ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার
Posted in ধারাবাহিক(শেষপর্ব)
ঠিক ৫ বছর পরে
.........................
বর্ধমান রাজাদের অনুগ্রহে গোলকপতির পাকাপোক্ত জীবিকার ভিত্তিটি পোক্ত হয়ে গেছিল রানীমা বিষণকুমারীর বদান্যতায়। যদিও রানীমা এখন আর ইহলোকে নেই তবুও গোলকপতির কর্মদক্ষতা ও সততার সাথে বর্তমানের রাজা তিলকচাঁদেরও কোন বিরোধ হয়নি বলে সে এখনও টিকে আছে।
পুরনো ও বিশ্বাসী যে ক'জন রাজকর্মচারী আপাতভাবে বিষণকুমারীর আমলে রাজবাড়িতে বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত হয়েছিল তাদের মধ্যে অতিগোপন ষড়যন্ত্রসম্পর্কিত নানা সংবাদের সরবরাহকারী ও বাজার সরকার গোলকপতিকে যে কেন তিনি বহাল রেখে দিলেন তার উপযুক্ত কারণটি বোধহয় বর্ধমানেশ্বরী মহাদেবী সর্বমঙ্গলা ছাড়া আর কারুর গোচর নয়। যদিও শাস্ত্রমতে রুধিরপ্রিয়া গৌড়েশ্বরী তাঁর অনন্তকালের প্রশ্রয়ে সেন রাজাদের সর্বদা পালন করে এসেছেন বলে জনশ্রুতি, তাই বোধহয় এই দূর্ভাগা বংশাবতংশটিকে তিনি মহাকারুণ্য থেকে আর বঞ্চিত করেননি।
....
তন্তুবায় গৃহে তাদেরও সেই ঘনায়মান রাত্রির মধুক্ষরা পরিণতিটি শেষঅবধি বেশীদিন অধরা থাকেনি। পরদিন খুব ভোরে এদের আশ্রয়টি ত্যাগ করে ও দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রীধনের হস্তধৃত গোলকপতি সেদিন অতি সগৌরবে রাজবাড়ি ফিরে এসেছিল।
শৈলবালার সীমন্তরেখায় প্রাকপ্রত্যূষে তার প্রদত্ত রক্তধারার রক্তিম অভিজ্ঞানটি এক অলৌকিক উপায়ে মন্ত্রশুদ্ধি হয়ে আজীবন থেকে গেছিল বলে ক্রমে সে ভুলতে পেরেছিল আজীবনের জন্মযন্ত্রণাটিকে।
সংসারে বাঁধা পড়ার এত স্বাভাবিক উদ্যোগটিও বহু ঘটনার পরে যে এভাবে স্থিতি হতে পারে সেটা প্রাকচল্লিশ বছর বয়স হবার আগে সে তা ভেবে ওঠার অবকাশ পায়নি।
.....
প্রিয় জন্মভূমিতে ভারতের মুকুটহীন রাজাটির আর ফিরে আসা হলনা। দিনসাতেকের মেনিনজাইটিস রোগের প্রকোপে নবদিগন্তের রেশটিকে বয়ে এনে পূর্বাচলের মাটিতে তাই আর জানানো হলনা আগামীকালের পটপরিবর্তনের ইতিকথা। রাজা ঘুমিয়ে পড়লেন মসৃণ তৃণরাজি বিধৌত আর্নেস্ট ডেল এর প্রান্তরে। সফেন সমুদ্রের অবিরল মুখরতা যেন সশ্রদ্ধ চিত্তে ঘুমপাড়ানি গানের তালে তালে যেন তাঁকে কেবল বলে উঠতে লাগল,
" পিতা নোহসি
পিতা নো বোধি
নমস্তেহস্তু,
........মা মা হিংসীঃ।"
......
তবে ভারতবর্ষ থেকে এর কিছুকাল পরেই আসবেন রামমোহনের অভিন্নাত্মা আর একজন বঙ্গসন্তান। শবদেহটি পুনরোত্থানের পর ব্রিস্টলে আবার নতুন করে যেমন গড়ে তুলে দিয়ে যাবেন একটি চারুময় শ্রদ্ধাবেদী, আবার তেমনই মাটি কিনে যাবেন এই দেশেই, চিরশয়ানের দিনে বন্ধুর উষ্ণতাকে আবার বরণ করে নেওয়ার দিনে। রামমোহনের সেই অনুজপ্রতীম বন্ধুটির নাম, দ্বারকানাথ ঠাকুর! তিনিও বিলেতের মাটীতে পা রাখতে চলেছেন.....কালসন্দর্ভ যে তাঁকেও খুব শীঘ্র আহ্বান করবে এখানে আসার জন্য !
......
বদনতলার মাঠ যেখানে ক্ষীরপাশা গ্রামের দিকে বেঁকে গেছে নিস্তব্ধ পর্থপ্রর্দশনার আবহে সেখানে ক'দিন হল এক বৃদ্ধ তান্ত্রিক এসে কুটির বেঁধে রয়েছেন। সাধকটি মাতা রুদ্রাণীর অনুগামী। এখন বঙ্গালের আকাশে বাতাসে প্রবল নিনাদে বৈদেশিক শাসকের রণভেরী বেজে চললেও গ্রামেগঞ্জে এখনও দু'চার জন অবধূত বা বজ্রযানী সাধকদের দেখা মেলে। তবে এঁরা জনবহুল স্থান সাধারণতঃ এড়িয়ে চলেন বলে জনমানসে এঁদের প্রচার কম।
সাধক কেনারাম তেমনই একজন সাধক।সহজিয়া মাতৃকাপূজনের যে রীতি রাজা রামকৃষ্ণ, রামপ্রসাদ বা কমলাকান্তের মত কবিমনষ্ক উন্মার্গীদের সাথে আমাদের দেখা করিয়ে ভাবতরঙ্গে ভাসিয়ে এসেছেন, ইনিও তাঁদের সুযোগ্য উত্তরসূরী।
কুটিরে বসে সন্ধ্যাহ্নিক শেষ করে তিনি আজ বড় উতলা। পল-অনুপলে তাঁর যেন কার জন্য আজ মন বড় চঞ্চল! কৌশিকী অমাবস্যার পূণ্য তিথি আজ প্রায় সমাপনের পথে! কিন্তু সে কি আজকে আর আসবেনা? সাধক জানেন আগামী চতুর্দশীর দিনেই তিনি ভববন্ধন পার করে সাধনমার্গে উত্তরণ করবেন চিরকালের মতন।
চিন্তা যে একটাই তাঁর অবর্তমানে রুদ্রাণী ও মহাভৈরবের পবিত্র শিলাদুটি কার দায়িত্বে রেখে যাবেন? কে তবৃ বংশপরম্পরায় এসে তাঁর বসতভিটার রক্ষয়িত্রী সেই ক্ষীণকটি ও দীর্ঘকায়া কালীমূর্তিটির সম্বৎসরের পূজার ভার
নেবে? মহাদেবীর এই পূজনরীতি হস্তান্তর না করতে পারা অনুশোচনাটি নিয়েই কি তবে ছাড়তে হবে ব্যর্থকাম জীবদেহটিকে?
দক্ষিণা কালিকা'র স্তবমন্ত্র নীরবে জপ করতে করতে শুনতে পেলেন অদূরে একটি পদশব্দ যেন এগিয়ে আসছে তাঁর দিকেই! এ যেন কেবল এক আগমন নয়, যথার্থ যুগপরিবর্তনের ভারপ্রাপ্ত এক যুগলের চরণধ্বনি যেন !
সাধক যেন নিজের ইড়া-পিঙ্গলা-সুষুম্নার ত্রিবেণী সঙ্গমে যেন টের পেলেন উদ্দীপনের সংকেতবার্তা।
....
গোলকপতি কাছাড়িবাড়িতেই এক মুৎসুদ্দীর কাছ থেকে ক'দিন হল পেয়েছে এক সাধকের আগমনবার্তা। তাই সে তার তিনমাসের সদ্যজাত শিশুটি ও তার মাতাটিকে নিয়ে এসেছে সাধকের আশীর্বাদসহ পদরেণু সংগ্রহ করতে।
.....
সাধক কেনারাম উৎসুক দৃষ্টিতে গোলকপতিদের শিশুসন্তানে দেহলক্ষণটি দেখে আশ্বস্ত হলেন। তার পর শৈলবালার নতমুখটি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দ্বারা ঈষৎ উপরে তুলে ধরে শান্ত স্বরে বললেন,
" মা..শৈল...আমায় চিনতে পেরেছিস্ তো?...আমি কিন্তু তোকে ঠিক চিনেছি! "
শৈলবালা তখন অস্ফূট কন্ঠে ডুকরে উঠে বলল,
" একী! মাধবকাকা! আপনি একোনো বেঁচে আছেন? কাকীমা আর রাধু যে আজও আপনার জন্য চোকের জল ফেলে ! "
গোলকপতির নির্বাক অবয়বটি দেখে সাধক বলতে শুরু করলেন,
- " যদিও সন্ন্যাসীর পক্ষে পূর্বাশ্রমের কথা আলোচনা করা মহাপাপ! তাও আজ তোমাদের এসবের কিছুটা বলে যাওয়া প্রয়োজন...এক বিশেষ কারণেই আমার পূর্বকল্পের এই স্বীকারোক্তি !"
শৈলবালা কোলে তার শিশুটিকে নিয়ে একটু যেন সন্ত্রস্ত হয়ে বসে কেনারামের মুখের দিকে চেয়ে রইল।
কেনারাম এবারে বলতে শুরু করলেন,
" শৈল'র বাপ আর আমি দুজনে জ্ঞাতি ভ্রাতা। আমার বিবাহের কিছুদিন পরে একবার কার্তিকমাসের এক চতুর্দশীর রাতে আমার চোখে এক দিগমন্ডল উদ্ভাসী রামধনুর আলো এসে ধরা পড়ে ও আমি তারপর থেকে যেন ক্রমে বদলে যেতে থাকি ও সবশেষে আমার শিশুকন্যাটির জন্মের অল্পদিন পরেই গৃহত্যাগী হয়ে সন্ন্যাস নিয়ে রামায়ণ বর্ণিত জনস্থানে গিয়ে কুড়ি বছর ধরে গোপনে শক্তিসাধনা করি ও ক্রমে গুরুকৃপায় সিদ্ধিলাভ ঘটে। মাতা রুদ্রাণী ও ব্রহ্মযামল তন্ত্র আমার আরাধ্যারূপে ক্রমাগত দান করে গেছেন ঐশীসাধনের সম্পদ।
আমার গুরু তাঁর অপ্রকটকালে আমাকে দুটি রুদ্রশিলা গচ্ছিত রেখে এক বিরল শক্তিমন্ত্রের তহবিলদারের পদে অভিষিক্ত করে যান। তবে সেই মন্ত্র ও শিলামূর্তিটি পরবর্তী কালে আমার পৌত্রীর স্বামীর বংশের কূলদেবীরূপে পূজিত হবেন সেকথাটিও বলে যান। আর সেই বংশের অবতংশটিকে চেনার জন্য এক সংকেতও আমাকে প্রদান করে গেছিলেন যার সন্ধানে এতকটি বৎসর ধরে আমি প্রতীক্ষমান।
তাই আজ তোমাদের সন্তানটির বক্ষদেশে একটি রক্তবর্ণের আঁচিল চিহ্ন দেখে আমি বুঝেছি যে আমার এই গুরুবাক্যটিও মিথ্যা হবার নয়।
আমি গৃহাশ্রম ত্যাগ করলেও পরিবারের সমস্ত সংবাদ দু'একজন ঘনিষ্ঠজনের মারফৎ লাভ করে এসেছি গত কুড়িটি বৎসর ধরে। এও জানি যে আমার জামাতাটি গতবৎসর সর্পাঘাতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে ও আমার অন্তঃসত্ত্বা কন্যাটি আপাতত তার মাতার কাছে এসে রয়েছে। ঈশ্বরাদিষ্টে তোমার এই পুত্রটির সাথে ভবিষ্যতে আমার পুত্রীর আসন্নসম্ভবা নবজাতিকা কন্যাটির শুভপরিণয় হবে ও দৈবানুগ্রহে রুদ্রশীলাটির কৌলিক পূজনটিও প্রচলিত হবে। "
সাশ্রুনেত্রে গোলকপতি ও শৈলবালা প্রবীণ সাধকের কথাগুলি শুনতে শুনতে ক্রমশঃ স্তম্ভিত হয়ে যায়। নীরবতার গাম্ভীর্য ভঙ্গ করে তাদের ক্রোড়ে শিশুপুত্রটি যেন এবারে অযাচিত ক্রীড়ামোদী চিত্তে কলহাস্য করে ওঠে। সাধক পরম স্নেহে তখন সেই শিশুটির ক্ষুদ্র ললাটে তর্জনীচালনা করে লিখে দেন, "ওঁ শৌং শৌং সঃ"- দক্ষিণাকালিকার এই বীজ মন্ত্রটি ও তাকে পরম আহ্লাদে সম্ভাষণ করে ওঠেন "ঈশ্বরচন্দ্র" সম্ভাষণে।
......
যুগান্তের কালধর্ম এভাবেই ক্রমে একটি পুরুষ থেকে প্রবাহিত হতে থাকে বংশের ধারাপতনে। কিছু মানুষ তার ক্ষুদ্র কালসন্দর্ভে এভাবেই অনন্ত আলোকবর্তিকাটি জ্বালাতে জ্বালাতে ক্রমে এগিয়ে যায় আধুনিকতম পৃথিবীর বর্ণময় বিচিত্রময়তায়।
তাই জীবনের প্রবাহমান হাসিকান্না এভাবেই এক প্রজন্মে অপরিচিত থাকলেও পুনর্যাপন করে চলে প্রজন্মান্তরেই।
আমরা এভাবেই যেন প্রতীক্ষা করে থাকি একেকটি নতুন কাহিনীসূত্রের। আমাদের এই জীবনধারণ যেন প্রবাহকালের অনন্ত যাত্রাপথের একেকজন বিচিত্র পথিক হয়েই।
................সমাপ্ত.....................
কৃতজ্ঞতা স্বীকার-
১) বাঙালির ইতিহাস আদিপর্ব - নীহার রঞ্জন রায়।
২) বর্ধমানের ইতিকথা - শ্যামসুন্দর বেরা।
৩) রামমোহন রায় - ব্রজেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়।
ডঃ রক্তিম মুখার্জ্জী।
শ্রী তমাল দাশগুপ্ত।
শ্রীমতী কুন্তলা সরকার।
এবং
বর্ধমানের সেন সরকার পরিবার।
0 comments: