Next
Previous
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in








পর্ব-২১

বণিকের মানদন্ড দেখ দিল রাজদণ্ডরূপে
(সময়ানুক্রমিক সংক্ষিপ্ত বিবরণী)-দ্বিতীয় অংশ


ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেবলমাত্র এই অন্তর্দ্বন্দের সুযোগে নিজেদের ব্যবসা বাড়িয়েছিল তাই নয় তারা এই সুযোগে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টাও করেছিল এবং বেশকিছু ক্ষেত্রে সাফল্যও পেয়েছিল।এর আর একটা বড় কারণ হলো যে পারস্পরিক সংঘাত আন্তঃরাজ্য ব্যবসার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করছিল। ১৭৮৪ সালে প্রকাশিত পিটসের ইন্ডিয়া অ্যাক্ট অনুযায়ী যদিও সামরিকখাতে ব্যয় কমানোর উদ্দেশ্যে ভারতবর্ষে ব্রিটিশদের রাজনৈতিক ক্ষমতাদখলের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল এবং কোম্পানি অধিকৃত অঞ্চলগুলিকে সুরক্ষিত রেখে রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে ব্যবসাবৃদ্ধির উপরে গুরুত্ব আরোপের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু লর্ড ওয়েলেসলি ১৭৯৮ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই এই আইনকে কার্যতঃ খারিজ করে দিল। ওয়েলেসলির একমাত্র লক্ষ্য ছিল ক্ষমতা দখল। নিজেকে ভারতবর্ষের একচ্ছত্র অধিপতি হিসাবে দেখার স্বপ্ন নিয়েই এদেশে এসেছিল সে। ১৭৯৮ সালে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে ইজিপ্ট এবং সিরিয়া আক্রমণ এবং অধিগ্রহণের চেষ্টা ওয়েলেসলিকে সাহায্য করেছিল ব্রিটিশ সরকারকে ভারত অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে তার সঙ্গে সহমত হবার জন্য। যদিও কারণ হিসাবে ফ্রান্সের ভারত আক্রমণের সম্ভাবনাকে তুলে ধরেছিল ওয়েলেসলি কিন্তু সে নিজে বিশ্বাস করতো যে ইজপ্ট থেকে স্থলপথে অথবা কেপ অফ গুড হোপের দিক থেকে জলপথে ফ্রান্সের ভারত আক্রমণের কোনও সম্ভাবনা সেই সময় ছিল না। কিন্তু ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারে অনীহাকে মাথায় রেখে ওয়েলেসলি ‘সাবসিডিয়ারি অ্যালায়েন্স’ প্রথা প্রস্তাব করে যাতে বলা হয় কোম্পানি কেবলমাত্র রাজ্যগুলির অভ্যন্তরীন ব্যাপারে নিজেদের নিয়ন্ত্রন কায়েম করবে কিন্তু রাজ্যগুলির রাজনৈতিক ক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেবে না। ওয়েলেসলির ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্খা চরিতার্থ করতে ভারতে কর্মরত অন্যান্য ব্রিটিশ আমলারাও সহযোগিতা করেছিল। অনেক ঐতিহাসিক বলে যে ওয়েলেসলি ব্রিটিশ সরকারের কাছে ভারতের ব্যবসা করার পরিবেশ অনুকূল করার জন্য রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল যে আবশ্যিক সে কথা নানাভাবে প্রমাণ করতে চেয়েছে। যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি অশান্ত তখন সেটাকে ভয়ঙ্কর বলে আবার যখন পরিস্থিতি শান্ত তখন সেখানে অশান্তির বাতাবরণ তৈরি করে ব্রিটিশ সরকারকে বিপথে চালিত করেছিল ওয়েলেসলি। তবে ব্রিটিশ সরকারের গন্যমান্য ব্যক্তিরা এতটা নির্বোধ ছিলনা যে তারা কিছু না ভেবে ওয়েলেসলির এই কর্মকান্ডে মদত দিয়েছিল। অন্য কোনও ইউরোপিয়ন শক্তি যেন কোনওভাবেই ভারতবর্ষ দখল করতে না পারে তার জন্য ওয়েলেসলিকে সবরকম মদত দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার। এই যুদ্ধের খরচ যোগাতে যখন ভাঁড়ারে টান পড়লো তখন ওয়েলেসলিকে দেশে ফিরিয়ে নিল ব্রিটিশ সরকার। সেটা ছিল ১৮০৫ সাল।

এই প্রেক্ষাপটে বুঝতে অসুবিধা হয়না কেন মাইসোরে হায়দার আলি এবং টিপু সুলতানের রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্রিটিশদের শিরঃপীড়ার কারণ হয়েছিল। দাক্ষিণাত্যে ব্রিটিশদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে লাগলো। ওদিকে মাইসোরের সীমানা উত্তরে কৃষ্ণা এবং পশ্চিমে মালাবার উপকূল অবধি এগিয়ে গেল। সুতরাং প্রতিবেশী রাজ্য মূলতঃ হায়দ্রাবাদ এবং মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো। এই রাজ্যগুলি প্রায়শই ব্রিটিশদের সাহায্য নিয়ে নিজেদের বাঁচাবার চেষ্টা করতো। ব্রিটিশরা আতঙ্কিত হত এই ভেবে যে মাইসোরের পিছনে ফরাসিদের সমর্থন আছে। কিন্তু এই আতঙ্ক অযৌক্তিক ছিল। মালাবার উপত্যকায় ব্যবসার ক্ষেত্রে মাইসোরের নিয়ন্ত্রন ব্রিটিশরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। গোলমরিচ এবং এলাচের ব্যবসা ছিল মাইসোরের নিয়ন্ত্রনে। ১৭৮৫ সালে টিপু সুলতান গোলমরিচ, এলাচ এবং চন্দনকাঠের আমদানির ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ১৭৮৮ সালে টিপু সুলতান ব্রিটিশদের ব্যবসা করার অনুমতি প্রত্যাহার করে নেয়। সেক্ষেত্রে ব্রিটিশদের কাছে মাইসোরের রাজনৈতিক পালাবদল ঘটানো ছাড়া আর কোনও রাস্তা খোলা রইলো না। কিন্তু টিপু সুলতান তখন মাইসোরকে কেন্দ্র করে সমগ্র দাক্ষিণাত্যে রাজ্যবিস্তারের পরিকল্পনায় ব্যস্ত। টমাস মুনরো এবং আলেক্সান্ডার রিডের মত কমবয়সী সামরিক আধিকারিকেরা পরিষ্কার জানিয়ে দিল যে যুদ্ধ ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। যদিও অসামরিক প্রশাসকেরা ভারসাম্য রক্ষা করার পক্ষে এবং যুদ্ধের বিপক্ষে ছিল তারাও কিছুদিনের মধ্যেই বিপদের আঁচ পেয়ে লর্ড কর্নওয়ালিশ এবং পরবর্তীকালে ওয়েলেসলির সঙ্গে ভারতের মানচিত্র থেকে মাইসোরের চিরকালীন বিলুপ্তির ব্যাপারে ঐকমত্য জানাল। তারপর চারদফা যুদ্ধের পর ১৭৯৯ সালে মাইসোরের দখল নিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। প্রথম যুদ্ধে(১৭৬৭-৬৯) মারাঠা এবং হায়দ্রাবাদের নিজাম ব্রিটিশদের পক্ষ নিয়ে হায়দার আলির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। পরবর্তীকালে আবার ১৭৯০ সালে তৃতীয় দফার যুদ্ধে এই দুই ভারতীয় শক্তি ব্রিটিশদের পক্ষ অবলম্বন করে এবং লর্ড কর্নওয়ালিশের নেতৃত্বে টিপু সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়। এর কিছুদিন আগেই ব্রিটিশদের আর এক মিত্র রাজ্য ত্রাভাঙ্কোরের রাজাকে আক্রমণ করেছিল টিপু সুলতান। এই যুদ্ধে ডিন্দিগুল, বারামহল এবং মালাবারকে মাইসোর থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় ব্রিটিশ। এর কিছুদিন পরে ফরাসিদের সাময়িক উত্থান এবং তাদের সঙ্গে টিপু সুলতানের গোপন আলোচনাকে অজুহাত করে মাইসোর আক্রমণ করে ওয়েলেসলি। এই ঔপিনিবেশিক আগ্রাসনের যুদ্ধে মাইসোরের রাজধানী শ্রীরঙ্গাপট্টম দখল করে নেয় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। শ্রীরঙ্গাপট্টম রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ হারায় টিপু সুলতান। মাইসোরকে আবার নিয়ে আসা হয় ওয়েলেসলির অনুগত ওয়েদার রাজবংশের অধীনে। মাইসোর হারালো তার স্বাধীনতা চিরকালের মতো। ওয়েলেসলি প্রবর্তিত চুক্তি অনুযায়ী মাইসোর অন্য কোনও ইউরোপিয়ন রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে না। মাইসোরের রাজদরবারে ব্রিটিশ প্রতিনিধি স্থায়ীভাবে থাকবে এবং তার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করবে মাইসোরের রাজা। এই চুক্তির অধীনে থাকতে সম্মত হওয়ার জন্য মাইসোরের কিছু অংশ হায়দ্রাবাদের নিজামকে দিয়ে দেওয়া হয়।

ইতিমধ্যে বোম্বে এবং গুজরাতের মধ্যে দিয়ে চিনের সঙ্গে কোম্পানির ক্রমবর্ধমান তুলার ব্যবসা তাদের ঐ অঞ্চলের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন করে তোলে। রাজত্বের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত এক পারিবারিক বিবাদকে হাতিয়ার করে ব্রিটিশরা ঐ অঞ্চলের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে। রঘুনাথ রাও চক্রান্ত করে তার ভ্রাতুষ্পুত্র পেশোয়া নারায়ণ রাওকে হত্যা করলে ঐ অঞ্চলের মারাঠা সর্দারদের রোষের মুখে পড়ে এবং বাঁচবার জন্য ব্রিটিশদের দ্বারস্থ হয়। ১৭৭৫ সালে রঘুনাথের বাহিনী গুজরাতে বিদ্রোহীদের হাতে পরাজিত হয় এবং তাকে উদ্ধারের জন্য মাদ্রাজ এবং বোম্বে থেকে বিশাল সেনাবাহিনী গুজরাতে এসে পৌঁছোয়। রঘুনাথের বিরোধীরা কোম্পানিকে রঘুনাথের থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের সর্তে বেশ কিছু ব্যবসায়িক সুবিধা দেবার প্রস্তাব করে পুরন্দর শান্তিচুক্তির খসড়া পেশ করে। কিন্তু পুরন্দর চুক্তি কলকাতার কোম্পানি অধিকর্তারা বাতিল করে দিলে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। ইতিমধ্যে মারঠারা নানা ফাডনিস, সিন্ধিয়া এবং হোলকারের নেতৃত্বে সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এবং ১৭৭৯ সালে ওয়াদগাঁও এর যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে ব্রিটিশদের পর্যুদস্ত করে। এরপর বাঙলা থেকে বিশাল বাহিনী এসে এলাকা পুনরুদ্ধার করে। নানা ফাডনিস এবং ভোঁসলে পরিবার ১৭৮১ সালে নিজাম এবং হায়দার আলির সঙ্গে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জোট বাঁধে। কিন্তু ১৭৮২ সালে এই যুদ্ধের ফলাফল ব্রিটিশদের অনুকূলে যায় এবং ১৭৮২ সালে সালবাই চুক্তির মধ্য দিয়ে মারাঠারা ব্রিটিশদের আনুগত্য স্বীকার করে নেয় এবং মাইসোরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষ নিতে সম্মত হয়।              

0

গল্প - আর্যা ভট্টাচার্য

Posted in






“হেলো”!

ব্যারিটোন ভয়েস কানে যেতে, এতোক্ষণ প্রকৃতিতে মগ্ন শ্রুতি, তাকিয়ে দেখে তার সামনের সীটে এক ভদ্রলোক বসে তার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছেন।

কখন এসে বসলেন ভদ্রলোক ! এতোক্ষণ তো ছিলেন বলে মনে হচ্ছে না! ইন ফ্যাক্ট শ্রুতি যখন ট্রেনে ওঠে তখন এই ফার্স্টক্লাস কোচটা একরকম ফাঁকাই ছিল। কোচের শেষ দিকে বোধহয় দু’ একজন ছিলেন।

এই সুন্দর আরামদায়ক কোচখানা প্রায় পুরোপুরি তার দখলে, ভেবেই শ্রুতির ইন্ট্রোভারটেড চিত্ত আনন্দে নেচে উঠেছিল। আ:, কী শান্তি! ভিড়ভাট্টা, বাচ্চাদের চিৎকার, কান্না কোনো ঝামেলা নেই। প্রকৃতি দেখতে দেখতে একা একা সুন্দর সময় কাটানো যাবে !

কিন্তু হা হতোস্মি! তার সেই আশায় এবং একাকীত্বে জল ঢালতে কে এই মূর্তিমান আবির্ভূত হলেন!

আর তার সামনে এসে বসলোই বা কখন.কে জানে! হয়তো শ্রুতি যখন এটেন্ডেন্ট মহিলার সঙ্গে কথা বলতে ওপাশে গেছিলো তখন এসে বসেছে।

অবশ্য আগে পরেও হতে পারে, কারণ ট্রেনের চারপাশের সৌন্দর্যে শ্রুতি এমনই বুঁদ হয়েছিল, যে অন্য কোনো দিকে মন দেবার মতন অবস্থাতেও সে যে ছিলনা, এটাও ঠিক।

আর এরকমটা হওয়াই তো স্বাভাবিক। এই প্রথমবার গ্রিন্ডেলওয়াল্ড যাচ্ছে শ্রুতি। উ:, কী রোমাঞ্চকর! গ্রিন্ডেলওয়াল্ড আর তার আশেপাশের সৌন্দর্য , যা সে এতোদিন শুধু ছবিতে দেখেছে, এবার চাক্ষুষ দেখবে। ভাবা যায়!

এখনো তো গ্রিন্ডেলওয়াল্ড আসতে একটু দেরী আছে, অথচ এখনই চারদিক কী অপরূপ হয়ে উঠেছে!

ট্রেনের বাইরে যেদিকেই তাকাও বরফের পাহাড় আর পাহাড়। মনে হচ্ছে স্নো পিক গুলোকে, ট্রেনের মস্ত মস্ত কাঁচের জানলার গায়ে কেউ যেন আঠা দিয়ে ছবির মতো সেঁটে রেখেছে।

আর ট্রেনের সঙ্গে ছুটে চলা চোখ ঝলসানো রকমের সাদা বরফ পাহাড়ের নীচে দিগন্ত ছোঁয়া , ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলা এমন গাঢ় সবুজ তৃণভূমি।

আর সেই সবুজ মেডো তে চরে বেড়াচ্ছে বাদামী সাদা ছোপ ছোপ গরু, দারুণ মিষ্টি বাচ্চা ভেড়া, মা-ভেড়া, পক্ষীরাজের মতো ঘোড়ারা-কোনোটা ধপধপে সাদা, কোনোটা কুচকুচে কালো,কোনোটা বাদামী, তাছাড়া মেশামেশি রঙের তো আছেই। ঠিক যেন রূপকথার দেশ।

গরুগুলো আবার একটু বেশি সাহসী। ট্রেনের প্রায় কাছ ঘেঁষে চরে বেড়াচ্ছে। আর তাদের গলায় সব বড়ো বড়ো ঘন্টা বাঁধা। সে সব ঘন্টার আবার কী সুরেলা আওয়াজ! শ্রুতির মনে হচ্ছে ওরা যেন গান গেয়ে গেয়ে তাকে ডাকছে।

হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ছে দূরে দূরে একেকখানা কটেজ । ছোটবেলায় শ্রুতি ড্রয়িং খাতায় যেমন আঁকতো,ঠিক তেমনি ছবির মতো তাদের ঢালু ছাদ, আর ছাদের কোনায় একটা করে চিমনি। ওপরে আশ্চর্য নীল আকাশ…

“ প্রথম বার কি”?

উল্টোদিকের সীটের ভদ্রলোকের কথায় সম্বিত ফেরে শ্রুতির। রূপকথার দেশ থেকে তার মন ঝপ করে ফিরে আসে ট্রেনের কামরায়।

শ্রুতির বিভোরতা দেখেই কিনা কে জানে,

ভদ্রলোক একদৃষ্টিতে একভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। কী গভীর নীল চোখ! আর সেই চোখদুটোয় আশ্চর্য কিছু যেন ঝিকমিক করছে! মুখে মৃদু হাসি।

ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকিয়ে শ্রুতির সারা শরীর হঠাৎ অকারণে কেন যেন কেঁপে উঠল।

কী হ্যান্ডসাম দেখতে! মনে হয় ছ'ফুটের কাছাকাছি লম্বা হবেন, গ্রীক গডের মতো মুখ, মাথার চুল অনেকটা পাতলা হয়ে এলেও তার গাঢ় সোনালী রঙ, সূর্যের পড়ন্ত আলোয় আগুন একেবারে।

হ্যান্ডসাম , আকর্ষক বিদেশি পুরুষ, শ্রুতি তো আর প্রথম দেখছেনা, কিন্তু এই ভদ্রলোকের ভেতর কী যেন আছে! চোখে চোখ পরা মাত্র তাকে পাগলের মতন টানছে। ভদ্রলোকের আকর্ষণের কাছে, এতোক্ষণ তাকে বুঁদ করে রাখা আশপাশ, প্রকৃতি সবকিছু একেবারে ফিকে, আলুনি লাগছে।

টেবিলের উপর রাখা ভদ্রলোকের গ্লাভস পরা হাতদুটো একবার ছোঁয়ার জন্য তার সমস্ত শরীর যেন আকুলি বিকুলি করে উঠলো। সামনের ভদ্রলোকের শরীরের ভাষাতেও যেন সেই একই আকুলতা!

এটা কি হচ্ছেটা কি? আর এই চল্লিশের ওপরে এসে? লাভ এট ফার্স্ট সাইট?

ফু:.!..সে সব গল্প কথা মাই ডার্লিং। বাস্তবে হয়না,, বলে মনে মনে নিজেকে কষে এক ধমক দিলো শ্রুতি

“ প্রথম বার?”-

আবার সেই স্বর।

“ হ্যাঁ,… মানে অফিসের কাজে বার্লিন এসেছিলাম, তো ভাবলাম গ্রিন্ডেলওয়াল্ড টা দেখেই যাই। আমার ছোটবেলার স্বপ্ন “

“স্বাভাবিক '

”স্যরি'?

শ্রুতির কথার উত্তর না দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে তাঁর সেই আশ্চর্য হাসিটি হাসেন ভদ্রলোক।

“আপনি চা খাবেন? আমি একটু চায়ের অর্ডার দিচ্ছি “

“ নো, থ্যাংকস “

শ্রুতির অনুরোধ উপেক্ষা করেই একমনে খুব খেয়াল করে শ্রুতির আপাদমস্তক জরিপ করতে লাগলেন ভদ্রলোক। ঠোঁটের কোনের হালকা হাসিতে খানিকটা অবয়সোচিত দুষ্টুমির আভাস।

,” নাউ ইউ হ্যভ নাইস অলিভ স্কিনকালার”-

আবার শ্রুতির অন্ত:স্থল ছুঁয়ে যাওয়া, গভীর অথচ মজার ভঙ্গিতে বলা পাগল করে দেওয়া সেই ব্যারিটোন ভয়েস।

একমুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেল শ্রুতি। তারপরেই খানিকটা নিজেকে সামলে নেবার চেষ্টায়, আর খানিকটা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে, একটু বেশিই জোরে হেসে উঠলো , “না,না, আপনি ভুল করছেন,। আমার স্কিন ট্যানড হয়ে এরকম হয়নি। আমার স্কিন টোন এরকমই। আমি ভারতীয় তো, আমাদের চামড়ার স্বাভাবিক রঙ এরকমই হয় সাধারণত “

মজাদার ভঙ্গিটা মুছে গিয়ে বিষন্নতার মতো কিছু ভদ্রলোকের মুখে ছড়িয়ে পড়লো।

অন্যমনস্ক ভাবে বার দুয়েক যেন ঘোরের মধ্যে “ ইন্ডিয়া… ইন্ডিয়া “ বলে চুপ করে গেলেন।

“আচ্ছা, আগে কি আমাদের কোথাও দেখা হয়েছে ? “

কিন্তু শ্রুতি তার প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই গ্রীন্ডেলওয়াল্ডের আগের স্টেশন থেকে স্টার্ট করেও ট্রেনটা হঠাৎ থেমে গেল। ভদ্রলোক ও উঠে, কোচের পিছনে, বোধহয় রেস্টরুমের দিকে চলে গেলেন।

শ্রুতি এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

কি হলো আবার! বিদেশের ট্রেন তো সাধারণত যেখানে সেখানে, যখন তখন থেমে যায়না! ব্যাপারটা কি হলো?

তখনই ট্রেনের অ্যনাউন্সমেন্ট সিস্টেমে জানানো হলো যে অপ্রত্যাশিত ভাবে ইন্জিনে কিছু অসুবিধা দেখা দিয়েছে। তাই স্টেশন থেকে ছাড়তে একটু দেরী হবে; অবশ্য খুব তাড়াতাড়ি, মানে আধঘন্টা খানেকের মধ্যেই ট্রেন পরের স্টেশন, গ্রীন্ডেলওয়াল্ডের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবে। প্যাসেঞ্জারদের এই অসুবিধার জন্য তারা নিতান্ত দুঃখিত।

শ্রুতি এদিক ওদিক তাকিয়ে কী করবে ভাবছে এমন সময় অ্যাটেনডেন্ট মেয়েটি, যার নাম মারিয়া _মানে শ্রুতি এই মাত্র ই খেয়াল করলো তার আইডিতে লেখা রয়েছে , শ্রুতির পাশ দিয়ে যাছিল। শ্রুতি ও ওমনি খপ করে তাকে ধরে ফেললো। “ “এক্সকিউস মি, ট্রেনের ইঞ্জিন ঠিক হতে তো একটু দেরি আছে, এই সময়টায় আমি কি নীচে নামতে পারি?”

মেয়েটি একটু ইতস্তত করে তাকে নামার পারমিশন দিলো। কিন্তু সেই সঙ্গে সাবধানও করে দিল, সে যেন দূরে না যায়। এই কথা শুনে একটু ভয় পেয়েই শ্রুতি জিগ্যেস করলো, “ কেন বলুন তো? জায়গাটা কি সেফ নয়?”

“না, না এই জায়গাটা খুব ই সেফ। আমার বাড়িও এখানে। এখন অবশ্য আমি আর আমার পার্টনার ইন্টারলেকেনে থাকি। গেছেন? না গেলে একবার ঘুরে নেবেন। ভারী সুন্দর শহর।

যাইহোক, এখানে ভয়ের কিছু নেই। নিশ্চিন্তে কাছাকাছি ঘুরুন ফিরুন। নো প্রব্লেম।

বরং একটা কাজ করুন। আপনার মোবাইল নম্বরটা আমাকে দিয়ে যান। ট্রেন ছাড়ার আগে আমি আপনাকে কল করে ডেকে নেব “

তাই সই।

সেটা অবশ্য খারাপ ও হবেনা। ওই সবুজ মেডোতে হাঁটা মানে এক অপার্থিব অনুভূতি! ভালোলাগায় ভরপুর হয়ে পাহাড় ছোঁয়া সবুজ মেডোর দিকে আস্তে আস্তে হাঁটতে শুরু করলো শ্রুতি।

অন্য কোচ থেকেও কয়েকজন নেমে এসে পায়চারি করছেন দেখা গেল। একটা বছর তিনেকের বাচ্চা মনের আনন্দে সবুজ ঘাসে ছুটে বেড়াচ্ছে। সত্যি এখানে ভয়ের কিছু নেই। চমৎকার জায়গা আর লোকজন।

হঠাৎ ঝপ করে শেষ বিকেলের রোদটা মরে গেলো আর চারদিকে কেমন যেন চাপা অন্ধকার ঘনিয়ে এলো, সঙ্গে হাড়কাঁপানো হিমেল হাওয়া। শ্রুতি কোটের পকেট থেকে বের করে টুপিটাও পরে নিলো।

শুধু যে সন্ধ্যে নেমে আসছে তা নয়, আকাশ জুড়ে গভীর কালো মেঘ করেছে। শ্রুতি দু এক পা সবে হেঁটেছে তার মধ্যেই ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।

“ আমার বাড়ি এক মিনিটের রাস্তা। এখানে ঠান্ডায় কষ্ট না পেয়ে, আসুন আমার সঙ্গে “

ও মা, আবার ট্রেনের সেই ভদ্রলোক!

কথাটা বলেই ভদ্রলোক পাশ কাটিয়ে এগিয়ে এসে শ্রুতির সামনে সামনে চলতে লাগলেন।

হঠাৎ এমন একটা প্রস্তাবে শ্রুতি তো একদম হকচকিয়ে গেল , আর তার সঙ্গে খানিকটা চিন্তায় ও পড়ে গেল। গা টা একটু ছমছম করে উঠলো।

ট্রেনের আলাপ…না ঠিক আলাপ ও বলা যায়না কারন এখনও তারা কেউ কারুর নাম পর্যন্ত জানেনা। এই অবস্থায় ভদ্রলোকের তাকে একেবারে বাড়ি যেতে বলাটা… স্বাভাবিক কি?

সুইটজারল্যান্ডে ছুটকো ছাটকা পিকপকেট ছাড়া ট্যুরিস্টদের সঙ্গে অন্য রকম ক্রাইম হয়না বললেই চলে। তাহলেও বলা তো যায়না। এই ভদ্রলোকের ধান্দা অন্যরকম হতেও তো পারে!

“ শ্রুতি! তোমার যখন এতোই ভয়, একা একা বেড়াতে এসেছো কেন?”-

মায়ের গলায় শ্রুতি নিজেই নিজেকে একটা ধমক দ্যায়।

“ ভয় করছে? “

আবার সেই মদির ব্যারিটোন ভয়েস।

ভদ্রলোক কি মনের কথাও পড়তে পারেন? মনে ভাবে শ্রুতি।

মুখে অবশ্য বলে, “ না, ভয় করবে কেন? “

আর সত্যি বলতে কি এখন ওর ততো ভয়ও লাগছেনা। এমন একজন নাইস এন্ড হট ভদ্রলোকের সঙ্গে সবুজ ঘাসের মখমলি কার্পেট মাড়িয়ে একসঙ্গে হেঁটে চলার সম্ভাবনা…না: মন্দ নয়!

ঠোঁটের কিনারে একটু হালকা হাসির রেখাও ফুটে উঠলো শ্রুতির।

যদিও তার স্বাভাবিক স্বভাব চরিত্রের সঙ্গে এই সিদ্ধান্ত ঠিক মেলেনা, তাহলেও এইমুহূর্তে কোনো এক আশ্চর্য কারণে, এই চিন্তা তার কাছে দারুণ, দারুণ আকর্ষক লাগছে।

তার বুকের ভেতরটা উত্তেজনায় কী ভীষণ যে ঢিপঢিপ করছে!

আহা হা…এই পথ যদি না শেষ হয়..

“এই যে বাড়ি। আসুন “

শ্রুতি ভদ্রলোকের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে, সুখ কল্পনায় গা ভাসিয়ে কখন একখানা দারুন কটেজের সামনে চলে এসেছে, খেয়াল ই করেনি।

“ আসুন “

এবার পুরোপুরি সম্বিত ফেরে শ্রুতির।

ঠিক যেন গল্পের বই থেকে তুলে আনা একখানা কটেজ । দরজায় বড় সাদা নেমপ্লেটে উজ্জ্বল লাল রঙে লেখা-“ ডঃ লিয়াম বাখম্যান “, আর তার নীচে, “পেট্রা বাখম্যান”।

“পেট্রা আপনার স্ত্রী?”


আবার সেই রহস্যময় হাসি।

“ভালোই হলো আলাপ হয়ে যাবে।আপনার স্ত্রী কি এখন বাড়িতে?’- অধিকাংশ ভারতীয় মহিলার মতন ই কৌতুহলে শ্রুতি জিগ্যেস করলো।

“ এক মিনিটে ঢুকে যাবে। এসেই পড়েছে।“

সেই আকর্ষক দৃষ্টিতে শ্রুতির দিকে তাকিয়ে হেসে ওঠেন ডঃ লিয়াম বাখম্যান। আর শ্রুতি এই প্রথম লক্ষ্য করে , লিয়ামের শ্বাদন্ত দুটো অন্য দাঁতের তুলনায় অনেকটা বেশী লম্বা আর ছুঁচলো।


বাড়ির ভেতরে ঢুকে শ্রুতি একেবারে মোহিত হয়ে যায়। কী সুন্দর সাজানো ঘর! জানলায় সাদা লেসের পর্দা, সিলিং থেকে অপূর্ব কারুকাজ করা ঝাড়লন্ঠন ঝুলছে, নীচে নরম কার্পেট , ছবি, ডেকরেটিং পিস…সব মিলিয়ে এ ঘর যে অনেক ভালোবাসায় সাজানো , তার ছাপ সর্বত্র।

এইরকম, ঠিক এই রকম বাড়িই তার চিরকালের ইচ্ছে ছিল। তার রূপকথার সংসার! এমন একটা বাড়ি আর এমন রোম্যান্টিক একজন পার্টনার পেলে শ্রুতিও হয়তো বিয়েটা করেই ফেলতো। আর তাহলে মা ও খুশ। বাবাও।

আচ্ছা, লিয়ামের বউ পেট্রাকে তো এখনো দেখা গেলোনা! বোধহয় কিচেনে চা কফি কিছু বানাচ্ছে।

লিয়াম এসেই ভেতরের দিকে চলে গিয়েছিল।

এখন বেড়িয়ে এসে সোফায় বসলো।

মুখোমুখি দুটো সোফায় বসে আছে শ্রুতি আর লিয়াম। লিয়ামের চোখে সেই আকর্ষণ, আকুলতা আরও অজানা কী যেন মেশা আশ্চর্য দৃষ্টি, স্থির হয়ে আছে শ্রুতির চোখে।

সারা ঘর জুড়ে সুরের হিল্লোল ছড়িয়ে বিজিসের গান প্রেম ছোঁয়ানো মদিরার মতো বাজছে,”হাউ ডিপ ইস ইয়োর লাভ”

শ্রুতির খুব প্রিয় গান। গানটা শুনতে শুনতে শ্রুতির সারা শরীর মন জুড়ে কী সাংঘাতিক উন্মাদনা! তার শরীর কাঁপছে, মুখচোখ লাল হয়ে যাচ্ছে… আর কেন কে জানে চোখ জ্বালা করছে…খুব…খুব”

“ আমার স্ত্রীর প্রিয় গান”- বলতে গিয়ে লিয়ামের গলা যেন ধরে আসে।

, *আমারও “

ধরা গলা শ্রুতির।

“ একটা অনুরোধ আছে। আপত্তি শুনবোনা”- আবেগপূর্ণ গলা লিয়ামের।


লিয়ামের ওই গলা শুনে শ্রুতির হৃদপিন্ড এক মুহূর্তের জন্য আবারও স্তব্ধ হয়ে গেল কথা বলার শক্তি নেই যেন। তার দুচোখ জুড়ে শুধুই লিয়াম।

“ একটা গিফট আছে। আমার স্ত্রীকে সারপ্রাইজ দিতে চাই। কিন্তু বুঝতে পারছিনা আঙুলে পরলে কেমন লাগবে। পছন্দ হবে কিনা। আপনার আঙুল টা একটু..”

নিঃশব্দে মোহগ্রস্তের মতো হাতটা বাড়িয়ে দেয় শ্রুতি। আংটি টা শ্রুতির অনামিকায় পরিয়ে দেয় লিয়াম। একমুহুর্তের জন্য লিয়ামের গ্লাভস ছুঁয়ে থাকে শ্রুতির হাত।

“ আপনার সঙ্গে আগে কখনও কি আমার দেখা হয়েছে”?

আবারও জিজ্ঞেস করে শ্রুতি।

কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর পাবার আগেই

ঝনঝন করে মোবাইল বেজে ওঠে।

ট্রেন পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ছাড়বে।

আকাশ গম্ভীর অন্ধকার আগেই হয়েছিল। এখন অল্প অল্প বরফ পড়ছে। জোরে হাওয়া ও দিচ্ছে।

ট্রেনে উঠে শ্রুতি সীটের দিকে যেতে যেতে পিছন ফিরে দেখে লিয়াম দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছে।

অবাক শ্রুতির চোখে প্রশ্নের ইশারা।

শ্রুতির চোখের দিকে কষ্টে ভরা গভীর চোখে তাকিয়ে নরম গলায় লিয়াম বললো, “ আমার গন্তব্য এই পর্যন্ত ই। আই হ্যাভ রিচড মাই ডেস্টিনেশন।“

“আর কোনো দিন কি আমাদের দেখা হবেনা লিয়াম “- শ্রুতির হৃদপিন্ড যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে।

“ হয়তো হবেনা…হয়তো হবে…গ্যালাক্সি অন্তহীন “

বলতে বলতে শ্রুতির কাছে এসে তাকে বুকের মধ্যে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো লিয়াম। হালকা পালকের মতো শ্রুতির ঠোঁটে লিয়ামের ঠোঁট।ও:, কী হালকা স্পর্শ, ছুঁয়ে আছে কী নেই যেন বোঝা যায়না। শুধু তার ভালোবাসার উত্তাপ বিস্মিত, আকুল শ্রুতিকে ছুঁয়ে থাকে মুহুর্তের জন্য। তারপর আস্তে আস্তে সরে যায় লিয়াম।

তার সাগর নীল চোখ থেকে জল উপছে ওঠে।

সুখ দুঃখ মেশা গভীর বিষন্ন স্বর লিয়ামের , “গুডবাই মাই লাভ “

ট্রেনের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।

“ আপনাকে একটু চা দিই ম্যাম?” মারিয়া এসে জিজ্ঞেস করে শ্রুতিকে।

“আচ্ছা মারিয়া, আপনার বাড়িতো এখানেই বলেছিলেন। আমার সামনের সীটে যে ভদ্রলোক বসেছিলেন, তাঁকে চেনেন আপনি ?”

আকুল আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে শ্রুতি। যেন এর উপরে তার জীবন মরণ নির্ভর করছে।

“আপনার সামনের সীটে…!”

খানিকটা বিভ্রান্ত শোনায় মারিয়ার গলা..” না ম্যাম কেউ তো ছিলেননা “

“ বুঝতে পারছি , আপনি হয়তো খেয়াল করতে পারেননি। নাম বললে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন। ভদ্রলোকের নাম লিয়াম বাখম্যান। ডঃ লিয়াম বাখম্যান”

আতংক বিস্ফারিত চোখে এমনভাবে চেয়ে থাকে মারিয়া, যেন ভূত দেখেছে।

“ ডঃ লিয়াম?!...কিন্তু উনি তো অনেক দিন আগেই মারা গেছেন।“

“কি বলছেন কি ?!আমি তো এখুনি ওনার বাড়ি থেকেও ঘুরে এলাম”

“কিছু মনে করবেননা ম্যাম, এটা অসম্ভব। ১৯৭৭/৭৮ সাল নাগাদ ডঃ লিয়াম আর ওনার স্ত্রী পেট্রার বিবাহবার্ষিকীর দিন পেট্রা ইন্টারলেকেন থেকে এই ট্রেনে করে ফিরছিল। দূর্ভাগ্যবশত এই ট্রেনের একটা সাংঘাতিক অ্যাক্সিডেন্ট হয়। পেট্রা শুধু যে মারা যায় তাই নয়, তার দেহ এমন ভাবে তালগোল পাকিয়ে গেছিলো যে তাকে আর চেনাই যায়নি। ওই সামান্য পোশাক আশাক দেখে আর কী… “

“ এসব কী বলছেন আপনি?” প্রায় না শুনতে পাওয়ার মতো অস্ফুট স্বর শ্রুতির।

“ সেই শোক ড:লিয়াম সহ্য করতে পারেননি। ওঁরা দুজনে দুজনকে খুব ভালো বাসতেন। একরকম লিজেন্ডারি লাভ বলতে পারেন। তারপর থেকে ড: লিয়াম কাজকর্ম প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। প্রতিদিন এই ট্রেনের ভেতর পেট্রাকে খুঁজে বেড়াতেন। মাথাটাই আরকি…

বারবার বলতেন, “ ওর মুখ আমাকে আর একবার দেখতেই হবে। ওকে প্রপারলি গুডবাই না করতে পারলে আমি মরেও শান্তি পাবোনা। ওকে আমার কাছে আসতেই হবে।“

শোকের যন্ত্রণাতেই হয়তো স্ত্রীর মৃত্যুর কয়েক মাস পরেই ডঃ লিয়ামও মারা যান।

ওনাদের অতো ভালোবাসা দিয়ে তৈরি করা কটেজটাও একদম ভেঙে চুরে পড়ে আছে।“

“আপনি ভুল লোকের কথা বলছেন মারিয়া। এ হতে পারেনা।

আমি অন্য লিয়ামের কথা বলছি। আমি এইমাত্র লিয়ামের বাড়ি থেকে ঘুরে এলাম যে”।

শ্রুতির দিকে একটা অদ্ভুত দৃষ্টি দিয়ে চলে যাবার আগে মারিয়া বলে গেল – “আপনি জানলা দিয়ে দেখুন, ট্রেনটা বাঁক নেবার মুখে ডঃ লিয়ামের বাড়িটা দেখা যায়। দেখুন তাকিয়ে ।“

জানলা দিয়ে আকুল হয়ে বাইরে তাকায় শ্রুতি। দুহাত দিয়ে, মুখ দিয়ে ট্রেনের জানালার কাঁচ আঁকড়ে ধরে পলকহীন চোখে বাইরের দিকে কটেজ খানা খুঁজতে থাকে।

হ্যাঁ, ওইতো, ওইতো কটেজ টা, কিন্তু একমুহুর্তে এ কী অবস্থা!

ভাঙাচোরা ছাত…তার খানিকটা আবার উড়েই গেছে। শুধু মাত্র আধভাঙা একপাশে হেলে থাকা দরজার গায়ে লাল রঙে লেখা ডঃ লিয়াম বাখম্যান। নামটা কালচে হয়ে গেলেও এখনও পড়া যাচ্ছে।

শ্রুতির মনে হয় সে বোধহয় পাগল হয়ে যাচ্ছে।

সে কি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে!

নাকি হ্যালিউসিনেট করছে!


কিন্তু তার বুকটা এমন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে কেন! বারবার চোখ ভিজে যাচ্ছে.. ফোঁপানোর মতো কিছু বুকের একেবারে ভেতর থেকে উঠে আসছে… ইচ্ছে করছে, চিৎকার করে কেঁদে উঠতে।

নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করতে করতে সামনের টেবিলে রাখা টিস্যু পেপারের দিকে হাত বাড়াতেই শ্রুতির চোখ আটকে গেলো আংটিটাতে। যেটা লিয়াম একটু আগেই তার অনামিকায় পরিয়ে দিয়েছে।

আংটিটার ' এল ' আর '- পি' অক্ষর দুটো পরস্পরকে জড়িয়ে মিশে আছে যেন,

আর তাদের চারপাশ ঘিরে গোল করে এমবস করা একটাই শব্দ –' Liebe ' ।

শ্রুতি জানে তার মানে 'ভালোবাসা'।।
0

কবিতা - অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়

Posted in






তোমাদের শরীরজুড়ে

মাধবীলতার মত জড়িয়ে আছে সুখ।


জীবনের ধুলো

আমাদের সারা গায়ে।


এ‌ই ধুলো অসহ্য মনে হয়। 


0

কবিতা - রঞ্জন রায়

Posted in







তোমরা এবার পথে নামো
ফুলের দল।
নইলে আজকে সুন্দরকে
কে বাঁচাবে!

তোমরা এবার হামলা করো
ফুলের দল,
নয়তো যত সবুজ ছিল
শুকিয়ে যাবে।

আমার দিকে তুলছ আঙুল!
হার মেনেছি।
জোয়ার এলে বৈঠা ফেলে
পালিয়ে গেছি।

রঙিন কাগজ, রাংতা মোড়া স্বপ্নগুলো,
তাকের উপর আছে তোলা,
জমছে ধুলো।

কথার পিঠে কথা জুড়ে
কানামাছি,
ঢের খেলেছি এখন তোদের
আশায় আছি।।
0

কবিতা - অমিতাভ মুখার্জী

Posted in






গোপিকা
তোমার প্রতিদিনের
ফেলে আসা সময়কে
লাল জুতোর ফিতে দিয়ে
বাঁধা ছিল
যেমন তেমন করে

তোমার
আক্ষেপ ছিল
মন খারাপ ছিল না

দিন পেরিয়ে যায়
দিন
পালটেও যায়
তোমারই ওই দিনযাপনে

সময়কে এড়িয়ে যাবার জন্য
তুমি
নিজেকে চালিয়ে নিয়ে যাও
ইঁদুরের মতো
তোমারই অবুঝ মনের মাঝে

সে তোমাকে মনে করুক
বা
দূরে সরিয়ে দিক

তুমি একটা জঙ্গলকে
জ্বালিয়ে দিতে পারো
বা
একটা ভালুককে
হত্যা করতে পারো
তারই সামনে

সে তা ভালো করেই জানে—

তোমারই মধ্যে হৈচৈ,
উত্তেজনা
তোমারই রাগের গভীর
অন্তরালে থাকে
রাগগুলো তোমার
আলজিভ থেকে বেরিয়ে
আসে,
তোমার ঠোঁট কেঁপে উঠে

তুমি
কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়া
একটা পৃথিবী
গড়তে চেয়েছিলে

তোমার চারিপাশে
রাস্তা দিয়ে চলে যাওয়া
গাড়িগুলোর
টায়ার থেকে
বাতাস বেরিয়ে আসে
চক্রাকারে

তোমারই আশেপাশে
কেউ নেই
সে তো নেই
তোমার কাছের
আর কেউ নেই

তোমার চারিদিকে
গোলাপগুলো ফুটে উঠেছে
গোপিকা ওরাই তোমার
সাথে থাকবে
তোমারই দিনযাপনে

আর কেউ নেই…।
0

ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

Posted in







লোটাস রুট

ফোলানো বেলুনের মতো বা সরু লম্বা গরুর শিং মতো দেখতে এমন পদ্মের শিকড় বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। খোসা ছাড়িয়ে, কেটে খুব ভালো করে ধুয়ে নিয়ে তবে রান্না করতে হয়। নাহলে, শিকড়ের ভিতরের ছিদ্রর মধ‍্যে কাদা মাটি ঢুকে থাকতে পারে। কেনার সময়ে তাই যদি দুই মুখ বন্ধ শিকড় কেনা যায়, তাহলে পরিষ্কার করতে সুবিধা হয়। পাতলা পাতলা করে কেটে, মিনিট পনের কুড়ি সেদ্ধ করে জল ফেলে দিতে হবে। সেদ্ধ করার সময়টা অবশ‍্য লোটাস রুটের পরিমানের ওপর নির্ভর করে। প্রেসার কুকারেও গোটা দু'তিনেক সিটি দিয়ে সেদ্ধ করে নেওয়া যায়। তবে, ভয় নেই, কখনই কিন্তু একদম গলে যাবে না। অদ্ভূত সুন্দর গন্ধওলা লোটাস রুট, থোড় বা ব‍্যাম্বু শুটের দোসর বলা যেতে পারে। একটু crunchy থাকবেই।

কালোজিরে, শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে, আলু ভাজতে বসাতে হবে। এরপর সামান‍্য জিরে গুঁড়ো, ধনে গুঁড়ো, নুন,হলুদ, চিনি দিয়ে কষাতে হবে। এরপর, ওই সেদ্ধ করে রাখা লোটাস রুট বা কমল কাকড়ি আলুর মধ‍্যে ঢেলে দিয়ে রান্না করতে হবে। সামান‍্য ভাজা মশলার গুঁড়ো বা বড়ি/ ডালের বড়া দেওয়া যেতে পারে। নামানোর আগে এক চিমটি রসুন গুঁড়ো। চাইলে ভাজা ভাজা বা একটু রসা রসা তরকারি করা যেতে পারে। মূলতঃ, ডাল ভাতের সঙ্গেই মানাবে।

পুষ্টিতে ভরপুর লোটাস রুট স্বাদ বদলের জন‍্য বানানো যেতেই পারে।

খোসা ছাড়িয়ে কেটে কিন্তু ফেলে রাখলে অক্সিডাইসড হয়ে যায় দ্রুত।



0

সম্পাদকীয়

Posted in








সদ্য অতীত হয়ে গেল একটি দিন। ১৬ ডিসেম্বর। তিপ্পান্ন বছর আগে এই দিনটিতেই পরিসমাপ্তি ঘটেছিল তেরো দিনের এক যুদ্ধের। ভাষার গরিমা বজায় রাখার লক্ষ্যে গড়ে ওঠা এক আন্দোলন থেকে অনেক প্রাণের বিনিময়ে জন্ম নিয়েছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। দিনটি তাই অর্জন করেছিল এক অনন্য মর্যাদা। দিনপঞ্জিতে চিহ্নিত হয়েছিল 'বিজয়-দিবস' রূপে। ইতিহাসে এমন তুলনা মেলা ভার, যখন দুই পড়শি দেশ যৌথভাবে একটি দিনের উদযাপন করে। পাকিস্তানি বাহিনীর অবর্ণনীয় অত্যাচারের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের যে প্রতিরোধ তৈরি হয়েছিল, ভারত তার সর্বশক্তি নিয়ে সেই লড়াইয়ে সামিল হয়। চেতনায় এক হয়ে যায় একদা রাজনৈতিক বিভাজনের শিকার এক সংস্কৃতি, একটি ভাষা। যার নাম বাংলা। দুই বাংলায় একই উদ্দীপনায় আজও পালিত হয় ভাষাদিবস। একই কবির কথা দিয়ে গাঁথা দুদেশের জাতীয়সঙ্গীত। এও এক বিরল দৃষ্টান্ত।

এবছর 'বিজয় দিবস'-এ ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন স্মরণ করলেন সেইসব বীর সেনানীর কথা, যাঁদের বলিদান ছাড়া ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতে পারত, সীমান্তের ওপার থেকে থেকে ভেসে এল বৈরিতার বাতাস। সরকারি প্রতিক্রিয়ায় বলা হল, ভারত রক্তস্নাত সেই দিনগুলির এক বন্ধুভাবাপন্ন অংশীদারমাত্র। তার বেশি কিছু নয়।

ঔপনিবেশিক প্রভুরা একদিন উপমহাদেশের মানচিত্রটি নতুনভাবে এঁকেছিলেন। আজ আবার যেন আরেকটি মানচিত্র রচিত হল। এবার আর ভৌগলিক নয়, মানসিক। আবার প্রমাণ হল রাজনীতির দায় বড় বিষম। প্রয়োজনে তা অস্তিত্বের মূল শিকড়টিতেই করতে পারে কুঠারাঘাত।

সুস্থ থাকুন। সচেতন থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান।
4

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - স্মৃতিকণা সামন্ত

Posted in








শ্মশানের জমিটা ঘাসে ঢেকে আছে। ছোটছোট গর্তে সকালের বৃষ্টিজমা জল। ব্যাঙ লাফিয়ে বেড়াচ্ছে দেদার। জমির পুবে তালপুকুরের পাড়, উত্তরের ঝোপঝাড় আর বাঁশবন ছুঁয়ে চলে গেছে মোরাম ফেলা বড় রাস্তা। রাস্তার উল্টোদিকের ঝুরো বটগাছ, আর গাছের ওপারে ডোমদীঘির কালো জল। বিকেলের রঙ নীলচে সবুজ।


দাদুর সাথে এসে বসি ওই বটের তলায়, শ্মশানের দিকে স্থির চেয়ে থাকে দাদু। দাদুর বাবা সূর্যনারায়ণ, তার বাবা সহদেব, তার বাবা এবং তার আর তারও আগের সব পুরুষের চলে যাওয়া দেখেছে এই সবুজ জমি, তালপুকুর, ডোমদীঘি আর ওই রাস্তা। চোদ্দপুরুষের সালতামামি লেখা আছে এই বংশের খেরোর খাতায়, দলিলে, পাট্টায়।

কোনও এক অখ্যাত দিনে এই গ্রামে এসেছিল আমাদের পূর্বজ, খড় মাটি বাঁশ দিয়ে তৈরি হয়েছিল আমাদের প্রথম বসত। জমিজিরেত, ঠাকুর দেবতার নামে কাটা হয়েছিল মন্দিরের ভিত, শিকড় চারিয়ে যাচ্ছিল মূল, আমাদের শাখাপ্রশাখারা বাড়ছিল ডালপালায়।


চৈতন্যদেব যখন দন্ডভুক্তির রাস্তা ধরে পৌঁছে যাচ্ছিলেন শ্রীক্ষেত্র তখনই কোনও এক মেঠোপথ ধরে রাস্তায় হাঁটছিল আমার পূর্বপুরুষ, পূর্বনারী আর তাদের বংশজ সন্তানরা। জাতিতে সদগোপ, পেশায় চাষী পেয়েছিল মল্লভূমের রাজস্ব আদায়ের ঠিকা। ডোম বাগদী দুলেরা ছিল তাদের সেপাই। কিন্তু তার আগে? তার, তার কিংবা তারও আগে কোন পাটক, বাটক কিংবা নগরীর কোণে ছিল আমাদের মেটে ঘর, গোয়ালঘর, চাঁপাফুলের উঠোন? কোন ভুক্তি, কোন দন্ড, কোন ভূমি?


বিকেল রঙ বদলাচ্ছে হনহন করে। দাদুর সাথে হাঁটছি ওই মেটে রাস্তায়। পায়ে পায়ে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি শতকের পর শতক। হাজার হাজার বছরের ধুলো জমছে আমাদের পায়ে, জামায়, চুলে। এই রাস্তা দেখেছে বর্গীর দল, কালা পাহাড়। তারও আগে কোনও আদিম কৌম জনগোষ্ঠীর পায়ের ছাপ পড়ে আছে এইখানে, এই ধুলোর আস্তরণে।


প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবীশ বলছেন কায়স্থ, সদগোপ আর কৈবর্ত সমাজ বাঙালীর প্রকৃত প্রতিনিধি। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ আর বৃহদ্ধর্মপুরাণ লিখেছে বর্ণসংকর বাঙালির কুল গোত্রের তালিকা। নৃতাত্ত্বিক সেই তালিকা হাতে খুঁজতে বেরিয়েছে বাঙালির জন্মসূত্র, আমার বাপ, দাদা, ঠাকুরদা, তস্য এবং তস্য ঠাকুরদার উৎসমুখের কথা।


ঝুরঝুরে সন্ধ্যা নামছে দীঘির জলে, বুনো ঝোপে, বাঁশের বনে, রাস্তায়। হুন হুনা, হুন হুনা, হুন হুনা রে, হুন হুনা...

পালকি চড়ে নতুন বউ আসছে গাঁয়ে। এসেছিল আমার ঠাকুমা, দিদি ঠাকুমা এবং আরও আরও সমস্ত প্র প্র প্রপিতামহীর দল। নববধূর সাজে, অলক্ত পা ফেলেছিল লালমাটির গায়ে, কাজল টানা চোখ তুলে প্রথম দেখেছিল এ গাঁয়ের গাছপালা, টলটলে দীঘি আর খোড়ো ছাউনির মেটে বসত। নৈষধ চরিতের দময়ন্তী সেদিন নববধূ। লাক্ষারসে রাঙানো ঠোঁট, পায়ে লাল আলতা, কানে মণিকুন্ডল, হাতে কেয়ুর কাঁকন, শঙ্খের বালা। তেমনই কি আমার সেই অজানা কোনও পিতামহীর ছিল– হাতে শঙ্খের বালা, কানে তালপাতার কুন্ডল, পরনে আটপৌরে সুতোর কাপড়, ঘোমটা ঢাকা আয়ত একজোড়া চোখ?


‘দ্য এনালস অফ রুরাল বেঙ্গল’ লিখতে গিয়ে হান্টার আক্ষেপ করেছেন বাঙালির এমন কোনও লিখিত ইতিহাস নেই যা দেখে তার আদিকথা জানা যায়। যা আছে, যেটুকু আছে তা প্রায় সবই রাজাদের দলিল, দানপত্র। সেখানে সাধারণের কথা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কিছু লিপি আছে, সেও সমাজের ছবি নয়। তবুও ইতিহাসবিদ খোঁজে সেইসব অন্ধগলিতে, সেইসব লিপি, দানপত্র, সাহিত্য, পুরাণ কিংবা পোড়ামাটির ফলকে। পাহাড়পুর আর ময়নামতীর বিহারে মন্দিরের গায়ে শিল্পী ঢেলে সাজিয়েছে সমাজের কথা, সাধারণ জীবনের কথা, মাঠেঘাটে কাজ করা মানুষের দিনযাপনের অনাড়ম্বর সব দলিল।


হাওয়া বইছে। বাঁশের পাতায়, তালগাছের মাথায় ঘষা খেয়ে শব্দ হচ্ছে শরশর, শনশন।দীঘির জলে ছোটছোট ঢেউ। মাটির দাওয়ায় বসে কুটনো কুটছে আমার পিতামহী কোনও এক প্রাগৈতিহাসিক সন্ধ্যায়। বেগুন, লাউ, কাঁকরোল, কচু, ইচা, বাচা, শকুল, রোহিতের ঝোলে ঝালে ভাজায় ম ম করছে আমাদের উঠোন, টুপটাপ ঝরে পড়ছে গোলকচাঁপার ফুল। পুকুরঘাটে বর্ষা নেমেছে।


প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলোয় তো বটেই; বর্মা, চীন, ইন্দোনেশিয়া, জাপান জুড়ে প্রধান খাবার ভাত মাছ– বাংলা আসাম উড়িষ্যারও তাই। মধ্য ভারত থেকে দক্ষিণে সিংহল অব্দি, পূর্বে উড়িষ্যা বাংলা আসাম পর্যন্ত, সিংহল থেকে অস্ট্রেলিয়া অব্দি ছড়িয়ে ছিল এক আদিম কৌমগোষ্ঠী। নৃতাত্বিকরা বললেন এই সেই আদি অস্ট্রালয়েড জন, যে জনের গঠনগত মিল পাওয়া গেছে কোল মুন্ডা সাঁওতাল শবর হো ভূমিজ উপজাতির শরীরে। করোটি, কপাল, নাক, চোখ, চুল, উচ্চতার খুঁটিনাটি বিচারে জানা গেছে এই আদি অস্ট্রালয়েড গোষ্ঠীর সাথে মিশেছে আর এক ভূমধ্যসাগরীয় জনস্রোত আলপাইন, এলপো দিনারীয় স্রোত। এক প্রাগৈতিহাসিক ভোরে মিলেমিশে যাওয়া সেই সংকর স্রোতে জন্ম নিল আমার প্রথম পূর্বজ।


পশ্চিমের গুজরাট থেকে মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু হয়ে একটা অ্যালপো দিনারীয় দল পৌঁছেছিল হয়ত উড়িষ্যা, বাংলার মাটিতে। তারও আগে কোনসময় এসেছিল ভূমধ্যসাগরিয় কোন নরগোষ্ঠী। এদের সঙ্গে মিশে গেছিল বাংলার সেইসব আদিম সাঁওতাল, ওঁরাও কিম্বা মুন্ডা জনজাতির আদি অস্ট্রালয়েড রক্ত। রক্তের সাথে রক্তের মিশেলে যেমন জন্ম নেয় নতুন প্রজন্ম তেমনই মিশে যায় রীতিনীতি, আর বিশ্বাস।


জল থৈ থৈ জমি। জল টুপটুপ মেঘ। বীজধান দুলছে হাওয়ায়। তার আগে লাঙল চলেছে, মসৃণ কাদামাটি। সাতপুরুষের জমি, নিজের হাতে লাঙল চষে আমার পূর্বপুরুষ, ফালাফালা মাটি। মাটি ঘাঁটতে ঘাঁটতে আরও আরও বহুদূর হেঁটে যায় আমাদের দাদু,তস্য এবং তস্য বাপ দাদারা। লাঙল নামানোর আগে পুজো দেয় হারান কাকা,পূজো দেয় আমার পূর্বপুরুষ। গোলায় ধান তুলে এনে লক্ষ্মীর বেড় পড়ে মরাইয়ের গায়ে; তেল সিঁদুরের ফোঁটা, গোবর নিকোনো মরাইতলায় অল্পনার আঁকিবুকি। ধানের ছড়া, কলার পাতা, কলা গাছ, হলুদ, পানে আমাদের কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। ভেজা চুল, এলো খোঁপায় আসন সাজায় আমারই কোনও দিদিঠাকুমা।


প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপে দ্বীপে জ্বলে ওঠে প্রদীপ। সুপারি, হলুদবাটা, ধানের ছড়া,কলার পাতার গন্ধ মেখে ভেসে যায় শাঁখের আওয়াজ, দূরে বহুদূরে গ্রাম নদী সাগর পেরিয়ে অজানা কোন দেশে। বাঙালির পুজোপার্বনে আদি নর্ডিক আর্য সভ্যতার ছাপ অল্পই, বাঙালির জীবন এবং চরিত্রেও তাই। যেটুকু বা তাও ওপরে, তার গভীরেও সেই আদি অস্ট্রেলিয় ধারা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপগুলিতে এই পান সুপারি, ধানের ছড়া, কলাপাতা, হলুদের ব্যবহার সমস্ত মাঙ্গলিক কাজে, ধানের ছড়ায় পুজো করে নাগা আর মুন্ডারী জনজাতি। পুজো করে বাঙালি আর তার ব্রাহ্মণ।


সামাজিকভাবে বাঙালি ব্রাহ্মণ উত্তরভারতীয় ব্রাহ্মণের মর্যাদা পায়নি কখনও। বাঙালী ব্রাহ্মণের নিকটতম সম্পর্ক বাংলার কায়স্থ আর বৈদ্যের সাথে। আর বাংলার নমঃশূদ্র চন্ডাল গোষ্ঠীর শরীর গঠনগতভাবে ঘনিষ্ঠ মিল খুঁজে পায় উত্তরের বর্ণব্রাহ্মণের সঙ্গে। ঠিক তারই পাশে বাংলার কায়স্থ কৈবর্ত আর সদগোপ দেহগত বৈশিষ্টে বাঙালির সব বর্ণের সবচেয়ে কাছের জন। বিহারের কিছু গোত্র ছাড়া এই তিন দলের আর কারোর সঙ্গে কোনও মিল তেমন পাওয়া যায়নি, নৃবিজ্ঞানীরা এমনটাই বলেন।


চাষ করে আমার সদগোপ পূর্বপুরুষ। ফালাফালা মাটি, আকাশ ছেঁচা জল, মাটি ঘেঁটে ঘেঁটে ফসল তোলে ঘরে। লাঙলের ফালে তেল সিঁদুরের পূজো অম্বুবাচীর দিনে। লাঙলের ব্যবহার অস্ট্রালয়েড জনের ধারা। লাঙল শব্দও এসেছে এদেরই ভাষা থেকে। অস্ট্রালয়েড ভাষায় লাঙল শব্দের মানে চাষ করা, কিংবা হল। এই একই অর্থে লাঙল শব্দের ব্যবহার সংস্কৃতে। ভাষাতাত্বিক যুক্তি দিলেন যদি কোনও জিনিসের ব্যবহার অজানা হয় তবে তার নির্দেশক শব্দও অভিধানে থাকেনা। আদি নর্ডিক আর্যরা কৃষিকাজ শিখেছে এদেশে এসে, লাঙল শব্দও তখন জুড়ে গেছে সংস্কৃত ভাষার অভিধানে। একই ভাবে দা, করাত, কানি, চোঙা, চিখিল, চোঙ, লেবু, কামরাঙা, ডুমুর ঝোপঝাড় ইত্যাদি এসেছে অস্ট্রিক শব্দ থেকে। দামলিপ্তি(তাম্রলিপ্ত) আর পৌন্ড্র, বঙ্গ এসব শব্দও অস্ট্রিক। নদী পাহাড় জঙ্গলেও পড়ে আছে অস্ট্রালয়েড জনের ছাপ। দাক্ হলো জল, দাক্ থেকে সংস্কৃত উদক। দাম-দাক্ দামোদর। আমাদের ভরা বর্ষার দামোদর।


মেঘ নামছে পাকুড় গাছের মাথায়। রাখাল ফিরে আসছে, দীঘির জলে ডোঙা বেয়ে ঘোরে হারান কাকার ছেলে পরেশ। মাথায় তালের টোকা। পেরিয়ে যাচ্ছি ফণীমনসার ঝোপ, মনসার থান, বর্গী’র মাঠ। বীজধান রোয়ার সময় এখন। চিকচিকে সবুজ ঢেউ ধানি জমির গায়ে। লাঙলের ফালে মাটি কেটে কেটে চাষ করে সেইসব অস্ট্রালয়েড মানুষ, সমতল জুড়ে, ধাপ কেটেকেটে পাহাড়ের গায়ে। চাষ করে আমার চৌদ্দপুরুষ, চাষ করে হারান বাগদী, কানন দুলে, শিবু ডোম।


পণ, গন্ডা, কাহনের হিসেবে বীজ রুইছে। মাড়াই করা খড়ের হিসেব হচ্ছে কাহন দরে। আজ নয়, কাল নয়, হাজার হাজার বছর ধরে আমার চাষী পূর্বজ শিখেছে এই হিসাব। প্রতি চারে এক গন্ডা, কুড়ি গণ্ডায় এক পণ, ষোল পণে এক কাহন। কাহনে পণে আঁটি গুনছে আমাদের ঠাকুরদা। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপের আদিম মানুষ গোনে দু হাতের দশ আঙুল, কুড়ির হিসাবে। গন্ডা হল একক, গন্ডা হল চার। চার কুড়িতে এক পণ। বিড়বিড় করে বীজধানের হিসাব কষে দাদু, বীজতলা জুড়ে সবুজ বিছায় হারান কাকা।


ভুবনেশ্বর শিবের ভাঙ্গা মন্দিরের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াই। স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা। কবেকার এই মন্দির ছিল জানেনা আমার দাদু, জানেনা গ্রামের কেউ। হয়ত মন্দির নয় ,বৌদ্ধ বিহার। বৌদ্ধ জৈন ব্যবসায়ীরা আসতো দ্বারকেশ্বরের ঘাটে ঘাটে, সওদা হত ধুনো, কাঁসার বাসন, আখের গুড়। ক্রিট দ্বীপের সাথে বাঙালির ব্যবসা ছিল মশলা, হাতির দাঁত, কাপড়ের।

দেবরাজ ইন্দ্র পণিদের কাছে শিখছেন পনীর আর ছানা তৈরির হালহকিকত। পণি থেকে আসা পণ্য কিম্বা বণিক শব্দের সূত্র আমাদের নিয়ে যায় দূরে, ভূমধ্য সাগরের দেশে। এই সেই ভূমধ্যসাগরীয় দল যারা হয়ত এসেছিল তামা'র খোঁজে। প্রফেসর এলিয়ট স্মিথ এই তামার ব্যবহারকেই দায়ী করেছেন মধ্যপ্রাচ্য আর ভূমধ্যসাগর উপকূলের মানুষগুলোর ভারত সহ নানান দেশে ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে, ঠিক যে কারণে মেগালিথ কাল্টে বিশ্বাসী সূর্যপূজারী লোকেরাও ছড়িয়ে যাচ্ছিল পৃথিবীর নানান কোণায়। আর্যভাষী অ্যালপো দিনারীয় দলগুলোও হয়ত এসেছিল এদেরই পিছু পিছু, সম্ভবতঃ নর্ডিক আর্যদেরও আগে।


বর্ধমানের আউস গ্রামের কাছে যে পাণ্ডু রাজার ঢিবি, সেই ঢিবিতেই পাওয়া গেছে ক্রিট দ্বীপে ব্যবহার হওয়া লিপিতে লেখা এক সিলমোহর। মিশরীয় এক নাবিকও তাঁর 'পেরিপ্লাস" বইয়ে লিখছেন প্রায় তিন হাজার বছর আগে ক্রিট দ্বীপে বাঙালি উপনিবেশের কথা।


বর্ষা ছিল সেদিন, উপুড় হয়ে পড়েছে আকাশ। লাল চেলি, চন্দনের টিপ– কড়ি খেলে ঠাকুমা, কড়ি খেলে আমার দিদিঠাকুমা। কড়ি খেলে ফিজি, নিউগিনি, পাপুয়ার মেয়েরা। মাঠঘাট ভাসছে বৃষ্টিফোঁটায়, বৃষ্টি নাচছে দীঘির জলে। কলার ডোঙায় ভেসে বেড়ায় কালু ডোম, পদ্মপাতায় টলটলে জল। পাড়ে ভিজছিল ডোমনি রাধু আর তার বাঁশের চুপড়ি। রাধুর চিকন সবুজ গা, ভ্রমরকালো চোখ, ছড়ানো নাক, ছোট্ট কপাল।


“এক সো পদমা চউসট্‌ঠী পাখুড়ি।

তহিঁ চড়ি নাচই ডোম্বি বাপুড়ি॥”


ডিঙ্গা ভাসছিল জলে। কাঠের সাথে কাঠ জুড়ে জুড়ে মস্ত ডোঙা ভেসে যাচ্ছিল জলে, প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউয়ের মাথায়। ভেসে যাচ্ছিল আদি অস্ট্রালয়েড মানুষ আর তাদের জলজ অভিসার সিংহল, ইন্দোনেশিয়া, মেলানেশিয়া ছাড়িয়ে আরও দূরে অস্ট্রেলিয়ার আদিম মাটিতে, প্রাগৈতিহাসিক এক সন্ধ্যার উপকূলে।


বৃষ্টি পড়ছিল খুব… বৃষ্টি পড়ছে জোরে। ভেসে যাচ্ছে মাঠ, দীঘির পাড়। দূর ,অতি দূর থেকে বিনবিন শব্দ উড়ে আসে হাওয়ায় এক কুড়ি, দু কুড়ি... চার কুড়ি পণ…
0

প্রবন্ধ - সেবিকা ধর

Posted in









জলকে 'জীবন' বলা নতুন কিছু নয়, এই তথ্য- সর্বজনবিদিত যেমন অ এর পর আ।পৃথিবীর তিনভাগ জল একভাগ স্থল এও আমাদের জানা।ত্রিপুরার মহিমময় জলভাণ্ডার তার নদী, খাল, হাওড়- বাওড়,দিঘি,ছোট বড় পুকুর সবই রাজ্যের মানুষের জীবন বেঁচে থাকা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতোভাবে জড়িত।ত্রিপুরার অতিবিখ্যাত গোমতী নদী রবীন্দ্রনাথের লেখায় অমর হয়ে আছে।এখন কথা হল ত্রিপুরার এই যে জলসম্পদ- জল তা নীর-বাসনা হয়ে অবিরত আমাদের কাছে এক শিল্পরূপ তুলে ধরে।ত্রিপুরার রাজারা ছিলেন বিদ্ব্যোৎসাহী।শিল্প ও সাহিত্য প্রেমী সংস্কৃতি বোধ সম্পন্ন মানুষ। রবীন্দ্রনাথকে তারা কীভাবে আপন করে নিয়েছিলেন তা ইতিহাসের সাক্ষ্য কণা হয়ে জেগে আছে।আমরা জলের কথা বললাম।এবার আমরা ত্রিপুরার কিছু জল সম্পদের কথা বলি।

ত্রিপুরায় যে যে নদী আছে মনু,হাওড়া,গোমতী, খোয়াই, দেও, জুড়ি, ধলাই ইত্যাদি প্রভৃতি সবই ত্রিপুরার মানুষের জীবনে সভ্যতার বহতা আঙ্গিক হিসাবে জড়িত।ত্রিপুরার রাজারা নদীর বুকে প্রাসাদ তৈরি করে জল ও জল শিল্পকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছিলেন।রাজস্থানের যে জলাশয় কেন্দ্রিক প্রাসাদ তার তুলনায় 'নীরমহল' একেবারেই স্বতন্ত্র। হয়তো স্থাপত্যের নিরিখে শিল্পের কলাকৌশলে সূক্ষ্মতায় রাজস্থানের প্রাসাদেরা যে শৈল্পিক চূড়া স্পর্শ করে নীরমহল হয়তো তার তুলনায় কিঞ্চিৎ ঊন হলেও তার শোভা এবং বৈশিষ্ট্য অনন্য।বিশেষ করে রাতে যখন আলো জ্বলে উঠে নীরমহল- এর মনুষ্যবিহীন ঘর ও বারান্দায় তখম মনে হয় স্বপ্ন লোকের কোনও অলৌকিক চাবি আমাদের সামনে এসে দোল খায়।তাকে ধরে নিয়ে স্বপ্ন ও কল্পনা এবং বাস্তবের দরজাটুকু খুলে ফেললে আনন্দ ও শৈল্পিক জাগরণে।আবার দিনে নীরমহলের শোভা অন্যরকম।

পৃথিবীর কোলে জলের শোভার মধ্যে জেগে থাকা সে যেন এক অলৌকিক রাজহংস।দূর থেকে ধীরে নৌকো পথে যত তার কাছে যাওয়া যায় তর তার মহিমময় রূপ যেন ফুটে ওঠে চোখের সামনে।শীত সকালের অলৌকিক কুয়াশার মধ্যে এই মহল যেন এক কুহক যাত্রার কথা বলে।নৌকো করে নেমে এসে ধীরে ধীরে ভেতরে এলে রাজার বিশ্রাম কক্ষ,নর্তকীদের নাচের জায়গা, বারান্দা, ঝরোখা, রাজাদের ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট স্বতন্ত্র নৌকো- ঘাট সবই আমাদের বোধ ও শৈল্পিক ভাবনাকে নবরসে জাড়িত করে।মুঘলরা ভারতবর্ষে সাম্রাজ্য বিস্তারের পর দিল্লিকে রাজধানী করলে অনেক ধরনের বাগান তারা বানিয়েছিলেন।মুঘল শাসকদের কাছে বাগান-বিলাস এবং জল একটা বড় ব্যাপার ছিল।সব ধরনের বাগানেই ছিল পরিকল্পনার ছাপ এবং জলের ব্যবস্থা। এমনকি তারা অতি বিখ্যাত সব স্থাপত্য জলের আয়োজন রাখতেন।মধ্য এশিয়ায় জলের অভাবে কি এই জল তৃষ্ণার অন্যতম কারণ? তাই স্থাপত্য নির্মাণ করলেই জলের আয়োজন। যেমন তাজমহল।ত্রিপুরার রাজাদের ব্যাপারটি স্বতন্ত্র। তারা জলের ভেতর শিল্প গড়েছেন।শিল্পের স্বপ্নের সঙ্গে জলের স্বপ্নও মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

এবার আসি আমরা নীরমহল প্রসঙ্গে।বোটে করে নীরমহল যেতে যেতে অজস্র পাখি এবং মাছ ধরার নৌকো চোখে পড়ে আমাদের। এর প্রাকৃতিক শোভা অনবদ্য। সৌন্দর্য মুগ্ধ টুরিস্টরা এই জলশোভার ছবি নেন অকাতরে।এই প্রাসাদের গম্বুজ ও ঝরোখা ইসলামিক ও হিন্দু স্থাপত্য শৈলীর সমন্বয়বাদী এক ধারাবাহিকতার কথা বলে।

নীরমহল যার অর্থ “জল প্রাসাদ”। এটি ১৯৩০ সালে রুদ্রসাগরের হ্রদের মধ্যবর্তী ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মানিক্য বাহাদুর কর্তৃক নির্মিত একটি রাজকীয় প্রাসাদ এবং এটি ১৯৩৮ সালে সম্পন্ন হয়। এটি ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলা থেকে ৫৩ কিলোমিটার দূরে মেলাঘরে রুদ্রসাগর লেকের মাঝখানে অবস্থিত এবং হিন্দু ও মুসলিম স্থাপত্য শৈলীর সমাহার করে।এই প্রাসাদটি ভারতের সবচেয়ে বড় এবং পূর্ব ভারতে একমাত্র। ভারতে শুধু দুটি জল প্রাসাদ আছে অন্য আরেকটি রাজস্থান রাজ্যের “জল মহল“। ত্রিপুরার ‘হ্রদ প্রাসাদ‘ হিসাবে পরিচিত, নীরমহল একটি গ্রীষ্ম বসবাসের স্থান হিসাবে নির্মিত হয়েছিল। সুন্দর রুদ্রসাগর হ্রদে প্রাসাদ নির্মাণের জন্য মহারাজা বীর বিক্রম মাণিক্য বাহাদুরের ধারণা ছিল এবং ১৯২১ সালে তিনি তাঁর প্রাসাদ নির্মাণের জন্য ব্রিটিশ কোম্পানি “মার্টিন ও বার্নসকে” স্বীকৃতি দেন। কাজটি সম্পন্ন করার জন্য কোম্পানিটি নয় বছর সময় নেয়। মহারাজা বীর বিক্রম মাণিক্য বাহাদুর ‘মাণিক্য রাজবংশের‘ ছিলেন, যা আজ বিশ্বের একক শাসক লাইন থেকে দ্বিতীয় বলে মনে করা হয়।

প্রাসাদ হল মহারাজার মহান দূরদর্শিতা এবং হিন্দু এবং মুসলিম ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির মিশ্রণের তার চিত্তাকর্ষক ধারণা।

প্রাসাদটিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়। প্রাসাদটির পশ্চিমাঞ্চল অন্দর মহল নামে পরিচিত। এটা রাজকীয় পরিবার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। পূর্ব দিকের একটি খোলা আড়ম্বরপূর্ণ থিয়েটার যেখানে নাটক, থিয়েটার, নাচ এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলি মহারাজা এবং তাদের রাজকীয় পরিবারের আনন্দ উপভোগের জন্য সংগঠিত হয়।

রুদ্রসাগর লেকে অবতরণে নীরমহল দুটি স্টারওয়েজ ঢুকিয়েছে। ‘রাজঘাট‘ থেকে হাতে চালানো নৌকা দিয়ে মহারাজ প্রাসাদে যান।

১২২ মিটার লম্বা কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে দুধ-সাদা রঙের প্রাসাদে রয়েছে সর্বমোট ২৪টি কক্ষ, যাকে ঘিরে রয়েছে সুন্দর বাগান। প্রাসাদের গম্বুজ আকৃতির মিনারগুলি, বিরাট ‘দরবার কক্ষ’, রাজা-রানির বিশ্রামকক্ষ, সুউচ্চ নজরমিনার সবই চমৎকৃত করবে। রুদ্রসাগরের পাড় থেকে জলের মধ্যে থাকা নীরমহলকে দেখে রাজস্থানের উদয়পুরের লেক-প্যালেস ‘জলনিবাস’-এর পিছোলা লেকের উপর অবস্থিত কথা মনে পড়বে। রুদ্রসাগর লেকের জলেও পড়ে নীরমহলের প্রতিবিম্ব। ৫.৩ বর্গকিলোমিটার আয়তনের রুদ্রসাগর সরোবর বিভিন্ন ধরনের পাখির বিশেষত পরিযায়ী জলকেলির এক নিরাপদ ঠাঁই। নীরমহলের প্রশস্ত ছাদ থেকেও রুদ্রসাগরের এক দারুণ দৃশ্য চোখে পড়ে।

যেটুকু সৌন্দর্য কথা,সৌন্দর্য মালা আমাদের সামনে দিয়ে যেন বা আমাদের সামনে কোনো সিনেমার ছবি হয়ে ছুটে গেল সেই শব্দমালাদের যে শিল্পিত রূপ তার বর্ণনায়।নীরমহলের ছায়ার আলোয় ইতিহাসে ভূগোলে করার চেষ্টা হল তা হয়তো অসম্পূর্ণই।প্রকৃত প্রস্তাবে যেকোনো রস ও সৌন্দর্য তো আসলে অপূর্ণই।অপূর্ণতাই তার সুন্দর হয়ে উঠার বহুমাত্রিক গুণ।
1

প্রবন্ধ - অম্লান রায় চৌধুরী

Posted in






এখন ফোন ইন্টারনেট সহ অন্যান্য ডিভাইস আমাদের জীবনের এতখানি
দখল করে নিচ্ছে যে বাস্তবের সঙ্গে আমরা তাল মিলিয়ে চলতে পারছিনা।
প্রতিক্ষণ আমাদের মনে হচ্ছে দুনিয়ায় হরেক রকমের ইভেন্ট ঘটে
চলেছে । সে সবের সঙ্গে সংযুক্ত ও সম্পৃক্ত না থাকতে পারলে বেঁচে থাকা
অর্থহীন । তাই আমি আইসক্রীম কিনতে গিয়ে ভারচুয়াল দুনিয়ায় একটানা
সফর করতে থাকি , আর এমনটা বুঁদ হয়ে যাই , শেষ মেশ আইসক্রীম আর
কেনা হয়না । হয়তা অন্য কিছু করে বাড়ি এলাম , আসল কাজটা এভাবেই
হয়না। এই প্রবণতা কে বলা হয় ‘ফোমো’ – যার অর্থ -- ফিয়ার অফ
মিসিং আউট । যার সঙ্গে মিশে থাকে বেশ মিঠে কড়ায় দানা বাঁধা আশঙ্কা
, উদ্বেগ ।

‘ফোমো’ র আগের ধাপ ‘ইয়েলো’ (ইউ অনলি লিভ ওয়ান্স)।
‘ফেমো’ র স্রষ্টা প্যাট্রিক ম্যাকগিনিস এর বিবরণ দিয়েছেন নিজের
জীবনের আখ্যান দিয়ে । নতুন শতকের একেবারে শুরুর পর্ব সেটা।
এই ফোমোর বিষয়টা এখন বেশ চালু। দেখা যায় সব সময় । একসময় আমি
ভাবতাম ‘ফোমো’র সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিশাল কোনো অঘটন বা আঘাত বা
এমন কিছু ঘটনা যা অনুমেয় যোগ্যও নয় – যেমন ৯/১১ দিনটির
ভাঙ্গচুরময় অভিজ্ঞতা। কিন্তু দেখলাম সেটা ঠিক নয় । ভুল ভেবেছিলাম ।
ফোমো মানুষের চেতনে অনেক আগে থেকেই বিরাজ করছে । বহু মানুষ আছে
যাদের দেখা যায় দিনের শুরু থেকেই শুধু খুঁজে ফেরে সুযোগ , সে কম পয়সায়
খাবার পাওয়া থেকে আরম্ভ করে , বেশী ডিসকাউন্টে ইলেকট্রনিকস
গুডস পাওয়া – সব কিছুর খোঁজ তার নখ দর্পনে। তাদের পাওয়ার জন্য
মরিয়া , এদের কাছে হারিয়ে যাওয়ার অপশন অনেক , কোনোটাকেই তাই
ছাড়তে চায়না , হয়ত মোবাইলের মতন এক জায়গায় দেখতে পায়না কিন্তু
খোঁজ পায় , কথা বলে , নিজের জীবনের ঝুঁকিকে সামনে রেখেও চলে এই
বাক্যালাপ , এটা তার আনন্দ , না হারিয়ে ফেলার আনন্দ , একেবারেই
‘ফোমো’য় আকৃষ্ট নিবিষ্ট – এক প্রকৃষ্ট বা ক্লাসিকাল উদাহরণ ।
তবে ঐ ‘ফোমো’ ও তার কনসেপ্টকে -- সোস্যাল মিডিয়া – এখনকার
ফেসবুক ও ইন্সটাগ্রাম – সম্ভবত আগুনের শিখার মতন একেবারে উসকে
দিয়েছে । করে তুলেছে ফোমোকে একটা ভয়াল ‘মডার্ন এপিডেমিক’ ।
প্যাট্রিক জে ম্যাকগিনিস, এই ফোমো কনসেপ্টের স্রষ্টা , দেখতেন তার
বন্ধুদের মধ্যে , যখন তিনি হার্ভার্ডে পড়তেন , কি ভীষণ রকমের
উত্তেজনা – ঐ ফেসবুক , ইন্সটাগ্রাম ইত্যাদি নিয়ে । কি অপরিমিত সময়
তারা ব্যবহার করত সেই সময় । এটাকেই উনি দেখতেন একটা ‘ক্রনিক
সিন্ড্রোম’ হিসাবে , এবং পরবর্তী কালে তাদেরকেই দেখতেন , যে তারা
আর পারছেনা তাল মিলিয়ে চলতে জগতের সঙ্গে ।এটা ক্ষতি , চরম
ক্ষতি। এই প্রসঙ্গে একটা ব্যাঙ্গাত্মক লেখা ম্যাকগিনিসের খুব মনে
পড়ে , সেখানে তিনি Two Fo’s নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন , একটা
ফো হলো ‘ফোমো’ যা আগেই বলেছি আর একটি হলো ‘ফোবো’ – ফিয়ার
অফ আ বেটার অপশন।

আরও আশ্চর্য লাগে যখন ম্যাকগিনিস সম্বন্ধে পড়ি এবং জানতে পারি
যে উনি বেশী চিন্তিত ছিলেন ‘ফোবো’ নিয়ে অথচ সারা দেশ চিন্তিত ছিলো
‘ফোমো’ নিয়ে। ওনার যুক্তি ছিল, যে, ফোমো কখনও আপনাকে নষ্ট করে
দেবেনা, আপনাকে আত্মা অবধি ব্যার্থ ও ক্ষয়িষ্ণু করে তুলবেনা ।
কিন্তু ফোবো তা করতে পারে । তার মতে, ফোবো আসলে মানুষকে কমিটেড
হতেই দেয়না। তাকে একটা সংশয়ের মধ্যে রাখে, সম্ভবত, হয়তো, এই
দোলায় সারাক্ষণ দোলায় । আসলে ফোবো একটি সিদ্ধান্তহীনতার
অভিশাপ ।

কোনো পরিকল্পনাকেই স্বতস্ফুর্ত ভাবে গ্রহণ করবার মতন মানসিকতা
তৈরি করতে দেয়না । এই ভয়টা আছে । অনেকেই বা বহু ক্ষেত্রেই মনের
মধ্যে একটা ‘আরো ভালো’ অথবা বোধ হয় ‘আরও একটু দেখা’ যেতে পারে
– এই সমস্ত ভাবনাগুলোকে প্রশ্রয় দেয়। তারা সব সময় ‘আরো ভালো’র
সন্ধানে মত্ত থাকে , আসল কাজের জিনিষটা শেষে পাওয়া হয়না । এই
ভীতিটা ম্যাকগিনিসের আছে এবং তার ব্যাক্ষায় বেশ দেখা যায় ।
দেখা যায়, দুটো চাকরীর অফার, ঠিক করতেই পারলোনা, দ্বীধায়,
সিদ্ধান্ত নিতে পারলোনা -- কোনোটাতেই শেষে জয়েন করা হলোনা । কিংবা
বেড়াতে যাওয়ার জন্য নানান জায়গার অপশন, বাছাবাছি করতে করতে
ভ্যাকেশন শেষ, যাওয়া হলোনা – এমনটা হয় , হচ্ছে , আর এটাই ‘ফোবোর’
ফল।

আসলে দ্বীধার মাত্রাটাকে বড় বেশী জোড় দেওয়া হয়, তাই সিদ্ধান্তের
ক্ষেত্রেও ততটাই শিথিলতা ।

‘ফোমো’ তে ব্যাক্তি মানুষ নিজে কষ্ট পায় । কিন্তু ফোবোর যাতনা সইতে
হয় আরও অনেক মানুষকে । ‘ফোবো’ ছেড়ে চলে যায়না, ফলটা চলতে থাকে
জীবনের অনেক দুর পর্যন্ত, কাজেই কাছ ছাড়েনা। অবচেতনকে কখনো
ছাড়েনা । বেশী বয়সে গিয়ে মনে পড়ে, ভুল সিদ্ধান্ত, জ্বালায়, করার কিছুই
থাকেনা । মানুষকে আরও আত্মসর্বস্ব বানায় ।

এখন দেখা যাক উপায় কী ? দেখা যাক না যে জীবন , শান্ত , বাগানে
দোয়েলের টানে --ফড়িংয়ের হুটোপুটিতেও শান্তভাবে পাখী শিস দিয়ে গান
গায় – এমন অবস্থাটাকে বরণ করা যায় কিনা । আরো ভাল কিছু না পাওয়া
অবধি পক্ষ অবলম্বন করবনা, এমন নির্বোধ আচরণ না হয় নাই–ই বা
করলাম । কারন আরো ভালোর কোনো নিশ্চয়তা নেই – এটাকে মাথায়
রাখতে হবে – ভবিষ্যতের উপর নিজের ইচ্ছাকে চাপিয়ে দেওয়াটা ঠিক নয়
, ফল ভালো হয়না , তার প্রমাণ আছে ঝুড়ি ঝুড়ি – সমাজ থেকে কিংবা
পুরান থেকে - অনেক আছে জীবনে – তাই ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ বলতে পারা অনেক
ভালো , ‘হয়তো’ বলার চেয়ে।

এতেই জীবন সহজ ও আনন্দময় হয় । গ্যারান্টি দিচ্ছেন কিন্তু সেই
মানুষটিই যিনি ‘ফোমো’ আর ‘ফোবো’, এই দুইয়েরই স্রষ্টা।
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in












নবনীতা দেবসেন: নারীকেন্দ্রিক জীবনদৃষ্টি




প্রিয় বাসু,

গতকাল সন্ধ্যায় তোমার চিঠি পেলাম। আকাশ কাঁসার বাসনের মতো রঙে ধূসর হয়ে আছে। কিছু পাখপাখালি আকাশে উড়লে মনে হয় খড়কুটো উড়ছে। কর্পোরেট জীবনের ব্যস্ততায় আগের মতন পড়তে পারি কোথাায় বলো! বিগতা যৌবনা শব্দটা ব্যবহার করে খোঁচা দিলে মনে হলো তবে তা তুমি বলতেই পারো। আগের মতন রোজ কবিতা পড়া হয়না তাই বলে ভেবো না সব ভুলে গেছি। খুব প্রিয় একটা কবিতার শেষ কটি লাইন তোমার সমস্ত চিঠির উত্তর হতে পারে।

আমি তোমার হই
তুমি
আমার কোলের শিশু হ'য়ে আমাকে বরণ করো
আমাকে হরণ করো
পূরণ করো।

বিংশ-একবিংশ শতকের বাংলা সাহিত্যে নবনীতা দেবসেন একজনই। তিনি উচ্ছল, সহাস্য, সুদূরপিয়াসী, কখনো তির্যক, কখনো ক্রুদ্ধ, প্রয়োজনে কঠোর। ছেলেভোলানো রূপকথা থেকে অচঞ্চল কবিতা, সরস ট্রাভেলগ থেকে প্রশ্নাত্মক অ্যাকাডেমিক রচনা – সবকিছুতেই তাঁর অনায়াস বিচরণ। তিনি ঠিক যতটাই ধ্রুপদি, ততটাই আধুনিক বা সমকালীন। তাঁর প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম প্রত্যয়‘ প্রকাশ পায় ১৯৫৯ সালে। তখন তাঁর মাত্র একুশ বছর বয়স। এই কাব্যগ্রন্থের ‘বৃন্তহীন একটি গোলাপ‘ কবিতাটির কথা মনে আছে? কবিতার শুরু এই রকম: “কিন্তু, তুমি এখন তো জানো/ বর্ণ গন্ধ ফুলের জঞ্জালে/ বুক রেখে কিংবা মুখ রেখে/ কোনো লাভ নেই।” বক্তব্য খুবই স্পষ্ট। কিন্তু চোখে লাগে ‘জঞ্জালে‘ শব্দটি। বর্ণ গন্ধ ফুল তাঁর পূর্ববর্তী সব কবিদের কাছে মহার্ঘ ছিল। নবনীতা এক কালোপযোগী তিক্ততা হানেন বর্ণ গন্ধ ফুলের প্রতি, ওই ‘জঞ্জালে‘ শব্দটি প্রয়োগ করে। কবিতাটিতে শুধুমাত্র ওই একটি শব্দই আধুনিকতার নিশান ওড়ায়। নবনীতা দেবসেনকে পড়তে গিয়ে কোথাও মনে হবে না প্রতিবাদী চেতনার বিস্ফোরণ আছে। দুঃসাহসী দামাল নবনীতার অকুতোভয় প্রকৃতি সেখানে ডালপালা মেলেনি। এজন্য তাঁর নারীবাদী চেতনায় বিদ্রোহী বিকার নেই, রয়েছে স্বাধিকারবোধে অসহনীয় আত্মপ্রত্যয়। ‘নারীবাদী লেখক’ তকমা আঁটাতে আপত্তি। কিন্তু, মেয়েদের অধিকার আদায়ের পক্ষে, অন্যায়ের প্রতিবাদে তাঁর প্রিয় টেম্পলপেড়ে মেরুন শাড়ির আঁচলের তলার প্রদীপটি মশাল হয়ে জ্বলে ওঠে। সে মশালের আলো ও আগুন ঝরে অক্ষরে। বাংলার রক্ষণশীল সমাজে নবনীতা আজীবন ডানপিটে পরিচয়ে সমুজ্জ্বল ছিলেন। নিজের মতো করে বেঁচেছেন হার না-মানা প্রকৃতিতে। ব্যক্তিত্বের বহুমুখী বিস্তারে নবনীতা মা রাধারানিকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন কখনও কখনও। নবনীতার কবিতাগুলিকে মনে হয় তাঁর স্পষ্টশ্রুত স্বগতোক্তি। কবিতার মধ্যে দিয়ে নবনীতা আসলে যেন নিজের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, তাঁর সব দুঃখ-শোক বা প্রণয়বাণী নিজেকেই শোনাতে চেয়েছেন। নবনীতার কবিসত্তাতেও নারীজীবনের বহুমাত্রিক প্রতিবাদী চেতনা সবাক্‌মূর্তি লাভ করেছে। পিতৃতান্ত্রিকতা থেকে মুক্তিপিয়াসী নবনীতা ত্রাতা হিসাবে পুরুষের রাজকীয় ভূমিকাকে মেনে নিতে পারেননি। ওঁর সারাজীবনের কবিতাতেই এক অতৃপ্ত প্রেমতৃষ্ণা ধিকিধিকি জ্বলতে দেখা যায়। প্রেমের রাশ হাতে রেখে পুরুষই বলতে চেয়েছে শেষকথা, নারী বাধ্য হয়েছে তা পালন করতে। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, আত্মস্বাধীনতা বিসর্জন দিয়ে অর্জিত প্রেমের রাজদণ্ডধারী রূপ ক্রমে প্রকট হবার সঙ্গে সঙ্গে, নিঃস্বার্থ সমর্পণের অবমূল্যায়ন বুঝতে শিখেছে নারী। এর মধ্যেকার ‘ঐতিহ্যপ্রসূত’ মহনীয়তা শিকারি ও শিকারের বাস্তব সম্পর্কে জর্জরিত। প্রেমিক হলেন প্রভু, নারীর আত্মোপলব্ধি ‘শিকার’ হিসাবে। নবনীতা তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম রাখলেন ‘লায়নটেমারকে’ (১৯৮৯-১৯৯৫)। নামকরণের মধ্যে পুরুষতন্ত্রকে আক্রমণের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত। তবে এই আক্রমণ, প্রতিবাদ ধ্বনিত হল নারীর নিজস্ব যন্ত্রণার সমাজতাত্ত্বিক প্রকাশে। কবি যেন নিজের থেকে এক নৈর্ব্যক্তিক দূরত্ব বজায় রেখে নিজের চোখে আঙুল দিয়ে নিজেকেই চেনাতে চাইলেন প্রহার-দগ্ধ নারীর বিকৃত স্বরূপ। নবনীতার কবিতার আরও একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, তার একাকীত্বের সুর। প্রেমের ডাকে সাড়া দিতে আকুল কবি। কিন্তু প্রণয়মুকুটের বদলে তাঁকে যেন চিরদিন শিরোধার্য করতে হয়েছে বিরহের বা নিঃসঙ্গতার কাঁটা। নবনীতা সেই শ্রেণির কবি, যিনি নিজের বক্তব্যকে পাঠকের কাছে জটিল অস্পষ্টতায় পেশ করতে চান না। তাই তাঁর কাব্যভাষা খুব সহজ। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে, তাঁর কবিতা সবলে সমস্ত পেশি ফুলিয়ে এক অত্যাশ্চর্য শক্তিরূপ প্রকাশ করতে পারে না। বড় বিনম্র তাঁর কাব্যভাষা। তাঁর উৎকৃষ্ট কবিতাগুলির সঠিক পরিচয় পাঠককে পেতে হয় সেই নম্রতা স্পর্শ করে। কবিতার প্রচ্ছন্ন ব্যঞ্জনার ছটা আটপৌরে প্রকাশভঙ্গিতে হয় হৃদয়ের সম্পদ।

তোমাকে এত বছর পর এইসব কেন লিখছি, লেখার কোন মানে আছে কিনা তাও জানিনা। তবে তোমার চিঠি অজান্তেই উস্কে দিচ্ছে অনেক কিছু। নবনীতা দেবসেনের কোন এক লেখায় পড়েছিলাম ‘সংসারের কোনো কোনো বাসন কোসন, কাপ পিরিচ সম্ভাব্য বন্ধুরতা অতিক্রম করে বিস্ময়করভাবে বহুদিন টিকে থাকে, কিন্তু একদিন হয়ত দেখা যায় যে জন্য এত আয়োজন, সেই সংসারটাই টেকে না, সম্পর্ক ভেঙে যায়।’ অমর্ত্য সেনের সঙ্গে বিয়ে এবং বিচ্ছেদ সম্পর্কে রসিকতার ছলে এক হৃদয়গ্রাহী স্বীকারোক্তি, অনেকটা জীবন পেরিয়ে এসে মনে হয় না কি চরম সত্য খেলাচ্ছলে লিখে দিলেন? আমাদের সম্পর্কটাও…

বিদ্রোহের সরবতাই বিপ্লবের আগমনী বার্তা বয়ে আনে। অথচ সেই সরবতা উচ্চকিত না হয়েও যে বৈপ্লবিক চেতনার বিস্তার করা যায়, তা লেখিকা নবনীতা দেবসেন দেখিয়ে দিয়েছেন। নারীবাদী লেখিকা হিসাবে কখনই তিনি সরব হয়ে ওঠেননি। অথচ, তার অবকাশ ছিল। তাঁর পরিবারের মধ্যেই সে রসদ মজুত ছিল। তাঁর মধ্যে পুরুষশাসিত সমাজে নারীদের বৈষম্যপীড়িত জীবনবোধে বলিষ্ঠ প্রতিবাদী চেতনায় নারীবাদের পরিচয় নানা ভাবেই প্রকাশমুখর। ছোটবেলায় ছোট ভাই দিদিকে মারলেও দিদি মারতে পারবে না, দিদিকে তা সহ্য করার চেতাবনির মধ্যে তাঁর মেয়েদের অন্যচোখে দেখার চেতনা জেগে উঠেছিল। সমাজে পুরুষের আধিপত্যে নারীদের আনুগত্যবোধের মধ্যে তাঁর প্রতিবাদী চেতনাই তাঁর বৈদগ্ধপূর্ণ বনেদি অবস্থানে আত্মপরিচয়ের সোপান হয়ে উঠতে পারত। সেখানে তাঁর আমৃত্যু ডাকাবুকো চরিত্রপ্রকৃতিই তাঁর সঙ্গতের পক্ষে যথেষ্ট সরব ছিল। বাংলার রক্ষণশীল সমাজে নবনীতা আজীবন ডানপিটে পরিচয়ে সমুজ্জ্বল ছিলেন।

হাসতে হাসতে এক কাপড়ে ট্রাকে চড়ে অরুণাচল সীমান্তে ভারত-চিনের ম্যাকমোহন লাইন ছুঁয়ে এসেছিলেন। তাঁর ভ্রমণকাহিনি ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমোহনে’। আবার হায়দরাবাদে সেমিনারে গিয়ে কুম্ভমেলায় গিয়েছেন একাকী। তাঁর লেখনীর পরশে তাই ‘করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে’ ভ্রমণসাহিত্যে প্রতিমায়িত হয়েছে। এ ভাবে দুরারোগ্য ব্যধিকে উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়েছেন পৃথিবীর দুর্গম পথে, বাংলা সাহিত্যে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতায় অসংখ্য ফসল ফলিয়েছেন অবলীলায়।

তোমার মনে আছে আমাদের বমডিলা ভ্রমণের কথা। পাহাড়ের গায়ে অজস্র স্ট্রবেরি গাছে লাল স্ট্রবেরি ঝুলে রয়েছে। অয়ন, তুমি আর সোমজা পাকদণ্ডি পথে পাহাড়ের উপরে উঠে হারিয়ে গেছিলে। হঠাৎ এক পশলা বৃষ্টি সহসাই আকাশ সোনালী রোদে ঝলমল। কুয়াশায় হারিয়ে যাওয়া রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তোমাদের খুঁজে পেলাম পাহাড়ের উপরে মনস্ট্রিতে। প্রার্থনা কক্ষে শাক্যমুনি বুদ্ধের বিশাল মূর্তি। মূর্তির একপাশে অবলোকিতেশ্বর ও অন্যপাশে রিনচেংপংযের মূর্তি। মনস্ট্রির মধ্যে ছায়াছন্ন বন্য ধুপের গন্ধ বাতাসে মিশে গিয়ে এক রহস্যময় প্রাচীনত্বের আভাস ছড়িয়ে পড়ছিল। আচ্ছা, আমাদের যে দিন গেছে সে কি একেবারই গেছে?

নবনীতার গল্পে অধিকাংশ নারী মধ্যবিত্ত শ্রেণির। তারা একদিকে আজন্ম-লালিত সংস্কারকে আঁকড়ে থেকেছে আবার সেই সংস্কারের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে উত্তরণের পথ খুঁজেছে। যেমন ‘বিমাতা’ গল্পের তাপসী। তাঁর গল্পের নারীরা জীবনের কথা বলে। ‘গদাধরপুর উইমেন্স কলেজ’ গল্পের কথক একজন নারী। সে চায় আত্মপ্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক মুক্তি। স্বামীর সংসারে অস্তিত্বহীন স্ত্রীর চরিত্র প্রথমদিকে তার ভালো লাগলেও একসময় খারাপ লাগতে থাকে। সে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়; কিন্তু সংসার ভেঙে নয়, সংসারে থেকেই। ‘এক্সপেন্স একাউন্ট’ গল্পটিতে একজন ছোট পিসিকে পাই আমরা, যিনি বৈশ্বিক আবহাওয়ায় বদলে যাওয়া কলকাতাকে দেখে ব্যথা পান। মেনে নিতে পারেন না। সুকৌশলে তিনি চারপাশের মানুষগুলোকে পুরনো দিনের ঐতিহ্যের কথা শোনান। ‘দাদামনির আংটি’ এক সাধারণ গৃহবধূর অসাধারণ হয়ে ওঠার কাহিনি। দাদামনির আংটি চুরি গেলে এই বধূ থানায় ডায়েরি করতে যায়। থানা ডায়েরি নিতে আপত্তি করে। বধূ প্রতিবাদ করে। সাফ সাফ বলে দেয়, ডায়েরি না নিলে তিনি নিজেই কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তার নামে এফআইআর করবেন। ‘পরীর মা’ গল্পের মা নিজের সন্তানকে ঘটনাচক্রে হারিয়ে ফেললেও অন্যের সন্তানকে বুকে টেনে নেন।
‘শুভমিতা প্রোপ্রাইটার’ গল্পে শুভমিতা দ্বিতীয়বার বিয়ে করলেও প্রথম সন্তান শুভকে ভুলতে পারে না। এমন অনেক মানবিক বার্তা আছে তাঁর গল্পে। আবার আধুনিক গল্পও রয়েছে। ‘আর্টিফিশিয়াল ইনসেমিনেশন’ তেমন একটি গল্প। এ-গল্পে এলিজাবেথ এক অসাধারণ নারী। সে অন্য পন্থায় সন্তান ধারণ করে কারো বাধা না মেনে। একটি অসাধারণ বাক্য আছে এ-গল্পে, ‘মায়ের মুখের একটা কথার ওপরে বাবার বাবাত্ব টলমল করছে। আর তো কেউ জানে না প্রকৃত বাবাটি কে!’ তাঁর গল্পে নারীর বহুমাত্রিক রূপ আমরা দেখি। গল্পের নারীরা হিংস্র নয়। পুরুষের ব্যাপারে তাদের অনীহা বা অশ্রদ্ধা নেই। প্রতিহিংসাও তারা দেখায় না। তাদের প্রতিবাদ পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। যা কিছু পুরনো তার বিরুদ্ধে। পুরনো ঐতিহ্যের মাঝে যে ভালো থাকে সেই ভালো বার্তাই পাই আমরা তাঁর সাহিত্যে।

পড়ন্ত বেলার রোদ্দুর পশ্চিমের জানলা দিয়ে লাল মেঝের ওপর গড়িয়ে পড়ছে। আমাদের দিনগুলি আর হয়ত ফিরবে না। পিছনের দিকে ফিরে গিয়ে ভাবলে মনে হয় কোন রূপকথার গল্পে হারিয়ে যাচ্ছি। অনেকদিন ধরেই একটা সন্ধ্যাজুড়ে তোমাকে চিঠি লিখতে চাচ্ছিলাম। ‘মাঝে মাঝে ভাবি। সবই কি তাহলে মিথ্যা? সব ভাবনা কি মিথ্যা? আমি আমার আত্মাকে জিজ্ঞেস করি। আমি কত যে খুশি হতাম যদি তুমি আমার মনের এই আর্তিটাকে বুঝতে পারতে! সন্ধ্যার সব হৈ হুল্লোড়, আড্ডায় কেন জানি বড় একা লাগে মনে হয় প্রেমহীন নাগরিক জীবনে, হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীতে আজ সবাই খুব নিঃসঙ্গ।

রূপকথার কথায় মনে পড়ল নবনীতা দেবসেনের রূপকথা। তাঁর প্রিয় বিষয় রূপকথা। আদর্শ জীবন, আদর্শ মানুষ, আদর্শ সমাজ তৈরির সুযোগ আছে রূপকথায়। তাঁর রূপকথায় মেয়েরা কুশীলব। রানি এসে রাজাকে উদ্ধার করে। রূপকথায় পুরুষরাই চিরদিন মেয়েদের উদ্ধার করে। মেয়েদের বন্দি করে, পেটায়, কাটে আবার উদ্ধারও করে। পুরুষই তাদের কষ্ট দেয়, আবার তারাই উদ্ধার করে। মেয়েদের আসল চেহারা নেই, তারা শুধুই বন্দিনী। ছেলেদের তুলনায় প্যাসিভ। তাঁর রূপকথায় মেয়েদের পজিটিভ ও অ্যাকটিভ রোল তুলে ধরা হয়েছে। তারা উদ্ধার করে যুদ্ধ করে নয়, অস্ত্রবলে নয়, বুদ্ধির অস্ত্রবলে। কেন রূপকথা লেখেন তা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, "আমার রূপকথার গল্পগুলি সেই পড়ুয়াদের জন্যে, যাদের বুকের মধ্যে শৈশব অমলিন আছে"। ‘চন্দনরাজার বউ’ গল্পে দেখা যায়, চন্দনরাজা সারাদিন মৃত্যু কোলে ঢলে থাকেন, শুধু মধ্যরাত্রে বেঁচে ওঠেন। কয়েক ঘণ্টা পর আবার মৃত মানুষে পরিণত হন। চন্দনরাজাকে এই ভয়ংকর অবস্থা থেকে মুক্ত করেন রাজকন্যা চন্দনী। ‘পদ্ম কদম’-এ রাজপুত্র কদমকুমারকে পহ্লবী রাজার কারাগার থেকে জেলেবাড়ির মেয়ে পদ্মকুঁড়ি উদ্ধার করেন। ‘সুসনি-কল্মি’ গল্পে রয়েছে, গরিব দুই বোন ছাগলের দুধ খাইয়ে রাজার দুরারোগ্য ব্যাধী সারিয়ে দেন। দুই রাজপুত্রের সঙ্গে বিয়ে হয় সেই দুই বোনের। আবার, ‘বোকা রাজার বুদ্ধিমতী রানি’ গল্পে দেখা যায়, রাজা যতবার বেরোন যুদ্ধ করতে, রানি ততবারই স্বপ্নের গল্প ফেঁদে রাজাকে বিরত করেন। রাজকর্মচারীরা বিপদে পড়লে তাঁদের পরামর্শ দিয়ে রক্ষা করেন পাশের রাজ্যের রাজকন্যা। রানির উদ্যোগের সেই রাজকন্যা রাজার বৌমা হলেন। বিয়ের পর একদিন ওই মেয়ে তাঁর শ্বশুরকে দিয়ে অঙ্গীকার করিয়ে নিলেন, তিনি কখনও আর যুদ্ধযাত্রা করবেন না। এইভাবে নবনীতা তাঁর রূপকথার গল্পগুলোতে নারীশক্তির জয়গান গেয়েছেন। ইচ্ছেমতী, রূপসা, পদ্মমুখী, পুঁটুরানী সব চরিত্ররাই যেন আসলে নবনীতার ছায়া হয়ে ওঠে। তারা যুদ্ধ করে না। অস্ত্র ধরে না। কিন্তু জয় করে নেয় শক্রুকে। শুধুমাত্র মেধা, মনন আর ভালোবাসা দিয়ে।

বৃষ্টি থেমে গেছে। শেষ বিকেলের নিস্তেজ শীর্ণ আলোতে প্রকৃতি, তার সবুজ, হলুদ, লাল, কালো নানা-রঙা নিশান উড়িয়ে দেয় আকাশে আকাশে, বহুবর্ণ গালচে বিছিয়ে দেয় জমিতে, উজ্জ্বল, অগণিত স্পন্দিত তারা আর জোনাকির ঝাড়লণ্ঠন ঝুলিয়ে দেয় আকাশের চাঁদোয়ার নীচে; অন্ধকার রাতে। জঙ্গলের মধ্যে জঙ্গল, গাছের মধ্যে গাছ, পাতার মধ্যে পাতা, ফুলের মধ্যে ফুল, স্মৃতির মধ্যে স্মৃতি সেঁধিয়ে যায়। মেয়েদের ভিতরে একটা আলাদা চোখ থাকে জানো তো? সেই চোখ দিয়ে দেখছি। তুমি গেট ঠেলে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলে না। জানো, প্রথম প্রথম তোমার কথা মনে পড়লে কী কষ্ট যে হত, তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। সেইজন্য আমি আস্তে আস্তে তোমার মুখচ্ছবিখানি বদলে দিয়েছি। এই যে পাহাড়, এই যে ছোটো নদী, ফুলের সমারোহ, প্রজাপতি এমনকি কাঠঠোকরা পাখিটির মধ্যেও ভাগ ভাগ করে দিয়েছি তোমাকে। ভাালো থেকো নিরন্তর। আশা করি দ্রুতই তোমার চিঠি পাবো।

শুভেচ্ছান্তে-

সুস্মি

২৪ নভেম্বর,২০২৪


0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in






ওরা কোনো কথা শোনে না। হাসতে থাকে সবাই। একসঙ্গে অন্তত গোটাদশেক হাত বের্শেনকে বয়ে নিয়ে যেতে থাকে। বসার ঘরে যেখানে টেলিফোন আছে, সেখানে সবাই মিলে ওকে নিয়ে যায়। সেখানে গের্ট একটা চওড়া চামড়া দিয়ে মোড়া আরামকেদারাতে বসে টেলিফোনে ডায়াল করছে। গের্ট বের্শেনকে নিজের হাঁটুর উপরে বসিয়ে হাতে টেলিফোনের রিসিভার ধরিয়ে দেয়।

‘হ্যালো’… বের্শেন কণ্ঠ থেকে বিরক্তির ছাপ এখনও মুছে ফেলতে পারেনি… ‘আমি কি ফ্রয়লাইন ইনেসের সঙ্গে কথা বলতে পারি?’

কেউ একজন ওপাশ থেকে পাল্টা প্রশ্ন করে, ‘কে কথা বলছেন ফোনে?’

‘বের্নহার্ড’ বলে কয়েকমুহূর্ত পরে বের্নহার্ডের খেয়াল হয় যে তার একটা ডাকনাম আছে এবং ইনেস তাকে সেই নামেই ডাকে। ইনেস তাকে জিজ্ঞেস করে যে সে ঠিকঠাক আছে কি না।

-‘না’ বলে বের্শেন, ‘কিন্তু তোমার আজ আসা উচিত ছিল একবার। সবাই ভেবেছিল তুমি আসবে। গের্ট, ফার্দিনান্দ… ‘

-‘কিন্তু তাতে তোমার কী, বের্শেন?’ ইনেসের কণ্ঠস্বরে শীতলতা, বন্ধুত্বের উষ্ণতা একটু কম মনে হয়।

-‘আ… আমি জানি না, জানি না’ বের্শেন তুতলে যায়… ‘আমি… আমরা ফেয়ারওয়েল পার্টি করছি।’

-‘আচ্ছা, বুঝলাম। সেইজন্য সবাই মাতাল হয়ে গেছে! কিন্তু বের্শেন, তুমিও?’

বের্শেন থমকে যায়….

-‘আরে… কথা তো বলো। চুপ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন?’ বাকিরা সমস্বরে চেঁচিয়ে বের্শেনের হাত থেকে রিসিভার কেড়ে নিয়ে কথা বলবার চেষ্টা করে। কিন্তু ইনেস লাইন কেটে দিয়েছে ততক্ষণে। সমস্বরে চিৎকার এবং এরকম অদ্ভুত অভিযোগ সে একেবারে পছন্দ করে না।

কিন্তু ফার্দিনান্দকে থামানো যাচ্ছে না। সে বসবার ঘরের সিঁড়ি দিয়ে সমানে ওঠানামা করছে। তার মুখটা সাঙ্ঘাতিক ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বড় বড় চোখদুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে।

‘একবার, অন্তত একবার কি সে আসতে পারত না আমায় বিদায় জানাবার জন্য?’ বন্ধুদের সামনে দাঁড়িয়ে ফার্দিনান্দ বলে যায়… ‘তোমাদের কি মনে হয় না যে তার আসা উচিত ছিল?’ ঘরের সিলিঙের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে অভিযোগ জানাবার ভঙ্গিতে সে বলে আর পায়চারি করে।

ছেলেরা প্রায় কেউই খেয়াল করেনি কখন দরজার বেল বেজেছে। হঠাৎ লুডভিগ তাড়াতাড়ি নিচে দৌড়ে গেল আর সবাই ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝে উঠবার আগেই দেখল যে ইনেস এসে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়েছে। ফার্দিনান্দের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে সে। ফার্দিনান্দের দৃষ্টি একদম শূন্য।

‘শুভ সন্ধ্যা, ভদ্রমহোদয়গণ!’ ইনেস বলে… ‘শুভ সন্ধ্যা ফার্দিনান্দ! কিন্তু আপনার কী হয়েছে? আপনাকে অপ্রকৃতিস্থ দেখাচ্ছে।’

ফার্দিনান্দ হঠাৎ হেসে উঠল। তার কাঠখোট্টা মুখটা একেবারে বদলে গেল এই হাসিতে। দেখে মনে হল বেদনাদায়ক অন্ধকার রাত অতিক্রম করে হঠাৎ এক আলোকোজ্জ্বল ভোরের সময়ে কেউ তাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলেছে। সে অনেকক্ষণ ধরে ইনেসের দিকে তাকিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। এক অসুস্থ মানুষের দিকে লক্ষ্য রাখার মত করে বাকিরা দূর থেকে একদৃষ্টে তার দিকে নজর রাখে…

দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ফার্দিনান্দের ফেয়ারওয়েল পার্টির সন্ধ্যাতেই বের্নহার্ডের বাবা হঠাৎ করেই আগেভাগে কিছু না জানিয়ে শহরে এসে উপস্থিত হন এবং ছেলেকে বাড়িতে না পেয়ে আশ্চর্য হয়ে যান। যদিও বের্নহার্ডের বিষয়ে ঠাকুমা সবসময় ভাল ভাল কথাই বলে থাকেন, তবুও ক’দিন ধরেই তার বাবার মনে বেশ কিছু সন্দেহ দানা বেঁধেছিল। তাঁর মনে এই ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে বের্নহার্ড যথেষ্ট পরিশ্রমী ছাত্র। কারণ স্কুল এবং সঙ্গীতশিক্ষালয়, এই দুই জায়গা থেকেই ভাল ফল করছে সে বরাবর। কিন্তু অল্পসংখ্যক যে পরিবারগুলির সঙ্গে বের্নহার্ডকে মেলামেশা করতে বলা হয়েছিল, সে তাদের কারো সঙ্গেই যোগাযোগ রাখে না। শুধু স্কুলের বন্ধু কার্লের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ আছে তার। সাধারণভাবে সবাই তার সম্বন্ধে বলছে যে ‘আকর্ষণীয় এবং আদবকায়দাদুরস্ত ছেলে’; কিন্তু কেউই তাকে বেশি দেখতে পায় না। এলাকার সম্মানীয় মানুষজন, সরকারি অফিসার, যাদের বেশ ভাল পরিবার আছে, বের্নহার্ডের বয়সী বাচ্চাকাচ্চা আছে, তাদের কারো সঙ্গে বের্শেন মেশে না। তাছাড়াও সন্ধেবেলায় তাকে বলা হয়েছিল নাচের স্কুলে ভর্তি হবার জন্য। সে বলেছিল যে তার নাকি সময় নেই। সে কথা যে ডাহা মিথ্যে, সেটাও পরিষ্কার।

বের্নহার্ডের ঠাকুমা অবশ্য তার পক্ষেই দাঁড়ালেন এবং বললেন যে বের্নহার্ড মিথ্যে কথা বলেনি। সাধারণত প্রতিদিন সে রাত এগারটা অবধি খাটে। সন্ধ্যায় মাঝেমধ্যে বেরয়, যদি কোথাও বাজনার অনুষ্ঠান থাকে। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে বের্শেন লক্ষ্য করল যে এর বেশি আর ঠাকুমা কিছুই বললেন না। উল্টে তার বন্ধুদের সম্বন্ধে বেশ আপত্তিজনক কথা বলতে লাগলেন, বিশেষত গের্ট আর ইনেস সম্বন্ধে। কারণ, বের্নহার্ডের বাবা তাদের সম্বন্ধেই জানতে চাইছিলেন। পরিষ্কার বললেন ঠাকুমা যে আজকালকার ছেলেমেয়েদের ব্যাপারস্যাপার তার মাথায় ঢোকে না বিশেষ। বের্শেন এই বন্ধুদের পছন্দ করে, করতেই পারে; এদের সঙ্গে লং ড্রাইভে যায়, সেটাও আলাদা ব্যাপার। কিন্তু এদের তিনি ঠিকঠাক বোঝেন না। ঠাকুমা নিজেও অল্পবয়সে খুব ভাল পিয়ানো বাজাতেন। তার প্রতিভাও ছিল। বের্শেন যখন বাজায়, তার ভারি ভাল লাগে। বের্শেনকে তিনি ভালবাসেন, এটাও ঠিক। বের্শেন যথেষ্ট প্রতিভাশালী। কিন্তু বের্শেনকে নিয়ে তিনি চিন্তিত। তাঁর অন্যান্য নাতিনাতনিদের থেকে বের্শেন অনেকখানি আলাদা স্বভাবের। তাঁর নাতিনাতনিদের মধ্যে অনেকেই বের্শেনের থেকে বয়সে বড়; অনেকেরই বেশ ভাল শিক্ষাদীক্ষা, অনেকেই যথেষ্ট প্রতিভার অধিকারী ( এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে বের্শেনের দিকে তাকিয়ে তাঁর একথা আরও বেশি করে মনে হচ্ছে)। কিন্তু কেউই বের্শেনের মত স্বাধীনচেতা নয়। জীবনে কী করতে চায়, সেসব ভাবনার বিষয়ে তারা অনেক সহজ। যেমন, রল্‌ফ… সে তো কখনই ভাবেনি যে সঙ্গীতজ্ঞ হবে; স্কুলের পড়াশুনা শেষ করে সোজা বাবার আমদানি-রপ্তানির ব্যবসায় যোগ দিয়েছে।

কিন্তু বের্নহার্ড? সে স্কুলের পাশাপাশি সঙ্গীতের পাঠ নিচ্ছে এবং সেটা নিয়েই সে ভবিষ্যতে এগোতে চায়। বাইরে খুব নরমশরম চেহারার হলেও এই ছেলে ভিতরে ভিতরে যা ভাবে, সেটাই করে। নিজের ভাবনাচিন্তার বিষয়ে অত্যন্ত একগুঁয়ে এবং উদ্ধত। সব থেকে ভয়ের ব্যাপার হল যে সে সবসময় নিজে বন্ধু নির্বাচন করে থাকে এবং এক্ষেত্রে কারো উপদেশ মানে না। বের্শেনের এইধরণের আচরণে ঠাকুমাও বাবার মতই চিন্তিত। মাত্র সতের বছর বয়সের এক কিশোরের পক্ষে এই আচরণ অত্যন্ত বাড়াবাড়ি বলে মনে হচ্ছে অভিভাবকদের। তাছাড়াও, চেনাজানা যে বিশিষ্ট পরিবারগুলির সঙ্গে তাকে যোগাযোগ রাখতে বলা হয়েছিল, সে তাদের ধারকাছ দিয়ে যায় না। বের্শেনদের মত সম্মানিত পরিবারে এহেন অদ্ভুত আচরণ একেবারেই প্রত্যাশিত নয়। এটাই ঠাকুমার আসল চিন্তা, যেটা একটা চাপা তিক্ততার জন্ম দিচ্ছে। আসলে এমন একজনকেও পাওয়া যাচ্ছে না যে বলবে যে বের্শেন ভাল ছেলে নয়। বের্শেনের সুন্দর মুখ, খোলামেলা বন্ধুত্বপূর্ণ এবং আদবকায়দাদুরস্ত ব্যবহার সবার মন টানে। তবুও যখনই বের্শেনের প্রসঙ্গ উঠছে, কোথায় গিয়ে যেন তাল কাটছে। সবাই বলে যে সে খুবই ভাল ছেলে… তবে…; এই তবে অব্যয়টাই অভিভাবকদের ভাবিয়ে তুলেছে। কোথাও কি অবিশ্বাসের একটা বাতাবরণ তৈরি হচ্ছে? প্রত্যেকে বলছেন যে বের্শেনের প্রতিভা এবং অন্যান্য ক্ষমতা নিঃসন্দেহে তুলনাহীন, কিন্তু কোনো একটা জায়গায় সম্ভবত তাকে কেউ বুঝতে পারছে না। সে যেন এই জগতসংসারে এক অচেনা আগন্তুকের মত অদৃশ্য সুতোর বাঁধনে বাঁধা আছে। বাঁধনটা অদৃশ্য, তাই তাকে কেউ বুঝতে পারছে না ঠিকঠাক এবং পুরোপুরি বিশ্বাসও করতে পারছে না। এই অবিশ্বাসের জায়গা থেকেই অনেকের কাছে বের্শেনকে বিপজ্জনক বলে মনে হচ্ছে।

(চলবে)