0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






মানুষ মাত্রেই শিকড় খোঁজে । যেহেতু সে উদ্ভিদ নয় তাই তার মূল এক ক্ষেত্রে প্রোথিত থাকেনা । খাদ্যের খোঁজে জলের খোঁজে নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের খোঁজে সে বারবার বেরিয়ে পড়ে পথে । তাই মূলও সরতে থাকে এক স্থান থেকে আর এক স্থানে । প্রাক ইতিহাস কাল হোল সেই কাল যখন মানুষ অস্থির হয়ে পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে বাসভূমির খোঁজে । এই বাহ্যিক খোঁজ কালের নিয়মে কখনও ক্ষান্ত হয় কিছুকাল। তারপর আবার যখন প্রকৃতির খেয়ালে ওলটপালট হয়ে যায় মানব পরিবেশের কিছুদিনের অর্জিত স্থিতি, তখন আবার শুরু হয় পর্যটন। আমরা আলোচনা করি এই স্থিতিকালের মধ্যে মানুষের আভ্যন্তরীণ খোঁজ কতটা গভীরে প্রবেশ করে। পৃথিবীর সমস্ত সভ্যতার ইতিহাস এই আভ্যন্তরীণ অগ্রগতির ইতিহাস। মানুষ যখন তার বেঁচে থাকার প্রাথমিক শর্ত পুরন করে উঠতে পারে তখনই সে নিজের ভিতরে ডুব দেয়। অবসর ও নিশ্চিন্ত জীবন ছাড়া এই আত্মানুসন্ধান সম্ভব হয়না। আমরা আজ যে ভারতবর্ষে বাস করি, যার ভৌগোলিক সীমা আপাতনির্দিষ্ট একটি রেখায় বাঁধা, প্রাগৈতিহাসিক ভারতবর্ষের রূপটি সেরকম ছিল বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। বরং তার মধ্যে মানব সভ্যতার সেই অস্থিরতার ছাপ সুপরিস্ফুট ছিল। আমাদের এই ভুখন্ডের ইতিহাসে বারবার সীমানার পরিবর্তন হয়েছে। সে তো অবশ্যম্ভাবী! আমরাও তাই নিজেদের পিতৃপুরুষের খোঁজে মাঝে মাঝে অতীত চারন করে থাকি। এইরকমই একটি অনুসন্ধিৎসা বাসা বেঁধেছিল মনে। আর তার খোঁজেই পাওয়া গেল অমূল্য কিছু সম্পর্ক ও প্রজ্ঞার আলোয় উদ্ভাসিত কিছু রচনা। হাতে এসেছিল শ্রদ্ধেয় শ্রীহরপ্রসাদ শাস্ত্রীর রচনাবলী। অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছি আমার এ অনুসন্ধিৎসা তো কোনও হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে ঝলমল করে ওঠা চিত্তের কথা নয়! শাস্ত্রীমশায় তো কবেই এই উৎসের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছেন! পেলাম শ্রীরাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সেই যে মহেঞ্জোদারো আবিষ্কার করে সকলকে তাক লাগিয়ে দেওয়া পণ্ডিত এবং সুরসিক, জ্ঞানী অথচ অগোছালো মানুষটি! এইভাবেই তো তাঁকে বর্ণনা করেছেন সহকর্মী বন্ধু আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়! ছিলেন শ্রীরমেশচন্দ্র মজুমদার মশায়ও। বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে এইসব উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক কিন্তু অনেকটাই আলোকিত করেছেন আমাদের পূর্ব ইতিহাস সম্পর্কে। তবে কেন এই রচনা? কারণ নিজের মত করে তাঁদের দেওয়া গভীর তথ্য কতটা হৃদয়ঙ্গম করা গেল তার হিসেব কষব বলে। আপাতত ডুব দেওয়া যাক প্রাক ইতিহাস বঙ্গে। তার আগে শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রদত্ত একটি ভাষণের সংক্ষিপ্তসার দেওয়া যাক। বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনের সপ্তম অধিবেশন। স্মৃতিচারণ করছেন শ্রীরাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। মহামহোপাধ্যায় বলছেন “আমার বিশ্বাস বাঙালি একটি আত্মবিস্মৃত জাতি। বাংলার ইতিহাস এখনও এত পরিষ্কার হয় নাই যে কেহ নিশ্চিত করিয়া বলিতে পারেন বাংলা ইজিপ্ট হইতে প্রাচীন অথবা নতুন”। তাঁর অনুমান যে যখন আর্যগন মধ্যএশিয়া থেকে পাঞ্জাবে আসে তখনও বাংলা সভ্য ছিল। তারা যখন এলাহাবাদ পর্যন্ত অগ্রসর হয়, তখন বাংলার সভ্যতায় ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে বাঙালিকে ‘ধর্মজ্ঞানশূন্য’ এবং ‘ভাষাশূন্য’ পক্ষী বলে বর্ণনা করেছে। এই আত্মবিস্মৃতি আমাদের মজ্জায় মজ্জায় বলেই একটি প্রাচীন সমৃদ্ধ জাতি হয়েও নিজেদের ইতিহাস সেভাবে রচনা ও রক্ষায় আমরা ব্রতী হইনি । কিছু বিচ্ছিন্ন চর্চা হয়েছে নিঃসন্দেহে, তবে তা এখনও জনমানসে বঙ্গীয় ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারকে থিতু করতে পারেনি । এই বিশ্বাস থেকেই এই রচনার অবতারণা।

বিদেশী ইতিহাসবিদদের দ্বারা প্রচলিত তত্ত্ব অনুসারে খ্রিষ্টপূর্ব ২২০০/২০০০ নাগাদ ককেশাস পর্বত অতিক্রম করে আদি ইন্দোইউরোপীয়দের একটি দল, যারা ইরানী ও ভারতীয় আর্যদের পূর্বপুরুষ বলে মনে করা হয়, ক্রমে উপস্থিত হয় উত্তর ইরাকে১। এই দলকেই সুনীতিকুমার বলছেন ইন্দোইউরোপীয়গণের আর্য শাখা। তিনি জানিয়েছেন পাঞ্জাবেই এদের বাস বেশি করে ঘটে, কারণ এই অঞ্চল আর্যদের কেন্দ্রস্থানীয় ইরাণের পাশেই অবস্থিত ছিল। তাঁর মতে – ঈরাণ বলিলে পারস্য আফগানিস্তান ও বেলুচিস্তান এই তিনদেশকেই ধরিতে হয়। অতএব পরিষ্কার হয়ে যায় যে পুরুষপুর বা পেশোয়ার, তক্ষশীলা ইত্যাদি ভারতীয় নামের জনপদগুলি তৎকালীন ভারত ভুখন্ডের অবিচ্ছিন্ন অংশ ছিল। যদিও আর্যরা আসলে বাইরে থেকে এই শ্বাপদসঙ্কুল অরন্যে ঢাকা দেশকে সভ্য করেছিল বলে দাবী ওঠে, কিন্তু এইসব টুকরো প্রমাণ দেখে বোঝা যায় বহিরাগত জাতিতত্ত্বটি আসলে আমাদের হীন জাতি প্রমানের মরিয়া চেষ্টা। ইতিহাসবিদ অধাপিকা রোমিলা থাপার এই দায় চাপিয়েছেন মিল প্রমুখ পাশ্চাত্যের ইতিহাসবিদদের ওপর। এঁরা প্রাচ্যভূমিকে সভ্য তকমা দিতে নারাজ। এছাড়াও শ্রীমতী থাপার উনবিংশ শতকের ভারতীয় জনমানসে এদেশের সেই বর্বর চিত্রটি আঁকার দায় তথাকথিত ইভাঞ্জেলিকালদের বলেও দাবী করেছেন। আদতেই তা নয়। অবশ্য আর্যদের পিতৃভূমি হিসেবে কাস্পিয়ান সাগরের উত্তরে ও উরাল পর্বতের দক্ষিণের মধ্যবর্তী ভূখণ্ডকেই মার্কা দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে ওখান থেকেই তাদের যাত্রা শুরু। সে তো মানবসভ্যতা সদা সঞ্চরনশীল! আমরা তাই ধরে নিই যে আর্যরা আমাদের তৎকালীন বাসভূমির উত্তর পশ্চিমের পার্বত্য উষর ভূমি থেকে নেমে এসেছিল শস্যশ্যামল নদীবাহিত উপত্যকা অঞ্চলে, মুলত জল ও খাদ্যের খোঁজে। তারা বহিরাগত নয়, তবে তাদের বাস ছিল সমগ্র মধ্য এশিয়া জুড়ে । কখনও তারা চলে গেছে পূর্ব ইউরোপ ধরে, কখনও নেমে এসেছে এশিয়া ভূমি ধরে। আর তাদের সেই নেমে আসার সময়ে তারা মোটেই সভ্য কোনও জনগোষ্ঠী ছিলনা। যাযাবর জাতি যেমন হয় ঠিক তেমনি মারকুটে হিংস্র স্বভাবের ছিল এরা। তারা তাদের পিতৃভূমি থেকে ঘোড়া এনেছিল। মানব সভ্যতাকে আর্যদের শ্রেষ্ঠ দান হোল বুনো ঘোড়াকে পোষ মানানো। ঘোড়ার অদ্ভুত গতিকে কাজে লাগিয়ে এরা সমৃদ্ধ জনপদে লুঠতরাজ করত, কখনও বা একটি দুটি ঘোড়া সেখানে বিক্রি করে যেত। এভাবেই উত্তরের ঘোড়া দক্ষিণে আসে ও দক্ষিণের গরু উত্তরে আসে। মনে করতে পারি অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা। রাজার অশ্ব ছুটে চলবে নিজের রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে। অন্য রাজ্যে যদি সে অবাধ গতি পায় তার অর্থ সে রাজ্য এই রাজার বশ্যতা স্বীকার করেছে। এই অপ্রতিহতগতি অশ্ব আসলে দুর্নিবার আর্য সভ্যতার রূপক। অবশিষ্ট ভারতভূমির অবস্থা তবে কেমন ছিল? আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি যে সিন্ধু সরস্বতী অববাহিকায় তখন এক অতি উচ্চমানের সভ্য মানবজাতির বসবাস ছিল। নাগরিক সভ্যতার চরম উৎকর্ষ ঘটেছিল এদের মধ্যে। সিন্ধু সভ্যতা বৈদিক সভ্যতার চেয়ে বহু প্রাচীন এবং পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীন নদীমাতৃক সভ্যতা, যেমন মিশরে নীলনদের অববাহিকায় গড়ে ওঠা মিশরীয় সভ্যতা, মেসোপটেমিয়ার টাইগ্রিস ও ইউফ্রেতিস নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠা সুমেরীয় সভ্যতা, ইত্যাদির সমসাময়িক। সিন্ধু সভ্যতার বিশেষ দিকগুলি নিয়ে আলোচনার পরিসর অন্যত্র খুঁজে নেওয়া যাবে। আপাতত বলি, সেই সময়ে দ্রাবিড় ও অস্ট্রিক জাতির মানুষ এই ভূখণ্ডের অধিবাসী ছিল। তারাও কোনও না কোনও সময়ে এখানে এসে বাসা বাঁধে। সে তো মানুষ তার উপযোগী বাসভূমি খুঁজেই চলেছে। যেহেতু সেইকাল নিতান্তই প্রাগৈতিহাসিক সেহেতু আমরা ধরে নিতে পারি এই অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীই ভারতবর্ষের আদি বাসিন্দা । অস্ট্রিক জাতির মানুষ মুলত অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী বলেই মান্যতা পেয়েছেন । আর দ্রাবিড় জনগোষ্ঠীর আদি হোল ভুমধ্যসাগরীয় অঞ্চল । এখন এরা যখন বহু আগেই ভারতে নিজেদের আস্তানা বেঁধেছেন তখন ধরেই নেওয়া যায় যে এদের জীবনধারণের প্রাথমিক শর্তাবলী পুরন হয়েছে আর্যদের আগেই । অতএব আর্যদের মধ্য, দক্ষিণ ও অবশেষে পূর্ব ভারতে প্রবেশের সময়ে সেইসব অঞ্চলে ইতিমধ্যেই উন্নত নাগরিক ও গ্রামীণ মানবজাতি বসবাস করছিল । দ্রাবিড় সভ্যতার কতখানি উৎকর্ষ ঘটেছিল তার প্রমাণ আমরা পাই লঙ্কাধীশ দশাননের প্রবল পরাক্রম ও স্বর্ণলঙ্কার কুবেরের মত সম্পদের বর্ণনায় । মেঘনাদের মত বৈজ্ঞানিক প্রতিভার স্বাক্ষরে ও বিভীষণের মত কূটনীতির ধুরন্ধর ব্যাক্তিত্বে । কেউ যদি মনে করেন যে বিভীষণ লঙ্কাকে রামচন্দ্রের হাতে সঁপে দিয়েছিলেন তবে তা ভুল । তিনি স্বাধীন লঙ্কাকে নিরঙ্কুশ ভাবে স্বাধীন রাখতেই রামচন্দ্রের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন । সেখানে তিনিই রাজা । লঙ্কার প্রজাদের শান্তির জন্যে এই জটিল রাজনৈতিক অঙ্কটি তিনি কষেছিলেন । এর সমর্থনে একটি তথ্য দেওয়া যাক। রামায়ণে লঙ্কাদ্বীপকে সিংহলও বলা হয়েছে। বুদ্ধদেবের জন্মের অনেক আগে বাঙালীরা জলে স্থলে এত প্রবল হয়েছিল যে বঙ্গরাজ্যের এক রাজপুত্র সাতশ লোক নিয়ে নৌকাযোগে লঙ্কাদ্বীপ দখল করেছিলেন। তাঁরই নাম থেকে এই দ্বীপের নাম হয় সিংহল। রাজপুত্রের নাম ছিল বিজয় সিংহ। যদিও বিজয় সিংহ নামটি আর্য ছোঁয়ায় সিক্ত। সিংহলের ইতিহাস থেকেই জানা যায় যে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে বিজয়সিংহ নামে কোনও বঙ্গরাজপুত্র সিংহলে উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন।

কত প্রাচীন বঙ্গ সভ্যতা? জানা যায় যে মিশর ব্যাবিলন প্রভৃতি দেশে ২০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত তামার ব্যাবহার অপ্রতিহত ছিল। প্রাচীন এই সাম্রাজ্যগুলো আর্যআক্রমণে ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ নাগাদ ধ্বংস হয়ে যায়। ভারতবর্ষের তাম্রযুগ হয়ত সিন্ধুসভ্যতার ধ্বংসের পরে পরেই শেষ হয়ে যায়। তামার উল্লেখের কারণ বাংলার যে প্রধান নদীবন্দরটির কথা আমরা প্রাচীন সব সাহিত্যে ভ্রমণবৃত্তান্তে ও শাস্ত্রে দেখতে পাই তার নাম তাম্রলিপ্তি। তমলুক বা তাম্রলিপ্তির নামের মধ্যে তামা যতটাই প্রভাব বিস্তার করুক না কেন, বাংলাদেশে মাত্র তিনস্থানে তামার অস্ত্র পাওয়া গিয়েছে। ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশে ঝটিযান পরগনায় তামাজুয়া গ্রামে একটি তামার কুঠারফলক পাওয়া যায়। কিন্তু তাম্রলিপ্তির আশেপাশে তো কোনও তামার খনি নেই! তবে এদেশে তামা এলো কি করে? শ্রীরাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন যে দক্ষিণাপথবাসী আদিম মানবের সাথে উত্তরাপথবাসী মানবের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মাদ্রাজ ও বাংলায় আবিষ্কৃত নতুন প্রস্তরযুগের অস্ত্রগুলোর সাদৃশ্য প্রচুর। শুধু তাই নয়, অস্ত্রগুলির পাথরও একই জাতীয়। কিন্তু যেখানে এই পাথর পাওয়া যেত সে জায়গা বাংলা থেকে বহুদূরে। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট বলের অনুমান যে এইসব প্রাচীন অস্ত্র আদিম মানব দক্ষিণ থেকে বাংলায় আনেন। তাই তামাও একইভাবে দক্ষিণ থেকে বাংলায় আনা সম্ভব। অর্থাৎ ভারতে যখন তাম্রযুগ চলছে তখন বাংলায় তামার তৈরি নানা জিনিস, উৎপন্ন না হলেও, আমদানি হচ্ছে।এই অঞ্চলের তখনকার তাম্রসভ্যতা কেবল সিন্ধু সভ্যতার কাছাকাছি মানের ছিলনা, উভয়ের মধ্যে ধর্ম ও কালচারের অনেক মিল ছিল এবং বানিজ্যিক সম্পর্কও মজবুত ছিল। বাংলার মত দক্ষিণ বিহারের তখনকার বাসিন্দারাও ছিলেন অস্ট্রিক দ্রাবিড় ও মঙ্গোলীয় রক্ত ও ভাষাভাষী মেশানো মনবগোষ্ঠী। রাজায় রাজায় যুদ্ধ থাকলেও এই অঞ্চলগুলির মধ্যে কোনও যুদ্ধের খবর পাওয়া যায়নি। কারণ আন্দাজ করা যায় যে, যে মানবগোষ্ঠী চাষবাসের উদ্ভব ঘটানো ছাড়াও দুনিয়ার সঙ্গে ব্যাপক বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল তাদের কাছে যুদ্ধের চেয়ে শান্তি ও সহযোগিতাই কাম্য ছিল। যুদ্ধ বর্বরের চরিত্র।

তাম্রলিপ্তির সংস্কৃত অর্থ হতে পারে তামার লেপ। কিন্তু আগেই বলেছি তমলুকের কাছে কোনও তামার খনি নেই। অন্য একটি অর্থ ধরি। বহু প্রাচীন সংস্কৃতে তাম্রলিপ্তিকে বলা হয়েছে দামলিপ্তি। অর্থাৎ দামলদের একটি বন্দর। বাংলায় যে এককালে দামল বা তামিল জাতির প্রাধান্য ছিল সেটা এথেকেই বোঝা যায়। লৌহযুগ শুরু হবার বহু আগেই বাঙালিরা নানাদেশে ধান চাল বিক্রি করত। যেসব নৌকোয় এই শস্য তারা নিয়ে যেত, সেগুলো বেতে বাঁধা হত। কেননা লোহার প্রচলন হয়নি তখনও। এই বেতে বাঁধা নৌকোকে বলা হত বালাম নৌকো। সেই বালাম নৌকোয় যে চাল আসত তাকে বলা হত বালাম চাল। এই চালের নাম তো সবাই জানে। বালাম কোনও সংস্কৃত কথা নয়। এই যে জলে স্থলে প্রবল, বানিজ্যে লক্ষ্মীর বসত, এমন একটি জাতিকে ঈর্ষা করা তো স্বাভাবিক! গাঙ্গেয় উপত্যকায় আর্য সাম্রাজ্যের সীমা শতপথ ব্রাহ্মনে পরিবেশিত একটি গল্পের মধ্যে খুব সুন্দর প্রকাশিত। কথিত আছে যে বিদেহ রাজ্যের রাজা বিদেগ মাথব, আগ্নি নিয়ে সদানীরা নদীর তীর পর্যন্ত পর্যটন করেন। এখানে এসে তিনি থেমে যান। কারণ পূর্বতীরের ভূমি অগ্নিকে উৎসর্গ করা হয়নি। রাজা তখন বিদেহভূমির বাকি অংশ, নদীর অপরপারের ভূমিকে ম্লেচ্ছদেশ বলে ঘোষণা করলেন। শ্রীমতী থাপার জানিয়েছেন জৈন ধর্মে মিলাক্কু, অর্থাৎ বর্বর, শবর, পুলিন্দা, ইত্যাদি আদি অধিবাসীদের সঙ্গে সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদের মেলামেশা নিষেধ ছিল। কিন্তু বৌদ্ধধর্মে আর্যদেশ ও ম্লেচ্ছদেশের মধ্যে কোনও বিভেদ ছিলনা। তাই আমরা পরবর্তী কালে দেখতে পাই বঙ্গের (বৌদ্ধ)সিদ্ধাচার্যরা সব তথাকথিত এই অন্ত্যজ বা নীচজাতির মানুষ ছিলেন। কিন্তু এঁদের প্রণীত ধর্ম, দর্শন ও গীতিগ্রন্থ গুলি কোনভাবেই অসংস্কৃত মানুষের রচনা তো নয়ই, বরং উচ্চভাবের দর্শনের ছবি পাওয়া যায়।

বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস প্রথম ভাগ, প্রথম খণ্ডে প্রাচ্যবিদ্যাবিশারদ শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু একটি সংস্কৃত শ্লোককে মনুর বাক্য বলে উদ্ধৃত করেছেন, যার বক্রার্থ মিথিলা বাদে অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ সৌরাষ্ট্র ও মগধ দেশে তীর্থযাত্রা বিনা অন্য কারণে গমন করলে পাতিত্যদোষ হয় ও পুনঃসংস্কার প্রয়োজন হত। সংস্কার মানে প্রায়শ্চিত্ত। শ্লোকটি পড়া যাক।

অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গেষু সৌরাষ্ট্রমগধেষু চ তীর্থযাত্রাং বিনা গচ্ছন্ পুনঃ সংস্কারমর্হতি।

অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ধ্বজাধারীরা নানা বৈদিক ক্রিয়াকর্মের দ্বারা শুদ্ধ করে নিত তাদের বংশজদের। মিথিলা বাদ কেন? কারণ মিথিলার রাজা জনক ঋষি যাজ্ঞবল্ক্যের শিষ্যত্ব গ্রহন করেছিলেন। স্বয়ম্বর সভায় আগত আর্য রাজপুত্র অযোধ্যার যুবরাজকে নিজের পালিতা কন্যার পাণিগ্রহণের অনুমতি দেন। সীতা কিন্তু ভূমিকন্যা। লাঙলের ফলায় উঠে আসা শিশুকন্যাটির জনকদুহিতা হিসেবে পরিচয় দুটি সাক্ষ্য দেয়। এক, তিনি ভূমিকন্যা, অর্থাৎ অনার্য। দুই, তিনি জন্মে পরিত্যক্ত। জনকদুহিতার বিবাহ আর্যরাজপুত্রর সঙ্গে হওয়ার অর্থ জনক আর্যসমাজভুক্ত হলেন।

বৃহৎ বঙ্গে তখন অস্ট্রিক জাতির মানুষ বাস করতেন। কোল, মোন, খোর ইত্যাদি। পরে যারা লোধা শবর ইত্যাদি জাতিবৈশিষ্ট বহন করেছেন । বাঙালীর ইতিহাস ধরতে গেলে তাই শ্রদ্ধেয় সুনীতিকুমারের মতে বাঙালি জাতির উৎপত্তি নিয়ে ভাবতে হয় । আজকাল যদিও সমভাষিতাকেই জাতীয়তার প্রধান লক্ষণ বলে ধরা হয়, তবে আচার্য সুনীতিকুমার অবশ্য সে যুক্তি মানেননি। তাঁর কাছে টানা ও পোড়েন দুটিই যদি ঠিক ভাবে না বোনা হয় তবে বস্ত্রের কোনও অস্তিত্ব থাকেনা । আমরা অবশ্যই ভাষার আলোচনায় যাবো, তবে তার আগে একটি উন্নত জাতির জন্মক্ষণটিকে ধরা বড়ই পবিত্র বলে মনে হয়। বিশেষত এখনও এই অঞ্চলে সাঁওতাল মুন্ডারী হো কুরকু শবর ইত্যাদি আরণ্যক ভাষাগুলি প্রাচীন অস্ট্রিক ভাষারই অবশেষ। তারা কি তবে বাঙালি নন? এ প্রশ্ন তো বড়ই প্রাসঙ্গিক! এখানে উল্লেখ্য যে ভারতবর্ষের পূর্ব দিকে যে সভ্যতা ছিল সেখানে মানুষ যুদ্ধ করতে ভালবাসত না । অবিশ্বাসের কোনও কারণ নেই কেননা আমরা সকলেই জানি যে সিন্ধু সভ্যতার মানুষও অস্ত্রের ব্যবহার জানত না। অত সভ্য ও উন্নত মানুষ অস্ত্র ব্যবহার করত না মানে তারা শত্রু হিসেবে কাউকে গণ্য করতনা । এরও একটি মনস্তাত্ত্বিক যুক্তি আছে । যে মানুষ তার জীবনের প্রাথমিক চাহিদা গুলি পূর্ণ করে ফেলেছে সে কখনই নিজেকে নিয়ে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কিত নয় । বরং বাহ্যিক জীবন থেকে সে তখন আভ্যন্তরীণ জীবনে বেশি আকৃষ্ট । আরও সে কী চায় ! আরও সে কিসের অনুসন্ধান করে!

ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গ বগধ চের জাতির উল্লেখ আছে । হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন “অতি অল্পদিন হইল ঐতরেয় আরণ্যকের একটি ব্রাহ্মনে উহাদের নাম পাওয়া গিয়াছে। বঙ্গ যে বাংলা ইহাতে কোনও সন্দেহ নাই। বগধ যে মগধ তাইতেও সন্দেহ হওয়া উচিত নয়। আর চের হলো কেরল প্রদেশের একটি শাখা।” ঐতরেয় ব্রাহ্মণে ভারতবর্ষ অথবা আর্যভূমির অথবা আর্যজাতির বসতি বিস্তারের সীমা নির্ধারণ করলেও তারপরই ঐতরেয় আরণ্যকে বলা হোল বঙ্গ-বগধ-চেরজাতি পক্ষীবিশেষ। এদের ধর্ম নেই। এরা নরকগামী। এর মোটামুটি অর্থ হোল যে এরা আর্যদের শত্রুবিশেষ। বসতি বিস্তারে বাধা দিতেন, তাই। এদেরকে আর্যরা তাই মানুষ না বলে পক্ষী বানর রাক্ষস ইত্যাদি নামে অভিহিত করত। এখন দেখা যাচ্ছে যে বুদ্ধদেব, মহাবীর ও আরও পাঁচটি অহিংস অনার্য ধর্ম এই পক্ষীদেশে প্রচলিত ছিল। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে ইন্দ্র দেবতার মন্ত্রে অভিষেক হওয়াতে যেসব রাজা বিশেষ অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন তার একটি সুদীর্ঘ তালিকা আছে । এই তালিকার শেষভাগে লেখা আছে যে ভরতরাজা ইন্দ্র অভিষেক নিয়ে ১৩৩টি অশ্বমেধ করেছিলেন । এর মধ্যে ৭৮টা যমুনার পশ্চিমে মরুষ্ণ দেশে ও ৫৫টা গঙ্গার পূর্বে জলবৃষ্টির দেশে । ৭৮ টা দেশের মধ্যে বেলুচিস্তান ছিলনা । কারণ তাহলে সেটাও ভরতের নামাঙ্কিত হত । এখন বাকি ৫৫ টির জন্য কতটা স্থান দরকার? শাস্ত্রীমশায় বলেছেন এলাহাবাদ থেকে ঠিক উত্তর মুখে রেখা টানলে ঐ রেখা ও গঙ্গার পূর্ব পারের মধ্যে যত দেশ পড়ে তা ওই অশ্বমেধের পক্ষে যথেষ্ট । এখানেই প্রমাণ পাওয়া গেল যে বঙ্গভূমি আর্য উপনিবেশ গড়ে ওঠার আগেই একটি সভ্য দেশ বলে মান্য ছিল । কত আগে থেকে তবে এ অঞ্চলে সভ্য মানুষের বাস? সভ্য অর্থে যারা অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের বাইরে আরও কিছু , যেমন চারুকলা, গীতি ও কাব্যরস, উন্নত দর্শন ইত্যাদির চর্চা করেছেন। একটু দেখে নিই লিখিত ঐতিহাসিক তথ্য আমাদের কতদুরে নিয়ে ফ্যালে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র এক বিখ্যাত প্রামাণিক গ্রন্থ। সেখানে সাংখ্যদর্শনের প্রশ্বস্তি শোনা যায়। যে ষড়দর্শন ভারতীয় দর্শনের মূলসাংখ্য তারই একটি। সাঙ্খ্যের রচয়িতা হলেন কপিল মুনি। আর্যরা যে সময়ে পশ্চিমে যাগ যজ্ঞ নিয়ে, দেশ দখল করতে, শূদ্রদের আয়ত্ত করতে, তাদের দাস বানিয়ে রাখতে ব্যস্ত তখন বঙ্গ বগধ চেরগণ পরকাল নিয়ে ব্যস্ত । কিসে জন্ম জরা মরণের হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যায় তাই নিয়ে ব্যস্ত । কি আছে সাংখ্যে? মহামুনি কপিল শুরু করেছেন যে সূত্র দিয়ে তার তাৎপর্য এইরূপ – ত্রিবিধ দুঃখের যে অত্যন্ত নিবৃত্তি তাহাই অত্যন্ত অর্থাৎ পরমপুরুষার্থ নামে অভিহিত হইয়া থাকে। ত্রিবিধ দুঃখ হোল আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক দুঃখ। এর অনন্তকালের জন্য উপশম, আর কখনও আত্মাকে কোনরূপ দুঃখের অনুভূতি পোহাতে হবেনা। জড়সম্বন্ধরহিত হয়ে এইরূপ আত্মস্বরূপে অবস্থানই হোল মুক্তি। কপিলমুনির সিদ্ধাশ্রম হোল গঙ্গাসাগরে। কপিলমুনি বাঙালি। আর কবতাক্ষের তীরে তাঁর গ্রাম। আর তিনি জন্মেছিলেন কপিলাবাস্তুতে । কপিলের বাস্তু । সেখান থেকে নেমে এসেছিলেন দক্ষিণের সাগরতীরে। গৌতমের চেয়ে অন্তত হাজার বছরের বড় । প্রমাণ, বুদ্ধ জন্মাবার আগে ২৪ জন বুদ্ধ জন্মেছেন । মহাবীর জন্মাবার আগে আরও ২৪ জন তীর্থঙ্কর জন্মেছেন । সর্বোপরি বৌদ্ধধর্ম যে সাংখ্যমত থেকে উৎপন্ন হয়েছে এ কথা অশ্বঘোষ একরকম বলেই গেছেন। বুদ্ধদেবের যে দুজন গুরু অড়াঢ় কালাম ও উদ্রক দুজনেই সাংখ্যমতাবলম্বী ছিলেন ও দুজনেই বলেছেন ‘কেবল’ অর্থাৎ জগতের সঙ্গে সম্পর্কশূন্য হতে পারলেই মুক্তি। বুদ্ধ সেই অবস্থান থেকে সরে এসে বলছেন কেবল হলেও অস্তিত্ব থেকে যায়। সুতরাং অস্তিত্ব থাকলে মুক্তি নেই। শ্রদ্ধেয় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছেন যে যদি বৌদ্ধধর্মের উৎস হিসেবে সাংখ্যমতকে ধরা হয় তবে একরকম স্বীকার করে নেওয়া হলো যে বৌদ্ধধর্ম আর্য ধর্ম থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। কিন্তু তা নয়। সাংখ্যমতকে শঙ্করাচার্য তো বৌদ্ধ মতের মতই অবৈদিক বলেছেন। “Chronology of the Samkhya Literature” প্রবন্ধে শাস্ত্রীমহাশয় সাংখ্যমতের সঙ্গে বৌদ্ধমতের সম্পর্ক বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। সাংখ্যমতে ঈশ্বরের অনস্তিত্বই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। সাংখ্য বলছেন, ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ প্রমানাভাবাৎ। প্রমানের অভাবে ঈশ্বর সিদ্ধ হইলেননা। বুদ্ধদেবও অনুরূপভাবে প্রমানের অভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের আগে পূর্বাচলে প্রচলিত ছিল আরো পাঁচটি ধর্ম মত ।এগুলিরও প্রধান নীতি ছিল অহিংসা। সুতরাং বুদ্ধদেব বা মহাবীর প্রথম ধর্মে অহিংসা প্রচার করেন তা ভাবা ভুল। প্রথম প্রথম বৌদ্ধ পণ্ডিতরা তাঁদের সাহিত্যে মাগধী, পালি ও অর্ধমাগধী ব্যবহার করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁরাও সংস্কৃত ব্যবহার করতে শুরু করলেন। এইখানে একটি কথা বলা চলে। কপিলমুনি সাংখ্যদর্শনের প্রবক্তা হলেও মনে করা চলে যে যে ভাষায় সাংখ্য (সংস্কৃত) লিপিবদ্ধ হয়েছে তা অনেক পরের কথা। তখনও লিপি জন্ম নেয়নি। শ্রুতিতেই শাস্ত্রের প্রচলন ছিল। সুতরাং সাংখ্যকে খ্রিস্টপূর্ব অন্তত হাজার বছর আগে জন্মানো শাস্ত্র বলে অনুমান করাই যায়। তথাগতের দুই গুরু অড়ার কালাম ও উদ্রক ছিলেন সাংখ্যমতাবলম্বী । আমরা বৌদ্ধধর্মের মূল কথাগুলি মনে করলে দেখব যে বুদ্ধদেব নিজে কতখানি প্রভাবিত ছিলেন সাংখ্যের দ্বারা। তাঁরও তো প্রধান লক্ষ্য ছিল জরাব্যাধিমৃত্যুর ত্রিফলা দুঃখের থেকে নিবৃত্তি! আর তিনি যখন জন্মেছেনই সাংখ্যের বাস্তুতে তখন এই প্রভাব অবশ্যম্ভাবী। অশ্বঘোষ বলছেন – গোতমঃ কপিলো নাম মুনিধর্মভূতাঃ বয়ঃ । কৌটিল্য ২৩০০ বছর পূর্বেকার লোক। তিনি যে তিনটি দর্শনের অস্তিত্ব স্বীকার করেছেন সেগুলি হোল সাংখ্য, যোগ ও লোকায়ত। অন্য দর্শনশাখা গুলির তখনও উৎপত্তি হয়নি। যদিও অধুনা যে বাইশটি সূত্র কপিলের রচনা বলে প্রচলিত সেগুলি ঈশ্বরকৃষ্ণ (খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতক) রচিত কারিকা দেখে লেখা। সেগুলি বড় প্রাচীন নয়। কারণ তার আগেও সাংখ্য মতের পুস্তক ছিল। মাঠর ভাষ্যের কথা ও শোনা যায়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও সাংখ্যমত যে অতি প্রাচীন সে অশ্বঘোষ ও কৌটিল্যের লেখা থেকেই বোঝা যায়।

শাক্য মুনি শেষ বুদ্ধ । মহাবীর শেষ তীর্থঙ্কর । সেসময় পূর্বাচলে সাংখ্য দর্শনের খ্যাতি তুঙ্গে । পূর্বাচল আর্থিক সমৃদ্ধিতেও মহীয়ান তখন । ফলে সমাজজীবনে উচ্চতর দর্শনচর্চা চলছে । ফলত আর্য্যদের মারকুটে মনোবৃত্তিকে ভালো চোখে তো দেখা হয়ই না , উপরন্তু কিভাবে দূরত্ব ও স্বাতন্ত্র বজায় রাখা যায় সেদিকেই সব প্রয়াস। সাংখ্যও তাই বেদবেদান্তের ছায়ামুক্ত। সাংখ্যের পুরুষপ্রকৃতিতত্ত্ব তাই বেদে খুঁজে পাওয়া যায়না। অনেকেই বলবেন যে সাংখ্যের ভাষা তো সংস্কৃত! এখানে ভাষাপ্রসারের তত্ত্বও বলতে হয় তবে। আর্যরা যে ভাষা ব্যাবহার করত তা সংস্কৃত নয়, বৈদিক। আচার্য সুনীতিকুমার বলছেন খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ থেকে ১৪০০ বা ১৩০০ পর্যন্ত যেসব আর্যভাষার নাম পাওয়া যায় সেগুলিকে বৈদিক সংস্কৃতের পূর্বঅবস্থার ভাষার শব্দ ও নাম বলা যায়। একে একসঙ্গে প্রাক-সংস্কৃত ও প্রাক-ইরানী বলা যায়। এই প্রাক-সংস্কৃত তখনও কোনও বিশিষ্ট সংস্কৃতির বাহন হতে পারেনি কারণ আর্যজাতি তখনও কতকটা আদিম যাযাবর অবস্থায় ছিল। পার্থিব সভ্যতায় বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। পূর্বাঞ্চলে তখন অস্ট্রিক সভ্যতা মুখ্যতর গ্রামীণ সভ্যতা ছিল বলে অনুমান করা হয়। দ্রাবিড় সভ্যতার মত নাগরিক সভ্যতা ছিলনা। এ থেকে এই ধারণাই প্রবল হয় যে পূর্বাঞ্চলের মানুষজন বস্তুবাদী ছিলেননা। ধীরে ধীরে অনার্য ভাষাগুলির সঙ্গে আর্যভাষার মিলন ঘটতে লাগল। বৈদিক ভাষায় ভাঙন ধরল ও তা প্রাকৃতের রূপধারণ করল। পাঞ্জাব অঞ্চলে, বিশেষ করে, পাণিনি ও তাঁর পূর্ববর্তী পণ্ডিতদের চেষ্টায় একটি সাহিত্যের ভাষা গড়ে উঠল ও সেটি সংস্কৃত নামে সুপ্রতিষ্ঠিত হোল।

এবার আসি আরও একটু এগিয়ে। মোটামুটিভাবে ধারণা করা গেছে যে আজ থেকে অন্তত তিন হাজার কি তারও কিছু বেশি সময় ধরে আমাদের এই ঠিকানা বেশ অগ্রসর এক মানবগোষ্ঠীর ঠিকানা। দেখে নিই কোথায় কি উল্লেখ আছে এর। গ্রীক ঐতিহাসিক ডায়োডরাস সিকুলাস লিখেছেন – যখন মহামান্য আলেকজান্ডার তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে আরও পূবে অগ্রসর হচ্ছেন তখন দুত এসে তাকে জানালো যে যে রাজা পুরুকে (পরমানন্দ চন্দ্র, কাঙরা উপত্যকার কাটচবংশীয় রাজা) তিনি পরাজিত(?) করেছিলেন তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র পুরু এখন গঙ্গাহৃদয় রাজ্যের শরনাপন্ন। তিনি ফেগাসের কাছ থেকে আরও জেনেছেন যে, সিন্ধুনদের অপরপ্রান্তে প্রথমে একটি মরুভুমি পড়ে। সেটিকে অতিক্রম করতে সময় লাগে প্রায় বারোদিন। তারপর আসে গঙ্গা নামে এক বিশাল নদী। তার গভীরতা ও ব্যাপ্তি যেকোনো ভারতীয় নদীর চেয়ে অনেক বেশি। এই নদী পেরিয়ে আসে প্রাচ্য (গ্রীক উচ্চারণে প্রাসি) ও গঙ্গাহৃদয় নামে দুই রাজ্য। এই রাজ্যের রাজা চন্দ্রমেষ। তাঁর দু লক্ষ পদাতিক, কুড়ি হাজার ঘোড়া, দুহাজার রথী এবং চারহাজার হাতী আছে। এই হাতীগুলি যুদ্ধের জন্য অস্ত্রসজ্জিত ও পুরো মাত্রায় প্রশিক্ষিত।৩ খুব সম্ভবত এই কারণেই আলেকজান্ডার আর এই নদী পার হবার সাহস করেননি। তাঁর সেনাদল রনহস্তী সামলানোর মত বীর ছিলনা বলেই মনে হয়। যেহেতু এ অঞ্চলে তখন সাম্রাজ্যবাদী রাজাদের অস্তিত্ব ছিলনা, নিজেরা নিজেদের রাজ্যের সীমার মধ্যেই খুশী থাকতেন, যেটুকু সৈন্যসামন্ত রাখা হত সে শুধু সমুদ্রবাহিত হয়ে এই মোহনারাজ্যে যদি জলদস্যু বা অন্য কোনোরকম বহিঃশত্রুর মোকাবেলা করতে হয়, তার জন্য। প্লুটার্কের বিবরণ থেকে জানতে পারি যে প্রাচ্য ও গঙ্গাহৃদয়ের রাজারা দুলক্ষ পদাতিক, আশিহাজার অশ্বারোহী, আটহাজার রথী ও ছহাজার রনহস্তী নিয়ে আলেকজান্ডারের সঙ্গে যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়েছিলেন।৪ মেগাস্থিনিস জানিয়েছেন গঙ্গার নিম্নগতিতে অবস্থিত এই সম্পন্ন রাজ্যগুলি কখনও সার্বভৌমত্ব হারায়নি। কোনও বিদেশী রাজা এগুলিকে আক্রমণ করে নিজ বশ্যতায় আনতে পারেনি। একদিকে যেমন এরা নিজেরাই খুব পারদর্শী ছিলেন রাজ্যরক্ষা ব্যাপারে, তেমনই গঙ্গা তার প্রছুর শাখাপ্রশাখা নিয়ে উর্বর অথচ বিদেশীর পক্ষে অগম্য ছিল। উপরন্তু হাতীকে সামলানোর বিদ্যে এই বিদেশীদের অধরা ছিল। মেগাস্থিনিসের বিবরনে গঙ্গাহৃদয়ের মোহনার কাছের এলাকাগুলো এখনকার সুন্দরবন অঞ্চলকেই মনে করায়। এবং আশ্চর্যের কথা এই যে সেইসব ছোট ছোট এলাকার ভূপতিরাও পদাতিক অশ্বারোহী ও রথী রাখতেন। যদিও সংখ্যায় তা নগণ্য।৫ শুধুই বিবরণ নয়। একসময়ে পূর্ব ভূখণ্ড যে বৈদেশিক বানিজ্যেও উন্নত ছিল তার প্রমাণস্বরূপ কিছু নিদর্শন পাই আমরা। যেমন বাংলাদেশের ময়নামতী অঞ্চলে পাওয়া এই রোমান মুদ্রা দুটি। এতে হারকিউলিসের মুখ মুদ্রিত।

Roman coins with inscriptions of Hercules have been discovered in Mainamati, Bangladesh

যে সময় থেকে ভারত ভূখণ্ডের ইতিহাস নানা নিদর্শনের মাধ্যমে একটা কাঠামো পেতে শুরু করেছে প্রায় সেই সময় থেকেই জানা যায় যে ভূখণ্ডের বণিক সম্প্রদায় বহির্বাণিজ্যে পোক্ত ছিল । সড়ক পথে যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে জল পথে পণ্য আমদানি রপ্তানি হত । জলপথ বলতে পূর্ব ভূখণ্ডের বন্দর গুলো প্রধান ছিল বলে মনে করতে পারি । খৃষ্টপূর্ব যেসব ঐতিহাসিক বিবরণ পাওয়া যায় সেখানেও তাম্রলিপ্তির উল্লেখ পাই । যুক্তি বলে যেখানে নৌ বাণিজ্য এমন সমৃদ্ধ ছিল সেখানে নৌ নির্মাণ শিল্পও নিশ্চয় অনেক উন্নতি লাভ করেছিল । তবে কেন বঙ্গের কোনও রাজত্বের কোনও বিশিষ্ট ব্যাক্তির নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়না ? কোনও মুদ্রা, কোনও শিলালেখে কেন বঙ্গের সেইসময়ের সমৃদ্ধির কথা নেই?

প্রাক বুদ্ধ ইতিহাসে , এমনকি শশাঙ্ক পূর্ববর্তী ইতিহাসেও বাংলার উল্লেখ সেভাবে নেই । শিল্পে বাণিজ্যে শিক্ষায় শিল্পকলায় যেন বঙ্গদেশের কোনও স্থানই নেই । অসভ্য এক ভূখণ্ড যেন । অরণ্য সংকুল, শ্বাপদ সংকুল এক বিপজ্জনক স্থান । এমনটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক । অথচ ফাহ ইয়েনের বিবরণ থেকে স্পষ্ট যে বাংলায় তখন বৌদ্ধ ধর্ম শুধু প্রভাব বিস্তার করেনি , ধর্ম ও বিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রও প্রস্তুত করেছিল । তাম্রলিপ্তি ছিল বন্দর নগর । সেখান থেকে জাহাজ যেত সুমাত্রা যবদ্বীপ সুবর্ণদ্বীপ ইত্যাদি দূর প্রাচ্যের দেশগুলিতে বাণিজ্য করতে । ভারতের বহির্বিশ্বের সঙ্গে বাণিজ্যের প্রধান যাত্রাপথ । কি যেত সেইসব জাহাজে ? সমগ্র উত্তর ভূখণ্ডের রপ্তানীযোগ্য পণ্য নদীবাহিত হয়ে এসে জড়ো হত বন্দর নগরটিতে । আর সেখানে নিশ্চয় ঠাঁই পেত বাংলার নিজস্ব শষ্যসম্পদের সঙ্গে সঙ্গে খাঁটি বঙ্গীয় মসলিন ও আখের গুড় । অতএব আর্থিক সমৃদ্ধি বাংলার কিছু কম ছিলনা । একটি সূত্র নিবেদন করি। কেমন ছিল সেইসময়ে বাংলার অর্থনীতি?

‘সাগরকে দক্ষিণে রেখে এবং তীরকে বামে রেখে নৌযানে ভাসার সময়ে গঙ্গা চোখের সামনে এলো। আর এর একেবারে কাছেই পূর্বের সর্বশেষ ভূমিখণ্ড, ক্রাইস। এই ভূখণ্ডের কাছের নদীটির নাম গঙ্গা। এটি নীলনদের মতই গতিশীল। এর তীরবর্তী যে বাণিজ্য নগরটি আছে তারও নাম এই নদীর নামে। এই নদীপথ দিয়েই মালাবথ্রম (মালাপত্র?), গাঙ্গেয় জটামাংসী, ও মুক্তা, এবং উৎকৃষ্ট মসলিন সরবরাহ হয়। শোনা যায় যে এই স্থানের নিকটে স্বর্ণখনিও আছে”। এটি খ্রিষ্টীয় প্রথম শতকে পেরিপ্লাসের লেখা।৭

একটি অল্পখ্যাত সূত্র জানাই এবার। চন্দ্রকেতুগড়। বারাসাতের কাছে উত্তর চব্বিশ পরগণার বেড়াচাঁপা নামে একটি অঞ্চলের কাছে এক পুরাতাত্ত্বিক ক্ষেত্র পাওয়া গিয়েছে। শ্রদ্ধেয় রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি মহেঞ্জোদারো আবিস্কারের কারণে বিখ্যাত, ১৯২২এ লিখছেন চন্দ্রকেতুগড় সম্পর্কে -ভগ্নাবশেষ এবং মূর্তিসমুদয় ইতিহাসের বিস্ময়! ১৯৫৬/৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউসিয়াম এই ভগ্নস্তুপে একটি মন্দির আবিষ্কার করেছে। মনে করা হয় যে এই মন্দিরটি খনা মিহিরের সমসাময়িক। আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বলছে যে এই মন্দির ও দুর্গ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে দ্বাদশ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ব্যাপ্ত এক নাগরিক সভ্যতার চিন্হ। মন্দিরটি পালযুগে নির্মিত।৮ এই সময়কাল শুরু হয়েছে মৌর্যযুগের শুরু থেকে এবং শেষ হয়েছে পালযুগের শেষ পর্যন্তয়। এই চন্দ্রকেতু কে, এই নিয়ে বেশ বিভ্রান্তি আছে। পণ্ডিতরা মনে করেন গ্রীক ঐতিহাসিকরা যে সান্দ্রকোটাস এর নাম উল্লেখ করেছেন তাঁদের বিবরণে তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। সান্দ্রকোটাস এর সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের কিছু মিল পাওয়া যায়, তবে চন্দ্রকেতুর মিল বেশি। এই সমস্ত তথ্যের উল্লেখ এইজন্যে যে বঙ্গভুমি, যদিও তার ভৌগোলিক সীমা হয়ত অন্যরকম ছিল, আদ্যন্ত এক সভ্য পৃথক কৃষ্টিসমৃদ্ধ জাতির মাতৃভূমি ছিল। অধ্যাপক সুনীতিকুমার তাঁর একটি প্রবন্ধে৯ জানিয়েছেন তাঁর এক ছাত্র শ্রীমান মোল্লা রবীউদ্দিন মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমায় সালু ডাকঘরের অন্তর্গত গীতগ্রামে বাস করতেন। সেখানে তাঁর গ্রামের ঠিক বাইরে সৈদগুর ডাঙা বলে একটি ঢিবি আছে। আচার্য জানিয়েছেন এই এলাকাটি সভতায় বাংলাদেশে অগ্রণী। বহু প্রাচীন দীঘি, বিহারের ধ্বংসাবশেষ, ঢিবি এখানে আছে, যা এখনও প্রত্নতত্ত্ববিভাগ খুঁড়তে শুরু করেননি। কর্ণসুবর্ণ এখানকার বিখ্যাত নগরী ছিল। এই সৈদগুর ডাঙাটি যদিও কবরে ভর্তি, তবুও ঝড় বৃষ্টি পড়লে ওপরের মাটি সরে গিয়ে বেশ কিছু অদ্ভুত জিনিস বেরিয়ে পড়ে। ওপর ওপর বেরিয়ে আসা জিনিসের মধ্যে নীল মীনেকাজের কাঁচের বড় বড় দানা, নীল মীনেকাজের পাত্রের টুকরো, ধাতুমূর্তি ইত্যাদি। এগুলিকে বিশেষ গুরুত্ব তিনি দেননি। কিন্তু একবছর প্রবল বর্ষায় সেই ঢিবির একাংশ ধ্বসে পড়ে। তখন সেখানে যা পাওয়া যায় তার একটি তালিকা দেওয়া যাক।

১ সাতটি তাম্রমুদ্রা। কোনটায় সুন্দর ভাবে আঁকা হাতী, কোনটায় বৃষমুণ্ড। কোনটা আবার প্রাচীন মিশরীয় হাতল সমেত ক্রস (crux ansata)। এছাড়া চৈত্য, পুকুর, গোড়া বাঁধানো গাছের চিত্রও আছে। শ্রীযুক্ত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীযুক্ত কাশীনাথ দীক্ষিত জানিয়েছেন এগুলো ভারতের সবচেয়ে পুরনো কাস্ট কয়েন, যা পুরাণযুগে প্রচলিত ছিল, ঠিক তার পরের সময়ের। এই তাম্রমুদ্রা গুলির সময় এঁরা নির্ধারণ করেছেন খৃস্টীয় দ্বিতীয় শতক। তবে এইসব মুদ্রা কোনও রাজার নামাঙ্কিত নয়। কারণ এগুলির প্রচলন ঘটত বনিকসঙ্ঘের দ্বারা। নিজেদের টাঁকশালে এই মুদ্রাগুলি তারা তৈরি করতেন। প্রমাণ হোল মুদ্রাগুলি মাঙ্গল্যসুচক চিহ্ন এবং ধাতুর বিশুদ্ধির উল্লেখ বহন করে। এ বানিজ্যে শ্রী ও অর্থলাভের আশায়, এমনটা ভাবা অসঙ্গত নয়।

২ বেশ কটি পোড়ামাটির পাত্রের টুকরো, এগুলি এলাহাবাদ অঞ্চলের ভীটাতে প্রাপ্ত বহুপ্রাচীন নিদরশনের সঙ্গে মেলে।

যদিও আচার্যের সময়কালে এই ঢিবিটির স্বরূপ উন্মোচিত হয়নি, আশা রাখি পরবর্তী কোনও সময়ে তা হয়েছে বা হবে।

এবার একটু ভাষার দিকে তাকানো যাক। পূর্বের রাজ্যগুলির এই শ্রী ও সমৃদ্ধি ইতিমধ্যে প্রমাণিত। নিশ্চয়ই এবার এঁদের নিজস্ব ভাষার প্রয়োজন পড়বে। কেননা ভাবনাচিন্তার জগত কাব্যের জগত তো একটি প্রয়োজনীয় স্বতন্ত্র ভাষার দাবী করে! যেহেতু বাংলা ভাষার উৎপত্তি আমরা চর্যাপদ থেকে ধরি, তাই এ অঞ্চলে তৎকালীন প্রচলিত ভাষা অনুমান করা যায় - মাগধী । উত্তর পূর্বাঞ্চলে তখন মাগধীই বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপ পরিগ্রহ করে প্রচলিত ছিল। তবে বিদ্যাচর্চার ভাষা ছিল সংস্কৃত। বাংলাভাষা যখন গড়ে উঠছে বাঙালি কবিরা সংস্কৃত ছাড়া আরও দুরকম ভাষা ব্যবহার করতেন। একটি সেদিনের নির্মীয়মাণ বাংলাভাষা, অন্যটি সমগ্র আর্যভারতের সাহিত্যে ও ভাববিনিময়ে আচরিত পশ্চিমী অপভ্রংশ, অর্থাৎ চারহাজার বছর আগেকার হিন্দুস্থানী ভাষা১০। এই কবিদের মধ্যে কেউ কেউ বাংলাভাষার স্বতন্ত্র একটি রূপ সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন এবং নিজেরা বাংলাভাষী হিসেবে গৌরব বোধ করতেন। আচার্যের অবিকল ভাষায় তুলে দিই, কিভাবে সেসময়ের একজন কবি সংস্কৃত ভাষায় আর্যাছন্দে রচিত একটি পদ্যে বাংলাভাষার সঙ্গে গঙ্গানদীর তুলনা করেছেন। “গঙ্গা যেমন বারির প্রাচুর্যে পরিপূর্ণ, বাংলাভাষার রচনায়ও তেমনি রয়েছে বিভিন্ন প্রকারের প্রাচুর্য। গঙ্গা সুন্দর তাঁর বক্রগতিশীলতায় আর বাংলাভাষা সুন্দর তার সূক্ষ্ম-তীক্ষ্ণ চতুরতায়”। উভয়েরই আশ্রয় গ্রহন করেছেন কবিরা। তাঁরা যেমন গঙ্গার সৌন্দর্য বর্ণনা করেছেন তেমনই বাংলাভাষাতে তাঁদের রচনা নির্মাণ করেছেন। ভেবেছেন এর সংস্পর্শে যারা আসবেন তারাই নদী আর ভাষা উভয়ের পূতস্পর্শলাভে পবিত্র হবেন। “ঘন-রস-ময়ী বঙ্কিম-সুভগা উপজীবিতা কবিভিঃ। অবগাঢ়া চ পুনীতে গঙ্গা বঙ্গালবাণী চ”১০। এখানে তবে পণ্ডিত কবি শ্লোককারদের দেখা পাইনা কেন? তার কারণ তখন কাব্যরচনা করতেন যাঁরা, তাঁরা রাজসভায় রাজ অনুগ্রহে সভাকবি ছিলেন। তাঁদের কাব্যচর্চা শুরুই হত রাজস্তুতি দিয়ে। এর নিদর্শন ভূরি ভূরি। কিন্তু সেসময় বাংলায় কোনও রাজসভার কবির দেখা মেলেনা। কারণ? কারণ বাংলায় প্রবল পরাক্রমশালী নৃপতিরা রাজত্ব করতেন না। করতেন ছোট ছোট রাজারা। এঁদের বড়সড় জমিদার বলা চলে। এঁরা শিল্পে ও বাণিজ্যে এতটাই স্বনির্ভর ছিলেন যে নিছক অন্য রাজার ধনসম্পদের লোভে পড়ে সে রাজ্য আক্রমণ করতেন না। বরং বহির্বাণিজ্যের আবশ্যিক শর্ত মেনে পরস্পর সৌহার্দ্য রক্ষা করে অনেকটা সমবায় প্রথা অবলম্বন করে সমুদ্রে জলযান পাঠাতেন। ভারতের মূল ভূখণ্ডের সম্রাটও বিলক্ষণ বুঝতেন এর মহিমা। তাই মনে হয় এখানে সৈন্য পাঠানোয় অনীহা ছিল তাঁদের । অর্থনীতি ভেঙে পড়তে পারে । অপরদিকে বাংলা নদীমাতৃক দেশ । চিরকাল সুজলা সুফলা । ধান, গুড় আর তণ্তুজাত বস্ত্র তার একান্ত নিজের জিনিস । সমৃদ্ধ শিল্প । সুতরাং বাংলার মানুষ খেয়ে পড়ে ভালো থাকতেন । যুদ্ধ করবার ইচ্ছে জাগত না । কে না জানে যুদ্ধ হলো অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে খর্ব করতে সবলের অত্যাচার ? এখনো দুনিয়া জুড়ে যে যুদ্ধ চলছে তার কারণ যাই বলা হোক না কেন মূল কারণ টাকা । এসময়ে মহাজনপদগুলি নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় আসীন কোনও সম্রাটের অধীন। যেমন ধরা যাক অশোক। অশোকের রাজত্বকালে কিরকম ছিল বাংলার অবস্থা? পুণ্ড্রবর্ধন। আধুনিক উত্তরবঙ্গের প্রাচীন নাম। পুণ্ড্র হোল সেই জনগোষ্ঠী যারা ইন্দোএরিয়ান ভাষা বলতনা। বাংলাদেশের বগুড়া জেলার করতোয়া নদীর অববাহিকায় এই প্রাচীন রাজ্যের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। যেহেতু এরা বৈদিক কৃষ্টিকে আত্মস্থ করেননি তাই ব্রাহ্মণ্য যুগে এদেরকে অস্পৃশ্য বলে হীন করা হয়েছে। মহাস্থানগড়ে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের একটি শিলালিপি পাওয়া গিয়েছে যেখানে ব্রাহ্মি হরফে প্রাকৃত ভাষায় লেখা। মনে করা হয়, অশোকের অনেক পূর্বেই পুণ্ড্রে বৌদ্ধধর্মের চর্চা শুরু হয়। পুণ্ড্র যদি উত্তরবঙ্গ হয় তবে তা কপিলাবাস্তু থেকে দুরত্বে বেশি নয়। সর্বোপরি তখন পূর্বাঞ্চলে সাংখ্য মতের জয়জয়কার। বৈদিক ধর্ম নয়, বরং সাংখ্যের প্রবর্তিত মত ও তা থেকে উদ্ভুত ধর্মই সাধারণের ধর্ম ছিল। স্বয়ং গৌতম ছিলেন সাংখ্যের পরিবর্তিত ও উন্নত মতের জন্মদাতা। পুণ্ড্রবর্ধনে এইসময়ে অজীবিক ধর্মাবলম্বী মানুষের বাস ছিল। মক্ষলি পুত্র গোশাল ছিলেন অজীবিক ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। উল্লিখিত শিলালিপিটিতে বলা হয়েছে, অশোকবদনের সূত্র অনুযায়ী, সম্রাট অশোক পুণ্ড্রের সমস্ত অজীবিকদের হত্যা করতে আদেশ দিয়েছিলেন। কারণ কোনও একজন অজীবিক একটি চিত্র এঁকেছিলেন যাতে গৌতম বুদ্ধ নির্গ্রন্থ জ্ঞাতিপুত্রের পদমূলে নত হয়ে প্রণাম জানাচ্ছেন। অজীবিকরা তখনও বৌদ্ধধর্মের আশ্রয়ে আসেনি। তাঁদের নিজস্ব ধর্মমত যথেষ্ট প্রগতিশীল ছিল। বৌদ্ধধর্ম তখন রাজধর্ম। বুদ্ধদেব স্বয়ং সম্রাটের আরাধ্য। তাই এই চিত্র তাঁর অভিমানে এমন আঘাত করেছিল যে তিনি এই নির্দেশ দেন। এর ফলে প্রায় আঠেরো হাজার অজীবিককে হত্যা করা হয়। তাহলে শুধু বৈদিক ধর্ম নয়, বৌদ্ধধর্মেও সন্ত্রাস ছিল! রাজধর্ম তখন বৌদ্ধধর্ম এবং স্পষ্টতই সম্রাট অশোক তখন বৌদ্ধধর্ম গ্রহনপূর্বক ধর্মাশোকে পরিবর্তিত। কলিঙ্গযুদ্ধের মর্মান্তিক পরিণতিতে যে অশোক গভীর অনুতপ্ত, পরবর্তীতে তাঁর পক্ষে আঠেরো হাজার ভিন্নধর্মের মানুষকে হত্যা করা অধর্ম হয়নি? সব্বজীবে দয়া তবে কই? এথেকে স্পষ্ট, কেন সেইসময়ের পুণ্ড্র, সমতট, গৌড়, বা গঙ্গাহৃদির উল্লেখ আমরা সমকালীন দলিলগুলিতে পাইনা। দুটি প্রত্যক্ষ কারণ হোল – এক, এই অঞ্চলের অধিবাসীরা ভিন্নজাতি, ধর্ম, ভাষা ও কৃষ্টির অনুসারী ছিলেন, যা তৎকালীন সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের চোখে হীনজাতি, হীনকৃষ্টি, হীনভাষা, ও হীনধর্ম। হীন অর্থ অনার্য। দুই, এই হীন মানুষগুলো কিন্তু স্বাধীন ও সার্বভৌমত্ব বজায় রেখে নিজেদের অস্তিত্বের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে গেছে চিরকাল। এখনও কি পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে বাকি ভারতের কিছু পার্থক্য থেকে যায়নি? কিন্তু বৌদ্ধধর্মের দুকুলপ্লাবী প্রভাব নিয়ে যখন তা সব প্রচলিত ধর্মকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল তখন সবার আগে পূর্বাঞ্চলেই তা ঘটল। বৌদ্ধধর্মের ঔপনিবেশিক প্রভাবের কথা কিন্তু মাথায় রাখতে হয়। পূর্বভারতে তখন যে সমস্ত সম্প্রদায় ছিল সেগুলিকে ঐচ্ছিক সমিতি বলা যেতে পারে। বৌদ্ধধর্ম প্রথম একটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ও ক্ষেত্রবিশেষে বলপূর্বক অন্য সম্প্রদায়ের মানুষকে বৌদ্ধধর্মের ছত্রের তলায় আনে। বুদ্ধ ক্ষত্রিয় ছিলেননা । তাঁর দেহসৌষ্ঠবে মঙ্গোলীয় প্রভাব স্পষ্ট। পরবর্তী কালে আর্যরাজারা বুদ্ধকে ক্ষত্রিয় ও আর্যবংশজাত বানিয়ে ছেড়েছেন।

৩৯৯ খ্রীষ্টাব্দে ফাহ ইয়েন ভারতের উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন । তখন উত্তর ভূখণ্ডের সম্রাট বিক্রমাদিত্য । পাটলিপুত্রে ফাহ ইয়েন তিন বৎসর কাল ছিলেন । সেখান থেকে আসেন তাম্র্লিপ্তিতে । এখানে তিনি বাইশটি সংঘারাম দেখেছিলেন । অর্থাৎ বাংলায় তখন বৌদ্ধ ধর্ম প্রধান ধর্ম । এখান থেকেই তিনি যবদ্বীপ যাত্রা করেন। অতএব সেই চতুর্থ শতকে বাঙালি যথেষ্ট সমৃদ্ধ এক জাতি যারা ধর্মের প্রসারে বিদ্যার প্রসারে অর্থ কাল ও স্থান ব্যয় করতে পারেন।

বাংলায় বৌদ্ধধর্মের প্রসারের ফলে পুণ্ড্র, সমতট, গৌড়, তাম্রলিপ্তি ইত্যাদি বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচুর বিহার নির্মিত হয়। তখন আমরা সর্বভারতীয় সম্রাটের অধীন। তবুও যে জাতিবৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়নি তার প্রমাণ বাংলার ধর্মে ও ধর্মীয় সাহিত্যে। যে চর্যাপদকে আমরা বাংলার প্রথম সূর্যকিরণ বলে মনে করি সেগুলিও তো আসলে বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের রচিত গুঢ় আধ্যাত্মিক সঙ্কেতধর্মী গীত, যা ধর্মীয় আসরে হোক বা নিভৃতে, গাওয়া হত। সহজযান ও বজ্রযান বৌদ্ধমতের প্রতিষ্ঠা ও বাংলায় হয়। দীপঙ্করশ্রী জ্ঞান অতীশ তো বৌদ্ধধর্মকে সমুহ বিনাশ থেকে বাঁচিয়েছিলেন। তাঁর মত পণ্ডিত ও প্রজ্ঞাবান আচার্য সেসময়ে আর কেউ নিশ্চয়ই ছিলনা। থাকলে তাঁর নাম ইতিহাসে সগৌরবে ঘোষিত হত। তবে তন্ত্রের প্রবেশে বৌদ্ধধর্মের মূলসুরটি গেল কেটে। দেহতত্ত্বের নামে নানা কদর্য আচার প্রবেশ করল ধর্মে। হয়ত সেইসময়ে এ ধর্মের বিনাশকাল চিহ্নিত হয়ে গিয়েছিল। সেন রাজারা সুদূর কর্ণাটক থেকে এসে যখন বাংলা অধিকার করলেন তখন পালযুগ সবে শেষ। পালরাজারা বৌদ্ধ হলেও সকল ধর্মে তাঁদের উদার দৃষ্টি ছিল। কিন্তু সেনরাজাদের সেই দূরদৃষ্টির অভাব বাংলার মানুষদের সঙ্গে তাঁদের এক হতে দিলনা। সঙ্কীর্ণ ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা বাঙালি জাতির মধ্যে জাতিগত সঙ্কীর্ণতা, অস্পৃশ্যতা ইত্যাদি প্রবিষ্ট করলেন। ধীরে ধীরে বিষবৃক্ষ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। আমরা সেইসব প্রাচীন বঙ্গীয় জনগনকে সমাজের নীচু, অশিক্ষিত, দরিদ্র ও হীনকর্মে প্রবৃত্ত মানুষ বলে দাগিয়ে দিলাম। এখনও সেই ট্র্যাডিশন চলছে। এখনও যেন উপলব্ধির সময় আসেনি যে, আমরা সমগ্রতার মাধ্যমেই হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করতে পারি। শ্রীমতী থাপার দুঃখ প্রকাশ করেছেন, যেভাবে সিন্ধুসভ্যতার আবিষ্কার হয়েছিল ভূখণ্ডের সমান্তরাল খননের দ্বারা, সেই একভাবে পূর্বাঞ্চলের ভূমিখণ্ড কেন যে সমান্তরাল খননকার্যের উপযুক্ত বলে মনে করা হলনা! প্রত্নতত্ত্ব তাহলে কিছু খুচরো লম্বখননের দ্বারা প্রাপ্ত নিদর্শনের ওপর নির্ভর করতনা। গাঙ্গেয় ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা জুড়ে একটি সমান্তরাল খননের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা কার্যকরী হলে আমাদের ইতিহাস অন্যরকম হত। এও যে ইচ্ছাকৃত নয় কে বলতে পারে? বারান্তরে এইসব অনার্য জাতির উৎস ও গতি সম্পর্কে একটি রচনার অবতারণা করা যাবে।

এরপরের ইতিহাস আমরা জানি। কিভাবে পালযুগের শেষে উত্তর ভারতে শোনা যাচ্ছিল এক নতুন ধর্মের মানুষের পদধ্বনি। কিভাবে তারা ভারতবর্ষ আক্রমণ করতে ধেয়ে আসছে। সব আমরা জানি। আমরা আরও জানি কি করে সেইসময়ের বাংলায় বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা নিজেদের সমস্ত পুঁথি, সমস্ত আরাধনার ধন গোপন করে ফেলেছিলেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় শ্রীহরপ্রসাদ শাস্ত্রীমহাশয় তিব্বত থেকে বহু বৌদ্ধপুঁথি উদ্ধার করে আমাদের সামনে হাজির করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে কী আত্মিক সম্পদে আমরা সম্পদবান! তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আলোচকের অসাধ্য। কোনও জাতি আত্মিক বা দার্শনিক ব্যাপারে তখনই মাথা ঘামাতে পারে যখন সে অন্ন বস্ত্র সংস্থানের চিন্তা থেকে মুক্ত হতে পারে।

তাই বাংলা কোনও অরণ্যসংকুল শ্বাপদসঙ্কুল জংলী জাতির বাসভূমি নয়। আর্যরা এসে তাঁদের শিক্ষিত ও সভ্য করেনি। বরং আর্যরাই অসভ্য বর্বর এক যাযাবর উপজাতি ছিল। যারা বসতির জন্যে খাদ্যের জন্যে এই ভূমির শান্তিপ্রিয় বাসিন্দাদের আক্রমণ করেছে। সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছে। এই ইতিহাস পুনরুদ্ধারের প্রয়োজন আছে। এই ইতিহাস আবার আমাদের পথপ্রদর্শক হতে পারে।



তথ্য সূত্র

১/ আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রণীত এশিয়া খণ্ডে সংস্কৃত ভাষার প্রসার ও প্রভাব । শারদীয় আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৩৫০ সন ।
২/ শ্রীহরপ্রসাদ শাস্ত্রী প্রণীত বৌদ্ধধর্ম- কোথা হইতে আসিল?। ‘নারায়ণ’ পত্রিকা ফাল্গুন চৈত্র ১৩২১।
৩/ Diodorus Siculus (c.90 BC – c.30 BC). Quoted from The Classical Accounts of India, Dr R.C. Majumder, p. 170-72/234.)
৪/ Plutarch (42-120 AD). Quoted from The Classical Accounts of India, p.198
৫/ Megasthenes (c.350 BC-290 BC).Quoted from the Epitome of Megasthenes, Indika. (Diod. II. 35-42.), Ancient India as Described by Megasthenes and Arrian. Translated and edited by J.W. McCrindle
৬/ Ptolemy (2nd century AD). Quoted from Ancient India as Described by Ptolemy, John W. McCrindle, p. 172.
৭/ The Periplus of the Erythraean Sea (1st century AD). Quoted from The Periplus of the Erythraean Sea, Wilfred H. Schoff, p. 47-8.
৮/http://timesofindia.indiatimes.com/city/kolkata/Finally-heritage-tag-for-2500-yr-old-Chandraketugarh/articleshow/11531973.cms
৯/“গীতগ্রাম আবিষ্কার”। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা ২ সংখ্যা, ১৩৩৫
১০/ আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বাংলার সংস্কৃতি’ প্রবন্ধ থেকে।
১১/ রমেশচন্দ্র মজুমদার রচিত বাংলাদেশের ইতিহাসঃ প্রাচীন যুগ। কলকাতা ১৯৮৮
১২/ অতুল সুর রচিত বাংলা ও বাঙালীর বিবর্তন। কলকাতা ২০০১
১৩/ সুকুমার সেন রচিত প্রাচীন বাংলা ও বানালী। কলকাতা ১৩৫০ (বাংলা সন)
১৪/ Thapar Romila (2010): Ancient Indian Social History, Some Interpretations. Orient BlackSwan. hyaderabad

[একালের রক্তকরবী বৈশাখ ২০১৭]

0 comments: