Next
Previous
Showing posts with label পথে প্রান্তরে. Show all posts
2

পথে প্রান্তরে - সুনৃতা মাইতি

Posted in


পথে প্রান্তরে


মানময়ীর পটচিত্রে পাটায়া
সুনৃতা মাইতি



বেচুবাবু কর্মসূত্রে কেবল বিদেশভ্রমণ করেন। আর আমি মানময়ী তাঁর দুই ঠ্যাঁটা বাছুরপোনা সহ গোয়ালঘরের খুঁটি আগলে হত্যে দিয়ে বসে থাকি। ঘর হইতে দুই পা ফেলিয়া এবং একটি ঘাসের উপর দুইটি শিশির বিন্দু ঝেলিয়া ঝেলিয়া যখন আমি জীবনের প্রতি অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধ, বেচুবাবু বিগলিত হয়ে বললেন..."ব্যাঙ্কক পাটায়াই চলো তবে।" বলেই শূন্যে হাত চালিয়ে কিঞ্চিৎ অঙ্ক কষে নিশ্চিন্ত হলেন। বেশ বুঝলাম বেচুবাবু দুই দেশের মুদ্রা - টাকা এবং ভাটের তুলনামূলক মাতা ভগিনী হিসাব করে সস্তায় হাত ঝেড়ে ফেললেন এই বেলা। এক ঢিলে দুই পাখি! আমার অবস্থা তখন নেইমামার চেয়ে কানামামা ঢের ভালো। অতএব আমতা আমতা করে রাজি হয়ে গেলাম। প্রথম সব কিছুই বড়ো রোমাঞ্চকর। তা সে প্রথম প্রেম হোক বা প্রথম বিদেশ ভ্রমণ। তাই সেই প্রথম বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আজও মানশ্চক্ষে চির অম্লান হয়ে ভাসে। আহা... পটলবাবুরাই কি কেবলমাত্র কলমাস্ত্র নিয়ে খেলবেন নাকি...? মানময়ীরা পিছে থাকবে কোন আক্কেলে, বলুন দেখি !

নেতাজী সুভাষ বোস হাওয়াই আড্ডা থেকে থাই এয়ারওয়েজে চলেছি সপরিবার বিদেশ ভ্রমণে। খেয়াল করে দেখি তদানীন্তন পশ্চিমবঙ্গের বিশুদ্ধ বাংলাভাষী সেলস বাবুদের একটি দলও চলেছেন ব্যাঙ্কক পাটায়া অভিমুখে। তাদের দেখেই পতিদেবতা বিড়বিড় করে স্বগোতোক্তি করলেন, "ব্যাঙ্কক তো নিমিত্ত মাত্র, আসল উদ্দেশ্য তো পাটায়া"। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় আমার বদ্ধমূল ধারণা সেলসের লোকেরা দুটি কারণে পাটায়া যায়... এক, টার্গেট অ্যাচিভ করার আনন্দে এবং দুই, টার্গেট অ্যাচিভড না হবার দুঃখে।

সে যা হোক, প্লেন আকাশে ডানা মেলতেই শুনলাম "দো দিনকা রাজা" এক সেলসবাবু সুন্দরী থাই বিমানসেবিকাকে ডেকে শুধোচ্ছেন,  "মে আই হ্যাভ রেড ওয়াইন প্লিজ?" ছেলেপুলে জাতীয় বস্তু সঙ্গে থাকলেই দেখবেন তাদের কান কটকট, মাথা ভনভন, পেট টনটন, দাঁত কনকন এইসব ধন্যাত্মক সমস্যা সবসময় এঁটুলির মতো সঙ্গে এঁটে থাকে। এইসব বিরক্তিকর ব্যাপারে আধঘন্টাটাক চলে গেছে... এর মধ্যেই আবার শুনি সেই এক কন্ঠস্বর "ক্যান আই গেট হোয়াইট ওয়াইন?" বক্তব্যের ধরণ কিছু পাল্টে গেলো বলে পেত্যয় হয়! এরপর আধঘন্টা কেটে গেছে এবং ছানাপোনার ঘ্যানঘ্যানানি সামলে একটু ঝিমিয়ে পড়েছি কি আধোঘুমে, শুনলাম সেই এক বঙ্গপূঙ্গবীয় কন্ঠস্বর "ওয়ানা টু হ্যাভ ককটেল। ব্রিং ইট সুন"। বুঝলাম আমরা গন্তব্যের খুব কাছাকাছি এসে পড়েছি। রাজামশাই "বাজা তোরা রাজা যায়" মনোভাব সহকারে থাই ভূমিতে পদার্পণ করতে চলেছেন ।

দঃ পূঃ এশিয়ার একটি থেরিবাদী বৌদ্ধধর্মাবলম্বী দেশ থাইল্যান্ড। এর উত্তরে মায়ানমার এবং লাওস, পূর্বে লাওস এবং কম্বোডিয়া, দক্ষিণে মায়ানমার এবং পশ্চিমে আন্দামান সমুদ্র। দঃ পূঃ এশিয়াতে থাইল্যান্ডই একমাত্র দেশ যেটি অষ্টাদশ এবং উনবিংশ শতকের ঔপনিবেশিকতার সরাসরি প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছিল। এটা অবশ্য ইতিহাসের প্রতিপাদ্য বিষয়। তবে মোদ্দা কথা থাইল্যান্ড সেসময় কলোনাইজড হয়নি। 

১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ এর মধ্যবর্তী আমেরিকা এবং ভিয়েতনামের লড়াই চলাকালীন আমেরিকার রণক্লান্ত সেনাদের "rest and recreation" এর ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়ায় ব্যাঙ্কক এবং তার উপকূলবর্তী শহরগুলি। এর প্রত্যক্ষ ফল হিসেবে শুরু হয় আমূল পাশ্চাত্যকরণ। থাইল্যান্ডের নিজস্ব ফ্যাশান, সঙ্গীত, নৃত্য, সামাজিক জীবন, এমনকি মূল্যবোধের মাপদণ্ড পর্যন্ত সেই ঝোড়ো পশ্চিমা হাওয়ায় বেসামাল হয়ে যায়। পরোক্ষ ফল হিসেবে আন্তর্জাতিক দেহব্যবসার মানচিত্রে থাইল্যান্ড একটি উল্লেখযোগ্য নাম হাসিল করে এবং অতি দ্রুত পুষ্ট হয় সেই দেশের অর্থনীতি। কিন্তু মজার কথা হলো, যৌনতার বিপনন অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলেও দেহব্যবসা কিন্তু সেখানে এখনও আইনসম্মত নয়।

আসল কথায় ফিরি এবার। পাটায়া হলো গিয়ে সেই দেশেরই পূর্ব উপকুলের একটি ছোট শহর। আবহাওয়া উষ্ণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য থাইল্যান্ডে মাত্র দুটি ঋতু - গ্রীষ্ম এবং বর্ষা। গোয়া, আন্দামান, কিংবা আমাদের অতি চেনা পাঁচপেঁচির দিঘার সাথে পাটায়া চরিত্রগত ভাবে অনেকটাই এক। কেবলমাত্র প্রবল আধুনিকায়ন, নিয়মশৃঙ্খলিত দেখভাল, যৌনতা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের চতুর বিপনন কৌশল একে পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় টুরিষ্ট হাবে পরিণত করেছে।

সকাল বেলায় হোটেলে চেক ইন করে প্রাতরাশ সারলাম। বুফেতে আমার জানা প্রায় প্রতিটি দেশের খাদ্যসম্ভার থরে থরে সাজানো। অদ্ভুত কায়দায় অমলেট বানানো হচ্ছে। মধ্যে স্টাফিং বা পুর দেওয়া হচ্ছে খাদকের ইচ্ছেমত। পর্ক, চিকেন বা ভেজিটেবল দিয়ে। এছাড়া বিখ্যাত থাই খাবার তো আছেই। রেড অথবা গ্রিন কারী কিংবা পাড থাই। এমনকি আমাদের অতি পরিচিত রাজমা চাবল পর্যন্ত বাদ নেই। 

সে যা হোক, প্রাতরাশ সেরে সবাই মিলে পাটায়া শহর দেখতে বেড়িয়েছি। একপাশে পাটায়া বিচ এবং অন্যদিকে থাইল্যান্ডের দীর্ঘতম রাস্তা সুকুমভিট রোড। এই দুই এর মধ্যবর্তী অঞ্চল জুড়ে শহরের যাবতীয় মনোরঞ্জনের উপাদান মজুত। পথে বিভিন্ন দেশের বহু ভাষাভাষী মানুষের সমাবেশ বেশ একটা "বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান" আবহ সৃষ্টি করেছে। চতুর্দিকে অবিমিশ্র উদার হাওয়ার সংস্পর্শে আমি যুগপৎ বিস্মিত ও প্রফুল্লিত। প্রকাশ্য দিবালোকে মানব ও মানবীর ঘনিষ্ঠ ভঙ্গি চোখে পড়লেই দুদণ্ড সেখানে দাঁড়িয়ে অজান্তেই দাঁত কেলিয়ে ফেলছি। কলকাতার সেন্ট্রাল পার্ক এবং ভিক্টোরিয়ার ঝোপঝাড় অভিলাষী প্রেমার্থীদের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে অমনি। আহারে বেচারারা! 

চওড়া রাস্তাঘাট চমৎকার ভাবে পরিচ্ছন্ন। পথের পাশে হরেক কিসিমের দোকানপাট। নিত্যদিনের সামগ্রীর জন্যে আছে সেভেন ইলেভেন নামের আধুনিক মুদি দোকান। প্রায় প্রতিটি রাস্তায়। জনবহুল রাস্তার একটু ভেতরদিকে আছে নানানদেশীয় খাদ্যের রেস্তোঁরা। পাটায়া খাদ্যবিলাসীদেরও অতিপ্রিয় স্থান। এখানে নারী শক্তির জয়জয়কার সর্বত্র। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে সিংহভাগ নারী এবং তারা অতি সুনিপুনভাবে দায়িত্ব পালন করছেন। পান থেকে চুন খসাটুকু পর্যন্ত বুক দিয়ে আগলে রেখে অতিথিকে জানাচ্ছেন... "খুন খাপ...খুন খাপ..." (থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু)। 

আমেরিকান দাদুদের একটি দলকেও "লাইফ বিগিনস অ্যাট সেভেনটি" মুখ করে সোৎসাহে ঘুরে বেড়াতে দেখলাম। বিশুদ্ধ ইংরেজী ভাষা যে এতটা গুরুত্বহীন হতে পারে এবং গোনাগুনতি কয়েকটা ইংরেজী শব্দ জানা থাকলেই যে জীবনটা দিব্য চলে যায়, পাটায়া না এলে সেটা কোনওমতে বুঝতাম না। রাস্তাজুড়ে দীর্ঘকায় ইউরোপিয়ানদের দল কৌপিন, লাঠি, ইউরো এবং একটি ম্যাপ সম্বল করে পাটায়া পরিভ্রমণ করছে। ইংরেজীর ধারও ধারছেনা কেউ! 

তাদের এমন হেন মনোভাব দেখে আমার অন্তরাত্মাতেও "আ মরি বাংলা ভাষা" সিনড্রোমটা চড়াৎ করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো। এমনিতেই আমি ফুটপাথ বিকিকিনি অন্তপ্রাণ এক মহিলা। অতএব পাটায়ার ফুটপাতেই শুরু করি পরীক্ষা নিরীক্ষা। আমার এইসব অদ্ভুত আচরণের সাথে ব্রাহ্মকুলজাত শান্তস্বভাব পতিদেবতাটি বিলক্ষণ পরিচিত। এইসব ক্ষেত্রে তিনি প্রখর ঝাঁ ঝাঁ রোদের মধ্যেও "আজি যত তারা তব আকাশে" মুখ করে অন্তরীক্ষপানে তাকিয়ে থাকেন। আমি ততক্ষণে রীতিমতো গড়িয়াহাটীয় কায়দায় দরদাম শুরু করে দিয়েছি। অবশ্যই মাতৃভাষায় -

থাইদিদি বলছেন..."তু হানদেদ ভাত"

আমি বলছি... "অসম্ভব... এ হতেই পারেনা! বিদেশি পেয়ে ঠকাচ্ছেন দিদি! আপনার দোকানে আর দ্বিতীয়বার আসবো? বলুন? পুজোর বাজার আছে সামনে।"

থাইদিদি বলছেন..."নো বাগেনিং...নো বাগেনিং...ইন্দিয়ান লেদি!"

যাচ্চলে কাকা! আমি বেজায় ব্যোমকে যাই। জানলো কি ভাবে? এ যে "আমি চিনিগো চিনি তোমারে" ব্যাপার স্যাপার! অন্তর্যামী নাকি? অথবা আমার হাতে দিবারের অমিতাভের মতো স্পষ্ট লেখা আছে "মেরা দেশ ইন্দিয়া হায়!" ট্রিপটা সম্পূর্ণ হবার আগেই অবশ্য এই রহস্যটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো আমার কাছে। 

থাই অর্থনীতিতে একটি বৃহৎ অবদান থাকলেও ইন্ডিয়ান টুরিষ্টদের খুব একটা শ্রদ্ধার চোখে দেখেনা থাই জনগণ। কারণটা সবার জানা। ভারতীয়দের ঝগড়ালু মনোভাব, টিটকিরি দেবার প্রবণতা, অপরিচ্ছন্নতা, প্রাণান্তকর দরদাম করার স্বভাব বা সুযোগ পেলেই নিয়মভঙ্গের চেষ্টা। 

বিকেলে অবশ্য অন্যরকম অভিজ্ঞতা হলো। সন্ধ্যা নামতে না নামতেই ঝলমল করে পাটায়ার চারিদিকে। ফুটপাতে উচ্চিংড়ে এবং নানারকম পোকামাকড়ের কাঁচামাল নিয়ে জাঁকিয়ে বসে যায় সান্ধ্য তেলেভাজার দোকানগুলি। অনতিদূরেই হাতছানি দেয় ভোম্বা সাইজ খানদানি থাই পেয়ারা। সুরসিকা থাই দিদিমা বসেছেন রঙচঙে কিছু সামগ্রী নিয়ে। হাতছানি দিয়ে ডাকছেন আমার কন্যাটিকে। "টেক ইট ফর মামা পাপা।" ঘাবড়ে গিয়ে দেখি জন্ম নিয়ন্ত্রক দ্রব্যাদি! কি বিচক্ষণ রে বাবা! সুদূর বিদেশ থেকে আগত এই দম্পতিকে একঝলক দেখেই বুঝে গেলেন, এরা এতই করিৎকর্মা যে এই মুহূর্তে এদের না থামালে একটি ছোটোখাটো গ্রাম সৃষ্টি হয়ে যাওয়াও কিছুমাত্র অসম্ভব নয়। অভিজ্ঞ এবং দূরদর্শী বটে! 

এদিকে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে উজ্জ্বলতা। মদির কটাক্ষ হেনে প্রসাধিত সুন্দরী শহরটি দু হাত বাড়িয়ে আহ্বান করে এক নেশাতুর সময়কে। যৌবন লাস্যে ভরপুর হয়ে যায় আবহ। পথপাশে ঝাঁপ খুলে বসে ভ্রাম্যমান ক্যারাভান বার। চারপাশে সঙ্গীত নৃত্যের অবিরল মূর্ছনা সেই যৌবনতরঙ্গে আনে তুমুল হিল্লোল। ম্যারাপ বাঁধা ছোটোছোটো বার কাম রেস্তোঁরাগুলোতে এক মনে গেয়ে যায় গিটার হাতে তরুণ গায়ক। চারিদিকে সুরের মায়াজাল ছড়িয়ে দেন বব ডিলান। সেই অনন্ত যৌবনা নগরিনীর মায়া কাজলে চোখ ধাঁধিয়ে বাসস্থানে ফিরে আসি মৃদু পায়ে। আগামীকাল সকাল থেকে শুরু হবে পাটায়া এবং তার অন্তর্গত পর্যটন কেন্দ্রগুলো পরিভ্রমণ।

"ইউ থ্রি মিনিটস লেত..." অত্যন্ত গম্ভীর মুখে জানালেন আমাদের মহিলা টুরিষ্ট গাইড। বলে কি হে? মিনিটের হিসেবে দেরি! এমনটা বাপের জন্মে শুনিনি বাপু! পরের বার থেকে এমন হবেনা... এই অঙ্গীকার সহ দুঃখ প্রকাশ করে সকাল সকাল রওনা হলাম নুং নুচ ভিলেজ মুখো। 

নুং নুচ ভিলেজ আদপে একটি সাজানো বাগান বই নয়। কঠিন ভাষায় বললে সপ্তদশ শতকজাত ইউরোপীয় রেঁনেসার ভাবধারায় অনুপ্রাণিত সজ্জিত উদ্যান। প্রচুর ক্যাকটাস, বনসাই এবং নানারকম লতা পাতার ভাণ্ডার পর্যবেক্ষণ করে বৃক্ষপ্রেমী মানুষদের আহ্লাদিত হবার কথা! যদি যান, থাই ক্লাসিকাল নৃত্য বাদ্যের কিছু নমুনাও দেখে নিতে পারেন ইচ্ছে হলে। তবে হ্যাঁ, ফেরার পথে অসীম প্রতিভাশালী হাতিদের সাথে পরিচয় করতে অবশ্যই ভুলবেন না। তারা পাবলিকের মনোরঞ্জন করে, নাচে, ফুটবল খেলে, ছবি আঁকে, জিমন্যাস্টিক করে, এমনকি অবলীলায় নির্ভুলভাবে অঙ্ক কষে দেয়। এমনভাবে যদি তাদের অঙ্ক অভ্যাস চলতে থাকে, আমার ধারণা, অচিরেই তারা পিথাগোরাস টপকে লগারিদমে পৌঁছে যাবে। 

সেই দিনই দ্বিতীয়ার্ধে দেখা হয়ে গেলো আন্ডার ওয়াটার ওয়ার্লড। এশিয়ার সবচেয়ে আধুনিক এবং দীর্ঘতম সমুদ্র অ্যাকোরিয়াম। অসংখ্য প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীদের স্বাভাবিক পরিবেশে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে সেখানে। শার্ক থেকে শুরু করে স্টারফিশ, সি হর্স, জেলিফিশ, এমনকি বিভিন্ন প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ, সি উইডস এবং সমুদ্র কোরাল... কি নেই সেই জলের তলার আজব দুনিয়ায়। আপাদমস্তক কাঁচের আ্যকোরিয়ামের বুক ফুঁড়ে তৈরি করা হয়েছে ১০০ মিটারের একটি পায়ে হাঁটবার টানেল। এ যেন জলেও নামলাম অথচ বেনীও ভিজলো না! আমার পুত্র, কন্যা তো বটেই মায় খুঁতখুঁতে বেচুবাবুটি পর্যন্ত ভয়ানক খুশি ।

তার পরের দিন প্রায় সারাদিন ধরে ঘুরে বেড়ালাম কোরাল আইল্যান্ডগুলোতে। নানারকম বোটে করে। কোরাল বা কোহ লান আইল্যান্ড আসলে পাটায়ার চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কয়েকটা নয়নাভিরাম দ্বীপ। আদিগন্ত স্বচ্ছ সুনীল আকাশ এবং চরাচর ব্যপ্ত অসীম জলরাশির মাঝখানে অগাধ বিস্ময়ে জেগে ওঠে আমাদের এই ক্ষুদ্র ইচ্ছে ভরা তুচ্ছ প্রাণটি। একের পর এক অসামান্য সুন্দরী দ্বীপের প্রাণহরা দৃশ্যে না মন হারাতে চাইলে সাহারা নিতে পারেন কিছু রোমাঞ্চকর মনোরঞ্জনের। আস্বাদ নিতে পারেন প্যারা ট্রুপিং, স্কুবা ডাইভিং কিংবা জেট স্কায়িং এর। 

সারাদিন টো টো করে সন্ধ্যাবেলায় সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলে গেলাম আলকাজার শো দেখতে। এটি একটি নৃত্যগীতের অনুষ্ঠান। অনেকটা অপেরার মতো। দীর্ঘাঙ্গী মঙ্গোলয়েড সুন্দরীরা নৃত্য গীতের উচ্ছ্বাসে মাতিয়ে রাখেন অপেরা হাউস। আমি সেই কুশীলবদের দেখে বুঝতেই পারিনি যে তাঁরা আদপে মহিলা নন। সাথে ছিলো অনবদ্য "লাইট এবং সাউন্ড এফেক্ট"। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশের জনপ্রিয় গানগুলিকে গ্রন্থিত করে একটি নৃত্যনাট্যের উপস্থাপনা করা হয়েছিলো। ভারতীয় গান "নাচলে নাচলে" চলাকালীন বেশ কটা সিটিও পড়লো হলে। 

তবে যেটা বলছিলাম। সেই নৃত্যশিল্পীদের কথা। তাঁরা নারী নন, আচরণগতভাবে পুরুষও নন। এঁদের আক্ষরিক অর্থে ট্রান্সজেন্ডার বা ট্রান্সসেক্সুয়ালও বলা যায়না। এঁদের পোশাকী নাম "ক্যাথয়ি" বা লেডিবয়। এঁরা গঠনগত ভাবে পুরুষ হলেও আচরণগত ভাবে নারী।গোটা থাইল্যান্ডে এই ধরনের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। নারীত্ব ভাবটি পাকাপোক্ত করতে অনেকেই সাহায্য নেন ব্রেষ্ট ইমপ্ল্যান্ট, সিলিকন ইঞ্জেকশন কিংবা অ্যাডামস আ্যাপেল রিডাকশনের মতো বৈজ্ঞানিক উপায়ের। শুধুমাত্র নাচাগানা নয়, নিজ নিজ ইচ্ছানুসারে রাষ্ট্রের প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে এমনকি দেহব্যবসাতে পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এঁরা। গোটা পৃথিবীর তুলনায় থাইল্যান্ডেই এঁদের অবস্থা সবচেয়ে সম্মানজনক। 

এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনা মনে পড়ে গেলো। পাটায়া ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনে সন্ধ্যাবেলায় হোটেলের লবিতে দেখি প্রবল দোলাচল। যে কোনও ঝামেলাঝাঁটির নীরব দর্শক হবার অভ্যাস আমার জ্ঞান হওয়া ইস্তক। তাই পোলাপানদের "বাবার কানে ঘ্যানাও এইবেলা" বলে হস্তান্তর করে আমি বাওয়াল সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে উৎসস্থলে রওনা দিই। 

ওমা কী কাণ্ড! কৌপিনসম্বল এক সর্দার পুত্তর ছুটছেন। পশ্চাতে এক থাই সুন্দরী। সে কি গতি, ভাইসাব! দেখলে ভুলতে পারবেন না কোনও দিন! পরে শুনি সেই ইন্ডিয়ান কেলো! সর্দার পুত্তর দরদাম পূর্বক "বড়ো আশা করে" যারে তুলে এনেছেন তিনি মোটেই বিশুদ্ধ ললনা নন, সেই বহু চর্চিত তৃতীয় লিঙ্গ। বন্ধ দরজার পশ্চাতে সেই হৃদয়বিদারক সত্যের মুখোমুখি হয়ে কয়েক পলের "উড়তা পঞ্জাব" সেই মুহূর্তে "ভাগতা মিলখা" হয়ে গেছেন। ভারতীয় অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েসন অভ্যাসকালে প্রতিটি দৌড়বীরের পিছনে এরকম একটা প্ররোচনা লেলিয়ে দেবার কথা সদর্থক ভাবে চিন্তা করতে পারেন কিন্তু! এতে অন্তত দৌড়ে ভারতের পদক প্রাপ্তির সম্ভাবনা একটু উজ্জ্বল হয়, এই আর কি!

পাটায়াতে থাকার শেষ দিনে দেখা হলো "স্রিরাচা টাইগার পার্ক", বৌদ্ধ এবং হিন্দু প্রভাবে তৈরি কাঠের স্থাপত্য "স্যাংচুয়ারি অব ট্রুথ" এবং জলে ভাসমান বিকিকিনির হাট "ফ্লোটিং মার্কেট"। মার্কেটে নজরে এল অনেক জিনিসের মাঝে বিক্রি হচ্ছে অক্টোপাস ভাজা ও কেজি দরে কুমিরের মাংস। ট্রাই করে দেখতে পারেন। এর পরের দিন আমরা উড়ে যাবো রাজধানী ব্যাঙ্কক অভিমুখে। সে অবশ্য অন্য গল্প। শেষের রাত্তিরে বায়না ধরলাম ওয়াকিং স্ট্রিট যাবো। বেচুবাবু কাষ্ঠ হাসি হেসে অতি কষ্টে সম্মত হলেন ।

বিচ রোডের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে আরম্ভ করে বালি হাই পাইয়ার পর্যন্ত ওয়াকিং স্ট্রিট এর ব্যপ্তি। থাই অর্থনীতির মাতাস্বরূপিনী এই স্থানটি না দেখিলে কি দেখিলেন জীবনে! পোলাপানদের হোটেলের রুমে ঘুম পাড়িয়ে কর্তা গিন্নি দুজনে মিলে বেশ ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে বেরিয়েছি ওয়াকিং স্ট্রিট দেখবো বলে। এখানে সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত অবধি কোনও গাড়িঘোড়া চলেনা। পুরো রাস্তায় পায়ে হেঁটে ঘুরতে হয়। নিয়ম শৃঙ্খলার দায়িত্ব টুরিষ্ট পুলিশের হাতে। এই পুলিশেরা অবশ্য বিভিন্ন দেশের মানুষজনকে নিয়ে তৈরি একটি স্বয়ংসেবক দল। 

তা সে রাস্তায় পা দিয়েই তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া। চারদিকে যৌবনের এমন খুল্লামখুল্লা প্রদর্শন আমি এ জন্মে অন্তত দেখিনি। নিওন আলোর মায়ামেদুর রঙিন বাতাবরণে নানান দেশের জনগণ স্বল্প পোশাকে ভ্রাম্যমান। স্ফুরিত ওষ্ঠাধর, বিলোল কটাক্ষযুক্তা, ক্ষীণকটি, গৌরাঙ্গী ললনারা যৌবন লাস্যে, হাস্যে, পরিহাসে পরিবেশ মদির করে তুলেছে। নারী মাংসের এমন উন্মুক্ত বিপনন সত্যিই ভীষণ আশ্চর্যের! যার পোশাকি নাম বুমবুম। এছাড়া গে, লেসবিয়ান থেকে শুরু করে লেডিবয় কিংবা যৌনতার সম্মিলিত আহ্বান - কি নেই এখানে! 

রাস্তার দুপাশে বিশেষ ম্যাসাজ পার্লার, ডিসকো থেক, সি ফুড স্টল কিংবা গো গো বারের ঢালাও আতিথ্য যেকোনও স্বাভাবিক লোকের মাথা ঘুরিয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ট। এর ওপর আবার শরীর বাঁকিয়ে মুচড়ে ডাণ্ডা পেঁচিয়ে ত্রিভঙ্গমুরারী হয়ে নেচে চলেছেন অত্যল্পবসনা পোলনাচনি ভগিনীরা। দাদুর কোলে নাতনি আপত্তিকরভাবে শায়িতা। আপনার পছন্দের সবরকম উপকরণ আছে হেথায়। শেতাঙ্গিনী, পীত অথবা বাদামীবরণ নারীর দল। এমনকি "তিন তিগারা কাম বিগাড়া" এই প্রবাদটিকে ভুল প্রমাণ করে তৃতীয় ব্যক্তিও হাজির আছে যুগলের আনন্দে নতুন মাত্রা দিতে। এমনকি আপনি যদি "জরা হাটকে" হন তার ব্যবস্থাও দিব্য আছে। সাথে আছে "সবারে করি আহ্বান" মার্কা চরম যৌনতার শো, উপভোগ করবার প্রশস্ত গ্যালারি ব্যবস্থা সহ। "আজ সবার রঙে রঙ মেলাতে হবে" এই লাইনটি সদা স্মরণ রেখে, আছে আদিরস বিজড়িত "রাশিয়ান শো" কিংবা ছুরি, কাঁচি, ভাঙা বোতল সম্বলিত কদর্য এবং বিপজ্জনক "থাই শো" 

এইসব শো গুলোর প্রতি চৈনিক বন্ধুদের ভয়ানক আকর্ষণ দেখলাম। তারা আজকাল ভ্রমণপিপাসু জাতি হিসেবে বিপুল নাম কিনেছেন। শুধুমাত্র একা বা পরিবার নিয়ে নয়, সম্পূর্ণ গোষ্ঠী তুলে এনেই তারা গুষ্ঠিসুখ অনুভব করে থাকেন। দেখি "রাশিয়ান শো" থেকে বেরিয়ে আবাল বৃদ্ধ বনিতার একটি দল চিং চাং কলরব সহকারে ভাবলেশহীন মুখে "থাই শো" তে ঢুকে গেলেন। ভাবখানা যেন "সবে মিলে করি কাজ... হারি জিতি নাহি লাজ"।

ওয়াকিং স্ট্রিট থেকে হোটেলের দিকে ফিরছি দুজনে। কারও মুখে কোনও কথা নেই। স্তব্ধ হয়ে গেছে সব কোলাহল। স্ট্রিটের বাইরের রাস্তা তখন শুনশান খাঁ খাঁ। পাটায়া কিছুক্ষণের বিরাম নিচ্ছে। চলতে চলতে কেবল মনে হচ্ছে প্রতিদিনের এই অবিরল ভোগসুখ ক্লান্ত করেনা মানুষকে! রাত বাজে আড়াইটা। পথের পাশে দোকানগুলোর ঝাঁপ ফেলে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করা হচ্ছে। একটি পাবে তখনও একলা মনে গেয়ে চলছে গিটার হাতে উদাসী তরুণ। শ্রোতাবিহীন নিরালায় এক অনাবিল শূন্যতার দীর্ঘশ্বাস! শেষ থেকে শুরুর অন্তহীন অপেক্ষা কিংবা শুরু থেকে শেষের চরম শূন্যতা। নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে একাকী বেজে চলেছেন জিম মরিসন...

This is the end
Beautiful friend 
The end of laughter and soft lies
The end of nights we tried to die...























2

পথে প্রান্তরে - বিধান তুঙ্গ

Posted in


পথে প্রান্তরে


কেদারনাথের পথে
বিধান তুঙ্গ



"বাবা, এতদিন পরে ফিরবে?" ছলছলে চোখে ছেলের প্রশ্ন, স্ত্রীর অভিমান ও আবেগঘন মুখের "সাবধানে থাকবে" প্রতিবারই মনকে ভারাক্রান্ত করে দেয়। প্রতিবারই ভাবি -আর নয়, এই শেষ - বয়স বাড়ছে, পরিবারের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টি করা! কি করব, কাকে বোঝাই পরিযায়ী মনের কথা। হিমালয়ের অমোঘ আকর্ষণ, নিশির ডাক উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই সব কিছু উপেক্ষা করে আবার চলেছি হিমালয়ে। উপাসনা মেলে আমরা সাত জন চেপে বসেছি হরিদ্বারের উদ্দেশ্যে। জঙ্গল, ঝরনা, বরফ, আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথে হারিয়ে যাই। গাড়োয়াল হিমালয়ের মাওয়ালি গিরিপথের (১৭৫৪৯ ফুট) মধ্যে দিয়ে কেদারনাথ পৌঁছাতে চাই। কেদারনাথে পৌঁছানোর চারটি পথ রয়েছে। মাওয়ালি গিরিপথ - যে পথে আমরা চলেছি, দ্বিতীয় -এডেন কল হয়ে গঙ্গোত্রী থেকে কেদারনাথ। তৃতীয় - ত্রিযুগীনারায়ণ-পঁওলীকঁটা হয়ে, চতুর্থ - প্রচলিত পথ গৌরীকুণ্ড হয়ে।



দ্বিতীয় দিন / ২৮ মে

না! হলো না -ইচ্ছে ছিল অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে থাকবো। সকাল ৫-৪০ মিনিট "চায়ে চায়ে"- সেই চিরপরিচিত ডাকে ঘুম ভেঙে গেল। না! কিছুতেই এখন উঠবো না। চোখ বন্ধ করে রইলাম। আগামী দিনের চিন্তা ভীড় করছে মনের গহ্বরে, চিন্তার কোষগুলি সজাগ হয়ে গেলে ঘুম আসে? অগত্যা ভোরের ডাকে সাড়া দিয়ে উঠে পড়লাম। সবাই শুয়ে আছে, উপায় নেই বসার। গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ভোরের নরম আলোকে স্নাত প্রান্তিক স্টেশনগুলি একটার পর একটা আসছে আবার হারিয়ে যাচ্ছে। চরাচর জেগে উঠেছে ধীরে ধীরে, পশ্চিম ভারত একটু দেরিতে জাগে। লেকভিউতে শুভশ্রী, নূপুরের হাঁটা শেষ হয়ে যায় এতক্ষণে। ছোট্ট অনীক মায়ের পায়ের কাছে অঘোরে ঘুমোচ্ছে। বাবা-মায়ের সাথে চলেছে হরিদ্বার - হৃষিকেশ বেড়াতে। রামরাজাতলার ডলিদি স্বামীর সাথে চলেছে হিমালয়ে। পঞ্চকেদার চারটি হয়ে গেছে, ৫৮ বছর বয়সে অবসরপ্রাপ্ত বয়স্ক স্বামীকে নিয়ে চলেছেন পঞ্চকেদারের কঠিনতম পথ রুদ্রনাথ। আমায়িক বয়স্ক মানুষ দুটি দেখে অনুপ্রাণিত হলাম। দেখতে দেখতে উত্তর প্রদেশের রাজধানী লক্ষ্মণাবতী পৌঁছে গেলাম। ঘড়ির কাঁটাতে সকাল ৭-৩৫ মিনিট, মানে ২০ মিনিট লেট। এখনও হরিদ্বার ৯ ঘন্টার পথ।

আমাদের অভিযানের লক্ষ্য ঘুট্টু হয়ে মশারতাল, মাওয়ালি গিরিপথ ও বাসুকিতাল হয়ে কেদারনাথ। কেদারনাথের পথে যতগুলি পথ আছে, তার মধ্যে অন্যতম ও সকল অভিযাত্রীদের কাছে আকর্ষণীয়। সাধারণত এপ্রিল থেকে জুন মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এবং সেপ্টেম্বর -অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই পথে অভিযান হয়। প্রাক বর্ষায় এই পথ অধিকাংশই বরফে ঢাকা থাকে।..

.......একি! দাঁড়িয়ে পড়লো কেন? বেশ তো চলছিল। উপাসনা এক্সপ্রেস জগদ্দল পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে লাসকার স্টেশনে। আমাদের বহু প্রতীক্ষিত স্টেশন হরিদ্বারের কিছু পূর্বে। সমস্ত মালপত্তর গুছিয়ে স্টেশনে নামার অপেক্ষায়। "দূরে কোথায় দূরে দূরে, আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে"- মোহিত হয়ে গেলাম বৃথা চ্যাটার্জির অপূর্ব কন্ঠস্বরে। সবার অনুরোধে কয়েকটি গান আমাদের শুনিয়ে দিলেন। বৃথা স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই গান নিয়েই আছেন। কয়েকজন বন্ধুর সাথে চলেছেন তুঙ্গনাথ-চন্দ্রশিলা অভিযানে। তাঁর ইচ্ছে পরবর্তীকালে আমাদের সাথে অভিযানে যাওয়ার। চলভাষের নম্বর বিনিময় করতে করতেই চলে এলো হরিদ্বার। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, সৌজন্য বিনিময়ের সুযোগটাও পেলাম না। পথের বন্ধু হারিয়ে গেল ভীড়ের মাঝে।

স্টেশনে নেমে অটো রিকশা করে বেরিয়ে পড়লাম হৃষীকেশের উদ্দেশ্যে। চারিদিকে অস্বাভাবিক ভীড়, পুণ্যলাভের আশায় দলে দলে মানুষ এসেছে পুণ্যভূমি হরিদ্বারে। এখন চারধাম যাত্রা চলছে, গঙ্গোত্রী -যমুনোত্রী -কেদার-বদরী। সারা উত্তরাখণ্ড রাজ্য জুড়ে অসংখ্য দেবদেবীর মন্দির। "হরির-দ্বার" হলো প্রবেশ পথ। চারিদিকে কংক্রিটের জঙ্গলে ভরে উঠেছে, অপরিচ্ছন্ন মলিন পথঘাট, ইঁট -পাথরের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছি আধুনিক সভ্যতা থেকে সাময়িক মুক্তির আশায়।

রাতে ঠাঁই হলো পূর্ব পরিচিত হোটেল নীলকণ্ঠে। দশ দিন হাঁটার রসদ এখান থেকেই সংগ্রহ করে নিয়ে যাব। হৃষীকেশ বাজারের কাছেই হোটেলটি।

ব্যাগ গুছিয়ে রাখার আগেই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হলো। মাথায় হাত -আজ রাতের মধ্যেই সব রেশন কিনে নিতে হবে, ঘুট্টু যাওয়ার গাড়ির ব্যবস্থা - কী করে সম্ভব? 

ঝড়ো হাওয়া আর মুশলধারায় বৃষ্টি হয়েই চলছে।

যাহ্‌!! লোডশেডিং হয়ে গেল - ষোলো কলা পূর্ণ। বৃষ্টি ধরে এসেছে, রেনকোট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে টর্চ। ভাগ্যক্রমে পাশেই ভালো একটা মুদির দোকান ছিল লিস্ট দেখে বলে দিলাম। সকালে তুলে নেব গাড়িতে। গাড়ির কী হবে? -অজয় ট্রাভেলস গাড়ির ভাড়া যা চাইছে তা আমাদের বাজেটের বাইরে। প্রকৃতি বিরূপ, গাড়ির জন্য স্টান্ডে যেতে পারছি না।

"হোটেল বন্ধ হয়ে যাবে, রাতে খাওয়া হবে না। চল আগে খেয়ে নিই " -রাজেশের আকুতি ভরা কন্ঠ।

রাজেশ আমাদের দলের সবচেয়ে শক্তিশালী ও সক্ষম সদস্য। সবাই যা খাবে, তা থেকে বেশির ভাগ সময় অন্য কিছু খেতে হবে। কিন্তু বিপদের সময় রাজেশ সবার আগে।

"বিধানদা, নটরাজচকে চলো। খুব ভালো আমিষ খাবার পাওয়া যায়"। এই বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে চার কিলোমিটার দূরের নটরাজচকে খেতে যাবো? যাব কি করে? প্রশ্ন শুনে উওর দিল - "অটো রিকশা ৭ টাকা নেবে"। চলো, যাওয়া যাক। গাড়ি সকালে ঠিক করা যাবে। টিপটপ খাবার হোটেলে পৌঁছলাম। সত্যিই অনবদ্য খাবার। মাটন রোগানযোশ-তন্দুরি রুটি স্যালাড সহযোগে রাতের খাবার সম্পূর্ণ করলাম। হোটেলে ফিরে পরের দিনের ভাবনা ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ হয়ে এলো। শুভ রাত্রি।



তৃতীয় দিন/ ২৯শে মে 

"বিধানদা, ওঠো ওঠো"- দরজায় স্বরূপের করাঘাতে ঘুম ভেঙে গেল। রোদ ঝলমলে সকাল। অপরাধবোধ নিয়ে তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। "চলো যাই, গাড়ি বুক করতে হবে"- দশ মিনিট সময় চেয়ে নিলাম রেডি হতে।

স্বরূপ ব্যানার্জী মেদিনীপুর টাউনের ছেলে, পেশায় ব্যবসায়ী, নেশায় পাহাড়ি। অসম্ভব প্রাণবন্ত ও উদ্যোমী মানুষ। যে কোনও কাজ দাও, ‘না’ বলবে না, দলের সম্পদ, উজ্জীবিত রাখে দলের সদস্যদের।

বেরিয়ে পড়লাম গাড়ির খোঁজে। অবশেষে নটরাজচকের স্টান্ডে অজয় ট্রাভেলসের অর্ধেক দরে বোলেরো গাড়ি পেয়ে গেলাম। গাড়ি নিয়ে হোটেলে ফিরে সবাইকে প্রস্তুত হতে বলে সমীরণদাকে কালকের বাজারের তালিকা মিলিয়ে নিতে অনুরোধ করলাম। সবাই ব্যাগপত্তর গাড়িতে তুলে মুদির দোকানে গেল রেশন আনতে। হৃষীকেশ ছেড়ে ঘুট্টু রওনা দিলাম সকাল ৮-৪৫ মিনিটে।

সমীরণদা আমার জেঠুর ছেলে। দাদা কম, বন্ধু বেশি। বুদ্ধিমান ও শান্ত মাথার মানুষটি বড় প্রিয় এবং নির্ভরশীল। তবে শরীর মোটেই নির্ভরশীল নয়।

রাজেশ পাল আমাদের বোলেরোর সারথি। হৃষীকেশের ছেলে, অভিজ্ঞ ও দক্ষ চালক। চলতে চলতে পৌঁছে গেলাম সেই বিতর্কিত তেহেরী জলাধারে, সুন্দরলাল বহুগুণার আন্দোলন বাঁচাতে পারেনি নিম্ন তেহেরীর গরীব মানুষদের। বাঁধের কাছে পুলিশের বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ উপেক্ষা করে ক্যামেরাবন্দী করা গেল জলাধার। চাম্বা, তেহেরী, অতিক্রম করে পৌঁছলাম ঘনশালীতে। চা পানের বিরতি। চালক রাজেশ এক দুঃসংবাদ বয়ে আনল - "সাব, আগে নেহি যা পাইঙ্গে"। বিনা মেঘে বজ্রপাত। কেন? কী হলো? 

দোকানদার রামকৃষরামকে জিজ্ঞাসা করলাম ঘুট্টু রাস্তায় কী হয়েছে? গাড়ি যাবে না? আশাব্যঞ্জক কিছু শোনালেন না। বললেন কাল রাতে বা সন্ধ্যায় এখানে cloud burst হয়েছে। মানুষ মারা যায়নি ঠিকই কিন্তু কিছু গোরু, মোষ, বাড়ি জলের তোড়ে ভেসে গেছে। পুলিশের কাছে ছুটে গেলাম শেষ খবরটা কি? কোনও আশা আছে কিনা, রাস্তার কি অবস্থা? 

আহ... বাঁচলাম। পুলিশ জানালো, রাস্তা প্রায় ঠিক হয়ে গেছে, ঘনশালীর এক কিলোমিটার পর মেরামতির কাজ চলছে। গাড়ি নিয়ে চলে এলাম ধ্বংসের কাছে। জলের তোড়ে রাস্তা ভেসে গেছে। দুটো যন্ত্রদানবের আধ ঘণ্টার প্রচেষ্টায় অপেক্ষার অবসান ঘটল।

এগিয়ে চললাম ঘুট্টুর উদ্দেশ্যে। এবার আস্তে আস্তে সবুজের পরিমাণ বেড়ে চলেছে। দুপাশের সবুজ অরণ্যের মধ্যে দিয়ে কালো সর্পিল রাস্তা ধরে ছুটে চলেছি। পথের পাশেই উপল বুকে নিয়ে ছুটে চলেছে বহমান ভিলাঙ্গানা নদী। পৌঁছে গেলাম ছবির মতো সুন্দর গ্রাম ঘুট্টু। ভিলাঙ্গানা নদীর ডান তীরে ছোট্ট টিলার উপরে আমাদের দুদিনের আশ্রয়স্থল এই গাড়োয়াল নিগমের বাংলো। এখান থেকে শুরু হবে আমাদের যাত্রা।



চতুর্থ দিন/ ৩০শে মে

সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। দক্ষিণের আকাশে কালো মেঘ। ভিলাঙ্গানার কলকল ধ্বনি ছাপিয়ে গর্জে উঠছে মেঘ। চায়ের চুমুক আর বিদ্যুৎ ঝলকানির মধ্যেই শুভানুধ্যায়ীদের পরপর ফোন। সতর্কবাণীর বন্যা বয়ে গেল আনন্দবাজার পত্রিকার সৌজন্যে। সবাইকে ধন্যবাদ, কথা দিলাম দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে হঠকারী সিদ্ধান্ত নেব না। পরিবার-বন্ধু সবার জন্য, নিজের জন্য পরিস্কার আবহাওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। সবাই প্রার্থনা করুন মঙ্গলময় ঈশ্বর আমাদের প্রতি বিরূপ না হন।

সকালের প্রাতরাশ করতে গিয়ে পরিচয় হলো এই অঞ্চলের বিখ্যাত পথপ্রদর্শক জয়পাল সিং এর সঙ্গে। যে মানুষটাকে গত একবছর ধরে বই আর অন্তর্জালে খুঁজে বেড়িয়েছি, তিনি সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ৬৫ বছরের সুঠাম চেহারার আমায়িক, পরোপকারী মানুষটি। ১৯৭২ সালে ১৫ টাকার দৈনিক মজুরিতে সামান্য কুলি হিসেবে জীবন যাত্রা শুরু করেছিলেন হিমালয়ের পথে পথে। বয়স বাড়লেও শরীর মন যুবকের মতো তরতাজা। হাতের তালুর মতো চেনেন গাড়োয়াল হিমালয়কে। প্রশ্ন করলাম, "মসম এইসা রহেগা? খোলে গা কি নেহি? হামলোগ যা পাইঙ্গে? "

উত্তরে যা বললেন আশাব্যঞ্জক নয়। কয়েকটি সম্ভাবনার কথা কথা বললেন - ১) এই রকম বৃষ্টি চলতে থাকলে দু-তিন দিনের মধ্যে আকাশ খুলে যাবে। ২) নিরবচ্ছিন্ন বৃষ্টি চললে খাটলিং কেভ পর্যন্ত যেতে বাধা নেই। ৩) রোদ উঠে গেলে গিরিপথ অতিক্রমে বাধা নেই।

আমাদের উপায় নেই অপেক্ষা করা ছাড়া। জয়পাল সিং-কে গল্প শোনানোর জন্য নিগমের বাংলোতে আমন্ত্রণ জানালাম। আপাতত তাস খেলতে চললাম।

দুপুর ১২-৫০ আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছে। জয়, কেদারনাথ কি জয়! 

খেলায় মনোযোগ আসছে না। মনের কোণে অজানা আশঙ্কা, গাইড ও কুলি এখনও এসে পৌঁছলো না। সকাল থেকে বারবার ফোনে যোগাযোগ করছি কতদূর এলো। বাসের সমস্যার জন্য আসতে দেরি হবে। দুপুরের আহারের ব্যবস্থা নিকটবর্তী ছোট্ট একটা হোটেলে। চতুরান সিং রাওয়াত হোটেলের মালিক কাম কুক। যত্ন নিয়ে যথাসাধ্য ভালো খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। ফোনে অডার্র দিলে নিগমের বাংলোতে চা ও খাবার দিয়ে যায়। অবশেষে গাইড রঘুবীর সিং সাত জন কুলি, এক জন রাঁধুনী নিয়ে হাজির। একটা চিন্তার অবসান হলো। নিগমের একটা হল ঘরে সবার বন্দোবস্ত করে বেরিয়ে পড়লাম বাজারে সব্জি আনতে। সমস্ত রসদ সংগ্রহ করতে করতেই রাতের খাবারের সময় হয়ে গেল। লোডশেডিং এ কেমন ভাবে গোছানো হবে? রঘুবীরকে সকালে গোছানোর পরামর্শ দিয়ে আজকের মতো ইতি টানলাম। 




পঞ্চম দিন / ৩১শে মে

সকাল ৫টায় উচাটন মন নিয়ে ঘুম ভেঙে গেল। আকাশের অবস্থা কেমন? আজ কি পারব না শুরু করতে? মেঘ মুক্ত আকাশে একফালি চাঁদ আর বরফে মোড়া শৃঙ্গ দেখে হৃদয় ভরে গেল। আনন্দ আর উত্তেজনায় সবাইকে ডেকে তুললাম। একে একে সবাই হাজির, চোখ মুখে আনন্দের আভাস। বর্তমানে ঘুট্টু থেকে রী পর্যন্ত গাড়িতে যাওয়া যায়। গতকাল দুটো গাড়ির সাথে কথা বলেছিলাম। সকাল ৮ টা ৩০ মিনিটে ঘুট্টুকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়লাম -জয় কেদারনাথ- ধ্বনি দিতে দিতে। ভাঙাচোরা রাস্তার উপর দিয়ে দুলতে দুলতে পৌঁছে গেলাম ১০ কিমি দূরের "রী" গ্রামে। 

এখান থেকেই শুরু হবে আমাদের হাঁটার পথ, গন্তব্য ১০ কিমি দূরের "গাঙ্গী"। গাইডের তত্ত্বাবধানে মালবাহকেরা নিজেদের বোঝা পিঠে তুলে নিল। শুরুতেই গাইডের নির্দেশ - আপলোক সাথ সাথ রহিয়ে গা, আগে পিছে মত্ রহ। আইসতা আইসতা চলতা রহ। অনুরোধ করলাম পেছনে থেকে সবাইকে নিয়ে আসতে।। 

রী-র নিগমের বাংলোর কাছাকাছি থেকে সকাল ১০টায় শুরু হলো যাত্রা। সামান্য চড়াই - উতরাই ভেঙে নেমে এলাম একটা ঝোরার মধ্যে। ঝোরা অতিক্রম করে শুরু দমফাটা চড়াই। বুকের পাঁজর হাপরের মতো উঠানামা করছে। কারোর মুখে কথা নেই একটাই প্রশ্ন- আর কতক্ষণ ভাঙতে হবে এই চড়াই? ডান দিকে ভিলাঙ্গানা অনেক নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে। শৃঙ্গ থেকে বয়ে আসা অভিক্ষিপ্তাংশগুলো বিনুনির মতো পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছে। ভিলাঙ্গানা হারিয়ে গেছে ঐ বিনুনি মধ্যে। প্রকৃতি সেজে রয়েছে অপরূপ সাজে। ক্যামেরা বন্দী করার ইচ্ছাটুকুও অবশিষ্ট নেই। প্রাণান্তকর চড়াই ভেঙে ৫ কিমি দূরের নালহান গ্রামে পৌঁছলাম ১ টা ২৫ মিনিটে। কুলিরা জানাল আজকের মতো চড়াই শেষ। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়লো। প্রথম দিন কষ্ট হয় সবচেয়ে বেশি, শরীর অভ্যস্ত হয়ে পড়লে সয়ে যায়। 

ছোট্ট গ্রাম নালহান। গ্রামের মানুষের জীবিকা মূলত কৃষি। বাকি সময় কুলির কাজ করে। ধাপ কৃষিতে ধান, আলু, মটর চাষ করে। জমিগুলোতে সবুজের আভাস কম, সবে বীজ বুনেছে, বর্ষার জলের অপেক্ষা। 

নমস্তে বাবুজী, মিঠাই দিজিয়ে - একদল শিশু - কিশোর ঘিরে ধরলো। লাল লাল ফাটা ফাটা গাল হাসি মুখের বাচ্চাগুলোর দেহে অভাবের চিহ্ন স্পষ্ট। লজেন্স দিয়ে বিদায় জানালাম। 

দু’কিমি পরেই ছোট্ট গ্রাম লালা অতিক্রম করে এগিয়ে চললাম গাঙ্গীর উদ্দেশ্যে, ছোট্ট চড়াই - উতরাই ভেঙে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। কলকাতার দূষিত বাতাস থেকে সাময়িক মুক্তি। রোডোড্রেনড্রন, বার্চ, জুনিপার, উইলো, বুনো গোলাপ, নানা নাম না জানা গাছে ঢাকা পথ। শুকনো পাতার মধ্যে আপন পদ যুগলের অদ্ভূত সুর মূর্ছনা। বাতাসে ফুলের সুবাস, নাম না জানা পাখির কলতান কষ্ট লাঘব করছে। পরিশ্রান্ত শরীর টানতে টানতে নিয়ে চলেছি। 

সঙ্গী দলের হিসাব রক্ষক কাম ম্যানেজার প্রণব। শান্ত স্বভাবের প্রণব ছাড়া এই দল অসম্পূর্ণ। প্রতি নিয়ত প্রণবকে নিয়ে মজা করতে করতেই অনেকটা সময় কেটে যায়। প্রতিবার খাবার শেষ করে সবাই হাত বাড়িয়ে দেয়- হাজমোলা দাও। কাউকে নিরাশ করে না। খুঁটিনাটি নির্ভুল হিসাবের সাথে প্রাণীদের বহু তথ্য তুলে ধরে। যেমন, আজ একটা প্রাণীকে দেখলাম গিরগিটির মতো কিন্তু আকারে বড়, নাম বলল - হিমালয়ান ক্যালোটিস ভারসিকালার। অবশেষে গাঙ্গী গ্রামের দেখা পেলাম। সময় ৩ টে ১৫ মিনিট। বেশ বর্ধিষ্ণু গ্রাম, কারুকাজ করা দরজা - জানালা। গ্রামের শেষ প্রান্তে সবুজ পাহাড়ের কোলে অবস্থিত গাড়োয়াল মণ্ডল নিগমের বাংলোতে নিলাম রাতের আশ্রয়। রাঁধুনী কীর্তনের হাতের অপূর্ব রান্না খেয়ে আশ্রয় নিলাম গরম লেপের (খুব গন্ধ L) তলায়।



ষষ্ট দিন/ ১লা জুন

"Good morning everybody, চায়ে লিজিয়ে"-কীর্তনের অভিবাদন আর চমৎকার চায়ের স্বাদে শুরু হলো সকাল। উওর -পূর্ব কোণে তুষারমৌলি শৃঙ্গ দৃশ্যমান। ভাবছি এই শৃঙ্গগুলির কী কোনও নাম আছে? এই সময় উপস্থিত হলো গ্রামের যুবক ভীম বাহাদুর। জিজ্ঞেস করায় বলল, বালা ও সহস্রতালের নিকটবর্তী শৃঙ্গ। জনপ্রিয় পথ হলো এই সহস্রতাল। বাহাদুরের কাছে জানতে পারলাম সে বছরের বেশি ভাগ সময় থাকে খাটলিং- চৌকি অঞ্চলে। মেষ পালক।

রুটি -সব্জি ও সেদ্ধ ডিম সহযোগে প্রাতরাশ সেরে সকাল ৭-৩০ বেরিয়ে পড়লাম বিরোধা গ্রামের উদ্দেশ্য। দূরত্ব ১১ কিমি। আজ তুলনামূলক সহজ পথ, উচ্চতা ২৫০০ ফিট বৃদ্ধি পেলেও তা হবে ধীরে ধীরে। গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে দ্রুত গতিতে সবাই পা চালালাম।

দু ঘন্টায় পৌঁছে গেলাম ৫ কিমি দূরের দেওক্ষী গ্রামে। ছোট্টছোট্ট শিশুগুলির দুহাত ভরে লজেন্স দিতে পারায় ভোরে গেল মন। অনাবিল হাসি সবার মুখে। মনে পড়ে গেল সন্তানের মুখ, বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো -"বাবা,বাবা "-শেষ বার যখন হয়েছিল এই শব্দটি দুবার বলতে পেরেছে। অপত্য স্নেহ বড় সাংঘাতিক বেদনার। প্রতিদিন রাতে মাকে ছেড়ে বাবার হাতকে বালিশ না করলে ঘুম আসে না।

গ্রামের শেষপ্রান্তে দেখি সমস্ত কুলি ও আমার কিছু বন্ধু অপেক্ষা করছে। কী ব্যাপার? "সাব মাটন চাহিয়ে"- এগিয়ে এসে বলল রতন সিং। "দেখো সাব, হিরণ"। দেখলাম সত্যিই মরা একটি হরিণ রাখা আছে পাথরের উপর। বৈশাখী দেবী নামের দেওক্ষী গ্রামের বয়স্ক মহিলা কুড়িয়ে এনেছেন। ১৫ কেজি ওজনের মৃত হরিণ খাওয়ার অভিপ্রায় আমার নেই। সবাইকে হতাশ করে সামনে এগিয়ে যেতে বললাম। 800 টাকায় গোটা হরিণ ফেলে আসার গঞ্জনা সহ্য করতে হলো।

মন মাতানো সবুজ শোভা আর ভিলাঙ্গানার গর্জন শুনতে শুনতে এগিয়ে চললাম। বৃক্ষরাজির মধ্যে দিয়ে থলাইসাগরের লুকোচুরি খেলা চলছে, কখনও আড়ালে কখনও দৃশ্যমান। পৌঁছে গেলাম বিস্তৃত সবুজ গালিচার বুগিয়াল কল্যাণী। অসংখ্য ভেড়ার পাল, পশু চারণভূমিতে ইতিউতি বিরাজমান। পরিচয় হলো দিল্লি থেকে আসা দলের সদস্য বাঁকুড়ার সুভাষের সঙ্গে। কয়েকজন বিদেশীদের সাথে খাটলিং অঞ্চলে হিমবাহের উপর কাজ করছে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করে বিদায় জানালাম। 

সামান্য চড়াই - উতরাই পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম আজকের গন্তব্য স্থল বিরোধা। সময় দুপুর ১-৩০। খরসু, বিছুটি গাছের জঙ্গলের মধ্যে আজকের তাঁবু পাতা হলো। কাঁটা আর বিছুটির যন্ত্রণা সহ্য করে রাত ৮টায় আহার পর্ব শেষ হলো। শোয়ার পর গৌরবকে অনুরোধ করলাম গান শোনাবার। 

গৌরব দলের সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। চাকরি করছে IOC তে। আমাদের সাথে এসেছে পাহাড়ের নেশায়। মাত্র ২৫ বছরের তরতাজা যুবক। সবার প্রিয়।



সপ্তম দিন/ ২রা জুন 

গতকাল রাতে গৌরবের গান আর ভিলাঙ্গানার কলকল জলোচ্ছ্বাস শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আজ সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেল সেই ভিলাঙ্গানার গর্জনে। গতকালের পরিকল্পনা অনুযায়ী সকাল ৭-৩০ টায় হাঁটা শুরু করার কথা, রাতে বৃষ্টির কারণে ভিজে টেন্ট শুকিয়ে শুরু করলাম ৮ টা ২০ মিনিট। আজ দীর্ঘ ১৩ কিমি পথ অতিক্রম করে পৌঁছাতে হবে তাম্বাকুণ্ড।

জয় কেদারনাথ ধ্বনি - দিয়ে দ্রুত পায়ে শুরু করলাম। সামান্য চড়াই ভেঙে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চললাম। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলতে চলতে উত্তরাখণ্ডের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কথা মনে পড়ে গেল। প্রায় তিন হাজার হেক্টর বনভূমি ধ্বংস হয়ে গেছে। বনভূমির নীচে প্রায় ছয় ইঞ্চি শুকনো পাতার আস্তরণ। সহজেই অনুমেয় আগুন লাগলে কী হতে পারে। পাতার কারণে পথের চিহ্ন প্রায় নেই, গাইডকে অনুসরণ করে এগিয়ে চলি। বারংবার গাইডকে প্রশ্ন, খারসোলি আর কতদূর? 

অবশেষে ১১ টা ৩০ মিনিটে পৌঁছলাম খারসোলিতে। খারসোলি ঝোরা পেরিয়ে অপর পারে যেতে হবে! যথেষ্ট খরস্রোতা। রাজেশ - wait কর !! ...বলতে বলতেই জুতো পরা পা ভিজিয়ে উল্টাতে উল্টাতে ওপারে পৌঁছাল। বাকিরা গাইড ও কুলির সাহায্য নিয়ে জুতো খুলে খারসোলি ঝোরা পেরিয়ে এলাম খারসোলি বুগিয়ালে। কীর্তনের বয়ে আনা খাবারে দুপুরের খাওয়া সারলাম। ১২ টা ১৫ মিনিটে হাঁটা শুরু করলাম তাম্বাকুণ্ডের উদ্দেশ্যে।

ধ্বসে যাওয়া পথ ও চড়াই আমাদের গতিকে শ্লথ করে দিয়েছে। অনেক পথ এখনও বাকি। পাহাড়ের উপর কালো মেঘের চোখ রাঙানি। পৌঁছে গেলাম সুন্দর একটা বুগিয়ালে। গাইড নাম বলতে পারল না, ম্যাপে বলছে ভূমিকা। অসংখ্য ভেড়া ও ঘোড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে বুগিয়াল ছেড়ে এগিয়ে চললাম, এমন সময় দূর থেকে শিস্ দিয়ে গাইড দাঁড়াতে বলল। বলল মাটন পাওয়া যাবে, কম দামে পাওয়া যাবে।

সবার মুখ দেখে মনে হলো এ সুযোগ হারানো ঠিক হবে না। অগত্যা ব্যক্তিগতভাবে নিমরাজি থাকলেও সবার জন্য 2000 টাকা দিয়ে 13 কেজি মাংস কেনা হলো। সবাই খুব খুশি। এদিকে আকাশ কালো হয়ে আসছে। বলতে বলতেই বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি এসে গেল। ভয় ও উৎকন্ঠায় মন ভরে গেল। খাঁড়া সরু বৃষ্টি-সিক্ত পথে বাকী রাস্তা হাঁটা বিপজ্জনক, তাঁবু রেডি করা আরও মুশকিল। গাইডকে নিকটবর্তী বুগিয়াল ভেলবাগীতে থামার পরামর্শ দিয়ে এগিয়ে যেতে বললাম । 

বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে চলেছি। ৩টা ১৫ মিনিটে পৌঁছলাম ভেলবাগী। টেন্ট রেডি, আকাশ পরিষ্কার। কি অপূর্ব জায়গা, কোনও আফসোস হচ্ছে না এগিয়ে যেতে না পারার জন্য। ২০০ ফিট নীচে প্রবল গতির ভিলাঙ্গানা। অপর পারে পাহাড় থেকে নেমে আসা উচ্ছ্বল ঝরনা। প্রায় ৫০০ ফিট উপর থেকে ধাপে ধাপে লাফিয়ে নামছে।

"ভালু, ভালু"- গাইডের প্রবল চিৎকারে তাকিয়ে দেখি ঝরনার পাশ দিয়ে বিশাল আকারের একটি ভল্লুক অবলীলায় খাড়া পাহাড়ে চড়ছে। দ্রুত গতিতে ক্যামেরা বন্দী করলাম। ভগবানকে ধন্যবাদ জানাই ভেলবাগীতে আমাদের আটকে রাখার জন্য। ভাল্লুক চিড়িয়াখানাতে দেখেছি, প্রকৃতির কোলে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াতে দেখা সৌভাগ্যের ব্যাপার।

ঝরনাকে পেছনে রেখে রঙিন টেন্টর পাশে পোজ দিয়ে ছবি তুলেছে সুনীত। কাল বলেছিলাম -"তুই আজ আমার সাথে হাঁটবি। মাথা নেড়ে সায় দিয়েছিল। কয়েক ঘন্টা পর আর দেখতে পাইনি। সন্ধ্যায় জিজ্ঞেস করাতে বলল -তোমার সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করেও পারলাম না, তোমার দুই স্টেপ আমার তিন স্টেপের সমান।

সুনীত ইতিহাসের শিক্ষক, দলের সবচেয়ে নির্ভরশীল ট্রেকার। দলের পিছিয়ে পড়া ট্রেকারদের গন্তব্য স্থলে নিয়ে আসার দায়িত্ব পালন করে। দলের সদস্যরা "শেরপা" নামে ডাকে। ছোট্ট চেহারার মানুষটির নানা ধরনের খাবারে এলার্জি থাকা সত্ত্বেও নির্বিকার মুখে যা পায় তাই খায়।



অষ্টম দিন/ ৩রা জুন 

আজ ভাল্লুকের রাজ্য ভেলবাগী থেকে ৪টা ২০ মিনিটে যাত্রা শুরু করলাম তাম্বাকুণ্ডের উদ্দেশ্যে। ১০২০০ ফিট উচ্চতা থেকে খাড়া পথ বেয়ে ২ ঘন্টায় ১১০০০ ফিট উচ্চতায় তাম্বাকুণ্ডে এসে পৌঁছলাম। অরণ্যসঙ্কুল ও খাড়া পাথুরে এই পথ গতকাল অতিক্রম করতে হলে শেষ বিকেলে অশেষ কষ্টের সম্মুখীন হতে হতো। তাম্বাকুণ্ডে তাঁবু ফেলার জায়গাও সমীত, পাথরের এক অভারহ্যাংয়ের কাছে রান্না করার জায়গাটা চমৎকার। বৃক্ষরাজির সংখ্যা ক্রমশ বিলীয়মান, উচ্চতা বৃদ্ধির সাথে সাথে গাছের দৈহিক আকৃতি ক্রমাগত খর্ব হয়ে চলেছে।

সাময়িক বিরতি নিয়ে এগিয়ে চললাম চৌকির উদ্দেশ্যে। কাঁটা ঝোপঝাড় ভেঙে এগিয়ে চলি। নিজের বুকের শব্দ শুনতে পাই। এবার নীচে নেমে ভিলাঙ্গানা অতিক্রম করে অপর পারে যেতে হবে, গাইড দুজনকে সঙ্গে নিয়ে নীচে নেমে গেল স্নো ব্রিজের কাছে। কিছু সময় পরে দ্রুত পায়ে গাইড উপরে উঠে এল। কী ব্যাপার? হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছে বলল -"সাব লকড়ি কা ব্রীজ ব্যাহে গ্যেয়া, আগে সে চলনা পড়েগা"

সবার মুখ শুকিয়ে গেল। প্রায় চার কিলোমিটার পথ অতিরিক্ত চলতে হবে। চড়াই ভেঙে চলেছি আর চলেছি। গাইডের ইশারায় নীচে দেখলাম কাঠের ব্রিজ। পথ নেই, ৭০ ডিগ্রি ঢালে ঝুরো পাথরের মধ্যে পিঠে ১৫ কেজি ওজনের বোঝা নিয়ে একবার পিছলে গেলে!! সাবধানে ছোট ছোট গাছগুলোকে আশ্রয় করে নড়বড়ে পায়ে সবাই নীচে নেমে এলাম। গাইড ও কুলিরা রোপ ফিক্সড করে বসে আছে। রুদ্রমূর্তির ভিলাঙ্গানার উপর দুটো সরু গাছ ফেলা আছে। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে সাক্ষাৎ মৃত্যুর পরোয়ানা তীব্র গতির ভিলাঙ্গানা। কোমরে ডিসেন্ডার বেঁধে একে একে সবাই পেরিয়ে এলাম।

এসে গিয়েছি ফুলের রাজ্যে, ছোট ছোট গাছে জুনিপার, রোডোড্রেনড্রন ফুল ফুটে রয়েছে। শরীরটাকে কোনওক্রমে বয়ে নিয়ে চলেছি, আর একটু। এসে পড়লাম দ্বিতীয় নদী দুধগঙ্গার কাছে। জলের পরিমাণ ও তোড় দেখে গাইড বলল এখন নদী পেরনো সম্ভব নয়। দুর্বার গতিতে বহমান দুধগঙ্গা। এপারেই কোনও স্থানে ক্যাম্পিং করতে হবে। আরও এক ঘন্টার প্রচেষ্টায় চৌকির উল্টোদিকে পাতা হলো তাঁবু।

ভয়ঙ্কর সুন্দর জায়গাটি, চারিদিকে সুবিশাল, তীক্ষ্ণ ঢালযুক্ত পর্বতগুলির মাঝে ছোট একটু জায়গা। মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে অবস্থান করছে এই চৌকি।

চৌকির একদিক থেকে বয়ে আসা ভিলাঙ্গানা, অন্যপাশে দুধবামক হিমবাহ থেকে নেমে আসা উচ্ছ্বল দুধগঙ্গা। সামনে বাঁ দিকে(উত্তরে) দেখা যাচ্ছে খাটলিং হিমবাহ। থলাইসাগর ও ফাটিং পিতয়ার শৃঙ্গ। আমাদের যাত্রার সমাপ্তি ঘটলো বিকাল ৩টা ৪৫ মিনিটে।

ক্লান্ত শরীরে অপেক্ষা রাতের খাবারের। হঠাৎ স্বরূপের চিৎকার - "তোমরা বাইরে এসো"!! আমরা ধড়মড়িয়ে বাইরে এলাম। দেখলাম একটা জন্তু দৌড়ে পালাচ্ছে। টর্চের আলোতে চোখ জ্বলজ্বল করছে, গাইড ও কুলিরা সবাই দৌড়ে এলো। কী ছিল জন্তুটা? প্রশ্ন করতে উত্তর মিলল -"লমড়ি সাব"।

চাঁদের পাহাড়ে শঙ্করকে কোয়োটরা ঘিরে ধরে ছিল।

খাবারের লোভে এরা দল বেঁধে আক্রমণ করতে পারে, টর্চের আলোতে এদের জলন্ত চোখ ভয়ের সৃষ্টি করেছে। একটা নয় একাধিক লমড়ি দেখা যাচ্ছে। আমার ব্যক্তিগত মতামত অবশ্য বড়ো আকারে শিয়াল। যাই হোক, সবাইকে সাবধানে থাকতে বলে রাতে তাঁবুর বাইরে আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করা হলো। এই পাথর -বরফের রাজ্যেও বন্য প্রাণী???? 



নবম দিন/ ৪ঠা জুন

আজ আমাদের বিশ্রামের দিন ছিল। উচ্চতার সাথে শরীর খাপ খাইয়ে নেওয়া খুব জরুরী। পরবর্তী রাস্তার দূরত্ব ও উচ্চতার কথা ভেবে কিছুটা এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গতকাল বিকেলের ঢেকে থাকা তুষারমৌলি শৃঙ্গ এখন দৃশ্যমান। গাইডের তাড়া সত্ত্বেও আমরা ৪ টা ৪৫ মিনিটের আগে যাত্রা শুরু করতে পারলাম না। শুরুতেই প্রবল গতির বহমান দুধগঙ্গাকে দড়ির সাহায্য নিয়ে পেরিয়ে এলাম। সকালে নদীতে জলের পরিমাণ ও তোড় দুটোই তুলনামূলক কম থাকে। বরফ গলা জলে হাঁটুর উপর পর্যন্ত অসাড় হয়ে গেল। পিঠে বোঝা নিয়ে সিঁড়ি মতো পথ বেয়ে চলেছি। যত উঠছি শৃঙ্গগুলি ততই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। পথের ক্লান্তি ঘুচিয়ে দিচ্ছে অনুপম প্রকৃতি। গাইড রঘুবীর বলল কয়েক দিন আগে যোগীন -১ শৃঙ্গ জয় করে এসেছে বাঙ্গালী অভিযাত্রী দলের সঙ্গে। বীরদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে যোগীন-১, একটু পেছনে যোগীন -৩। আরও পেছনে থলাইসাগর।

সবাই ধীর গতিতে পৌঁছলাম আজকের গন্তব্য কুণ্ডলী বা ছোট মশারতালে। উচ্চতা ১৪০০০ ফিট। ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডের পাশে ঝরনার জল পেয়ে সবার ভালো করে স্নান করার ইচ্ছে হলো। সবাই দৌড়ে গেলেও বরফ গলা জলের উষ্ণতা সবার ইচ্ছে শুষে নিল।



দশম দিন/ ৫ই জুন 

আজ আমাদের গন্তব্য মশারতাল। সকাল ৪টা ৩০ মিনিটে সব্জি ও রুটি খেয়ে- জয় বাবা কেদারনাথ- ধ্বনি দিতে দিতে বেরিয়ে পড়লাম। এক টানা চড়াই ভেঙে যত উপরে উঠছি সামনের শৃঙ্গগুলি আরও উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। একই ছবি বারবার ক্যামেরা বন্দী করছি। থলাইসাগর আস্তে আস্তে চোখের আড়ালে চলে গেল। এই থলাইসাগর শৃঙ্গ জয় করে রাতারাতি প্রচারের আলোয় এসে ছিল ছন্দা গায়েন। যোগীন শৃঙ্গগুলি যেন আরও বেশী করে অহংকার প্রকাশ করছে। এবার গঙ্গোত্রী শৃঙ্গগুলি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জাওনলি শৃঙ্গকে বিপুল মনে হচ্ছে। বাম দিকের খাড়া ঢালে ঝুলে রয়েছে দুধগঙ্গার জন্মদাতা দূধগঙ্গা বামক হিমবাহ।

"পাকড়াও, পাকড়ো"- হঠাৎ তাকিয়ে দেখি মুকেশ ও রতন সিং খাড়া ঢালে তীব্র গতিতে একটা পাখির পেছনে ছুটে চলেছে। পাখি লাফিয়ে লাফিয়ে ক্রমাগত উপরে চড়ছে, পেছনে লাঠি ও পাথর হাতে দুজন বিপজ্জনক ভাবে দৌড়ে চলেছে। মনে হচ্ছে দুটি বানর পাহাড়ে লাফিয়ে চড়ছে। পাখি তাড়া খেয়ে খাড়া ঢালে নেমে যাওয়ায় হতাশ হয়ে ফিরে এল। ফেজান্ট জাতীয় পাখি হবে। 

আমরা মশারতালের কাছাকাছি জায়গায় তাঁবু খাটালাম। সময় ১২ টা ১০ মিনিট। পোশাক পরিবর্তনের সুযোগ পেলাম না আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। শুরু হলো প্রবল তুষারপাত, সঙ্গী ঝোড়া হাওয়া। দমকা হাওয়ায় তাঁবু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, ভেতরে চারজন তাঁবুর রড ধরে বসে আছি, তুষারভারে তাঁবু ঝুলে পড়েছে। ভেতর থেকে আইস্ এক্স দিয়ে বরফ ফেলার চেষ্টা করছি। ভয় হচ্ছে টেন্ট না উড়িয়ে নিয়ে যায়। মনে মনে প্রার্থনা করছি থেমে যাক এই তুষারঝড়। অবশেষে ৫ টা ৪০ মিনিট নাগাদ ঝড় থামলো। প্রবল ঠাণ্ডায় হাত পা জমে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে নিই, প্রার্থনা করতে লাগলাম আগামীকালের আবহাওয়া যেন ভালো থাকে। কাল আবহাওয়া ভালো থাকা খুব জরুরী। বিপজ্জনক ১৭০০০ ফিটের বেশি উচ্চতার খাড়া গিরিবর্ত অতিক্রম করতে হবে। সকাল ৬টার মধ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হবে। তারও আগে ৫ টা ৩০ মিনিটের মধ্যে মশারতালে পুজো দিতে যেতে হবে। ঠিক হলো প্রাতরাশের পূর্বে আমি আর আর স্বরূপ রঘুবীরের সাথে যাব। কীর্তন জানালো ভোর ৪ টা ৩০ মিনিটে চা দেবে।



একাদশ দিন/ ৬ই জুন 

"চায়ে, চায়ে, বিধানজী উঠিয়ে"- কীর্তনের ডাক শুনে ঘুম ভেঙে গেল। টর্চের আলোয় ঘড়ি দেখলাম ঠিক ৪ টা ৩০ মিনিট। ঠাণ্ডায় স্লিপিং ব্যাগের ভেতর থেকে শরীর বেরতে চাইছে না। মনের ক্লান্তি দূর করে উঠে বসলাম । সারা রাত্রি চাপা টেনশন, উচ্চতা জনিত কারণে ভালো ঘুম হয়নি। আকাশ একদম পরিষ্কার। চটপট প্রস্তুত হয়ে স্বরূপকে সঙ্গে নিয়ে রঘুবীরের সঙ্গী হলাম। মাত্র ১৫ মিনিটের পথ, অক্সিজেনের অভাবে হাঁপিয়ে উঠছি। বরফ ও বোল্ডার পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছে গেলাম অনিন্দ্য সুন্দর লেক "মশারতালে"। চারিদিকে উঁচু পাহাড়ের মাঝে অর্ধেক জমে থাকা চক্ষু আকৃতির লেকটি। রঘুবীর ভক্তি ভরে পূজো করে চলেছে আর আমারা ছবি তোলাতে ব্যস্ত। রঘুবীরের মৃদু ধমকে প্রার্থনায় বসলাম। পুজো সাঙ্গ করে ফিরে এলাম। প্রাতরাশ সেরে ৬ টা ১৫ মিনিটে শুরু হলো যাত্রা। মশারতাল থেকে ১০০০ ফিট উচ্চতা খাড়া পৌঁছে গেছে মাশার টপে। রঘুবীরের কেটে দেওয়া বরফের স্টেপে সাবধানে পা ফেলে উঠে চলেছি। বারংবার পিছলে যাচ্ছে পা, দু ঘন্টার কষ্টসাধ্য চেষ্টায় পৌঁছে গেলাম মাশার টপে। উচ্চতা ১৬০০০ ফিটের বেশি। চারিদিকে অগুন্তি তুষারাবৃত শৃঙ্গরাজি। বিশ্রাম ও ফোটো সেশনের পর এগিয়ে চললাম অভীষ্ট মাওয়ালি গিরিবর্তের দিকে।

গতকাল রঘুবীর রাওয়াতকে সঙ্গে নিয়ে প্রবল তুষারপাত উপেক্ষা করে রাস্তা পর্যবেক্ষণ করতে বেরিয়ে ছিল। ফিরতে পারেনি, পাথরের আড়ালে থেকে তুষারঝড়ের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করেছে। যত দূর চোখ যায় শুধুই বরফের হাতছানি। চলতে চলতে রঘুবীর হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো গভীর খাদের কিনারে। আমি পা চালিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম -"কোই তকলিফ্"? রঘুবীর যা বলল, শেষ বার যে রাস্তায় এসেছিল সেই রাস্তায় অসংখ্য ফাটল অর্থাৎ ক্রিভাসপূর্ণ। অতয়েব বিকল্প পথের অনুসন্ধান। খাড়া ধ্বংস যুক্ত পাথুরে ঢাল ধরে এগিয়ে চলার নির্দেশ দিল। এই ভাবে এক ঘন্টার প্রচেষ্টায় পৌঁছে গেলাম মাওয়ালির পাদদেশে। কচ্ছপের পিঠের অংশ পেরিয়ে শুরু হবে মাওয়ালি গিরিপথের খাড়া চড়াই।

একে একে পায়ে পরে নিলাম গেইটার। রঘুবীর, কীর্তন, রাওয়াত দ্রুততার সাথে সবাইকে দড়ি দিয়ে বেঁধে বেঁধে নিল। ১৫০ ফিটের দড়িতে প্রথমে রঘুবীর এবং শেষ কীর্তন। মাঝে আমরা। প্রাথমিক পরামর্শ দিয়ে শুরু হলো দড়ি বাঁধা অবস্থায় হাঁটা। ২০-২৫ পা হাঁটছি আবার দাঁড়িয়ে পড়ছি।

হঠাৎ করে চারিদিক সাদা মেঘে ঢেকে গেল। একে বলে White Out। ১৫ ফিট দূরের সুনীতকে ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। ফেলে যাওয়া পায়ের ছাপ দেখে পা মেলাচ্ছি। আগে তবুও অনুমান করতে পারছিলাম কতদূর এসেছি!! পায়ের নিচে মৃত্যু ফাঁদ, ক্রিভাস। প্রকৃতি বিরূপ, ভয়ঙ্কর তুষারপাতের আশঙ্কা। প্রাণপণে হেঁটেই চলেছি। দুর্বল, ধীর গতির সমীরণদাও চলেছে নিরলসভাবে। বাতাসে অক্সিজেনের অভাব, জল খেতে অবধি পারছি না। হৃৎপিণ্ড ফেটে যেতে চাইছে, গলা শুকিয়ে কাঠ। রঘুবীর বলে চলেছে--"থোড়াসা বাকি, চলিয়ে চলিয়ে, রুকিয়ে গা মত্"। মনের সমস্ত বল, জেদ এক করে অবশেষে পৌঁছে গেলাম আমাদের বহু আকাঙ্ক্ষিত "মাওয়ালি গিরিবর্তে।"

সবাই আনন্দে আত্মহারা, আনন্দাশ্রু চোখে দিয়ে বয়ে চলেছে। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে শুরু হলো শুভেচ্ছা বিনিময়। আকাশ পরিষ্কার। রঘুবীর শুরু করল পুজো। পুজোর প্রসাদ ও চকলেট খেয়ে উদযাপন করলাম আমাদের সাফল্য। স্মৃতি হিসাবে ক্যামেরা বন্দী হলো অসংখ্য ছবি।



দ্বাদশ দিন/ ৭ই জুন 

গতকাল পাস অতিক্রম করার আনন্দ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। গাইড রাঘুবীরের তাড়ায় ১১ টা ৩০ মিনিট নাগাদ হাঁটতে শুরু করি। প্রথম ঘণ্টায় পিচ্ছিল বরফে আছাড় খেতে খেতে পৌঁছে গিয়েছিলাম পুঁইয়াতালে। ছোটো একটা সরোবর। বরফের রাজ্য শেষে শুরু হয়েছিল বোল্ডারের রাজত্ব, সঙ্গে হাঁটু ভাঙ্গা উৎরাই। দীর্ঘ এবড়ো খেবড়ো পথ আর পরিশ্রান্ত শরীর টানতে টানতে ৩ টা ২০ মিনিট অর্থাৎ সাড়ে ৯ ঘণ্টার যাত্রা শেষ হয়েছিল বাসুকিতালের ৩০০ মিটার আগে।

আজ আমাদের ট্রেকিং এর শেষ দিন, যদিও কেদারনাথ থেকে ১৬ কিমি হেঁটেই ফিরতে হবে। প্রচলিত বাঁধানো পথ বলে আমাদের কাছে গুরুত্ব কম। সকাল থেকেই নানা ভাবনা মনের মধ্যে ভীড় করছে। অনেক দিন হয়ে গেল বাড়ির সাথে যোগাযোগ হয়নি। কেদারনাথ এ মোবাইল নেটওয়ার্ক আছে। কেমন দেখতে হয়েছে বর্তমান কেদারনাথ?? আজকের আবহাওয়ার পূর্বাভাসও ভালো নয়। গতকাল রাতের তুষারপাতের কারণে তাঁবু এখনও ভিজে, অপেক্ষা সূর্যের আলোর। মেঘলা আকাশে সূর্যের খোঁজ না করে ভেজা তাঁবু গুঁটিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ১৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম বাসুকিতালে। কাঁচের মতো স্বচ্ছ জল। বেশ বড়ো লেকটি। শিবের ত্রিশূল আর নুড়ি-পাথরে সিঁদুরের ছোপ দেখে বুঝলাম, এখানেও মহাদেবর আরাধনা হয়। মালবাহকদের কাছে জানতে পারলাম, কিছু উৎসাহী পুণ্যলোভী মানুষ কেদারনাথ থেকে এখানে আসে পুজো দিতে। অবশ্যই এই সময় নয়। সরোবর প্রান্ত থেকে একটি পথ সোজা উঠে গেছে বাসুকি টপের দিকে। কিছুক্ষণ পরেই বাঁধানো পথ হারিয়ে গেল বরফ তলায়। সঙ্গে সংযোজিত হলো ঝিরিঝিরি তুষারপাত। এ পথের সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যপট রয়েছে এই বাসুকি টপে।এই অঞ্চলের সমস্ত শৃঙ্গরাজি পটে আঁকা ছবির মতোই দৃশ্যমান হয়। মেঘলা আকাশে কিছুই দৃষ্টিগোচর হবে না।

বরফের গভীরতা ও তুষারপাতের তীব্রতা বেড়েই চলেছে। ৯৫ কেজি ওজনের স্বরূপ সামনে চলেছে। দেহভারে কখনও কখনও কোমর পর্যন্ত বরফে ডুবে যাচ্ছে। রাগে, কষ্টে মাঝে মাঝে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। ওর তৈরি করা চৌবাচ্চাগুলিতে সন্তর্পনে পা ফেলে এগিয়ে চলেছি। কীর্তনের সহযোগিতা ও তৎপরতায় ১১ টা ১৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম বাসুকি টপে। একে একে সবাই চলে এলো। ঝিরিঝিরি তুষারপাতের মধ্যে কয়েক মিনিট বিশ্রাম নিয়ে আবার চলা শুরু। ১৫ মিনিটে পৌঁছে গেলাম কেদার টপ এ। শৃঙ্গের মেলা দেখা যায় এখান থেকে- ভাতৃকুণ্ড, কীর্তিস্তম্ভ, কেদারনাথ, কেদারডোম, মহালয়া, চৌকাম্বা, প্রভৃতি। সারা পথের সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য এখান থেকেই মেলে। আমাদের দুর্ভাগ্য, প্রকৃতি বিরূপ।

ঘন্টা ধ্বনি না? মালবাহক বাহাদুর বলল, মন্দিরের ঘন্টা ধ্বনি। "থোড়া আগে চলিয়ে সাব, মন্দির দেখাই দেগা"। বুকের মধ্যে উত্তেজনা অনুভব করছি। ঘন্টার শব্দ ক্রমে বাড়ছে, বুকের মধ্যে প্রতিধ্বনি করছে। ১১ বছর বয়ে বেড়ানো অস্বস্তি আজ দূর করতেই হবে। ২০০৫ সালের মে মাস- দু বছরের শিশু পুত্র ও স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলাম এই পবিত্র ভূমে। গৌরীকুণ্ড থেকে হাঁটা শুরু করে শেষ পর্যন্ত পৌঁছেছিলাম ঘোড়ার পিঠে সওয়ারি হয়ে। কেমন আছে জমজমাট সেই কেদারনাথ? কেমন আছে ভারত সেবাশ্রম?

২০১৩ সালের ১৬ই জুন মন্দাকিনীর বুকে ভেসে যাওয়া কেদারনাথ কেমন আছে? সন্ধ্যাবেলা ভারত সেবাশ্রমের মহারাজকে প্রণাম করে বলেছিলাম- "কাল চোরাবালিতাল ট্রেক করতে যাব, স্থানীয় কোনও গাইড পাওয়া যাবে?" হাঁ হাঁ করে উঠে বারণ করেছিলেন-"রাস্তা ভাঙা, প্রচুর বরফ, বিপদজনক পথ। পরিবার নিয়ে এসেছ, এখানেই ঘুরে বেড়াও। কি দরকার ওখানে যাওয়ার?" নাছোড়বান্দা মনোভাব দেখে কয়েকটি জরুরী পরামর্শ দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন অহেতুক ঝুঁকি না নেওয়ার। গাইড না নিয়ে যাওয়া যাবে না। সেই মহারাজ হারিয়ে গেছেন মন্দাকিনীর প্লাবনে। স্থানীয় ঘোড়াওলার সাহায্য নিয়ে ৩.৫ কিমি দূরের স্বর্গীয় স্থানে পৌঁছে গিয়েছিলাম। অপরূপ হিমবাহ সৃষ্ট লেক চোরাবালিতাল। গান্ধীর চিতা ভস্ম বিসর্জন দেওয়ার পর থেকে এটি গান্ধী সরোবর নামে পরিচিত হয়েছে। মেঘ ভাঙা বৃষ্টি আর পাথরের প্লাবন নেমে এসেছিল কেদারনাথ এর বুকে। সরকারি হিসাবে প্রাণ গিয়েছিল ৬০০০ মানুষের, আহতের সংখ্যা অগুনিত। বেসরকারি মতে সংখ্যা অনেক বেশি। প্রকৃতির রুদ্ররোষ শশ্মান করে দিয়েছিল কেদারধাম। অষ্টম শতাব্দীতে দুর্গম কেদার উপত্যকায় শঙ্করাচার্যের তৈরী স্বয়ংম্ভূ মন্দিরটি অক্ষত রয়েছে। শৈব শক্তি অক্ষত রেখেছে মন্দিরকে।

"বিধানদা দেখ মন্দির !" সুনীতের ডাকে ঘোর কেটে তাকিয়ে দেখলাম, মেঘের আড়াল সরে গিয়ে কেদারনাথ উন্মুক্ত। হাঁটার গতি আরও বেড়ে গেল। খাড়া ঢালে নেমে গেছে পথ। টেলিক্যামেরায় চোখ দিয়ে মন ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। এত পাথরের স্তূপ!! প্রবল স্রোতস্বিনী মন্দাকিনী আজ ক্ষীণ তটিনী। দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে মন্দিরের পাশ দিয়ে বহমান। মন্দিরের পেছনের অংশ আজ বোল্ডার ভূমিতে পরিণত। আবার ঢেকে দিলো মেঘ। ৪০০০ মিটার উঁচু কেদারটপ থেকে ক্রমাগত নেমেই চলেছি। হাঁটুর ব্যাথাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে চলেছি। ধসের কারণে মাঝে মাঝেই রাস্তা অদৃশ্য, টিপটিপ বৃষ্টি পিছল রাস্তায় গতি কমিয়ে দিচ্ছে। বারে বারে মনে হচ্ছে আর একটু নামলেই পৌঁছে যাব কেদারনাথ এ। দুধগঙ্গা, মধুগঙ্গা, স্বর্গ দুয়ারী, সরস্বতী, প্রভৃতি নদীর মিলনে মন্দাকিনীর সৃষ্টি। কত যে ঝরনা নেমে এসেছে মন্দাকিনীর বুকে তার হিসেব নেই। সাদা অন্ধকারে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি, হাতড়ে বেড়াচ্ছি পথ। ডানদিকের ঝোরা পেরিয়ে নেমে এলাম মন্দাকিনীর ডান তীরে। কিন্তু ওপারে যাব কি ভাবে?? ব্রীজ নেই, পাথর ডিঙ্গিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কয়েকটি বাড়ি দেখে এগিয়ে গেল স্বরূপ। পরপর বাড়িগুলিতে খোঁজ করে কারও দেখা পেলাম না। মনে হয় ’১৩ সালের পর থেকেই পরিত্যক্ত।

তাহলে উপায়!!! ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছি যদি কারও দেখা মেলে! গাইড ও পোর্টার ছাড়াই এগিয়ে আসার ফল। দূরে অপর পাড়ে নদীর কিনারে আসা এক ব্যক্তিকে দেখে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলাম কোন পথে যাব ওপারে। দূরত্ব আর নদীর জলের শব্দে শুনতে পেলনা বোধহয়। ইঙ্গিতে বোঝালাম কি চাইছি। সামনের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে এগিয়ে যেতে বলল। ১.৫ কিমি হেঁটে পৌঁছে গেলাম ভাঙা ব্রিজের কাছে। সাবধানে ব্রিজ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম কেদারধাম এ। দুই দিক থেকে বয়ে আসা মন্দাকিনীর উপর তৈরি হয়েছে সরস্বতী ব্রিজ। নীচে হরিদ্বারের মতো বাঁধানো ঘাটে পুণ্যার্থীরা মাথায় জল দিচ্ছে। ব্রিজের অপর পারে গড়বাল মণ্ডল বিকাশ নিগম তৈরি করেছে আধুনিক কটেজ, অসংখ্য অস্থায়ী সুইস টেন্ট। মাথাপিছু ২৫০ টাকার বিনিময়ে ঠাঁই হলো অস্থায়ী সুইস টেন্টে। আধুনিক বন্দোবস্তর জন্য টেন্টগুলি বেশ ভালো। কাকভেজা হয়ে একে একে সবাই পৌঁছে গেল। কেদার টপ থেকে আসতে সময় লাগল ৩ ঘন্টা। পেটের ভেতর ছুঁচোর ডন বৈঠক শুরু হয়ে গেছে। খেতে এলাম গড়বাল মণ্ডল বিকাশ নিগম এর ভোজনালয়ে। পরিচ্ছন্ন ভোজনালয় বেশ বড়ো, এখন প্রায় ফাঁকা।

বাড়িতে ফোন করলাম, জানালাম কেদারনাথ এ পৌঁছে গেছি, সবাই ভালো আছে। পরিবারের কাতর অনুনয় -"ওখানে না থাকাই ভালো। বড়ো বিপদের জায়গা"। আশ্বস্ত করলাম ভয়ের কিছু নেই। মন্দির বড়ো টানছে, আজই সাঙ্গ করব ১১ বছরের গ্লানি। ২০০৫ সালে এসেছিলাম কেদারনাথ এ, আশ্রয় নিয়েছিলাম মন্দাকিনীর তীরে ভারত সেবাশ্রমে। সকালে মন্দির দর্শনে গিয়ে কয়েক হাজার মানুষের দীর্ঘ লাইন শিব দর্শনের ইচ্ছেকে নিভিয়ে দিয়েছিল। পুণ্য অর্জনের জন্য ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড়ানোর ইচ্ছে হয়নি। ছোট ছেলে নিয়ে এতক্ষণ লাইনে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। এত কষ্ট করে এসেও সে বারে দ্বাদশ জ্যোতির্ময় লিঙ্গ দর্শন হয়নি।

স্বরূপ ও আমি পোশাক বদলে মন্দির দর্শনে বেরিয়ে পড়লাম। গুটি গুটি পায়ে মন্দির পৌঁছনোর পূর্বেই পুলিশের হাত থামিয়ে দিল আমাদের। পরিচয় পত্র চেকিং হচ্ছে। বর্তমানে চারধাম যাত্রীদের জন্য বায়োমেট্রিক পরিচয় পত্র আবশ্যিক হয়েছে। কী হবে আমাদের? পুলিশ কর্তাকে বললাম, আমরা মাওয়ালি পাস ট্রেকিং করে কেদারনাথ এ এসেছি। বন দপ্তরের অনুমতি পত্র রয়েছে। হাসি মুখে ছেড়ে দিল। বাঁধানো পথের দুপাশে দুমড়ানো মোচড়ানো বাড়ি গুলির কঙ্কাল ২০১৩ স্মৃতি বহন করছে। ভারত সেবাশ্রম সংঘের বিশাল বাড়িটির ভিতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে। প্লাবনের করাল গ্রাসে ভেসে গেছে বাকিটা।

পৌঁছে দেখলাম লোকজন বেশি নেই। পুজোর জন্য মন্দিরের গেট ২ ঘন্টা বন্ধ থাকবে। মন্দির কমিটির অফিসে সৌম্য দর্শন এক যুবা পাশের গেট দেখিয়ে বললো-"দর্শন করনা হ্যায়, অন্দর জাইয়ে, আভি পূজা চল রাহা হ্যায়।" অবিশ্বাসী মন কখনও কখনও কাকতলীয় ঘটনার ব্যাখ্যা করতে পারে না, চিরদিন গেঁথে থাকে মনের গভীরে। ত্রিকোনাকার গ্রানাইট পাথরের মূর্তি ছুঁয়ে প্রণাম করলাম। এতদিনের বাসনা পূর্ণ হলো। মন্দির চত্ত্বরের মাঝে হোমাগ্নি ঘিরে কিছু ভক্ত ও সন্ন্যাসী ওম গ্রহণ করছে। ভীড়ে থিক থিক করত এই মন্দির চত্ত্বর, মানুষ শূন্য এখন।

সন্ন্যাসীদের আখড়া দেখার অভিপ্রায়ে মন্দিরের পেছনে গেলাম, কিছুই নেই কেবল বোল্ডারের রাজত্ব। শঙ্করাচার্যের সমাধি ক্ষেত্রেটিও অবশিষ্ট নেই। মন্দিরের পেছনে বিপুল আকৃতির একটি গণ্ডশিলা দাঁড়িয়ে রয়েছে মন্দিরকে আড়াল করে। ভীমশিলা নামের বোল্ডারটি মন্দিরকে রোষের হাত রক্ষা করেছে। বর্তমান এই শিলা পূজিত হয়। কথিত আছে, পাণ্ডবরা এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করেন, সংস্কার করেন শঙ্করাচার্য। দেবাদিদেবের ধ্যানের উপযুক্ত স্থান বটে। হিমালয়ের নিভৃত কোলে সাধুদের উপাসনার স্থলের বড় অভাব।

মেঘের পর্দা সরিয়ে বিকালের অন্তিম আভা ছড়িয়ে দিয়েছে কেদার চূড়ায়। মেঘ আর আলোর খেলায় মোহময় হয়ে উঠেছে চারিদিক। হায় রে আধুনিক সভ্যতা!! কয়েক মিনিটও থাকতে দেবে না নিজের মতো করে, অনুভব করতে দেবে না ভালো লাগাকে। বিকট শব্দ দানব, ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে কেদারনাথ এর শান্ত পরিবেশ। উফঃ, উফঃ, কী অসহনীয় এই শব্দ!! উত্তরাখণ্ড সরকার কেন ব্যবস্থা করেছে এই উড়ানের?? ৩ কিমি আগে শেষ করলে হয় না!! এতক্ষণের ভালোলাগার অনুভূতিগুলি বিরক্তিতে বদলে যাচ্ছে। সরকার কেদার যাত্রীদের সুবিধার্থে হেলিকপ্টার সার্ভিস চালু করেছে। প্রতি ১০ মিনিট অন্তর উড়ানের শব্দে কান ফেটে যাচ্ছে। সঙ্গে কেদার পুনর্গঠন এর কাজে ব্যবহৃত গাইতি, কোদাল, স্টোন ক্রাশার ইঞ্জিনের শব্দ মিলে মিশে ভয়াবহ অবস্থা। তোমরা সবাই একটু চুপ করবে??? আশুতোষ ধ্যান করবেন। জাগিয়ে দিও না, জাগিয়ে দিও না, জেগে উঠলে শুরু করে দেবেন তাণ্ডব নৃত্য। ধ্বংস করে দেবেন সব কিছু।




0

পথে প্রান্তরে - শ্রাবণী দাশগুপ্ত

Posted in


পথে প্রান্তরে



সুহানী মন্দারমনি 
শ্রাবণী দাশগুপ্ত



দুপুর দুটো পনেরোয় কাণ্ডারী এক্সপ্রেসে হাওড়া থেকে দীঘা ফ্ল্যাগ স্টেশন। মাঝে কাঁথি, এখনও সেই কন্টাই লেখা – ছোট্টো এক টুকরো থামা এক মিনিটের জন্যে। দিনে চারবার যাতায়াত করা ভারতীয় ট্রেন সময়ে পৌঁছাল দেখে ভয়ানক অবাক হলাম। পাঁচটা দশেই সাঁঝের আভাস। স্টেশন চত্বর ছাড়িয়ে রাস্তাটা হাইওয়ে হলেও, চওড়া নয়। কালীপুজোর দিন, এদিক ওদিক দুচারখানা ছোটো প্যাণ্ডেল আলোয় সাজানো। বাজী পুড়ছে, পয়সা নয়। উদ্দণ্ড অসভ্যতা নেই। ভালো লাগছিল। দুধারে ম্যানিকিওর না করা সহজ সবুজ। অন্ধকার চেপে এসে অস্পষ্ট ও ছায়াময়। গায়ে গায়ে খুপরি দোকান, আলো টিমটিম। আধখেঁচড়া ইঁটের বাড়ি। গাড়ি যতো এগোয়, সড়ক শীর্ণ, এক আধটা গাড়ি, ট্রেকার, ভুটভুটি, মন্দারমনি-কাঁথি বা দীঘা-কাঁথি বাস। আরও কয়েকটা আঞ্চলিক নাম লেখা (শুনিনি আমি)। বেঁকে টেরে চলেছে পাশ কাটিয়ে, যেন বনপথ ধরে চলেছি। প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট চলার পরে, সঙ্কীর্ণ কাঁচা রাস্তা – দুধারে জলা, লম্বা ঘাস। ওই ঘোর আঁধারে গা-শিরশিরে ভৌতিক অনুভূতিতে বিভোর হয়ে, আধঘন্টা আরও। তারপরে গুটিকয় হোটেল, আলো জ্বলে না। চালক বলেন, ওধারে লাইট নেই কোথাও। বড়ো হোটেলরা জেনারেটর চালিয়ে নিজেরা বন্দোবস্ত করেছে। নজরে এলো ‘সান সিটি’ লেখা সাইনবোর্ড’, ছোটো করে লেখা ‘রোজ ভ্যালি’। বিঘে বিঘে জমির ওপরে বিলাসবহুল সৈকতাবাস। এখন প্রায় জনশূন্য। পাঁচিলের আড়ালে ওয়াটার পার্ক থেকে রোপওয়ে, সব বন্ধ। গৌরী সেনের দল বিপাকে পড়েছেন যে! আলো জ্বলছিল অবশ্য। উজ্জ্বলতার পাশে বাকি অন্ধকার আরও গাঢ়।

প্রতিটা অতিথি আবাস সৈকতের ওপরে। মূল দরজার বাইরে পা ফেলতেই বালি, পরের সকালে দেখলাম। অমাবস্যা রাতের মোটা চাদর, তাই দেখতে পাই নি। সৈকতাবাসের আলোয় যতটুকু দৃশ্যমান ছিল, ব্যাস। কারণ বুঝলাম না ঠিক, শুনলাম সরকারের সহৃদয় আনুকূল্য মন্দারমনির ভাগ্যে জোটে নি এপর্যন্ত। তাই এ আঁধারে...। তা হোক, তবু বেশ লাগছিল। চটকহীন প্রকৃতির অবিকল রূপ দেখে ‘দিঠি জুড়ন গেলা’। বাইরে বসি। অবিরল ঢেউ গড়িয়ে আসার চেনা শব্দ কান ভরে। রিসর্টের গেটের বাইরে চারচালা দোকান। চটচটে শক্ত বেলাভূমির ওপর দিয়ে দৌড়চ্ছে গাড়ী, ট্রেকার, স্কুটার। তাদের আলো যতটুকু ও যতক্ষণ – ছুমন্তরে কিঞ্চিৎ দৃশ্য। আমরাও ওভাবে এসে পৌঁছেছি। জল এগিয়ে পায়ের পাতা ছোঁয় ছোঁয়। গোরু একপাল এদিক ওদিক ভূমিশয্যায়। জানি না কেন ওরা থাকে ওভাবে। 

ভেবেছিলাম সূর্যোদয় দেখব, ঘর ছেড়ে কোথাও বেড়াতে গেলেই যেমন ঘন বাসনা জাগে। অথচ ক্লান্তি মেটানো আরামের ঘুম চোখ ছেড়ে যেতে চায় না বড়ো। তাই একটু দেরিতেই, প্রায় সাতটা বাজে তখন। সূর্য আমাদের প্রস্তুতির জন্যে ‘গ্রেস টাইম’ দেয় নি। তবু জুড়িয়ে গেল চোখ। ঢেউয়ের খেলা খেলছে সমুদ্দুর, যেমন আবহমান খেলে থাকে। অযথা আসা যাওয়া, ছুঁয়ে দিতে চাওয়া। সে তো এক রকম। কিন্তু এই সৈকত! কত দূর অবধি মাটির আঁচল বিছিয়ে। তাতে সোনারঙ রোদ্দুরের নিভৃত আরাম। শুধু তাকিয়ে থাকা, তাকিয়ে দেখা। দুহাত আকাশে ছুঁড়ে উদার হওয়া, আর কিছু নেই। পেছনে ঝাউসারি সবুজ পাড়ের সীমানা গেঁথে। আমরা তিনটি অবধূতের মতো ভালো লাগা মেখে ঢেউ ছুঁয়ে বাতাসের গলায় কথা বলি। 

‘‘কি, যাবেন না কি মোহনার দিকে?’’ এক মানুষ পাশ থেকে এসে দাঁড়ালেন ভুটভুটি নিয়ে। লুঙ্গি-পরা। বেশ পরিপাটি চুল। আন্তরিক, পরিশীলিত কথক, যেমন গ্রামীনরা হন। শহর থেকে ‘বেড়াতে আসা’দের ছোঁয়াচে আধুনিকতার লেপনটি যথার্থ হয়েছে, অনেকখানি জীবিকার তাগিদেও। সেই ভোরে উনিই প্রথম – আর্লি বার্ড। ভাড়া ঠিক করে ওঠা গেল। গজগমনের মতো পা দোলাতে দোলাতে চলেছি। গমগমে সমুদ্দুর বাঁদিকে। অন্যদিকে অসামান্য বিস্তার নির্জনতার, সেইটেই আমাকে বেশি টানছিল। বালির ওপরে সূক্ষ্ম দানার আলপনা বালি দিয়েই, কাঁকড়া আর ঝিনুকের দেহনিসৃত। মানুষটি দেখালেন হাত ছুঁড়ে – ‘‘ওই যে দেখুন লাল কাঁকড়া।’’ আমরা নেমেছি যান থেকে। ছুটোছুটি করে হামলে পড়েছি, ‘‘ও মা! ও মা! তাই না কি? কই কই?’’ আমাদের অভিজ্ঞতায় বিশ্বের দ্বাদশ আশ্চর্য... ক্যামেরা রেডিই – এ্যাকশন, শুট্‌! ধরি ধরি মনে করি ধরতে গেলেম... ওরা মোটেই পোজ দিলে না। অসংখ্য পালাচ্ছে দৌড়াচ্ছে দেখছি অদূর থেকে। কাছে যেতে না যেতেই নিমিষে গুহাবাসী। আমাদের পরিচালক নিজের কথা শোনাচ্ছেন মনোরম টোনে... পয়সাকড়ি বেশ আছে ওঁর, জমিজমা কাছে, গ্রামে। দুই মেয়ের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়েছেন, ওঁদের গ্রাম্য মুসলমান সমাজের রীতি দস্তুর। ছেলেরা পড়ছে। শুনছি আলাপন। আমরা শহরবাসী গুটিয়ে থাকি, এক হই না, আত্মীয় হই না। শুনি, ভালো লাগে, নিজেদের ভাঙি না। 

দূর সবুজের প্রান্ত থেকে বালিতে পায়ের ছাপ রেখে একটি অপু আসছে ছুটে... হাতে-ধরা লাল কাঁকড়া, আমাদের দেখাবে। সামনে এসে তুলে ধরে, ‘‘কিচ্ছু করে না, দেখো দেখো।’’ আমরা বোকা বোকা বিস্ময়ে মূক! 

কী দারুণ। দাঁড়া ছবি তুলি এবারে, একটাকে তো পাওয়া গেল। কাঁকড়া ছেড়ে দিয়েছে বালিতে, সেটি লজ্জায় আত্মহত্যার কথা ভাবছিল কি না, জানি না। দেখা হলো, ফোটো হলো, সব হলো। অপু বলল, ‘‘পয়সা দেবে বাবু, বিসকুট খাব?’’ আমাদের গুজগুজ - অস্বস্তি – দশ-বিশ টাকা রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলতেও পারি, তা বলে বাচ্চাটার এই ভিক্ষে শিক্ষে? 

‘‘এ্যাই, ইস্কুলে যাস না?’’ যেন ইস্কুলে গেলে সব সমাধান... সব ভালো, সব আলো জ্বলে জ্বলে উঠবে। 

‘‘যায় যায়, ওই যে দুপুরে খাবার দেয়,’’ আমাদের পরিচালক বলেন, ‘‘দ্যান বাবু, বড্ড গরীব, ওর বাপের জমিটমি নাই কিছু।’’ দেখে নিয়েছে আরও কয়েকটি অপু দুগ্‌গা পটু বিনি! ওদের সুতোতেও লাল কাঁকড়া। এসেছে এক সাথে, পয়সা দেবে, বিসকুট খাবো? পিছু ছাড়ে না কিছুতেই! খুচরো শেষ হয়ে আসে। বিস্কুটই তো? প্রশ্ন খোঁচায় – শৈশব... এই শৈশব...! এভাবেই শুরু? বিশাল উদার প্রকৃতির প্রান্তে এসে অনুদার হতে ইচ্ছে করে না। নিজেরাই তো কত খরচ করে রিসর্টে...। অদূরে নদীর মোহনা, বালির ওপরে দাঁড়িয়ে দেখি। অন্ধকার, কালো আর সমস্যাগুলো ভাসিয়ে দেবার মন নিয়ে আলো চোখে দাঁড়িয়ে থাকি। সপ্তডিঙা মধুকর চলেছে সারি সারি জলের ওপরে। মাছ-ধরা জেলে ডিঙি। কী অপরূপ প্রশান্তি সবখানে।

উলটো রাস্তা ধরে ফেরে ভুটভুটি। রিসর্টের সামনেই কারা ওয়াটার স্পোর্টস্‌-এর সরঞ্জাম গুছিয়ে বসেছে – এও ব্যবসা। আকাশে ওড়ো বেলুন চেপে, জলে নেমে স্কুটার চালিয়ে ভেজো, মোটর বোটে ঢেউয়ের মাথায় চড়ে নাচো! ইচ্ছে করছিল, একটু ভীতিও যে...। আপাতত চিন্তাটুকু যেন টলমলে, আমাদের যান এগোতে থাকে। সমুদ্দুরও ‘‘এই খেলবি? খেলবি না কি?’’ করে পাড়ের দিকে ঢেউ ছুঁড়ে দিচ্ছে। সূজ্যিঠাকুর হেলাফেলায় আঁচ বাড়াচ্ছেন, কমাচ্ছেন। মেঘগুলো ভারী নেকী কি না! ওপাশ জুড়ে বৃহৎ মানে বিস্তৃত, মানে আলিশান ক্যাম্পাস ‘রোজ ভ্যালী সান সিটি’র। সব ভুলে তাকিয়ে, চোখ যায় ধাঁধিয়ে। উঁচু পাঁচিলের ভেতরে যন্তরমন্তর, খেলাখেলি। বাইরে বোল্ডার বসানো (যদিও ঢেউ কদাপি অত দূরে পৌঁছায় না)। সমুদ্রমুখী সারি সারি দোতলার বারান্দা। মন্দারমনি যে আদ্যোপান্ত পশ্চিমবঙ্গীয় গ্রাম, ভুলিয়ে দেবার যৎপরোনাস্তি চেষ্টা। মন্দির আছে, ঢুকে দেখার অনুমতি দিলেন না সিক্যুরিটি, বাইরে থেকে ‘নমো নমো গৌরী সেন’ বলে কপালে হাত ঠেকালাম। 

পাকস্থলী জানান দিচ্ছে, জাবনা দেবার আয়োজন করা দরকার। বিরতি দিয়ে রিসর্টে ফিরি। তার বর্ণন না করি, তবে এটুকু বলি, সামগ্রিকভাবেই প্রকৃতি-নির্ভর, বাহুল্যহীন ও অতি মননশীল পরিকাঠামো। ভালো লাগাটা সহজ হয়ে আপনা থেকে উঠে আসে। বাঙালী মালিকানা, সৌহার্দ্য ও অতিথিপরায়নতা কর্মীদের। কে বলে বাঙালী ব্যবসাবিমুখ? গত রাতে এখানে পরিচয় হয়েছিল এক নিবিড় আত্মমগ্ন মৃৎশিল্পীর সঙ্গে। এক দলা এঁটেল মাটি, দুহাতের দশ আঙুল আর ছোট্ট এক ছেনী – একের পর এক সৃষ্টির মহিমায় মিশে আছেন। রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পেয়েছেন, জানালেন বিনা অহমিকায়। কলকাতায় অবারিত গতায়াত – ‘সৃষ্টি’র দুর্গামূর্তি গঠন করেন। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জেনে নিলাম আর দু’চার কথা। শুনলাম চুপচাপ... দেখলাম ক্যাম্পাস জুড়ে তাঁর কাজ, মন জুড়নো। 

পায়ের যা অবস্থা আমার, ধকল সয় না। একটু পরেই জিরোন চায়। খানিক পরে বের হলাম, সমুদ্রস্নান করতেই। সমুদ্রের ঢেউ দেখে দূর থেকে ভাবি, ভারী হম্বিতম্বি – ‘‘এইও, আমাকে ভয় পাস না নাকি?’’ এরকম করে চোখ পাকাচ্ছে গাল ফুলিয়ে। এক পা এক পা সাহস করি আমরা। শক্ত মাটি পায়ের নিচে, বালি ভুসভুস না। এই ডুবল গোড়ালি, ওই দূর থেকে ঢেউ পাকাচ্ছে, আমরা পায়ের নিচে বালিমাটি আঁকড়ে। যেমন হয় পুরীতে – মাটি কখন সরে যায় পায়ের নিচ থেকে – ধরণী দ্বিধা, স্নানার্থীর তোয়াক্কা না করে! দূর, ও রকম কিচ্ছু না, কিচ্ছু না। বাচ্চা বাচ্চা ঢেউ, গায়ে জোর নেই একফোঁট্টা। আবার পদক্ষেপ একটুকু, ইস্‌, জল হাঁটুও ছোঁয়নি! কিন্তু দেখাচ্ছে যেন একটা বিষম গোলমাল পাকাতে আসছে প্রায় সুনামির মতো। তীরের কাছে আহ্লাদীপনা, ‘‘এই চ’, কুমীরডাঙা?’’ অতএব বেশ দুর্দম নাবিকের সাহসে, হারিয়ে যাব অকুল অচিন্‌ পাথারে – ভেবে নেওয়া যাক। ব্যাপারটা প্রায় তেমন, এত নীরব, এত নিশ্চিন্দি, এত জনবিরল – এই স্বাভাবিক। যত ভাবি, দিক না দু’এক ধাক্কা, দিক না ফেলে, আছড়ে – নাঃ অনেক দূর অবধি শুধু কোমর জল। কলকাতার বর্ষাকালে একবার এরকম – ভেবেই রোমাঞ্চিত! এভাবেই তিনটি ঘন্টা নিশ্চিন্তে - খেলা খেলা সারা বেলা। বালিতে কালচে পলি, কাদা ঘুলিয়ে ওঠে জলের সঙ্গে। পায়ে সুড়সুড়ি জলজ লতাপাতার, স্টার ফিশ, শঙ্কর মাছের লেজ। অসংখ্য দেখেছি ভেজা বালিতে, অবশ্যই ক্ষুদ্রাকৃতি। আমার তনয়া আবার ‘pisces’, খুব জলবিলাসী। অনেক কষ্টে টেনেটুনে...। 

খাওয়ার পর দিবানিদ্রাটি ভেঙে বেরিয়ে দেখি, দিনের আলো নিভে এলো সুজ্যি ডোবে ডোবে। ঘোর ঘোর আঁধার নামছে। যেহেতু তীরে একফোঁটা আলো নেই, মানে কোনও ল্যাম্পপোস্টও, একটু পরে ঠিক ‘খাবো তোকে ঘচাং ফু’! আকাশ দেখে মনে হচ্ছে দশমীর সিঁদুর খেলা হয়ে গেছে একটু আগে – ‘ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ’। আমরা ফাঁকতালে সান্ধ্য ভ্রমন সেরে নিই – হঠাৎ স্বাস্থ্য সচেতনতা। কতটুকু সময় আর? জল ছুঁয়ে চলে আসি, পাড়ে দাঁড়িয়ে চলমানতার আওয়াজ শুনতে পাই। ব্যাস। ট্রেকার, গাড়ি, স্কুটার নির্ভয়ে বালি পার হয়ে যায়, আসে। দেখি, তারপর রিসর্টে ঢুকে আসি। ঝাউবনে পাতা ঝিরঝির, অন্ধকারে তারা আকাশ, দূর থেকে গড়িয়ে আসা ঢেউ। মানুষ কতভাবে যে প্রকৃতির কাছে ঋণী!

যেখানে ছিলাম, বেশ কুঞ্জবন কুঞ্জবন ভাব। মৃৎশিল্পীর কাজ টেরাকোটার মূর্তি, ঝাউবন, মায়াময় আলো, এমন কি শান্তিনিকেতনের নাম দিয়ে অঞ্চল বিভাজন – ‘শ্যামলী’, ‘উদীচী’ – এরকম। রাত্তিরে প্রতিজ্ঞা নিয়ে শোয়া গেল, সূর্‍যোদয় দেখবই দেখব। 

সাড়ে পাঁচটায় দিগন্ত ছাপিয়ে আলো ফুটছে, ঢেউয়ের আনাগোনা তেমনই। তড়িঘড়ি গেটে এসে ন্যাকার মতো শুধোই, ‘‘এখানে কখন সূর্য ওঠে ভাই?’’ চরাচরে কোথাও সূর্য ওঠে, কোথাও ডোবে, এই দৈনন্দিনতা যতটা স্বাভাবিক, ভুরু কুঁচকে ভাবতে বসলে, তার চেয়ে কোটি গুণ রহস্যাবৃত। আমরা দুটো ঘটনার সমন্বয় ঘটিয়ে সমস্তটুকু সহজ করে, আপন করে নিয়ে বলি, ‘‘ওঠ ওঠ, ভোর হলো যে!’’ সূর্য উঠে পড়ে। খোলা নীলের দিকে তাকিয়ে থাকি, ‘‘ক-খ-ন?’’ আরও অল্প দু’চার মানুষ ক্যামেরা নিয়ে...। কত জায়গায় কতভাবে এই দেখা, এই ভালো লাগা, ক্যামেরাবন্দী করে রাখা। অথচ ভাবছিলাম, সে কি আজ দেখা দেবে, না দেবে না? শেষ অবধি একটু একটু করে... ‘‘ওই ওই ওই যে! ওঁ জবাকুসুমসংকাশং কাশ্যপেয় মহাদ্যুতিম্‌।’’ জলে রঙ, আবার মুগ্ধ হওয়া, যেমন শহুরেরা চিরকাল হয়ে এসেছে।

এদিকে এপাড়ে, আগের সকালে যা যা দেখেছিলাম, ঠিক তেমন করে জাগছে জগৎ, গ্রাম, সমুদ্রতীর। ভুটভুটি, জল খেলার আয়োজন। 

চায়ের জন্যে প্রাণমন আকুলি বিকুলি। বেরনোর আগে খাই নি। বালির ওপরে ছোট্ট চালাঘর, আপ্যায়ন দু’হাত ছড়িয়ে। আশা করেছিলাম মাটির খুড়ি, বদলে কাগজের কাপ। আর দুপুরে খাওয়ার আমন্ত্রন (অবশ্য নিখরচায় নয়)। সে যাই হোক, ‘জানাবাবু’ জানাতে বলেছেন সকলকে – যদি কেউ মন্দারমনি বেড়াতে যান, ওঁর কাছে খাবেন। আমরা মৎস্যলোভী। মাছের ফিরিস্তি নিলাম। টাইগার প্রণ খাওয়াবেন, অথবা পমফ্রেট বা ভেটকি, যেটা পছন্দ। সঙ্গে কি? মানে, তরিতরকারী? বাচন শুধু মৌখিক নয়, শারীরিকও, হাত নেড়ে দেখালেন, ‘‘সরু চালের ভাত, মুগের ডাল, আলুভাজা।’’ বারে বারে বললেন, ‘‘হোটেলে তো রোজই খেলেন, দেখেন না আমি কেমন খাওয়াই!’’ ভালো লাগল, তবু অনিশ্চিত, ‘‘মাছ টাটকা দেবেন তো?’’ 

আমার হাজারি-ঠাকুরের কথা মনে পড়ছিল কেন কে জানে!

যে যেমন দেখে, স্থান মাহাত্ম্য তার কাছে তেমন, এই স্বীকৃত সত্য। গোলাপের দিকে চেয়ে বললে গোলাপ সুন্দর, গোবর দেখে নাক সিঁটকে বোঝাই, ওটা গোবর। আমার হলো, ওই নীরব মুক্তিটুকুর আমেজ খুঁজে বুঁদ হয়ে থাকা। তবে, আমাদের দেশটা নির্জনতার কদর করে কই? অখ্যাত, অবিখ্যাত কোনও এক জায়গা সন্ধানী পর্যটকের আবিষ্কারে সার্থক হওয়ামাত্র হৈহৈ রৈরৈ, যতক্ষণ পর্যন্ত নাক মুখ কুঁচকে না উঠছে, ‘‘ছিঃ দীঘা! ওখানে কেউ যায় আজকাল?’’ ঘটনা এরকম। পর্যটকের ধাক্কাধাক্কি আর অশালীন ভীড়ে বেড়ানো মাটি। সৌন্দর্য ভোগের ত্র্যহস্পর্শ। আর যে জায়গা সরকারি দাক্ষিণ্যবঞ্চিত, সম্বল শুধু পর্যটক। যাক কচকচি। এরাজ্য তো আরও চমৎকার – দলনীতি, ভয়নীতি এবং ‘বরাভয়’-নীতির আঁতুড় তথা উপবন। 

রোদ্দুর বড্ড তেজী। এমনিতেও সমুদ্রে নামার পরিকল্পনা নেই, কারণ ফিরতে হবে। রিসর্ট চত্বরে এলোমেলো পদচারণা, বিল মেটানো, ইত্যাদি। এক প্রান্তে ওয়াচ টাওয়ার আছে, সেখানে উঠে আশপাশ দেখি। যারা জলে গেছে, হিংসে করি, ইস কি মজা! দোপহর কা খানা – ‘হাজারি ঠাকুরে’র হোটেলে। পরিপাটি ডাল-ভাত-ভাজা, লেবু-লঙ্কা-নুন। চিংড়িগুলো অসম্ভব টাটকা, যেমন বলেছিলেন, ফাঁকি দেন নি। চমৎকার ঝাল ঝাল রান্না – একেবারে ঘরোয়া। চালাঘরের মধ্যে রন্ধনশিল্পী, খুব সম্ভব পত্নী। উনুনে লোহার কড়াতে, কাঠের জ্বালে, বাটা মশলার রান্না... বাহুল্য নেই, কিন্তু এমন স্বাদু কেন, কারণ বুঝতে অসুবিধে হলো না। কি বলব ভেবে পাই না। ‘‘আবার যখন আসব, আপনার চালাঘর পাকাপোক্ত ও বড়ো হোটেল হয়ে যাবে।’’ শুনে বললেন, ‘‘সবাই বলেন এমনটা... আট বছর ধরে এখানেই আমি।’’

দীঘা থেকে ফিরতি ট্রেন। দুটো নাগাদ বেরিয়ে পড়া হল। শুরুতে একই পথ ওদিকে।

তখন ঝাঁ ঝাঁ দুপুর, সব স্পষ্ট, খুল্লম খুল্লা ভালো ও মন্দ। দুপাশে জলার মধ্যে দিয়ে মাটির সরু পথ দৃশ্য। সে রাতে গাড়িতে বসে ভয়ভয় করছিল, এবারে চোখ সরে না। কুঁড়ে, গোরু, মুরগী, ধানক্ষেত, ভাঙা কোঠাঘর যথাযথ। কিন্তু সুরে তালে মেলে না! ঘন বাঁশঝাড়ে বাধা পেয়ে মাটিতে আসার সুযোগ খুঁজছে রোদ। বিভূতিভূষণের গ্রামবাংলা মনে পড়ে, এমনটাই যেন। দুপা এগোতে না এগোতে বদলে যায় ছবি, ভোডাফোন বা ফেয়ারনেস ক্রিমের হোর্ডিং। ভাঙা পাঁচিলে বিজ্ঞাপন। বিতৃষ্ণায় জ্বলি।

চুপ কর, স্যাডিস্ট নাকি? বকুনি দিই নিজেকে। তাও ভাবনার ঘরে তালা পড়ে কই? শহর যবে থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসতে শুরু করেছে, অনেক কিছু খোয়া গেছে গ্রাম থেকে – ‘বুক-ভরা মধু বঙ্গের বধু’ এখন টেলিভিশনের অখাদ্যি সিরিয়ালে। শহর গ্রামকে কুমীরের মতো আধা গিলে ছিবড়ে করে রেখেছে। উহার নাম ‘মফঃস্বল’! সব মালামাল এখন। বিরক্ত লাগে, ভালো লাগা উবে যায়, যত রাস্তা এগোতে থাকি।

ভর দুপুরে দীঘা। আকার প্রকার দেখে টের পাওয়া যায় সরকারী নেক নজর। দীঘা আগে বার দুই এসেছি, ঠিক আছে... উঁহু... মানে, ওই আর কি! থিকথিক বড্ড বেশি। দীঘা স্টেশন ছাড়িয়ে এগোয় গাড়ি। নিউ দীঘা - বিস্বাদ খিচুড়ি পরিবেশ। ভাঙাচোরা খোবলানো পাকা রাস্তা, চালাঘরে ঝিনুকের উপহার সম্ভার। একপাশে হোটেলগুলো, তাদের বিজ্ঞাপন পোস্টার, এই সব। দুঘন্টার ওপরে বসে থাকতে হবে। তারপর ট্রেন। পাড় বাঁধানো সমুদ্রের রাস্তার ধারে বেঞ্চিতে বসি। লাউড স্পিকারে ‘আমার পূজার ফুল’ আরও এরকম গান প্রবল সরব – রসভঙ্গ আর নির্জনতার রক্তাক্ত বলিদান। চুপচাপ আমরা সমুদ্রমুখী। সিঁড়ি বেয়ে ভেজা বালিতে গেছেন অনেক মানুষ। আরও বাড়ছে। আইসক্রিমের গাড়ি, আইস-গোলা, কুলফির গাড়ি। রোদের দাপট কমে আসে ক্রমে। লাল গোলাটি কখন লুকিয়ে পড়ে ল্যাম্পপোস্টের আর ছোটো দোকানের আড়াল খুঁজে। 

দীঘা স্টেশন। অবাক হই! ছোট্টোমতো, শিশু স্টেশন। ঝকঝকে তকতকে – অবিশ্বাস্য লাগে যেন। লোকসংখ্যার বাড়াবাড়ি না থাকলে সব সুন্দর, সব পরিচ্ছন্ন, সব পরিমিত। ট্রেনের অপেক্ষায় আমরা... ব্যাক টু হাওড়া।