Next
Previous
Showing posts with label স্মৃতির সরণী. Show all posts
0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in
 

স্মৃতির সরণী


কথামালা 
বিপুল দাস


(পর্ব ২)
একা একা ঘুরে বেড়াই। বাড়িতে একাচোরা, বাইরে একলসেঁড়ে। মনখারাপের আলো ছড়িয়ে আছে আকাশজুড়ে। ধুস্‌, কিচ্ছু ভালো লাগে না। একা একা অনেক দূরে, সেই ঘোষালবাগান পার হয়ে ফুলেশ্বরী নদীর দিকে চলে যেতে ইচ্ছে করে। বাড়িতে দিদির রচনা বই’একের ভিতরে চার’ এর সব রচনা পড়া শেষ। ‘একটি বর্ষার দুপুর’ পড়ে কেমন নেশা-নেশা লাগে। এখানে সেখানে গল্পের বই খুঁজে বেড়াই। মায়ের তালাখোলা ট্রাঙ্কে এভাবেই একদিন পেয়ে গেলাম বিশালগড়ের দুঃশাসন, রত্নদ্বীপ, একশটি সহজ ম্যাজিক। ভাবতে থাকি শকুনের ডিমের ভিতরে পারদ পুরিয়া খাইলে উড়িতে পারা যায় – সত্যি নাকি। সিক্সটি ওয়ানে দাদার বিয়ে। আমার ক্লাস সিক্স। দোল দোল চতুর্দোলায় আর পান্নাহিরে চুনি তো নয় তারার মালা ... পাশের ঘটকবাড়ির অমলদা রেকর্ডে পিন পালটে দিচ্ছে। একটা বেশ মোটা কবিতার বই, রবীন্দ্রনাথের ‘সঞ্চয়িতা’ কেউ উপহার দিয়েছিল।

কবিতা তা হলে এ রকমও হয়। আশ্চর্য হয়ে গেলাম। ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল আর কোন দেশেতে তরুলতা ছাড়াও অন্য রকম কবিতা হয় তা হলে। ে কী অসাধারণ শব্দের রহস্য ! ছন্দের ঝংকার ! আমার প্রাণ জেগে উঠল। সত্যি সত্যি ‘ কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখীর গান, না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ’। নেশায় আমি চুর হয়ে গেলাম, ভোঁ হয়ে গেলাম। আশ্চর্য এক জগৎ। যেন স্বপ্নময়। কিছুই চিনি না, অথচ চেনা-চেনা মনে হয়। আমি এক ‘গুপ্ত’ সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে বসলাম। তার পথে পথে হিরেমানিক। আশ্চর্য এক জগতে আমার ভ্রমণ শুরু হ’ল।

দূরে একদিন দেখেছিনু তব কনকাঞ্চল-আবরণ

নবচম্পক-আভরণ।

কাছে এলে যবে হেরি অভিনব

ঘোর ঘননীল গুণ্ঠন তব,

চলচপলার চকিতচমকে করিছে চরণ বিচরণ—

কোথা চম্পক-আভরণ।।

চ-এর অনুপ্রাশে শরীর শিরশির করে। মাথার ভেতরে ঘোর লাগে। বিশ্বাস করুন, আমি সেই বয়সেই এক চির-রহস্যময়ীর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি। এই পৃথিবীজুড়ে, নদীর ওপারের ওই পলাশবনে, ভোরবেলার কুয়াশামাখা ধানখেতে, সন্ধ্যাবেলা পশ্চিমে সূর্যডোবায় আমি দৃশ্যমানতার বাইরেও অস্পষ্ট কিছু টের পাই। এখনও, এই বয়সেও আমি তাকে স্পষ্ট বুঝি না। কনকাঞ্চলের ইশারাটুকু শুধু টের পাই। বাতাসে সেই আঁচলখানি যখন ওড়ে, তখন হঠাৎ “ ওই ওই রব ওঠে, ওই ওই / তারপর সব শান্ত নিরুদ্বেগ সবুজ পৃথিবী,/ ধোয়া তুলসিপাতা”। -- (শঙ্খ ঘোষ)

এক ভিক্ষু ‘জল দাও’ বললে চণ্ডালিকার হাত কেঁপে উঠেছিল। বেঁচে থাকার জন্য জলহীন মানুষও কাতর প্রার্থনায় দু’হাত তুলে ধরে চণ্ডাল আকাশের দিকে। আল্লা মেঘ দে, আল্লা পানি দে। বেঁচে ওঠার মন্ত্র, বেঁচে থাকার কলমা। সৃষ্টির আদিতে দেখ সেই কারণবারি। মাতৃগর্ভের পিচ্ছিল তরল। অন্ধকারময়। ওম্‌-এই প্রণবধ্বনি উচ্চারিত হলে প্রসবকালীন জল ভাঙে। জলই তো প্রাণের গোপন কথা।

H2O – এই সংকেত বড় শুকনো। মানুষের বুকের গভীরে যে টলটলে জল, তার কোনও খবর দিতে পারে না এই সংকেত। এই ফর্মুলায় প্রকৃত জলের বড় অভাব। পৃথিবীর তিন-চতুর্থাংশে সাম্রাজ্য বিস্তারকারী জলের কথা, লক্ষ লক্ষ জলচর প্রাণীর কথা, গঙ্গা, নীলনদ, হোয়াং হো, এমন কী ছোট্ট ধরলা ও তার পারে ফাঁদেপড়া বগার কথা কিছুই বলা হয়ে ওঠে না এই ফর্মুলা দিয়ে।

লাইফলাইন বলে যদি কিছু থাকে, তবে সেটি জলপ্রবাহ। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এই প্রবাহ প্রকৃতপক্ষে রক্তবাহী ধমনি। নাব্য নদী বেয়ে আসে ভাস্কো দা গামা, জোব চার্ণক। নগর সভ্যতার পত্তন হয়। বণিক যায় এলাচ, লবঙ্গ, চিনাংশুক, চুয়াচন্দন নিয়ে। নদীপথে চলেছেন একজন পর্যটক আমাজনের উৎস সন্ধানে। নদীপথে চলেছেন ধর্ম-প্রচারক। কারও হাতে বাইবেল কারও হাতে তথাগতের বাণী। নদীপথে চলেছে হাসেম আলি, কাঁধে মাছধরার জাল। নদীপথে বোটের ওপর বসে আছেন কবি। এই জলেই আমাদের তর্পণ। আমাদের সব অনুতাপ অঞ্জলি করে ভাসিয়ে দিই গাঙের জলে। দূর দক্ষিণে ভেসে যায় একমুঠো ফুল। এই নদী বেয়ে এক নারী পৌঁছে যায় ইন্দ্রের সভায়। ছিন্ন খঞ্জনার মত নাচে। নদীর মতই জীবনপ্রবাহ এগিয়ে যায় সামনের দিকে।

“সম্মুখের বাণী/নিক তোরে টানি/মহাস্রোতে/পশ্চাতের কোলাহল হতে/অতল আঁধারে অকূল আলোকে...”

পাহাড় থেকে গড়িয়ে নেমেই মহানন্দা সমতলে এসেছে শিলিগুড়িতে। পাহাড় গড়িয়ে পাথর আসে। পাথর গড়িয়ে চূর্ণীভবন চলে দীর্ঘকাল ধরে। নদীর গর্ভে বালি জমে। এখন ওই রুগ্ন, কঙ্কালসার নদীর দিকে তাকালে আমার বুকের ভেতরে কষ্টটা টের পাই। থাক, আমি দুঃখটা বালিচাপা দিয়ে রাখি।

কিছুদিন আগে আগে হঠাৎ মনে হ’ল যাই, একটু সেই নদীকে দেখে আসি। আমার প্রিয় মহানন্দা। রাস্তা পার হয়ে নতুন বসতির ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে নদী আর খুঁজেই পাই না। এ কী রে বাবা, পুকুরচুরি শুনেছি, আস্ত নদীটাও চুরি হয়ে গেল নাকি। যেখান দিয়ে হেঁটে এলাম, একদিন সেখানে ডুবজলে সাঁতার কাটতাম। অনেক সরে গেছে নদী। শেষে পাওয়া গেল। ঘরবাড়ি শেষ হওয়ার পর একটা ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়ালাম। এখানে অন্ধকার। একটা বড় গাছও হয়ে গেছে এ ক’বছরে। হিসেব করে দেখলাম তা প্রায় চল্লিশ বছর পরে আবার নদীর পারে এসে দাঁড়িয়েছি। গাছ তো বড় হতেই পারে।

গাছটার নীচে গিয়ে বসলাম। আমার ছেলেবেলার নদী। আমার পায়ের কাছে মহানন্দা। উত্তরে তাকালে স্পষ্ট দেখা যায় তিনধারিয়া, কার্শিয়াং-এর আলো। অন্ধকারে কালো জল পাড়ে এসে ছলাত্‌ ছলাত্‌ শব্দে ভেঙে পড়ছে। সেই চিরকালের চেনা নদীকে ভীষণ অচেনা মনে হয়। কোথা থেকে এসেছে এই নদী ? কত যুগ ধরে বয়ে চলেছে এই নদী ? এর নাম কে রেখেছে মহানন্দা ? জগদীশচন্দ্র বসুর সেই বিখ্যাত লেখাটার কথা মনে পড়ল। ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে। আমি তো বিখ্যাত মানুষ নই, তবু ইচ্ছে হ’ল নদীর সঙ্গে কথা বলতে। ফিসফিস করে উচ্চারণ করলাম –

নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ ?

কার্শিয়াং-এর কাছে একটা ছোট্ট সরোবরে আমার জন্ম।

নদী, তোমার যাত্রাপথের গল্প বলো।

পাহাড়ে কত শত চঞ্চল ঝর্ণা এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। তাদের সবাইকে নিয়ে পাহাড়ের বন্ধন ছেড়ে নেমে এলাম শিলিগুড়ির সমতলে। আমার পবিত্রতা নষ্ট হয়ে গেল। এ শহরের মানুষ নদীকে ভালোবাসে না। আমি কলুষিত হলাম। ওদিকে সুকিয়াপোখরি থেকে বালাসন এসে আমার সঙ্গে মিলিত হ’ল। শিলিগুড়ি পার হয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত বরাবর এগিয়ে চলেছি। গজলডোবা থেকে তিস্তা ক্যানাল হয়ে তিস্তার জল এসে পড়েছে আমার বুকে। লকগেট বন্ধ করে সেই জল পাঠিয়ে দেওয়া হয় পশ্চিমে। শুখা মরশুমে ফসল ফলায় উত্তর আর দক্ষিণ দিনাজপুরের সুখা জমিতে।

তারপর ?

তারপর বিহারে ঢুকে পড়েছি। নেপাল থেকে আসা মেচি নদীর সঙ্গে দেখা হ’ল কিষাণগঞ্জের কাছে। সমস্ত জলসম্পদ নিয়ে ক্রমে আরও দক্ষিণে এঁকে বেঁকে, কতবার দিক পালটে অনেক পথ পার হওয়ার পর নাগর ও কুলিকের মিলিত ধারা এসে মালদহ জেলার মহানন্দপুরের কাছে আমার সঙ্গে মিশে গেল। তখন আর আমার সেই পাহাড়ি চঞ্চল খরধারা নেই। কিছুটা অলস ছন্দে আমার এগিয়ে চলা। কত স্ফীত হয়েছি।

তারপর ?

বরেন্দ্রভূমির ভিতর দিয়ে অলসগমনে যেতে যেতে ইংরেজবাজারের নিমাসরাই-এ কালিন্দির সঙ্গে দেখা। সে তার সব জলভার আমাকে দিল। এরপর বাংলাদেশের সীমান্তে টাঙনের সঙ্গে দেখা। আমি তখন মিলিত জলভারে বিপুলা। আমাদের পাশপোর্ট-ভিসা নাই। অক্লেশে বাংলাদেশে ঢুকে গেছি। এরপর পুনর্ভবা এসে যুক্ত হয়েছে আমার সঙ্গে। শেষ পর্যন্ত রাজশাহী জেলার গোদাবাড়ি ঘাটে পদ্মায় আমার সমর্পণ। মোট তিন’শ কিলোমিটার পথ পার হয়েছি। কত পাহাড়, সমতল ভূমি, নগর, বন্দর, কত জনপদ পার হয়েছি। কত জনপদের উত্থান পতন দেখলাম। কত বন্যা, ঘাটে বসে গাঁয়ের বধূর কান্না, আমার শীতল জলে চিরজীবনের মত জ্বালা জুড়িয়েছে কত মানুষ। কান পাতলে সব শুনতে পাবে। ইতিহাসে সব লেখা থাকে না। লোকগাথায়, জনপ্রবাদে, গ্রামীন ছড়ায়, পূজাপার্বণে,লোকাচারে, সারিগানে, ভাটিয়ালিতে, ভাওয়াইয়ায় নদীর কথা ছড়িয়ে থাকে।

নদী, তুমি কি প্রাচীনা ?

পাহাড়ে কিন্তু আমার নাম মহলদি। লেপচা শব্দ মহলদির অর্থ বাঁকা। আমি প্রাচীনা, তবে সুপ্রাচীনা নই। নদীপথ চিরদিন স্থির থাকে না। পূর্বের গতিপথ থেকে অনেক সরে গেছি আমি। তিস্তা বা ত্রিস্রোতার পশ্চিমধারা পুনর্ভবার সঙ্গে আমার মিলন ছিল আইয়রগঞ্জের কাছে। পরে রামপুর-বোয়ালিয়ার কাছে পদ্মায় মিশে যেতাম। তারও আগে লক্ষণাবতী পার হয়ে করতোয়ার সঙ্গে আমার জলধারা মিশে যেত। কী বিশ্বাস হয় না ? ফান ডেন ব্রোকের নক্‌শায় দেখ আমার গতিপথ ছিল আরও পশ্চিমে। মহানন্দার প্রাচীন প্রবাহের কথা ইতিহাস খুঁজলে ঠিকই পাবে। নদীবহুল এই অঞ্চলের নদীগুলো ক্রমাগত খাত পাল্টেছে। যে জাতি নদীকে ভালোবেসেছে, নদীও তাকে পত্রেপুষ্পে, ফুলেফলে উর্বরা করে গোলায় ফসল ভরে দিয়েছে। মানুষের চেয়ে নদী অনেক প্রাচীন। নদীকে শাসন করা যায় না।

স্তব্ধ হয়ে অনেক ক্ষণ বসে রইলাম। নদীকথা শুনতে শুনতে সব ভুলে গিয়েছিলাম। উত্তরে পাহাড়ের আলোকমালা, দক্ষিণে অনেকদূরে নতুন ব্রিজের আলো। অবিশ্রান্ত ছোট ছোট ঢেউ এসে ছলছল শব্দে ভেঙে যাচ্ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে অনন্ত ধারায়। লোকে বলে বটে – জলের মত সহজ। জল অত সোজা নয়। মানুষ অবজ্ঞা করে বলে -- সব কিছু জলে গেল। অথচ শেষ পর্যন্ত সব কিছু জলেই ভাসিয়ে দিতে হয়। গঙ্গাজল মুখে দিতে হয়। এই নশ্বরদেহ পঞ্চভূতে বিলীন হয়ে গেলে জলে পুঁতে দিতে হয় অবশেষ। জলেই পিতৃপুরুষের তর্পণ। নদী উদাসীন থাকে। সে শুধু দেখে যায় মানুষের আসা-যাওয়া।

“ফিরে নাহি চাও,

যা কিছু তোমার শুধু দুই হাতে ফেলে ফেলে যাও।

কুড়ায়ে লও না কিছু, কর না সঞ্চয়;

নাই শোক, নাই ভয় –

পথের আনন্দবেগে অবাধে পাথেয় কর ক্ষয়”

বড় হতে থাকি। ষাট ফোঁটা রক্তের তাৎপর্য বন্ধুরা খুব সাঁটে বুঝিয়ে দেয়। শুনেই বুকের ভেতরে হুড়ুমদাড়ুম শব্দ হতে থাকে। মনে হয় বাড়িতে ফিরলে আমার মুখ দেখেই মা সব বুঝে ফেলবে। মালা সিনহা, সায়রা বানু, আশা পারেখ, নন্দা – এদের নিয়ে তুল্যমূল্য আলোচনা হয়। একজন কেউ তাত্ত্বিক নেতা গভীর ভাবে আমাদের ভেতরের কথা বোঝানোর চেষ্টা করে, কিন্তু আমার খুব সন্দেহ হয়, নিজের অভিজ্ঞতা বলে চালানোর চেষ্টা করলেও মনে হয় গল্পে জল আছে। কিন্তু দাদার ভয়ে সন্ধের আগেই বাড়ি ফিরতে হয়। বন্ধুরা ফুটবল খেলার শেষে পি ডাব্লিউ অফিসের সামনে হেলানো শিরীষ গাছে বসে পা দোলায় আর সদ্য-শোনা গল্প নিজের মনের মাধুরী মিশায়ে পুনর্নির্মাণ করতে থাকে। দীপককে সবাই রিকোয়েস্ট করে আঈ মিলন কি বেলা শোনানোর জন্য। দীপক টুসকি দিয়ে চারমিনারের লেজ ছুঁড়ে ফেলল।

দীপক কিছুক্ষণ ঘাড়ের চুল আঙুল দিয়ে ঘোরালো, তারপর বলল আজ ও অন্য গান গাইবে। গাতা রহে মেরা দিল দীপক হেভি গাইত। তার বাঁ পা ছিল কংক্রিটের পিলারের মত, ডান পা ছিল বটের ঝুরির মত, দু’বগলে ক্রাচ। ও মেরে হামরাহি – বলে দুটো হাত ফ্রি করে সামনে বাড়িয়ে দিত দীপক। মনে হত সত্যি বুঝি ওয়াহিদা মাঠ পেরিয়ে লেন, লেন পেরিয়ে পি ডাব্লিউ রোডের দিকে চলে যাচ্ছে। দেব আনন্দের লিপের সমস্ত গান দীপকের মুখস্থ। ভালো গাইত। আঁখো হি আঁখোমে ইশারা হো গয়্যা – সি আই ডি, আভি না যাও ছোড় কর – হামদোনো, তুঝে জীবন কি ডোর সে বাঁধ লিয়া হ্যায় – আসলি নকলি। সব অ্যাকিউরেট সুরে গাইত।

দীপক হাতদুটো সামনে এনে ডিং ডাং টারা ডিং ডাং গিটার বাজানোর ভঙ্গি করল, মুখে সাউন্ড দিল। একটু আগেও কানাই-এর একটা গানের সঙ্গে ভাট্টা দু’টো দশ নয়া দিয়ে তাল রেখেছে। দীপক আর একবার চুল ঘুরিয়ে নিল। আভি না যাও ছোড় কর ... ট্রিং টিক টিক ... কে দিল আভি ভরা নেহি... সামনে হাত বাড়িয়ে দিল দীপক। এটা ওর কায়দা। ওর ধারণা অনেকটাই দেবানন্দ্‌ হয় এতে। এমনভাবে সামনে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, সবাই মাঠের ঘন অন্ধকারে তাকিয়েছিলাম আমরা, যেন সাধ্‌না অন্ধকারের আড়াল নিয়ে কোথাও চলে যাচ্ছে। ওদের মনে হয় সাধ্‌নার কপালের সামনে সেই বিখ্যাত ঝুরোচুল অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। হায় হায় শব্দ ওঠে বুকের ভেতরে। দু’একজনের কান্না পায়। আভি আভি তো আঈ হো বাহার বনকে ছাঁঈ হো... আমাদেরও অস্পষ্ট ঠোঁট নড়ে। তখন দীপক বুঝতে পারে হিট করেছে গানটা।

শৈলেন্দ্র স্মৃতি পাঠাগারের চাঁদা চার আনা। আমি মেম্বার হয়ে গেলাম। ওই চার আনাই ছিল চিচিং ফাঁক। তখন স্বর্গের দরজা খুলিয়া গেল। সত্তর দশকের মাঝামাঝি লিটল্‌ ম্যাগাজিন বের করার পরিকল্পনা হল। মূলত আমি, গীতাংশু কর ও নিখিল বসু। তার আগে খুচখাচ কবিতা লিখছি। সব পড়ছি। যা পাচ্ছি, সব। টাউন স্টেশনের ক্যান্টিনে চুটিয়ে আড্ডা। আমার কাছে 'ফিরে এসো চাকা' আছে শুনে নিখিল অবাক হয়ে গেল। 'পাহাড়তলি' নামটা নিখিলই ঠিক করল। আমাকে বলল -- তুমি গল্প লিখবে। বুঝলাম ব্যাপারটা সিরিয়াস। এমনি সময় আমাকে 'তুই' করে বলে।
পাহাড়তলি ছাপা হত পটলডাঙার 'অমি প্রেস' থেকে। কমল সাহার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হল। তখনই কমল খুব ভালো ছবি আঁকছে। যোগাযোগ হল অঞ্জন সেন, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, নিশীথ ভড়দের সঙ্গে। কলকাতা থেকে লেখা সংগ্রহ, প্রেসে গিয়ে পাহাড়তলির প্রুফ দেখা ওরা সানন্দে করত। প্রথম সংখ্যায় স্যামুয়েল বেকেট সম্পর্কে লিখলেন অশ্রুকুমার সিকদার। কবিতা লিখেছিলেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, শংকর চট্টোপাধ্যায়,মোহিত চট্টোপাধ্যায়, দেবারতি মিত্র, অঞ্জন সেন, রানা চট্টোপাধ্যায়, শিবশম্ভূ পাল, আরও অনেকে। পর পর কয়েকটি সংখ্যার প্রচ্ছদ করলেন শ্যামল দত্তরায়। চতুর্থ সংখ্যায় ছিল অনন্য রায়ের 'হে স্মৃতি, ঘুম আসছে না' শীর্ষক বিখ্যাত কবিতা। ঈনিডের অনুবাদ প্রসঙ্গে আলোচনা ছিল অমিতাভ গুপ্তের। পঞ্চম সংখ্যায় উদয়নারায়ণ সিংহ, বীতশোক ভট্টাচার্য, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের লেখা। ষষ্ঠ সংখ্যা ছিল বিশেষ কবিতা সংখ্যা। মধুসূদনের 'বঙ্গভাষা', বিষ্ণু দে'র 'সেই অন্ধকার চাই', সমর সেনের 'মদনভস্মের প্রার্থনা' নিয়ে আলোচনা করেছিলেন যথাক্রমে পুষ্কর দাশগুপ্ত, সজল বন্দ্যোপাধ্যায় ও অশ্রুকুমার সিকদার। একটি, দুটি ও তিনটি করে কবিতা ছিল অমিয় চক্রবর্তী, অরুণ মিত্র, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, আলোকজ্যোতি রায়, শোভন চক্রবর্তী, তুষার বন্দ্যোপাধ্যায়, পুণ্যশ্লোক দাশগুপ্ত, অলোকনাথ মুখোপাধ্যায়, অন্যমন দাশগুপ্ত, মনোজ রাউত, অমিতাভ গুপ্ত, বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়, সমর চক্রবর্তী, অঞ্জন সেন, বিপুল দাস, সৈয়দ কওসর জামাল, নিখিল বসু, গীতাংশু কর, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ও আলোক সরকারের।

আজ ভাবতে গিয়ে খুবই অবাক হয়ে যাই সত্তরের দশকে শিলিগুড়িতে বসে আমরা কী ভাবে 'পাহাড়তলি' প্রকাশ করেছি। অবশ্য কলকাতার বন্ধুরা, ধুপগুড়ি থেকে পুণ্যশ্লোক -- সবাই না হলে এটা হত না। পরবর্তী কালে নিখিল বসু শিলিগুড়ি ছেড়ে চাকরিসূত্রে ধুপগুড়ি চলে যায়। সেখানে গিয়েও সে 'লালনক্ষত্র' সম্পাদনা করতে থাকে। গীতাংশু চাকরির জন্য কলকাতায়। আমি একা শিলিগুড়িতে। পাহাড়তলি বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু আমি সিরিয়াসলি লেখালেখির জগতে ঢুকে পড়লাম।

(ক্রমশ)
0

স্মৃতির সরণী - বিপুল দাস

Posted in


স্মৃতির সরণী 



কথামালা
বিপুল দাস



আমার জন্ম শিলিগুড়ি হাসপাতালে। আমার ১২/১৩ বছর বয়স পর্যন্ত সেই হাসপাতালটা ছোটোই ছিল। তখন কখনও সেটার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় খুব আপন মনে হতো ঘরগুলো। তারপর কবে সেই একতলা ছোট্ট বাড়িটা ভেঙে দোতলা হ’ল, ক্রমে তিনতলা, চারতলা, বড়ো বড়ো বিল্ডিং, আলাদা আলাদা বিভাগ। এখন কতবার সেই হাসপাতালের সামনে দিয়ে আসা-যাওয়া করি। এখন আর সেই অনুভূতি হয় না। একবারও মনে পড়ে না এখানেই কোনও এক এগারই শ্রাবণ, বুধবার অঝোর ধারায় ভুবনজোড়া কান্নার মাঝে আমার প্রথম কান্না মিশে গিয়েছিল। সেই যে আমার হৃদয়জুড়ে বিষাদের মেঘ চিরকালের আসন পেতে বসেছে – তারপর যত দিন যায়, মেঘ ঘনতর হয়ে ওঠে। জলভার দুঃসহ হয়ে উঠলে আকাশের দিকে দু’হাত তুলে ‘আয় বৃষ্টি’ বলে ডাক দিই।

বাবা মায়ের ছোটো ছেলে আমি। দাদা আমার চেয়ে বারো বছরের বড়ো, দিদি আট বছরের। ভাইবোনের সঙ্গে যে বন্ধুর মতো মেলামেশা, সেটা কেমন, আমার জানা নেই। শুধু শাসন ছিল। দাদার, দিদির, বাবার, মায়ের। তিন সন্তানকে মানুষ করার সংগ্রামে আমার ভিটেমাটি-ছেড়ে-আসা-বাবা আমাদের খোঁজ নেবার সময় পাননি। মা নির্ভেজাল সাদাসিধে গ্রাম্য মহিলা। অসুখবিসুখ হ’লে খোঁজ নেওয়া আর দু’বেলা খেতে দেওয়া ছাড়া সন্তান মানুষ করার অন্যান্য বিষয়ে আশ্চর্য রকম উদাসীনতা ছিল তার। বাবা সে তুলনায় আমাদের লেখাপড়ার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। কিন্তু বাবামায়ের সঙ্গে, দাদাদিদির সঙ্গে কোনও দিনই আমার হৃদ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। ভীষণ বদরাগি ছিল আমার দাদা। একবার সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ায় আমার পিঠে কাবলি জুতোর প্রচন্ড প্রহার পড়েছিল। সে জুতোর নীচে আবার একটা পেরেকের মাথা বেরিয়ে ছিল।

আমার সেই দাদা (বড়দা ডাকতাম। আমার কাকা এবং জ্যাঠা, যাঁরা ‘দালানকোঠা, নাইরহলের বাগান, পুষ্কর্ণি, আমবাগান, ধানি জমি ইত্যাদি কে রক্ষা করিবে, নচেৎ শ্যাখেরা ভোগ করিবে’এই বাহানায় ওদেশে থেকে গিয়েছিলেন, তাঁরা একটি করে লায়েক ছেলেকে এপারে আমাদের এখানে পাঠিয়ে দিতেন, তারা আমাদের সঙ্গেই সকালে ফ্যানাভাত, দুপুরে ডালভাত ও রাতে রুটিসব্জি খেত। পরবর্তীকালে ঘাঁড়ে রোঁয়া গজালে অন্যত্র উড়ে যেত। এদেরই আমি মেজদা, সেজদা ডাকতাম।) ছিল পড়াশোনায় অসম্ভব মেধাবী। এখনও তার পুরনো বন্ধুরা অঙ্কে বড়দার অসাধারণ মেধার কথা বলে। কিন্তু নিজের পড়াশোনার ক্ষতি করে আমার জন্য সময় ব্যয় করতে রাজি ছিল না।

খুব, ভীষণ, টানাটানির ভেতর দিয়ে আমাদের সংসার চলত তখন। ডিম, দুধ, মাংস দূরের কথা, সপ্তাহে হয়তো এক আধদিন মাছের টুকরো পাতে পড়ত। ওপার থেকে আবার একজন দাদা এলে বাবা আরও দু’টো টুইশান নিত। দাদার ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার। কিন্তু আই এস সি পাশ করার পর বাবা সারেন্ডার করলেন। তিনি আর একা সংসার টানতে পারছেন না। দাদা অনেক কান্নাকাটি করলেও চাকরি নিতে হয়েছিল। এই দাদাকে পরবর্তী কালে দেখেছি রাক্ষসের মতো মাছ-মাংস-মিষ্টি খেতে। বাটিতে মাংস কম হলে বা মাছের পিস ছোটো হলে সব ছুঁড়ে ফেলত বউদির মুখের ওপর। স্মরণ থাকে যে, ব্লাড-সুগার বিপজ্জনক সীমা পার হলেও দাদা বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করে প্রাণভরে খেয়ে গেছে এবং অকালেই সাধনোচিত ধামে প্রস্থান করেছে। এই সাইকোলজি নিয়ে পরে ‘খাদক’ নামে একটা গল্প লিখেছিলাম।

আমার দিদি প্রতিবন্ধী। তখন পোলিও নির্মূল কর্মসূচিতে অমিতাভ বা শাহ্‌রুখ ছিল না। ফরিদপুর জেলার অন্তঃপাতী রাখালতলি গ্রামে পালস্‌ পোলিও অভিযান ছিল না। ফলে পোলিওমাইলাইটিসের ভাইরাস দিদিকে পেড়ে ফ্যালে। স্থানীয় ওঝার কেরামতিতে খুব তাড়াতাড়ি তার ডান পা সরু পাটকাঠির মতো হয়। মাকে রান্নাঘরে সাহায্য করা এবং নিজের পড়াশনা ছাড়া তার কোনও অস্তিত্ব বোঝা যেত না। নিজেকে একেবারে নিজের ভেতরেই গুটিয়ে রাখত দিদি। এ ভাবেই দিদি গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে(এদেশে এসে)। একটা সরকারি চাকরিও জুটে যায়। অবসর নেবার কিছুদিন বাদে সে-ও রক্তের চিনির আধিক্য-হেতু চির-চিনির দেশে চলে যায়।

আমার পরিবার বিষয়ে সাতকাহন বলার উদ্দেশ্য আমার অবস্থান বুঝতে পাঠকের সুবিধা। আমি কেমন সঙ্গীহীন একা একা বেড়ে উঠেছি। সংসারে সব সময় কেমন ত্রস্ত থেকেছি। ক্রমে আমারও একটা একেবারে নিজস্ব পৃথিবী আমিই তৈরি করে নিয়েছিলাম। আমার গোপন ভুবন। সেখানে আমিই হেডস্যার, আমিই কানাই। গরমের ছুটির দুপুরে মহানন্দার বিস্তীর্ণ বালুচরে একা একা ঘুরে বেড়াতাম। ফাল্গুন-চৈত্র দুপুরের দিকে একটা বালুর ঝড় ওঠে। নাকেমুখে বালি ঢুকে পড়ে। দাঁত কিচকিচ করে। দূর থেকে দেখতাম শুকনো বালু, শুকনো পাতা, ছেঁড়া কাগজ নিয়ে একটা গরম বাতাসের স্রোত পাক খেয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে। আমার খুব ইচ্ছে করত ঘুর্ণির কেন্দ্রে গিয়ে দাঁড়াতে। দেখি না কী হয়। যথেচ্ছ বুনোকুল খেয়ে মহানন্দার টলটলে সবুজ জলে ঝাঁপ দিয়েছি। বাড়ি একদম পাশে এই নদী আমার বাল্য-সহচর। প্রাণভরে সাঁতার কেটেছি। সময়ের জ্ঞান থাকেনি। শেষে মা খুঁজতে এলে অন্য ঘাটে উঠে এক দৌড়। তখন আমার চোখ টকটকে লাল।

নদীর পারে শিমুলতলায় বসে একা একা কত সময় কেটেছে আমার। ওপারে পলাশবন। বসন্তে এপার থেকে দেখি ওপারে থোকা থোকা আগুন। একা একা সেই আগুন দেখি। অস্পষ্ট, কেমন একটা ছুঁই-ছুঁই-করেও ছুঁতে না পারার ইশারা আমার বুকের ভেতরে খেলা করে।ভরা বর্ষায় পাহাড় গড়িয়ে আসে গেরুয়া জলের স্রোত। পাহাড়ে ধস্‌ নামে। শেকড়সুদ্ধ চা-গাছ, শালগাছ, মরামানুষ ভেসে যায়। একবার উপুড় হয়ে ভেসে যাওয়া সাদা লাশ দেখেছিলাম। ছিপ দিয়ে চ্যালামাছ ধরছিলাম। উত্তরে উজান থেকে একজ লোক চিৎকার করে আমাকে কী যেন বলছিল। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল না। সে হাত ইশারা করে আমাকে পার থেকে দূরে সরে যেতে বলছিল। হঠাৎ নাকে বিকট একটা পচা গন্ধ এল। দেখলাম একটা মরামানুষ, ফুলে ঢোল, ভেসে যাচ্ছে। খুব ভয় পেয়েছিলাম। সেই গন্ধ এখনও মাঝে মাঝে নাকে আসে। অনেক দিন একা মাছ ধরতে যাইনি।

এখন আর সে নদী চিনতে পারি না। এখন নদীর পারে কখনও দাঁড়ালে বুঝি নদী আর আমার নেই। আমার সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটে গেছে। ওপারে সেই পলাশবন এখন বিশাল বসতি। এপারে নদীপার বলে কিছু নেই। নদী অনেক দূরে সরে গেছে। পাড়জুড়ে লোকালয়। দোতলা বাড়ি। সেখানে টিভি চলছে। যেখানে ছিল বালুচর, বুনোকুলের ঝোঁপ – সেখানে পাকা রাস্তা। নিউতরুণ বয়েজ ক্লাব। আর আমার সেই স্বচ্ছসবুজ জলের টলটলে নদী, স্পষ্ট নুড়ি দেখা যেত, সে নদী অতি শীর্ণ, দীর্ণ, সমস্ত শহরের আবিলতা নিয়ে বিষাদময় এক ভিখারিনির মতো বয়ে যায় দক্ষিণে। তার এই ক্লেশভার, এই অপমান দেখে আমার চোখে জল আসে। এই নদীতে একা এক দুপুরে মাছ ধরার সময় প্রথম সাদালাশ দেখেছিলাম। যুবতী নারীকে অসংবৃত স্নান দেখেছিলাম। প্রথম উন্মুক্ত নিটোল ধবল স্তনভার দেখেছিলা। বাড়ি ফিরে সেদিন আমার জ্বর এসেছিল। প্রাইমারি স্কুলের বেঞ্চে কে যেন ছুরি দিয়ে খারাপ কথা লিখে রেখেছিল। সেই প্রথম আমি ‘যোনি’ শব্দের চালু প্রতিশব্দটি শিখলাম। তখন ধানখেতের আলের ওপর দিয়ে স্কুলে যাই। বর্ষাকালে আল ডুবে থাকে। তখন ঘুরপথে পালবাড়ির পেছন দিয়ে যাওয়া হয়। যে রাতে খুব বৃষ্টি নামে, পরদিন সকালে সব জল-থৈথৈ। ধানখেতের সব জল যেখান দিয়ে সাদা ফেনা তুলে বড়ো মাঠে পড়ছে, সেখানে হাতজাল ধরে স্রোতের উল্টোমুখে দাঁড়িয়ে থাকে বদনড্রাইভার। চকচকে পুঁটিমাছের ঝাঁক লাফ দিয়ে দিয়ে জালে পড়ে। দেখতে থাকি। স্কুলের দেরি হয়ে যায়। শীতকালে পায়ের ওপর আমন ধানের শিষ লুটিয়ে পড়ে। ধানকাটা হয়ে গেলে স্কুলে যাওয়ার পথে খা খা মাঠের দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতরেও কেমন শূন্যতা এসে ভরে যায়। বেলা সাড়ে দশটার সময়ও মাঠের শিশির শুকোয় না। আকাশ মেঘলা, উত্তুরে হাওয়ায় ছেঁড়া সোয়েটারের ভেতরে আরও কুঁকড়েমুকড়ে যাই। ধানগাছের গোড়া থেকে ব্লেড দিয়ে নাড়া কেটে বাঁশি বানাই। খারাপ শব্দটা শেখার পর বাঁশি বাজাতে আর ভালো লাগে না।

(ক্রমশঃ)
0

স্মৃতির সরণী - সোনালী

Posted in



স্মৃতির সরণী


রামধনু
সোনালী


ইংরেজি মাধ্যম ইস্কুলে পুপু শিখে এলো ভিবজিয়োর। রঙ মিলিয়ে মিলিয়ে ছবি। ভি ফর ভায়োলেট, আই ফর ইন্ডিগো মানে ডিপ ব্লু, বি ফর ব্লু, জি ফর গ্রিন, ওয়াই ফোর ইয়েলো, ও ফর অরেঞ্জ, আর ফর রেড।

মা সঙ্গে সঙ্গেই বাড়িতে বললেন দেখো, বেনীআসহকলা। বেগুনি, নীল, আকাশি, সবুজ, হলুদ, কমলা, লাল।

অক্ষর। শব্দ। আর মজা।

“টেইল ইন কাউ ডাঙ্গ অ্যান্ড কাউ ডাঙ্গ ইন টেইল”; বাবা মশাইয়ের অনবদ্য ভাষায় ল্যাজে গোবরে হবার ইংরেজি।

শুধু শব্দ নিয়ে খেলা করতে করতেই যে কত আনন্দ রোজকার দিনগুলোর মধ্যে ভরে দেওয়া যায়, এ যারা পুপুর ছোট বেলার ধারে কাছে না এসেছে তাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল।

শব্দ আর তাল। ছন্দ আর সুর। আর রাশি রাশি মজা।

এই সবই একখানা দশ ফুট বাই দশ ফুটের এক কামরা ভাড়া বাড়ির সব নেইদের অনায়াসে ঢেকে রাখত। সর্বদা রাজকন্যার মতো আহ্লাদে ডগমগ করে রাখত পুপুকে। ছোট দুই বছরের পুপু সকালের বিছানায় চোখ কচলাতে কচলাতে শুনত,

“সাগর সাগর সাগর নদীর জলে ডাগর ---সাগর ডাকে যদি ঝর্না হবে নদী।”

দেড় হাত মানুষ। সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি ভুঁড়ির ওপর টাইট। লাল টুকটুকে হাফ প্যান্ট। কদম ছাঁট খোঁচা খোঁচা চুল। বাবা নিজের পত্রিকার সম্পাদকীয় লিখছেন উপুড় হয়ে শুয়ে। পুপু বাবার পিঠের ওপর। খানিক পরে সে উসখুস করতেই বাবা ঘাড় ঘুরিয়ে মুখ ফেরান। মেলাও দেখি।

“একা একা বসে ছাতে
পুপু খায় আলু ভাতে –”

ভালো মিল না হলে সমস্যা। তাল কাটলে বাবা বাতিল করে দেবেন। বলবেন, এত মিলল না, চিলল।

হাতে খড়ি হলো যখন, মা “বুড়ো আংলা’ বইটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

“ পপু সোনা মা বুড়ি যখ
করে কেবল বকর বক---”

তো এই সব যখের ধনের মতো দামি সম্পত্তি নিয়েই পুপু আর তার বাবা মায়ের রাজ্যপাট। সারা বছরে যে মাত্র এক বারই তারা ভাল জামা কিনতে দোকানে যায় দুর্গা পুজোর সময় তাতে কারও কোনও দুঃখ গজানোর মতো ফাঁকফোকর ছিল না।

তখন নটার সাইরেন বাজত। আওয়াজ হতো ভোঁ করে। সব বাড়িতে লোকে ঘড়ি মেলাত তার সংগে। বাবা মশাই রোজ দাড়ি কাটেন সেই সময়। অফিসের গাড়ি আসবে। হঠাৎ এক দিন গুন গুন করে বললেন, এই শোন গানটা।

“বাঁশী বাজল কোথায়?
গোকুলে তো নাইরে কানু
সে যে গেছে মথুরায়
তবে বাঁশী বাজল কোথায়?”
0

স্মৃতির সরণী - ঈশানী রায়চৌধুরী

Posted in


স্মৃতির সরণী


অ-রূপকথা

ঈশানী রায়চৌধুরী



পূর্ব প্রকাশিতর পর



(৫)



চার চারটে বছর কেটে গেল লালবাজারে। যাবজ্জীবন কারাবাসের হুকুম হলে একটা সময়ের পরে কয়েদীর আর তেমন হেলদোল হয় না, তা আমিও সে নিয়মের ব্যতিক্রম ছিলাম না। চাপ একটাই ছিল, ওই হায়েস্ট মার্কসের কলামটা আর এটা শেষ পর্যন্ত নিশ্চিত করা যে রেজাল্ট বেরোলে যেন আমার আগে আর কারো নাম না থাকে। কারণ তাহলে আমার ফাঁসি হবেই, মায়ের হাতে।

ক্লাস নাইনে উঠলাম আমরা। এবার তিনটে থেকে দুটো সেকশন হলো। যারা অ্যাডিশনাল ম্যাথস বা বায়োলজি নিল, তারা 'এ' সেকশন আর লজিক-সাইকোলজি নিলে 'বি'। আমার আদৌ ইচ্ছে ছিল না সায়েন্স সাবজেক্টের চক্করে পড়ি, কিন্তু আমাদের বাড়ি বরাবর হিটলারের ভক্ত। অগত্যা!

কিছু পুরোনো বন্ধু গেল অন্য সেকশনে। কিছু নতুন বন্ধু এল। ক্লাস এইটে আমাদের ইংরিজি পড়াতে এসেছিলেন এক দিদি। নিঘাত বোয়েল ফাজিল (জ-এর উচ্চারণ জেড-এর মতো)। গুজরাটি বোরি মুসলমান মহিলা, অবিবাহিতা। একটি বর্ণ বাংলা বোঝেন না। 

সিস্টাররা তবু বাংলা বলেন। কিন্তু তাতে কী! অসাধারণ শিক্ষিকা। আমরা মুগ্ধ ছিলাম। আমি অন্তত ক্লাস এইটের আগে যতটা বাংলা গল্প উপন্যাস পড়তাম, ততটা ইংরিজি সাহিত্য পড়তাম না। দিদি আমাকে আমূল বদলে দিলেন। আমার সঙ্গে একটা অদ্ভুত লেনদেনের সম্পর্ক তৈরী হলো....ইংরিজি বইয়ের। আমার বাড়িতে ছিল কিছু, দিদির বাড়িতে তো সবই....আমরা বই বদলাবদলি করতাম। সেই যে নেশা তৈরী হলো, সেই যে ইংরিজি -বাংলা দুই-ই আঁকড়ে বাঁচা শুরু হলো ক্লাস নাইনে দিদি ক্লাস নিতেন না বটে, কিন্তু আমার নেশাটি অটুট রইল।

দিদি যখন স্কুলে আসেন, সঙ্গে একটি আছোলা বাঁশ এনেছিলেন। দিদিরই বান্ধবী আর এক ইংরিজির দিদিমণি। ক্লাস নাইনে উঠে আমাদের চোখ কপালে উঠল। তাঁর বান্ধবীটি, জয়শ্রী ঘটক। ওই রক্ষণশীল স্কুলে, যেখানে কানে ঝোলা দুল পরা বা চুলে রঙিন ক্লিপ লাগানো পর্যন্ত নিষিদ্ধ, সেখানে তিনি প্লাক করা ভুরুতে, ঠোঁটে লিপগ্লস লাগিয়ে, স্লিভলেস ব্লাউজে এবং নাভির নীচে শাড়ি পরে মোহময়ী। তবে সে মোহ ঘুচে গেল প্রথম দিনেই, যেদিন ক্লাসে এসে চিবিয়ে চিবিয়ে দাঁত চেপে প্রবল অ্যাকসেন্ট সম্বলিত ইংরিজিতে ঘোষণা করলেন, উনি কোনও ইডিয়সি বরদাস্ত করবেন না। আর কী যে পড়ান, চেপা দাঁতের দুর্গ পেরিয়ে গ্লস-চিকচিক ঠোঁট ডিঙিয়ে সে তো আমাদের কানেই ঢোকে না! ক্লাস টেস্টে তো ডাহা ফেল করব! এবং তাই হলো। ক্যাটরিনা ম্যান্সফিল্ডের 'দ্য ডল'স হাউস' –এর ওপরে প্রথম পরীক্ষাটি হলো এবং তাতে আমি দশে আড়াই পেলাম। না না, হাসার কিছু নেই, ওটাই হায়েস্ট। মাকে দিয়ে খাতা সাইন করাতে হবে তো! আমি প্রচুর সাহস সঞ্চয় করে জয়শ্রীদিকে জিজ্ঞেস করলাম, "ম্যাডাম, একটু যদি গাইড করে দেন...কোথায় ভুল...." তিনি অতি লীলায়িত ভঙ্গিমায় গোলাপি নখপালিশ মাখা হাত উল্টে বললেন, "কোত্থাও ভুল নেই তো! শুধু এই লাস্ট সেন্টেন্সটা তুমি কমপ্লেক্স সেন্টেন্স লিখেছ, ওটা কম্পাউন্ড সেন্টেন্স লিখলে বেটার হতো।"

তবে এ যমযন্ত্রণা বেশিদিন সইতে হয়নি। জয়শ্রীদি দু-তিন মাস পরেই বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন এবং তার মাসখানেক বাদে আমাদের রেহাই দিয়ে হতভাগ্য স্বামীটির স্কন্ধে আরূঢ়া হলেন। আমাদের ইংরিজি পড়াতে এলেন সিস্টার ম্যাক্সিমিলা। ক্লাসে চন্দনগন্ধী বাতাস বইতে শুরু করল।



সিস্টার ম্যাক্সিমিলা দুটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। আজ থেকে চার দশক আগে তা মোটেই সহজ ছিল না, বিশেষ করে চুড়ান্ত রক্ষণশীল রোমান ক্যাথলিক স্কুলে।

প্রথমটি হলো 'প্রেয়ার রুম'। এই স্কুলেও চ্যাপেল ছিল, আমরা মাঝে মধ্যে ইচ্ছে সুখে সেখানে গিয়ে বাইরে রাখা মন্ত্রপূত জর্ডন নদীর জল মাথায় ছিটিয়ে ভেতরে হাঁটু গেড়ে বসে বিড়বিড় করে প্রার্থনাও করতাম। তবে সাধারণ রোজের প্রার্থনা তো উঠোনেই হোতো। আবার চ্যাপেলের পাশেই প্রায় একটা 'সিক রুম'-ও ছিল, সেখানে খুব বেকায়দায় পড়লে অসুখের ছুতোয় এক আধবার আমিও গিয়ে প্রাণে বেঁচেছি (আসলে সে ঘরটা এত সুন্দর করে সাজানো আর গ্র্যান্ড পিয়ানোও ছিল যে হোমওয়ার্ক করতে ভুলে গেলে মাথাব্যথার ভান করতেই হতো!)। কিন্তু প্রেয়ার রুমের কনসেপ্ট আলাদা। ঘরটি আধো-অন্ধকার, মেঝেতে জাজিম, মোমদানিতে মোমবাতি, কিছু ফুল সাজানো ফুলদানিতে আর আবছা ধূপের গন্ধ (টাটকা ফুল আর নতুন মোম, রোজ ধূপ জ্বালানো হতো ....ডিউটি ভাগ করে দেওয়া হতো আমাদের )। কোনও ঠাকুর দেবতা ধর্মগুরুর ছবি বা মূর্তির বালাই নেই। শুধু চোখ বুজে প্রার্থনা করাটি আছে। এ এক অদ্ভুত ঈশ্বর -নিরীশ্বরবাদের ধারণা। কোনও জুলুম নেই, কোনও বাধ্যতামূলক নিয়ম নেই, কোনও ধরাবাঁধা সময় নেই। প্রার্থনার তো নির্দিষ্ট সময় থাকে না, তাই না? ওই প্রেয়ার রুম আমাদের নিজেদের চিনতে শেখার প্রথম ধাপটি তৈরী করে দিয়েছিল।

দ্বিতীয় বিষয়টি আবার বৈপ্লবিক। সিস্টার আমাদের "সেক্স এডুকেশন"- এর ক্লাস চালু করলেন। চিন্তা করুন! এক সন্ন্যাসিনী আমাদের জন্মচক্রের পাঠ দিচ্ছেন, রীতিমতো ছবি এঁকে, চার্ট তৈরী করে। বলছেন, মেয়েদের অনেক অসুবিধে, অনেক বিপদ। তাদের এগুলো জানা দরকার। আমরা ক্লাস করছি, নোট নিচ্ছি, বাড়ির লোকজন চমকে যাচ্ছে। তবে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। একদিন সিস্টার আমাকে ক্লাসে ফট করে দাঁড় করিয়ে বললেন, "ঈশানী, মেয়েরা কতটা বুঝছে জানি না, তুমি একটু বাংলায় ওদের এক্সপ্লেন করো।"

সব্বোনাশ! এ গূঢ়তত্ত্ব বাংলায়! আমি হাত নেড়ে বলেছিলাম, "কিচ্ছু ভাববেন না সিস্টার, এরা সব্বাই যথেষ্ট সেয়ানা, ঠিক যা বোঝার বুঝে নিচ্ছে।"

এখন ফিরে তাকাই যখন, সিস্টারের কথা ভাবি.... মনে হয়...কিছু কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা সময়ের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে থাকেন ...চিন্তায়, ভাবনায়, কাজে। সিস্টার ঠিক তেমনটিই ছিলেন। 




(৬)



বেশিদিন সুখ কারওর কপালে সয় না। আমারও তাই হলো। নাইনের অ্যানুয়েল পরীক্ষায় ভেবেছিলাম অঙ্কতে সব ঠিকই করেছি, বিধাতা মুচকি হেসেছিলেন। রেজাল্ট বেরোনোর দিন আমার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে সিস্টার ভেরোনিকা অমোঘ বাক্যটি উচ্চারণ করলেন, "ঈশানী অ্যানুয়েলে কিন্তু থার্ড হয়েছে।" রিপোর্টকার্ডে আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েছিল অঙ্কের নম্বর। আমি একশ'তে ঊনপঞ্চাশ পেয়েছি! খবর নিয়ে জানলাম, জ্যামিতিতে পঞ্চাশে ঊনপঞ্চাশ পেয়েছি বটে, কিন্তু অ্যালজেব্রাতে পঞ্চাশে শূন্য! আমি সব x-y-z দেওয়া অঙ্কগুলো a-b-c দিয়ে আর a-b-c-র অঙ্কগুলো x-y-z দিয়ে কষে এসেছি। এ নিয়ে বিশদ আলোচনায় যেতে চাই না। হাফ-ইয়ার্লি আর অ্যানুয়েলের নম্বর যোগ করে যদিও আমার সামান্য পদোন্নতি হলো, কপালে সেকেন্ড প্রাইজ, কিন্তু সেই থেকে আমার দু-কানের মাপে সামান্য অ্যাসিমেট্রি আছে। সাদা চোখে অবিশ্যি ঠাহর করা যায় না।

ক্লাস টেনে উঠে যে ক্লাসরুম আমাদের কপালে জুটল, সেটি খাসা। চারতলার ওপরে জানলার পাল্লা একটু কায়দা করে খুলে রাখলে যদি ঠিকঠাক ডেস্কটি ম্যানেজ করা যায়, দিদিদের সাধ্যি নেই ওই ডেস্কের ছাত্রীকে দেখতে পাবেন স্পষ্ট করে। আমি জানলার ধরে মৌরসীপাট্টা গাড়লাম। জানলা দিয়ে উদাস চোখে পাশের বাড়িগুলোর ছাদে রংবেরঙের শাড়ি ঝুলতে দেখা যায়, রোদে দেওয়া আচারের বয়াম, দু-চারটে শখের ফুলগাছ। কে জানে কার বাড়িতে মুরগি পুষেছে, তারা নিয়মিত জানান দেয়। তারা ডাকাডাকি শুরু করলেই জীবজন্তুর বিষয়ে সবজান্তা ডেইজি ফিসফিস করে ঘোষণা করে, "ডিম পেড়েছে"। এবং আমি প্রবল তর্কে সামিল হই একটা মুরগি দিনে ম্যাক্সিমাম ক'টা ডিম দেয়। জীববিদ্যার মুখে ছাই দিয়ে নির্ঘাৎ অনেক, কারণ বাজারে মুরগির চেয়ে ডিমের সংখ্যা বেশি। সে তর্ক শুনে সিস্টার ভেরোনিকা দৈববাণী উচ্চারণ করেন, "ঈশানী বায়োলজি খাতার পাতায় একাই ঝুড়ি ঝুড়ি ডিম পাড়বে।"

সংস্কৃত জ্ঞানভাণ্ডার বাড়াতে সাহায্য করে সুতপা। গোয়াবাগানের গোঁড়া পরিবারের মেয়ে, বাড়িশুদ্ধু কোনও মঠে কোনও বাবাজির কৃপাধন্য, যে বাড়িতে নিয়মিত নাম-সংকীর্তন হয় এবং মেয়েরা পনেরো পেরোলেই বাইরে শাড়ি পরে, সে বাড়ির কন্যা সুতপা আমাকে বিপুল পরাক্রমে 'স্তোকনম্রা' থেকে 'বলাৎকার'... যাবতীয় সংস্কৃত শব্দের আভিধানিক অর্থ শেখাতে তৎপর হয়।

এই "বাইরের বই" পড়ে জ্ঞান বাড়ানোর তাগিদে আমার শুরু হয় জানলার আড়াল খুঁজে ক্লাসে কোলের ওপরে গল্প/কবিতার বই রেখে পড়া। সব ক্লাসে সুবিধে হোতোনা। বেছে নিয়েছিলাম দেবিকাদির ইতিহাস ক্লাস। আমি একা নই। এ নেশা পাপিয়া দত্তরও ছিল। একবার শোভাদির ভূগোল ক্লাসে চান্স নিতে গিয়ে ধরা পড়লাম দুজনই। পাপিয়া বেঁচে গেল অক্লান্ত বকুনির হাত থেকে, কারণ ও পড়ছিল শরৎবাবুর 'ক্লাসিক", বোকার মরণ আর কাকে বলে! আমি ধরা পড়লাম সুনীলের "বৃত্তের বাইরে" হাতে নিয়ে। শোভাদি "ম্যায়েরা বড়ই লঘুচরিত্রের" নিদান হেঁকে রাগ করে পাঁচটা ভাব-সম্প্রসারণ হোমটাস্ক দিয়েছিলেন।



ইতিহাস ক্লাসেও ধরা পড়লাম। সেদিন হাতে ছিল "ধূসর পাণ্ডুলিপি"। দেবিকাদি খুব ঠাণ্ডা মাথায় মেজাজ ঠিক রেখে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, "ক্লাসে এমন দুর্মতি কেন?"

আমি বলেছিলাম, "ইতিহাস নিজে নিজেই তো পড়া হয়ে যায়। আমার ভালো লাগে না ক্লাসে পড়া শুনতে।"

আমাকে তাজ্জব করে দেবিকাদি বলেছিলেন, "ঠিক আছে, অনুমতি দিলাম। তুমি অন্য বই পড়তে পারো। তবে অন্যদের ডিস্টার্ব না করলেই হলো।"

এক -দুজন সহপাঠিনী এ হেন পক্ষপাতিত্বে বিপুল প্রতিবাদ জানালে দেবিকাদি যুক্তি দিয়েছিলেন, "অনুমতি দিয়েছি, কারণ ক্লাসে পড়া শুনুক বা না শুনুক, ঈশানী আমাকে পরীক্ষার খাতায় ওর কাছ থেকে যা আশা করি, তার চেয়ে অনেক বেশিই দেয়।"

এখন বুঝি, আগে অতটা দিতাম কি না জানি না, এ কথা শোনার পরে অন্তত নিজের কাছে নিজে দায়বদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম।

এই বাড়তি পড়ার নেশা এমনই ছিল যে আমরা ঠোঙা পড়াও বাদ দিতাম না। আর এক পাপিয়া ছিল, পাপিয়া ঘোষ, তার বাড়িতে রোজ ঠাকুর পুজোর নকুলদানা গুজিয়া আসত কাগজের ঠোঙায়। তাকে বলা ছিল, ঠোঙা সাহিত্য কালজয়ী। তাতে বঙ্কিম থেকে পাড়ার দাদাকে লেখা প্রেমপত্র এমনকী বটতলা সাহিত্যও থাকে। ফলে সে রোজ ঠোঙা সাপ্লাই করত। ঠোঙা পড়ে পড়ে আমরা তিন চারজন পৃথিবীর বহু বিষয়ে ওয়াকিবহাল হয়েছিলাম। তবে এ কথা 'চুকলিখোর' ভালো মেয়েরা জানত না। এ সব প্রিভিলেজড গ্ৰুপের জন্যই শুধু বরাদ্দ ছিল।

ছেলেদের স্কুলে কী হয় জানি না, তবে আমাদের, মানে মেয়েদের স্কুলে তো ওই সেলাই আর ড্রয়িং ক্লাস বাধ্যতামূলক । আমার মতো অপদার্থ অপোগণ্ডদের জন্য সে প্রায় হিটলারের কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্প। প্রতি সপ্তাহে ঠাকুরের মাথায় ফুল চড়িয়ে বিড়বিড় করে বলি, "এ সপ্তাহে ক্লাস বানচাল হোক।" কিন্তু দিদিমণিদের সোনার স্বাস্থ্য! আমারও যে জ্বরজারি হয়, তাও সপ্তাহের অন্যদিনগুলোতে। বিশেষ করে যে দিন লাইব্রেরি ক্লাস থাকে। অবিশ্যি আমাদের সময়ের লাইব্রেরির গল্প যত কম করা যায়, ততই মঙ্গল। মহাপুরুষদের জীবনী, কিছু ভ্রমণ বৃত্তান্ত, কিছু ছেলেমানুষী রূপকথা ... এই সবই বেশি। আর ছিল কিছু বিদেশী বইয়ের অনুবাদ।

কাজেই লাইব্রেরি ক্লাসের জন্য প্রাণ হাঁকুপাকু করে বটে ....কিন্তু তা হট্টগোল করার উৎসাহে। সেলাই আর ড্রয়িং ক্লাসে সে সুখ নেই। কিছুতেই আঁচলসমেত শাড়ির পাড় বা হাড়জিরজিরে খিটখিটে বুড়োর মুখ এঁকে উঠতে পারি না, অথচ আমার আশেপাশে কেমন ফুলেল আঁচল উড়তে থাকে সিলিং ফ্যানের হাওয়ায়, বুড়োর চোখ দুটো পাশের ডেস্কের খাতার সীমানা পেরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ফিচেল হাসি হাসে। আমার খাতায় নম্বর হোঁচট খেয়ে সেই যে মুখ থুবড়ে পড়ে, একেবারে কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার।

সেলাই ক্লাসও তথৈবচ। ক্লাস টেনে উঠেও আমার উন্নতির লক্ষণ নেই। হেম সেলাই ভাবলেশহীনভাবে সটান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কুচকাওয়াজ করে। ডাবল চেন এক একটা দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট চেহারা, আবার এক একটা সেই দুর্ভিক্ষের মূর্তিমান কারণ মার্কা চেহারা। উল বুনতে গিয়ে ঘর পড়ে যায়। আমি অবিশ্রান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাই মঞ্জুলা দিদিমণিকে বোঝাতে যে স্রেফ প্রতি কাঁটায় শুধু সোজা ঘর বুনলেও দিব্যি ডিজাইন হয়। এই সব এঁড়ে তর্কের কারণে আমি দিদিমণির বিষনজরে। পরীক্ষায় বুনতে হয় খুদে মোজা, খুদে জাম্পার, কিংবা খুচ করে আস্ত কাপড় বেবাক কেটে ফেলে ডেকোরেটিভ রিপু। কী আপদ! কোনওরকমে যাচ্ছেতাই জোড়াতালি দিয়ে কাজ সারি। নম্বর আর পাঁচের কোটা পেরোয় না! অথচ অন্যরা কেউ কেউ কেমন ফটাফট কাজ করে, নম্বর পায়। আমার সেলাই বোনা "কার্টসি মা" অব্যাহত থাকে। মানে সারা বছরের কাজ। পরীক্ষায় ক্যাচ কট কট কেস। কী ভাগ্যিস, লাল দাগটুকু পড়ে না।

ক্লাস এইট পর্যন্ত এসব আপদ বালাই ছিল। ক্লাস নাইনে উঠে কিঞ্চিৎ ফুর্তি এসেছিল মনে। ওয়ার্ক এডুকেশন এল। ভাবলাম, সেলাই থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া গেল। ও হরি, কিস্যুই না। এই পুঁতির বটুয়া, এই চুমকির কাজ, এই অ্যাপ্লিক .... আমার জীবন মহানিশা, হাতেও হ্যারিকেন। আবার নাকি ক্লাস টেনে উঠে মোমবাতি, সাবানও বানাতে হবে। মোমবাতিটা খানিক উৎরে গেল, শুধু অর্ধেকের বেশি মোমবাতির সলতেগুলো মাথা উঁচু করে শহীদ হতে রাজি হলো না। কিন্তু সাবান? দেখতে ঠিক চিটচিটে গুড়ের নারকেল নাড়ু। তাতে আবার ওই বেশি ঝুনো নারকেল হলে কেমন একটা তেল তেল বিদিকিচ্ছিরি গন্ধ ছাড়ে, ঠিক তেমন।

ঠিক নাড়ু পাকানোর মতো করে আমরা মহা উত্তেজনায় গোল্লা পাকাচ্ছি, মঞ্জুলা দিদিমণি সরেজমিনে তদন্ত করতে এসে বললেন, "কী করছ?"

আমি দোষের মধ্যে বলে ফেলেছিলাম, "সাবানের পিণ্ডি চটকাচ্ছি".... সে কী রাগ! গার্জেন কল হবার দশা! অথচ আক্ষরিকভাবেই কিন্তু সেটাই করা হচ্ছিল। আমরা খুব চেষ্টা করছিলাম, সাবান যাতে একটা জিওমেট্রিক শেপ পায় , কিন্তু হতভাগা সাবান নিজেই এমন একবগ্গা, কে জানত!

সুতরাং ব্যাক টু স্কোয়ার ওয়ান। সেই মঞ্জুলাদি। সেই পাঁচ বা ছয়ের ঘরে নম্বর। সেই ক্লাসে খোরাক। সেই কিছু মেয়ের দিদিমণির সঙ্গে গা ঘেঁষা .... মা –বেড়াল আর ছানা -বেড়ালের মতো আর সেই আমাকে মঞ্জুলাদির শাসানি, "এই একশ' নম্বর আমার হাতে, তোমাকে পঞ্চাশের বেশি দেবই না, দেখব কী কর অবাধ্য মেয়ে!"

(কারণে অকারণে বকুনি আর হেনস্তার কারণে আমার তো পুরোনো খার ছিলই। সেই রাগে মঞ্জুলাদি অ্যালকোহলকে "অ্যালকোলাহল" বলতেন বলে দোষের মধ্যে আমি বলেছিলাম, "বেশি কোলাহল হলে মন দিয়ে ক্লাস করি কী করে!" সেই থেকেই আর কী.... মানে আরও গোল বেধে গেল। সাপে - নেউলে কেস!)

তবে আমিও তো কম পাজী ছিলাম না! অনেকেই তো বাড়িতে মা, ঠাকুমা, দিদির দৌলতে সেলাই ক্লাসে করে কম্মে খাচ্ছে। সবাই কি সবেতে এক্সপার্ট হয় নাকি? শুধু আমি একাই বিষ নজরে? এমন মজা দেখাব না!

স্কুলে হাতের কাজ, সেলাই, বোনার একজিবিশন হতো ঘটা করে। ক্লাস ফোরের, সিক্সের ...কী সব সেলাই, বোনা! বাপ রে! দেখে মনে হবে মায়ের পেট থেকে পড়েছে উল বুনতে বুনতে বা নিজের অন্নপ্রাশনের কার্পেটের আসন নিজেই সেলাই করেছে। কেউ কেউ হয়ত ক্ষণজন্মা মহিয়সী, তারা পারত, কিন্তু বেশিরভাগই "কার্টসি মা মাসি দিদি" কেস।

ওই একজিবিশনে বাইরের লোকও আসতে পারত কেনাকাটা করতে। আমার এক বন্ধুর দিদিকে ফিট করলাম। সে বেচারী সারা স্কুললাইফ আমারই মতো অবমাননার শিকার। ঠিক বেরোবার আগে একটা খাতা থাকত, দর্শকদের প্রতিক্রিয়া লেখার জন্য। সব্বাই তাতে ভালো ভালো কথা লিখত। সেগুলো আবার পরে চেঁচিয়ে পড়ে শোনানো হতো সবাইকে।

তা একজিবিশন শেষ। সবাই দর্শক- প্রতিক্রিয়া জানতে উদগ্রীব। যে পড়ে শোনাচ্ছিল, সে দেখি তোতলাচ্ছে। যা লেখা আছে, পড়লে সত্যনাশ!

কী লেখা আছে এমন?

"বাঃ, দেখে বড় ভালো লাগল যে গার্জেনদের হাতের কাজ, উল বোনা, সেলাই ....সবেতেই ভারী উন্নতি হয়েছে। দিনে দিনে আরও শ্রীবৃদ্ধি হোক। তবে কচিকাঁচারা কেমন শিখল, খুব একটা সত্যিই বোঝা গেল না।"

নেকনজরে ছিলাম না, হাত কচলাতে পারতাম না, ঘাড় বেঁকা তে-এঁটে টাইপ ছিলাম তো, মঞ্জুলাদি সত্যিই আমাকে অন্যায়ভাবে মাধ্যমিকের ইন্টারনাল অ্যাসেসমেন্টে পেনালাইজ করেছিলেন। অবিশ্যি করেও যে তাতে খুব জব্দ করতে পেরেছিলেন, তা নয়...কারণ আগেই থেকে ওঁর শাসানিতে অভ্যস্ত ছিলাম বলে নিজেকে বাকি বিষয়গুলোতে সেভাবেই তৈরী করেছিলাম, যাতে মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর পরে মায়ের দৌলতে কানের অ্যাসিমেট্রি আরও না বেড়ে যায়। তবে আজও ....আমার ক্ষোভের জায়গাটা রয়েই গেছে। থেকেও যাবে। আমৃত্যু।




(৭)



ক্লাস টেনে আমরা মুর্শিদাবাদ গিয়েছিলাম। শিক্ষামূলক ভ্রমণ। ইতিহাসের আনাচে কানাচে ঘোরাঘুরি। সে কী রোমাঞ্চ! যারা চার দশক আগে আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে প্যারোলে ছাড়া পেয়ে দু-দিনের জন্য বাড়ি যেত, তারা ছাড়া এ আনন্দ আর কেউ বুঝবে না। বাসে করে যাওয়া, দু-রাত্তির বাইরে থাকা। সঙ্গে সিস্টার জিটা, সিস্টার ভেরোনিকা, দেবিকাদি (সঙ্গে ল্যাংবোট পিয়াসা, দিদির বাচ্চা মেয়ে) আর নিঘাতদি। দেবিকাদি ভয়ে ভয়ে যাচ্ছেন। আমরা যেকোনও মুহূর্তে পিয়াসার শব্দভাণ্ডার বাড়িয়ে দিতে পারি। বাংলা ব্যাকরণ ক্লাসে তখন আমাদের যাবতীয় উৎসাহ বহুব্রীহি সমাসের ব্যাসবাক্যে...উটকপালি, চিরুনদাঁতি ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি আমাদের দেখবেন না মেয়ে আগলাবেন? আমাদের বিরাট কৌতূহল সিস্টারদের চুলের দৈর্ঘ্য নিয়ে। মানে তাঁরা নেড়ুমুণ্ডি, না কদমছাঁট না ববকাট। সে কৌতূহল মিটেছিল, কারণ মুর্শিদাবাদে রাতে শুতে যাওয়ার সময়ে পাকেচক্রে সিস্টার জিটার মাথা থেকে টুপিটি খুলে যায়।

আমি খুব দুষ্টু ছিলাম। বাজি ধরেছিলাম, সবাই ইউনিফর্ম পরলেও আমি রঙিন জামায় ফুরফুরে হয়ে ঘুরব। কিন্তু কী করে? খুব সহজ। বাসে লাঞ্চ ট্রে উল্টে দাও ...নিজের ইউনিফর্মের ওপরে। ভাত, ডাল, বাঁধাকপির তরকারি আর ডিমের ঝোলে সাদা জামা মাখামাখি। তখন বাস থামিয়ে অচেনা বাড়ির কলের জলে জামা ধুয়ে বাসের পেছনের সীটে শুকোতে দাও আর ব্যাগ থেকে রঙিন জামাটি পরে নাও। বাড়তি স্কুল ড্রেসটা পরের দিন পরতে হবে তো! এতে যা হলুদের দাগ, বাড়ি গিয়ে সাবান সোডা দিয়ে ফোটাতে হবে।

মনে আছে, ফেরার পথে জয়ন্তীর কেনা ছানাবড়ার হাঁড়ি ওর ঘুমে কাতর অবস্থার সুযোগ নিয়ে আমরা শেষ করেছিলাম। শুধু রস পড়েছিল। জয়ন্তীর সে কী হাঁউমাউ করে চিল্লানো! ফেরার পথে আমরা কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করেছিলাম, যাতে বাস খারাপ হয়। আমরা আরও খানিক বাড়ির বাইরে থাকতে পারি। তেত্রিশ কোটি দেবদেবী আর যীশু আমাদের সহায় ছিলেন। বাস খারাপ হয়েছিল। আমরা স্কুলে ফিরেছিলাম মাঝরাত পার করে।

ওই অত সাদা সবকিছু (যদিও সাদা আমার সবচেয়ে প্রিয় রং)... নিয়ম ভাঙার খুব ঝোঁক ছিল আমার। মুর্শিদাবাদে কেলেঙ্কারি করে আশ মিটল না, স্কুলে এবার একদিন বন্ধুদের বললাম, আমার খুব ইচ্ছে, একদিন স্কুলে রঙিন জামা পরব। জানি আপাতভাবে সে গুড়ে বালি। কিন্তু আমি পরবই পরব। একদিন। সারাদিন ধরে। চ্যালেঞ্জ! কিন্তু কী করে?

সেদিন আকাশে খুব মেঘ । আমার মন পেখম তুলেছে। আজই! স্কুলে এসেছি খুব সকাল সকাল। তেমন কেউ তখন আসেনি। ঝমঝম করে এই নামল! আমি মাঝের শানবাঁধানো চাতালে। মনের আনন্দে খুব ভিজছি। বেশি না, দশ মিনিটে কাজ শেষ। আর না। এবারে একে একে করে আসছে অন্যরা, ছাতা নিয়ে। লক্ষ্মী খুকুর দল! আমিই দুষ্টু! সেদিন উঠোনে প্রার্থনার পাট নেই।

"ইস, তুই এত ভিজলি কী করে?"

"আর বলিস না, ছাতা নিয়ে বেরোইনি। ও কিছু না, গায়ে শুকিয়ে যাবে।"

প্রথম ক্লাস ইংরিজি। আমার হিসেব করাই আছে। সিস্টার ম্যাক্সিমিলা।

" ইস, ঈশানী, তোমার তো জ্বর এসে যাবে!"

আমি বোকা ভীতু চোখে, মাথা নীচু। বাড়ি পাঠাবার প্রশ্ন নেই। শুকনো জামা নেই। এভাবে থাকলে বিকেল পর্যন্ত নির্ঘাত ডবল নিউমোনিয়া!

সিস্টার ডাকলেন, "ডেইজি, তুমি খুব কাছেই থাক। আমি জানি। যাও, ঈশানীকে নিয়ে। তোমার বাড়ি। তোমার একটা ফ্রক পরে আসুক। স্কুল ড্রেস না হলেও ঠিক আছে। এসে এই জামাটা বরং শুকিয়ে নিয়ে পরে বাড়ি ফিরবে।"

আমার চোখে ঝিলিক। ডেইজির ঠোঁটে চাপা হাসি। সুদীপ্তা, পাপিয়া ....মুখে হাত চাপা । আর "ভালো "মেয়েদের চোখে ভর্ৎসনা! ছিঃ! কী দুষ্টু!

আমার মনে আছে, সেদিন ইস্কুলে আমি কমলা-কালো-বাদামী ফ্রকে। সারাদিন!

এখন একটা মন আর তাতে বসত করা গুবরে পোকাটা বলে, "কাজটা কি ভালো হয়েছিল?"

আমি তাকে চোখ পাকিয়ে দাবড়ানি দিই, "উফ, ছাড় তো! খালি খোঁচা মারা! বেশ করেছিলাম। আমার সেদিন অন্যরকম হতে ইচ্ছে হয়েছিল খুব!"

ক্লাস টেনের প্রি-টেস্টে আমাকে বংশদণ্ড দিলেন শোভাদি। ভূগোলে ফেল করলাম। একশ'তে আটত্রিশ। চল্লিশ পাসমার্ক। ফেল করেও অবিশ্যি সেকেন্ড হয়েছি। কিন্তু ফার্স্ট হইনি এবং লাল কালি। অথচ আমি সত্যি ফেল করার মতো পরীক্ষা দিইনি। তাজবি ব্যাপার, একঝাঁক মেয়ে ফেল করেছে। এবং ওই ভূগোলেই। বাড়ি গেলে নিগ্রহের আর বাকি থাকবে না। বাড়িতে পটাসিয়াম সায়ানাইড নেই, পারম্যাঙ্গানেট আছে ...কিন্তু একথাবা খেলেও মরার চান্স কতটা জানি না। খাতা সই তো করাতেই হবে। খাতা দেখে মা আমার যা হাল করেছিল, ভাবলে এখনও শিউরে উঠি। যত বলি, ফেল করার মতো লিখিনি...কে শোনে কার কথা! শেষে মা বলল, শোভাদির সঙ্গে দেখা করবে। আমি তাতেই রাজি।

শোভাদি গম্ভীর গলায় মাকে বললেন, "আসলে ফেল করেনি, বুঝলেন! আমিই শাস্তি দিয়েছি। ও এমন একটা কেয়ারলেস মিস্টেক করেছিল যে রাগে অস্থির হয়ে ওর সব ক'টা উত্তর থেকে আমি দু-নম্বর করে মাইনাস করেছি।”

অর্থাৎ কুড়িটা উত্তরে মাইনাস হয়েছে চল্লিশ নম্বর! আমি পেয়েছিলাম আটাত্তর।

সব জেনে যখন সেটা জোর গলায় মাকে বলতে গেলাম, মা এক দাবড়ানি দিয়ে বলল, "লজ্জা করে না! লেটার মার্ক্স্ হয়নি!"

অথচ মৈত্রেয়ীও ওই আটত্রিশই পেয়েছিল। হতচ্ছাড়ি বাড়িতে বকুনির হাত থেকে বাঁচতে বলেছিল, "আমাকে বকছ কেন? ঈশানীও লাল কালি।" আমার সে রাতে বাড়িতে খাবার জোটেনি, ওর কাকা বলেছিলেন, "তাই না কি? তাহলে তো ঠিকই আছে! লাগাও পোলাও-মুরগি।"

এই মৈত্রেয়ী পরে ভূগোলের অধ্যাপিকা হয়! কী আয়রনি!

নবনীতা দেবসেনের "স্বজন সকাশে" পড়তে গিয়ে দেখি একটি অধ্যায় দু-জন পাদ্রীকে নিয়ে লেখা। দু-জনের মধ্যে একজনের সঙ্গে আমাদের স্কুলজীবনে প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল। ফাদার ফালোঁ। অমনি এই দুপুরে চোখ বুজে দেখি পৌঁছে গেছি মানিকতলা -বীডন স্ট্রিট ক্রসিঙে। 

একজন লম্বা রোগাসোগা পাদ্রী, পাক্কা সাহেবী চেহারা, হালকা দাড়ি। বাইসাইকেলটাকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে চলেছেন আমাদের স্কুলের দিকে। পথে যত এটা ওটা কিনছেন। দুটো আপেল, চারটে কলা, এক থাবা আঙুর, এক মুঠো খেজুর, এমনকি চাট্টি আলু-পেঁয়াজও। প্রত্যেক ফেরিওয়ালার কাঁধে হাত দিয়ে কথাও বলছেন বাংলায়। কিন্তু কেনার পর সওদা যে কোথায় রাখছেন ...দেখা যাচ্ছে না। পরে বুঝেছিলাম, সাদা আলখাল্লার পকেটে। আমার বিশ্বাস, আলখাল্লার এধার ওধার জুড়ে চারদিকেই ঘুরিয়ে পকেটের মতো ব্যবস্থা। সারা মহল্লার বাজার ঢুকে যাবে। পকেট নির্ঘাত কোমর থেকে গোড়ালি পর্যন্ত। সব সময়েই মুখে দেবশিশুর মতো হাসি। 

আমাদের স্কুলে ফাদার যেতেন আমাদের সঙ্গে ধর্মালোচনা করতে। আমাদের তখন ক্লাস নাইন টেন। ফাদার মানেই "ধম্ম আলোচনা"। ওঁর বিদেশী উচ্চারণে "ধর্ম" যদিও "ধম্মে" পর্যবসিত হতো, তাতে ধর্মচর্চার (আসলে দর্শনচর্চার) গুরুত্ব কিছুমাত্র কমত না। তখন উশখুশ করতাম সাইকোলজি রুমে বসে (দু সেকশনের কম্বাইনড ক্লাস, হরি ঘোষের গোয়াল ...তবে বেশিটাই মিটমিটে দুষ্টুমি, মিশনারী স্কুলে অনুশাসনের প্রাবল্য খুব বেশি), কী যে বড় বড় তত্ত্বকথা...ভালো লাগে না ছাই, ঘুম পায়। তার ওপর ফাদার মাঝেমাঝেই ধর্ম, দর্শন ...এসবের ওপর রচনা লেখার হোমওয়ার্ক দেন। ছাইপাঁশ যা মনে আসে, লিখি, এদিক সেদিক থেকে কোটেশন তুলে অল্পবিদ্যা জাহির করি। কী হয় এ সব ধর্ম আর নীতিশিক্ষার ক্লাস করে?

তখন বুঝিনি। এখন ভাবি, ফিরে দেখি যখন ...এই মানুষটি কোনও দিন বাইবেল চর্চা করেননি ক্লাসে, ধর্মালোচনা যা করতেন...পুরোটাই দর্শনভিত্তিক এবং তা সর্বধর্মসমন্বয়ের দর্শন। তাতে ঝড়ের মতো আসত গীতা-বাইবেল-কোরান-উপনিষদ সব। আর বলতেন ...ধর্মকর্ম কর। কর্মের মধ্যে দিয়ে ধর্মপালন, মনুষ্যত্বের ধর্মপালন। বিবেকানন্দর কথা উঠে আসত। আসত হরিজনদের কথা। সকলের জন্য শিক্ষা আর স্বাস্থ্যের প্রয়োজনের কথা। বলতেন, "ধর্ম'' কেমনের "চক্ষু" দিয়ে "দর্শন" করতে শেখো। 

এ সব তো ভুলেই গিয়েছিলাম বইটা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, আচ্ছা, ফাদার ফালোঁর সঙ্গে কার চেহারার যেন ভারী মিল? মনে পড়ছে, আবার পড়ছে না...

তারপর দেখি আমার আলমারিতে সেই কবে পুনে থেকে দাদুর এনে দেওয়া চিনেমাটির যীশুর মূর্তি। সেই হালকা দাড়ি, একজোড়া মায়াবী চোখ, পা পর্যন্ত লুটোনো আলখাল্লা...

মনে পড়ে গেল!



(উপসংহার)



প্রি-টেস্ট মিটল। দু-মাস আমাদের আপাদমস্তক ঝাড়াইবাছাই করে তৈরী করা হলো টেস্ট পরীক্ষার জন্য। ক্লাসের সময় কমে এল, বাড়িতে পড়ার সময় বাড়ল। টেস্টের রেজাল্ট বেরোল। এবার প্রথম বড় পরীক্ষা। নিজেকে প্রমাণ করার পালা। আমার ওপরে কার কতটা আশা, কে যে কতটা হতাশায় ভোগেন আমাকে নিয়ে... বুঝি না...এটুকু বুঝি... মেয়েরাও অর্জুন হয়। আমাকেও ওই পাখির চোখে লক্ষ্যভেদ করতে হবে। মায়ের ভয়েই শুধু নয়, নিজের দায়েও।

খুব জেদ ছিল আমার। পাখির চোখে চোখ রেখে তীর ছুঁড়তে পেরেছিলাম তাই।

এই এত বছর পরে ধুলোবালি ঝেড়ে পুরোনো বইয়ের পাতা খুলে বসা, তাকে পড়া ...মোটেই সহজ কাজ নয়। এই যত সালতামামি। সম্পর্ক এবং সখ্যের।

কিছু কিছু সখ্য এমনই, যা সময়ের বিস্তীর্ণ উঠোন পেরিয়ে রয়ে যায় নিজস্ব নির্ভার দাবিতে। দেখা হয় না, কথা হয় না। কিন্তু যখন হয় বা হবে, আমি নিশ্চিত জানি, যে তখন মনে হবে মাঝের ওই বয়ে যাওয়া সময়টা থমকে ছিল। কিংবা আদৌ ছিলই না! এই সব সম্পর্ক তো আমার আছে, হয়তো বা আজ এত বছর পরে অজস্র নয়, আঙুলে গোনা সামান্য দুটো চারটে ... তবু তারা ঝুরো ফুলের পাপড়ি হয়ে বিছিয়ে আছে নির্জন চলার পথে। ঝিমঝিম মাতাল সুরভি ছড়িয়ে।

যত দিন মাস বছর গেছে, জটিল হয়েছি আমি। গুরুভার হয়েছে মনস্তত্ত্ব। ঘরের বাইরে চৌকাঠ, চৌকাঠ ছাড়িয়ে উঠোনে পা। খুব সন্তর্পণে। কাঁটা না বেঁধে,পচা শামুকে পা না কাটে! নিরাপদ রাস্তায় হাঁটি এখন। এ পথে ফুল বিছিয়ে নেই আগের মতো। দু পাশে অনেক ফুলগাছ যদিও। রং বেরঙের আধচেনা অচেনা ফুল। যারা সুরভি ছড়াতে নিতান্ত অপারগ।

দাঁড়াব কেন? এগিয়ে যাই।

মাঝেমাঝে ছেঁড়া ফুটিফাটা আঁচলের খুঁট খুলে ওই বড় মায়ায় কুড়িয়ে জড়ো করা ঝুরো ফুলের পাপড়িতে নাক মুখ ডুবিয়ে দিই। খুঁজি। সখ্য। আশ্রয়। সেই তো ঢের!

সবাই বলে, একটা বয়সের পর বেশি মানুষজনের সঙ্গে নাকি আর বন্ধুত্ব হয় না। ভাগ্যিস! আমার শতছিন্ন আঁচলে আর জায়গা কই, ফুল কুড়োবার? ফুল জমাবার?

সে এক অন্যরকম ফিকে কমলা-রঙা সকাল, বাসন্তী দুপুর, গোলাপি গোধূলি আর ঘন নীল জমিতে জরির ফুল তোলা রাত্রি ছিল আমাদের বালিকাবেলা আর কিশোরীকালের। এবং প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ ভালোবাসার । রঙিন ধুলোর ঝড় আবির ছিল মুঠিভরা। ছিল ভীরু আঙুল, সাহসী চোখ, বেহিসেবি সাধ, সীমিতসাধ্য। ঠোঁটে ভেসে থাকত অব্যক্ত অভিব্যক্তির মধুরিমা। আকাশ নির্মেঘ তবু কত বৃষ্টি ... হৃদয়ের আনাচেকানাচে।

ভালো থেকো ....ভুলে থাকা হৃদয়ের সাতরং।
0

স্মৃতির সরণী - ঈশানী রায়চৌধুরী

Posted in


স্মৃতির সরণী


অ-রূপকথা
ঈশানী রায়চৌধুরী



(১) 

ক্লাস ফোরের অ্যানুয়াল পরীক্ষা যখন ঘাড়ের ওপরে ফোঁসফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছ, জানতে পারলাম আমরা দক্ষিণ কলকাতার বাস উঠিয়ে উত্তর কলকাতায় যাব। ভবানীপুরের বাড়িটা যে আমার খুব প্রিয় ছিল তা নয়, তবে আশুতোষ মুখার্জী রোডের ওপর ওই স্কুলটা আমার বড় প্রিয় ছিল। এত সবুজ মাঠ, এত বিরাটবড় উপুড় করা বাটির মতো নীল আকাশ, চ্যাপেলে পিয়ানো, লাগোয়া হোস্টেলে উঁকিঝুঁকি মারার লোভ, ঝুপ্পুস বিশাল একটা কুঁচফলের গাছ... মাটিতে পড়ে থাকা অজস্র লাল টুকটুকে ফল টিফিনবেলায় কুড়োনোর অনন্ত লোভ...এ সব কিছু ছেড়ে যাওয়ার কথা ভেবে আমার কচি মনে একটা দুঃখের নদী তৈরী হয়েছিল। সে দুঃখের নদীতে বান ডাকালো মায়ের ঘোষণা। আমাকে তিনটে স্কুলে অ্যাডমিশন টেস্ট দিতে হবে। বেথুন, ব্রাহ্ম গার্লস আর হোলি চাইল্ড।

বেথুনে পরীক্ষা দিলাম স্কুলের লাইব্রেরিতে বসে আর সত্যি বলতে কী, মনে মনে ঠিক করে নিলাম এখানেই পড়ব...যে স্কুলের লাইব্রেরিতে এত্ত বই, সে স্কুল ভালো হতে বাধ্য! ব্রাহ্ম গার্লসের প্রশ্নপত্র ছিল সবচেয়ে সহজ। ওই এখনকার ভাষায় যাকে "কেক ওয়াক" বলে। আর হোলি চাইল্ডে পরীক্ষা দিতে এসে মনটা খুব দমে গিয়েছিল। এ কী রে বাবা! সবুজ ঘাসের বালাই নেই, শানবাঁধানো উঠোন, আকাশটা এক টুকরো নীল রুমালের মতো, ঘরগুলো কী কঠিন আর ঠাণ্ডা চোখের...সাদা পোশাক পড়া এক নান গার্ড দিচ্ছেন...তিনি যে কী বাংলা বলেন...স্পষ্ট নয়। সব মিলিয়ে সে এক বিচ্ছিরি অবস্থা। কবিতার সংক্ষিপ্তকরণ করতে দেওয়া হয়েছে... মানে সাইক্লো করা প্রশ্নপত্রের কালি ধেবড়ে গেছে (বেথুন, ব্রাহ্ম গার্লসে ছাপা প্রশ্নপত্র ছিল...এরা কী কিপ্টে রে বাবা!)...আমি ধরে নিয়েছি ওটা সংক্ষিপ্তকরণই করতে হবে... গার্ড বলছেন... সারাংশ -ভাবার্থ (শেষ অক্ষরটা হসন্ত দিয়ে)...আমি জিজ্ঞেস করে মরছি প্রেসি-সামারি-না সাবস্ট্যান্স (আগের স্কুলে প্রভাদি বঙ্গললনা হয়েও নিখুঁত বিলিতি উচ্চারণে তিনটি শব্দের অর্থ শিখিয়েছেন আমাদের ক্লাস ফোরেই...এ গার্ড তো দেখি বাংলাটাই ভালো করে বলছেন না...সব্বোনাশ! এদিকে না বুঝে ভুল লিখলে মা জানতে পারলে কান পেঁচিয়ে দেবে)...শেষ পর্যন্ত ওই তিনটের মাঝামাঝি একটা জিনিস খাড়া করা গেল। তবে আমি এই স্কুলে কিছুতেই পড়ছি না। এ পুরো জেলখানা। আর স্কুল ড্রেসটাও তো দেখেছি কেমন ফ্যাকফ্যাকে সাদা। আমরাও কি নান না কি? সব এত রংহীন! না না, আমার পোষাবে না। বেথুন, ব্রাহ্ম গার্লসে লাল ফিতে, লাল বেল্ট, ফ্রকটা কেমন স্মার্ট, ঠিকঠাক...আমার পুরোনো স্কুলে অবিশ্যি নীল ছিল...তা হোকগে...তবু তো রং ছিল একটু। তার ওপর কেমন সামনে পেছনে মস্ত কলার...হাতির কানের মতো লটপট করছে...দূর!

তবে মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক! বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে তিনটে স্কুলেই আমার নামটা এক নম্বরে এল। আমি ঘোষণা করলাম, বেথুনে পড়ব। কীভালো লাইব্রেরি! মা চোখ লাল করে বলল, "বাজে বায়না করে লাভ নেই। আগেই নিজের পড়ার বইতে মন দাও। হোলি চাইল্ডে পড়তে হবে। কারণ ঐটেই সবচেয়ে কড়া নিয়মের স্কুল। ওখানে পড়লে সিধে থাকবে তুমি।"

জলভরা চোখে ব্যাজার মুখে আমি হোলি চাইল্ডে নাম লেখালাম। পঞ্চম শ্রেণী, 'ক’বিভাগ। আমার সঙ্গে আরও দু-জন ভর্তি হলো। একজন গেল সেকশন 'বি’তে, মৈত্রেয়ী ঘোষ। আর অন্যজন আমারই সেকশনে। শেফালিরানী চৌধুরী, যদিও আমি তন্নতন্ন করে খুঁটিয়ে দেখেও তার মধ্যে কোনো রানীসুলভ চেহারা বা আচরণ কিছুই পেলাম না।

প্রথম দিন ক্লাসে এসে দেখি আগের বছরের ফার্স্ট-সেকেন্ড-থার্ড গার্লরা তাদের প্রাইজ নিয়ে এসেছে দেখাতে। ফার্স্ট গার্ল পেয়েছে "তালপাতার ভেঁপু" নামের একটা বই, সেকেন্ড গার্ল "মেবারের রাণা প্রতাপ" আর থার্ড প্রাইজ একটা লুডোর বোর্ড। আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, এ প্রাইজ পাওয়াও যা, না পাওয়াও তাই। কাজেই ফার্স্ট সেকেন্ড হওয়ার বেকার পরিশ্রম করে লাভ নেই।

বুঝিনি, ভাবা আর তা বাস্তবায়িত করে তোলা...এক কথা নয়। কারণ আমার ভাবনা আর রূপায়ণের মাঝে চীনের প্রাচীর হয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে...সে বড় কঠিন ঠাঁই। আমার মা।


(২)

পুরোনো স্কুলে ইংরিজিতে প্রেয়ার হতো চ্যাপেলে। এখানে চাতালে দাঁড়িয়ে বাংলায় প্রার্থনা করা হয়। আবার সপ্তাহের নিয়মে। সোমবার বন্দে মাতরম, মঙ্গলবার ধনধান্যপুষ্প ভরা, এরপর জনগণমন, হও ধরমেতে ধীর আর যীশুর গান...তোমারই করুণা...। একটু এদিক ওদিক হওয়ার জো নেই। সকলে গায়, আমি উসখুস করি, গলা মেলাই না। তারপর তিনভাগে ভাগ হয়ে তিনটি সিঁড়ি দিয়ে ক্লাসে যাওয়া। কপাল মন্দ, তাই বাঁদিকে সারসার জলের কলের পাশের সিঁড়ি দিয়ে ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে চারতলায় উঠতে হয়, কিন্তু শব্দ হয় না সিঁড়িতে। মাঝের সিঁড়ি দিয়ে যেতে পারলে খাসা হতো। কাঠের সিঁড়ি...খটখট আওয়াজ করা যেত। নিয়ম মেনে নিয়ম ভাঙার অন্য মজা।

মনে আছে, প্রথম দিন ছিল ইংরিজি ক্লাসটেস্ট। আমি ক্লাসে গেছি এক সপ্তাহ পরে, ট্রান্সফারের নিয়মকানুন মিটে যাওয়ার পরে। যে কবিতার ওপরে পরীক্ষা, সেটা আমার পড়া (মা মোটামুটি বছরের শুরুতে সিলেবাস শেষ করিয়ে রেখে দিত), কিন্তু বন্দনাদি? সাদা শাড়ি সাদা ব্লাউজে সেজে শ্যামলা রঙের চেহারায় মোহিত করে দীঘল বেণী দুলিয়ে মরালগ্রীবাটি নেড়ে আমার পরীক্ষা দেওয়ার সদিচ্ছায় বাধ সেধে বললেন, "তুমি তো এটা পড়োইনি। তুমি চুপ করে বসে থাকো|" যত বলি, আমি জানি...তত ঘাড় নাড়া বেড়ে যায়। দুত্তেরি! আমি বসে বসে রাফ খাতার পেছনে ডুডলিং করি। বাকিরা আঙুলে ধ্যাবড়া করে ফাউন্টেন পেনের কালি মাখে।

হোলি চাইল্ডে আমার প্রথম সাপ্তাহিক পরীক্ষা ছিল ইতিহাসে। মোগল সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাস লিখ। লতিকাদি আমাদের ইতিহাস পড়াতেন। আমার সবচেয়ে প্রিয় দিদিদের একজন। যাঁর পড়ানোর গুণে আমাকে অন্তত কোনোদিন ইতিহাস "মুখস্থ" করতে হয়নি। সে পরীক্ষায় আমি পঁচিশে বাইশ পেয়েছিলাম। ওটাই হায়েস্ট ছিল। লতিকাদি বলেছিলেন, "নতুন এসেছ ? বা:!"

সাময়িকভাবে আত্মশ্লাঘা হলেও বাড়ি ফেরার পথে শিউরে উঠেছিলাম। এই "হায়েস্ট " -এর গন্ধ নেশার মতো। আমার মা জননীর আবার এ নেশায় বুঁদ হয়ে থাকার নেশাটি আমার অক্ষর পরিচয়ের দিনটি থেকেই রপ্ত করা আছে। আমি কি তবে আজ নিজের কবর নিজেই খুঁড়লাম ?

একদিকে এই দুশ্চিন্তা, অন্যদিকে শুরু হচ্ছে হতচ্ছাড়া সেলাই আর ড্রয়িং ক্লাস। দুটোতেই আবার আমার জুড়ি নেই! একটা লাইন ঠিক করে টানতে পারি না, জলরঙের কন্সিস্টেন্সির মা বাপ নেই...তুলি দিয়ে বোলালে দেখি রঙের চেয়ে জল বেশি, সেলাই করতে গেলে ছুঁচ ফুটে যায় হাতে, হেম সেলাই তো জগতের সবচেয়ে কঠিন ফোঁড়...যতই ছুঁচ হেলাই, আমার হেম সেলাই খটখটে চোখে সটান শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকে, উল বুনতে গেলে ঘর পড়ে যায় এবং যখন পড়ে তখন টের পাই না...টের পেতে পেতে দু-কাঠির মোজা বোনা প্রায় শেষের দিকে পৌঁছে যায়...আমি নিশ্চিত সেলাই ড্রয়িঙে ফেল করব। এবং তাই হয়। সেলাইটা টায়েটায়ে উৎরে গেলেও ড্রয়িঙে আমি হাফ -ইয়ারলিতে...এক নম্বরের জন্য লাল কালিতে চিহ্নিত হই। তবে সব মিলিয়ে যা রেজাল্ট হয়, তাতে ফিলোমিনাদি হেঁড়ে গলায় সামান্য ধমক দিয়ে সেবারের মতো ছেড়ে দেন। আমিও এমন নির্বিকারে ঘুরতে থাকি, যেন আমাকে লাল কালিতে দেগে দেওয়াটা দিদিরই অবিমৃষ্যকারিতা!

তবে অ্যানুয়েলে কেমন বিচ্ছিরি লাগবে না লালকালিটা? মানে মা তো ফার্স্ট না হলে কান পেঁচিয়ে দেবে...এদিকে তার সঙ্গে ওই এক বালতি দুধে এক ফোঁটা চোনার মতো লাল কালি... আমি খুব মন দিয়ে ঘটিবাটির কার্ভ আর আঁচলাসমেত শাড়ির পাড় প্র্যাকটিসে মন দিই। অধ্যবসায়ে কী না হয়!

লাল বদলে যায় রয়াল ব্লু-তে। পার্মানেন্টলি। যদিও সেলাই ড্রয়িঙে বা পরবর্তীকালে ওয়র্ক এডুকেশনে সে নীল খুব উজ্জ্বল ছিল না... ফিকে... জল মেশানো... তবু... নীল তো! 


(৩)

ক্লাস ফাইভে অঙ্ক নিতেন নীলিমাদি। খুব রোগা, ফর্সা, চশমা পরা, একটু খামখেয়ালি ধাঁচের। নম্বর দিয়ে আবার বড় বড় করে মন্তব্য দিতেন, বাজে-ভালো-খুব ভালো-অতি ভালো+। মাঝেমাঝে ++ ও থাকত। হোলি চাইল্ডে অনেক দিদিরই কোনো অজ্ঞাত কারণে পদবী ছিল সেন এবং তাঁদের সে পদবী বদলের কোনো সদিচ্ছাও ছিল না। নীলিমাদি, বন্দনাদি, নন্দিনীদি সব্বাই। এমনকী আল্পনাদিও। অবশেষে আল্পনাদি যেদিন কোঁকড়া চুলের ফাঁকে সরু সিঁথিটি রঙিন করলেন এবং সেন থেকে ভটচায্যি হলেন, আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচলাম। তবে ততদিনে আমরা ক্লাস টেনে। 

ক্লাস সিক্সে শুরু হলো অতি অখাদ্য জ্যামিতির উৎপাত। পড়াতে এলেন সুজাতাদি। ইয়াব্বড় কাঠের জ্যামিতি বাক্স (বোর্ডে আঁকার জন্য) এবং প্রভূত পরিমাণে পক্ষপাতিত্ব সঙ্গে নিয়ে। সে এক অকথ্য অত্যাচার! আমাদের মাঝেমাঝেই বোর্ডে তোলেন। কী করে যে ওই রাক্ষুসে কম্পাস কায়দা করে ধরতে হয় যীশুই জানেন, তাতে আবার চক লাগাতে হয়। আমি না পেরে দিদির বিষনজরে পড়ি এবং সুচরিতা কাঁটা কম্পাস বাগিয়ে ধরে এবং দিদির সব কথায় ঢকঢক করে ঘাড় হেলিয়ে চোখের মণি হয়ে ওঠে। সুচরিতার কথা বললাম, কারণ আমি আর সুচরিতা এক্সট্রিম কেস... বাকিরা ভালো -মন্দর মাঝে ত্রিশঙ্কু হয়ে ঝুলে থাকে।

ড্রয়িং ক্লাস হয়ে ওঠে আতঙ্কের কারণ পোর্ট্রেট আঁকা শুরু হয়। সব ব্যাটা হয় অ্যাপোলোর মতো সুন্দর, নয় তো বুদ্ধদেবের মতো সর্বংসহ। আমি আঁকতে গেলেই সে মুখ পি টি দিদিমণি অঞ্জলিদির মতো হয়ে যায়।

সেলাই ক্লাস শুরু হয় চার কাঁটার মোজা বোনা দিয়ে। আমার নাকাল অবস্থার ফারাক হয় না। দু-কাঁটাতেই ডুবজল, চার কাঁটাতে নাভিশ্বাস ওঠে। আর ছুঁচেরকাজ করতে গিয়ে আবিষ্কার করি, আমার সবচেয়ে প্রিয় ফোঁড় রান সেলাই।

ক্লাস সিক্স। গড় বয়স এগারো। সে বয়স "ফুলের বনে যার পাশে যাই, তারই লাগে ভালো"-র ইশারা মনে উঁকিঝুঁকি দেওয়ার বয়স। তখন সাপ্তাহিক "দেশ"-এ ধারাবাহিক চলছে সুনীলের "একা এবং কয়েকজন", বেতার জগতে শীর্ষেন্দুর "জীবনপাত্র"। আমরা চুটিয়ে পড়ছি এবং বহুবিধ জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হচ্ছি। বাইবেলের কঠোর অনুশাসনের সাধ্য কী যে আমাদের দমিয়ে রাখবে? ফলে নীতিশিক্ষার ক্লাসে কানে তুলো গুঁজে বসে থাকি, ফিসফিসিয়ে নবীন কিশোরদের সম্মোহক চাউনি নিয়ে আলাপচারিতা হয়, কেউ কেউ বাছুরে প্রেমের গুল্প ফাঁদে এবং আমরা শুনে শিহরিত হই। সে শুধু অবাক হওয়ার বয়স। সেবয়সে বক্তার বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করার তাগিদ থাকে না। সে "যত শুনি, তত শিখি"-র বয়স। পড়ার বই আর গল্পের বইতে অহর্নিশ দ্বন্দ্ব জারি থাকে এবং আমার নম্বরের গ্রাফ কোনো নিয়মের বালাই না রেখে ইচ্ছেসুখে ওঠানামা করে।

আমাদের সময়ে হেডমিস্ট্রেস ছিলেন সিস্টার অ্যাগনেস। বাঘে গরুতে যেমন তেমন তেমন মনিব হলে একঘাটে জল খায়, সিস্টারের ভয়ে দিদিমণিদের, ছাত্রীদের এবং তাবৎ গার্জেনকুলের একঘাটে ঘাড় গুঁজে জল খেতে আপত্তি ছিল না। সিস্টার যে খুব বকাবকি করতেন, তা নয়। ওই ঠাণ্ডা গম্ভীর চোখ দেখলেই আমাদের গলা শুকিয়ে যেত, হাঁটু কাঁপত ঠকঠক করে। সে এক অদ্ভুত নীরব শাসন! কিন্তু ক্লাসে বসে এই সব নওলকিশোরদের নিয়ে "নির্দোষ" চর্চা করতে গেলে তেমন দিদিমণি চাই, যিনি হয় জাগ্রত এবং উদাসীন (সোনার পাথরবাটি) অথবা নিদ্রালোভী। তা তেমনও ছিলেন বৈকি একজন। এলিজাবেথ গোমস। দৈর্ঘ্যে তিনফুট, প্রস্থে বা বেড়েও তাই, একতাল নৈবেদ্যের ওপরে ছোট্ট দেদো সন্দেশের মতো মাথাটি আর সন্দেশের ওপরে দোপাটি ফুলের পাপড়ির আকারে ছোট্ট বড়ি খোঁপা। কোনোমতে জেগে জেগে হেঁটে স্কুলে ঢুকতেন এবং ক্লাসে এসেই ঘুমিয়ে পড়তেন। পড়াতেন হিন্দি। আমরা জানতাম, দু-বছর পড়ব এবং নিশ্চিন্তে ভুলে যাব, তাই দিদিও আমাদের ঘাঁটাতেন না, আমরাও দিব্যি রসেবশে থাকতাম ওই পিরিয়ডে। খুব সোরগোল করলে অবিশ্যি চটকা ভেঙে লাল চোখে সরু গলায় ডেস্কে স্কেল পিটিয়ে তর্জন গর্জন করতেন, তবে সে আস্ফালন ধোঁপে টিকত না। কবিতা মুখস্থ করার কথা। গাধা এক থা মোটা তাজা। তা প্রথম লাইনটা জোরে জোরে বললেই উনি নাক ডাকতে শুরু করতেন ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে, আমরা বাকিটা হুঁ হুঁ করে চালিয়ে দিতাম। একের পর এক ওই এক ছত্র কবিতা, বাকিটা হুঁ হুঁ। তবে মাঝেমাঝে জাগতেন। সেই অবসরে সিলেবাস শেষ হতো।

সিস্টার অ্যাগনেসের শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে যেমন নবীন প্রেমিকরা আসত আমাদের ফিসফিসানিতে, তেমন করেই কী ভাবে যেন এন্ট্রি নিয়েছিল এক বেঁটে সিড়িঙ্গে চশমা নাকে চানাচুরওয়ালা। সে ব্যাটা টিফিনের সময়ে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে জাঁকিয়ে ব্যবসা করত। দশ পয়সা করে আধ আঙুল ঠোঙায় (অত সরু আর ছোটঠোঙা বানাতেও এলেম লাগে) বিক্রি করত বাদাম, চানাচুর বা মটর, পাঁচ পয়সায় কুট্টি কুট্টি বুনো কুল, কেলেকুষ্টি হজমিগুলি আর চিড়িক তোলা ইলেকট্রিকনুন। আমার জুটত না সে সব অমৃত, কারণ পকেটমনির সীন ছিল না আমার বাড়িতে আর "পুষ্টিকর" (অর্থাৎ অখাদ্য) টিফিন খাওয়া বাধ্যতামূলক ছিল। সে ব্যাটার কাছে ধারবাকির কারবার ছিল না (ভাগ্যিস ছিল না, কারণ শোধ করার উপায়ও তো ছিল না আমার)। লোকটাকে দেখলেই আমার গা জ্বলে যেত।

সে জ্বালা কমত শুধু বুধবার। টিফিনের পরের পিরিয়ডে লাইব্রেরি ক্লাস। শেফালিদি। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, আমি মিঠে কথা বলে বলে মন ভিজিয়ে নিয়েছিলাম দিদির। আগেই তাই ইন্সপেক্ট করে রোল নম্বর হিসেবে করে নিজের পছন্দের বই (মানে যেগুলো ওই মন্দের ভালো, যেমন রাণুর প্রথম ভাগ বা তালনবমী) গুঁজে রাখতাম পাইলে। উপায় কী! যে লাইব্রেরিতে শুধু মহাপুরুষদের জীবনী, যেখানে সবচেয়ে রোম্যান্টিক বইয়ের নাম "নন্দকান্ত নন্দাঘুন্টি" (আমি আবার একবার ওটা ইস্যু করে বোকা বনেছিলাম। ভূগোলে কাঁচা ছিলাম খুব...ভেবেছি নন্দ আর নন্দা মানে রোমিও -জুলিয়েট টাইপ কিছু গল্প টল্প হবে!)...সেখানে জোচ্চুরি না করে উপায় কী!



(৪)

ক্লাস সেভেনে নতুন একটি মেয়ে এল। ডাফ স্কুল থেকে। কাকলি। আমার খুশির আর শেষ রইল না। আমার মতোই ক্লাসে কথা বলতে ভালোবাসে এ মেয়ে। আমরা পাশাপাশি বসে গল্প করে করে ক্লাসটিচার মিনতিদির জীবন এমন মহানিশা করে তুললাম, যে দিদি আমাদের মাঝে পাঁচিল করে মিতা গুপ্তকে বসিয়ে দিলেন। তাতে আমাদের ভারী বয়েই গেল। আমরা দু-জন মিলে মিতার মাথা ডেস্কে চেপে শুইয়ে রেখে তা ঠেসে ধরে (যাতে মাথা তুলতেই না পারে) গল্প চালিয়ে যাচ্ছি রোজ। মিতার অবস্থা শুনে মিনতিদি আর রিস্ক না নিয়ে পুরোনো ব্যবস্থাই বহাল রাখলেন। শুধু কথায় কথায় বললেন, "একটা মাত্র মেয়ে যারা, তারা ভারী অবাধ্য হয়।" আমাদের ভারী গাত্রদাহ হলো। আমি আর কাকলি...কারো ভাই বোন নেই। মিনতিদির মেয়ে শম্পা তখন ক্লাস থ্রীতে পড়ে। আমরা তাকে পাকড়ে হাঁড়ির খবর নিলাম। তারপর মিনতিদিকে একদিন বললাম, "শম্পার তো ভাই বোন নেই দিদি, না ? ভারী অবাধ্য হবে কিন্তু কালে কালে। দেখবেন!"

ক্লাস সেভেনে থাকতেই একদিন শুনলাম স্কুলে আসবেন ভ্যাটিকান সিটি থেকে কার্ডিনাল মেৎসোকান্তি। সে তো সাজ সাজ রব। লালমুখো সাহেব, গ্যাটম্যাটকরে ইঞ্জিরি বলবেন, ধর্মকথাও নিশ্চই...আমাদের পইপই করে নানা সহবত শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। নির্দিষ্ট দিনে সাদা ধবধবে সারপ্লিস আর লাল সোনালি সরু শাল জড়িয়ে কার্ডিনাল স্কুল পরিদর্শনে এলেন। আমরা সরু-মোটা গলায় "গুড আফটারনুন" বলে চারটে করে টফি আর একটা করে ছোট টিফিন কেক পেলাম। 

আমাদের তো খেলার মাঠ ছিল না। শানবাঁধানো উঠোন ছিল আর অতি হতচ্ছাড়া পি টি ক্লাস ছিল। তাতে যে কী হাতিঘোড়া ড্রিল হতো, না বলাই ভালো! ওই করে কী চতুর্বর্গ লাভ হতো, তাও জানি না! 

স্কুলে আসি, নিয়মমাফিক ক্লাস হয়, পরীক্ষা হয়, বকুনি হয়, নিগ্রহ হয়...সেই এক থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়। আমি সেয়ানা। পরীক্ষা দিয়ে অক্লেশে বলি, "দারুণ হয়েছে।" ভাবটা এই, এখন থেকে বকুনি খেয়ে মরি আর কী! যেটা পারিনি...বলে দিই যে ক্লাসের কেউ পারেনি। কিন্তু বাড়িতে যে ভবিদেবী বিরাজমানা, তিনি ভুললে তো! এমন গার্জেন আমার, স্কুলে গিয়ে হেডমিস্ট্রেসকে বলে আসা হলো, রিপোর্ট কার্ডে যেন সব সাবজেক্টে একটা নতুন কলাম যোগ করা হয়...তাতে তিন সেকশন মিলিয়ে সে সাবজেক্টে হায়েস্ট মার্ক্স্ লেখা থাকবে। ব্যাপারটা বোঝা গেল? যাতে আমাকে অনন্ত চাপে রাখা যায়! আমাদের সেবছরে ক্লাস সেভেনের অ্যানুয়েল পরীক্ষা থেকে সেই কালান্তক নিয়মের শুরু। আমার মা জননীর উর্বর মস্তিষ্কের ফসল।

ক্লাস এইট হলো আমাদের। এ বছরের ক্লাসরুম যদিও চারতলার ওপরে, কিন্তু চিলতে বারান্দা পেরোলেই রাস্তা দেখা যায়। বীডন স্ট্রীট দিয়ে পরেশনাথের মিছিল যায়। ওই একটি দুটি দিন জগঝম্প বাজতে শুরু করলেই আমরা পিঁজরাপোলের ছাগলছানারা তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে বারান্দায় ভিড় জমিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ি। প্রায় উল্টোদিকের স্কুল ভবতারণ। সেখানকার পাকা এবং আধপাকা কিশোরদের বুকে ঢেউ খেলে যায়।

এই ক্লাস এইটে উঠে আমাদের ক্লাসের দেবী চৌধুরী প্রেমে পড়ল। সে একেবারে লাট খাওয়া প্রেম যাকে বলে। দেবীরা থাকত বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাবের গলিতে। প্রেমিকের নাম বাচ্চু। লম্বা হিলহিলে, গায়ের রং শ্যামলা, সিগারেট খেয়ে ঠোঁট কুটকুটে কালো, এক হাতে স্টিলের বালা, ড্রেনপাইপ প্যান্ট, চকরাবকরা শার্ট... একেবারে পাড়ার উঠতি গুল্লু মস্তান। দেবী আবার তাকে "বাচ্চুদা" বলে। আহা, সে তো বলবেই। গুরুজন বলে কথা! তা একদিন সন্ধেবেলা দেবী তার হাত ধরে গলির মোড়ে গুনগুন করছিল... পড়বি তো পড় মিনতিদির চোখে! আর পায় কে! মিনতিদি পরের দিন দেবীকে ধরে...
-- ছি ছি দেবী! তুমি একটা ছোকরার হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলে?
-- কে বলল? 
--কে আবার বলবে? আমি নিজে দেখেছি। ছিঃ, তোমার দিদি ছবি কতদিন আগে পাস করে বেরিয়ে গেছে, কই, তার তো এমন খারাপ স্বভাব ছিল না! 
এবার দেবী ফিল্ডে নামল।
-- দিদি আলাদা, আমি আলাদা। আর দেখুন, স্কুলে যতক্ষণ আছি... নিয়ম মেনে চলছি। স্কুলের বাইরে আমার গার্জেন শুধু আমার বাড়ির লোক। তাঁদের যখন সমস্যা নেই, আপনারা এত চেঁচামেচি করছেন কেন? চাইলে গার্জেন কল করে দেখুন। আমরা লুকিয়ে চুরিয়ে মিশি না।

মিনতিদির বাক্যি হ'রে গেল। আমরা গুল্লিগুল্লি চোখে দেবী চৌধুরাণীর তেজ দেখলাম। পরের বছর অবিশ্যি ও অন্য স্কুলে চলে যায়।

তবে এ ঘটনার পরে নিশ্চয়ই টিচার্স রুমে প্রবল হৈচৈ হয়েছিল। কারণ আমাদের মরাল গার্জেন হিসেবে এন্ট্রি নিলেন সিস্টার রোমানা। আমরা দুটো পিরিয়ডের মাঝের সময়টুকুতে কী কী করছি, কী নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছে...এ সবের ট্র্যাক রাখতে সিস্টার রোমানা আড়াল থেকে তৎপর হলেন। চরিত্র সংশোধনী বটিকা তো পাওয়া যায় না, কিন্তু তা বলে তো কচি কচি মেয়েদের ছেড়েও রাখা যায় না! দরজার আড়ালে সিস্টার। আমরাও চালু মাল, একটু সাদা ঝিলিক দেখি দরজার আড়ালে আর জোরে জোরে নিষ্পাপ আলাপ আলোচনা করি। কিছুদিন চৌকিদারি করে সিস্টার রণে ভঙ্গ দিয়েছিলেন।

এত কথার মাঝে বলতে ভুলেছি, সিস্টার অ্যাগনেস চলে যাওয়ার পরে হেডমিস্ট্রেস হলেন সিস্টার ম্যাক্সিমিলা। মাল্টাতে বাড়ি, ফুটফুটে মেমসাহেব, মুখে অনাবিল হাসি আর বুকে একরাশ ভালোবাসা নিয়ে। আমি আমার স্কুলজীবনে এত ভালো আর কাউকে বাসিনি। সিস্টার এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন। আমাদের সবক'টি কচিকাঁচা বালিকাহৃদয়কে। আমরা এই প্রথম ভয় না পেয়ে কোনো শিক্ষিকাকে শতকরা একশ'ভাগ ভালোবাসতে শিখলাম। আমরা কোনো ক্ষোভের কারণ ঘটলে তা নিয়ে খোলা মনে আলোচনা করার জায়গায় পৌঁছেছিলাম। হোলি চাইল্ডের নীল আকাশ এই প্রথমই একটুকরো রুমালের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে আমাদের সবার কাছে অনন্ততার অনুভব নিয়ে এসেছিল। আমরা সত্যিই মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলাম।

(চলবে)
4

স্মৃতির সরণী - বিভাস রায় চৌধুরী

Posted in


স্মৃতির সরণী


অগ্নি বাণ
বিভাস রায় চৌধুরী 



সন্ধ্যে নাগাদ ব্যারাকপুরের পরিত্যক্ত রানওয়ের এক কোণে চুপচাপ আমাদের হেলিকপ্টারপার্ক করে দিয়ে আমরা যে যার মেস এ চলে গেলাম। ক্যাপ্টেন শুধু জানিয়ে দিলেন পরদিন ভোর চারটেতে রিপোর্টিং। সেই সাত সকালে আমরা কুম্ভীগ্রাম এয়ার ফোর্স ইউনিট (শিলচর এয়ারপোর্ট) থেকে উড়ে, শিলং, গৌহাটি, বাগডোগড়া (শিলিগুড়ি) হয়ে ব্যারাকপুর পৌঁছতে সূর্য্য ডুবে গেল। অন্ধকারে একটা শক্তিমান ট্রাক আমাদের পাঁচজনকে টিমটিমে আলো আঁধারী মেসের সামনে নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার বলে গেল কাল ভোরে ও নিজেই এসে এখান থেকেই পিক আপ করে নিয়ে যাবে। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সিনেমার মতো এয়ার ফোর্স স্টেশন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ফলে এই সেক্টরে আমাদের আর্মি, এয়ার ফোর্স একটু বেশি রকমের শান্ত।

পরদিন ভোরবেলা এসে হেলিকপ্টার রেডি করে টেক অফ করতে পূর্ব আকাশে লালি ধরে গেল। পশ্চিম দিগন্তের রেখা তবুও কালচে।

ব্যারাকপুর থেকে সোজা গঙ্গার উপড় দিয়ে উড়ে এসে, হাওড়া ব্রিজের কাছে বাঁয়ে পাক খেয়ে ইডেনের লাইট পোস্টের কান ঘেঁষে ল্যান্ড করলো রেস কোর্সে। হাওড়া ব্রীজ আসলে ‘নো ফ্লাইং জোন’। আকাশ থেকে সেই প্রথম হাওড়া ব্রীজ, ইডেন, ধর্মতলা দেখা। একটা তিরিশ মিটার এলাকা ঘাস কেটে হেলিপ্যাড বানানো। স্মোক জেনারেটর জ্বলছে। সেদিন সাত সকালে রেস কোর্সে কোনও ঘোড়া ঢুকতে পারেনি। এক কোণে একটা অলিভ গ্রীন জিপসি আর কয়েকজন আর্মি অফিসার দাঁড়িয়ে। হেলিকপ্টার ল্যান্ড করতেই পাইলট ইঞ্জিন বন্ধ না করে, আমাদের একজনকে ইশারা’তে বললেন নীচে গিয়ে দাঁড়াতে। 

শীতের সকালে হেলিকপ্টারের ব্লেডের হাওয়া কানের পাস দিয়ে গুলির মতো ঘষে গেল। একটা পাতলা স্যুট কম্বিনেশন গায়ে। 

মিনিট দুয়েকের মধ্যে আরেকটা জিপসি এসে একদম ঘুরন্ত টেল ব্লেডের কাছে থামল। হেলিকপ্টারের পেছনে যে পাখা থাকে, ভীষণ জোরে ঘোরে বলে অনেকের চোখে পরে না। হাত দিয়ে ড্রাইভারকে ইশারা করে পেছতে বললাম। চারজন সায়েন্টিস্ট নামলেন। হাতে একটা করে নোট প্যাড আর একজনের কাছে একটা এস এল আর ক্যামেরা। 

পৌনে ঘন্টা পরে আমরা সমুদ্রের ধারে একটা কংক্রিটের হেলিপ্যাডে নামলাম। ডিফেন্স সিকিউরিটি কোর এর গার্ড জানালো জায়গাটার নাম চাঁদিপুর। দূরে কতগুলো গ্রাম দেখা যাচ্ছে। আর বাকিটা DRDO র বাউন্ডারী। 

কিছুদিন আগেই এখান থেকে অগ্নি মিসাইলের টেস্ট লঞ্চ হয়েছিল। সেই টেস্ট নিয়ে হৈ চৈ কম হয়নি। তবে প্রথম টেস্টের মিসাইল ছিল হাজার কিমি রেঞ্জের, সাথে হাজার কেজির নিউক্লিয়ার বোম নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা। তখনই বলা হয়েছিল, এর পরের টার্গেট দুই হাজার কিমি দূরত্বে মারতে পারে এমন মিসাইল বানানো। সাথে মাথায় লাগানো থাকবে হাজার কেজির নিউক্লিয়ার বোম। 

চারিদিকে বেশ সাজ সাজ রব। DRDO থেকে একজন অফিসার এসে ঐ চারজনকে নিয়ে গেলেন। একটা গাড়ী আমাদের নিয়ে পৌঁছে দিল ওদের ক্যান্টিনে। সমুদ্রের ধারে মেস। সামনে ধুধু বালির সমুদ্র সৈকত, জল তখন প্রায় দুই কিমি দূরে। সকাল থেকে এক কাপ গরম জলও জোটেনি, চা তো স্বপ্ন। ক্যান্টিনে গরম গরম পুরী আর আলুর তরকারী, সঙ্গে এক গ্লাস করে চা। আহা!

দুপুর দশটা নাগাদ আবার ‘টেক অফ’, মিনিট দুয়েকের মধ্যে নীচে শুধু জল আর জল। তার মধ্যে প্রচুর কচ্ছপ ভেসে আছে। এগুলো সব অলিভ রিডলে, সামুদ্রিক কচ্ছপ। এই কচ্ছপেরা প্রতি বছর অস্ট্রেলিয়া থেকে ওড়িশা’তে দলে দলে ডিম পাড়তে আসে। সেক্সুয়ালি ডিমরফিক এই কচ্ছপের পুরুষ প্রজাতির ওজন প্রায় ৪০ কেজি, আর মহিলাদের ওজন ৩৫ কেজির কাছাকাছি। মেক্সিকো আর কোস্টারিকাতেও ডিম পাড়তে যায়, কিন্তু এই অলিভ রিডলের ডিম পাড়া উৎসব ওড়িশা’র গাহিরমাথা এলাকাতেই সব চেয়ে বেশি। 

হেলিকপ্টার যখন খুব নীচু দিয়ে ফ্লাই করে, মানে ১০০ বা ২০০ মিটারের উচ্চতায়, সেই উড়ন্ত হেলি থেকে সমুদ্রের নীল জল আর তার মধ্যে জলজ উদ্ভিদ বা এই সব কচ্ছপের ভেসে থাকা দেখতে দেখতে মনেই থাকেনা সময় কোথা দিয়ে চলে গেল। 

একটা আইল্যান্ড দেখা যাচ্ছে। এর নাম তখন ছিল হুইলার্স আইল্যান্ড। আপাত দৃষ্টিতে এই আইল্যান্ড, অলিভ রিডলের ব্রিডিং গ্রাউন্ড বা প্রজনন ক্ষেত্র। আসলে এই দ্বীপকেই সেই সময় তৈরি করা হচ্ছিল ইন্ডিয়ার মিসাইল টেস্ট লঞ্চ প্যাড হিসেবে। ওড়িশা সরকার ১৯৯৩ সালে এই দ্বীপ Defence Research and Development Organisation (DRDO) দিয়ে দেয়। 

আইল্যান্ডে কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। রিডলে ছাড়াও দেখতে পেলাম অসংখ্য লাল কাঁকড়া। আর কি কি দেখলাম সেগুলো লেখা যাবেনা। তবে বুঝলাম কিছু একটা হতে চলেছে।

সেবারের মতো বিকেলে সেই চার মূর্তীকে দমদম এয়ার পোর্টে নামিয়ে পরদিন কুম্ভীগ্রামে ফিরে এলাম। 

ওদিকে দেশের পশ্চিম সীমান্তে তখন অন্য কিছু চলছিল। ৫৮ নং ইঞ্জিনিয়ার রেজিমেন্টের এক দল সেনা তখন ব্যাস্ত মরুভূমিতে কিছু করতে। কিভাবে করতে হবে জানে, কিন্তু কেন করছে জানেনা। এক জন দু’জন করে নতুন লোক আসেন। আর্মির ড্রেস পরেই আসেন, কিন্তু হাঁটা চলা দেখেই সন্দেহ হয়। 

খাবার আসে প্যাকেটে। জল আসে প্লাস্টিকের পাউচে। খাওয়া হয়ে গেলে কিছু ফেলে রাখলে হবে না। সব প্যাকেট বানিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দিতে হবে। এক জায়গার কাজ শেষ হলে সরে এসে অন্যত্র আবার সেই ভাবেই কাজ চলে। কাজ হয়ে গেলে তাঁবু ওঠাও আর চলো অন্য সাইটে। 

আমরা ফিরে আসতেই, আবার একটা হেলিকপ্টার আরেক দিন চাঁদিপুর গেল। ফিরে এল দিন তিনেক বাদে। আবার একদিন গেল, ফিরেও এলো। শীত কমে গেল। বেশ কয়েক বার চাঁদিপুর ট্রিপ মেরে আমরা এটাকে প্রায় জল ভাত ভেবে নিয়েছি।

এর মধ্যেই একদিন আবার আমার টার্ন এলো চাঁদিপুরের। তবে এবারে অন্য রুটে। কলকাতা বাই পাস করে সোজা কলাইকুন্ডা। সেখান থেকে ভুবনেশ্বর। পুরনো এয়ারপোর্টের একটা হ্যাঙ্গারে হেলিকপ্টার রেখে আমাদের আস্তানা DRDO র গেস্ট হাউস। পরদিন সকালে দেখি গেস্ট হাউসে একটু বেশি রকমের চাপা উত্তেজনা। 

সকালে এয়ারপোর্টে গিয়ে সব কিছু রেডি করতে করতে, সিডিউল টাইমের আগেই কনভয় এসে গেল। খান তিনেক গাড়ী। যাত্রী দু’জন। একজন প্রধান মন্ত্রীর সাইন্টিফিক অ্যাডভাইজার, অন্যজন তার সাগরেদ। সোজা হুইলার্স আইল্যান্ড। গ্রীষ্মের প্রখর রোদে, হেলিপ্যাড তেতে আছে। সেখানেই হেলিকপ্টারের নীচে দাঁড়িয়ে একটা ডাবের জল খেলেন অ্যাডভাইজার সাহেব। একটা চার্ট পেপার সাইজের সার্কিট ডায়াগ্রাম নিয়ে সেখানেই মিনিট দশেকের মিটিং করে তারপর গেলেন লঞ্চ প্যাডের কাছে। সেখানেও প্রচুর ভিড়। মানুষের থেকেও বেশি যন্ত্রপাতি। আর তার প্যাকিং কেস। একটা কুড়ি মিটার লম্বা অগ্নি-২, মিসাইল, ঘাড় কাত করে শুয়ে আছে। দুই হাজার কিমি দূরত্বে অ্যাটম বোমা মারতে পারার মতো মিসাইল তখন আমাদের হাতে ছিল না। সবার মধ্যে একটা চাপা উত্তেজনা। 

গরম বাড়ছে, ১৯৯৮ সালের ১১ মে মাস। সন্ধ্যেবেলা আসামের জঙ্গল আর চা বাগান ঘেরা সেই ইউনিট থেকে ফিরে টায়ার্ড শরীর ঠাণ্ডা মেঝেতে এলিয়ে দিয়ে টিভি খুলতেই শুনলাম পোখরানে অপারেশন শক্তি সাকসেসফুল। ভারত, দ্বিতীয়বার পারমাণবিক পরীক্ষা সফল ভাবে করে ফেলেছে। প্রায় ৪৫ কিলো টন ‘টি এন টি’র বিস্ফোট, আর সেটা করেছে সবার অজান্তে। পাকিস্তানী গুপ্তচর আর আমেরিকান স্যাটেলাইটকে ধোঁকা দিতে অগ্নি -২ এর টেস্ট প্রিপারেশনের জন্য আমাদের গত চার পাঁচ মাস ধরে চাঁদিপুর আর হুইলার্স আইল্যান্ডে চক্কর কেটেছি। যাতে আমেরিকান স্যাটেলাইটের চোখ ভারতের পূর্ব প্রান্তে ফোকাস হয়ে থাকে। সেই সুযোগে পোখরানে আর্মির ছত্রছায়ায় আমাদের নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট এর দল সমস্ত প্রস্তুতি ঠিক ভাবে করে ফেলতে পেরেছিলেন। কারোর সন্দেহ হয়নি। 

আর হ্যাঁ, ঐ প্রাইম মিনিস্টারের অ্যাডভাইজার ছিলেন, মিসাইল ম্যান, কালাম সাহেব। পরে রাষ্ট্রপতি হলে, তখনও একবার সুযোগ হয়েছিল ওঁকে নিয়ে এক দুর্গম পাহাড়ে যাওয়ার। সে গল্প অন্য কোথাও শোনাবো। আর ওই হুইলার্স আইল্যান্ডের নাম পালটে দেওয়া হয়েছে। কালাম আইল্যান্ড। 



রাম চন্দ্রের সেতু বানাতে কাঠবেড়ালি’র একটা ছোট্ট রোল ছিল। পুণ্যভূমি পোখরানে আমেরিকান সি আই এ আর পাকিস্তানী আই এস আই ইন্টেলিজেন্সিকে ধোঁকা দিতে আমরা দেশের পূর্ব প্রান্তে সেই রোলটাই প্লে করেছিলাম।