0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in






৩৭

ফাইনহালস সঙ্গে সঙ্গে জেনারেলকে চিনতে পারল। তাকে আগের চেয়ে অনেক ভালো দেখাচ্ছে; উদ্বেগহীন, শান্ত দেখাচ্ছে। গলায় ক্রসটা রয়েছে তাঁর। শান্তভাবে দু’জন রক্ষীর সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন তিনি। মুখে কি হালকা একটা হাসির রেখা দেখা যাচ্ছে? রক্ষীদের মেশিনগানের নল দুটোই তাঁর দিকে তাক করে রাখা আছে। তাঁকে একেবারেই ক্লান্ত, বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে না। শান্ত, সৌম্য, পরিশীলিত মুখমণ্ডলে হালকা হাসির রেখা তাঁর ব্যক্তিত্বে অন্য মাত্রা যোগ করেছে। ধীর পদক্ষেপে উঠোন পেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন তিনি।

‘ওই লোকটা জেনারেল’ বলে উঠলেন বয়স্ক মানুষটি, মিঃ ফিঙ্ক। ‘এখানে কর্নেল, মেজর, অনেকেই আছে। প্রায় জনাত্রিশেক।’

অল্পবয়েসি মহিলাটি পাশের ঘর থেকে গ্লাস এবং বোতল নিয়ে এলো। বুড়ো ফিঙ্কের সামনে জানালার তাকে রাখল একটা গ্লাস। আরেকটা গ্লাস ফাইনহালসের চেয়ারের সামনে টেবিলের উপরে রাখল। ফাইনহালস জানালায় দাঁড়িয়ে রইল। জানালাটা দিয়ে বাড়িটার পেছন দিকে প্রধান রাস্তা পেরিয়ে দূরে অনেকটা দেখা যাচ্ছে। রাস্তার ওপারে, যেখানে দু’ জন রক্ষী মেশিনগান হাতে দাঁড়িয়ে আছে, সেই জায়গাটা ফাইনহালস চিনতে পারল। একটা কফিনের দোকানের জানালা দেখা যাচ্ছে। এই রাস্তাতেই হাইস্কুলটা ছিল। কফিনের দোকানটা এখনও আছে। জানালায় রাখা কফিনটা কালো পালিশ করা, রূপোলী কারুকাজ করা; রূপোলী ঝালরের ঝকমকে পাড়ের কালো চাদর দিয়ে ঢাকা। হয়তো তেরো বছর আগে এই পথে হাইস্কুলে যাবার সময়ে যে কফিনটা সে দেখতে পেত এই দোকানের জানালায়, এখনও সেই কফিনটাই রাখা আছে।

‘উল্লাস!’ বুড়ো ফিঙ্ক নিজের গ্লাসটা একটু উঁচুতে তুলে ধরেন। ফাইনহালস তাড়াতাড়ি টেবিলে ফেরত যায়। অল্পবয়সী মহিলাকে বলে ‘ধন্যবাদ’; তারপর বুড়োর দিকে নিজের গ্লাসটা তুলে ধরে বলে ওঠে ‘উল্লাস!’ পান করে সে। ওয়াইনটা বেশ ভালো।

-‘আচ্ছা, আপনার মতে কখন ঘরে ফেরা আমার জন্য সবচেয়ে ভালো?’ ফাইনহালস বুড়োকে প্রশ্ন করে।

‘আগে দেখে নিতে হবে যে কোন জায়গাটায় আমেরিকানরা নেই, সেই জায়গাটা দিয়ে যেতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় কের্পেল দিয়ে... আপনি কের্পেল চেনেন?’

‘হ্যাঁ’ উত্তর দেয় ফাইনহালস... ‘ওইখানে ওরা কেউ নেই?’

‘নাহ। ওইখানে ওরা নেই। লোকজন প্রায়ই ওইদিক থেকে এখানে রুটি নিতে আসে। রাতের দিকে, মেয়েরাও আসে দল বেঁধে।’

‘গোলাগুলি সব দিনের বেলায় চলে’... বলে ওঠে অল্পবয়েসি মহিলাটি।

‘হ্যাঁ’... বলে ওঠেন বয়স্ক মানুষটি... ‘ওরা দিনের বেলা গুলি চালায়।’

‘ধন্যবাদ!’ বলে ফাইনহালস, ‘আপনাদের অনেক ধন্যবাদ!’ গ্লাসটা খালি করে ওয়াইনটা পুরোটা খেয়ে ফেলে সে।

‘আমি পাহাড়ের দিকে যাব।’ উঠে দাঁড়িয়ে বলে ওঠেন বুড়ো মানুষটি, ‘আপনি যদি আমার সঙ্গে আসেন, সবচেয়ে ভালো হয়। উপর থেকে সব ভালোভাবে পরিষ্কার দেখা যাবে। আপনাদের নিজেদের বাড়িটাও দেখা যাবে...’

‘হ্যাঁ। আমি আপনার সঙ্গে যাব।’

ফাইনহালস টেবিলে বসে থাকা মহিলাদের দিকে তাকায়। তারা টেবিলে বসে সবজি কাটছে। বাঁধাকপির পাতাগুলো ছাড়িয়ে, বেছে, কেটে ঝাঁঝরির মধ্যে রাখছে। শিশুটি খেলনা গাড়িটা একপাশে সরিয়ে রেখে মেঝে থেকে মুখ তুলে তাকায়... ‘আমি কি সঙ্গে আসতে পারি?’

‘হ্যাঁ,’ বলে ওঠেন বুড়ো ফিঙ্ক, ‘চলো আমার সঙ্গে।’ তামাকের পাইপটা বুড়ো জানালার তাকে রাখেন।

‘ওই যে!’ উত্তেজিত হয়ে চাপা চিৎকার করে ওঠেন বুড়ো ফিঙ্ক, ‘দেখুন, ওই যে, পরের জনকে নিয়ে আসছে।’

ফাইনহালস দৌড়ে জানালার কাছে যায়। কর্নেল। এখন তাঁর চালচলন বেশ ঢিলে দেখাচ্ছে। সরু মুখটা দেখে মনে হচ্ছে বেশ অসুস্থ। জামার কলার, যেটার সঙ্গে সব মেডেলগুলো লাগানো, সেটা যেন অতিরিক্ত বড় দেখাচ্ছে কর্নেলের মুখের তুলনায়। অতিকষ্টে হেঁটে যাচ্ছেন তিনি। হাঁটুগুলো যেন নড়ছে না। হাতগুলো কেমন যেন ল্যাতপ্যাত করছে।

‘লজ্জা!’ বুড়ো ফিঙ্ক বিড়বিড় করতে থাকেন, ‘লজ্জা… অপমান!’ দেওয়ালের হুক থেকে নিজের টুপিটা পেড়ে নিয়ে মাথায় পরেন তিনি।

‘আবার দেখা হবে।’… বলে ফাইনহালস।

‘আবার দেখা হবে।… বলে মহিলারা।

‘আমরা খাবার সময়ে ফিরব’… বলে ওঠেন বুড়ো ফিঙ্ক।

(চলবে)

0 comments: