মচারী আপাতভাবে বিষণকুমারীর আমলে রাজবাড়িতে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত হয়েছিল তাদের মধ্যে অতিগোপন ষড়যন্ত্রসম্পর্কিত নানা সংবাদের সরবরাহকারী ও বাজার সরকার গোলকপতিকে যে কেন তিনি বহাল রেখে দিলেন তার উপযুক্ত কারণটি বোধহয় বর্ধমানেশ্বরী মহাদেবী সর্বমঙ্গলা ছাড়া আর কারুর গোচর নয়। যদিও শাস্ত্রমতে রুধিরপ্রিয়া গৌড়েশ্বরী তাঁর অনন্তকালের প্রশ্রয়ে সেন রাজাদের সর্বদা পালন করে এসেছেন বলে জনশ্রুতি, তাই বোধহয় এই দূর্ভাগা বংশাবতংশটিকে তিনি মহাকারুণ্য থেকে আর বঞ্চিত করেননি।

....

তন্তুবায় গৃহে তাদেরও সেই ঘনায়মান রাত্রির মধুক্ষরা পরিণতিটি শেষঅবধি বেশীদিন অধরা থাকেনি। পরদিন খুব ভোরে এদের আশ্রয়টি ত্যাগ করে ও দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রীধনের হস্তধৃত গোলকপতি সেদিন অতি সগৌরবে রাজবাড়ি ফিরে এসেছিল।

শৈলবালার সীমন্তরেখায় প্রাকপ্রত্যূষে তার প্রদত্ত রক্তধারার রক্তিম অভিজ্ঞানটি এক অলৌকিক উপায়ে মন্ত্রশুদ্ধি হয়ে আজীবন থেকে গেছিল বলে ক্রমে সে ভুলতে পেরেছিল আজীবনের জন্মযন্ত্রণাটিকে।

সংসারে বাঁধা পড়ার এত স্বাভাবিক উদ্যোগটিও বহু ঘটনার পরে যে এভাবে স্থিতি হতে পারে সেটা প্রাকচল্লিশ বছর বয়স হবার আগে সে তা ভেবে ওঠার অবকাশ পায়নি।

.....

প্রিয় জন্মভূমিতে ভারতের মুকুটহীন রাজাটির আর ফিরে আসা হলনা। দিনসাতেকের মেনিনজাইটিস রোগের প্রকোপে নবদিগন্তের রেশটিকে বয়ে এনে পূর্বাচলের মাটিতে তাই আর জানানো হলনা আগামীকালের পটপরিবর্তনের ইতিকথা। রাজা ঘুমিয়ে পড়লেন মসৃণ তৃণরাজি বিধৌত আর্নেস্ট ডেল এর প্রান্তরে। সফেন সমুদ্রের অবিরল মুখরতা যেন সশ্রদ্ধ চিত্তে ঘুমপাড়ানি গানের তালে তালে যেন তাঁকে কেবল বলে উঠতে লাগল,

" পিতা নোহসি

পিতা নো বোধি

নমস্তেহস্তু,

........মা মা হিংসীঃ।"

......

তবে ভারতবর্ষ থেকে এর কিছুকাল পরেই আসবেন রামমোহনের অভিন্নাত্মা আর একজন বঙ্গসন্তান। শবদেহটি পুনরোত্থানের পর ব্রিস্টলে আবার নতুন করে যেমন গড়ে তুলে দিয়ে যাবেন একটি চারুময় শ্রদ্ধাবেদী, আবার তেমনই মাটি কিনে যাবেন এই দেশেই, চিরশয়ানের দিনে বন্ধুর উষ্ণতাকে আবার বরণ করে নেওয়ার দিনে। রামমোহনের সেই অনুজপ্রতীম বন্ধুটির নাম, দ্বারকানাথ ঠাকুর! তিনিও বিলেতের মাটীতে পা রাখতে চলেছেন.....কালসন্দর্ভ যে তাঁকেও খুব শীঘ্র আহ্বান করবে এখানে আসার জন্য !

......

বদনতলার মাঠ যেখানে ক্ষীরপাশা গ্রামের দিকে বেঁকে গেছে নিস্তব্ধ পর্থপ্রর্দশনার আবহে সেখানে ক'দিন হল এক বৃদ্ধ তান্ত্রিক এসে কুটির বেঁধে রয়েছেন। সাধকটি মাতা রুদ্রাণীর অনুগামী। এখন বঙ্গালের আকাশে বাতাসে প্রবল নিনাদে বৈদেশিক শাসকের রণভেরী বেজে চললেও গ্রামেগঞ্জে এখনও দু'চার জন অবধূত বা বজ্রযানী সাধকদের দেখা মেলে। তবে এঁরা জনবহুল স্থান সাধারণতঃ এড়িয়ে চলেন বলে জনমানসে এঁদের প্রচার কম।

সাধক কেনারাম তেমনই একজন সাধক।সহজিয়া মাতৃকাপূজনের যে রীতি রাজা রামকৃষ্ণ, রামপ্রসাদ বা কমলাকান্তের মত কবিমনষ্ক উন্মার্গীদের সাথে আমাদের দেখা করিয়ে ভাবতরঙ্গে ভাসিয়ে এসেছেন, ইনিও তাঁদের সুযোগ্য উত্তরসূরী।

কুটিরে বসে সন্ধ্যাহ্নিক শেষ করে তিনি আজ বড় উতলা। পল-অনুপলে তাঁর যেন কার জন্য আজ মন বড় চঞ্চল! কৌশিকী অমাবস্যার পূণ্য তিথি আজ প্রায় সমাপনের পথে! কিন্তু সে কি আজকে আর আসবেনা? সাধক জানেন আগামী চতুর্দশীর দিনেই তিনি ভববন্ধন পার করে সাধনমার্গে উত্তরণ করবেন চিরকালের মতন।

চিন্তা যে একটাই তাঁর অবর্তমানে রুদ্রাণী ও মহাভৈরবের পবিত্র শিলাদুটি কার দায়িত্বে রেখে যাবেন? কে তবৃ বংশপরম্পরায় এসে তাঁর বসতভিটার রক্ষয়িত্রী সেই ক্ষীণকটি ও দীর্ঘকায়া কালীমূর্তিটির সম্বৎসরের পূজার ভার

নেবে? মহাদেবীর এই পূজনরীতি হস্তান্তর না করতে পারা অনুশোচনাটি নিয়েই কি তবে ছাড়তে হবে ব্যর্থকাম জীবদেহটিকে?

দক্ষিণা কালিকা'র স্তবমন্ত্র নীরবে জপ করতে করতে শুনতে পেলেন অদূরে একটি পদশব্দ যেন এগিয়ে আসছে তাঁর দিকেই! এ যেন কেবল এক আগমন নয়, যথার্থ যুগপরিবর্তনের ভারপ্রাপ্ত এক যুগলের চরণধ্বনি যেন !

সাধক যেন নিজের ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্নার ত্রিবেণী সঙ্গমে যেন টের পেলেন উদ্দীপনের সংকেতবার্তা।

....

গোলকপতি কাছাড়িবাড়িতেই এক মুৎসুদ্দীর কাছ থেকে ক'দিন হল পেয়েছে এক সাধকের আগমনবার্তা। তাই সে তার তিনমাসের সদ্যজাত শিশুটি ও তার মাতাটিকে নিয়ে এসেছে সাধকের আশীর্বাদসহ পদরেণু সংগ্রহ করতে।

.....

সাধক কেনারাম উৎসুক দৃষ্টিতে গোলকপতিদের শিশুসন্তানে দেহলক্ষণটি দেখে আশ্বস্ত হলেন। তার পর শৈলবালার নতমুখটি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দ্বারা ঈষৎ উপরে তুলে ধরে শান্ত স্বরে বললেন,

" মা..শৈল...আমায় চিনতে পেরেছিস্ তো?...আমি কিন্তু তোকে ঠিক চিনেছি! "

শৈলবালা তখন অস্ফূট কন্ঠে ডুকরে উঠে বলল,

" একী! মাধবকাকা! আপনি একোনো বেঁচে আছেন? কাকীমা আর রাধু যে আজও আপনার জন্য চোকের জল ফেলে ! "

গোলকপতির নির্বাক অবয়বটি দেখে সাধক বলতে শুরু করলেন,

- " যদিও সন্ন্যাসীর পক্ষে পূর্বাশ্রমের কথা আলোচনা করা মহাপাপ! তাও আজ তোমাদের এসবের কিছুটা বলে যাওয়া প্রয়োজন...এক বিশেষ কারণেই আমার পূর্বকল্পের এই স্বীকারোক্তি !"

শৈলবালা কোলে তার শিশুটিকে নিয়ে একটু যেন সন্ত্রস্ত হয়ে বসে কেনারামের মুখের দিকে চেয়ে রইল।

কেনারাম এবারে বলতে শুরু করলেন,

" শৈল'র বাপ আর আমি দুজনে জ্ঞাতি ভ্রাতা। আমার বিবাহের কিছুদিন পরে একবার কার্তিকমাসের এক চতুর্দশীর রাতে আমার চোখে এক দিগমন্ডল উদ্ভাসী রামধনুর আলো এসে ধরা পড়ে ও আমি তারপর থেকে যেন ক্রমে বদলে যেতে থাকি ও সবশেষে আমার শিশুকন্যাটির জন্মের অল্পদিন পরেই গৃহত্যাগী হয়ে সন্ন্যাস নিয়ে রামায়ণ বর্ণিত জনস্থানে গিয়ে কুড়ি বছর ধরে গোপনে শক্তিসাধনা করি ও ক্রমে গুরুকৃপায় সিদ্ধিলাভ ঘটে। মাতা রুদ্রাণী ও ব্রহ্মযামল তন্ত্র আমার আরাধ্যারূপে ক্রমাগত দান করে গেছেন ঐশীসাধনের সম্পদ।

আমার গুরু তাঁর অপ্রকটকালে আমাকে দুটি রুদ্রশিলা গচ্ছিত রেখে এক বিরল শক্তিমন্ত্রের তহবিলদারের পদে অভিষিক্ত করে যান। তবে সেই মন্ত্র ও শিলামূর্তিটি পরবর্তী কালে আমার পৌত্রীর স্বামীর বংশের কূলদেবীরূপে পূজিত হবেন সেকথাটিও বলে যান। আর সেই বংশের অবতংশটিকে চেনার জন্য এক সংকেতও আমাকে প্রদান করে গেছিলেন যার সন্ধানে এতকটি বৎসর ধরে আমি প্রতীক্ষমান।

তাই আজ তোমাদের সন্তানটির বক্ষদেশে একটি রক্তবর্ণের আঁচিল চিহ্ন দেখে আমি বুঝেছি যে আমার এই গুরুবাক্যটিও মিথ্যা হবার নয়।

আমি গৃহাশ্রম ত্যাগ করলেও পরিবারের সমস্ত সংবাদ দু'একজন ঘনিষ্ঠজনের মারফৎ লাভ করে এসেছি গত কুড়িটি বৎসর ধরে। এও জানি যে আমার জামাতাটি গতবৎসর সর্পাঘাতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে ও আমার অন্তঃসত্ত্বা কন্যাটি আপাতত তার মাতার কাছে এসে রয়েছে। ঈশ্বরাদিষ্টে তোমার এই পুত্রটির সাথে ভবিষ্যতে আমার পুত্রীর আসন্নসম্ভবা নবজাতিকা কন্যাটির শুভপরিণয় হবে ও দৈবানুগ্রহে রুদ্রশীলাটির কৌলিক পূজনটিও প্রচলিত হবে। "

সাশ্রুনেত্রে গোলকপতি ও শৈলবালা প্রবীণ সাধকের কথাগুলি শুনতে শুনতে ক্রমশঃ স্তম্ভিত হয়ে যায়। নীরবতার গাম্ভীর্য ভঙ্গ করে তাদের ক্রোড়ে শিশুপুত্রটি যেন এবারে অযাচিত ক্রীড়ামোদী চিত্তে কলহাস্য করে ওঠে। সাধক পরম স্নেহে তখন সেই শিশুটির ক্ষুদ্র ললাটে তর্জনীচালনা করে লিখে দেন, "ওঁ শৌং শৌং সঃ"- দক্ষিণাকালিকার এই বীজ মন্ত্রটি ও তাকে পরম আহ্লাদে সম্ভাষণ করে ওঠেন "ঈশ্বরচন্দ্র" সম্ভাষণে।

......

যুগান্তের কালধর্ম এভাবেই ক্রমে একটি পুরুষ থেকে প্রবাহিত হতে থাকে বংশের ধারাপতনে। কিছু মানুষ তার ক্ষুদ্র কালসন্দর্ভে এভাবেই অনন্ত আলোকবর্তিকাটি জ্বালাতে জ্বালাতে ক্রমে এগিয়ে যায় আধুনিকতম পৃথিবীর বর্ণময় বিচিত্রময়তায়।

তাই জীবনের প্রবাহমান হাসিকান্না এভাবেই এক প্রজন্মে অপরিচিত থাকলেও পুনর্যাপন করে চলে প্রজন্মান্তরেই।

আমরা এভাবেই যেন প্রতীক্ষা করে থাকি একেকটি নতুন কাহিনীসূত্রের। আমাদের এই জীবনধারণ যেন প্রবাহকালের অনন্ত যাত্রাপথের একেকজন বিচিত্র পথিক হয়েই।

................সমাপ্ত.....................

কৃতজ্ঞতা স্বীকার-

১) বাঙালির ইতিহাস আদিপর্ব - নীহার রঞ্জন রায়।

২) বর্ধমানের ইতিকথা - শ্যামসুন্দর বেরা।

৩) রামমোহন রায় - ব্রজেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।

ডঃ রক্তিম মুখার্জ্জী।

শ্রী তমাল দাশগুপ্ত।

শ্রীমতী কুন্তলা সরকার।

এবং

বর্ধমানের সেন সরকার পরিবার।