Next
Previous
Showing posts with label গল্প. Show all posts
0

গল্প - মনোজিৎকুমার দাস

Posted in






বিলের মাঝের কয়েকটি গ্রাম । জঙ্গলকাটি , স্বরূপপুর , আগুন পাখি ,বিলকমল ,সোনাঝরা । গ্রাম কয়েকটি জঙ্গলকাটি জমিদারীর আধীন । লেখাপড়া হীন অন্ত্যজ শ্রেণির গরীব প্রজাদের ওপর অন্যায় অত্যাচার আর ব্যাভিচার করতে কসুর করেনি ওই জমিদারগোষ্ঠী । কসুর করেনি খাজনা না দেওয়ার অভিযোগে গরীব প্রজাদের জমি নিলামে বিক্রি করে দিতে।

ওই গোষ্ঠির জমিদার বাহাদুর নিবারণবাবুর চরিত্র সদরে ফুলের মত পবিত্র ।আর ভিতরে মাকাল ফলের ভেতরের মত কালো ।রিরংসা জাড়িত নিবারণবাবু কাম চরিতার্থ করার জন্য একদল দালাল, লেঠেল আর পাইক পেয়াদা সদা প্রস্তুত । জমিদার বংশের বড়বাবু থেকে মেঝবাবু ,সেজবাবু , ছোটবাবুদের চরিত্র একই ছাঁছে বাঁধা ।

সুন্দরী সুন্দরী বউ ঘরে থাকতে খাসতালুকের প্রজাদের বউ মেয়েদের প্রতি আসক্তি তাদের প্রবল ! ভাবলে হাসি পায় , জমিদাররাই আবার সমাজপতি হয়ে অন্ত্যজ শ্রেণির প্রজাদের অপকর্মের নামগন্ধ পেলে শূলে চড়াতে কসুর করেনি

নিবারণ তাদের এস্টেটের জমিদার হওয়ার আগে নিবারণের বাবা রাজশেখর জঙ্গলকাটির জমিদার ছিলেন, এক সময় তিনি বয়সের ভারে নুব্জ হয়ে পড়েন । তার ছেলেমেয়ের সংখ্যা অর্ধ ডজন । রাজশেখরের রক্ষিতা কামিনীসুন্দরী এককালে ডাকসাইটে সুন্দরী ছিল তা তার বেশি বয়সের চেহারা দেখেও বুঝতে পারা যেত । বিরজাবালা রাজশেখরে অগ্নিসাক্ষী করা বউ হলেও একসময় অন্দরমহলের সর্ব্ময় ক্ষমতা ছিল কামিনীসুন্দরীর ওপর।
অল্প বয়সে রাজশেখরের ছেলেমেয়েরা জানতো সেই তাদের মা । রক্ষিতা হয়েও রাজশেখরের সংসারের হাল ধরে রাখার জন্য কামিনীসুন্দরীই আসলে রাজশেখরের পরিবারের সর্বেসর্বা ছিল তার যৌবনের ফুটন্ত দিনগুলোতে ।বলতে গেলে বলতে হয়, সেই কালপর্বে রাজশেখরের শয়নকক্ষের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল অনিন্দ্যসুন্দরী রক্ষিতা কামিনীসুন্দরীর ওপর ।

বড়বাবুর সুপুত্র নিবারণ তার বয়ঃসন্ধিক্ষণের কাল থেকেই ছিল রিরংসা জারিত । তার কামনার বহ্নি থেকে অন্ত্যজ শ্রেণির উঠন্ত বয়সী মেয়েরা খুব কমই রেহাই পেয়েছে । নাদুসনদুস সুন্দর চেহারার তের চোদ্দ বছর বয়সের ছেলেরা পর্যন্তও তার হাত থেকে রেহাই পায়নি । জমিদার পরিবারে সমকামিতা পাকাপোক্ত আসন গেড়ে বসে ,যা ছিল ধরা ছোঁয়ার বাইরে ! এমন কি নিকট সম্পর্কের বোন ফুলবালা নিবারণের কামনার বহ্নিতে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় । ফুটফুটে কিশোরীরটির কুমারিত্বকে ছিড়ে খায় নিবারণ সুযোগ বুঝে । নিবারণ অনেক আগেই তার কৌমার্য ভঙ্গের অভিষেক ঘটিয়েছিল বাড়ির কাজের মেয়ের সঙ্গে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে ।
ব্রিটিশ রাজত্বের বিদায় ঘন্টা বাজার শেষলগ্নের কথা । চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুবাদে সৃষ্ট জমিদাররা কামিনী ও কাঞ্চনের পেছনে খেপা কুকুরের মতো ছুটে বেড়ানোর নজির জঙ্গলকাটির জমিদার বাড়িতে এক সময় প্রকট রূপ ধারণ করে ।

কুমারিত্ব হারানো ফুলবালার বিয়ে তার বাপ মা একটা ভাল ছেলের সাথে দিলে রাজশেখর জমিদারবাবু বড় পুত্র নিবারণের মাথায় যেন বজ্রাঘাত হয়। তারপর তার বাবা রাজশেখর জমিদার মারা যাওয়ায় নিবারণের পোয়াবার হল । তার ওপর জমিদারীর ভার পড়ে । বলে রাখা ভাল জমিদার বাবু মারা যাবার আগেই নিবারণের বিয়ে দিয়ে যান পাবনার সাতআনি জমিদার সূর্যকান্ত চৌধুরী একমাত্র সুন্দরী মেয়ে রূপমালার সাথে । রূপমালা তার স্বামীকে বসে রাখতে পারেন না । নিবারণবাবু তখন অগাধ ক্ষমতার অধিকারী । তিনি ফন্দি আটেন যে করেই হোক ফুলমালাকে তার চাই চাই । সঙ্গপাঙ্গদের সাথে পরামর্শ করে নিবারণ ঠিক করলেন ফুলমালা বাপের বাড়ি এলে তাকে সোয়ামীর বাড়িতে ফিরে যেতে দেয়া হবে না । ফুলমালার স্বামী কমলকান্ত সরল সোজা মানুষ । প্রথম প্রথম নিবারণ কমলকান্তের সঙ্গে ভাল ব্যবহার করেন । তিনি ভাবেন , কমলকান্তকে প্রথমেই রাগিয়ে নেয়া যাবে না । তার সাথে ভাল ব্যবহার করায় কমলাকান্ত জমিদার বাবুর ওপর বেজায় খুশি হয় ।
কমলাকান্ত বাড়ি ফিরে গেলে নিবারণ নিজমূর্তি ধারণ করেন ।
ফুলমালার ইচ্ছে ছিল না বিবাহ পূর্বজীবনের পঙ্কিল জীবনে আবার ফিরে যেতে । কিন্তু ইচ্ছে না থাকলেও ফুলমালার ভাগ্যে সুখ লেখা ছিল না । ফুলমালার বর তাকে নিতে এলে নানা অজুহাতে তাকে মারধর করে তাড়িয়ে দিল নিবারণবাবুর লেঠেলরা ।তারপর ফুলমালা চিরদিনের জন্য নিবারণের রক্ষিতা হিসাবে জীবন কাটিয়ে এক সময় ইহধাম ছেড়ে গেল ।

সেকালে বাল্যবিধবার অভাব ছিল না গ্রামগঞ্জে। মেয়ে সরবরাহকারী দালালরা সেই সব বাল্যবিধবাদের খোঁজ এনে দিত জমিদারদেরকে । অনেক বাল্যবিধবাই এই শ্রেণির জমিদার জোদ্দারদের লালসার শিকার হতো অবলীলাক্রমে।

গোপালনগর গ্রামে একটি বাল্যবিধবার খোঁজ এনে দেয় ফেলু দালাল নিবারণ জমিদারকে। একদিন ফেলু দালাল তাকে বাবুকে বলল,“ গোপালনগরে একটা ডাসা মালের খোঁজ পাইছি বাবু।লবঙ্গলতা নামের মেয়েটির চেহারা সুরত দেখলি পারে আশি বছরের বুড়োও ---’ বাবু ধমক দিয়ে ফেলু দালালের কথা থামিয়ে দিয়ে বলে উঠেন,“ আসল কথাটা ক তো দেখি। ডাসা মালটাকে আমার বাগান বাড়িতে কবে নিয়ে আসবি তাই বল।”
“ মোর সব কতা শুনে তবে আমারে ওই কতাডা কন হুজুর।”
“ সব কথা কীরে গাধা।না আসতি চাইলে সামনের আমাবশ্যার রাতে পদ লেঠের দলবল দিয়ে মালটাকে তুলে নিয়ে আসবি ।তবে খবরদার পদটা আবার যেন আগে ভাগে এঁঠো করে না দেয়। তুইতো জানিস আমি কারো এঠো মাল আমার ভোগে লাগাইনে।”
“ হুজুর ,মুইরে তো কতা কতিই দিচ্ছেন না!” ফেলু দালাল কথাটা বলে মনে মনে হেসে ভাবে হুজুর এঁঠো ভোগে লাগায় না!তোর মত শকুনরা তো ভাগোরের মরাই চেটে তোলে। ফেলু দালালকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে নিবারণবাবু নরম সুরে বলে,“ তা হলি ক তোর কথা।”
“তাহলি ডাসা মালটার কতা মন থিকে ঝেড়ে ফেলেন হুজুর!মালটাতো এহন আপনার গোপালনগরের পিয়ারের বন্ধু বিয়ে না করে আইবুড়ো থাকা গজেন গোসাইয়ের সেবাদাসী।তার মুখির গ্রাস আফনি কারে নিতি পারবেনে কিনা কন হুজুর।”
ফেলু দালাল কথা শেষ করে বাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। নিবারণ ফেলু দালালের কথা শুনে কী যেন ভেবে বলে উঠেন,“ লবঙ্গলতা না কী বললি! তা কপালে তিলক কাটা মালাটালা জপ করা গজেন আবার এ লাইনে কবে থকে এসে জুটেছে বলতে পারিস্ ফেলু !

কানু বউ বাচ্ছাকে ভারতে পাঠিয়ে দিয়ে বাগদির মেয়েটাকে ঘরে তুললি আমি তোরে কই ছিলাম দ্যাশটা রসাতলে যাচ্ছে।তা তুই ক লবঙ্গলতার চেহারায় কেমন জেল্লা আছে যাতে আমার বন্ধু গজেন গোসাই তার সঙ্গে লীলে করছে। কুঞ্জ অগ্রদানে ঠাকুর বোশেখ মাসে পঞ্জিকা পড়তে এসে যথার্থ্ কথা কইছিল,‘ এই কলিকালে মানির মান থাকবে না, রাজপ্রজা এক আসনে পাত পাড়বে।”
নিবারণবাবু কথা থামিয়ে গোখুরো সাপের মত গজরাতে থাকলেন্।তারপর তিনি বেশ সময় ধরে কী যেন ভেবে এক সময় ফেলু দালালকে বললেন,“ আমার বন্ধু গজেন গোসাইকে খেঁপিয়ে লাভ নেই।সহিসকে বল,‘ ঘোড়া রেডি করতে,’ আমি নিজেই গজেন গোসাইয়ের ওখানে এখনই যাব। আমি দেখতে চাই গোসাই কী দেখে মেয়েটিকে সেবাদাসী করেছে।!”

নিবারণ বিকালের দিকে গোপালনগরের গজেন গোসাইয়ের আশ্রমের উদ্ধেশ্যে ঘোড়া ছুটালেন।এক সময় গজেন ও নিবারণ এক গ্লাসের বন্ধু ছিল। এক সময় নিবারণের অনেক অপকর্মের সাথী ছিল গজেন। কিন্তু হঠাৎ করে গজেন তারক গোসাইজীর সংস্পর্শে এসে সাচ্চা সাত্ত্বিক বনে যাওয়ার খবর নিবারণ আগে থেকেই শুনেছিলেন। নিবারণ গোপালনগরে পৌঁছে প্রথমেই গজেন গোসাইয়ের আশ্রমে সন্ধ্যের পর পরই হাজির হলেন। গজেন গোসাই তাকে তার আশ্রমে দেখতে পেয়ে চিন্তায় পড়ল এই ভেবে কেন তার একালের একগ্লাসের দোস্ত হঠাৎ করে কোন মতলবে তার আশ্রমে হাজির!গজেন গোসাই নিবারণকে আপ্যায়ন করতে কসুর করল না।
ফেলু দালালের কথা মত নিবারণ গজেন গোসাইয়ের আশ্রমে কোন সেবাদাসীকে দেখতে পেলেন না।তবে তিনি জানতে পারলেন বালবিধবা সুন্দরী মেয়েটি মাঝেমধ্যে গজেন গোসাইয়ের আশ্রমে এসে থাকে।
নিবারণ ভাবলেন, এককালের তার এক গ্লাসের দোস্ত এখন গোসাইজী, তার সঙ্গে বুঝে সুঝে কথাবার্তা বলতে হবে।সুযোগ বুঝে এক সময় সে গজেন গোসাইকে বললেন,“ আশ্রমে তো অনেক সেবাদাসী থাকে শুনেছি,তোর আশ্রমে তো বুড়োবুড়িদের দেখছি মাত্র । তোর সেবাদাসী কোথায়?”
“ আমি এখন বুঝতে পারছি তুমি আমার আশ্রমে দেবাদাসীর খোঁজ করতেই এসেছো। আজ রাতটা এখানে থাকলে সকালে সেবাদাসীকে দেখতে পাবে। সে আমার সেবাদাসী নয়, আমার আশ্রমের শ্রীকৃষ্ণের সেবাদাসী, আর সে আমার স্হেময়ী মা।”! গজেন গোসাইয়ের কথা শুনে নিবারণ হো হো করে হেসে বলে উঠেন, “ দু’দিনের বৌরাগী ভাতকে কয় অন্ন!” তার কথা শুনে গজেন গোসাই হেসে বলে,“ তোমার এক গ্লাসের দোস্ত গজেন আর আজকের গজেন গোসাইয়ের মধ্যে ফরাক আকাশ পাতাল। সকালেই আমার মাকে দেখতে পেয়ে বুঝতে পাবে সে এক আলোর শিখা।”
গজেন গোসাই রাতে নিবারণকে প্রসাদ খাইয়ে আশ্রমের একটা রুমে শোবার ব্যবস্থা করল। তার আগে নিবারণে ঘোড়াটাকে আশ্রমের গোশালার এক কোণে বেঁধে রেখে এলো গজেন গোসাই নিজেই।বিছানায় শুয়ে মাত্র লবঙ্গলতার কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় নিবারণ ঘুমিয়ে পড়লেন।গভীর রাত!ফেলু দালালের বর্ণনা মত চেহারার একটা সুন্দরী ষোড়শী মেয়ে তার সামনে হাজির। অনিন্দ্যসুন্দরী মেয়েটির চারদিকে একটা আলোর জ্যোতি। নিবারণ হাত বাড়িয়ে তাকে জাপটে ধরতে গেলে সুন্দরী মেয়েটি মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।মুহূর্তের মধ্যে মেয়েটি আবার এসে হাজির হলে তিনি ভাবলেন, গজেন গোসাইকে ধন্যবাদ! তাহলে তার সুন্দরী ষোড়শী সেবাদাসী মেয়েটিকে তার কছে পাঠিয়েছে।এবার মেয়েটি কাছে এসে বলল,“ আপনি আমার জন্য এখানে এসেছন, তাই আমি না এসে পারলাম না।এবার নিবারণ আহ্লাদে গদ গদ হয়ে তার হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে বললেন,“ ওগো সুন্দরী, তুমি আমার বাহুলগ্না হও।”
“ তথাস্তু!” নিবারণ দু’হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে গেলে একটা আগুনের শিখা যেন তাকে ঘিরে ধরল।নিবারণ ঘুমের ঘোরে চিৎকার করে বলে উঠল,“ গজেন গোসাই তুমি কোথায় আছো , আমি যে জ্বলে পুড়ে থাক হয়ে গেলাম।”
গজেন গোসাইক ভেতরের রুমে থেকে নিবারণে রুমে ছুটে এসে দেখতে পেল নিবারণ বিছানার বসে ঘেমে নেয়ে উঠেছেন। “সুন্দরী ষোড়শী এক অগ্নিকন্যা আমাকে পুড়িয়ে মেরেই ফেলেই ছিল তুমি না এলে গজেন!” নিবারণের বুঝতে পারল সে স্বপ্ন দেখে চিৎকার করে উঠেছে।
“ তুমি কি আমাকে পুড়িয়ে মেরে ফেলবার জন্য ওই মেয়েটিকে পাঠিয়েছিলে।”
“ কী যা তা বলছো নিবারণ! তুমি স্বপ্ন দেখে কী আবোলতাবোল বলছো।” পরদিন ভোরেই নিবারণ গজেনকে কিছু না বলেই গোশালা থেকে নিজেই ঘোড়া বের করে সেখান থেকে কেটে পড়ল।

জমিদারী লাটে উঠল ,সরকার তা খাস করে নিলে ।নিবারণের একমাত্র ছেলে অভিরাম বাবকে বেটা সেপাইকা ঘোড়া । লেখাপড়ায় লালবাতি জ্বালিয়ে বাউন্ডেলাপনা করাই তার একমাত্র কাজ । এদিকে জমিদার বাবু নিবারণ একদিন নিরুদেশ হয়ে গেলেন চিরতরের জন্য । পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও নিবারণের খোঁজ পেল না ।লোকে বলাবলি করল , খারাপ চরিত্রের লোকের এমনই হয় । অনেক পরে প্রকাশ পেল একজন গরীব প্রজার নবপরিণতা বউয়ের ইজ্জত লুটতে গেলে তারা নিবারণকে পিটিয়ে মেরে লাশ গুম করে দেয় ।

জমিদারী না থাকলেও নিবারণের একমাত্র ছেলে অভিরামের পায় কে ! এদিকে অভিরামের কাকা কানুবাবুর চরিত্র তার দাদা নিবারণের থেকেও সরেস । নিজের সোমত্ত বউ ও একমাত্র ছেলেকে ইন্ডিয়ায় পাঠিয়ে দিয়ে নিজে বলরাম বাগদির যুবতী বউ মালতিকে বাড়িতে তুলো। আর অন্যদিকে, মালতির সোয়ামী বলরামকে মারধর করে গ্রাম ছাড়া করল নিবারনের লেঠেলরা। মালতির মেয়ে জন্মালে লোকে বলাবলি করল মেয়েটি কানুবাবুর ঔরসজাত ।

দিনের পর পর দিন ,বছরের পর বছর কেটে গেলে মালতির রূপযৌবনে ভাটা পড়তে থাকল, আর তার মেয়ে সাধনা শিশু থেকে কিশোরী হল , তারপর দিনে দিনে যৌবনবতী হয়ে উঠল । এবার কানু বাবুর লোলুপ দৃষ্টি পড়ল সাধনার ওপর । এক সময় সে মাকে ভোগ করেছে এবার মেয়ে সাধনাকে ভোগ করতে লাগল । এক সময় কানুবাবুর শরীর ভেঙে পড়ল। প্যারালাইজড অবস্থায় তিন বছর বিছানায় পড়ে থেকে মানবেতর দিন কাটিয়ে একদিন তার ইহলীলা সাঙ্গ হল।

এদিকে দিন বদলে পালা শুরু হল । জমিদারতন্ত্রের অবসান হলেও জমিদারের শেষ বংশধর অভিরামের রক্তে বিষ । নিজের ঘরে সুন্দরী বউ আর ফুটফুটে দুটো মেয়ে আর একটা ছেলে । কিন্তু অভিরাম আসক্ত বাড়ির পাশের অন্ত্যজ শ্রেণির এক গরীব মানুষের অবিবাহিতা মেয়ের প্রতি । অভিরাম মেয়েটির সঙ্গে অবৈধ কাজে লিপ্ত থাকার কথা চাউর হতে দেরি হল না । এক সময় মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা হল । সে অভিরামকে চাপ দিয়ে বলল ," আমরা স্বামী স্ত্রীর মত রাতে পর রাত কাটিয়েছি ।এখন আমার গর্ভে তোমার সন্তান। আমাকে বিয়ে করে পেটের সন্তানকে বাঁচাও ।"
অভিরাম কী তাতে রাজি হয় ! অভিরাম গা ঢাকা দিয়েও পার পেল না।তার বিরুদ্ধ সালিশ বসল।রায় হল মেয়েটিকে হয় বিয়ে করতে হবে নয় তো মেয়েটি নামে তিন বিঘে জমি লিখে দিতে হবে আর সে সঙ্গে এক লাখ টাকাও দিতে হবে।

সালিশের রায় মেনে না নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না অভিরামের। অভিরাম জমি ও টাকা দিয়ে সেবারের মত রেহাই পেল। অভিরাম জঙ্গলকাটি জমিদারীর শেষ বংশধর। কয়লা ধুলে কি ময়লা যায়! জমিদার বংশের আভিজাত্য অস্তিমজ্জায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা অভিরামের দুই মেয়ে আর এক ছেলে। নিলীমা বড় মেয়ে আর ছোট মেয়ে অনিন্দ্যিতা। একমাত্র ছেলে শিবরাম। অভিরামের বউ সুলেখা প্যারালাইজড হয়ে শয্যাশায়ী।

সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাবে , একটা অত্যাচারী জমিদার পরিবারের অমানুষ লোকটার বউ হয়ে সারাটা জীবন তো কত রকমের ভোগান্তির শিকার হয়ে জীবনটা বরবাদ হয়ে গেল , জীবনে সুখ কাকে বলে জানতে পারলাম না। তার অপাপবিদ্বা মেয়ে দুটোর কী হবে সে মরে গেলে।রোগ শয্যায় শুয়ে সে প্রতিজ্ঞা করে যে করেই হোক মেয়ে দুটোকে বিয়ে দিয়ে মরতে হবে। আমি কোনক্রমেই লাম্পট্য জারিত বাবার অপকর্মের ভাগীদার মেয়ে দুটোকে হতে দেব না। ওদের বিয়ে না দিয়ে চোখ বুঁজলে নিলীমা ও অনিন্দ্যিতাকে শকুনেরা ছিড়ে খাবে।

সে তার দাদাদের সাহয্যে মেয়ে দুটোকে বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগে।সে ভাবে , তার বিয়ের সময় তাদের তিরিশ চল্লিশ বিঘে জমি ছিল। অথচ তার স্বামী অভিরাম একে একে সব জমিই বিক্রি করে আজ নি:স্ব। শুধুমাত্র অবশিষ্ট আছে ভিটে বাড়িটা ।

একদিন রাতে অভিরামের বউ সুলেখা তার স্বামীকে বলে ,“ তোমার সাথে একটা জরুরী কথা আছে।” বউয়ের কথা শুনে অভিরাম কথা জড়িয়ে জড়িয়ে বলে,“ বু-ড়ো বয়সে আমা-র সা-থে কী ক-থা থাক-তে পারে! সুলেখা বুঝতে পারে আজ আবার মদ গিলে এসেছে।সে ভাবে, মদ আর মাগীবাজি করে তিরিশ- চল্লিশ বিঘে জমি সাবার করে দিয়ে আজ তার স্বামী ---। সে আর ভাবতে পারে না।সুলেখা সে রাতে তার স্বামীর সঙ্গে আর কোন কথা বলে না। সে প্রতিজ্ঞা করে সে তার দাদা অমল আর বিমলকে ধরে মেয়ে দুটোর বিয়ে দেবোই। তার স্বামী একমাত্র তাদেরকেই ভয় পায়। ওদের বিয়ে না দিয়ে মরলে তার আত্মা শান্তি পাবে না।

শেষ পর্যন্ত দাদাদের সাহায্যে ভিটে বাড়িটা বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে নিলীমা ও অনিন্দ্যিতার মোটামুটি কর্ম্ করা দুটো ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে সুলেথা স্বস্তি পায়।মেয়েদের বিয়ের মাস তিনেক পরে সুলেখা মারা যায়।অভিরাম তার একমাত্র ছেলে জয়দেবকে নিয়ে ভিটে বাড়ি ছেড়ে এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে এক সময় অভিরাম পাগল হয়ে যায়।

জমিদার বংশের ছেলে জয়দেবের চেহারা সত্যি রাজপুরুষের মত। সে তার আধা পাগল বাবা অভিরামকে নিয়ে এক গিরিধারীর আশ্রমে আশ্রয় নেয়।জয়দেব একটু বড় হলে গেড়ুয়া বসন পরে ভিক্ষা করতে শুরু করে।বছর খানেক পরে অভিরাম একদিন মারা যায়। আপন বলতে জয়দেবের আর কেউ থাকে না। মাথায় গেড়ুয়া রঙের পাগড়ি, পরনে গেড়ুয়া বসনে জয়দেব এখন রাধা গোবিন্দের নাম করে মুষ্টি ভিক্ষা করে বেড়ায়।
35

গল্প - অসীম দেব

Posted in

কৈশোর যৌবনে ভ্যালেন্টাইন ডে কথাটাই আমরা শুনি নি। যদি কোনভাবে বিই কলেজে পড়াকালীন জানতাম যে ভ্যালেন্টাইন’স ডে কি বস্তু, তাহলে আমাদের কি অবস্থা হতো? আর আমাদের কলেজের টেলিফোন দাদুরই বা কি অবস্থা হতো? গল্পের খাতিরে ধরে নিচ্ছি যে কিছুক্ষনের জন্য আমরা বিই কলেজের ৭০ এর দশকে আছি। এবং ধরে নি যে ভ্যালেন্টাইন’স ডে ৭০এর দশকেও ছিলো।

একটা ভূমিকা। সেই সময় গোটা বিই কলেজ ক্যাম্পাসের হস্টেলের ১,২০০ ছাত্রছাত্রীর জন্য ছিলো একটিই মাত্র পাবলিক ফোন। আর আমাদের সকলের ফোনদাদু ছিলেন এক বহুল চর্চিত বর্ণময় চরিত্র, যিনি সারাদিন নাতনীদের ফোন রিসিভ করে ছেলেদের হস্টেলে হস্টেলে গিয়ে মেসেজ পৌঁছে দিতেন। ফোন করা অদেখা অপরিচিতা সব নাতনীরাই ছিলো তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। এতটাই প্রিয় ছিলো যে ফোন এলে আমাদের দাদু সেই ফোন আর ছাড়তেই চাইতেন না। এবার সেই পটভূমিকায় একটি গল্প লেখার চেষ্টা করছি। সব চরিত্রই কাল্পনিক। দুর্ভাগ্যবশত যদি মিল দেখা যায়, সেটা নেহাতই কাকতালীয়।

*******

টেলিফোন দাদুর চিন্তার শেষ নেই। গতবারের ভ্যালেন্তিন দিবসের দিনটি বারবার মনে আসছে। এবার সেরকম হলে এই চাকরীট যে তিনি ছেড়েই দেবেন, সেরকম সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছেন। সে না হয় চাকরী ছেড়ে দেবেন। কিন্তু সামনের সপ্তাহেই ভ্যালান্তিন দিবসে যে উৎপাতগুলো হবে, ক্যাম্পাসের ১,২০০ অবাধ্য ছেলেমেয়েকে সেইদিন তিনি কিভাবে সামলাবেন? এখন বয়স হয়েছে। এই বয়সে সামলানো? এই বয়সে এত টেনশন নেওয়া যায়?

স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সেক্রেটারি ইন্দ্রনাথ বলে দিয়েছে যে আপনি বরং প্রিন্সিপালকে গিয়ে আপনার সমস্যার কথা বলুন। তাই দুর্গানাম জপ করতে করতে বেলা এগারোটা নাগাদ ফোনদাদু গেলেন প্রিন্সিপালের অফিসে। সেক্রেটারি হারানবাবু নিয়মমতনই জানতে চাইলেন, কি ব্যাপারে দেখা করতে চান?

ভ্যেলেন্তি দিবস নিয়ে ওনার সাথে কিছু কথা আছে।

হারানবাবু চায়ে চুমুক দিচ্ছিলেন। একটা বিষম খেলেন।

“ভ্যালেন্টাইন’স ডে? আপনার ভ্যালেন্টাইন’স ডে নিয়ে প্রিন্সিপাল স্যার কি করবেন?” হারানবাবু অবাক।

“সে অনেক লম্বা কথা, অনেক ঝামেলা আছে, তুমি সেসব বুঝবে না। আমি সেটা সোজা স্যারকেই বলবো।“

হারানবাবু আর কথা বাড়ালেন না। ফোনদাদু প্রিন্সিপালের ঘরে ঢোকার দরজা ফাঁক করে উঁকি দিয়ে দেখলেন। সব চেনা লোকেরাই আছেন, নিশ্চিন্তে কথা বলা যাবে। আবার দুর্গানাম জপ করে ঘরে ঢুকলেন।

“স্যার, একটা নিবেদন ছিলো। স্যার, জানি না, কিভাবে আপনাকে বোঝাবো। বলছিলাম, সামনের সপ্তাহেই তো ভ্যালেন্তিনন দিবস। তাই কিছু কথা ছিলো।“

শুধু প্রিন্সিপাল নয়, সেখানে উপস্থিত প্রফেসর তরুণ শীল, প্রফেসর সুনীল চৌধুরী, উপেন মৌলিক, ভঞ্জ স্যার, আর অন্য যারা ছিলেন সকলেই অবাক। এই সত্তর বছর বয়সী টেলিফোন দাদু ভ্যালেন্টাইন ডে নিয়ে আলোচনা করতে এসেছেন সোজা কলেজের প্রিন্সিপালের সাথে?

“স্যার, বলছিলাম, প্রতিবার ভীষণ গোলমাল হয়। এবারেও ঝামেলা হবে। সকাল থেকেই বাইরের সারা দুনিয়ার মেয়েরা আমাকে ফোন করবে। আর এছাড়াও...”

প্রিন্সিপাল আর দেরী না করে ওখানেই দাদুকে থামিয়ে দিলেন।

আরে? সে তো প্রতিদিনই আপনার নাতনীরা দাদু, দাদু করে ডেকে কত সুখদুঃখের কথা বলে। আর আপনার তো প্রচুর সুনামও আছে, আপনি নাতনীদের সাথে ফোনে অনেক কথা বলেন। এ তো নতুন কিছু নয়।


না স্যার, ঐদিন অনেক অনেক ফোন আসবে। আপনি বুঝতে পারছেন না স্যার।


ফোন এলে আসবে। রোজ দশটা ফোন আসে, সেদিন পঁচিশটা ফোন আসবে। আপনি রোজ যেভাবে আপনার নাতনীদের সাথে কথা বলেন সেভাবেই সেদিনও কথা বলবেন। এখানে সমস্যা কোথায়?

না, প্রিন্সিপাল স্যার ফোনদাদুর সমস্যা বুঝতেই চাইছেন না।

দাদু চলে গেলে প্রথমেই মুখ খুললেন প্রফেসর তরুণ শীল। “ওফ, গতবারের ভ্যালেন্টাইন’স ডে আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছিলো। সকালে উঠেই দেখি আমার কোয়ার্টারের বাইরের সিঁড়িতে লাল গোলাপ ফুলের পাহাড়। জানি না ছেলের দল কখন যে রেখে গেছে। ঠিক যেন কবরখানা। একবার পরিস্কার করি, জঞ্জাল ফেলার জায়গায় ফুলগুলো ফেলে আসি, তো কিছুক্ষণ পরেই দেখি আবার সেই ফুলের পাহাড়। পরে শুনলাম, ঐ জঞ্জাল থেকেই ছেলেরা সেই ফুলই আবার তুলে নিয়ে এসে আমার বাড়ির সিঁড়িতে রেখে যায়। বোঝো এবার! আমার দুই মেয়ে তো রেগে ফায়ার।”

প্রফেসর সুনীল চৌধুরীর অভিজ্ঞতা অন্যরকম। “আপনি তো থাকেন মধুসূদনের বাড়িতে, সেই এক কোনায়। কিন্তু আমার কোয়ার্টার তো রাস্তার উপরেই একতলায়। গতবার ছেলেরা বাড়ির সামনে সক্কালবেলায় নাচতে নাচতে কীর্তন গেয়েছিলো ইয়ে জিন্দেগী উসি কি হ্যায়, প্যার কিসি সে হো গয়া। কি সাহস!!”

প্রফেসর চৌধুরী জানেন যে, ছেলেরা আনারকলি সিনেমার এই গানটা ওনার বড় মেয়ে তিলুর উদ্দেশ্যেই গায়। আর প্রিন্সিপাল ছিলেন রসিক লোক, অন্যরকম ভাবেন।

এ তো ভালো গান। আমার বিয়ের পরে ঐসময়ের বিখ্যাত গান। আর তুমিও তো তখন কচি বয়সের ছিলে, ঝর্ণা সিনেমায় গিয়ে এই সিনেমাটা অনেকবার দেখেছিলে, সেরকমই তো জানি।

হোক সেই সময়ের গান। তাই বলে সক্কাল সক্কাল বাড়ির সামনে কেত্তন গাইবে?

ভঞ্জ স্যারেরও অভিযোগ আছে। “আরে, আপনাদের ভাগ্যে তো বছরে শুধু একদিন। আমার মেয়ে চুমি তো ম্যাক আর রিচার্ড হলের ছেলেদের থেকে নিয়মিত চিঠি পায়। সোহম নামের এক ছেলে, সে কবিতা লিখে পাঠায়। হিমাই নামের ছেলেটা হস্টেলের সামনে মোটর বাইক চালায়।“

এবার উপেনবাবু মুখ খুললেন। “আমারও একই সমস্যা।“

প্রিন্সিপাল স্যার অবাক, “তোমার মেয়ে? আরে, তোমার মেয়ের তো স্কুলে যাওয়ারও বয়স হয় নি।“
- আমার ক্ষেত্রে মেয়ে নয় স্যার, আমার ভাইঝি’কে গান গেয়ে শোনায়। সেকেন্ড গেট দিয়ে আসতে যেতে “নিম্মি কেমন আছো?” বলে হাঁক মারে। এঁরা কি বয়সের ধার ধারে? ভেবে দেখুন, দান্তেবাবুর মাত্র সাত আট বছরের মেয়ে সোমা যখন প্রাইমারি স্কুলে যায়, তখন সাহেবপাড়ার সব ছেলেরা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ভাবতে পারেন?
প্রিন্সিপাল স্যার এতসব জানতেন না। সকলের কথা শুনে বুঝলেন যে, এই ভ্যালেন্টাইন’স ডে’তে ছেলেদের মধ্যে উন্মাদনাটা একটু বেশিমাত্রায়ই থাকে।

ওদিকে বাড়িতে ফোনদাদুর স্ত্রীও খেয়াল করেছেন, যে স্বামী কেমন যেন চিন্তিত, কিছু একটা সমস্যা নিশ্চয় আছে, কিন্তু দাদু কিছুই খুলে বলছেন না। অবশেষে দিদিমার “আমার মাথা খাও” বারবার শুনতে শুনতে বলেই দিলেন নিজের সমস্যার কথা। দিদিমা এই ভ্যালেন্তিন দিবস ব্যাপারটা জানতেন না। সব শুনে উল্টো দশ কথা শুনিয়ে দিলেন। সারা পৃথিবী জুড়ে প্রতি বছর এত বড় একটা পূণ্যতিথি আসে। ঐ দুধের শিশুর ছেলেমেয়েরাও কত নিষ্ঠাভরে সেই তিথি পালন করে অথচ দাদু জীবনে একদিনের জন্যও সেটা পালন করলেন না? দিদিমা ওয়ার্নিং দিয়ে দিলেন, এই বছর তুমি যদি ভ্যালেন্তিন দিন পালন না করো, তো তোমার একদিন আর আমারও একদিন হয়ে যাবে।

নির্দিষ্ট দিনে ফোনদাদু বেশ ফুরফুরে মেজাজেই বাড়ি থেকে বেরোলেন। দিদিমা বলে দিয়েছেন, আজকে ভ্যালেন্তিন দিন, মনে থাকে যেন। দাদু অন্যদিন ফোনবুথে আটটা নাগাদ চলে আসেন, আজ সাতটার আগেই পৌঁছে গিয়ে দেখেন ইতিমধ্যেই লম্বা লাইন পড়ে গেছে। দূর থেকেই বুঝলেন কি একটা যেন ঝামেলা চলছে। আজ এসব যে হবেই, সেটা তিনি আগেই আন্দাজ করেছিলেন।

ব্যাপারটা জটিল। মাঝরাতে কিছু ছেলে ইট পেতে লাইন রেখে গিয়েছিলো, সেই ইটগুলো উধাও। কিছু ছেলে লাইন দিয়েছিলো, কিন্তু ভোরবেলা বেগ আসাতে হস্টেলে গিয়েছিলো, পেট হাল্কা করতে। ইটের লাইন সামলে রাখার জন্য যাদেরকে বলে গিয়েছিলো, তাঁদেরও বেগ এসে যায়। তাঁরাও সব নিজেদের পেট হাল্কা করতে হস্টেলে চলে যায়। এরপর ছেলেরা ফিরে এসে দেখে সব গোলমাল হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে লাইনে বিরাট বিশৃংখলা।

একটা ফার্স্ট ইয়ারের মেয়ে এই সাত সকালেই উপস্থিত। কানপুরে বয়ফ্রেন্ডকে ফোন করবে। ছেলেদের লাইনে সে দাঁড়াবে না। আর সবার আগে সেই ফোন করবে। ছেলেরা শুনেই রেগে গেলো। মেয়েটি লাইন ভেঙে সবার আগে চান্স পাবে, সেটা কোন সমস্যাই নয়। অভিযোগ অন্যরকম। কলেজে হাজার খানেক ছেলের মাঝে কি একজনকেও পাওয়া গেলো না, যে এই মেয়ে খুঁজে খুঁজে কানপুরের এক বয়ফ্রেন্ডকেই পছন্দ করলো? যে ছেলেরা ভোররাতে এসে লাইন দিয়েছে, তাঁরাও মেয়েটার দাবী মানতে রাজি নয়। ওদিকে দাদু শুনতে পাচ্ছেন, বুথের মধ্যে একের পর এক ফোন বেজেই চলেছে। কি কান্ড!

বুথ খুলতেই আবার ঝনঝন করে ফোন বেজে উঠলো। দিনের প্রথম ফোনটা তুলতেই অপর প্রান্ত থেকে একটা মিষ্টি গলার আওয়াজ “দাদু, আমি খেয়ালী বলছি, এতবার তোমাকে ফোন করছি, সেই সকাল থেকে।“ রোজ এত এত ফোন আসে, কে যে খেয়ালী, কে যে পিয়ালী, কে যে কোয়েলী এসব কিছুই দাদুর মনেই থাকে না। তবে এইরকম মিষ্টি আওয়াজে দাদু এক অনাবিল রোমাঞ্চের আনন্দ অনুভব করেন। দাদুর পার্থিব সব টেনশন দূর হয়ে যায়,

“হ্যাঁ, দিদিমণি, কেমন আছো?” দাদু তাঁর রোজকার নিজস্ব স্টাইলে আলাপ শুরু করে দিলেন।

দাদু, আজ ভ্যালেন্টাইন ডে দাদু, আই লাভ ইউ দাদু, আই লাভ ইউ, লাভ ইউ।

দাদু রোজই অনেক অনেক ফোন রিসিভ করেন, কিন্তু আই লাভ ইউ কেউ বলে না। দাদু ঠিক শুনছেন তো? বিশ্বাস হয় না।

দাদু, লামিকে, মানে ঐ শংখকে একটা খবর দিতে হবে, দাদু। আজ বিকেল চারটের সময় লামি যেন লাইটহাউস সিনেমার বাইরে আমার জন্য অপেক্ষা করে। খবরটা দিয়ে দিও প্লিজ।

দেখো কান্ড! গতকালই তো তিন তিনটে ফোন এসেছে এই লামির জন্যই। হ্যাঁ, স্পস্ট মনে আছে দাদুর। একজন বলেছে, আজ দুপুরে হস্টেলে গিফট নিয়ে আসবে, একজন বলেছে লিপিতে দুপুরের শো’তে রাম তেরি গঙ্গা মইলির টিকিট কেটে রাখবে। আরেকজন কি যে বলেছিলো ঠিক মনে আসছে না, তবে সেও সিনেমার কথাই বলছিলো। আর আজ এখন এই সাত সকালে কে এক খেয়ালীও সেই সিনেমার কথাই বলছে। যাক গে, সে লামিই বুঝবে। দাদুর কাজ মেসেজ দেওয়া, দিয়ে দেবে।

ফোনে কথা শেষ হতেই সঙ্গে সঙ্গে আবার ফোন বেজে উঠলো। কিন্তু ছেলেরা নিয়ম করে দিয়েছে, যে দুটো ইনকামিং পরপর চলবে না। সাথে সাথে আউটগোইং চালু রাখতে হবে। লাইনে সবার আগে সমীর, ১৫ নম্বর হস্টেলের, ছেলেরা নাম দিয়েছে রমণীরঞ্জন, ছোট করে রমণী। মাঝরাতে এসে লাইন দিয়েছে, সকালে প্রচন্ড বেগ আসা সত্ত্বেও বেগ চেপে রেখে লাইনে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলো। আর বেশিক্ষণ হয়তো চেপে রাখতে পারবে না।

দাদু, আমি মালদা’র ঝামাগ্রামে ফোন করবো।

মালদা, চামাগ্রাম, ঝামাগ্রাম। হবে না। হবে না। সে তো এসটিডি করতে হবে। এখানে এসব এসটিডি ফেসটিডি হয় না। অন্য কোথাও যাও।“

দাদু বেশ বিরক্ত। এই খেয়ালী মেয়েটা বেশ ভালো মেজাজ এনে দিয়েছিলো, এই ঝামাগ্রামের ছেলেটা এসে সব বরবাদ করে দিলো।

মালদা হবে না? তাহলে দাদু এই নম্বরটাই লাগিয়ে দিন।

এটা কোথাকার?

এটা এখানের, হাওড়ার, শালিমার, ঐ ফোরশোর রোডে।“

দাদু নম্বর লাগিয়ে দিলেন। শুনলেন ছেলেটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা হিন্দীতে কথা বলছে। মামুলী কথা, দাদু তাড়া দিয়ে যাচ্ছেন, ফোন ছাড়তে হবে। লাইনে আরও অনেক ছেলে আছে। কিন্তু রমণী নিজের মনেই মিনিট তিনেক ধরে কথা বলে গেলো।

এই ফোন শেষ হতেই রমণী আরও একটা কলকাতার নম্বর ধরিয়ে দিলো। দাদু নিরুপায়, রমণীকে ফোন ধরিয়ে দিলেন।

এই ফোন শেষ হতেই রমণী আরও একটা ফোন করতে চায়। বাইরে লাইনে দাঁড়ানো ছেলেরা এবার হল্লা লাগিয়ে দিলো। একদল বলছে কেউ একটার বেশি ফোন করতে পারবে না। রমণী কাতর অনুরোধ জানলো, যে রাত থাকতেই সে লাইন দিয়েছিলো, এমনকি সকালে প্রচন্ড বেগ আসা সত্তেও সে লাইনে অবিচল ছিলো। দাদুকে অনুরোধ, আর একটাই, শুধু একটাই ফোন সে করতে চায়। “দাদু, প্লিজ। আমি আর থাকতে পারছি না। এই ফোন করেই আমি পায়খানা করতে ছুটবো।“ দাদু নিজের সামনেই দেখছেন, ছেলেটা বেগের চাপে ছটফট করছে, কিন্তু নিজের লক্ষ্যে অবিচল।

বাইরে আবার তুমুল হট্টগোল, অধিকাংশ ছেলেরাই বলছে অন্তত তিনটে ফোন যেন সকলকে করতে দেওয়া হয়। আবার কেউ কেউ চারটে পাঁচটা ফোনের অধিকারও দাবী করছে। দাদু সব শুনে নিয়ম করে দিলেন, কেউ দুটোর বেশি পরপর আউটগোইং ফোন করতে পারবে না। এরপরে দুটো ইনকামিং এর জন্য স্লট রাখতে হবে। এদিকে দেখা গেল যে অনেকেই আছে যারা শুধু ইনকামিং এর অপেক্ষায় ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। দাদু তাঁদের একটা আলাদা জোনে ভাগ করে দিলেন।

সবে মিনিট পনেরো হয়েছে, দাদু বুথে এসেছেন। এইসব দেখে এরই মধ্যে দাদুর পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম। খেয়ালীর সাথে কথা বলে আজকের দিনটা সুন্দর শুরু হয়েছিলো। কিন্তু এই বদ ছেলের দল সেটা বিগড়ে দিলো। দাদু উঁকি মেরে বাইরের লাইন দেখলেন। আন্দাজ শ’খানেক ছেলে, এবার ধীরে ধীরে আরও নিশ্চয় আসবে। মানে সারাটা দিনই বরবাদ।

এবার একটা ইনকামিং ফোন এলো। সুন্দর মিস্টি গলা। “দাদু, আমি নুপুর, তুমি কেমন আছো?”

দাদুর আবেগ আবার উথলে উঠলো। এই “তুমি” সম্বোধন দাদুর খুব ভালো লাগে। যেন নিজের আপন লোক। আপনি আপনি বলে ডাকলে মেয়েগুলোকে কেমন যেন দূরের লোক মনে হয়।

“আমি ভালো আছি নুপুর, তুমি কেমন আছো?”

বাইরে প্রতিবাদ, “দাদু, সময় কম, কথা কম। কাজের কথায় আসুন। শুধু মেসেজটা নিয়ে নিন।“

দাদুর ইচ্ছে ছিলো আরও কিছুক্ষন মেয়েটির সাথে কথা বলেন। মেয়েটার সাথে দু’দন্ড কথা বলে যে আনন্দ পাবেন, সেই যো নেই।

দাদু, আপনাদের সাত নম্বর হস্টেলে অনিরুদ্ধ থাকে, তবে তুমি ঐ নামে ওঁকে খুঁজে পাবে না। শকুন আর বিরিঞ্চি নামেই ছেলেরা ওঁকে চেনে। আমাকে বলেছিলো, আজকের দিনের জন্য সুলা রাসা সিরাজ প্রেজেন্ট করতে। আমি বাজারে গিয়ে দেখি, ওটা তো রেড ওয়াইন, সেটা তো মদ। আমি বুঝতে পারছি না দাদু, ও কি আমার থেকে মদের বোতল গিফট চেয়েছে? তুমি একটু ওকে বলবে? যেন আমায় ফোন করে? প্লিজ দাদু।

এই “প্লিজ” কথাটায় এত মধু ঝড়ে পড়ে যে দাদু আর না করতে পারেন না।

শোনো মেয়ে, কি যেন নাম বললে? যদি মদ হয়, বিনা দ্বিধায় দিয়ে যাও। এখন তো মডার্ন মেয়েরা মদ, গাঁজা, চরস এসবই প্রেজেন্ট করে।

ঠিক আছে দাদু, আমি আজ এক বোতল রেড ওয়াইন নিয়ে আসছি। তোমার জন্যও কি আনবো দাদু?

না গো দিদিমণি, আমার জন্য দরকার নেই। তবে এক বোতলে ওঁদের কি আর হবে? এলে কম করেও চার পাঁচ বোতল নিয়ে এসো। ওঁদের হস্টেলে আরও অনেক মদ খাওয়ার পাবলিক আছে, এক বোতলে ওঁদের হবে না। আর পারলে বিড়ি সিগারেটও আনতে পারো।

দাদু ভাবেন, কি যে দিনকাল এলো! গতকালই একটা স্কুলে পড়া মেয়ে এই সাত নম্বর হস্টেলেই শৈবাল নামের একটা ছেলেকে ভ্যালেন্তিন দিবস উপলক্ষ্যে একগাদা সিগারেট উপহার দিয়ে গেছে। ছেলেটা সিগারেট খায়, কিন্তু বাড়ি থেকে যে টাকা আনে, সেই বাজেটে কুলোয় না, তাই মেয়েটা ভালোবেসে নিয়মিত সিগারেট উপহার দেয়। দাদু ভেবে ভেবে কুলকিনারা পান না। স্কুলে পড়া মেয়ে তাঁর বয়ফ্রেন্ডকে ভ্যালেন্তিন দিবসে সিগারেট, মদ উপহার দেয়?

একটি মেয়ে এসেছে, দাদু ভাবেন এঁকে তো কলেজে ছোট্টবেলা থেকেই দেখছেন। ক্যাম্পাসেরই কোন স্টাফের মেয়ে। নিশ্চয় বাড়ি থেকে ফোন করতে অসুবিধে, তাই এখান থেকেই ফোন করতে চায়। “দাদু, চিনতে পারছো? আমি তিলু।“

দাদু, দুঃখ পেলেন। মুখ চেনেন, নামটাই জানেন না।

আশেপাশের ছেলেদের মধ্যে খানিকটা গুঞ্জন উঠলো। এই তিলুর উপর ওদের অনেক অভিমান আছে। বিই কলেজে জন্ম, বাবা বিই কলেজের প্রফেসর, আর মেয়েটা নিজেও বিই কলেজেই পড়ে। অথচ বিই কলেজের এত ছেলে থাকতেও ও কেন যাদবপুরের ছেলের সাথে প্রেম করে? না হয় যেদো ছেলেটা চ্যাম্পিয়ন স্পোর্টসম্যান, তাই বলে বিই কলেজে কি স্পোর্টসম্যানের আকাল পড়েছে?

তিলু হিন্দী ইংরেজিতে মিনিটখানেক প্রেমালাপ করে চলে গেলো। ছেলের দল মুখ হাঁ করে সব দেখলো। দাদু যাবার সময় বললেন, “আবার এসো তিলু। যখনই সময় পাবে চলে এসো।“ দাদু সুযোগ পেলেই কলেজের নাতনীদের কত আদর করে বলেন তাঁরা যখনই সময় পাবে, যেন এই ফোনদাদুর কাছে চলে আসে। কিন্তু শুদুই দরকার ছাড়া কোন মেয়েই আসে না। এখানেও দাদুর দুঃখ।

আজকে দাদু সত্যিই ব্যাস্ত। লাইন দিয়ে এরকম দাঁড়ানো প্রতি বছরই একদিন হয়। এবার যেন আরও বেশি। তার উপর এবছর সিকিউরিটির লোকেরা যত সব অচেনা মেয়েদের দাদুর কাছেই পাঠিয়ে দিচ্ছে। তাঁরা সব রকমারি গিফট নিয়েও আসছে। কেউ আনছে ফুলের তোড়া, অনেকেই আনছে মদের বোতল। আবার অনেকের গিফটগুলো এমনভাবে প্যাকেটে মোড়া যে বোঝাই যাচ্ছে না ভেতরে কি আছে। শুনেছেন গতবার ময়ূখ নামে ওর পুরুলিয়ার এক ছেলেকে ওঁর জেলা স্কুলের গার্লফ্রেন্ড গিফট প্যাকে গাঁজার সরঞ্জাম পাঠিয়েছিলো। মেয়েটি ময়ুখকে এত ভালোবাসে যে ময়ুখের কোন ইচ্ছাই সে অপূর্ণ রাখবে না। দাদু আবার ভাবেন, আর অবাক হয়ে যান। আজকালের মেয়েরা ছেলেদের এতই ভালোবাসে যে ভ্যালেন্তিন দিবসে মদের বোতল, গাঁজা এইসব উপহার দেওয়ার প্রথা চালু করে দিয়েছে?

এবার একটা ছেলের ফোন। দাদু বিরক্ত, ছেলেদের ফোন একদমই পছন্দ করেন না। “দাদু, আমি সুকান্ত বলছি। ফাইন্যাল ইয়ারের সুকান্ত, সিউড়ি থেকে বলছি।”

– হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি বলো, বাইরে লম্বা লাইন।

– কেমন আছেন দাদু?

– বাইরে লম্বা লাইন, তাড়াতাড়ি কাজের কথা বলো।

– দাদু, লেডিজ হস্টেলে অঞ্জনাকে একটা মেসেজ দিতে হবে।

দাদু রেগে যাচ্ছেন। কে এক মর্কট সুকান্ত, কাজের কথা না বলে অযথা সময় নষ্ট করছে।

– দাদু, অঞ্জনাকে বলবেন, আমি আজ সিউড়ি’তে আটকে গেছি, বিকেলে কলেজ যাচ্ছি। লেডিজ হস্টেলের নীচে অপেক্ষা করবো।

– ঠিক আছে, বলে দেবো।

– দাদু, প্লিজ ভুলে যাবেন না।

– কি মুস্কিল। আরে বলছি তো, বলে দেবো। ফোন ছাড়ো, বাইরে লম্বা লাইন।

– এই সন্ধ্যে ছ’টা নাগাদ। মানে এই পাঁচ দশ মিনিট দেরি হতে পারে।

দাদুর বিরক্তির পারদ বাড়ছে। একটু রেগেই বললেন, “বলেছি তো, খবর দিয়ে দেবো। এবার ফোন ছাড়ো।“

– ঠিক আছে দাদু, আপনি ভালো আছেন তো?

দাদু ফোনের লাইন কেটে দিলেন। সুকান্ত ছেলেটা দাদুর মেজাজটাই বিগড়ে দিলো।

ফোনের আসর চলছে। ছেলেমেয়েরা আসছে, যাচ্ছে। দেখতে শুনতে একটি বেশ স্মার্ট, মডার্ণ মেয়ে এসেছে। বললো “হোয়ার ইজ শ্যাঙ্গুপ্তা হল, দাদু?”

ইংরেজি শুনে খানিকটা ঘাবড়ে গেলেও দাদু নিজেকে সামলে নিলেন। বুঝলেন বাইরের মেয়ে। দাদু খুশী, একের পর এক অল্পবয়সী নাতনীরা আসছে। এঁদের অনেকের সাথেই আগে ফোনে অনেক কথা হয়েছে। সামনাসামনি এই প্রথম। দাদুর মন খুব প্রফুল্ল। খুবই মিঠে গলায় প্রশ্ন করলেন “কোন হল?

– শ্যাঙ্গুপ্তা হল।

দাদু কিছুই বুঝলেন না। পাস থেকে একজন আওয়াজ দিলো, “দাদু সেনগুপ্ত হস্টেলের কথা বলছে।“
– তাই বলো, সেনগুপ্ত হল। কার জন্য এসেছো? তোমার চেনাজানা কেউ আছে ওখানে?

– ও, ইয়েস। আমি স্যুকান্ট কে মিট করতে চাই। কিছু গিফট এনেছি ফর হিম।

দাদুর কেমন যেন সন্দেহ হলো। একটু আগে যে ছেলেটি ফোন করেছিলো, তাঁর নামও তো সুকান্ত। বললেন, “তুমি কি সিউড়ি শহরের সুকান্তের কথা বলছো?”

পিছনে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, সে এগিয়ে এলো। “এক্সকিউজ মি, তুমি সুকান্তকে চেনো?”

– অফ কোর্স চিনি। হিলেকটোনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইন্যাল ইয়ার, শ্যাঙ্গুপ্তে থাকে।

– না, তুমি চেনো না। ও সিউড়ি নয়, বালিগঞ্জে থাকে। আমি ওকে পনেরো নম্বর হস্টেলের দিন থেকে চিনি, আমি অনেকবার হস্টেলে ওঁর রুমে এসেছি।

– শো হোয়াট? ও আমাকে বলেছে পাশ করে গেলেই ডারজিলিন, ডীগা, সান্টীনিকেটন নিয়ে যাবে।
– দীঘা? শান্তিনিকেতন? ব্যাস? ও কিন্তু আমাকে বলেছে সিমলা, গোয়া নিয়ে যাবে। থ্রি নাইটস ফোর ডেজ প্রোগ্রাম।“

আশেপাশের জনতার মাঝে একটু মৃদু গুঞ্জন উঠলো। সুকান্তকে ওরা সবাই চেনে। ক্যালিবাজ ছেলে। তাই বলে এখন থেকেই থ্রি নাইটস ফোর ডেজ আউটডোর প্রোগ্রাম? সাধারণ ছেলেদের ক্যালি লাইটহাউস, মেট্রো, অলকা, মায়াপুরী, ইডেন গার্ডেন, ভিক্টোরিয়া, ব্যাস ঐ পর্যন্তই। এর উপরের গ্রেডের ছেলেদের জন্য গার্ডেন বারের মদ, গাঁজা। কিন্তু সুকান্ত এখন কলেজে থাকতেই থ্রি নাইটস ফোর ডেজ প্রোগ্রাম সেট করছে?

দাদু ভাবছেন, এই সুকান্ত প্রায়ই ফোন করতে আসে। দিন দুয়েক আগেই ফোনে কাকে যেন বলছিলো মেয়েটি যেন পাসপোর্ট রেডি রাখে। ব্যাংকক নিয়ে যাবে। এখন অন্য দুটি মেয়ে এসে বলছে দীঘা, সিমলা, গোয়া। আবার খানিক আগে ফোনে বলেছে যে সন্ধ্যাবেলায় এসে অঞ্জনার সাথে দেখা করবে।

না, ফোনদাদুর মাথায় কিছুই ঢুকছে না।

ইতিমধ্যে আরেকটা ইনকামিং ফোন। একটি মেয়ে করছে। “দাদু, ভালো আছো? আমি একটূ তাড়াতাড়িতে আছি। সেনগুপ্ত হলের সুকান্তকে একটা খবর দিতে হবে।“

– সুকান্ত, সেনগুপ্ত হলের? শোনো মেয়ে, তোমার নম্বর অনেক পিছনে, মানে তুমি পাঁচ নম্বরে আছো।

– পাঁচ নম্বর? মানে?

– মানে, তোমার পাসপোর্ট আছে?

– হ্যাঁ, আছে তো। সুকান্তই করিয়ে দিয়েছে। ও পাশ করলেই আমরা ইউরোপ বেড়াতে যাবো। সেরকমই আমাদের প্ল্যান আছে।“

না। দাদু আর নিতে পারছেন না। উনি জেনেছেন, এইসব কাজকম্মোকে আধুনিক বাঙ্লায় বলে মাল নামানো। যাই হোক, কে কোথায় কি মাল নামাচ্চে, দাদুর জানার কি দরকার? দাদুর কাজ খবর পৌঁছে দেওয়া, আজকে যে সব গিফট আসছে, সেগুলো পৌঁছে দেওয়া, তিনি শুধু তাই করবেন। আবার মাঝে মাঝেই হতাশায় ভুগছেন। উনি কেন কলেজজীবনে এরকম ভাগ্য নিয়ে জন্মান নি?

এভাবেই সারাটা দিন কেটে গেলো। কতজন যে আজ তিনটে, চারটে, পাঁচটা করে ফোন করেছে। আর কতজনের জন্য যে চারটে, পাঁচটা করে ইনকামিং ফোন এসেছে, তাঁর হিসাব করা মুস্কিল। তাঁর উপর পাহাড়প্রমাণ ফুল, আর কতরকমের যে গিফট। আরও জানলেন, ছেলেরা কিরকম সব মাল নামায়।

এবার ঘরে ফিরতে হবে। দাদু সমস্ত গিফট হস্টেলের ছেলেদের কাছে পাঠান নি, কিছু নিজের জন্য লুকিয়ে রেখে দিয়েছেন, যদিও জানেন না, প্যাকেটের ভেতর কি আছে। কাজ শেষ করে রিক্সা ডেকে ঐ লুকিয়ে রাখা গিফটগুলো নিয়ে বাড়ি চললেন।

ফুল আর গিফট প্যাক পেয়ে দিদিমা খুব খুশি। ফুলগুলো সাজিয়ে রেখে, এক এক করে প্যাক খুলছেন। বেশিরভাগই মদের বোতল, আর আছে সুগন্ধি পারফিউম, দামী পেন, এইসব। দামী পেন মনে হয় পড়াশুনায় ভালো ছেলেদের জন্য মেয়েরা পাঠিয়েছে।

চলো গিন্নি, আজকের সন্ধ্যায় আমরা একসাথে ওয়াইন খাই। যাও, গেলাস নিয়ে এসো।

দিদিমা রান্নাঘর থেকে গেলাস নিয়ে এলেন।

আরে, আরে স্টিলের গেলাস নয়। স্টিলের গেলাসে কেউ ওয়াইন খায় না। কাঁচের গেলাস নিয়ে এসো।

কাঁচের গেলাসে রেড ওয়াইন খেতে খেতে দিদিমা দাদুর গলা জড়িয়ে সোহাগ করে বললেন “হ্যাঁ গো, এই ভ্যালেন্তিন তিথিটা কি বছরে একবারই আসে? পুন্নিমে অমাবস্যার মতন প্রতি মাসে আসতে পারে না?”

1

গল্প - ময়ূরী মিত্র

Posted in






যীশু যীশু করে মাথা খেপেছিল একবার ৷ কারণ যীশুকে দেখতে খুব সুন্দর ৷ টিকালো নাক ,ঘাড় অব্দি কোঁকড়া চুল , জল পড়ছে না অথচ জলভরা চোখ ৷ বারবার আয়নায় যীশুর চুল দেখে নিজের চুলে ওরকম স্টাইল করতে চাইতাম ৷ হত না--কুকুরের লেজের মতো গুঁটিয়ে যেত আমার চুল ৷ চুলের কুঁই কুঁই কান্নাও শুনতে পেতাম যেন ৷ রেগে গিয়ে ক্যালেন্ডারের যীশুকে পাঁচ আঙুলে কুঁচকে দিতে চাইতাম ৷ যীশু হাসতেন -- কাঁটার মুকুটের ফাঁক দিয়ে হলুদ কমলা আকাশ উঁকি দিত ৷ দিনের আকাশ তাও যীশুর চারপাশে তারারা ফুটে ৷ মনে হত --যীশু লোকটার ক্ষমতা আছে ৷ একসঙ্গে সূর্য তারা নিয়ে --দ্যাখো কেমন খেলা করছে ৷
আমার বন্ধুহীন হয়ে থাকাটা যীশু মেনে নেয়নি ৷ নেওয়ার কথাও নয় ৷ কেননা মানুষ খুব ভালোবাসে যীশু৷ বাচ্চাদের ফটাফট বন্ধু করে নেয় ৷ যীশুর হাত ধরে আমার কাছে এল চিকলেট ৷ কমলা আকাশের যীশুকে পুজো করা একটা বাচ্চা মেয়ে ৷ বাচ্চাটা এমনভাবে আমার গায়ে লেগে থাকছিল যে বন্ধুত্বের মাঝপথে তাকে ডাকলাম --চিকলেট ৷ আরে আমিও তো তখন বাচ্চা ---রামকৃষ্ণের প্রসাদ খেয়ে বেড়াই ৷ লুচি আর শুকনো বোদে ৷
আমার বাচ্চা মাথা থেকে বাচ্চা বন্ধুকে দেওয়া নাম চিকলেট ৷ চিকলেট মাঠ খুব ভালোবাসত ৷ বেলগাছিয়ায় তখন পরপর তিনটে সবুজ মাঠ ৷ তার কোনো না কোনোটাতে বিকেলবেলা চিকলেট আমার হাত ধরে ঘুরত ৷ আসলে আমি আমার মুঠোয় চিকলেটের আঙুল পুরে রাখতাম ৷ চিকলেটের বদের ধাড়ি ভাইটা দূর থেকে দেখত ৷ আমার সঙ্গে মোটে মিশত না৷ তারা খ্রিস্টান আমি হিন্দু --এসব ভাবনা যে তার এই না মেশার জন্য কাজ করত না - আমি নিশ্চিত ৷ আসলে সে থাকতে তার বোনের ওপর সমবয়সী আরেকটা মেয়ের প্রতিপত্তি ভালো ভাবে নিতে পারেনি চিকলেটের ভাই ৷ ডাকিনি কখনো --তবে মনে মনে ভাইটারও নাম দিয়ে রাখলাম - পটকাকালী ৷

খুব যত্ন করে বই মলাট দিত চিকলেট ৷ একদম টানটান থাকত মলাট ৷ আর আমি রাক্ষসের মতো বই খেতাম ৷ নতুন বই কেনার দু তিনসপ্তাহের মধ্যে বেশিরভাগ পাতা আরশোলার পাপড়ি হয়ে যেত ৷ এসব দেখে পটকাকালীর ঘোর আপত্তি সত্ত্বেও চিকলেট নিজে নিজেই আমার বই মলাটের দায়িত্ব নিয়ে নিল ৷ দুপুরবেলা বইয়ে হাতী , বিল্লির জলছবি লাগাতে লাগাতে চিকলেট বলত --
---জানিস না বুঝি --যীশু এক যোদ্ধা ৷
--যাহ ঢপ ৷
----নারে ! সত্যি --এই দ্যাখ --যোদ্ধা না হলে কেউ কাঁটার মুকুট পরে এত হাসে ! মুকুট আসলে যীশু নিজে নিজেই পরে নিয়েছে ৷ মানুষের কাঁটা সাফের জন্য সবগুলো কাঁটা তুলে নিজের মুকুটে লাগিয়েছে৷ এসব ভাবালু কথা শুনে ঠিক করলাম - স্কুলে টিফিন না খেয়ে চিকলেটকে দেব ৷ ততদিনে বুঝে গিয়েছিলাম - চিকলেটের খিদে বেশী ৷ দুটো ধপধপে কালাকাঁদ বিকেলে চিবিয়ে চিবিয়ে খেত চিকলেট ৷ লালার সন্দেশের গুঁড়োটা কিছুতে গিলত না ৷ পটকাকালী একদিন আমাকে বলল --ওকে একটা করে সন্দেশ দে না রে ! দুটোই দিবি ?

চিকলেট নিজের বইয়ে খবরের কাগজের মলাট দিত ৷ পাশে আমার ব্রাউন পেপারগুলো খুব বিচ্ছিরি লাগত ৷ একদিন এর -তার থেকে পয়সা নিয়ে বেশ কটা লাল - সবুজ- হলুদ -বেগনে মার্বেল পেপার এনে উপহার দিলাম চিকলেটকে ৷ বললাম --বাড়ি গিয়ে আজ নিজের বইয়ে রঙিন কাগজের প্যাক দিবি ৷ ঠিক তো চিকু ?
বন্ধুর হাতে রঙিন বই দেখার আশায় অনেকগুলো চুমু দিলাম চিকলেটকে ৷ রঙিন কাগজ নিয়ে সেই যে চিকলেট চলে গেল -আর আসে না ৷ তিনদিন মতো অপেক্ষা --তারপর মাঠ পেরিয়ে দৌড় চিকলেটের ঘরে ৷ দেখি --দিনেরবেলাতেই ছোট্ট একটা বাল্ব জ্বলছে ঘরটায় ৷ তার মধ্যেই চিকলেট তার রাশ রাশ ছেঁড়া জামা সুটকেসে ভরছে ৷ শুনলাম তারা মামার বাড়ি জামসেদপুর চলে যাবে ৷

বরাবরের মতো তো চলে যাবি ! তাও এত জোরজোর হাসি তোর কেন পায় রে চিকলেট ? বাবা ! একটা করে জামা ভরছিস আর হেসে গড়াচ্ছিস ৷
সস্তার তক্তাপোষে খ্যাচখ্যাচ আওয়াজ ওঠে ৷

চিকলেট বলে--
আমার মামার খুব বড় কেক কোম্পানি ৷ আমায় ফাদারের স্কুলে ভর্তি করে দেবে -সাদা গাউন দেবে ৷

ভীষণ ঝগড়া করতে ইচ্ছে হচ্ছিল ৷ বন্ধুর সৌভাগ্য না বন্ধুর চলে যাওয়া -- কোনটা যে আমাকে অশ্রুহীন করেছিল -আজ তা কী করে নির্ণয় করি !

---- চিকলেট --এই চিকলেট --সুটকেসের ডালা বন্ধ করে দিলি যে বড়ো ! আমার মার্বেল পেপারগুলো নিয়ে যাবি না ?

---না ৷ মামা নতুন দেবে তো ! তুইই নিয়ে যা রে ৷
এবার বই ছিঁড়লে রঙিন মলাট দিস ৷--- সেই একইরকম কটকটে সুখের হাসিটা হেসে বলল চিকলেট ৷

আমাকে মাঠ অব্দি এগিয়ে দিল পটকাকালী ৷ বড্ড ভুলভাল প্রতিশ্রুতিও দিয়ে ফেলল পটকা --বড় হয়ে তারা নাকি আমার জন্য একডজন ক্রিম কেক নিয়ে ফিরবে ৷

আমি নখ দিয়ে মাঠের ঘাস খোঁচাচ্ছিলাম ৷ দেখতে চাইছিলাম - আগামী শীতে ঘাসের ডগায় কতটা শিশির জমলে মাঠ নরম হবে ৷
নরম মাটিতে ইয়া লম্বা ঘাস গজায় ৷
পায়ে কাঁকড় কম লাগে ৷
1

গল্প - মনোজ কর

Posted in

 























নবম পর্ব

ব্রিটিশশক্তির দুই উপাদান- গুপ্তচর এবং বিশ্বাসঘাতক

পলাশির যুদ্ধে গুপ্তচরেরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। অন্যায় এবং নীতিহীন পদ্ধতিতে সংবাদ সংগ্রহ করে ব্রিটিশদের কাছে পৌঁছে দেওয়া ছিল রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরের বিশ্বাসঘাতকদের অর্থ উপার্জনের একটা বড় রাস্তা। এদের খবরের উপর ভিত্তি করেই ক্লাইভ ঠিক সময়ে অ্যাডমিরাল ওয়াটসন এবং কলকাতা কাউন্সিলের কাছে যুদ্ধ শুরুর আবেদন জানায়। কোম্পানি এই গুপ্তচরদের প্রভূত পরিমাণে আর্থিক সাহায্য করে একেবারে নিজেদের তাঁবেদার বানিয়ে তুলেছিল। এই গুপ্তচরেরা সাংকেতিক ভাষা তৈরি এবং ব্যবহারে পারদর্শী ছিল। বিশেষ করে সংখ্যাকে শব্দ এবং শব্দকে সংখ্যা দিয়ে লেখার বেশ চল ছিল এই সাংকেতিক ভাষাগুলিতে। উদাহরণ হিসাবে a’র জায়গায় 19, বা b’র জায়গায় 15 ইত্যাদি। আবার কিছু কিছু ক্যাপিটাল লেটার দিয়ে কোনও বিশেষ ব্যক্তি বা জায়গা বোঝানো হত। যেমন A মানে ওয়াটস, D মানে মীরজাফর ইত্যাদি।

১৭৫৭ সালের আগস্ট মাসে ক্লাইভ নিজে লন্ডনের কোর্টে লিখছে যে তার হাতে সিরাজের লেখা কিছু চিঠি এসেছে যে চিঠিগুলো ফরাসিদের লেখা হয়েছিল। এই চিঠিগুলোর অনুবাদ পড়লে এ কথা বোঝা অনেক সহজ হয়ে যাবে যে কেন সিরাজকে অবিলম্বে সিংহাসনচ্যুত করা দরকার। রেভারেন্ড লং পন্ডিচেরির কমান্ডার চার্লস জোসেফ দ্য বাসসি কে লেখা সিরাজের বেশ কিছু চিঠি অনুবাদ করেছিল। এই চিঠিগুলোর সময়কাল ১৭৫৭’র ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি অর্থাৎ ব্রিটিশদের সঙ্গে আলিনগর চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার কয়েকদিন পরেই যখন ক্লাইভ চন্দননগর আক্রমণের প্রস্তাব পেশ করেছে এবং সে বিষয়ে ওপরওয়ালাদের সঙ্গে মতবিনিময় চলছে। চিঠিটি এইরকম,

‘সর্বমহান আধিকারিক এবং মহিমান্বিত বন্ধুবর মঁসিয়ে বাসসি,

আপনি হয়ত অবগত আছেন যে উপদ্রবসৃষ্টিকারী ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল এবং কর্নেল ক্লাইভ বিনা কারণে চন্দননগরের গভর্নর মঁসিয়ে রেনোঁর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়েছে। আমি যেহেতু মানবসমাজের মঙ্গলকামনায় আত্মনিবেদন করেছি সেই হেতু আমার সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে মঁসিয়ে রেনোঁর পাশে দাঁড়াতে মনস্থ করেছি। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি আমার পাঠানো সৈন্যদের নিয়োগ করতে পারেন। প্রয়োজনে আমি নিজে গিয়ে তাঁর পাশে দাঁড়াব। ইংরেজরা যারা বিনা কারণে উপদ্রব সৃষ্টি করছে নিশ্চয়ই যথোপযুক্ত শাস্তি পাবে। আমার সৈন্যবাহিনীকে নিজের সৈন্যবাহিনী বলে মনে করবেন। আশা করি আমি যে দু’হাজার সৈন্যের জন্য আমি আপনার কাছে অনুরোধ করেছিলাম আপনি তা অবশ্যই পাঠিয়েছেন। যদি এখনও না পাঠিয়ে থাকেন তবে সত্বর পাঠাবার ব্যবস্থা করলে বাধিত হব। মঁসিয়ে রেনোঁ আপনাকে বিস্তারিত ভাবে সবকিছু জানাবেন। আপনার স্বাস্থ্যের সংবাদ জানার জন্য উদগ্রীব থাকব। ‘

দ্বিতীয় চিঠির সময়কাল মার্চের মাঝামাঝি যখন মঁসিয়ে বাসসি চন্দননগরকে ব্রিটিশদের হাত থেকে বাঁচানোর উদ্দেশ্যে চন্দননগরের দিকে আসছে। দুর্ভাগ্যবশত, অনেক দেরি হয়ে গেছে । ১৪ই মার্চ যখন এই চিঠি লেখা হয় তখন ফরাসিদের সঙ্গে ক্লাইভের বাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে এবং ২৩শে মার্চ চন্দননগরের ফরাসিরা ক্লাইভের কাছে আত্মসমর্পণ করে। চিঠিতে সিরাজ চন্দননগরকে রক্ষার উদ্দেশ্যে মঁসিয়ে বাসসির উড়িষ্যা উপকূলে পৌছনোর খবরের প্রাপ্তিস্বীকার করে জানায় যে সে বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করার উদ্দেশ্যে মঁসিয়ে বাসসির সঙ্গে দেখা করার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সিরাজ একথাও জানায় যে নিকটবর্তী নায়েব, সুবেদার এবং ফৌজদারদের জানানো হয়েছে তারা যেন মঁসিয়ে বাসসির জন্য সবরকম সহযোগিতার ব্যবস্থা করে।

মার্চের শেষে লেখা তৃতীয় চিঠিটি এইরকম।

আমি অবগত হয়েছি যে আপনি উড়িষ্যা উপকূলে ইছাপুরে এসে পৌঁছেছেন। এই সংবাদে আমি অতিশয় আনন্দিত। আমি আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। ব্রিটিশদের অন্যায় সম্বন্ধে আর কী বলবো? বিনাকারণে তারা মঁসিয়ে রেনোঁর সঙ্গে গন্ডগোল করে কারখানা দখল করে নিয়েছে। ওরা এখন মঁসিয়ে ল’র সঙ্গে গন্ডগোল পাকাতে চাইছে। কিন্তু আমি তা হতে দেব না। আমি আমার সমস্ত শক্তি নিয়ে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব। যখন আপনি বালাসোরে এসে পৌঁছবেন আপনার আপত্তি না থাকলে তখন আমি মঁসিয়ে লকে আপনার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করব। শুভেচ্ছাসহ।

জিন লয়ের মতানুসারে বাংলায় ব্রিটিশদের সঙ্গে ফরাসিদের যুদ্ধের মূল কারণ সাতবছরব্যাপী ইউরোপের যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সংবাদ বাংলায় পৌঁছোয় ১৭৫৭ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটিশদের কলকাতা পুনর্দখলের অব্যবহিত পরেই। এছাড়াও মঁসিয়ে রেনোঁ সিরাজের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হবার জন্য অধীর হয়ে পড়েছিল। লয়ের মতে ওয়াটসন এবং ক্লাইভ সিরাজের দরবারে লয়ের গতিবিধির ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিল। তাদের ধারণা ছিল যে ফরাসিরা সিরাজের দরবারের সকলকে উপঢৌকন দিয়ে হাত করে ফেলেছে। কিন্তু সত্য এটাই যে সিরাজের দরবারে সিরাজ ছাড়া আর সকলেই ব্রিটিশদের পক্ষে ছিল।

জিনস ল তার স্মৃতিচারণায় বলেছে যে সিরাজকে গদিচ্যুত করা ব্রিটিশদের জন্য অপরিহার্য ছিল। ফরাসিদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করা ছিল তার প্রথম পদক্ষেপ। সিরাজ এবং অতিরিক্ত সৈন্যসহযোগে ফরাসিরা একত্রে হয়ত বাধার সৃষ্টি করতে পারত। ব্রিটিশরা চেয়েছিল যেই নবাবের আসনে বসুক না কেন সে যেন ব্রিটিশদের স্বার্থরক্ষা করে। ফরাসিদের পক্ষে খুব একটা বেশি কিছু করা সম্ভব ছিল না। বিশেষকরে চন্দননগর দখল হয়ে যাবার পর ফরাসিরা অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। ব্রিটিশদের সঙ্গে সিরাজের নিজের দরবারের সিরাজবিরোধী শক্তিরা হাত মেলানোর ফলে ব্রিটিশদের শক্তি বহুগুনে বেড়ে যায়। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও ফরাসিরা রাই দুর্লভ এবং জগতশেঠের সমর্থন আদায় করতে পারেনি। কলকাতার ঘটনার পর কেউই ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস পাচ্ছিল না। লয়ের মতে জগতশেঠ মাধবরাই এবং তার ভাই স্বরূপচাঁদ সিরাজের বিরুদ্ধে নানারকম চক্রান্তে লিপ্ত ছিল। সিরাজের সামনে তারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নানারকম কুমন্তব্য করে সিরিজকে উত্তেজিত করত। এর পিছনে দুটো উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত সিরাজের আস্থা অর্জন করা এবং দ্বিতীয়ত সিরাজকে বিপথে চালনা করা। অল্পবয়সী সিরাজ উত্তেজনার বশে ক্রোধান্ধ হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তার সমস্ত পরিকল্পনা চিৎকার করে সবার সামনে বলে ফেলত।এতে ব্রিটিশদের পক্ষে সাবধানতা অবলম্বন করা অনেক সুবিধাজনক হয়ে যেত। তাছাড়াও জগতশেঠের সাহায্যে মীরজাফর এবং অন্যান্য মহামান্য ব্যক্তিদের নিজেদের দিকে টেনে নিতে পেরেছিল ব্রিটিশেরা। আলিবর্দির মন্ত্রীসভার সদস্যরা যারা সিরাজের হাতে অপমানিত হয়েছিল তারাও এই সুযোগে প্রতিশোধস্পৃহায় ব্রিটিশদের পক্ষ নিল।

জিনস ল’ এর কথা অনুযায়ী যে সিরাজের যে চিঠির উপর ভিত্তি করে অ্যাডমিরাল ওয়াটসন চন্দননগর আক্রমণ করেছিল সেই চিঠির বয়ান তৈরির পিছনে ব্রিটিশদের হাত ছিল। এই চিঠির রচয়িতাকে ব্রিটিশরা উৎকোচ প্রদান করেছিল এবং চিঠির বয়ান এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে চিঠির ব্যাখ্যা অন্যরকমভাবে করার সুযোগ থাকে। সিরাজ বিশ্বাস করত যে চিঠি তার নির্দেশ অনুযায়ী লেখা হবে এবং সেই চিঠি পড়ার কোনও প্রয়োজন নেই। । তার চেয়েও বড় কথা যে মুসলমান নবাবেরা চিঠিতে তাদের নাম সই করত না। নবাবের সামনে সেই চিঠিতে সিলমোহর লাগানো হত এবং সেই চিঠি খামবন্দি করে শক্ত করে আটকে দেওয়া হত। অনেকে মনে করে সই না করার পিছনে নবাবদের অন্য উদ্দেশ্য থাকত। কোনও কারণে বিতর্ক সৃষ্টি হলে নবাবরা এই ভাবে পত্রলেখকদের উপর নির্দেশ না মানার বা না বোঝার দোষ চাপিয়ে দেবার রাস্তা খোলা রাখত।

কেবলমাত্র কর্মচারিরা নয় নবাবের হারেমের খোজারা পর্যন্ত সিরাজের প্রতি বিরক্ত ছিল এবং তার বিরুদ্ধে চক্রান্তে অংশ নিয়েছিল। সিরাজের বিরুদ্ধে এই সর্বব্যাপী চক্রান্তের মূল রূপকার ছিল জগতশেঠ। জগতশেঠ সিরাজের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ব্রিটিশদের সবরকম ভাবে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। জিনস ল সিরাজের দরবারের সকলকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে নবাবের সেনাবাহিনীর একটা অংশকে ব্রিটিশদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করতে চন্দননগর পাঠানোর প্রস্তাবে সিরাজ রাজি হয়ে গিয়েছিল। জিনস ল জানত রাই দুর্লভকে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না তাই সেনাবাহিনীর উপপ্রধান মীরমদনের সঙ্গে দেখা করে তার সঙ্গে মোটা অঙ্কের চুক্তিতে সেনাবাহিনী পাঠানোর ব্যবস্থা পাকা করে ফেলে। রাই দুর্লভ, মীরমদন ছাড়াও অন্যান্য সেনাপ্রধান এবং আধিকারিকদের অর্থের বিনিময়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সবরকমের সাহায্যের আশ্বাস আদায় করে নেয় সে। সব যখন তৈরি এবং সিরাজের সম্মতি কেবল সময়ের অপেক্ষা সিরাজ জানালো যে অস্ত্রপ্রয়োগের আগে ব্রিটিশদের সঙ্গে আলোচনার সমস্ত প্রচেষ্টা চালানো উচিৎ। এর কারণ হিসাবে সিরাজ যুক্তি দেয় যে ব্রিটিশরা তার অনুমতি ব্যতিরেকে কোনও রকম আক্রমণ করবে না বলে জানিয়েছে। সুতরাং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তড়িঘড়ি সেনাবাহিনী না পাঠিয়ে অপেক্ষা করা এবং পরিস্থিতির ওপর নজর রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। এই প্রসঙ্গে ৭ই মার্চ সিরাজকে উদ্দেশ্য করে ক্লাইভের লেখা চিঠির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যে চিঠিতে ক্লাইভ চন্দননগর আক্রমণের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে লেখে যে সিরাজের অনুমতি ছাড়া আক্রমণের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করা যাবে না। জিনস ল তার স্মৃতিচারণায় বলে যে ফরাসিদের সাহায্য এবং সৈন্য পাঠাতে দেরি করার পিছনে জগতশেঠের প্রচ্ছন্ন ভূমিকা ছিল।

নিরপেক্ষভাবে দেখতে গেলে বলা যেতে পারে যে ক্লাইভের সঙ্গে কোনরকম বিরোধিতা না করার যে সিদ্ধান্ত সেইমূহূর্তে ভীতসন্ত্রস্ত সিরাজ নিয়েছিল তা সঠিক ছিল মূলত দু’টি কারণে। প্রথমত ফরাসিদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে এবং সেনাবাহিনী পাঠালে ক্রুদ্ধ ক্লাইভ সিরাজের অনুমতির তোয়াক্কা না করে চন্দননগর আক্রমণ করতে পারে। দ্বিতীয়ত একবার চন্দননগর ব্রিটিশদের করায়ত্ত হলে বাংলায় ব্রিটিশবিরোধী শক্তি হিসাবে ফরাসিদের আর কোনও অস্তিত্ব থাকবে না এবং যুদ্ধজয়ী ব্রিটিশ এই যুদ্ধকে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে । জিনস ল যখন জগতশেঠের কাছে সাহায্যের আবেদন নিয়ে হাজির হয় জগতশেঠ তখন ধার শোধ করার ব্যাপারে ফরাসিদের সময়ানুবর্তিতার অভাব নিয়ে ঊষ্মা প্রকাশ করে। ল তাদের মূল আলোচনায় টেনে আনলে তারা জানায় যে তাদের সম্বন্ধে ফরাসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্রিটিশদের সাহায্য করার যে অভিযোগ উঠেছে তা সর্বৈব মিথ্যা এবং সর্বোপরি তাদের জ্ঞান এবং বিশ্বাসমতে ব্রিটিশদের এইমূহূর্তে চন্দননগর আক্রমণের কোনও পরিকল্পনা নেই।

নাছোড়বান্দা জিনস ল ছাড়বার পাত্র নয়। সে বলে যে সে নিশ্চিত যে ব্রিটিশরা চন্দননগর আক্রমণ করবে এবং জগতশেঠের কাছে তার একান্ত অনুরোধ যে তিনি যেন সিরাজকে সৈন্য পাঠানোর জন্য অনুমতি দেবার পরামর্শ দেন। তার উত্তরে জগতশেঠ জানায় যে সে অপারগ কারণ সিরাজ এই মূহূর্তে ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চায় না। ল এর বুঝতে বিলম্ব হয় না যে জগতশেঠ কোনও ভাবেই ফরাসিদের সাহায্য করবে না। জগতশেঠের মনোভাব আরও স্পষ্ট হয় তখন যখন জগতশেঠের ঘনিষ্ঠ রঞ্জিত রাই ব্যঙ্গের সুরে বলে,’ তোমরা ফরাসি বীর। তোমরা ব্রিটিশদের এত ভয় পাচ্ছ কেন? ওরা আক্রমণ করলে তোমরাও প্রত্যাঘাত কর। কে না জানে মাদ্রাজ উপকূলে তোমরা কী করেছ? আমরাও ঔৎসুক্যভরে অপেক্ষা করছি দেখার জন্য যে ফরাসিরা কেমন করে তাদের ব্যবসা চালায়?’ কথাপ্রসঙ্গে সিরাজকে গদিচ্যুত করার কথা কানে আসে ল এর। ল যখন সিরাজেকে সবকিছু জানায় সিরাজ পুরো ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দেয়। আত্মম্ভর, অপরিণত সিরাজকে পরবর্তীকালে এর মূল্য চোকাতে হয় জীবন দিয়ে।
0

গল্প - জাকিয়া শিমু

Posted in






পর পর পাঁচদিন ঠিক একইসময়ে অজানা নম্বর থেকে ফোন কলটা আসে, আজও ঘড়ি ধরে বসে আছি এবং ঠিক বারটা ন’মিনিটের মাথায় ফোনটা মন্দিরের ঘণ্টার মতো কাঙ্ক্ষিতশব্দে বেজে উঠল! আমি সাধারণত অজানা নাম্বারের ফোন ধরি না,উপরন্ত কাছের কেউ না হলে, কাজের সময়ে ফোনালাপে যারপরানই বিরক্ত হই। ফোনকলে নিজদেশের কোড নম্বর নির্দেশ করে। পৃথিবীর ঘূর্ণন গতির কারণে কোড নির্দেশিত সেদেশে এখন মাঝরাত আর আমার এখানে ভরদুপুর। আমি একটু ভেবেচিন্তে চলি,মূখ্যত আমাকে চলতে হয়। যারদরুন অকালে কপালে গুটিকয় ভাঁজও পড়ে গেছে, ভাঁজের নিচে হালকা পেতলরঙের ঠাণ্ডা চোখদুটো আলগোছে বন্ধ করে ফোনের বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বসি- ফোনটা আসলে কার ! ধরব কি,ধরব না, এমনতর দোটানা-মন নিয়ে নয়, বলতে গেলে বুঝেসুঝে কপালের ভাঁজে দ্বিগুণ বিরক্তি টেনে গলায় যথাসম্ভব গাম্ভীর্য নিয়ে ফোনটা ধরি। এপাশ থেকে ফোনটা ধরতে; ওপ্রান্তের ভার ভার,কতোকাল না-শোনা কিন্তু প্রতিক্ষণের কাঙ্ক্ষিত গলায়, নিজের নামটা শুনে আচমকা শরীরটা হিমশীতল বরফখণ্ডের মতো জমে যায়! হৃদপিণ্ডে আঁচড় কেটে যাওয়া মানুষটার কণ্ঠস্বরে,নিজের বর্তমানকে ছুড়ে ফেলে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শিহরণে চৌদ্দ বছরের বালিকার মতো ভেতর ভেতর লাফিয়ে উঠি। ফোনের ওপ্রান্তের প্রশ্নের উত্তরে বহুকথা কথারঝুলিতে উপচে-পড়া জমা থাকলেও এমুহূর্তে আমার কণ্ঠ স্থির স্থানু হয়ে আছে, যেন জাঁতিকলে কেউ তা চেপে ধরে আছে !

এরপর থেকে আমি তুমুল হারে বদলে যেতে শুরু করি- আমার রোজকার কাজকর্ম সম্পূর্ণ ভিন্নবলয়ে আবর্তিত হতে থাকে। সকালে আড়মোড়া ভেঙ্গে কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ির নিয়মিত-অভ্যাসটা হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে হুরমুড়িয়ে বিছানা ছেড়ে, ঝটপট সকালের কাজ গুছিয়ে অফিসে চলে আসি। আমি সাধারণত সকালের কফিটা আয়েশ করে অফিসবন্ধুদের সাথে গল্পেরঝাঁপি মেলে উপভোগ্যে অভ্যস্ত কিন্তু কফিকাপের ঝনঝনানিতে এখন আর মন বসে না। অথচ এই দু’দিন আগেও কাজের ফাঁকে ফাঁকে আড্ডাটা না হলে কাজে মন ফেরানো মুশকিল ছিল। এসব আর কোন কিছুই আমাকে টানে না শুধু ফোন কলটার জন্য অবরুদ্ধ উচ্ছ্বাস নিয়ে দুপুর অবধি তীব্র তৃষ্ণার্ত চাতকের মতো অপেক্ষায় থাকি। অফিসের কাজ গোঁজামেলে কোনমতে করি বটে,ক্ষণে ক্ষণে ঘড়ির কাটায় অস্থির চোখযুগল আটকে থাকে। মিনিট কাটতে সময় নেয় যেন ঘণ্টা পেরিয়ে,মনে হয় বারোটা বাজতে আজকাল দীর্ঘ সময় কেটে যায়। পয়ত্রিশ বছর বয়সী এই আমি আচমকা চৌদ্দ বছরের প্রথমপ্রেমে-পড়া খুকির মতো ছটফট করি। একটা সময় পর ফোনটা ঠিক সময়ে বেজে উঠে। আলাপের ঘোরে মধ্যাহ্ন বিরতি কোন নিমিষে কেটে যায়,টের পাই না কিন্তু কথা যে সব অ-বলাই থেকে যায় ! রাতজাগা-সময়ে গুছিয়ে রাখা কথাগুলো শেষপর্যন্ত আগামিকালের জন্যে পড়ে থাকে। আমরা এই দীর্ঘসময়ে যদিও আমাদের কাছে খুব অল্পসময় মনে হয়, কতো কি কথা বলি, যার কোন অর্থ নেই কিংবা বেশ অর্থবহ অন্তত আমাদের কাছে তো তাই মনে হয়! আমরা আমাদের আজন্ম লালিত স্বপ্নের আত্নহননের দহনের দিনযাপনের গল্প করি। সময়ের ব্যবধান ভুলে একলহমায় অতীতদিনে ফিরে যাই। সময়ের ঘণ্টা বেজে উঠলে ফোনটা ছাড়তে হয়। পরের দিন আবার আগের দিনের গল্পের বাকি অংশ ধরে কথা শুরু করব প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হই বটে আসলে সেসব কথা মনেমুড়িয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গে আলাপ চলে আসে। এভাবে প্রতিদিনের গল্পগুলো পুঁতিরমালার মতো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।

আমাদের সম্পর্কটা আদিতে কী ছিল ! এখনই বা তার কী নাম হবে ! উত্তর পাওয়া দুষ্কর হলেও বলতে দ্বিধা নেই এমন সুন্দর পরিচ্ছন্ন সম্পর্ক জগতে খুব কমই হয়। তবে সম্পর্কটা বোঝা ভারি মুশকিল, অনেকটা দিঘির কালোজলে হারিয়ে যাওয়া নাকছাবির মতো- পরখ করে দেখলে ঝকমকিয়ে উঠে, হাত বাড়ালে কাদাজলে লুকিয়ে পড়ে, এমন বুক ধড়ফড় ধুঁয়াশাঘেরা’ একটা সম্পর্ক। আমাদের নিজেদের মধ্যে প্রথম পরিচয়ের শুরুটা পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখেছি, সঠিক করে কারোরই মনে নেই। আমরা একই স্কুলে পড়তাম,যদিও দু’জনের শ্রেণি ছিল- দুই ক্লাস উপর-নিচ। পড়াশুনায় আমরা স্কুলের সেরা ছিলাম। সে সুবাদে হাজারো মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলাম আমরা। আর তাতে ওটুকু কচিবয়সেও শীতের সকালের কুয়াশার মতো অহমের একটা চাদরে আমরা জড়িয়ে গিয়েছিলাম। কেন্দ্রীয় মানুষগুলো সাধারনের মতো হতে নেই, এমন বোধে আসক্ত ছিলাম এবং তালঠোকা কায়দায় অচিরেই কলার থোরের আবরণের ন্যায় একটি গাম্ভীর্যের ভাঁজ পড়ে আমাদের ব্যক্তিত্বজুড়ে। তবে আমাদের মনের জানালা খোলাউন্মুক্ত ছিল, তাতে কোন আবরণ স্পর্শ করতে পারেনি যা আমাদের অস্বীকার করার উপায় ছিল না। একই স্কুলে পড়তাম তাই দেখা হবার সুযোগ ছিল, দেখা হতোও বটে। আমরা কেউ কারো সাথে সহজভাবে মিশতে অভ্যস্ত ছিলাম না, অথচ আমাদের মন চাইত নিজেদের মধ্যে একঝোঁক কথাবার্তার বিনিময় হউক। সেটা অবশ্য মনের কথা, আজ পর্যন্ত কেউ তা কথার ছলেও প্রকাশ করিনি তবে হলফ করে বলা যায়, আমরা খুব চাইতাম আমাদের একটা সম্পর্ক হউক। আজকে এতদিন পরও কী আমরা সেরকম কিছু চাইনা ! তবে সেসময়ে কথা যে একেবারেই হত না, তা কিন্তু নয়। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একত্রে আমাদের দফতরি কাজ করার নিয়ম ছিল। যতটুকু মুখে না বললেই নয় ততটুকু চালিয়ে নেওয়ায় অভ্যস্ত ছিলাম। যদিও অব্যক্ত কথাগুলো পাশাপাশি বোঝাপড়ায়, ব্যক্তকথার চেয়ে হাজারগুণ বেশি বলা হয়ে যেত, চোখে চোখ না রেখেও মনেরচোখে একে অপরকে দেখেছি শত সহস্র বার।

একটা সময় পর মানুষটা স্কুলগণ্ডি পেড়িয়ে শহরের নামকরা কলেজে চলে যায়। তখন থেকে আমি আমার ভেতরের ভিন্ন এবং সম্পূর্ণ নতুন এক জগতের মুখোমুখি হই। আমার অতলস্পর্শী মনের আকাশে দিকশূন্য চিল ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়, খাঁ খাঁ করে মনের জমিন। বুকের গভীরের অচিনবোধ এই আমাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মানুষ হিসেবে আমাকে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমি জীবনের প্রথম কারো জন্য এমন নির্লজ্জ যদিও বিষয়টা আমি ব্যতীত কেউ জানতে পারে না, বেপরোয়া হয়ে পড়ি। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে দ্বিপ্রহরের ঢলে পড়া চাঁদের আলোতে পুকুরঘাটে চুপচাপ বসে থাকি। পুকুরের বুক থেকে ছুটে আসা বিরহী জলতরঙ্গের আলোকচ্ছটা আমাকে উদাস করে তোলে। জোসনা-ঝরা নারিকেল শাখে মৃদু কম্পনে আমি আমাকে হারিয়ে ফেলি! কতশত ভাবনার অনুরণে আমি বুঁদ হয়ে বসে থাকি। রাত্রগুলো নির্ঘুমে কেটে যায়, চোখের চারপাশে শ্বেতভল্লুকের মতো আঁধার কালো রেখা পড়ে। দিনগুলো কাটে রথেরচাকার মতো ঢিলেঢুলে, টেনে হেঁচড়ে। পড়াশুনায় মন নেই এমনকী দৈনন্দিন আটপৌরে কাজগুলোও করতে ব্যর্থ হয়ে পড়ি। সে-বয়সে এমন পরিবর্তনে আমার পরিবারও ভিন্ন চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠে। ডা. রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থ হলে জীন-ভূতের আছর ছাড়াতে দোয়া-কবজে নিস্তার খোঁজে।

একসময় আমার অবশ্য চৈতন্য ফেরে এবং নিজের সাথে বোঝাপড়ায় বসি। সহজে সত্যতা ধরতেও পারি- আমাদের একসাথে, একপথে পাশাপাশি চলার প্রতিজ্ঞা ছিল না কোনোকালে, দ্বিধাম্বিত ছিলাম,ভালোবাসার খুঁটির জোর যদিও আমাদের মধ্যে ছিল তাও যে অত্যন্ত নড়বড়ে ছিল! পরিচয়ের শুরু থেকে আমরা সমান্তরালে হেঁটেছি, কেউ কাউকে যেন একফোঁটা ছাড় দিইনি। কলারমোচার মতো খোলস ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে আমাদের বড়ো বেশি দ্বিধা কিংবা নত হয়ে যাওয়ার প্রবণতা ছিল! নিজের সাথে নিজমনের তর্কের সময়টাও বিমর্ষময় হয়ে উঠে, কিছু অদেখা দীর্ঘশ্বাস সঙ্গোপনে বুকের গভীরে জমা হয়ে থাকলেও সে অবস্থা একটা সময় পরে মোটামুটি কাটিয়ে ওঠি। তারপর সময় মিলিয়ে যেতে- ধীরেসুস্থে স্মৃতির দেয়ালে ছায়া পড়ে, অবশস্মৃতিগুলো অনুভূতির চৌকাঠ পেড়িয়ে শূন্যতায় মিশে যায় তবে মুছে যেতে পারে না চিরতরে। সেসবের কিছুটা আঁচ হলেও ধূসররঙের অস্তিত্ব হয়ে হৃদপিণ্ডে লেপটে থাকে পাকাপোক্তভাবে। মনের গভীরে পুড়ে যাওয়া সেই প্রথম-প্রেমের অপূর্ণ স্বপ্নের কষ্টটা আমাদের বয়ে নিতে হয়েছে এতকাল।

এরপর প্রায় সাত বছর পর তার সাথে আমার আবার দেখা হয়-কোন এক ভাদ্রমাসের ভ্যাপসা গুমোট লাগা ধূসর সন্ধ্যাবেলায়, ঢাকার নীলক্ষেতের বইবাজারের খুপরিঘরগুলোর পাশে। সময়টা ঠিক এখনো মনে আছে, আমি বার বার আকশের দিকে তাকাচ্ছিলাম- কারণ আকাশজুড়ে তখন সীসারঙা মেঘেরা দাপাদাপি করছিল এবং ক্রমেই তা দুধেলগাভির ওলানের মতো ভারী হয়ে আসছিল, যে কোনো সময় টুপ করে ঝরে পড়ে বলে। সেরকম একটা অস্থির সময়ে আমি আমার হলের বন্ধু, মিলার সাথে প্রায় ঘণ্টা দুই নীলক্ষেতে সস্তাদরে প্রয়োজনীয় বই দরকষাকষিতে কিনে হলে ফিরতে রিকসার খোঁজে দাঁড়িয়ে আছি। চারপাশের হাঁকাহাঁকি ঠেলাঠেলি, রিকশার অতিরিক্ত টুংটাং আওয়াজ, গাড়ি বাসের অযাচিত বেহুদা হর্নের শব্দকে পাশ কাটিয়ে বুকচিরে বসে যাওয়া মানুষটার গম্ভীরকণ্ঠে উচ্চারিত আমার নামটা সেসব অযাচিত শব্দ ছেদ করে আমার কানে আসে লাগে। ভেবেছিলাম অবচেতন মনের কাণ্ড হবে হয়তো,তারপরও কেমন একটা লজ্জাবনত চোখে ভিড়ের ভেতর হন্যে হয়ে পেছন ঘুরে তাকে তালাশ করি। সে সুযোগে মানুষটা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি পাশ ফিরতে চমকে উঠি এবং মুহূর্তে নিজেকে ঝিনুকের শক্ত খোলসটার মতো একটা আব্রুবেড়ায় আচ্ছন্ন করে ফেলি! লোকটা নিজেও বোধকরি আমার মতো অচেনা একটা বোধে বাধা পড়ে ভেতরকার উচ্ছ্বাস প্রাণপণে চেপে রেখে কিছুটা সময় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। যেন আমাদের বাড়ি ফেরার বড্ড তাড়া,কোন বাহনের খোঁজে আমাদের এভাবে পাশাপাশি অচেনা কারো মতো দাঁড়িয়ে থাকার কথা ছিল!

তবে দু’চারটা বাক্য বিনিময় যে হল না, তা কিন্তু নয়। কেমন আছি, জানতে চাওয়া হল- যদিও তার লাজুক কিংবা দ্বিধাম্বিত চোখজোড়া হাজার কথার জ্বালায় মরে যাচ্ছিল, চোখেরভাষা মনেরমানুষের কাছে গোপন করা যায় না। আমার মনেরশরীর তখন পুরোপুরি সম্মোহিত ছিল,ওটুকু উত্তর বের হতে সমস্ত শরীর নিংড়ে তীব্র আবেগের স্রোত বইছিল এমনহারে যে শেষপর্যন্ত কণ্ঠ ভেদে একটি অস্ফুট শব্দ বের হতেও ব্যর্থ হয় তবে বাধ্যমেয়ের মতো মাথা দুলিয়েছি। ততক্ষণে আকাশ ফুটু হয়ে বৃষ্টি হয়ে নেমে আসে। আমরা চারপাশের প্রচণ্ড ভিড়বাট্টা কাটিয়ে বলাকা সিনেমা হলের পাশে ছোট্ট এক ঘড়ি-ঘরে ঢুকে পড়ি। মিলা কথাপটু মেয়ে। লোকটার সাথে নানান বিষয়ে, অনবরত কথা বলেই যাচ্ছে, আমি নিরব হয়ে শুনছি। মানুষটা উচ্চশিক্ষা নিতে সামনের মাসে দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।

ভাদ্র মাসের বৃষ্টি, খানেকক্ষণ ক্ষান্ত দেয়, আবার ঝুরঝুরিয়ে নামে। আকাশের ভাবসাব ভালো নয়,জোরেসোরে ডলক নামবে বলে। আমরা রিকসা নিয়ে যে যার পথে ফিরে যাই। এবারও আমাদের মনের গভীরে তোলা কাপড়ের মতো জমিয়ে রাখা কথাগুলো অদৃশ্য দেয়ালের ওপাশটায় চাপা পড়ে গেল! আমার বুকটা নিংড়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস বেরিয়ে আসল, চোখে নীরবজল। রিকসার পেছনের ছোট্ট জানালা দিয়ে বিপরীত পথে চলে যাওয়া রিকসার দিকে চোখ রাখি, লোকটা জগতসংসারের সমস্ত মায়া দু’চোখে ভরে আমাদের রিকসার দিকে চেয়ে আছে। ও-চাহনি হাজার না-বলা কথা, এক মুহূর্তে বলে গেল যেন!

এরপর আমাদের আর দেখা কিংবা যোগাযোগের সুযোগ হয় না। আমরা হেলায়ফেলায় আমাদের হারিয়ে ফেলি। তবে আমাকে আবার সেই পূর্বের অসুখে জেঁকে ধরে, সেই চৌদ্দ বছর বয়সের নির্জন সময়ের উদভ্রান্ত কল্পনারা মনের মাঝে নতুন করে আবার জেগে উঠে। আমি পাতলা কাঁচের মতো ঝুরঝুরিয়ে ভেঙ্গে পড়ি, তার শেষমুহূর্তের সেই মায়াদৃষ্টি আমাকে বিস্তর নাড়িয়ে, ভেঙ্গেচূরে আমার মধ্যে রীতিমত একটা অবর্ণনীয়-বিষাদের জনপদ তৈরি করে দিয়ে যায়। আমি সেই নিঃসঙ্গ পথে অসীম বিষণ্ণতায় একাকী পথে হাঁটি। রাতগুলো জেগে জেগে ভোর হয়, চোখেরকোণে প্রথমপ্রেমে পড়া খুকির মতো বেদনার্ত অভিমান জমে উঠে। উদ্ভট ছেলেমানুষী গ্রাস করে আমাকে। এত বড় শহর তাকে আমি কোথায় খুঁজে পাই ! রিকশা নিয়ে একা একা শহরের এপ্রান্ত অপ্রান্ত ঘুরি। ভরদুপুরে আনমনে বলাকা সিনেমা হলের পাঁশে সেই ঘড়িরদোকানে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি। কতশত লোক পারাপার হয়, কিন্তু সেই মানুষটা এপথে আর ফিরে আসে না ! নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানগুলোতে তাকে খোঁজার ছলে অযথা বই হাতিয়ে যাই। একসময় নগরে সন্ধ্যা নামে, আমি ঘরে ফিরি, শহর ঘুমিয়ে পড়ে আমি মাথার উপর খানিক ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদের সাথে পাগলের প্রলাপ বকি।

সময়, গভীর-ক্ষত সারিয়ে দিতে পারে- কথাটা আদতে সত্য নয় তবে জীবনের আটপৌরে অভ্যস্ততার সাথে মিলিয়ে দিয়ে সাময়িক কষ্ট প্রশমনে তার ভূমিকা মানতেই হয়। সেসূত্রে আমার হাহাকাররা অভ্যাসের সাথে তেলজলের মিশ্রনের মতো অমিশ্রিত অদৃশ্যমান এককুণ্ডলীর তৈরি করে এবং আমি অসহনীয় সেই বাঁধন ছিঁড়ে একসময়ে আবার বের হয়ে আসি তবে হৃদয় খুঁড়ে তৈরি হওয়া ক্ষতের আঁচড়গুলো একান্ত হয়ে আমার বুকে রয়ে যায় ঠিকই। পড়াশুনা শেষ করি এবং বিদেশে পাড়ি জমাই। বিদেশে এসে পড়াশুনা করে ভাল চাকুরীও জুটে যায়। সংসার,চাকুরী সবকিছু নিয়ে ভালোমন্দে দিনগুলো কেটে গেলেও একান্ত নিভৃতে ছলে-কৌশলে মনেরগভীরে বেড়ে ওঠা দগদগে ক্ষতের সেই অস্তিত্ব আমার মনের চৌকাঠে আছড়ে পরে নিয়ম করে।

এতকাল পরে আবার ফোনের ওপ্রান্ত থেকে, মানুষটা আমাকে শূন্যে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আমরা কেউ কারো কাছে আজও কিছু খোলাসা করে চাই না। আমাদের চাইবার কিছু নাই হয়তো,কিংবা আসলে আমরা বুঝে উঠতে পারি না। অপক্ক বয়সের কথাগুলো আজও অযথা বলে যাওয়ার বৃথা চেষ্টা করি। স্মৃতিগুলো, যদিও দু’জনের মনে গভীর চিহ্ন এঁকে দেওয়ার মতো কোন স্মৃতি আমাদের নেই তারপরও খুব প্রিয় কোন কাঁচের পাত্র ভেঙ্গে গেলে যত্ন করে টুকরোগুলো একত্র করার চেষ্টা চলে প্রাণপণে সেরূপে আমরা আমাদের হারানো অতীতের আবছায়া-খুঁটিনাটি স্মৃতিগুলো বড় আক্ষেপে হাতড়ে চলি। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করি আমার মতো সেও, সঠিক সময়ে না বলা কথার আক্ষেপে চৈত্রের খরতাপে খড়মাঠের মতো দাহ্য হচ্ছে। মাঝে অনেক বছর চলে গেছে তারপরও মানুষটার সেসময়ের অতিসাধারণ আটপৌরেস্মৃতি মনে রাখার ক্ষমতায় চমকে উঠি, এমনকি আমার ভেতরের লুকায়িত অনুভূতিগুলোও তাকে ছুঁয়ে দিয়েছিল যা আমার কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়।

ফোনের অপরপ্রান্তের কথা মুগ্ধ হয়ে শুনি। আজ কথাপ্রসঙ্গে তিনি এমন একটা ঘটনা তুলে আনলেন যা কিনা এতদিন আমার মনেরতলায় চাপা পড়েছিল,সে যেই বলতে শুরু করল অমনি যেন সচিত্র সেসব রঙিন পর্দায় দেখতে শুরু করলাম। মানুষটা স্কুল শেষে কলেজে ভর্তি হয়েছে সেসময়ের কথা। সে তুখড় মুখস্থবিদের মতো সেদিনটির কথা বলে যায়-

সেদিন শরতের সেই মধ্যাহ্নবেলায় শারদ নীলে বুঁদ হয়ে ছিল আকাশ, যেন নীল শাড়িরআঁচল উড়ে গিয়ে আকাশে ভেলা হয়ে ভাসছে। আমি চোখ বন্ধ করি,হুবহু সেই দিনে ফিরে যাই। আকাশনীলের ছায়া পড়েছিল ঝিলের জলে- আমি তাজ্জব বনে যাই! আসলেই তাই, সেদিনের আকাশ-জমিন সর্বত্র নীলের মেলা বসেছিল যেন। লাল সাদা শাপলা নীল জলে মনের সুখে ভাসছে। রঙিন প্রজাপতি আর ঘাসফড়িংদের মেলা জুড়ে বসেছিল ঝিলের পরে। সবে বর্ষা বিদায় নিয়েছে তারপরও তার রেশটুকু রয়ে গিয়েছিল প্রকৃতি জুড়ে-বাতাসে ভেজা ভেজা গন্ধ। নীলাকাশের বুক জুড়ে শরতের আহ্লাদি মেঘ,সূর্যকে ক্ষণে ক্ষণে আড়াল করতে ব্যস্ত। রোদহীন সেই নরম প্রকৃতির আঁচ নিতে আমরা বন্ধুরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে নৌকো চড়ে ঝিলে বেড়াতে যাই। আমাদের পরনে ছিল নীল-সাদা স্কুল ড্রেস। মানুষটি সেপথ ধরে নৌকো নিয়ে শহর থেকে বাড়ি ফিরছিল। আমি দূর থেকে দেখেছিলাম বটে যদিও সে তার স্বভাব মতো আমাদের দিকে ফিরেও চায়নি। না তাকিয়েও এত বিস্তর দেখা যায়, তার মুখে এতদিন পরে না শুনলে হয়তো বিশ্বাস করা কঠিন ছিল। সেদিন থেকে মানুষটার নাকি নীলরঙটা পছন্দের তালিকায় প্রথম হয়ে রয়ে গেছে!

রং নিয়ে অবশ্য আমারও একটি গোপনকথা আছে, কৌশলে লুকিয়েছি। কিন্তু আমাকে বোকা বনে দিয়ে নীলরঙ আঁকড়ে ধরা মানুষটি হুহু করে হেসে উঠে,পরক্ষণে আমার হলুদ-রঙের রহস্য জানতে চায়, আমি ফোনের এপ্রান্ত থেকে লজ্জায় হাওয়ায় নড়ে-ওঠা লালরঙটা জবার মতো দোলে ওঠি।

আমাদের স্কুলে মাঝে মধ্যে উপস্থিত যুক্তিতর্কের আয়োজন করা হত। সেরকম এক আয়োজনের বিষয় ছিল- হলুদ বনাম সবুজ। বিষয় নিজেদের ইচ্ছেয় নয়, আধুলি ছুঁড়ে যাদের ভাগ্যে যে বিষয় পড়বে তা নিয়ে বিতর্ক হবে। আমাদের দল সবুজের পক্ষে, বিপক্ষ দলে মানুষটির অবস্থান। তুমুল বিতর্ক চলছে। হলুদ রং’ বিষয় হিসেবে কঠিন বটে, সহজে উপযুক্ত ব্যাখ্যা খোঁজে পাওয়া মুশকিল। তারপরও সে জ্ঞানের গভীরতায় বিষয়কে খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করে তোলে। তার উপস্থাপন ছিল চমৎকার উপভোগ্য, আমি বিপক্ষদলে থেকেও মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার বক্তব্য শুনছিলাম। সবুজ’ আমাদের দলের রং, বিষয় হিসেবে হলুদের চেয়ে সহজ বটে। আমি শুরুতেই আমাদের দেশের পতাকা, সবুজ ফসলের মাঠ এসবে সবার নজর ফেরাই। আমার মতো আমার দলের বাকিরাও সহজেই বিভিন্ন সহজ ব্যাখ্যায় বিতর্ক চালিয়ে নেয়। আমরা জিতে যাই। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আমার পছন্দের রং’টা শুধু বদলে যায়। হলুদ রং আমার অপছন্দের তালিকার প্রথম দিকে ছিল। প্রিয় রং’ সাদার জায়গা খুব সহজে হলুদ এসে দখল করে নিল। এরপর থেকে আমি হলুদ রং ছাড়া অন্য কোন রং চোখে দেখি না, আমার যাবতীয় বিষয়ে হলুদের ছড়াছড়ি। বিষয়টা বেশ গোপনীয় হলেও মানুষটার নজর এড়াতে পারেনি। ৪ এভাবে ফোনে এমনসব গল্পে আমাদের সময় খুব ভাল কাটতে লাগল।

যোগাযোগ ব্যবস্থার সহজলভ্যতায় যোগাযোগ এখন চোখ-নাকের দূরত্বে। ইচ্ছে করলে সেকেন্ডের ভেতর প্রিয় মানুষকে দেখা যায়, কথা বলা যায় তবে পৃথিবীর গতির কারণে একপাশে দিন, অন্যপাশে রাত। আমার বিপরীত প্রান্তে থাকা খুব কাছের এক স্কুল বন্ধু মাঝরাতে ফোনে আমাকে খোঁজে, যার শব্দে আমি গভীর ঘুম থেকে একলাফে জেগে উঠি। খানিকক্ষণ লাগে দম ফিরে পেতে- বুকের ধরফড়ানি কাটিয়ে ফোনটা কানের কাছে নিতে-ওপাশের উচ্ছ্বাস আমার বাকি রাতের ঘুম কেড়ে নেয় একনিমিষে। যার সাথে একসময়ে একদিন দেখা না হলে মনখারাপের তাড়সে ছটফট করতাম সে কিনা এত বছর পরে এই রাতদুপুরে ! বন্ধুর বিয়ে হয়ে যায় কিশোরীবেলায়, তার সাথে আর দেখা হওয়ার সুযোগ হয়নি। আমাদের জমানো শত গল্প ঝুড়ি ভরে যেন উপচে পড়ছে, আমরা এই মাঝরাতে সমানতালে কথা বলেই যাচ্ছি ! বন্ধুরবাড়ি আমাদের পাশেরগাঁয়ে কাজেই ছেলেবেলার বন্ধুদের খোঁজখবরে তার কোঁচড় ভর্তি হয়ে আছে। রাত শেষ হয় কিন্তু আমাদের গল্পের ডালা মেলে আরও জোরেশোরে। গল্পে -গল্পে প্রসঙ্গের নড়চড়ে, আমার প্রিয় মানুষটির কথা চলে আসে। আমার ভালোলাগার বিষয়টি আমার এই বন্ধু জানত। বন্ধুর গাঁয়ে মানুষটার গ্রামেরবাড়ি এবং এরা পরস্পর লতায় পাতায় জড়ানো ধরনের আত্নীয়ও বটে। তার প্রসঙ্গ উঠতেই আমার বন্ধু ফোনের ওপাশে ডুকরে কেঁদে উঠে! এপ্রান্তে আমি বিস্মিত হয়ে তার কান্নার কারণ জানতে উন্মূখ হয়ে থাকি। একসময় বন্ধু নিজেকে সামলে নিয়ে জানায়-

গত তিন বছর আগে রোড এক্সিডেন্টে আমার ভালোবাসার মানুষটি মারা গেছেন !
0

গল্প - আর্যা ভট্টাচার্য

Posted in






পড়াশোনা তো কবেই শেষ। আজ প্রায় দু’বছর হলো কমলিকা সেবন্তীর সঙ্গে একই স্কুলে পড়াচ্ছে।

আহা, হলই বা মন্টেসারি স্কুল, কিন্তু একটা নামী স্কুল তো।

আর সেবন্তী হলই বা সায়েন্সের স্টুডেন্ট তা বলে লিটারেচার জানবে না?

মাত্র কালকেই বাড়ি ফেরার সময় গল্প করতে করতে কমলিকা জানতে পেরেছে যে, সেবন্তী ওয়াদারিং হাইটস পড়েনি!

কমলিকা আর সেবন্তী দুজনেই স্কুল থেকে ফেরার পথে মেট্রো ধরে।

কমলিকা রাসবিহারী তে নেমে বালিগঞ্জের অটো ধরে আর সেবন্তী তারপরে রবীন্দ্রসরোবরে নেমে যায়।

চারুমার্কেটের খুব কাছেই ওর বাড়ি। তাই বাকি রাস্তা টা হেঁটেই চলে যায়।

তবে এ সব কিছু তেমন ইম্পর্টেন্ট নয়। আসল ইম্পর্টেন্ট কথা হল সেবন্তী ওয়াদারিং হাইটস পড়েনি! ওহ্ মাই গড!!

সেবন্তীর সঙ্গে আজ মেট্রোয় বসে ফেরার সময়ে , স্কুল জীবনের হার্টথ্রব নিয়ে কথা হচ্ছিল।

কমলিকা তো ভীষণ উত্তেজিত টিত হয়ে জানিয়েছিল যে স্কুল জীবন থেকে আজ পর্যন্ত তার ওয়ান এন্ড ওনলি হার্টথ্রব হচ্ছে হিথক্লিফ।

আর তখনই একটা আশ্চর্য বোকা বোকা লস্ট মুখ করে সেবন্তী জিগ্গেস করেছিল, ‘ হিথক্লিফ কে রে ? তোর স্কুলের কোনো ছেলে? এংলোইন্ডিয়ান ?”

“মাআআআআনে? হিথক্লিফ আমার স্কুলের ছেলে ? !! তুই ওয়াদারিং হাইটস পড়িসনি ?”

বিস্ময় তখন কমলিকার চোখ দুটো দুটাকার রসগোল্লার মতো বড় বড় হয়ে প্রায় ঠিকরে বেরিয়ে আসে আরকি!

সেবন্তী হিথক্লিফকে চেনে না! ওয়াদারিং হাইটস পড়েনি! জাস্ট ভাবা যায়!

পৃথিবীতে এমন একজন মানুষ আজও আছে যে শিক্ষিত তার উপর কমলিকার বন্ধু অথচ হিথক্লিফের কথা জানেনা। এ যেন পৃথিবীর নবম আশ্চর্য !

আর এই খবর জানার পরে কমলিকা তো একবারে থ! কিছুক্ষণের জন্য তার মুখ থেকে পুরো বাক্যি হরে গেছিল। কোনো কথাই বলতে পারেনি।

বিস্ময়ের উপর বিস্ময়!

সেবন্তী যে শুধু ওয়াদারিং হাইটস পড়েনি তাই নয়, ক্লাসিকস প্রায় কিছুই পড়েনি।…কী কান্ড!

তা সে যাক গে; সে ওর যা ভালো লাগে করুক। তা বলে ওয়াদারিং হাইটস!

কমলিকার সব থেকে প্রিয় বই! সে যে কতো বার পড়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

প্রথম পড়েছিল যখন তখন ক্লাস সেভেন। তিনদিন ঘুমোতে পারেনি। লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছিল। উফফ! কী কষ্ট! কী কষ্ট!

সেই থেকে হিথক্লিফ তার ইটারনাল ক্রাশ।

আর তার প্রিয় বন্ধু সেবন্তী, হিথক্লিফের সঙ্গে তার পরিচয় হবেনা! এটা হতে পারেনা।

সেবন্তীকে কমলিকা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে ‘ শোন, কালকেই আমি বইটা তোকে এনে দেবো। একবার পড়ে দ্যাখ। পুরো পাগল হয়ে যাবি-

অনেক দিন বাদে আবার ওয়াদারিং হাইটস নিয়ে আমি গল্প করতে পারবো। আমার অন্য বন্ধুদের তো কবেই ওয়াদারিং হাইটস পড়া হয়ে গেছে,

এখন আর কেউ হিথক্লিফকে নিয়ে কথা বলতে উৎসাহী নয়।“

বলতে বলতে কমলিকার মুখটা কেমন যেন একটু মিইয়ে আসে।

পরমুহূর্তেই প্রবল উৎসাহে উজ্জ্বল চকচকে চোখে সেবন্তীর দিকে তাকিয়ে বলে, “কাল ই বইটা নিয়ে আসবো। ঠিক আছে?”

ওর এতো উত্তেজনা দেখে সেবন্তীও নেচে উঠেছিল। ‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ নিয়ে আসিস। বইটা শেষ করার পর দারুণ গল্প জমবে। ‘

সে না হয় হ'লো, কিন্তু বইটা গেল কোথায়?

বাড়ি ফিরে থেকে নিজের ঘরের সব জায়গা আতিঁপাঁতি করে দেখছে, তাও পাচ্ছেনা।

ঠিক সময় বুঝেই দরকারী জিনিসগুলো যে কোথায় যায়!

লেহ! এটা কী! ক্লাস সেভেনের ইংরেজি টেক্সট? এখানে কি করছে আজও?

একটু মজা পেয়ে, একটু অবাক হয়ে বইটার পাতা ওল্টাতেই, একটা চিরকূটের মতো হলদেটে হয়ে যাওয়া কাগজ তার পায়ের কাছে পড়লো।

খানিকটা কৌতুহল বশেই কাগজ টা হাতে তুলে নিল কমলিকা। এটা তো হিমাচল প্রদেশ ট্যুরিজমের হোটেলের একটা বিলের ছেঁড়া টুকরো!

আর তার পেছনে এটা কি লেখা ! একটা নাম্বার মনে হচ্ছে।

আরে! এটা তাকে দেওয়া সাংলার সেই বেয়ারার ফোন নাম্বার। তাই না?

কী যেন নাম ছিল?... হাঁ, রাজ। মা বলতো,’রাজ বেয়ারা ‘।… এতো দিন ধরে নম্বরটা রয়ে গেছে!

কী আশ্চর্য ব্যাপার!

অবশ্য ঠিক রাজের নয়, ওটা সাংলা ট্যুরিস্ট লজের নম্বর।

কাগজটার দিকে তাকিয়ে, নিমেষে কমলিকার মন ক্লাস সেভেনের সেই পুজোর ছুটিতে পৌঁছে গেল।

শিমলা থেকে কল্পা ঘুরে তারা সবে তখন সাংলায় পৌঁছেছে।

বাবা চেক ইনে গেছে, কমলিকা আর মা গাড়ি থেকে নেমে একটু হাত, পা ছড়াচ্ছে।

আর তখনই রাজবেয়ারার যেন ‘আবির্ভাব’।… হ্যাঁ, ঠিক তেমনই মনে হয়েছিল।

বেয়ারা হলে কী হবে? কী সুন্দর দেখতে!... এতো সুন্দর লোক কমলিকা এর আগে কখনো দেখেনি!

মায়ের সংগে সেও কিছু পুরনো হিন্দি সিনেমা দেখেছে, সেখানে একজন নায়ককে সে দেখেছে। নামটাও মনে আছে, উমম…শশীকাপুর। এই বেয়ারাটাও পুরো শশীকাপুর।

নাহ, তার থেকেও বেটার। কারন এই ‘রাজ বেয়ারা’র মধ্যে একটা অদ্ভুত রাগেডনেস আছে। যেটা শশীকাপুরের মধ্যে নেই।

সোনালী চুল ; নিক কার্টারের মতো মাঝখানে সিঁথি করে আঁচড়ানো, লম্বাটে মুখ আর কমলিকার থেকে কঅত্তটা লম্বা।

উঁহু শশীকাপুর নয়।… ঠিক যেন মাইকেল শ্যুমাখার!

তাছাড়া কী চমৎকার স্বভাব।… কী সুন্দর এটিকেট। এতো দিন সব বেয়ারারা তাকে বাচ্চি বলতো।

কিন্তু রাজ লাগেজ নেবার সময় তাকে বাচ্চি বলেনি। বলেছিল… ‘আইয়ে মেডাম’।

সে যে কী আনন্দ! সে কথা মনে পড়ে এখনো তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

সেই মুহূর্ত থেকেই, মানে চোখাচোখি হওয়া এবং মেডাম বলার পর থেকেই রাজবেয়ারার সংগে তার মনেমনে বেশ ভাব জমে উঠেছিল।

আর ওকে দেখামাত্রই কীভাবে যেন কমলিকার মনে ওর প্রতি হালকা একটা অনুরাগ অনুরাগ ভাবও জন্মে গেছিলো।

রাজ বেয়ারাও যে সেটা বুঝতে পারেনি তা নয়।

সেটা বুঝতে পেরেই তো প্রায় ফিদা।আর চোখাচোখি হলেই ব্লাশ করছিল।

সোলমেট কথাটা কমলিকা আগে বন্ধুদের মুখেই শুনেছিল।

আর ওয়াদারিং হাইটস পড়ার পর সে শিওর হয়েছিল যে হিথক্লিফই তার সোলমেট।

অন্য আর কেউ হতেই পারে না।

কিন্তু রাজ বেয়ারাকে দেখার মুহূর্ত থেকে কমলিকার পুরো জগৎ একেবারে পাল্টে গেছিল।যাকে বলে 'টপসি টারভি' হয়ে যাওয়া।

এই তো তার আসল হিথক্লিফ। তার সোলমেট। আর কোনোদিন কেউ তার সোলমেট হতেই পারবেনা ।

সাংলায় পৌঁছতে পৌঁছতে তাদের প্রায় বিকেল হয়ে গিয়েছিল। তবে তখনও প্রচুর দিনের আলো ।

তাই লাগেজ রেখে বাবা বলেছিল, “ সন্ধে হতে দেরি আছে। চলো, চারপাশটা দেখে আসা যাক”

একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে , মা বাবার সঙ্গে বেরোবার সময় কমলিকা দ্যাখে, একটা গাছের নিচে রাজ উবু হয়ে বসে তাদের ড্রাইভারের সঙ্গে গল্প করছে।

তাদের দেখে ড্রাইভার আর রাজ দুজনেই উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো ।

কেন কে জানে!

“ যত্তসব অদ্ভুত! আমরা কি টিচার যে উঠে দাঁড়াতে হবে? “ মনে মনে ভেবেছিল কমলিকা।

তারপর একটু পিছিয়ে গিয়ে রাজের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হেসেছিল। রাজ ও হেসেছিল। মা বাবা এমনকি ড্রাইভারেরও চোখ এড়িয়ে।

হিথক্লিফ নির্ঘাৎ ক্যাথারিনের দিকে তাকিয়ে সবার চোখ এড়িয়ে এ ভাবেই হাসতো। বুকের মধ্যে যেন কী একটা হচ্ছে;… জীবনে এই প্রথম বার!

রাস্তায় বেড়িয়ে কিছুটা হাঁটার পরে কিছুক্ষণের জন্য রাজের কথা তার মাথা থেকে বিলকুল বেরিয়ে গেছিল।

সাংলা জায়গাটা সত্যিই সুন্দর! চারপাশে পাহাড়। বরফ ও আছে। তবে এ সময়ে অল্প। নীচ দিয়ে কী সুন্দর নীল রঙের একটা নদী বয়ে চলেছে।

সাদা ফ্যানা তার সর্বাঙ্গে। সেই নদীর পাড়ে কয়েকটা তাঁবু। ইশ! ওখানে যদি থাকা যেতো!

ওহ, নো…তাহলে তো রাজের সংগে দ্যাখাই হতোনা। ভাগ্যিস ওখানে তারা থাকছেনা।

চারপাশটা দেখে, ঘুরে ফিরে, তাদের ফিরতে প্রায় সন্ধে সাতটা বেজে গেল।

এবং তখন তারা সকলেই বেজায় ক্লান্ত।

একটু টানা ঘুম খুব দরকার। কাল আবার সকাল সকাল বেরোনো আছে। মা তাই বলেছিল আর্লি ডিনার করে নেবে।

কিন্তু তখনই একটা মুশকিল হলো।

ওই হোটেলে ডিনারের জন্য কোন রুম সার্ভিস নেই। ডিনারটা ডাইনিং রুমে গিয়েই করতে হবে। সে রকম ই নিয়ম। রুম সারভিস হবেনা।

কিন্তু মা এতোটা জার্নি করে, তারপর পাহাড়ি রাস্তায় আপ এন্ড ডাউন করে খুব ক্লান্ত।তার উপর যা ঠান্ডা! মা হাত মুখ ধুয়ে তাই তাড়াতাড়ি এসে কম্বলের তলায় ঢুকে পড়েছে।

এমতাবস্থায় কম্বলের আরাম থেকে বেরিয়ে, ড্রেস আপ করে ডাইনিং রুমে যেতে মা নিতান্ত নারাজ।

এদিকে মা র রিকোয়েস্ট, অভিমান কিছুই বাবাকে নিয়ম ভেংগে রুম সার্ভিসের জন্য ম্যানেজারের হাতেপায়ে ধরাতে রাজী করাতে পারলো না ।

মা তখন ঘোষণা করে দিল, “নিকুচি করেছে। আজ রাতে আমি খাবোইনা।“

ঠিক সেই সময় , মা বাবার আদরের ‘পুটুস ‘অর্থাৎ কমলিকা ঘরের জানলা দিয়ে দেখে রাজ বাগান দিয়ে যাচ্ছে।

আর সময় নষ্ট না করে মাকে ‘ একটু বাগানে যাচ্ছি ‘ বলেই বাগানের দিকে দে ছুট।

পেছন থেকে মায়ের গলায়, “সাবধানে… এই মেয়ে…. নতুন জায়গা… ‘ আরও কী কী সব ভেসে আসতে লাগলো, কমলিকার ঠিক মতো কানেও গেলো না।

ছুটে বাগানে গিয়ে দেখে রাজ চলে যায়নি। বাগানে ওই ঠান্ডায় খালি গায়ে এক্সেরসাইজ করছে। উ: কী মাসেল!

হিথক্লিফ যখন কাঠ কাটতো , ওকেও নিশ্চয়ই এরকমই লাগতো।

কমলিকার চোখ যেন আর সরেইনা।

কমলিকাকে দেখে ব্যায়াম থামিয়ে রাজ হিন্দিতে, জিজ্ঞেস করলো ‘ কিছু লাগবে মেডাম?’

“রাজ! মায়ের শরীর টা ভালো নেই , আমাদের ডিনারটা আজ ঘরে দিতে পারবে?”-বলতে গিয়ে তো কমলিকা লজ্জায় লাল টাল হয়ে একশা;

নাহ কমলিকা একা নয়, আবছা আলোয় ঠাওর করে দেখলে বেশ বোঝা যায়, রাজের মুখে আর হাসিতেও লালিমার আভাস।

“জী মেমসাব। আমি ঘরে গিয়ে অর্ডার নিয়ে আসছি”

রাজ বেয়ারা যখন রুমের দিকে যেতে শুরু করেছে তখনই পেছন থেকে কমলিকা বলে ওঠে,

‘ আমাকে মেমসাব বলবেনা। আমার ডাক নাম পুটুস।আর ভালো নাম কমলিকা।

আমরা এখন বন্ধু। তুমি আমাকে নাম ধরে, পুটুস বলেই ডেকো।বাড়ির সবাই আর পাড়ার বন্ধুরাও তাই বলে।

এই যেমন আমি তোমাকে ডাকলাম।

‘রাজ’ বলেই তো ডাকলাম। তাইনা ?

তাহলে আমি তোমাকে রাজ বলব আর তুমি আমাকে বলবে 'পুটুস'। কেমন?”

মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে রাজ হনহন করে তাদের রুমের দিকে চলে গিয়েছিল।

আর বাগানে একা দাঁড়িয়ে তারাভরা আকাশের দিকে মুখ তুলে ‘ ইয়েএএএ’ বলে পুটুস চেঁচিয়ে উঠেছিল।

সে পেয়ে গেছে তার রিয়েল লাইফ হিথক্লিফকে।

পরের পুরোটা দিন তাদের ঘুরে বেড়াতেই কেটে গিয়েছিল। ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধে।

মা, বাবা ক্লান্ত হয়ে ফিরে যখন বিশ্রাম করছে তখন কমলিকা আস্তে আস্তে বাগানে এসে একটা গার্ডেন চেয়ার টেনে নিয়ে বসেছিল।

যদি রাজকে দেখা যায়। কিন্তু না। কোথাও রাজকে দেখা যাচ্ছেনা।

রাজকে দেখা গেল সেই রাত্রে। তাদের জন্য স্পেশালি রুম সার্ভিস দিয়ে যাবে বলে ডিনারের অর্ডার নিতে এসেছে।

আর এবার নিজে থেকেই। ডাকতেও হয়নি।

'পুটুস'কে ভালোবাসে বলেই না।

কমলিকার আনন্দে পুরো নেচে উঠতে ইচ্ছে করছিল।

কিন্তু মা বিয়িং মা, তখনই জিজ্ঞেস করে বসলো, “ তোমার এতো অল্প বয়স, পড়াশোনা করো না? “

মা র এই স্বভাবটা খুব খারাপ। স্কুলে টিচার আছো থাকোনা। তা না, সারা বিশ্বের ছেলে মেয়েদের শিক্ষিত করার যেন ব্রত নিয়েছে।

বাড়িতে পড়িয়ে পড়িয়ে আর জ্ঞান দিয়ে দিয়ে কমলিকার লাইফ হেল করছে, আর এখন রাজকে ধরেছে।

উত্তরে অবশ্য রাজ খুব পোলাইট ভাবেই জানিয়েছিলো, সে টেন অবধি পড়েছে কিন্তু তারপর ওর বাবা অসুস্থ হয়ে পরায় ওকেই কাজ করতে হচ্ছে।

বাড়িতে মা, বাবা, ভাই বোন আছে, দাদু আছে, কাজ না করলে সকলে খাবে কি?

“ তা হলেও, প্রাইভেটে পড়াশুনো চালিয়ে যাও।“ মায়ের নাছোড়বান্দা জ্ঞানদান।

“ জী মেমসাব, কোশিশ করেংগে”বলে লাজুক ভাবে কমলিকার দিকে একটা চোরা চাহনি দিয়ে রাজ ডিনার আনতে চলে গেছিল।

মা তাও এ বিষয় ছাড়বেনা।

এবার বাবার দিকে তাকিয়ে ভাষন, “ কতোই বা বয়স ছেলেটার বলো? বছর আঠেরো উনিশ ম্যাক্সিমাম।

এই বয়সে পড়াশুনো করলে তবেই না ভালো কিছু করতে পারবে।

এদের দ্যাখো, কোনো উচ্চাশাই নেই। আশ্চর্য! “

বাবা যথারীতি নির্বাক।

কিন্তু মা র জন্য কমলিকার তো নাক কাটা গেল!

কিন্তু মা সে কথা বুঝলে তো।

কিন্তু না, সেখানেই শেষ নয়।

পুটুসকে ভালোবেসে রাজ নিয়ম ভেংগে রুমে ডিনার দিয়ে গেল, আর বাবা কি করলো?

ওকে মাত্র পঞ্চাশটা টাকা টিপস দিলো!!

মাত্র পঞ্চাশ!

আরে বাবা এটা পুটুসের প্রেস্টিজের প্রশ্ন। দিলে যদি, অন্তত পাঁচশো… না পাঁচশো না… এক হাজার টাকা দাও। ছি:।

আর রাজকে দ্যাখো, কতো সভ্য! ‘থ্যানকু’ বলে চুপচাপ টাকাটা নিয়ে চলে গেল।

‘ শেখো, ওর কাছ থেকে কিছু শেখো’ মনে মনে বলতে লাগলো পুটুস।

কমলিকার মনে আছে সেদিন রাতে উত্তেজনায় প্রায় ঘুম ই হয়নি তার।

পরদিন ভোর হতেই ঘর থেকে বেড়িয়ে বারান্দায় চেয়ারে গিয়ে বসেছিলো ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে। রাজকে দেখবে বলে।

হ্যাঁ, ওই তো রাজ। বেড টি নিয়ে একটা রুমের দিকে গেল।

কমলিকাও তাড়াতাড়ি সোয়েটারের উপর চাদর ভালো ভাবে জড়িয়ে নিয়ে বাগানে নেমে দাঁড়ালো।

“ কিছু লাগবে? “

গলা শুনে কমলিকা দ্যাখে রাজ কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।

“ চা দেব? “

বাড়িতে কমলিকা চা পায়না। সকালে দুধ বরাদ্দ।

“ পুটুস! চুপচাপ দুধটা খেয়ে নাও”…মায়ের হেঁড়ে গলা কমলিকার কানে যেন বেজে উঠলো।… এখানেও।

কিন্তু এখানে তো আর মা দাঁড়িয়ে নেই, তাই রাজের সামনে বড়োদের মতো মুখ করে বললো, “ হ্যাঁ, খাবো।

তুমিও তোমার চা আনো। এসো, দুজনে বাগানে এক সাথে বসে চা খাই”।

মনে মনে ভাবে ঠিক সিনেমার মতন।

“ না, মেডা..”

“ পুটুস… পুটুস বলো”

“ হাঁ, ওহী..কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে বসে চা খেতে পারবোনা। গেস্টের সঙ্গে বসে চা খাবার পারমিশন নেই আমাদের”

“ তাহলে থাক। আমিও খবোনা” উদাস হয়ে বলেছিল পুটুস।…

সেদিন ছিল তাদের ছিটকুল যাবার প্ল্যান।

শেষ দুপুরে ছিটকুল থেকে ফেরার পরে পুটুস তাল ধরেছিল আপেল বাগান দেখবে। বাগানের ভেতরে গিয়ে।

কিন্তু মা, বাবা তখন এক পাও হাঁটতে নারাজ।

সুযোগ বুঝে পুটুস নিরীহ মুখ করে বলেছিল, “ রাজ আমাকে নিয়ে যাবে কিনা জিজ্ঞেস করব মা?”

তার মনে অবশ্য তখন আশা আশংকার লাড্ডু ফুটছে।

‘হে ভগবান! মা যেন রাজি হয়ে যায়। আর রাজ ও।‘ রাজ তাকে আশেপাশের আপেল বাগান দেখাতে নিয়ে গেলে কী মজাটাই না হবে!

মা অবশ্য একটু আপত্তি করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু বাবা তার দলে ছিল সব সময়ের মতোই।

তখনও মাকে চুপ করিয়ে দিয়ে বলেছিল, “ আহা যাকনা। এই তো বয়েস। ঘুরবে, ফিরবে, প্রকৃতিকে একটু চিনবে…আর এখানকার স্টাফ খুবই রিলায়েবল।

তুমি নিশ্চিন্তে বিশ্রাম করো। আমিও একটু গড়িয়ে নিই… আর পুটুস বেশি দূরে যাসনা যেন।‘

বাবা নিজেই রিসেপশনে ফোন করে রাজকে ডেকে পাঠিয়েছিল।

রাজ রুমে এলে বাবা রাজকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘ তোমার কি এখন এখানে কোনো কাজ আছে রাজ? না থাকলে ওকে কাছাকাছির কিছু আপেল বাগান দেখিয়ে আনতে পারবে?

বেশী দূরে যেওনা যেন । ঠিক আছে? “

রাজ ও বাধ্য ছেলের মতো মাথা নেড়ে কমলিকার পেছন পেছন বেড়িয়ে এসেছিলো।

আপেল বাগান দ্যাখা, যাতায়াতের পথে রাজের সংগে গল্প করা.…কী যে ভালো কেটেছিল সেই সময়টা!

রাজ গাছ থেকে আপেল পেড়ে কমলিকাকে একটা দিয়েছিল, নিজেও একটা নিয়েছিলো। কী মিষ্টি ছিল যে সেই আপেল!

আর একটা উপরি পাওনা হয়েছিল কমলিকার। কামরু ফোর্ট দেখা।

হোটেলে ফিরে তাদের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কমলিকা জিজ্ঞেস করেছিল, “ তুমি কলকাতায় যাওনা? গেলে দেখা হতো। “

মাথা নেড়ে না বলেছিল রাজ।

“ তোমরা কি কাল সকালে চেক আউট করবে?” দু:খী দু:খী মুখে 'পুটুসে'র চোখের দিকে কেমন একটা করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল রাজ।

“ হ্যাঁ। তোমার ফোন আছে? তাহলে নাম্বারটা দাও। কলকাতা গিয়ে ফোন করবো।“ তখন কমলিকা প্রায় কাঁদো কাঁদো।

“ নেহি পুটুস। আমার বাড়িতে ফোন নেই। “ আর ঠিক সেই সময় হোটেলের ম্যানেজার না কে যেন ডাইনিং রুম থেকে রাজকে চেঁচিয়ে ডেকেছিল।

‘আমি যাই। কাল চলে যাবার আগে রিসেপশনে গিয়ে একবার দেখা কোরো’ বলেই রাজ দৌড়ে চলে গেছিল।

আর কমলিকাও চোখের জল মুছতে মুছতে ঘরে ফিরে এসেছিল।

তখনও মা বাবা ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে।

পরদিন বেলা এগারোটা নাগাদ মা বাবা যখন লাগেজ নিয়ে ব্যস্ত, সেই ফাঁকে কমলিকা একবার টুক করে রিসেপশনে চলে গিয়েছিল।

আর রাজ এসে সাংলা ট্যুরিস্ট লজের একটা ছেঁড়া পাতায় এই ফোন নম্বরটা লিখে দিয়ে বলেছিল,

“ এটা ট্যুরিস্ট লজের নম্বর। তুমি এখানে ফোন কোরো পুটুস। এরা আমাকে ডেকে দেবে। আমি বলে রাখবো “

আর তখনই মা র বাজখাঁই চিৎকার শোনা গেল, “ পুটুস, পুটুস… এই মেয়েটাকে নিয়ে আর…”

দেন এন্ড দেয়ার 'পুটুস' দে ছুট।

ছুটতে ছুটতেই শিমলা থেকে কেনা তার নবলব্ধ ব্যাগের ভিতরে তাড়াতাড়ি কাগজখানা ভরে নিয়ে ছিল।

রাজের কথা স্কুলে সে তার বেস্ট ফ্রেন্ড শ্বেতা ছাড়া আর কাউকে বলেনি।

শ্বেতার সঙ্গেই স্কুল থেকে ফেরার পথে সে একদিন নয়, দুদিন নয়, গুনে গুনে তিনদিন স্কুলের কাছের পাবলিক টেলিফোন বুথ থেকে রাজের সেই ফোন নাম্বারে ফোন করেছিল।

কিন্তু প্রত্যেক বার সেই এক উত্তর –‘ দিস নাম্বার ডাস নট এক্সিস্ট…এই নম্বরটির অস্তিত্ব নেই ‘

রাজ তার সঙ্গে এ রকম করতে পারলো! মিথ্যে নম্বর দিলো! ট্রেইটার..কতো রাত যে সে এই ভেবে কমলিকা কেঁদে কাটিয়েছে!

তারপর বন্ধুবান্ধব, পড়াশুনোর চাপ, নতুন ক্রাশ- কখন যেন রাজের কথা সে ভুলেও গেল।

আজ এতোদিন পরে আবার সাংলা ট্যুরিস্ট লজের ছেঁড়া কাগজে লেখা নম্বরটা তার হাতে উঠে এলো! কী যেন ছিল নাম্বারটা? দেখিতো…

ভালো করে ফোন নাম্বারটা দেখে হো হো করে হেসে ওঠে কমলিকা।

আররে, ফোন হবে কি করে! শুধু তো নাম্বার। এস টি ডি কোডটা তো দেওয়াই নেই। লাইন পাবে কি ভাবে!

হাসতে হাসতেই কাগজের টুকরোটাকে পাকিয়ে মাটিতে ফেলে দিলো কমলিকা। এখনই কাজের মাসি আসবে ঝাঁট দিতে।

আবার কী মনে করে কাগজটা মাটি থেকে তুলে, হাত দিয়ে চেপে চেপে টানটান করে, তারপর সুন্দর করে ভাঁজ করে, শিমলায় কেনা সেই ব্যাগটা,

যার মধ্যে তার ছোটবেলার প্রেশাস পুতুল, কার্ড সব ভরে রেখেছে, সেখানেই রাজের হাতে সাংলা ট্যুরিস্ট লজের নাম্বার লেখা কাগজটাকেও রেখে দিলো কমলিকা।