Next
Previous
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in








নোবেল জয়ী হান কাং-এর লেখায় টুকরা টুকরা রক্তাক্ত জগৎ




প্রিয়বরেষু
বাসু,

তোমার চিঠি যখন হাতে পেয়েছি দোল পূর্ণিমার রঙ তখন আমার মর্মে লেগে আছে। কর্মব্যস্ত জীবন থেকে কয়েকটা দিন চুরি করে শান্তিনিকেতন কাটিয়ে এলাম। খুব চেয়েছিলাম তুমি আসো চুটিয়ে আড্ডা দেই তোমার সাথে। তুমি তো এলে না, হয়ত সত্যিই অসুস্থ ছিলে কিংবা নিছক অসুস্থতা দেখিয়ে এড়িয়ে গেলে। ভালোই হলো মুখোমুখি হলে হয়ত অতীতের অনেক কবর চাপা কথা জেগে ওঠতো। তোমার শরীর এখন কেমন? সুভাষ ডাক্তারকে তো সেই ছোটবেলা থেকেই দেখাচ্ছো এবার অন্য একজন ডাক্তার দেখাও। প্রায়শ তোমার অসুস্থতার কথা শুনি এত ঘনঘন অসুস্থতা ভালো লক্ষণ নয় মোটেই।

হারুকি মুরাকামি আমার প্রিয় লেখকদের একজন। তার লেখা আমাকে খুব ভাবায়। সম্প্রতি ইজরাইলি গল্পকার, স্ক্রিপ্টরাইটার ও ফিল্মমেকার এটগার কেরেটের লেখাও আমার বেশ প্রিয়। ২০২৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া দক্ষিণ কোরিয়ার হান কাং কে তুমি কি পড়েছো? মানুষের জীবনের ভঙ্গুরতা, যন্ত্রণার কথা বার বার হানের কলমে উঠে এসেছে আর গদ্য হয়ে উঠেছে কবিতা। ফুটপাতে পুরানো বই ঘাঁটতে গিয়ে আমার হাতে আসে ২০১৬ সালে ডেবোরো স্মিথের অনুবাদে ইংরেজিতে হান কাংয়ের লেখা সবচেয়ে জটিল চিন্তার অভিনব উপন্যাস 'হিউম্যান অ্যাক্ট' যা 'সোনানিয়ন ওন্দা' নামে প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। তখন থেকে আমি হানের লেখার সাথে পরিচিত কিন্তু এত জলদি সে নোবেল পাবে ভাবিনি।

হিউম্যান অ্যাক্টস লেখা হয়েছে দ্বিতীয় পুরুষের বর্ণনায়। ইতিহাসভিত্তিক এ উপন্যাসের ভাষা আদতে কাব্যিক। ছয়টি অধ্যায় আর শেষে উপসংহার নিয়ে মোট সাত খণ্ডের উপন্যাসটিতে আছে চুন ডু হুয়ান নামের এক সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী কিশোরের গল্প। স্কুলপড়ুয়া কিশোর দং হো ১৯৮০ সালের মে মাসে জড়িয়ে পড়ে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে দানা বাধা গণতন্ত্রকামীদের আন্দোলনে। পরবর্তী অধ্যায়গুলোয় পাল্টে যায় পরিপ্রেক্ষিত। জেয়ং দে নামের আরেক নিহত কিশোরের বয়ানে এগোতে থাকে কাহিনি। পড়তে পড়তে কারও মনে পড়তে পারে ওরহান পামুকের মাই নেম ইজ রেড–এর কথা। এখানে নামহীন লেখকের চরিত্রটি হতে পারেন হান কাং নিজেই, যিনি গোয়াংজু অভ্যুত্থানের কিশোর শহীদ দং হোর কবরে মোমবাতি জ্বালিয়ে সম্মান জানিয়ে আসেন। তারপর সিউলে ফিরে উপন্যাস লিখতে শুরু করেন আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে। হানের হিউম্যান অ্যাক্ট পড়তে শুরু করে আমি রীতিমত অবাক হয়েছিলাম। বইটির প্রেক্ষাপটের সঙ্গে আমাদের নকশাল আন্দোলন কিংবা সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। ১৯৮০ সালে কোরিয়ার গোয়াংজুতে সংঘটিত গণতান্ত্রিক আনন্দোলনের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে এই উপন্যাসের কাহিনি। সেসময় ঘটনাচক্রে আন্দোলনে যোগ দেয় উপন্যাসটির মূল চরিত্র স্কুল শিক্ষার্থী ডংহো। ছাত্র-জনতার এই আন্দোলন দমন করতে রাষ্ট্রীয় বাহিনী চরম নিপীড়ন চালায়। আন্দোলনকারী অনেক ছাত্রকে তারা হত্যা করে। স্কুল শিক্ষার্থী ডংহো এরকম বেশ কিছু মৃতদেহ উদ্ধার করে এবং তাদের লাশের উপর দক্ষিণ কোরিয়ার পতাকা বিছিয়ে দিতে দেখা যায়। যদিও বিক্ষোভকারীদের বেশিরভাগই ছিল ছাত্র এবং ডংহোর বয়স ছিল সবার চেয়ে কম, তবুও স্বৈরাচারী শাসকের নিপীড়নের উপর বিশ্বাস করা ছিল কঠিন। ডংহোর মা উদ্বিগ্ন অবস্থায় দিন কাটাতে থাকে।

সেসময় আন্দোলনকারীদের ধরতে রাতের বেলা রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে অভিযান চালাতে দেখা যায়। স্কুল ছাত্র ডংহোর সবচেয়ে কাছের বন্ধু জিয়োংকে তার চোখের সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়। হপ্তাখানেকের মাঝে জিয়োংয়ের বোন জিয়োংমি নিখোঁজ হয়। এমতাবস্থায় সেই এলাকায় রাতে অভিযান করার জন্য আসে বাহিনী। ডংহোর মা তাকে রাতে বাসায় না ফেরার জন্য বলে, কারণ ডংহোকে অভিযান করে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে মা উদ্বিগ্ন থাকে। উপন্যাসটি লেখক ডংহোর মৃত বন্ধু জিয়োংয়ের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বর্ণনা করা শুরু করে। সেখানে দেখা যায়, জিয়োং একটি লাশের স্তুপের মাঝে পরে আছে এবং সে বুঝতে পারছে তার নিখোঁজ বোন জিয়োংমিকেও সম্ভবত মেরে ফেলা হয়েছে। সে তার জীবিত বন্ধু ডংহোকে নিয়ে ভাবে এবং এসব হত্যাকান্ডের শাস্তি একসময় স্বৈরশাসক পাবে তার আশা ব্যক্ত করতে থাকে। ঠিক সেসময়ই সে বুঝতে পারে একদল রাষ্ট্রীয় বাহিনী এসেছে লাশের স্তুপের কাছে, জনগণ থেকে লুকাতে তারা লাশগুলো পুড়িয়ে দিতে চায়। হানের এই লেখা পড়তে পড়তে আমার নকশাল আন্দোলনের শোনা গল্পগুলোর কথাই মনে পড়তে থাকে।

তোমার নিশ্চয়ই পরাগ মিত্রের কথা মনে আছে। যার কাছে নকশাল আন্দোলনের গল্প শুনতাম আমরা। কমরেড কাকার কাছেও বহু ইতিহাস আমরা শুনেছিলাম। তাঁর মুখেই শোনা সেইসময় নকশালবাদে যোগদানের জন্য অনেক ছাত্র কলেজ পর্যন্ত ছেড়েছিল। চারু মজুমদার ছাত্রদের নকশাল আন্দোলনে যোগ দিতে প্রলুব্ধ করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন, এই বিপ্লব শুধুমাত্র গ্রামীণ জনগণের জন্য নয়, বরং যারা ‘শ্রেণী শত্রু’ তাদের বিরুদ্ধে লড়াই। এই শ্রেণী শত্রুর তালিকায় পড়বে সরকার থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যবসায়ী, পুলিশ এবং আরো অনেকে। নকশালপন্থীরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে নেয়। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স নকশাল কার্যকলাপের জন্য অন্যতম ঘাটি হয়ে ওঠে। নকশালবাড়ি আন্দোলন বছরখানেকের মধ্যে অনেকটা স্তিমিত হয়ে এলেও অনেক বিশ্লেষকই মনে করেন, আজ পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় পরও সেই আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা এবং তাৎপর্য বিন্দুমাত্র হারিয়ে যায়নি। এটি স্বাধীন ভারতের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসকে আমূলভাবে বদলে দিয়েছে। নকশাল আন্দোলন নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস-গান-কবিতা লেখা হয়েছে। সমরেশ মজুদারের ‘উত্তরাধিকার’-এর চার প্রধান চরিত্র নকশালবাদ থেকে অনুপ্রাণিত হয়। বুকার পুরষ্কারজয়ী লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের ‘দ্য গড অফ স্মল থিংস’-এর একটি চরিত্র নকশাল আন্দোলনে যোগ দেয়। মহেশ্বেতা দেবী তার ‘হাজার চুরাশির মা’ এই আন্দোলনের পটভূমিতেই লেখেন। পরে একই নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ঝুম্পা লাহিড়ী, অনুরাগ মিশ্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সহ আরো অনেকের লেখনীতে নকশাল আন্দোলন বারবার উঠে এসেছে।

হান কাংয়ের লেখা কেমন? কী তাঁর উপন্যাসের মূল বিষয়? মূল ভাষার সৌন্দর্য বোঝার মুরোদ আমার নেই, তাই তাঁর অনুবাদক ডেবরা স্মিথের অনুবাদই ভরসা। তবে হিউম্যান অ্যাক্ট পড়ার পরে আমি খুঁজে খুঁজে তার অন্য উপন্যাসগুলো পড়েছি এবং পড়ার পরে মনে হয়েছে হান কাংয়ের লেখার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাহুল্য বিবর্জিত লেখা। কলেবরের জায়গা থেকে অতি সংক্ষেপিত এবং মাত্র চারটি উপন্যাস লিখেই নোবেল জিতে নিয়েছেন তিনি। পৃষ্ঠার হিসেবেও সেটা ৬০০ থেকে কম। আমাদের পরিচিত অনেক লেখকের একটি উপন্যাসের চেয়ে কম, হান কাংয়ের সারাজীবনের গদ্য। চাইলে গোটা হান কাং পড়ে ফেলা যায় এক সপ্তাহে। বাহুল্য বিবর্জিত স্পষ্ট অথচ জটিল চিন্তার এই লেখাগুলোর দ্বারা দক্ষিণ কোরিয়ান কাব্যময় লেখার ভঙ্গিমায় হান কাং আমাদের নিয়ে যায় এমন এক জগতে, যেখানে বাস্তবতার ভয়াবহতা টের পাওয়া যায় ক্রমেই। মৃত লাশের মনে হতে থাকে জীবিত নিপীড়নের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা, অথচ আমাদের মনে হয়েছিল মৃত্যুই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর।

হান কাংয়ের উপন্যাস ‘দ্য হোয়াইট বুক’ র পটভূমি হিসেবে এসেছে যুদ্ধ-পরবর্তী পোল্যান্ডের ওয়ারশ। নিরস্ত্র কথকের ছোট বোনের মৃত্যু সম্পর্কে খণ্ড খণ্ড চিন্তামগ্নতা নিয়ে তৈরি হয়েছে এই উপন্যাসের কাহিনি। জন্মের দুই ঘণ্টা পর মৃত্যু হয় শিশুটির। ‘দ্য হোয়াইট বুক’ উপন্যাসের উপস্থাপনশৈলীর মধ্যে নতুনত্ব লক্ষ করা যায়। দুঃখ, ক্ষতি এবং মানবাত্মার ভঙ্গুরতার কথা বলার জন্য ভাত, চিনির খণ্ড এবং বুকের দুধসহ মোট ৬৫টি সাদা বস্তুর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এখানে। এখানে উপস্থাপিত কাহিনির সঙ্গে লেখকের বাস্তব জীবনের অনেক মিল পাওয়া যায়, বিশেষ করে তাঁর বোনের শিশুবেলার মৃত্যুর সঙ্গে। হান কাংয়ের আরেক উপন্যাসের নাম ‘গ্রিক লেসনস’। উপন্যাসে বাকশক্তি হারানো একজন নারী প্রাচীন গ্রিক ভাষা পাঠ করার সিদ্ধান্ত নেয়। যার কাছে পাঠ নেবে তারও অবস্থা ওই নারীর মতোই: ধীরে ধীরে সে দৃষ্টিশক্তি হারাতে থাকে।
তবে এ উপন্যাসে দেখানো হয়েছে, ভালোবাসার প্রায়শ্চিত্তমূলক শক্তির মধ্যে আশাবাদী ও মানবীয় বিশ্বাস নিহিত থাকে। কারণ তাদের পাঠদান ও পাঠগ্রহণের প্রক্রিয়ায় পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। একজন আরেকজনের মানসিক যন্ত্রণা ও দুশ্চিন্তার কথা জানতে পারে, অনুভব করতেও পারে। পর্যায়ক্রমে তারা আরো নিকটবর্তী হতে থাকে। ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশের পর হান কাংয়ের এই উপন্যাস বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় ইতিবাচক সাড়া পায়।

এই সবগুলোই হয়ত তোমার পড়া কিন্তু আমাকে অবাক করেছে ১৯৭০ সালের শেষে জন্ম নেয়া হান কাং লেখালেখি শুরু কবিতার মাধ্যমে ১৯৯৩ সালে। একটি সাহিত্য ম্যাগাজিনে ছাপা হয় তার পাঁচটি কবিতা। পরের বছর ঔপন্যাসিক হিসেবে অভিষেক হয় তার। তিন দশকের লেখালেখিতে আন্তর্জাতিকভাবে তিনি নজরে আসেন অনেক পরে। ২০০৭ সালে প্রকাশিত 'দ্য ভেজেটেরিয়ান' উপন্যাসটি ইংরেজি অনুবাদে প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। হিসেব করলে হান কাংয়ের আন্তর্জাতিক পরিচিতি মোটের উপর দশ বছর। এত কম সময়ের পরিচিতিতে নোবেল পুরস্কার জেতার ঘটনা আগে সেভাবে ঘটেনি। তার উপর এবারে নোবেল প্রত্যাশী যেসব লেখকদের নাম সামনে আসছিল, হান কাং তাদের মেয়ের বয়সীই হবে। এর বাইরেও মজার একটি বিষয় হলো, ২০১২ সাল থেকে (কাজিও ইশিগুরো ব্যতিরেকে) এক বছর পরপর সাহিত্যে নারী লেখককে নোবেল জিততে দেখা যায়। ২০২৪ সালের নোবেলেও এই ধারাবাহিকতা দেখা গেল। সব মিলিয়ে এবারের সাহিত্যের নোবেল বেশ অদ্ভুতই বটে। তুমি হান কাংয়ের কি কি পড়েছো জানিও। তুমি আরো গভীরভাবে হান কাংয়ের লেখার বিশ্লেষণ করতে পারবে আমি জানি।

হান কাংয়ের দ্য ফ্রুট অব মাই উওম্যান উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে একটা অভিনবত্ব চোখে পড়ে মোট আটটি কাহিনির সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এ উপন্যাস। এখানকার ভিন্ন ভিন্ন পর্বে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যর্থতার চিত্র দেখানো হয়েছে। বেশির ভাগ জায়গায় তারা জীবনে কোনো আশা দেখতে পায় না। ‘মাই উওম্যান’স ফ্রুট’ অংশে হতদরিদ্র জেলেপল্লীতে জন্ম নেওয়া এক নারীর কথা বলা হয়েছে। নিজের চেষ্টায় সে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে যেতে চায়। তবে তার বিশ্বাস হলো, জগতের রূপ দেখতে হলে বিয়ে করাও দরকার। সে জন্য স্বামীর সঙ্গে আগে সংসার পাতে সে। কিন্তু কিছুদিন পর তারা একে অন্যের প্রতি আর টান অনুভব করে না। এক পর্যায়ে স্বামীর কাছ থেকে দূরে কোথাও পালিয়ে পাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে। কিন্তু সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। তারপর সে গাছ-লতা হয়ে ঘরের ছাদ পেরিয়ে যাওয়ার কথা কল্পনা করে। এ উপন্যাসে দেখানো হয়েছে মানসিক ক্লান্তি আর আধুনিক জীবনের নিরাশা পেরিয়ে যাওয়ার মতো মানুষের ইচ্ছাশক্তি থাকার বিষয়। তবে দ্য ফ্রুট অব মাই উওম্যান গল্পটির ভাবকাঠামোর পরিশীলিত রূপান্তর ঘটিয়ে দীর্ঘ দশ বছর পর ২০০৭ সালে এই গল্পটিকেই তিনি দ্য ভেজিটারিয়ান উপন্যাসে রূপ দেন। এক নারীর নিরামিষাশী হওয়ার সিদ্ধান্তের ফলে পারিবারিক সংকট আর সামাজিক নিষ্ঠুরতার গল্পকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে দ্য ভেজিটারিয়ান। এটি লিখতে তিনি তিন বছর সময় ব্যয় করেন। এটির কেন্দ্রীয় ও নারী চরিত্রকে ঘিরে গড়ে ওঠা অন্যান্য চরিত্রের পটভূমি এবং গাছপালা ও সূর্যকিরণের চিত্রকল্পের আবহ তৈরির জন্য তিনি অনেক ভাবনাচিন্তা ও পর্যবেক্ষণ করে মাসের পর মাস খেটে উপন্যাসটি সমৃদ্ধ করেন। দ্য ভেজিটারিয়ান তিনটি পর্বে বিভক্ত। ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে অসুস্থ হওয়ার পর মাছ–মাংস খাওয়া ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ইয়েয়ং হাই নামের এক বিবাহিত নারী। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে তার স্বামী চেইয়ং দেখতে পায় ফ্রিজ থেকে সব প্রাণিজ আমিষ খাদ্য ফেলে দিচ্ছে সে। নিজে নিরামিষভোজী হয়েই ইয়েয়ং ক্ষান্ত নয়, স্বামীর জন্যও মাছ–মাংস রাঁধতেও সে অস্বীকৃতি জানায়। শান্তভাবে বলে যে দিনের মধ্যে দুই বেলাই যেহেতু চেইয়ং বাইরে খাওয়াদাওয়া করে, তাই এক বেলা নিরামিষ খেলে তার এমন কিছু ক্ষতি হবে না। উপন্যাসের প্রথম পর্বে ইয়েয়ংয়ের ভেজিটারিয়ান হওয়া নিয়ে অস্বস্তি, যা ক্রমে পারিবারিক সংকট, অতঃপর সংঘাতের রূপ নেয়—সেটুকু ইয়েয়ং হাইয়ের স্বামী চেইয়ংয়ের বয়ানে, সোজাসাপটা ভাষায় লেখা। মাঝেমধ্যে কেবল কিছু অংশ লেখা হয়েছে ইটালিকে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, সেগুলো ইয়েয়ং হাইয়ের স্বপ্নের বিবরণ। তাতে যত না কাব্য, তার চেয়ে বেশি আছে ভয়ানক সব নৃশংসতার চিত্র। রক্তাক্ত, বীভৎস সেই সব দুঃস্বপ্ন ইয়েয়ংকে ভয়ানকভাবে তাড়া করে। স্বপ্ন ভেঙে জেগে ওঠার পর প্রাণী হত্যা আর মাংস ভক্ষণের পুরো প্রক্রিয়াটি অস্বাভাবিক নিষ্ঠুর বলে মনে হয় তার কাছে। যদিও প্রতি বেলা মুরগি, গরু, শূকর, অক্টোপাসসহ নানা ধরনের মাছ–মাংস সব সময়ই ছিল তাদের খাদ্যতালিকায়। ইয়েয়ং হাই নিজে খুব ভালো রাঁধুনি। ছোটবেলায় মায়ের কাছে প্রায়ই ওয়েস্টার খাবারের জন্য বায়না করত।

দ্বিতীয় পর্বে ‘মঙ্গোলিয়ান মার্ক’ লেখা হয়েছে সর্বদ্রষ্টা বক্তার (ওমনিশ্যান্ট ন্যারেটর) ভাষায়। এখানে মূল দৃষ্টিভঙ্গি ইয়েয়ং হাইয়ের ভগ্নিপতির। আর তৃতীয় পর্ব ‘ফ্লেইমিং ট্রিজ’–এর বক্তা ইয়েয়ং হাইয়ের বোন ইন হাই। তিনটি অংশের মাঝখানে সময়ের ব্যবধান দুই বছর করে। মূল চরিত্রের সরাসরি বক্তব্য খুব অল্প পরিমাণ হলেও তার প্রাণী হত্যা নিয়ে পরিবর্তিত মনোভাব অনেকটাই বোঝা যায়। নিজে খাওয়ার জন্য অন্য প্রাণকে ধ্বংস করার ব্যাপারটি সহ্য করতে না পারা ইয়েয়ং একপর্যায়ে স্বামীর ‘শরীরে মাংসের গন্ধ’ পায় বলে তার সঙ্গে যৌন সংসর্গও ত্যাগ করে। স্বামীর বয়ানে জানা যায়, এই প্রত্যাখ্যানের ফলে ইয়েয়ংকে বৈবাহিক ধর্ষণের শিকার পর্যন্ত হতে হয়।

ইয়েয়ং হাইয়ের নিজের শরীর ও জীবনের ওপর তার অধিকার না থাকার বিষয়টির উল্লেখ করে এ আখ্যানকে তার আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার লড়াই হিসেবে দেখেছেন দ্য ইনডিপেনডেন্ট–এর বিশ্লেষক জুলিয়া পাসকাল। দ্য অস্ট্রেলিয়ান বইটিকে অদ্ভুতুড়ে বা ‘আনক্যানি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। গ্যাজেট ভ্যান আনটওয়েরপেন বলেছে, এটি হারুকি মুরাকামির ভক্তদের জন্য উপযোগী এক বই। আবার দ্য আইরিশ টাইমস একে দেখছে নারীদের প্রতি নিষ্ঠুরতার আখ্যানরূপে। আর দ্য গার্ডিয়ান–এর মতে, এই উপন্যাস নানা পীড়াদায়ক প্রশ্ন সামনে নিয়ে আসে।

উপন্যাসে হান কাং এমন এক দুনিয়ার চিত্র তুলে ধরেন, যা দৈনন্দিনতায় ভরা; কিন্তু খানিকটা বীভৎস, অদ্ভুত। পারিবারিক পরিস্থিতি বর্ণনার মধ্য দিয়ে তিনি উপস্থাপন করেন সমাজের সেসব রক্তাক্ত অনুভূতি, সচরাচর যেসব জনসমাজের সামনে আসে না। দ্য ভেজিটারিয়ান–এ বিষয়গুলো যেমন পোক্তভাবে উপস্থিত, তেমনি আছে হিউম্যান অ্যাক্টস–এও। মহান সাহিত্য যা করে, খবরের কাগজে পড়ে ভুলে যাওয়া একেকটি তথ্য বা গল্পের পেছনের বিশাল আখ্যানটিকে মহাকাব্যের মতো বিস্তৃতিতে নিয়ে যায়—হিউম্যান অ্যাক্টসও একই কাজ করেছে। ডং হো নামের কিশোরও হানের ছোটবেলায় পাওয়া সেই স্মরণিকা থেকে উঠে আসা। গোয়াংজুর গণহত্যার সময় নিহত আরও নাম না জানা কিশোর-তরুণেরাও উপন্যাসের চরিত্র হয়ে এসেছে। হান কাংয়ের কলমে বিভিন্ন নামের এসব শহীদ আসলে কাল্পনিক কোনো চরিত্র নয়। গোয়াংজু অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে লেখা হিউম্যান অ্যাক্টস–এর সঙ্গে পাঠকেরা নকশাল বা সম্প্রতি বাংলাদেশে ছাত্র–জনতার যে অভ্যুত্থান ঘটল, তার মিল পেতে পারেন।

খুব বেশি না লিখেও দক্ষিণ কোরিয়ার নোবেলজয়ী এই কথাশিল্পী আখ্যান রচনায় অনন্য আর নিজস্ব শৈলী সৃষ্টিতে সমর্থ হয়েছেন। দ্য কনভারসেশন–এর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে হান কাং যে কথা বলেন, সেটি হয়তো তাঁর লেখালেখির মূল মন্ত্র। কাংয়ের কথা হলো, মূলত তাঁর উপন্যাস মানবজীবনের যন্ত্রণা আর বেদনা নিয়ে লেখা। মানুষের প্রতি মানুষের অমানবিক বর্বর আচরণ, অসহনীয় নির্মমতা তাঁকে খুবই পীড়া দেয়।

এ কারণেই কি হান কাংয়ের লেখার অন্দরমহলে এত চাপা রক্তের ছাপ দেখা যায়, আর একের পর এক তিনি লিখতে থাকেন রক্তাক্ত মানুষের গল্প?

কোরিয়ান চলচ্চিত্রে যাঁদের আগ্রহ, তাঁরা এ ব্যাপারে একমত হবেন যে হত্যা, মৃত্যু, নৃশংসতাকে অন্য এক দৃষ্টিতে দেখার আর দেখানোর প্রবণতা আছে কোরিয়ানদের মধ্যে। সম্প্রতি অস্কার পাওয়া ছবি প্যারাসাইট–এও আমরা দেখেছি চরম দারিদ্র্যের ফলে মানবিক অধঃপতন এবং এর সমান্তরালে ধনকুবের এক পরিবারের বিলাসী জীবনযাপনের প্রতি বিদ্বেষ; ফলাফল হত্যা আর নিষ্ঠুরতা।

কাংয়ের লেখায় যে টুকরা টুকরা রক্তাক্ত জগৎ, যে নিষ্ঠুরতা, তা বৃহদাকারের নয়, অনেকটা ফুটকির মতো; কাব্যিক ভাষার আচ্ছাদনে অজস্র রূপক দিয়ে ঘেরা। তাঁর উপন্যাসে ডুব দিলে অনুভব করা যায় সেই ‘আনক্যানি’ ভরা দুনিয়াকে।

বাংলা নববর্ষের শুভেচ্ছা সহ-

তোমার সুস্মি
১২ এপ্রিল,২০২৫
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in




















জেরাল্ডের এপার্টমেন্টেরও জেরাল্ডের মতই দু’খানা আলাদা সত্তা আছে। তাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের কোনও বিরোধ নেই। একজন আরেকজনের ব্যাপারে নাক গলায় না এবং একজন আরেকজনকে এতটুকুও জায়গা ছেড়ে দেয় না। সত্তা দুটি এতটাই আলাদা যে সত্যি সত্যিই একজনের সঙ্গে আরেকজনের সাক্ষাৎ হবার কিম্বা মিলেমিশে কাজ করবার সেরকম কোনও অবকাশ তৈরি হয় না। অবশ্য তাদের মালিকানা রয়েছে একজন মানুষের হাতে এবং সেই মানুষটির চারপাশের পরিবেশের মধ্যে একসঙ্গে ও প্রায় একই সময়ে তাদের স্ফুরণ ঘটতে থাকে। জেরাল্ডের প্রকৃত সত্তা কোনটি তা কেউ বলতে পারে না, এবং তিনি নিজেও যে কেন কোনও বিশেষ একটিকে অগ্রাধিকার দেন না, সেই বিষয়টা জানা যায় না। কিন্তু প্রাধান্য দেবার প্রাসঙ্গিকতা এখন শুধু গৌণ নয়, বেশ দেরি হয়ে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর, পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের যুবক জেরাল্ড সন্দেহাতীত ভাবে দ্বৈতসত্তার অধিকারী। তবে তার সঠিক কারণটা কারো কাছেই বোধগম্য নয়। হয়তো বা শারীরিক এবং মানসিকভাবে তিনি খুব দুর্বল ছিলেন শিশু বয়সে। এমনটিও বলা হয় যে তাঁর রক্তে বিচিত্র জাতির মিশ্রণ ঘটেছে। তাঁর মা ছিলেন এক ইহুদি বিদ্বান পণ্ডিত ব্যক্তির কন্যা এবং তাঁর বাবা উত্তর ফ্রান্সের কৃষক পরিবারের সন্তান, যে পরিবারে এক দু’জন ধর্মযাজক ছাড়া বেশির ভাগ মানুষ ছিল ক্ষেতখামারের মালিক। জেরাল্ড তাঁর পূর্বজদের সম্বন্ধে উল্লেখ করতে পছন্দ করতেন, যেমন মনস্তত্ত্ব বিষয়ে আগ্রহের বিষয়টা তিনি সম্ভবত তাঁর পিতামহের থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। তাঁর পিতামহ ছিলেন একজন যাজক। বিশাল বিদ্বান না হলেও তিনি ছিলেন সুবক্তা এবং মানুষের মন ও আত্মাকে পড়ে ফেলবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। অপরপক্ষে মানুষ বিষয়ে জেরাল্ডের বাবার সেরকম আগ্রহ ছিল না। তিনি কাঠখোট্টা, লাজুক প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। এক কৃষককন্যাকে বিবাহ করে গ্রামের খামারবাড়িতে বসবাস করে নিস্তরঙ্গ জীবন কাটানো ছাড়া বিশেষ কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না তাঁর। কিন্তু খামারের মালিকানা আসলে ছিল জেরাল্ডের বাবার খুড়তুতো দাদার এবং অবশেষে জেরাল্ডের বাবা কৃষককন্যার বদলে প্রফেসর রোজেনদালের জ্ঞানী এবং পরিশীলিত স্বভাবের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। সেই কন্যার ত্বক ছিল সম্পূর্ণ সাদা এবং হাতগুলো ছিল ভীষণ ফ্যাকাসে। জেরাল্ডের বাবা প্যারিস গিয়েছিলেন আইন বিষয়ে পড়াশুনা করবার জন্য, যদিও সে কার্যক্রম আর শেষ করে উঠতে পারেননি। এক বন্ধুর মাধ্যমে প্রফেসর রোজেনদালের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল তাঁর। একাকিত্ব, কঠোরতা এবং নিজস্ব ক্ষোভের বাতাবরণ সামলে উঠতে উঠতে কী ভাবে যেন প্রফেসর রোজেনদালের কন্যার প্রেমে পড়েছিলেন তিনি। প্রথমে যদিও সেই কন্যাকে খুব অদ্ভুত মনে হত তাঁর। ওই কন্যার সৌন্দর্য তাঁর মনে অদ্ভুত ভীতির উর্দ্রেক করতো এবং আসলে তিনি সেই কন্যাকে ঘৃণা করতেই চেয়েছিলেন। মেয়েটি তাঁকে বন্য জন্তুর মত মনে করে, এ কথা বুঝতে পেরে মনে ব্যথা পেয়েছিলেন তিনি। কালেভদ্রে মেয়েটি তাঁর সঙ্গে কথা বলত। যেটুকু বলত, সে কথা ভারি সংযত। যদিও মেয়েটি খুবই জ্ঞানী ছিল, তবুও তাঁর সঙ্গে ছোটখাট সাধারণ বিষয়েই কথাবার্তা হত। মেয়েটি জানত যে সে ছাত্র, পড়াশুনা করে; তবুও ভারি ভারি তত্ত্বের কথা কোনো দিন বলেনি তাঁর সঙ্গে। তিনি অনুভব করেছিলেন যে সেই মেয়েটিও তাঁর প্রেমে পড়েছে। একদিন কাছে ডেকেছিলেন মেয়েটিকে এবং ধর্ষণ করেছিলেন। অবশেষে তাঁদের বিবাহ হয় এবং জেরাল্ডের জন্ম হয়। জন্মের সময় জেরাল্ডের মায়ের অবস্থা মরোমরো হয়েছিল, কারণ শিশু এত বিশাল আকারের ছিল যে সবাই ভেবেছিল বড় হয়ে বাবার মত দৈত্যাকৃতি চেহারা হবে। কিন্তু পাঁচ বছর বয়সে তাঁর ভারি অসুখ করেছিল এবং বাড়বৃদ্ধি কমে গিয়েছিল। ছোটখাট চেহারা নিয়েই বেড়ে ওঠেন তিনি; প্রাপ্তবয়স্ক হবার আগেই মায়ের মৃত্যু ঘটে। তাঁর বাবা প্যারিস শহরটার সঙ্গে কখনই নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারেননি; ফলে জেরাল্ডকে পড়াশুনার জন্য প্যারিসে রেখে দিয়ে তিনি গ্রামে ফিরে যান তাঁর নিঃসন্তান খুড়তুতো দাদার রেখে যাওয়া খামারবাড়িতে।

সেই থেকে জেরাল্ড নিজের মত থাকেন। তিনি ডাক্তারি পড়েছিলেন; প্যারিসের হাসপাতালে কয়েকবছর শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে করতে শল্যচিকিৎসক হিসেবে বেশ পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছিলেন এবং বুঝতেও পারেননি যে কবে যেন তিনি এক বিখ্যাত মানুষ হয়ে উঠেছেন। এই পর্বের শুরুতেই যে দু’খানা সত্তার কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, সেই বিষয়টার সঙ্গে জেরাল্ডের এক বিশেষ প্রতিভার গূঢ় সম্পর্ক আছে। যেমন, তাঁর একটা অদ্ভুত মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণী ক্ষমতা আছে। শল্যচিকিৎসক হিসেবে অবশ্য সেই প্রতিভার সদ্ব্যবহার করবার সুযোগ পান না তিনি। কিন্তু শল্যচিকিৎসক হিসেবে অনেক বেশি মানুষের সঙ্গে পরিচিতি ঘটবার সুযোগ থাকে এবং অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে তাঁর পর্যবেক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে পারেন। জেরাল্ড একেবারেই কৌতূহলী ব্যক্তি নন। যাঁদের পর্যবেক্ষণ করবার জন্য তাঁর আগ্রহ জন্মায়, তাঁদের তিনি একটু আলাদাভাবে খাতির করেন। তাঁদের জীবন বিষয়ে অবশ্য তিনি কিছু জানতে চান না। তাঁদের কার্যকলাপ অথবা মানুষ তাঁদের সম্বন্ধে কী বলে, সেসব নিয়েও তিনি এতটুকুও মাথা ঘামান না। কিন্তু তিনি তাঁদের সঙ্গে দেখা করেন, ধীরস্থির ভাবে তাঁদের দিকে চেয়ে থাকেন, নানা কথাবার্তা বলেন, তাঁদের মুখমণ্ডলে আনন্দ অথবা বিষাদের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করতে থাকেন নিবিষ্টমনে। তাঁদের হাত নাড়া, চলাফেরা, বসে থাকা কিম্বা দাঁড়ানোর ভঙ্গিমা, কে কী ভাবে সিগারেট ধরাল… এইসব… সব কিছুই যেন মানুষগুলির মনোজগতের দরজা খুলে দেয় জেরাল্ডের কাছে। তিনি দাবি করেন যে অনেককিছুই মানুষ লুকিয়ে রাখতে পারে, কিন্তু বাইরের চেহারায় মানুষের মনের ছবি ফুটে উঠবেই। মানুষের মনের ছবি খুঁজে বের করবার ইচ্ছেটাই জেরাল্ডের আগ্রহের প্রধান চালিকাশক্তি। তিনি প্রতারিত হতে চান না এই ব্যাপারে। সব সময় সত্যিটা খুঁজে বের করতে মন চায় তাঁর। বিভিন্ন বস্তুর আপেক্ষিকতা তাঁকে দীর্ণ করে। তিনি শিখেছেন যে মানুষকে মূল্য দেওয়া উচিত এবং কেউ কেউ তাঁকে এই শিক্ষা দিয়ে যায় যে তাঁর এই ভাবনা সম্পূর্ণ ভুল। যে ভাবে উৎকৃষ্ট শিল্পকর্মের নির্দিষ্ট মূল্য থাকে, সেইভাবেই মানুষকেও মূল্য দেওয়া উচিত বলে মনে হয় তাঁর; কিন্তু মাঝেমাঝে তিনি ভুল প্রমাণিত হন। কারণ, সবার সেই মূল্য পাবার যোগ্যতা থাকে না। মূল্য এবং অযোগ্যতার মধ্যে পার্থক্য না করতে পারার অক্ষমতা অবশ্য খুব বেশি বিরক্তিকর ব্যাপার নয়। কিন্তু অপরপক্ষে জেরাল্ড অনুভব করেন যে, বিপরীতে, তার এই ক্ষমতার সঙ্গে কল্পনা বা আত্মবিশ্বাসের কোনো সম্পর্ক নেই; মানুষের যেমন দৃষ্টিশক্তি থাকে, ঠিক তেমনই এটি একটি শক্তি, একটি প্রতিভা এবং অবিশ্বাস্যভাবে তিনি এই ক্ষমতার অধিকারী। ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবার জন্য তিনি শব্দ হাতড়ে ফিরতে থাকেন। এই ক্ষমতার গুণগত বৈশিষ্ট্য কথায় প্রকাশ করতে গেলে সেরকম কোনও নির্দিষ্ট নিয়ম কিম্বা আইন নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে যে, নৈতিকতার মান দ্বারা মানুষকে বিচার করা চলে না এবং শিল্পকীর্তিগুলিও সব সময় সৌন্দর্যের মান দ্বারা বিচার করা সম্ভব হয় না। কারণ নৈতিকতা নির্বিকল্প নয়, এবং সৌন্দর্য মানুষের স্বাদের মত পরিবর্তনশীল। তবে যে সৌন্দর্য চিরকালীন এবং শাশ্বত, তার সঙ্গেই হয়তো বা একমাত্র তুলনা চলে জেরাল্ডের এই বিশেষ ক্ষমতার গুণমানের বিধিগুলির। যদিও বিষয়টা পুরোপুরি শিল্পকলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না, কারণ বিশ্বসংসারের নানা বিচিত্র প্রাণময় এবং জড়বস্তু… সব, সবকিছুর প্রতি জেরাল্ড আকর্ষিত বোধ করেন এবং এই আকর্ষণের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর এই বিশেষ ক্ষমতার রহস্য।

আমরা দেখতে পাচ্ছি যে জেরাল্ডকে আর পাঁচটা সাধারণ দ্বৈতসত্তাসম্পন্ন মানুষের শ্রেণিতে রাখা যাবে না। তাঁর ব্যাপারটা এমন নয় যে একটা বহির্জগতের পেশাগত সত্তা এবং আরেকটা ঘরোয়া সত্তা; এমন নয় যে একটা প্রকাশিত এবং আরেকটি গোপনীয়; এমন নয় যে একটা সত্তা দিনের বেলায় প্রকাশ পায় এবং আরেকটি রাতে। তাঁর ক্ষেত্রে এরকম অতিসরলীকরণ একেবারে অর্থহীন। তাঁকে দ্বিখণ্ডিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী বা দ্বৈতসত্তাসম্পন্ন মানুষ বলে সরাসরি দেগে দেওয়া যাবে না। আগেই বলেছি যে তাঁর ক্ষেত্রে একটি সত্তার সঙ্গে আরেকটির কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু তাঁর অন্তরে একটা গোপন নেশা আছে যেটা তাঁকে সত্যসন্ধানের জন্য তাড়িয়ে বেড়ায়। তিনি খুঁজে বের করতে চান যে এই জগতে ‘সত্য মূল্য’ বলতে ঠিক কী বোঝায়। আমাদের জীবনের দৈনন্দিন ওঠাপড়ায়, প্রতিনিয়ত যন্ত্রণাকাতর মনুষ্যজীবনে কী সেই পরম প্রাপ্তি, কোন বস্তু একেবারে ধ্রুব, যার ঐশ্বরিক কর্তৃত্ব আছে এবং যা একেবারে স্বতন্ত্র… এই সব তিনি খুঁজে ফিরতে থাকেন। আমরা যদি বলি যে জেরাল্ড প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বরের অন্বেষণে রত, তাহলে অসঙ্গত হবে না। জেরাল্ডের প্রতিদিনের সাধারণ জীবনযাপনে, পেশাগত কাজে যে সত্তা ব্যস্ত থাকে, তাঁর সঙ্গে যে মানুষটি পিয়ানো বাদনরত কিশোর বের্নহার্ডের মুখের দিকে তাকিয়েছিল, তাঁর কোনো মিল ছিল না। জেরাল্ড হঠাৎ যেন এক কোমল হাতের পরশ অনুভব করেছিলেন…

‘আমাদের সম্পদ…’ তিনি বলেছিলেন তাঁর সঙ্গীতশিক্ষক বন্ধুকে। তিনি অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন বের্নহার্ডের বাজনা শুনে এবং বলেছিলেন যে এই ছেলে একদিন খুব ভাল পিয়ানোবাদক হবে এবং কোনো কোনো মাপকাঠিতে এই কিশোরের প্রতিভা অসামান্য।

‘এই সম্পদ রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। অতি অবশ্যই এই কিশোরের সত্তা বিশেষ স্বতন্ত্র!’ বের্নহার্ডের হালকা বাদামি মুখমণ্ডলের বিষণ্ণ চোখের দিকে তাকিয়ে উচ্চারণ করলেন জেরাল্ড। তিনি এখনও জানেন না যে বের্নহার্ডের ঠিক কোন বৈশিষ্ট্য তাঁকে আকর্ষণ করছে। কিন্তু এত অল্পবয়সী একজন মানুষ কী ভাবে এত অনায়াসে বাখের কম্পোজিশন বাজিয়ে দিতে পারে? এই কিশোরের বাহ্যিক প্রকাশ এবং বাজনা সবকিছুই এক ছন্দে গাঁথা; কোথাও এতটুকু বিন্যাসের অভাব নেই। জেরাল্ড বাদ্যযন্ত্রের উপরে আনত কিশোরের ক্ষীণকায় শরীরের দিকে তাকিয়ে ভেবে চলেন… কাঁধ ঈষৎ ঝুঁকে পড়েছে, মুখ অদ্ভুত গাম্ভীর্যে পরিপূর্ণ, সুরের প্রতি সম্পূর্ণ নিবেদনে ডুবে আছে মন। গাঢ় সোনালী চুলের গুচ্ছ এসে পড়েছে কপালে, ধূসর চোখ বিষাদে ঢাকা, চেয়ে আছে পিয়ানোর চাবিগুলোর দিকে, মাঝে এক দু’ বার বাজনা থেকে মুখ তুলে জেরাল্ডের সঙ্গে চোখাচোখি হল। দুই হাত বড়, চওড়া, সুন্দর, উষ্ণ, বলিষ্ঠ কিশোরের হাত…

জেরাল্ড পরে বের্নহার্ডের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলেন যে সে কেমন যেন বিব্রত বোধ করছে কথা বলতে। তিনি তাঁর বাজনা এবং প্রতিভা ইত্যাদি নিয়ে প্রশংসা করছিলেন। কিন্তু এই কিশোর অপ্রতিভ ভঙ্গিতে চুপ করে থাকে। জেরাল্ড তাঁর অস্বস্তি কাটাবার চেষ্টা করেন, কিন্তু বিশেষ লাভ হয় না। এক্ষেত্রে জেরাল্ডের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা কিছুটা ধাক্কা খায়। বের্নহার্ডের বাজনা শুনে তাঁর মনে হয়েছিল যে এই কিশোর অত্যন্ত পরিণতমনস্ক এবং সপ্রতিভ। অথচ ব্যাপারটা ঠিক তার উল্টো। অর্থাৎ তাঁর ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আসলে তিনি এই বয়সের ফরাসি ছেলেদের বিষয়েই সাধারণত জানেন, যারা শিক্ষা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি সপ্রতিভ এবং বাক্যবাগীশ হিসেবে গড়ে তোলে। এই জায়গাতেও একটা প্রতিবন্ধ কাজ করছে, কারণ বের্নহার্ড এখনও ফরাসি ভাষা খুব ভাল শিখে উঠতে পারেনি। ফলে সে নিজেকে সাবলীলভাবে প্রকাশ করতে পারছে না।

শেষে জেরাল্ড বের্নহার্ডকে জানিয়েছিলেন যে কোনও প্রয়োজনে কিম্বা যদি কোনও বিষয়ে কিছু জানার দরকার হয়, তাহলে যেন সে অতি অবশ্যই জেরাল্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রয়োজন ছাড়াও সে যখন ইচ্ছে যেতে পারে জেরাল্ডের কাছে। বের্নহার্ড তাঁকে ধন্যবাদ দেয় এবং তাঁর ঠিকানা ও ফোন নাম্বারের জন্য একটা ভিজিটিং কার্ড চেয়ে নেয়। জেরাল্ড আন্তরিকভাবে বলেন যে আবার তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য তিনি ইচ্ছুক। শীঘ্রই আবার যেন সে দেখা করে। কিন্তু জেরাল্ড সেদিন ভুল ভেবেছিলেন। বের্নহার্ড জেরাল্ডের সঙ্গে দেখা করেছিল ঠিকই। তবে খুব তাড়াতাড়ি সেই সাক্ষাৎ ঘটেনি। বেশ অনেকগুলো সপ্তাহ চলে গিয়েছিল এবং সেই সময়টুকুর মাঝখানে বের্নহার্ডের জীবনে অনেককিছু বদলে গিয়েছিল।



(চলবে)
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in



















চব্বিশ

আজ সমীরণ সকালে বলল,আজ আমরা অট্টহাসতলা যাব।তৈরি হয়ে সকলে বেরিয়ে পড়ল।সমীরন বলে,কলকাতা থেকে ধর্মতলা থেকে নিরোলের সরকারি বাস (SBSTC) পাবেন। তবে বাসে সময়টা একটু বেশিই লাগে। বাস ছাড়ার সময় হল বিকেলে তিনটে। ওই বাস বাসটি নিরোল পৌঁছায় সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা নাগাদ। নিরোলে নেমেই টোটো রিক্সা করে পৌঁছে যান অট্টহাস সতীপীঠে। আপনি চাইলে মন্দিরে আগে থেকে ফোন করেও আসতে পারেন। তাতে আপনারই সুবিধা। অতিথিতের থাকার জন্য জায়গা আছে। ভক্তদের থাকা, খাওয়া মন্দির থেকেই পরিচালিত হয়।

এছাড়াও কাটোয়ার আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্মস্থান। যেমন, চৈতন্য চরিতামৃতের লেখক কৃষ্ণদাস কবিরাজের বাড়ি ঝামতপুর নামের এক গ্রামে। বাংলায় মহাভারতের রচয়িতা কাশীরাম দাসের বাড়ি কাটোয়া মহকুমার অন্তর্গত সিঙ্গি গ্রামে। ফলে অট্টহাসে এলে আপনি এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্মস্থানেও আসতে পারবেন ঘুরতে। অন্যদিকে কাটোয়া থেকে ১০ কিলোমিটার দূরেই জগদানন্দপুর গ্রাম। সেখানেই রয়েছে রাধাগোবিন্দ জিউয়ের মন্দির। যদি আপনার পুরাতত্ত্ব নিয়ে আগ্রহ থাকে, তাহলে এই মন্দিরের গঠনশৈলি আপনাকে অবাক করবেই।মন্দিরের পূর্বপাশে সাধক ভোলাবাবার মন্দির ৷ পঞ্চমুন্ডির আসন ৷ রটন্তী কালিকা মন্দির ৷এই কালীর কাছে ডাকাতরা পুজো করত ৷ আগে অট্টহাসে পূজার পর শিবাভোগের( শিয়ালকে খাওয়ানো ) ব্যবস্থা ছিল ৷ ১৯৭৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় শৃগালকূল ধ্বংস হওয়ায় ৷ এখন ওই প্রথা উঠে গেছে ৷ শাক্তদেবী হলেও এখানে বাৎসরিক পুজো হয় বৈষ্ণবীয় উৎসবের সময় দোল বা ফাল্গুনী পূর্ণিমায় ৷ এখানে ধূমধাম সহকারে ওই উৎসবের প্রচলন করেন স্বামী ব্রহ্মানন্দ বা কাটোয়ার বিখ্যাত দুলাল সাধু ৷

যদিও বীরভূমেও অট্টহাস সতীপীঠ আছে ৷যা লাভপুরের কাছে ৷ সেখানেও গিয়েছি ৷ আগে বলেছি সেই সাধনপীঠ তথা সতীপীঠের কাহিনী ৷

এই সতীপীঠে দেবীর পাথরের প্রতিমা উপর মহিষমর্দ্দিনীর পাথর মূর্তি রেখে নিত্যসেবা করা হয় ৷মহাভোগ যোগে কালীমন্ত্রে দেবী পূজিতা হন ৷এখানে মূল অধিষ্ঠাত্রী দেবী দন্তরা চামুন্ডা ৷ ভূগর্ভের কয়েক হাত নিচে রয়েছে সতীর মূল শিলা বা পাথর ৷হাজারেরও বেশি বছর আগের একটা নথি পাওয়া গেছে একটা স্কেচ তাতে এর প্রমাণ পাওয়া যায় ৷ "অট্টহাসে চ চামুন্ডা তন্ত্রে শ্রী গৌতমেশ্বরী "৷ তাই , অনেকে বলেন এখানে

প্রাচীন বৌদ্ধ দেবীর হিন্দুআয়ন হয়েছে ৷ তাই , মনে হয় হিন্দু ও বৌদ্ধ তান্ত্রিক , বজ্রযানী ও সিদ্ধাচার্যগণ এখানে সাধনা করেছেন ৷

মায়ের কাছেই ছোট মন্দিরে বিল্লেশ থাকলেও মূল

বিল্লেশ মন্দির বিল্লেশ্বর গ্রামে ৷সেখানে শিব লিঙ্গ মাটিতে বসা ৷ কষ্ঠি পাথরের শিববাহন ষাঁড়ের মূর্তি ৷ মহাপীঠ নিরূপম

গ্রন্থে এই পীঠের কথা বলা হয়েছে ৷ এই পীঠে একসময় ভয়ানক রঘু ডাকাত পুজো করে ডাকাতি করতে যেত ৷ সে নরবলি দিত বলে জনশ্রুতি আছে ৷আবার যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত "বাংলার ডাকাত " বইয়ে বলেছেন এখানে বেহারী বাগদী নামে এক ডাকাত পুজো করে নরবলি দিত ৷ ত্রিশ একর জঙ্গলে ঘেরা এই মন্দিরে আজও গা ছমছমে পরিবেশ ৷

মন্দিরের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে ঈশাণী নদী। কাছেই রয়েছে শ্মশান। এই এলাকাটি আগে এত বেশি জঙ্গলে ভরা ছিল যে, দিনের বেলায়ও যেতে সাহস পেতেন না অনেকে। তবে এখন খুব সুন্দর ভাবে সাজানো হয়েছে মন্দিরটিকে। রাতে ঘুমানোর সময় কানে আসবে শিয়ালের ও প‍্যাঁচার ডাক, সকালে উঠবেন পাখির ডাকে। শান্ত পরিবেশে ভক্তি ভরে পুজো দিতে পারবেন আপনি। কথিত আছে একমনে মাকে ডাকলে সতীমায়ের উপস্থিতি অনুভব করা যায় আজও।

সত্য যুগে দক্ষ যজ্ঞে সতী শিবনিন্দা সহ্য করতে না পেরে দেহত‍্যাগ করেন। এর পর মহাদেব বীরভদ্রকে পাঠান দক্ষকে বধ করতে।সতীর দেহ নিয়ে তিনি শুরু করেন তাণ্ডবনৃত্য ।ফলে বিষ্ণু সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ বিভিন্ন ভাগে খণ্ডিত করেন। এই অংশ গুলো যেখানে পরেছে সেখানে শক্তিপীঠ স্থাপিত হয়েছে ।এগুলোকে সতীপীঠ বলে । এগুলি তীর্থে পরিণত হয়েছে। এখানে দেবীর অধর / নিচের ঠোঁট, পতিত হয়।

এরপর অনেক বছর কেটে যায়।এই স্থান জঙ্গল হয়ে ওঠে।তখন এ স্থানের নাম ছিল খুলারামপুর বা তুলারামপুর।পরবর্তীতে এই গ্রামের নাম দক্ষিণ ডিহি হয়।এই গ্রামে কিছু কৃষক বাস করত।তারা মাঠে চাষবাদ করত। ঈশানি নদীর ধারে অবস্থিত এ স্থান ছিল ঘন জঙ্গলে ঢাকা। দিনের বেলাতেও ওখানে কেউ যেত না। একদিন কৃষকরা চাষ করতে গিয়ে এক সাধুবাবাকে জঙ্গলে ধ‍্যানমগ্ন দেখতে পায়।তাড়া কৌতূহলী হয়ে দলবদ্ধভাবে তার কাছে যায় ও তাকে প্রণাম করেন।সাধুবাবা এখানে যজ্ঞ করেন।যজ্ঞ শেষে তিনি যজ্ঞস্থানে একটি ত্রিশূল পুঁতে দিয়ে অদৃশ্য হয়ে যান।চলে যাবার আগে বলেন, এটি একটি সতীপীঠ।

এখানে দেবী ফুল্লরা ও ভৈরব বিশ্বেশ ।এখানে দেবীর দন্তুরা চামুণ্ডা মূর্তি ।এখানে দেবীকে অধরেশ্বরী নামে পূজা করা হয়।এখানে আছে এক প্রাচীন শিলামূর্তি।মন্দিরের অষ্টধাতুর মূর্তিটি চুরি হয়ে গেছে।

সারা বছর এখানে ভক্তরা আসে।তবে নভেম্বর থেকে মার্চ মাস এ পাঁচ মাস এখানে বহু ভক্তের সমাগম হয়।বহু ভক্তের ইচ্ছাপূরণ হয়েছে এখানে পূজা দিয়ে ।দোলের সময় এখানে বিশাল মেলা বসে। এখানে থাকার জন্য অতিথি নিবাস আছে।মন্দির থেকে ভক্তদের থাকা, খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in



















তৃতীয় পর্ব

হিন্দোশিয়া থেকে ফিরে এসে পানু রায় ভাবছিলেন কী করে একটু অর্থপূর্ণ ভাবে সময় কাটানো যায়। সহজাত বুদ্ধির সদ্ব্যবহার করে যদি কিছু মানুষের উপকার করা যায় আর সঙ্গে সঙ্গে কিছু রোজগার হয় তাহলে মন্দ কী? তাছাড়া দেশে বিদেশে মানুষকে চেনা এবং বোঝার অর্জিত অভিজ্ঞতাও তো কম নয়। সুন্দরী আর জগাই এর কোনও কাজ নেই। ওরা দু’জনেই সৎ, পরিশ্রমী এবং বুদ্ধিমান। ওদেরও কাজে লাগানো যেতে পারে এই নতুন উদ্যোগে। ওনার নিজের জন্যও যেমন সুন্দরী এবং জগাই এর জন্যও তেমন শারীরিক এবং মানসিক পরিশ্রমের খুবই প্রয়োজন। আর বেশিদিন কেবল খেয়ে আর ঘুমিয়ে কাটালে শরীর এবং মাথা দু’টোই ভোঁতা হয়ে যাবে। তাই কাউকে কিছু বলার আগে একদিন সুন্দরী আর জগাইকে ডেকে নিজের পরিকল্পনার কথা জানালেন পানু রায়। জানালেন যে উনি একটি উপদেষ্টা সংস্থা চালু করতে চান। এই সংস্থার মূল কাজ হবে বিপন্ন মানুষদের সাহায্য করা বা সঠিক পরামর্শ দেওয়া এবং অবশ্যই অর্থের বিনিময়ে। মূল পরামর্শদাতার কাজ করবেন তিনি নিজে এবং তাকে সহযোগিতা করবে সুন্দরী এবং জগাই। অফিসের ভিতরের কাজ করবে সুন্দরী এবং বাইরের কাজ করবে জগাই। তবে প্রয়োজনে বা ক্ষেত্রবিশেষে এর ব্যতিক্রম হতে পারে। অর্জিত অর্থ পূর্বনির্দিষ্ট অনুপাতে তিনজনের মধ্যে ভাগ হবে। সব শুনে জগাই বলল,’ দাদু, অত হিসেব নিকেশ আমাদের বোঝবার দরকার নেই। তুমি যখন যা বলবে আমরা তখন তা করবো। আমাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে নিও আর ভুলভ্রান্তি হলে ক্ষমা করে দিও। তবে চেষ্টার ত্রুটি হবে না সে তুমি খুব ভালোভাবেই জানো। তোমার সঙ্গে টাকার কোনও হিসেব করতে পারব না। সব তুমি রেখ। দরকার হলে চেয়ে নেব। তুমি আমাদের বাবা, মা, দাদু সবকিছু। পানু রায় বললেন,’ তোদের কথা মানছি। তোরা ছাড়া আমার আর কে আছে? তবে ব্যবসার একটা নিয়ম থাকা দরকার। সেই নিয়মেই ব্যবসা চলা উচিৎ। না হলে, ব্যবসা টিকে থাকবে না।‘জগাই আর সুন্দরী চুপ করে রইল।

পরেরদিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর সকলকে ডেকে নিজের পরিকল্পনার কথা জানালেন পানু রায়। সবাই মহা উৎসাহে হৈ হৈ করে উঠল। পচা, কেস্ট, মাধাই সবাই বলে উঠলো,’ দাদু, আমরাও আছি তোমাদের সঙ্গে। দরকার পড়লে শুধু একবার ডেকো।‘ মাধাই বলল,’ দাদু, তোমাকে একটা জরুরি খবর দিই।‘ পানু রায় বললেন,’ কী খবর?’ সকলে উৎসুক হয়ে মাধাই এর দিকে তাকিয়ে রইল। মাধাই বলল,’ কেলো দারোগার পদন্নোতি হয়ে বারৌনিতে পুলিশ প্রধান হিসেবে যোগ দিয়েছে গত সপ্তাহে। আজই পেলাম খবরটা।‘ খবরটা শুনে চুপ করে রইল সবাই। শুধু পচা চিৎকার করে উঠলো ,’ দাদু, খেলা জমে যাবে।‘ ঘরভর্তি সবাই হেসে উঠলো হো হো করে।

দেখতে দেখতে নতুন সংস্থার কাজকর্ম শুরু হয়ে প্রায় দেড় বছর কেটে গেল। বেশ কয়েকটা ছোট ছোট সমস্যার দ্রুত সমাধান করে দিলেন পানু রায়। অবশ্যই সুন্দরী এবং জগাই এর সহযোগিতা ছাড়া যে এই কাজগুলো করা যেত না সেকথা বারবার বলেন পানু রায়। ঘটনাচক্রে বেশ কয়েকবার কেলো দারোগার মুখোমুখিও হতে হয়েছে। হেনস্তার একশেষ হয় লোকটা প্রতিবার। মুখে কিছু না বললেও পানু রায়ের ওপর বেশ চটে থাকে সবসময়। কথাবার্তায় আভাসে ইঙ্গিতে বুঝিয়েও দেয়। সুযোগ পেলে সুদে আসলে তুলে নেবার অপেক্ষায় থাকে সবসময়।

সেদিন সকালে অফিসে একটা মোটা আইনের বইয়ে ডুবে ছিলেন পানু রায়।খেয়াল করেননি অনেকক্ষণ ধরে দরজার সামনে অপেক্ষা করছে সুন্দরী। সুন্দরীও ইচ্ছে করেই পানু রায়ের মনঃসংযোগে ব্যাঘাত ঘটাতে চায়নি। বেশ কিছুক্ষণ পরে বই থেকে মুখ তুলে সামনে সুন্দরীকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,’ সুন্দরী, কিছু বলবে?’ সুন্দরী বলল,’ একজন অবিবাহিতা মহিলা যিনি একজন অবিবাহিত পুরুষের সঙ্গে বসবাস করেন তার আইনগত অবস্থান কী?’ পানু রায় ভুরু কুঁচকে বললেন,’ আইনগত কোনও বিশেষ অবস্থান নেই। কিন্তু হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞাসা করছো কেন?’

-কারণ জনৈকা রেবা কৈরালা বাইরে অপেক্ষা করছেন এবং বলছেন তিনি নাকি কৃষ্ণকালীর সঙ্গে থাকেন।

-কৃষ্ণকালী চৌধুরী –মানে যাঁর সম্পত্তির আইনি সমস্যাটা আমরা কিছুদিন আগে মেটালাম? কিন্তু কৃষ্ণকালী অবিবাহিত বলছ কেন?

- আরে না না, ওনার কথা বলছি না। আমি ওনার ছেলের কথা বলছি।

-তাই বলো। আমি ভাবলাম তোমার হঠাৎ মাথার গোলমাল হল নাকি?

-না, মাথা ঠিক আছে। কিন্তু ঐ বাবা আর ছেলের নাম আমি কিছুতেই মনে রাখতে পারিনা। সবসময়ে কেমন যেন গুলিয়ে যায়।

-শোন বাবার নাম কৃষ্ণকালী আর ছেলের নাম কালীকৃষ্ণ। গুলিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক। কৃষ্ণকালী মানে বাবা বিবাহিত এ নিয়ে কোনও সংশয় তোমার নেই নিশ্চয়ই। ছেলে কালীকৃষ্ণ অবিবাহিত। বাবা ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ের সন্ধান করছিলেন বলেই শুনেছি। এখন তো দেখছি গল্প অন্য। যাই হোক তোমার যদি নাম মনে রাখতে অসুবিধে হয় তাহলে বাবাকে বড়কালী আর ছেলেকে ছোটকালী বলে আপাতত চালাও।

-সেটাই সুবিধেজনক হবে। ঠিক আছে।

- সুন্দরী, আমার যতদূর মনে আছে ছোটকালী পুরনো গাড়ির ব্যবসা করে। মাধাই এর সঙ্গে যোগাযোগ আছে বলে জানি। কিন্তু রেবা কৈরালার কী সমস্যা?

-সমস্যাটা রেবা কৈরালার ব্যক্তিগত। ওনার মনে হয় ছোটকালীর সঙ্গে ওনার সম্পর্কের ব্যাপারটা বললে তুমি ওর সমস্যাটা শুনতে আগ্রহী হবে।

-বুঝলাম, কিন্তু সমস্যাটা কী?

-রেবা কৈরালার কাঠমান্ডুতে একটা ক্যাসিনো আছে। আমার মনে হয় সমস্যাটা ক্যাসিনো সংক্রান্ত।

-সুন্দরী, ছাব্বিশের ওপর এক হাজার টাকা বাজি ধর।

হিন্দোশিয়ায় ঘন্টার পর ঘন্টা ক্যাসিনোতে কাটিয়েছে ওরা সবাই। সুন্দরী অদৃশ্য সংখ্যাচাকা ঘুরিয়ে একেবারে ধারে অদৃশ্য রৌপ্যগোলক ছেড়ে দিল। পানু রায় এবং সুন্দরী দু’জনেই ঠিক যেমন সত্যিকারের খেলার সময় সবাই চাকার দিকে তাকিয়ে থাকে তেমনি তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। দেখলে মনে হবে সত্যিই যেন খেলছে ওরা। স্তব্ধতা ভেঙে সুন্দরী বলে উঠল,’ দুঃখিত,দাদু। তিন এ থেমেছে চাকা।‘ পানু রায় হেসে বললেন,’ হতভাগ্য আমি পরাজিতের দলে।‘

-আর রেবা কৈরালা?

- চল, বড়কালীকে ফোন করে জানা যাক এই মহিলার আসল পরিচয়। তার আগে বল মহিলার বয়স কত?

-তেইশ-চব্বিশ হবে?

-ফর্সা না শ্যামবর্ণ?

-ফর্সা

-শঙ্খিনী না পদ্মিনী?

-শঙ্খিনী।

-কটিদেশ?

-ক্ষীণ।

-মুখমন্ডল?

-সত্যিই সুন্দরী! দাদু, তুমি পারোও বটে।

-সুন্দরী, জলে নামার আগে বড়কালীকে স্মরণ করা যাক।

-হ্যালো, কৃষ্ণকালী চৌধুরী আছেন? ওনাকে বলুন আমি সুন্দরী, পানু রায়ের অফিস থেকে বলছি। উনি আমাকে চেনেন। হ্যাঁ,সুন্দরী, পানু রায়ের অফিস থেকে।একটু তাড়াতাড়ি করবেন প্লিস। খুব জরুরি দরকার।

সুন্দরী কিছুক্ষণ ধরে রইল। ইশারায় পানু রায়কে বোঝাল ওদিকে কোনও আওয়াজ নেই। কিছুক্ষণ পরে- কী বললেন, দেশের বাইরে? কোথায় গেছেন? কোন নাম্বারে ওনাকে পাওয়া যেতে পারে?

আবার একটু থেমে- ও আচ্ছা, তাহলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ হলে দয়া করে বলবেন আমাকে ফোন করার জন্য। আমার নাম্বার উনি জানেন। খুব দরকার। অবশ্যই বলবেন প্লিস। অনেক ধন্যবাদ।

ফোন রেখে সুন্দরী বলল,’ এলিনা, বড়কালীর সেক্রেটারি। বড়কালী দেশের বাইরে এবং তার ফোন নাম্বার কাউকে দিতে নিষেধ করেছেন বড়কালী।‘

পানু রায় অবাক হয়ে বললেন,’ এলিনা? মনীষার কী হল? ওহো, মনীষার তো বিয়ে হয়ে গেছে।‘

সুন্দরী বলল,’ অনেকদিন আগে। বছরখানেক তো হবেই।‘

-বল কী? এক বছর হয়ে গেল?

-একটা কফি মেসিন আর একটা ইনডাকশন হিটার দেওয়া হয়েছিল। বিল বার করলেই সঠিক তারিখ পর্যন্ত জানা হয়ে যাবে।

- না না, ওসব বাদ দাও। তার মানে কৃষ্ণকালীর সঙ্গে আমরা কোনও কাজ করিনি ঐ নতুন সেক্রেটারি আসার পর অর্থাৎ এক বছর হয়ে গেল আমাদের কৃষ্ণকালীর সঙ্গে যোগাযোগ নেই।

-মনে হয় আমাদের চুক্তিরও শেষদিন পার হয়ে গেছে। বড়কালী এখন আমাদের ক্লায়েন্ট নয়।

-কী আর করা যাবে? আমার মনে হয় এবার রেবা কৈরালার সঙ্গে কথা বলা যাক। শোনা যাক ওনার কী বলার আছে। ওনাকে ভিতরে নিয়ে এস সুন্দরী।

সুন্দরী উঠে যায় এবং কিছুক্ষণ পরে রেবাকে নিয়ে ফিরে আসে। পানু রায়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, ’রেবাদেবী, ইনিই পানু রায়।‘ রেবা কৈরালা, ফর্সা সুন্দরী আস্তে আস্তে পানু রায়ের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। পানু রায় হাত বাড়িয়ে দেন। পানু রায়ের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলে,’ আমার সৌভাগ্য, মিঃ রায়।‘ রেবা কৈরালার প্রতিটি পদক্ষেপ এতটাই ধীরস্থির যে সহজেই পানু রায় বুঝলেন যে এই মহিলা আপাদমস্তক পেশাদার। তবে কেন জানি পানু রায়ের মনে হল এই মহিলার পা দু’টি শরীরের তুলনায় একটু বেশি লম্বা। তবে তাতে মহিলার সৌন্দর্য বেড়েছে বই কমেনি। পানু রায় চেয়ারের দিকে হাত দেখিয়ে বসতে বললেন রেবাকে।

-আপনার কথা শোনার আগে আপনাকে জানিয়ে রাখি যে আমি প্রায় একবছর আগে কৃষ্ণকালী চৌধুরীকে আইনি পরামর্শ দেবার ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধ ছিলাম। কৃষ্ণকালী একজন প্রখর বুদ্ধিমান ব্যবসায়ী সেইজন্য সম্ভাব্য বিপদ এড়িয়েই উনি সবসময় কাজ করতেন। আইনি পরামর্শ নেবার প্রয়োজন ওনার খুব একটা পড়তো না। যদিও এখন আমরা চুক্তিবদ্ধ নই তবুও ওনাকে সঠিক পরামর্শ দেওয়া এবং সম্ভাব্য বিপদের হাত থেকে ওনাকে রক্ষা করা আমার কর্তব্য বলে মনে করি। সর্বোপরি উনি ব্যক্তিগতভাবে আমার একজন ভালো বন্ধু।

রেবা সোজা হয়ে একটা পায়ের ওপর আর একটা পা তুলে হেলান দিয়ে বসে বলল,’ ঠিক সেই কারণেই আমি আপনার কাছে এসেছি।‘

পানু রায় বললেন,’ আর একটা কথা বলে রাখি আপনাকে যে কোনও ব্যাপারে পরামর্শ দেবার আগে আমি সমস্ত ব্যাপারটা কৃষ্ণকালীকে জানাব এবং আমার কোনও পরামর্শ বা কাজ যে তার বিরুদ্ধে যাবে না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে তবেই কাজে হাত দেব। আশা করি সে ব্যাপারে আপনার কোনও আপত্তি নেই। ‘

-শুধু যে আপত্তি নেই তাই নয় আমি এখানে এসেছি যেহেতু আপনি ওনার আইনি পরামর্শদাতা এবং আমি চাই আপনি ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করুন।

-ঠিক আছে। এই কথাই রইল। এবার বলুন কী বলতে চান।

-নেপালে আমি উত্তরাধিকারসূত্রে একটি সম্পত্তির মালিকানা পেয়েছি।

-কী ধরণের সম্পত্তি?

-একটি ছোট হোটেল এবং ক্যাসিনো।

-নেপালের কয়েকটি ক্যাসিনো সত্যিই বিশাল এবং পৃথিবীবিখ্যাত।

-না না, সেরকম কিছু নয়। এটি আপাতত ছোট কিন্তু যে জায়গায় এটি অবস্থিত সেটি ভীষণ সুন্দর।প্রয়োজনে এটি বাড়াবার জন্য চারিদিকে প্রচুর জায়গা রয়েছে।

-এই সম্পত্তির কতটা অংশ আপনি উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছেন? পুরোটা?

-না। এই সম্পত্তিটি একটি ছোট কোম্পানির। আমার বাবা ঐ কোম্পানির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমার ভাগে চল্লিশ শতাংশ আর বাকি ষাট শতাংশ চারজনের মধ্যে ভাগ হবে।

-আপনার বাবা কবে গত হয়েছেন?

প্রশ্নটা শুনে রেবার মুখটা কঠিন হয়ে উঠলো। রেবা ততোধিক কঠিনভাবেই উত্তর দিল,’ ছ’মাস আগে। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।‘

পানু রায় বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,’ খুন?’

-হ্যাঁ, হয়ত খবরের কাগজে পড়েছেন।

-আপনার বাবা কি প্রসাদ কৈরালা?

-আপনি ঠিক বলেছেন। আমি প্রসাদ কৈরালার একমাত্র সন্তান।

-আমি যতদূর জানি এই হত্যারহস্যের আজও কোনও সমাধান হয়নি।

-মিঃ রায়, কোনও হত্যারহস্যেরই সমাধান নিজে নিজে হয়না।

-দেখুন, এটা যদি আপনার কাছে কোনও অস্বস্তিকর বিষয় হয় তাহলে এই নিয়ে আলোচনার দরকার নেই।

-না না, সেরকম কিছু নয়।জীবনে অনেক কিছুই অস্বস্তিকর ঘটে । আমি আপনার কাছে আসার আগে নিজের অনুভূতি প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েই এসেছি।

-ঠিক আছে। বলুন এই সম্বন্ধে আপনার কী বলার আছে।

-আমার মা মারা যায় যখন আমার বয়স চার বছর। তখনই নাকি শুরু হয় সাতবছরের দুর্ভাগ্যচক্র। অন্তত আমার বাবা তাই বিশ্বাস করত। বাবা সাঙ্ঘাতিকরকম কুসংস্কারাচ্ছন্ন ছিল। আমার মনে হয় সব জুয়াড়িরা ঐরকমই কুসংস্কারাচ্ছন্ন হয়। আস্তে আস্তে বাবা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং আর্থিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে শুরু করে। বাবার হাতে তখন না ছিল কোনও টাকা আর না ছিল কোনও কাজ।বাধ্য হয়ে বাবা একটা বেআইনি শুঁড়িখানায় কাজ শুরু করে। কিছুদিন বাদে ঐ শুঁড়িখানার মালিক মারা যায়। বাবা তখন নিজেই শুঁড়িখানাটা চালাতে থাকে। মালিকটার কোনও ছেলে মেয়ে ছিলনা বা থাকলেও কেউ এসে বাবার কাছ থেকে মালিকানা দাবি করেনি। তারপর অনেকদিন বাদে যখন শুঁড়িখানা আইনসিদ্ধ ব্যবসার অন্তর্গত হল তখন বাবা ওটাকে ছোটখাট সুন্দর একটা হোটেল হিসেবে গড়ে তুলল। আমি বাবার দুর্ভাগ্যের গল্প বলে আপনাদের সময়ের অপচয় করছি না তো?

-একেবারেই নয়। আপনি বলুন।

-বাবা পরবর্তীকালে প্রভূত অর্থের অধিকারী হয়। বাবার জুয়ার নেশা ছিল। সৌভাগ্যক্রমে জুয়া থেকেও বাবা অনেক টাকা রোজগার করে। বাবা যে কেবল বেআইনি ব্যবসার ব্যাপারেই উৎসাহী ছিল তা কিন্তু নয়। তবুও শুঁড়িখানার ব্যবসাটা বাবা চালাতেই থাকল। জুয়া আর টাকা ওড়াবার নেশা ছিল বাবার রক্তে। আর সকলের মত জুয়াড়িদের মধ্যে অনেক ভাল গুণও থাকে।জুয়াড়িরা হেরে গিয়েও নিজেদের আবেগ সংবরণ করতে জানে। সর্বস্বান্ত হয়েও তারা নিজেদের আচরণে কথায় তা প্রকাশিত হতে দেয়না। কিন্তু জুয়াড়িরা তাদের পরিবার পুত্র-কন্যাদের সময় দিতে পারে না কারণ জুয়া খেলা হয় রাত্রে। সুতরাং আমিও আমার বাবাকে খুব একটা কাছে পাইনি। বাবা আমাকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বড় বড় বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করে দিত। জুয়াড়ির মেয়ের পক্ষে বোর্ডিং স্কুলে ঢোকা সহজসাধ্য ছিল না। তাই বাবা শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারী হিসাবে পরিচয় দিত। শেয়ারবাজারের জুয়া খেলা সমাজের চোখে অন্যায় নয় কিন্তু জুয়ার টেবিলে মাঝরাতে জুয়াখেলা সমাজের কাছে একেবারেই গ্রহনযোগ্য নয়। বাবা কোনওদিন আমাকে ছোট বা মাঝারি মাপের বোর্ডিং স্কুলে ভর্তি করতে চাইত না। আর আমার পক্ষেও ঐসব বড়লোকদের নাকউঁচু ছেলে মেয়েদের সঙ্গে ওঠাবসা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ত। তারপর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কী ভাবে কে জানে বাবার আসল পরিচয় জানাজানি হয়ে যেত আর আমাকে স্কুল ছাড়তে হত। আমিও বাবার কিছু গুণ রপ্ত করেছিলাম। আমার মুখচোখে আমার অনুভূতির কোনও প্রকাশ হতনা। বন্ধুত্বের কোনওরকম তোয়াক্কা করতাম না আমি কারণ আমি বড়লোক হবার ভাণ করতে পারতাম না। এমনি করে স্কুলের পড়া শেষ করে আমি নিজে রোজগারের পথ খুঁজতে আরম্ভ করলাম। পেশাদারি মডেলিং এর কাজ করে বেশ কিছু পয়সা উপার্জন হল আমার। ইতিমধ্যে বাবা কাঠমান্ডুতে চলে গিয়ে কয়েকজন মিলে একটা কোম্পানি বানিয়ে একটা সম্পত্তি কিনে সেখানে একটা মাঝারি মাপের হোটেল বানিয়ে আমাকে কাঠমান্ডুতে চলে আসতে বলল। কিন্তু আমি যা ভেবেছিলাম তা হলো না। বাবা সারারাত বাইরে থাকতো। সকালে ফিরে ঘুমিয়ে পড়ত। দুপুর তিনটের সময় ঘুম থেকে উঠতো। আবার সন্ধ্যে হতে না হতেই বেরিয়ে যেত। ইতিমধ্যে সম্পত্তির দাম বাড়তে থাকল। দেখলাম আমাদের হোটেলের পাশের বড় জমিটা কিনল একদল লোক। তারা আমাদের হোটেলটা কিনতে চাইল। শুনলাম ঐ জমিদু’টো একত্র করে ওরা নাকি সুইমিং পুল, নাইট ক্লাব সমেত বিশাল পাঁচতারা হোটেল বানাবে। বাবা বিক্রি করতে রাজি ছিল কিন্তু দামে পোষাচ্ছিল না। খবর পাওয়া গেল যারা জমিটা কিনতে চাইছে তারা প্রভাবশালী সমাজবিরোধী। বাবা তাদের কাছে অনেক দাম চেয়ে বসল। ওরা ক্ষেপে গেল। নানারকম ভাবে বাবাকে ভয় দেখাতে শুরু করল।বাবা ওদের পাত্তা না দিয়ে একটা বিশাল অঙ্কের টাকা চেয়ে চেপে বসে রইল। ওটাই ছিল বাবার দিক থেকে মারাত্মক রকমের ভুল।

পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন’ ওরাই কি আপনার বাবাকে খুন করেছিল?’

রেবা বলল,’ আমি জানিনা।কেউ জানে না। বাবা খুন হয়েছিল এবং তাতে অন্য বিনিয়োগকারী যারা ছিল মানে বাবার পার্টনারেরা ভয় পেয়ে গেল। তারা যে কোনও দামে তাদের অংশ বিক্রী করে দিতে রাজি ছিল। কিন্তু বাবার মৃত্যুতে ঐ লোকগুলোর কোনও লাভ হল না।

-তারপর কী হল?

-আমি উত্তরাধিকারসূত্রে চল্লিশ শতাংশ পেলাম।বাকি ষাট শতাংশ রইল অন্য চারজন পার্টনারের কাছে, প্রত্যেকের পনের শতাংশ। আমার কাছে যখন বাবার মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছলো আমি একেবারে ভেঙে পড়লাম। প্রথম ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই একজন লোক মালিকানা অর্জন করার পদ্ধতি শুরু করে দিল।বাকি চারজনের মধ্যে তিনজন ঐ লোকগুলো যা দাম দেবার প্রস্তাব দিয়েছিল তাতেই রাজি হয়ে গেল। বাবার মৃত্যুর আগে থেকেই আমার কালীকৃষ্ণের সঙ্গে আলাপ ছিল এবং মাঝেমাঝেই আমাদের যোগাযোগ হত।

সুন্দরী জিজ্ঞাসা করল,’ ছোটকালী?’ রেবা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল,’ কিছু বললেন?’ পানু রায় বললেন,’না, না। কিছু নয়। আপনি বলুন।

রেবা বলতে থাকল,’ আমি কালীকৃষ্ণের বাবার মধ্যে বিশেষ কিছু দেখতাম। উনি ঠিক আর পাঁচজনের মত নয়। বাবার মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই উনি আমার সঙ্গে দেখা করে জানতে চাইলেন এই ব্যাপারে আমি কী জানি। আমি যা জানি বললাম। কালীকৃষ্ণের বাবা আমার আগেই আন্দাজ করেছিলেন যে অন্য পার্টনারেরা যা দাম পাবে তাতেই তাদের অংশ বিক্রী করে দেবে। তিনি ঐ অদৃশ্য বিনিয়োগকারীকে হারিয়ে দেবার জন্য বেশি দাম দিতে চাইলেন কিন্তু ততক্ষণে তিনজন অংশীদার তাদের অংশ বিক্রী করে দিয়েছে। কালীকৃষ্ণের বাবা চতুর্থজনের কাছ থেকে পনের শতাংশ কিনে নিলেন। এখন পরিস্থিতি এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। কালীকৃষ্ণের বাবা অর্থাৎ কৃষ্ণকালীবাবুর কাছে পনের শতাংশ এবং আমার কাছে চল্লিশ শতাংশ। এখন নতুন একদল লোক পুরো একশ শতাংশ কেনার চেষ্টা করছে।

পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ আপনি কী করতে চান?’

রেবা বলল,’ আমি বিক্রী করতে চাই। কিন্তু আমি চাইনা এরা বাবাকে খুন করে সস্তায় আমার অংশ কিনে নিক।বাবার জীবন গেছে। আমি চাইনা এই লোকগুলো বাবার মৃত্যুর কোনও সুযোগ নিক এবং লাভবান হোক।‘

পানু রায় জিজ্ঞাসা করলেন,’ আর কিছু বলবেন?’

রেবা বলল,’ হ্যাঁ, আরও একটা বিষয় বলার আছে।‘

-বলুন

-একজন লোক যাকে আমি পাখিবাবু বলে উল্লেখ করব সে এই শহরে আছে। বলা বাহুল্য পাখিবাবু ওনার আসল নাম নয়। আমি জানিনা পাখিবাবু ঐ নতুন দলটার প্রতিনিধি কি না কিন্তু আমি পাখিবাবুকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি। যখন আমি কাঠমান্ডুতে মডেলিং করতাম তখন থেকেই চিনি। আমি এটুকু জানতাম যে বাবার মৃত্যুর পরে পরেই যখন অন্য তিনজন পার্টনার চরম আতঙ্কিত অবস্থায় ছিল তখন একজন লোক নগদ টাকার বিনিময়ে তাদের অংশ লিখিয়ে নিয়ে চলে যায়। তাকে তারপর আর কেউ দেখেনি। আমি কয়েকদিন আগে পর্যন্ত এটাই জানতাম। এখন জানলাম পাখিবাবু ঐ অংশগুলো নিজের নামে সরকারি খাতায় নথিবদ্ধ করতে চায় এবং দু’দিন আগে আমাকে ফোন করে বলে যে সে আমার এবং কৃষ্ণকালীবাবুর অংশ কিনে নিতে আগ্রহী এবং আমাকে কাল রাত্রি ৮-৩০এ তার সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ জানিয়েছে।

-আপনি কী করতে চান?

-আমি কৃষ্ণকালীবাবুর সঙ্গে দেখা করে জানতে চাই তিনি রাজি আছেন কি না। আমি চাই উনি এবং আমি একসঙ্গে বিক্রী করি তা না হলে আমার অংশ আগে কিনে নিলে নিয়ন্ত্রণ পাখিবাবুর হাতে চলে যাবে এবং সে ক্ষেত্রে কৃষ্ণকালীবাবুর অনেক লোকসান হয়ে যাবে। আমি কৃষ্ণকালীবাবুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু উনি দেশের বাইরে।ওনার সেক্রেটারি আমাকে সহ্য করতে পারে না এবং আমাকে কোনওরকম ভাবেই সহযোগিতা করছে না।

-ওনার ছেলে কালীকৃষ্ণ কী বলছে? সে কি জানে তার বাবা কোথায়?

-কালীকৃষ্ণ শহরে নেই। ফোন পাওয়া যাচ্ছে না।

-আমার মনে হয় কৃষ্ণকালী ঐ লোকটার সঙ্গে আপনার দেখা করার ব্যাপারটা পছন্দ করবেন না। উনি সম্ভবত চাইবেন আমি পাখিবাবুর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করি।

-আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার কাছে এটা আমরা বাবার সম্মানের ব্যাপার। আমি সেইখানে শুরু করতে চাই যেখানে আমার বাবা শেষ করে গেছে।

-আপনি চান আপনার বাবার খুনী ধরা পরুক?

-অবশ্যই, এবং সেটাই আপনার কাছে আসার অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ।

- বলুন সে ব্যাপারে যা যা বলতে চান।

-আপনি আমার চেয়ে ভাল জানেন যে এই ধরণের জমিজমাসংক্রান্ত খুনখারাপির ব্যাপারে পুলিশ অনেক বড় বড় কথা বলে। সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে এই শহরের শান্তিরক্ষাকারীরা যে এইসব গন্ডগোল একদম সহ্য করবে না সে কথা সকলকে জানায় এবং প্রতিশ্রুতি দেয় যে কয়েকদিনের মধ্যেই খুনের তদন্তের নিষ্পত্তি হবে এবং খুনী উপযুক্ত শাস্তি পাবে। কিন্তু আজ অবধি আমি একটাও খুনের তদন্ত শেষ হতে দেখিনি । একবার শুধু হয়েছিল যেখানে একটা ভুল লোককে খুনী বলে ধরে আনা হয়েছিল।

- তাহলে আপনি আমার কাছ থেকে কী চান?

-আমার অংশীদারত্ব বিক্রীর কাজটা শেষ হলে আমি চাই আপনি আমার বাবার খুনে ব্যাপারটা দেখুন। আমি চাই আপনি কিছু সূত্র বের করে সেটা পুলিশের হাতে দিন যাতে বাকি কাজটা তারা করতে পারে। সূত্রের সন্ধান এবং ব্যাখ্যা করার কাজটা পুলিশের দ্বারা হবে না। ওটা যদি দয়া করে আপনি করেন।

-গোয়েন্দা এবং পুলিশের মধ্যে সমন্বয়সাধনের জন্য একজন আইনি পরামর্শদাতার কোনও প্রয়োজন নেই। পুলিশ যাতে খুনের তদন্তের নিষ্পত্তি করতে পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্য আমাকে নিয়োগ করার কোনও প্রয়োজন নেই।

-কিন্তু পুলিশ নিজে নিজে আজ অবধি কী করতে পেরেছে?

-আমি জানি না।

-কেউ জানে না।

-আপনি কি মনে করেন যে আপনার পরিচিত এই পাখিবাবু আপনার বাবার খুনের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে?

-থাকতেই পারে এবং তার সম্ভাবনা প্রবল।

-সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় আপনি নিজে কথা না বলে কৃষ্ণকালীকে এ ব্যাপারে কথা বলতে দিন।

-আপনি হয়ত জানেন না যখন কৃষ্ণকালীবাবু ওনার পনের শতাংশ কেনেন তখন ভেবেছিলেন আমি ওনার পুত্রবধূ হব এবং আমাদের বিবাহের উপহার হিসাবে এই পনের শতাংশ উনি আমাকে দেবেন। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পালটে গেছে।

-আপনার সঙ্গে আমি কী করে যোগাযোগ করতে পারব?

-আপনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন না। আমি আপনার সঙ্গে কাল সকাল দশটায় যোগাযোগ করতে পারি?

পানু রায় একবার সুন্দরীর দিকে তাকালেন। বললেন,’ ঠিক আছে। কাল সকাল দশটায়।‘

রেবা সুন্দরীকে জিজ্ঞাসা করল,’আমি কি পিছনে বেরোবার দরজা দিয়ে বেরুবো?’

পানু রায় বললেন, ‘হ্যাঁ’। রেবা দরজা খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে পানু রায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,’ কাল কথা হবে। এরমধ্যে দয়া করে যদি কৃষ্ণকালীবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন তাহলে ভীষণ উপকার হয়।‘রেবা কৈরালা বেরিয়ে গেল।দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

পানু রায় বললেন,’ সুন্দরী, আমার মনে হয় না এই মহিলার সঙ্গে জুয়া খেলা ঠিক হবে।‘

সুন্দরী মুচকি হেসে বলল,’দাদু, এতক্ষণ কী খেলছিলে তাহলে?’

পানু রায় বললেন,’ জানি না। আমার মনে হয় এখন আমার বড়কালীর নতুন সেক্রেটারির কাছে যাওয়া উচিৎ। দেখি কোনও নতুন খবর পাওয়া যায় কি না?

সুন্দরী বলল,’ দাদু, রেবা যদি নিজের অংশ বিক্রী করে দেয় এবং তাতে যদি বড়কালী রাজি হয়ে যায় তাহলে কি তুমি ঐ খুনের ব্যাপারটায় মধ্যস্থতা করতে রাজি হবে?

-আমি জানি না, সুন্দরী। সবটাই নির্ভর করবে পরিস্থিতির ওপর। তবে আমার মনে হয়না সে ব্যাপারে আমাকে ওর খুব একটা দরকার লাগবে।

-দাদু, আমার কিন্তু ব্যাপারটা সুবিধের মনে হচ্ছে না। আমার কেমন যেন বারবার মনে হচ্ছে এই ব্যাপারটায় তোমার না জড়ানোই ভাল।

পানু রায় হেসে বললেন,’ এখনই এত দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। আপাতত এলিনা রাইএর সঙ্গে দেখা করে নতুন কিছু জানতে পারি কি না দেখি। তারপর অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।‘
0

গল্প - গান্ধর্বিকা ভট্টাচার্য

Posted in




















“মা!মা!”

গলার আওয়াজ না মেলাতেই হৈমন্তী মালিনীর ঘরে ঢুকে পড়ল। তারপর গটগট করে হেঁটে গিয়ে জানলার পর্দা সরিয়ে দিল।

“কি ফার্স্ট ক্লাস রোদ উঠেছে দেখ!”

মালিনী চশমা ছাড়াই বাইরের নীল আকাশ আর বরফের পাহাড়ের অবয়ব দেখতে পেল।

“আজ আমরা রিচুয়ালটা সেরে ফেলি? আবার কবে এরকম ওয়েদার পাব কে জানে?”

মালিনী বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর মাঝে নাকের ওপরটা চেপে ধরল। এত সকাল সকাল ওর চিন্তা করতে কষ্ট হয়।

“কারা কারা আছেন এখন?”

হৈমন্তী গড়গড় করে বলে গেল,

“এভারেস্টে সোনিয়া চৌধুরী আছেন, কাল চেক আউট করবেন। তিস্তায় অভিষেক ব্যানার্জি আর ওনার ওয়াইফ – অনুজা। মংপু আর রডোডেনড্রন খালি আছে। কাঞ্চনজঙ্ঘায় মিস্টার শ্রীনিবাসন উঠেছেন।”

“ওই পেইন্টার ভদ্রলোক? এসে গেছেন?”

“হ্যাঁ, কাল চেক ইন করেছেন। তোমাকে বললাম তো!”

মালিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এতদিন অবধি সে-ই কৃষ্ণচূড়া লজের সব ব্যবস্থাপনা করে এসেছে, কোনদিন একটা ছোট ভুলও হয়নি, কিন্তু আজকাল সবকিছুর কেমন খেই হারিয়ে যাচ্ছে। যেন বহুবার বাজিয়ে তানপুরার তার ক্ষয়ে গেছে।

“ঠিক আছে, আজকেই করে ফেলা যাক,” বলে মালিনী বিছানা থেকে উঠে পড়ল। “পেমাকে বল আমাকে এক কাপ চা দিয়ে যেতে। আর আজ আমি ঘরেই ব্রেকফাস্ট করব।”

“কেন মা?” হৈমন্তী ভুরু কুঁচকে এগিয়ে এল, “তোমার শরীর ভালো নেই?”

“না সেরকম কিছু নয়। বয়স হচ্ছে তো।”

হৈমন্তী আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

কৃষ্ণচূড়া লজের বেডরুমগুলো দোতলায়, লবি আর খাবার ঘর এক তলায়। মেনু নির্দিষ্ট থাকলেও, আগে থেকে বলে রাখলে অতিথিদের পছন্দের খাবারও তৈরী করা হয়। আগে মালিনী নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তদারকি করত। এখন সেই ভারটা হৈমন্তী নিয়েছে। গেস্টদের ব্রেকফাস্ট শেষ হয়ে এলে হৈমন্তী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।

“অনেকদিন পরে এত সুন্দর রোদ উঠেছে। তাই আজ আমরা এই কৃষ্ণচূড়া লজের একটা ট্রাডিশন সেরে ফেলব।”

অতিথিরা সন্তর্পণে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। কৃষ্ণচূড়া লজের ট্রাডিশন? কি করতে বলবে রে বাবা?

“বাইরের যে কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখেছেন, যার নামে আমাদের এই লজের নাম, ওর নীচে আমরা গেস্টদের সঙ্গে একদিন পিকনিক করি,” হৈমন্তী মিষ্টি হেসে বলল। “আজ যেহেতু রোদ আছে, চলুন ওখানেই চা-কফি আর আড্ডা হয়ে যাক।”

ঘরের মধ্যে আটকে থাকা নিঃশ্বাস এবার ছাড়া পেল।

“হ্যাঁ হ্যাঁ, এতো দারুণ প্রস্তাব,” অভিষেক সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। “আউটডোর যখন, আশা করি স্মোকিং এ কারুর আপত্তি নেই।”

সোনিয়াকে দেখে মনে হল তার ধূমপানে যথেষ্ট আপত্তি আছে, কিন্তু গণতন্ত্রে সংখ্যালঘুর কথা কে-ই বা শুনেছে? সবাই মিলে হইহই করে গাছের দিকে রওনা দিল।

কৃষ্ণচূড়া গাছটা লজের ডানদিকে অনেকটা জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ঘিরে একটা কাঠের টেবিল আর বেঞ্চ। নীচে পাহাড়ের ঢালে পাইনের বন, আর আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘা ঝকঝক করে। সবাই বেঞ্চের ওপর পছন্দসই জায়গা বেছে বসে পড়ল। একটু পরে মালিনীও এসে সবার সঙ্গে যোগ দিল।

“এই হাইটে সাধারণত কৃষ্ণচূড়া গাছ দেখতে পাওয়া যায় না, তাই না?” অনুজা মালিনীকে জিজ্ঞেস করল।

মালিনী ক্লান্ত হাসি হাসল। প্রায় প্রত্যেকটা পিকনিকে এই কথাটা ওঠে। উত্তরটা মালিনীর মুখস্থ হয়ে গেছে।

“একদম ঠিক। আশেপাশে তাকিয়ে দেখুন, শুধু দেবদারু আর রডোডেন্ড্রনের জঙ্গল। আসলে আমার স্বামীকে একজন এই গাছের একটা ডাল গিফট করেছিলেন। আমার স্বামীও এমনিই, প্রায় অবহেলা করেই ডালটা পুঁতে দিয়েছিলেন। সবাই ভেবেছিল, দু'দিন পরে হয়তো আপনেই মরে যাবে। ওমা, কিছুদিন পরে দেখা গেল ডালটা একটু বড় হয়েছে। আমাদের কিন্তু এতে কোন কৃতিত্ব ছিল না! না গোড়ায় জল দিয়েছি, না পাখির হাত থেকে বাঁচিয়েছি, না কিছু। শুধু শুধু, বিনা যত্নেই গাছটা বড় হতে লাগল। এই এত বড় হয়েছে। কিন্তু মজার কথা হল, আজ অবধি একটাও ফুল ফোটেনি।”

“সেকি? ফুল ফুটল না কেন?”

মালিনী কাঁধ ঝাঁকাল।

“সেটা একটা রহস্য। আমার মনে হয়, হয়তো এখানকার জল হাওয়ার কারণে।”

“দ্যাট ইজ সো ইন্টারেস্টিং!” সোনিয়া সাদা লোমের শালটা ভালো করে জড়িয়ে নিল। এমনিতে তেমন ঠান্ডা না থাকলেও গাছের তলায় বেশ একটা হিমেল ভাব আছে। “ভেরি মিস্টিরিয়াস!”

“চা, না কফি, কোনটা আনাব?” হৈমন্তী কৃষ্ণচূড়ার ইতিকথায় যতি টানল।

“দার্জিলিংএর এত কাছে এসে কফি কে খাবে?” অনুজা নাক কুঁচকে বলল, “আমার জন্য দার্জিলিং টি! নো মিল্ক, নো সুগার।”

বাকিরাও চায়েই সম্মতি দিল। হৈমন্তী লজের দিকে রওনা দিল।

“বাই দ্য ওয়ে, আজ আমাদের মধ্যে একজন সেলেব্রিটি উপস্থিত আছেন,” মালিনী শ্রীনিবাসনের দিকে নির্দেশ করলেন, “ইনি স্বনামধন্য চিত্রকর মিস্টার এম শ্রীনিবাসন!”

“ও মা!” অনুজা হাঁ হয়ে গেছে। “আমি কাল থেকে ভাবছি আপনাকে কেন চেনা চেনা লাগছে!”

“আমি দেখেই চিনতে পেরেছিলাম,” সোনিয়া হাসতে হাসতে বলল, “কিন্তু বুঝতে পারিনি আপনি পরিচয় দিতে চান কি না।”

“এখন যখন পরিচয় হয়েই গেল, আপনি আমাদের জন্য কিছু আঁকুন না!” অভিষেক সিগারেটে একটা লম্বা টান দিল।

অনুজা ওর হাঁটুতে হাল্কা করে চাপড় মারল।

“ওরকমভাবে বলে দিলেই কি এঁকে ফেলা যায় নাকি? আর্টিস্টের মনের ভেতর থেকে সাড়া আসতে হবে। তাই না, শ্রীনিবাসন বাবু?”

“আমি শুনেছি, একজন বড় অভিনেত্রী অনেকবার শ্রীনিবাসন বাবুকে তাঁর বরের ছবি আঁকতে অনুরোধ করেছিলেন,” সোনিয়া জুতো খুলে বেঞ্চে পা মুড়ে বসল। “কিন্তু শ্রীনিবাসন বাবু কিছুতেই রাজি হন নি।”

“কেন?” অভিষেক ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল। “টার্মসে পোষায় নি?”

শ্রীনিবাসন মৃদু হাসল।

“উনি যেমন ছবি চেয়েছিলেন, তেমন আঁকা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।“”

অনুজার চোখ গোল হয়ে গেল। “কোন কুরুচিকর ছবি?”

“নো নো,” শ্রীনিবাসন মাথা নাড়ল, “সেরকম না। উনি ছবিতে ওঁর বরের চোখে ওঁর প্রতি যে ভালোবাসা দেখতে চেয়েছিলেন, আমি সেটা দেখতে পাইনি। ওঁর স্বামী সেই ভালোবাসা অন্য কোথাও খুঁজছিলেন। সেরকম ছবি আঁকলে উনি খুশী হতেন না।”

“তার মানে, আপনি আঁকার মাধ্যমে মানুষের সত্যিটা বের করে আনেন?”

“…সেরকম কিছু বলতে পারেন।”

“নাউ কাম অন, শ্রীনিবাসন বাবু,” অভিষেক সিগারেটটা বুটের নীচে থেঁতলে দিল। “এবার আমার প্রচণ্ড আগ্রহ হচ্ছে। আপনাকে আমাদের ছবি আঁকতেই হবে! আমি দেখতে চাই আপনি আমাদের মধ্যে কি দেখতে পাচ্ছেন।”

হৈমন্তী ফিরে এসেছে। সে-ও অভিষেকের সঙ্গে গলা মেলাল।

“হ্যাঁ, প্লিজ! একটা ছবি আপনাকে আঁকতেই হবে! আমরা খুব সম্মানিত হব। ছবিটা বাঁধিয়ে লবিতে রেখে দেব!”

“ওকে, ওকে!” শ্রীনিবাসন হেসে উঠল। “আমি চেষ্টা করছি। কিন্তু দুটো কথা আমি আগে থেকে বলে রাখছি। সাবধান বাণীও বলতে পারেন। এক, আমি যে সত্যটা দেখতে পাচ্ছি শুধু সেটাই আঁকব। আর দুই, ছবিটা আঁকার পর আমাদের মধ্যে থেকে কোন একজন হারিয়ে যাবেন।”

গাছের নীচে যেন মুহূর্তে বিদ্যুৎ খেলে গেল। সবাই সোজা হয়ে বসল। সোনিয়া একটু শিউরে উঠল।

“হারিয়ে যাব, মানে?”

“হারিয়ে যাব মানে লস্ট,” অভিষেক অস্বস্তি ঢাকার জন্য হেসে উঠল। “খুঁজে পাওয়া যাবে না।”

“লস্ট মানে আমি জানি,” সোনিয়া ঠান্ডা চোখে অভিষেক দিকে তাকাল। “কিন্তু হারিয়ে যাওয়া মানে তন্ময় হয়ে যাওয়া, বা নিজেকে ভুলে যাওয়াও তো হয়। এক্ষেত্রে উনি কোনটা বলছেন তাই জানতে চাইছিলাম।”

শ্রীনিবাসনের হাসি মুছে গেল, “সেটা যে হারিয়ে যাবে, সে বুঝতে পারবে। অন্য কেউ বুঝবে না।”

অভিষেক, অনুজা আর সোনিয়া পরস্পরের দিকে তাকাতে লাগল। মালিনী অন্যমনস্ক। যেন কোন কথা শুনতেই পায়নি।

“সাউন্ডস লাইক ফান,” হৈমন্তী হাততালি দিয়ে উঠল। “আপনাকে কোন আঁকার সরঞ্জাম দিতে হবে?”

“একটা কাগজ আর পেনসিল হলেই চলবে।”

কয়েক মিনিটের মধ্যেই সরঞ্জাম যোগাড় হয়ে গেল। সেই সঙ্গে চা-ও এসে গেল। শ্রীনিবাসন কাজে লেগে গেল।

“আমাদের কি পোজ দিয়ে বসতে হবে?” অভিষেক পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করতে করতে জিজ্ঞেস করল।

“না, আপনারা যেমন খুশী থাকুন। আমার যা দেখার ছিল, দেখা হয়ে গেছে।”

“অলরাইট দেন।”

অভিষেক চায়ের কাপ হাতে খাদের দিকে এগিয়ে গেল। সামনে গভীর, নীল আকাশ - যেন কোন দূর অতীতে রঙ করা হয়েছিল। সেই রঙ আর বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। পাহাড়ের টাটকা হাওয়া। চোখ ঝলসানো বরফের পাহাড়।

“কি সুন্দর, না?”

অভিষেক খেয়ালই করেনি কখন অনুজা ওর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

“হুঁ।”

“আচ্ছা, ওই অভিনেত্রীর মতো যদি আমিও তোমার ছবি আঁকতে বলি, তাহলে তোমার চোখে উনি কি দেখবেন?”

“শ্রীনিবাসন?” অভিষেক আবার সিগারেট ধরাল, “ওর কথায় তুমি বিশ্বাস কর নাকি? মানুষের ভেতরের সত্যিটা টেনে বের করে আনে…ওসব গিমিক শুধু। কারুর সত্যিটা জেনে ফেলা অত সোজা নয়।”

“তবু যদি তর্কের খাতিরে বলি-”

অভিষেক জঙ্গলের দিকে ঘুরে দাঁড়াল।

“ওসব বোকা বোকা তর্কের কোন মানে হয় না।”

অনুজা আনমনে চায়ের কাপটা দু'হাতের পাতায় জড়িয়ে ধরল - যেন ধোঁয়া হয়ে পালিয়ে যাওয়া উত্তাপটুকু ধরে রাখতে চাইছে। সোনিয়া একটা কাঠের গুঁড়ির ওপর বসে আছে। হৈমন্তী গিয়ে ওর পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল।

“প্রথম সোলো ট্রিপ কেমন লাগছে?”

সোনিয়া হেসে উঠল।

“আপনারা ওয়েবসাইট পড়েন? আমি তো ভাবলাম বোধহয় ওগুলো স্ট্যান্ডার্ড ফিল আপ করতে হয়!”

“না, না। আমরা গেস্টদের সব অনুরোধ খুব মন দিয়ে পড়ি, এবং যতদূর সম্ভব ব্যবস্থা করার চেষ্টা করি। আমার মা তো প্রত্যেক গেস্টের রুচি অনুযায়ী ঘর আর ভিউও ঠিক করে। যেমন, আপনি নিরিবিলি আর শান্তি চেয়েছিলেন বলে কোণার ঘরটা আপনার জন্য রেখেছিলাম।”

সোনিয়ার হাসিতে অপরাধবোধের ছায়া পড়ল।

“বর, বাচ্চা, চাকরি, সব সামলে নাস্তানাবুদ হয়ে যাচ্ছিলাম। তাই আমার বর বলল, একটা সোলো ট্রিপ করে এস।”

“একদম ঠিক করেছেন।”

সোনিয়া চার ধারে নজর ঘোরাল।

“এই লজটা আপনি আর আপনার মা চালান?”

হৈমন্তী কাঁধ ঝাঁকাল।

“এই মুহূর্তে তাই। আসলে এটা আমার ঠাকুরদার বাড়ি। মা যখন বিয়ে করে এল, তখন ঠিক করল বাড়িটা মেরামত করে একটা গেস্ট হাউস বানাবে। একদম ঘরোয়া ব্যবস্থা। বাড়ির একদিকে আমরা থাকব, আর অন্য দিকে কয়েকজন গেস্ট। ওই সময়ে কিন্তু হোমস্টের আইডিয়াটাই ছিল না! মা আর বাবা মিলে একটা নতুন জিনিস শুরু করল। তারপর আমার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন বাবা মারা যায়। সেই থেকে মা একাই বিজনেস চালিয়েছে। ইদানিং আমি আর আমার বরও জয়েন করেছি। ও এখন একটা কাজে কোলকাতা গেছে। আপনি আর ক'দিন থাকলে আলাপ করাতাম।”

“এরকম নির্জন একটা জায়গায় আপনারা দু'জন শুধু থাকতেন? ভয় করত না?”

“দু'জন না। আমি দার্জিলিঙে হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেছি। তারপর দিল্লিতে। মা একাই থাকত। কিন্তু বাহাদুর, পেমা, তেনজিং – ওরা সবাই মায়ের বিশ্বস্ত। বাবাকেও এখানে সবাই খুব ভালোবাসত। যদি বিজনেসের কথা বলেন তাহলে মা একাই পুরোটা দাঁড় করিয়েছে। আমি গল্প শুনেছি, যে বাবা যখন মারা গেছে সেই মাসেও কুক থেকে মালী, একজনেরও মাইনে বাদ পড়েনি।”

“আমাদের আর্টিস্ট বাবু কি করছেন?” অভিষেকের গলা ভেসে এল। “কিছু আঁকতে পারছেন, নাকি রণে ভঙ্গ দিয়েছেন?”

সবার দৃষ্টি কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে চলে গেল। কিন্তু শ্রীনিবাসন কই? বেঞ্চ খালি। শুধু টেবিলের ওপর কাগজটা পাথর চাপা দেওয়া রয়েছে। আবার সেই নৈঃশব্দ্য নেমে এল। অবিশ্বাস সত্বেও সবাই ভয়ে ভয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখল, কেউ নিখোঁজ হয়ে গেল কি না। না, গুনতি ঠিক আছে। অভিষেক গলা খাঁকারি দিয়ে এগিয়ে গিয়ে পাথর সরিয়ে কাগজটা তুলে নিল। তারপর হোহো করে হেসে উঠল।

“আচ্ছা বুর্বক বানালো লোকটা…হেঃ হেঃ হেঃ!”

সাহস পেয়ে বাকিরাও টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল।

***

দুপুরে সবাই লাঞ্চ খেতে গেলে মালিনী দু'হাতে কাগজটা তুলে নিল। যে কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় সবাই বসে চা খাচ্ছিল শ্রীনিবাসন সেই গাছটার ছবি এঁকেছে। শুধু নীচের টেবিল আর বেঞ্চটা নেই। তার বদলে আছে ফুল – গাছটার ডালে ডালে ফুলের ছড়াছড়ি। নীচেও গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল পড়ে আছে।

পাহাড়ের দিক থেকে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া ছুটে এসে মালিনীর চোখ বন্ধ করে দিল। এক মুহূর্তর জন্য। চোখ খুলে সে চমকে উঠল।

আকাশে আগুন লেগে গেছে!

না, আগুন নয়। সারি সারি কৃষ্ণচূড়া গাছের বন। লাল শিখার চেয়েও উজ্জ্বল, জ্বলন্ত, অশান্ত…ঠান্ডা হাওয়ায় দোল খাচ্ছে, তারপর তুমুল আবেগে ডাল থেকে ছিঁড়ে মাটিতে পড়ে স্তূপাকার হচ্ছে। কোথায় এই কৃষ্ণচূড়ার বন? এ তো আজকের নয়…কত যুগ, কত শতাব্দী আগের গাছ এরা? যেন চিরকাল পৃথিবীর বুকে এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।

মালিনী দেখতে পেল কৃষ্ণচূড়ার বন পেরিয়ে দূরে কেউ যেন দাঁড়িয়ে আছে, তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মালিনী সেদিকে এগিয়ে গেল।

“শ্রীনিবাসন?”

শ্রীনিবাসন উত্তরে শুধুই মুচকি হাসল।

“আপনি জানতেন, আমিই এই ছবির ভেতর হারিয়ে যাব?”

শ্রীনিবাসন মাথা নেড়ে 'না' বলল।

“আমার ছবি শুধু একটা আমন্ত্রণ। কে সাড়া দেবে আমি নিজেও জানিনা। কিন্তু যখন আমার ভেতর থেকে আমন্ত্রণ আসে, আমি জানি কেউ না কেউ সাড়া দেবেই।”

গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে হাওয়ার শব্দ ভেসে আসছে। গভীর, আরো গভীর…সমুদ্রের গর্জনের মতো…

“অন্য কোথাও গিয়ে বসা যাক?”

“নিশ্চয়ই,” শ্রীনিবাসন মাথার পেছন চুলকে বললেন, “কিন্তু কোনদিকে যাব?”

“মানে? এটা আপনার বাগান নয়?”

“একেবারেই না। আমি শুধু আসার পথটা তৈরী করেছি। বাগানটা সম্পূর্ণ আপনার,” শ্রীনিবাসন এদিক ওদিক তাকাল, “আপনি তো আগেও এই বাগানে এসেছেন।”

মাথার ভেতরের এক অন্ধকার কোণায় উড়তে থাকা প্রজাপতির মতো অনুভূতিটা এতক্ষণে মালিনী চিনতে পারল। সত্যিই তো! এই বাগানে তো সে আগেও এসেছে। ওই তো, ওই রাস্তাটা দিয়ে কিছুদূর গেলেই ফুলের বাগান। কিন্তু তখন তো কৃষ্ণচূড়া গাছের সারি ছিল না।

শেষ কবে সে এই বাগানে এসেছিল?

বিস্মৃতির পর্দা ঠেলে একটা ছবি ভেসে উঠল।

“তুমি চলে গেছ বলে হৈমন্তী আর আগের মতো হাসে না, কথা বলে না। তোমার মা পাপাইয়ের বাড়ি থাকতে চলে যাচ্ছেন। আমি কাউকে খুশী করতে পারছি না…”

চোখের জলের মতো ঝরে পড়া ফুলের বনকে পেছনে ফেলে মালিনী এগিয়ে চলল। সমুদ্রের গর্জন বন্ধ হয়ে হাওয়া শান্ত হয়ে এল। বাগানের এই দিকটা মালিনীর সবচেয়ে প্রিয়। দুই ধারে গুচ্ছ গুচ্ছ লাল গোলাপ ফুটে আছে। তার সঙ্গে আছে হলুদ গাঁদা, সাদা জুঁইফুল, চন্দ্রমল্লিকা…দূর থেকে জলের শব্দ আসছে। মালিনী জানে, ওখানে একটা শ্বেত পাথরের ফোয়ারা আছে, আর একটা বসার জায়গা।

“আপনি অনেক দায়িত্ব নিয়েছেন…”

শ্রীনিবাসনের কথায় মালিনী চোখের তারায় প্রশ্ন এঁকে ঘুরে তাকাল।

“আপনার স্বামী মারা যাওয়ার পরে হৈমন্তীর দায়িত্ব, সংসারের দায়িত্ব, কৃষ্ণচূড়া লজের দায়িত্ব – সবকিছু আপনার ওপর এসে পড়েছিল। শক্ত থাকা ছাড়া আপনার কোন উপায় ছিল না। তাই একমাত্র এই বাগানে এসে আপনি নিজের দুঃখ উজাড় করে দিতে পেরেছিলেন। একমাত্র এখানেই, যখন আপনি সম্পূর্ণ একা ছিলেন।”

মালিনী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাথরের সীটে বসে পড়ল।

“আমার স্বামী…রজত…ও তখন সবে চলে গেছে। আমাদের জীবনের সব থেকে দুঃখের সময় ছিল সেটা। সেই শেষবারের মতো এই বাগানে এসেছিলাম।”

“উনি খুব স্পেশাল মানুষ ছিলেন?” শ্রীনিবাসনও বসে পড়ল।

“ওর মতো মানুষ আমি দেখিনি। ওর কাছে সাহায্য চাইতে এসে কেউ খালি হাতে ফিরে যায়নি। কত লোককে যে টাকা ধার দিয়েছে…আমরা যখন কৃষ্ণচূড়া লজ খুললাম, যে চাকরি চাইতে এসেছে ও তাকেই কাজে রেখেছে। এতজনের মাইনে দিতে টানাটানি হবে জেনেও। অনেকে ওর এই স্বভাবের সুযোগও নিয়েছে। আমি ওকে বলতাম, এই যে তুমি অমুককে এত টাকা ধার দিচ্ছ, ও কিন্তু জীবনে ফেরত দেবে না। রজত বলত, না দিক। ওর কাজটা তো হয়ে যাবে। রজত বোকা ছিল না, ও জানত পৃথিবীতে সৎ, অসৎ, দু'রকম মানুষই আছে। তা জেনেও, মানুষের মনের অন্ধকার দিকটা বুঝেও, ও সকলের উপকার করত।”

শ্রীনিবাসন অল্প হাসল।

“সত্যি অসাধারণ মানুষ ছিলেন।”

মালিনী মুহূর্তের জন্য চুপ করে রইল।

“আমি সময় থাকতে সেকথা বুঝতে পারিনি। রজতের স্বভাবের জন্য দিন দিন ওর সঙ্গে সংসার করা আমার পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠছিল। শেষে…” মালিনী ঢোঁক গিলল, “শেষে আমি ভাবতে শুরু করলাম, যদি কৃষ্ণচূড়া লজের দায়িত্ব আমি একা সামলাই তাহলে কত বেশী টাকা বাঁচবে, আমরা কত ভালোভাবে থাকব, হৈমন্তী কত ভালো স্কুলে পড়তে পারবে…রজত যেদিন চলে গেল সেদিনও এই কথাই ভেবেছি…”

মালিনী শ্রীনিবাসনের দিকে তাকাল, যেন ভর্ৎসনা শোনার আশায়। কিন্তু শ্রীনিবাসন কিছু না বলে মালিনীর দিকে তাকিয়ে রইল।

“সেদিন আমরা সবজি কিনতে বেরিয়েছিলাম,” মালিনী একটু থেমে আবার বলতে শুরু করল। “কাছাকাছি একটা বাজার বসে, তাই পায়ে হেঁটেই গেছিলাম। ফেরার সময়ে একটা গাড়ি ব্রেক ফেল করে সোজা আমার দিকে ছুটে এল। ভয়ে বা বিস্ময়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। পা অচল হয়ে গেল। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম গাড়িটা আমার দিকে ছুটে আসছে।” বরফ হয়ে জমে থাকা কান্নার একটা ফোঁটা মালিনীর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। “যখন সম্বিৎ ফিরল, দেখলাম আমি রাস্তার এক ধারে পড়ে আছি। আর রজতের রক্তাক্ত শরীর রাস্তায় লুটোচ্ছে। আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার আগে, আমাকে বাঁচানোর আগে রজত একবারও নিজের জীবনের কথা ভাবেনি!”

মালিনী আকাশের দিকে তাকাল। আকাশটা যেন দিন দিন আরো দূর হয়ে ওর নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।

“অন্যের জীবন চুরি করে বেঁচে থাকার গ্লানি – এ এক ভয়ংকর বোঝা। সারা জীবন ধরে এই বোঝা টেনে টেনে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। এখন আমার সকালে চোখ খুলতেও ইচ্ছে করে না। জানেন, সেদিন যদি রজতের বদলে আমি মরে যেতাম, রজতের জীবনের গতি পালটাত না। কারণ ও শুধু দিতেই শিখেছিল, কারুর থেকে নিতে শেখেনি। তাই ওর নিজের মতো করে বাঁচার জন্য সেভাবে কাউকে প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু আমরা যারা ওর থেকে নিতে অভ্যস্ত ছিলাম – প্রতিদিন, খেয়ালও না করে নিয়েই যেতাম, আমাদের জীবন ওকে ছাড়া চৌচির হয়ে গেল। আমি যদি রজতের জীবন চুরি করে না নিতাম, সেদিন যদি রজতের বদলে আমি মরে যেতাম – তাহলে? এই প্রশ্নটা আমি সবার চোখে দেখেছি। এমনকি হৈমন্তীরও…”

মালিনী কথাটা শেষ করল না। হয়তো শেষ করার মতো কোন কথা বাকি ছিল না। কোথাও একটা পাখি একটানা ডেকে চলেছে। গোলাপ ফুলের ওপর একটা ভ্রমর ঘুরপাক খাচ্ছে। মালিনী দু'হাতে নিজের রগ টিপে ধরল।

শ্রীনিবাসন মৃদু গলা খাঁকারি দিল।

“কিন্তু সেদিন আপনাকে না বাঁচাতে পারলে আপনার স্বামী কি নিজেকে ক্ষমা করতে পারতেন? তিনি কি সারা জীবন অপরাধবোধে ভুগতেন না?”

“সেটাই হওয়া উচিৎ ছিল। রজতের বদলে বেঁচে থাকার জন্য আমি মনে মনে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে চেয়ে ক্লান্ত হয়ে গেছি, এমনকি রজতের কাছেও। কিন্তু ক্ষমা আমার কপালেই নেই। আমি যে এতবার ভেবেছি – কোনভাবে যদি কৃষ্ণচূড়া লজের দায়িত্ব আমার একার হাতে চলে আসে – সেটা কি রজতের মৃত্যু কামনা করাই ছিল না? তারপর রজতের মৃত্যুতে আমি কোন অধিকারে ক্ষমা চাইতাম, বা চোখের জল ফেলতাম? সেটা কি শঠতা ছাড়া কিছু নয়?”

“তাই আপনি মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে শুধু নিজের কর্তব্য করে গেছেন। কৃষ্ণচূড়া লজ দাঁড় করিয়েছেন, মেয়েকে ভালো স্কুল কলেজে পড়িয়েছেন, বিয়ে দিয়েছেন, শাশুড়ীকে নিয়মিত টাকা পাঠিয়েছেন – নিজের সবটুকু দিয়ে আপনার স্বামীর অভাব পূরণ করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কেউ দেখেনি আপনি সেটা করতে গিয়ে নিজের ওপর কতটা অত্যাচার করেছেন – সম্ভবত আপনি নিজেও বোঝেননি…যে আপনি ক্লান্ত, খুব ক্লান্ত।”

শ্রীনিবাসনের কথাগুলো তুলোর মতো মালিনীকে জড়িয়ে নিতে লাগল। মালিনী ঢুলে পড়ল। যেন কতদিনের জমা ক্লান্তি ওকে ঘিরে ধরেছে। আর এক মিনিটও চোখ খুলে রাখতে পারছে না।

“আমি যা করেছি সেটা আমার ন্যায্য প্রায়শ্চিত্ত।”

“প্রায়শ্চিত্তরও শেষ থাকে। আপনার স্বামী নিজের জীবনের পরিবর্তে আপনাকে যে উপহার দিয়েছেন, আপনি তাকে শাস্তি বানিয়ে নিলেন…” শ্রীনিবাসন উঠে পড়ল। “এই বাগানটা ক্লান্ত, একাকী মানুষের জন্য তৈরী। ঘুম পেলে আপনি এখানে ঘুমতে পারেন। কেউ আপনাকে বিরক্ত করবে না।”

“ঘুমব? সত্যি ঘুমব? কতক্ষণ ঘুমতে পারব?”

“যতক্ষণ না কেউ আপনাকে ডাকতে আসে।”

***

“মা! মা!”

হৈমন্তী উদ্বিগ্ন হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল।

“বেডরুম মে দেখা হ্যায়?” পেমা কোমরে দু'হাত রাখল। গেস্টদের ডিনার হয়ে গেছে। এবার তার বাড়ি যাওয়ার সময়।

“হ্যাঁ, দেখে এলাম তো। এতক্ষণ তো তাই ভাবছিলাম, যে মা হয়তো ঘুমচ্ছে। এখন গিয়ে দেখলাম ঘর খালি। সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম, বলল মা-কে দুপুরের পর আর দেখেনি।”

“উস পের কে নীচে তো নেহি?”

“পের? কৃষ্ণচূড়ার নীচে? যেখানে চা খাচ্ছিলাম?”

বলতে বলতে হৈমন্তী সেদিকে পা বাড়াল। লন্ঠনের আবছায়া আলোয় বেঞ্চটা ফাঁকা বলেই মনে হচ্ছে কিন্তু…

“মা!”

হৈমন্তী ডাক দিতেই যেন শূন্য থেকে মালিনীর অবয়ব ফুটে উঠল। হৈমন্তী এক ছুটে বেঞ্চের কাছে চলে গেল। কাছ থেকে মা-কে দেখে ভারী মমতা হল ওর। বাচ্চার মতো বেঞ্চে বসে টেবিলের ওপর মাথা রেখে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সামনে শ্রীনিবাসনের ছবিটা রাখা।

“মা! উঠে পড়! রাত হয়ে গেছে তো!”

হৈমন্তীর ডাকে মালিনী উঠে চোখ কচলাতে লাগল। ওর মাথা থেকে একটা কৃষ্ণচূড়ার ফুল পড়ে গেল।

কৃষ্ণচূড়ার ফুল? এখানে?

হৈমন্তী চমকে ওপর দিকে তাকাতেই ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল।

আকাশ ভর্তি তারা, আর তার নীচে, কাল অবধি একটাও ফুল না ফোটা কৃষ্ণচূড়া গাছের প্রত্যেকটা ডাল থেকে আগুনের মতো লাল ফুল থোকা থোকা ঝুলে আছে।
0

গল্প - বিশ্বজিৎ চট্টোপাধ্যায়

Posted in







আমি তাকে ডাকি নি।সে যখন বলল, আমি আজ আসব,আপত্তি করিনি। ভালো কথা।আসতে চাইছে আসুক। আমাদের বাড়ি শহর থেকে একটু দূরে। ট্রেনে করে একটা স্টেশনে এসে ১ নং প্ল্যাটফর্মে নামতে হবে। পাশেই অটোস্ট্যান্ড।তারপর অটো। তারপর বেশ কিছুটা হাঁটা... তারপর একটা চালু মিষ্টির দোকান। আমাদের বাড়ির নাম বললে ঠিক দেখিয়ে দেবে। বাগানওলা বাড়ি। চিনতে অসুবিধে হবার কথা নয়।
এই লোকটাকে আমি ভালো করে চিনি না। কেবল নামে চিনি। ছবিতে মানুষকে কতটা চেনা যায়? আজকাল অনেকেই নকল ছবি লাগায়। তাছাড়া অপরিচিত মানুষকে বাড়ি গিয়ে চিনতে হবে? কে জানে?
ওর একটি কবিতা পড়ে আমার ভালো লেগেছিল। কবিতাটি ছিল তার প্রেমিকার জন্মদিন নিয়ে। কবিতার নামও 'প্রেমিকার জন্মদিন'। তার মধ্যে একটা লাইনে এসে আমি ছিটকে যাই।

লাইনটা হলো: তিস্তার চরের মতো দীর্ঘ বাল্যকাল।
আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে ছিলাম।
তারপর আমার প্রতিক্রিয়া জানাই।
এই কবিতার শেষ লাইন ছিল এই রকম।
আমন্ত্রিত লোকটিও জানেনা সে আগন্তক কিনা। দারুণ না?
সেই থেকে ওর কবিতা পড়ি। পড়তেই থাকি।ও রাতদিন কবিতা লেখে। মূলত সনেট। কিছু দীর্ঘ কবিতা, গানের লিরিক এসবও লেখে।
আমি নিজে কবিতা লিখতে পারি না। কিন্তু ভালো কবিতা পড়তে ভালবাসি। আগে গল্প লেখার চেষ্টা করতাম। এখন মাঝে মাঝে অনুবাদ করি। কিন্তু ঠিক হয়ে ওঠেনা। অণুগল্প মাঝে মধ্যে লিখি।
এই লোকটার সঙ্গে যোগাযোগ হতো ফেসবুকের মাধ্যমে। একদিন ও বন্ধুত্ব প্রস্তাব পাঠালো।এক সপ্তাহ পর আমরা বন্ধু হলাম।ও বলল: এত তাড়াতাড়ি?
আমি উত্তর দিইনি। কারণ আমার সময় লাগে। এটাই আমার স্বভাব। যদিও কিছু মানুষ ভাবে এটা আমার একটা সচেতন স্ট্রাটেজি।
যাই হোক ফেসবুক থেকে মেসেঞ্জার, পরে ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে ওর সঙ্গে যোগাযোগ হলো। কোনো ব্যক্তিগত কথাবার্তা নয় শুধু লেখা চালাচালির সম্পর্ক।

আমার গল্প পড়ে ও বলল , ভালো হয়নি। আরও ছোট করে লিখে দেখুন।আর অনুবাদগুলো ঠিক জমছে না। তবে মেঘাকে নিয়ে আমার লেখা একটা অণুগল্প ওর ভালো লেগেছে বলল।যে এত ভালো কবিতা লেখে তার প্রশংসা পেতে কার না ভালো লাগে?
তবু সে তো ঠিক বন্ধু নয়। আগন্তকই বলা যায়। তবে আসতে চাইছে যখন আসুক।এর আগে কোনো সত্যিকারের কবিকে সামনে থেকে দেখেছি বলে মনে পড়েনা।

মুশকিল হলো ও আজ আসবে বলে লিখেছে। কিন্তু আজকেই বাড়িতে কেউ নেই। ফাঁকা বাড়ি। আমি কুঁড়ে এবং অপারগ একজন মানুষ। কিচ্ছু পারিনা। এখন আর আমন্ত্রণ বাতিল করার সময় বা সুযোগ কোনোটাই নেই।
অগত্যা কাজে হাত লাগালাম।চার পিস টোস্ট বানালাম। এটা পারি। দুটো মুরগির ডিম সহ পেঁয়াজকুচি,টোম্যাটো ও চিলি সস দিয়ে ওমলেট বানালাম। চানাচুর ও বিস্কুট ছিল। ভেজিটেবল চপ আনিয়ে নিলাম। ফ্রিজে গুড়ের পায়েস আছে। কফি বানিয়ে নিতে পারব।
এইবার নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করা যায়।

একদিন এই লোকটাকে আমার দেখা দরকার ছিল। ওকি সত্যিকারের মানুষ না একজন অলৌকিক কবি?ওর কবিতা পড়লে গা শিরশির করে।কেন?

এখনও আসছে না তাই নিজের সঙ্গে নিজেই কথা বলি :যদি দ্যাখো,জানলার শিক দিয়ে গলা বাড়িয়ে অবয়বহীন কোনো আগন্তুক তোমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,ভয় পেয়োনা। তোমার সবচেয়ে প্রিয় বইটার ওপর একবার হাত রাখো।
কোনো প্রিয়জনের দিকে ভুলেও তাকিও না,দীর্ঘশ্বাস যেন তাকে স্পর্শ না করতে পারে।

ভুলে যাও আজকের দিনে কী হয়েছিল বা কী হয়নি।আকাশি রঙের বুশশার্ট,খয়েরি ট্রাউজার্স আর
কালো রোদচশমা পরে বেরিয়ে এসো আগন্তুকের পিছু পিছু।তাকিয়ে দ্যাখো, বসন্ত কি মহা সমারোহে ফুটে উঠেছে চারপাশে। অথচ দ্যাখো এ বিচিত্র পৃথিবী তোমার পদছাপ নিতে অপারগ।
দুএকটি রাস্তার কুকুর চিৎকার করে এগিয়ে এসেও কী জাদুবলে থমকে যাবে।

দেখতে পাবে তোমার আসন্ন বই ও পুরনো ফোটোগ্রাফের ওপর কয়েকটি বাসি ফুল আর শত্রুদের হাহাকার পড়ে আছে। শুধু তোমার সেই প্রিয় বইটা শেলফে নেই। হারিয়ে গেছে না চুরি হয়েছে কেউ খোঁজ করেনি।
আলির কবিতা পড়ে আমার যা হয়েছিল লেখার চেষ্টা করলাম।আলি কবি আসবে বলেও আসেনি। আমার ভুল হয়েছিল।আলি কোথাও আসেনা।সে একজন আগন্তক এবং আমার কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বী।
কিন্তু আমার প্রিয় বইটা শেলফ থেকে কোথায় হারিয়ে গেল? যেটা ছাড়া আমি এক লাইনও লিখতে পারি না।
সেই বইচোরকে আমি চিনিনা। আপনি চেনেন?