Next
Previous
0

গল্প - সৌরভ হোসেন

Posted in







চৈত্রের পানি

এই অসময়ে হুট করে শিলাবৃষ্টিটা কোত্থেকে যে এল! এ নিশ্চয় আল্লাহর গজব? তা না হলে এই ঘোর চৈত্র মাসে কেনই বা হুড়মুড় করে এমন শিল পড়বে? গদগদে সবুজ ধানগাছগুলোকে মাটির সাথে নুইয়ে থাকতে দেখে সাদেরের অন্তরটা ডুকরে উঠল! সে পারলে, ধানগাছের শীষ ধরে হাউমাউ করে কাঁদে। গড়াগড়ি দেয়। মনে মনে মেঘকে গাল পাড়ল, ল্যাড়খেকি ম্যাঘ বিহানের আর সুমা পালো ন্যা? বিহালো তো বিহালো পাথরের মুতোন শিল বিহালো! অ্যাক পশলা পানি বিহালেই পাত্তোক।

সাদের জানে, ফাল্গুনের পানি আগুন। কিন্তু চৈত্রের পানিও কি কম আগুন? ফসলের দুষমন এই চৈতি বৃষ্টি। ফুঁ দিয়ে, জাড় মেখে যখন ঝেঁপে নামে, তখন চাষি হাই হাই করে, সব্বনেশে ম্যাগ পাড়িমোষের মুতন ফুঁসি উঠচে! সব ফসলপানি ইব্যার ধুয়ি মুছি লিয়ি যাবে গ!

সাদের দুব্রোঘাসে ঢাকা আলটায় লেটা মেরে বসল। জমা জলে পরনের লুঙ্গিটা ভিজে গেল। ভেজা লুঙ্গির কালহা রস তার পাছায় ঠেকল। ওদিকে হুঁশ নেই তার। খুঁটল চোখগুলো ভাঙা ডিমের কুসুমের মতো থলবল করছে। ফ্যাকাশে মুখটার ওপর জালি বেলার রোদ ছিটকে পড়ে মুখটা ঢাকা ঘাসের মতো হলুদ হয়ে উঠছে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না সাদেরের। রাতের লাথিটা তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এই নুইয়ে পড়া ধানিজমিটাকে দেখে নিজেকে তার বড় অপরাধী মনে হচ্ছে। নিজেকে এই ঘাস-আলে পুঁতে দিতে ইচ্ছে করছে। সে যেন চৈত্রের এই হড়কা শিলের মতো দাগি আসামি। ধানগাছের নষ্ট থোড় দুই হাত দিয়ে জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল সাদের। সাদেরকে এই সাতসকালে ধানের আলে বসতে দেখে জোলের ভুঁই থেকে হাঁক ছাড়ল মসলেম, “তুমার ভুঁইয়ের কী হাল গ, সাদেরভাই? আমার তো অ্যাক কাঠাও খাড়া হয়ী দাঁড়ি নাই! অ্যা আল্লাহর গজব। শালোর শিল সব ধুয়িমুছি শেষ করি দিয়ি গেলচে!“

কথাগুলো সাদেরের কানে তীরের মতো বিঁধল। মনে হল, শিল নয়, মসলেম যেন তাকে উদ্দেশ্য করেই কথাগুলো বলল! সে আলগোছে উত্তর দিল, “একই হাল। সবকডার মাজা ভেঙি গেলচে।“

“থোড়গুলান কেবুলই পুষ্ট হয়ী উঠছিল, আর অমনি হারামি শিল ম্যাগ ফুটি দুদ্দাড় করি পড়ি সব শ্যাষ করি দিয়ি গ্যালো গ! অ্যাখেই বুলে হাতে না মেরি ভাতে মারা।“

“রুজির মালিক আল্লা, যা করে ভালোর লেগিই করে।“ থির চোখদুটো ফ্যাল ফ্যাল করে আসমানের দিকে তুলল সাদের।

“অ বুলা ছাড়া আর কী বা করার আচে। আল্লা তো কুনুকিচুর দোষ লিবে না। কখনও ম্যাগ-পানি, কখনও ঝড়-ঝঞ্ঝা, কখনও ওইদ-খরা তো কখনও এই দুপেয়ি মানুষের ঘাড়ে দোষ চাপি আল্লা রিহাই পায়।“

“ই বচ্ছর দক্ষিণে ধান কাটতে যাবা না?”

“না গেয়ি কী করব? ইখানে থেকি না খেয়ি শুকি শুকি মরব? তা তুমিও যাবা নাকি?”

“হু, যাব। কী আর করব? প্যাটে ভাতপানি তো লাগবে? ইবার ধানের যা ছড়াদ, তাতে ঝেরিঝুরি পাঁচমুন ধান পাব কি না সন্দেহ। সব পাতান হয়ী যাবে!“

“প্যাটের ভিত্তর দানা গজানোর সুমায় যদি অ্যামুন খাইকুন্নি শিল লাথি মারে, তাহলে কি আর ফল জন্মায়? অ পাতানই হয়।“

“হু।“ সাদের শুধু ঘাড় নাড়ল। ‘লাথি’ কথাটা তার কানে বাজতেই তার অন্তরটাও যেন লাথি খেয়ে উঠল। তার মনে হল, মসলেম তাকে ঠেস মেরেই কথাটা বলল। রাগ অভিমান মনে পুষে পরনের লুঙ্গিটা নেংটি মেরে, সড়সড় করে ধানের জমিতে নেমে পড়ল সাদের। হুমড়িয়ে পড়ে থাকা ধানগাছগুলোর ভাঙা মাজা খাড়া করে দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। মাজার আর সে ক্ষমতা নেই যে শীষগুলোকে ধরে রাখবে। ধানগাছের গুঁড়ির চুড়ুত জমাজলে শীষের ঝরা সাদা রেণুগুলো থলথল করে ভাসছে। তা দেখে সাদেরের ভেতরটা ধড়াক করে উঠল! মাটির উশরায় চুঁইয়ে পড়া থলথলে রসটার কথা মনে পড়ে গেল। তার নিজেকে বড় গোনাহগার মনে হল। ভাবল, এই রক্তমাংসের মানুষ শুধুই কি একটা রুহুর খোল? নাহ। এই রক্তমাংসের দেহের মধ্যে একটা প্রকৃতিও আছে। সেখানে ঝড় ওঠে, বৃষ্টি হয়। রোদ-খরাতে পুড়ে পুড়ে রুটি স্যাকা খুলা (তাওয়া)র মতো তেতে ওঠে।

মাঝেমধ্যে তুফান উঠে সব ছাড়খাড় করে দিয়ে যায়। ধানগাছে খসখস করে শব্দ হচ্ছে। চচ্চড়ে পোকা চড়বড় করে এদিকওদিক তিড়িংবিড়িং করে লাফ মারছে। সাদেরের গা-হাত ঝরা ফুলের রেণুতে পাকিয়ে গেল। চৈত্রের বিহেন রোদ সে গায়ে হাতে পড়ে খিলখিল করে উঠল। সাদের খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে এই লম্বা ধানগাছগুলোর থোড় টিপে দেখল, ভেতরে দানাপানি আছে কি না। সাদেরকে হাত দিয়ে থোড় টিপতে দেখে, হুক হুক করে কোদালের কোপ দেওয়া বন্ধ করে মসলেম সেখ ঠাট্টা করল,

“কি গ, থোড়ে হাতচালি দেকচ নাকি, ভিত্তরে দানাবিচি আচে কি না?“

‘হাতচালানো’ শব্দটা শুনে সাদেরের নাড়িভুঁড়ি উল্টি মারল। কিচ্ছু ‘রা’ করল না সে। মাথাটা একটু বেশিই ঝোঁকাল। যেন কোন একটা কিছু থেকে নিজেকে আড়াল করতে চায়ল। তার উস্কোখুস্কো চুলের মাথাটাও ধান গাছের ঝোড় হয়ে উঠল। কিন্তু ‘হাতচালানো’ কথাটা তার মাথা ঘুলিয়ে দিচ্ছে। থোড়ে হাত দিতে ভয় পেল সে। নুইয়ে পড়া ধানগাছের ওপর ‘থপ’ করে বসে পড়ল। চিনচিন করছে বুক। মনের ভেতর একের পর এক প্রশ্ন আউরিবাউরি খাচ্ছে। ক্যানে হাতচালাতে লিয়ি গেছুনু? ক্যানেই বা হুট কইরি উভাবে পা’টা উঠি গেল?



শিল 

চোখ সবে টাটিয়ে এসেছিল। আচমকা টালির ওপর দুদ্দাড় শব্দ শুনে ধড়ফড় করে উঠে পড়েছিল সাদের। ঝোড়ো হাওয়াই কাঁপতে কাঁপতে ‘দপ’ করে নিভে গেছিল টিমটিম করে জ্বলতে থাকা লম্পটা। সাদেরের মুখ ফুটে বেরিয়ে এসেছিল, ‘হাই আল্লা!

শিল!’ সাদেরকে অমনভাবে নামতে দেখে, তাহেরার কাঁচা ঘুমটাও ভেঙে গেছিল। লম্বা গড়নের চামটা দেহে ফাসা ঢোলের মতো তার ঢলঢলে পেটটা টুস্কা হয়ে পড়েছিল। দুম করে চোখের পাতা খুললেও হুড়মুড় করে ওঠার শক্তি ছিল না তার। মিহি গলায় শুধু জিজ্ঞেস করেছিল, “কী হইল গো?”

“শিল পইচ্চে!” পিন্ধনের লুঙ্গিটা আলগোছে গুঁজে বারান্দায় বেরিয়ে এসেছিল সাদের। তার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তা, চৈত্রের এই শিলাবৃষ্টি ধানের ফুল সব ঝড়িয়ে দেবে! থোড়গুলো সব নষ্ট করে দেবে! সব ধান পাতান হয়ে যাবে! উঠোনে তখন শিলের খৈ ফুটছে। বিদ্যুতের ঝলসানো আলোতে পড়ে থাকা শিলগুলো রূপোর মতো ঝকমক করছিল। একটা ভাঙা শিল হাতে তুলে সাদের ফ্যাসফেসে গলায় বলেছিল, “ওগো, বর্ষার মা, দেখি যাও, সব্বনেশে শিলে উঠ্যেন ভরি গ্যালো।“ তাহেরা উত্তর দেয় নি। শুধু “উঃ” “উঃ” করেছিল।

সাদের মনে মনে বলেছিল, ধানের থোড়ের পেটগুলোও শিলের পটবাড়ি খেয়ে নিশ্চয় এতক্ষণ এভাবেই কুদরাচ্ছে। হাতের মুঠোয় শিলের টুকরো চিপে ধরে এক সতরের উশরাটায় ঠাই দাঁড়িয়ে ফসলের আঁক কষেছিল সাদের। ঘরের ফসল আর মাঠান ফসল মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিল। আচমকা পায়ের সামনে পড়ে থাকা শিলের টুকরোটাকে ভ্যাকাম করে লাথি মেরে উঠোনে ফেলে দিয়েছিল। আসলে সাদের এই বরফখণ্ডের মধ্যে নিজের কদর্য রূপটা দেখতে পাচ্ছিল। সেও তো এই রক্তমাংসের মানুষ থেকে মাঝেমধ্যে হড়কা শিল হয়ে ওঠে। তার মনের আকাশে পাড়িমষের মতো কালো মেঘ ওঠে। সে মেঘে ঝড়ের তাণ্ডব বয়।



আল্লাহর গজব

“ইবার কাদানের টাকাকডাই উঠবে না! ই ধান গরুর শানিই (বিচালি) হবে!” ‘ঘুঁত’ করে কোদালের কোপ দিয়ে আফসোস করল মসলেম। মাথায় ফেট্টি বাঁধা গামছাটা খুলে মুখ মুছতে মুছতে এবার হাঁড়া গলাটা একটু চরিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তুমার বউর খবর কী গ?”

কথাটা সাদেরের কানে সপাটে চড় খাওয়ার মতো বাড়ি খেল। কিন্তু সে যে কুকম্মটা করেছে তা তো আর ধামাচাপা দেওয়ার মতো নয়? সে রাতেই গোটা পাড়া ঢ্যাড়ড়া পড়ে গেছিল। গোটা পাড়ার মেয়ে-মরদে ছিঃ ছিঃ করেছিল। ঝোপ ধানের গুঁড়িতে ঠেসে বসে পড়ল সাদের। তার হাড়গিলে পাদুটো যেন শরীরের আর ভার নিতে পারছে না। তারা যেন এই আসামি শরীরটার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করল। একটা শিকড় উপড়ানো ধান গাছের লটকানো দেহ দেখে সাদেরের ভেতরটা থক করে উঠল। সে রাতে মুখথুবড়ে পড়ে থাকা তাহেরার নিথর শরীরটার কথা মনে পড়ে গেল। নিজেকে তার জ্যান্তশিল মনে হচ্ছে এখন।

ধানের থোড়ে হাত দিতে লজ্জা করছে সাদেরের। কৃষকের হাতের স্পর্শ পেয়েই তো ধানের থোড় ‘ধেই’ করে ওঠে। খিলখিল করে হাসে। কৃষক যে তাদের বাপ মা। অথচ তাহেরার কথা মনে আঁচড় কাটতেই পরানচাষি সাদের যেন একজন বেইমান বাপ।

সে যে বড় পাপ করে ফেলেছে! সে রাতের কু-কীত্তিতে আল্লাহর আরশ যে কেঁপে উঠেছিল। তার জন্যে আল্লাহর আযাব নেমে আসবেই। জাহান্নামের দরজা খুলে যাবে নিশ্চিত। কবরের ফেরেশতাকে কী উত্তর দেবে সে? সে যে একজন খুনি! ফড়ফড়ে মসলেম কোদালটাকে ধানের আলে খাড়া করে রেখে, একটা আধপুষ্ট থোড়কে চিপে বলল, “কিছু কিছু থোড়ে অ্যাখুনও দুধরস আছে গ। এই দ্যাখো জোরে টিপলে সাদা রস ব্যারহাচ্ছে।“ মসলেমের বিড়ি খাওয়া ঠোঁটে মিহি হাসি। চোখ নিংড়ে খসে পড়ছে ধুকধুক করতে থাকা ক্ষীণ আশা।

“অ্যাক শিলে কি সব যায়?” ঝোপের আড়াল থেকে ভেসে উঠল কথাটা।

“কে বুলল, যায় না? গ্যালো বচ্ছরের আগা বচ্ছর, মুনে আচে? সে কি শিল, বাপরে বাপ, আদ্ধেক রাইত জুড়ে শিল্বৃষ্টি হয়ীছিল! মাঠখে মাঠ ধান অ্যাকেবারে মাটিতে মিশি দিয়ছিল! সব ধান ঝেরে পাতান হয়ী গেলছিল!” আকাল বছরের দুঃখের স্মৃতি জাবর কাটল মসলেম। সাদেরও জানে, এক শিলেই সব ধুলিস্যাত হয়ে যেতে পারে। আল্লাহর গজব নেমে আসলে এই দুনিয়ার কারোরই কিছু করার থাকে না। সাদের হাড়ে হাড়ে জানে, মানুষের শরীরের ফুলই এক লাথিতে ঝরে যায় তো ধানের থোড় তো ঝরবেই। মানুষের নাড়ি যে জড়িবুটির আটসাট বাঁধনে বাঁধা থাকে, ধানের থোড়ফুল তো সেভাবে বাঁধা থাকে না?

মসলেম থপথপ করে ঘাসে ঢাকা আল দিয়ে হেঁটে আসল। সাদের ভুঁইএর যে প্রান্তে বসে বসে বাঁকা ধান খাড়া করছিল সেখানে ‘দ’ হয়ে বসল। গামছা দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে একবার খক করে কেশে বলল, “অ্যাকটা বিড়ি দাও দেখি।“ সাদের বাঁকা মাজা সোজা করে দাঁড়াল। ভাবল, ব্যাটা মসলেম তো এবার গেঁড়ে বসতে চায়ছে। ব্যাটা বিড়ি চায়ছে মানে এবার গল্পের আসর পাড়বে। এ কথা সে কথা গাহাতে গাহাতে পাপ রাতের ঘটনাটা শুনার ফন্দি আঁটবে। কিন্তু বিড়ি নাই, বলাও যাবে না। একটু আগেই তাকে বিড়ি টানতে দেখেছে মসলেম। “বিড়ি তো নাই গ, যে কডা ছিল, বসতে গিয়ি ভেঙ্গি গেলচে মুনে হয়” বলেই নেংটিমারা লুঙ্গির ভাঁজে জড়ানো বিড়ির প্যাকেটটা থেকে দুটো বিড়ি বের করল সাদের। একটা নিজের কানে গুঁজে আর একটা মসলেমকে দিয়ে বলল, “ধরাও।“ মসলেম আলের ওপর ধিকধিক করে জ্বলতে থাকা নাড়ার আঁটিআগুনটা মুখের কাছে ধরে বিড়িটা মুখে পুরে একটা জোরে টান দিল। ফুঁক ফুঁক করে দুবার ধোঁয়া ছাড়ল। সাদের কান থেকে বিড়িটা মুখে নিয়ে মসলেমের জ্বলন্ত বিড়িটার গনগনে আগুনে তার বিড়ির মুখটা ঠেকিয়ে আগুন ধরাল। একবার ফুঁক করে টেনে খক করে কাশল সাদের।

মসলেম জোরে সুখটান দিয়ে লম্বা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “ই বচ্ছর পাপের বচ্ছর। অর লেগিই আল্লার গজব নেমি এসচে।“

“শিল কি আজ লতুন? বাপদাদোর আমল থেকিই হয়ী আসচে।“ বিড়বিড় করে উঠল সাদের। মসলেমের কথাটা তার গায়ে লাগল।

‘পাপ’ কথাটা তার কানে বাজলেই সেই রাতের ‘লাথিটা’ তার হৃদয়ে কুড়ুল মারে। মসলেম বিড়িটা মুখে পুরে ডান হাত দিয়ে একটা থোড়ের পেট টিপে বলল, “সব খোল হয়ী গেলচে গ! প্যাটটা ক্যামুন ঢলঢলে চামটা! ভেত্তরের অসকষ সব শুকি খটখটি হয়ী গেলচে! পুয়াতি মেয়ির প্যাটের পুষ্ট ছেলি লষ্ট হয়ী গ্যালে প্যাটটা য্যামুন চামটা হয়ী যায়, অ্যা ঠিক ত্যামুন!”

সাদেরের নাড়িভুঁড়ি পাক মেরে উঠল। গা-গতর হলহল করে কাঁপছে। বিড়িটা মুখের ভেতর পুরে ফুঁক ফুঁক করে দু-তিনবার ধুকপুকানি টান মারল। গব গব করে দলা পাকিয়ে ধোঁয়া বের হল। খুটোল চোখে ঝাপসা স্মৃতি টাটকা হয়ে উঠল।



লাথি

সাদের মুখ্যুসুখ্যু আবোড় লোক হলেও, কোনদিনও তুকতাকে বিশ্বাসী ছিল না। তাবিজ-কবোজ, ঝাড়পুক, পানিপড়া, হাতচালানো তার কাছে ছিল শেরেকি। কিন্তু তার নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর সংসারে যখন পরপর তিন কন্যাসন্তানের জন্ম হল, তখন তার সে বিশ্বাসে চিড় ধরল। মনের মধ্যে দানা বাঁধতে লাগল নানান সংস্কার। সে ভেবেছিল, তিন মেয়ের পর আবারও যদি কন্যাসন্তানের জন্ম হয়, তবে খড়কুটো ধরে কোনরকমে বেঁচে থাকা হাভাতের সংসারটা একেবারে উচ্ছেন্নে যাবে! সে আল্লাহর ওপর অভিমান করে উঠেছিল, গরিবের ঘর ভরে এত্ত বিটি দ্যাওয়ার কী দরকার ছিল? তাহেরা তখন সাতমাসের পোয়াতি। চতুর্থবারের জন্য তার পেট ভরে উঠেছে। সাতমাসেই ঠিলির মতো ফোলা পেট! এদিকে সাদেরের ঘুম হয় না। তার মাথায় অনবরত ঠকঠক করে, বিটি না ব্যাটা? সে মনে মনে তার প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকে। নানান ফন্দিফেউর আঁটে। কাছের লোকজনদের জিজ্ঞেস করে। শেষে হাজিপাড়ার সালেমুদ্দি মোল্লার কাছ থেকে ঠিকানাটা পেয়ে যায় সাদের।

বটগাছের গা লাগা ছোট্ট একটা ঝুপড়ি। বড়বড় হরফে লেখা, ‘কবিরাজি ঔষধের দোকান’। কবিরাজি ওষুধ খেলে পেটের সন্তান পুষ্ট হবে বলে তাহেরাকে নিয়ে এসেছে সাদের। সাদের চেম্বারে তাহেরাকে বসিয়ে রেখে পাশের ঘুপচি ঘরে কবিরাজজীর সাথে কি সব ঘুটুরমুটুর করল। কবিরাজজী তার কুঁচকানো ভ্রূ সাট করে, গালে আলতো টোল ফেলে ঘাড় নেড়ে জানালেন, “ঠিক আছে। হয়ে যাবে। এ আমার এক তুড়ির কাজ। আগে হাতচালিয়ে দেখেনি, তারপরে দাওয়াই দিচ্ছি।“

কবিরাজের ইশারা পেয়ে সাদের তড়বড় করে উঠে বাইরের বেঞ্চ থেকে তাহেরাকে এই অন্দরঘরে নিয়ে এল। কবিরাজমশায় তাহেরাকে একটা চওড়া কাঠের বেঞ্চে চিৎ করে শুইয়ে দিলেন। তারপর তাহেরার ঢোল পেটটা থেকে সুতির মেরুন শাড়িটা সরিয়ে উদেম পেটে হাত বোলাতে বোলাতে কিসব ফুঁ-মন্তর আউড়াতে লাগলেন। মাঝেমধ্যে জোরে ফুঁ ঝেরে হাতের আঙুল দিয়ে ফোলা পেট চেপে চেপে কি যেন পরখ করলেন। মিনিট পাঁচেক এভাবেই হাতচালানো চলল। হাতচালানো হয়ে গেলে তাহেরাকে চেম্বাররুমে পাঠিয়ে কবিরাজজী ফিসফিস করে সাদেরকে গোপন কিছু একটা জানালেন। তারপর ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে বললেন,

“একদম চিন্তা করবেন না। জড়ীবুটিগুলো ঠিকঠিক ভাবে খাইয়ে দেবেন। দিন পনেরোর মধ্যেই কাজ হয়ে যাবে।“

কবিরাজজী এত করে বললেও, ওসব জড়িবুটির প্রতি বিশ্বাস হচ্ছিল না সাদেরের। দিন পনেরো মানে তার কাছে অনন্তকাল।

অতদিন অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য তার ছিল না। তার মাথায় শুধু কবিরাজজীর গলা নামিয়ে ফিসফিস করে বলা “বিটি’ কথাটা কটমট করে কাটছিল। সে চায়ছিল চটজলদি ফায়সালা।

সে রাতে তেমন কিছুই হয়েছিল না। এরকম ঠুকমুক আগেও অনেকবার হয়েছে। কিন্তু তাহেরার অল্প কথাতেই সাদেরের মাথা তেতে উঠেছিল! সে যেন মনে মনে এই ছুতোই খুঁজছিল। তাহেরার অপরাধ, সে স্বামীকে না জানিয়ে আশাকর্মীর দেওয়া ওষুধ খেয়েছিল। সে স্বামীর নিষেধ শোনেনি। সাদের বারবার করে মানা করে দিয়েছিল, কবিরাজের ওষুধ ছাড়া অন্য কুনু ওষুধ খাবা  না। তাহেরাও মুখের ওপর তর্ক করেছিল। মুখে লাগাম লাগাতে পারেনি। তাহেরা যেই বলেছিল, “উসব জড়িবুটি আমি খাব না”,

অমনি সাদেরের মাথা বিগড়ে গেছিল। মরদ সাদের তার ডান পা’টা তুলে তাহেরার ভরা পেটে ‘ভ্যাকাম’ করে এক লাথি মেরে দিয়েছিল। ব্যস। ওতেই কেল্লাফতে। কাটা গাছের মতো আলুথালু হয়ে মেঝেতে পড়ে গেছিল পোয়াতি তাহেরা। দুই ঊরুর ফাঁক দিয়ে অনর্গল বয়ে গেছিল রক্ত-স্রাব। নষ্ট পুত্রসন্তানের রস-কষ। পরান চাষি সাদের চোখ ফেড়ে দেখেছিল, তার ঘরের খেতিতে একটা পুষ্ট থোড় নষ্ট হয়ে কীভাবে গলে গলে পড়ছে।