Next
Previous
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in



















১০

জেরাল্ডের এপার্টমেন্টটার কথা আগেই লিখেছি। তবে সেটার খুঁটিনাটি বর্ণনা এখন থাক। পরে যখন বের্নহার্ড সেখানে যাবে, তখন নাহয় তার চোখ দিয়েই আমরা সেখানকার ব্যাপারস্যাপার জেনে নেব।

আসলে সবারই টাকাকড়ির প্রয়োজন। অদ্ভুত এইসব ছেলেমেয়েগুলো যারা বাড়িঘর ছেড়ে এসে শহরে পড়ে আছে, যাদের এখনও কোনো চাকরিবাকরি জোটেনি, অথচ সবার প্রতিভা আছে। প্যারিসে আসবার পর প্রথম প্রথম সবার বেশ আত্মবিশ্বাস থাকে; কিন্তু কিছুদিন পরে আর ভেবে কূলকিনারা পায় না যে কী ভাবে কোন কাজ করা উচিত। নিজেদের দুর্ভাগা মনে করতে শুরু করে তারা, এবং এই পরিস্থিতি যদি অনেকদিন ধরে চলে, তাহলে যেভাবে হোক টাকাকড়ি রোজগার করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাটাই তখন তাদের জীবনের প্রধান উদ্দেশ্যে পরিণত হয়।

ব্যাপারটা খুব অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু আবার খুব অনায়াস সুন্দরও নয় যখন মানুষ নিজের সহজাত প্রবৃত্তিতেই অস্তিত্বরক্ষার লড়াইতে নেমে পড়ে। পুরো প্রক্রিয়াটা সাধারণত স্থূল প্রকারের হয়; তাছাড়া এই প্রক্রিয়াটা অবিরত চলতে থাকে। সবকিছু হঠাৎ নগ্ন এবং বেয়াব্রু হয়ে পড়ে এবং মানুষ অদ্ভুত উদ্ধত এবং হিংস্র আচরণ করতে শুরু করে। বের্নহার্ড নিজের স্কুলে বা সঙ্গীতবিদ্যালয়ের ছেলেদের মধ্যে এর আগে এরকম ব্যাপার দেখেছে। ফার্দিনান্দের মাসের শেষের দিকে পয়সা ফুরিয়ে যেত। তখন সসেজ আর বাঁধাকপির স্যালাদ খাবার জন্য সে অন্যের কাছ থেকে ধার করত। কিন্তু সবসময় কাছাকাছি কোনো না কোনও অভিভাবক থাকতেনই, বাবা মা কিম্বা মাসি কিম্বা পরিবারের অন্য কোনো সদস্য বা পারিবারিক বন্ধু। কোথাও না কোথাও একটা অবলম্বন বা নির্ভরতা থাকত। কিন্তু এখানে, মানে প্যারিসে, সে এমন অনেককে দেখেছে, যারা বলে যে “জে নে তু সাঁপ্লুমো পেরসোঁ” মানে তাদের একেবারে কেউ নেই। এই “Je n'ai tout simplement personne” শব্দটা, মানে দুনিয়ায় একেবারে কেউ না থাকার ব্যাপারটা বের্নহার্ড প্রথম শুনেছিল এক তরুণ রাশিয়ানের কাছে, যে লাঞ্চ করবার পরে তাকে বলেছিল টাকাটা দিয়ে দিতে, কারণ সে একেবারে কপর্দকশূন্য।

বের্নহার্ডের বাড়িওয়ালী মাদাম দুবোয়ার কাছে আরও একজন ছাত্র থাকে, চার্লস, যে নিজের স্নাতক পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। ছেলেটা বেশ লক্ষ্মীছাড়া ধরনের, উনিশ বছর বয়স, গতবছরের দ্বিতীয় সেমিস্টারে ফেল করেছে। ছেলেটার বাবা একটা ছোট মফস্বল শহরে থাকেন। প্রতি মাসে তিনি ছেলেকে একটা করে চিঠি লেখেন। তিনি মাদাম দুবোয়ার কাছে সরাসরি টাকা পাঠিয়ে দেন। মাদাম দুবোয়া সেই টাকা থেকে মাসে চার বার করে প্রতি সপ্তাহে চার্লসের হাতে দরকারি টাকাকড়ি দেন; অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে হিসেব করে তিনি এই কাজটা করেন এবং অগ্রিম একেবারেই দিতে চান না। তাছাড়া তিনি সব কাপড়জামা ধুয়ে ভাঁজ করে গুছিয়ে রাখেন, যদিও সেসব করতে তিনি একেবারেই বাধ্য নন। চার্লসকে তিনি মায়ের মতই যত্নআত্তি করেন। বের্নহার্ড এখানে আসবার আগে সে একাই ছিল মাদাম দুবোয়ার বাড়িতে। কিন্তু এই তরুণ গাঢ় ব্লন্‌ড চুলের জার্মান এই বাড়িতে এসে তার রাজত্বে ভাগ বসিয়েছে। মাদাম দুবোয়ার হৃদয়ে সম্ভবত চার্লসের জন্য আগের মত স্নেহ আর নেই। অনেক কিছু ঘটেছে। এই নতুন ছেলেটা শুধু যে নিজের ঘরদোর ঠিকমত গোছগাছ করে রাখে, তাই নয়, দেখা হলেই খুব সুন্দর করে মাদাম দুবোয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ স্বরে সুপ্রভাত জানায় এবং জিজ্ঞেস করে যে কেমন আছেন তিনি। মাদাম দুবোয়া চার্লসের জামাকাপড়, স্যুট ধুয়ে ইস্ত্রি করে দিলেও সে কখনই উল্টে কিছু বলে না, বরঞ্চ এমন ভাব করে যেন এসব তার জন্মগত অধিকার। এদিকে বের্নহার্ডকে মাদাম দুবোয়া যে কোনও কিছু পরিষেবা দিলেই সে সঙ্গে সঙ্গে ধন্যবাদ জানায়।

এছাড়াও চার্লসের বেশ কিছু বদ অভ্যাস আছে, যে কারণে ক্রমশ মাদাম দুবোয়ার স্নেহের জায়গাটা থেকে সে সরে যাচ্ছে। প্রতি রাতে সে দেরি করে ফেরে বাড়িতে। এপার্টমেন্টের দরজাটা খুলে ঢুকবার সময় প্রচুর আওয়াজ করে এবং সাধারণত করিডোরের আলোটা নেভাতে ভুলে যায়। মাঝরাত অবধি নিজের ঘরে বসে সিগারেট খায়, তারপর সিগারেটের পেছনের অংশটা অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে ঘরের মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে। বাইরে থেকে খাবার কিনে এনে ঘরে বসে খায় তারপর বাকি খাবার কাগজে মুড়ে ড্রেসিং টেবিলে রেখে দেয় দিনের পর দিন। এইসমস্ত বদ অভ্যাস বাড়িওয়ালীকে সহ্য করতে হয়। তবুও এমনিতে সব মিলিয়ে তার ব্যবহার খারাপ নয় বলে মাদাম দুবোয়া তার এই বদ অভ্যাসগুলিকে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখে থাকেন। তিনি তলিয়ে ভেবে দেখেছেন যে হয়তো শিশুকালের কিম্বা সাম্প্রতিক কোনও যন্ত্রণাকাতর অভিজ্ঞতার ফলেই চার্লস এত অগোছালো আর বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এইসব পর্যবেক্ষণ করে মাদাম দুবোয়ার হৃদয় স্নেহে দ্রব হয়ে যায়, আবার একই সঙ্গে তিনি কিছুটা অপরাধবোধেও ভোগেন; কারণ তিনি এরই মধ্যে সুন্দর এই জার্মান কিশোর বের্নহার্ডকে এই অগোছালো তরুণ চার্লসের থেকে একটু বেশি স্নেহ করতে শুরু করেছেন।

একদিন সকালে দু’জনের দেখা হল সিঁড়িতে। চার্লস থেমে দাঁড়িয়ে বের্নহার্ডকে বলে, ‘আপনার সঙ্গে কিছু কথা ছিল।’ বের্নহার্ড বিনীতভঙ্গিতে বলে ‘নিশ্চয়ই’। তারপর চার্লসের পিছুপিছু তার ঘরে যায়। চার্লসের ঘর তার ঘরের উল্টোদিকেই। চার্লস তার ঘরের জানালা বন্ধ করে একটা চেয়ার এগিয়ে দেয়। বের্নহার্ড ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখে যে বেশ কিছু বই চারদিকে ছড়ানো ছেটানো রয়েছে। বেশির ভাগ পাঠ্য বই, কুর্স সুপেরিয়া অথবা মধ্যযুগের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। চার্লসের মেজাজমর্জির সঙ্গে বইগুলো ঠিক খাপ খাচ্ছে না…

দু’জনে মুখোমুখি বসে। তাদের হাত টেবিলের উপরে রাখে। টেবিল ল্যাম্পের আলো পড়ে তাদের মুখে।

চার্লসকে খুব অস্থির দেখাচ্ছে। দুই চোখ দিয়ে যেন সে গোটা দুনিয়াটা গিলে নেবে। প্রতিটি কথার সঙ্গে এলোমেলো নিঃশ্বাস পড়ছে। সে যেভাবে কথা বলছে, নিজের মনের ভাব প্রকাশ করবার চেষ্টা করছে, এই পুরো প্রক্রিয়াটা ভয়ানক ক্লান্তিকর। সে যেন সঠিক শব্দটি খুঁজে পাচ্ছে না কথা বলতে গিয়ে, নিজস্ব বক্তব্যের মধ্যে স্বচ্ছতা আর ব্যাপ্তি আনবার চেষ্টা করতে গিয়ে যেন ক্রমাগত লড়াই করে চলেছে এই তরুণ। প্রথম সাক্ষাতে তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বের্নহার্ডের বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল। সে বুঝতে পারছে না যে চার্লস তার কাছ থেকে কী চায়। হঠাৎ তার নিজের স্কুলের বন্ধু কার্লের কথা মনে পড়ল, যার সঙ্গে মিলেমিশে সে লাতিন ক্লাসের প্রজেক্টগুলো করত। কার্লেরও ভাল নাম চার্লস, যদিও এই সামনে বসে থাকা ফ্যাকাসে, ভয়ঙ্কর প্রলাপ বকে যাওয়া ঘোরগ্রস্ত মানুষের সঙ্গে কার্লের তেমন কোনও মিল নেই।

কিন্তু চার্লস তার কাছে ঠিক কী চায়? বের্নহার্ড জানে না যে তার পক্ষে আদৌ কতখানি করা সম্ভব চার্লসের জন্য। চার্লস যে ভীষণ বাড়াবাড়ি রকমের অস্বাভাবিক আচরণ করছে, নিশ্চয়ই তার পেছনে কোনও কারণ আছে: চার্লসের জীবনে নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক কিছু ঘটে গেছে। সেগুলোর মুখোমুখি হতে পারছে না সে, কিন্তু ধীরে ধীরে নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টা করছে। অপ্রত্যাশিতভাবে সে বিস্মিত হয়েছে, নিজেকে প্রতারিত মনে হচ্ছে তার, অসহায় বোধ করছে সে। তার মনে হচ্ছে যে তার পাশে এখন কেউ নেই।

পুরো ঘটনাতে অবশ্যই তার নিজের দোষ আছে। অদ্ভুত অযৌক্তিক এক জীবন সে যাপন করছে। কোনও কিছুতে পরোয়া নেই, লজ্জা নেই। নিজের শরীরের যত্ন নেই, অথচ সে যে শারীরিকভাবে খুব শক্তিশালী বা সুস্থ, ব্যাপারটা এমনও নয়। শুধু শরীর নয়, তার আত্মাও ভুগে চলেছে তার অতিরিক্ত চাহিদার কারণে। চার্লসকে বাইরে থেকে যতই রুক্ষ এবং নির্মম দেখাক না কেন, ভেতরে ভেতরে সে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ এবং সংবেদনশীল। সে যে কাজেই হাত দেয়, সেটা করতে গিয়ে তার কোনও মাত্রাজ্ঞান থাকে না। যে কোনো বিপদ, যে কোনও অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে আগ বাড়িয়ে এগিয়ে যায় এবং তারপর বিপজ্জনক ভাবে তার মধ্যে ফেঁসে যায়। যদি কেউ তাকে জিজ্ঞেস করে যে সে কেন এমন করছে, কারণ সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান হওয়া সত্ত্বেও এক অর্থহীন জীবন যাপন করছে, তাহলে হয়তো উত্তরে সে বলবে যে সে নিজেকে নিজেই ঘেন্না করে।

‘জে মি দিতেস্ত’ (Je me déteste)… ‘আমি নিজেকে ঘেন্না করি’ এই হল তার প্রতিদিনের লব্জ। যদিও এইসব কথা সাধারণত মানুষ ধর্তব্যের মধ্যে আনে না, তবুও এইসব কথা থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায় তার আত্মধ্বংসী মানসিকতা।

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in



















২০.২

ওই তিন নম্বর কিসসার জাদুতেই রঙ্গনাথ আজকাল ভয়ডর শিকেয় তুলে বেলাকে নিয়ে কল্পনা করতে শুরু করেছে। ক’দিন আগে মেলা থেকে ফেরার সময় রুপ্পনবাবুর প্রেমপত্র নিয়ে যে কিসসাটি শুনেছিল তারপর আর রুপ্পনের সঙ্গে এ’নিয়ে কোন কথাবার্তা বলার হিম্মৎ হয়নি। এখন এই খালি সময়ে বেলাকে নিয়ে ওর মনে যে ঝড় উঠেছে সেটা শান্ত করতে ওর সহায় শুধু কল্পনা, হস্তমৈথুন আর কুন্ঠা ছাড়া উপায় কি! তবে এইসব যুগে যুগে শিল্পীদের প্রেরণা যুগিয়েছে। তাই এখন রঙ্গনাথ এক শিল্পীর জীবনযাপন করছে বলা যেতে পারে।

ও দেখতে কেমন?

“মধুমতী” সিনেমার বৈজয়ন্তীমালার মত? নাকি “গোদান”এর শুভা খোটে? অথবা “অভিযান” এর ওয়াহিদা রহমান? না না, এরা সব তো অনেক আগেই ভারতমাতা হয়ে গেছে। বেলা এখনও বেশ তাজা। কেমন হবে? জানা নেই। কিন্তু যাই হোক, যেমনই হোক, হবে তো “ খুদা কী কসম লাজবাব”! চৌধবী কা চাঁদ সিনেমার গানের কলি রঙ্গনাথের গলায় হাড়ের মত আটকে গেছে, তবু মুখে হাসি ফুটেছে। অন্ধকারে প্রায় দেড় ইঞ্চি চওড়া মুচকি হাসি, বড় মধুর।

বেলাকে নিয়ে অনেক ভেবেছে। এত ভেবেছে যে নানান মাপের এবং ওজনের শ’খানেক নিতম্ব ও স্তন ওর মাথায় ভাসছে আর ডুবছে। ওগুলো জোড়ায় জোড়ায় হাজির হয়, গোছা গোছা ফুটে ওঠে, তারপর একে অন্যকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে যায়। রঙ্গনাথের খুব ইচ্ছে যে এগুলো থেকে একটা ভরন্ত নারী শরীর দেখা দিক, কিন্তু সে গুড়ে বালি! ওর কল্পনায় একবার একটি নারীদেহ এল বটে, কিন্তু তাতে চেহারা গায়েব! ওর মনে খানিকক্ষণ কুছ বাতিল স্তনের গোলা আকার খেলা করতে লাগল। শেষে, উত্তিষ্ঠত-জাগ্রত শরীরকে ঢিলে করার পর ও লেপের ভেতর সেঁধিয়ে গেল।

পরের রাত। রঙ্গনাথ ছাতে একা শুয়ে রয়েছে। কিন্তু বেলার কথা ভুলে গিয়ে ওর মামা বৈদ্যজীর ক্রোধে তমতম করা বীর্যময় চেহারা মনে পড়ছে।

দিনের বেলা শনীচর আর কালিকাপ্রসাদের চেষ্টায় তৈরি কো- অপারেটিভ ফার্মের উদ্বোধন হয়েছিল। মুখ্য অতিথি হয়ে যে অফিসার এসেছিলেন বৈদ্যজী তাঁকে নিজের সমবায় ইউনিয়নে টাকা তছরুপের ঘটনার উল্লেখ করলেন। তারপর ওনাকে মনে করিয়ে দিলেন যে তছরুপ হওয়া টাকা যাতে সরকার অনুদান হিসেবে সমবায় ইউনিয়নকে দিয়ে দেয় সে’ বাবদ একটি প্রস্তাব ওনাদের দপ্তরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।

বৈদ্যজী শীতল স্বরে ওনাকে বোঝাতে চাইলেন যে সরকার ওই অনুদান না দিলে এটাই বোঝা যাবে যে সরকারি আমলারা সমবায় আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে উৎসুক নন।

অফিসারটি বোধহয় ডেল কার্নেগীর বিখ্যাত “প্রতিপত্তি ও বন্ধুলাভ” বইটি সদ্য সদ্য পড়েছেন। উনি বৈদ্যজীর প্রত্যেকটি কথায় বলতে লাগলেন “আপনি ঠিক বলেছেন, কিন্তু ----“। এই বাক্যটি উনি সাতবার আউড়েছিলেন। আটবারের সময় ওনার গলার থেকে “আপনি অনুদান পেয়ে যাবেন” গোছের সুমধুর গান ঠিক বেরয় নি। বরং সেই পুরনো হেজে যাওয়া বাক্য-- “আপনি ঠিক বলেছেন, কিন্তু—“।

এবার শোনামাত্র বৈদ্যজীর মধ্যে দুর্বাসা মুনির ক্রোধ, হিটলারের একনায়কত্ব এবং নেহেরুর বিরক্তি একসঙ্গে জেগে উঠল। আর উনি সেই অফিসারের আদ্যশ্রাদ্ধ করতে লাগলেন—“এভাবে দেশোদ্ধার করবেন? এইসব ‘কিন্তু’,’পরন্তু’, ‘অধিকন্তু’, ‘তথাপি’ দিয়ে? এসব কী? শ্রীমান্‌ এগুলো নপুংসকের ভাষা। অকর্মণ্য ব্যক্তি এভাবেই নিজেকে এবং দেশকে বঞ্চিত করে থাকে। আপনার নির্ণয় স্পষ্ট হওয়া উচিত। কিন্তু! পরন্তু! থুঃ”!

বৈদ্যজী থামলেন না। দেশের দুর্দশা নিয়ে এক পেল্লায় লেকচার ঝাড়লেন। তাতেও পুরোপুরি শান্ত না হয়ে খানিকক্ষণ গজগজ করতে লাগলেন। অফিসারটিও অনেক বিনম্র, কিন্তু খানিকক্ষণ গজগজ করলেন। তারপর বাকি সবাই গজগজ করতে লাগল। শনিচরের জলসা তো অনেক আগেই শেষ। কাজেই এই সব গজগজানিতে ওর সাফল্যে কোন কলংকের দাগ লাগেনি। তবে শেষ পর্য্যন্ত গজগজানিরই জয়!

রঙ্গনাথ ওর শহরবাসের সময় এ’ধরণের গজগজানি অনেক শুনেছে। সব সময়, সব জায়গায়। ও জানত যে আমাদের দেশ হল গজগজানির দেশ। অফিসে, দোকানে, কলকারখানায়, পার্ক এবং হোটেলে, খবরের কাগজে, গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধে—যেদিকে তাকাও লোক গজগজ করছে তো করছেই। ও ভাল করে বুঝে গেছল—এটাই আমাদের যুগের চেতনা।

তবে এখানে গাঁয়ে এসেও সেই গজগজানি! চাষিরা সরকারি আমলাদের নিয়ে গজগজ করে। আমলারা প্রথমে জনতার থেকে নিজেকে আলাদা করে নিয়ে জনতার বিরুদ্ধে গজগজ করে। তারপর এক নিঃশ্বাসে নিজেকে সরকার থেকে আলাদা করে সরকারের বিরুদ্ধে গজগজ করে। সবারই কোন না কোন কষ্ট, কিন্তু কেউ দুঃখকষ্টের মূলে যেতে রাজি নয়। কষ্টের যা কিছু তাৎক্ষণিক কারণ চোখে পড়ছে শুধু সেটা নিয়েই যত গজগজানি!

কিন্তু বৈদ্যজী ছিলেন ব্যতিক্রম, কখনও গজগজ করতেন না। আজ রঙ্গনাথের বুক ভেঙে গেল। ও ভেবেছিল মামাজী প্রথমে পবিত্র ক্রোধে গর্জে উঠবেন, ফের শুরু হবে প্রচন্ড বৃষ্টি, মুষলাধার। উনি গর্জে তো উঠেছিলেন, ফের গজর গজর করে বসে পড়লেন।

কেন?

ওই অফিসারটি লেজ নাড়াতে নাড়াতে এবং গজগজ করতে করতে ইশারা করল যে কো-অপারেটিভের তবিল তছরুপের ব্যাপারে স্পেশ্যাল অডিট করানো জরুরী।

রঙ্গনাথ ভাবল—এটা গর্জে ওঠার নয়, বরং গজর গজর করার দেশ।


রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে এক স্থুল কর্কশ আওয়াজ রঙ্গনাথের কানে থাপ্পড়ের মত আছড়ে পড়ল। কুশহরপ্রসাদ নিজের ঘরের চৌকাঠে বসে কাউকে গাল পাড়ছে। ও গজগজকরার দলের বুড়ো নেতা বটেন। কিন্তু ও কান্নাকাটি করছে না এবং ওর গালাগালের লক্ষ্য ওর ছেলে ছোটে পালোয়ান নয়, অন্য কেউ। কাকে গালি দিচ্ছে বোঝা মুশকিল। কারণ, কুশহর যখন ছোটেকে গালি না দিয়ে অন্য কাউকে দেয়, তখন অস্পষ্ট ভাববাচ্যে বলে। যেমন জঙ্গলে ময়ুর নাচে, উদবোধনের সময় নেতাগণ বলে থাকেন।

শব্দ! নিতান্ত জুমলা মাত্র। কুশহরপ্রসাদ থেকে থেকে গরজায়, ফের চুপ মেরে যায়। গাঁয়ের অন্য মুড়োয় একটা নেড়ি কুকুর ভৌ ভৌ করে, তারপর হঠাৎ ক্যাঁ ক্যাঁ করে ওঠে। মনের ভেতর কুকুরটার যে ছবি ফুটে ওঠে তাহল-- লেজ পেছনের দু’পায়ের ফাঁকে, মুখটা বুকের উপর ত্যাড়া হয়ে লটকে আছে, আর ডানদিক থেকে কারও লাঠির বাড়ি খেয়ে এঁকে বেঁকে চলছে। আরও ক’টা কুকুর ডেকে ওঠে।

রামাধীন ভীখমখেড়বী’র বাড়ির দরজা থেকে কোন নবযুবকের চড়া সুরে মিনমিন করে গাওয়া গান ভেসে আসছে। কান পেতে শুনলে বোঝা যায় ওটা কোন যাত্রাপালার গানের কলি।

“তোর মুখের কথা শুনে আমি এই বুঝেছি সার,

প্রেমে পড়েছিস কোন কাঙালের—চিত্ত চমৎকার”।

ও বারবার ওই একটা লাইন গেয়ে চলেছে। গাইতে গাইতে ওর গলা ধরে যায়, স্বর কেঁপে ওঠে। এটা হয়ত দেশি চোলাইয়ের প্রভাব, অথবা সত্যিই সে নিজের প্রেমিকার দুর্ভাগ্যে কাঁদছে। কেন যে এক ভিখিরির প্রেমে পড়ল! গাঁয়ের চার-পাঁচটা বখাটে ছোঁড়া নীচের গলি দিয়ে চলে গেল। গয়াদীনের ঘরে চুরি হওয়ার পর থেকে ওরা পালা করে রাত-পাহারা দেয়। আর “জাগতে রহো” হাঁক পাড়তে পাড়তে কিছু নতুন শ্লোগান তৈরি করে নেয়।

“জাগতে রহো!

সিকি আধুলি রূপোর চাঁদি,

জয় হোক তোমার মহাত্মা গাঁধী”!

সব শ্লোগানই মহা ফালতু। এখন সিকি আধুলির চলন কোথায়? সব তো পঁচিশ আর পঞ্চাশ নয়া পয়সা। সিকি খতম, আধুলি খতম, মহাত্মা গান্ধীও খতম। এরা বুঝে না বুঝে, কিছু না ভেবে স্লোগান দিয়ে যায়। কোথাও একটা রেলগাড়ি যাচ্ছে। ইঞ্জিনের তীব্র সিটি দূরে মিলিয়ে যেতে যেতে এসব শ্লোগানের উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিত স্বরকে খানিকক্ষণ চেপে দেয়।

ক্রমশঃ ফিকে হয়ে আসা আওয়াজ আর গাঢ় অন্ধকারের মাঝে কখন যে ঘুম এসে গেছল! ঘুমের মধ্যে রঙ্গনাথের মনে হল ও একটা লিফটে চড়ে দ্রুত বেশ ক’টা তলা ছাড়িয়ে নীচে নামছে। হঠাৎ লিফট এক ঝটকায় তিন চার তলা ছাড়িয়ে উপরে উঠতে লাগল। রঙ্গনাথ ছটফটিয়ে উঠল।

নারকেল তেল আর কোন শস্তা সেন্টের গন্ধ ওর নাকে ঢুকছে। গন্ধটা না ভাল, না বিচ্ছিরি—শুধু গন্ধ মাত্র। চুড়ির হালকা রিনিঠিনি ওর ঘুমন্ত চেতনায় এক ধাক্কা দিল। এক মুহুর্তে ওর এমন অনুভূতি হল যা সারাজীবন খাজুরাহো কোণার্কের শিল্পকলা অধ্যয়ন করেও মানুষ শিখতে পারে না।

মেয়েটি এসে খাটিয়ার এক কোণায় বসেছে। ওর এক হাত রঙ্গনাথের অন্য পাশে। রঙ্গনা্থে বুকে এক জোড়া স্তনের ভারী চাপ। যদিও ওই যুগল স্তন আর ওর বুকের মাঝখানে স্তন ঢাকা কাপড় এবং রঙ্গনাথের লেপ রয়েছে। তবু স্তনের দৃঢ় স্পর্শ এবং উষ্ণতা সব বাধা পেরিয়ে ওকে স্পর্শ করছে। রঙ্গনাথের নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়।

কেউ রঙ্গনাথের মুখের থেকে লেপ সরিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ঘুরঘুট্টি আঁধারে কেউ কাউকে ভাল করে দেখতে পাচ্ছে না। ওর বুকে বারুদ ভরা উষ্ণ স্পর্শের ছোঁয়া আর চাপ যেন আরও বেড়ে গেছে। তখনই ওর গালের উপর এক কোমল রেশমী গাল নেমে এল। কেউ গহন নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল- ওমা, ঘুমিয়ে পড়লে নাকি?

রঙ্গনাথের ঘুম হাওয়া হয়ে গেছে। ও মাথা নাড়ল আর মুখ থেকে এক অস্বাভাবিক স্বর বেরিয়ে এল—কে? কে তুমি?

এক মুহুর্তের জন্য বুকের উপর চেপে বসা যুগল স্তনের ধুকধুকি থেমে গেল। কেউ এক লাফে খাটিয়া থেকে সরে ছাদের এক কোণে চলে গিয়েছে। চাপা গলায় মেয়েলি স্বরে শোনা গেল—‘হায় মেরী মাইয়া’!

ও মাগো!

মাকে স্মরণ করা খুব ভালো। কিন্তু এখন শুধু ঘাবড়ে গিয়ে মুখ থেকে মাতৃনাম বেরিয়েছে। রঙ্গনাথ লেপ ছুঁড়ে ফেলে উঠে বসেছে। কিন্তু ততক্ষণে অজানা অদেখা মেয়েটি এই ছাত থেকে ওই ছাত, সেখান থেকে সেই ছাত করে-টরে আর কোথাও অদৃশ্য হয়ে গেছে।

খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গিয়ে ও বারান্দায় এল। বাইরে ঠান্ডা। ও কান খাড়া করে চেষ্টা করল—যদি কিছু শোনা যায়। কিন্তু হাওয়ার সরসরানি ছাড়া আর কিছু পেল না। যে এসেছিল তার “‘হায় মেরী মাইয়া’ বলে মাতার পবিত্র নাম স্মরণের পরে আর কিছু বোঝার বাকি ছিল না।

দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করে ফের খাটিয়ায় শোয়ার সময় ওর কিছু ব্যাপার মাথায় ঢুকল।

প্রথম, কোণার্ক, ভুবনেশ্বর, খাজুরাহোর নারীমূর্তির উরোজ যদি পাথরের রূপ ছেড়ে কারও বুকে চেপে বসে তাহলে কাউকে পাগল করার জন্যে যথেষ্ট।

দ্বিতীয়, পুরাতত্ত্ব এবং ভারতীয় শিল্পকলা নিয়ে আজ অব্দি যা পড়েছে সব ফালতু, ভুলে ভরা।

তৃতীয়, ভারতীয় শিল্পকলায় ডক্টরেট করার চেয়ে সুরলোকের সুন্দরীদের মত দুই জীবন্ত স্তনের আশ্রয় পাওয়া সফলতার পরাকাষ্ঠা।

আর এসব হালকা এলোমেলো কথার আড়ালে যে আসল কথা, যে আফশোস ওকে কুরে কুরে খাচ্ছে তা হল—শ্রীমান, আপনি একটা বোকাপাঁঠা! চেঁচানোর কী দরকার ছিল? ঘাবড়ে গেলে কেন? ওকে আরও কিছু করার সুযোগ দিয়ে দেখতে? তা না---!

শ্রীমান, আপনি শুধু বোকাপাঁঠাই নন, একটা গাধাও বটেন।

শ্রীমান, আপনি ওসব কিস্যু না। শুধু একজন সাধারণ হিন্দুস্তানী ছাত্র, ব্যস্‌। যার কপালে শুধু মেয়েদের ছবিই সম্বল।

অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও ঘুম এল না। একবার কিছু না ভেবেই নিজের বুক ছুঁয়ে দেখল। নাঃ, ওখানে কিছু নেই। শুধু নিজের রোমশ বুক।

কে মেয়েটি? ভাবার চেষ্টা করল, কিন্তু বৃথা। ওর চেতনা আচ্ছন্ন করে জোড়া পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে যে!

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in



















পঁচিশ

আজ সমীরণ ক্ষীরগ্রাম যাওয়া ঠিক করল।সমীরণ বলল, জনশ্রুতি অনুসারে এই জলাশয়ের দক্ষিণ দিকে দেবী সতীর ডান পায়ের আঙুল পড়েছে। দেবী যোগাদ্যা মায়ের স্থায়ী বাসস্থান এই জলাশয়ের নীচে। একমাত্র বৈশাখ সংক্রান্তিতে দেবীকে জল থেকে তুলে মূল মন্দিরে ভক্তদের সামনে রাখা হয়। এই দিন সবার অধিকার থাকে দেবীকে স্পর্শ করার পুজো দেবার। এই সংক্রান্তিতে সারাদিন ধরে মায়ের পুজো হয় ও গ্রামে মেলা বসে। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এই দীঘির ঘাটে মা যুবতীর বেশ ধরে শাঁখা পড়েছিলেন। সেই উপলক্ষে বৈশাখ মাসের উৎসবে মাকে শাঁখা পড়ানো হয় এবং গ্রামের বধূরাও ওই দিন শাঁখা পরে। পুজো শেষ হলে ভোরবেলা দেবীকে আবার ক্ষীরদীঘিতে রেখে আসা হয়। এছাড়াও বছরের অন্যান্য বিশেষ সময়ে দেবীকে জল থেকে তুলে মন্দিরে এনে পুজো করা হলেও ভক্তরা দেবীর দর্শন পান না। একমাত্র বৈশাখ সংক্রান্তির দিনই দেবীর দর্শন করা যায়।

পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে দেবী যোগাদ্যাকে ক্ষীরগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্বয়ং রাম। লংকায় রাম রাবণের যুদ্ধ চলাকালীন রাবণের ছেলে মহীরাবণ রাম ও লক্ষণকে মায়াজালে আবদ্ধ করে পাতালে নিয়ে আসে বলি দেবার জন্য।এই পাতালে মহীরাবণের আরাধ্যা দেবী ছিলেন ভদ্রকালি তথা দেবী যোগাদ্যা ।প্রতিদিন দেবীর সামনে নরবলি দেওয়া হতো। কিন্তু মহীরাবণের সেই উদ্দশ্য সফল হয় নি। হনুমান মহীরাবণকে পরাজিত করে রাম ও লক্ষণ কে উদ্ধার করেন। মা যোগাদ্যা রামের কাছে থাকতে এবং তার হাতে পুজো নেবার ইচ্ছে জানালে রাম দেবীকে পাতালপুরী থেকে পৃথিবীতে এনে এই ক্ষীর গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন। এই সব বর্ণনা কবি কৃত্তিবাসের রচনায় পাওয়া গেছে। যারা ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন তাদের মতে এই ক্ষীরগ্রাম থেকে বহু প্রাচীন পুঁথি উদ্ধার হয়েছে যেখানে যোগাদ্যা বন্দনার প্রায় ৪০টি পুঁথি পাওয়া গিয়েছে।

দেবী মূর্তিটি কালো কষ্টি পাথরের। দেবীর রূপ দশভূজা ও দেবী মহিষমর্দিনী। বলা হয় প্রাচীন মূর্তি চুরি যাওয়ায় বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ দাইহাটের নবীনচন্দ্র ভাস্করকে দিয়ে দশভূজা মহিষমর্দিনীর একটি প্রস্তর প্রতিমা তৈরি করিয়েছিলেন। এই প্রতিমাটিই ক্ষীরদীঘির জলের নীচে রাখা থাকে। তবে মূল মন্দিরে কোনো প্রতিমা নেই। গর্ভগৃহে বেদী রাখা আছে এই বেদীতেই মায়ের নিত্য পুজো করা হয়। মাকে আমিষ ভোগ প্রদান করা হয়। এই মন্দিরের একটু দূরে রয়েছে ভৈরব ক্ষীরকণ্ঠের শিব মন্দির। একসময় এক অলৌকিক ঘটনা ঘটে, হারিয়ে যাওয়া মূর্তিটি নিয়ে। ক্ষীরদীঘি সংস্কারের সময় নতুন মূর্তির সাথে খোঁজ মেলে হারিয়ে যাওয়া মূর্তির। পুরনো মূর্তি ফিরে পাবার আনন্দে গ্রামবাসীরা আরও একটি মন্দির গড়ে তোলেন। এই মন্দিরেই রাখা থাকে পুরনো যোগাদ্যা মূর্তিটি। ফলত এখন গ্রামে গেলে সারাবছরই মায়ের দর্শন পাওয়া যায়। এবং বৈশাখ সংক্রান্তির সময় গ্রামের দুই মন্দিরেই সমান আরাধনা চলে।

0

গল্প - মনোজ কর

Posted in



















 চতুর্থ এবং পঞ্চম পর্ব




 চতুর্থ পর্ব

পানু রায় বড়কালীর অফিসে ঢুকেই দেখলেন ঘর আলো করে সেক্রেটারির টেবিলে বসে আছে এক লম্বা, ফর্সা, নীলচক্ষু, কৃষ্ণকেশী সুন্দরী। বুঝতে অসুবিধে হলনা এই মহিলাই এলিনা রাই, বড়কালীর নতুন সেক্রেটারি। আসবাবপত্রগুলোর অবস্থানের কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে। টেবিলটা আগে যেদিকে ছিল সেখান থেকে সরিয়ে উল্টোদিকে রাখা হয়েছে। কুচকুচে কালো মেহগিনির প্রেক্ষাপটে এলিনা রাইএর রঙ যেন ফেটে বেরুচ্ছে। পানু রায় বুঝলেন টেবিলের অবস্থান পরিবর্তনের পিছনে অন্য কিছু ভাবনাচিন্তা কাজ করেছে। পানু রায় নিশ্চিত হলেন যখন দেখলেন যে জানালার পর্দার রঙ এমনভাবে নির্বাচন করা হয়েছে যাতে তার থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে ঘরের উজ্জ্বলতা অনেকগুন বেড়ে যায় আর তার সঙ্গে বেড়ে যায় এলিনার সযত্নে প্রসাধন করা মুখের ঔজ্জ্বল্য। পানু রায় দরজা খুলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অফিসের ফোন বেজে উঠলো। এলিনা হাসিমুখে পানু রায়কে স্বাগত জানিয়ে ফোনটা তুলে নিল। ঠোঁটের কাছে ফোনটা নিয়ে কয়েক মিনিট এত আস্তে কথা বলল এলিনা যে এত কাছে বসে থেকেও কিছুই শুনতে পেলেন না পানু রায়। শুধু শুনতে পাওয়া গেল ফোন রাখার সময় এলিনা বলল,’ কৃষ্ণকালী শহরে নেই। আমি দুঃখিত। আমি জানিনা উনি কবে ফিরবেন। আপনি কোনও মেসেজ দিতে চান? ও আচ্ছা, অনেক ধন্যবাদ।‘ফোন রেখে এলিনা পানু রায়ের দিকে তাকাল। পানু রায় বললেন,’ আমার নাম পানু রায়।‘

-আপনিই পানু রায়। আপনার কথা স্যারের কাছে শুনেছি। আপনিই ওনার আইনি পরামর্শদাতা, তাই না?’

-ঠিক বলেছেন।

-আপনার অফিস থেকে আপনার সেক্রেটারি একটু আগে ফোন করেছিলেন। বললেন আমি যেন স্যার ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই ওনাকে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলি।

-অনেক ধন্যবাদ। আচ্ছা, আপনি কি টেবিলটা সরিয়েছেন? ওটাতো আগে ওখানে ছিল না।

-না আমি সরাইনি।

-কিন্তু মনীষা যখন ছিল তখন ওটা উল্টোদিকে ছিল।

-হ্যাঁ, মনীষা টেবিলটা যেখানে রেখেছিল সেখান থেকে আমি সরিয়েছি। ও টেবিলটা ভুল জায়গায় রেখেছিল। ওখানে আলো ঠিকমত পৌঁছচ্ছিল না।

-মনীষার সঙ্গে আপনার কথা হয়?

-না, সেরকম কথা হয় না। তবে এখানে দু’বার এসেছিল। তার বেশি কিছু নয়।

-ওর নাম আগে মনীষা ঝা ছিল। এখন ওর পদবি কী হয়েছে জানেন?

-ওর সঙ্গে যার বিয়ে হয়েছে তার নাম পরেশ প্রসাদ।

-ঠিক ঠিক। আমার এবার মনে পড়েছে। আচ্ছা এলিনা, কৃষ্ণকালী এখন কোথায়?

-উনি ব্যবসার কাজে বাইরে গেছেন।

-কবে গেছেন?

-উনি গতকাল বিকাল থেকে অফিসে নেই।

পানু রায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এলিনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কোনও বিশেষ কারণে গেছেন?’

এলিনা বলল,’ না, বিশেষ কিছু নয়। আপনি তো জানেন উনি প্রায়ই ব্যবসার কাজে বাইরে যান। ওনার বিভিন্নরকম ব্যবসা আছে। তাছাড়া নানা শহরে ওনার সম্পত্তিও আছে।

পানু রায় বললেন,’ আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমি ওনাকে ব্যবসা সংক্রান্ত বিষয়ে আইনি পরামর্শ দিয়ে থাকি।‘

-হ্যাঁ, আমি ওনাকে আপনার সঙ্গে কথা বলতে শুনেছি।

-আমার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করার খুব দরকার।

-সেটা কি রেবা কৈরালা সংক্রান্ত কোনও বিষয়ে?

পানু রায় মুখের ভাবে কিছু প্রকাশ না করে জিজ্ঞাসা করলেন,’ কেন? একথা কেন জিজ্ঞাসা করছেন?’

এলিনা বলল,’ দেখুন সেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা। আমি চাই না এই আলোচনায় কোনও তৃতীয় ব্যক্তির প্রবেশ ঘটে। আমরা কি এই অফিস সামনে থাকে বন্ধ করে পিছনের দরজা খুলে স্যারের ব্যক্তিগত কেবিনে গিয়ে আলোচনা করতে পারি? সেখানে কেউ আসতে পারবে না।

পানু রায় বললেন,’ অবশ্যই।‘এলিনা চেয়ার থেকে উঠে লম্বা লম্বা পা ফেলে বাইরে বেরিয়ে অফিস বন্ধ করে পিছনের দিক দিয়ে গিয়ে একটা মস্ত দরজা খুলে একটা সুসজ্জিত বিশাল ঘরে ঢুকল। পিছনে পিছনে পানু রায়ও ঢুকলেন। এলিনা কৃষ্ণকালীর মস্ত মেহগিনি টেবিলের ওপর ভর দিয়ে সামনে ঘুরে পানু রায়ের দিকে সোজা তাকিয়ে এমন ভাবে দাঁড়াল যেন মনে হল কোনও সিনেমার শট দিচ্ছে।

- স্যার কিন্তু ভীষণ রেগে যাবেন যদি শোনেন যে আমি আপনার সঙ্গে রেবা কৈরালার ব্যাপারে কোনও কথা বলেছি। আপনি মানুষের চরিত্র ভালোই বোঝেন এবং আপনাকে নিশ্চয়ই বলে দেবার প্রয়োজন নেই যে রেবা কৈরালা একজন অত্যন্ত স্বার্থপর এবং ধুরন্ধর মহিলা।আপনি নিশ্চয়ই জানেন রেবা কৈরালার সঙ্গে স্যারের ছেলে কালীকৃষ্ণের খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল। এখন কালীকৃষ্ণের নজর একটি অন্য মেয়ের দিকে পড়েছে এবং রেবা কৈরালা স্যারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে। আমি বুঝতে পারছি না রেবার আসল উদ্দেশ্য কী? তবে রেবা নিজের লাভ ছাড়া আর কিছু বোঝে না। আমি রেবার ওপর গোয়েন্দাগিরি করতে চাই না এবং আশা করি আপনিও চান না। কিন্তু একটা কথা আপনাকে বলি, আপনি কিন্তু খতিয়ে না দেখে ওর গল্পে বিশ্বাস করবেন না।

এতটা বলে এলিনা একটু থামল। তারপর বলল,’ স্যার বা কালীকৃষ্ণ যদি ঘুণাক্ষরেও টের পায় যে আমি আপনাকে এসব কথা বলেছি তাহলে আমাকে সঙ্গে সঙ্গে তাড়িয়ে দেবে। অবশ্য তাহলেও স্যারের প্রতি আমার দায়বদ্ধতার কোনও পরিবর্তন হবে না। এখন আপনি বলুন আপনি আমাদের এই আলোচনার গোপনীয়তা রক্ষা করবেন না স্যারকে এই আলোচনার কথা জানিয়ে দেবেন।

পানু রায় বললেন,’ আপনি আমাকে বিশ্বাস করে কথাগুলো বলেছেন। কথা দিলাম সেই বিশ্বাস অটুট থাকবে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন কোনও তৃতীয় ব্যক্তি ঘুণাক্ষরেও একথা জানবে না।‘

এলিনা পানু রায়ের সামনে এগিয়ে এসে বলল,’ অনেক ধন্যবাদ।‘ তারপর নিজের হাতদু’টো পানু রায়ের দিকে বাড়িয়ে দিল। পানু রায় নিজের দু’ হাতের মধ্যে এলিনার হাতদু’টো নিয়ে বললেন,’ আমার বয়স ১০৫। এখন আমি আসি।‘ বিস্মিত এলিনা অবাক হয়ে দেখল শিরদাঁড়া সোজা করে দৃঢ় পদক্ষেপে দরজার ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেলেন পানু রায়।




 পঞ্চম পর্ব

বড়কালীর অফিস থেকে বেরিয়ে পানু রায় সুন্দরীকে ফোন করলেন। জিজ্ঞাসা করলেন,’ মনীষা ঝা মানে এখন মনীষা প্রসাদের ঠিকানা আছে তোমার কাছে?’ ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে সুন্দরী বলল,’দাদু, ধরে থাক। আমি তোমাকে মনীষার ফোন নম্বর কিংবা ঠিকানা দিচ্ছি।‘

-আমার ঠিকানা চাই।

কিছুক্ষণ পরে সুন্দরী পানু রায়কে মনীষার ঠিকানা জানিয়ে বলল,’ মনীষাকে আমার আদর আর শুভেচ্ছা জানিও।‘

‘অবশ্যই’ বলে পানু রায় হাত দেখিয়ে একটা ট্যাক্সি থামিয়ে মনীষার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। প্রায় আধঘন্টা পরে ট্যাক্সি ড্রাইভার বলল,’ এসে গেছি।‘ পানু রায় ভাড়া মিটিয়ে বললেন,’ একটু অপেক্ষা কর। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরব।‘

ট্যাক্সি থেকে নেমে বাড়িটার কাছে পৌঁছে বেল বাজাতে যাবেন ঠিক তখনই একগাল হেসে দরজা খুলে দাঁড়াল মনীষা। বলল,’ পানু রায়!!! আপনাকে কতদিন পরে দেখলাম। কি যে আনন্দ হচ্ছে আমার! ভেতরে আসুন।‘পানু রায় ঢুকতে ঢুকতে বললেন,’ তোমাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে, মনীষা।‘ মনীষা হেসে বলল,’ আপনি আগের মতই রসিক আছেন। আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে আর মাত্র দু’ মাস। আমাকে এখন দেখতে হয়েছে হাতির মত। আমি বাড়ির সব কাজ বন্ধ করে দিয়েছি। বসার ঘরটাও পরিস্কার করা হয় না। অপরিচ্ছন্নতা ক্ষমা করবেন। এই চেয়ারটায় বসুন। কী নেবেন চা না কফি? ‘

-না না, ঠিক আছে। আমি এসেছিলাম কৃষ্ণকালী সম্বন্ধে কিছু খবর জানতে।

-কী সংক্রান্ত খবর?

-আমি জানতে চাই কী করে ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে?

-কেন? উনি কি শহরের বাইরে?

-হ্যাঁ, সেটাই তো সমস্যার কারণ।

-আপনি এলিনার সঙ্গে কথা বলেছেন?

-হ্যাঁ, ওর সঙ্গেই প্রথমে যোগাযোগ করেছিলাম।

-কিন্তু যা জানার ছিল তা জানতে পারলেন না, তাই তো?

-না, আসলে কিছুই জানতে পারলাম না।

মনীষা হেসে বলল,’ আমিও দু’বার অফিসে গিয়েছিলাম।এমনি জানতে সব কী রকম চলছে। কোনও উত্তরই পাইনি। তাই আর যাইনা।

-তোমার সঙ্গে কৃষ্ণকালীর দেখা হয়েছিল?

-না, দু’বারের একবারও না। প্রথমবার আমি জানতাম উনি খুব ব্যস্ত ছিলেন কিন্তু দ্বিতীয়বার এলিনা তো স্যারকে জানাতেই চাইলনা যে আমি ওনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

-কিন্তু কেন? কিছু আন্দাজ করতে পার?

-আমি জানিনা। আমি স্যারের অফিসে কাজ করেছি প্রায় বারো বছর। বারো বছর সময় ওনার ব্যবসা এবং ওনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার পক্ষে যথেষ্ট, তাই না? ওনার স্ত্রীবিয়োগের পর উনি একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। উনি যখন আস্তে আস্তে স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে আসছিলেন তখনই আমার বিয়ের ঠিক হয়। কিন্তু ওনার এই অবস্থায় আমি কিছুতেই ওনাকে লম্বা ছুটি নেবার কথা বলতে পারছিলাম না। বিশ্বাস করুন আমি বিয়ে প্রায় তিন মাস পিছিয়ে দিলাম যাতে ওনার ব্যবসার কোনও ক্ষতি না হয়।

-তারপর?

- উনিই কী ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে আমি কিছু একটা ওনাকে বলতে পারছি না। তারপর আমার আঙ্গুলে হীরের আংটি দেখে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে আমার বিয়ে কবে। তারপর কথায় কথায় বুঝতে পারলেন যে আমি ওনার কাছে ব্যাপারটা লুকোতে চাইছি। উনি ভীষণ রাগারাগি করলেন। বললেন এটা আমার করা উচিৎ হয়নি এবং আর দেরি না করে বিয়েটা সেরে ফেলতে। না হলে, উনি আমাকে আর অফিসে আসতে দেবেন না। এমন মানুষ আজকের দিনে সত্যিই পাওয়া যায় না।

-যখন তুমি ওখানে ছিলে তখন রেবা কৈরালার কথা শুনেছিলে?

-না, রেবা কৈরালা পরে এসেছে। আমি যখন ছিলাম তখন কালীকৃষ্ণের প্রেম চলছিল এলিনা রাইএর সঙ্গে। কিন্তু সম্পর্কটা আস্তে আস্তে ভেঙে যাচ্ছিল বলে শুনছিলাম। ঘন ঘন সুন্দরী মেয়েদের প্রেমে পড়া কালীকৃষ্ণের স্বভাব। পরে শুনলাম রেবা কৈরালা বলে এক সুন্দরীর আগমণ ঘটেছে কালীকৃষ্ণের জীবনে। তাই এই ভাঙন এলিনার সঙ্গে ভালোবাসার। কালীকৃষ্ণের অনুরোধে স্যার এলিনাকে চাকরিতে বহাল করেন। অফিসের শোভা বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোনও কাজে আসেনি এলিনা। নীতিজ্ঞানহীন এবং নাকউঁচু এক মহিলা। টাইপ করা ছাড়া আর কিছু ওর আসেনা। সারাদিন টিভি আর ভিডিওতে সুন্দরী সেক্রেটারিরা কীরকম পোষাক পরে, কীরকম সাজগোজ করে সেইসব দেখে দেখে সময় কাটায়।

-তাহলে, কৃষ্ণকালীর ব্যবসা কী করে সামলাচ্ছে এলিনা?

-আমিওতো সেটাই জানতে চাই।

-আমার মনে হয় কৃষ্ণকালী কাঠমান্ডুতে আছে। কাঠমান্ডুতে গেলে সাধারণত কোথায় থাকে কৃষ্ণকালী?

মনীষা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল,’ সাভেরা মোটেলে থাকার সম্ভাবনা নব্বই শতাংশ। ওটা অপেক্ষাকৃত নতুন কিন্তু খুব ভালো বলে শুনেছি। আমি বারদুয়েক বুকিং করে দিয়েছিলাম। কিন্তু এলিনা অবশ্যই জানবে স্যার কোথায় উঠেছেন।

-এলিনা বলল ও কিছু জানেনা।

মনীষা ঘাড় নেড়ে বলল,’ হতেই পারেনা। স্যার বাইরে থাকলেও সবসময়ে অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। এমনকি যখন উনি কাউকে না জানিয়ে কোথাও যেতেন তখনও কিন্তু আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। আমাকে জানিয়ে রাখতেন প্রয়োজনে কোথায় ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব।‘

-কিন্তু এলিনা বলল এই ব্যাপারে ও সম্পূর্ণ অন্ধকারে। অবশ্য সত্যি কথা নাও বলতে পারে। হয়ত ইচ্ছে করেই জানাল না।

-মিথ্যে বলছে বলেই আমার মনে হয়, মিঃ রায়।আমি আপনাকে এতটুকু প্রভাবিত করতে চাইনা। আপনি নিশ্চয়ই বোঝেন বিয়ের পর একটা মেয়ের অনেক পরিবর্তন হয়। বাড়িতে অনেক বেশি সময় দেবার দরকার হয়। সম্পূর্ণ নিজের সংসার। সব দায়িত্ব নিজের। তবুও ওই অবস্থায় স্যারকে একেবারে ছেড়ে যাবার কথা ভাবিনি। আমি স্যারকে বলেছিলাম সময় করে মাঝেমধ্যে এসে আমি এলিনাকে আস্তে আস্তে সব বুঝিয়ে দেব যাতে কোনও অসুবিধে না হয়। কিন্তু এলিনা কোনও আগ্রহ দেখাল না। আমি চলে এলাম। ভাবলাম কিছু দরকার হলে নিশ্চয়ই ফোন করবে।তার পরেও ফোন এলনা দেখে একদিন ওই অঞ্চলে কিছু কেনাকাটা সেরে ভাবলাম হাতে যখন একটু সময় আছে অফিসে গিয়ে স্যারের সঙ্গে একবার দেখা করে আসি, অনেকদিন দেখা হয়নি। স্যারের যদি কোনও সাহায্যের দরকার হয় জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারি। কিন্তু এলিনা আমার সঙ্গে বাইরের লোকের মতই ব্যবহার করল। বলল স্যারের সঙ্গে দেখা হবে না। উনি নাকি জরুরী মিটিংএ আছেন। ফিরে এলাম। প্রায় দু’মাস পরে আবার একদিন কী মনে হল অফিসে গেলাম। সেদিন এলিনা আমার সঙ্গে একটু বেশি ভদ্রতাই করল। প্রায় দশ পনের মিনিট বসে রইলাম। এলিনার সঙ্গে টুকটাক কথা চালাচ্ছিলাম। ও কিন্তু স্যারকে জানালই না যে আমি দেখা করতে এসেছি। আমি আর এ নিয়ে কথা বাড়াতে চাইলাম না।ফিরে এলাম। ভাবলাম যদি দরকার হয় স্যার নিশ্চয়ই আমাকে ফোন করবেন।

-ফোন এসেছিল?

মনীষা রাগে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর বলল,’ আমি নিশ্চিত যে আমি চলে আসার পর অন্তত একশ’ সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে ওরা যেখানে আমার সাহায্য দরকার ছিল।আমি বুঝতে পারি ঐ নাটুকে, ন্যাকা এলিনা কেন আমাকে ফোন করেনি কিন্তু আমি সত্যিই বুঝতে পারিনা কেন স্যার আমাকে ফোন করলেন না? যে খবরটা আমার দিতে এক সেকেন্ডও লাগবে না সেই খবর এলিনা ফাইল ঘেঁটে খুঁজেই পাবে না, খবর দেওয়া তো দূরের কথা। কোথায় কোন ফাইল আছে তাই ও ভালো করে জানেনা।

- তুমি কৃষ্ণকালীকে তারপর কখনও ফোন করনি?

-না। আমি ভেবেছিলাম দরকার হলে স্যার আমাকে ফোন করবেন। আমি চাইনি ঐ মেয়েটা তৃতীয়বারের জন্য আমাকে হেনস্তা করুক।

-বেশ, আজ তাহলে আমি আসি। তুমি মাঝেমধ্যে ফোন কোরো। আবার সব স্বাভাবিক হয়ে গেলে আমাদের অফিসে এসো। আমি এবং সুন্দরী খুব খুশি হবো তুমি এলে।ভালো থেকো।আশা করি সবকিছু ভালোয় ভালোয় মিটে যাবে।

-নিশ্চয়ই আসবো। খুব ভালো লাগলো আপনার সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হয়ে।খুব ভালো থাকবেন।

মনীষা দরজায় দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না পানু রায় অপেক্ষারত ট্যাক্সিতে উঠে অফিসের দিকে রওনা দিলেন।
0

গল্প - সনাতন সিংহ

Posted in



















।। ১ ।।

কোজাগরী জোৎস্না।মাথার উপর থালার মতো চাঁদ। রুপোলি আলোর প্লাবনে হাবুডুবু খাচ্ছে সারা গ্রাম।গাছগাছালি,ঘর-বাড়ি,মাঠ-ঘাট জ্যোৎস্নায় বিভোর। খিলখিল করছে সর্বত্র।তার আভায় পাড়ার খেলার মাঠও এখন টইটুম্বুর।বউ-ঝি,ছেলে-পুলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সেখানে।গোটা মাঠ এখন কয়েকটা ভাগে সীমানা তৈরি করেছে।

এই কোণে বউ-ঝিরা।

বউ-বসান্তি খেলছে। ঐ তো, একটা মেয়ে

কিৎকিৎ কিৎকিৎ করে, বউয়ের মাথা ছুঁয়ে, দৌড়ে তাড়া করছে অপর পক্ষের মেয়েটাকে।সেও আঁক-কেটে, বাঁক-কেটে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।তার দলের অন্যরা তখন বউকে মুনে আছে,যাতে উঠে পালাতে না পারে!

মাঠের মাঝে ছেলে-পুলের দল।

কাবাডি খেলছে। অন্যের কোর্টে ঢুকে একজন লাফাচ্ছে আর কাউকে ছুঁয়ে পালিয়ে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছে

-কাবাডি,কাবাডি…

-ভোলা, মেরেই আসবি। দম ফেলবি না। যাহ, মেরে এলেই আমার শালী তোর… মার ভোলা। মেরে আয়য়য়য়…

উত্তর দিকটায় মাঝবয়সীরা গল্প-গুজবে মশগুল।কারো কারো হাতে বিড়ির আগুন জ্বলজ্বল করছে। চাঁদের আলোয় তাদেরই একটা দল আবার তাস খেলছে।

রাস্তার কোলটা বয়স্কদের।ইটের রাস্তায় বসে, পা ঝুলিয়ে আছেন মাঠে।একথায় সেকথায় তাঁরাও চন্দ্রতাপে বার্ধক্যকে বারবার ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এমন ফেলে আসা কোজাগরী রাতে।

এ গ্রামের বাড়ি বাড়ি লক্ষ্মীপুজো। বলতে গেলে প্রায় সবাই রাত জাগে। ভরা জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে, হুল্লোড়ে, গল্প করে কাটিয়ে দেয়। এটুকুতে সবার ছাড়।কেউ কাউকে বকেও না।এ রাতটার জন্য সমবচ্ছর অপেক্ষা করে তারা।

সন্ধ্যা থেকেই হরিনামের দল, বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে বেড়ায়। দু'পাড়ার দুটো দল।যেমন পুরোহিত নিয়ে কাড়াকাড়ি,তেমনি ঐ গানের দলের। পুরোহিত না পেলে নিজেরাই সেরে নেয়,কিন্তু হরিনামের দল লাগবেই।বলতে গেলে তারা সারারাত গান গেয়ে, সব বাড়ি তাই শেষ করে উঠতে পারে না। কার বাড়ি আগে যাবে? সেই নিয়ে রাগারাগি। তবুও পুজোর উপাচার নিয়ে অপেক্ষা করে। কি করবে? হরিনামের দল ছাড়া যে পুজো সম্পূর্ণ হয় না।অগত্যায়,অপেক্ষা করতে করতে কারো চোখ ঢুলুঢুলু। 'পুজো দেখব', 'পুজো দেখব' করে বাচ্চারা ঘুমিয়ে পড়ে শেষে। তবে সারারাত খোল-করতালের আওয়াজের সঙ্গে তাদের সমবেত ক্লান্ত গানও বাতাসে ভেসে ভেসে বেড়ায়।

রাস্তায় লোকজনেরও কমতি থাকে না। এপাড়া ওপাড়া থেকে কচিকাঁচা তো আছেই, সঙ্গে বউ-ঝি-বুড়িরা। প্রসাদ, নাড়ু তো তারা নিচ্ছেই, সঙ্গে কোনো কোনো বাড়ি থেকে বিলিয়ে দেওয়া বাতাসা-খই-মুড়ি। কারো কোঁচড়ে, কারো বা পুটলিতে।

পীযুষদের বাড়ির পুজো-বাতাসা-খই-মুড়ি বিলিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে। লুচি, ছোলার ডাল খেয়ে এসে সে সবেমাত্র মাঠে পা দিচ্ছিল।

অম্লান দৌড়ে এল তার কাছে। হাঁপাচ্ছে।

-ও-দা, যা-যাবে না?

-কোথায় রে?

-সে-সেই, ব-বলেছিলে না !

-অহ! কিন্তু এখন তো অনেক রাত !

-তাতে কি হয়েছে? দিনের আলোর মতো তো দেখা যাচ্ছে সব। চলো…

-হ্যাঁরে, পটকা নেই এখানে? ওকেও নয় ডেকে নে?

-দুর, চলো তো।আর কাউকে জোড়াতে হবে না।

আজ লক্ষ্মীপূজোর বাজার করে ফেরার সময় পীযুষ দেখেছিল ব্যাপারটা। সাইকেল থেকে নেমে মাঠের দিকে তাকিয়ে ছিল অপলকে।

-এ মাঠে শালতি নৌকা? তেলেডোঙা ছাড়া এ বস্তু তো দেখা যায় না! এল কোথা থেকে? মাঠের টলটলে জলে শালতিটা তরতর করে চলছে।

-আরে, ওঠা কে? বারুণকা' না?

ধজি জলের ভেতরে চেপে ধরে নৌকার এক মাথা থেকে অন্য মাথায় হেঁটে যাচ্ছে।আবার তুলে নিয়ে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে।

তখনই মনটা নেচে ওঠে...

-আজ রাতে যদি ঐ নৌকায় চড়ে সারা মাঠটা ঘোরা যায়? ওহ ,কি যে আনন্দ

হবে! জোৎস্না রাত।ফুরফুরে হাওয়া।জলের ঝিকমিকি !

ওহ,আর সে ভাবতে পারছে না।

-নাহ, আজ রাতে আসতেই হবে। যার নৌকা হোক, আমি চাইলে বরুণকা না করবে না।

পথে অম্লানের সঙ্গে দেখা।তাকেই একথা সে বলেছিল।

-ও দা, নৌকা দেবে তো?

-চল না দেখি।আমি চাইলে হয়তো না করবে না। কিন্তু…

-কিন্তু কি?

-ভরা পূর্ণিমা।তায় আবার এত রাত।

-কার নৌকা জানো?

-না। তবে শুনলাম নাকি রাতে পাহারা দেবার জন্য ওটা ভাড়া করেছে।মাঠে নাকি কারা বেশ কিছুদিন জাল পাতছে। মাছ চুরি হচ্ছে খুব। তাই কাল থেকে রাতে পাহারা দেওয়া শুরু করেছে।

-কারা ভাড়া করেছে?

-আরে, ঐ, স্বর্নজয়ন্তী স্ব-রোজগার যোজনার যে গ্রূপ আছে না,তারাই।ওরাই তো মাছ চাষ করেছে।

কথা বলতে বলতে তারা এখন এপাড়ায়। বরুণদের উঠোনে।

-এরা তো ঘুমিয়ে পড়েছে!

-হ্যাঁ।তাই তো।চল… ফিরে যাই।

-একবার নয় ডেকেই দেখো না? যদি…

-বলছিস। কিন্তু… দাঁড়া, একবার ডেকেই দেখি।…কাকা। ও… কা… কোমর সমান মাটির বারান্দা।একটা বিছানা পাতা রয়েছে। মশারিও খাঁটানো।

ভেতরে কেউ একজন শুয়ে আছে মনে হয়।

পীযুষ হতাশ হয়ে পড়ল।

-নারে, সাড়া দিল না।

-আর একবার ডাকোই না।

আশাভঙ্গের ভয়ে পীযুষ অম্লানের কথা রাখল।

-কাকা, ও কাকা… জেগে আছো? কাকা…

মশারির ভেতর থেকে বিরক্তিকর গলা ভেসে এল

-কে পলাশ? আরে, একটু শুতে দে। ক'টা বাজে? এক্ষনি ডাকছিস?

-সবেমাত্র চোখটা জুড়ে এসেছে।এসে হাজির হলি।

ইতস্তত করছে পীযুষ। আমতা আমতা করে উঠল।

-কা-কাকা আ-আমি। পীযুষ।

এবার মশারির বাইরে মুন্ডুটা বেরিয়ে এল।

-এত রাতে? তোমার তো সেই সন্ধেয় আসার…

-না… মানে… আসলে…

-তোমার কাকীমা তো তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিল, যদি আসো। এই তো কিছুক্ষণ আগেই শুয়ে পড়ল।দাঁড়াও।ডাকি?

-না, না। আসলে আমি… নৌকা চড়ব বলে… একটু দেবে?

-দেখো কান্ড!

-দাও না, কাকা… কি বলবে পীযুষকে? মেয়েটা তার কাছে পড়ে। পাড়ার আর পাঁচটা ছেলের মতো নয় সে। বেশ মেধাবী। কলেজে পড়ছে। নিজের খরচা নিজেই চালায় টিউশন করে। বাজে নেশাও নেই।গ্রামে একটা সুনাম আছে তার।ব্যবহারও ভালো। অনেকেই তাকে স্নেহ করে। বরুণও তাদের মধ্যে একজন। নিজের পাড়ার ছেলেরা বলেছিল

-আজ রাতে নৌকাটা দিও। একটু ঘুরব।

কিন্তু তাদের ভাব-গতিক ভালো ঠেকেনি বরুণের।মাল-খেয়ে কোথায় আবার বিপদ বাধিয়ে বসবে… তাই তাদের না করে দিয়েছে। কিন্তু পীযুষ তো তাদের থেকে আলাদা। কি যে বলবে? ভাবছে।

-ও কাকা,কি হল? দাও না…

-ঠিক আছে। এই দেখো, চাবিটা আবার কোথায় রাখলুম?

টর্চ জ্বেলে বিছানা হাতড়াচ্ছে।

-কিন্তু আমাদের তো আবার একটু পরেই বেরতে হবে… আচ্ছা… সে নয় দেখব'খন।

চাবিটা নাও। কিন্তু মাঠের মাঝখানে যাবে না। বড় বড় পুকুর। বেশ গভীর। আর ঐ পোতাগুলো ভালো নয়। দূরে থেকো। আর সাবধান, ঘোর পূর্ণিমা কিন্তু। সঙ্গে আমি নয় যেতুম। কে আছে আর? সবেমাত্র শুয়েছি। চোখ জ্বালা জ্বালা করছে। একটু না ঘুমলে…

-আমি আর অম্লান। ঠিক আছে,

মনে থাকবে।

চাবিটা হাতে নিল পীযূষ। আহ্লাদে তাদের পা যেন মাটিতে পড়ছে না। এগিয়ে গেল রাস্তার দিকে।

দুটো বাড়ির পরেই মাঠ। শালতিটা শিকল দিয়ে রাস্তার গাছের সঙ্গে বাঁধা। তালা লাগানো।

অম্লান আগেই উঠে গেছে। পীযুষ তালা খুলে শিকল ছুঁড়ে দিল নৌকায়। দু-হাতে নৌকা ঠেলে লাফিয়ে পড়ল তার খোলে।


।। ২ ।।

তিনটে গ্রাম। তাদেরকে জুড়ে আছে তিনটে রাস্তা। রাস্তা জুড়ে গাছ আর গাছ। আর তাদের মাঝে কয়েকশ বিঘে জমি ঘিরে এই বিশাল মাঠ। মাঠে কয়েকটা পুকুর। সুতিখাল। সবটা জুড়েই ফিসারি।

পঞ্চায়েতের সহযোগিতা আছে বলে মালিকদের সঙ্গে কোনো-প্রকার আলোচনা ছাড়াই এই মাছচাষ। ইনকাম হলে নাকি রাস্তার কাজে লাগাবে। তাই কাউকে একটা পয়সাও দেয়নি। বর্ষায় অনেকেই জাল পেতে মাছ ধরত। সেটাও বন্ধ। তা নিয়ে অনেকের ক্ষোভ। সকলের সন্দেহ লাভের টাকা নাকি ওরাই মেরে দেবে। তাই লোক চুরিচামারী করে, জাল পাতে।

মাঠের কোথাও এক-মানুষ জল। কোথাও বেশি। দু-এক জায়গায় শোলা-চাষ। ধানগাছ নেই বললে চলে। বর্ষায় সব হেজে গেছে। কোথাও কোথাও ঘাস আর ঘাস। বাদ বাকিটায় কেউ যেন রুপো গলিয়ে ঢেলে দিয়েছে। তবে সারা মাঠের বুকে দুটো উঁচু পোতা, তাল-খেজুর-বাবলাকে বুকে নিয়ে দ্বীপের মতো জেগে আছে তারা।

আলতো আলতো বাতাস বইছে। তিরতির করে ঢেউ উঠছে। তাদের নৌকা চলেছে তরতরিয়ে। আকাশ-গঙ্গায় যেন দুই অচিন নাবিক পরিক্রমায় বেরিয়েছে। এ জলরাশি, নদীর মতো দরাজ বুকে তাদের যেন কাছে টেনে নিয়েছে। নৌকার এক মাথায় বসে আছে পীযূষ। যেন স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র তার স্বর্গরাজ্যে বিরাজ করছেন। নীরবতায় অবিমিশ্র জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে তার শরীর। অম্লান ধজি চেপে এক প্রান্ত থেকে হাঁটতে হাঁটতে তার কাছে আসছে। প্রত্যেকবার এসে যেন সে প্রণাম ঠুকে যাচ্ছে।

-কিরে অম্লান, কেমন লাগছে বললি না তো?

একটু হাঁপিয়ে গেছে সে। তার প্রাণের মাঝে আনন্দের স্রোত বইছে হু হু করে।

-কি বলব দাদা? পারলে যেন সাঁতার দেই। কি যে ভালো লাগছে! রাতে বাড়ি ফিরব না। ও… বরুণকা যা বলে বলুক। সেই সকালে…

-দূর পাগল। রাতে হিম পড়বে।ঠান্ডা লেগে যাবে।

-ও লাগুক গে।

-লাগুক গে? তারপর তোর বাবা-মা যদি জানতে পারে যে সঙ্গে আমি ছিলাম।আমাকে ছাড়বে?

-ওসব আমি জানি না।

আজ অম্লানকে দেখে পীযুষের খুব ভালো লাগছে।

এই তো ক'দিন আগেই পীযুষই তাকে সবার সামনে মেরেছিল। আর মারবেই না কেন?

তার লেখা চিঠিটা পড়বে তো পড়বে একেবারে সুরমার বাবার হাতে। মেয়েকে প্রেমপত্র? মেনে নিতে পারে? সোজা চলে এসেছিল পীযুষের পড়ানোর জায়গায়। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছিল

পীযুষের। তার আস্কারাতেই অম্লান নাকি এমন করেছে। এখানে সে নাকি গুপ্ত-বৃন্দাবন তৈরি করেছে! পড়াশোনা বাদ দিয়ে এখানে নাকি এসব শেখানো হয়!

সারা গ্রামে কেউ কোনোদিনই তার দিকে আঙ্গুল তুলতে পারেনি। নিজে অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে এতদূর পর্যন্ত এগিয়েছে।তাও আবার টিউশনি করে। ঠিকমতো মাইনেও দেয় না অনেকেই। তবুও সে কোনোদিন তার দায়িত্ব থেকে সরে আসেনি। অথচ এই লোকটা একঘর ছেলেমেয়ের সামনে তাকে এত বড়ো একটা অপবাদ দিচ্ছে? অপমান করছে?

ডাকিয়ে এনেছিল অম্লানের বাবা-মাকে। তাদের ছেলে এমন করতে পারে সে কথা তারা কিছুতেই বিশ্বাস করছে না।কিন্তু সুরমার বাবা তোড়পে যাচ্ছে সমানে।

অম্লানও কিছুতেই স্বীকার করতে চাইছে না।

প্রথম থেকেই না না করছে। কিন্তু সুরমা? বাবার ভয়ে আর চুপ করে থাকতে পারেনি। সবার সামনে বলেই ফেলল

-হ্যাঁ, ও আমাকে চিঠি দিয়েছিল।

অম্লান মরিয়া হয়ে ওঠে

-এ-এই মি-মিথ্যে কথা একদম বলবি না।

সুরমার পাশেই ছিল পুটু। সে ফুঁসে উঠল।

-মিথ্যে কথা না? ঠিক আছে,এসব বাদ দে। সেদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে তুই ওর গায়ে হাত দেসনি? কিরে বল, এটাও মিথ্যে?

মাথা আর ঠিক রাখতে পারল না পীযুষ। ঠাস ঠাস করে চড়িয়ে দিল অম্লানকে।

-এসব শেখাই এখানে? কিরে? বল? তোর জন্য আমি অপমানিত হব? এতজনের সামনে আমাকে… ছিঃ ছিঃ…

কাল থেকে আর তুই পড়তে আসবি না। বের হ। দূর হয়ে যা…

অম্লানের চোখ বেয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। মুখে কোনো কথা নেই। মাথা নিচু করে গ্যাট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

অম্লানের মা কেঁদে উঠল।

-আর কত জ্বালাবি? তোর জন্য কারো কাছে কি মুখ দেখাতে পারব না? মর না, মর। মরলে তো আমাদের হাড়ে একটু বাতাস লাগে।

-ওহ, তুমি আর গোল পাকিও না। থামো দেখি।

বলতে বলতে অম্লানের বাবা,এগিয়ে গেল সুরমার বাবার কাছে। তার হাত দুটো ধরে বলল

-দাদা, ছেলে মানুষের কাজ। মাপ করে দিও। আমি দায়িত্ব নিচ্ছি, ও আর এমন করবে না। সব ভুলে যাও, দাদা। পাঁচ-কান হলে আরো খারাপ হবে… সুরমা, মা রে, মন খারাপ করিস না।পীযুষ, এখন আসি বাবা, পরে কথা বলব।

সপ্তাখানেক পরে অম্লানের বাবা-মা পীযুষের হাতে ধরে বলেছিল

-বাবা, ওকে একবার ক্ষমা করে দিতে পারো না? স্কুলেও যাচ্ছে না। ঘর বন্ধ করে থাকে। ঠিক মতো খায় না। তুমি একবার আমাদের বাড়িতে যদি যেতে....

-ঠিক আছে কাকিমা, আমি যাবো। এতজনের মাঝে ওকে মেরেছি তো, তাই হয়তো ও খুব কষ্ট পেয়েছে।

অম্লান আবার স্কুলে যেতে শুরু করে। পীযুষ তার সেই দগ্ধ ঘায়ে অল্প অল্প করে প্রলেপ লাগিয়ে দিতে থাকল। সেও পীযুষের আরো কাছের হয়ে উঠল।

এখন দেখলে তা আর মনে হবে না যে, সে ক'দিন আগেই এমন একটা কাজ করেছিল।


।। ৩ ।।

জামা স্যাঁতস্যাঁত করছে। চুল ভিজে ভিজে ভাব। হিম ঝরছে। জোলো হাওয়া বইছে ফুরফুর করে। পীযুষের শীত শীত করছে।

-অম্লান, এবার চল ফিরি। ওরা তো আবার পাহারা দিতে বের হবে। চল।

-আর একটু থাকি না দাদা?

-না, চল অনেকক্ষণ হয়ে গেল। এবার তুই বস। তখন থেকে তো বাইছিস। আমি চালাই।

-তুমি চালাবে? পারবে?

-ধজিটা তো দে.....

-হ্যাঁ হ্যাঁ, নাও। সোজা ঐ পোতায় নিয়ে গিয়ে তোলো। তারপর সেই পুস্কর গুনীনের মতো ভুতে আমাদের আটকে রাখুক সারারাত।

-মন্দ হবে না। কি বলিস?

অন্য গ্রাম ঘেঁষেই চলছিল তারা। পুকুর পাড়ের মাচা মাঠের উপর ঝুলছে, জল ছুঁই ছুঁই ভাব। অম্লান কিছু একটা ধরে টান দিল।

-আরে কি ছিঁড়ছিস? চারদিকে জল। মাচায় কি কোথায় উঠে থাকবে কে জানে?

-ওহ, কত বড় শসা! খাবে?

-না, চল। লোকে খারাপ বলবে।এমন করে?

-তথাস্তু বৎস।

-পাকামি করছিস। ওদিকে বরুণকা'রা হয়তো অপেক্ষা করছে। হ্যাঁ রে সোজা যাব?

অম্লানের মতের অপেক্ষা না করে সোজা বাইতে শুরু করল। পীযুষের অপটু হাতে শালতি এঁকে বেঁকে চলছে। চাইছে সোজা নিয়ে যেতে, কিন্তু বেঁকে যাচ্ছে অন্যদিকে।

অম্লান নৌকার মাথায় ছোট্ট বেদির মতো চৌকোয়, উল্টোমুখ করে বসে, পা ঝুলিয়ে দিয়েছে জলের উপর। পীযুষ নাজেহাল হচ্ছে। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। সে আছে নিজের ঘোরে।

অনেকখানি এগিয়ে এসেছে তারা। মাঝমাঠ। পীযুষ অনন্তর পোতা এড়িয়ে যেতে চাইছে, কিন্তু নৌকা যেন সেই দিকেই ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছে। ভয় করছে তার। পোতার লম্বা লম্বা তালগাছগুলো যেন কোন মায়াবলে তাকে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এখন আর শীত শীত করছে না। পোতার একদম কাছেই এসে পড়েছে।

ধজিটা জোরে চাপল পীযুষ।

-একি! থৈ পেল না কেন? পুকুরে পড়লাম নাতো ?

টান পড়ল ধজিতে। টানার চেষ্টা করছে সে।

-জালে আটকায়নি তো? বোধহয় পুকুরের মুখেই জাল পেতেছিল। একি! ধজিটা নৌকার তলায় ঢুকে যাচ্ছে যে!

প্রাণপনে টানছে সে। জোরে টানতে গিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ছে।

-অ-অম্লান, আ-আমরা মনে হয় পুকুরে পড়েছি। ধজিটা জালে আটকেছে মনে

হচ্ছে! কিছুতেই ছাড়াতে পারছি না।

পোতার কাছে বড়ো পুকুরের উপর তারা ভাসছে। নৌকা দুলতে দুলতে শ্লথ গতিতে এগোচ্ছে পুকুরের ভেতরে। পীযুষ ঝুঁকে পড়ে ধজিটা টানার চেষ্টা করছে সমানে।

-কই রে? দেখ…

অম্লান এগিয়ে এল পীযুষের কাছ। ধাক্কা মারল সজোরে। ঝপাস করে জলে পড়ল পীযুষ। কেঁপে উঠল পুকুরের জল।

-সবার সামনে আর মারবি আমাকে? বল? সুরমার সামনে তুই চড় মেরেছিলি?

পীযুষ ভুস করে ঠেলে উঠল জলের উপর। হাঁপিয়ে উঠেছে সে। হাত-পা ছুঁড়ে সাঁতরাচ্ছে। নাকে-মুখে জল ঢুকছে।

-এ-এ-এটা কি ক-ক-করলি তু-ই?

সাঁতরে কাছে আসছে সে। অম্লান রাগে ফুঁসছে। হাতে শিকলটা তুলে নিয়ে পাক দিচ্ছে শূন্যে।

তার মূর্তি দেখে পীযুষ শিউরে উঠছে। সাঁতার ভুলে যাচ্ছে সে। তার উপর এই গভীর পুকুর, পোতা, সঙ্গে ভরা পূর্ণিমা-রাত তার শরীরকে অবশ করে দিচ্ছে।

নৌকার কাছে এল পীযুষ। লোহার শিকলটা সপাট করে আড়ছে পড়ল তার মাথায়।

-আ-আ-আ…

ডুবে গেল পীযুষ।

-তোর জন্য স্কুলে সবাই টিটকারী করেছিল। সেই থেকে স্কুলে ঢুকতে পারিনা। রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বেড়াই। পাড়ার লোকও আমার দিকে কেমন করে তাকায়। সব, সব তোর জন্য। মর তুই মর…

-অম্লা…

লোহার শিকলের আঘাতে মাথা ঘুরছে পীযূষের। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। তীব্র যন্ত্রণায় মাথাটা যেন কুঁকড়ে যাচ্ছে। হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে। অন্ধকারে সে তলিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছে…

অম্লানের খিলখিল হাসি ছড়িয়ে পড়ল জোলো মাঠে।

শূন্যে ঘোরানো শিকল আসতে আসতে গতি হারিয়ে নেমে এল তার কাছে। দরদর করে ঘামছে সে।

অপেক্ষা করছে জলের দিকে তাকিয়ে।

নৌকা এখন পুকুরের মাঝখানে ভেসে আছে স্থির হয়ে।

জলের তোলপাড় ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।

অম্লান জেগে বসে রইল সেখানে।
0

গল্প - রূপশ্রী ঘোষ

Posted in



















মনে হয় একটা দুর্দিন ঘনিয়ে আসছে। কী হবে কেউ জানে না। সবাই ভাবছে কিনা তাও জানে না সৃজনী। কিন্ত তার নিজের মনে হচ্ছে কিছু একটা দুর্দিন ঘনিয়ে আছে। দূরে একটা ট্রেন, তাও যেন কেমন মন খারাপ করে একা হেঁটে যাচ্ছে, দৌড়চ্ছে না। ঢিমে তাল। দুর্দিনটা কীভাবে আসবে এটা নিয়েও ভাবে সৃজনী। ভূমিকম্প রূপে, প্রলয় রূপে, তীব্র ঝড় ঝঞ্ঝা হয়ে? নাকি অন্যকিছু? কিছুই ভেবে উঠতে পারে না সে, কিন্তু একটা দুর্দিন যে আসবে সেটা সে বোঝে। কারণ আর তাদের বাড়ির উত্তর পুর্ব কোণের ছাদে বসে একটা কাক এক নাগাড়ে ডেকে চলেছে। জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে ওটা নাকি খুব খারাপ ব্যাপার! জ্যোতিষ না বললেও, সৃজনীর মনে মনে যেন কিছু একটার আভাস পাচ্ছে। আজ ভোরে জানলার ধারে দাঁড়িয়ে দেখল একটা শকুন মনমরা হয়ে দূরের একটা বাড়ির ছাদ থেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। কোথাও কোনো খাবার মেলেনি হয়তো। দুদিন আগেও দেখল সুইমিং পুলের জলে ভোরের চাঁদটা খুব কাঁপছিল। কেন কাঁপছিল সৃজনী জানে না। এই নয় যে, বাইরে খুব জোরে বাতাস বইছিল। বাতাসও কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে। ঝড়ের পূর্বে বাতাস স্তব্ধ হয়ে যায়, এটা সি স্তব্ধতা কী কে জানে। সবই কেমন যেন একটা ভাসা ভাসা, অনিশ্চিত ব্যাপার। তবুও একটা দুর্দিন যে ঘনিয়ে আসছে সেটা সে খুবই বুঝতে পারছে। দিনদিন রোদ খুব চড়া হচ্ছে। বারান্দার গাছগুলোয় নিয়মিত জল দিয়েও বাঁচানো যাচ্ছে না। কাগজফুল, অর্কিড আর দু একটা নাম না জানা ফুল তার টবে আছে। সে খুব বেশি গাছ চাষও করেনি, আর গাছেদের নামও বিশেষ জানে না। এরমধ্যে স্নেক প্ল্যান্টটা পুরোই মরে গেল। গোড়া উপড়ে ফেলে দিতে হয়েছে গাছটা টব থেকে। আর একটা পাতাবাহার, রোজই প্রায় পাতা ত্যাগ করে খোলস ত্যাগের মতো। দুদিন ছাড়াই দেখা যায় গাছটার গোড়ার দিক থেকে একটা করে পাতা ব্রাউন হয়ে ঝিমিয়ে পড়ে, অভিমানে না লজ্জায় বোঝা মুশকিল মাথা নত করেই থাকে। গোড়া থেকে সেই পাতাটা তুলে ডাস্টবিনে ফেলে দেয় সৃজনী। জানলার ধারে দাঁড়িয়েও সে দেখে দূরের ঘাস, শহরের গাছ, অন্যান্য বাড়ির ছাদের ফুল সব কেমন শুকিয়ে যেন একটা জেহাদ ঘোষণা করছে। কিসের জেহাদ কে জানে। যতদূর চোখ যায় ততদূর পর্যন্ত সৃজনী ওই একই জিনিস দেখতে পায়। সবাই যেন প্রতিবাদ করতে করতে অবশেষে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে টাইপের অবস্থা। তবুও কোথাও কি খুশির খবর নেই? আছে তো। আজ মৌমিতা দৌড়ে এসে বলল, সে টিমের ওনার। সে একটা টিম কিনেছে। তাদের কমপ্লেক্সে। হ্যাঁ, একেবারেই আই পি এলের মতো ব্যাপার আর কী। একেবারেই খেলা খেলা ব্যাপার। কারণ খেলোয়াড়রা টাকা পায় না। কিন্তু সব নিয়ম কানুনই হয় ওই আই পি এলের নিয়ম মেনে। এখানেও অকশন বিড হয়, টিম ওনার থাকেন, খেলোয়াড় কেনা হয়, টাকা না পেলেও। একটা মিছিমিছি দাম হাঁকা টাইপের, কিন্তু টিম ওনাররা নাকি টাকা পায় শোনা গেছে। পিচ তৈরি করে, রাতে মাঠে আলো-টালো দিয়েই খেলা হয়। একেবারে ইলাহি ব্যাপার। মৌমিতা দৌড়ে এসে সৃজনীকে বলল,

হাই! হ্যালো! কেমন আছো? গুডমর্নিং

গুডমর্নিং, ভালো আছি। তুমি কেমন আছো বলো?

ভালো আছি। জানোতো আমি একটা টিম ওনার। কিন্তু সবাই কেমন আমার পিছনে লাগছে। বলছে আমার টিম নাকি হারবে।

ও তাই নাকি? তুমি টিম ওনার? দারুণ ব্যাপার তো। না না জিতবে তোমার টিম চিন্তা কোরো না

সৃজনী মৌমিতার আহ্লাদি আহ্লাদি গলা থামিয়ে দিয়ে তাকে জেতার আশ্বাস দিয়ে বেরিয়ে গেছিল। সৃজনীর মনে হল, মৌমিতা নিজেকে কেমন যে নীতা আম্বানি নীতা আম্বানী ভাবতে শুরু করেছে। খুশিতে টগবগ করছে। খুব এন্থুজিয়াসটিক মহিলা, তাকে দেখলেই বোঝা যায়। কোনো একটা ছুতো নাতা পেলেই সে হইহই করতে ভালোবাসে। খুব মজা করে, ভীষণ উত্তেজনা নিয়ে এনজয় করে সব ব্যাপার। সৃজনীর দেখে মনে হয়, বাঃ এই তো বেশ ভালো ব্যাপার। কোথাও তো খুশি বেঁচে আছে। তার চারপাশের মানুষজন কেমন আনন্দে আছে। এসব দেখতেও বেশ ভালো লাগে। তবুও তার মধ্যেই তার মনে হয় একটা দুর্দিন এগিয়ে আসছে। কোথায় যেন একটা বিষাদের সুর সে শুনতে পায়। কোথাও কি তাল কেটে গেছে? নাকি একতারার তারটাই ছিঁড়ে গেছে? কিছুই বুঝে উঠতে পারে না সৃজনী। তাহলে কি আর বাউল গান হবে না? আর কি শান্তিকেতন যাবে না সে? ট্রেনে উঠে কত বাউল শুনেছে সে। এ সুরেও তো মন উদাস হয়েই থাকে। এও তো বিষাদ। বিষাদ সুর শুনে আনন্দ কিংবা সুখ হতে পারে কিন্তু খুশি বা উত্তেজনা কি হবে? উন্মাদনা? বাউলরা তো উন্মাদই। বায়ু রোগ। কে জানে। সৃজনীর ফোন বেজে ওঠে। দূরের গ্রাম থেকে আসা এক খবর। একশো কিলোমিটার দূরে এক ছায়া সুনিবিড় গ্রাম। সেখানে দিঘির শীতল জল আছে। জলের বুকে হাঁস খেলে বেড়ায়। দূরভাষ বেজে ওঠে। দূরভাষের কাজই তাই। দূর থেকে ভেসে আসা, ভেসে যাওয়া। সৃজনীর ভাই জানতে চাইল,

কি রে তুই কী কিছু পার্সেল পাঠিয়েছিস?

হ্যাঁ, গেছে ওটা?

হ্যাঁ, এসেছে তো। আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি, যার জিনিস সে ঠিক বুঝেছে। সে ওটা পেয়ে খুব খুশি। নিয়ে পুরোনো বাড়িতে চলে গেছে। দিদিদের দেখাতে। সে তো আনন্দে লাফাচ্ছে।

যাক ওটা যে পৌঁছেছে সেটাই দেখার ছিল। ওটা একটা পরীক্ষামূলক পাঠানো গিফট। এখন ওখানে অনলাইন জিনিস পাঠানো যায় কিনা সেটাই দেখার ছিল। যাক তাহলে এবার চাইলে এটা সেটা পাঠাতে পারি।

হ্যাঁ, পারিস তো। সব আসে এখন।

বলে আরও একটা কুশলাদির খবর নিয়ে সৃজনী ফোন রেখে দিল। ভাবল, এই তো খুশি আনন্দ এসব কিছু নেই সে ভাবছে কেন? দিব্যি আছে। খুঁজে নিলেই হয়। সৃজনীর একটা ছোট্ট ভাইজি আছে পাঁচ বছরের, সে লিপস্টিক পাগল মেয়ে। সৃজনীকে দেখলেই বলে, ‘পিসিমনি লিপস্টিক কিনে দেবে। তুমি এবার যখন আসবে লিপস্টিক নিয়ে আসবে আমার জন্যে’। ছোট্ট ভাইঝির আবদার মেটাতে সে এই অনলাইন ব্যবস্থার সাহায্য নেয়। সব সময় অতদূরে যাওয়া সম্ভব হয় না। গিয়ে ফেরাটা একটু পরিশ্রম সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই সময় সুযোগ বুঝে যেতে হয়। কিন্তু মন তো খচখচ করে ভাইঝির আবদারে। তাই সে অনলাইনেই পাঠিয়ে দেয়। এভাবে দূর থেকেই একটু তার আবদার ছুঁয়ে নেওয়া। একশো কিলোমিটার দূরের একটা গ্রাম। সেখানেও আজ সব জিনিস অনলাইন পৌঁছে যায়। সব সংস্থা থেকেই। কলকাতা বা কলকাতার কাছে হতে হবে এমনটা আর নয়। চোখের সামনে সব দ্রুত কেমন বদলে যাচ্ছে। দৃশ্যগুলো খুব দ্রুত চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে। একটা একটা দৃশ্য, তার আয়ু খুব ক্ষীণ। যেন আর বেশিদিন করে টিকতে চায় না, রচিত হয়েই শেষ হয়ে যেতে চায়। গ্রাম শহর সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। যেভাবে দেশ বিদেশ হয়েছে। গোটা পৃথিবী এখন গোটা গ্রাম। সত্যিই তো আর তো কোনো তফাৎ নেই। সব কেমন কাছের হয়ে গেছে। কেবল কাছের হচ্ছে না, একজন মানুষের কাছে আর একজন মানুষ। বা কাছের মানুষ বলে যদি কিছু থেকেও থাকে তারা, সব দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু এত দূরে সরে গিয়ে সব যাচ্ছে কোথায়? কেউ জানে না। তবুও একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সৃজনীর সেই এক আশঙ্কা কিছু যেন একটা দুর্দিন আসতে চলেছে। সেই দুর্দিনে কী অপেক্ষা করছে কেউ জানে না। জন্ম যেমন সত্য, মৃত্যুও তেমনি। কিন্তু এ দুটোর মাঝে কি আর কোনো দুর্দিন হতে পারে? যদি হয়, তাহলে সেটাই বা কী? সৃজনী নিজেও জানে না, কিন্তু সে খুব ভালোমতো বুঝতে পারছে একটা দুর্দিন ঘনিয়ে আসছে, কালবৈশাখীর ঘন কালো মেঘের মতোই। রাস্তা খুব প্যাচপেচে। কদিন টিপটিপ করে বৃষ্টি হল। সে একটু ভিজেও গেছে বেরিয়ে। শোনা যাচ্ছে আরও বড়ো কোনো আশঙ্কার কথা, কারণ সরকার থেকে অরেঞ্জ অ্যালার্ট জারি হয়েছে। এর মধ্যেই সৃজনী তার পরিচিত মানুষদের থেকে মেসেজ পেতে থাকল,

কি রে তোদের ওখানে ভূমিকম্প টের পেলি? খবরে তো দেখাচ্ছে ওদিকের সব সিলিং ফ্যান দুলতে দেখা গেছে…

না, কোনোরকম কম্পনের টের পাইনি। আজকাল ফেসবুক না খুললে বুঝি না যে, ভূমিকম্প হয়েছে।

সে কি? পাসনি?

না, ভূমিকম্প কেবল সোস্যাল মিডিয়ায় হয়। ছোটোবেলার মতো আর শাঁখ বাজিয়ে তুলে দেওয়া হয় না বা কিছুবছর আগে পর্যন্ত যে, কলকাতার হাইরাজগুলো থেকে সব ভয়ে নেমে এসে গেট টুগেদার হত সেসবও হয়। এখন মানুষের অভ্যেস হয়ে গেছে আফটার শকের আর ভয় পায় না…

ভূমিকম্প ঘিরে সৃজনীর অনেক অভিজ্ঞতা আছে। সবার আগে মনে পড়ল তার প্রতিবেশী সোমালিদির কথা। সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে প্রায় অজ্ঞান হয়েই পড়ছিল। সিঁড়ি দিয়ে নামা তো দূরের কথা। ঘর থেকে বেরিয়ে লবিতে বসে বসে কান্না আর কাঁপ। সৃজনী একটুও ভয় না পেয়ে, তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে নিচে নামিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছিল। এসব ভাবতে ভাবতেই সে ফেসবুক, টিভি সবই অন করল। চোখ কপালে তুলে সৃজনী কেবল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতে পারল না। দেশলাই বাস্কের মতো গুঁড়িয়ে যাওয়া, ধসে পড়া ধ্বংসস্তুপ আর হাহাকার শুনতে লাগল। থাইল্যান্ডের রজধানী ব্যাঙ্কককের একটা নির্মীয়মান হাইরাইজ চোখের সামনে গুঁড়িয়ে যাওয়ার ভিডিও সে দেখতে পাচ্ছে… এরপর মৃত্যু নিয়ে আর ভাবার কী আছে তার। মায়ানমারে এমন দুর্দিন মানুষ টের পাচ্ছে, তার প্রভাব পার্শ্ববর্তী দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বকলকাতা দিল্লিও তার সামান্য আঁচ পেয়েছে। যা সৃজনী পায়নি। কিন্তু সৃজনী আরও কোনো বড়ো দুর্দিন আসার সঙ্কেত যেন ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে। এটা তাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কোন রূপে তা আসবে সেটার সে আজও টের পায়নি। কিন্তু লোকজন বলাবলি, ভাবনা চিন্তা শুরু করেছে কলকাতা নিয়ে। কলকাতায় এখন অনেক আকাশছোঁয়া বিল্ডিং। সেগুলোও দেশলাই বাক্স হবে কিনা এ বিষয়টা এখন মানুষের বৈঠকি আড্ডার ঢুকে পড়েছে।

সৃজনীর মতো কেউই জানে না সে দুর্দিন কীভাবে আসছে। কিন্তু আসছে। প্রকৃতি নটরাজ হলে কারোর কোনো রেহাই নেই। জীবন এখন গলা পর্যন্ত দুর্দিনে ডুবে থেকেও আরও বড়ো কোনো দুর্দিনের অপেক্ষায়।

কিন্তু কতটা বড়ো কেউ জানে না। সৃজনী কেবল টের পায় একটা দুর্দিন আসছে অবিলম্বে।

এরমধ্যেও তার সেই ছোট্ট ভাইঝি এতটাই খুশি যে, সে রোজ লিপস্টিকের বাক্সটা মাথার কাছে নিয়ে ঘুমোতে যায়। এর থেকে বড়ো শান্তি সৃজনীর কাছে আর কিছু নেই। টিভি বন্ধ করে দেয়।
0

গল্প - দোলা সেন

Posted in



















[১]

“ ও মণিদি, কেমন হয়েছে বলো তো কার্ডটা?”

“এতক্ষণ ধরে একটা কার্ড বানালি? আমারটা দেখ, কি সুন্দর একটা পাখি বানিয়েছি। মিতু, তুই কিছু বানাচ্ছিস না যে!” তিন্নি মুখ না তুলেই বলে উঠল। সে তখন পাখির চোখে পুঁতি বসাতে ব্যস্ত।

“ধ্যেৎ। এগুলো কোনো উপহার হলো? আমি বাপিকে বলব নিউ মার্কেট থেকে একটা খুব সুন্দর গিফ্ট কিনে আনতে”।

মিতু বরাবরই একটু নাক উঁচু। ওর বাবার শাড়ির দোকান আছে। হর হপ্তা কলকাতা যায়।

তিন্নি আর দিয়ার মুখটা ছোট হয়ে গেছে দেখে, মণিদি হাল ধরতে এগিয়ে আসে। সে এতক্ষণ ধরে একটা ফুলসমেত ফুলদানি বানানোর কাজে মেতে ছিল। ওর হাতের কাজ অসাধারণ। সামনে টিচার্স ডে। এই হোস্টেলের মেয়েদের একটা ঐতিহ্য আছে। তারা টিচার্স ডের উপহার আর রাখি কখনো দোকান থেকে কেনে না। ওদের হাতের কাজ বড়দের তত্ত্বাবধানে বরাবরই খুব সুন্দর হয়। যেমন এই ঘরে পাঁচজন তাদের মণিদির কাছে বসে নানারকম জিনিস তৈরি করছিল।

তিন্নি আর দিয়ার মুখটা দেখে মায়া হলো মণিদির। সে হাল ধরল এবার।

‘আসলে কী জানিস, উপহারের আসল দাম তার আন্তরিকতায়। সবসময়েই যে সেটা জিনিসই হতে হবে তার মানে নেই। খুব অন্যরকমভাবেও দেওয়া যায় সেটা”।

দিয়া হালে পানি পেল যেন। খুব উৎসাহভরে বলল – “মণিদিদি, আমি না একটা বিদেশী গল্পে পড়েছিলাম দুটি কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে তাদের মিসকে ভালোবেসে রক গার্ডেন বানিয়ে দিচ্ছিল। একটা দ্বীপ থেকে পাথর আনার সময় নৌকোডুবি হয়ে...”

দিয়ার গলাটা ভারি হযে এল। মণিদিদি সস্নেহে ওর মাথাটা ঘেঁটে দিয়ে বলল – “বিদেশ যেতে হবে কেন রে? এই আমাদের দেশেই...”

গল্পের গন্ধ পেয়ে সক্কলে হাতের কাজ ফেলে মণিদিদির চারপাশে গোল হয়ে বসে – “বলো, বলো”।

মণিদি একটু হেসেই ফেলল – “এটা শুনতে গেলে একটু ইতিহাসের কথা বলতে হবে কিন্তু”।

রিঙ্কু রঙমাখা হাতটা মনের ভুলে মাথায় বুলিয়ে ফেলে বলে – “তা হোক। তুমি বলো”।

অগত্যা ফুলদানিটা টেবিলের ওপর যত্ন করে সরিয়ে রাখে মণিদি। তারপর হাতটা মুছে নিয়ে পা ছড়িয়ে বসেল

“ বেশ কিছুটা সময় পিছিয়ে যেতে হবে, বুঝলি? ১৯৪৬ এর শেষের দিকে। সে এক অস্থির সময়...”

‘অস্থির কেন?” – দিয়া চুপ থাকতে পারে না মোটেই।

মণিদি তিন্নির দিকে ঘুরল – “এর উত্তর তুই দিতে পারবি?”

তিন্নি আঙুল গোনে – “সাতচল্লিশে ভারতের স্বাধীনতা। তার আগে উমম্... ছেচল্লিশের দাঙ্গা?”

“একদম ঠিক। যার সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, সেই ব্রিটিশ সিংহের আধিপত্য সারা বিশ্বেই অস্তমিত হবার মুখে। ভারতও তার থেকে বাদ নয়। কিন্তু কে চালাবে সেই সদ্য স্বাধীন দেশ? কিভাবে রক্ষা করা যাবে বিচিত্রের মধ্যে ঐক্য?

যতই গান লেখা হোক – বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান _ নানা জাতি, নানা মতের মিলনে সে মহাসাগরে সেতু বাঁধা সহজ কাজ নয়। নানা স্বার্থের সংঘাতে জ্বলে উঠল ভারত। উজ্জ্বল শিখায় নয়, প্রবল জাতিগত দাঙ্গায়। সেই কালো দিনের অবসান ঘটাতে নেতারা সিদ্ধান্ত নিলেন দেশ ভাগ হোক ধর্মের ভিত্তিতে। সাধারণ মানুষও নেতাদের মতোই বিশ্বাস করল – “স্বরাজ আসিছে চড়ে জুড়িগাড়ি”। ইংরেজ ভারত ছাড়লেই সব সমস্যা দূর হয়ে যাবে – সূর্যোদয়ের পর যেভাবে রাতের অন্ধকার নিমেষে দূর হয়”।

মিতু চিন্তিতভাবে বলল – “তবে যে বাবা বলে, শাসক বদলালেই উন্নতি হয় না? মানুষদের ভাবনা বদলাতে হয় আগে?”

মণিদি সোজা হয়ে বসল – “কাকু একদম ঠিক বলেছেন রে। তাহলে শোন - ঠিক সেই সময়ে, এই অস্থির চিত্রপট থেকে অনেক দূরে কয়েকজন মানুষ অন্যরকম ভাবছিলেন। তাঁদেরও মনে হয়েছিল, মানুষের মনে যদি চেতনার আলো, শিক্ষার দ্যুতি না পৌঁছানো যায়, তাহলে স্বাধীনতা কথাটির অর্থ বইয়ের পাতাতেই আটকে থাকে। যেমন মনে হওয়া, তেমনি কাজ। তৈরি হলো ‘সেবা সংঘ’। বিভিন্ন অনগ্রসর এলাকায় তাঁরা স্কুল তৈরির কাজে লেগে পড়লেন।

কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল, কাজটা সহজ নয় মোটেই। এই পিছিয়ে পড়া জনজাতিকে শিক্ষিত করে তোলার পথে প্রধান বাধা দ্বিমুখী। এক - বিদায়ী ইংরেজ শাসক, দুই – স্থানীয় ভূস্বামী বা রাজা”।

রিঙ্কু অস্থির হয়ে উঠল – “কেন মণিদি? ইংরেজ কেন? আমাদের আধুনিক শিক্ষায় ওদের অবদান তো কম নয়! বেথুন সাহেবের কথাই ধরো, কিম্বা হ্যালহেড বা উইলিয়াম কেরি...। মেয়েদের স্কুল, বাংলা ব্যাকরণ তৈরিতে এঁদের অবদান তো আমরা ইতিহাসেই পড়েছি। তাহলে ছেচল্লিশে হঠাৎ তারা শিক্ষবিরোধী হয়ে উঠল কেন গো?”

মণিদি বলল – “তোরা একটা শব্দ বোধহয় খেয়াল করিসনি। সেবা সংঘ কাজ করছিল অনগ্রসর এলাকায়। পিছিয়ে পড়া জনজাতির জন্য। যেখান থেকে ইংরেজ শাসকের, ভূস্বামীদের সেবা মেলে। মজুর, চাষী, জেলে...। এরা শিক্ষিত হলে - সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলে চিনলে - নিঃশব্দে রোজের বেগার খাটবে কে?”

দিয়া বিরক্ত হচ্ছিল – “ গল্পের মাঝখানে নিজেদের জ্ঞান জাহির না করলেই নয়? মণিদি গল্প বলো”।

মণিদি হেসে ফেলে শুরু করল – “আসলে পটভূমিটা না জানা থাকলে, এ গল্পের কোনো মানে থাকে না রে। যাই হোক শোন –

রাজস্থানের দক্ষিণ পশ্চিমে ডুংগারপুর রাজ্য। সেখানকার রাজা – মহারাওয়াল লক্ষণসিংহ। যে সে রাজা নন, রাজ্যে তাঁকে সম্মান জানানোর জ্ন্য পনেরখানা গান স্যালুটে হয়। সে এক বিশেষ সম্মান। খোদ ইংল্যান্ডের মহারানী সে অনুমতি দিয়েছেন! তা স্কুল করার জন্যে, সেই রাজ্যের ভীল অধ্যুষিত গ্রাম রাস্তাপালকে বেছে নিয়েছিলেন সেবা সংঘের কিছু নিবেদিত কর্মী।

প্রস্তাব শুনেই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন মহারাওয়াল। বুনো ভীলের দল চিরটাকাল মুখ বুজে রাজপুতদের সেবা করে এসেছে। রাজার চাবুককে নতমস্তকে স্বীকার করে নিয়েছে ঈশ্বরের প্রসাদের মতো। যে সব সরল চোখে, ঈশ্বর আর মহারাওয়াল সমার্থক ছিল, সেই চোখ ফোটাতে চায় ওই উটকো আপদগুলো? তারপর কি আর ওরা আগের মতো মান্য করবে মহারাওয়ালকে?

না না, এসব কিছুতেই চলতে পারে না। অতএব তিনি ফতোয়া জারি করলেন – এ রাজ্যেতে নাহি রবে শিক্ষা সদাচার... হাঃ হাঃ হাঃ।

থামানো গেল না কিন্তু! রাজা জমি না দিলে কী হবে, এগিয়ে এলেন নানাভাই কণ্ঠ নামের এক মহাপ্রাণ। নিজের বাড়ি তিনি খুলে দিলেন স্কুলের জন্য। শিক্ষকেরও অভাব হলো না, জানিস? এগিয়ে এলেন সেঙ্গাভাই। এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা – রাজদণ্ডের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীও জুটে গেল!”

তিন্নি রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞাসা করল – “তারপর? ওরা পড়তে পারল?”

মণিদি বোধহয় শুনতে পেল না। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল এক অদ্ভুত ক্লাসরুম।

[২]

ব্ল্যাকবোর্ডে ‘ক’ লিখতেই...

“ক সে কলম” – নানা স্বরের ঐকতানে ক্লাসরুমটা গমগম করে ওঠে। নানান বয়েসের মানুষের ভিড় সেখানে। খস খস... পেনসিলের প্রবল ঘষায় খাতা যায় যায়। তবু ক লিখতে পারার আনন্দে কালো মুখগুলি বড় উজ্জ্বল। আর সেই আলোয় উদ্ভাসিত সেঙ্গাভাইয়ের মুখ। শ্রেণিকক্ষে ঘুরে ঘুরে সবাইকে উৎসাহ দিচ্ছেন তিনি –

“ইয়ে কলম সামহালকে রখনা। ইসকে তাকত..

জানো তো, এই কলমের জোর রাজার দণ্ড, পুলিশের ডাণ্ডার চেয়েও শক্তিশালী। মনে রেখ, শিক্ষাই শক্তির উৎস। যেদিন নিজেদের চিনতে শিখবে, সেদিন তোমাদের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। মহারাওয়ালও নয়”।

“রাম, রাম। এইসা মত বোলিয়ে” – বর্ষীয়ান ছাত্রটির মুখে চোখে ভয় – মহারাওয়াল যে স্বয়ং ঈশ্বরের প্রতিভূ!

“রাজাকে খিলাফ কুছ শুননা ভী পাপ হ্যায়।”

সেঙ্গাভাইয়ের চোখদুটো একবার জ্বলে উঠেই শান্ত হয়ে যায়। শুধু এই অন্ধবিশ্বাসের জন্যেই, এই দুর্মর শক্তিশালী ভীলজাতি যুগ যুগ ধরে রাজপুত শাসকের অত্যাচার সয়ে আসছে নির্বিবাদে। আজও ডুংগারপুরের ভীলেরা চরমভাবে নির্যাতিত।

স্বাধীনতা দরজায় কড়া নাড়ছে – মাসকয়েকের মধ্যেই ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হবে। একথা এখন দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট। কিন্তু মানুষ যদি স্বাধীনতার অর্থই না বোঝে, তাহলে তাদের অধীনতার শিকল কখনো ঘুচবে না। শিকলের মালিকানার হাতবদল ঘটবে শুধু। তাই সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষা। চেতনার যেটি প্রথম ধাপ। এই রাস্তাপাল গ্রামে সেবা সংঘের পাঠশালা প্রতিষ্ঠার কারণ এটাই।

সেঙ্গাভাই বলছিলেন –

“আজ পড়া থাক। একটা গল্প শোন বরং।

এই বনে, পাহাড়ে একসময় শুধু ভীলেরা থাকত। তাদের ছিল – বনের শিকার, খেতির ফসল, চাঁদের আলোয় ঢোলথালের দ্রিমি দ্রিমি, কৌড়ির সুরে ছেলেমেয়েদের নাচ।

প্রায় পাঁচশ বছর আগে গিহ্লোট বংশের এক নির্বাসিত রাজকুমার, তার কিছু অনুচরকে নিয়ে, ভীলরাজা ডুংগারিয়ার আশ্রয় নিয়েছিল। তারপর একসময় সেই বিশ্বাসঘাতক রাজকুমার, আশ্রয়দাতাকে হত্যা করে, সে নিজেই রাজা হয়ে বসল। সেই ডুংগারিয়ার নাম থেকেই তোমাদের এই রাজ্য - ডুংগারপুর!’

বছর বারোর একটি মেয়ে উঠে দাঁড়ায় এইবার – ‘এই গিহ্লোট বংশের রাজা নাগাদিত্যের অত্যাচারের বিরুদ্ধেই ভীলবিদ্রোহ হয়েছিল না? পুরো রাজবংশ ভীলেদের রোষে ছারখার হয়েছিল। উয়োলোগ দেওতা নেহি হ্যায় বাপু। ইনসান হ্যায়। অগর গলতি করে তো...’

সেঙ্গাভাই সস্নেহে তাকিয়ে থাকেন। আগে বলা কাহিনি ঠিক মনে রেখেছে কালিবাঈ। বড় তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী এই মেয়েটি।

চাষী বাপমায়ের মেয়ে। তার বাবার বড় শখ মেয়ে লেখাপড়া শিখে মানুষের মতো মানুষ হবে। সেঙ্গাভাইধের কাছে আসা দিদিমণিদের মতো। এমন অপমানিত দাসের জীবন হবে না তার।

পড়া এগিয়ে চলছিল – নতুন করে নিজেদের চিনতে শিখছিল সরল মানুষগুলো। ক সে কলম থেকে শুরু করে ইতিহাস, ভূগোল, যুগ যুগ ধরে তাদের ওপর হয়ে আসা অত্যাচারের আর তার প্রতিবাদের গল্প...


[৩]

মণিদি বলে চলছিল এক ঘোরের মধ্যে –

“ঠিক এখান থেকেই বিপদের আঁচ পাচ্ছিলেন মহারাওয়াল। স্বাধীনতার সঙ্গে সিংহাসনের মতো ভীলদের নিঃশর্ত আনুগত্যও যদি হারাতে হয়, তাহলে তাঁর প্রতিপত্তিরও অবসান ঘটবে! এই জন্যেই পাঠশালা স্থাপনায় এত আপত্তি ছিল ডুঙ্গারপুরের অধিপতি মহারাওয়াল লক্ষ্মণ সিংহের। তবু কী অসীম দুঃসাহস ওই নানাভাই কণ্ঠের! সে নিজের বাড়ি পাঠশালার জন্য দান করেছে! এর একটা ব্যবস্থা...”

দিয়ার গলা ভারি হয়ে উঠেছে উৎকণ্ঠায় – “ওদের উপর খুব অত্যাচার করল ওই মহারাওয়াল?”

মণিদি কেমন যেন হাসল – “মহারাওয়াল ভয় পেয়েছিলেন, বুঝলি। আসলে রাজপুত আর কজন? ওঁর সব সৈন্য বা রক্ষকদের বেশিরভাগই তো ভীল। তাদের বাড়ির অনেকেই যাচ্ছে ওই স্কুলে। কে জানে কী শিখে আসছে সেখান থেকে! তাদের উপর ভরসা করতে পারছিলেন না তিনি। যদি তারা ঘুরে দাঁড়ায়? না না, এত বড় ঝুঁকি তিনি নিতে পারেন না। বরং খবর পাঠালেন ম্যাজিস্ট্রেটকে। ইংরেজ তখন জানে এবার তাদের ছেড়ে যেতে হবে এই আরাম আয়েশ আর দৌলত। তারাও হিংস্র হয়ে উঠেছিল। ক্ষোভ উগরে দেবার এই সুযোগটা তারা ছাড়ল না।

তারিখ ছিল - ১৯৪৭ এর ১৯শে জুন। পুলিসবাহিনী এলো পাঠশালা বন্ধ করতে। রুখে দাঁড়ালেন নানাভাই আর সেঙ্গাভাই। পুলিশ এটাই চাইছিল। নিরস্ত্র প্রতিবাদীদের উপর বীরত্ব দেখাবার এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে? নির্বিচার লাঠি চলল। নানাভাই ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারালেন। সেঙ্গাভাই মারের চোটে জ্ঞান হারালেন। গ্রামের লোককে ভালোমতো শিক্ষা দিতে সেঙ্গাভাইয়ের আহত অচেতন দেহকে গাড়ির সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধল তারা। গাড়ি চালিয়ে অজ্ঞান দেহটাকে রাস্তায় হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে লাগল ব্রিটিশের পুলিস। আর ভয়ে, আতঙ্কে, ঘৃণায় পাথর হয়ে সেই দৃশ্য দেখছিল সারা গ্রামের মানুষজন। রাওয়ালের বিরুদ্ধে, পুলিসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ না করাটাই যে এই অসহায় মানুষগুলির যুগ যুগ বাহিত রক্তের শিক্ষা! তারা অঝোরে কাঁদছিল, যেমন করে কেঁদে এসেছে যুগ যুগ ধরে।

সেই সময়, তখন মাঠে কাজ করছিল কালিবাঈ। গোলমাল শুনে কাস্তে হাতেই দৌড়ে এসেছিল। তার গুরুকে ওরা...

‘বাপজিইইই’ – আর্ত চিৎকার করে কাস্তে হাতেই প্রাণপণে দৌড়াল কালিবাঈ। অন্ধ আবেগের স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল পুরুষানুক্রমে বাহিত সংস্কার। পুলিস মজা দেখার জন্য গাড়ি থামাতেই, মেয়েটা ঝাঁপিয়ে পড়ে দড়ি কেটে ফেলল এক কোপে। তাই দেখে চটক ভাঙল অন্য মেয়েদেরও। তার দল বেঁধে এগিয়ে এল সেঙ্গাভাইয়ের পরিচর্যায়। কালিবাঈ জল আনছিল মুখে দেবার জন্যে।

এত সাহস, পুলিসের কাজে, মজা দেখানোয় বাধা? ক্ষিপ্ত পুলিস গুলি চালাল। রক্তে স্নান করা দেহটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। কালিবাঈয়ের আনা জলে মিশে গেল তারই রক্তের ধারা। আর সেই রক্ত তুফান তুলল জমে থাকা অসহায় মানুষগুলোর মনে।

তাদের হতবাক আতঙ্ক ক্ষোভে ফেটে পড়ল এতক্ষণে। শত্রুহননের ডাক দিয়ে, মারু ঢোল বাজতে লাগল উদ্দাম বেগে। সংকেত পেয়ে, ভীলেরা দলে দলে তাদের তীরধনুক, বর্শা নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করল। পালিয়ে বাঁচল পুলিসবাহিনী। সব ভুললেও মারুর ডাক ভোলেনি তারা। পিছু হটলেন রাওয়ালও”।

তিন্নি শুধু বলল – “তারপর?”

মনিদি বলল – “ হ্যাঁ, তারও পর থাকে বইকি। এরপর আরও বড় বাহিনী এসেছিল রাস্তাপালে। ভীলদের গ্রামটাকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে ছেড়েছিল। কিন্তু কী জানিস, আলো যখন জ্বলে তখন কিছুতেই অন্ধকার জিততে পারে না। এ লড়াই সেখানেই থামল না। অবশেষে হার মানতে বাধ্য হলেন লক্ষ্মণ সিং। ভীলদের পড়াশোনার অধিকার মেনে নিতে হযেছিল তাঁকে”।

মিতু হাঁটুতে মুখ রেখে শুনছিল এতক্ষণ। এবার মুখ তুলল। জলে ভেজা চোখ না মুছেই, ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল – “ডুঙ্গারপুর মনে রেখেছে কালিবাঈকে?”

মণিদি বলল – শহীদের বলিদান বৃথা যায় না রে মিতু। ডুঙ্গারপুর তাকে শুধু মনে রাখেনি, প্রাণে রেখেছে তার শিক্ষার আর্তিকে। গুরুর জন্য, শিক্ষার অধিকারের জন্য শহীদ হওয়া সেই মেয়ে বেঁচে রইল ডুঙ্গারপুরের মানুষের ভাবনায়, কাজে। সেখানে আজ ৮৪.৩৮% জন স্বাক্ষর”।

লম্বা শ্বাস ছাড়ল মেয়ের দল – “আমরাও আর পড়ায়, কাজে ফাঁকি দেব না মণিদি। যেটা ঠিক বলে জানব, তার জন্য লড়ব”।

মণিদি হাসল – “বিপ্লব আলো ছড়ায় যুগে যুগে। কখনো হারিয়ে যায় না, মনে রাখিস।”

********

স্বাধীনতার পঁচাত্তর বৎসর উদযাপনে মূর্তি গড়ছিলেন ভাস্কর। একহাতে কাস্তে, অপর হাতে বই দিয়ে কালিবাঈয়ের মুখে তৃপ্তির হাসিটি বড় যত্ন করে ফুটিয়ে তুললেন তিনি। বৃত্তটি সম্পূর্ণ হলো।