গল্প - মনোজ কর
Posted in গল্পদশম পর্ব
ইংরেজ বনাম ফরাসি-বিঘ্নিত সহাবস্থান - অসহায় সিরাজ
জিন ল আর জগতশেঠের কথাবার্তার মধ্যে যখন সিরাজের প্রসঙ্গ এল , যখন তার নিষ্ঠুরতার কথা উঠল কথাপ্রসঙ্গে ল এর বুঝতে অসুবিধে হল না যে জগতশেঠেরা সিরাজের জায়গায় অন্য নবাব চাইছে।কোনরকম রাখঢাক না রেখে একটু নিচু গলায় একজন ল’কে জানিয়ে দিল যে এখানে এই প্রসঙ্গ আলোচনা না করাই ভাল। যদি সত্যি সত্যি জগতশেঠেরা সিরাজকে সরাবার ব্যাপারে আগ্রহী না হত তাহলে অবশ্যই তাদের হাবেভাবে আচারে ব্যবহারে তার প্রকাশ পেত। ইংরেজদের অনুগত ওমনিচাঁদ ওখানে ছিল। ওরা হয়ত সবাই ভেবেছিল যে সিরাজ গদিচ্যুত হলে ফরাসিরাও হয়ত ওদের মত শান্তি পাবে। তখনও পর্যন্ত ইংরেজদের সঙ্গে ফরাসিদের শত্রুতা সেই জায়গায় যায়নি বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। ল পরে বুঝেছিল যে তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হয়েছিল। ক্লাইভ ইতিমধ্যেই জগতশেঠের সঙ্গে এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল যে সিরাজকে সরানোর চক্রান্ত যদি কার্যকর হয় তাহলে ফরাসিদের সমস্ত সম্পদ জগতশেঠের হাতে তুলে দেওয়া হবে। ঘটেছিলও তাই। ল পরবর্তীকালে বুঝতে পেরেছিল যে চক্রান্ত আরও গভীর। জগতশেঠ আর ইংরেজদের মিলিত চক্রান্ত শুধু সিরাজের বিরুদ্ধে নয়, ফরাসিদের বিরুদ্ধেও। কিন্তু সেদিন জগতশেঠের সঙ্গে কথা হবার পর ল এর মনে হয়েছিল যে সিরাজ এবং ফরাসিরা নিরাপদ নয় যদিও এই চক্রান্তের গভীরতা সম্পর্কে সেদিন সে কিছু আন্দাজ করতে পারেনি। অনেক ভেবে এই চক্রান্তের খবর নিয়ে সেদিন সন্ধ্যাবেলা ল পৌঁছে গেল সিরাজের দরবারে। সব শুনে সিরাজ হেসে উড়িয়ে দিল। ল এর মনে হল এই অপরিণতমস্তিষ্ক কিশোরের তলিয়ে ভাবার তো কোনও ক্ষমতাই নেই তারপর সবসময় একাধিক স্ত্রী এবং দাসীপরিবৃতা হয়ে থাকে সে। কখন যে কী বলে তার কোনও মাথামুন্ডু থাকেনা বেশিরভাগ সময়। ঘটনাচক্রে সেইসময় ব্রিটিশ ফ্যাক্টরির প্রধান ওয়াটসও এসে উপস্থিত হল। সিরাজ ল এবং ওয়াটস দু’জনকেই শান্তি ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য অনুরোধ করল। ওয়াটস কিন্তু ব্যাপারটা এড়িয়ে গিয়ে বলল যে নবাব যেন এ ব্যাপারে অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের সঙ্গে পত্রালাপ করে। ল নিজেকে সামলাতে না পেরে বলল সে জানে যে আগের মতই নবাবের চিঠিকে কোনরকম গুরুত্ব দেবেনা ওয়াটসন। সিরাজ জ্বলে উঠল। চিৎকার করে বলল তা কী করে সম্ভব।ওরা কি জানেনা সিরাজ কে? কী তার ক্ষমতা? দরবারশুদ্ধু লোক একসাথে যোগ দিল সিরাজের সঙ্গে এবং জানিয়ে দিল যে সিরাজের আদেশ যেন পালন করা হয়।
অ্যাডমিরালের উত্তর সিরাজের কাছে আসার আগেই ওয়াটসন এবং ক্লাইভ চন্দননগর আক্রমণ করল। সে দিনটা ছিল ১৫ই মার্চ, ১৭৫৭। ল সেই রাত্রেই ব্রিটিশদের চন্দননগর আক্রমণের সংবাদ নিয়ে সিরাজের কাছে ছুটে গেল। মাঝরাত্রে এক খোজা এসে নবাবকে খবর দিল যে ব্রিটিশরা চন্দননগর আক্রমণ করেছে। সিরাজ তার সেনাবাহিনীকে চন্দননগর যাবার আদেশ দিল কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আদেশ ফিরিয়ে নেওয়া হল। ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোনওরকম পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে কি না সেই সিদ্ধান্ত কিছুতেই নিতে পারল না সিরাজ। ফরাসিরা পিছু হটছে শুনে রাইদুর্লভকে এগোতে বলা হল কিন্তু যেই খবর এল চন্দননগর ব্রিটিশদের দখলে চলে গেছে সিরাজ সে আদেশ প্রত্যাখ্যান করে নিল। দৃশ্যত দ্বিধাগ্রস্ত সিরাজ একবার ভাবলো যে ফরাসিদের সঙ্গে জোট বাধাটা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে আবার পরমুহূর্তে মনে হল চন্দননগর যদি ইতিমধ্যেই দখল হয়ে যায় তাহলে এই জোট অর্থহীন হয়ে যাবে। ল কী করবে কিছু বুঝে উঠতে পারল না। সিরাজের অবস্থাও তথৈবচ। চন্দননগর এখান থেকে ১৫ দিনের রাস্তা। এখন সেনা পাঠিয়ে কোনও লাভ নেই। তার অনেক আগেই ব্রিটিশরা চন্দননগর সম্পূর্ণ দখল করে নেবে।চন্দননগর দখল মানেই আজ হোক বা কাল হোক ইংরেজদের পরবর্তী গন্তব্য মুর্শিদাবাদ। উপায়ান্তর না দেখে ল গুপ্তচর লাগিয়ে ওয়াটস এর চিঠির সন্ধান করতে শুরু করে দিল। পাকা খবর এসে পৌঁছল যে ব্রিটিশরা আর কিছুদিনের মধ্যেই মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করবে। ইংরেজ সেনারা এখন পলায়মান ফরাসি সৈন্যদের ধাওয়া করে বন্দি করতে ব্যস্ত থাকবে। ল সিরাজকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করাল যে এই সময় অন্তত একশ সৈন্য যদি কাশিমবাজারের ফ্যাক্টরিতে পাঠানো যায় তাহলে কাশিমবাজারে যে কয়জন ফরাসি সৈন্য আছে তারা কিছুটা সাহস পাবে। ল সিরাজকে আরও রাজি করাল যে কাশিমবাজার ফ্যাক্টরির চারিধারে পাঁচিল তুলে অতিরিক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সিরাজের আদেশ অনুযায়ী কাজ শুরু হল কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই পুরো ব্যাপারটা প্রহসনে পরিণত হল। ভীতসন্ত্রস্ত সিরাজের মনে হল ইংরেজরা যদি তার এই ফরাসিদের সাহায্য করার ব্যাপারটা জানতে পারে তাহলে বিপদ বাড়তে পারে। সিরাজ তড়িঘড়ি ল’কে ডেকে প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার ব্যবস্থা করতে বলল। সিরাজ ল’কে একথাও জানাল এই পরিস্থিতিতে সরাসরি আক্রমণে যাওয়ার চেয়ে ওদের কথা মেনে নেওয়া ভাল হবে। যদিও এই মেনে নেওয়া তার অনভিপ্রেত তবুও এ ছাড়া এই সময়ে আর কোনও উপায় নেই।
ল স্থির করল কাশিমবাজার ফ্যাক্টরি সে সিরাজকে হস্তান্তর করে দিয়ে সে কাশিমবাজার ছেড়ে চলে যাবে। সিরাজ যা ঠিক মনে করবে তাই করবে। পরিণতির জন্য সিরাজই দায়ী থাকবে। ল যখন মোটামুটি নিজের প্রয়োজনমত কিছু সামগ্রী ও টাকাপয়সা নিয়ে ফ্যক্টরি ছেড়ে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে সিরাজের দরবারের একজন আধিকারিক এসে জানাল যে সিরাজ নির্দেশ দিয়েছে যে সে যে কোনও অবস্থাতেই ফ্যাক্টরি ছেড়ে না যায়। সিরাজ কিন্তু ল কে ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণের কথাও বলেনি। ব্রিটিশদের আক্রমণ যে ক্রমশ অনিবার্য হয়ে উঠছে সে কথা বুঝতে পেরে ল মত পরিবর্তন করল না। বারবার সিরাজকে অনুরোধ করল যে তাকে যেন কোনও নিরাপদ স্থানে যাবার অনুমতি দেওয়া হয় এবং নিরাপত্তাসহকারে সেই জায়গায় পাঠাবার ব্যবস্থা করা হয়। ৮ই এপ্রিল এই মর্মে ল’কে অনুমতি এবং নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হল যে সে যেন পাটনার নিকটবর্তী ফুলবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়, অন্য কোথাও নয়। আবার এক অজ্ঞাতকারণে ১০ই এপ্রিল সেই অনুমতি প্রত্যাখ্যান করে নেওয়া হল।
ওদিকে ওয়াটস চুপচাপ বসে না থেকে কাশিমবাজারে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করার কাজে নেমে পড়ল। ছদ্মবেশে নবাবের প্রহরীদের চোখ এড়িয়ে একে একে সৈন্যরা এসে কাশিমবাজারে জমা হল। কাশিমবাজার ফ্যাক্টরিতে নিয়মিত যাতায়াত আছে এমন একজন লোককে খুঁজে বের করে সিরাজের কাছে এই সৈন্য আমদানির খবর পাঠাল ল।সিরাজ এবং ল এর কপালে ভাঁজ পড়ল যখন খবর এল নদীপথে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ব্রিটিশ যুদ্ধাজাহাজকে মুর্শিদাবাদের দিকে আসতে দেখা গেছে। যে লোকটা ল এর দূত হয়ে সিরাজের কাছে গিয়েছিল তার হাত দিয়ে সিরাজ খবর পাঠাল যে ল যেন কোথাও না যায়। ল পরে জেনেছিল এই লোকটা ফরাসি এবং ইংরেজ দু’জনের কাছ থেকেই মোটা অর্থের বিনিময়ে গোপন খবর সরবরাহ করত।
উত্তেজনার পারদ যখন বাড়তে থাকল তখন ১৩ই এপ্রিল সিরাজের দরবারে ডাক পড়ল ল এর। প্রবল বৃষ্টি সত্ত্বেও ল সকাল বেরিয়ে পড়ল সকাল দশটায়। সিরাজের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সবসময়েই সন্দিহান থাকে ল। আজ সেই সন্দেহের মাত্রা দ্বিগুন হওয়াই স্বাভাবিক। যাবার আগে সকলকে বলে গেল যে যদি দুপুর দ’টোর মধ্যে সিরাজের দরবার থেকে সে না ফেরে তবে চল্লিশজন প্রহরীকে যেন পাঠানো হয়। বৃষ্টি পেরিয়ে ল যখন দরবারে পৌঁছল তখন সিরাজ মধ্যাহ্নভোজের জন্য হারেমের দিকে রওনা দিয়েছে। ল কে একটা লোকভর্তি হলঘরে নিয়ে গিয়ে অন্য অনেক দর্শনপ্রার্থীদের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজের পংক্তিতে বসানো হল। বিস্বাদ এবং নিম্নমানের খাবার ও পানীয় দিয়ে কোনওক্রমে ক্ষুন্নিবৃত্তি করার পর অন্য একটি হলঘরে তাকে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে সিরাজ ছিল না। সেখানে ওয়াটস এবং জগতশেঠের অনুগত কয়েকজন মান্যগণ্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিল। প্রথামত কুশল বিনিময়ের পর তাকে জিগ্যেস করা হল যে সে ওয়াটসকে কিছু বলতে চায় কি না। ল জানাল তার ওয়াটসকে কিছু বলার নেই। ওয়াটস তখন নিজেই সরাসরি ল’কে জিজ্ঞাসা করল যে সে তার ফ্যাক্টরি ওয়াটস এর হাতে সমর্পণ করতে চায় না ফ্যাক্টরির বাকি সকলের সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে ইংরেজদের আতিথেয়তা উপভোগ করতে চায়। সেখানে তার এবং তার লোকজনদের থাকতে এবং খেতে যাতে কোনও অসুবিধে না হয় সেদিকে লক্ষ রাখার দায়িত্ব ওয়াটসের। ওয়াটস একথাও জানাল যে সিরাজেরও একই ইচ্ছা। ল পরিস্কার জানিয়ে দিল যে তার এবং তার সহকর্মীদের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হাত দেওয়া কেবল অনভিপ্রেতই নয় নীতিবিরুদ্ধ আচরণও বটে। যদি ফ্যাক্টরি সমর্পণ করতেই হয় তবে তা করা হবে সিরাজকে , ইংরেজকে নয়। ওয়াটস তখন দরবারে উপস্থিত দেওয়ানদের উদ্দেশ্যে বলল যে তার পক্ষে ল’কে কিছু বোঝানো অসম্ভব। দেওয়ানেরা চেষ্টা করে দেখতে পারে। তার অনুরোধে দরবারে উপস্থিত বাকি সকলে ল’কে রীতিমত করজোড়ে অনুরোধ করতে শুরু করে দিল যে সে যেন ওয়াটসের কথা শোনে। সিরাজ ইংরেজদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আগ্রহী এবং সিরাজ তাকে বাধ্য করবে ওয়াটসের প্রস্তাব মেনে নিতে। ল কিন্তু তার সিদ্ধান্তে অনড় রইল এবং ওয়াটসের বশ্যতা মানতে রাজি হলনা। সে জানিয়ে দিল যে সে কাশিমবাজারেই থাকবে এবং ইংরেজদের চক্রান্তের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই চালাবে। দরবারের আর সবাই অনেকক্ষণ ধরে বুঝিয়ে কোনও ফল না পেয়ে ওয়াটসের সঙ্গে আলোচনা করে সিরাজের সঙ্গে দেখা করার জন্য অন্দরে গেল। দলে ছিল কয়েকজন দেওয়ান, কয়েকজন ব্রিটিশদের দালাল আর কয়েকজন জগতশেঠের লোক। তারা ফিরে এসে জানাল যে সিরাজ জানিয়েছে ল যেন এই মুহূর্তে নিঃশর্তে ওয়াটসের প্রস্তাব মেনে নেয়। কিন্তু ল তার অবস্থানে অনড়। সে জানিয়ে দিল যে সে সিরাজের এই আদেশ মানা তার পক্ষে অসম্ভব এবং যেহেতু সিরাজ তাকে ডেকে পাঠিয়েছে সুতরাং সিরাজের সঙ্গে দেখা না করে সে দরবার ছেড়ে একপাও নড়বে না। ইতিমধ্যে ল এর নিরাপত্তারক্ষীরা এসে পৌঁছেছে এবং রাজপ্রাসাদের দিকে যেতে শুরু করেছে। ল এর অনড় অবস্থানের কথা যখন সিরাজের কানে এল সিরাজ ল এর সঙ্গে একাকি দেখা করতে রাজি হয়ে গেল।
নিয়মমাফিক সৌজন্য বিনিময়ের পর সিরাজ ল’কে বলল যে হয় তাকে ওয়াটসের প্রস্তাব মেনে নিতে হবে অথবা তার এলাকা ছেড়ে চলে যেতে হবে। সিরাজ জানাল এই অবস্থার জন্য ফরাসিরাই দায়ী। এখন ইংরেজদের হাতে তাকে ভুগতে হচ্ছে এবং সে কোনও ভাবেই চায়না যে গোটা দেশ ইংরেজদের হাতে ভুগতে শুরু করুক। যেহেতু ফরাসিদের নিজেদের রক্ষা করার সামর্থ্য নেই তাদের উচিৎ ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করা। সিরাজ মনে করিয়ে দিল যে যখন ওয়াটসন এবং ক্লাইভের যুদ্ধজাহাজ ইংরেজদের কলকাতা পুনরুদ্ধারের পর হুগলি নদি ধরে এগিয়ে আসছিল তখন ফরাসিদের কাছে সাহায্য চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল সে। আজ ল কী করে আশা করে যে সে সিরাজের কাছে সাহায্য পাবে। ল প্রত্যুত্তরে জানাল যে ওয়াটসের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে সে নিজেকে অসম্মান করতে পারবে না। যেহেতু সিরাজ চায় না সে এখানে থাকুক তাই সে পাটনা চলে যেতে পারে। সিরাজই তাকে একসময় পাটনা যাবার অনুমতি দিয়েছিল। সিরাজ বাদে বাকি সকলে ল’কে দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পশ্চিমে মেদিনীপুর বা কটক যাবার পরামর্শ দিল। দৃশ্যত বিচলিত ল সোজাসুজি সিরাজকে জিজ্ঞাসা করল সে কি চায় যে রাস্তায় সে শত্রুদের হাতে বন্দি হয়। সিরাজ জানাল যে এরকম কোনও অসাধু অভিপ্রায় তার কোনওদিন ছিলনা এবং এবং এখনও নেই। ল এর যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারে কেউ সহযোগিতা না করলেও তার নিরাপত্তার দায়িত্ব সিরাজের এবং আল্লা তার মঙ্গল করবেন। ল উঠে দাঁড়িয়ে সিরাজকে অভিবাদন জানিয়ে সৌভাগ্য এবং শুভযাত্রার প্রতীক হিসাবে তার হাত থেকে পানপাতা গ্রহণ করে বিদায় নেবার মুহুর্তে সিরাজ বলল যে এই পরিস্থিতিতে ইংরেজদের সঙ্গে সঙ্ঘর্ষে না যাবার জন্য সে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি পরিবর্তন হলে সে আবার তাকে ডেকে পাঠাবে। ল তার উত্তরে জানাল যে সে সম্ভাবনা নেই। সে স্থিরনিশ্চিত এটাই তাদের শেষ সাক্ষাৎ।
১৫ই এপ্রিল,১৭৫৭- ল যখন মুর্শিদাবাদ ছেড়ে যাবার সমস্ত প্রস্তুতি সম্পূর্ণ করে ফেলেছে তখন সিরাজ ক্লাইভকে চিঠি পাঠিয়ে জানাল যে সে ইংরেজদের পরামর্শ অনুযায়ী ল’কে মুর্শিদাবাদ থেকে বহিষ্কারের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করেছে এবং তার একান্ত অনুগত পাটনার নায়েব রাজা রামনারায়ণকে নির্দেশ পাঠিয়েছে যে ল যেন কোনওভাবেই তার এলাকাতে থাকতে না পারে তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে। গুপ্তচর এবং বিশ্বাসঘাতকদের সহযোগিতায় ক্লাইভের চোখ এবং কান তখন সিরাজের দরবার, গুপ্তকক্ষ অতিক্রম করে হারেম অবধি পৌঁছে গেছে। ক্লাইভের কাছে এই খবরও এসে পৌঁছেছে যে সিরাজ বিদায়-উপহার হিসাবে ল’কে শুধু দশহাজার টাকা নগদ নয় এই আশ্বাসও দিয়েছে যে যখন ফরাসি গণ্যমান্য ব্যক্তিরা কটকে আসবে তখন সিরাজ তাকে ডেকে পাঠাবে। ক্লাইভের একান্ত বিশ্বাসভাজন অনুচর ওয়াটস ক্লাইভকে জানিয়েছে যে একশ’ ফরাসি নিরাপত্তারক্ষী, ষাটজন তেলেঙ্গি , ত্রিশটি বলদচালিত শকট এবং চারটি হাতি সহযোগে ল এর বাহিনী মুর্শিদাবাদের রাজপথ দিয়ে শহরের সীমান্তের দিকে চলে গেছে। শতশত মানুষ রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে ল এর এই বর্ণময় শোভাযাত্রা দেখেছে এবং তাকে বিদায় অভিনন্দন জানিয়েছে। কিন্তু ল জানে না যে এই শোভাযাত্রার মধ্যে লুকিয়ে আছে ওয়াটসের দুই গুপ্তচর যাদের কাজ প্রভূত অর্থের বিনিময়ে ল এর বিশ্বাসভাজন নিরাপত্তারক্ষী এবং সহযাত্রীদের বিশ্বাসঘাতকে পরিবর্তন করা।
পলাশির যুদ্ধজয়ের পর ব্রিটিশদের এই ঐতিহাসিক চক্রান্তে ওয়াটসের কার্যকারিতা এবং দক্ষতার প্রশংসা করে ৬ই আগস্ট,১৭৫৭ তে লন্ডনের রাজদরবারে এক সভায় ক্লাইভ জানায় যে পলাশির যুদ্ধজয়, ফরাসিদের নির্মূল করা এবং মিরজাফরের সঙ্গে চুক্তি করার পিছনে ওয়াটসের ভূমিকার প্রশংসা না করা অত্যন্ত অন্যায় হবে।
ল এর এই অভিযানের সময় বারে বারে সিরাজের কাছ থেকে বৈপরীত্যে ভরা বার্তা আসতে থাকে। ২রা মে যখন ল বিশ্রাম নেবার জন্য ভাগলপুরে একটু থেমেছে তখন সিরাজের কাছ থেকে খবর এল যাত্রা ত্বরান্বিত করার জন্য। আবার যখন যাত্রার গতিবৃদ্ধি করা হল তখন খবর এল গতি মন্থর করার জন্য। দোলাচলচিত্ত সিরাজের নির্দেশ পালন করতে করতে ৪৫০ কিলোমটার যাত্রা শেষ করতে প্রায় ৪৫ দিন লেগে গেল। পথিমধ্যে অবশ্য ৪৫ জন ফরাসি যারা চন্দননগর থেকে যুদ্ধের সময় পালাতে পেরেছিল তারা এই দলে যোগ দিল। ল এর তখন একটা আশ্রয় দরকার যেখানে পথশ্রমে ক্লান্ত ল এর নিরাপত্তারক্ষীরা কয়েকদিন একটু বিশ্রাম পায়। সৌভাগ্যক্রমে সিরাজের সহকারী পাটনার ভারপ্রাপ্ত নায়েব রাজা রামনারায়ণ তাদের সাদর অভ্যর্থনা জানাল পাটনায়। ল এবং তার দলবল রাজা রামনারায়ণের আতিথ্যে পাটনাতে অপেক্ষা করতে লাগল পরবর্তী নির্দেশের জন্য।
সিরাজের বিরুদ্ধে চক্রান্ত এখন আর কোনও গোপন ব্যাপার নয়। সমস্ত ব্রিটিশ ছাউনিতে এবং রাজদরবারের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে এখন এটাই আলোচনার বিষয়। কিন্তু অবাক কান্ড এটাই যে সিরাজের তথাকথিত বিশ্বাসী গুপ্তচরেরা সর্বত্র ছড়িয়ে থাকলেও তার কানে এ কথা পৌঁছল না যে তার বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং ক্রোধ ক্রমশ সংঘবদ্ধ হচ্ছে এবং তার বিরুদ্ধে এক গভীর ষড়যন্ত্র ইতিমধ্যেই ঘনীভূত হয়েছে। মিরজাফরের সঙ্গে ব্রিটিশদের চুক্তি সম্পন্ন হয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিক ভাবে চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে ১৯শে মে। কিন্তু তার অনেক আগেই ২৬শে এপ্রিল ওয়াটস চিঠি দিয়ে ক্লাইভকে জানিয়েছে যে মিরজাফর প্রস্তুত।
৮ই জুন ল সিরাজের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি প্রার্থনা করে দূত পাঠালে সিরাজ তাকে ফিরিয়ে দেয় এবং জানায় যে এখন দেখা করার কোনও প্রয়োজন নেই। দূত ফিরে এসে জানায় সিরাজের কথায় বা ব্যবহারে তার মনে হয়েছে সিরাজ বেশ নিশ্চিন্তেই আছে এবং অদূর ভবিষ্যতে কোনও বিপদের আশঙ্কা সে করছে না। পলাশির যুদ্ধের মাত্র দু’ সপ্তাহ আগে ১০ই জুন সিরাজকে লেখা ল এর চিঠির আর এক নিষ্পৃহ উত্তর ১৯শে জুন ল এর কাছে এসে পৌঁছয়। পলাশির যুদ্ধের তখন আর কয়েকদিন বাকি। চিঠি এবং উত্তর পৌঁছনোর বিলম্বের জন্য ল রাজা রামনারায়ণের কাছে প্রতিবাদ জানালে রাজা রামনারায়ণের ঔদাসীন্য এবং নিষ্পৃহ মনোভাব ল’কে ভাবিয়ে তুলল। তবে কি চক্রান্তের জাল সিরাজের পরম বিশ্বাসী রাজা রামনারায়ণকেও গ্রাস করেছে?
আমি শুনেছি আপনি ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু এত ভালো ঐতিহাসিক বিষয়ে গবেষণা কখন করলেন? খুব ভালো লেখা চলছে। অনেক ধন্যবাদ এত ভালো একটা ঐতিহাসিক সিরিজ দেওয়ার জন্য।
ReplyDeleteতোমাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। তোমাদের স্নেহ ভালোবাসা আমাকে উৎসাহিত করে নতুন নতুন বিষয় জানতে এবং লিখতে। এমনিভাবেই পাশে থেকো সবসময়।🙏
Delete