0
undefined undefined undefined

সম্পাদকীয়

Posted in







এই সম্পাদকীয় লেখার সময় আমরা এক অভূতপূর্ব সময়ের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এদেশ এমন একটি ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে, যা চিরতরে বদলে দিতে পারে প্রাচীন এক সংস্কৃতির ভবিষ্যত গতিপথ। নানান সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে বিশ্ববাসী বারবার ভারত নামক বহুধাবিভক্ত আশ্চর্য এক দেশকে দৃষ্টান্ত হিসাবে দেখতে চেয়েছে। অতি শীঘ্র আমরা বুঝতে পারব, সেই চিত্রটির আমূল পরিবর্তন হয়ে গেল কিনা।

যে ঘটনাটির সম্ভাব্য অভিঘাত ঘিরে এত কথা অথবা বলা ভালো কল্পনা আর আবেগ ঢেলে এক মহাকবি একদিন যে চরিত্রটি নির্মাণ করেছিলেন, তিনি তো ভালোবাসার নায়ক হয়ে এক বিপুল জনজাতির অন্তঃপুরে বসবাস করে আসছিলেন। শতাব্দীপ্রাচীন এক সৌধের বিনিময়ে নির্মিত এক বাসস্থানে তাঁর পুনঃপ্রতিষ্ঠার কোনও আবশ্যকতা ছিল কি?

চারপাশের অসংখ্য অনৈতিক কার্যকলাপ সহ্য করতে করতে অবশ্য এই আয়োজনটিকে আর বিচ্ছিন্ন বলে মনে হয় না। কারণ ভালো-মন্দের মধ্যে যে লক্ষণরেখাটি বিরাজ করত, তা ঘুচে গেছে অনেক আগেই। মূল্যবোধ নামক যে বস্তুটি কোনও একদিন আমাদের মধ্যে অবস্থান করত, তার কংকালসার দেহটি বড়জোর এখনও বহন করে চলেছি আমরা।

এরই মধ্যে আমাদের বার্ষিক বই-পার্বণ শুরু হয়ে গেছে। বিগত বছরগুলির তুলনায় এর কলেবর বৃদ্ধিও পেয়েছে অনেক। সত্যিই তো বইয়ের ক্ষমতা যে সীমাহীন। নিরক্ষরকে আক্ষরিক করা ছাড়াও সে যে পারে মনের বন্ধ জানালাগুলির আগল খুলে দিতে!

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান।

0 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






জীবন থেকে হারিয়ে যায় অনেক কিছুই l কালের নিয়মে l তবুও কখনো কখনো মনে হয় কিছু কিছু ঐতিহ্য ধরে রাখার দায় আমাদের ও ছিল l বাঙালী সত্যিই আত্মঘাতী l নাহলে কলকাতার অন্যতম গর্ব পেশাদার রঙ্গমঞ্চ গুলো এভাবে শেষ হয়ে যায় ! গ্রে স্ট্রীট আর কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটের সংযোগে দাঁড়িয়ে থাকা স্টার থিয়েটার l পঞ্চাশের দশক থেকে স্টারের খ্যাতি আকাশ ছুঁতে থাকে l সেই সময়ে স্টারের সত্বাধিকারী সলিল কুমার মিত্র স্টার কে ঢেলে সাজান l প্রথম ঘূর্ণায়মান মঞ্চ তৈরি হয় l উত্তম কুমার সারা জীবনে একটি মাত্র কমার্শিয়াল নাটক করেছিলেন l সেটি হলো শ্যামলী l মূক এক তরুণীর ভূমিকায় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় l নাটকটি ১৯৫৩ সালের ১৫ই অক্টোবর মুক্তি পায় ও প্রথম দফায় ৪৮৪টি অভিনয় হয় ১৯৫৫ সালের ১৩ই নভেম্বর পর্যন্ত l শ্যামলী থেকেই পেশাদার রঙ্গমঞ্চে বৃহস্পতি শনি রবি ও ছুটির দিন শোয়ের চল শুরু হয় l এই প্রথা পাবলিক থিয়েটারের অবলুপ্তি পর্যন্ত বহাল ছিল l শ্যামলী থেকে যে খ্যাতি ও অর্থপ্রাপ্তি ঘটে তাইতে উত্সাহিত হয়ে সলিল মিত্র আবার স্টারের সংস্কার শুরু করেন l প্রথম শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত প্রেক্ষাগৃহ স্টার l সেই সময়ে এই সংস্কারের জন্যে পাঁচ লক্ষ টাকা ব্যয় হয়েছিল l কতদুর ভালবাসা থাকলে এ সম্ভব হয় তা দৈনিক বসুমতীতে উচ্ছসিত ভাষায় প্রকাশ পেয়েছিল l এ হেন স্টার থিয়েটার নানা মঞ্চসফল প্রযোজনার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে পরবর্তী দশকে l নীহার রঞ্জন গুপ্তের কাহিনী অবলম্বনে তাপসী নাটক মঞ্চস্থ হয় ১৯৬৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি l এই নাটকে নায়ক দীপকের ভূমিকায় ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় l অত্যন্ত সফল হয় এই নাটক ও l কত পরে ১৯৭৯\৮০ নাগাদ কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে সৌমিত্র নিজের পরিচালনায় করেন নামজীবন l ততদিনে তাঁর চিন্তা ভাবনায় মহান পরিচালক সত্যজিত রায়ের ছাপ সুস্পষ্ট l নাটকের ডিটেলিং দেখলে মনে হতে বাধ্য l অদ্ভুত ভাবে সেসময়ে কারো মনে হয়নি যে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে সস্তা হালকা শিল্প রচিত হয় l তৃপ্তি মিত্র প্রথম নায়িকার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন সেতু নাটকে l বিশ্বরূপা তে l গ্রুপ থিয়েটারের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুখ হয়েছিলেন তিনি l সেতু তেও তাঁর অভিনয় অসামান্য l সেতু বিশ্বরূপায় আর অঙ্গার মিনার্ভায l এই দুটি নাটকে আলোকসম্পাতে ছিলেন তাপস সেন l কী অসাধারণ সাধনা ছিল যে তাঁর l

স্টার থিয়েটারের গৌরবের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে l ১৮৮৮ সালের ২৫শে মে নসীরাম নাটক দিয়ে স্টারের যাত্রা শুরু l স্বয়ং গিরিশচন্দ্র এই নাটকটি নসীরাম ছদ্মনামে রচনা করেন l প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই স্টারেই স্বামী বিবেকানন্দ ভগিনী নিবেদিতাকে একটি অনুষ্ঠানে পরিচয় করিয়ে দেন সুধী সমাজে l সাধারণ রন্গালযের প্রতিষ্ঠা কাল ১৮৭২ l তার মাত্র ষোল বছরের মাথায় স্টার শুরু করে তার জীবন l প্রথম থেকেই স্টারের ভাগ্যে বৃহস্পতি l ১৯৩৮ সাল থেকে প্রায় তেত্রিশ বছর এই রঙ্গমঞ্চের দায়িত্বে ছিলেন সলিল কুমার মিত্র l এই সুদীর্ঘ তেত্রিশ বছরে স্টারে কত যে নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে তা বলার নয় l এইসব নাটকের কুশীলবরা জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছিলেন l সলিল কুমার মিত্র প্রথম কর্মীদের জন্যে প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু করেন l স্টারের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে থিয়েটারের প্রতি অকুণ্ঠ দরদ নিয়ে পরিচালক, কতৃপক্ষ, শিল্পী ও কলাকুশলীরা সফল ও শিল্প গরিমায় উজ্জ্বল নাটক একাদিক্রমে উপহার দিয়ে গেছেন l তাই বড় রকমের বিপর্যয় স্টারের ভাগ্যে জোটেনি l কিন্তু হঠাতই সলিল মিত্র স্টারের দায়িত্ব রঞ্জিত পিকচার্স এর হাতে তুলে দেন l কারণ সম্পূর্ণ অজ্ঞাত l দিনটা ছিল ১৯৭১ খ্রীষ্টাব্দের ৩১শে মার্চ l রঞ্জিতমল কাংকারিযা হন নতুন মালিক l বলা যায় স্টারের সৌভাগ্য লক্ষ্মী সেদিনই বিদায়ের লগ্ন স্থির করে ফেলেন l ধীরে ধীরে মানের অবনতি ঘটতে থাকে l নাট্যকার দেবনারায়ন গুপ্তের শেষ নাটক জনপদবধু অভিনীত হয় ১৯৭৩ সালের ২০শে সেপ্টেম্বর। পারিবারিক উপভোগ্য কাহিনীর নাট্যকার হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন তিনি। ১৯৭৪ থেকে রঞ্জিতমল নিজেই সব দায়িত্ব নিয়ে ভাড়া করা লোক দিয়ে নিজের নামে নাটক রচনা, নির্দেশনার সব কাজ করাতেন। ১৯৮০ থেকে নাটকের মানের অবনতি ঘটতে থাকে। ১৯৮৭তে টগরী নাটক দিয়ে রঞ্জিতমলের অধ্যায় শেষ হয়। ১৯৯১তে যখন স্টারে আগুন লাগে তখন স্টার ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি ওখানে ঘটক বিদায় নাটক করছিলেন। ১৯৭৪, ওই সময়ে মাত্র দশ কি এগারো হব, দেখেছিলাম পরিচয় বলে একটি নাটক l শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় ও শমিতা বিশ্বাস ছিলেন মুখ্য ভূমিকায় l অভিনয় ভালো হলেও বড়দের মুখে শুনেছি নাটক রসোত্তীর্ণ হয়নি l বিশেষ সেই সময়ে উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটার, অজিতেশ বন্দোপাধ্যায়ের নান্দীকার একের পর এক মননশীল নাটক মঞ্চস্থ করে চলেছে l তখনও নাটক দেখার অনুমতি জোটেনি l তবু রবিবার বা ছুটির দিনে সকালে স্টারে অফিস রিক্রিয়েশন ক্লাবের নাটক বৈকুন্ঠের উইল দেখেছিলাম l সরযু দেবী ছিলেন নাটকে l তিনি নাট্যজনের এতই শ্রদ্ধার পাত্রী ছিলেন যে শিল্পীরা তাঁকে সরযু মা বলে ডাকতেন l আমাদের খেলাধুলার জন্যে কাছাকাছি গোয়াবাগান পার্ক ছাড়া মাঠ ছিলনা l নানারকম নেশাভাঙ জনিত দুষ্কর্ম চলত বলে সেখানে যাওয়া মানা l ফলে স্টারের পেছনে স্টার লেন, রাজাবাগান, ক্ষুদিরাম বোস রোড এইসব এলাকায় ছোটাছুটি করে খেলতাম l বড় রাস্তায় যেতাম না l তবুও থিয়েটার আরম্ভ আর ভাঙার সময় স্টারের আশেপাশে যাওয়া বারণ ছিল l ভিড়ে হারিয়ে যেতে পারি এমন আশঙ্কা ছিল হয়ত l স্টারের গায়ে গ্রে স্ট্রীট ঘেঁষে একটা আতর আর জর্দার দোকান ছিল l ছেলেবেলায় সেইটি ছিল প্রবল আকর্ষণ l দোকানের সামনে ফুটপাতে দাঁড়ালে সুবাসে মাথা ঝিমঝিম করত l একটা বিষয় লক্ষণীয় যে স্টারে কখনই ক্যাবারে গার্ল দিয়ে তথাকথিত বস্ত্রবিপ্লব ঘটিয়ে বাজার ধরার চেষ্টা হয়নি। মানের অবনতি সত্বেও সুস্থ রুচির নাটক উপস্থাপনার চেষ্টা হত।



এখানে একটু বলা প্রয়োজন যে সে সময়ে কিভাবে এইসব থিয়েটার গুলো চালানো হত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হলমালিকের থেকে লিজে বা ভাড়ায় কেউ হল নিয়ে পরিচালনার দায়িত্বে থাকতেন। তিনিই থিয়েটার কোম্পানির কর্ণধার। থিয়েটারে অভিনেতা অভিনেত্রীরা বাঁধা মাইনেতে কাজ করতেন। বহু সময়ে কর্ণধার নাটক পরিচালনার দায়িত্বেও থাকতেন। নাট্যকারকে শো পিছু রয়্যালটি দেওয়া হত। কোনও কোনও সময়ে নাট্যকারকে মাইনে দিয়ে রাখার ঘটনাও ঘটেছে। পরিচালক তাই নানাপ্রকারে সফল ও জনমোহিনী নাটক মঞ্চস্থ করতে চেষ্টা করতেন। বিভিন্ন সময়ে দেখা যায় যে কুশীলবদের জমকালো পোশাক, অনর্থক নাচ গান, বা মঞ্চে মায়াজাল, ইংরেজিতে যাকে বলে ইল্যুশন, সৃষ্টি করে দর্শকের চিত্তজয়ের চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এসব সমালোচিত হয়েছে বারবার। কারণ এসবই মূল নাটক ও অভিনয় থেকে দর্শকমনের একাগ্রতা হরন করে। উদাহরনে বলা চলে অঙ্গার নাটকের শেষ দৃশ্যটি। দৃশ্যটি বড়ই ট্র্যাজিক। কয়লাখনির খাদের মধ্যে কয়েকজন কর্মী আটকে পড়েছে। এদিকে হু হু করে জল বাড়ছে খাদে। অবশেষে এই জলের মধ্যে ডুবে তাদের মৃত্যু হোল। দৃশ্যটি তাপস সেন অদ্ভুত নৈপুণ্যে নির্মাণ করেন। মঞ্চের ভেতর খাদের জল বাড়ার দৃশ্য এত অপূর্ব হয়েছিল যে হল হাততালিতে ফেটে পড়ত। মাঝ থেকে যে মর্মান্তিক দৃশ্যে মানুষ মরছে সেই ট্র্যাজেডি কেউ অনুভব করতনা। সব ছাপিয়ে তাপস সেনের আলোর কারসাজি মুগ্ধ করত দর্শককে। বলা ভালো স্বয়ং নাট্যাচার্য শিশির কুমার মঞ্চে ইল্যুশনের পক্ষপাতী ছিলেন না। সুতরাং আধুনিক নাটকের আঙ্গিক ও প্রয়োগ নিয়ে যত কথাই হোক না কেন এসবে পেশাদার রঙ্গমঞ্চের ভুমিকা যে অনস্বীকার্য তা স্বীকার করে নেওয়াই ভালো। এই যে থিয়েটার, এর দর্শক কারা ছিলেন, জানলে এখনকার প্রযোজকরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন। এখন যখন হলে দর্শক টানার হাজার চেষ্টা করেও হাউসফুল বোর্ড ঝোলানো প্রায় মিথ তখন থিয়েটার পাড়ায় দিনের পর দিন হলগুলোতে হাউসফুল বোর্ড ঝুলত। অগ্রিম কাউন্টারেই টিকিট নিঃশেষ হয়ে যেত। শুধু যে কলকাতার লোকজন বা কাছাকাছি মফস্বলের লোক আসত নাটক দেখতে তা মোটেই নয়। অনেক দূর থেকেও মানুষ আসত নাটক দেখতে। পুজোর কেনাকাটার সঙ্গে নাটক দেখা অবিচ্ছেদ্য ছিল। নিজের পরিবারেও দেখেছি বার্ষিক ছুটিতে আসা দূরাগত আত্মীয় স্বজন ভ্রমণসুচীতে নাটক দেখা ও রেখেছেন। নামী শিল্পী, অনবদ্য অভিনয়, অপূর্ব আলোক সম্পাত, নাটকের আবেদন ইত্যাদি ইত্যাদি খবরের কাগজ বাহিত হয়ে শুধু মফস্বল নয়, দূর প্রবাসেও ছড়িয়ে পড়ত। ফলশ্রুতি এই বিপুল দর্শক সমাগম। একেবারে শুরুর দিকে সম্পন্ন গ্রামীন ভদ্রলোকেরাও আসতেন। হোটেলে থেকে থিয়েটার আর কালীঘাট ঘুরে যেতেন। ক্রমশ গণ্ডী সংকুচিত হতে থাকে। অবশ্য সত্তরের দশক পর্যন্ত এই ঢল অব্যাহত ছিল। তবে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে বিপুল মুনাফার চিত্র কখনই ধরা পড়েনি। অনেক আগে দর্শক টানতে নাটক নামান হত পৌরাণিক কাহিনী অবলম্বনে। যাতে তার জাঁকজমকে মানুষ আকৃষ্ট হয়। হতও হয়ত। তবে নাটক নামাতে যে পরিমাণ ব্যয় হত, সেট পোশাক ইত্যাদি জনিত, তার খুব স্বল্প অংশই উঠে আসত। মাঝে কিছু ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু তা কখনই সামগ্রিক চিত্র নয়। স্টারের পর আলোচনায় রাখলাম মিনার্ভাকে। যদিও এই অতীতচারিতা বিভিন্ন দিকে ছুটে যাচ্ছে বারবার, কিন্তু তা খানিকটা স্বেচ্ছাকৃত। সামগ্রিক ছবি ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস মাত্র। ১৮৯৩ সালে ৬নং বিডন স্ট্রীটের গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রেক্ষাগৃহ নিশ্চিন্হ হয়ে গেলে প্রসন্ন কুমার ঠাকুরের দৌহিত্র নগেন্দ্রভূষণ মুখোপাধ্যায় ওই জমির ওপর মিনার্ভা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। ২৮শে জানুয়ারী সেকশপীয়ারের ম্যাকবেথের মঞ্চরুপ নিয়ে গিরিশচন্দ্র মিনার্ভার দ্বারোদঘাটন করেন। এরপর ৫ই ফেব্রুয়ারী মুকুল মঞ্জুরা, ২৫শে মার্চ আবু হসেন, ও ২৩শে ডিসেম্বর জনা, প্রভৃতি বিখ্যাত নাটকগুলি অভিনীত হয়। এরপর ১৮৯৫ সালের গিরিশচন্দ্র আবার (আগে স্টারে অভিনীত) প্রফুল্ল নাটকটি নঞ্চস্থ করেন। নাটকে তিনি যোগেশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁর অভিনয় এতই অনবদ্য হয়েছিল যে নট-নাট্যকার অপরেশচন্দ্র তাঁর রঙ্গালয়ে ত্রিশ বছর বইতে লিখেছেন, - গিরিশের যোগেশের পাশে অমৃতলালের (স্টারে অমৃতলাল যোগেশ সাজতেন) যোগেশ হীনপ্রভ হইয়া পড়িল। মনে হইল একজন যথার্থ যোগেশ, আর একজন যোগেশ সাজিয়াছেন। এরপরই ১৮৯৬ সালের ২৩শে মার্চ গিরিশ মিনার্ভার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছেদ করেন। এই সময়ে অর্ধেন্দুশেখর মিনার্ভার দায়িত্ব নেন। এরপর গিরিশচন্দ্র আবার এক বছরের জন্য মিনার্ভায় ফেরেন। মিনার্ভার ইতিহাস বড়ই উথাল পাথাল। অনেকগুলি নাটক কিন্তু এই অস্থির সময়ের মধ্যেও অভিনীত হয়। ১৯০৪ সালে অমরেন্দ্রনাথ দত্ত মিনার্ভার দায়িত্ব দেন বন্ধু চুনীলাল দেবকে। এরপর মিনার্ভার লিজ হস্তান্তরিত হয় মনোমোহন গোস্বামীর হাতে। এত কিছুর মাঝেই মিনার্ভায় গিরিশচন্দ্রের বলিদান ও সিরাজউদৌলা, দ্বিজেন্দ্রলালের রাণা প্রতাপ সিংহ নাটক মঞ্চস্থ হয়। অথচ দেখতে পাচ্ছি যে এর মাঝে হাইকোর্ট নিযুক্ত মিনার্ভার রিসিভার শেলী ব্যানার্জি মিনার্ভা নিলামে দিলেন। গিরিশচন্দ্রের বুদ্ধিতে মনোমোহনবাবু ষাট হাজার টাকায় থিয়েটারটি কিনে নেন। এরপর নানা মালিকানা, অংশীদারি পরিচালনার চক্রে পড়ে অবশেষে ১৯২২ সালে মিনার্ভা আরও একবার ভীষণ আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যায়। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে এভাবে পুড়ে যাওয়া কোনও নতুন ট্রেন্ড নয়। আজ যখন স্টার রংমহল, বিশ্বরুপা আগুনে পুড়ে তাদের অস্তিত্বকে বিলীন করে দিচ্ছে তখন আমাদের মতন কিছু স্পর্শকাতর, অতীতবিলাসী বাঙালি ভাবছি এ কী হোল! এমন করে অস্তিত্বের বিলুপ্তি! আরও কিছু বছর পরে তো সমসাময়িক প্রজন্ম জানতেই পারবেনা যে পেশাদার রঙ্গমঞ্চ বলে কিছু ছিল আর বেশ কিছু মানুষ সেই সব রঙ্গমঞ্চে কী অদ্ভুত ভালবাসায় দারিদ্র ভুলে, অপমান ভুলে দিনের পর দিন ইতিহাস সৃষ্টি করে গেছেন। নাটকের ইতিহাস। শুধু মনে হয় আর একটু সচেতনতা দরকার ছিল বোধ হয়। যাই হোক তবু মিনার্ভা চলতে থাকে। ১৯৫১ সালেও দেখতে পাই শরৎচন্দ্রের চন্দ্রনাথ অভিনীত হয়। এই নাটকের প্রধান তিনটি ভূমিকায় অহীন্দ্র চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস ও সরযূ দেবী অভিনয় করেন। ১৯৫৩ সালে মিনার্ভার দুঃসময়ে রাসবিহারী সরকার এসে দাঁড়ান মিনার্ভার পাশে। থিয়েটার হলটি ভাড়া নিয়ে মঞ্চস্থ করেন ঝিন্দের বন্দী। নাটকটি অসাধারণ জনপ্রিয় হয়। অনেকেই মনে করেন এই নাটক নাটকের ইতিহাসে একটি মাইলস্টোন। পঞ্চাশের দশকে বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠীও এখানে নাটক করেছেন। রক্তকরবী মঞ্চস্থ হয়। তবে ব্যবসায়িক থিয়েটারের সঙ্গে পাল্লা না দিতে পেরে ছেড়ে দিতে হয় এই মঞ্চ। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত উৎপল দত্তের লিটল থিয়েটার মিনার্ভাতে নাটক করে। শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে, উৎপল দত্তের অধিনায়কত্বে লিটল থিয়েটার মিনার্ভায় নিয়মিত অভিনয় শুরু করে। ১৯৫৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর প্রথম অভিনীত হয় অঙ্গার। পণ্ডিত রবিশঙ্কর সুর সংযোজনায়। আর তাপস সেনের সেই ঐন্দ্রজালিক আলোকসম্পাত। অত্যন্ত জনপ্রিয়তার সঙ্গে অঙ্গার দু বছর ধরে চলে। এরপর আসে ফেরারী ফৌজ। এতেও তাপস সেন স্বীয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। বলা যেতে পারে লিটল থিয়েটারের আগমনে মিনার্ভা আবার প্রাণ ফিরে পায়। উৎপল দত্ত পরপর অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম, সেকস্পীয়ারের চারশ বছরের জন্মোৎসব উপলক্ষে A Midsummer Night’s Dream অবলম্বনে চৈতালি রাতের স্বপ্ন, ওথেলো, জুলিয়াস সীজার, প্রভৃতি নাটক উপহার দিতে থাকেন। অবশেষে জাহাজের নাবিক বিদ্রোহের পটভূমিকায় কল্লোল মঞ্চস্থ হয়। নাটকের নির্মাণেও বিপ্লব ঘটে যায়। এখানে বরং উৎপল দত্ত সম্বন্ধে দু চার কথা বলে নেওয়া যাক। কী বলেছিলেন তিনি যখন কল্লোল বিরূপ সমালোচনায় বিদ্ধ হয়? বলছেন – কলকাতার দৈনিক পত্রিকাগুলোর নাট্যসমালোচকবৃন্দ থিয়েটার নাটক বা অন্য কলাবিদ্যা সম্পর্কে জ্ঞানের জন্য বিশেষ পরিচিত নন। কিন্তু তারা বরাবরই তাদের প্রভুদের সেবাদাসত্বে সমর্পিতপ্রাণ বিশ্বস্ত সৈনিক। এরাই কল্লোল নাটকের সমালোচনার নামে যেমন খুশি কাল্পনিক গুঁতোগুঁতি শুরু করেছেন। চীনাদের বিরুদ্ধে প্রবল জাতিগত বিদ্বেষের কারণে আমরা কল্লোল নাটকে এদের ঢুকতে দিইনি। কিন্তু এদের প্রভুদের নির্দেশে এরা টিকিট কেটে ঢুকলেন এবং সমালোচনার নামে ইতিহাসের অজ্ঞাত সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে দুঃসাহস দেখালেন। (Towards a revolutionary theatre) . এমন কড়া সমালোচনা স্বয়ং নির্দেশক করছেন এ একমাত্র উৎপল দত্তের সিগনেচার উবাচ। এই আধুনিকতায় দাঁড়িয়েও কিন্তু এই বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব পূর্বসূরিদের প্রতি তাঁর চরম শ্রদ্ধা রেখে গেছেন। ভিত তৈরি নাহলে যে কিছুই হতনা। দেখা যাক তাঁর শ্রদ্ধা নিবেদনের ভঙ্গীটি। “এটা অনস্বীকার্য যে নবাব বাদশাদের দরবারে যেমন রাগসঙ্গীতের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুশীলন হত বা উচ্চতম স্তরের শেরেশায়েরি হত, সেটা এইসব নয়া ব্যবসায়ীদের বিশৃঙ্খল মাতাল আসরে সম্ভব ছিলনা। কিন্তু এইসব আসরে জনতার প্রবেশাধিকার ছিল। যা বাদশার দরবারে জীবনে কখনও হবার আশা ছিলনা। এভাবে শিল্পের গনতন্ত্রীকরন হল, এবং এটি বুর্জোয়াদের আঘাতে সৃষ্ট। এভাবে কাব্য সঙ্গীত অভিনয়ের বৃহৎ এক দর্শকগোষ্ঠী তৈরি নাহলে বাংলা থিয়েটারের জন্মই হতনা। গিরিশবাবুরা সাহস করে টিকিট বেঁচে নাটক করার কথা ভাবতেই পারতেন না। দর্শকদের চাহিদা মেটাতে গিয়েই পেশাদার নাট্যশালার সৃষ্টি হয় সারা দুনিয়ায়। এবং রাজা রাজড়াদের একচেটিয়া অধিকার ভেঙে নাটক ও সঙ্গীতকে আপামর জনতার নাগালের মধ্যে আনে বুর্জোয়ারাই” (আশার ছলনে ভুলি)। তবে এই সাধারণ জনের কাছে তুলে ধরা সত্বেও নাটকের কলাকে যে বরেন্যজন চেষ্টা করে গেছেন উচ্চতর শিল্পে উন্নীত করতে সেও তাঁর বক্তব্যে তুলে ধরেছেন যখন তিনি গিরিশচন্দ্রের মঞ্চসজ্জা নিয়ে বলছেন – গিরিশবাবু অবশ্যই মঞ্চকৌশলের ক্ষেত্রে নতুন যুগের প্রবর্তক। ধরা যাক তাঁর কমলে কামিনী নাটক। সমুদ্রযাত্রার দৃশ্যে মঞ্চ জোড়া বিশাল তরণীতে শ্রীমন্ত সওদাগর ও নাবিকরা। পিছনে দৃশ্যপটটা সচল। সামুদ্রিক ঝড়ও দেখানো হয়েছিল মঞ্চে। গিরিশের প্রায় সব নাটকেই মঞ্চ কৌশলের সচেতন উপস্থিতি আমরা লক্ষ করি। শঙ্করাচার্য চলেছেন আর নদীর স্রোত তাঁকে অনুসরণ করছে, বা জনা নাটকে অকস্মাৎ গাছে আগুন জ্বলে ওঠা এবং দেখতে দেখতে পত্রপুষ্পহীন দগ্ধ বৃক্ষকাণ্ডের দাঁড়িয়ে থাকা – এ সবে শুধু মঞ্চনিপুণ গিরিশকে পাইনা, পাই কবি গিরিশচন্দ্রকে (আশার ছলনে ভুলি)। অথচ এই মানুষটিই নিজের অনুপম প্রয়োগের কৌশল বলতে গিয়ে বলছেন – থিয়েটার এবং দর্শক পেলে আমি যবনিকা বাদ দেব। তারপরে বাদ দেব উইংস বর্ডার প্রভৃতি। তারপর হটাবো সীন জাতীয় জিনিস। মেঝেটাকে নানা আকারের বেদী দিয়ে ভরে দেব। এলোমেলো শ্রমিক এদিক ওদিক সিঁড়ি দিয়ে ... অভিনেতা যাতে চলতে গেলেই সিঁড়ি ব্যবহার করতে বাধ্য হয়। ঝড় বোঝাতে ব্যবহার করব ক্রেস এর আঁকা কালো রেখা কাঁটা পর্দা বা ব্রেশট বর্ণিত বিদ্যুৎ আঁকা পর্দা। জল বোঝাতে ব্যবহার করব নীল পোশাক পরা জনা কুড়ি নর্তকী। আগুন বোঝাতে হয়ত উদয়শংকর প্রচলিত কিছু লাল রিবন নাড়াবো। বৃষ্টি বোঝাতে ছাতা খুলে ধরব। যুদ্ধ বোঝাতে পর্দা আর বেদীগুলো নাড়াবো ভীমবেগে (চায়ের ধোঁয়া)। এই উত্তরণ অনুশীলন যোগ্য। মিনার্ভা সম্বন্ধে বলতে গিয়ে এই তথ্য উদ্গীরনে আমার ব্যক্তিগত আবেগ নিঃসন্দেহে কাজ করেছে। নাত্যশিল্পের একশ বছরের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে মিনার্ভায় পা রেখেছেন প্রতিটি যুগের প্রায় প্রতিটি কিংবদন্তী নাট্যব্যক্তিত্ব। মিনার্ভার জীবনযুদ্ধ যতই প্রবল হয়েছে ততই সফল হয়েছে সেখানে প্রতিভার বিকাশ। আর শেষ পর্যন্ত উৎপল দত্তের আবির্ভাবে মিনার্ভা মুছে দিয়েছে পেশাদার নাটক ও গণনাট্যের বিভাজন। বড় অদ্ভুত এই বিভাজন। শেষকথা তাত্বিকেরা বলবেন, আমার সীমাবদ্ধ বোধে মনে হয় কমার্শিয়াল থিয়েটার রুজির জন্য, মুনাফার জন্য শিল্পের শর্তের সঙ্গে কোথাও একটা আপস করে, যেটা গ্রুপ থিয়েটার করেনা। যদিও বর্তমানে এ ধরনের আলোচনাই চলেনা। শিল্প মানোত্তীর্ণ কিনা বলার সময়ে বন্ধুদের মধ্যে এধরনের উক্তি করে বড়ই বিপদে পড়েছি। হয়ত ব্যাখ্যা দিয়েছি যে এ শিল্প মেধা বা মননের কাছে আবেদন রাখেনি, এর আবেদন নিতান্তই জৈব। তখন দেখেছি সেই ছোট আলোচনা সভাতেও বিরুদ্ধ মত উঠে এসেছে। শিল্প শিল্পই। তার ভালো খারাপ হতে পারেনা। শিল্প সমাজ জীবনের প্রেক্ষাপট। সমাজ যদি আদর্শহীনতা ও অবক্ষয়ের শিকার হয় তবে শিল্পে তার প্রভাব পড়বেই। এখন আমিও এ প্রসঙ্গে সহমত।



কথায় বলে ধান ভানতে শিবের গীত! সেইরকম রঙ্গমঞ্চের ধ্বংসের ইতিহাস বলতে গিয়ে নাট্যজগতের মানুষজনের কথা এসে যায়। এসে যায় তাঁদের কথা যারা নাটকের ইতিহাসে স্থায়ী ছাপ রেখে গেছেন। সেটা স্বাভাবিক। কারণ নাটক ছাড়া নাট্যশালার কিবা অস্তিত্ব! শুরু করা যাক আরও একটি ঐতিহ্যশালী রঙ্গমঞ্চের কথা। রঙমহল থিয়েটার। স্টারের ফুটপাত ধরে কলেজ স্ট্রিট মুখো হাঁটতে শুরু করলে কিছুটা গেলে একই দিকে পড়বে রঙমহল থিয়েটার। ১৯৩১ সালের ১৭ই বৈশাখ ৬৫/১ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে এই নাট্যশালার উদ্বোধন হয়। একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা বলি, নাট্যাচার্য শিশির কুমার এর কিছুদিন আগেই দলবল নিয়ে আমেরিকা সফরে যান। এখন যারা নাটক করেন আশা করি আশা করি তাঁরা সকলেই এ বিষয়টি অবগত আছেন। পূর্বসূরিদের কাছে আমাদের যে কত ঋণ! রঙমহল উদ্বোধন করেন নট-নাট্যকার অপরেশচন্দ্র লাহিড়ী। এই সময়ে শিশির কুমার ও সতু সেন আমেরিকা থেকে সদ্য ফিরেছেন। সতু সেনকে তাপস সেনের পূর্বসূরি বলা চলে। তিনি তখন অসামান্য দক্ষতায় শিল্প নির্দেশনা ও আলোক সম্পাতের কাজ করছেন। ১৯৩১ সালে নাট্যনিকেতনে অভিনীত ঝড়ের রাতে নাটকে সতু সেনের এই অদ্ভুত আলো ও মঞ্চ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। শ্রীযোগেশ চৌধুরীর পরিচালনায় রঙমহলে প্রথম শ্রীশ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া নাটক মঞ্চস্থ হয়। তারপর ১৯৩৩ সালে শিশিরকুমার মহানিশা নাটকের পরিচালনার দায়িত্বে। মঞ্চ ও আলো সতু সেন। সতু সেন প্রথম এই থিয়েটারে ঘূর্ণায়মান মঞ্চ তৈরি করেন। সে সময়ের নিরিখে এই কাজ একান্তই বৈপ্লবিক। তখন এত টেকনোলজির উন্নতি হয়নি। এই নাটকটিও নাটকের ইতিহাসে এক মাইলস্টোন। ১৯৩১ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত রঙমহলে বিভিন্ন বিখ্যাত পরিচালক ও নটনটীদের নিয়ে বহু সার্থক নাটক মঞ্চস্থ হয়। যোগেশচন্দ্র চৌধুরীর নাট্যরূপে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিটেকটিভ, শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের স্বামি স্ত্রী ও তটিনী বিচার, বিধায়ক ভট্টাচার্যের মেঘমুক্তি, মাটির ঘর, বিশবছর আগে, প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের রত্নদীপ-নাটক বিধায়ক ভট্টাচার্য, প্রভৃতি মঞ্চস্থ হয়। এরপর রঙমহলের দরজা বন্ধ হয়। আবার জুন মাসে যামিনী মিত্র দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কে নিয়ে রঙমহলের দরজা খোলেন। বিধায়ক ভট্টাচার্যের রক্তের ডাক, তুমি ও আমি মঞ্চস্থ হয়। কিন্তু যামিনী মিত্র দায়িত্ব ছেড়ে দেন। ১৯৪২ থেকে ৪৭ এর মধ্যে রঙমহলে অভিনীত অনেক নাটকের মধ্যে রামের সুমতি, সন্তান, বাংলার প্রতাপ, রাজপথ, এবং সেই তিমিরে রঙমহলের আর্থিক সাফল্য এনে দেয়। অহীন্দ্র চৌধুরী, জহর গাঙ্গুলি, নিরমলেন্দু লাহিড়ী, সন্তোষ সিংহ, মিহির ভট্টাচার্য, রানীবালা, সুহাসিনী, প্রমুখ বিশিষ্ট অভিনেতা অভিনেত্রী তখন রঙমহলের সাথে যুক্ত। কিন্তু অভিনেতা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন রঙমহলের লেসী রূপে যথেষ্ট দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে কাজ করলেও তাঁর বেহিসেবী খরচে বিপুল ঋণভারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। নটসূর্য অহীন্দ্র চৌধুরী তখন নিজের উদ্যোগে একের পর এক নাটক নামান। রিজিয়া ও মেবারপতন দারুন সফল হয় তবুও শরৎচন্দ্র সম্পূর্ণ ঋণমুক্ত হতে পারলেন না। কোর্টের আদেশে তিনি দেউলিয়া ঘোষিত হন ও তাঁকে থিয়েটারের কর্তৃত্ব ছাড়তে হয়। সীতানাথ মুখোপাধ্যায় এরপর রঙমহলের ভার নেন। তাঁর আমলে দেবনারায়ন গুপ্তের নাট্যরূপে নিষ্কৃতি নাটক উল্লেখযোগ্য। অভিনয় হয় ১৯৫০ সালের ২রা অক্টোবর। এই নাটকের আর্থিক সাফল্য রঙমহলে স্বচ্ছলতা এনে দিলেও মামলা পিছু ছাড়েনা। ১৯৫৪ সালে জিতেন বসু ও বিঠল ভাই মানসাটা থিয়েটারের লেসী হন। সেই বছরে নভেম্বরে ডঃ নীহাররঞ্জন গুপ্তের উল্কা মঞ্চস্থ হয়। অত্যন্ত জনপ্রিয় নাটকটি প্রায় দু বছর ধরে চলে। এরপর বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরিচালনায় তারাশঙ্করের কবি। একটা কথা লক্ষ্য কড়া যাচ্ছে যে সেসময়ে বিখ্যাত কথাসাহিত্য থেকে নাটক করার চল ছিল। ১৯৬২ সালে রঙমহলের লেসীদের তরফে কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় যে হল ভাড়া দেওয়া হবে। এমনকি গুজব ওঠে যে এটি সিনেমা হলে রূপান্তরিত হবে। স্বভাবতই নাটকের শিল্পী ও কলাকুশলীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাঁদেরই অক্লান্ত পরিশ্রমে এতগুলি সফল নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। তাঁরা ডঃ প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রের কাছে এব্যাপারে আবেদন জানালে তিনি মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে বিষয়টি জানান। তাঁর মধ্যস্থতায় শেষপর্যন্ত ঠিক হয় লেসীরা অতঃপর শুধু কলাকুশলীদের বেতন দেবেন। নাটকের টিকিট বিক্রির অ্যাঁয় থেকে শিল্পীরা হলভাড়া দেবেন লেসীদের, আর অবশিষ্ট আয় নিজেদের মধ্যে বেতন হিসেবে ভাগ করে নেবেন। নতুন ব্যবস্থায় শিল্পীদের পক্ষে সরযূ দেবী ও জহর রায় এই দায়িত্ব গ্রহন করেন। অর্থাৎ শিল্পীরা নিজেদের রুজি ও নাটক বাঁচাতে লেসীদের এই দাবী শিরোধার্য করার ঝুঁকি নেন। অন্যথায় হল হাতছাড়া হওয়া আটকানো যেতনা। এঁদের প্রথম নাটক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আদর্শ হিন্দু হোটেল। ১৯৬২ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি প্রথম অভিনয়। ১৯৬২ থেকে ১৯৭১ সালের মধ্যে এই শিল্পীগোষ্ঠী বারোটি নতুন নাটক মঞ্চস্থ করে। এর মধ্যে বিধায়ক ভট্টাচার্যের অতএব, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের নহবত, সুনীল চক্রবর্তীর আমি মন্ত্রী হব, মনোজ মিত্রের বাবাবদল উল্লেখযোগ্য। এরপর ও জহর রায় মৃত্যুকাল পর্যন্ত রঙমহলের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯৭৭ সালের ১লা অগাস্ট পরলোকগমন করেন। বর্তমানে এই থিয়েটার হল আর নেই। এখানে এখন সিগনাম এরিস্ট্রো বলে একটি শপিং মলের নির্মাণ জারি। ২০০১ সালে হলে আগুন লাগে। এর আগে হলটি বিয়েবাড়ি ও প্রদর্শনী উপলক্ষে ভাড়া দেওয়া হচ্ছিল। তদন্তে প্রকাশ যে একটি শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন লাগে। যদিও স্যাবোট্যাজ এর তত্বওঅনেকে সামনে এনেছেন। এতকালে নিশ্চয় সেই হলের পরিবর্তে নতুন দোকানবাড়িটির কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। শুধু এক সময়ের বাংলার সংস্কৃতির পীঠ এই মঞ্চগুলো আর নেই। রঙমহলের জীবনযাত্রা মাত্র সত্তর বছরেই শেষ হয়ে গেল। খুব আশ্চর্য লাগে যখন দেখি অন্য দেশে ঐতিহ্যপূর্ণ কোনও ভবন, যা সেখানকার সংস্কৃতিকে বা ইতিহাসকে কোনও না কোনোভাবে ধনী করেছে, তার সংরক্ষণে সরকার, সাধারণ মানুষ, ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর এক সাথে হাতে হাত রেখে কাজ করে চলেছে, সেখানে আমাদের চোখের সামনে সংস্কৃতির ইতিহাস, মানচিত্র সব ধ্বংস হয়ে চলেছে, আমাদের কিছু ভ্রূক্ষেপ নেই। আধুনিক অর্থনীতির গড্ডালিকাতে এক একটি ভোগায়তন জন্মেই চলেছে। যেন আমাদের শুধু চোখ ধাঁধানো পোশাক গয়না জুতো চাই, আসবাবে ঠাসা কামরা চাই, আর পেটে ঢোকানোর জন্য সুখাদ্য চাই। এছাড়া আর কোনও ক্ষুধা নেই, থাকতেই পারেনা।

যে চারটে প্রধান রঙ্গমঞ্চের কথা বলব বলে লেখা শুরু করেছিলাম তার মধ্যে শেষ হোল বিশ্বরুপা। যে নাট্যনিকেতন মঞ্চে ঝড়ের রাতে নাটকে সতু সেন ঝড় তোলেন সেই মঞ্চ শিশির কুমার লিজ নেন ১৯৪২ সালে। নামকরণ হয় শ্রীরঙ্গম। তার আগে ১৯৩২ থেকে ১৯৪১ সালের মধ্যে সেখানে ষোলটি নাটক সেখানে অভিনীত হয়। নাট্যনিকেতনের শেষ নাটক তারাশঙ্করের কালিন্দী। তারপরই শ্রীরঙ্গম। সূচনাকাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত অভিনীত নাটকগুলি হোল, মাইকেল, বিপ্রদাস, বিন্দুর ছেলে, ও দুঃখীর ইমান। প্রতিটি নাটকেই প্রায় নাট্যাচার্যর অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর ছিল। শুধু বিন্দুর ছেলে নাটকে শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি অভিনয় করেননি। কিন্তু দারুন ছিল পরিচালনা। ১৯৪৬ এর পর নাট্যাচার্য আর্থিক লাভালাভকে তুচ্ছ করে পরীক্ষামূলক ভাবে কয়েকটি নাটক মঞ্চস্থ করেন। এর মধ্যে দুঃখীর ইমান ও পরিচয় নাটক দুটি উল্লেখযোগ্য। শিশির কুমারের নটজীবনের শেষ ঐতিহাসিক নাটক তখত ই তাউস। এই নাটকে জাহান্দার শাহ্‌র ভুমিকায় তাঁকে মানুষ মনে রেখেছে। বলিষ্ঠ মঞ্চায়ন। দুঃখের কথা হোল পরীক্ষামূলক নাটকের প্রযোজনার ফলে তাঁকে চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়তে হোল। ১৯৫৩ সালে প্রশ্ন নাটক মঞ্চস্থ হয়। অহীন্দ্র চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস, জহর গাঙ্গুলি, সরযূ দেবী, প্রমুখের প্রবল চেষ্টায়ও নাট্যাচার্য শ্রীরঙ্গমকে ধরে রাখতে পারলেননা। ১৯৫৬ সালে সরকার ব্রাদার্সের হাতে শ্রীরঙ্গমের মালিকানা হস্তান্তর হয়ে যায় এবং তাঁরা হলটিকে নতুন করে ঢেলে সাজান। তাঁদের প্রযোজিত প্রথম নাটক তারাশঙ্করের আরোগ্য নিকেতন। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় মঞ্চস্থ হয়। এখানে উল্লেখের প্রয়োজন আছে যে, নাট্যাচার্য শিশির কুমারের মূল্যায়ন কথাটার অনেক ভার। আমার মত অর্বাচীনের এই ধৃষ্টতা অমার্জনীয়। বরং শ্রদ্ধায় দুটো কথা নিবেদন কড়া যাক। পরবর্তী কালে যারা অপেশাদার রঙ্গমঞ্চেও নাটক নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন, নাটককে একটি জনমোহিনী শিল্পমাধ্যম থেকে মননশীল চারুশিল্পে উত্তরণ ঘটিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই নাট্যাচার্যের কাছে কোনও না কোনোভাবে ঋণী। ১৯৫৭ সালের ৬ই বৈশাখ মঞ্চস্থ হয় বিধায়ক ভট্টাচার্যের নাটক ক্ষুধা। বিশ্বরুপার দ্বিতীয় নাটক। এই নাটক অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। পরপর অসামান্য সব নাটক নামতে থাকে। এরপরই নামে সেতু। এই নাটকে তৃপ্তি মিত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আবার তাপস সেনের সেই দারুন আলোকসম্পাত। মঞ্চের ওপর চলন্ত রেলগাড়ির ইঞ্জিনের আলো বিস্ময়কর রকমের জীবন্ত হয়ে উঠত। একটানা চলার ক্ষেত্রে সেতু রেকর্ড সৃষ্টি করে। ১৯৬৭/৬৮ সাল পর্যন্ত সরকারদের তত্ত্বাবধানে পরপর রঙ্গিনী, এক পেয়ালা কফি, আগন্তুক ইত্যাদি নাটক চলে। আগন্তুক ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত প্রায় দুবছর ধরে চলে। উপরোক্ত শেষ তিনটে নাটকে থিয়েটার সেন্টারের শিল্পীরা অভিনয় করেন। পরিচালনা তরুন রায়ের। বিশ্বরুপায় এরপর রাসবিহারী সরকার সরাসরি পরিচালনায় আসেন। তাঁর প্রথম সফল নাটক বিমল মিত্রের কাহিনী অবলম্বনে বেগম মেরী বিশ্বাস। এখনও যারা স্মৃতিচারণ করতে পারেন সেইরকম প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে তুলে ধরছি এক উদ্ধৃতি। ইনি অন্য কেউ নন, স্বয়ং বিধায়ক ভট্টাচার্যের কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীবিমোচন ভট্টাচার্য। সেতু নাটক চলাকালীন তাঁর অভিজ্ঞতাও কিছুটা ধরা পড়ে।

“কি এমন ছিল পেশাদারী মঞ্চে ? মহিলা অভিনেত্রীদের ছোটরা ডাকতেন মা বলে ,প্রভা মা , আঙ্গুর মা , ইন্দু মা , সরজু মা । আমার নিজের দেখা সেই অন্তরঙ্গ পরিবেশ । এটা পাল্টিয়ে গেল যখন তৃপ্তি মিত্র এলেন সেতু নাটকে অভিনয় করতে। ম্যাডাম ডাক চালু হল ।নতুন নাটক যখন পড়া হত আগের নাটকের সবাই গোল হয়ে বসতেন । নাটক পড়া হয়ে গেলে পরিচালক বলে দিতেন কোন চরিত্রের জন্যে কাকে ভাবা হয়েছে । দেখা যেত কেউ কেউ বাদ পড়েছেন । থিয়েটার এর টাকাটাই তাঁদের স্থায়ি রোজগার ছিল । ফলে বেকার হয়ে যাবার ভয়ে নাট্যকারের কাছে ছুটতেন তাঁরা ।নাট্যকার লিখেও দিতেন কোন ছোট চরিত্র। ব্যাস , অন্তত এক দু বছরের জন্যে নিশ্চিন্ত হতেন তাঁরা”।

রাসবিহারী সরকারের পরিচালনায় শঙ্করের চৌরঙ্গী বিশ্বরুপার আর এক মাইলস্টোন। এ নাটকে প্রথম মঞ্চে ক্যাবারে দেখানো হয়। মিস সেফালি ছিলেন সেই নৃত্যশিল্পী। গল্পের প্রয়োজনে হোটেলে এই নাচের দৃশ্যের অভিনয় হত। এর জন্য চৌরঙ্গীর গায়ে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তকমা লাগে। সে সময়ের কিছু স্মৃতির উল্লেখ করি। বিশ্বরুপা ছিল গ্রে স্ট্রিট থেকে শুরু হওয়া ক্ষুদিরাম বোস রোডের শেষ মাথায়। আমাদের খেলার এলাকায় পড়ে। খেলতে খেলতে কখনও চলে গেছি। ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুযোগে মাঝে মাঝেই গ্রিনরুমে ঢুকে পড়তাম। বলা বাহুল্য শো শুরুর বেশ আগে। তখন মেক আপ চলছে। মনে পড়ে তরুন কুমার তাঁর বিরাট ভুঁড়ি নিয়ে বসে মেক আপ নিতেন। আমি কখনও তাঁর ভুরিতে খোঁচা দিয়ে দেখতে চেয়েছি ওটা সত্যিই ভুঁড়ি, নাকি বানানো। ছোট বেলায় হাটেবাজারে ছবিতে সেই পেট থেকে কলের মতন জল পড়ার দৃশ্য মনে করে ভাবতাম এত বড় ভুঁড়িতে জল না হয়ে যায়না। উনিও স্নেহপূর্ণ প্রশ্রয়ে কখনও কিছু বলেননি। বরং টুকরো টুকরো কথায় গল্প চালিয়ে যেতেন। বাবার বিশেষ বন্ধু ছিলেন অজয় গাঙ্গুলি। তিনিই বরং দেখতে পেলে পাঠিয়ে দিতেন। যাও এখান থেকে। এটা বড়দের জায়গা। তখন প্রাপ্তবয়স্কদের নাটক চলছে। একদিন বাবা কটা সংলাপ লেখা কাগজ হাতে দিয়ে বললেন যা বুড়োদা কে দিয়ে আয়। কিসের সংলাপ আর মনে নেই। তো সেই কাগজের তাড়া নিয়ে গিয়েছি ওঁকে দিতে। উনি বললেন তাই তো তুই এলি তোকে কি দেখাই? বলে মুখের পেশি স্থির রেখে একটা কানকে অদ্ভুত ভাবে নাড়াতে লাগলেন। আমি অবাক। খুব চেষ্টা করলাম নিজেও, যদি পারি। অবশ্যই হলনা। উনি কাছে বসিয়ে বললেন আমি তো বুড়ো, আমার মতন বুড়ো হ তখন পারবি। ছোট বেলা থেকে কত কানমলা খেয়েছি, তাইতেই কান লুজ হয়ে গেছে। আমি কি জানি কি খেয়ালে হঠাৎ বলে বসলাম তোমার দাদাকে একদিন দেখাবে? তাঁর সে কি হাসি! বললেন তুইও আমার দাদাকে দেখতে চাস? এই জন্মালি যে রে! তখন ধারণাই ছিলনা যে এঁরা সেলিব্রিটি। তাঁদের ব্যবহারে তা কখনও প্রকাশ পেতনা।

মানিকতলা খালের পাশে আর একটি মঞ্চ ছিল। নাম কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ। ১৯৫৩ সালে তৈরি মঞ্চতি ১৯৫৭ সালে নট নাট্যকার মহেন্দ্র গুপ্ত এই মঞ্চে অভিনয় শুরু করেন। তাঁর পরিচালনায় রাজা রামপাল ও শাপমুক্তি নাটক মঞ্চস্থ হয়। ১৯৬৬ সালে নান্দিক গোষ্ঠী বিধায়ক ভট্টাচার্য রচিত এন্টনি কবিয়াল মঞ্চস্থ করেন। বলা চলে এই নাটকের হাত ধরেই কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চ নাট্যামোদীদের কাছে পরিচিতি লাভ করে। নাটকে অভিনয় করেন এন্টনির ভূমিকায় সবিতাব্রত দত্ত, সৌদামিনী কেতকী দত্ত ও ভোলা ময়রা জহর গাঙ্গুলি। গান এ নাটকের বিশেষ সম্পদ। আড়াই বছর চলেছিল নাটকটি। এরপর নটী বিনোদিনী, মুখোশের আড়ালে, দয়াল অপেরা ইত্যাদি নাটক মঞ্চস্থ হয়। ১৯৭২ সালে হরিদাস স্যান্যাল এই মঞ্চ ভাড়া নেন। জরাসন্ধের মল্লিকা মঞ্চস্থ হয়। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় ছিলেন নামভূমিকায়। তাঁর মর্মস্পর্শী অভিনয় যারা দেখেছেন কখনও ভোলেননি। এই নাটকের একটি দৃশ্যের কথা বলি। জ্ঞানেশ মুখার্জি বাবা। তিনি একটি চেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। তাঁর ছেলে অনুপ কুমার। বেকার। ছেলের ক্রিকেট খেলার ঝোঁক। তার হাতে একটা ক্রিকেট ব্যাট। সে দাঁড়িয়ে আছে বাবার চেয়ারের পেছনে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে শ্যাডো প্র্যাকটিস করে চলেছে। বাবা একটি একটি করে প্রশ্ন করে চলেছেন আর ছেলে প্র্যাকটিস করতে করতে তার উত্তর দিচ্ছে। ক্রমশ প্রশ্ন তীক্ষ্ণ হচ্ছে। বেকার ছেলে। সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে হাতের ব্যাট থামছেনা অথচ বডি ল্যাংগুয়েজে যন্ত্রণা ফুটে উঠছে। ভোলবার নয় সে দৃশ্য। বহুদিন চরিত্রটির জন্যে মনে কষ্ট পোষা ছিল। এর বেশ ক বছর পর সৌমিত্র করেন নামজীবন। প্রায় এই সময়েই প্রতাপ মঞ্চে অসীম চক্রবর্তী পরিচালিত সুবোধ ঘোষের বারবধূ মঞ্চস্থ হয়। কেতকী দত্ত ছিলেন মুখ্য ভূমিকায়। এ নাটকটিও প্রাপ্তবয়স্ক তকমাধারী ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে অসীম চক্রবর্তী নাটকে প্রথম পাশ্চাত্য ভাবধারায় অণুপ্রানিত বাংলা নাটক মঞ্চস্থ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে সেই সব নাটক সেসময়ে দর্শক আনুকুল্য পায়নি। তিনি যখন বারবধূ করেন তখন সুবোধ ঘোষের এই গল্পটিকে ভুলে মানুষ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য এই নাটক দেখতে ভিড় জমায়। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে অপসংস্কৃতির অভিযোগে নাটকটি বন্ধ করে।

১৯৭০ সালে রাজা রাজকিশন স্ট্রিটে রঙ্গনা নামে আর একটি মঞ্চ স্থাপিত হয়। অহীন্দ্র চৌধুরী মঞ্চের নামকরণ করেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায় উদ্বোধনে উপস্থিত ছিলেন। এই মঞ্চে নান্দীকার গোষ্ঠী নিয়মিত অভিনয় করতেন। এঁদের প্রথম নাটক তিন পয়সার পালা। তারপর পরপর নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র, মঞ্জুরী আমের মঞ্জুরী, শের আফগান, নটী বিনোদিনী মঞ্চস্থ হয়। নিতান্ত বালিকা বয়স। তবুও এই সব নাটকের কিছু কিছু দৃশ্য মনে পড়ে। মনে পড়ে তিন পয়সার পালায় গান - চেষ্টা করলে হাঙরেরও মুখ দেখতে পাবে। মনে পড়ে নটী বিনোদিনীতে মঞ্চের এক কোণে চেয়ারে গুরমুখ রূপী রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বসে, আর অপর প্রান্ত থেকে ঠমকে ঠমকে আসছেন বিনোদিনী কেয়া। মনে পড়ে মঞ্জুরী আমের মঞ্জুরীর সেই মনোলগ। কিন্তু বড় অস্পষ্ট। আজ আর অজিতেশ নেই। সেই সব স্বাদ ফিরিয়ে দেবার কেউ নেই। যখন সাংস্কৃতিক মুখ হিসেবে উৎপল দত্ত ও শম্ভু মিত্র কলকাতার রঙ্গমঞ্চে রাজত্ব করছেন তখন লালমাটির দেশ থেকে ঝড়ো হাওয়ার মত অজিতেশ এলেন।

হয়ত সস্তা নাটক হত, পারিবারিক নাটক হত, আবার মননশীল নাটক ও হত, কিন্তু সব শেষে সৃষ্টিশীল কিছু মানুষ থিয়েটার ভালোবেসে কয়েক দশক কলকাতার রঙ্গমঞ্চ মাতিয়ে রেখেছিলেন। এভাবেই স্বল্পস্থায়ী জীবনকাল নিয়ে পেশাদার বঙ্গরঙ্গমঞ্চের শেষঅঙ্ক দেখতে হোল কলকাতার মানুষকে। এ দুঃখ কোথায় রাখি!

ঋণ স্বীকার – বিমোচন ভট্টাচার্য।

বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস – দর্শন চৌধুরী

একশো বছরের নাট্য প্রসঙ্গ – দেবনারায়ন গুপ্ত।

উৎপল দত্তের কিছু রচনা, বিভিন্ন বই থেকে নেওয়া।

[নবাবী বইমেলা সংখ্যা ২০১৮]

0 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - তুহিন দাস

Posted in






লন্ডন থেকে প্রকাশিত হতো কবিতা ও সমালোচনার লিটলম্যাগ ‘নাইন’ (‘Nine’) । এ পত্রিকার সম্পাদকরা ছিলেন পিটার রাসেল, জি.এস. ফ্রাসার, ইয়ান ফ্লেচার প্রমুখ। মে ১৯৫০ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় ৯৬-১০০ পৃষ্ঠায় কবি বুদ্ধদেব বসুর লেখা ‘দ্য সিচুয়েশন অফ দ্য রাইটার ইন বেঙ্গল টু-ডে’ শিরোনামে এ প্রবন্ধটি ছাপা হয়।

“আমি দেখেছি যে উপন্যাস, যা চিন্তা ও আবেগ প্রকাশের জন্য সবচেয়ে শক্তিশালী ও নমনীয় মাধ্যম ছিল, তা হলিউডের ব্যবসায়ীদের হাতে যান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক শিল্পের অধীনস্থ হয়ে উঠছিল, অথচ যা ক্ষুদ্র চিন্তা-সবচে’ নির্দিষ্ট আবেগকেও প্রতিফলিত করতে সক্ষম ছিল। অল্প গতিসম্পন্ন অনিবার্য মিথস্ক্রিয়ার কারণে একটি শিল্প যেখানে শব্দগুলো চিত্রের অধীনস্থ, সেখানে ব্যক্তিত্ব জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সেখানে একটি প্রবহমান অসম্মান ছিল, লিখিত শব্দের শক্তিকে অন্য একটি আরো চকচকে ও স্থুল শক্তির অধীন হতে দেখে আমার একটি ঘোর তৈরি হয়েছিল…।”

এ কথাগুলো কুড়ির দশকের আমেরিকান মেধাবী উপন্যাসিক এফ. স্কট ফিটজেরাল্ডের, তিনি জানতেন যে তিনি কি সম্বন্ধে কথা বলছেন, হলিউডে যার নিজেরও একরকম সফলতা ছিল, এবং এ কথাগুলো তার সময়ের চেয়ে আরো সাধারণভাবে ও তিক্তভাবে আমাদের সময়ে সত্য। স্থুলশক্তি আমেরিকা ছাড়িয়ে ইউরোপ থেকে প্রাচ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। সমগ্র বিশ্বসভ্যতা আজ তার কবলে পড়েছে। লিখিত শব্দ ‘সংস্কৃতি' হিসাবে বিজ্ঞাপিত একটি গণপণ্য প্রচারের জন্য কিছু যান্ত্রিক মাধ্যমের অধীনতা করে; স্বতঃস্ফূর্ত, ব্যক্তিগত, সৃজনশীল শিল্পীকে নির্মূল করার জন্য সমাজের তীব্র সংকল্প বিদ্যমান, তাদের শিল্প ও সাহিত্যের নান্দনিক স্থানচ্যুতি ঘটে এবং আধ্যাত্মিক প্রয়োজনের অবস্থানের থেকে তুচ্ছ বিনোদন বা ব্যবহারিক উপযোগের দিকে ঝোঁকে। আজকের দিনে এগুলো আজ প্রতিটি দেশে, এমনকি বাংলার লেখকদের পরিস্থিতি। আমি এমনও বলি, কারণ ভারতের অবস্থা পশ্চিমের অবস্থা থেকে আলাদা বলে মনে করা হয়, এবং অন্তত নেতিবাচক অর্থে হলেও ভারতে লেখকদের অবস্থা ভালো এমনটি আশা করা হয়। ভারত একটি প্রাচীন দেশ, একটি প্রাচীন ও ভারসাম্যমূলক সভ্যতা, যার অভ্যন্তরীণ শান্তির একটি ঐতিহ্য আছে, বিশ্ব-বাণিজ্যের কেন্দ্র থেকে দূরে—এমন একটি দেশ, যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে তুলনামূলকভাবে নিজেকে অক্ষত রেখে জেগে উঠেছিল, এবং দরকষাকষি করে রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করে: বরং সমগ্র পৃথিবীর মধ্যে এটি হৃদয়স্পর্শী, রয়েছে দিল্লির একঘেয়ে বাগ্মীতা, গান্ধীর নামের বিশাল প্রচার মূল্য, এমনকি ভারতকে প্রতিশ্রুতির দেশ হিসেবে উপস্থাপন করা যেতে পারে, এবং আমাদের লেখকদের সামনের দিকে এগোনোর মতো যথেষ্ট আশাবাদী হবার মতো সবকিছু রয়েছে।

তবে আসুন আমরা ঘটনাগুলিকে একটু ঘনিষ্ঠভাবে দেখি। এটা সত্য যে, আমরা অন্তঃত যুদ্ধের ভৌতিক ভয়াবহতা থেকে রেহাই পেয়েছিলাম, কারণ জাপানি বিমান হামলা ছিল মৃদু ও কেন্দ্রীভূত নয় এবং বাংলার দুর্ভিক্ষ ব্যতীত আমাদের বস্তুগত ও মানবিক ক্ষতিও কম; এতো কম যে তা ধরার মতো নয়, ব্রিটেন, জাপান, কিংবা জার্মানীর সঙ্গে তুলনা করলে তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু একটি ঔপনিবেশিক দেশ অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও এমন একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে যার কারণগুলোতে একটি ছোট একাডেমিক শ্রেণী ছাড়া অন্য কারো জন্য সামান্যতম আগ্রহের ছিল না, এমন একটি যুদ্ধ যাকে জনগণের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শুধুমাত্র একটি অপ্রয়োজনীয় বিপর্যয় বা শোষণ করার জন্য প্রভুদের একটি বিরল সুযোগ হিসাবে দেখেছে যাদের পরাজয় অবশ্যই কাঙ্ক্ষিত ছিল—এই ধরনের একটি দেশ একটি বিশাল নৈতিক ধ্বংসের নিন্দা করেছিল, যার প্রভাব সম্ভবত প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অনুভূত হবে। আর ঠিক সেটাই ঘটেছে ভারতে। যুদ্ধ কারখানা ও ঘরবাড়ির পরিবর্তে আমাদের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে; যেমন ভাল ও মন্দের মৌলিক ধারণাগুলি, মন্দ কাজের বিরুদ্ধে উচ্চারণ, অপরাধকে মহিমান্বিত, এবং শেষদিকে ভণ্ডামিকে মাত্রাতিরিক্ত করে তুলেছে। সুতরাং, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে স্বাধীনতার পর প্রথম পদক্ষেপ যা ভারত শুধুমাত্র নৈতিক দেউলিয়াত্বের মূল্যে পেয়েছিল তা ছিল গান্ধীর হত্যাকাণ্ড: যুদ্ধ দ্বারা চাপিয়ে দেয়া বর্বরতার দীর্ঘ উৎসাহ দ্বারা এর পথ প্রস্তুত করা হয়েছিল, এবং আমাদের যুদ্ধ, সেখানে কখনও অস্ত্র ব্যবহার না করা লোকেরা অবশেষে গণ-দুর্দশায় লিপ্ত হওয়ার একটি সুযোগ পেয়েছিল, এবং এটি তার ধারাবাহিকতায় শেষ হয়েছিল। যখন ভারতীয় জীবনে ব্রিটিশদের সম্পর্কে সবচেয়ে খারাপ কথা বলা হয়েছে, তখন সত্যটুকুও থেকে যায় যে ব্রিটিশরা বাইরের দিক ছাড়া ভারতীয় জীবনের বুননকে নষ্ট করতে পারেনি, বা সম্ভবত এটি একেবারে অন্যরকম বিষয় ছিল; দুর্নীতি শিকড়কে হুমকির মুখে ফেলছে এবং দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক দুর্দশার অনুকূল পথে অগ্রসর হচ্ছে যার বর্তমান কারণগুলি সাধারণ মানুষের কাছে খুবই অস্পষ্ট। এ খুবই ভঙ্গুর এমন অবস্থা যেখানে সাহিত্য সামগ্রিকভাবে কম উন্নতি করতে পারে।

ভারতের সবচেয়ে সাহিত্যমনস্ক অংশ বাংলায় প্রতিবন্ধকতা বেশি। লর্ড কার্জনের প্রস্তাবিত বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ১৯০৫ সালে শুরু হওয়া ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম ইতিহাসের অদ্ভূত বিদ্রুপের দ্বারা ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছিল এবং কার্জনের ধারণার চেয়েও বেশি নিষ্ঠুরতা বাংলা পেয়েছিল। আমি পাকিস্তান সৃষ্টির বিরুদ্ধে তর্ক করার প্রস্তাব করছি না, কারণ এটা এখন একটি বাস্তবতা, এবং সমস্ত যুক্তি অকেজো হবে; আমি এও সচেতন যে পাকিস্তান ভারতীয় মুসলমানদের জন্য বস্তুগত প্রয়োজনের না হলেও একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজনের ছিল; তারপরও মানচিত্র থেকে বাংলার নাম মুছে ফেলা অবশ্যই বিপুল সংখ্যক নির্দলীয় মানুষের কাছে অসহনীয় হবে, যারা কখনই আশা করা থামাবে না যে দুই বাংলা আবার এক হবে। এদিকে, একজন বাঙালি লেখক হিন্দু হোক বা মুসলমান হোক, অনুভব করতে পারে না যে এই দেশভাগ তার কাছে কি অর্থ বহন করে, একজন লেখক হিসাবে তার ইতোমধ্যে বোঝা হয়ে থাকা সমস্যাগুলির সঙ্গে নতুন এক সমস্যা যুক্ত হয়েছে। তার বইয়ের খুব ছোট বাজার এখনও কাস্টমস হাউস দ্বারা সীমাবদ্ধ; একদিকে হিন্দি আর অন্যদিকে উর্দুর প্রভাবে বাংলা ভাষা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, ইতোমধ্যেই তা বোঝা যাচ্ছে; কেননা সামগ্রিকভাবে বাঙালি সংস্কৃতির মারাত্মক বিকৃতির আশঙ্কাও রয়েছে, ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার পথপ্রদর্শক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাঙালি সংস্কৃতির মতো একটি জিনিস বিদ্যমান, যা ভারতের সাধারণ সংস্কৃতি থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। সবকিছুর উপরে যুদ্ধ ও রাজনীতির ষড়যন্ত্রে নতুন বিপদের সৃষ্টি হয়েছে। এফ. স্কট ফিটজেরাল্ড এ প্রসঙ্গে বলেছেন,”স্থুল শক্তির কম দীপ্তি থাকলেও সমান নৃশংসতার সঙ্গে তা চকচকে”। ব্রিটেন ও আমেরিকার লেখাপত্রের অসুখী ভাগ্য নিয়ে আজ অনেক কিছু লেখা হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে, উপরোক্ত কারণে এবং আরও কিছু কারণের জন্য আমি বর্তমানে হিসেব করব যে এটি অপেক্ষাকৃত খারাপ।

এক্ষেত্রে নিকট অতীতের দিকে এক পলক দৃষ্টি দেয়া শিক্ষামূলক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, অষ্টদশ শতাব্দীর ষাটের দশকের দিকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের পক্ষে সম্ভব ছিল একজন জুতো প্রস্তুতকারকের কাছে তার মহাকাব্য পড়তে যাওয়া। বর্তমান শতাব্দীর প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সাহিত্য সম্মেলনে অকৃত্রিম উদ্দীপনা নিয়ে বক্তব্য দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। ঊনিশশো ত্রিশের দশক পর্যন্ত বাংলা ক্রমাগত সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন তৈরি করেছে যা সাহসী লিটল ম্যাগাজিনগুলো পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল, অনেক অ-লেখক দ্বারা সমর্থিত এবং বিরোধিতাও ছিল, এর মধ্যে এমনকি সাধারণ শিক্ষিত জনগণের কথাও শোনা গেছে। যা আজ চিন্তা করা যায় না। এটা গুজব ছিল যে সাক্ষরতা বাড়ছে; প্রতি বছর ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার্থীর সংখ্যা আগের বছরের থেকে বেশি হয়, যুদ্ধের আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি সংবাদপত্র এবং ম্যাগাজিন রয়েছে (কাগজের ঘাটতি সত্ত্বেও), এবং অবশ্যই সিনেমা এবং রেডিও রয়েছে। একই সময়ে, গণসংস্কৃতির অগ্রগতির সরাসরি বিপরীত অনুপাত দেখা যাচ্ছে, যার ইঙ্গিতগুলি হল, সাহিত্য ও সাহিত্যের শিল্পের প্রতি আগ্রহ হ্রাস পাচ্ছে এবং এমন এক বিন্দুতে সে হ্রাস পেয়েছে যেখানে অনেকেরই আর একটি বইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখার ক্ষমতা নেই যদি না বইটি একটি চলচ্চিত্রের অনুষঙ্গ অথবা রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের পক্ষের মাধ্যম হয়। যারা এখনও জীবন্ত শব্দের শক্তি সম্পর্কে সচেতন তারা বেশিরভাগই সেই অতি-নিপীড়িত কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সবচেয়ে মূল্যবান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অন্তর্গত, যা আজ বাংলায় ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে। যুদ্ধের অন্যতম পরিণতি হল সামাজিক শ্রেণীগুলির স্থানচ্যুতি; কলকাতায়, উচ্চ শ্রেণীকে এখন কমবেশি স্থুল এবং সদ্য ধনী বৃত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ বলে মনে হচ্ছে, এবং নিম্নবিত্ত বা শ্রমিক শ্রেণী, আপাতদৃষ্টিতে আগের চেয়ে ভালো, সিগারেট টেনে, বুশ-শার্ট পরে কিংবা সিনেমা হলের সামনে লাইন দিয়ে পেটি-বুর্জোয়া স্তরে ওঠার আকাঙ্ক্ষা করছে। বর্তমান বিবেচনায় এ উভয় শ্রেণীকে বাদ দেয়া নিরাপদ, সেক্ষেত্রে আমরা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সঙ্গে রয়ে গেছি, যার মধ্যে আছে অফিস কর্মী, অধ্যাপক, শিক্ষক প্রমুখ; চীনের ক্ষেত্রেও এমনটি ছিল, অর্থনৈতিক সংকটে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তাদের মধ্যে সৌভাগ্যবান যারা উভয়ই করতে পারে, এবং বাকি যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাদের সক্রিয় পড়ার জন্য সময় খুব কম, বা তাদের যদি সময় থাকে তবে তাদের সংবেদনশীলতা ঘুমিয়ে পড়ে। এই মধ্যবিত্ত জনগণের একটি ছোট্ট অংশ যাদের বলা যেতে পারে বাঙালি লেখক, যারা চারপাশের পরিস্থিতির দ্বারা চালিত হয়ে একটি মানসিক যন্ত্রণায় ডুবে যাচ্ছে যা প্রতি বছর অপেক্ষাকৃত ভারী হচ্ছে।

এটি লেখকের জীবনযাপনের বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে, যা আধুনিক বিশ্বে একটি সর্বজনীন সমস্যা, এবং যার কিছু সমাধান অবশ্যই হওয়া উচিত এবং কারণ স্পষ্টতই বাস্তবতা হল যদি সাহিত্যকে বাঁচতে হয় তবে সাহিত্যকর্মীকে আগে বাঁচতে হবে, এবং একটি বই লেখা হত না যদি না এর লেখক কোনোভাবে জীবনধারণ করতে পারতেন। এমনকি পশ্চিমা দেশগুলিতেও, এমন অনেক লোক নেই যারা শুধুমাত্র লেখক হিসাবে তাদের উপার্জনের উপর বেঁচে থাকতে পারে, বিশেষ করে যদি তারা কবি বা নন-ফিকশন গদ্যের লেখক হন, যেমন ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের ঊনবিংশ শতাব্দীর বেশিরভাগ কবিদের অ-উপার্জিত বা পরোক্ষ আয় ছিল, যা একজন শিল্পীর জন্য সেরা জিনিস; তাদের মধ্যে কেউ কেউ ইয়েটস, জয়েস, ডিএইচ লরেন্স এবং রিল্কে ব্যক্তিগত দাতাদের পৃষ্ঠপোষকতা উপভোগ করেছেন, যা দ্বিতীয় সেরা উপায়; এবং বর্তমানে জীবিত অনেক লেখকদের মধ্যে অনেকে হালকা চাকরিতে কাজ করেছেন বা করছেন, তাদের মধ্যে এলিয়ট অন্যতম, অথবা সাংবাদিক, সম্প্রচারক, প্রভাষক ইত্যাদি হিসাবে তারা তাদের মধ্যম প্রতিভাকে কাজে লাগিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে একটি অবশ্যই বেছে নিতে হবে, এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। আমেরিকায় অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে, তরুণ লেখকদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলি শুষে নিচ্ছে, ফলে তাদের গবেষণার জন্য সাহিত্যকে ছেড়ে দেওয়ার ঝুঁকি রয়েছে; হেনরি মিলার আরেকটি উপায় তৈরি করেছেন, যিনি শহর থেকে দূরে একজন সন্ন্যাসী হিসেবে বসবাস করতে পছন্দ করেন, যদি সন্ন্যাসী এবং লেখকের মধ্যে দ্বন্দ্ব দূর করা যায় তাহলে ঠিক আছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, আমি এটিকে একটি সম্ভাব্য বিকল্প হিসাবে বিবেচনা করি না, কারণ, রাশিয়ার মহান সাহিত্যের বড় ধরনের পতন প্রত্যক্ষ করার পরে, আমি একজন সক্রিয় লেখক হিসাবে বলতে বাধ্য যে এর চেয়ে অন্য যে কোনও কিছুই পছন্দনীয়।

এখন অবধি, বাঙালি লেখকের জীবনযাত্রা কমবেশি একই উপায়ে ধারণ হয়েছে, কেউ কেউ, তাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের পরোক্ষ আয় ছিল; উনিশ শতকের বেসরকারী উদার পৃষ্ঠপোষকতা আজ আর অজানা নয়, এবং লেখকদের একটি আশ্চর্যজনক সংখ্যা প্রতিটি অর্থে আরামদায়ক সরকারী কর্মসংস্থানে রয়েছে। হয় রাষ্ট্রের কর্তব্যগুলোর প্রকৃতি খুব বেশি বদলে গেছে, বা আমাদের লেখকদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে, কারণ সরকারী চাকরীতে তাদের কয়েকজনকে এখন সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে; বেশি প্রচলিত অর্থে, একজন লেখক হলেন কোনও ধরনের শিক্ষক, যার অর্থ দারিদ্র্য, বা কোনও ধরনের সাংবাদিক, যার অর্থ (আবার নাও হতে পারে) বস্তুগত ভরণপোষণের স্থায়িত্ব, তবে এ ক্ষেত্রে সৃজনশীল লেখার ক্ষেত্রে বাধা বা বিকৃত হওয়া প্রায় নিশ্চিত, বা এমনকি লেখক একজন চলচ্চিত্র পরিচালকও হতে পারেন, যার মানে বড় অঙ্কের টাকা এবং লেখক হিসেবে বিলুপ্তি। তিনি একজন সম্প্রচারক, প্রকাশক, বিজ্ঞাপনের জন্য কপিরাইটার, বা এই সমস্তগুলি একসঙ্গেও হতে পারেন। ধনী বণিক শ্রেণী ও বেসরকারী পৃষ্ঠপোষ্ঠকদের ক্রমবর্ধমান অতিরিক্ত লোভের কারণে অস্তিত্বহীন অভিজাতত্বের সঙ্গে ফরমায়েশের অশ্লীলতাও আসে, যদি না কোনও লেখক খুব বেশি ভাগ্যবান হন—তবে তা এখন প্রশ্নাতীত হয়ে গেছে।

তবুও মূল সমস্যাটি এই নয় যে লেখক এই পেশার মাধ্যমে যথেষ্ট উপার্জন করতে পারেন না—কারণ এটি সবসময় এমন হয়েছে—তবে পেশাটি নিজেই পথ হারিয়েছে। তিনি কোনোভাবে প্রচলিত উপায়ে জীবনযাপন করতে পারেন, অথবা তিনি দরিদ্র থাকতেই সন্তুষ্ট হতে পারেন, দারিদ্র সম্পর্কে, রিল্কে ঠিকই বলেছেন, এটা তাকে প্রয়োজনীয় কিছু থেকে বঞ্চিত করতে পারে না। মৌলিক বস্তুগত চাহিদাগুলি ছাড়াও তার জন্য যা অপরিহার্য, তা হল তার রচিত সাহিত্যের গুরুত্ব থাকা উচিত—শুধুমাত্র অন্যান্য লেখকদের কাছে নয়, অন্তত অল্পকিছু সংখ্যক সতর্ক ও বুদ্ধিমান পাঠকদের কাছে, যারা তাকে অনুভব করাবে যে তিনি যা করছেন তা করা মূল্যবান, অর্থাৎ সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয়। এবং ঠিক সেটাই আজ বাঙালি লেখক অনুভব করতে পারেন না, যদি না চরিত্রের এক বিরাট প্রচেষ্টার মাধ্যমে তার চারপাশে জীবন্ত জগতের জন্য জীবন্ত সাহিত্যের ব্যাপারটা থেমে গেছে। তিনি আর জানেন না—যুদ্ধের আগে পর্যন্ত তিনি যা জানতেন—কার জন্য তিনি লিখছেন; লেখক ও পাঠকের মধ্যে সেই সূক্ষ্ম, নীরব যোগাযোগ আর নেই যা একজন শিল্পী হিসাবে তার ধারাবাহিকতার জন্য প্রয়োজনীয়; এবং গুরুতর মৌখিক সমালোচনা খুব কমই হয়, এবং যদিও অন্য কোনো কারণে নাও হয় এই কারণে যে আমাদের নিকট অতীত সাহিত্য সমালোচনার একটি ভাল পরিসংখ্যান দেখায়, বর্তমান পরিস্থিতি খুব কমই একটি কারণেরও অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়। এই ধরনের প্রকাশনাগুলির কঠোরভাবে সীমিত বিক্রয়ের জন্য খরচ অসহনীয়ভাবে বেশি, এবং আমেরিকা এবং ব্রিটেনের মতো রকফেলার ফাউন্ডেশন বা মরগান ট্রাস্ট লেখকদের ভর্তুকি দেয় না। গণরুচির সূচক হিসাবে, কেউ কেউ সমাজের একজন ধনী নারীর মন্তব্য উল্লেখ করতে পারেন, যিনি বইয়ের থেকে চলচ্চিত্রগুলোকে মূল্যায়ন করেছিলেন কারণ একটি চলচ্চিত্র নব্বই মিনিটে একই গল্প উপস্থাপন করে (যেমনটি তিনি মনে করেন) যা পড়তে পুরো দুই দিন সময় লাগে। আমেরিকান বুদ্ধিজীবীদের অভিযোগ কারণ শুধুমাত্র হলিউডের সীলমোহর একটি উপন্যাস বিক্রি করতে পারে, তবে যাই হোক না কেন, আমেরিকায় উপন্যাস অবলম্বনে যে চলচ্চিত্রগুলো তৈরি করা হয় তা এখনও তেমন পারছে না; বই থেকে চলচ্চিত্র যা অদ্ভুত এবং খুব অপ্রচলিত চর্চা যা আজকাল বাংলায় মোটামুটি নিয়মিত। এক্ষেত্রে আমাদের জনতা আমেরিকার জনতাকে পেছনে ফেলেছে যে শুধুমাত্র তারা উপন্যাসটি পড়তে চায় তখন নয় যখন শুধু এটি নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, বরঞ্চ সব সেলুলয়েড হিটকে মুদ্রণ আকারে পড়ার জন্য জোর দেয়, আমাদের সর্বাধিক বিক্রিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে চলচ্চিত্রের দৃশ্য, যা বর্ণনার মতো দেখতে প্যাচআপ করা হয়েছে এবং উপন্যাস হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে।

বিষয়বস্তুগত দিক থেকে, আমাদের প্রবীণ লেখকদের বৃহত্তর সংখ্যক লেখক লেখক হিসেবে রুদ্ধ হয়ে গিয়েছেন। কেউ কেউ, যারা একসময় খুব ভালো কথাসাহিত্যিক ছিলেন, তারা এখন একজন গড় স্কুলছাত্রের মানসিক স্তর নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন; কেউ কেউ রাজনীতিতে জনপ্রিয় সাহিত্য আন্দোলন ও তত্ত্বকে কাজে লাগাচ্ছেন, অথবা তাদের নিজেদের হতাশাকে যুক্তিযুক্ত করতে ব্যবহার করছেন; আমাদের দু-একজন শ্রেষ্ঠ কবি নির্জনে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন। তরুণ লেখকদের ক্ষেত্রে, তাদের প্রতিভাগুলো প্রায়শই Demos-কে খুশি করার প্রকট আকাঙ্ক্ষা এবং সাফল্যের জ্বলন্ত পথের দ্বারা ধ্বংস করা হয় যা অবশেষে একজন চলচ্চিত্র পরিচালকের অবস্থানে নিয়ে যায়। যখন এ দু’টো মিলিত হয়, তখন তারা কাজের চেয়ে প্রচারণা করতে বেশি পছন্দ করে, এটাই হল বই ও আইডিয়ার থেকে বর্তমানে সবচেয়ে প্রচলিত হার। কোনও চরম দুরাবস্থার পরিবর্তে সাধারণ বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষয়িষ্ণুতাকে এই বাস্তবতার জন্য দায়ী হতে পারে যে লেখক নিজেরাই হয় নিয়মিতভাবে আগ্রহী নন হয় সাহিত্যে কিংবা জীবনে সাহিত্যের গভীর মানে-তে, এবং তখন তারা মাঝে মাঝে নিজেদেরকে ছদ্মবেশী করেন যাতে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি হিসাবে উত্তীর্ণ হন। এবং যে কোনও জায়গায় যে কোনো পরিস্থিতিতে এমন অবশ্যই কিছু লেখক রয়েছেন, যেসব লেখকরা স্বতন্ত্র শব্দ উচ্চারণ করার অনিবার্য তাগিদে বিচলিত—যারা নিজেদের বহিরাগত, অনুপ্রবেশকারী, প্রায় নির্বাসিত মনে করেন, তাদের অস্তিত্ব চারদিক থেকে হুমকির মুখে পড়ে, সভ্যতা ধ্বংস হতে পারে না এ তিক্ত ধৈর্য যে বিশ্বাস থেকে আসে, নিজেদেরকে শক্তিশালী করার জন্য আর কিছু না থাকা সত্ত্বেও তা দিয়ে প্রগতিশীল অবনতির সময়ে কোনো ধরনের অপেক্ষা ব্যতীত তারা এক ধরনের গোপন, অপরাজেয় পরিশ্রম চালিয়ে যান। বাংলায় সাহিত্যের শিল্প যদি পুনরুজ্জীবিত হয় তবে তা হবে তাদের পরিশ্রমের মাধ্যমে।

0 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - ভায়লেট হালদার

Posted in






কোন কোন দেশে নারীদের যৌনতা বিষয়ে দীক্ষা দেওয়াকে মানবিক মনে করে এবং এটাকে সামাজিক ভাবেই স্বীকৃতি দেয়া হয়। এরকম একটি দীক্ষা রীতির নাম ‘যৌন শুদ্ধি।’ বেশ কয়েকটি আফ্রিকান দেন এটি একটি প্রচলিত প্রথা। এই যৌন আচার প্রথা অনুযায়ী প্রথম ঋতুমতী কোন কিশোরী এবং সদ্য বিধবা নারীকে কোন পুরুষের সঙ্গে যৌন সঙ্গম করে পরিশুদ্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করা হয়। কিশোরী মেয়েদের ক্ষেত্রে যৌন নির্মূলকরণ আচার এবং কিশোরী থেকে নারীত্বে উত্তীর্ণ হওয়ার একটি ধাপ বা রূপ হিসেবে দেখা হয়।

দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশের নাম মালাউয়ি। এই দেশের দক্ষিণাঞ্চলের গ্রামগুলোতে আছে অদ্ভুত দুইটি প্রথা, তার মধ্যে একটি প্রথার নাম কুসাসা ফুম্বি ( Sexual cleansing) অন্যটি ‘কুলোয়া কুফা।‘ মহামারী, রোগ বালাই থেকে মুক্তি বা কোন বিপদ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে কুসাসা ফুম্বি প্রথার উৎপত্তি হয়েছিল। কুমারী মেয়েদের কুমারীত্ব জীবনের অবসান ঘটাতে অর্থের বিনিময়ে পুরুষ ভাড়া করা হয়। স্থানীয় ভাষায় ‘হায়েনা’ (hyena) একটি পেশার নাম। যে সব পুরুষেরা এই অমানবিক পেশার সঙ্গে যুক্ত তারা ‘হায়েনা’ নামেই পরিচিত। ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার নামে অনিচ্ছা স্বত্বেও অগণিত কিশোরী কন্যা শত লাঞ্চনা গঞ্জনা সহ্য করে মুখ বুজে এই প্রথার শিকার হচ্ছে। কেননা হাজার হাজার বছর ধরে এই প্রথা চলে আসছে। অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে এই প্রথার উদ্ভব হয়েছিল।

‘কুসাসা কুম্বি’ প্রথা অনুযায়ী, কোন কিশোরী প্রথমবার ঋতুমতী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পরিবারের অভিভাবক বাধ্যতামূলক ভাবেই একজন হায়েনাকে অর্থের বিনিময়ে ভাড়া করে থাকেন, ঐ কন্যার সঙ্গে যৌনমিলন করার জন্য। তবে এই কাজের জন্য যে কোন পুরুষকে ভাড়া করা যাবে না। শুধুমাত্র হায়েনাদের দিয়ে এই কাজ করাতে হবে। এই প্রথা অনুযায়ী যৌনমিলনের আগে কিছু রীতিনীতি আছে, সেগুলো পালন করতে হয়। যেমন, সদ্য ঋতুমতী হওয়া কিশোরীকে গ্রামের কয়েকজন নারী গ্রামের ভেতরের একটি জঙ্গলে নিয়ে যায়। সেখানে আগে থেকে একটি ঘর বানানো হয়ে থাকে, যা দীক্ষা শিবির নামে পরিচিত। এই দীক্ষা শিবিরে কয়কজন নারী মিলে কয়েকদিন ধরে কিশোরী মেয়েটিকে বড়দের শ্রদ্ধা করা, রান্না ও গৃহকর্ম, সদাচরণ, শালীনতা, পরিস্কার পরিচ্ছনতা, যৌন আচরন তথা কীভাবে পুরুষকে যৌন আনন্দ দিতে হয়- এই বিষয়ে শিক্ষা দিয়ে থাকে। এই পর্বকে বলা হয় যৌন দীক্ষা অনুষ্ঠান (Sexual initiation rites of girls)। শিক্ষা ও দীক্ষা পর্ব শেষে কিশোরীকে অর্থের বিনিময়ে একজন পুরুষ যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌন মিলন করতে দেয়া হয়, যিনি হায়েনা ‘নামে’ পরিচিত। হায়েনা একটি পেশা এবং তিনি অর্থের বিনিময়ে একজন কিশোরীকে যৌনতার মাধ্যমে যৌবনে প্রবর্তন করেন। যতদিন না সদ্য ঋতুমতী কিশোরী একজন হায়েনার সঙ্গে যৌন সংসর্গ করবে, ততদিন কিশোরী পরিশুদ্ধ হবে না। পরপর তিনদিন ওই কিশোরীকে হায়েনার সঙ্গে থেকে যৌন সংসর্গ করতে হবে অর্থাৎ এটাই কিশোরী থেকে নারীতে উত্তরণের প্রমাণ, এর মধ্য দিয়েই একজন কিশোরী শুচি হয়, তাই এই অনুষ্ঠানের নাম ‘নারী শুচিকরণ।‘ কিন্তু কিশোরী কোনদিন জানতে পারে না যে সে কার সঙ্গে যৌনমিলন করেছে, কেননা যৌনমিলনের সময় কিশোরীর চোখ বাঁধা থাকে। আর এ সব কিছুরই আয়োজন ও ব্যয়ভার বহন করে কিশোরীর পরিবার। কোন কিশোরী কিংবা কোন পরিবার এই প্রথা মানতে অস্বীকার করলে ধরে নেওয়া হয়, ঐ কিশোরীর পরিবার কোন জটিল রোগে আক্রান্ত। অথবা ঐ কিশোরীর পরিবার, গ্রামের দিকে ধেয়ে আসছে কোন দুরারোগ্য ব্যধি, মহামারী, অমঙ্গল ও ভয়ঙ্কর কোন বিপদ। ফলে গ্রামবাসীরা ঐ কিশোরী ও পরিবারের উপর আক্রমণ করে, অত্যাচার করে, সামাজিক ভাবে হেয় করে।

কোন নারীর স্বামীর মৃত্যু হলে শোকপ্রাপ্ত ঐ নারী অশুচি বলে বিবেচিত হন। ফলে স্বামীকে সমাধিস্ত করার আগে সদ্য বিধবাকে শুদ্ধ করতে একজন হায়েনার সঙ্গে যৌনমিলন করতে হবে, এটাই ‘কুলোয়া কুফা’ প্রথা নামে পরিচিত। যদি সদ্য বিধবা নারী গর্ভবতী হয়ে থাকে তবুও তাকে পুরুষ যৌনকর্মী হায়েনার সঙ্গে যৌন সঙ্গম করার মাধ্যমে বিধবাকে শুচি হতে হবে, এটাই তাদের বিশ্বাস।

এই পুরুষ যৌনকর্মী হায়েনাদের অনেকেই এইডস আক্রান্ত। এদের মধ্যে মালাউয়ির একজন হায়েনার নাম এরিক আনিভা। তিনি দুই স্ত্রী ও পাঁচ সন্তানের জনক। এরিক আনিভা এইডসে আক্রান্ত হয়ে ভুগছেন বহুদিন ধরে। কয়েক বছর আগে বিবিসি’র প্রায় ২৭ মিনিটের একটি রেডিও রিপোর্ট ‘Stealing innocence in Malawi’এ প্রচারিত হয়েছিল। এই সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে তার স্বীকারোক্তিতে তিনি দম্ভ করে বলেছিলেন, ‘ আমি মোট ১০৪জন কিশোরী ও বিধবা নারীর সঙ্গে যৌন সংগম করেছি। তবে এর মধ্যে বেশীরভাগই ছিল ১২/১৩ বছর বয়সী স্কুল পড়ূয়া কিশোরী। তাদের প্রত্যেকে আমাকে দৈনিক কর্মমূল্য হিসেবে চার থেকে সাত ডলার দিত। তাদের সঙ্গে শারীরিক মিলন করে আমার ভাল লেগেছে, আমি জানি মেয়েগুলোরও। সব মেয়েই তাদের হায়েনা হিসেবে আমাকে পেয়ে গর্ববোধ করে। তৃপ্ত মেয়েরা অন্য মেয়েদের বলে, আনিভা হচ্ছে প্রকৃত পুরুষ। অনিভা জানে, কিভাবে একজন নারীকে আনন্দ দিতে হয়।‘

আনিভা এই কুপ্রথা টিকিয়ে রাখা ও নিজের উপার্জনের স্বার্থে গর্ব করে এইসব কথা রেডিও সাক্ষাৎকারে প্রচার করলেও অনেক মেয়েই জানিয়েছে, তারা নিতান্তই অনিচ্ছায় আনিভার সঙ্গে শারীরিক সংগম করতে বাধ্য হয়েছে। কারণ তারা যৌন সংগমের মাধ্যমে যৌন শুচি না হলে তাদের বাবা-মা ও পুরো পরিবারের উপর আক্রমণ করতো গ্রামবাসী। সামাজিক ভাবে প্রচলিত এই প্রথা মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই বলে মন্তব্য করেন মারিয়া নামের একজন কিশোরী। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে যৌনমিলন না করার ফলে, অনেক নারী যৌন বাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। কেউ কেউ বা গর্ভবতী হন। ফলে অনেক নারীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে অমানবিক ও বিভীষিকাময় জীবন যাপন করেন।

বিবিসির রিপোর্টের এক সপ্তাহ পরেই মালাউয়ের রাষ্ট্রপতি পিটার মুথারিকার নির্দেশে এরিক আনিভা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এইচআইভি পজেটিভ হওয়া স্বত্বেও তিনি তা গোপন রেখে অর্থের বিনিময়ে যৌন সংগম করার জন্য তাকে মাত্র দুই বছরের কারদণ্ড দেয়া হয়েছিল।

মালাউয়িতে এই কুপ্রথার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে ‘প্রজেক্ট ডিগনিটি’ নামের মানবাধিকার একটি সংগঠন। ১৩/১৪বছর বয়সে এই কুপ্রথার শিকার হয়েছিলেন মানবাধিকার কর্মী নাতাশা অ্যানি টনথলা। এই প্রথার বিলুপ্তি জন্য প্রাণপণে লড়াই করে চলেছেন বহুদিন ধরে।

এছাড়াও আফ্রিকা মহাদেশের জাম্বিয়া, উগান্ডা, তানজানিয়া, কেনিয়া, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, আইভরি কোস্ট, কঙ্গোর বিভিন্ন অঞ্চলে এই প্রথা এখনো টিকে আছে। মোটকথা, নারী অনিচ্ছায় নারীর সঙ্গে যৌনক্রিয়া করা ধর্ষণের সামিল। ‘কুসাসা ফুম্বি’ ও ‘কুলোয়া কুফা’ প্রথা মুলত আনুষ্ঠানিক ভাবে ঢাকঢোল পিটিয়ে নারীকে ধর্ষণ করার স্বাধীনতা ও অধিকার পুরুষেরা পেয়ে থাকে। এই প্রথা নারীর মানবিক অধিকার লঙ্ঘন করে, নারীকে লাঞ্চিত ও মর্যাদাহানি করে নারীকে পুরুষতন্ত্রের দাসী বানিয়ে রাখতে বাধ্য করে। নারীর প্রতি বৈষম্য এবং সকল প্রকার অমানবিক প্রথার বিলুপ্তি হতে আর কত দেরী?

0 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - দীপকরঞ্জন ভট্টাচার্য

Posted in






রোরো নদীর জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই বালক। জল থাকলে পাথরও থাকে, তাই সে চেয়ে দেখছে এদিক ওদিক। আরে, ওই তো পাথর! এদিকে বুক পকেট থেকে তার উঁকি দেয় পালক। পালক মানেই তো পাখি! পাখির ভিতর নারী। আর পাথরে ঘুমোয় এক জখম পুরুষ। সেই মেয়েকে একা ছলছলে জলে ঠেলে দিতে সাহস হয় না তার। যায় যদি, হাতে হাত ধরে যাক। তাহলে তো তার এক সঙ্গীর প্রয়োজন। চলো পুরুষ, জল-আগুনের সঙ্গী হও, এই বলে সে পাথরে পালকটুকু জড়িয়ে ছুঁড়ে দেবে ভাবে। আরও ভাবে, সে নিজেই তবে কি সেই পাথর? তার বুকেও কি লুকিয়ে আছে কোনো সাতরাঙা পালকের পাখি? ... এইখানে এসে আমাদের একবার দু'চোখ বুজে ফেলতে হয়। খুলে নিয়ে দেখি, সেই বালক কোত্থাও নেই। আছে কি সেই রোরো নদীও? আর সেই পালকের মতো নরম এক নারী :

'রোরো নদীর ধার থেকে ঐ একটি বালক/ কুড়িয়ে পেয়েছিল রঙিন বুকের পালক/এবং একটি পাথর পেয়ে, সেই পালকে/ জড়িয়ে,ছুঁড়ে দিয়েছিল এপার থেকে/ পালক কি আর একাকিনী ওপার যাবে?'

বোর্খেসের 'সারকুলার রুইনস' গল্পটা মনে পড়ে তোমার? সেই যে... একটা লোক ভাবত দিনরাত শুধু স্বপ্ন দেখবে, সেই স্বপ্নই হবে তার ইচ্ছেপুরণের চাবিকাঠি। সেই স্বপ্নগুলোই তার আসল জীবন আড়াল করা প্রকৃত জীবন। নানান ব্যর্থ চেষ্টার পরে একদিন হঠাৎ স্বপ্নের সঙ্গে তার একরকম সমঝোতা হয়ে যায়। স্বপ্নের কামারশালার আগুনে আর আঘাতে সত্যি সত্যিই তারপর সে এক ইচ্ছামানুষ হয়ে উঠল! হৃৎপিন্ড থেকে চোখের পাতা অবধি সমস্ত কিছুতে :

'এবার বসন্তকালে বৃষ্টি হল স্বপ্নের ভিতর/ স্বপ্নের ভিতর হল বজ্রপাত'

'গভীরতা পড়ে থাকে, উপরে লাফায় তারই জল/ রমণীর সাজ আর স্বরূপের বিরোধের মতো/ এবং স্বপ্নের মতো মুহূর্তকে আক্রমণ করে, ফসফরাস, শাদা সিঁড়ি...'

স্বপ্নের ভিতর নিজেকে গড়ে নিতে নিতে সারাজীবন যিনি একটিমাত্র কবিতাই লিখে গেছেন, তাঁর নাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়। তাঁর কবিতার লাইনগুলোর আড়ালে মনের এক সাতমহলা বাড়ি মুখ ডুবিয়ে থাকে। যেন একটা পুকুরের মধ্যে ডুব দিয়ে আর ভেসে না ওঠার খেলা, যতক্ষণ ডুবে থাকা যায় ততক্ষণ যা দেখা-জানা হল, তাই দিয়েই কবিতা লেখা! তাই বোধহয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থেই আমরা 'পাতাল থেকে ডাকছি' শিরোনামের একটি কবিতা পেয়ে যাই! পাতাল থেকে ডাকছি --- প্রকাশ্যের প্রকাশ নয়, গহন আজানার রহস্যময় উন্মোচন! আমাদের কল্পনা আর চেতনার দুয়ারেই তাঁর কবিতা কড়া নাড়ুক, এ-যেন তাঁরই চাওয়া।

দু'টুকরো হয়ে বাহির-ভিতরে ছড়িয়ে প'ড়ে, নিজেই নিজের ছায়া হয়ে, দর্শক এবং শ্রোতা হয়ে, নারী এবং পুরুষ হয়ে, স্বপ্নাবিষ্ট বালক এবং আশ্চর্য জাদুকর হয়ে, তারই মতো ইজের গুটিয়ে এক সম্মোহিত মিছিলের পায়ে পা মেলায় তাঁর কবিতা। সঙ্গে থাকেন তাঁর পথভোলা ঈশ্বর।তাঁকে ডাকলে তিনি বালক কবির হাত ধরে চৌরঙ্গীর ছটফটে ব্যস্ত মোড় পার করে দেবেন। কখনো ঘুম থেকে জেগে ওঠার আকুতি -- সে-জেগে ওঠাও বোধহয় আরও এক স্বপ্নচুড়োর দিকে ঢলে পড়া --- কখনো ঘুমেই চিরসমর্পণ :

'সেগুনমঞ্জরী হাতে ধাক্কা দাও, জাগাও আমাকে/আমি আছি বিষঘুমে, জাগাও আমাকে/...জাগাও আমাকে তুমি গাছের মতন/ দীর্ঘদেহী গাছ, ঐ গাছের মতন/ পাতায় পাতায় জাগবে অরণ্যকুহেলি/...আমাকে জাগাও তুমি হলুদের মাঠে/ চঞ্চল হরিণ এসে সম্মুখে তাকাবে/...আমাকে জাগাও তুমি সেই পদ্মবনে/যেখানে ছোবল দেবে সাপে সর্বক্ষণ ... শুধু জাগরণ চাই, বারেক জীবন!' (অংশ)

'কেউ কি কখনো জাগে? নিভন্ত ঘুমন্ত রোরো নদী,/ স্বপ্নের ভিতরে চলে জলোচ্ছল, জলোচ্ছল; বেগে/ ঘুমের নিজস্ব এক প্রাপণীয় অন্ধকার আছে।'

তাঁর সম্বন্ধে শুধু এইটুকু বলা যায়, যে তাঁর আছে এক তীব্র হাতছানির মালিকানা -- স্বপ্নমঞ্জরির ঘ্রাণ তাঁর সারা পথে। বাইরের থেকে কথা তুলে নিয়ে, বাইরের কথা বলতে গিয়ে, হয়তো নকশাল আন্দোলনের ভয়াবহ দিনগুলোর কথাই সেইসব --- টানে-টোনে মনে ভর দেওয়াই শক্তির স্বভাবজাত। যা দেখছি তাই যেন শেষ কথা নয়, তার একটা 'ভিতর' আছে, একটা মনের-দেখার দিক আছে! সেইজন্যেই হয়তো তাঁর কবিতায় 'ভিতর' কথাটির এতবার যাতায়াত। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পুতুল নাচের ইতিকথায়' শশী ডাক্তার কুসুমকে কী বলেছিলেন, মনে পড়ে তোমার? -- ' শরীর! শরীর! তোমার কি মন নাই কুসুম?'

' "হ্যান্ডস আপ্" ---হাত তুলে ধরো --- যতক্ষণ পর্যন্ত না কেউ তোমাকে তুলে নিয়ে যায়/ কালো গাড়ির ভিতরে আবার কালো গাড়ি, তার ভিতরে আবার কালো গাড়ি/ সারবন্দি জানলা, দরজা, গোরস্থান --- ওলোটপালোট কঙ্কাল / কঙ্কালের ভিতরে শাদা ঘুণ, ঘুণের ভিতরে জীবন, জীবনের ভিতরে মৃত্যু --- সুতরাং / মৃত্যুর ভিতরে মৃত্যু/ আর কিছু নয়!'

রহস্যময়তার জন্যেই তো কবিতার কাছে যায় মানুষ! যা কিছু জানার বাইরে --- প্রেম, মৃত্যু, শরীরের অগুন্তি আগুনশিখা -- সে-সব ছুঁয়ে দেখতেই কবিতার কাছে যাওয়া। সেখানে নারীও 'কালবেলা'-র 'মাধবীলতা'র মতো মনোময়, প্রতিদিনের নারী সে নয়! সে তবে কে? মধুলোভী কোনো সোনার অলীক ভ্রমর! তাকে নিয়ে একা একাই খেলার ভিতরে ঢুকে যান কবি, যেখানে আর কেউ কোত্থাও নেই। তাকে দূর থেকে গোপন দৃষ্টিজ্বরে পুড়িয়ে দিতে চেয়ে থাকেন শুধু। তাকে পাবার-হারাবার অভিঘাতে টুকরো টুকরো হয়ে শেষ অবধি ভেঙে পড়েন:

'আমি সোনার একটা মাছি খুন করেছি রাতদুপুরে/...খুন করে নীল ভালোবাসায় চমকপ্রদ জড়িয়ে গেলাম।।' (অংশ)

'এই খেলাটি একলা আমার, খেলব -- যেন তার কপালের/ কাঁচপোকাটি তেমনি থাকে, চারদিকে জল, খন্দ-খানা/ কেশ করেছি আবোল-তাবোল, চুম্বনে ঐ দগ্ধ গালের/ আধখানা খাই, আধ্লা রাখি --- বুক ভরে বাস হাস্নুহানার/ এই খেলাটি একলা আমার, তোর সেখানে খেলতে মানা।' (অংশ)

'কী তুমুল বৃষ্টি হল শান্তিনিকেতনে... / ডুবে গেল কাশ ফুল, ভেসে গেল ঝরা শিউলি তলা। /... কাঁকর লেগেছে স্তনে, মাথা ভর্তি কাঁকরের ফুল,/ দুহাতে সরাই সব, তোমার স্বপ্নের মতো দেহ ---/ বাহু গন্ধে নুন জল, যতক্ষণ মেঘ থাকে ভালো।'

'আমার রমণী শুয়ে, দুই পাশে দুটি মাছরাঙা / আমার সর্বস্ব আজ ভাঙা/ আমার সর্বস্ব আজ ভাঙা।/ হাত পা ও বুকের পাঁজর / চারিদিকে অক্ষর অক্ষর/ চারিদিকে অক্ষর/...আর কিছু নেই!'

মিলনশেষের এক ক্লান্ত আলুথালু নারীর চারিদিকে এত অক্ষর

0 comments:

0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in






৩৬

অল্পবয়সী যে মহিলাটি টেবিলে বসেছিল, সে ফাইনহালসের দিকে মুখ তুলে তাকাল। ফাইনহালস লক্ষ্য করল যে ওই মহিলার হাতের আঙুলগুলো ভারি সুন্দর, সরু সরু এবং মাটিতে থেবড়ে বসে মেঝের ভাঙা টালির উপর দিয়ে যে বাচ্চাটা নিজের খেলনাগাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, তার হাতও অমন সাদাটে, সরু সরু। ছোট ঘরটার মধ্যে কেমন যেন ভ্যাপসা ধোঁয়া ধোঁয়া তেলমশলা মেশানো রান্নার গন্ধ। দেওয়ালে চার দিকে রান্নার কড়াই, বাসনপত্র ঝোলানো, সাজানো।

যে বয়স্ক পুরুষটি ঘরের জানালার কাছে একটা চেয়ারে বসে বাইরে উঠোনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, ঘরের দু’ জন মহিলাই মুখ ফিরিয়ে এবার তার দিকে তাকালো। সেই মানুষটি একটা চেয়ারের দিকে আঙুল দেখিয়ে ফাইনহালসকে বললেন, ‘প্লিজ বসুন!’

ফাইনহালস বয়স্ক মহিলার পাশের চেয়ারে বসে। সে বলতে থাকে… ‘আমার নাম ফাইনহালস। আমার বাড়ি ভাইডেসহাইমে। আমি বাড়ি ফিরছিলাম…’

দু’ জন মহিলা পরস্পরের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। বয়স্ক পুরুষটি নড়েচড়ে বসে।

তাকে উজ্জীবিত দেখায়… -‘ফাইনহালস… ভাইডেসহাইম থেকে… ইয়াকব ফাইনহালসের ছেলে নাকি?’

-‘হ্যাঁ,… কিন্তু ভাইডেসহাইমের খবরাখবর কী?’

বয়স্ক মানুষটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে একগুচ্ছ মেঘের মত ধোঁয়া ছাড়েন পাইপ থেকে… ‘খারাপ নয়। ওরা ঠিকঠাকই আছে। আসলে ওরা অপেক্ষা করছে যাতে আমেরিকানরা এসে ওদের জায়গাটার দখল নেয়। কিন্তু আমেরিকানরা ওই জায়গাটা অবধি যাচ্ছেই না। ওরা এখানে এসে তিন সপ্তাহ ধরে বসে আছে। ভাইডেসহাইম পর্যন্ত আর দু’ কিলোমিটার মাত্র; কিন্তু ওই অবধি গেল না ওরা। শুনেছি ওখানে জার্মানরাও নেই। ফলে ওইটা এখন নেই মানুষের বেওয়ারিশ জমি। কারুর মাথাব্যথা নেই… এই অবস্থাটা অবশ্য বেশিদিন চলতে পারে না।

‘মাঝেমধ্যে শুনতে পাচ্ছি জার্মানরা গুলিগোলা ছুঁড়ছে…’ অল্পবয়সী মহিলাটি বলে ওঠে… ‘কিন্তু খুবই কম শোনা যায়।’

‘হ্যাঁ, শুনতে পাবেন।’ বলে বৃদ্ধ মানুষকে ফাইনহালসের দিকে আগ্রহভরে তাকায়… ‘এখন আপনি কোত্থেকে এলেন?’

‘ওই দিকে, আমরা অপেক্ষা করছিলাম তিন সপ্তাহ ধরে… যে আমেরিকানরা আসবে’

‘রাস্তার ওই পারে?’

‘নাহ, আরেকটু দক্ষিণে- গ্রিনজ্‌হাইমের কাছে।’

‘আচ্ছা, গ্রিন্‌জহাইম। সেখান থেকে এলেন এখন?’

‘হ্যাঁ, রাতে ওইখানেই ছিলাম।’

‘তারপর সেখানে সিভিলিয়ানের পোশাক পরে নিলেন?’

ফাইনহালস মাথা নাড়ে… ‘নাহ, সাধারণ পোশাক আগেই পরেছিলাম। ওরা এখন প্রচুর সৈনিককে ছাঁটাই করছে।’

বয়স্ক মানুষকে শান্তভাবে হাসেন। অল্পবয়সী মহিলার দিকে তাকান… ‘শুনছ, ট্রুড… ওরা নাকি প্রচুর সৈনিককে এখন ছাঁটাই করছে। ওহ, শুনে এখন আর কী বা করবে? হাসবে…’

অল্পবয়সী মহিলাটির আলু ছাড়ান হয়ে গেছে। সে আলুগুলোকে ঘরের কোণে বেসিনে কলের নিচে একটা ঝাঁঝরিযুক্ত পাত্রের মধ্যে মধ্যে রেখেছে। কল খুলে ক্লান্ত হাতে আলুগুলো ধুতে লাগল সে। বয়স্ক মহিলাটি ফাইনহালসের হাত স্পর্শ করল…

‘সত্যিই এখন অনেক মানুষকে ছাঁটাই করছে?’

‘অনেক’ বলে ফাইনহালস… ‘কোনো কোনো ইউনিটে শুনেছি সবাইকে ছাঁটাই করেছে… বাকিরা গিয়ে সব রুর উপত্যকায় জড়ো হচ্ছে। কিন্তু আমি রুরে যাইনি।’

অল্পবয়সী মহিলাটি বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে। নিঃশব্দে কাঁদছে সে। সরু কাঁধদুটো কান্নার দমকে কেঁপে উঠছে।

‘নাকি কাঁদবে…’ জানালায় বসে থাকা বয়স্ক পুরুষটি বলে ওঠেন… ‘হাসবে না কাঁদবে!’ ফাইনহালসের দিকে একবার তাকিয়ে আবার হাতের তামাকের পাইপ দিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অল্পবয়সী মহিলার দিকে নির্দেশ করে বলে ওঠে… ‘তোমার স্বামী চলে গেল… আমার ছেলেটা!’ মহিলা ধীরে ধীরে সাবধানে আলুগুলো ধুতে থাকে এবং কাঁদতে থাকে… ‘হাঙ্গেরিতে, গেল বার হেমন্তের পাতা ঝরার সময়ে’ বলে ওঠেন বয়স্ক লোকটি।

‘গ্রীষ্মে, হেমন্তে নয়’… ফাইনহালসের পাশে বসে থাকা বয়স্ক মহিলাটি বলে ওঠেন, ‘ওকে ছেড়ে দেবে শুনেছিলাম, বেশ কয়েক বার ছাড়বার কথা হয়েছিল। ওর তো শরীরটা একেবারেই ভালো ছিল না, খুব কষ্ট করে চালাচ্ছিল। কিন্তু ওকে কিছুতেই ওরা ছাড়ছিল না। ওর উপরে ক্যান্টিনের দায়িত্ব ছিল যে।’ তিনি মাথা নাড়েন, আর অল্পবয়সী মহিলার দিকে তাকান। সে সাবধানে ধোয়া আলুগুলোকে একটা পরিষ্কার কেটলির মধ্যে রেখে বেশ কিছুটা জল ঢালে। সে এখনও কাঁদছে, নিঃশব্দে কেঁদে যাচ্ছে। চুলার উপরে কেটলিটা বসিয়ে এককোণে যায় সে। পোশাকের পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে।

ফাইনহালস বুঝতে পারে যে তার মুখটা ধীরে ধীরে ঝুলে পড়ছে। সে ফিঙ্কের সম্বন্ধে ভাবে না খুব একটা। মাঝেমধ্যে মনে পড়ে মুহূর্তটা। কিন্তু এই মুহূর্তে সে তীব্রভাবে ভাবছে। মনে মনে ভাবতে ভাবতে ওই মুহূর্তগুলো সে আরও পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছে। এতটা পরিষ্কার যখন বাস্তবে ঘটনাটা ঘটেছিল, তখনও হয়তো সে দেখেনি। সেই প্রচণ্ড ভারি স্যুটকেসের মধ্যে হঠাৎ গ্রেনেডের ফুলকি এসে পড়ল, স্যুটকেসের ঢাকনাটা উড়ে গেল, চারদিকে ফোয়ারার মত ওয়াইন ছিটকে পড়ল, উফফ, কাচের ভাঙা টুকরো ছড়াতে লাগল চারদিকে; ফিঙ্কের চেহারাটা যে এত ছোটখাট, সেটা সে খেয়াল করেনি যতক্ষণ না তার শরীরের বিরাট রক্তাক্ত ক্ষতের উপর হাত রেখে পরক্ষণেই সে তার হাতটা সরিয়ে নিয়েছিল…

বাচ্চাটা মেঝের উপরে বসে খেলছিল। ফাইনহালস একদৃষ্টে বাচ্চাটার দিকেই তাকিয়েছিল। মেঝেতে যে জায়গাটাতে টালিটা ভেঙে গেছে, বাচ্চাটা ঠিক সেই জায়গাটা ঘিরে খেলনা গাড়িটা চালিয়ে যাচ্ছে। ছোট ছোট জ্বালানি কাঠের টুকরো ওই গাড়িটায় বোঝাই করছে, নামিয়ে রাখছে, আবার বোঝাই করছে। হাতের আঙুলগুলো সূক্ষ্ম, সরু, সরু এবং তার মায়ের মতই ধীরে ধীরে ক্লান্ত ভঙ্গিতে সাবধানী আঙুলের নড়াচড়া শিশুটির। বাচ্চাটির মা এখন টেবিলে এসে বসেছে, মুখের অর্ধেকটা ঢেকে রুমাল দিয়ে চেপে আছে। ফাইনহালসের দেখে খুব কষ্ট হচ্ছিল। একবার মনে হল যে সে বলে ফিঙ্কের মৃত্যুর ঘটনাটা তার চোখের সামনে ঘটেছিল। কিন্তু সে দ্রুত মুখটা বন্ধ করে মাথা নামিয়ে বসে। তারপর চিন্তা করে যে পরে না হয় বলবে। বৃদ্ধ মানুষটিকে বলবে। কিন্তু এখন নয়…

যাই হোক, ফিঙ্ক হাসপাতালের ক্যান্টিন থেকে কী ভাবে হাঙ্গেরিতে গিয়ে পৌঁছালো, সেটা নিয়ে মনে হয় ওদের এখন আর সেরকম কোনো মাথা ব্যথা নেই।

বয়স্ক মহিলাটি আবার তার হাতে স্পর্শ করে… ‘আপনার কী হয়েছে? কিছু খাবেন? শরীর ঠিক আছে তো?’

‘না, আমি ঠিক আছি।’ বলে ওঠে ফাইনহালস, ‘অনেক ধন্যবাদ!’ বয়স্ক মহিলাটির তীব্র দৃষ্টির সামনে তাঁর অস্বস্তি হয়, ‘সত্যিই কিছু খাব না। অনেক ধন্যবাদ!’

‘এক গ্লাস ওয়াইন’ জানলার কাছ থেকে বৃদ্ধ মানুষটি প্রশ্ন করে, ‘কিম্বা শ্নাপ?’

‘হ্যাঁ’ বলে ফাইনহালস, ‘এক গ্লাস শ্নাপ খেতে পারি।’

‘ট্রুড’ ডাকেন বৃদ্ধ মানুষটি, ‘এই ভদ্রলোককে একটা শ্নাপ দাও।’

অল্পবয়সী মহিলাটি টেবিল থেকে উঠে পাশের ঘরে যায়।

‘আসলে আমরা খুব ছোট জায়গায় থাকতে বাধ্য হচ্ছি এখন’… বয়স্ক মানুষটি বলেন ফাইনহালসকে।

‘শুধু রান্নাঘর আর খাবার ঘর’… বলেন বয়স্ক মহিলাটি… ‘তবে ওরা বলছে যে শীগগির বেরিয়ে যাবে এখান থেকে। সঙ্গে অনেক ট্যাঙ্ক আছে। তাছাড়া বন্দিদেরও এই জায়গাটা থেকে অন্যত্র চালান করবে শুনছি।’

- ‘এই বাড়িতে কোনো বন্দি আছে?’

--‘হ্যাঁ’… উত্তর দেন বয়স্ক পুরুষটি… ‘বড় হলঘরে যুদ্ধবন্দিরা আছে। শুধু উচ্চপদস্থ অফিসারদের এখানে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এমনকি এদের মধ্যে একজন জেনারালও আছেন। জিজ্ঞাসাবাদ হয়ে গেলে, এরা চলে যাবে। দেখুন ওদিকে!’

ফাইনহালস জানালায় গিয়ে দাঁড়ায়। বয়স্ক মানুষটি দ্বিতীয় উঠোনের সামনে যেখানে রক্ষীরা পাহারা দিচ্ছে, সেই জায়গাটা ছাড়িয়ে মূল প্রবেশপথের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। ছোট হলঘরটা পেঁচানো কাঁটাতার দিয়ে ঘিরে রাখা।

‘ওই যে, লক্ষ্য করুন’ বলেন বয়স্ক মানুষটি… ‘একজনকে নিয়ে আসা হচ্ছে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।’



(চলবে)

0 comments:

0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(১২)

গোলকপতির খুব ইচ্ছা করছিল যে সামনে দাঁড়িয়ে থেকে এই অন্যায় সতীদাহ প্রথাটির তীব্র বিরোধিতা করে। কিন্তু একে সে বিদেশি তায় রাজবাড়ির দয়ায় সবেমাত্র কোনওমতে একটা জীবিকার উপায় হয়েছে, সেই অবস্থায় এরকম একটা গন্ডোগোলে জড়িয়ে পড়াটা মোটেও সুবিধের হবে না।

তার একবার মনে হল যে একছুটে মেয়েটিকে উদ্ধার করে নিয়ে কোথাও চলে গিয়ে আবার সংসারী হয়।

পরক্ষণেই তার আবার মনে হল যে নিজের জীবিকাই যেখানে অনিশ্চিত , সেখানে আর একজন জীবনসঙ্গিনীর যোগ্য হয়ে উঠতে গেলেও তার যেটুকু স্থৈর্য্য প্রয়োজন সেটা তার আজও ফিরে আসেনি।

ক'দিন হল রাতে চোখ বুজলেই ও দেখতে পাচ্ছে যে লক্ষ্মীমণির রোগক্লান্ত মুখের অতন্দ্র আঁখিপল্লবদুটি অস্ফূটে ওর দিকে তাকিয়ে থেকে চাইছে আগামীকালের এক অবধারিত পটপরিবর্তনের ইঙ্গিতসহ পুনর্যাপনের প্রতিশ্রুতিটি।

কিন্তু সমস্যা হল যে এই নারীটি তার সম্পূর্ণ অপরিচিত। বৃদ্ধ স্বামীটির মৃত্যুর পূর্বে সে একজন অচেনা পুরুষের সাথে কূলত্যাগিনী হওয়ার সাহস সে কেন দেখাবে?

.....

হিন্দু রমণীদের কাছে পরপুরুষের কাছে ভ্রষ্টা হওয়ার চেয়ে অগ্নিস্নানে পূণ্যবতী হওয়াটাই তো এতকাল ধরে বাঞ্ছনীয় ও কাম্য হয়ে এসেছে! রাজপুত নারীদের সতী মাহাত্ম্য সম্পর্কিত সব কাহিনি তো এ দেশের গ্রামেগঞ্জেও ভাট মুখে বরাবর প্রচারিত হয়ে এসেছে তাই এ মেয়েটিকে উদ্ধারকর্মের ঈপ্সাটি যেন আকাশকুসুম সদৃশ ভিত্তিহীন বটে।

.........

দ্বারকানাথ এগিয়ে এসে সহাস্যবদনে রামমোহনের ভৃঙ্গারটি থেকে কয়েকটি আখরোট আর বাদাম তুলে নিয়ে বললেন,

" কাল অবধি সতীদাহের বিপক্ষে মাত্র সতের'জন বিশিষ্টের মুসাবিদা যোগাড় করা সম্ভবপর হইয়াছে। শুনিয়াছি পাথুরিয়াঘাটায় আমার জ্ঞাতিভ্রাতাদের এ বিষয়ে এখনো কিছু আপত্তি আছে।

তবে যেহেতু ভ্রাতৃবরের সদ্যজাত পুত্রটির অন্নপ্রাশন অনুষ্ঠানে কাল আমি নিজে উপস্থিত থাকব, তাই আমি আশা করি যে তোমাকে আরও দ্বাদশ সংখ্যক অভিজাত জমিদারের এ বিষয়ে সমর্থনটি স্বাক্ষরিত অবস্থায় এনে দিতেও সক্ষম হব। আবার যখন সপ্তাহান্তে আমি রাণীগঞ্জে দুটি কয়লাখনি ক্রয় করতে যাবো তখন নিকটের মানভূম অঞ্চলে গড় পঞ্চকোটের রাজাটির সহিত সাক্ষাৎ করে এই একই বিষয়ের প্রসঙ্গটি তুলে তাঁহার মতামতটিও জেনে আসব বলে মনস্থ করেছি।শুনছি এই জমিদারেরা বঙ্গালভাষী না হলেও বেশ সজ্জন প্রকৃতির। এই রাজারা বর্তমানে আদিবাসী অধ্যূষিত কাশীপুরে একটি সুরম্য চন্ডী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন ও দরিদ্র প্রজাদের নাকি সপ্তাহান্তে অন্ন-বস্ত্র-অর্থ সবই ওঁদের রাজভান্ডার থেকে সসম্মানে সেবাকর্মের নিমিত্তে দান করে থাকেন। "

....

রামমোহন এবার সপ্রশংস হাসিতে বন্ধুবরের দক্ষিণহস্তের করাঙ্গুলীগুলি নিজের বক্ষে খানিকক্ষণ চেপে ধরে রেখে বললেন,

" লাটসাহেব শর্ত দিচ্ছেন যে এই মুসাবিদাটি আরো পঞ্চদশ সংখ্যক বিশিষ্টজনের স্বাক্ষর সমণ্বিত হলেই উনি স্বয়ং শীতকালীন অধিবেশনে সতীদাহ বিরোধী বিষয়ক পত্রটি পুনরায় বিলাতে প্রেরণ করতে পারবেন।

তবে তুমি যদি নিজের উদ্যমে আজ অবধি যে কয়েকটি সহি সংগ্রহ হয়েছে তাহার সাথে আরো দ্বাদশজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সমর্থন সংগ্রহ করে আনতে পারো তাহলে আমিও নিজের উদ্যোগে তদুপরি আরও সপ্তসংখ্যকটি সমর্থনসূচক স্বাক্ষরের সংগ্রহকার্য্যটিও অবশ্যই সফল হয়ে লাটভবনে পুনরায় হিজ হাইনেস বেন্টিঙ্কের দরবারে যেতে পারব।

তবে যেহেতু আমি পৌত্তলিকতা বর্জন করেছি সেহেতু পাথুরিয়াঘাটাস্থিত উক্ত অনুষ্ঠানভবনে নিমন্ত্রণ পেয়েও এমতাবস্থায় অন্নগ্রহণ করতে পারব না বটে; তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে এখন তুমিও ক্রমে স্বয়ং কালান্তরের সরব তূর্যনিনাদটির যোগ্য হয়ে উঠছ ! আজ যে আমি সত্যি বড় সন্তুষ্ট হে বেরাদর ! "

অতঃপর এই দুই কালান্তরের সেনানায়ক উভয় উভয়কে একটি উষ্ণ ও দৃঢ় আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন।

0 comments:

1
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in








শিবপালগঞ্জ গাঁ বটে, কিন্তু বসেছে শহরের কাছালাছি বড় রাস্তার ধারে। অতএব বড় বড় নেতা ও অফিসারকুলের এখানে আসতে কোন নীতিগত আপত্তি হওয়ার কথা নয়। এখানে শুধু কুয়ো নয়, টিউবওয়েলও আছে। বাইরে থেকে দেখতে আসা বড় মানুষেরা তেষ্টা পেলে প্রাণসংশয় না করেই এখানকার জল খেতে পারেন। এইসব ছোটখাট অফিসারের মধ্যে কোন না কোন এমন একজন দেখা দেন যে তাঁর ঠাটবাট দেখে স্থানীয় লোকজন বুঝে যায় যে এ এক্কেবারে পয়লা নম্বরের বেইমান। অথচ ওকে দেখে বাইরের লোকজন নিজেদের মধ্যে বলাবলি করে—কী ভদ্র, কী ভালো!নিশ্চয় কোন বড় ঘরের থেকে এয়েচে।দেখ না, আমাদের চিকো সায়েব এর সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়েছে। ফলে খিদে পেলে এঁরা নিজেদের চরিত্রে কোন দাগ না লাগিয়েও বিনা দ্বিধায় এখানে খেয়ে নিতে পারেন। কারণ যাই হোক, সেবার শিবপালগঞ্জে জননায়ক আর জনসেবক—সবার আনাগোনা বড্ড বেড়ে গেছল। শিবপালগঞ্জের বিকাস ও উন্নয়ন নিয়ে সবার বড্ড চিন্তা। তাই তারা যখন তখন লেকচার দিতে থাকেন।

এই লেকচারপর্বটি গঞ্জহাদের জন্যে ভারি মজার। কারণ এতে গোড়ার থেকেই বক্তা শ্রোতাকে এবং শ্রোতা বক্তাকে হদ্দ বোকা ধরে নেয়। আর এটাই সব গঞ্জহা্দের জন্যে আদর্শ পরিস্থিতি বটে! তবু, লেকচার এত বেশি হলে শ্রোতাদের পক্ষে হজম করা কঠিন হয়ে পড়ে! লেকচারের আসল মজা হল—যখন শ্রোতা বুঝে যায় লোকটা ফালতু বকছে আর বক্তা নিজেও বোঝে যে ও ফালতু বকবক করছে। কিন্তু কিছু লোক এমন গম্ভীর মুখে লেকচার দেয় যে শ্রোতারা সন্দেহ করতে বাধ্য হয় যে লোকটা যা বকছে সেটা নিজে অন্ততঃ বিশ্বাস করে। এ’জাতীয় সন্দেহ হলেই লেকচারটা বেশ গাঢ় এবং পানসে হয়ে যায় এবং শ্রোতাদের পাচনশক্তির ওপর চাপ হয়ে যায়। এইসব দেখেশুনে গঞ্জহার দল যে যার হজম করার ক্ষমতা মেপে ঠিক করে নেয়—কে কখন লেকচার শুনবে। কেউ খাবার খাওয়ার আগে তো কেউ দুপুরের ভোজনের পর। তবে বেশিরভাগ লোক লেকচয়ার শুনতে আসত দিনের তৃতীয় প্রহরের ঝিমুনি থেকে সন্ধ্যাবেলায় জেগে ওঠার মাঝের সময়টুকুতে।

সেসব দিনে গাঁয়ে গাঁয়ে লেকচার দেবার মুখ্য বিষয় ছিল ‘ কৃষি’। তার মানে আগে লেকচারের জন্যে অন্য কোন বিষয় ছিল এমনটা ভাববেন না যেন!আসলে গত কয়েকবছর ধরে কৃষকদের পটিয়ে পাটিয়ে বোঝান হচ্ছে যে আমাদের এই ভারতবর্ষ কিন্তু একটা কৃষিপ্রধান দেশ। গেঁয়ো শ্রোতারা কক্ষণো এ’নিয়ে আপত্তি করেনি।তবে প্রত্যেক বক্তা লেকচারব শুরু করার আগে ধরে নিতেন যে শ্রোতারা নিশ্চয়ই আপত্তি করবে। তাই ওঁরা খুঁজেটুজে একের পর এক নতুন যুক্তি সাজাতেন আর কোমর কষে প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন যে ভারত অবশ্য একটি কৃষিপ্রধান দেশ। এরপর ওঁরা বলতে শুরু করতেন—চাষবাসের উন্নতি মানেই দেশের উন্নতি।তবে এর পরে আরও কিছু বলার আগেই দুপুরের খাওয়ার সময় হয়ে যেত। তখন ওই শান্ত সুভদ্র অফিসারটি, মানে যে খুব বড়ঘরের ছেলে এবং যার সঙ্গে চিকো সায়েব নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, বক্তার পিঠের কাপড়ে টান মেরে মেরে ইশারায় বলার চেষ্টা করত, চাচাজি, রান্না হয়ে গেছে। কখনও কখনও এমন হতে যে বাকি বক্তারা এর পরের কথাগুলোও বলে ফেলতেন, তখন স্পষ্ট হত যে এনাদের আগের আর পরের বক্তব্যে বিশেষ ফারাক নেই।

ঘুরেফিরে একটাই কথাঃ ভারত একটি কৃষিপ্রধান দেশ আর তোমরা হলে কৃষক। ভাল করে চাষ কর বাছারা, বেশি বেশি ফসল ফলাও। সব বক্তার মনেই একটা সন্দেহের ঘুর্ঘুরে পোকা কুরকুর করত- চাষারা বোধহয় বেশি ফসল ফলাতে চায় না।

লেকচারে যা খামতি থাকত তা’ বিজ্ঞাপনে পুষিয়ে যেত। একদিক দিয়ে দেখলে শিবপালগঞ্জের দেয়ালে লেখা বা সাঁটা বিজ্ঞাপন জনপদটির সমস্যা ও তার সমাধানের সঠিক পরিচয়। উদাহরণ দিচ্ছি, সমস্যাটা হল ভারত এক কৃষিপ্রধান দেশ এবং বদমাশ চাষাগুলো বেশি করে ফসল ফলাতে উৎসাহী নয়। এর সমাধান হল চাষিদের খুব লেকচার দেয়া হোক এবং ভাল ভাল ছবি দেখানো হোক। তাতে মেসেজ দেয়া হবে যে তুমি নিজের জন্যে না হোক, দেশের জন্যে তো ফসল ফলাও!এভাবেই কৃষকদের ‘দেশের জন্যে ফসল উৎপাদন করো’ গোছের পোস্টার দেয়ালে দেয়ালে ভরে গেল। চাষিদের উপর পোস্টার আর ছবির মিশ্রিত প্রভাব এমন হল যে সবচেয়ে সাদাসিদে চাষিও ভাবতে লাগল যে এর পেছনে সরকারের নিশ্চয়ই কোন চাল আছে।

একটা বিজ্ঞাপন তখন শিবপালগঞ্জে সাড়া ফেলে দিয়েছিল যাতে মাথায় কষে বাঁধা গামছা, কানে কুন্ডল, গায়ে মেরজাই একজন হৃষ্টপুষ্ট চাষি বুকসমান উঁচু গমের শীষ কাস্তে দিয়ে কাটছে। ওর পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একজন বঊ যার ঠোঁটে কৃষিবিভাগের অফিসারমার্কা হাসি; একেবারে আপনহারা-মাতোয়ারা ভাব। বিজ্ঞাপনের নীচে এবং উপরে ইংরেজি ও হিন্দিতে লেখা-“ অধিক ফসল ফলাও”। মেরজাই পরা কাস্তে হাতে চাষীদের মধ্যে যে ইংরেজি অক্ষর চেনে তাকে ইংরেজিতে এবং যে হিন্দি চেনে তাকে হিন্দিতে পটকে দেওয়ার উদ্দেশে এই বিজ্ঞাপনটি তৈরি। আর যারা ইংরেজি বা হিন্দি কিছুই চেনে না তারা অন্ততঃ হাসিমুখ চাষিদম্পতিকে তো চিনবেই। আশা করা যায় চাষির পেছনে হাসিমুখ বৌয়ের ফটোটি দেখা মাত্র ওরা মুখ ঘুরিয়ে পাগলের মত ‘অধিক অন্ন’ ফলাতে লেগে যাবে। কিন্তু বিজ্ঞাপনটির আজকাল মাঠেঘাটে চর্চার কারণ অন্য। বিশেষজ্ঞদের মতে পুরুষটির চেহারা খানিকটা যেন বদ্রী পালোয়ানের সঙ্গে মেলে। কিন্তু মেয়েটি কে এ’নিয়ে রসিকদের মধ্যে প্রচুর মতভেদ দেখা গেল। এই গাঁয়ের অনেক মেয়েছেলের মধ্যে ভাগ্যবতীটি কে তা’নিয়ে আজও ফয়সালা হয় নি।

তবে সবচেয়ে উচ্চকিত বিজ্ঞাপন চাষের নয় ম্যালেরিয়ার। নানান জায়গায় বাড়ির দেয়ালে পাটকিলে রঙে লেখা হল—‘ম্যালেরিয়া খতম করব ভাই, তোমার সবার সাহায্য চাই‘ এবং ‘মশার বংশ হবে ধ্বংশ’। এই প্রচারের পেছনেও ধারণা ছিল যে কিসান গরু-মোষের মত মশাপালনে আগ্রহী। তাই মশা মারার আগে ওদের হৃদয়-পরিবর্তন করা দরকার। হৃদয়-পরিবর্তন করতে দাপট দেখানো দরকার, আর দাপট দেখাতে ইংরেজি চাই।এই ভারতীয় তর্ক-পদ্ধতি অনুসরণ করে ম্যালেরিয়া-নাশ্ বা মশক-লাশ করার সমস্ত আপিল প্রায় সবটাই ইংরেজিতে লেখা অতএব লোকজন এই বিজ্ঞাপনগুলোকে কবিতা নয়, চিত্রকলা বা আলপনা হিসেবে মেনে নিল। তাই নিজেদের বাড়ির দেয়ালে পাটকিলে রঙের ইচ্ছেমত ইংরেজি লেখার অনুমতি দিয়ে দিল। দেয়ালে দেয়ালে ইংরেজি আলপনা আঁকা চলতে থাকল, মশাও মরতে লাগল, কুকুর ঘেউ ঘেউ করে চলল আর লোকজন নিজের পথে চলতে থাকল।

একটা বিজ্ঞাপন সাদাসিদে ঢঙে বলছে—আমাদের সঞ্চয় করা উচিত। কিন্তু গাঁয়ের মানুষকে ওদের পূর্বপুরুষেরা মরার আগে শিখিয়ে গেছেন—দু’পয়সা বাঁচানোর চেষ্টা করা উচিৎ। আর এই নীতিকথাটি গ্রামের সবার ভালো করে জানা আছে। তবে এরমধ্যে নতুনত্ব এইটুকু যে এখানেও দেশ জুড়ে দেয়া হয়েছে। মানে নিজের জন্যে নাহোক, দেশের জন্যে তো সঞ্চয় কর।

হক কথা। বড় মানুষেরা- যত শেঠ-মহাজন, উকিল, ডাক্তার—সবাই পয়সা বাঁচায় নিজেদের জন্যে। তাহলে দেশের জন্যে সঞ্চয় করতে ছোট ছোট চাষির দল, গরীব-গুর্বোর কোন আপত্তি হওয়ার কথা নয়। সবাই নীতির হিসেবে ঐক্যমত যে পয়সা বাঁচানো উচিৎ। এখন সঞ্চিত অর্থ কোথায় এবং কীভাবে জমা করতে হবে তাও লেকচারে এবং বিজ্ঞাপনে স্পষ্ট করে বলে দেয়া হয়েছে। তাতেও লোকজনের কোন আপত্তি নেই। শুধু এটাই বলা হয়নি যে সঞ্চয় করারা আগে তুমি যে খাটাখাটনি করবে তার জন্যে তোমার মজুরি কত হওয়া চাই।

পয়সা বাঁচানোর ব্যাপারটা যে আয় ও ব্যয়র সঙ্গে যুক্ত, এই ছোট্ট কথাটা বাদ দিয়ে বাকি সব বিজ্ঞাপনে বলা রয়েছে। মানুষজন ভাবল—বেচারা বিজ্ঞাপন, চুপচাপ দেয়ালে সেঁটে রয়েছে, খেতে চাইছে না, পরতে চাইছে না, কাউকে যেমন কিছু দিচ্ছে না, তেমনই কারও কাছে কোন আবদার করছে না। যেতে দাও, খোঁচাখুঁচি কর না।

কিন্তু রঙ্গনাথকে হাতছানি দিচ্ছে যে বিজ্ঞাপনগুলো তারা আদৌ পাব্লিক সেক্টরের নয়, বরং এই বাজারে প্রাইভেট সেক্টরের অবদান।এদের থেকে উৎসারিত আলোর নমুনা দেখুন। এলাকায় সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়া ব্যামো হল দাদ।বিজ্ঞাপনটি বলছে, “এমন একটা ওষুধ পাওয়া গেছে যেটা দাদের উপর লাগিয়ে দিলে দাদের শেকড় অব্দি উপড়ে আসে, মুখে পুরে ফেললে সর্দি-কাশি সেরে যায়, আর বাতাসায় ভরে জলের সঙ্গে গিলে ফেললে কলেরা সারাতে কাজ দেয়। এমন ওষুধ কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি। এর আবিষ্কারক এখনও জীবিত, শুধু বিলেতের সাহেবসুবোর চক্রান্তে উনি আজও নোবেল পাননি’।

এ দেশে এধরনের নোবেল না পাওয়া আরও বড় বড় ডাক্তার রয়েছেন। একজন থাকেন জাহানাবাদ জনপদে। ওখানে ইদানীং বিদ্যুৎ এসে গেছে। তাই উনি নপুংসকতার চিকিৎসা বিজলির শক দিয়ে করছেন। নপুংসকদের কপাল ফিরেছে।আর একজন বিখ্যাত ডাক্তার, অন্ততঃ গোটা ভারতে খুব নামডাক, বিনা অপারেশনে অণ্ডকোষ বৃদ্ধির চিকিৎসা করেন। আলকাতরার পোঁচ দিয়ে লেখা এই জরুরি খবরটি শিবপালগঞ্জের যেকোন দেয়ালে দেখা যেতে পারে। মানছি, অনেকগুলো বিজ্ঞাপন বাচ্চাদের শুকনো কাশি, চোখের অসুখ এবং আমাশা ইত্যাদি নিয়ে। কিন্তু আসল রোগ হল হাতে গোণা তিনটি—দাদ, অন্ডকোষের ফোলা এবং নপুংসকতা। শিবপালগঞ্জের ছেলেপুলের দল অক্ষর পরিচয়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব রোগের চিকিৎসার বিষয়েও দেয়াললিপির মাধ্যমে জ্ঞানলাভ করতে থাকে।

বিজ্ঞাপনের এমন ভীড়ের মাঝে বৈদ্যজীর বিজ্ঞাপনটি—”নবযুবকদের জন্যে আশার কিরণ” -আলাদা করে চোখে পড়ে। এটি ‘নপুংসকদের জন্যে বিজলীচিকিৎসা” গোছের অশ্লীল দেয়াললিপিগুলোর সঙ্গে লড়ালড়ি এড়িয়ে যায়। এবং ছোট ছোট গলি চৌমাথা দোকান এবং সরকারি অফিসগুলোর গায়ে—যেখানে ‘প্রস্রাব করিবেন না’ এবং ‘বিজ্ঞাপন মারিবেন না’ বলে সবাই জানে- টিনের ছোট ছোট তক্তির ওপর লালসবুজ অক্ষরে দেখা দেয়। তাতে ‘নবযুবকদের জন্যে আশার কিরণ’, নীচে বৈদ্যজীর নাম এবং দেখা করার সময় – এটুকুই লেখা থাকে।

একদিন রঙ্গনাথের চোখে পড়ল যে রোগের চিকিৎসায় একটা নতুন উপসর্গ এসে জুটেছে ববাসীর(অর্শ)! সাতসকালে কয়েকজন মিলে একটি দেয়ালে বড় বড় অক্ষরে লিখতে শুরু করেছে—‘ববাসীর’।

এ তো শিবপালগঞ্জের বিকাশ শুরু হওয়া! এই শব্দটির চারটে প্রমাণ সাইজ অক্ষর যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে- এখন আমাশার যুগ চলে গেছে। ধীরে ধীরে হাঁটিহাঁটি, পা-পা করে এন্ট্রি নিচ্ছে নরমসরম শরীর, অফিসের চেয়ার, সভ্যভব্য চালচলন, দিনভর চলতে থাকা খাওয়াদাওয়া এবং হালকা পরিশ্রমের যুগ। আর দিকে দিকে ব্যাপ্ত ‘নপুংসকতা’র মোকাবিলা করতে আধুনিকতার প্রতিনিধি হিসেবে লড়াইয়ের ময়দানে নামছে ‘ববাসীর’। বিকেল নাগাদ ওই দানবীয় আকারের বিজ্ঞাপন একটা দেয়ালে নানারঙে সেজে দিকে দিগন্তে উদঘোষ করতে লাগল—“ ববাসীরের বাজি রেখে চিকিৎসা!

দেখতে দেখতে চার-পাঁচ দিনেই সারা দুনিয়া ববাসীরের বাজি রেখে সারিয়ে তোলার দম্ভের সামনে নতজানু হল।চারদিকে ওই বিজ্ঞাপনের ছড়াছড়ি। রঙ্গনাথ হতভম্ব, একই বিজ্ঞাপন একটি দৈনিক খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে! কাগজটি রোজ সকাল দশটা নাগাদ শিবপালগঞ্জে পৌঁছিয়ে লোককে জানান দেয় যে স্কুটার ও ট্রাকের সংঘর্ষ কোথায় হয়েছে, আব্বাসী নামক তথাকথিত গুন্ডা ইরশাদ নামের কথিত সব্জিওলাকে তথাকথিত ছুরি দিয়ে কথিত রূপে কোথায় আঘাত করেছে।

সেদিন রঙ্গনাথের চোখে পড়ল যে ওই পত্রিকার প্রথম পাতার একটা বড় অংশ কালো রঙে লেপে দেয়া আর তার থেকে বড় বড় সাদা অক্ষরে ঝলসে উঠছে—ববাসীর! অক্ষরের ছাঁদ একেবারে দেয়াললিপির বিজ্ঞাপনের মত। ওই অক্ষরগুলো ববাসীর(অর্শ)কে এক নতুন চেহারা দিল আর আশপাশের সবকিছু যেন ববাসীরের অধীনস্থ কর্মচারি হয়ে গেল। কালো প্রেক্ষাপটে ঝকঝকে ববাসীর সহজেই লোকের চোখ টানল।এমনকি যে শনিচর বড় বড় অক্ষর পড়তে গেলে হিমসিম খায়, সেও পত্রিকার কাছে সরে এসে অনেকক্ষণ মন দিয়ে চোখ বুলিয়ে রঙ্গনাথকে বলে উঠল—হ্যাঁ, চীজ বটে!

এই কথাটির মধ্যে প্রচ্ছন্ন গর্ব রয়েছে। মানে শিবপালগঞ্জের দেয়ালে ঝকমক করা বিজ্ঞাপন কোন সাধারণ বস্তু নয়, শহরের কাগজেও ছেপে বেরোয়। এভাবে বোঝা গেল যে যা রয় শিবপালগঞ্জে, তা’ রয় বাইরের কাগজে।

তক্তপোষের উপর বসে ছিল রঙ্গনাথ।ওর সামনে খবরের কাগজের একটা পাতা তেরছা হয়ে পড়ে রয়েছে।আমেরিকা মহাশূন্যে একটা নতুন উপগ্রহ পাঠিয়েছে।ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে গোলাগুলি চলছে। গমের ফলন কম হওয়ায় রাজ্যের কোটা কমিয়ে দেয়া হবে। সিকিউরিটি কাউন্সিলে দক্ষিণ আফ্রিকার কোন সমস্যা নিয়ে গরমাগরম তর্ক-বিতর্ক চলছে। এসবের মধ্যে দৈত্যকার বাজের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছে ওই সাদাকালো বিজ্ঞাপন, নিজস্ব টেরচা অক্ষরের ছাঁদে সবার মনযোগ কেড়ে নিয়ে চেঁচিয়ে যাচ্ছে- ববাসীর! ববাসীর! অর্শ! অর্শ! বিজ্ঞাপনটি ছেপে বেরোতেই শিবপালগঞ্জ ও আন্তর্জাতিক দুনিয়ার মধ্যে ‘ববাসীর’ এক সফল যোগসূত্র হয়ে দাঁড়াল।

ডাকাতদলের আদেশ ছিল যে রামাধীনের তরফ থেকে একটি টাকার থলি এক বিশেষ তিথিতে বিশেষ স্থানে গিয়ে চুপচাপ রেখে আসতে হবে।ডাকাতির এই মডেল এখনও দেশের কোথাও কোথাও বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু এই মডেলটি মধ্যযুগের, কারণ তখন এসব রূপোর বা নিকেলের সিক্কা চলত যা থলি বা বটুয়ায় রাখা হত। আজকাল টাকা কাগুজে রূপ ধারণ করেছে। পাঁচহাজার টাকা তো প্রেমপত্রের মত একটা খামে ভরে কাউকে দেয়া যায়। দরকার পড়লে একটা চেক কেটে দিলেও হয়। তাই ‘ পরশু রাত্তিরে অমুক টিলার উপরে একটা পাঁচহাজার টাকার থলি রেখে চুপচাপ কেটে পড়’ গোছের আদেশ পালন করা বাস্তবে বেশ অসুবিধেজনক। যেমন টিলার উপর খামে ভরে ছেড়ে আসা নোটগুলো এতোল বেতোল হাওয়ায় উড়ে যেতে পারে।খামের ভেতরের জাল চেক হতে পারে। সংক্ষেপে বললে, শিল্প-সাহিত্য-প্রশাসন-শিক্ষার মত ডাকাতির ক্ষেত্রেও মধ্যযুগীন কায়দাকানুন থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণ অনেক সমস্যা তৈরি করতে পারে।

যাই হোক, ডাকাতের দল এতশত ভাবেনি, বোঝাই যাচ্ছে।কারণ যারাই রামাধীনের বাড়িতে ডাকাতির আগাম চিঠি পাঠিয়েছিল তারা কেউ আসল ডাকাত নয়। ইদানীং গ্রাম-সভা আর কলেজের রাজনীতির বখেড়ায় রামাধীন ভীখমখেড়ভী এবং বৈদ্যজীর মধ্যে আকচাআকচি বেড়ে গেছল। এটা যদি শহর হত এবং পলিটিক্স একটু হাই-লেভেলের হত, তাহলে এতদিনে কোন মহিলা থানায় গিয়ে রিপোর্ট লেখাত যে রামাধীনবাবু ওঁর শীলভঙ্গ করার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন, কিন্তু মহিলার সাহস ও সক্রিয় প্রতিরোধের সামনে হার মেনেছেন। এবং মহিলাটি তাঁর শীল পুরোপুরি আস্ত রেখে সোজা থানায় পৌঁছে গেছেন। কিন্তু জায়গাটা এখনও গ্রাম বটেক, তাই রাজনীতির যুদ্ধে ‘শীলভঙ্গ’ নামক অস্ত্রটি এখনও হ্যান্ড গ্রেনেডের সম্মান পায়নি। তাই ডাকাতির ধমকিভরা চিঠি গোছের পুরনো কৌশল অবলম্বন করে রামাধীনকে ক’দিন জ্বালাতন করার চেষ্টা- এই আর কি।

ডাকাতির চিঠিটা যে জালি এটা সবাই জানে। মানে, পুলিশ, রামাধীন এবং বৈদ্যজীর পুরো দরবার- সবাই। আগেও এ’রম চিঠি অনেকবার অনেকের কাছে এসেছে। তাই অমুক তারিখে তমুক সময় টাকা নিয়ে টিলায় পৌঁছতেই হবে -রামাধীনের এমন কোন চাপ ছিলনা। চিঠিটা নকল না হয়ে আসল হলেও রামাধীন চুপচাপ টাকা পৌঁছে দেয়ার বান্দা নয়, তার চেয়ে ঘরে ডাকাত পড়ুক, সেই ভাল।কিন্তু থানায় রিপোর্ট লেখানো হয়ে গেছে, ফলে পুলিশেরও কর্তব্যবোধ জেগে উঠল।কিছু না কিছু করতেই হবে।

সেই বিশেষ দিনে গাঁ থেকে টিলা পর্য্যন্ত স্টেজ পুলিশকে সঁপে দেয়া হল। ওরা চোর-পুলিশ খেলতে লেগে গেল। টিলার মাথায় তো যেন একটা থানা খুলে গেল। ওরা আশপাশের পড়তি ফাঁকা জমি, পাথুরে রুক্ষ এলাকা, জংগল, খেত-খামার, ঝোপঝাড় সব খুঁজে দেখল, কিন্তু ডাকাতদের টিকিটি দেখা গেল না। ওরা টিলার পাশে গাছের ঘন ডালপালা নেড়ে দেখল, খ্যাঁকশেয়ালের গর্তে সঙীন দিয়ে খোঁচা মারল, আর সমতলে নিজের চোখে কটমটিয়ে দেখে বুঝে গেল যে ওখানে যারা আছে তারা ডাকাত নয়, বরং পাখির ঝাঁক, শেয়ালের পাল ও বিবিধ পোকামাকড়।রাতের একপ্রহরে কিছু প্রাণীর সমবত চিৎকারে চটকা ভাঙলে ওরা আশ্বস্ত হল,-- ডাকাত নয়, হুক্কাহুয়া। আর পরে ঝটপট ঝটপট,-- পাশের বাগবাগিচায় বাদুড়ে ফল ঠোকারাচ্ছে। সেই রাতে ডাকাত দল এবং বাবু রামাধীনের মধ্যেকার কুস্তি ১-১ ড্র হল। কারণ টিলায় ডাকাতেরা কেউ আসেনি, রামাধীনও টাকার থলি নিয়ে যায়নি।

থানার ছোট দারোগাটি সদ্য চাকরিতে যোগ দিয়েছেন। টিলায় চড়ে ডাকাত ধরার কাজ ওনাকেই দেয়া হয়েছিল। উনি ভেবেছিলেন মাকে নিয়মকরে প্রতিসপ্তাহে পাঠানো চিঠির আগামী কিস্তিতে লিখবেন—‘ মা, ডাকাতের দল মেশিনগান চালিয়েছিল; ভয়ংকর গোলাগুলি । তবু মা তোমার আশীর্বাদে আমার গায়ে একটা আঁচড়ও লাগেনি’।

কিন্তু কিছুই হলনা। রাত্তির একটা নাগাদ উনি টিলা থেকে সমতলে নেমে এলেন। ঠান্ডা বেড়ে গেছল। অমাবস্যার ঘন অন্ধকার। আর ওঁর মনে জেগে উঠল নগরবাসিনী প্রিয়ার জন্যে আকুলিবিকুলি। উনি ছিলেন হিন্দি সাহিত্যে স্নাতক। এতসব কারণ মিলে ওঁর গলায় গান এল; প্রথমে গুনগুনিয়ে তাদারোগারপর স্পষ্ট সুরে—‘হায় মেরা দিল! হায় মেরা দিল’!

এবার “তীতর কে দো আগে তীতর, তীতর কে দো পীছে তীতর” প্রবাদের মত আগে দু’জন, পেছনে দু’জন সেপাই নিয়ে ছোট দারোগা চলেছেন। দারোগার গানের সুর চড়ছে দেখে সেপাইরা ভাবছে- ঠিক আছে, ঠিক আছে; নতুন নতুন ডিউটিতে এসেছেন, ক’দিন বাদে লাইনে এসে যাবেন।খোলা ময়দান পেরিয়ে যেতে যেতে দারোগার গলা আর উদাত্ত হল। বোঝা গেল, যে নেহাত বোকা বোকা কথাগুলো মুখ ফুটে বলতে লজ্জা করে সেগুলো নিয়ে দিব্যি গান গাওয়া যায়।

রাস্তা প্রায় এসে গেছে। তখনই একটা বড়সড় গর্ত থেকে আওয়াজ এল- কর্ফৌন হ্যায় সর্ফালা?

দারোগার হাত কোমরের রিভলভারে চলে গেল। সেপাইরা হকচকিয়ে গেল। তখন গর্ত থেকে আবার শোনা গেল- কর্ফৌন হ্যায় সর্ফালা?

এক সেপাই দারোগার কানে ফুসফুসিয়ে বলল—গুলি চলতে পারে। গাছের আড়ালে সরে যাই হুজুর?

গাছের আড়াল প্রায় পাঁচগজ দূরে। দারোগা সেপাইয়ের কানে ফুসফুস করে বললেন-তোমরা গাছের আড়ালে যাও; আমি দেখছি।

এবার উনি বললেন- ‘গর্তের ভেতরে কে? যেই হও, বাইরে বেরিয়ে এস’। তারপর একটি সিনেমার স্টাইলে বললেন-‘তোমাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। আর আধমিনিটের মধ্যে না বেরিয়ে এলে গুলি চালাব’।

গর্তের থেকে কোন সাড়াশব্দ নেই। তারপর হঠাৎ শোনা গেল- মর্ফর গর্ফয়ে সর্ফালে, গর্ফোলি চর্ফলানেওয়ালে!

[এসব শব্দের দ্বিতীয় অক্ষরে ‘র্ফ’ বাদ দিয়ে পড়লেই মানে স্পষ্ট হবে—মর গয়ে সালে, গোলি চলানেওয়ালে! ঠিক ছোট মেয়েরা যেমন নিজেদের মধ্যে ‘চি’ জুড়ে কোড বানিয়ে কথা বলে। লাভার বলতে হলে বড়দের সামনে বলে-চিলাচিভাচির।]

প্রত্যেক ভারতীয় ঘর ছেড়ে বাইরে বেরোলে ভাষার মারপ্যাঁচে্র মুখোমুখি হলে নিরেট আকাট হয়ে যায়। এতরকম আঞ্চলিক কথ্যভাষা বা বুলি ওদের কানের পরদায় আছড়ে পড়ে যে ওরা খানিকবাদে হার মেনে ভাবে—হবে নেপালি কি গুজরাতি!এই ভাষাটাও ছোট দারোগাকে নাজেহাল করে দিল। উনি ভাবতে লাগলেন -ব্যাপারটা কী? এটুকু বঝা যাচ্ছে যে কেউ গালি দিচ্ছে। কিন্তু কোন ভাষায় দিচ্ছে কেন বোঝা যাচ্ছে না?

বোঝাবুঝির পালা শেষ হলে যে গুলি চালাতে হয় এই আন্তর্জাতিক নীতিটি ওনার ভাল করে জানা আছে। তাই শিবপালগঞ্জে ওই নীতি প্রয়োগ করবেন ভেবে উনি রিভলবার বাগিয়ে হেঁকে উঠলেন—“গর্তের বাইরে বেরিয়ে এস, নইলে এবার গুলি চালাব’।

কিন্তু গুলি চালানোর দরকার হলনা। এক সেপাই গাছের আড়ালা থেকে বেরিয়ে এসে বলল-হুজুর, গুলি চালাবেন না যেন। এ ব্যাটা জোগনাথওয়া, মাল টেনে গাড্ডায় পড়ে গেছে।

সেপাইয়ের দল মহোৎসাহে গর্তের চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল। দারোগা বললেন—জোগনাথওয়া? সেটা আবার কে?

এক পুরনো সেপাই বলল—এ হল শ্রীরামনাথের পুত্র জোগনাথ, একলা মানুষ, তবে একটু বেশি মাল টানে।

সবাই মিলে জোগনাথকে টেনেটুনে দাঁড় করালো, কিন্তু যে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায় না, তাকে অন্যেরা কতক্ষণ ধরে রাখবে! তাই ও ল্যাগব্যাগ করে পড়ে যাচ্ছিল, একবার সামলানো হল তারপর ও গর্তটা উপর পরমহংসের মত বসে পড়ল। এবার ও বসে বসে চোখ মিটমিট করে হাতটাত নেড়ে একবার বাদুড় আর একবার শেয়ালের মত আওয়াজ বের করে একটু মানুষের স্তরে নেমে এল, কিন্তু ওর মুখ থেকে ফের ওই শব্দ বেরোল-- কর্ফৌন হ্যায় সর্ফালা?

দারোগা জিজ্ঞাসা- এটা আবার কোন বুলি?

সেপাই বলল- বুলি দিয়েই তো চিনলাম যে ব্যাটা জোগনাথ ছাড়া কেউ নয়।ও ‘সর্ফরী’' বুলি কপচায়। এখন হুঁশ নেই তাই গাল পাড়ছে।

যোগনাথের গাল পাড়ার প্রতি নিষ্ঠা দেখে দারোগা প্রভাবিত হলেন। বেহুঁশ অবস্থায়ও কিছু না কিছু করছে তো! উনি ওর ঘেঁটি ধরে ঝটকা মেরে বললেন- হোশ মে আও। হুঁশ ফিরে আসুক ব্যাটার।

কিন্তু জোগনাথ হুঁশ ফেরাতে চায় না যে!খালি বলল-সর্ফালে!

সেপাইয়ের দল হেসে উঠল। ওকে চিনত যে সেপাই, সে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে চেঁচাল—জর্ফোগনাথ, হর্ফোশ মেঁ অর্ফাও! জোগনাথ, হোশ মেঁ আও।

এতেও জোগনাথের কোন হেলদোল নেই; কিন্তু ছোট দারোগা এবার সর্ফরী বুলি শিখে ফেললেন।মুচকি হেসে টিপ্পনি করলেন—এই শালা আমাদের সবাইকে শালা বলছে যে!

উনি দু’ঘা দেবেন ভেবে যেই হাত তুললেন অমনই একজন সেপাই ওনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল-যেতে দিন হুজুর, যেতে দিন।

সেপাইদের এতটা মানবতাবাদী দৃষ্টিকোণ দারোগাবাবুর খুব একটা পছন্দ হলনা।উনি তামাচা মারতে উদ্যত হাত সামলে নিলেন কিন্তু আদেশের স্বরে বললেন- ব্যাটাকে নিয়ে চল আর হাজতে পুরে দাও।ধারা ১০৯ এর কেস ঠুকে দাও।

জনৈক সেপাই বলে উঠল—এটা ঠিক হবেনা হুজুর!ওর এ’ গাঁয়েই বাস। দেয়ালে রঙ দিয়ে বিজ্ঞাপন লেখে। কথায় কথায় সর্ফরী বুলি ঝাড়ে। ব্যাটা বদমাশ বটে, কিন্তু দেখনদারির জন্যে কিছু-না-কিছু কাজটাজ করতেই থাকে।

ওরা জোগনাথকে মাটির থেকে টেনে তুলে কোনরকমে পা চালাতে বাধ্য করে রাস্তার দিকে এগোয়। দারোগা বললেন,’ বোধহয় দারু খেয়ে গালি দিচ্ছিল। কোন-না-কোন ধারা ঠিক লেগে যাবে।এখন তো ব্যাটাকে লেন

সেপাইটি নাছোড়বান্দা। ‘কেন যে হুজুর খামোখা ঝঞ্ঝাট বাড়াচ্ছেন!কী লাভ! গাঁয়ে পৌঁছে ওকে এখন ওর ঘরে এক ধাক্কায় ঢুকিয়ে দিয়ে তবে ফিরব।একে হাজতে পুরবেন কী করে?জানেনই তো, ও হল বৈদ্যজীর লোক।

ছোট দারোগা চাকরিতে সবে এসেছেন, কিন্তু সেপাইদের মানবতাবাদী ভাবনার আসল কারণটা উনি চটপট বুঝে ফেললেন। সেপাইদের থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে পেছন পেছন চলতে চলতে উনি ক্রমশঃ ঘোর অন্ধকার, অল্প অল্প শীত নগরে বিনিদ্র রাতজাগা প্রিয়া এবং ‘হায় মেরা দিল’ গুনগুনিয়ে ক্রমশঃ শান্ত হলেন।

1 comments: