Next
Previous
Showing posts with label ধারাবাহিক. Show all posts
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in






৩৭

ফাইনহালস সঙ্গে সঙ্গে জেনারেলকে চিনতে পারল। তাকে আগের চেয়ে অনেক ভালো দেখাচ্ছে; উদ্বেগহীন, শান্ত দেখাচ্ছে। গলায় ক্রসটা রয়েছে তাঁর। শান্তভাবে দু’জন রক্ষীর সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন তিনি। মুখে কি হালকা একটা হাসির রেখা দেখা যাচ্ছে? রক্ষীদের মেশিনগানের নল দুটোই তাঁর দিকে তাক করে রাখা আছে। তাঁকে একেবারেই ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে না। শান্ত, সৌম্য, পরিশীলিত মুখমণ্ডলে হালকা হাসির রেখা তাঁর ব্যক্তিত্বে অন্য মাত্রা যোগ করেছে। ধীর পদক্ষেপে উঠোন পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন তিনি।

‘ওই লোকটা জেনারেল’ বলে উঠলেন বয়স্ক মানুষটি, মিঃ ফিঙ্ক। ‘এখানে কর্নেল, মেজর, অনেকেই আছে। প্রায় জনাত্রিশেক।’

অল্পবয়েসি মহিলাটি পাশের ঘর থেকে গ্লাস এবং বোতল নিয়ে এলো। বুড়ো ফিঙ্কের সামনে জানালার তাকে রাখল একটা গ্লাস। আরেকটা গ্লাস ফাইনহালসের চেয়ারের সামনে টেবিলের উপরে রাখল। ফাইনহালস জানালায় দাঁড়িয়ে রইল। জানালাটা দিয়ে বাড়িটার পেছন দিকে প্রধান রাস্তা পেরিয়ে দূরে অনেকটা দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ওপারে, যেখানে দু’ জন রক্ষী মেশিনগান হাতে দাঁড়িয়ে আছে, সেই জায়গাটা ফাইনহালস চিনতে পারল। একটা কফিনের দোকানের জানালা দেখা যাচ্ছে। এই রাস্তাতেই হাইস্কুলটা ছিল। কফিনের দোকানটা এখনও আছে। জানালায় রাখা কফিনটা কালো পালিশ করা, রূপোলী কারুকাজ করা; রূপোলী ঝালরের ঝকমকে পাড়ের কালো চাদর দিয়ে ঢাকা। হয়তো তেরো বছর আগে এই পথে হাইস্কুলে যাবার সময়ে যে কফিনটা সে দেখতে পেত এই দোকানের জানালায়, এখনও সেই কফিনটাই রাখা আছে।

‘উল্লাস!’ বুড়ো ফিঙ্ক নিজের গ্লাসটা একটু উঁচুতে তুলে ধরেন। ফাইনহালস তাড়াতাড়ি টেবিলে ফেরত যায়। অল্পবয়সী মহিলাকে বলে ‘ধন্যবাদ’; তারপর বুড়োর দিকে নিজের গ্লাসটা তুলে ধরে বলে ওঠে ‘উল্লাস!’ পান করে সে। ওয়াইনটা বেশ ভালো।

-‘আচ্ছা, আপনার মতে কখন ঘরে ফেরা আমার জন্য সবচেয়ে ভালো?’ ফাইনহালস বুড়োকে প্রশ্ন করে।

‘আগে দেখে নিতে হবে যে কোন জায়গাটায় আমেরিকানরা নেই, সেই জায়গাটা দিয়ে যেতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় কের্পেল দিয়ে... আপনি কের্পেল চেনেন?’

‘হ্যাঁ’ উত্তর দেয় ফাইনহালস... ‘ওইখানে ওরা কেউ নেই?’

‘নাহ। ওইখানে ওরা নেই। লোকজন প্রায়ই ওইদিক থেকে এখানে রুটি নিতে আসে। রাতের দিকে, মেয়েরাও আসে দল বেঁধে।’

‘গোলাগুলি সব দিনের বেলায় চলে’... বলে ওঠে অল্পবয়েসি মহিলাটি।

‘হ্যাঁ’... বলে ওঠেন বয়স্ক মানুষটি... ‘ওরা দিনের বেলা গুলি চালায়।’

‘ধন্যবাদ!’ বলে ফাইনহালস, ‘আপনাদের অনেক ধন্যবাদ!’ গ্লাসটা খালি করে ওয়াইনটা পুরোটা খেয়ে ফেলে সে।

‘আমি পাহাড়ের দিকে যাব।’ উঠে দাঁড়িয়ে বলে ওঠেন বুড়ো মানুষটি, ‘আপনি যদি আমার সঙ্গে আসেন, সবচেয়ে ভালো হয়। উপর থেকে সব ভালোভাবে পরিষ্কার দেখা যাবে। আপনাদের নিজেদের বাড়িটাও দেখা যাবে...’

‘হ্যাঁ। আমি আপনার সঙ্গে যাব।’

ফাইনহালস টেবিলে বসে থাকা মহিলাদের দিকে তাকায়। তারা টেবিলে বসে সবজি কাটছে। বাঁধাকপির পাতাগুলো ছাড়িয়ে, বেছে, কেটে ঝাঁঝরির মধ্যে রাখছে। শিশুটি খেলনা গাড়িটা একপাশে সরিয়ে রেখে মেঝে থেকে মুখ তুলে তাকায়... ‘আমি কি সঙ্গে আসতে পারি?’

‘হ্যাঁ,’ বলে ওঠেন বুড়ো ফিঙ্ক, ‘চলো আমার সঙ্গে।’ তামাকের পাইপটা বুড়ো জানালার তাকে রাখেন।

‘ওই যে!’ উত্তেজিত হয়ে চাপা চিৎকার করে ওঠেন বুড়ো ফিঙ্ক, ‘দেখুন, ওই যে, পরের জনকে নিয়ে আসছে।’

ফাইনহালস দৌড়ে জানালার কাছে যায়। কর্নেল। এখন তাঁর চালচলন বেশ ঢিলে দেখাচ্ছে। সরু মুখটা দেখে মনে হচ্ছে বেশ অসুস্থ। জামার কলার, যেটার সঙ্গে সব মেডেলগুলো লাগানো, সেটা যেন অতিরিক্ত বড় দেখাচ্ছে কর্নেলের মুখের তুলনায়। অতিকষ্টে হেঁটে যাচ্ছেন তিনি। হাঁটুগুলো যেন নড়ছে না। হাতগুলো কেমন যেন ল্যাতপ্যাত করছে।

‘লজ্জা!’ বুড়ো ফিঙ্ক বিড়বিড় করতে থাকেন, ‘লজ্জা… অপমান!’ দেওয়ালের হুক থেকে নিজের টুপিটা পেড়ে নিয়ে মাথায় পরেন তিনি।

‘আবার দেখা হবে।’… বলে ফাইনহালস।

‘আবার দেখা হবে।… বলে মহিলারা।

‘আমরা খাবার সময়ে ফিরব’… বলে ওঠেন বুড়ো ফিঙ্ক।

(চলবে)
0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(১৩)

আগামীকালের দিনটি হয়ত একটি অপ্রত্যাশিত যুদ্ধজয়ের দিন হিসাবে ইতিহাসের বুকে লেখা থাকবে। লাটভবন থেকে ফেরার পথটিতে দূর্গন্ধময় ধূলি-কর্দম সব যেন আকস্মিক মুছে গিয়ে শহর কলকাতা যেন অমরাবতীর আলোয় জেগে ওঠর প্রহর গুণছে।

তবে দুঃখের বিষয় এই যে গুটিকয়েক স্বপ্নময় মানুষ ছাড়া শহরের আগামীদিনের এই রাজবেশ ধারণটি আর কেউই দেখতে পাচ্ছেনা।

দেশবাসীর এই চক্ষুষ্মানতার অভাবে রামমোহনের মত এই কালবদলের রূপকারগণ তাই হয়তো বিরলে অশ্রুস্নাত হন।

আসমুদ্রহিমাচলবিধৌত ভূখন্ডটিতে আগামীকাল থেকেই বৈধ হতে চলেছে সতীদাহ বিরোধী আইনটি। লর্ড বেন্টিঙ্ক নিজে আজ রামমোহন ও ধর্মযাজক উইলিয়াম কেরীকে লাটভবনে ডেকে এনে একটি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আজ এই সুসংবাদটি দিয়েছেন। তবে এই আইনটির বিরোধীতা করে প্রিভি কাউন্সিলেও যে বেশ কিছু চিঠি জমবে সেটা আর কহতব্য নয়।

বৈষ্ণবদের স্বামীনারায়ণ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা সহজানন্দ স্বামী পশ্চিম ভারতে ১৮ শতকের গোড়ায় সতীদাহের বিরুদ্ধে প্রচার করতে শুরু করেছিলেন বটে তবে জনসমর্থনের অভাবে হতাশ হয়েছিলেন বলে ক'দিন এসবে ক্ষান্ত দিয়েছিলেন। আবার এই বিষয়টি নিয়ে ইংরেজ শাসক ভাবতে বসেছে ও রামমোহন এর পিছনে জড়িত সেটা জানতে পেরে তিনিও রামমোহনকে স্বেচ্ছায় তাঁর সমর্থনটি জানিয়ে একটি চিঠি দিয়েছেন। সেই পত্রটিতে তিনি বলেছেন যে নেহাত সহজানন্দ এখন বৃদ্ধ হয়েছেন, নচেৎ তিনি নিজে উপস্থিত থেকে রামমোহনকে আলিঙ্গন করতেন।

দ্বারকানাথও বেশ কিছু সংখ্যক জমিদারদের সমর্থন যোগাড় করে তাঁর দেওয়া কথাটি রেখেছিলেন।

তাই উৎসাহী রামমোহন আর বিলম্ব না করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে শেষতম পিটিশনে লিখেছিলেন যে,

"এই সমস্ত ঘটনা প্রতিটি শাস্ত্র অনুসারে হত্যা।"

অবশ্য বেদভাষ্যের পাশাপাশি পরাশর সংহিতা ও নারদ সংহিতাও এক্ষেত্রে বেশ কাজে এসেছে। সনাতন ধর্মে যে সতীদাহ বলে আদৌ কিছু নেই সেটা মেনে নিতে রক্ষণশীল সমাজপতিদের বেশ বেগ পেতে হয়েছে।

এই বিষয়ে তার একদা বন্ধুস্থানীয় শোভাবাজারের রাজা রাধাকান্ত দেব ও তাঁর অনুগামীদের অসহযোগিতার চাপ না থাকলে হয়ত লড়াইটা এত দীর্ঘায়িত হত না। তবে আজ বিশ্বাস করা কঠিন যে মাত্র কিছুদিন আগে সতীদাহপ্রথা রদ হতে পারে শুনে প্রথমেই তাকে স্বাগত জানাতে মাঠে নেমে পড়েছিল ‘সমাচার চন্দ্রিকা’। এই পত্রিকার সম্পাদক ভবানীচরণ সেদিন লিখেছিলেন – “আমাদের মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্য্যন্ত শিউরে উঠছে। আমরা বিপন্ন, ভীত, বিস্মিত।”

......

এটাই স্বস্তির ঘটনা যে লর্ড বেন্টিঙ্ক, মেটকাফ, বেলি প্রমুখর সমর্থনে কাউন্সিল সতীদাহ প্রথাকে “illegal and punishable act by criminal courts” বলে শেষমেশ নিষিদ্ধ করতে পেরেছেন । আর কদিনের মধ্যেই 'বেঙ্গল হরকরা'র মত ইংরেজী পত্রিকাটির বিদ্বজ্জনেরাও এটিকে সর্বান্তকরণে স্বাগত জানাবে বলে স্বয়ং সম্পাদক মার্শম্যান মহাশয় তাঁকে আশ্বস্ত করেছেন। এই দীর্ঘ লড়াইয়ে মিত্রবর দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, হরিহর দত্ত, কালীনাথ রায় এরা সবাই পাশে না থাকলে আজকের শুভসূচনাটাই হয়ত কোনওভাবে সম্ভব হতনা।

লাটভবনে আজ শপ্যাঁ জাতীয় দ্রাক্ষারস পান করতে করতে রামমোহন হঠাৎ টের পেলেন যে তাঁর দীপ্যমান ও বলশালী শরীরে যেন কোন ফাঁকে বার্ধক্য এসে থাবা বসাতে চাইছে। পাগড়ির নীচে বাবরি ছাঁদের কেশগুচ্ছে যেন লবণ ও মরিচের সামান্য বাহুল্যে যেন আসন্ন ঋতুপরিবর্তনের ইঙ্গিতটির বিষাণ বেজে উঠছে!

আপনমনেই গুম্ফ আন্দোলিত করে সবার অলক্ষ্যেই তখন নিজের মনে যেন একটু মুচকি হেসে উঠলেন আপাত গম্ভীর ও মেধাণ্বিত মধ্যবয়স্ক অথচ চিরতরুণ স্বয়ং রামমোহন।

......

গোলকপতির মনে পড়ল যে আচার্য সর্বজ্ঞ শাস্ত্রী একবার ওকে শুনিয়েছিলেন যে অথর্ব বেদভাষ্যে আছে যে,

‘‘ইয়ং নারী পতি লোকং বৃণানা নিপদ্যত উপত্ব্য মর্ন্ত্য প্রেতম্। ধর্মং পুরাণমনু পালয়ন্তী তস্ম্যৈ প্রজাং দ্রবিণং চেহ ধেহি।।’’

(# অথর্ববেদ ১৮.৩.১)

অর্থাৎ প্রজাপিতা বলছেন যে,

‘‘হে মনুষ্য! এই স্ত্রী পুনর্বিবাহের আকাঙ্খা করিয়া মৃত পতির পরে তোমার নিকট আসিয়াছে। সে সনাতন ধর্মকে পালন করিয়া যাতে সন্তানাদি এবং সুখভোগ করতে পারে।’’

এমনকি এই শ্লোকটির সমর্থন আবার আছে ঋক বেদেও,

‘‘উদীষর্ব নার্ষ্যভি জীবলোকং গতাসুমেতমুপশেষ এহি। হস্তাগ্রাভস্য দিধিষোস্তবেদং পত্যুর্জনিত্বমভি সংবভূব।।’’

(# ঋকবেদ ১০.১৮.৮)

সহজ বাংলায় শাস্ত্রীমহাশয় সেদিন বলেছিলেন,

‘‘হে নারী! মৃত পতির শোকে অচল হয়ে লাভ কি?বাস্তব জীবনে ফিরে এস। পুনরায় তোমার পাণিগ্রহণকারী পতির সাথে তোমার আবার পত্নীত্ব তৈরী হবে।’’

সাম্প্রতিকের কয়েকটি ' সম্বাদ ভাস্কর ' ও 'সংবাদ কৌমুদী'র পাতায় এই একই কথা নিয়ে সপক্ষে বিস্তর লিখেছেন এক তেজোবান ব্রাহ্মণ যুবক নাম রামমোহন রায়। গোলকপতির বেশ মনে আছে যে এই ক'দিন আগে রাজবাড়ির মহাফেজখানার কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে ওই প্রবন্ধগুলির লেখকটির ব্যক্তিজীবনের কিছু কথা সে শুনেছে। এমনকি মহারাজ তেজচন্দ্র বাহাদুরের সাথে সেই লোকটির শাস্ত্রজ্ঞানে বিতর্কের প্রসঙ্গটিও লোকের মুখে মুখে ফেরে। তবে উনি রাজকুমার প্রতাপচন্দ্রের সুহৃদ বলে বর্ধমানে মাঝেমাঝেই বেড়াতে আসেন।

এই লোকটির পিতৃদেবটিও রাজনীতিতে অভিজ্ঞ ও রাণীমা বিষণকুমারীর বেশ আশ্বাসভাজন ব্যক্তি। দেওয়ানী আইনের অনেক জটিল সমাধান রামকান্ত রায় নামের প্রবীণ বৃদ্ধটির নখদর্পণে থাকে বলে রাণীমাও তার উপর নির্ভর করে থাকেন। সতীদাহের মত ঘৃণ্যপ্রথাটির বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার জন্য লোকটির উদ্দেশ্যে সে মনে মনে কূর্ণিশ জানায়।

ইস্! গোলকপতির এখন বড় আফশোস্ হচ্ছে! যদি তার সাথে সেই লোকটির ভাল করে আলাপ থাকত তাহলে সে এখনই এই সম্ভাব্য সতীদাহের সম্ভাবনাটি রোধ করে তরুণীটির জীবন এই বহ্ন্যুৎসব থেকে বাঁচাতে পারত!

....

( * এই পর্বটির জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই-

# রানা দত্ত মহাশয়।
# রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গ সমাজ - শিবনাথ শাস্ত্রী।
# বাংলায় নবচেতনার ইতিহাস (২০১৬), স্বপন বসু, পুস্তক বিপণি (২০১৪)।
# বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা (২০০৯), বিনয় ঘোষ।
# বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ (২০১১), বিনয় ঘোষ। )
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in




















দশ

সেই রাত কাটলো ভয়ে ভয়ে ।সকালে উঠে শুনলাম ব্রাহ্মণ পাড়ার দীপক বাইরে বসে গান করছিলো আর ভূতে তাকে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছো । শুনে আমার খুব রাগ হলো ।ভাবলাম, দাঁড়া আজকের রাতে তোদের ব্যবস্থা হচ্ছে।

দাদা ও দিদি ঠিক বারোটার মধ্যে অমল কে সঙ্গে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে এলেন ।তাদের দেখে আমার বুকের ছাতি চল্লিশ ইঞ্চি হয়ে গেলো মনে হচ্ছে।

ঠিক চারটের সময় মঙ্গল চন্ডীর উঠোনে গ্রামবাসীরা হাজির হয়ে গেলো । জয়ন্ত দা বলতে শুরু করলেন, আজ আমরা সবাই রাতে জেগে থাকব । কে বা কারা এই কুকর্ম করছে আমাদের জানা দরকার ।

একজন বলে উঠলেন, ভূতের সঙ্গে লড়াই করে কি পারা যাবে ।

দিদি বললেন, ভূত বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই । তারপর তিনি আরও কিছু কথা বললেন গ্রামবাসীদের সাহসী করার জন্য ।

আবার একজন বললেন, তাহলে আগুন জ্বলে উঠছে কেমন করে ।

দাদা বললেন, এসব কিছু বিজ্ঞান বিষয়ের ব্যাপার ।আগে ধরা হোক অপরাধী কে তারপর সব বোঝা যাবে ।

এখন রাত দশটা বাজে । গ্রামের সবাই জেগে আছে ।ঠিক রাত বারোটার সময় একটা দশ ফুটের লোক হেঁটে আসছে গ্রামের দিকে । দাদা থানায় ফোন করে দুজন বন্দুকধারী পুলিশ আনিয়েছেন ।সাধারণ লোকের বুদ্ধির সঙ্গে এখানে ই দাদার পার্থক্য । কখন যে সমস্ত ব্যাবস্থা করে রেখেছেন কেউ জানি না । ভূত কাছাকাছি আসা মাত্র পুলিশ দু রাউন্ড গুলি চালালো ফাঁকা আকাশে । গুলির আওয়াজ শোনা মাত্র ভূত টি ভয়ে মাটিতে পড়ে গেলো । সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের সাহসী ছেলেরা বিকট চিৎকার করে ধরে ফেললো ভূত বাবাজিকে । বেচারা তখন জোড়া হাতে ক্ষমা চাইছে ।তাকে বিচারের জন্য ফাঁকা জায়গায় আনা হলো ।সবাই বসে পড়লেন । এবার দাদা বলতে শুরু করলেন,দেখুন সবাই এই চোরটি রণ পা ব্যবহার করেছে লম্বা হওয়ার জন্য । রণ পা টি বাঁশের তৈরী নয় ।একজন বললো,তাহলে ও ছোটো বড় কি করে হতো ।

দিদি বললেন, রণ পা টি বিশেষ ধরণের । এর মাঝে একটি শক্ত স্প্রিং আছে। যার ফলে এ যখন লাফ দি তো তখন এটি ছোটো বড়ো হতো ।

আর একজন বললো, তাহলে মুখ দিয়ে আগুন বেরোতো কি করে।

দিদি বললেন, এটা তো সহজ ব্যাপার । সার্কাসে আপনারা দেখে থাকবেন মুখের মধ্যে পেট্রোলিয়াম বা কেরোসিন জাতীয় দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করে এরা মানুষকে অবাক করে দেন । এই চোরটিও তাই করেছে ।

দাদা এবার চোরটিকে ধমক দিয়ে বললেন,তুমি জঘন্য অপরাধ কেন করছো জবাব দাও ।এবার চোরটি উঠে জোড় হাতে বললো,আমরা মাদক দ্রব্য চোরাপথে চালান করি । তাই ভূতের ভয় দেখিয়ে আমরা মানুষকে বাড়িতে ঢুকিয়ে রাখি ।এর ফলে আমাদের চোরা চালানে সুবিধা হয় ।তারপর থেকে আর ভূূতের উপদ্রব হয় নি।

1

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in





















কোপারেটিভ ইউনিয়নের তবিল-তছরূপের ঘটনাটি বড্ড সাদামাটা ঢঙের, বড্ড সরল। রোজ রোজ চারদিকে যে শত শত তছরূপ হচ্ছে তার থেকে এ একেবারে আলাদা। এর সৌন্দর্য্য এর সরলতায়। এ একেবারে বিশুদ্ধ তছরূপ; কোন প্যাঁচ নেই। এতে কোন জাল দস্তখতের গল্প নেই, না কোন জালি হিসেব, না কোন নকল বিল দেখিয়ে টাকা তোলা হয়েছে।এমন তছরূপ করতে বা ধরে ফেলতে কোন টেকনিক্যাল যোগ্যতার দরকার নেই। যা দরকার তা’হল প্রবল ইচ্ছাশক্তি।

ব্যাপারটা হচ্ছে এ’রকমঃ

কোপারেটিভ ইউনিয়নের একটা বীজগুদাম ছিল, তাতে গম ভরা। একদিন ইউনিয়নের সুপারভাইজার রামস্বরূপ দুটো ট্রাক নিয়ে ওই গুদামে এল। ট্রাকে গমের বস্তা ভরা হচ্ছিল। যারা দূর থেকে দেখছিল তারা ভাবল এ তো কোপারেটিভের নিত্যকর্ম।ট্রাক যাবে কাছের অন্য একটি বীজগুদামে মাল পৌঁছাতে। রামস্বরূপ ড্রাইভারের পাশে গিয়ে বসল এবং ট্রাক রওনা হল। একটু পরে বড় রাস্তা ছেড়ে একটা কাঁচা রাস্তা ধরে নিলে পাঁচ মাইল দূরে ওই বীজগোদাম। কিন্তু ট্রাক সেদিকে না ঘুরে সোজা এগিয়ে চলল। এখান থেকেই ফ্রড, ধোঁকা, বা তছরূপ আরম্ভ হল। ট্রাক সোজা শহরের গায়ে ওখানকার সব্জীমন্ডি বা ফসলের থোক বাজারে গিয়ে থামল। সেখানে ট্রাক দুটো গমের বস্তাগুলো নামিয়ে দিয়ে তবিল-তছরূপ বা ধোঁকার কথা একদম ভুলে মেরে দিল এবং পরের দিন থেকে আগের মত কয়লা-কাঠ এসব বইতে শুরু করল। এরপর রামস্বরূপের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। লোকে ধরে নিল ব্যাটা গমটম বেচে কয়েকহাজার টাকা ট্যাঁকে গুঁজে বোম্বাই-টোম্বাইয়ের দিকে কেটে পড়েছে।পুরো ঘটনাটা একটা রিপোর্টের রূপ ধরে লোক্যাল থানায় জমা হল এবং বৈদ্যজীর ভাষায়—কাঁটা ফুটেছিল, বেরিয়ে গেল।

কিন্তু ইউনিয়নের এক ডায়রেক্টর কাল শহরে গিয়ে যা দেখতে পেলেন তার সারমর্মঃ রামস্বরূপ ওই মেরে দেয়া টাকা খরচ করতে বোম্বাই নয়, স্থানীয় শহরকেই পছন্দ করেছে। ডায়রেক্টর সাহেব ওখানে কেন গেছলেন? মনে করুন, সেরেফ শহর দেখার জন্যে শহর দেখতে।ওখানে গেলে ওনার অন্যসব কাজকর্মের মধ্যে একটা কাজ বাঁধা ছিল। তা’হল কোন পার্কে যাওয়া, সেখানে গাছের ছায়ায় বসে ছোলাসেদ্ধ খাওয়া, মন দিয়ে রঙীন ফুল ও মেয়ে দেখা, এবং কোন অল্পবয়েসি ছোকরাকে দিয়ে মাথায় তেল মালিশ করানো। যখন ওনার এইসব কাজকম্ম শেষ হওয়ার মুখে তখনই ঘটনাটি ঘটে। উনি বসেছিলেন গাছের ছায়ায় একটা বেঞ্চে। আরামে চোখ বুঁজে গেছল, আর ছোঁড়াটার নরম ও পাতলা আঙুল ওনার মাথায় তিড়-তিড়-তিড় বোল বাজাচ্ছিল। ছেলেটা বেশ মজা করে ওনার চুলে তবলার কোন ত্যাড়াম্যাড়া বোল তুলছিল আর উনি চোখ বুজে আফসোস করছিলেন- হায়, তেলমালিশ যে শেষ হতে চলেছে! একবার উনি চোখ খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু এতক্ষণ মালিশ পেয়ে ঘাড়টাও দুঁদে অফিসার হয়ে গেছে। পেছনে ঘুরলোই না। অগত্যা উনি সামনে যা দেখা যাচ্ছে তাই মন দিয়ে দেখতে লাগলেন।

উনি দেখলেনঃ সামনে আরেকটি গাছ এবং তার নীচে আরেকটি বেঞ্চ। সেখানে বসে রামস্বরূপ সুপারভাইজার একটা ছোঁড়াকে দিয়ে তেল মালিশ করাচ্ছে।ওর মাথা থেকেও তিড়-তিড়-তিড় বোল উঠছে এবং দেখা করার ওর চোখ বুঁজে রয়েছে। ডায়রেক্টর এবং টাকা-মেরে-দেয়া সুপারভাইজার দুজনেই তখন পরমহংস ভাব ধারণ করে যে যার নিজস্ব দুনিয়ায় লীন। শান্তিপূর্ণ-সহাবস্থানের একেবারে আদর্শ স্থিতি।

কেউ কারও কাজে হস্তক্ষেপ করলেন না। পনের মিনিট ধরে একে অপরকে না দেখার ভান করে উত্তম প্রতিবেশির মত যে যার বেঞ্চে বসে রইলেন। তারপর আড়মোড়া ভেঙে উঠে মালিশের ছোকরাদের যথোচিত পারিশ্রমিক দিয়ে পরেরবার এখানেই দেখা করার প্রতিশ্রুতি আদায় করে যে যার রাস্তায় চলে গেলেন।

শিবপালগঞ্জে ফিরে আসার সময় ডায়রেক্টর সাহেবের চৈতন্য হল যে তেলমালিশের সুখ পেতে গিয়ে উনি কোপারেটিভ মুভমেন্টের সঙ্গে বেইমানি করেছেন। মনে পড়ল -রামস্বরূপ ফেরার এবং পুলিশ ওকে খুঁজছে। রামস্বরূপকে ধরিয়ে দিলে ধোঁকাধড়ি ও তছরূপের মামলাটা আদালতে দাঁড়াত। হয়ত ওঁর নাম খবরের কাগজেও ছাপা হত।এসব ভেবে ভেবে ওঁর কষ্ট বেড়ে গেল। বিবেক জাগ্রত হয়ে ওঁকে খোঁচাতে লাগল।কাজেই গাঁয়ে ফিরে বিবেককে শান্ত করতে উনি বৈদ্যজীর দরবারে হাজির হয়ে এক পুরিয়া হিংগ্বাষ্টক চূর্ণ মুখে ঢেলে বললেন-“ আজ পার্কে একজনকে দেখলাম, একদম রামস্বরূপের মত”।

বৈদ্যজী বললেন,” হবে হয়ত; অনেক লোকের চেহারায় অমন মিল-মিশ থাকে”। ডায়রেক্টরের বোধ হল এটুকুতে বিবেক শান্ত হবেনা। উনি এদিক ওদিক দেখে বললেন,’ তখনই মনে হল, যদি রামস্বরূপই হয়?”

বৈদ্যজী ওঁর দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। উনি আবার বললেন,’ রাআমস্বরূপই ছিল। ভাবলাম শালা এখানে কী করছে? ব্যাটা মালিশ করাচ্ছিল”।

“তুমি ওখানে কী করছিলে শ্রীমান”?

“আমি ক্লান্ত হয়ে একটা গাছের ছায়ায় জিরিয়ে নিচ্ছিলাম”।

বৈদ্যজী বললেন।‘ তক্ষুণি পুলিশে খবর দেয়ার ছিল”।

ডায়রেক্টর চিন্তায় ডুবে গেলেন; তারপর বললেন,” ভেবেছিলাম রামস্বরূপ যেন বুঝতে না পারে যে ওকে দেখে ফেলেছি, তাই আর পুলিশে খবর দিইনি”।

তবিল-তছরূপের অপরাধী বোম্বাই নয়, পনের মাইল দূরের শহরে রয়েছে এবং তেলমালিশ করানোর জন্যে ওর ধড়ের উপর মুন্ডুটা এখনও টিকে আছে—এই খবরটি বৈদ্যজীকে রীতিমত চিন্তায় ফেলে দিল। ডায়রেক্টরদের মীটিং ডাকা জরুরি। তবে খবরটা উনি খালি পেটে শুনেছেন, ভাঙ সেবনের পর শোনা দরকার—তাই মীটিংযের সময় ধার্য হল সন্ধ্যেবেলা।

শনিচরের চোখে পৃথিবীতে একমাত্র মানুষ হলেন বৈদ্যজী এবং অন্তরীক্ষে একমাত্র দেবতা হলেন হনুমানজী। হনুমানজি শুধু ল্যাঙোট পরে থাকেন, তাই শনিচর শুধু আন্ডারওয়ারেই কাজ চালিয়ে নেয়।গেঞ্জি তখনই পরত যখন কোথাও সেজেগুজে যাওয়ার দরকার হত। এত গেল হনুমানজির প্রভাব। বৈদ্যজীর প্রভাবও কম নয়। তার জেরে শনিচর পথচলতি যেকোন লোককে কুকুরের মত খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠত। কিন্তু বৈদ্যজীর ঘরের কেউ, এমনকি একটা কুকুরও যদি হয়, শনিচর তার সামনে ল্যাজ নাড়াতে থাকবে। কথা হল, বৈদ্যজীর ঘরে কোন কুকুর নেই আর শনিচরেরও পেছনে ল্যাজ নেই।

যা কিছু শহরের তাতেই ওর কৌতূহল। তাই রঙ্গনাথকে নিয়েও ওর খুব উৎসাহ; রঙ্গনাথ এলেই শনিচর তার আশপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। আজকেও তার ব্যতিক্রম হল না।বৈদ্যজী গেছেন ডায়রেক্টর্সের বৈঠকে , দোরগোড়ায় শুধু দু’জন—রঙ্গনাথ এবং শনিচর। সূর্য ডুবছে, শীতের সন্ধ্যায় সবার ঘর থেকে যে ঝাঁঝালো ধোঁয়া কুন্ডলি পাকিয়ে ওঠে ছাতের উপরের আকাশকে ভারি করে তারও ব্যতিক্রম হয়নি।

রাস্তা দিয়ে কেউ খট খট করে যাচ্ছে। বিকলাঙ্গদের নিয়ে আমাদের মনে যে সাত্ত্বিক ঘৃণা জমে থাকে সেটা পিচ করে বাইরে ফেলে শনিচর বলল- ‘শালা লঙরবা (ল্যাংড়া) চলল’। কথাটা বলে ও ব্যাঙের মত লাফ মেরে বাইরের রোয়াকে এসে থ্যাবড়া মেরে বসে পড়ল।

রঙ্গনাথ আওয়াজ দিল—লঙ্গড় হো ক্যা?

ওকিছুটা এগিয়ে গেছল। ডাক শুনে থেমে পেছনে মুড়ে জবাব দিল—হাঁ বাপু; লঙ্গড়ই বটি।

-দলিলের ‘নকল’ পেলে?

রঙ্গনাথের প্রশ্নের উত্তর এল শনিচরের কাছ থেকে।

-আর নকল? ওর ভাগ্যে এবার শিকে ছিঁড়বে। সেটা কড়িকাঠ থেকে টাঙিয়ে তাতে খোঁড়া পা’ ঝুলিয়ে উনি দোল দোল দুলুনি করবেন।

এসব কথায় লঙ্গরের কোন হেলদোল নেই। ওখান থেকে চেঁচিয়ে বলল- নকল পাইনি বাপু, আজ নোটিস বোর্ডে ‘আপত্তি’ লটকেছে।

--হলটা কী? ফের ফীস কম পড়েছিল?

--ফীসটিস নয়, এবার আমার মামলার মূল কাগজে অনেক ভুল বেরিয়েছে। ঠিকানায় ভুল, আবেদনকারীর দস্তখত ভুল জায়গায়, তারিখের দুটো সংখ্যা মিশে গেছে ,একটা জায়গায় কাটাকুটি, তাতে দস্তখত নেই-এইরকম অনেকগুলো ভুল।

রঙ্গনাথ বলল, ‘এই দফতরের কর্মচারিগুলো হাড় বজ্জাত, খুঁজে খুঁজে যত্ত ফালতু আপত্তি’!

লঙ্গড় এবার এমন বক্তিমে ঝাড়ল যেন গান্ধীজি প্রার্থনাসভায় বোঝাচ্ছেন—ইংরেজকে ঘৃণা করা ঠিক নয়।

-না বাপু!দফতরের লোগগুলোর কোন দোষ নেই, ওরা তো ওদের কাজ করেছে। যত গণ্ডগোল আর্জিনবিসের আর্জি লেখায়। আসলে আজকাল বিদ্যাচর্চা লোপ পাচ্ছে।নতুন নতুন ছোকরাগুলো এসে ভুলে ভরা আর্জি বানাচ্ছে।

রঙ্গনাথের মন সায় দিল যে বিদ্যার লোপ হচ্ছে, কিন্তু লঙ্গড়ের বলা কারণটা ওর হজম হলনা। ও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু লঙ্গড় মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে জোরগলায় চেঁচিয়ে বলল- কোই বাত নহী বাপু, কাল দরখাস্তটা ঠিক করিয়ে নেব।

তারপর ও একপায়ে খটখটিয়ে এগিয়ে গেল।এসে শনিচর মাথা নেড়ে বলল,’ ‘কোত্থেকে যে যত বাঙ্গড়ু এসে এই শিবপালগঞ্জে জোটে’!

রঙ্গনাথ ওকে বোঝাল যে সবজায়গার এক হাল।এই দিল্লির কথাই ধর।

এবার ও শনিচরকে দিল্লির কিসসা শোনাতে লাগল। ভারতীয়দের বুদ্ধি যেমন ইংরেজদের জানলা দিয়ে দুনিয়ার খোঁজ পায়, তেমনই শনিচর রঙ্গনাথের জানলা দিয়ে দিল্লির খোঁজখবর নিতে লাগল। ওরা দু’জন খানিকক্ষণ এতেই মজে রইল।

আঁধার নামছে, কিন্তু এতটা ঘন হয়নি যে চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষ ও পশুর তফাৎ বোঝা যাবেনা। বৈদ্যজীর বৈঠকখানায় একটা লণ্ঠন টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে।সামনের রাস্তা দিয়ে তিন নবযুবক হা-হা করে হাসতে হাসতে চলে গেল।ওদের কথাবার্তায় কিছু শব্দ- যেমন ‘দুকুরবেলা’,’ফান্টুস’, ‘চকাচক’, ‘তাস’ ও ‘পয়সাকড়ি’- এমনভাবে ঘুরে ফিরে আসছিল যেন প্ল্যানিং কমিশনের মিটিংযে ‘ইভ্যালুয়েশন’,‘কোঅর্ডিনেশন’,’ডাভটেলিং’ অথবা সাহিত্যিকদের বৈঠকে ‘পরিপ্রেক্ষিত’,’জনগণ’, ‘যুগচেতনা’ বা ‘সন্দর্ভ’ ইত্যাদি শোনা যায়। ওই তিন যুবক কিছু একটা বলতে বলতে বৈঠকখানার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।শনিচর বলল- বদ্রীভাইয়া এই জানোয়ারগুলোকে কুস্তি শেখায়। বুঝুন, এসব হল বাঘের হাতে বন্দুক তুলে দেয়া। এই শালাদের ঠেলায় এখনই ভদ্দরলোকদের রাস্তায় বেরনো দায়; এরপরে কুস্তির দাঁওপ্যাঁচ শিখলে তো অন্যদের গাঁ ছেড়ে চলে যেতে হবে’।

আচমকা একটা বিচ্ছিরি রকমের অট্টহাসি -- ওই তিনজনের গলা থেকে।

সবশ্রেণীর মানুষেরই হাসি ও অট্টহাসির আলাদা আলাদা স্টাইল আছে।কফিহাউসে সমাসীন সাহিত্যিকদের হাহা শরীরের নানান জায়গা থেকে বেরোয়। কারও পেটের গভীর থেকে, তো কারও গলা বা মুখগহ্বর থেকে। ওদের মধ্যে এক-আধজন এমনও থাকে যে বসে বসে খালি ভাবে—সবাই হাসছে কেন? আবার অফিসারকুল যখন ডিনারের পরে কফিতে চুমুক দিয়ে যে হাসি হাসেন, তার জাতই আলাদা। ওই হাসির উৎসস্থল পেটের গহনে একদম নাভিমূলে। ওই হাসির ওজনের সঙ্গে সাধারণ হাসির তুলনা করা মানে ওনাদের মাইনের সঙ্গে আসল আমদানিকে দাঁড়িপাল্লার দুদিকে তোলা।রাজনীতির কারবারিদের হাসি বেরোয় মুখের থেকে মেপেজুকে। এই হাসি কেমন ফাঁপা এবং দ্বিমাত্রিক। মানে হাসির দৈর্ঘ্য-প্রস্থ রয়েছে কিন্তু গভীরতা নদারদ।ব্যবসাদারেরা প্রায়শঃ হাসে না। যদি হাসে তাও এমন সূক্ষ্ম ও সাংকেতিক ভাষায় যে মনে হয় ব্যাটা ইনকাম ট্যাক্স দেয়ার ভয়ে হাসির আসল স্টক লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু এই নবযুবকদের অট্টহাসি আলাদা জাতের, এ হাসি ক্ষমতার দম্ভের। এ হাসির আওয়াজ মানুষের গলা থেকে বেরোয়, কিন্তু মনে হয় মোরগ, ভাম বা ঘোড়ার গলা থেকে আসছে।

ওই হাহা-হাহা শুনতেই শনিচর ধমকে উঠল- এখানে দাঁড়িয়ে কী ছিঁড়ছ? যাও, কেটে পড়।

ছেলেগুলো ওদের হাসির পকেট-বুক এডিশন বের করল, তারপর কেটে পড়ল।এমন সময় অন্ধকারে এক নারী লালটিনেরচজ মলিন আলোয় এলোমেলো ছায়া ফেলে ছমছম করে চলে গেল। যেতে যেতে ও বিড়বিড় করছিল যে সেদিনের ছোকরাগুলো, যাদের ও ন্যাংটোপুঁটো দেখেছে, আজ ওর সঙ্গে প্রেম করতে চায়! এইভাবে মহিলাটি গোটা পাড়ায় খবরটা চাউর করে দিল যে আজকালকার ছোকরাগুলো ওকে লাইন মারে এবং ওর এখনও লাইন মারার বয়েস রয়েছে। তারপর ঘনিয়ে আসা অন্ধকারে গায়েব হয়ে গেল। শনিচর টিপ্পনি কাটল,’ ব্যাটা কানা না জানে কোত্থেকে এই কুত্তিটাকে জুটিয়েছে, যখন রাস্তা দিয়ে যায় কেউ না কেউ ঠিক ওকে আওয়াজ দেয়’।

এই গাঁয়ে ‘কানা’ বোলে তো পন্ডিত রাধেলাল। ওর একটা চোখ অন্যটির চেয়ে ছোট, তাই ‘গঁজহা’র দল ওকে কানা বলে ডাকে।

আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য হল- এক হিসেবে আমাদের সবকিছুই প্রাচীন ঐতিহ্য—কেউ বাইরে, মানে অন্য রাজ্যে, যাবে তো কথায় কথায় বিয়ে করে নেবে। অর্জুনের সঙ্গে চিত্রাংগদা আদি উপাখ্যানে তাই হয়েছিল। ভারতবর্ষের প্রবর্তক রাজা ভরতের পিতা দুষ্যন্তের সঙ্গেও তাই। যারা আজকাল ত্রিনিদাদ কি টোবাগো, বর্মা কি ব্যাংকক যাচ্ছে তাদের সঙ্গেও ঠিক ওইসব হচ্ছিল। এমনকি আমেরিকা বা ইউরোপে গেলেও একই হাল। সেই হাল হল পন্ডিত রাধেলালের। অর্থাৎ যে ব্যাটা নিজের পাড়ায় থাকতে নিজেদের সমাজের এক ইঞ্চি বাইরে বিয়ে করার কথায় ভির্মি খায়, যেই সে দেশের বাইরে পা রাখে অমনই বিয়ের ব্যাপারে কেশর ফোলানো সিংহ হয়ে ওঠে।দেবদাস নিজের পাড়ার মেয়ে পার্বতীকে বিয়ে করার হিম্মত জোটাতে পারল না, উলটে একটা গোটা প্রজন্মের জন্যে কান্নাকাটির মশলা ছেড়ে গেল। ওকে যদি একবার বিলেত পাঠিয়ে দেয়া যেত, তাহলে ও নি;সংকোচে কোন ফর্সা মেম বিয়ে করে ফেলত। দেশের বাইরে গেলে আমরা হরদম যা করি সেটা হল প্রথমেই কাউকে বিয়ে করে ফেলা এবং তারপর ভাবতে বসা যে এই বিদেশ- বিভুঁইয়ে কী করতে এসেছি যেন? লোকে বলে যে পন্ডিত রাধেলালও একবার পূবদেশে গিয়ে কিছু করবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু একটা মাসও কাটল না—উনি ওই ‘কুত্তি’কে বিয়ে করে শিবপালগঞ্জে ফিরে এলেন।

একবার পূর্বাঞ্চলের কোন জেলায় একটা চিনির কলে পন্ডিত রাধেলালের চাকরি পাওয়ার জোগাড় দেখা যাচ্ছিল। চৌকিদারের চাকরি। উনি গিয়ে আরেকজন চৌকিদারের ঘরে থাকতে লাগলেন। তখন পন্ডিত রাধেলালের বিয়ে হয়নি। এদিকে ওঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল মেয়েছেলের হাতের রান্না খেতে না পাওয়া। সাথী চৌকিদারের স্ত্রী কিছুদিনের জন্যে এই সমস্যার সহজ সমাধান করে দিয়েছিলেন।রাধেলাল ওদের বাড়িতে শুতে এবং দু’বেলা খেতে লাগলেন।একটি বিশ্বপ্রসিদ্ধ প্রবাদ আছে যে নারী উদরের গলিপথ ধরে পুরুষের হৃদয়ে প্রবেশ করে।ওই নারীও রাধেলালের পেটে সিঁধ কেটে শনৈঃ শনৈঃ ওর হৃদয়ের দিকে গুটি গুটি এগোতে লাগলেন। ওই মহিলার হাতের রান্না রাধেলালের এত ভাল লাগল এবং মহিলাটি নিজের হাতে ওর পেটের মধ্যে খোঁড়া সিঁধে এমন ফেঁসে গেলেন যে একমাসের মধ্যে মহিলাটিকে রাধেলাল নিজের খাবার বানাতে শিবপালগঞ্জে নিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। চলে আসার সময় আগের বাড়ি থেকে বছর-দু’বছরের ঘরে বসে খাওয়ার মত রসদও সঙ্গে করে নিয়ে এলেন। ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর চিনি মিলের এলাকার লোকজন ভাবল—রাধেলালের বন্ধু চৌকিদারটি এক্কেবারে ভোঁদাই।এদিকে শিবপালগঞ্জের লোকজন বলল—রাধেলাল হল মরদ কা বেটা! তার আগে ওই এলাকার লোকজন রাধেলালকে চিনত ‘কখনও জব্দ না হওয়া সাক্ষী’ হিসেবে, এখন চিনল ‘কখনও সুযোগ ফস্কাতে না দেওয়া মরদ’ হিসেবে। রাধেলাল এভাবে বিখ্যাত হয়ে গেল।

অবশ্যি, ওই ‘কখনও জব্দ না হওয়া সাক্ষী’ খ্যাতিটিই রাধেলালের জীবিকার পুঁজি। ও নিরক্ষর এবং সাক্ষরের আলোআঁধারিতে আদালতে দাঁড়িয়ে অম্লানবদনে “আমি লেখাপড়া শিখিনি” অথবা ‘ খালি দস্তখত করতে পারি’ গোছের কোন একটা দরকারমত বলতে পারে।কিন্তু দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনকানুনের এমন প্রখর জ্ঞান যে ও যেকোন মামলার সাক্ষী হয়ে যেকোন পক্ষের হয়ে বয়ান দিতে পারে। কোন উকিল আজ অব্দি ওকে জেরা করে জব্দ করতে পারেনি। যেভাবে যেকোন জজ তার এজলাসের যেকোন মামলার রায় দিতে পারে, যেকোন উকিল যেকোন মামলার ওকালত করতে পারে ঠিক তেমনই পন্ডিত রাধেলাল যেকোন মামলার ‘আই-উইটনেস’ হতে পারে। সংক্ষেপে, মোকদ্দমাবাজির শৃংখলে জজ, উকিল, পেশকার, মুহুরির মত রাধেলালও একটি অনিবার্য গাঁট। আর যে ইংরেজি আইনের মোটরগাড়িতে চড়ে আমরা বড় গর্বের সঙ্গে ‘রুল অফ ল’ বলে চেঁচাই, তার চাকার ‘টাইরড’ হল রাধেলাল এবং সেই সুযোগে ও আইনের শাসনের গতিকে ইচ্ছেমত এদিক-সেদিক করে। একবার যখন এজলাসে দাঁড়িয়ে ও ‘মা গঙ্গার দিব্যি, ঈশ্বরের দিব্যি-যাহা বলিব, সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না’ বলে শপথ নেয়, তখন বিরোধী পক্ষ থেকে ম্যাজিস্ট্রেট অব্দি বুঝে যায় যে আর যাই হোক, ও সত্যি বলতে আসেনি। কিন্তু বুঝে হবেটা কি কচুপোড়া, ফয়সালা তো বুঝদারিতে হবেনা, আইন মোতাবেক হবে। অথচ পন্ডিত রাধেলালের জবানবন্দী শুনতে যাই মনে হোক, আইনের বিচারে একদম নিখাদ।

রাধেলালের সম্মান যেমনই হোক, ওনার প্রেয়সীর ব্যাপারে গাঁয়ের হিসেব একদম স্পষ্ট। ও স্বামীকে ছেড়ে পালিয়ে এসেছে, অতএব ‘কুত্তি’। লোকেরা ওকে আওয়াজ দিতে পারে, কারণ সবার বিশ্বাস ওর আওয়াজ খেতে ভাল লাগে। শিবপালগঞ্জের ছোঁড়াদের কপাল ভাল যে কুত্তিটাও ওদের নিরাশ করেনি।সত্যিই ওর লাইন মারা বা আওয়াজ খাওয়া খুব ভাল লাগত, তাই আওয়াজের পালা চুকলে ওর গালির ফোয়ারা ছুটত। আর গালাগাল তো ‘গঞ্জহা’দের অভিব্যক্তির সবচেয়ে জনপ্রিয় শৈলী।

শনিচর এবার রঙ্গনাথকে রাধেলালের কিসসাটা বেশ নাটকীয়ভাবে শোনাচ্ছিল।তখনই ওই তিনটে ছোঁড়ার একজন এসে বৈঠকখানার দরজায় দাঁড়িয়ে পড়ল। খালি গা’, শরীরময় আখাড়ার মাটি, ল্যাঙ্গোটের পট্টি কোমর থেকে পা’ পর্য্যন্ত হাতির শুঁড়ের মত দোলা খাচ্ছে। এদানীং শিবপালগঞ্জে যেসব ছোকরা ল্যাঙোট পরে চলাফেরা করে তাদের মধ্যে এই স্টাইলটাই বেশ জনপ্রিয়। শনিচর প্রশ্ন করল,’ কী ব্যাপার ছোটে পালোয়ান’?

পালোয়ান শরীরের জোড়গুলিতে দাদ চুলকোতে চুলকোতে বলল,” আজ বদ্রীভাইয়াকে আখাড়ায় দেখলাম না যে? কোথায় টপকেছে”?

-‘টপকাবে কেন, এদিক সেদিক কোথাও হবে’।

-‘ গেছে কোথায়’?

‘ইউনিয়নের সুপারভাইজার ট্রাকে গমের বস্তা ভরে গায়েব হয়ে গেছে। সেই নিয়ে ইউনিয়নের মিটিং চলছে। বদ্রীও ওখানেই হবে’।

পালোয়ান নিতান্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে চাতালে পিচ করে থুতু ফেলল।‘বদ্রীভাইয়া মিটিংযে বসে কি ডিম পাড়বে? সুপারভাইজার ব্যাটাকে পাকড়ে এক ধোবিপাট আছাড় দিত, তাতেই শালার দম বেরিয়ে যেত। মিটিং শিটিং করে হবেটা কী’?

রঙ্গনাথের কথাটা মনে ধরল। বলল,’তোমাদের এখানে মিটিংযে বুঝি ডিম পাড়ে’?

পালোয়ান এপাশ থেকে কোন প্রশ্ন আসবে ভাবেনি। জবাবে বলল,’ডিম পাড়বে নাতো কি বাল ছিঁড়বে? সবাই মিটিংযে বসে রাঁড়ের মত কাঁও কাঁও করবে আর আসল কামকাজের বেলায় খুঁটি জাপ্টে ধরবে’।

হিন্দিভাষার বাগধারার এই রূপের সঙ্গে রঙ্গনাথের বিশেষ পরিচয় ছিলনা। ও ভাবল, লোকজন খামোকাই আফশোস করে যে আমাদের ভাষায় মজবুত শক্তিশালী শব্দের নিতান্ত অভাব।যদি হিন্দি সাহিত্যের ছাত্রদের চারমাসের জন্যে ছোটে পালোয়ানের মত আখাড়ায় পাঠানো হয়, তাহলে কিছু ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও ওরা ওখানকার মাটির ছোঁয়ায় এ’ধরণের শব্দকোষ গড়ে তুলবে।শনিচর এবার ছোটে পালোয়ানের দিকে সম্ভ্রমের চোখে দেখে ভাল করে আড্ডা দেয়ার মতলবে ভেতরে ডেকে নিল—‘ভেতরে এস পালোয়ান’।

“বাইরে কি মাথায় বাজ পড়ছে? আমি এখানেই ফিট’। তারপর ছোটে পালোয়ান একটু আত্মীয়তা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল,’ তোমার কেমন চলছে রঙ্গনাথ গুরু’?

রঙ্গনাথ নিজের ব্যাপারে ছোটে পালোয়ানের সঙ্গে বেশি কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। দু’বেলা দুধ-বাদামে সাঁটিয়ে আখড়ায় কুস্তির গল্প কফি হাউসে খুব একটা পাত্তা পায়না। কিন্তু ছোটে পালোয়ান এই নিয়ে একটা গোটা রাত কাবার করে দিতে পারে। রঙ্গনাথ বলল,’আমি তো একদম ফিট, এবার তোমার হালচাল শোনাও। সুপারভাইজার ব্যাটার হঠাৎ গম বেচে দেয়ার কি দরকার পড়ল’?

ছোটে পালোয়ান ফের তাচ্ছিল্যের সঙ্গে চাতালের উপর থুতু ফেলল, ল্যাঙোটের ঝুলন্ত পট্টি কষে বাঁধল এবং এইসব ব্যর্থ চেষ্টার মাধ্যমে এটা বোঝাতে চাইল যে ও ন্যাংটো নয়। এভাবে ও রঙ্গনাথের সমপর্যা্য়ে এসে বলল-আরে গুরু, ওর হাল হল ‘পোঁদে নেই ইন্দি, ভজরে গোবিন্দি’। লক্ষনৌ শহরে দিনরাত ফুট্টূফৈরি করে বেড়াত; বিনা মশলা কিসের ফুট্টূফৈরি, কিসের ইন্টূমিন্টু? গম বেচবে না তো কী?

--এই ফুট্টূফৈরি কী জিনিস?

পালোয়ান হেসে ফেলল।‘ফুট্টূফৈরি শোননি?ওই শালার শালা বড় মাগীবাজ। তা’ মাগীবাজি কি ছেলের হাতের মোয়া? বড় বড় মানুষের পেছন ফেটে যায়।জমুনাপুরের জমিদারী এতেই ছারখার হয়ে গেছল’।

দেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা যায় ইংরেজি ফিলিম দেখতে। ইংরেজি ডায়লগ বুঝতে পারেনা তবু মুচকি মুচকি হেসে দেখাতে চায় খুব বুঝেছে আর সিনেমাটা বেশ হাসির।অজ্ঞতা ঢাকতে রঙ্গনাথও তাই করছিল। পালোয়ান বলে চলেছে, ‘ আমি এই রামস্বরূপ সুপারভাইজারের নকশাবাজি গোড়া থেকেই বুঝে গেছলাম। বদ্রী পালোয়ানকে তখনই বলেছিলাম, ওস্তাদ, এ ব্যাটা লক্ষনৌ যায় মাগীবাজি করতে।তখন তো বদ্রী ওস্তাদেরও বিশ্বাস হয়নি।বলেছিল- বেশি টিক টিক করিস না ছোটু। শালা কাঠ খাবে তো আঙরা হাগবে।

এখন দেখ, কাঠও খাওয়া হল, আবার ট্রাকভর্তি গম উড়িয়ে নিয়ে গেল। গোড়াতে তো বৈদজী মহারাজও ধামাচাপা দিচ্ছিলেন।এখন জোয়ারের গু’ ভেসে উঠেছে তো সবাই ইউনিয়ন অফিসে বসে ফুসুর ফুসুর করছে। শুনছি, প্রস্তাব পাশ করবে। প্রস্তাব না ঘোড়ার ডিম!ফসল-গুদামের সারা ফসল তো রামস্বরূপ ফাঁক করে দিয়েছে। এখন প্রস্তাব পাশ করে ওর কি ছেঁড়া যাবে’?

রঙ্গনাথ—বদ্রীকে খামোখা বলেছিলে। তখন যদি বৈদ্যজীকে গিয়ে খুলে বলতে তাহলে উনি সেদিনই সুপারভাইজারকে ওখান থেকে সরিয়ে দিতেন।

‘আরে গুরু, আমার মুখ খুলিওনা। বৈদ্যজী তোমার মামা, আমার কী? আমার বাপ তো নয়। সত্যিটা যদি ঠূঁসে দিই তো তোমার কলজেতে গিয়ে চোট লাগবে’।

শনিচর বাধ দিল,‘ছোটু পালোয়ান, খুব যে রঙবাজি ঝাড়ছ, ভালকরে ভাঙ চড়িয়ে এসেছ মনে হচ্ছে’?

‘ বেটা, রঙবাজির কথা নয়, আমার তো একেকটা রোঁয়া জ্বলছে।সব্বার লেজ তুলে দেখ, খালি মাদী আর মাদী।বৈদ্য মহারাজের ব্যাপারে আমাকে জিজ্ঞেস না করলেই ভাল।ওর হিসেবের খাতা খুলে বসলে সমানে গরম ভাপ বে্রোতে থাকবে।সামলানো মুশকিল হবে।এই রামস্বরূপ এতদিন বৈদ্যজীর মুখে মুখ, তিনরকমের কথাবার্তা। আজ যখন দু’গাড়ি গমের বস্তা ভরে গায়েব হয়ে যেতেই দু’দিন ধরে টিলটিল করছেন!আমিও ইউনিয়নের সদস্য, বলেছিলেন মিটিনে এসে প্রস্তাবের পক্ষে হাত তুলে দিও।বললাম-আমাকে হাত-টাত তুলতে বোল না মহারাজ।একবার যদি হাত তুলি তো লোকজনের পিলে চমকে যাবে। হাঁ, ওই ব্যাটা রামস্বরূপ রোজ শহরে চসর-পসর করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথায় ওকে ধরে এনে লালবাড়িতে আটকে রাখার ব্যবস্থা হবে, তা না, প্রস্তাব পাশ কর। বদ্রী উস্তাদ রেগে কাঁই, কিন্তু করবেটা কি, নিজেরই বাপ।যদি কাপড় খুলে উরুত দেখাও তো লাজ, আবার ওটা খুলে দেখাও তো লাজ’।

এবার বৈঠকখানার সামনের দিকে লোকজনের আগমনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে।চাতালে খদ্দরের ধুতিপাঞ্জাবি ও তিরছে টুপি পরা সৌম্যদর্শন বৈদ্যজী মহারাজের আবির্ভাব হল। পেছন পেছন কয়েকজন ভক্তবৃন্দ, সবার পেছনে বদ্রী পালোয়ান। দেখামাত্র ছোটে এগিয়ে এল,’ওস্তাদ, একটা জবরদস্ত ফান্টুশ মামলা।বলব বলে তখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি’।

‘দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রোগা হয়ে গেলে নাকি? মামলাটা কী ঝেড়ে কাশো’।

এভাবে শিষ্যের অভর্থনা করে গুরুশিষ্য চাতালের আরেক কোণে গিয়ে নিজেদের মধ্যে গভীর আলোচনায় ডুবে গেল।

বৈদ্যজী জনাচার-পাঁচ চ্যালাকে নিয়ে বৈঠকখানার ভেতরে গেলেন। একজন আরাম করে এমন এক লম্বা শ্বাস টানল যা ফোঁপানিতে শেষ হল।আরেকজন তক্তপোষে গুছিয়ে বসে এক লম্বা হাই তুলল যে ওটা ধীরে ধীরে বদলে গেল তীব্র সিটির আওয়াজে। বৈদ্যজীও কম যান না। উনি তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে টুপি আর কুর্তা খুলে এমন কায়দায় তক্তপোষের অন্য মাথায় ছুঁড়ে ফেললেন যেন কোন বড় গায়ক লম্বা তানের শেষে সমে ফিরল। বোঝা গেল যে সবাই কোন বড় কাজ সেরে ক্লান্ত হয়ে গা’ এলিয়ে দিয়েছেন। শনিচর বলল,’মহারাজ কি খুব ক্লান্ত? তাহলে আর একবার (ভাঙের)’শরবত ছেঁকে দিই’?

বৈদ্যজী কিছু বলেননি, কিন্তু ইউনিয়নের এক ডায়রেক্টর বললেন- দ্বিতীয় নম্বর তো মিটিংয়ের মাঝখানেই হয়ে গেছ। এবার বাড়ি যাওয়ার নম্বর।

এতক্ষণ বৈদ্যজী চুপচাপ বসে অন্যদের কথা শুনছিলেন।এই ওনার অনেক পুরনো অভ্যেস। কারণ উনি অনেক আগে শিখেছিলেন—যে ব্যক্তি নিজে কম খেয়ে অন্যদের বেশি করে খাওয়ায়, নিজে কম বলে অন্যদের বেশি বলতে দেয়, সেই কম বোকা বনে অন্যদের বেশি করে বোকা বানায়।হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে বলে উঠলেন—রঙ্গনাথ, তুমি কী বল?

যেভাবে বৈদ্যজী ব্যাপারটা কী সেটা খোলসা না করে রঙ্গনাথের অভিমত জানতে চাইলেন, সেও সেই ভাবে ব্যাপারটা কী সেটা না বুঝে ও বলে উঠল—আজ্ঞে যা হয়, সেটা ভালর জন্যেই হয়।

বৈদ্যজী গোঁফের ফাঁকে মুচকি হেসে বললেন- তুমি ঠিকই বলেছ। বদ্রী গোড়ায় প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ছিল, শেষে ও চুপ মেরে গেল। প্রস্তাব সবার সমর্থনে পাশ হয়ে গেল। যা হল তা’ ভালর জন্যেই হল।

রঙ্গনাথের খেয়াল হল যে খামোকা নিজের রায় জাহির করে ফেলেছে। এবার ও একটু উৎসুক হয়ে জানতে চাইল—আপনারা কোন প্রস্তাব পেশ করেছিলেন?

‘আমরা প্রস্তাব- সুপারভাইজার আমাদের যে আটহাজার টাকার ক্ষতি করেছে তার ভরপাই করতে সরকার আমাদের অনুদান দিক’।

এমন যুক্তি শুনে রঙ্গনাথের মাথা ঘুরে গেল।

--‘সরকারের কী মাথাব্যথা?তছরূপ করবে আপনার সুপারভাইজার আর খেসারত দেবে সরকার’?

-‘নইলে কে দেবে?সুপারভাইজার তো গা’ঢাকা দিয়েছে।আমরা পুলিশে খবর দিয়েছি। এখন সরকারের দায়িত্ব। আমাদের হাতে কিস্যু নেই। যদি থাকত, তাহলে সুপারভাইজারকে ধরে এনে ওর থেকে গমের দাম পাইপয়সা আদায় করে ছাড়তাম। এখন যা করার সরকার করুক। হয় ওকে বন্দী করে আমাদের সামনে পেশ করুক, নয় অন্যকিছু করুক। যাই হোক, যদি সরকার চায় যে আমাদের ইউনিয়ন বেঁচে থাকুক এবং জনগণের কল্যাণ করুক তাহলে আমাদের অনুদান দিক। নইলে ইউনিয়ন পথে বসবে।আমরা আমাদের যা করবার করে দিয়েছি, এবার সরকারের পালা। ওরা কত অপদার্থ, তাও আমার ভালই জানা আছে’।

বৈদ্যজী এমন নিখুঁত যুক্তি সাজাচ্ছিলেন যে রঙ্গনাথের মাথার ঘিলু নড়ে গেল। উনি বারবার কিছু শব্দ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আওড়াচ্ছলেন, যেমন ‘সরকারের অকর্মণ্যতা’, ‘জনগণের কল্যাণ’, ‘দায়িত্ব’ ইত্যাদি। রঙ্গনাথ বুঝতে পারল যে ওর মামা পুরনো প্রজন্মের বটে, কিন্তু নতুন প্রজন্মের পছন্দের ভাষা ভালই রপ্ত করেছেন।

বদ্রী পালোয়ান ছোটে পালোয়ানের সঙ্গে পরামর্শ সেরে ফিরে এসেছে।বলল,’রামাধীনের বাড়িতে ডাকাতি হয়নি, তবে এদিক ওদিক কিছু ছিঁচকে চুরির খবর আসছে।

পালোয়ান বাবার সামনে একটু সামলে সুমলে কথা বলে। এই কথাগুলো ও এমনভাবে বলল যেন ছোটের সঙ্গে এতক্ষণ এই আলোচনাই হচ্ছিল যা বাবাকে জানিয়ে দেওয়া ওর পরম কর্তব্য।

বৈদ্যজী বললেন,‘চুরি! ডাকাতি! সর্বত্র এই খবর। দেশ রসাতলে যাচ্ছে’।

বদ্রী পালোয়ানের যেন এসব কথা কানে যায়নি।একজন হেলথ ইন্সপেক্টর যেভাবে জনসাধারণকে কলেরা নিবারণের উপায় বোঝায় তেমনই ভাবে বলল, ‘গোটা গাঁয়ে এখন খালি চুরির চর্চা। আমাদের জেগে ঘুমোতে হবে’।

শনিচর লাফিয়ে উঠে নিজের জায়গা বদলে বদ্রীকে জিজ্ঞেস করল, ‘জেগে আবার ঘুমোয় কী করে পালোয়ান’?

বদ্রী কড়াস্বরে বলল,‘টিকির টিকির করবে না তো! আজকে ইয়ার্কি-ফাজলামি ভালো লাগছে না’।

তারপর ও অন্ধকারে চাতালের কোণায় গিয়ে ছোটে পালোয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল।
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in






৩৬

অল্পবয়সী যে মহিলাটি টেবিলে বসেছিল, সে ফাইনহালসের দিকে মুখ তুলে তাকাল। ফাইনহালস লক্ষ্য করল যে ওই মহিলার হাতের আঙুলগুলো ভারি সুন্দর, সরু সরু এবং মাটিতে থেবড়ে বসে মেঝের ভাঙা টালির উপর দিয়ে যে বাচ্চাটা নিজের খেলনাগাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, তার হাতও অমন সাদাটে, সরু সরু। ছোট ঘরটার মধ্যে কেমন যেন ভ্যাপসা ধোঁয়া ধোঁয়া তেলমশলা মেশানো রান্নার গন্ধ। দেওয়ালে চার দিকে রান্নার কড়াই, বাসনপত্র ঝোলানো, সাজানো।

যে বয়স্ক পুরুষটি ঘরের জানালার কাছে একটা চেয়ারে বসে বাইরে উঠোনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, ঘরের দু’ জন মহিলাই মুখ ফিরিয়ে এবার তার দিকে তাকালো। সেই মানুষটি একটা চেয়ারের দিকে আঙুল দেখিয়ে ফাইনহালসকে বললেন, ‘প্লিজ বসুন!’

ফাইনহালস বয়স্ক মহিলার পাশের চেয়ারে বসে। সে বলতে থাকে… ‘আমার নাম ফাইনহালস। আমার বাড়ি ভাইডেসহাইমে। আমি বাড়ি ফিরছিলাম…’

দু’ জন মহিলা পরস্পরের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। বয়স্ক পুরুষটি নড়েচড়ে বসে।

তাকে উজ্জীবিত দেখায়… -‘ফাইনহালস… ভাইডেসহাইম থেকে… ইয়াকব ফাইনহালসের ছেলে নাকি?’

-‘হ্যাঁ,… কিন্তু ভাইডেসহাইমের খবরাখবর কী?’

বয়স্ক মানুষটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে একগুচ্ছ মেঘের মত ধোঁয়া ছাড়েন পাইপ থেকে… ‘খারাপ নয়। ওরা ঠিকঠাকই আছে। আসলে ওরা অপেক্ষা করছে যাতে আমেরিকানরা এসে ওদের জায়গাটার দখল নেয়। কিন্তু আমেরিকানরা ওই জায়গাটা অবধি যাচ্ছেই না। ওরা এখানে এসে তিন সপ্তাহ ধরে বসে আছে। ভাইডেসহাইম পর্যন্ত আর দু’ কিলোমিটার মাত্র; কিন্তু ওই অবধি গেল না ওরা। শুনেছি ওখানে জার্মানরাও নেই। ফলে ওইটা এখন নেই মানুষের বেওয়ারিশ জমি। কারুর মাথাব্যথা নেই… এই অবস্থাটা অবশ্য বেশিদিন চলতে পারে না।

‘মাঝেমধ্যে শুনতে পাচ্ছি জার্মানরা গুলিগোলা ছুঁড়ছে…’ অল্পবয়সী মহিলাটি বলে ওঠে… ‘কিন্তু খুবই কম শোনা যায়।’

‘হ্যাঁ, শুনতে পাবেন।’ বলে বৃদ্ধ মানুষকে ফাইনহালসের দিকে আগ্রহভরে তাকায়… ‘এখন আপনি কোত্থেকে এলেন?’

‘ওই দিকে, আমরা অপেক্ষা করছিলাম তিন সপ্তাহ ধরে… যে আমেরিকানরা আসবে’

‘রাস্তার ওই পারে?’

‘নাহ, আরেকটু দক্ষিণে- গ্রিনজ্‌হাইমের কাছে।’

‘আচ্ছা, গ্রিন্‌জহাইম। সেখান থেকে এলেন এখন?’

‘হ্যাঁ, রাতে ওইখানেই ছিলাম।’

‘তারপর সেখানে সিভিলিয়ানের পোশাক পরে নিলেন?’

ফাইনহালস মাথা নাড়ে… ‘নাহ, সাধারণ পোশাক আগেই পরেছিলাম। ওরা এখন প্রচুর সৈনিককে ছাঁটাই করছে।’

বয়স্ক মানুষকে শান্তভাবে হাসেন। অল্পবয়সী মহিলার দিকে তাকান… ‘শুনছ, ট্রুড… ওরা নাকি প্রচুর সৈনিককে এখন ছাঁটাই করছে। ওহ, শুনে এখন আর কী বা করবে? হাসবে…’

অল্পবয়সী মহিলাটির আলু ছাড়ান হয়ে গেছে। সে আলুগুলোকে ঘরের কোণে বেসিনে কলের নিচে একটা ঝাঁঝরিযুক্ত পাত্রের মধ্যে মধ্যে রেখেছে। কল খুলে ক্লান্ত হাতে আলুগুলো ধুতে লাগল সে। বয়স্ক মহিলাটি ফাইনহালসের হাত স্পর্শ করল…

‘সত্যিই এখন অনেক মানুষকে ছাঁটাই করছে?’

‘অনেক’ বলে ফাইনহালস… ‘কোনো কোনো ইউনিটে শুনেছি সবাইকে ছাঁটাই করেছে… বাকিরা গিয়ে সব রুর উপত্যকায় জড়ো হচ্ছে। কিন্তু আমি রুরে যাইনি।’

অল্পবয়সী মহিলাটি বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। নিঃশব্দে কাঁদছে সে। সরু কাঁধদুটো কান্নার দমকে কেঁপে উঠছে।

‘নাকি কাঁদবে…’ জানালায় বসে থাকা বয়স্ক পুরুষটি বলে ওঠেন… ‘হাসবে না কাঁদবে!’ ফাইনহালসের দিকে একবার তাকিয়ে আবার হাতের তামাকের পাইপ দিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অল্পবয়সী মহিলার দিকে নির্দেশ করে বলে ওঠে… ‘তোমার স্বামী চলে গেল… আমার ছেলেটা!’ মহিলা ধীরে ধীরে সাবধানে আলুগুলো ধুতে থাকে এবং কাঁদতে থাকে… ‘হাঙ্গেরিতে, গেল বার হেমন্তের পাতা ঝরার সময়ে’ বলে ওঠেন বয়স্ক লোকটি।

‘গ্রীষ্মে, হেমন্তে নয়’… ফাইনহালসের পাশে বসে থাকা বয়স্ক মহিলাটি বলে ওঠেন, ‘ওকে ছেড়ে দেবে শুনেছিলাম, বেশ কয়েক বার ছাড়বার কথা হয়েছিল। ওর তো শরীরটা একেবারেই ভালো ছিল না, খুব কষ্ট করে চালাচ্ছিল। কিন্তু ওকে কিছুতেই ওরা ছাড়ছিল না। ওর উপরে ক্যান্টিনের দায়িত্ব ছিল যে।’ তিনি মাথা নাড়েন, আর অল্পবয়সী মহিলার দিকে তাকান। সে সাবধানে ধোয়া আলুগুলোকে একটা পরিষ্কার কেটলির মধ্যে রেখে বেশ কিছুটা জল ঢালে। সে এখনও কাঁদছে, নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। চুলার উপরে কেটলিটা বসিয়ে এককোণে যায় সে। পোশাকের পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে।

ফাইনহালস বুঝতে পারে যে তার মুখটা ধীরে ধীরে ঝুলে পড়ছে। সে ফিঙ্কের সম্বন্ধে ভাবে না খুব একটা। মাঝেমধ্যে মনে পড়ে মুহূর্তটা। কিন্তু এই মুহূর্তে সে তীব্রভাবে ভাবছে। মনে মনে ভাবতে ভাবতে ওই মুহূর্তগুলো সে আরও পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছে। এতটা পরিষ্কার যখন বাস্তবে ঘটনাটা ঘটেছিল, তখনও হয়তো সে দেখেনি। সেই প্রচণ্ড ভারি স্যুটকেসের মধ্যে হঠাৎ গ্রেনেডের ফুলকি এসে পড়ল, স্যুটকেসের ঢাকনাটা উড়ে গেল, চারদিকে ফোয়ারার মত ওয়াইন ছিটকে পড়ল, উফফ, কাচের ভাঙা টুকরো ছড়াতে লাগল চারদিকে; ফিঙ্কের চেহারাটা যে এত ছোটখাট, সেটা সে খেয়াল করেনি যতক্ষণ না তার শরীরের বিরাট রক্তাক্ত ক্ষতের উপর হাত রেখে পরক্ষণেই সে তার হাতটা সরিয়ে নিয়েছিল…

বাচ্চাটা মেঝের উপরে বসে খেলছিল। ফাইনহালস একদৃষ্টে বাচ্চাটার দিকেই তাকিয়েছিল। মেঝেতে যে জায়গাটাতে টালিটা ভেঙে গেছে, বাচ্চাটা ঠিক সেই জায়গাটা ঘিরে খেলনা গাড়িটা চালিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট জ্বালানি কাঠের টুকরো ওই গাড়িটায় বোঝাই করছে, নামিয়ে রাখছে, আবার বোঝাই করছে। হাতের আঙুলগুলো সূক্ষ্ম, সরু, সরু এবং তার মায়ের মতই ধীরে ধীরে ক্লান্ত ভঙ্গিতে সাবধানী আঙুলের নড়াচড়া শিশুটির। বাচ্চাটির মা এখন টেবিলে এসে বসেছে, মুখের অর্ধেকটা ঢেকে রুমাল দিয়ে চেপে আছে। ফাইনহালসের দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল। একবার মনে হল যে সে বলে ফিঙ্কের মৃত্যুর ঘটনাটা তার চোখের সামনে ঘটেছিল। কিন্তু সে দ্রুত মুখটা বন্ধ করে মাথা নামিয়ে বসে। তারপর চিন্তা করে যে পরে না হয় বলবে। বৃদ্ধ মানুষটিকে বলবে। কিন্তু এখন নয়…

যাই হোক, ফিঙ্ক হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে কী ভাবে হাঙ্গেরিতে গিয়ে পৌঁছালো, সেটা নিয়ে মনে হয় ওদের এখন আর সেরকম কোনো মাথা ব্যথা নেই।

বয়স্ক মহিলাটি আবার তার হাতে স্পর্শ করে… ‘আপনার কী হয়েছে? কিছু খাবেন? শরীর ঠিক আছে তো?’

‘না, আমি ঠিক আছি।’ বলে ওঠে ফাইনহালস, ‘অনেক ধন্যবাদ!’ বয়স্ক মহিলাটির তীব্র দৃষ্টির সামনে তাঁর অস্বস্তি হয়, ‘সত্যিই কিছু খাব না। অনেক ধন্যবাদ!’

‘এক গ্লাস ওয়াইন’ জানলার কাছ থেকে বৃদ্ধ মানুষটি প্রশ্ন করে, ‘কিম্বা শ্নাপ?’

‘হ্যাঁ’ বলে ফাইনহালস, ‘এক গ্লাস শ্নাপ খেতে পারি।’

‘ট্রুড’ ডাকেন বৃদ্ধ মানুষটি, ‘এই ভদ্রলোককে একটা শ্নাপ দাও।’

অল্পবয়সী মহিলাটি টেবিল থেকে উঠে পাশের ঘরে যায়।

‘আসলে আমরা খুব ছোট জায়গায় থাকতে বাধ্য হচ্ছি এখন’… বয়স্ক মানুষটি বলেন ফাইনহালসকে।

‘শুধু রান্নাঘর আর খাবার ঘর’… বলেন বয়স্ক মহিলাটি… ‘তবে ওরা বলছে যে শীগগির বেরিয়ে যাবে এখান থেকে। সঙ্গে অনেক ট্যাঙ্ক আছে। তাছাড়া বন্দিদেরও এই জায়গাটা থেকে অন্যত্র চালান করবে শুনছি।’

- ‘এই বাড়িতে কোনো বন্দি আছে?’

--‘হ্যাঁ’… উত্তর দেন বয়স্ক পুরুষটি… ‘বড় হলঘরে যুদ্ধবন্দিরা আছে। শুধু উচ্চপদস্থ অফিসারদের এখানে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এমনকি এদের মধ্যে একজন জেনারালও আছেন। জিজ্ঞাসাবাদ হয়ে গেলে, এরা চলে যাবে। দেখুন ওদিকে!’

ফাইনহালস জানালায় গিয়ে দাঁড়ায়। বয়স্ক মানুষটি দ্বিতীয় উঠোনের সামনে যেখানে রক্ষীরা পাহারা দিচ্ছে, সেই জায়গাটা ছাড়িয়ে মূল প্রবেশপথের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। ছোট হলঘরটা পেঁচানো কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রাখা।

‘ওই যে, লক্ষ্য করুন’ বলেন বয়স্ক মানুষটি… ‘একজনকে নিয়ে আসা হচ্ছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।’



(চলবে)
0

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(১২)

গোলকপতির খুব ইচ্ছা করছিল যে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে এই অন্যায় সতীদাহ প্রথাটির তীব্র বিরোধিতা করে। কিন্তু একে সে বিদেশি তায় রাজবাড়ির দয়ায় সবেমাত্র কোনওমতে একটা জীবিকার উপায় হয়েছে, সেই অবস্থায় এরকম একটা গন্ডোগোলে জড়িয়ে পড়াটা মোটেও সুবিধের হবে না।

তার একবার মনে হল যে একছুটে মেয়েটিকে উদ্ধার করে নিয়ে কোথাও চলে গিয়ে আবার সংসারী হয়।

পরক্ষণেই তার আবার মনে হল যে নিজের জীবিকাই যেখানে অনিশ্চিত , সেখানে আর একজন জীবনসঙ্গিনীর যোগ্য হয়ে উঠতে গেলেও তার যেটুকু স্থৈর্য্য প্রয়োজন সেটা তার আজও ফিরে আসেনি।

ক'দিন হল রাতে চোখ বুজলেই ও দেখতে পাচ্ছে যে লক্ষ্মীমণির রোগক্লান্ত মুখের অতন্দ্র আঁখিপল্লবদুটি অস্ফূটে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে চাইছে আগামীকালের এক অবধারিত পটপরিবর্তনের ইঙ্গিতসহ পুনর্যাপনের প্রতিশ্রুতিটি।

কিন্তু সমস্যা হল যে এই নারীটি তার সম্পূর্ণ অপরিচিত। বৃদ্ধ স্বামীটির মৃত্যুর পূর্বে সে একজন অচেনা পুরুষের সাথে কূলত্যাগিনী হওয়ার সাহস সে কেন দেখাবে?

.....

হিন্দু রমণীদের কাছে পরপুরুষের কাছে ভ্রষ্টা হওয়ার চেয়ে অগ্নিস্নানে পূণ্যবতী হওয়াটাই তো এতকাল ধরে বাঞ্ছনীয় ও কাম্য হয়ে এসেছে! রাজপুত নারীদের সতী মাহাত্ম্য সম্পর্কিত সব কাহিনি তো এ দেশের গ্রামেগঞ্জেও ভাট মুখে বরাবর প্রচারিত হয়ে এসেছে তাই এ মেয়েটিকে উদ্ধারকর্মের ঈপ্সাটি যেন আকাশকুসুম সদৃশ ভিত্তিহীন বটে।

.........

দ্বারকানাথ এগিয়ে এসে সহাস্যবদনে রামমোহনের ভৃঙ্গারটি থেকে কয়েকটি আখরোট আর বাদাম তুলে নিয়ে বললেন,

" কাল অবধি সতীদাহের বিপক্ষে মাত্র সতের'জন বিশিষ্টের মুসাবিদা যোগাড় করা সম্ভবপর হইয়াছে। শুনিয়াছি পাথুরিয়াঘাটায় আমার জ্ঞাতিভ্রাতাদের এ বিষয়ে এখনো কিছু আপত্তি আছে।

তবে যেহেতু ভ্রাতৃবরের সদ্যজাত পুত্রটির অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানে কাল আমি নিজে উপস্থিত থাকব, তাই আমি আশা করি যে তোমাকে আরও দ্বাদশ সংখ্যক অভিজাত জমিদারের এ বিষয়ে সমর্থনটি স্বাক্ষরিত অবস্থায় এনে দিতেও সক্ষম হব। আবার যখন সপ্তাহান্তে আমি রাণীগঞ্জে দুটি কয়লাখনি ক্রয় করতে যাবো তখন নিকটের মানভূম অঞ্চলে গড় পঞ্চকোটের রাজাটির সহিত সাক্ষাৎ করে এই একই বিষয়ের প্রসঙ্গটি তুলে তাঁহার মতামতটিও জেনে আসব বলে মনস্থ করেছি।শুনছি এই জমিদারেরা বঙ্গালভাষী না হলেও বেশ সজ্জন প্রকৃতির। এই রাজারা বর্তমানে আদিবাসী অধ্যূষিত কাশীপুরে একটি সুরম্য চন্ডী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন ও দরিদ্র প্রজাদের নাকি সপ্তাহান্তে অন্ন-বস্ত্র-অর্থ সবই ওঁদের রাজভান্ডার থেকে সসম্মানে সেবাকর্মের নিমিত্তে দান করে থাকেন। "

....

রামমোহন এবার সপ্রশংস হাসিতে বন্ধুবরের দক্ষিণহস্তের করাঙ্গুলীগুলি নিজের বক্ষে খানিকক্ষণ চেপে ধরে রেখে বললেন,

" লাটসাহেব শর্ত দিচ্ছেন যে এই মুসাবিদাটি আরো পঞ্চদশ সংখ্যক বিশিষ্টজনের স্বাক্ষর সমণ্বিত হলেই উনি স্বয়ং শীতকালীন অধিবেশনে সতীদাহ বিরোধী বিষয়ক পত্রটি পুনরায় বিলাতে প্রেরণ করতে পারবেন।

তবে তুমি যদি নিজের উদ্যমে আজ অবধি যে কয়েকটি সহি সংগ্রহ হয়েছে তাহার সাথে আরো দ্বাদশজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সমর্থন সংগ্রহ করে আনতে পারো তাহলে আমিও নিজের উদ্যোগে তদুপরি আরও সপ্তসংখ্যকটি সমর্থনসূচক স্বাক্ষরের সংগ্রহকার্য্যটিও অবশ্যই সফল হয়ে লাটভবনে পুনরায় হিজ হাইনেস বেন্টিঙ্কের দরবারে যেতে পারব।

তবে যেহেতু আমি পৌত্তলিকতা বর্জন করেছি সেহেতু পাথুরিয়াঘাটাস্থিত উক্ত অনুষ্ঠানভবনে নিমন্ত্রণ পেয়েও এমতাবস্থায় অন্নগ্রহণ করতে পারব না বটে; তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে এখন তুমিও ক্রমে স্বয়ং কালান্তরের সরব তূর্যনিনাদটির যোগ্য হয়ে উঠছ ! আজ যে আমি সত্যি বড় সন্তুষ্ট হে বেরাদর ! "

অতঃপর এই দুই কালান্তরের সেনানায়ক উভয় উভয়কে একটি উষ্ণ ও দৃঢ় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন।
1

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in








শিবপালগঞ্জ গাঁ বটে, কিন্তু বসেছে শহরের কাছালাছি বড় রাস্তার ধারে। অতএব বড় বড় নেতা ও অফিসারকুলের এখানে আসতে কোন নীতিগত আপত্তি হওয়ার কথা নয়। এখানে শুধু কুয়ো নয়, টিউবওয়েলও আছে। বাইরে থেকে দেখতে আসা বড় মানুষেরা তেষ্টা পেলে প্রাণসংশয় না করেই এখানকার জল খেতে পারেন। এইসব ছোটখাট অফিসারের মধ্যে কোন না কোন এমন একজন দেখা দেন যে তাঁর ঠাটবাট দেখে স্থানীয় লোকজন বুঝে যায় যে এ এক্কেবারে পয়লা নম্বরের বেইমান। অথচ ওকে দেখে বাইরের লোকজন নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে—কী ভদ্র, কী ভালো!নিশ্চয় কোন বড় ঘরের থেকে এয়েচে।দেখ না, আমাদের চিকো সায়েব এর সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। ফলে খিদে পেলে এঁরা নিজেদের চরিত্রে কোন দাগ না লাগিয়েও বিনা দ্বিধায় এখানে খেয়ে নিতে পারেন। কারণ যাই হোক, সেবার শিবপালগঞ্জে জননায়ক আর জনসেবক—সবার আনাগোনা বড্ড বেড়ে গেছল। শিবপালগঞ্জের বিকাস ও উন্নয়ন নিয়ে সবার বড্ড চিন্তা। তাই তারা যখন তখন লেকচার দিতে থাকেন।

এই লেকচারপর্বটি গঞ্জহাদের জন্যে ভারি মজার। কারণ এতে গোড়ার থেকেই বক্তা শ্রোতাকে এবং শ্রোতা বক্তাকে হদ্দ বোকা ধরে নেয়। আর এটাই সব গঞ্জহা্দের জন্যে আদর্শ পরিস্থিতি বটে! তবু, লেকচার এত বেশি হলে শ্রোতাদের পক্ষে হজম করা কঠিন হয়ে পড়ে! লেকচারের আসল মজা হল—যখন শ্রোতা বুঝে যায় লোকটা ফালতু বকছে আর বক্তা নিজেও বোঝে যে ও ফালতু বকবক করছে। কিন্তু কিছু লোক এমন গম্ভীর মুখে লেকচার দেয় যে শ্রোতারা সন্দেহ করতে বাধ্য হয় যে লোকটা যা বকছে সেটা নিজে অন্ততঃ বিশ্বাস করে। এ’জাতীয় সন্দেহ হলেই লেকচারটা বেশ গাঢ় এবং পানসে হয়ে যায় এবং শ্রোতাদের পাচনশক্তির ওপর চাপ হয়ে যায়। এইসব দেখেশুনে গঞ্জহার দল যে যার হজম করার ক্ষমতা মেপে ঠিক করে নেয়—কে কখন লেকচার শুনবে। কেউ খাবার খাওয়ার আগে তো কেউ দুপুরের ভোজনের পর। তবে বেশিরভাগ লোক লেকচয়ার শুনতে আসত দিনের তৃতীয় প্রহরের ঝিমুনি থেকে সন্ধ্যাবেলায় জেগে ওঠার মাঝের সময়টুকুতে।

সেসব দিনে গাঁয়ে গাঁয়ে লেকচার দেবার মুখ্য বিষয় ছিল ‘ কৃষি’। তার মানে আগে লেকচারের জন্যে অন্য কোন বিষয় ছিল এমনটা ভাববেন না যেন!আসলে গত কয়েকবছর ধরে কৃষকদের পটিয়ে পাটিয়ে বোঝান হচ্ছে যে আমাদের এই ভারতবর্ষ কিন্তু একটা কৃষিপ্রধান দেশ। গেঁয়ো শ্রোতারা কক্ষণো এ’নিয়ে আপত্তি করেনি।তবে প্রত্যেক বক্তা লেকচারব শুরু করার আগে ধরে নিতেন যে শ্রোতারা নিশ্চয়ই আপত্তি করবে। তাই ওঁরা খুঁজেটুজে একের পর এক নতুন যুক্তি সাজাতেন আর কোমর কষে প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন যে ভারত অবশ্য একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এরপর ওঁরা বলতে শুরু করতেন—চাষবাসের উন্নতি মানেই দেশের উন্নতি।তবে এর পরে আরও কিছু বলার আগেই দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে যেত। তখন ওই শান্ত সুভদ্র অফিসারটি, মানে যে খুব বড়ঘরের ছেলে এবং যার সঙ্গে চিকো সায়েব নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, বক্তার পিঠের কাপড়ে টান মেরে মেরে ইশারায় বলার চেষ্টা করত, চাচাজি, রান্না হয়ে গেছে। কখনও কখনও এমন হতে যে বাকি বক্তারা এর পরের কথাগুলোও বলে ফেলতেন, তখন স্পষ্ট হত যে এনাদের আগের আর পরের বক্তব্যে বিশেষ ফারাক নেই।

ঘুরেফিরে একটাই কথাঃ ভারত একটি কৃষিপ্রধান দেশ আর তোমরা হলে কৃষক। ভাল করে চাষ কর বাছারা, বেশি বেশি ফসল ফলাও। সব বক্তার মনেই একটা সন্দেহের ঘুর্ঘুরে পোকা কুরকুর করত- চাষারা বোধহয় বেশি ফসল ফলাতে চায় না।

লেকচারে যা খামতি থাকত তা’ বিজ্ঞাপনে পুষিয়ে যেত। একদিক দিয়ে দেখলে শিবপালগঞ্জের দেয়ালে লেখা বা সাঁটা বিজ্ঞাপন জনপদটির সমস্যা ও তার সমাধানের সঠিক পরিচয়। উদাহরণ দিচ্ছি, সমস্যাটা হল ভারত এক কৃষিপ্রধান দেশ এবং বদমাশ চাষাগুলো বেশি করে ফসল ফলাতে উৎসাহী নয়। এর সমাধান হল চাষিদের খুব লেকচার দেয়া হোক এবং ভাল ভাল ছবি দেখানো হোক। তাতে মেসেজ দেয়া হবে যে তুমি নিজের জন্যে না হোক, দেশের জন্যে তো ফসল ফলাও!এভাবেই কৃষকদের ‘দেশের জন্যে ফসল উৎপাদন করো’ গোছের পোস্টার দেয়ালে দেয়ালে ভরে গেল। চাষিদের উপর পোস্টার আর ছবির মিশ্রিত প্রভাব এমন হল যে সবচেয়ে সাদাসিদে চাষিও ভাবতে লাগল যে এর পেছনে সরকারের নিশ্চয়ই কোন চাল আছে।

একটা বিজ্ঞাপন তখন শিবপালগঞ্জে সাড়া ফেলে দিয়েছিল যাতে মাথায় কষে বাঁধা গামছা, কানে কুন্ডল, গায়ে মেরজাই একজন হৃষ্টপুষ্ট চাষি বুকসমান উঁচু গমের শীষ কাস্তে দিয়ে কাটছে। ওর পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন বঊ যার ঠোঁটে কৃষিবিভাগের অফিসারমার্কা হাসি; একেবারে আপনহারা-মাতোয়ারা ভাব। বিজ্ঞাপনের নীচে এবং উপরে ইংরেজি ও হিন্দিতে লেখা-“ অধিক ফসল ফলাও”। মেরজাই পরা কাস্তে হাতে চাষীদের মধ্যে যে ইংরেজি অক্ষর চেনে তাকে ইংরেজিতে এবং যে হিন্দি চেনে তাকে হিন্দিতে পটকে দেওয়ার উদ্দেশে এই বিজ্ঞাপনটি তৈরি। আর যারা ইংরেজি বা হিন্দি কিছুই চেনে না তারা অন্ততঃ হাসিমুখ চাষিদম্পতিকে তো চিনবেই। আশা করা যায় চাষির পেছনে হাসিমুখ বৌয়ের ফটোটি দেখা মাত্র ওরা মুখ ঘুরিয়ে পাগলের মত ‘অধিক অন্ন’ ফলাতে লেগে যাবে। কিন্তু বিজ্ঞাপনটির আজকাল মাঠেঘাটে চর্চার কারণ অন্য। বিশেষজ্ঞদের মতে পুরুষটির চেহারা খানিকটা যেন বদ্রী পালোয়ানের সঙ্গে মেলে। কিন্তু মেয়েটি কে এ’নিয়ে রসিকদের মধ্যে প্রচুর মতভেদ দেখা গেল। এই গাঁয়ের অনেক মেয়েছেলের মধ্যে ভাগ্যবতীটি কে তা’নিয়ে আজও ফয়সালা হয় নি।

তবে সবচেয়ে উচ্চকিত বিজ্ঞাপন চাষের নয় ম্যালেরিয়ার। নানান জায়গায় বাড়ির দেয়ালে পাটকিলে রঙে লেখা হল—‘ম্যালেরিয়া খতম করব ভাই, তোমার সবার সাহায্য চাই‘ এবং ‘মশার বংশ হবে ধ্বংশ’। এই প্রচারের পেছনেও ধারণা ছিল যে কিসান গরু-মোষের মত মশাপালনে আগ্রহী। তাই মশা মারার আগে ওদের হৃদয়-পরিবর্তন করা দরকার। হৃদয়-পরিবর্তন করতে দাপট দেখানো দরকার, আর দাপট দেখাতে ইংরেজি চাই।এই ভারতীয় তর্ক-পদ্ধতি অনুসরণ করে ম্যালেরিয়া-নাশ্ বা মশক-লাশ করার সমস্ত আপিল প্রায় সবটাই ইংরেজিতে লেখা অতএব লোকজন এই বিজ্ঞাপনগুলোকে কবিতা নয়, চিত্রকলা বা আলপনা হিসেবে মেনে নিল। তাই নিজেদের বাড়ির দেয়ালে পাটকিলে রঙের ইচ্ছেমত ইংরেজি লেখার অনুমতি দিয়ে দিল। দেয়ালে দেয়ালে ইংরেজি আলপনা আঁকা চলতে থাকল, মশাও মরতে লাগল, কুকুর ঘেউ ঘেউ করে চলল আর লোকজন নিজের পথে চলতে থাকল।

একটা বিজ্ঞাপন সাদাসিদে ঢঙে বলছে—আমাদের সঞ্চয় করা উচিত। কিন্তু গাঁয়ের মানুষকে ওদের পূর্বপুরুষেরা মরার আগে শিখিয়ে গেছেন—দু’পয়সা বাঁচানোর চেষ্টা করা উচিৎ। আর এই নীতিকথাটি গ্রামের সবার ভালো করে জানা আছে। তবে এরমধ্যে নতুনত্ব এইটুকু যে এখানেও দেশ জুড়ে দেয়া হয়েছে। মানে নিজের জন্যে নাহোক, দেশের জন্যে তো সঞ্চয় কর।

হক কথা। বড় মানুষেরা- যত শেঠ-মহাজন, উকিল, ডাক্তার—সবাই পয়সা বাঁচায় নিজেদের জন্যে। তাহলে দেশের জন্যে সঞ্চয় করতে ছোট ছোট চাষির দল, গরীব-গুর্বোর কোন আপত্তি হওয়ার কথা নয়। সবাই নীতির হিসেবে ঐক্যমত যে পয়সা বাঁচানো উচিৎ। এখন সঞ্চিত অর্থ কোথায় এবং কীভাবে জমা করতে হবে তাও লেকচারে এবং বিজ্ঞাপনে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। তাতেও লোকজনের কোন আপত্তি নেই। শুধু এটাই বলা হয়নি যে সঞ্চয় করারা আগে তুমি যে খাটাখাটনি করবে তার জন্যে তোমার মজুরি কত হওয়া চাই।

পয়সা বাঁচানোর ব্যাপারটা যে আয় ও ব্যয়র সঙ্গে যুক্ত, এই ছোট্ট কথাটা বাদ দিয়ে বাকি সব বিজ্ঞাপনে বলা রয়েছে। মানুষজন ভাবল—বেচারা বিজ্ঞাপন, চুপচাপ দেয়ালে সেঁটে রয়েছে, খেতে চাইছে না, পরতে চাইছে না, কাউকে যেমন কিছু দিচ্ছে না, তেমনই কারও কাছে কোন আবদার করছে না। যেতে দাও, খোঁচাখুঁচি কর না।

কিন্তু রঙ্গনাথকে হাতছানি দিচ্ছে যে বিজ্ঞাপনগুলো তারা আদৌ পাব্লিক সেক্টরের নয়, বরং এই বাজারে প্রাইভেট সেক্টরের অবদান।এদের থেকে উৎসারিত আলোর নমুনা দেখুন। এলাকায় সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়া ব্যামো হল দাদ।বিজ্ঞাপনটি বলছে, “এমন একটা ওষুধ পাওয়া গেছে যেটা দাদের উপর লাগিয়ে দিলে দাদের শেকড় অব্দি উপড়ে আসে, মুখে পুরে ফেললে সর্দি-কাশি সেরে যায়, আর বাতাসায় ভরে জলের সঙ্গে গিলে ফেললে কলেরা সারাতে কাজ দেয়। এমন ওষুধ কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। এর আবিষ্কারক এখনও জীবিত, শুধু বিলেতের সাহেবসুবোর চক্রান্তে উনি আজও নোবেল পাননি’।

এ দেশে এধরনের নোবেল না পাওয়া আরও বড় বড় ডাক্তার রয়েছেন। একজন থাকেন জাহানাবাদ জনপদে। ওখানে ইদানীং বিদ্যুৎ এসে গেছে। তাই উনি নপুংসকতার চিকিৎসা বিজলির শক দিয়ে করছেন। নপুংসকদের কপাল ফিরেছে।আর একজন বিখ্যাত ডাক্তার, অন্ততঃ গোটা ভারতে খুব নামডাক, বিনা অপারেশনে অণ্ডকোষ বৃদ্ধির চিকিৎসা করেন। আলকাতরার পোঁচ দিয়ে লেখা এই জরুরি খবরটি শিবপালগঞ্জের যেকোন দেয়ালে দেখা যেতে পারে। মানছি, অনেকগুলো বিজ্ঞাপন বাচ্চাদের শুকনো কাশি, চোখের অসুখ এবং আমাশা ইত্যাদি নিয়ে। কিন্তু আসল রোগ হল হাতে গোণা তিনটি—দাদ, অন্ডকোষের ফোলা এবং নপুংসকতা। শিবপালগঞ্জের ছেলেপুলের দল অক্ষর পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব রোগের চিকিৎসার বিষয়েও দেয়াললিপির মাধ্যমে জ্ঞানলাভ করতে থাকে।

বিজ্ঞাপনের এমন ভীড়ের মাঝে বৈদ্যজীর বিজ্ঞাপনটি—”নবযুবকদের জন্যে আশার কিরণ” -আলাদা করে চোখে পড়ে। এটি ‘নপুংসকদের জন্যে বিজলীচিকিৎসা” গোছের অশ্লীল দেয়াললিপিগুলোর সঙ্গে লড়ালড়ি এড়িয়ে যায়। এবং ছোট ছোট গলি চৌমাথা দোকান এবং সরকারি অফিসগুলোর গায়ে—যেখানে ‘প্রস্রাব করিবেন না’ এবং ‘বিজ্ঞাপন মারিবেন না’ বলে সবাই জানে- টিনের ছোট ছোট তক্তির ওপর লালসবুজ অক্ষরে দেখা দেয়। তাতে ‘নবযুবকদের জন্যে আশার কিরণ’, নীচে বৈদ্যজীর নাম এবং দেখা করার সময় – এটুকুই লেখা থাকে।

একদিন রঙ্গনাথের চোখে পড়ল যে রোগের চিকিৎসায় একটা নতুন উপসর্গ এসে জুটেছে ববাসীর(অর্শ)! সাতসকালে কয়েকজন মিলে একটি দেয়ালে বড় বড় অক্ষরে লিখতে শুরু করেছে—‘ববাসীর’।

এ তো শিবপালগঞ্জের বিকাশ শুরু হওয়া! এই শব্দটির চারটে প্রমাণ সাইজ অক্ষর যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে- এখন আমাশার যুগ চলে গেছে। ধীরে ধীরে হাঁটিহাঁটি, পা-পা করে এন্ট্রি নিচ্ছে নরমসরম শরীর, অফিসের চেয়ার, সভ্যভব্য চালচলন, দিনভর চলতে থাকা খাওয়াদাওয়া এবং হালকা পরিশ্রমের যুগ। আর দিকে দিকে ব্যাপ্ত ‘নপুংসকতা’র মোকাবিলা করতে আধুনিকতার প্রতিনিধি হিসেবে লড়াইয়ের ময়দানে নামছে ‘ববাসীর’। বিকেল নাগাদ ওই দানবীয় আকারের বিজ্ঞাপন একটা দেয়ালে নানারঙে সেজে দিকে দিগন্তে উদঘোষ করতে লাগল—“ ববাসীরের বাজি রেখে চিকিৎসা!

দেখতে দেখতে চার-পাঁচ দিনেই সারা দুনিয়া ববাসীরের বাজি রেখে সারিয়ে তোলার দম্ভের সামনে নতজানু হল।চারদিকে ওই বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। রঙ্গনাথ হতভম্ব, একই বিজ্ঞাপন একটি দৈনিক খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে! কাগজটি রোজ সকাল দশটা নাগাদ শিবপালগঞ্জে পৌঁছিয়ে লোককে জানান দেয় যে স্কুটার ও ট্রাকের সংঘর্ষ কোথায় হয়েছে, আব্বাসী নামক তথাকথিত গুন্ডা ইরশাদ নামের কথিত সব্জিওলাকে তথাকথিত ছুরি দিয়ে কথিত রূপে কোথায় আঘাত করেছে।

সেদিন রঙ্গনাথের চোখে পড়ল যে ওই পত্রিকার প্রথম পাতার একটা বড় অংশ কালো রঙে লেপে দেয়া আর তার থেকে বড় বড় সাদা অক্ষরে ঝলসে উঠছে—ববাসীর! অক্ষরের ছাঁদ একেবারে দেয়াললিপির বিজ্ঞাপনের মত। ওই অক্ষরগুলো ববাসীর(অর্শ)কে এক নতুন চেহারা দিল আর আশপাশের সবকিছু যেন ববাসীরের অধীনস্থ কর্মচারি হয়ে গেল। কালো প্রেক্ষাপটে ঝকঝকে ববাসীর সহজেই লোকের চোখ টানল।এমনকি যে শনিচর বড় বড় অক্ষর পড়তে গেলে হিমসিম খায়, সেও পত্রিকার কাছে সরে এসে অনেকক্ষণ মন দিয়ে চোখ বুলিয়ে রঙ্গনাথকে বলে উঠল—হ্যাঁ, চীজ বটে!

এই কথাটির মধ্যে প্রচ্ছন্ন গর্ব রয়েছে। মানে শিবপালগঞ্জের দেয়ালে ঝকমক করা বিজ্ঞাপন কোন সাধারণ বস্তু নয়, শহরের কাগজেও ছেপে বেরোয়। এভাবে বোঝা গেল যে যা রয় শিবপালগঞ্জে, তা’ রয় বাইরের কাগজে।

তক্তপোষের উপর বসে ছিল রঙ্গনাথ।ওর সামনে খবরের কাগজের একটা পাতা তেরছা হয়ে পড়ে রয়েছে।আমেরিকা মহাশূন্যে একটা নতুন উপগ্রহ পাঠিয়েছে।ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে গোলাগুলি চলছে। গমের ফলন কম হওয়ায় রাজ্যের কোটা কমিয়ে দেয়া হবে। সিকিউরিটি কাউন্সিলে দক্ষিণ আফ্রিকার কোন সমস্যা নিয়ে গরমাগরম তর্ক-বিতর্ক চলছে। এসবের মধ্যে দৈত্যকার বাজের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওই সাদাকালো বিজ্ঞাপন, নিজস্ব টেরচা অক্ষরের ছাঁদে সবার মনযোগ কেড়ে নিয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে- ববাসীর! ববাসীর! অর্শ! অর্শ! বিজ্ঞাপনটি ছেপে বেরোতেই শিবপালগঞ্জ ও আন্তর্জাতিক দুনিয়ার মধ্যে ‘ববাসীর’ এক সফল যোগসূত্র হয়ে দাঁড়াল।

ডাকাতদলের আদেশ ছিল যে রামাধীনের তরফ থেকে একটি টাকার থলি এক বিশেষ তিথিতে বিশেষ স্থানে গিয়ে চুপচাপ রেখে আসতে হবে।ডাকাতির এই মডেল এখনও দেশের কোথাও কোথাও বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু এই মডেলটি মধ্যযুগের, কারণ তখন এসব রূপোর বা নিকেলের সিক্কা চলত যা থলি বা বটুয়ায় রাখা হত। আজকাল টাকা কাগুজে রূপ ধারণ করেছে। পাঁচহাজার টাকা তো প্রেমপত্রের মত একটা খামে ভরে কাউকে দেয়া যায়। দরকার পড়লে একটা চেক কেটে দিলেও হয়। তাই ‘ পরশু রাত্তিরে অমুক টিলার উপরে একটা পাঁচহাজার টাকার থলি রেখে চুপচাপ কেটে পড়’ গোছের আদেশ পালন করা বাস্তবে বেশ অসুবিধেজনক। যেমন টিলার উপর খামে ভরে ছেড়ে আসা নোটগুলো এতোল বেতোল হাওয়ায় উড়ে যেতে পারে।খামের ভেতরের জাল চেক হতে পারে। সংক্ষেপে বললে, শিল্প-সাহিত্য-প্রশাসন-শিক্ষার মত ডাকাতির ক্ষেত্রেও মধ্যযুগীন কায়দাকানুন থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণ অনেক সমস্যা তৈরি করতে পারে।

যাই হোক, ডাকাতের দল এতশত ভাবেনি, বোঝাই যাচ্ছে।কারণ যারাই রামাধীনের বাড়িতে ডাকাতির আগাম চিঠি পাঠিয়েছিল তারা কেউ আসল ডাকাত নয়। ইদানীং গ্রাম-সভা আর কলেজের রাজনীতির বখেড়ায় রামাধীন ভীখমখেড়ভী এবং বৈদ্যজীর মধ্যে আকচাআকচি বেড়ে গেছল। এটা যদি শহর হত এবং পলিটিক্স একটু হাই-লেভেলের হত, তাহলে এতদিনে কোন মহিলা থানায় গিয়ে রিপোর্ট লেখাত যে রামাধীনবাবু ওঁর শীলভঙ্গ করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন, কিন্তু মহিলার সাহস ও সক্রিয় প্রতিরোধের সামনে হার মেনেছেন। এবং মহিলাটি তাঁর শীল পুরোপুরি আস্ত রেখে সোজা থানায় পৌঁছে গেছেন। কিন্তু জায়গাটা এখনও গ্রাম বটেক, তাই রাজনীতির যুদ্ধে ‘শীলভঙ্গ’ নামক অস্ত্রটি এখনও হ্যান্ড গ্রেনেডের সম্মান পায়নি। তাই ডাকাতির ধমকিভরা চিঠি গোছের পুরনো কৌশল অবলম্বন করে রামাধীনকে ক’দিন জ্বালাতন করার চেষ্টা- এই আর কি।

ডাকাতির চিঠিটা যে জালি এটা সবাই জানে। মানে, পুলিশ, রামাধীন এবং বৈদ্যজীর পুরো দরবার- সবাই। আগেও এ’রম চিঠি অনেকবার অনেকের কাছে এসেছে। তাই অমুক তারিখে তমুক সময় টাকা নিয়ে টিলায় পৌঁছতেই হবে -রামাধীনের এমন কোন চাপ ছিলনা। চিঠিটা নকল না হয়ে আসল হলেও রামাধীন চুপচাপ টাকা পৌঁছে দেয়ার বান্দা নয়, তার চেয়ে ঘরে ডাকাত পড়ুক, সেই ভাল।কিন্তু থানায় রিপোর্ট লেখানো হয়ে গেছে, ফলে পুলিশেরও কর্তব্যবোধ জেগে উঠল।কিছু না কিছু করতেই হবে।

সেই বিশেষ দিনে গাঁ থেকে টিলা পর্য্যন্ত স্টেজ পুলিশকে সঁপে দেয়া হল। ওরা চোর-পুলিশ খেলতে লেগে গেল। টিলার মাথায় তো যেন একটা থানা খুলে গেল। ওরা আশপাশের পড়তি ফাঁকা জমি, পাথুরে রুক্ষ এলাকা, জংগল, খেত-খামার, ঝোপঝাড় সব খুঁজে দেখল, কিন্তু ডাকাতদের টিকিটি দেখা গেল না। ওরা টিলার পাশে গাছের ঘন ডালপালা নেড়ে দেখল, খ্যাঁকশেয়ালের গর্তে সঙীন দিয়ে খোঁচা মারল, আর সমতলে নিজের চোখে কটমটিয়ে দেখে বুঝে গেল যে ওখানে যারা আছে তারা ডাকাত নয়, বরং পাখির ঝাঁক, শেয়ালের পাল ও বিবিধ পোকামাকড়।রাতের একপ্রহরে কিছু প্রাণীর সমবত চিৎকারে চটকা ভাঙলে ওরা আশ্বস্ত হল,-- ডাকাত নয়, হুক্কাহুয়া। আর পরে ঝটপট ঝটপট,-- পাশের বাগবাগিচায় বাদুড়ে ফল ঠোকারাচ্ছে। সেই রাতে ডাকাত দল এবং বাবু রামাধীনের মধ্যেকার কুস্তি ১-১ ড্র হল। কারণ টিলায় ডাকাতেরা কেউ আসেনি, রামাধীনও টাকার থলি নিয়ে যায়নি।

থানার ছোট দারোগাটি সদ্য চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। টিলায় চড়ে ডাকাত ধরার কাজ ওনাকেই দেয়া হয়েছিল। উনি ভেবেছিলেন মাকে নিয়মকরে প্রতিসপ্তাহে পাঠানো চিঠির আগামী কিস্তিতে লিখবেন—‘ মা, ডাকাতের দল মেশিনগান চালিয়েছিল; ভয়ংকর গোলাগুলি । তবু মা তোমার আশীর্বাদে আমার গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি’।

কিন্তু কিছুই হলনা। রাত্তির একটা নাগাদ উনি টিলা থেকে সমতলে নেমে এলেন। ঠান্ডা বেড়ে গেছল। অমাবস্যার ঘন অন্ধকার। আর ওঁর মনে জেগে উঠল নগরবাসিনী প্রিয়ার জন্যে আকুলিবিকুলি। উনি ছিলেন হিন্দি সাহিত্যে স্নাতক। এতসব কারণ মিলে ওঁর গলায় গান এল; প্রথমে গুনগুনিয়ে তাদারোগারপর স্পষ্ট সুরে—‘হায় মেরা দিল! হায় মেরা দিল’!

এবার “তীতর কে দো আগে তীতর, তীতর কে দো পীছে তীতর” প্রবাদের মত আগে দু’জন, পেছনে দু’জন সেপাই নিয়ে ছোট দারোগা চলেছেন। দারোগার গানের সুর চড়ছে দেখে সেপাইরা ভাবছে- ঠিক আছে, ঠিক আছে; নতুন নতুন ডিউটিতে এসেছেন, ক’দিন বাদে লাইনে এসে যাবেন।খোলা ময়দান পেরিয়ে যেতে যেতে দারোগার গলা আর উদাত্ত হল। বোঝা গেল, যে নেহাত বোকা বোকা কথাগুলো মুখ ফুটে বলতে লজ্জা করে সেগুলো নিয়ে দিব্যি গান গাওয়া যায়।

রাস্তা প্রায় এসে গেছে। তখনই একটা বড়সড় গর্ত থেকে আওয়াজ এল- কর্ফৌন হ্যায় সর্ফালা?

দারোগার হাত কোমরের রিভলভারে চলে গেল। সেপাইরা হকচকিয়ে গেল। তখন গর্ত থেকে আবার শোনা গেল- কর্ফৌন হ্যায় সর্ফালা?

এক সেপাই দারোগার কানে ফুসফুসিয়ে বলল—গুলি চলতে পারে। গাছের আড়ালে সরে যাই হুজুর?

গাছের আড়াল প্রায় পাঁচগজ দূরে। দারোগা সেপাইয়ের কানে ফুসফুস করে বললেন-তোমরা গাছের আড়ালে যাও; আমি দেখছি।

এবার উনি বললেন- ‘গর্তের ভেতরে কে? যেই হও, বাইরে বেরিয়ে এস’। তারপর একটি সিনেমার স্টাইলে বললেন-‘তোমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। আর আধমিনিটের মধ্যে না বেরিয়ে এলে গুলি চালাব’।

গর্তের থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। তারপর হঠাৎ শোনা গেল- মর্ফর গর্ফয়ে সর্ফালে, গর্ফোলি চর্ফলানেওয়ালে!

[এসব শব্দের দ্বিতীয় অক্ষরে ‘র্ফ’ বাদ দিয়ে পড়লেই মানে স্পষ্ট হবে—মর গয়ে সালে, গোলি চলানেওয়ালে! ঠিক ছোট মেয়েরা যেমন নিজেদের মধ্যে ‘চি’ জুড়ে কোড বানিয়ে কথা বলে। লাভার বলতে হলে বড়দের সামনে বলে-চিলাচিভাচির।]

প্রত্যেক ভারতীয় ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোলে ভাষার মারপ্যাঁচে্র মুখোমুখি হলে নিরেট আকাট হয়ে যায়। এতরকম আঞ্চলিক কথ্যভাষা বা বুলি ওদের কানের পরদায় আছড়ে পড়ে যে ওরা খানিকবাদে হার মেনে ভাবে—হবে নেপালি কি গুজরাতি!এই ভাষাটাও ছোট দারোগাকে নাজেহাল করে দিল। উনি ভাবতে লাগলেন -ব্যাপারটা কী? এটুকু বঝা যাচ্ছে যে কেউ গালি দিচ্ছে। কিন্তু কোন ভাষায় দিচ্ছে কেন বোঝা যাচ্ছে না?

বোঝাবুঝির পালা শেষ হলে যে গুলি চালাতে হয় এই আন্তর্জাতিক নীতিটি ওনার ভাল করে জানা আছে। তাই শিবপালগঞ্জে ওই নীতি প্রয়োগ করবেন ভেবে উনি রিভলবার বাগিয়ে হেঁকে উঠলেন—“গর্তের বাইরে বেরিয়ে এস, নইলে এবার গুলি চালাব’।

কিন্তু গুলি চালানোর দরকার হলনা। এক সেপাই গাছের আড়ালা থেকে বেরিয়ে এসে বলল-হুজুর, গুলি চালাবেন না যেন। এ ব্যাটা জোগনাথওয়া, মাল টেনে গাড্ডায় পড়ে গেছে।

সেপাইয়ের দল মহোৎসাহে গর্তের চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল। দারোগা বললেন—জোগনাথওয়া? সেটা আবার কে?

এক পুরনো সেপাই বলল—এ হল শ্রীরামনাথের পুত্র জোগনাথ, একলা মানুষ, তবে একটু বেশি মাল টানে।

সবাই মিলে জোগনাথকে টেনেটুনে দাঁড় করালো, কিন্তু যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় না, তাকে অন্যেরা কতক্ষণ ধরে রাখবে! তাই ও ল্যাগব্যাগ করে পড়ে যাচ্ছিল, একবার সামলানো হল তারপর ও গর্তটা উপর পরমহংসের মত বসে পড়ল। এবার ও বসে বসে চোখ মিটমিট করে হাতটাত নেড়ে একবার বাদুড় আর একবার শেয়ালের মত আওয়াজ বের করে একটু মানুষের স্তরে নেমে এল, কিন্তু ওর মুখ থেকে ফের ওই শব্দ বেরোল-- কর্ফৌন হ্যায় সর্ফালা?

দারোগা জিজ্ঞাসা- এটা আবার কোন বুলি?

সেপাই বলল- বুলি দিয়েই তো চিনলাম যে ব্যাটা জোগনাথ ছাড়া কেউ নয়।ও ‘সর্ফরী’' বুলি কপচায়। এখন হুঁশ নেই তাই গাল পাড়ছে।

যোগনাথের গাল পাড়ার প্রতি নিষ্ঠা দেখে দারোগা প্রভাবিত হলেন। বেহুঁশ অবস্থায়ও কিছু না কিছু করছে তো! উনি ওর ঘেঁটি ধরে ঝটকা মেরে বললেন- হোশ মে আও। হুঁশ ফিরে আসুক ব্যাটার।

কিন্তু জোগনাথ হুঁশ ফেরাতে চায় না যে!খালি বলল-সর্ফালে!

সেপাইয়ের দল হেসে উঠল। ওকে চিনত যে সেপাই, সে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে চেঁচাল—জর্ফোগনাথ, হর্ফোশ মেঁ অর্ফাও! জোগনাথ, হোশ মেঁ আও।

এতেও জোগনাথের কোন হেলদোল নেই; কিন্তু ছোট দারোগা এবার সর্ফরী বুলি শিখে ফেললেন।মুচকি হেসে টিপ্পনি করলেন—এই শালা আমাদের সবাইকে শালা বলছে যে!

উনি দু’ঘা দেবেন ভেবে যেই হাত তুললেন অমনই একজন সেপাই ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল-যেতে দিন হুজুর, যেতে দিন।

সেপাইদের এতটা মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ দারোগাবাবুর খুব একটা পছন্দ হলনা।উনি তামাচা মারতে উদ্যত হাত সামলে নিলেন কিন্তু আদেশের স্বরে বললেন- ব্যাটাকে নিয়ে চল আর হাজতে পুরে দাও।ধারা ১০৯ এর কেস ঠুকে দাও।

জনৈক সেপাই বলে উঠল—এটা ঠিক হবেনা হুজুর!ওর এ’ গাঁয়েই বাস। দেয়ালে রঙ দিয়ে বিজ্ঞাপন লেখে। কথায় কথায় সর্ফরী বুলি ঝাড়ে। ব্যাটা বদমাশ বটে, কিন্তু দেখনদারির জন্যে কিছু-না-কিছু কাজটাজ করতেই থাকে।

ওরা জোগনাথকে মাটির থেকে টেনে তুলে কোনরকমে পা চালাতে বাধ্য করে রাস্তার দিকে এগোয়। দারোগা বললেন,’ বোধহয় দারু খেয়ে গালি দিচ্ছিল। কোন-না-কোন ধারা ঠিক লেগে যাবে।এখন তো ব্যাটাকে লেন

সেপাইটি নাছোড়বান্দা। ‘কেন যে হুজুর খামোখা ঝঞ্ঝাট বাড়াচ্ছেন!কী লাভ! গাঁয়ে পৌঁছে ওকে এখন ওর ঘরে এক ধাক্কায় ঢুকিয়ে দিয়ে তবে ফিরব।একে হাজতে পুরবেন কী করে?জানেনই তো, ও হল বৈদ্যজীর লোক।

ছোট দারোগা চাকরিতে সবে এসেছেন, কিন্তু সেপাইদের মানবতাবাদী ভাবনার আসল কারণটা উনি চটপট বুঝে ফেললেন। সেপাইদের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে পেছন পেছন চলতে চলতে উনি ক্রমশঃ ঘোর অন্ধকার, অল্প অল্প শীত নগরে বিনিদ্র রাতজাগা প্রিয়া এবং ‘হায় মেরা দিল’ গুনগুনিয়ে ক্রমশঃ শান্ত হলেন।
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in






নয়

-কি হয়েছে রে,একটি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলাম । মেয়েটি বললো, জগন্নাথ মন্দিরের ভিতর স্বয়ং জগন্নাথ ঠাকুর এসেছেন ।ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম , একটি বড় পোকা ঠিক জগন্নাথ ঠাকুরের মত সব কিছু ।খুব আশ্চর্য হওয়ার কথা ।এদিকে দাদা ও দিদি এসে গেছেন । ওনাদের বন্ধুর বাড়ি নিয়ে গোলাম । কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া হলে গ্রামের সবকিছু ঘুরে দেখলেন । পাশের গ্রামে অনেক ভেড়া ,ছাগল জাতীয় পশু দের বলি দেওয়া হচ্ছে দেখে দাদা ও দিদির খুব রাগ হলো ।ওনারা বললেন, এই সুযোগে বলি প্রথা বন্ধ করতে পারলে ভালো হয় । দেখা যাক এই নিরীহ পশু দের যদি বাঁচানো যায়। তার জন্য একটু মিথ্যার আশ্রয় নিতে হলে নিতে হবে ।

যাইহোক গ্রাম ঘুরে বেশ ভালো লাগলো ওনাদের ।রাত্রিবেলা সোরগোল । জগন্নাথ ঠাকুরের প্রসাদ খেয়ে অনেকেই অসুস্থ । তারা সবাই কাটোয়া হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ।দাদা মন্দিরের ভিতর ঢুকে বললেন, এত পশুর বলি দান দেওয়া হচ্ছে এই বিপদ অই কারণেই হয়েছে । গ্রামের সবাই যদি প্রতিজ্ঞা করে , বলি প্রথা বন্ধ করবে, তাহলে সবাই সুস্থ হবে । সবাই ঠাকুরের সামনে তাই বললো । আর কিছু করার নেই । বলি বন্ধ হলেই হবে ।অনেক কিশোর কিশোরী ,বুড়ো বুড়ি এই সিদ্ধান্তে খুব খুশি । গ্রামের বেশির ভাগ লোক পশু বলি চায় না ।কিন্তু অভিশাপের ভয়ে কেউ মুখ খোলে না ।হাসপাতাল থেকে সবাই সুস্থ হয়ে ফিরে এলে দিদি বললেন, এই পোকা টি জগন্নাথ ঠাকুরের মত দেখতে । কিন্তু এটি একটি বিষাক্ত পোকা । গভীর জঙ্গলে ওরা থাকে । রাতে প্রাসাদের আঢাকা থালার মধ্যে যাওয়া আসা করার ফলে বিষাক্ত ফ্লুয়িড খাবারে লেগে যায় । সেই প্রসাদ সকালে খাওয়া হয়,আবার তারপরে বলিপ্রথার পাপের ফল ।এই দুয়ে মিশে আমাদের গ্রামের অনেকেই অসুস্থ ।

বিজ্ঞানের যুক্তি দিয়ে সব কিছু বিশ্লেষণ করলেই সব পরিষ্কার হয়ে যায় জলের মতো ।দাদা বললেন, মনে রাখতে হবে , আমরা মানুষ ,পশু নই । তাই আমরা নিজেরা বাঁচার পাশাপাশি আর বাকি সবাইকে বাঁচতো দেবো । তবেই আমরা সুন্দর এক পৃথিবী সৃষ্টি করতে পারবো। কেতুগ্রাম থানার ভুলকুড়ি গ্রামে সন্ধ্যা ছ'টার পর আর কেউ বাইরে বেরোয় না ।একমাস যাবৎ এই অন্ঞ্চলে ভূতের অত্যাচার খুব বেড়ে গেছে ।

গ্রামের শিক্ষিত ছেলে বাবু ছুটতে ছুটতে এসে আমাকে বললো, জানো দাদা জবা দের দোতলা ঘরে জবা শুয়েছিলো । ঠিক বারোটার সময় জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে জবার মাথার চুল ছিঁড়ে নিয়েছে ।

-----কবে রে বাবু

------ গতকাল রাতে

------এখন কেমন আছে

-----এখনি ডাক্তার খানা নিয়ে যাবে বলছে

আমি কয়েকদিন ধরে এইরকম কথা শুনছি ।ভাবছি কি করা যায় ।আমার বাড়িতেও তো এইরকম আক্রমণ হতে পারে ।

আজকে রাতে রাস্তায় কেউ নেই । আমি দোতলার বারান্দায় রাত বারো টা অবধি জেগে থাকলাম । কিন্তু ,কাকস্য পরিবেদনা । কেউ নেই । একটু ভয় ভয় লাগছে ।তারপর রাত্রি র অপরূপ রূপে মগ্ন হয়ে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম ।সকাল বেলা পেপার আর চা নিয়ে কোকিলের ডাক শুনছিলাম ।

হঠাৎ মন্ডল পাড়ার স্বদেশ এসে আমেজ টা নষ্ট করে দিলো ।

-----দাদা,কালকে আমাদের পাড়ায় ভূতটা ঘুরছিলো ।প্রায় দশ ফুট লম্বা ,বড়ো হাত আর কালো রঙ ।ভয়ে আমার বাবা অজ্ঞা ন হয়ে গিয়েছিলো ।

____এখন ভালো আছেন ?

_____না না ,এখনও বু বু করছে ।

আমি আবার চিন্তার মধ্যে ডুবে গেলাম ।কি করা যায়,এই সমস্যা সহজে সমাধান করা খুব কঠিন ।প্রকৃতির নিয়মে আবার রাত হলো ।গ্রামের সহজ সরল মানুষ এই সব বিপদের দিন অসহায় হয়ে যায় ।রাতে শুয়ে চিন্তা করলাম মুস্কিল আসান করার জন্য কিশোর মনোবিজ্ঞানের সুমন্ত ভট্টাচার্য মহাশয়কে খবর দিতে হবে । সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে চড়খীর অমল কে ফোন করলাম । আমার মনে আছে অদৃশ্য নাথ সেই ভয়ংকর বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিলো জয়ন্ত দা ও হৈমন্তী দি র জন্য।

অমল ফোন করে সুমন্ত ভট্টাচার্য মহাশয়ের আসার সমস্ত ব্যবস্থা করে দিলো ।সঙ্গে আসছেন কিশোর মনো বিজ্ঞানের সহ সম্পাদনা সচিব রত্না দিদি । তিনি বিখ্যাত পরিবেশ বিজ্ঞানী । আমার একটু সাহস বাড়লো । ওদের সাথে আমার বন্ধু অমল কেও আসতে বললাম ।
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in

 














৩৫



ফিঙ্কের সম্পত্তির বহর দেখে ফাইনহালসের চোখের পলক পড়ছিল না। সামনে অবশ্য অপরিসর একটা পুরনো বাড়ি, যেটার গায়ে সাইনবোর্ড লাগানো আছে… ‘ফিঙ্কের পানশালা ও সরাইখানা ১৭১০ সালে প্রতিষ্ঠিত’। একটা লড়ঝড়ে সিঁড়ি, যেটা রেস্তরাঁয় উঠে গেছে। দরজার বাঁয়ে একটা জানালা, ডানদিকে দুটো জানালা। ডানদিকের শেষের জানালার পর থেকেই শুরু হচ্ছে ওয়াইনের খামার। একটা সরু গেট সবুজ রঙ করা, যার মধ্য দিয়ে অতিকষ্টে একটা গাড়ি ঢুকতে পারে।

কিন্তু এখন, গেট খুলে ভেতরে ঢুকে সামনের করিডোর পেরিয়ে বিশাল উঠোনটা দেখে সে থমকে দাঁড়াল। চতুষ্কোণ উঠোন ঘিরে নতুন ঝকঝকে কিছু বিল্ডিং। দোতলায় কাঠের রেলিং দেওয়া টানা বারান্দা সব কটা বিল্ডিংএ। আরেকটু এগিয়ে গিয়ে আরেকটা গেট খুলে দিলে আরেকটা উঠোন। সেটা ঘিরে কিছু ছাউনি দেওয়া ঘর। ডানদিকে একটা একতলা বাড়ি। দেখে মনে হচ্ছে একটা বিশাল হলঘর সেই বাড়িটার মধ্যে। সে সবকিছু ধীরে সুস্থে দেখতে লাগল; কান পেতে শুনবার চেষ্টা করল কোনো শব্দ পাওয়া যায় কি না। তারপর দু’ জন আমেরিকান রক্ষীকে দেখে আবার থমকে দাঁড়াল। দ্বিতীয় উঠোনের সামনে এরা পাহারা দিচ্ছে। একটা নির্দিষ্ট ছন্দে কিছুক্ষণ পর পর একজন আরেকজনকে অতিক্রম করে যাচ্ছে পায়চারি করতে করতে। বন্ধ খাঁচার মধ্যে দু’খানা জানোয়ার একসঙ্গে থাকলে এমন হয়, দেখেছে ফাইনহালস। একজন চশমা পরা, ঠোঁট নড়ছে ক্রমাগত, কিছু মুখে নিয়ে চিবাচ্ছে লোকটা। আরেকজন সিগারেট খাচ্ছে। দু’জনেরই ইস্পাতের হেলমেট একটু আলগা করে পেছনে হেলানো। দু’জনকেই ভারি ক্লান্ত দেখাচ্ছে।

ফাইনহালস বাঁয়ে দরজাটার পাল্লায় একবার ধাক্কা দিল। দরজাটার গায়ে লেখা আছে ‘ব্যক্তিগত’। ডানদিকের দরজার গায়ে অতিথিশালার সাঙ্কেতিক চিহ্ন আঁকা আছে। দুটো দরজাই বন্ধ। সে কিছু সময় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করল। রক্ষীদের পায়চারি করা দেখল। নৈঃশব্দ্যের মধ্যে দূরে কোথায় যেন বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল। বল ছোঁড়ার মত গ্রেনেড ছোঁড়া শুরু হয় অনেক সময়। দরকার না থাকলেও ছোঁড়া হয়। লড়াইয়ের জন্য নয় সব সময়; কতকটা হল্লা করার জন্য, শব্দ করে করে ভয়টা জিইয়ে রাখবার জন্য। যেন ঘোষণা হয়ে চলেছে সব সময়… ‘যুদ্ধ, এটা যুদ্ধ। হুঁশিয়ার, যুদ্ধ!’ পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খেয়ে শব্দগুলি প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। ফলে এমনিতেই শব্দ বেড়ে যাচ্ছিল। কিছু সময় পরে ফাইনহালস বুঝতে পারল যে জার্মানদের দিক থেকে কোনো গোলাগুলি ছোঁড়া হচ্ছে না। আমেরিকানরা একতরফা গ্রেনেড ছুঁড়ে যাচ্ছে।

সেই অর্থে কোনো গুলিবিনিময় হচ্ছে না কোথাও। একতরফা ভাবে বিস্ফোরণের শব্দ নদীর ওপারে শান্ত পাহাড়ি প্রকৃতির মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন হুমকির পরিবেশ জারি রাখবার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। ফাইনহালস ধীরে ধীরে করিডোরের একদম অন্ধকার প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াল। বাঁয়ে একটা সিঁড়ি মাটির নিচে সেলারের দিকে গেছে। ডানদিকে একটা ছোট দরজা, যেটার উপরে একটা কার্ডবোর্ড পেরেক দিয়ে আটকানো আছে। কার্ডবোর্ডের উপরে লেখা ‘রান্নাঘর’। ফাইনহালস রান্নাঘরের দরজায় টোকা দিল।

খুব ক্ষীণ একটা শব্দ শুনতে পেল সে… ‘ভেতরে আসুন।’

হাতল ঘুরিয়ে ভেতরে ঢুকে সে চারটি মুখ দেখতে পেল। চারটি মুখের মধ্যে দু’টি মুখের সঙ্গে সেই মুখটির সাদৃশ্য দেখে সে চমকে উঠল। কতটুকুই বা সে দেখেছিল সেই প্রাণহীন, ক্লান্ত মুখটিকে? হাঙ্গেরিয়ান গ্রামের এক তৃণভূমিতে, লালচে আগুনের আভায় সে দেখেছিল তাকে। এখন এখানে মুখে পাইপ নিয়ে জানালার কাছে বসে থাকা এই বৃদ্ধ লোকটিকে দেখতে অনেকটা সেই মুখের মত; সেও এমনি রোগা আর বুড়োটে গড়নের হালকা চেহারার ছিল আর চোখে ছিল এক ক্লান্ত জ্ঞানী ভাব। দ্বিতীয় যে মুখের সঙ্গে সেই মুখটির সাদৃশ্য দেখে সে ভয় পেল এখন, সেটা হল একটা বাচ্চা ছেলের মুখ। কত আর বয়স হবে বাচ্চাটার? বছর পাঁচ ছয়েক। বাচ্চাটা হাতে একটা কাঠের খেলনাগাড়ি নিয়ে মেঝেতে কুঁকড়ে বসে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। বাচ্চাটারও রোগাপাতলা গড়ন। মুখের ভাব কেমন বুড়োটে, ক্লান্ত, জ্ঞানী ধরনের; গাঢ় রঙের চোখের মণি, একদৃষ্টে কিছুক্ষণ তাকে দেখে তারপর উদাসীনভাবে চোখ নামিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে খেলনাগাড়িটা মেঝেতে ঘষে ঘষে চালিয়ে খেলতে থাকে বাচ্চাটা।

দু’জন মহিলা টেবিলে বসে আলুর খোসা ছাড়াচ্ছিল। একজন বয়স্ক, তার মুখ চওড়া, বাদামি গায়ের রঙ, ভালো স্বাস্থ্য। খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে অল্প বয়সে খুব রূপ ছিল তার। পাশে যে মহিলা বসে আছে, সে ফ্যাকাসে আর বুড়োটে চেহারার। খুঁটিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে যতটা বুড়োটে দেখাচ্ছে, সে আসলে তত বয়স্ক নয়। আসলে মহিলার বয়স অল্প। কিন্তু খুব ক্লান্ত আর বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। হাতের নড়াচড়াও ক্লান্ত এবং দ্বিধাগ্রস্ত। ব্লন্‌ড সোনালি চুলের গোছা ফ্যাকাসে কপাল পেরিয়ে এলোমেলো হয়ে মুখের উপরে পড়েছে। কিন্তু বয়স্ক মহিলার চুল আঁচড়ে সুন্দর পরিপাটি করে বাঁধা।

‘সুপ্রভাত!’ বলল ফাইনহালস।

‘সুপ্রভাত!’ তারা উত্তর দিল। ফাইনহালস ঘরে ঢুকে তার পেছনে দরজাটা বন্ধ করল। একটু ইতস্তত করে সে প্রথমে একটা খাঁকারি দিয়ে গলাটা সাফ করে নিল। তারপর সে অনুভব করল যে সে ঘামছে। ঘামের স্রোতে পরনের শার্টটা বগলের কাছে আর পিঠের কাছে একেবারে তার শরীরে লেপটে বসেছে।



(চলবে)