ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়
Posted in ধারাবাহিক১৬
মোষের গোয়াল। এখন ওখানে ছাই আর খড়ের সাহায্যে গোয়ালের ভিজে মেজে পরিষ্কার করা হচ্ছে। মোষের পেচ্ছাপের ঝাঁঝ ছাইগাদায় চাপা পড়লেই যে পরিষ্কার করছিল সে বুঝে যায় –হ্যাঁ, মেজে সাফ হয়েছে বটে। লোকটা ছাইয়ের উপর একটা লম্বা চওড়া চাটাই বিছিয়ে দিল। তার উপরে একটা ভয়ংকর জমকালো রঙের শতরঞ্জি , তার এক কোণে লেখা—ন্যায় পঞ্চায়েত, ভীখমখেড়া, অর্থাৎ ভীখমখেড়া গ্রাম-পঞ্চায়েতের বিচারসভা।
এবার লোকটা সতরঞ্চির মাঝাখানে একটা কাঠের সিন্দুক আর ময়লা থলে রাখল। তারপর বাইরের বাঁধানো চাতালে গিয়ে দু’বারের চেষ্টায় যতটা থুতু ফেলা যায় সেটা সেরে একটা বিড়ি ধরাল।
শিবপালগঞ্জ গ্রামসভাও এই ন্যায় পঞ্চায়েত, ভীখমখেড়ার অধীন। কুশহরপ্রসাদ এখানে ওর ছেলে ছোটে পালোয়ানের বিরুদ্ধে বাপকে ভালো মতন ঠ্যাঙানোর অভিযোগে মামলা ঠুকেছে। আজ তার তিন নম্বর শুনানি। প্রথম দুই দফায় কাজ বলতে এইটুকু হয়েছিল যে কুশহর এবং ছোটে পালোয়ান—বাদী এবং বিবাদী- হাজির ছিল। পঞ্চদের অনুপস্থিতিতে মামলার শুনানি হতে পারেনি।
চাতালে বসে বিড়ি-ফোঁকা লোকটা পঞ্চায়েতের চাপরাশি। বিড়ি শেষ করে আবার দুই দফা থুতু ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে নিজের মনে বলল—ওরা কোথায়? মরে গেছে নাকি?
তারপর কোন উত্তর না আসায় আরেকটা বিড়ি ধরিয়ে ফেলল।
একটু পরে দেখা গেল চারজন একসঙ্গে হেঁটে এদিকে আসছে। দু’জন বাপ আর ছেলে—কুশহরপ্রসাদ এবং ছোটে পালোয়ান। অন্য দুজন পঞ্চায়েত সদস্য বা পঞ্চ। কুশহরপ্রসাদের মাথায় দুটো আঘাতের হালকা চিহ্ন রয়েছে আর সেটাকে সবাইকে দেখানোর ইচ্ছেয় ও নেড়া মাথা হয়ে এসেছে। এখন মাথার উপর মরুভূমিতে আঘাতের দুটো দাগ বেশ স্পষ্ট।
ওরা এসে সতরঞ্চির উপর বসে পড়ল। কিন্তু ছোটে পালোয়ান ওখান থেকে বেরিয়ে খোলা আকাশের নীচে রোদ পোহাতে লেগে গেল। একজন পঞ্চ চাপরাশিকে জিজ্ঞেস করল—সরপঞ্চ (মোড়ল) এখনও আসেন নি?
“এখন কী করে আসবেন?”, চাপরাশি জবাব দিল,” শিবপালগঞ্জ গিয়েছিলেন। তহসীল অফিসে কোন কাজ ছিল। বোধহয় সেখানেই আটকে গেছেন”।
গ্যাঁজানো জমে উঠল। একজন পঞ্চ কুশহরকে জিজ্ঞেস করল—‘এখন তোমার চোট কেমন? ঘা’টা শুকিয়েছে মনে হচ্ছে’?
কুশহর খকখক করতে লাগল। তারপর মুখ ফুলিয়ে বলল—আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছ? ওই যে দাঁড়িয়ে রয়েছেন আমাদের শ্রবণকুমার! ওকেই শুধোও না!
ছোটে পালোয়ান নিজেকে শ্রবণকুমারের রোলে ভাবতে রাজি নয়। কাঁধে বাঁক নিয়ে তার থেকে বাবা-মাকে মুরগীর মত ঝুলিয়ে চলা অত্যন্ত লজ্জাজনক। এসব তো মজদূরের কাজ! ও রেগে গেল। বলল—‘এখানে শ্রবণকুমারের বাপও এক শ্রবণকুমার। ওকেই প্রশ্ন কর। আমাদের বংশে সব শালাই শ্রবণকুমার; শ্রবণকুমারের ঝাড়’!
এক পঞ্চ ওকে বাধা দিল। “গালাগালি করবে না ছোটে। এতে আদালতের অসম্মান হয়”।
ছোটে উত্তর দিল,” শালা কোন গালি নয়”।
এটা বলে ওএসে সতরঞ্চির উপর বসে পড়ল। হঠাৎ খেয়াল হল পঞ্চেরা রেগে যাচ্ছে। তখন ও মুচকি হেসে এমন ভাব করল যেন এতক্ষণ হাসিঠাট্টা চলছে। তাই ডায়লগ ঝাড়ল-“চৌদ্দটা বাচ্চার বাপ হয়েছি আর আমাকেই শেখাবে মেয়েমানুষ কী জিনিস! আমাকে বলছ সালে বলা মানে গালি দেয়া? আরে, এ’তো কথাবলার একটা ঢঙ। আমার কথাবলার কায়দাই হল সালে দিয়ে শুরু করা”।
একজন পঞ্চ আপত্তি করল-না, সালে বলা তো গালি দেয়া!
ছোটে পালোয়ান ফের হাসল, যেন ভালমানুষ সেজে পঞ্চায়েতের সহানুভূতি আদায় করবে। এবার বলল, “ গালি! আসল গালি তো শোননি পণ্ডিতজী! কানে ঢুকলে কলজে নড়ে উঠবে”।
বৈঠকে ঢুকেই সরপঞ্চের (পঞ্চায়েত প্রধান) মনে হল দেরি হওয়ার কারণটা সাথীদের জানিয়ে দেয়া দরকার। উনি গুনগুন স্বরে বলতে লাগলেন।
“চারদিকে দুর্নীতি! তহসীল অফিসে একটা দরখাস্ত দেয়ার ছিল। ভেবেছিলাম পেশকারের হাতে ধরিয়ে চলে আসব। কিন্তু ও বলল- তহসীলদারের সঙ্গে সওয়াল- জবাব শেষ করে যাও”।
একজন পঞ্চ এই কৈফিয়ত মন দিয়ে শোনেনি। সে একটু চড়া সুরে বলল—“তবুও অনেক দেরি হয়েছে। একটা বাজতে চলল। হিন্দুস্থানীদের এই একটা খারাপ অভ্যাস। ইংরেজরা এই ব্যাপারে থিক ছিল। সময়ের খেয়াল রাখত”।
সরপঞ্চ বেশ জোর দিয়ে বলল—“ঠিক আছে। তুমি তো হাজির হয়েছিলে। তুমি কোন ইংরেজের থেকে কম নাকি”?
এবার ওসতরঞ্চির মাঝখানে আসনপিঁড়ি হয়ে বসে চাপরাশিকে বলল—“শুনানি শুরু করা যাক। হাঁক পাড়ো”।
চাপরাশি দেখেছে যে বাদী-বিবাদী দুই পক্ষই হাজির। তবু দুষ্টুমি করে আদালতের নকল করে উঁচু গলায় হাঁক দিল—‘কুসহর বনাম ছোটে, কেউ হা-আ -আ-আ--- জির’?
ছোটে খেঁকিয়ে উঠল—“হাজির তো বটেই! দেখতে পাওনি? চোখ নাকি জামার বোতাম”?
সরপঞ্চ প্রশ্ন করল-‘পঞ্চায়েত -মন্ত্রী আজও আসে নি”?
‘ওনার শালার ভায়রাভাইয়ের ঘরে আজ কোন অনুষ্ঠান আছে। উনি সেখানেই গেছেন। আমার বাড়িতে খবর পাঠিয়েছেন’। একজন পঞ্চ বা পঞ্চায়েত সদস্যের মন্তব্য।
“এই পঞ্চায়েত মন্ত্রীটিও না, একটি অকর্মার ধাড়ি,-- শিকারের সময় কুত্তার হাগা! প্রত্যেকবার কাজের সময় ফাঁকি। কোন ফাইলটা কোথায় রেখেছে—এটা কে বলবে? নিজে গেছেন নেমন্তন্ন খেতে, আমি রয়েছি ফাইল খুঁজতে”।
সরপঞ্চ রেগে গিয়ে বিড়বিড় করতে লাগলেন। ছোটে পালোয়ান এসবে কান না দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। সরপঞ্চের অনুযোগ ফুরোয়নি।
-‘ওই ব্যাটা পঞ্চায়েত-সচিব গতবার যখন টাকাপয়সার তছরূপের দায়ে ফেঁসেছিল তখন দিনে চারবার আমার ঘরে আসত। এমন জুতো ঘষেছিল যে আমার দরজার সামনের ধূলো সাফ হয়ে গেছল। এখন এদিকে আসতে হলে এড়িয়ে যায়, অজুহাত খোঁজে। ব্যাটা খানদানী বদমাশ”স্ক
ছোটে পালোয়ান অন্যমনস্ক হয়ে চাতালের সামনের নিমগাছের দিকে তাকিয়েছিল। হঠাৎ কথা কানে যেতেই চমকে উঠে বলল—‘ সারপঞ্চজী, বদমাশ বললে কাকে’?
সরপঞ্চ চিড়বিড়িয়ে উঠলেন। “তোমার কেন খুজলি হচ্ছে? এতক্ষণ পঞ্চায়েত -সচিবের কথা হচ্ছি্ল। এবার তোমার বদমাইশির ফাইল খুলল বলে—দেখতে থাক”।
ছোটে উঠে পড়ল। তাচ্ছিল্যের স্বরে বলল, ‘এখানে কোন মোকদ্দমা করা বেকার। সরপঞ্চ তো প্রথম থেকেই আমাকে বদমাশ ঠাউরে বসেছেন। ফয়সালা আর কী হবে’?
কুসহরপ্রসাদ এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিল। হঠাৎ উঠে পড়ে ছোটে পালোয়ানকে বলল—ঠিক আছে। এবার চল, যাওয়া যাক।
তারপর বোধহয় মনে পড়ল যে ছেলের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা ওই দায়ের করেছে। ঘাবড়ে গিয়ে ধপ করে বসে নিজের বোকামিকে ঢাকতে গিয়ে বলল—‘ যখন মামলা এখানে দায়ের হয়েছে, তখন পুরো শুনানি এখানেই হবে। সরপঞ্চজীই ফয়সলা করবেন’।
চাপরাশি চাতালে বসে ওখান থেকে সব দেখছিল। সে এবার বলে উঠল—‘ঠিক বলেছ কুসহর! কেউ বলল—আমার মা ফের বিয়ে করেছে। তো অন্যজন বলল—খারাপ কাজ। তখন ছেলে বলল—বিয়ে করে ফের তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে। অন্যজন বলল—আরও খারাপ।
এই হল বেত্তান্ত। তুমি যখন ছেলের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা শুরু করেই দিয়েছ তখন মাঝখানে দোনোমোনো করার কোন মানে নেই’।
কুসহর চাপরাশির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল যার অর্থ ফালতুলোকও যদি কাজের কথা বলে তখন পালটা জবাব দিতে নেই। তারপর ও ছোটে পালোয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল—‘বসে পড়। আজ মোকদ্দমা হয়েই যাক’।
ছোটে বলল—‘বাপু! তুমি তো দুমুখো সাপ। সামনে পেছনে দু’দিকেই চলতে থাক। এখানে আমাকে শুরুতেই ‘বদমাস’ বলে দিয়েছে। আগে আর কী শুনব? আমি চললাম’।
ও যাবার উপক্রম করতেই সরপঞ্চ হুংকার দিয়ে উঠল—‘এখান থেকে চলে গেলেই হল? এটা কী ইয়ার্কি হচ্ছে? গেলে হাতকড়ি লাগিয়ে টেনে আনব। ভালয় ভালয় বসে যাও। মোকদ্দমা হতে দাও’।
ছোটে পালোয়ান পাত্তা দিয়ে বলল,- এসব আমাকে শিখিও না। আমি তোমার এখানে মোকদ্দমায় রাজি নই। উঠে সোজা ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে যাব আর তোমার শুনানি আটকে দেবার জন্য আর্জি পেশ করব, আজকেই’।
এই পঞ্চায়েতি আদালতে একজন পঞ্চ ছিল যে রাষ্ট্রসংঘের সেই সব সদস্যদের মত, যারা মূল সমস্যা থেকে সরে গিয়ে বিশুদ্ধ নীতির কথা আওড়ায়। এই কায়দায় তারা বাস্তবিক কারও বিরোধ করে না, বদলে অন্যরাও এদের বিরোধিতা করে না। “জনগণ শান্তি চায়”, “আমাদের সভ্যতার ভিত্তি হল বিশ্বভ্রাতৃত্ব এবং ভালবাসা” গোছের কেতাবী বাকতাল্লা শুনে পাজির-পাঝাড়া দেশও সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। তাতে ওই রাজনীতিবিদের দম্ভ হয় –কেমন খাঁটি কথা বললাম!
তো আমাদের পঞ্চটিও ওইরকম ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে একটি খাঁটি কথা বলার চেষ্টা করলেন—‘ পালোয়ান, শোন। পঞ্চ হল পরমেশ্বর। এই ন্যায়ের আসনে বসে কেউ অন্যায় করতে পারেনা। মুখের ভাষা যাই বেরিয়ে থাক, কলম যখন চলবে তখন ন্যায়োচিত রায়ই বেরোবে। বসে পড়’।
এই নিরামিষ বাণী পালোয়ানকে বেশ প্রভাবিত করল। ধপ্ করে মেজেতে বসে বিড়বিড় করতে লাগল—‘আমি কি জানতাম যে পঞ্চদের কলম আসল, মুখের কথা নকল? কিন্তু তুমি যদি ন্যায়বিচারের ভরসা দাও তো আমি বসতে রাজি’।
পঞ্চ উবাচ,” হ্যাঁ, হ্যাঁ। ভরসা দিচ্ছি তো। তুমি এখানে দম লাগিয়ে মোকদ্দমা লড়ো, সারাজীবন লড়তে থাক; কিন্তু রায় তো কলম দিয়েই বেরোবে’।
কোন নাটক -নৌটংকী ছাড়াই এত সহজে সমস্যার সমাধান হবে-- এটা চাপরাশির ঠিক হজম হল না। সে বলে উঠল—“ কথাবার্তার কোন দাম নেই, পণ্ডিতজী? এটা কী বললেন? কথায় আছে না—মরদের বাত আর ঘোড়ার লাথ কখনও বিফল হয় না”।
সরপঞ্চ মনে মনে নিজের ভুল বুঝে অস্বস্তি বোধ করছিল। চাপরাশিকে ধমকে উঠল—‘কতবার বলেছি মুখটা বন্ধ রাখতে! তা না, সবসময় নিজের চরখা চালানো চাই। দেব নাকি একটা কষে’?
পঞ্চ –একে ছাড়ুন, ফাইল খুলুন।
ফাইল খোলা হল। সরপঞ্চ একজন পঞ্চকে বলল—পড়ুন, কুসহরের জবানবন্দী আসামীকে পড়ে শুনিয়ে দিন।
পঞ্চ ভদ্রলোক ফাইলটা এমন করে এদিক সেদিক উলটে পালটে দেখতে লাগল যেমন কোন হিন্দি জানা ব্যক্তি তামিল, তেলুগু, কন্নড়, মালয়ালম লিপিতে লেখা দস্তাবেজ নেড়েচেড়ে আবার মাতৃভাষাতেই ফিরে আসে।
এবার ও একটা ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলল—“আপনি থাকতে আমি আর কী পড়ব? আপনিই পড়ে মোকদ্দমা শুরু করুন”।
ফাইল নয় তো যেন গরম পোড়া আলু! রাষ্ট্রসংঘ- ছাপ পঞ্চ ওটাকে নেড়েচেড়ে সরপঞ্চকে ফেরত করে দিল। সরপঞ্চ এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে অন্য পঞ্চের হাতে চালান করে দিল। দ্বিতীয় পঞ্চ ফাইলের এককোণায় একটা গোল সীলকে খুব মন দিয়ে দেখছিল। হঠাৎ ফাইল এক নম্বর পঞ্চকে ধরিয়ে দিল। এভাবে ফাইলটি কয়েক হাত ঘুরে উদ্ধার হয়ে গেল।
শেষে বাদী কুসহরপ্রসাদ বলল, ”সরপঞ্চজী, পঞ্চায়েত সচিব তো আজ আসেননি। আপনারা এই ফাইল নিয়ে লেখাপড়ার ঝামেলায় কতক্ষণ ফেঁসে থাকবেন? তারচেয়ে নতুন তারিখ দিয়ে দিন। মোকদ্দমা পরে হবে’খন”।
সরপঞ্চ বীরমূর্তি ধরলেন। “তুমি এসব কী বলছ কুসহর? যে সেপাই হয়ে বন্দুকের গুলি দেখে ঘাবড়ে যায় আর যে সরপঞ্চ হয়ে লেখাপড়ায়, তার তো---“।
ছোটে পালোয়ান হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙল, চটচট শব্দ শোনা গেল। তারপর চড়া স্বরে বলল—একঘন্টা ধরে তোমরা কেবল তিন-তেরো করে যাচ্ছ। মোকদ্দমা করবে, নাকি ছোলা ভাজতে থাকবে”?
এটা শোনামাত্র সরপঞ্চ মামলা শুরু করে দিল। ফাইলটা পড়ার ফের চেষ্টা করতে লাগল। একটা পাতা বের করে নিজের মুখের কাছে ধরল। ওর ঠোঁটের কোনায় থুতু জমল। চোখের কোনা কুঁচকে গেল। সেখানে কাকের পায়ের নকশা ফুটে উঠল। মনে হচ্ছে, এটা ওনার জীবনের দুর্লভ মুহুর্ত।
এবার ফাইল ওনার মুখের একেবারে সামনে। উনি একটা লম্বা শ্বাস টানলেন। তারপর ফাইলের একটা পাতাও না চিবিয়ে সবটুকু মেজেতে পটকে দিয়ে বললেন—“আমি কুসহরপ্রসাদের বক্তব্য পড়ে নিয়েছি। ওবলছে যে ওর ছেলে ছোটে ওকে অকারণ লাঠিপেটা করেছে। এটা ‘তাজিরাত হিন্দ’ (ইন্ডিয়ান পেনাল কোড) এর ধারা ৩২৩ এর নালিশ”।
ছোটে এমনভাবে বসে রয়েছে যেন মামলাটার সঙ্গে ওর কোন সম্বন্ধ নেই। সরপঞ্চের দুই ভুরুর মাঝে একটা পাতলা লাইন ফুটে উঠল। উনি প্রশ্ন করলেন, “বল কুসহর, ব্যাপারটা এই তো? আসামী ছোটে তোমাকে পিটিয়েছে”?
--“হ্যাঁ সরপঞ্চজী, হাজার লোকের সামনে মেরেছে। আমার হাড়-পাঁজরা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে”।
সরপঞ্চ গম্ভীর হলেন,” ভেবে কথা বল কুসহর। যদি হাড় ভেঙে গিয়ে থাকে তাহলে মামলা অনেক সঙ্গীন। ফের তোমাকে শহরের আদালতে যেতে হবে। এখানে শুধু ধারা ৩২৩ এর শুনানি হয়। ধারা ৩২৫ লাগলে শহরে গিয়ে কলের জল খাওয়া ছাড়া নিস্তার নেই”।
কুসহর কিছু ভেবে বলল, “আচ্ছা সরপঞ্চজী, আমার হাড়-পাঁজরা সত্যিই ভেঙেছে নাকি? ও তো একটা কথাবলার ভঙ্গী। তবে ও আমাকে খুব মেরেছে। খড়ের গাদায় লাঠিপেটা করার মতন। এই দেখুন, মাথায় এখনও ঘা’ রয়েছে। ও ব্যাটা আমার ছেলে নয়, দুশমন”!
একজন পঞ্চ চাটাইয়ের এক কোনা চেপে বসে চুপচাপ মালা জপছিল। কপালে শ্বেত তিলক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা! বয়সে প্রবীণ। দেখলে মনে হয় ইনি রাশিনক্ষত্র- তিথি -লগ্ন এসবের বিচারে পটু। পুরুতের কাজ করেন এবং বৈদ্যজীর ভূমিকায় চিকিৎসাও করেন। এবং এসব করে গ্রামীণ এলাকায় বেশ সুখে আছেন। শুধু তাই নয়, সুযোগ পেলে ওনার প্রতিভার জাদু শহুরে এলাকাতেও দেখাতে পারেন। ওখানে গিয়ে বড় বড় অফিসারের সাড়ে সাতি বা শনির দশা দূর করে এবং প্রমোশন বা বিলেত যাত্রা নিয়ে ভবিষ্যতবাণী করে ওদের থেকে মোটা দক্ষিণা এবং তার চেয়ে বড় সরকারী অনুদান বাগাতে পারেন।
কুসহরের মুখ থেকে যেই শুনলেন যে ছোটে ওর ছেলে নয়, দুশমন –অমনি ওনার মালা জপা থেমে গেল। ্মুখ থেকে বেরিয়ে এল—হে প্রভো!
ছোটে গলা খাঁকরে এই উক্তির সমর্থন করল। সরপঞ্চ বললেন—“ কী ব্যাপার! বড় কাশি উঠছে যে”?
পালোয়ান বলল, “আমার বাবা বিধবার মত কান্নাকাটি শুরু করেছে। ওর কথা আগে শুনে নাও। আমার কাশির হিসেব তারপরে কর”।
সরপঞ্চ কুসহরকে বললেন, “তোমার হাড়-টাড় ভাঙেনি তো? তাহলে মামলাটা ধারা ৩২৩ এর মোতাবেক হবে”।
একটু থেমে কথাটা দ্বিতীয়বার বললেন, “তাহলে মামলাটা ধারা ৩২৩ এরই হবে। লাঠি চলেছে, কোঁচ-বর্শা তো চলেনি? যদি চলে থাকে তো এখনই বলে দাও । তখন মামলাটা ৩২৫ হয়ে যাবে”।
এবার কুসহর গেল ঘাবড়ে। “না না সরপঞ্চজী, আমাদের কোঁচ-বর্শার কাজ নয়। সাতপুরুষ ধরে আমাদের বংশে শুধু লাঠিবাজীই হয়েছে”।
উনি বললেন—“ ঠিক। কুসহর, এবার বলো ছোটে তোমাকে মারল কেন”?
ছোটে বলল, “ও আর কি বলবে, আমিই বলছি”।
সরপঞ্চ মুচকি হাসলেন। “মোকদ্দমায় নম্বর হিসেবে চলতে হয় পালোয়ান। প্রথমে ফরিয়াদী, তারপর আসামী। ঘাবড়িও না, তোমার নম্বরও আসবে”।
--“কে ঘাবড়াচ্ছে! আর তুমিও ঘাবড়িও না। ভগবান চাইলে একদিন তোমার নম্বরও এসে যাবে”।
সরপঞ্চ এর জবাব না দিয়ে কুসহরকেই ফের জিজ্ঞেস করল,”তো বলে ফেল ভাই, ছোটে তোমাকে মারল কেন”?
--“কী আর বলব। কেন মারল? নতুন শিঙ-ওঠা বলদ কেন কাউকে গুঁতোয়—এটা কোন প্রশ্ন হল? নওজোয়ান, তায় পালোয়ান। গাঁয়ে কেউ সাহস করে এর সঙ্গে লড়তে যায় না। তো এর শরীর মসমস করে, হাত চুলকোয়। এসবের জ্বালায় আমার গায়েই হাত তুলল—“।
-“একদম ভুল। একহাতে তালি বাজে না। তুমিও কিছু-না-কিছু অবশ্য করে থাকবে”।
কুসহর গলার স্বর নরম করে বলল,”আমি কী করতে পারি সরপঞ্চজী? আমি কি ছোটের সঙ্গে কুস্তি লড়ব”?
সরপঞ্চজী মুখ বেঁকালেন। নীচের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে যেন খুব চিন্তা করছেন এমন ভঙ্গীতে বললেন, “তুমি এত সোজা নও কুসহর। এখানকার আদালত তোমাকে হাড়ে হাড়ে চেনে। আমি গোপনে চর লাগিয়ে আসল ঘটনা জেনে নিয়েছি। এই বয়সেও তোমার মেয়েবাজির সখ যায়নি। আমাকেই ঢপ দিচ্ছ মহারাজ? তুমিও কিছু কম নও”।
কুসহর বলল, “সরপঞ্চজী, আমাকে বাড়িতে লাঠিপেটা করল। আর এখানে তুমি কথার ঘায়ে মারছ , এটা কী রকম ন্যায়”?
মালা জপতে থাকা পঞ্চ সরপঞ্চকে বলল, “যা ঢাকা রয়েছে তা ঢাকা থাকুক প্রভো! আর তুমি বেশি খুঁচিও না কুসহর মহারাজ! তুমি ভারি মহাত্মা! সব জানা আছে”।
ইউএনও মার্কা সত্যবাদী পঞ্চ সরপঞ্চকে বলল, “মামলা চলুক। কুসহর যাই হোক, যেমনই হোক, আমাদের সামনে মামলাটা তো ৩২৩ ধারার। ওতেই লেগে থাকুন”।
কিন্তু সরপঞ্চের মাথায় মামলার গরম চড়ে গেছল। তেরিয়া হয়ে বলল, “তুমি কী জান কোথায় কী হচ্ছে? একটু আগে তহসীল অফিস থেকে ফিরছিলাম। পথে অনেকের সাথে কথা হল। শনিচরও ছিল। সবাই যা যা বলল, শুনে কান নোংরা হয়ে গেল। এই কুসহর কারও চেয়ে কম নয়। যতটুকু মাটির উপরে ততটাই মাটির নীচে। গ্রামের---“।
এই অপমান কুসহরকে ধ্বসিয়ে দিল। ও অসহায় ভাবে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। বয়সকালে ও খুব গরম মেজাজের ছিল, তবে সবটাই মারপিটের সময়ে। কায়দা-কানুনের সামনে ও সবসময় দীনহীন। এই সময় ও দশদিকেই হাতজোড় করতে লাগল। ওর চোখ থেকে দুঃখ ঝরে পড়ল বলে।
কিন্তু দুই পঞ্চ আর সরপঞ্চ আরামসে বসে চুপচাপ ওর কাহিল অবস্থা দেখে চলেছে। কুসহর এবার ধীরে ধীরে মাথা তুলে ছোটে পালোয়ানের দিকে তাকাল। আর ওদিকে দেখতেই ওর মুখ হাঁ হয়ে গেল।
ছোটের ভ্রু টেরা হয়েছে, ঠোঁট শক্ত করে চাপা। ও নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে উঠে সরপঞ্চকে বলল , “এই কথার পাঁচফোড়ন! টিকটিক করা বন্ধ কর। একটা কানের নীচে তড়াক্ করে দিলেই ফাইল-টাইল নিয়ে মাটির নীচে সেঁধিয়ে যাবে। দু’ঘন্টা ধরে দেখছি, আমার বাপকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে হারামী বলা হচ্ছে। আমার বাপ হারামী হলে তোমার বাপ কী”?
বলতে বলতে ছোটে’র আওয়াজ গমগম করে উঠল। “আমি এখনও মরে যাইনি। যদি আসল বাপের হোস্ তো আমার বাপকে গালি দিয়ে দেখ”।
চারপাশে সন্নাটা! চাপরাশি ধীরে ধীরে চালের অন্য দিকে সরে গিয়ে বেড়ালের মত একলাফ দিয়ে লুকিয়ে পড়ল। সরপঞ্চ হতভম্ব। মালা জপতে ব্যস্ত পঞ্চ চোখ বুঁজে বলল—প্রভো!
ছোটে একইভাবে গর্জাতে লাগল।–“এ প্রভো! তোমার মালাটালা মুখে ঠুঁসে পেট দিয়ে বার করব। এই প্রভো-প্রভোওয়ালা তামাশা পিচ করে বেরিয়ে যাবে। তুমিও আমার বাপকে গালি দিচ্ছিলে”।
কুসহরের মুখে এবার বোল ফুটল,” এ ছোটুয়া! ঢের হয়েছে। এবার চুপ কর। আদালতের ব্যাপার। উল্টে মামলা হতে পারে”।
“তুমি এইসব ভেবে চুপ করে থাক বাপু। আমি সব জানি। কাল শহরে যাচ্ছি। আর এদের বিরুদ্ধে মামলা লাগিয়ে আসছি। ব্যাটারা ভরা সভাতে তোমাকে না জানি কী কী সব বলেছে! যদি এদের এক-একটাকে জেলের কোঠিতে চাক্কি না পেষাই, তো আমি তোমার পেচ্ছাপ থেকে পয়দা হইনি”।
এইসব বলতে বলতে ও কুসহরের হাত ধরল এবং একরকম হ্যাঁচড়াতে হ্যাঁচড়াতে বাইরে নিয়ে গেল।
(চলবে)
0 comments: