ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক৩
ফ্লককে নিয়ে বের্নহার্ড বেশ কয়েকবার হাঁটতে গেছে। ফ্লকের গায়ের পশম আসলে সাদা। যদিও একেবারে ফুটফুটে সাদা রাখা বেশ ঝামেলার কাজ। উদাহরণস্বরূপ, আজ ফ্লকের গায়ের পশমের রঙ ছিটছিটে ধূসর। ইনেস সেই কারণে সবার কাছে ক্ষমা চাইল। বলল যে দুর্ভাগ্যবশত আজ সে ফ্লককে ভালোভাবে স্নান করাবার মত যথেষ্ট সময় পায়নি। তাছাড়া গৃহভৃত্য ফ্রান্জলও আজ আগে বেরিয়ে গেছে।
‘তোমার বন্ধু ফ্রান্জল’… গের্টকে বলে ইনেস… ‘তোমাকে শুভেচ্ছাসহ শ্রদ্ধা জানিয়েছে।’ গের্ট ফ্রান্জলকে বেশ পছন্দ করে। ফ্রান্জল সুপুরুষ, দীর্ঘদেহী, সোনালি চুল, বলিষ্ঠ গড়ন। দেখেই বোঝা যায় যে বের্নহার্ডের চেয়ে অনেক বেশি শক্তি ধরে সে, যদিও তার চেয়ে মোটে এক বছরের বড়।
গের্টের ফ্রান্জলকে নিয়ে বাড়াবাড়ির ব্যাপারটা ইনেস একেবারেই ভালো চোখে দেখে না। যদিও ফ্রান্জল সম্বন্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই। কিন্তু, সে সবসময় বলে যে সে এটাই বুঝে উঠতে পারে না যে আসলে গের্ট তার বাড়িতে তার সঙ্গে দেখা করতে আসে, নাকি ফ্রান্জলের সঙ্গে।
‘অন্তত ফ্লককে ফ্রান্জল তোমার চেয়ে ভালো ভাবে সামলে রাখতে পারে’… গের্ট বলে ইনেসকে, ‘ফ্রান্জলকে তোমার হিংসে করার কোনো কারণ নেই।’
কিন্তু কারণ যে আছে সেটা ইনেস একটুও না হেসে প্রকাশ করে। সে মনে করে গের্টের উপর তারই অধিকার। তাছাড়া গের্ট যে অকারণে ফ্রান্জলকে আহ্লাদ দিয়ে এবং সিগারেট দিয়ে বিগড়ে দিচ্ছে, সেটা তার একেবারেই অপছন্দ।
বের্নহার্ডের কাছে এই আলোচনাটা খুবই হাস্যকর বলে মনে হয়। যদিও ইনেসের কণ্ঠস্বর শুনে আবার তার মনে হয় যে বিষয়টা যথেষ্ট গুরুগম্ভীর হয়ে উঠছে। তার একটু অস্বস্তি হতে থাকে, যেটা কাটানোর জন্য সে ফ্লকের গায়ে হাত বোলাতে থাকে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই ইনেস অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল। এখন সে ‘বের্শেন, বের্শেন’ বলে আহ্লাদে বের্নহার্ডের গলা জড়িয়ে ধরে বসে আছে। কিছুটা ধারের দিকে সরে গিয়ে মাঝখানে তার বসার জন্য আরেকটু জায়গা করে দেয় ইনেস। সামনে এগিয়ে চলেছে তারা। শহর ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মাঠঘাট পেরিয়ে চলেছে। দিগন্তরেখার কাছে যে গাঢ় রেখাটা দেখা যাচ্ছে সেটা দূরের জঙ্গল। পথের ধারে বাচ্চাকাচ্চার দল তাদের গাড়িটা দেখে হাত নাড়ছে, হইহই করে ডাকাডাকি করছে। পথের ধুলো উড়ছে। বাইরের হাওয়ায় বের্নহার্ডের মনে হচ্ছে যে তার দম বন্ধ হয়ে যাবে এখনই।
গের্ট এবং ইনেস… এই দু’জনের মাঝখানে বসে থাকাটা যথেষ্ট কঠিন এবং ক্লান্তিকর। রীতিমত ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হচ্ছে বের্নহার্ডকে। তাদের বাক্যালাপে মধ্যস্থতা করতে হচ্ছে তাকে।
- ‘ইনেস… সামলাও একটু, ফ্লককে সামলাও। আমায় বিরক্ত করছে ফ্লক।’… গের্ট চিৎকার করে। গের্টের কথাগুলো আবার ইনেস শুনতে পাচ্ছে না হাওয়ায়।,
-‘বের্শেন, ও কী বলছে?’ ইনেস বের্নহার্ডকে জিজ্ঞেস করে। বের্নহার্ড ফ্লককে টেনে নিয়ে এসে তার দুই হাঁটুর মাঝে বন্দি করে রাখবার চেষ্টা করে। তারপর আবার ইনেস শুরু করে…
-‘গের্ট, তুমি গতকাল এলে না কেন? প্রফেসর তোমার খোঁজ করছিলেন। তিনি বললেন যে গত তিন সপ্তাহে নাকি তোমাকে একবারের জন্যেও ক্লাসে দেখেননি। তার সঙ্গে একবার অন্তত দেখা কোর তুমি; ভীষণ দরকার।’
-‘আমি একটা কথাও বুঝতে পারছি না।…গের্ট চেঁচিয়ে ওঠে।
-‘ভীষণ দরকার প্রফেসরের সঙ্গে দেখা করা…’বের্নহার্ড ইনেসের কথার পুনরাবৃত্তি করতে শুরু করে। কিন্তু বাক্য সম্পূর্ণ হবার আগেই গের্ট তাকে থামিয়ে দেয়…
-‘এই ‘দরকার’ শব্দটা শনিবারে একদম নিষিদ্ধ বের্শেন। তুমি আজ অনেকবার এই শব্দটা উচ্চারণ করে ফেলেছ।’
ওরা আজ অনেকদূর চলে যাচ্ছে শহর ছাড়িয়ে। একটা বড় লিনডেন গাছের নিচে বসে ওরা কফি খায়। বের্নহার্ড লক্ষ্য করে যে এর মধ্যেই পাঁচটা বেজে গেছে। আজকের ট্রেনটা সে আর ধরতে পারছে না।
-‘অসাধারণ’ গের্ট বলে ওঠে… ‘আজ তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে। বাড়ি যেতে হবে না। তুমি এখন ঠিক করে ফেলো কার সঙ্গে আজ শোবে? আমার সঙ্গে নাকি ইনেসের সঙ্গে? আমরা বৃদ্ধ দম্পতি সেজে এখন তোমার বাবা মা কে জানিয়ে দিচ্ছি ফোন করে যে তুমি আমাদের সঙ্গেই আছো।’
বের্শেন মরিয়া হয়ে উঠেছে বাড়ি ফিরবার জন্য। যদিও সে গের্টের সামনে সে কথা প্রকাশ করে না। কারণ, গের্ট এরকম কিছু শুনলেই হাসাহাসি, ইয়ার্কি শুরু করবে। তবে বের্নহার্ডের মুখচোখ দেখে সে প্রশ্ন করে…
-‘তোমার বাবা মা খুব রাগ করবেন বুঝি?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘আমি ফোন করলেও রেগে যাবেন?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘যাচ্ছেতাই ব্যাপার। তুমি তোমার বাবা মাকে একদম ঠিকঠাক শিক্ষা দিতে পারনি।’
কিন্তু ইনেস ঠিক করে যে এরকম অবস্থায় বের্নহার্ডকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে। ইনেস ব্যাপারটা এত সহজে সমাধান করে ফেলে যে কারোর আপত্তি করবার কিছু থাকে না।
ওদের পৌঁছাতে প্রায় সাড়ে সাতটা বেজে যায়। বের্শেনের নরম চেহারার মা খুবই চিন্তিত ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন যে বের্নহার্ড মাঝপথে কোথাও হারিয়ে গেছে। কারণ যে ড্রাইভার স্টেশনে গিয়েছিল বের্নহার্ডকে আনতে, সে খালি গাড়ি নিয়ে ফিরে এসেছে অনেকক্ষণ।
বের্নহার্ডের বন্ধুরা একসঙ্গে রাতের খাবার খাবে এখন। বের্নহার্ডের ছোট বোন মনি রাতপোশাক পরেই বসবার ঘরে চলে এসেছিল দাদার বন্ধুদের দেখবে বলে। সে ভারি আশ্চর্য হল পুরোদস্তুর ‘এক ভদ্রলোক এবং এক ভদ্রমহিলা’ দেখে। গের্ট যখন তাকে কোলে নিয়ে নিজের হাঁটুর উপরে বসিয়ে রেখেছিল, তখন অচেনা লোকজন দেখে মনি কাঁদোকাঁদো মুখ করে বসেছিল। অবশেষে ফ্লককে দেখে তার সাহস আবার ফেরত এল। প্রথমে সে হাল্কা হাল্কা করে ফ্লকের ঘাড়ে মুখে হাত বোলাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল মনি ফ্লকের সঙ্গে খেলতে খেলতে মেঝেতে কার্পেটে লুটোপুটি খাচ্ছে এবং দুজনেরই গলা দিয়ে আহ্লাদের, খুশির শব্দ বেরিয়ে আসছে। তার মধ্যেই রাতের খাবারের জন্য ডাক পড়ল এবং বের্নহার্ডের বাবা তার কাজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। বের্নহার্ড তার বন্ধুদের সঙ্গে বাবার আলাপ করিয়ে দিল। তবে তাকে খুবই অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল। সবাই বসবার ঘরের লাগোয়া খাবার ঘরে এল। টেবিলে দুটো রূপোর বাতিদান সাজানো আছে। দুটো পরিষ্কার ন্যাপকিন রাখা আছে অতিথিদের চেয়ারের সামনে। রাতের খাবার বের্নহার্ডের কাছে আজ খুব আহামরি কিছু মনে হচ্ছিল না। সে নিজের জায়গায় চুপচাপ বসে খেতে লাগল। মায়ের নানা প্রশ্নের জবাবে এক দুটো হুঁহাঁ করছিল। তার মা তার দিকে হাসিমুখে চেয়ে বসেছিলেন। কিন্তু সে অন্যমনস্কভাবে খাবার খেয়ে যাচ্ছিল। তার বাবা ইনেস এবং গের্টের সঙ্গে নানা কথাবার্তা বলছিলেন। তার মনে হল যে বাবার ইনেসের সঙ্গে কথা বলতে বেশ ভাল লাগছে। বাবা এমন এক দুটো কথা বলছেন, যেটা থেকে পরিষ্কার যে ইনেসের সুন্দর চেহারা নিঃসন্দেহে তার মনে ছাপ ফেলেছে। ইনেসের নরম বাদামী ব্লন্ড চুলের গুচ্ছ, যা তার সুন্দর মুখমণ্ডল ঘিরে রয়েছে, তা যেকোনো মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। তার ধূসর চোখে বুদ্ধিমত্তার ঝলক দেখে বোঝা যায় যে সে সবকিছু মন দিয়ে এবং হৃদয়বত্তা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করে। তার হাসিও উজ্জ্বল, বন্ধুত্বপূর্ণ। সে কখনই খুব জোরে কথা বলে না। বরঞ্চ থেমে থেমে ধীরে সুস্থে উষ্ণতার স্পর্শ দিয়ে প্রতিটি শব্দ উচ্চারণ করে। ইনেস এখন তার বাবার সঙ্গে লাল ওয়াইন এবং সাদা ওয়াইনের পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করছে। একই রকম দক্ষতা নিয়ে সে গের্টের সঙ্গে অটোমোবাইল নিয়ে অথবা বের্নহার্ডের সঙ্গে সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করতে পারে। কখনই এমন মনে হয় না যে মেয়েটার মধ্যে এতটুকু দেখানেপনা আছে, কিম্বা ভান করছে, কিম্বা এমন কিছু বলছে, যেটা অসহ্য এবং একঘেয়ে। ইনেসের এই ব্যাপারটাই বের্নহার্ডের খুব ভাল লাগে। আমাদের সবার মধ্যে ইনেস সেরা… খাবার খেতে খেতে ইনেসের দিকে তাকিয়ে এই কথাটা ভাবতে থাকে বের্নহার্ড।
(চলবে)
0 comments: