0
undefined undefined undefined

সম্পাদকীয়

Posted in







তিন বছর আগের ভারতবর্ষ। তখনও অতিমারির হিংস্র দৃষ্টি স্তিমিত হয়ে আসেনি পুরোপুরি। অজানা আশঙ্কা ঘিরে রেখেছে আমাদের তখনও। তারই মধ্যে উত্তরপ্রদেশের হাথরাস উঠে এসেছিল সংবাদ শিরোনামে। একটি উনিশ বছরের দলিত মেয়েকে গণধর্ষণের পর মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে রেখে যায় চারটি উচ্চ বর্ণের যুবক। নির্যাতিতা যাতে কোনও মৌখিক বয়ান দিতে না পারে, সেইজন্য ক্ষতবিক্ষত করে দেওয়া হয়েছিল তার জিভ। কিন্তু আশ্চর্য তার জীবনীশক্তি! পক্ষকাল বেঁচে থেকে সে শুধু অন্তিম জবানবন্দীই নথিভুক্ত করে না, শনাক্তও করে যায় অপরাধীদের।

পরবর্তী ঘটনাক্রমকে অতি নাটকীয় বললেও কিছুমাত্র বলা হয় না। আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে মেয়েটির দেহ পুড়িয়ে ফেলা হয় ময়না তদন্তের আগেই। নানান চাপের মুখে অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করলেও প্রমাণের অভাবে ছাড়া পেয়ে যায় তারা এবং অসামান্য তৎপরতায় গ্রামটির চারপাশে রচনা করা হয় নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলয়।

এমন পরিস্থিতিতে কেরালা থেকে অকুতোভয় এক তরুণ সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান প্রকৃত সত্য খুঁজে পেতে প্রায় অকুস্থলে পৌঁছে যান। বিশেষ ক্ষমতাবলে প্রশাসন সেদিন কাপ্পানকে শুধু আটকই করেনি, কাল্পনিক নানাবিধ অভিযোগে কারাবাস করতে হয় তাঁকে পরবর্তী আঠাশ মাস।

অবশেষে স্বাধীনতার 'অমৃত মহোৎসব' উদযাপনের মধ্য পর্যায়ে এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে জামিনে মুক্তি পান কাপ্পান। কিন্তু শেষ হয় না তাঁর হয়রানি। জটিল আইনী প্রক্রিয়ার নাগপাশে আজও রুদ্ধ তাঁর জীবন। এ কেমন মুক্তির আলো, যা তাঁকে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে দেয় না? প্রাণনাশের অদেখা হুমকিতে কাটে বিনিদ্র রজনী? শুধু আদালতে হাজিরা দিতে লেগে যায় সপ্তাহব্যাপী সময়? এ কি তবে এক 'মুক্ত কারাবাস'? 'প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা'।

সুস্থ থাকুন। সৃজনে থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান।

0 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - দীপারুণ ভট্টাচার্য

Posted in






সম্প্রতি এক ISKCON সাধু স্বামী বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণদেব সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করে শিরোনামে এসেছেন। বিষয়টা নিয়ে ক্রমাগত আলোচনা, সমালোচনা, নানান ভিডিও পোস্ট চলছে সোশ্যাল মিডিয়াতে। সম্ভবত আমরা এখন এমন এক সময়ে বাস করছি যখন ভালো কাজ করে শিরোনাম অর্জন করা খুব মুস্কিল। কাজটি আগেও মুস্কিলই ছিল কিন্তু বর্তমানে ভালোর প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহ ও সম্ভ্রম ক্রমেই কমে যাচ্ছে। বরং আগ্রহ বেড়েছে খারাপের প্রতি। তাই বিতর্কিত, বিকৃত ও বিরূপ প্রতিক্রিয়াতে মানুষ বেশি আকর্ষণ বোধ করেন। আর একটা বিষয় এসেছে যাকে বলে ট্রেণ্ড। আর অর্থাৎ কি চলছে। যা চলছে তার সঙ্গে গা ভাসিয়ে দেওয়া এই সময়ে যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকলেই অনেক মানুষের দৃষ্টি পেতে আগ্রহী। বিষয়টার মধ্যে কতটা সততা, নিষ্ঠা ও পবিত্রতা আছে সেটা বিচার্য হচ্ছে না।

ছোটবেলায় স্কুলে রচনা লেখা হত, বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ। এখন এমন কিছু লিখতে হলে সহজে বলা যাবে না বিষয়টা। বাজার অর্থনীতির যুগে এই বিষয়টা সবই বুঝে গেছেন যে মানুষের মধ্যে যে ভালো গুণ আছে তাকে জাগিয়ে তোলার থেকে খারাপ গুণ বা দোষকে জাগিয়ে তোলা যায় সহজেই। আর এই জাগিয়ে তোলাকে যদি একবার কাজে লাগানো যায় তাহলেই মুনাফা আসবে। বিষয়টা প্রথম বুঝেছিলেন মেগা সিরিয়াল নির্মাতারা। কাজেই সংসারের হাজার ভালো গল্প বাদ দিয়ে তারা দেখাতে শুরু করেন সম্পর্কের নোংরা, অন্ধকার দিকগুলো। ক্রমেই সংবাদ মাধ্যম থেকে সোশ্যাল মিডিয়া এমন কি নির্বাচিত সরকারগুলো পর্যন্ত এই অস্ত্র এখন বারংবার ব্যবহার করছেন। সাজানো ভাড়া করা লোক দিয়ে টিভি চ্যানেলগুলো সারাদিন দুই ধর্মের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিকারী আলোচনা করছেন। বছর দশে আগেও যা ছিল অভাবনীয়। এক অনলাইন সংবাদ সংস্থা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের এক উচ্চ পদস্থ আমলার নাম উল্লেখ করে দাবি করে, তিনি নাকি রোজ সকালে প্রতিটি জাতীয় টিভি চ্যানেলকে ফোনে নির্দেশ দেন আজ কোন কোন ধর্মীয় উস্কানি মূলক বিষয় তাদের প্রচার করতে হবে! বিষয়টা যদি সত্যি হয় তবে বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারতবর্ষ সর্বনাশের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে।

যাই হোক, আমরা আবার সেই সাধুর কথায় ফিরে আসি। যিনি নিজের কিংবা তার সংস্থার স্বার্থে স্বামী বিবেকানন্দ ও ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের অপ-ব্যাখ্যা করেছেন। সাধু এবং তাদের গেরুয়া পোশাক ভারতীয়দের মনে একটা রূপকল্প তৈরি করে। যদিও আমরা জানি অধিকাংশ সাধুর বাস্তবিক রূপ এর থেকে অনেক আলাদা। হয়তো সম্পূর্ণ বিপরীতও হতে পারে। তবুও আমরা সাধু সম্পর্কে আমাদের চিরাচরিত ধারণা ছেড়ে দিতে রাজি নই। এর পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। প্রথম কারণ আমরা ধর্মভীরু। দ্বিতীয় কারণ হাজার হাজার বছর ধরে সাধারণ মানুষ ও ঈশ্বরের মাঝখানে সাধুদের যে আসন আমরা দিয়েছি তা এখুনি ফিরিয়ে নিতে আমরা রাজি নই। হয়তো আরও অনেক কারণ আছে। সাধুরা যে গেরুয়া পোশাক পরেন এই রং আসলে আগুনের সঙ্গে সমর্থক। আগুন যেমন সব কিছুকে পুড়িয়ে বিশুদ্ধতা দেয়, সাধুও তেমন সংসাররে সব কিছু ছেড়ে বিশুদ্ধ পথে ঈশ্বরের দিকে এগিয়ে যাবেন এটাই কাম্য। কিন্তু অধিকাংশ সাধু তা করেন কি? আমরা জানি, করেন না। যোগ সাধনাকে ব্যাবহার করে এক সাধু হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে যাচ্ছে। শুধু করেই যাচ্ছেন তা হয়। সরকারের ট্যাক্স ফাঁকি দিচ্ছেন। তবুও মন্ত্রীদের নিয়মিত দেখা যাচ্ছে তার অনুষ্ঠানে। অন্য একজন সাধু ধর্ষণের মামলায় সাজা পেয়ে জেলে আছেন। এক সময়ে দেশের দক্ষিণ পন্থী নেতা মন্ত্রীর দল ধরে ঐ সাধুটির আশীর্বাদ নিতে ভিড় করেছিলেন। কাজই বোঝা যাচ্ছে বর্তমান সময়ে সাজানো সাধু ও সত্যি সাধুকে আলাদা করা মানুষের পক্ষে খুব মুশকিল। হয়তো সেই মুশকিল আগেও ছিল। তাই রামকৃষ্ণদেব বলেছিলেন, ‘সাধুকে দিনে দেখবি, রাতে দেখবি। তারপর বিশ্বাস করবি’। কিন্তু আমরা কি তাই করি?

এবার আলোচনা করা যাক সাধুটি কি কি আপত্তিকর কথা বলেছেন। প্রথম কথা বিবেকানন্দ ধূমপান করতেন, দ্বিতীয় কথা তিনি মাছ মাংস খেতেন। একজন সাধু কোনদিন এমন করতে পারেন না! তৃতীয় যে বিষয়টা আলোচনায় প্রধান স্থান নিয়েছে সেটি রামকৃষ্ণ দেবের বাণী, যত মত তত পথ। এ ছাড়াও আরও কয়েকটি কথা সাধুটি বলেছেন যা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা অর্থহীন। আমার মূলত আলোচনাটি এই কয়েকটি বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবো।

প্রথম প্রসঙ্গ, ধূমপান। নরেন্দ্র নাথ দত্ত প্রথম ধূমপান করেছিলেন শৈশব কালে। গল্পটা মোটামুটি ভাবে সকলের জানা। তাঁর উকিল বাবার কাছে নানান জাতের লোক আসতেন। আর তাদের জন্যে রাখা হত নানান রকমের তামাক সেবন ব্যবস্থা। নরেন্দ্র দেখলেন সেখানে ব্রাহ্মণদের হুঁকো আলাদা, অন্যান্য জাতের হুঁকো আলাদা। প্রশ্ন করে জানলেন এক জাতের লোক অন্য জাতের হুঁকো খেলে নাকি জাত যাবে। বিষয়টা পরীক্ষা করার জন্য তিনি সব জাতের হুঁকো খেয়ে বোঝার চেষ্টা করলেন তাঁর জাত যায় কি না। বিবেকানন্দ কি সেই সময় থেকেই ধূমপান করতে শুরু করেন? মনে হয় না। সম্ভবত কলেজে পড়ার সময় থেকে তিনি ধূমপান করতে শুরু করেন। পরবর্তী কালে সাধু হওয়ার পরেও তিনি এই নেশা ছাড়েন নি। এই বিষয়ে আঙুল তোলার সময়ে আশাকরি ISKCON সাধুটির মনে শিব ঠাকুরের নাম একবারও আসেনি। যদি আসতো তাহলে তিনি স্বামীজীর ধূমপান বিষয়ে এই মন্তব্য করতে না। তান্ত্রিক মতে ভারতীয়রা শিবের যে পূজা করেন তার একটি বিশেষ উপকরণ হল ধূমপান সামগ্রী। যার মধ্যে গাঁজাও রয়েছে। নানান ধর্মীয় মেলায় আমরা গাঁজাখোর সাধুদের দেখি এবং কিছুই মনে করি না। তবে ISKCON সাধুটির পক্ষে নিশ্চয়ই এত কিছু মাথায় রাখলে মন্তব্যটি করা কঠিন হয়ে যেত। তাই তিনি এসব কিছুই মনে রাখেন নি। সম্ভবত তিনি এক ও একমাত্র কৃষ্ণের ভক্ত। শিবের মত গাঁজা খোর, শ্মশান বাসী অনার্য দেবতা কে তিনি পছন্দ করেন না। এমন কি মনে মনে ঘৃণাও করতে পারেন! মনে হয় মহাভারতের শান্তি পর্বটি তিনি পরেন নি। যেখানে নারায়ণ অর্থাৎ কৃষ্ণ বলছেন, শিব ও কৃষ্ণের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যিনি শিব তিনিই কৃষ্ণ। কাজেই বিবেকানন্দের ধূমপান বিষয়টি এই সাধুকে কোন ভাবেই বুঝিয়ে পারা যাবে না।

এবার সাধুর মাছ মাংস খাওয়ার বিষয়ে আসা যাক। এই বিষয়টা নিয়ে অনেকের মনেই অনেক সংশয় আছে। আমরা ছোট থেকে দেখেছি বিধবা ঠাকুমা মাছ মাংস খান না আর ঠাকুর দেবতা নিয়ে থাকেন। আমাদের তাই মনে হয় ঈশ্বরকে পেতে গেলে নিরামিষ খেতেই হবে। বিষয়টা আজকের নয়। স্বামীজী যখন আমেরিকায় গিয়েছিলেন তখনও এই প্রশ্নের মুখোমুখি তাকে হতে হয়েছে। অনেকে তাকে এ জন্যে ভণ্ড সাধু বলেছেন কারণ তিনি মাছ মাংস খান। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, আমি সাধু তাই যা পাই তাই খাই। খাবার না পেলেও দোষারোপ করি না। নিরামিষ খাবারের দাবি করে এদের বিব্রত করতে চাই না। এত গেল বিবেকানন্দের কথা। আমরা যদি পৃথিবীর অন্যান্য সাধুদের কথা চিন্তা করি তাহলে দেখব নানান জায়গার মানুষের খাদ্যাভ্যাস যেমন আলাদা তেমনই সাধুদের। উদাহরণ হিসাবে গৌতম বুদ্ধর জীবনকে দেখা যেতে পারে। যদি কেউ প্রশ্ন করে মৃত্যুর আগে গৌতম বুদ্ধ কি খাবার খেয়েছিলেন? তাহলে আমাদের বলতে হবে রুটি ও শুয়োরের মাংস। এই তথ্য নিশ্চয়ই ওই ISKCON সাধুটি জানেন না। জানলে বিবেকানন্দের খাওয়া বিষয়ে কথা বলতেন না। কিংবা এটাও হতে পারে যে তিনি গৌতম বুদ্ধকেও সাধু হিসাবে বিবেচনা করেন না! এই বিষয়ে তার মতামত না জেনে তাকে আক্রমণ করা উচিৎ নয়।

তবে আমিষ নিরামিষ বিষয়ে কয়েকটা কথা এখানে বলা যেতে পারে। আমিষাশীরা বলবেন, গাছেরও প্রাণ আছে। উত্তরে নিরামিষাশীরা বলবেন, গাছের ব্যথা লাগে না। আমিষাশীরা তখন প্রশ্ন তুলতে পারেন, ও তার মানে যার ব্যথা লাগে না তার বেঁচে থাকার অধিকার নেই! আচ্ছা তাই যদি হবে তাহলে একটি মাছ প্রাকৃতিক ভাবে মারা গেলে কিংবা একটা ছাগল বুড়ো হয়ে মরলে কি তাকে নিরামিষ জ্ঞানে খাওয়া যেতে পারে? আসলে এই ভাবে ভাবলে জল ফুটিয়ে খাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। কারণ তাতেও বীজাণু আছে। তাই খাদ্য বিষয়ে বলতে গেলে বলতে হয় খাদ্য ধর্ম মতে তিন প্রকার। সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক। আমরা নিরামিষ বলছি যাকে রান্নার গুনে সেটাও সাত্ত্বিক থেকে রাজসিক হয়ে যেতে পারে। শরীর রাখার জন্য খাবারের প্রয়োজন আছে এবং অনেক রকম খাবারের প্রয়োজন আছে। এই সত্য আমাদের মানতেই হবে। আর এটাও মানতে হবে যে আমাদের শরীরের একশো ভাগই আমিষ। এক দলা আমিষের মধ্যে বাস করে যিনি নিরামিষ খান তিনিই সাধু, এমন হাস্যকর যুক্তি না দেওয়াই ভালো। যে শিশু মায়ের স্তন্য পান করেছে যুক্তি দিয়ে ভাবলে বোঝা যায় সে নিরামিষ নয়, আমিষ খাচ্ছে। এই যুক্তিতে গরুর দুধও আমিষ। তবে ওই সাধুটি কথা বলে হাততালি পেতে এসেছেন। এইসব যুক্তির মুখোমুখি হতে মনে হয় রাজি হবেন না।

বিবেকানন্দ বিষয়ে বলতে গিয়ে সাধুটি বলেছেন, স্বামীজী নাকি শিকাগো ধর্মসভায় “হিন্দুত্ত্ব” বিষয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন। এখানে বলে নেওয়া ভালো, হিন্দুত্ত্ব শব্দের কোন অর্থ অভিধানে নেই। এবং স্বামীজী এই বিষয়ে ধর্মসভায় কোন কথা বলেন নি। তিনি হিন্দু ধর্মের কথা বলেছেন; সনাতন ধর্মের কথা বলেছেন। হিন্দুত্ত্ব শব্দটি সম্ভব আরএসএস-এর আবিষ্কার। নিবন্ধ লেখকের কাছে হিন্দুত্ত্ব কথাটির অর্থ হিন্দু ছাড়া অন্যান্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ বোধ ছাড়া কিছু নয়। বিশিষ্ট লেখক অধ্যাপক রাম গুহ তাঁর একাধিক রচনায় হিন্দুত্ত্ব শব্দটির এই একই ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সম্ভবত এইসব জানার সুযোগ বা মানসিকতা ওই সাধুর এখনও হয়নি। যে ধর্মসভায় স্বামীজীর ভাষণের কথা তিনি বলেছেন সেই ভাষণ তিনি নিজে পড়েছেন কি না, উপলব্ধি করেছেন কি না, এই বিষয়ে নিবন্ধ লেখকের গভীর সন্দেহ রয়েছে।

এবার একটু বলা যাক, ঠাকুর রামকৃষ্ণদেব সম্পর্কে সাধুটি যে ভুল ব্যাখ্যা করেছেন সেই প্রসঙ্গে। পৃথিবীতে মূলত দুই ধরনের মানুষ রয়েছেন। এক, যারা ঈশ্বর, আল্লাহ বা ওই জাতীয় নিজের থেকে বড় কোন শক্তিতে বিশ্বাস রাখেন আর একদল এমন কোন বিশ্বাস রাখেন না! বলাই বাহুল্য বিশ্বাস রাখা মানুষের সংখ্যাই এক্ষেত্রে বেশি। তবে বিশ্বাস রাখা মানুষরা সবাই যে একই মতে বিশ্বাস রেখেছেন এমন তো নয়। হিন্দু, মুসলমান কিংবা খ্রিস্টানদের বিশ্বাস যেমন আলাদা; তেমনই হিন্দুদের মধ্যেও আলাদা আলাদা বিশ্বাস রয়েছে। কেউ কালীকে বিশ্বাস করে কেউ বা কৃষ্ণকে। কেউ রামকে পূজা করে আবার কেউ হনুমানকে। কেউ আবার নিরাকারবাদী। বৌদ্ধ ধর্মে যেমন কোন ঈশ্বরই নেই। তাদের চেষ্টা অত্যন্ত শূন্যের অনুভূতি লাভ। শ্রী রামকৃষ্ণদেব নানান মতে সাধনা করে উপলব্ধি করেন, এই সব মতই আমাদের এক সত্যের কাছে পৌঁছে দেয়। সেই কথাটাই সহজ ভাবে তিনি বলেছেন, যত মত তত পথ।

ISKCON সাধুটি বলেছেন, সব পথ এক দিকে নিয়ে যেতেই পারে না। ব্যঙ্গ করে বলেছেন, GPS লাগিয়ে দেখুন আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন! না, সাধুটিকে কিছু বোঝানো লেখকের উদ্দেশ্য নয়। কারণ তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই কথাটা বলেছেন। মনে মনে তিনি বেশ জানেন যে এই জীবনে তিনি এমন কিছু বলে যেতে পারবেন না যা, ‘যত মত তত পথ’ কথাটির সমতুল্য হবে! লেখকের উদ্দেশ্য সাধুটির কথা শুনে যে সব সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্নে উঠেছে তাদের কাছে কয়েকটা প্রসঙ্গ তুলে দিতে যাতে তারা নিজেরাই বিষয়টা বিচার করে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারেন।

যদি প্রশ্ন ওঠে ঈশ্বর, আল্লাহ ইত্যাদির মধ্যে কি কি গুণ আছে? অনেক উত্তর আসবে। জ্ঞান, দয়া, ক্ষমা, শক্তি ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি প্রশ্ন করা হয় এই গুণ গুলো তাদের মধ্যে কতটা পরিমাণে আছে? উত্তর আসবে অসীম! অর্থাৎ আমার ঈশ্বর এমন একজন যার জ্ঞান, বুদ্ধি, শক্তি সহ সব কিছুই অসীম। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে যুক্তি বলে ঈশ্বর, আল্লাহ ইত্যাদি যা যা মানুষ কল্পনা করেছে তার প্রত্যেকটাই অসীম। এটা একটা যুক্তির বিষয়। পাঠকরা একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন। এখন যদি যুক্তির বিচারে এটা হয় যে ঈশ্বর, আল্লাহ ইত্যাদি সবাই অসীম। তাহলে আর একটি প্রশ্ন উঠে আসে। আচ্ছা একাধিক অসীম কি এক সঙ্গে থাকতে পারে? জীবনানন্দ তার ১৯৪৬-৪৭ কবিতায় লিখেছেন, ‘অনন্ত তো খণ্ড নয়’। ভাবলে সহজেই বোঝা যায় এটা হতে পারে না। অর্থাৎ অসীম একটি হতে বাধ্য। তবে কি তাকেই নানান মানুষে নানান ভাবে কল্পনা করছেন, নাম দিচ্ছেন? যেমন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পুকুরের উদাহরণ দিয়েছেন। নানান ঘাটে মানুষে একই বস্তুকে কেউ জল বলছে, কেউ পানি বলছে আবার কেউ বা বলছে ওয়াটার! এই চিন্তা থেকেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কথার ব্যাখ্যা করতে হবে। তিনিই উপলব্ধি করেছিলেন নানান পথের সাধক শেষ পর্যন্ত একই উপলব্ধিতে কোন না কোন দিন পৌঁছে যাবেন। মনে হয় ISKCON সাধুর এখনো এই সব গভীর উপলব্ধির সময় আসেনি। প্রসঙ্গত একটা কথা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন। যারা কথামৃত পড়েছেন বিষয়টা তাদের কাছে নতুন নয়। যৌন সুখ বিষয়টা হাজার ব্যাখ্যা করলেও শিশুরা যেমন বুঝতে পারবে না, মনে হয় এই ‘যত মত তত পথ’ কথাটিও সাধুটির কাছে একই রকম।

প্রসঙ্গত ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে। যেখানে তিনি বলছেন, ছাদে অনেক ভাবে ওঠা যায়। সিঁড়ি দিয়ে, মই দিয়ে, দড়ির সাহায্যের বা আরও অনেক ভাবে। কিন্তু একটি পা সিঁড়িতে আর একটি পা মইতে দিয়ে ছাদে ওঠা যায় না। প্রসঙ্গটা ISKCON সাধুর বিষয়ে বলতে গেলে বলতে হয়, মহান মানুষের নিন্দা করে কোনদিন মহান হওয়া যায় না! ‘যত মত তত পথ’ কথটির একটি চমৎকার ইংরেজি অনুবাদ আছে। Infinite Paths to Infinite Reality অর্থাৎ অনন্ত সত্যের কাছে পৌঁছাবার অনন্ত পথ রয়েছে। এটাই শ্রীরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ বলে গিয়েছেন।

অনেকে বলবেন ISKCON কর্তৃপক্ষ সাধুটির বিষয়ে কিছু শাস্তি মূলত ব্যবস্থা নিয়েছেন। আচ্ছা, ভিডিওটি যদি এভাবে ছাড়িয়ে না পড়তো কিংবা রামকৃষ্ণ ভক্তরা যদি ISKCON এর উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি না করতেন তাহলে কি তারা ব্যবস্থা নিতেন? এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে না। তবে ISKCON কর্তৃপক্ষ এমন কোন আশ্বাস দিয়েছেন কি যে তাদের মঞ্চ কে ব্যবহার করে আগামী দিনে আর কোন সাধু এমন কথা বলবেন না, একটা তারা নিশ্চিত করবেন? বিষয়টা পাঠকদের চিন্তার জন্যে রাখা রইল। আসলে মহাপুরুষদের নামে বাজে কথা বলে মহাপুরুষদের অপমান করা যায় না। তবে তাদের যারা পছন্দ করেন, ভক্তি করেন সেই মানুষদের মনে কষ্ট দেওয়া যায়। যারা এমন বাজে কথা বলেন তাদের মূল উদ্দেশ্যও কিন্তু সেটাই। তাই বিষয়টা নিয়ে রামকৃষ্ণ ভক্তরা উত্তেজিত হতেই পারেন। কিছু দিন আগে এক রাজনৈতিক দলের নেতা সারদা দেবী সম্পর্কে ভুল কথা বললেও তার প্রতিবাদ হয়। হয়তো আগামী দিনেও এমন প্রতিবাদ হবে। কারণ যাদের নিজেদের আলো নেই তারা মহাপুরুষদের কুৎসা করে তাঁদের আলোর অংশ পেতে চেষ্টা করেন। ইতিহাস কোনদিন এদের মনে রাখে না।

0 comments:

1
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়

Posted in







এই রচনার মূলে একজন আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ এবং সেই সূত্রে কিছু জানা-অজানা তথ্য সামনে আনা। আশির দশকের একেবারে শেষে একটি মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, যিনি ছিলেন একজন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ, নাম—পাহান। স্থান—রাজরাপ্পা।
বোকারো-পেটেরবার-রাজরাপ্পা-রামগড়-রাঁচীর বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে বাস করেন বহু আদিবাসী সম্প্রদায় ভুক্ত মানুষ। অঞ্চলটি ঝাড়খন্ড নামক দেশের নতুন একটি রাজ্যের অন্তর্গত, যে রাজ্যটির জন্ম মাত্র ১৫ই নভেম্বর, ২০০০ সালে।
সমগ্র দেশের আট দশমিক তিন শতাংশ ( ৮.৩%) শতাংশ আদিবাসীর অবস্থান এই রাজ্যটিতে। রাজ্যটিতে বসবাস করেন প্রায় বত্রিশ রকমের জনজাতি। এই আদিবাসী ও জনজাতি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে আটটি জনজাতির প্রাধান্য এখানে খুব বেশি এবং তাদের আদিম যুগের আদিবাসী/জনজাতি বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। সংখ্যার বিচারে তার মধ্যে অবশ্যই বীরহোর সম্প্রদায়ের প্রাধান্য অধিক।
যদিও শবরদের কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখিত হয় না, কারণ তাদের উপস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর কিংবা উড়িষ্যার মত নয়, কিন্তু এই আলোচনা একজন শবর জাতির মানুষকে নিয়েই।
পাহান নামে আদিবাসী যার সঙ্গে পরিচয় রাজরাপ্পায়, তিনি ছিলেন শবর জাতির মানুষ। সেখানকার কোল-প্রজেক্টে কাজ করেন যে সব অফিসার, তাঁদেরই কোন একটি বাংলোতে তিনি মালির কাজ করতেন। শবর জাতির মানুষ ঠিক আধুনিক কায়দায় বাগানের পরিচর্যা করতে পারেন কিনা এই নিয়ে তর্ক চলতেই পারে, কিন্তু সেই সময় ওই মানুষটি একটি বাংলোর বাগানের গাছপালা দেখাশোনার কাজেই নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর চেহারার বৈশিষ্টই তাকে জানিয়ে দেয় তিনি আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত একজন মানুষ। নম্র, বিনয়ী, ঝকঝকে সাদা দাঁত চোখে পড়ে কথা বলতে গেলেই। নাক-চোখ-মুখের গঠন আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের মতই। কিন্তু অত্যন্ত দরিদ্র, ক্ষয়াটে চেহারা। দেখে বেশ বয়স্ক মনে হলেও আদতে তা ছিল না। পাহানের পরনে প্রায় ছিঁড়ে যাওয়া একটি রঙ্গিন কাপড়ের টুকরো কোনমতে কোমরে জড়ানো। খালি গা, খালি পা। ওই অবস্থাতেই প্রথম সাক্ষাৎ। পরে মালিকদের দেওয়া একটি আকাশনীল রঙের জামা আর খাকি রঙের একটি হাফপ্যান্ট তাঁর পরনে থাকত। আর অন্য কোন পোশাকে তাঁকে কখনও দেখিনি। মাথা নিচু করে কাজে আসতেন, কাঁধে একটি কুঠার। আসা-যাওয়ার সময় সর্বদাই কাঁধে ঝোলানো থাকত সেই কুঠার। স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছেই জানা যায় পাহান আদতে শবর জাতির অন্তর্ভুক্ত একজন, তাই সবসময় কাঁধে কুঠার ঝোলানো থাকে। তাঁকে কখনও উচ্চাসনে বসতে দেখিনি। সবসময় মাটিতে উবু হয়ে বসতেন অথবা দাঁড়িয়ে থাকতেন। তখনও তার মাথা নিচু। সেই ব্যক্তির মতে,পাহান একজন অচ্ছুৎ, নিম্নশ্রেণির মানুষ, তাই উঁচু জায়গায় বসেন না। সকলের সামনে মাটিতে বসে থাকেন।
সত্যি কথা বলতে কি,শবর সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানা ছিলনা। পরবর্তীকালে জানার আগ্রহ থেকে বইপত্র ঘেঁটে দেখেছি, আজকের দিনে শবরদের অবস্থা যাই হোক না কেন,শবরদের অতীত ছিল রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, হর্ষচরিত এবং চর্যাপদের পাতায়। ঐতরেয় ব্রাহ্মণেও শবরদের উল্লেখ আছে। এ থেকে সহজেই অনুমান করা যায় জাতিটির প্রাচীনকালের অস্তিত্ব। তথাকথিত ‘আর্য’দের আগমনের পূর্বে যে সব ‘অনার্য’ জাতিগুলি বসবাস করত এদেশে, শবর জাতিটি ছিল তাদের অন্যতম।

জাতিতত্ত্ববিদদের মতে, শবররা কোলরীয় শ্রেণীর অন্তর্গত। হিমালয়ের উত্তরপূর্ব দিক থেকে ভারতে প্রবেশ করেছিল এইরকম অনুমান করা হয়ে থাকে। পরবর্তীকালে মধ্যভারত, উড়িষ্যা ও উত্তর মাদ্রাজের দিকে তারা চলে যায়। প্রাচীন সব গ্রন্থে পুন্ড্র- শবর কথার উল্লেখ পাওয়া যায় কারণ অনেক আগে শবরদের পুন্ড্ররাজ্যে ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বসবাস ছিল।
সংষ্কৃত অভিধানে পাওয়া যায় যে শবররা পত্রপরিধান করত। পত্রপরিধানকারীদের শবর এবং ময়ুরপুচ্ছ পরিধানকারীদের কিরাত বলে সম্বোধন করা হত। কিছুদিন আগেও উড়িষ্যায় পত্রপরিধানকারী শবরদের দেখা মিলত।
.
প্রাক আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আদিযুগের সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য ও প্রাচীনতম গ্রন্থ হল চর্যাগীতি বা চর্যাপদ। মনে করা হয় এগুলি পালরাজাদের সময়ে রচিত অর্থাৎ প্রায় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত এবং এই রচয়িতাগণ ছিলেন বৌদ্ধ সহজিয়া সম্প্রদায়ের কবি। চর্যাগীতিতে তৎকালীন অন্ত্যজ সমাজের প্রতিফলন দেখা যায়। লোকজীবনের বিশেষত নিম্নশ্রেণী ও অন্ত্যজশ্রেণীর জীবন গীতিগুলিতে সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে। সেকালে যে আদিম কোলজাতির বসবাস ছিল যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল শবর জাতি,এইউল্লেখ চর্যাপদেও পাওয়া যায় । এই নিম্নশ্রেণীর মানুষগুলির বসবাস ছিল তৎকালীন সভ্য,নাগরিক সমাজ থেকে দূরে বড় বড় পাহাড়ের শিখরদেশে। চর্যাগীতিতে শবরদের সম্বন্ধে এমনই উল্লেখ পাওয়া যায়---
‘ বরগিরিসহর উত্তুঙ্গমুনি সবরেঁ জহি কিঅ বাস ‘( কাহ্নপাদ-১৯)
চর্যাগীতিতে শবরপাদ নামে একজন কবির কথা জানা যায়, সম্ভবত তিনিও ছিলেন জাতিতে শবর। চর্যাগীতিতে আরো পাওয়া যায়---
‘উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরো বালি।
মোরঙ্গী পীচ্ছ পরহিন সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী’ ইত্যাদি।
অর্থাৎ জনবসতি থেকে দূরে পর্বতে বাস করে শবর-শবরী। শবরীর গলায় গুঞ্জার মালা এবং ময়ূরপুচ্ছ পরিধান করে আছে। এই প্রসঙ্গে মাত্র কিছুদিন আগেও উড়িষ্যার ঘনজঙ্গলে যেখানে শবররা বসবাস করে তাদের পরিধানে ময়ূরপুচ্ছ ও পত্রপরিধান দেখা গেছে। আরো একটী চর্যাগীতিতে শবরদের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে বলা হয়েছে—‘ টালত মোর ঘর নাহি পরিবেশি’ ( ঢেন্‌ঢেনপাদ ৩৩ নং) অর্থাৎ উঁচু টিলার উপরে ঘর, যেখানে কোন প্রতিবেশী নেই।
এই প্রসঙ্গে ব্যক্তিগত একটি ভাবনা মনে আসে, চর্যাগীতিতে শবর-শবরীদের কথা বলা হয়, চর্যাগীতিতে যে কবি শবরপাদকে শবর জাতি বলে মনে করা হয়, তবে কি রামায়ণে বর্ণিত ‘শবরীর উপাখ্যানে’র শবরীও কি এই শবর জাতির অন্তর্গত?
রামায়ণে শবরীর প্রতীক্ষার কাহিনি আমরা জানি। বহুযুগ আগে,সেই শবরীও কি শবরকন্যা ছিলেন? জাতিতত্ত্ববিদ দের মতে যদি জনগোষ্ঠী সম্পপ্রদায়ের মানুষেরা উচ্চবর্ণ ও তথাকথিত ‘আর্য’ দের তাড়নার ফলে নানাদিকে চলে যান। যার মধ্যে বন-জঙ্গলে, গুহা- গিরি-কন্দরে বসতি স্থাপন করারকথাওয়াছে। সেখানে বলা হচ্ছে যে কিছু জন উত্তর মাদ্রাজের দিকে অর্থাৎ দক্ষিণের দিকেও চলে যান। শবরী উপাখ্যানে আমরা দেখি তাঁর অবস্থান ছিল পম্পা সরোবর এবং তৎসংলগ্ন অরণ্যে। প্রাচীন পম্পা সরোবর হল বর্তমানের হাম্পি। তবে কি, প্রাচীন শবরজাতি পম্পাসরোবরঞ্চলেবসতি স্থাপন করেছিলেন? হয়তো এ সত্য নয়, তবু এমন একটি অনুমান করতে ক্ষতি কি!
আরও একটি কথা উল্লেখ করার মত, পুরীর জগন্নাথ দেবকে শবরদের দেবতা বলা হয়। উড়িষ্যায় যে অনেক শবরের বাস, সে আমরা সকলেই জানি। কোন একসময় যে শবরজাতি উন্নতির ফলে রাজা বা সেখানের প্রধান হয়ে উঠেছিলেন, তাতে সন্দেহ নেই। পুরীর দেবতার অবয়ব দেখে অনেকেই অনুমান করেন তিনি আদিবাসী সমাজের দেবতা। পুরীতে উৎসবের সময় রাজ পরিবারের উত্তরাধিকারীগণই পূজার অধিকারী হন।
.
বলতে গেলে ভারতে বৃটিশ শাসনের সময় থেকেই শবরদের অস্তিত্বের সংকট শুরু হয়। বন কেটে বসত নির্মাণের ফলে তাদের উৎখাত করা হয়। যে মানুষগুলি বন-জঙ্গলে লুকিয়ে একান্ত অরণ্যচারী জীবন যাপন করত, তারা প্রকাশ্যে এসে পড়ার ফলে দিশেহারা, নানাদিকে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য হল। কাজকর্মের কোন সংস্থান না থাকায় অভাব-অনটন, তার ফলে যে কোন উপায়ে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি করতে গিয়ে চুরি-চামারি এবং শেষ পর্যন্ত শবরদের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠল দস্যুবৃত্তি বা অপরাধপ্রবণ জাতি হিসাবে পরিচিতি লাভ।
কিন্তু শুধুমাত্র ইংরাজদের কাছেই নয়, দেশীয় উচ্চবর্ণ, ও বর্ণহিন্দুদের কাছেও তারা সমাজে অস্পৃশ্য, অচ্ছ্যুত হিসাবেই একঘরে হয়ে রইল। সুতরাং তাদের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলাই সমাজের উদ্দেশ্য হল। যদিও তারা নিজেদের হিন্দু বলেই মনে করে থাকে এবং লক্ষ্মী, মঙ্গলচন্ডী তাদেরও দেবতা বলে জানা যায়। শব দাহ করার রীতি তাদের মধ্যেও আছে, তবে অশৌচ পালনের জন যে মাথা মুন্ডনের প্রথা আছে, সেটি তারা নিজেরাই নিজেদের মাথা মুন্ডন করে থাকে।
শবর কথাটি এসেছে ‘সগর’ শব্দ থেকে, যার অর্থ কুঠার বা যাকে আমরা বলি কুড়ুল। শবরদের হাতে কুঠার দেখতে পাওয়া যায় এবং তারা সব সময় কুঠার নিয়ে ঘোরাফেরা করে, এটিই তাদের বৈশিষ্ট্য। শবরদের এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই পাহান মালির চেহারাটি চোখে ভেসে ওঠে। কারণ পাহানকে দেখেছি প্রতিদিন কাঁধে একটি কুড়ুল নিয়ে বাগানে কাজ করতে আতেন। বইপত্র ঘাঁটাঘাটি করতে গিয়ে আরো জানা গেল যে, বিহার-উড়িষ্যার রিসার্চ সোসাইটির পত্রিকার দ্বিতীয় খন্ডে ( ১৯১৫ সালে প্রকাশিত) শবরদের কুঠার প্রাপ্তি নিয়ে একটি কাহিনি আছে।
কাহিনিটি এইরকম--- অনেকদিন আগে মানভূমের কয়েকটি জায়গায় তামার ফলক লাগানো কিছু অস্ত্র পাওয়া যায়। সেখানকার পোখুরিয়া গ্রামের এক পাদ্রীও ঠিক একইরকমের কয়েকটি তামার অস্ত্র আশেপাশের অঞ্চল থেকে পান এবং সেগুলি নিজস্ব সংগ্রহে রেখে দেন। পাদ্রির নাম ক্যাম্পবেল সাহেব। সেইসময় মানভূমের ডিস্ট্রিক্ট ইঞ্জিনীয়ার ছিলেন রায়বাহাদুর নন্দগোপাল মুখোপাধ্যায়। তিনি এই অস্ত্রগুলিকে দেবী প্রতিমার বল্‌গা বলে চিহ্নিত করেন। পরে জানা যায় যে সেগুলি তাম্রযুগের অস্ত্রশস্ত্র এবং তা প্রকাশিত হয় সোসাইটির জার্নালে। প্রশ্ন জাগে,সেইকুঠার জাতীয় অস্ত্রগুলি কি প্রমাণ করে, সেই স্থান ছিল শবর জাতির একসময়ের বাসস্থান? পরে নানা তাড়নায় সেখান উৎখাতের ফলে অন্যত্র চলে যান? জানা হয়নি অনেক কিছুই।
একটি মানুষের কথা বলতে গিয়ে সেই মানুষটি সম্বন্ধে ও তাদের জাতির ইতিহাস, বৈশিষ্ট্য, এবং ভারতের ইতিহাসে সেই জাতির বৃত্তান্ত সম্বন্ধে কিছু জানা গেল।
অতীতের ঐতিহ্য তো এভাবেই খুঁজে চলা !

1 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - অরিন্দম ব্যানার্জী

Posted in




















বহুদিন পর গতকাল মাঝরাতে ছাদে উঠেছিলাম। অন্ধকার নিশুতি রাতে তারাভরা আকাশটার দিকে তাকিয়ে চোখ দু'টো যেন জুড়িয়ে গেল। একমনে অনেকক্ষণ সেইদিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে হল ছায়াপথ জুড়ে ওই যে অগণ্য আলোকবিন্দুর মত নক্ষত্র, এরা সব কোথা থেকে এলো? কোটি কোটি সৌরজগৎ যেন নিঃসীম অন্ধকারে ভাসছে; কত অসংখ্য গ্রহ-উপগ্রহ – আমাদের পৃথিবীর মত আরো কত অগুনতি পৃথিবী হয়ত সেখানে আছে। আমাদের চেতনার নাগাল থেকে অনেক দূরে প্রকৃতির আরো কত আশ্চর্য আয়োজন রয়েছে হয়ত সেইসব জগতে, ভাবলে বিস্ময় জাগে! সেই নিস্তব্ধ অন্ধকারে, নক্ষত্রখচিত বিরাট শামিয়ানায় বসে ভাবতে লাগলাম, এসবের উৎস কী? এই প্রতীয়মান বিশ্ববৈচিত্রের অন্তরালে কোন একক সত্য আছে কি, যার থেকে এই এত কিছু সৃষ্টি হয়েছে? আর যদি তা থাকেও, তার সাথে আমাদের রোজকার জীবনের সুখ-দুঃখ, ওঠা-পড়া, জয়-পরাজয়ের সম্পর্কই বা কী?

আমার এক বন্ধু ছিল যে সারা সারা রাত জেগে শুধু তারাদের ছবি তুলতো। আকাশগঙ্গা, এ্যান্ড্রোমেডা, এইসব ছায়াপথের দিকে ক্যামেরা তাক করে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতো। ও বলতো, তারাভরা আকাশে কি একটা গভীর রহস্য আছে, ছায়াপথের স্তিমিত আলোয় তাই অমন ভাবগম্ভীর মৌনতা! ও আমাকে একদিন বলেছিল, ভেবে দেখ, মহাবিশ্বের এই অকল্পনীয় পরিব্যাপ্তির তুলনায় পৃথিবীর স্থান কতটুকুই বা! বরং এই যে চিরপরিচিত শস্যশ্যামলা গ্রহটাকে আমরা আমাদের ঘর বলে জানি, তার চতুর্পাশে যে বিপুল মহাশূন্যতা আছে, তার পরিসীমা কেমন দুর্লঙ্ঘ‍্য, তার ভাষা কেমন দুর্বোধ্য! তা সত্ত্বেও মানুষ যে সেই অসীমকে তার চিন্তার পরিধিতে বাঁধতে চায় তার কারণ মানুষের মনে একটি শাশ্বত জিজ্ঞাসা আছে যা তাকে কেবল তার ক্ষুদ্র পরিসরটুকু নিয়েই তৃপ্ত থাকতে দেয় না, অজানার আহ্বানে তাকে সাড়া দিতে হয়। ঠিকই, আজ বুঝি, এই অজ্ঞাত অনন্তকে জানার চেষ্টা মানুষের একটি চিরকালের প্রবণতা – সভ্যতার আদিকাল থেকেই মানুষ এই বিশ্বধাঁধাকে নানাভাবে ধরতে চেয়েছে, এই বিরাট অনন্ত ব‍্যোমে তার ক্ষুদ্র অস্তিত্বের মূল্য কতখানি তা বারংবার মেপে দেখতে চেয়েছে। এইভাবেই জন্ম হয়েছে কত থিওলজির, সৃষ্টি হয়েছে কত দর্শন এবং বিজ্ঞানের। সময়ের সাথে সাথে মত-পথের বিভিন্নতা বেড়েছে, পুরাতন দৃষ্টিভঙ্গির সাথে নতুন দর্শনের কখনো সহাবস্থান হয়েছে আবার কখনো হয়েছে সংঘাত। ইতিহাসজুড়ে বিশ্বাসের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব-বিবাদ কিছু কম হয়নি, তবে কোনদিনই বিশ্ব-রহস্যের কোন একটিমাত্র ব্যাখ্যা, কোন একটিমাত্র ছবি পৃথিবীতে নিরঙ্কুশ আধিপত্য পায়নি। সমাজ চিরকালই এই ব্যাপারে শতধাবিভক্ত থেকেছে। চিন্তাশীল মানুষ অনেকসময় বিভ্রান্ত হয়েছে, ভেবেছে, কোন মতটা ঠিক! কোন পথে গেলে সে তার অস্তিত্বের অর্থ খুঁজে পাবে! তবে চিন্তাধারার এই বৈচিত্র এবং দ্বন্দ্ব শুধু অতীতকালেরই বৈশিষ্ট নয়– আমাদের এই সমকালের মর্মেও নিহিত আছে এই সূক্ষ সংশয়বাদ, মানুষের সেই শাশ্বত জিজ্ঞাসা আজও তৃপ্ত হয় নি। আজও বিশ্বরহস্যের সর্বসম্মতিক্রমে কোন নিষ্পত্তি হয়নি। কেউ বলতেই পারেন: বিজ্ঞানের এই অভাবনীয় অগ্রগতির যুগে এইসব প্রশ্নের কী মূল্য? পৃথিবীটা তো আজ শুধু 'বোকাবাক্সে' নয়, সাড়ে পাঁচ-ইঞ্চির মুঠোফোনের মধ্যে এসে ঢুকেছে। ঠিকই, কিন্তু সভ্যতার এই অগ্রগতির পরেও অস্তিত্ত্বের মৌলিকতম প্রশ্নগুলি যে একই রকম অমীমাংসিত রয়ে গেছে, সে কথাও কি অস্বীকার করা যায়?


আমার যেমন প্রায়ই মনে হয়, বিশ্বের কোন রূপটা সত্যি? যেটা মানুষে দেখে নাকি যেটা জীব-জন্তুরা দেখে? মানুষ রামধনুর সাতখানা রং দেখতে পায় কিন্তু একটি কুকুর তুলনায় অনেক কম রঙিন একটা পৃথিবী দেখে, তার চোখ অত রঙের বৈচিত্র বোঝে না। উল্টোদিকে, একটা হামিং-বার্ড মানুষের চাইতে বেশি রং দেখতে পায় – তার কাছে পৃথিবীটা মানুষের চাইতে আরো অনেক বেশি রঙিন। আশ্চর্য নয় কি? বিভিন্ন পশুপাখি বিভিন্ন ভাবে বিশ্বকে দেখে। তাহলে এত দেখার মধ্যে কোন্ দৃষ্টিভঙ্গিকে ঠিক বলে ভাবব – মানুষের নাকি ওই অসংখ্য জীবজন্তুদের?

অনেকেই বলবেন, সত্যটা আসলে আপেক্ষিক, যার যার তার তার। কিন্তু তার উত্তরে বলা যায়, এই পৃথিবীতে তো বেশ কিছু কোটি প্রজাতির জীব রয়েছে, তার মানে সত্যটা কি ওই অত কোটি ধরণের? তাও কি হয়? যে-পৃথিবীটাকে সব প্রাণী একই সময়ে একই সাথে ভোগ করছে তার স্বরূপ একই সময়ে কোটি রকমের কি করে হবে? মুহূর্তের একটি ভগ্নাংশে 'লাল' রং তো লাল-ই – লালটা এক রঙেরই ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা কি করে হবে? বিজ্ঞান বলবে: আলোক-রশ্মিতে সব রঙের সহাবস্থান আছে – বস্তুগুলি (objects) আলোর কিছু রং প্রতিফলিত ক'রে বাকি রং শুষে নেয়; সেই প্রতিফলিত আলোর সংস্পর্শে বিভিন্ন প্রাণী তাদের চোখের গঠনতন্ত্রের প্রকারভেদে একই বস্তুতে রঙের বিভিন্ন মাত্রা দেখে, অর্থাৎ, আলোর রঙেই বস্তু রঙিন হয়। এই যুক্তি একেবারে অকাট্য । কিন্তু তাহলেও একটি ক্ষণে সেই বস্তুটির কোন্ রংটাকে যথার্থ বলে মানবো সেই প্রশ্নের উত্তর কিন্তু এতে নির্ধারণ করা গেল না! নিরপেক্ষ সত্য কোনটা?

জীব-জন্তুদের কথা না হয় বাদ দিলাম, একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষেরই কি কিছু কম তফাৎ! একজনের রুচি, বিশ্বাস, চিন্তা, আদর্শ অপরজনের সাথে মেলে না। ইতিহাসজুড়ে তাই মানুষে-মানুষে, জাতিতে-জাতিতে কতই না বিরোধ, কতই না দ্বন্দ্ব। চিন্তার ভিন্নতাই সভ্যতাকে পথ দেখিয়েছে। তা বলে সবাই যে অবশ্য এই ভেদাভেদকে স্বীকার করেছেন এমন নয়, কেউ কেউ একেবারে ব্যতিক্রমী চিন্তাও করেছেন – যেমন প্রাচীন গ্রীসের সোফিস্ট দার্শনিক প্রোডিকাস্ (খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী), যিনি বলেছিলেন, মানুষে-মানুষে কোন বিষয়ে তর্ক বা মতবিরোধ একেবারেই অসম্ভব কারণ দু'জন মানুষ যদি কোন বিষয় নিয়ে তর্ক করে তাহলে বুঝতে হবে তারা মোটেই এক বিষয়ে কথা বলছে না – তাই বিরোধ নিরর্থক। কথাগুলো প্রথম পড়ে অবাক হয়েছিলাম, যেখানে দ্বন্দ্ব আর তর্কই নিজের মতামত প্রকাশের প্রতিষ্ঠিত উপায় সেখানে এই রকম চিন্তা করলে কি চলে!


যাই হোক, মোটের ওপর তার মানে একটি কথাই নিশ্চিত করে বলা যায় – বিশ্বের স্বরূপ সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞানের কোন নিশ্চয়তা নেই; জগৎটা কেমন সেটা পরোক্ষভাবে বলা গেলেও, সরাসরিভাবে বলা সম্ভব নয়, কারণ যে যার নিজের মতো করে বিশ্বকে দেখে। যেমন আগেই বলেছি, একই বিশ্বের এই বিভিন্নতা চিরকালই মানুষের চিন্তাশক্তিকে বিভিন্ন দিকে প্রেরিত করেছে। প্রোডিকাসের সমসাময়িক আরেক গ্রীক দার্শনিক, স্বনামধন্য সক্রেটিস যেমন বলেছিলেন, বিশ্বটা কেমন সেটা জানা কোনমতেই সম্ভব নয়, তাই সেই প্রশ্নে বৃথা সময় নষ্ট না করে, 'কি ভাবে বাঁচা উচিত' সেই প্রশ্নে মনোনিবেশ করাই ভাল। তাই তিনি অধিবিদ্যা (Metaphysics) থেকে নীতিতত্ত্ব (Ethics)-এ চলে এসেছিলেন। গ্রীক-দর্শনের একাংশের কাছে বিশ্বের স্বরূপ হল অবর্ণনীয় এবং অনিশ্চিত – তাঁদের ভাষায় "এ্যাপোরিয়া" (aporia)। এই কারণে, সেই প্রাচীন গ্রীসেরই স্কেপটিক দার্শনিকেরা বলেছিলেন, নিশ্চিত জ্ঞান বলে কিছু হয়না– 'Knowledge is impossible!' সক্রেটিসের কথায় আরেকজন বিশ্ববিখ্যাত মনীষীর কথা মনে পড়ে – তথাগত বুদ্ধ। বুদ্ধদেব বলেছিলেন, কারও পায়ে যদি হঠাৎ একটি বিষাক্ত তীর এসে ঢোকে, সে কি তখন সেই তীরন্দাজের ঠিকুজি-কুষ্ঠী জানতে চাইবে নাকি আগে ওই তীরটা পা থেকে বের করে ব্যথার উপশমের চেষ্টা করবে? তাঁর কাছেও অধিবিদ্যার তুলনায় নৈতিকতাই ছিল বেশি গুরুত্ত্বপূর্ণ। সেই কোন প্রাচীন কালের দু'জন মনিষী, যাঁরা পৃথিবীর দুই প্রান্তের অধিবাসী ছিলেন এবং যাঁরা কোনদিনও একে অপরের সংস্পর্শে এসেছেন বলে জানা নেই, তাঁদের চিন্তার এই সাদৃশ্য বিস্ময়কর বলে মনে হয়!


বিশ্বের দর্শন নিয়ে কথা হলে ভারতের ষড়দর্শনের অন্যতম, অদ্বৈতবেদান্তের কথা আপনিই চলে আসে। ভারতীয় চিন্তানায়কদের আড়াই সহস্রাব্দব্যাপী দর্শনচিন্তার ফলশ্রুতি হল অদ্বৈতবাদ। দর্শনের ইতিহাসে অদ্বৈতবেদান্ত নিশ্চিত ভাবেই একটি মাইলস্টোন, যা পূর্ববর্তী বা পরবর্তী ভারতীয় দর্শনগুলিকে পূর্ণতা দেয়। এই অদ্বৈতবেদান্তেও বিশ্বকে 'অনির্বচনীয়' বলা হয়েছে। খ্রীষ্ট পরবর্তী সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে গৌরপাদ-নামক এক দক্ষিণভারতীয় সন্ন্যাসী প্রথম অদ্বৈততত্ত্বকে পূর্ণাঙ্গ দর্শন হিসেবে প্রচার করেছিলেন যদিও তাঁর জগদ্বিখ্যাত উত্তরসূরি শঙ্করাচার্যের মাধ্যমেই অদ্বৈবেদান্ত একটি বিশ্বমানের দর্শনে পরিণত হয়েছিল। অদ্বৈতবাদীরা বললেন, এই দৃশ্যমান জগৎ হল "রজ্জুতে সর্পভ্রমের" মত একটি ভ্রান্তি যার অপর নাম হল "মায়া"। তবে এই ভ্রান্তিজনিত জগতের আড়ালে একটা সার সত্য আছে যা অপরিণামী এবং শাশ্বত। সেই নিরপেক্ষ চিরসত্যের একটা সুন্দর নাম আছে – 'ব্রহ্ম', যাঁর ওপর আপেক্ষিক এই বিশ্বের অস্তিত্ব নির্ভর করে। অন্ধকার পথে দড়ি বা রজ্জুকে আমরা সাপ ভুল করি, বেদান্তের পরিভাষায় রজ্জুতে সাপের 'অধ্যাস' হয়। ঠিক তেমনই, অপরিণামী ব্রহ্মকে আমরা মায়ার প্রভাবে পরিবর্তনশীল জগৎ বলে ভুল করি, অর্থাৎ ব্রহ্মে জগতের অধ্যাস হয়। ব্রহ্মই অবশ্য একমাত্র সত্য, এই জগতের উপাদান এবং নিমিত্ত কারণ। এই অধ্যাস-সৃষ্ট বিশ্বটা সত্য না মিথ্যে সেটা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়– বিশ্বের স্বরূপ তাই "অনির্বচনীয়"। অদ্বৈতবেদান্তের উৎস যেহেতু ব্রহ্মসূত্র ( খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী) এবং উপনিষদ, তাই একথা বলাই যায় যে এই অদ্বৈতচিন্তা প্রাচীন ভারতে অন্তত উপনিষদের যুগ থেকেই ছিল (প্রাচীনতম উপনিষদগুলি খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম থেকে পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে রচিত হয়েছিল)। ঋগ্বেদে বহুবার "মায়া" শব্দটি ব্যবহার হয়েছে তবে যে-অর্থে শঙ্করাচার্য এই শব্দ ব্যবহার করেছেন তা পূর্ণরূপে প্রথম পাওয়া যায় শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে (খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী)।

ভারতে দর্শনের যেটি আদিযুগ তার প্রায় সমকালে, ভারতবর্ষ থেকে অর্ধেক পৃথিবী দূরে, প্রাচীন গ্রীসের ইলিয়া অঞ্চলে একজন দার্শনিক জন্মেছিলেন যাঁর নাম ছিল পারমিনিডিস্ (খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দী), যাঁকে কেউ কেউ সক্রেটিসের গুরু বলেও মনে করেন। তিনিও বলেছিলেন যে বিশ্বটা আসলে অলীক এবং এই পরিবর্তনশীল দৃশ্যমান বিশ্বের পেছনে একটি অপরিণামী সত্য আছে, যাকে তিনি 'এক' বা One বলেছেন। অবশ্য, তাঁর "এক" আর উপনিষদের "সৎ-চিৎ-আনন্দস্বরূপ" ব্রহ্মের মধ্যে অনেক তফাৎ আছে। পারমিনিডিসের সমসাময়িক আরেক গ্রীক মনিষী হেরাক্লিটস্ আবার বলেছেন, বিশ্বটা যুগপৎ এক এবং বহু। এই জগতে স্থিরতা বলে কিছু নেই – একই নদীতে আমরা দু'বার পা রাখতে পারি না। এই কথাগুলিও প্রাচীন বৌদ্ধদর্শনের কথা মনে করিয়ে দেয়। বৌদ্ধমতে, এই বিশ্বের সবকিছুই ক্ষণিক, প্রতি মুহূর্তে বিশ্বটা বদলে বদলে যাচ্ছে। তবে এই পরিবর্তনের ঘূর্ণির আড়ালে কোন অনাদি-অনন্ত সত্তা বা ব্রহ্ম নেই।


দর্শনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে মনে হয়, যে প্রাচীনযুগে ভারত এবং গ্রিসের চিন্তা একে অপরকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। যেমন বিখ্যাত দার্শনিক প্লেটো, সক্রেটিসের শিষ্য। তাঁর চিন্তার সাথে আমাদের দেশের অদ্বৈততত্ত্বের অনেক মিল আছে (অমিলও অবশ্য প্রচুর)। প্লেটো বলেছেন সত্যের দু'টি স্তর আছে। নিরপেক্ষ ধারণার (Forms) স্তর আর আপেক্ষিক বস্তু-জগতের স্তর। ধারণা বা আকারই হল স্থির সত্য। পরিদৃশ্যমান এই জগৎটা সেইসব আকারের অপূর্ণ অনুকরণ মাত্র। এই বস্তুজগৎ সম্বন্ধে কোন নিশ্চিত জ্ঞান সম্ভব নয়, বড়জোর জগৎকে আপেক্ষিক বলা যেতে পারে। মজার ব্যাপার, প্লেটোর শিষ্য এ্যারিস্টটল তাঁর নিজের গুরুর তত্ত্বকেই "transcendental moonshine" বা অতীন্দ্রিয় অবাস্তবতা বলে উপহাস করেছেন। এ্যারিস্টটলের মতে এই বিশ্বটা সৎ, তা কখনোই আপেক্ষিক কিংবা অলীক নয়।

অনেক কথাই তো বললাম, কিন্তু এত কথার মধ্যে বিজ্ঞানকে বাদ দিলে কেমন করে চলবে? আমরা তো বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির যুগে বাস করছি !পদার্থ বিজ্ঞানের দু'টি ধারা আছে –ক্ল্যাসিক্যাল আর কোয়ান্টাম ফিজিক্স। আর এই দু'টির মধ্যখানে জমিয়ে বসে আছে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব (Theories of Relativity)। ক্ল্যাসিক্যাল তত্ত্ব এবং আইনস্টাইনের তত্ত্ব, উভয়েরই সিদ্ধান্ত হল এই যে, কোন একটি বস্তুর বর্তমান গতি এবং অবস্থান যদি জানা থাকে তাহলে সেই বস্তুর ভবিষ্যতের গতি-অবস্থানেরও পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব। কিন্তু অপরদিকে কোয়ান্টামের বিজ্ঞানীরা বলছেন, কিছুতেই একটি বস্তু (বা কণার) বর্তমান অবস্থা থেকে তার ভবিষ্যতের অবস্থার নিশ্চিত পূর্বগণনা সম্ভব নয় – হয় আমরা কণাটির গতি জানতে পারি না হয় অবস্থান, দু'টি একসাথে কখনোই নয়। কোয়ান্টাম তত্ত্ব আবার ঐখানেই থেমে না থেকে বলছে, একটি কণা শুধুমাত্র কণাই নয়, সেটি কখনও কণা, কখনও তরঙ্গ– রীতিমত রঙ্গ! আইনস্টাইন সাহেব কোয়ান্টামের এই অনিশ্চয়তাকে মানতে পারেননি, তিনি বলেছিলেন, "God does not play dice" – ঈশ্বর পাশা খেলেন না। বলা বাহুল্য, ঈশ্বর বলতে তিনি প্রচলিত মতে ঈশ্বরের কথা বলেননি, জড়প্রকৃতির কথা বলেছেন। একসময় এই নিয়ে আইনস্টাইনের সাথে কোয়ান্টাম তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা নিলস্ বোরের পর পর কিছু তর্ক-বিতর্ক হয়েছিল যা পরবর্তীকালে "Bohr-Einstein debate"-নামে সর্বজনবিদিত হয়েছে।


এত কথার পর একটি বিষয়ই শুধু স্পষ্ট হল: দর্শন এবং বিজ্ঞানের আবহমানকালের প্রয়াস সত্ত্বেও বিশ্বরহস্য সম্বন্ধে মানবমনের অন্তর্নিহিত সংশয়ের নিশ্চিত নিরসন আজও সম্ভব হয়নি। কত সভ্যতা এসেছে, ইতিহাসের কালখণ্ডে নিজেদের পদচিহ্ন রেখে দিয়ে আবার সময়েরই খরস্রোতে মিশে গেছে। তাদের জায়গায় জেগেছে নতুন সভ্যতা, নতুন আদর্শ নিয়ে। কত মহামনীষী যুগে যুগে তাঁদের সমকাল এবং উত্তরকালকে মহতী চিন্তার শক্তিতে ধন্য করেছেন, আমরা সবাই তাঁদের কাছে ঋণী। কিন্তু আজ এত বছর পরেও, মানুষ সৃষ্টির মৌলিকতম প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজে পায়নি। জীবনের উপাদান কী? এই বিশ্ব কোথা থেকে এলো? বিশ্বের বিরাট আয়োজনে আমাদের প্রয়োজনই বা কী? এইসব জিজ্ঞাসা এখনো পর্যন্ত আলোর প্রতীক্ষায় আছে।

ওই নক্ষত্রখচিত আকাশ তাই মানুষের কাছে আজও একই রকম বিস্ময়কর। আজও তার কুহক তিন হাজার বছর আগের কোন রাত্রির মতোই এক "এ্যাপোরিয়া"।



তথ্যসূত্র:

১) The History of Philosophy – A C Grayling

২) A History of Indian Philosophy : Vol I – Surendranath Dasgupta

৩) Greek Philosophy : Thales to Aristotle – Reginald E Allen.

৪) পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস: প্লেটো ও এ্যারিস্টটল – দেবব্রত সেন।

৫) Brahmasutras: According to Sri Sankara – Swami Vireswarananda

৬) Brief Answers to the Big Questions – Stephen Hawking

৭) Wikipedia

৮) Internet Encyclopedia of Philosophy (https://iep.utm.edu)

0 comments:

0
undefined undefined undefined

প্রবন্ধ - অনিন্দিতা মণ্ডল

Posted in






একটি মানুষ শিশু ভালোবাসেন। মানুষটি বিখ্যাত। সারা দেশ জুড়ে সাধারণ মানুষের মনে তাঁর সম্পর্কে একটি স্বপ্নের রাজকুমার গোছের ভাবমূর্তি তৈরি করতে এই স্বাভাবিক বৃত্তিটিকে অনেক বড় করে মহৎ করে দেখাতে হয়েছে। ফলশ্রুতি – আমাদের একটি জাতীয় দিবস। শিশু দিবস। যেন শিশুকে ভালবাসতে গেলে বিশেষ হতে হবে। অথচ সেই কবেই যেন কে বলে গিয়েছেন, যে মানুষ শিশু ফুল আর গান ভালবাসেনা সে খুন করতে পারে। সুতরাং এটি মানুষের স্বাভাবিক মনের বৃত্তি। আস্বাভাবিক বৃত্তিই তো প্রাণ নেওয়া!

বাচ্চাদের দেখতে, তাদের সঙ্গে থাকতে, তাদের হাসি কথা আহ্লাদিপনা দেখে আদর করতে সকলেরই ইচ্ছে করে। আমার দেখা এমন মানুষ আছেন যারা প্রকৃতপক্ষে খুবই রাশভারী, গম্ভীর, হাসেন কম। কিন্তু একটি শিশুর উপস্থিতিতে তাঁর মুখের সেই সরলরেখা আস্তে আস্তে বাঁকা চাঁদের মতো হয়ে উঠতে দেখেছি। কাউকে আবার একপাল বাচ্চার মধ্যে হঠাৎ খুশিতে মেতে উঠে তাদেরই মতো হয়ে উঠতে দেখেছি। ভারী সুন্দর সেই সব অভিব্যক্তি। বলা বাহুল্য যে নিজে দর্শক হয়ে নির্মল আনন্দ পেয়েছি। নিজেকে যে ভারী আস্তরণের আবরণে অহর্নিশি ঢেকে রাখা আছে তা সরে গিয়ে ভেতরকার সেই সরল শিশুটি বেরিয়ে আসে। একজন প্রকৃত মানুষ, যার মান হুঁশ সদাজাগ্রত ছিল, সেই তাঁর একটি কথা মনে পড়ে। ‘পরমহংস নিজের সঙ্গে কটি বালক রাখতে ভালোবাসে। তাদের ভাব আরোপ করবে বলে’। আদতে আমাদের প্রতিদিনের তিলতিল করে গড়ে তোলা কৃত্রিমতা, সামাজিক ছাঁচে ফেলে মনকে নির্দিষ্ট নৈতিক রূপে ও মাপে তৈরি করা, বহু জ্ঞান ও অজ্ঞানতাকে জাহির করা ও ঢেকে রাখার অদম্য প্রয়াসে, যা নিয়ে জন্মেছি সেই সরল মন, ভেতরের সেই শিশুটিকে হারিয়ে ফেলি। প্রকৃত মানুষটি কিন্তু বলেছিলেন জীবনের সবচেয়ে জরুরী পাঠ হল তিলতিল করে তৈরি করা সেই মহার্ঘ আবরণটিকে বর্জন করে ভেতরের আদি অকৃত্রিম শিশুকে খুঁড়ে বের করে আনা। সেই প্রকৃত ‘আমি’। বাকিটা ‘অহং’।

এখন দেখি ম্যানেজমেন্ট গুরুদের লেখা কেতাবে আবশ্যিক একটি শর্ত তুলে ধরা হয় – ইগো ভয়ানক বস্তু। এ থেকে যতদূর সম্ভব দূরে থাকো। কিন্তু একে বর্জন করি কিভাবে? জানা নেই।

একটি শিশুদের ব্যবহার্য পণ্যপ্রস্তুতুকারী সংস্থা বিনামূল্যে বিলি করেছে একটি পুস্তিকা হাতে এলো সেদিন। তাইতে নানারকম দরকারী কথার সঙ্গে দেখি শিশুদের প্রতি আমাদের কেমন ব্যবহার করা উচিত তার একটি দীর্ঘ তালিকা। দেখে চমকিত হলাম। তাহলে এতদিন ধরে না জানি কত ভুল করে এসেছি! এটি তো কেউ কখনও শেখায়নি? নীতিশিক্ষার নতুন ক্লাস? খুব প্রয়োজন? মনে মনে রেগে উঠছি। সযত্নচর্চিত ইগোয় আঘাত লাগছে। ‘আমাকে’ আবার শিখতে হবে? গর্বিত মা আমি! দুটি শিশুকে রাতকে দিন করে বড় করেছি! সেই মা কিনা এক ব্যবসায়ীর থেকে শিখবে শিশুর প্রতি ব্যবহার! বিরক্ত হয়ে পুস্তিকাটি সরিয়ে রেখেছি। খবরের কাগজ হাতে তুলেছি। প্রথম পাতা থেকেই শুরু হল নানা কিসিমের মানুষের ইগোর সংঘাত। নেতা ব্যবসায়ী ডাক্তার উকিল মন্ত্রী খেলোয়াড়, এমনকি সাধারণ মানুষ পর্যন্ত। এরই মধ্যে কেউ পুরস্কার পাচ্ছেন, তার ছবি। ঝলমলে মুখ। ভেতরের পাতায় পৌঁছলাম। একটি রঙিন পত্র। ‘শিশুদের ছোট ভাববেন না’। তার পাশের পাতাতেই তিন বছরের শিশুটির মৃত্যু সংবাদ। শরীরে ছুঁচ ফুটিয়ে কে জানে কি চেয়েছিল লোকটা, শিশুটি যন্ত্রণা থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। মারা গেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাগজ বন্ধ করি। মনে পড়ে শিশুটির মায়ের জবানবন্দী। অজস্র পরস্পর বিরোধী কথা। কেন? কি করে এই মায়ের সহজাত বোধ লোপ পেয়েছে? নীতিশিক্ষার ক্লাস করেনি? নাকি শৈশবে কেউ তাকে ভালোবাসা দেয়নি? আরও সে কি চেয়েছিল জীবন থেকে? সন্তান লাভের পরেও? কাগজ সরিয়ে রাখি। পুস্তিকাটি তুলে নিই। চোখে পড়ে একটি লাইন – কখনও কোনও বাচ্চাকে শরীর স্পর্শ করার আগে তার অনুমতি নিন। সে অনুমতি না দিলে তাকে আদর করতে যাবেন না। সে স্বচ্ছন্দ বোধ করেনা। নিজের ভেতরে ভয়ানক ভুমিকম্প টের পাই। তাই তো! এত রীতি নীতি, এত শিশুরক্ষা আইন, শেষ পর্যন্ত কটি শিশুকে তারা রক্ষা করতে পারছে? অসম্ভব যে! আমাদের চাওয়ার তালিকা এমন দীর্ঘ হয়ে চলেছে যে তা থেকে শিশুও রক্ষা পাচ্ছেনা। একটু ভাবতে বসি। নিজের পুত্রকন্যা অতৃপ্ত জীবনবাসনা পূরণের জাদু-ই-চিরাগ হবে, এ থেকে শিশুদের যৌন হেনস্থা ও ধর্ষণ পর্যন্ত চলে গিয়েছে বাসনারেখা। না না, আঁতকাবার কিচ্ছু নেই। যারা ভাবছেন ছেলেমেয়েকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার করে সমাজের ভালো করতে চাই। সেটার সঙ্গে দ্বিতীয় অমানবিক কর্মটি এক হল কি করে? বলি। প্রথমটি নিজের মানসিক আনন্দ লাভ। বাসনা পূরণ। আর সেটি করতে গিয়ে বাচ্চাদের যে কত যন্ত্রণা কত অত্যাচার সইতে হয় সে আমরা সবাই জানি। আমরা মানে, মা বাবারা। দ্বিতীয়টিও তো তাইই!! শিশুটির জন্ত্রনার মধ্যে লুকিয়ে থাকা এক অত্যাচারীর আনন্দ লাভ! জানি এ পর্যন্ত পড়ে সরিয়ে দিয়েছেন লেখাটি। তাই রাখা উচিত। কারণ সমাজ এখনও এই নীতিটি তৈরি করেনি যার মধ্যে দিয়ে আমরা দর্পণে নিজেদের মুখ দেখতে পাই। তবু যদি কখনও নির্জনে বসে ভাবা সম্ভব হয় তাহলে দেখতে পাবো, জীবনে আমরা বহু বাসনায় পর্যুদস্ত হয়ে চলেছি। অবিরত নিজের অহংকে আরও আরও বাসনার ঘৃতাহুতি দিয়ে আরও আনন্দের অনুসন্ধান করে চলেছি। তবে উপায়?

উপায় সহজ। সহজাত। ‘নির্বাসনা হও’। কারো কাছে কিছু চেয়ো না। নিজের কাছেও নয়। সন্তান তোমাকে একটি নির্মল আনন্দ দিয়েছে জন্মমুহূর্তেই। এর অধিক আর কিচ্ছুটি চেয়োনা। বরং ধীরে ধীরে নিজের ওপরে স্তুপ করে তোলা ইগোর আবর্জনা সরিয়ে দাও। যদি পেরে ওঠা যায় তবে ভেতরের সেই আদি অকৃত্রিম শিশু জেগে উঠবে। যে শিশু এই বিরাট বিশ্ব লয়ে আনমনে খেলা করে। সেই অহেতুক আনন্দ আমাদের অহংজাত শতেক নিরানন্দকে দূর করে দেবে। স্বভাবে ফিরতে পারব। দর্পণে নিজের স্বরূপ ভেসে উঠবে। সত্যস্বরূপ।

[শব্দের মিছিল ওয়েবম্যাগ ডিসেম্বর ২০১৭]

0 comments:

0
undefined undefined undefined

অমৃত সদন - শামিম আহমেদ

Posted in





















রাজসভায় পৌঁছে একলব্য যে রাজপুরুষকে দেখলেন তিনি টকটকে ফর্সা। উচ্চতাও চোখে পড়ার মতো। কৃশও নন আবার স্থূলও নন। জলদগম্ভীর কন্ঠে সেই পুরুষ একলব্যকে বললেন, তুমি হস্তিনায় কেন এসেছো?

একলব্য ভাবলো, সত্য কথা বলা ভাল। তাতে ধর্ম রক্ষা পাবে আবার কোনও ঝামেলায় পড়তে হবে না। সে উত্তর দিল, আচার্য দ্রোণের কাছে ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা করতে।

রাজপুরুষ মৃদু হাসলেন। তার পর বললেন, আচার্যের কাছে না গিয়ে অস্ত্রবাজারে গেলে কেন?

“আজ্ঞে, ভাবলাম বাজারটা একবার দেখে নিই। নতুন জায়গা কিনা!”

“কোথা থেকে এসেছো?”

“দণ্ডকারণ্য।”

“সেখানে তো জরসন্ধের এক সেনানায়ক হিরণ্যধনু রাজত্ব করেন!”

একলব্য জানায়, সে হিরণ্যধনুর পুত্র, নিষাদ রাজকুমার।

রাজপুরুষ দ্রোণাচার্যকে ডেকে পাঠালেন।

কৃশকায় দাড়িওয়ালা এক প্রৌঢ় এসে দূর থেকে রাজপুরুষকে নমস্কার করে বললেন, আমাকে ডেকেছেন হে গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম?

“এই বালক আপনার কাছে অস্ত্রশিক্ষা করতে চায়। জাতিতে নিষাদ, জরাসন্ধের সেনানায়ক হিরণ্যধনুর পুত্র। এর সঙ্গে কথা বলে নিন।”

দ্রোণাচার্য একলব্যকে নিয়ে রাজসভা থেকে বেরিয়ে অস্ত্রশালার কাছাকাছি এলেন। তার পর বললেন, ভালোই তো ঘোঁট পাকিয়েছো বাপু! জরাসন্ধের লোক এসেছে হস্তিনায় অস্ত্রশিক্ষা করতে। কচের অসুরপুরীতে আসার মতো ঘটনা।

একলব্য তাঁর কথার কিছুই বুঝতে পারলেন না। প্রণাম করলেন দূর থেকে। তার পর বললেন, অনেক আশা নিয়ে এসেছি গুরুদেব, আমাকে নিরাশ করবেন না।

দ্রোণ প্রশ্ন করলেন, তুমি নিষাদ?

একলব্য জবাব দেয়, আজ্ঞে।

“জানো, নিষাদ কারা?”

“ওই যারা শিকার করে তারা।”

দ্রোণ বলেন, শিকার তো ক্ষত্র পুরুষরাও করে থাকেন। আমার মতো ব্রাহ্মণও মৃগয়ায় যান।

“তবে আপনিই বলে দিন গুরুদেব, নিষাদ কারা?”

দ্রোণ বললেন, নিষাদ হল অনার্য বর্বর, ছোটজাত। অধার্মিক ও প্রজাপীড়ক রাজা বেণকে মহর্ষিরা হত্যা করেন। মৃত বেণের দক্ষিণ ঊরু মন্থন করলে এক খর্ব কদাকার দগ্ধ কাষ্ঠতুল্য পুরুষের আবির্ভাব হয়। ঋষিরা তাকে বলেন, ‘নিষাদ’—উপবেশন করো। এই পুরুষ থেকে জলজঙ্গলপর্বতবাসী নিষাদ ও ম্লেচ্ছদের উৎপত্তি। আর বেণের ডান হাত মন্থন করে উৎপন্ন হন ক্ষত্রিয় রাজা পৃথু, তিনি ধনুর্বাণধারী শাস্ত্রপারঙ্গম। শস্ত্রবিদ্যায় অধিকার ক্ষত্রিয়দের, নিষাদদের নয়।

একলব্য মনে মনে ভেঙে পড়ে। সে দ্রোণের দগ্ধ কাষ্ঠতুল্য চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে অপলক। তার পর নিজের অজান্তে প্রশ্ন করে ফেলে, আপনি তো বামুন, তাহলে কী করে অস্ত্রবিদ্যা শেখাচ্ছেন। এই বিদ্যা তো ব্রাহ্মণের নয়।

সহসা দ্রোণাচার্য ক্রুদ্ধ হয়ে পড়েন। নিষাদ বালকের এই ধৃষ্টতা দেখে তিনি হতবাক। ভীষ্ম জানতে পারলে ওর যে কী শাস্তি হবে, তা ও জানে না। ক্রোধ সংবরণ করে তিনি একলব্যকে ফিসফিস করে বললেন, সূতপুত্রকেও আমি শিষ্য করেছি কিন্তু তোমাকে নিতে পারব না। তাহলে আমার চাকরি থাকবে না। ব্যস এটুকুই। বাড়ি যাও। নিজে নিজে ধনুর্বিদ্যা শেখো, নিষাদরা চেষ্টা করলে নগরবাসী ক্ষত্রিয়দের থেকেও অনেক ভাল ধনুর্ধর হতে পারে।

দ্রোণাচার্য স্থান পরিত্যাগ করলেন। একলব্যকে পথে দেখিয়ে রাজসভার চত্বর থেকে বের করে দিল রাজপ্রহরী। নিষাদ রাজকুমার ভাবল, সে আজই নিজের রাজ্যে ফিরে যাওয়ার জন্য যাত্রা শুরু করবে। যাওয়ার আগে কামারের বাড়ি যাবে একবার, নিষাদরা কখনও অকৃতজ্ঞ হয় না।

বিদায় দেওয়ার সময় কামারের সঙ্গে ছিল বেশ কয়েক জন সঙ্গী। তাদের কথাবার্তা শুনে একলব্যের কেমন যেন মনে হয় যে তারা তারই লোক, আত্মীয়; অথচ সে আগে এদের কখনও দেখেনি।

কামার তাদের একজনকে বলল, এই যুবক হল জরাসন্ধের সেনানায়ক হিরণ্যের পুত্র। ওর সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জানি, জানাটাই আমার কাজ। ছুরি শান দেওয়ার ফাঁকে আমার কাজ বার্তা সংগ্রহ করা, কেবল ভর্জিত বার্তাকু ভক্ষণ নয়।

একজন সিড়িঙ্গে মতো লোক বলল, রাজপ্রাসাদে শুনছি সব বলাবলি করছে।

তার সঙ্গী খর্বকায় লোকটি বলল, ভয়! শঙ্কাই ওদের শেষ করে দেবে। একলব্য যদি ভাল ধনুর্ধর হয়ে হস্তিনাপুর থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে নগরের শিক্ষা অরণ্যে চলে যাবে, তার পর একদিন অরণ্যবাসীরা ওদের থেকে নেওয়া শিক্ষায় ওদের মেরে ফেলবে।

কামার বলে, না। দ্রোণাচার্য বলেছেন যে একলব্য শিষ্য হিসাবে নিলে অন্য রাজপুত্রদের মধ্যে ওর অনার্যতা সংক্রামিত হবে। আর সেটা হলে দ্রোণের চাকরি থাকবে না। বহু কষ্টে এই চাকরি তিনি পেয়েছেন। এতদিন তো খেতে পরতে পেতো না।

একজন স্থূল লোক জানায়, অরণ্যের লোক মানেই হল হস্তিনার শত্রু। তাদের জ্ঞানগম্যি ভয়ঙ্কর।

কামার বলে, একলব্যের উদ্দেশ্য নিয়ে ওরা সন্দেহ প্রকাশ করেছে। একলব্য ধনুর্বিদ্যা শিখে অপপ্রয়োগ করবে। যেন ওরা অস্ত্রচালনা শিখে মানুষের মৃত্যুর বদলে জন্ম দেবে!

সিড়িঙ্গে বলে, নিষাদরা হল ক্রোধী, ওদের তীরধনুকের শিক্ষা দিলে মানুষ মেরে বেড়াবে।

খর্ব লোকটি খ্যাক খ্যাক করে হেসে বলে, বামুনের ছেলে অশ্বত্থামা বুঝি খুব শান্ত? ওর মতো রাগী ছেলে নাকি ভারতে আর একজনও নেই!

কামার বলল, কী বললি, ভারত?

খর্ব লোকটি হাত জোড় করে বলে, ভুল হয়ে গেছে কামার মশাই, কুরুপ্রদেশ বলি?

কামার রেগে জবাব দেয়, না! শোন, অশ্বত্থামা ক্রোধী হয়েছে কেন জানিস? ছেলেবেলায় খেতে পেত না বেচারা। যাক গে, একলব্যের বেলা বইয়ে দিয়ে লাভ নেই কোনও। তুমি যাও বাছা। জয় মহাদেবের জয়!

একলব্যের ঘোড়া ছুটতে লাগল টগবগ! কামারের কন্যা তাকিয়ে রইল অপলক, যতক্ষণ না একলব্য দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।

নিষাদরাজ্যে ফিরে এসে মন ভাল নেই একলব্যের। সে সর্বক্ষণ ভাবে, কেন দ্রোণ তাকে শিষ্য হিসাবে নিলেন না? সে কি শুধুই রাজনীতির কারণে, নাকি সে জাতিতে ম্লেচ্ছ বলে! ম্লেচ্ছ বা নিষাদের ব্যাপারটা খুব জোরালো প্রমাণ বলে মনে হয় না তার। আসলে রাজরোষের ভয়ে, চাকরি যাওয়ার আশঙ্কায় একলব্যকে দ্রোণ গ্রহণ করতে পারেননি। রাজপ্রাসাদের আশঙ্কা, নিষাদের ছেলে রাজকুমারদের গুরুর কাছে শিক্ষালাভ করবে, এটা কোন ধরণের দুঃসাহস! তার চেয়েও বড় আশঙ্কা হল, নিষাদ মানেই বিদ্রোহী। প্রাসাদ জঙ্গলের মানুষদের ভয় পায়। দ্রোণাচার্যকে মন্দ লাগেনি একলব্যের। না খেতে পাওয়া একজন কৃশকায় মানুষ, নিজের ব্রাহ্মণ্যবৃত্তি ছেড়ে শুধু পেটের দায়ে স্বদেশ পাঞ্চাল ছেড়ে হস্তিনায় এসে বাস করছেন! তিনি একলব্যকে কেন শিষ্যত্বে বরণ করতে পারছেন না, সে কথা ঠারে ঠারে বুঝিয়েও দিয়েছেন।

মূর্তি বানাতে বানাতে এই কথাগুলি ভাবছিল একলব্য আর তার তৈরি মূর্তি যেন একটি বঞ্চনার প্রতিমূর্তি হয়ে উঠছিল ক্রমশ। কৃষ্ণা অঙ্গাগ্রণী মাঝামধ্যে বলছিল, নাকটা ঠিক হয়নি; কাদা দিয়ে কি দাড়ি বানানো যায় নাকি! সে সব কথায় বেশ মজাই পাচ্ছিল একলব্য। মূর্তি তৈরি হতে বেশি সময় লাগল না। কিন্তু শুকনো বেশ ঝামেলার। তখন ফেটে যায় মূর্তির নানা অঙ্গ। সে সময় সেই ফাটল সারতে অনেক হ্যাপা পোহাতে হয়।

দ্রোণাচার্যকে সেই একবারই দেখেছিল একলব্য। রোদে মূর্তি যত শুকোয় তত যেন ফাটল বাড়তে থাকে। একলব্য ভাবে, এই ফাটল আসলে দ্রোণাচার্যের মন। শেষমেশ যখন মূর্তি শুকনো হল, তখন গাছের বাকল আর ফুল নিঙড়ে তারা যে রঙ বানায়, তাই শন দিয়ে আস্তে আস্তে বুলিয়ে দিল অঙ্গা।

অঙ্গাগ্রণীর রঙের বোধ বেশ খারাপ। দাড়ির একদিক করেছে সাদা আর একদিক কালো। এমনকি একটি হাতের রঙ লাল, অন্যটি সবুজ। একলব্য ভেবে পায় না এসবের কী মানে! অঙ্গাকে জিজ্ঞাসা করলে বলে, লোকটা ভাল আবার খারাপ, তাই এমন রঙ। একলব্য একটু রুষ্ট হয়, সে বলে—এই মূর্তি আমার গুরু, তাঁকে লোকটা বলছিস অঙ্গা!

অঙ্গা জবাব দেয়, মূর্তিকে বলিনি, দ্রোণাচার্যকে লোক বলেছি। সে তো লোকই। তবে এই মূর্তিটা তার চেয়ে ভাল, আমাদের বানানো তাই এত সুন্দর। একলব্য ও অঙ্গাগ্রণী দুজনে মূর্তিটির সামনে গড় হয়ে প্রণাম করে।

0 comments:

0
undefined undefined undefined

পথে প্রবাসে - অচিন্ত্য দাস

Posted in







আমি আর সার্জেন্ট ম্যাথু

ক্যালিফোরনিয়ার দক্ষিণ দিকে এই শহরে আমি আগেও থেকেছি। উঁচু-নিচু পাহাড়ি অঞ্চল জুড়ে ছড়ানো শহর। বাস বা মেট্রো ট্রেন তেমন নেই যে এদিক ওদিক ঘুরে আসা যাবে। দোকান-পাট, বাজার কিংবা পার্ক, এত দূরে দূরে যে গাড়ি ছাড়া যাওয়াই যায় না। তবু বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে একটা পেট্রোল ভরানোর জায়গা আছে, এরা বলে গ্যাস স্টেশন। সঙ্গে দু-একটা রেস্তঁরা, স্টার বাকস্ কফির দোকান, ‘পাঁচ ডলারে এক পাইন্ট’ লেখা বিয়ারের ঠেক।

সেখানে যেতে হলে চার লেনের বড় চওড়া রাস্তার ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হয়। ডানদিক দিয়ে সাঁ সাঁ করে দ্রুতগতিতে গাড়ি, ট্রাক চলে যায়। আর বাঁ-দিকের জমি একটা টিলায় অনেকখানি উঁচুতে উঠে গেছে। টিলার ঢালে ইতস্তত পাইন, ইউক্যালিপ্টস বা ম্যাপেল গাছ। আর আছে বুনো ঝোপঝাড়, ঘাস, আগাছা। এ রাস্তায় আমি আগে অনেক অনেক বার হেঁটেছি তবে এবারের পথচলা একেবারে অন্যরকম লাগছিল।

আমি বড় হয়েছি কোলকাতা শহরে, বাড়িতে সকাল থেকে রাত্তির অবধি রেডিওতে কলকাতা ক চালানো থাকত। বাড়ির রেডিও কোন কারণে বন্ধ হলেও বিরতি বলে কিছু ছিল না। পাশের বাড়ি বা পাশের পাশের বাড়ি থেকে স্পষ্ট শোনা যেত। কলকাতা ক এ রবীন্দ্রনাথের গানের আনুষ্ঠান, রেকর্ড বা লাইভ, লেগেই থাকত। সকাল-দুপুর-সন্ধে-রাত্তিরের বাছবিচার ছিল না। বহু গানের লাইন তাই মনের চেতন-অবচেতন কুঠুরিতে ঢুকে পড়েছিল, এতদিন পরেও রয়ে গেছে। পথচলা অন্যরকম লাগার সঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতর থেকে বেজে উঠল – ‘এ পথে আমি যে গেছি বারবার, ভুলিনি তো একদিনও, আজ কি ঘুচিল চিহ্ন তাহার উঠিল বনের তৃণ...’

আসলে চেনা রাস্তা এবারে অন্যরকম লাগার কারণ আছে। এ বছর এদেশে ভালো বৃষ্টি হয়েছে, তাই শীতের পরে বসন্ত আসার সঙ্গে সঙ্গে মাঠঘাট ঝোপঝাড় বুনো ফুলে ভরে উঠেছে। এরকম বুনো ফুলের উৎসব আগে দেখিনি। হলদে, গাঢ় হলদে, বেগুনি, সাদা, গাঢ় নীল, কমলা – বিচিত্র সব রঙের ছড়াছড়ি। কোথাও একই আগাছায় ভিন্ন রঙের ফুল – সাদার পাশে তিন চার রকমের লাল। ঘাসের ওপর ফোটা বেগুনি ফুল একেক জায়গায় এমন ভাবে ছেয়ে রয়েছে যে একটু দূর থেকে মনে হয় কেউ যেন বুরুশ দিয়ে জমি রং করে রেখেছে।

রাস্তা অন্যরকম লাগার আরেকটা কারণও আছে অবশ্য। বছর সাতেক আগে এ শহরে যখন এসেছিলাম তখন এ রাস্তায় হাঁটতাম আমরা দুজনে। লক্ষ্য থাকত কফির দোকান। দোকানের দেয়ালে টাঙানো তালিকাটা দেখতাম – সেখানে নানা রকমের কফির নাম লেখা। আমাদের মধ্যে বচসা শুরু হয়ে যেত। আমি বলতাম আজ ‘আমেরিকানো উইথ হ্যাজেল নাট ফ্লেভর’ নেবো। সে বলত একদম না। আজ কাপুচিনো। আমি বলতাম বড় কড়া – দুপুরের ঘুমটা ভালো হবে না। শেষে অবশ্য ওর কথাই থাকত। সে আমার পাশে আজ হাঁটছে না। গত বছর আমার সাথী সব পথের শেষে চলে গেছে সবকিছু ছেড়ে। এখন বুঝলাম ওই বচসাটুকু না থাকায় কফিপান করার সব মজা সব আগ্রহ কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। আমি আজ লক্ষ্য ছাড়াই হাঁটছি।


রাস্তায় মানুষ দেখা যায় না বললেই চলে। তবে দৈবাৎ সামনে কেউ এসে পড়লে, তিনি মহিলা বা পুরুষ যেই হোন না কেন, মিস্টি হেসে ‘হাই’ বা ‘গুড আফটারনুন’ বলেন। আমিও ব্যাপারটা শিখে নিয়েছি। যেমন একটি লোককে দেখলাম তিনজন সঙ্গী নিয়ে আসছেন ওদিক থেকে। তিনজন মানে তিনটি কুকুর – একটি বড় আর দুটি শিশু কুকুর। সব এক জাতের, মানে ছোট দুটো বড়টির সন্তান হবে আর কি। সারমেয়চারক (মেষচারক কথাটা অভিধানসম্মত হলে এ শব্দটিও চলা উচিত) আমাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে ফুটপাথ ছেড়ে পাশের আগাছাময় জমিতে তিনটি পোষ্য নিয়ে সরে গেলেন। মুখে বললেন ‘সরি’। মানে এনার কারণে আমার পথ চলার অসুবিধে হয়েছে, তাই তিনি দুঃখিত। সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ভদ্রতাবোধ আমি ইউরোপ-আমেরিকা বা জাপানের মতো দেশেই দেখেছি। আমাদের দেশ হলে ইনি আমার দিকে কটমট করে তাকাতেন – সে খরদৃষ্টির মানে – ‘আরে উজবুক কোথাকার! রাস্তা ছেড়ে দাঁড়া, কামড়ে দিতে পারে। চোখ নেই নাকি।’

আমি আমার সাধ্য মত ইংরেজিতে বললাম “না, না ঠিক আছে। তোমার ‘হাস্কি’ তিনটে খুব সুন্দর।” এইরকম দেখতে কুকুরের জাত যে হাস্কি তা আমার নতুন শেখা। সুযোগ পেয়েই প্রয়োগ করে দিলাম। লোকটি আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে স্মিত হেসে চলে গেলেন।

বুনো ফুলের বাহার দেখে মনে হচ্ছিল ঋতুরাজ বসন্ত স্বয়ং সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। হলদে ফুলে ছেয়ে থাকা প্রান্তর যেন তাঁর বসন প্রান্ত, থেকে থেকে মৃদু বাতাসে আন্দোলিত। লাল-নীল-কমলা-গোলাপী ফুল যেন তাঁর অঙ্গের ভূষণ, মাথার মুকুট। এ দেশ আমাদের দেশ থেকে বহুদূরে, সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে। পৃথিবীর উল্টোপিঠে। এখানকার জলবায়ু, গাছপালা, জীব-জন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। তবু রাস্তার ধারে রঙ-বেরঙের ফুলের ঘটা দেখে মনের ভেতরে সেই অনেকদিনের ফেলে আসা কলকাতা ক বাজতেই থাকল। ‘রং লাগালে বনে বনে কে…’, বনে এমন ফুল ফুটেছে…’ বা ‘কী অচেনা কুসুমের গন্ধে…’। রবীন্দ্রনাথ যদি বসন্তকালে এই দেশে, এই অঞ্চলে কটাদিন কাটিয়ে যেতেন তাহলে গীতবিতানে আরও শখানেক বসন্তের গান নিশ্চয় যোগ হতো। এইসব এলোমেলো কথা ভাবতে ভাবতে হাঁটছি, এমন সময় বাঁ পাশে একটা কম আগাছার জায়গা দেখলাম। এরকম নেড়া জমি দেখলে বোঝা যায় এ দেশের মাটি কিছুটা রুক্ষ ধরনের। তবে এখানে এমন কিছু ছিল যে আমাকে দাঁড়িয়ে যেতে হলো।

ফুট চারেক উঁচু একটা ক্রস মাটিতে পোঁতা। তার নিচে অনেক ফুল রয়েছে। প্লাস্টিকের ফুল নয়, কেউ আজ কিংবা বড়জোর কাল সন্ধেবেলা রেখে গেছে। সেখানে কাচের ফ্রেমে বাঁধানো দু-তিনটে ছবিও রয়েছে। একটি যুবকের, মোটর সাইকেল পাশে নিয়ে। আর রয়েছে অনেকগুলো আমেরিকার পতাকা, কিছু সাজাবার উপকরণ। একটা নীল রঙের কাগজের চক্রও আছে। এ জিনিস ছোটবেলায় চড়কের মেলা থেকে কিনতাম, হাওয়া দিলে ঘুরতে থাকে। যত জোরে হাওয়া বয় তত জোরে ঘোরে। আমরা বলতাম সুদর্শন চক্র। ক্রসটার আড়াআড়ি আংশতে একটা নাম লেখা আছে – সার্জন্ট ম্যাথু লোয়ানথাল। যেটা দেখে আমার মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল তা হলো – ছেলেটি মারা গেছে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে। জন্ম পনেরোই অক্টোবর উনিশশো পঁচানব্বই আর মৃত্যু …. তারিখটা ঠিক দেখছি তো … ইস, জন্মদিনেই ছেলেটি মারা গেছে। আরও বোঝা যাচ্ছে ছেলেটি আমেরিকার নৌসেনাতে কাজ করত। কাছেদূরে এতো ফুল ফুটেছে যে আমার সেই ‘সাত ভাই চম্পা’ গল্পটা মনে পড়ে গেল। এই ভাইটির জন্য কি কোথাও পারুল বোন নেই! যে একবার ডাকলেই ছেলেটি ছবি ছেড়ে উঠে এসে পা দিয়ে তার মোটর-সাইকেলটা ঝটাং করে চালু করবে?

আজকাল সকলের পকেটেই এক সবজান্তা মহাপুরুষ বাস করেন যাঁর নাম শ্রীগুগুল মহারাজ। আমি তাঁকে স্মরণ করে প্রশ্ন রাখলাম – সার্জন্ট ম্যাথু সম্বন্ধে জানতে চাই। এদেশে ফাইভ-জি চলে, তাই পট করে জবাব এসে গেল। ছেলেটি মোটর-সাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছিল, কয়েকদিন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে পনেরোই অক্টোবর মারা যায়। ছেলেটি এই শহরে নৌসেনার ঘাটিতে কাজ করত, কাজের স্বীকৃতি হিসাবে বেশ কটা পদকও পেয়েছিল।

আমার মনে হলো ছেলেটি তার চব্বিশতম জন্মদিনটা দেখে যাবে বলেই হাসপাতালে ওই কটা দিন প্রাণটুকু ধরে রেখেছিল।

কফির দোকান অবধি গেলাম তারপর উদ্দেশ্যহীন ভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে কফি না নিয়েই ফিরতি পথ ধরলাম। কোলকাতা ক, ভিনদেশি প্রকৃতির আশ্চর্য সুন্দর রূপ এসবের সঙ্গে ওই সার্জেন্ট ম্যাথুর কথাটা মাথায় রয়ে গিয়েছিল।

সার্জেন্ট ম্যাথুর জায়গাটা এবার আমার ডানদিকে। আমার পা আবার আটকে গেল। মনের ভুল? কি জানি। ছবির ম্যাথু আমাকে ডাকছে। ‘দাঁড়াও পথিকবর জন্ম যদি তব বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল …’ না, না তা কী করে হবে। এ তো অন্য দেশ। আর এটা নিশ্চয় একটা স্মৃতিচিহ্ন – এ শহরে সামরিক বাহিনীর জন্য এক বিস্তৃত সমাধি ক্ষেত্র আছে (আমি দেখেছি) – এ ছেলেটির সমাধি নিশ্চয় সেখানে। তবু আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ছবির ম্যাথু হাসিহাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বলছে “তোমাকে ভারি আনমনা লাগছে, তুমি কি কিছু ভাবছ যেতে যেতে?”

বললাম “হ্যাঁ, এ রাস্তা আমার চেনা। অনেক হেঁটেছি দুজনে। এখন সে আর নেই। তাই একা একা লাগছে, এই আর কি…”

“তুমি তো অন্যদেশের মানুষ। কবে এসেছিলে?”

“গত বছরই এসেছিলাম কিন্তু আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়াতে তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে গিয়েছিলাম। তার আগে এসেছিলাম দুহাজার ষোলতে, সেবার দুজনে এ রাস্তায় প্রায় রোজই হাঁটতাম।”

এ অঞ্চলে মাঝেমাঝেই জোর হাওয়া ওঠে। প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়া। ঝোপ-ঝাড় বড় গাছের পাতা সকলেই একসঙ্গে নুয়ে পড়ল। মহাসাগরের বাতাসকে সম্মান জানিয়েই বোধহয়। আর সেই সুর্দশন চক্র বাতাস পেয়ে হসহস শব্দ করে ঘুরে উঠল। আমার মনে হল এই ধ্বনি, গাছ-পালায় পলক দুয়েকের এই সঞ্চরণ – এ যেন ছবিতে আটকে থাকা ম্যাথু ছেলেটির দীর্ঘশ্বাস।

“ওহ, দুজার ষোলো! ষোলতে তো আমি এখানে ছিলাম না। তখন আমি নৌসেনাতে কাজ করি। এই শহরেই নৌসেনার বড় ঘাঁটি আছে জান তো? আমাকে সকলে খুব ভালোবাসতো, কাজে খুবই ভালো ছিলাম। অনেকগুলো মেডেল, পদক, সম্মান-টম্মান পেয়েছিলাম”

“তারপর কী হলো?”

“আরে আর বলো কেনো। এই রাস্তাদিয়েই আমার প্রিয় বাহন মানে মোটর-সাইকেলে কোথায় যেন যাচ্ছিলাম। সেদিন একটু বেশি জোরেই চালাচ্ছিলাম, তবে ওই রকম গতিতে আগে বহুবার চালিয়েছি, কিছু হয়নি। সেদিন কী করে যেন হাতটা একটু নড়ে গেল – সোজা ধাক্কা খেলাম রাস্তা-বিভাজকে মানে যাওয়ার আর আসার রাস্তার মাঝে যে সিমেন্ট করা আলের মতো থাকে সেটাতে। চোখ খুলে দেখি হাসপাতালের বিছানায়। তারপরেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

“কতদিন যে শুয়েছিলাম জানি না। একদিন একটু সময়ের জন্য ঘুম ভেঙেছিল। দেখলাম আমার ছোটবোন আমার বিছানার পাশে বসে খুব কাঁদছে। তার হাতে একটা রঙীন ফিতে মোড়া বাক্স। বলল “আজ তোর জন্মদিন…’। ব্যাস তারপর আর কিছু খেয়াল নেই। আরও বোধহয় অনেকদিন পরে একদিন ঘুম ভেঙে দেখি আমি এখানে। আমার সামনে ফুলটুল রাখা, বাড়ি থেকে কেউ না কেউ এসে দিয়ে গেছে। দিয়েও যায় রোজ। মরে গেছি, তাই রোজই আমার জন্মদিন!”

আমি বললাম “জানো ম্যাথু, আমাদের দেশে বলে যে মানুষ বারবার নতুন মানুষ হয়ে জন্মায়। তুমি হয়তো আবার কোথাও, কোনো পরিবারে জন্মাবে।”

ম্যাথু কিছু বলল না। তারপর যেই আমি যাবার জন্য পা বাড়িয়েছি, ম্যাথু বলল “শোন, একটা কথা বলি তোমাকে? তুমি অবশ্য আমার থেকে বয়সে অনেক বড় তবু আমি চারিদিক দেখতে দেখতে কিছু শিখেছি। ভাবছিলাম তোমাকে বলি, যদি তোমার মনটা একটু ভালো হয়”

ছবির দিকে এক পা এগিয়ে গিয়ে বললাম “বল, নিশ্চয় শুনব”

“জানো বন্ধু, এই যে আমি মরে গিয়েছি তাতে কিন্তু কোথাও কিছু পাল্টায়নি। সেই আগের মতোই শীতের পর বসন্তকাল এসেছে। ফুল ফুটেছে। আকাশ ঘন নীল, থেকে থেকে মহাসাগরের বাতাস বয়ে যাচ্ছে। আমার বন্ধুরা, আমার বাড়ির লোকেরা আমাকে মনে রেখেছে ঠিকই, তবে সকলেই নিজের নিজের কাজে ফিরে গেছে। আমার জন্য কেউ বসে নেই। সত্যি আমার জন্য কেউ বসে নেই স…ত্যি… ওই দেখ আকাশে …”

বিকট আওয়াজে কানে তালা লেগে গেল। দুটো জেট প্লেন বেশ নিচু দিয়ে উড়ে গেল একসঙ্গে। ম্যাথু বলল “ওগুলো নৌসেনার উড়োজাহাজ। আমি কত উড়েছি। আমার বন্ধুরা চালাচ্ছে। আমি চিনি ওদের। আমাকে সকলে কী যে ভালোবাসতো, কিন্তু দেখ কাজ ওরা করে চলেছে, কাজ ছাড়লে তো চলে না...

“তাই বলছিলাম কী বন্ধু – তুমিও তোমার যা কাজ করার আছে তা করতে থাকো। পৃথিবীর নিয়ম কী জানো? যা হয় তা হয়। যা হচ্ছে তা হচ্ছে। যা হবার তা হবে। আমাদের কাজ কাজ করে যাওয়া। তবে কখনো ভাবতে বসো না যে এ কাজটা করছি বলে এটা হবে, ওটা পাবো। কী থেকে কী হয় তা সঠিক কেউ জানে না। ওসব প্রত্যাশায় নিজেকে জড়িয়ে না ফেলাই ভালো। এটাই সার কথা বন্ধু।”

দেড়টা বেজে গেছে, রদ্দুর কড়া হচ্ছে। আমি একটা হালকা সোয়েটার পরে বেরিয়েছিলাম, ওটা খুলে হাতে ঝুলিয়ে নিলাম। ম্যাথু বলে উঠল “ইস, তুমি দেখছি ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। আরো কিছুটা হাঁটতে হবে যে তোমাকে। ইচ্ছে করছে মোটর-সাইকেলে বসিয়ে তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি”

আমি বললাম “বেশি দূর তো নয়, আমি বাড়ি পৌঁছে যাব। তবে ম্যাথু ভাই, একটা কথা বলি তোমাকে। তুমি আজ যা শেখালে তা দিয়ে আর যেটুকু রাস্তা আমার বাকি রয়েছে সেটুকু হেঁটে পার হয়ে যেতে পারব।”






0 comments:

0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in







৩০

যুদ্ধটা হল বলেই মিসেস সুজান অনেক টাকা রোজগার করতে পারলেন। কিন্তু এই কথাটা ভাবতে তার একটুও ভাল লাগে না যে হয়তো বা তার স্বামীর মত কর্মঠ মানুষ ভেনজেলকে এই যুদ্ধের জন্যই রোমানিয়াতে বেকার বসে থাকতে হয়েছিল। বসে থাকতে থাকতে কী ভাবে যেন গুলি খেয়ে লোকটা মরে গেল। সৈনিকেরা যে কাজের কাজ কিছুই করে না, সেটা তো তিনি নিজের চোখে দেখতে পাচ্ছেন। সময় নষ্ট করে, সারা বছর ধরে একগাদা টাকা খরচ করছে এরা। একবার গুলি করল, কোথায়? না জঙ্গলে নড়েচড়ে বেড়ানো হরিণের গায়ে। আরেকবার গুলি করল, কোথায়? না, এক গরিব বিপন্ন মহিলাকে, যে নিজের বাচ্চাকে রাতের বেলা ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছিল। পুরো ব্যাপারটা ন্যক্কারজনক এবং হাস্যকর। এমন এক কাজে দেশের ছেলেগুলোকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে যে সবাই আলসে হয়ে গেছে। তিনি নিজে কত পরিশ্রম করেন সারাদিন ধরে। গরু, মুরগি, শুয়োরের সেবাযত্ন করা থেকে শুরু করে সৈনিকদের জন্য রান্না করা, তাদের পোশাক কাচাকুচি করা সবকিছু। কোনো কোনো সৈনিক তো নিজের জুতোটাও নিজে পালিশ করে না, মোজাজোড়াও নিজেরা কাচে না। মিসেস সুজান অর্থের বিনিময়ে সব কিছু করেন। গত মাস থেকে একজন চাকর রাখতে হল তাঁকে। টেসার্জি গ্রাম থেকে একটা লোক পেয়েছেন তিনি। কারণ, গর্ভবতী হবার পর থেকে মারিয়া আর তাঁকে কোনো কাজে সাহায্য করতে পারে না। ওই সার্জেন্টের ঘরেই সে থাকে এখন তার বউয়ের মত। ওই লোকটার সকালের নাশতা বানিয়ে দেয়, পোশাক কাচাকুচি করে, আবার মাঝে মাঝে সে সার্জেন্টকে বকুনিও দেয়।

সৈনিকদের এই বাড়িতে থাকার ঠিক তিন বছর পরে একদিন সকালে, একজন খুব উঁচু পদের অফিসার এলেন, যার ট্রাউজারে লাল ডোরা, সোনালি কলার। মিসেস সুজান পরে শুনেছিলেন যে ইনি সত্যিকারের জেনারেল। আরও কয়েকজন অফিসারকে নিয়ে খুব দ্রুতগতির এক গাড়িতে করে টেসার্জির দিক দিয়ে এলেন তিনি। মুখটা বেশ হলদেটে, দুঃখী দুঃখী ভাব। কিন্তু এসেই তার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পিটারের উপরে প্রচণ্ড চোটপাট শুরু করলেন তিনি, কারণ পিটার কোমরের বেল্ট আর পিস্তল ছাড়াই সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল।

সেই অফিসার রাগে গজগজ করতে করতে তার বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন। মিসেস সুজান তাঁকে মাটিতে অধৈর্য হয়ে পা ঠুকতে দেখেছিলেন। জেনারেলের মুখটা রাগে আরও হলদেটে, আরও ছোট হয়ে যাচ্ছিল। পাশে দাঁড়ানো আরেক অফিসারকে প্রচণ্ড চিৎকার করে ধমকাচ্ছিলেন। সেই অফিসারের কাঁচাপাকা চুল, বয়স অনেক, প্রায় ষাটের উপরে হবে। ধমক খেয়ে টুপির উপরে রাখা লোকটার সন্ত্রস্ত আঙুলগুলো কাঁপছিল। মিসেস সুজান এই বয়স্ক অফিসারকে চেনেন। কারণ মাঝে মাঝে এই অফিসার সাইকেল চালিয়ে টেসার্জির রাস্তা ধরে এখানে আসেন। খুব নরম সুরে সার্জেন্ট আর অন্যান্য সৈনিকদের সঙ্গে কথা বলেন এই বাড়ির খাবার ঘরে বসে। আবার সাইকেল নিয়ে ফিরে যান। পিটার তাঁকে এগিয়ে দিতে যায়। কিছুটা রাস্তা সাইকেল নিয়ে হেঁটে হেঁটে কথা বলতে বলতে যান। যাই হোক, সেদিন অবশেষে পিটার তাড়াতাড়ি কোমরে বেল্ট আর পিস্তল নিয়ে সবার সঙ্গে নদীর পাড়ে গেল।

নৌকা করে নদী পেরিয়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেল সৈনিকেরা। কিছুক্ষণ পরে ফেরত এলো। ভাঙা ব্রিজের সামনে অনেকটা সময় দাঁড়িয়ে রইল তারা। তারপর ছাদে গেল। তারপর উচ্চপদস্থ অফিসার সমেত যে দলটা ঐদিন সকালে এসেছিল, তারা গাড়ি করে ফিরে গেল । তারা যাবার সময়ে পিটার আরও দুজন সৈনিককে দু’ পাশে নিয়ে তাদের গাড়ির সামনে হাত তুলে দাঁড়িয়ে রইল। সম্ভবত গাড়িটা টেসার্জি পৌঁছে যাওয়া অবধি তারা ওইভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। তারপর রাগত অবস্থায় পিটার ঘরে ফিরে এলো। মারিয়াকে একটাই কথা বলেছিল সে, ‘মনে হচ্ছে যে ব্রিজটা এবারে বানানো হবে।’

তার ঠিক দু’ দিন পরে, আরেকটা গাড়ি, খুব দ্রুতগামী একটা ট্রাক এলো টেসার্জির দিক থেকে। সেই গাড়ি থেকে নেমে এলো সাত জন সৈনিক এবং একজন তরুণ অফিসার। সেই অফিসার তাড়াতাড়ি এসে ঢুকল এই বাড়িতে। তারপর সার্জেন্টের ঘরে গিয়ে প্রায় আধঘণ্টা ধরে কথা বলল। মারিয়া কথার মাঝে ঢুকবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু ওই তরুণ অফিসার তাঁকে বাইরে যেতে বলে। সে আবার ঢুকেছিল সেই ঘরে। এবার তাঁকে ওই তরুণ অফিসার বেশ রুঢ়ভাবে ঘরের বাইরে বের হয়ে যেতে বলে। পুরনো সৈনিকদের নিজেদের মালপত্র গোছাতে দেখে মারিয়া কাঁদতে শুরু করে। কাঁদতে কাঁদতে সে লক্ষ্য করে যে নতুন সৈনিকদের দলটা নিজেদের মালপত্র টেনে ভেতরে নিয়ে আসছে। সে আধঘণ্টা ধরে কেঁদে যায়। প্রফেসর এসে তার কাঁধে হালকা একটা চাপড় দিলে সে রেগে ওঠে। তারপর পিটারকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। পিটার অবশেষে মালপত্র নিয়ে নিজের ঘর থেকে বেরোয়। মুখ লাল, সে কথা বলতে থাকে মারিয়ার সঙ্গে; মারিয়াকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করে। পিটার গাড়িতে উঠবার আগের মুহূর্ত অবধি মারিয়া তাঁকে আঁকড়ে ধরে থাকে। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কেঁদে যায় সে যতক্ষণ না গাড়িটা দ্রুতগতিতে টেসার্জির রাস্তা ধরে। গাড়িটা অদৃশ্য হয়ে গেলেও সে দাঁড়িয়ে থাকে। সে জানে যে পিটার যদিও তাঁকে কথা দিয়েছে, কিন্তু সে আর ফিরে আসবে না…

ব্রিজ তৈরির কাজ শুরু হবার দিন দুয়েক আগে ফাইনহালস বার্কজাবা গ্রামে এসেছে। গ্রামে বাড়ি বলতে একটা পাব, আর দুটো বাড়ি, যার মধ্যে একটা বাড়ি প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সে যখন এই বাড়িতে এলো, তখন আলু খেত থেকে উড়ে আসা বিশ্রী তিতকুটে ধোঁয়াতে চারদিক ঢেকে গেলেও এক অদ্ভুত নীরবতা, শান্তি বিরাজ করছে। কে বলবে দেশে যুদ্ধ লেগেছে…

লাল ফার্নিচার ভ্যানে করে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরবার পরে ধরা পড়ে যে তার পায়ে একটা স্প্লিনটার লেগেছে। অপারেশন হবার পরে দেখা যায় যে সেটা বোমার টুকরো নয়, কাচের টুকরো। সেই টোকাইয়ার বোতলের ভাঙা টুকরো। তারপর তাঁকে নিয়ে অদ্ভুত বিব্রতকর একটা বিচার শুরু হয়। কারণ যুদ্ধে আঘাত পেলে রূপোর মেডেল পাবার কথা। কিন্তু কাচের টুকরো বেরনোর পরে প্রধান চিকিৎসক তাঁকে মেডেল দিতে অস্বীকার করেন। বরঞ্চ এমন সন্দেহ করা হয় যে পুরস্কার পাবার লোভে সে নিজেই নিজেকে আঘাত করেছে। অবশেষে লেফটেন্যান্ট ব্রেশট, যিনি পুরো দুর্ঘটনার সাক্ষী ছিলেন, তার পাঠানো বিবৃতির ফলে ফাইনহালস অবশেষে ওই বিচার থেকে মুক্ত হয়। আঘাত তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়, কিন্তু সে প্রচুর ওয়াইন খেতো এই সময়ে। একমাস পরে তাঁকে এখানে, এই বার্কজাবাতে পাঠানো হল। সে নিচে পাবে বসে অপেক্ষা করছিল, যখন গ্রেস তাদের দুজনের জন্য কোন ঘরটা ফাঁকা, সেটার তত্ত্বাবধান করছিল। সে পাবে বসে ওয়াইন খেতে খেতে আগের ব্যাচের সৈনিকদের চলে যাওয়ার শব্দ শুনছিল আর ইলোনার কথা ভাবছিল। পুরনো সৈনিকেরা গোটা বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তাদের জিনিসপত্র, পোশাক এসব খুঁজে খুঁজে নিজেদের মালপত্র গোছাচ্ছিল। বাড়িওয়ালী পাবের কাউনটারের পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন। একটু বয়স্ক হলেও বেশ সুন্দরী, এখনও সুন্দরী তিনি। কিন্তু তার মুখটা ভারি বিষণ্ণ। ভেতরে করিডোরে শোনা যাচ্ছে আরেকজন মহিলা চিৎকার করছে আর কান্নাকাটি করছে।

পুরনো সৈনিকদের নিয়ে ট্রাকটা ছেড়ে যাওয়ার সময়ে ফাইনহালস শুনতে পেল যে সেই মহিলা আরও চিৎকার করে কান্নাকাটি করতে শুরু করেছে।

গ্রেস এসে ফাইনহালসকে তার ঘরে নিয়ে গেল। ঘরটার ছাদ নিচু। ছাদে আর দেওয়ালে জায়গায় জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়ছে। কালো বিমের ছাদ। ঘরে কেমন বাসি গন্ধ। বাইরের দিকটা দেখা যাচ্ছে জানালা দিয়ে। বাগানটা সাজানো নয় বিশেষ। এলোমেলো। উঁচু উঁচু ফলের গাছ, ঘাসজমি, কিছু ফুলের গাছ, আস্তাবল, খামার, তার পিছনে একটা ছাউনিতে রঙ চটা একটা পুরনো নৌকা, এসব দেখা যাচ্ছে জানালা দিয়ে। বাইরেটা নিস্তব্ধ। পাঁচিলের উপর দিয়ে নদীতে জেগে থাকা ভাঙা ব্রিজের অংশ দেখা যাচ্ছে। মরচে ধরা শিকগুলো জেগে আছে জলের উপরে। কংক্রিটের স্তম্ভগুলো শ্যাওলায় ঢাকা। নদীটা খুব বেশি হলে চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ গজ চওড়া।

এখন সে গ্রেসের খাটে শুয়ে আছে। গতকাল সৈনিকদের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে তার সঙ্গে গ্রেসের আলাপ হয়েছে। আলাপ হওয়ার পর থেকেই ফাইনহালস ঠিক করেছে যে সে অকারণে গ্রেসের সঙ্গে কথা বলবে না। গ্রেসের বুকে চারখানা মেডেল। সে পোলিশ, রোমানিয়ান, ফরাসি, রুশি নানা জাতের মহিলাদের নিয়ে রসালাপ করতে পছন্দ করে। এদের সবার সঙ্গে তার কখনো না কখনো আলাপ হয়েছিল, সম্পর্ক হয়েছিল, তারপর কী ভাবে সম্পর্ক ভেঙে গেল ইত্যাদি আলোচনা করতে ভালবাসে গ্রেস। ফাইনহালসের এসব আলোচনা শুনতে ভালো লাগে না। এই কথাগুলো শুনতে শুনতে তার ক্লান্তি এবং বিরক্তি আসে, সে বিব্রত বোধ করে। কিন্তু গ্রেস এমন একজন মানুষ, যে মনে করে তার বুকে চারটে মেডেল আছে বলেই সবাই তার কথা শুনবে।

সে, ফাইনহালস, যার মোটে একটা মেডেল আছে, সে গ্রেসের কথা শুনবার জন্য আদর্শ ব্যক্তি। তাছাড়া সে কথা শুনে যায়, উল্টে কিছুই বলে না। কোনো কথার ব্যাখ্যা অবধি চায় না। নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে তার সঙ্গে আলাপ হয়ে, গ্রেস খুব খুশি। অবশ্য বার্কজাবাতে এই ঘরে এসে এসে ফাইনহালস তাড়াতাড়ি ঘুমোবার তোড়জোড় শুরু করে, কারণ গ্রেস এক স্লোভাক মহিলার হৃদয় কী ভাবে ভেঙেছিল, সেই গল্প আরম্ভ করবার উপক্রম করে।

আসলে ফাইনহালস বড় ক্লান্ত ছিল। প্রায়ই যখন সে ঘুমোতে যায়, তখন শোবার সময় ভাবে আজ সে যদি স্বপ্নে ইলোনার দেখা পায়। কিন্তু আজ অবধি এক রাতেও সে ইলোনাকে স্বপ্নে দেখেনি।



(চলবে)

0 comments:

0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - শ্যামাপ্রসাদ সরকার

Posted in




















(৬)

শাস্ত্রনিষ্ঠ তাবড় ধনীসমাজের অনেকেই যদিও রামকান্ত রায়ের কনিষ্ঠ পুত্রটিকে দু-চক্ষে দেখতে পারেনা তবুও শহর কলকাতার বেশ কিছু নব‍্য ধনী রাজপুরুষ আবার রামমোহনকে বেশ ভক্তিশ্রদ্ধাও করে। বিশেষতঃ পিরালী বামুনদের নেতাগোছের ধনী জমিদার ও বণিকমহলে সুনাম আছে এমন এক প্রায় সমবয়সী যুবা দ্বারকানাথ, রামমোহনের চিন্তাভাবনার বিশেষ অনুগামী। ঘনিষ্ঠ মহলে পরস্পরকে এরা আজকাল "বেরাদর " বলে সম্বোধন করে। যদিও রামমোহন তার নিজের পিতৃকুল তথা পিতৃদেব স্বয়ং রামকান্তের কাছে এইসব বিধর্মীসুলভ কার্যকলাপের জন‍্য সুনাম খুইয়ে এখন একরকম ত‍্যাজ‍্যপুত্র হওয়ারই পথে।

....

আরও একটি মজার কথা এই যে সাকিন বর্ধমানের বর্তমান মহারাজ তেজচন্দ্রও রাজ‍্যভার সামলানোর কাজে তাঁর নিজের মায়ের অতিঅভিবাবকত্বের জন‍্য বেশ বিরক্ত। অবশ‍্য তিনি এসবের চেয়েও আরো বেশী বিরক্ত মাতার ঘনিষ্ঠ এই রামকান্ত রায়ের উপরে। রামকান্তর এখন বিষম নাজেহাল অবস্থা। একদিকে তাঁর ছোটছেলে রামমোহন অন‍্যদিকে মহারাজ তেজচন্দ্র এই দুজনেই তাঁকে যথেষ্ট জেরবার করে তুলেছে।

....

এদিকে বর্ধমানের সিংহাসনে বসেই তেজচন্দ্র তাঁর নিজের মা মহারানী বিষণকুমারী'র নামে কোম্পানি প্রদত্ত মাসোহারাটি বন্ধ করা সহ আরো নানারকম অশান্তির সূত্রপাত শুরু করেছেন। এমনকি তাঁর ইচ্ছা যে এই নবাবহাটের মন্দির সংলগ্ন খাসজমিগুলির বিনিময়ে আরও অর্থ উপার্জন করে তহবিল ভরানো।

যদিও তার বেশীটাই নর্তকী ও বারবনিতাদের পিছনে ব‍্যায় করতেই তিনি বেশী উৎসাহী। তাই আগামী পূণ‍্যাহের সময় এসব সম্পত্তিকে নাকি তিনি নীলামে তুলতেও চেয়েছিলেন।

তবে স্বস্তি এই যে রাজকর্মপরিচালনায় বিদগ্ধ প্রবীণ খানাকুলবাসী রামকান্ত রায়ের বুদ্ধিমত্তার জোরেই রানীমা বিষণকুমারী যেমন ইংরেজ কোম্পানির কাছে নিজের দাবী আদায়ে সফল হয়েছেন বলে আর বেনামে এই নীলামের দরপত্রটি রদ করতে সক্ষম হয়েছেন।

সেজন‍্য পুত্রের তীব্র বিরোধীতা সত্ত্বেও তাঁর খাসতালুকে তৈরী হওয়া সর্বমঙ্গলা মন্দির সহ এই নবাবগঞ্জের মন্দিরটিতেও তিনি সপ্তাহকালব‍্যাপী এক সুবিশাল অন্নকূট উৎসব করবেন।দেবানুগ্রহের ঋণস্বীকার ও তাঁর ব‍্যক্তিগত সংকটমোচনের উদযাপনটিকে তিনি বিশেষভাবে আরও মূল‍্যবান করে তুলতে চান বলে চৈত্রমাসে শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতেই এখানে এই অন্নকূট মহোৎসবটি পালিত হওয়ার কথা।

.....

নবাবহাটে আজ সুবিপুল লোকারণ‍‍্যের মধ‍্যে থেকে আর বন্ধুস্থানীয় একজন আড়তদার দিগম্বর বিশ্বাস এসে গোলকপতিকে ভীড়ভাট্টা থেকে সরিয়ে নিয়ে একটু আড়ালে এসে বলল,

" নগেনদা বলল তোমায় এক্কুনি খপরটা এসে দিয়ে যেতে। এ যে একেবারে ঘোড়ার মুকের খপর! শুনলুম যে তেজচাঁদ নাকি ষড় করে রানীমার খাবারে রাঁধুনির হাত দিয়ে বিষ দিতে গেচিল।

তাই একোন থেকে রানীমা ঠিক করেচেন যে রাজবাড়ির কোন কিচু মায় আনাজ পর্যন্ত ছোঁবেনা নে কো! তাই এবার থেকে তিনি নিজের এক বাজার সরকারের মাধ‍্যমে তৈজসপত্তরের বাজার করাবেন আর স্বপাকে যেমন একবেলা খান তাই খাবেন! তাই জোরকদমে তিনি একজন বিশ্বাসী ও সদ্বংশীয় একজনকে খুঁজচেন! তা সে বাউন না। হলেও হপে! একোন নাকি তেনার খাস বর্ধমানের সব লোকজনদের ওপর থেকে সঅঅব বিশ্বেস আর ভক্তি নাকি চটে গেচে.... তা দা'ঠাউর আপনি আর কেন ওখেনে গ‍্যে একটা কাজ নিচ্চেন নেকো? তাহলে আপনারও যেমন তাহলে একটা হিল্লে হয় আর নগেন'দা বা আমাদের মত আড়তদারেদেরও যে দুটো রোজগারপাতি হয়!

হে...হে..তা বেধবা হলেও তো রাজরাণী বলে কতা! ভগমান না করুন, এই উমরে পৌঁচে তিনি আর যে কটা দিন আচেন আর কি...মানে ইয়েএএ.....এখেনকার এই খাস আড়ত থেকে মাল না গেলে কি ওঁর মুকে রুচবে!

তা আজ দুপুরে অন্নছত্তরের সময় রাণীমাকে গ‍্যে এড্ডা পেন্নাম ঠুকে এসে নিজের সবটা ওঁকে গ‍্যে বলুন দিকি ! আরে বাবা...সেই বিক্রমপুর থেকে এসচেন বলে আপনি তো আর ভেসে আসা যেসে লোক নন মশাই..! "

0 comments:

0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in






তিন

বিজয় ভাবে,সংসারে সং সেজে দিবারাতি নিজেকে ঠকিয়ে কোন ঠিকানায় ঠাঁই হবে আমার ।নিজেকে নিজের প্রশ্ন কুরে কুরে কবর দেয় আমার অন্তরের গোপন স্বপ্ন । জানি রাত শেষ হলেই ভোরের পাখিদের আনাগোনা আরম্ভ হয় খোলা আকাশে । আমার টোনা মাসিকে টোন কেটে অনেকে অভিশাপ দিতো । আমি দেখেছি ধৈর্য্য কাকে বলে । আজ কালের কাঠগোড়ায় তিনি রাজলক্ষ্মী প্রমাণিত হয়েছেন । কালের বিচারক কোনোদিন ঘুষ খান না । তাই তাঁর বিচারের আশায় দিন গোনে শিশুর শব, সব অবিচার ,অনাচার কড়ায় গন্ডায় বুঝে নেবে আগামী পৃথিবীর ভাবি শিশু প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি। অপেক্ষায় প্রহর গোনে নিজের অন্তরের প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে । সাবধান খুনীর দল ,একবার হলেও অন্তত নিজের সন্তানের জন্য শান্ত পৃথিবী রেখে যা । ঋতু পরিবর্তন কিন্তু তোর হত্যালীলায় বন্ধ হবে না নির্বোধ ।শান্ত হোক হত্যার শাণিত তরবারি ।নেমে আসুক শান্তির অবিরল ধারা। রক্ত রঙের রাত শেষে আলো রঙের নতুন পৃথিবী আগামী অঙ্কুরের অপেক্ষায়। শিউলি শরতের ঘ্রাণে শিহরিত শরীর। শিউলি নামের শিউলি কুড়োনো মেয়েটি আমার শৈশব ফিরিয়ে দেয়।মনে পড়ে পিসির বাড়ির শিউলি গাছটার তলায় অপেক্ষা করতো ঝরা ফুলের দল। সে জানত ফুল ঝরে গেলেও

বিজয় ভাবে,তার কদর হয় ভাবি প্রজন্মের হাতে । সে আমাদের ফুল জীবনের পাঠ শেখায়। মানুষও একদিন ফুলের মত ঝরে যায়। । শুধু সুন্দর হৃদয় ফুলের কদর হয়। বিদেশে ষাট বছরেও মানুষ স্বপ্ন দেখে। নিজেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরখ করার সুযোগ মেলে। কিন্তু আমাদের কয়েকজন বন্ধু লোক ব্যাঙ্গের সুরে বলে, বুড়ো ঢ্যামনার ভিমরতি হয়েচে। সখ দেখো এখনও রঙীন জামা পড়ে। ব্যায়াম করে। মেয়েদের সঙ্গে কতা বলে।একটু হাসি ঠাট্টা করলে বলবে, মিনসে, ঘাটের মরা এখনও দুধ তোলা রোগ গেলো না।সব স্বপ্ন দেখা বন্ধ রেখে বুড়ো সেজে থাকলেই সম্মান পাওয়া যায় বেশি। নিজের মনে গুমরেওঠে যত স্মৃতি। শেয়ার করার কেউ নেই। তারপর মরে যাওয়ার পড়ে অন্তিম কাজ, নির্লজ্জ ভুরিভোজ। তবু সব কিছুর মাঝেই ঋতুজুড়ে আনন্দের পসরা সাজাতে ভোলে না প্রকৃতি। সংসারের মাঝেও সাধু লোকের অভাব নেই। তারা মানুষকে ভালোবাসেন বলেই জগৎ সুন্দর আকাশ মোহময়ী, বলেন আমার মা। সব কিছুর মাঝেও সকলের আনন্দে সকলের মন মেতে ওঠে। সকলকে নিয়ে একসাথে জীবন কাটানোর মহান আদর্শে আমার দেশই আদর্শ।

বিজয় আত্নসমালোচনা করে। সে নিজেকে ভাঙে, গড়ে আবার স্মৃতির বুকে ঝাপিয়ে পড়ে বারবারে।সে আর পাঁচজনের মত নয়। সে ভাবে, সত্য শিব সুন্দরের আলো আমার দেশ থেকেই সমগ্র পৃথিবীকে আলোকিত করুক। আমার দুই বোন। তিন ভাইঝি। বোনেদের নাম রত্না স্বপ্না। রত্না হলো কন্যারত্ন। সব অভাব অভিযোগ তার কাছে এসে থমকে পড়ে অনায়াসে। আর অপরের উপকার করতে স্বপ্নার তুলনা মেলা ভার। ভাইঝিরা তানুশ্রী, দেবশ্রী,জয়শ্রী। এরা বড়দার মেয়ে আর মেজদার মেয়ে পৃথা,ছেলে ইন্দ্র। এরা সকলেই আমার খুব প্রিয়। বাবুর মেয়ে তিন্নি আমার ছেলে সৈকত। রূপসী বাংলার রূপে ছুটে যাই। কিন্তু আমার চেনা পৃথিবীর সবটা হয়ে যায় অচেনা বলয়,মাকড়সার জালের মতো জটিল । সবাই এত অচেনা অজানা রহস্য ময় ।বুকটা ধকধক করছে,হয়তো মরে যাবো, যাবো সুন্দরের কাছে,চিন্তার সুতো ছিঁড়ে কবির ফোন এলো । এক আকাশ স্বপ্ন নিয়ে, অভয়বাণী মিলেমিশে সৃষ্টি করলো আশা ।আর আমি একা নই,কবির ছায়া তাঁর মায়া আমাকে পথ দেখায়...আমার মায়ের বাবার নাম ছিলো মন্মথ রায়। মনমতো পছন্দের দাদু আমাদের খুব প্রিয় ছিলেন। যখন মামার বাড়ি যেতাম মায়ের সঙ্গে তখন দাদু আমাদের দেখেই মামিমাকে মাছ,ডিম,মাংস রান্না করতে বলতেন। কখনও সখনও দেখেছি মামিমা নিজে ডেঙা পাড়া,সাঁওতাল পাড়া থেকে হাঁসের ডিম জোগাড় করে নিয়ে আসতেন। তখন এখনকার মতো ব্রয়লার মুরগি ছিলো না। দেশি মুরগির বদলে চাল,ডাল,মুড়ি নিয়ে যেতো মুরগির মালিক। নগদ টাকর টানাটানি ছিলো। চাষের জমি থেকে চাল,ডাল,গুড় পাওয়া যেতো। মুড়ি নিজেই ভেজে নিতেন মামিমা। আবার কি চাই। সামনেই শালগোরে। সেখানে দাদু নিজেই জাল ফেলে তুলে ফেলতেন বড়ো বড়ো রুই, কাতলা,মৃগেল। তারপর বিরাট গোয়ালে কুড়িটি গাইগরু। গল্প মনে হচ্ছে। মোটেও না। এখনও আমার সঙ্গে গেলে প্রমাণ হিসাবে পুকুর,গোয়াল সব দেখাতে পারি। আহমদপুর স্টেশনে নেমে জুঁইতা গ্রাম। লাল মাটি। উঁচু উঁচু ঢিবি। আমি পূর্ব বর্ধমানের ছেলে। সমতলের বাসিন্দা। আর বীরভূমে লাল উঁচু নিচু ঢিবি দেখে ভালো লাগতো।আমাদের মাটি লাল নয়। কি বৈচিত্র্য। ভূগোল জানতাম না। জানতাম শুধু মামার বাড়ি। মজার সারি। দুপুর বেলা ঘুম বাদ দিয় শুধু খেলা। আর ওই সময়ে দাদু শুয়ে থাকতেন। ডিসটার্ব হতো।একদিন ভয় দেখানোর জন্যে বাড়ির মুনিষকে মজার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়েছিলেন। তখন ছেলেধরার গুজব উঠেছিলো। আমরা দুপুরে খেলছি। দাদু বার বার বারণ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,আজ কিন্তু ছেলেধরা আসতে পারে। আমি খুব ভিতু ছিলাম। আমার মামার ছেলে বাঁটুলদা,হোবলো,ক্যাবলা,লেবু। সবাইকে বললাম। তখন বারো থেকে পনেরো বছরের পালোয়ান আমরা। সকলের ভয় হলো। দাদু কোনোদিন মিথ্যা বলেন না। কথার মধ্যে কনফিডেন্স না থাকলে তিনি রাগ করতেন। একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন,এই অঙ্কটা পারবি। পড়ে দেখ। আমি বললাম,বোধহয় পারবো। তিনি রেগে বললেন, বোধহয় কি? হয় বল না, কিংবা হ্যাঁ। নো অর ইয়েস। ধমকের চোটে কেঁদে ফেলেছিলাম। এই সেই দাদু বলেছেন, আজ ছেলেধরা আসবে। সাবধান। সবাই ঘুমোবি। দুপুরের রোদে বেরোবি না। বাধ্য হয়ে শুলাম। দাদুর নাক ডাকা শুরু হলেই সবাই দে ছুট। একেবারে বাদাম তলায়। চিনে বাদামের একটা গাছ ছিলো। ঢিল মেরে পারছি। এমন সময়ে মুখ বেঁধে ছেলেধরা হাজির। হাতে বস্তা। বস্তা ছুড়ে ঢাকা দিতে চাইছে আমাদের । আমরা সকলেই প্রাণপণে বক্রেশ্বর নদীর ধারে ধারে গিয়ে মাঝিপাড়ায় গিয়ে বলতেই বিষ মাখানো তীর আর ধনুক কাঁধে বেড়িয়ে পড়লো। বীর মুর্মু। সাঁওতাল বন্ধু। ছেলেধরা তখন পগাড় পাড়। আর দেখা নেই। বড়ো হয়ে সত্য কথাগুলি জানতে পেরেছি। দাদু ওই সাঁওতাল বন্ধুকে বকেছিলেন,ছেলেগুলোকে ভয় দেখাতে নাটক করছিলাম। আর তুই এক নম্বরের বোঙা। একবারে অস্ত্র হাতে। যদি মরে যেতো ছেলেটো। বন্ধু বললো,আমাকে অত বোঙা ভাবিস নি। তোর মুনিষটো আমাকে আগেই বলেছে তোর লাটকের কথা। আমি অভিনয়টো কেমন করেছিলাম বল একবার। দাদু ওদের খুব ভালোবাসতেন। ওদের অসময়ের বন্ধু ছিলেন দাদু। দাদুকে আমরা বলতাম টাইগার বাম বা বিপদের বন্ধু। ওষুধ মলমের স্পর্শে যেমন ফোড়া ভালো হয়ে যায়। তেমনি বিপদের সময় দাদুর উপস্থিতি সকল সমস্যার সমাধান করে দিতো। একবার ডেঙা পাড়ায় ডাকাত পরেছিলো। জমিদার বাড়িতে। তখন ফোন ছিলো না। জানাবার উপায় নেই। পাশের বাড়ির একজন দাদুকে ডাকতেএসেছিলো। দাদু ঘুম থেকে উঠেই লাঠি হাতে লোকজন ডেকে সিধে চলে গিয়েছিলেন। তখন লাঠিই প্রধান অস্ত্র। লাঠিখেলায় দাদুর সমকক্ষ কেউ ছিলো না। চারজন বাছা বাছা তরুণকে বললেন,আমার মাথায় লাঠি মারতে দিবি না। তারপর শুরু হলো লড়াই। পঁচিশজন ডাকাত সবকিছু ফেলে লাগালো ছুট। জমিদার দাদুকে বললেন,আপনার জন্যই আজকে বাঁচলাম। ভগবান আপনার ভালো করবেন। বাড়ির মহিলারা দাদুকে মিষ্টিজল খাইয়ে তবে ছাড়লেন। বাকি লোকেরাও খেলেন। দাদুর লাঠি খেলার দলের কথা আশেপাশে সবাই জানতো। দাদুর মুখেই শুনেছি হাটবারে ডাকাত সর্দার হাটে এসেছিলো। বলেছিলো,আপনার মায়ের দুধের জোর বটে। আপনাকে পেন্নাম।সাহসকে বলিহারি জানাই। আপনি ওই গ্রামে থাকতে আর কোনোদিন ডাকাতি করবো না। দাদু বলেছিলে, ছেড়ে দে ডাকাতি। তোকে জমিদার বাড়িতে ভালো কাজ দেবো। শেষে ওই ডাকাতদল জমিদারের লাঠিয়াল হয়েছিলো। ডাকাতি করা ছেড়ে দিয়েছিলো। এখন চোর ডাকাতগুলো চরিত্রহীন, দুর্বল,নির্গুণ। সেই ডাকাত সর্দার সন্ধ্যা হলেই দাদু আর জমিদারকে শ্যামাংগীত শোনাতো। সম্পর্কে দাদু হলেই তো আর বুড়ো হয়ে যায় না। দাদুর যখন চল্লিশ বছরের তখন মায়ের বিয়ে হয়েছিলো। দাদু আঠারো বছরেই মায়ের বিয়ে দিয়েছিলেন। মায়ের মুখ থেকে শোনা কথা। বিয়ের পরেও আমার মা তালবোনা পুকুরে তাল পরলেই সাঁতার কেটে সবার আগে তাল কুড়িয়ে আনতেন। দাদু আমার মা,বড়মা সবাইকে সব বিষয়ে পারদর্শী করে তুলেছিলেন। আর আমার মামা শান্ত লোক।গাঁয়ের মাসি বলতেন, একটা ব্যাটা। দুটি বিটি। তাই ঠাকুমার আদরে দাদা ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে থাকতেন। জুঁইতা গ্রামটা ছিলো একটা ঘরের মতো। গ্রামের বাসিন্দারা সেই ঘরের লোক। কোনোদিন বুঝতে পারিনি, কে আপন, কেই বা পর। গ্রাম না দেখলে ভারতবর্ষকে চেনা অসম্ভব। মামার বাড়ি গেলেই গ্রামে ঢুকতেই স্কুল। তারপর মামার বাড়ি আসতে অনেক সময় লেগে যেতো। আমার বড়দাকে ওখানে সবাই মিনু বলে ডাকতো। মাকে বলতো গীতু। হাঁটছি হঠাৎ এক মামা বললেন, কিরে গীতু ভালো আছিস,আই মিনে আয়। সুদপে,রিলপে আয়। আমাদের নাম ওখানে আদরের আতিশয্যে বিকৃত হয়ে যেতো।আবার কোনো মাসি বলতেন,আয় গীতু কতদিন পরে এলি, একটু মিষ্টিমুখ করে যা,জল খা। কোন পাষন্ড এই আদরের ডাক উপেক্ষা করবে। কার সাধ্য আছে। ফলে দেরি হতো অনেক। ইতিমধ্যে গীতু,মিনে দের দলবেঁধে আসার খবর রানার পৌঁছে দিয়েছে আগেই। তাই দেখা হয়ে যেতো মামির সঙ্গে কোনো এক বাড়িতে।আঁচলে ডিম আর হাতে মাছ নিয়ে হাসিমুখে হাজির। আরও অনেক কথা হারিয়ে গেছে স্মৃতির গভীরে।

0 comments:

0
undefined undefined undefined

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in







অধ্যায়-২ 


শিবপালগঞ্জ থানাতে একটি লোক দারোগাজীকে বলছে--- "আজ-কাল করতে করতে অনেক দিন গড়িয়ে গেছে হুজুর! আমার চালান পেশ করতে আর দেরি করবেন না।"
এই আরামকেদারাটি বোধ্হয় মধ্যযুগীন কোন সিংহাসন ছিল, ঘষে ঘষে আজ এই হাল। দারোগাজী ওতে বসে ছিলেন, আবার শুয়েও ছিলেন। এমন কাতর আবেদন শুনে মাথা তুলে বললেন," চালানও হয়ে যাবে, তাড়া কিসের? কিসের বিপদ?"
লোকটি আরামকেদারার পাশে পড়ে থাকা একটি প্রাগৈতিহাসিক মোড়ায় চেপে বসে বলতে লাগল," আমার জন্যে তো সমূহ বিপদ। আপনি আমায় চালান করে দিন, তো ঝঞ্ঝাট মিটে যায়।"
দারোগাজী গুজগুজ করতে করতে কাউকে গালি দিতে লাগলেন। একটু পরে বোঝা গেল যে উনি বলছেন--- কাজের ঠ্যালায় চোখে অন্ধকার দেখছেন। এত কাজ যে অপরাধের তদন্ত হচ্ছে না, মামলার চালান পেশ হচ্ছে না, আদালতে সাক্ষী যাচ্ছে না। এত কাজের বোঝা যে একটা কাজও হচ্ছে না।
মোড়া ঘষটে আরামাকেদারার গা ঘেঁষে এল। বলল, " হুজুর, শত্রুরা বলাবলি করছে যে শিবপালগঞ্জে দিনেদুপুরে জুয়োর আড্ডা বসছে। পুলিস কাপ্তেনের কাছে বেনামী চিঠি গেছে। আর আপনার সঙ্গে তো আমাদের সমঝোতা ছিলই যে বছরে একবার চালান করবেন। এই বছর চালান করতে করতে অনেক দেরি হয়ে গেধ্হে। এই সময় করে ফেলুন, তো লোকের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে।"


শুধু আরামকেদারা কেন, সবকিছুই যেন মধ্যযুগের। তক্তপোষটা, ওর ওপরে বিছিয়ে দেয়া ছেঁড়াখোড়া শতরঞ্জি, শুকনো খটখটে দোয়াত,কোনামোড়া আধময়লা রেজিস্টার --- সবগুলো যেন কয়েকশ' বছর আগের থেকে রাখা আছে।
এখানে বসে চারদিকে চোখ ঘোরালেই মনে হবে যেন ইতিহাসের কোন কোণায় দাঁড়িয়ে আছি। এখনো এই থানায় ঝর্ণাকলমের আমদানি হয় নি, তবে খাগের কলম বিদায় নিয়েছে। টেলিফোন আসেনি। অস্ত্রশস্ত্র বলতে কিছু পুরনো রাইফেল, মনে হয় সিপাহীবিদ্রোহের সময় কব্জা করা। এমনিতে সেপাইদের জন্যে অনেকগুলো বাঁশের লাঠি আছে। কবি বলেছেন যে ওগুলো নদী-নালা পেরোতে বা খেঁকি কুকুর ঠ্যাঙাতে বেশ কাজে লাগবে।
থানার জন্যে কোন জীপ-টিপ নেই। তবে বাহন হিসেবে জনাকয় চৌকিদারের আদরে টিঁকে থাকা ঘোড়া আছে। সে তো শেরশাহের আমলেও ছিল।
আগেই বলেছি যে থানার ভেতর ঢুকলেই মনে হবে যেন হুড়মুড়িয়ে কয়েক্শ' বছর পেছনে এসে পড়েছি। আমেরিকান থ্রিলার পড়ার অভ্যেস থাকলে তো প্রথমেই মনে হবে কোথায় আঙুলের ছাপ দেখার আতসকাঁচ, কোথায় ক্যামেরা আর ওয়ারলেসওলা গাড়ি? তার জায়গায় যা যা আছে সেতো বলাই আছে।
আরও আছে--- সামনে তেঁতুলগাছের নীচে বসে একটা আধন্যাংটো ল্যাংগোটপরা লোক, ভাঙ্গের শরব্ত বানাচ্ছে। একটু পরে জানতে পারা যাবে যে একা ওই একটা লোক বিশটা গ্রামের দেখাশুনোর জন্যে আছে। ও যেমন আছে তেমনি অবস্থায় ওখানে বসে বসেই বিশ গাঁয়ের ক্রাইম ঠেকাতে পারে, ঘটনা ঘটে গেলে তার খোঁজখবর করতে পারে, আর কিছু না ঘটলে কিছু করিয়ে দিতে পারে। আতসকাঁচ, ক্যামেরা,কুকুর, ওয়্যারলেস ওর জন্যে নিষিদ্ধ বস্তু। দেখলে কিন্তু থানার পরিবেশ বেশ রোম্যান্টিক আর অতীতদিনের গৌরব নিয়ে মজে থাকার অনুকূল। যেসব রোম্যান্টিক কবি হারিয়ে যাওয়া অতীতের কথা ভেবে ভেবে কষ্ট পান, তাঁদের এখানে কিছুদিন থাকতে বললে ভালো হয়।
তবে জনগণের আশা-ভরসা বলতে থানার ওই দারোগাজী আর তার কুল্যে গোটা দশ-বারো সেপাই। থানাটির অধীনে প্রায় আড়াই থেকে তিনশ' গাঁ; তবু যদি আট মাইলের মধ্যে কোন গাঁয়ে সিঁধ পড়ে তবে জনতা আশা করবে যে এই সেপাইদের মধ্যে থেকে কেউ না কেউ নিঘ্ঘাৎ দেখে ফেলেছে। আর যদি মাঝরাতে বারো মাইলের মধ্যে ডাকাতি হয় তাহলে পুলিশ নিশ্চই ডাকাতদের আগে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাবে। এই বিশ্বাসের জন্যেই কোন গাঁয়ে একটা-দুটো বন্দুক ছাড়া কোন হাতিয়ার রাখতে দেয়া হয় নি।
আর ভয় আছে যে গাঁয়ে হাতিয়ার রাখার অনুমতি দিলে ওখানের বর্বর-অসভ্য লোকজন হাতিয়ার চালানো শিখে নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা বাধাবে,খুনজখম শুরু হবে, রক্তের নদী বইবে। আর ডাকাতদের থেকে নাগরিকদের বাঁচানো? সেসব দারোগাজী আর তাঁর দশ-বারো সেপাইয়ের জাদুকরী-ক্ষমতার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।
এঁদের এই ম্যাজিক পাওয়ারের সবচেয়ে বড় প্রমাণ খুনের মামলায় দেখা গেছে। ফলে বিশ্বাস জন্মেছে যে তিনশ' গাঁয়ে কার মনে কার জন্যে ঘৃণা জন্মেছে, কার সঙ্গে কার শ্ত্রুতা, কে কাকে কাঁচা চিবিয়ে খেতে চায়-- তার খুঁটিনাটি খবর আগে থেকেই এদের কাছে আছে। তাই এঁরা আগে থেকেই এমন চাল চালবেন যাতে কেউ কাউকে মারতে না পারে, আর মারলেও চটপট ধরা পড়ে যায়।
কোথাও খুন হলে এঁরা হাওয়ার বেগে অকুস্থলে গিয়ে খুনীকে ধরে ফেলবেন, শবদেহ নিজেদের কাস্টডিতে নেবেন, রক্তে-ভেজা-মাটি হাঁড়িতে ভরে ফেলবেন আর প্রত্যক্ষদর্শীদের এমন দিব্যদৃষ্টি দেবেন যাতে তারা যেকোন আদালতে মহাভারতের সঞ্জয়ের মতন যা ঘটেছে তার হুবহু বর্ণনা করতে পারে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে দরোগাজী আর তার সেপাইরা মানুষ নয়, আলাদীনের প্রদীপ থেকে বেরিয়ে আসা দৈত্য। এদের এমনি বানিয়ে রেখে ইংরেজ ১৯৪৭ এ এদেশ ছেড়ে নিজেদের দেশে ফিরে গেছে। তারপরে ধীরে ধীরে রহস্য ফাঁস হল যে এরা দৈত্য নয় মানুষ, আর এমনি মানুষ যারা নিজেরাই দৈত্য বেরিয়ে আসবে এই আশায় প্রদীপ ঘষেই যাচ্ছে।
শিবপালগঞ্জের জুয়াড়ি কোম্পানীর ম্যানেজিং ডাইরেক্টর বেরিয়ে গেলে দারোগাবাবু একবার চোখ তুলে চারদিক দেখে নিলেন। সর্বত্র শান্তি। তেঁতুলগাছের নীচে ভাঙ্গ ঘুটতে থাকা ল্যাংগোটছাপ সেপাইটা পাশে স্থাপিত শিবলিঙ্গের ওপর ভাঙ্গের সরবত ঢালছে, জনৈক চৌকিদার ঘোড়ার পাছায় দলাই-মলাই করছে, লক-আপের ভেতর এক ডাকাত জোরে জোরে হনুমান-চালিশা পড়ছে আর বাইরের ফটকে ডিউটিরত সেপাই- সম্ভবতঃ সারারাত্তির জেগে থাকার ফলে---একটা থামের গায়ে হেলান দিয়ে ঢুলছে।
দারোগাবাবু একটা ছোট্ট ভাতঘুম মারবেন বলে খালি চোখ বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন, দেখতে পেলেন রূপ্পনবাবু আসছে। উনি গজগজ করতে লাগলেন-- একটু যে চোখ বন্ধ করব তার জো নেই!
রূপ্পনবাবু ঢুকতেই উনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন আর 'জনতার সঙ্গে ভদ্র-ব্যবহার সপ্তাহ' অনেক আগে চলে গেলেও উনি বেশ বিনম্র ভাবে হ্যান্ডশেক করলেন। রূপ্পনবাবু বসতে বসতেই শুরু করলেন, " রামাধীনের বাড়িতে লাল কালিতে লেখা চিঠি এসেছে। ডাকাতের দল পাঁচহাজার টাকা চেয়ে পাঠিয়েছে। লিখেছে অমাবস্যার রাতে দক্ষিণের টিলার ওপরে--"।
দারোগাবাবু মুচকি হেসে বললেন," এতো মশায় বড্ড বাড়াবাড়ি! কোথায় পুরনো দিনে ডাকাতেরা নদী-পাহাড় ডিঙিয়ে এসে টাকা নিয়ে যেত, আর এখন চায় কি ওদের ঘরে গিয়ে টাকা দিয়ে আসতে হবে!"
রূপ্পনবাবু বল্লেন," যা বলেছেন। যা দেখছি এত ডাকাতি না, ঘুষ চাওয়া।"
দারোগাবাবু একসুরে বল্লেন, " ঘুষ, চুরি, ডাকাতি---আজকাল সব এক হয়ে গেছে। ---পুরো সাম্যবাদ।"
রূপ্পনবাবু," আমার বাবাও তাই বলছিলেন।"
--"কী বলছিলেন?"
--" এই, সব সাম্যবাদ হয়ে যাচ্ছে।"
দুজনেই হেসে উঠলেন।
এবার রূপ্পন বললেন, " না, আমি ঠাট্টা করছি না। সত্যি সত্যি রামাধীনের ঘরে এমনি চিঠি এসেছে। বাবা আমাকে তাই পাঠালেন। উনি বলেছেন যে রামাধীন আমাদের বিরোধী হতে পারে, কিন্তু ওকে এমন করে বিরক্ত করা উচিৎ হবে না।"
--" সুন্দর বলেছেন। বলুন, কাকে কাকে বলতে হবে,- বলে দেব।"
রূপ্পনবাবু গর্তে ঢোকা চোখ কুঁচকে খানিকক্ষণ দারোগার দিকে তাকিয়ে রইলেন।
দারোগা চোখ নামান নি। হেসে বল্লেন," ঘাবড়াবেন না। আমি থাকতে ডাকাতি হবে না।"
রূপ্পনবাবু আস্তে আস্তে বল্লেন, " তা জানি। চিঠিটা জাল। আপনার সেপাইদেরও একটু জিগ্যেস করে দেখবেন। হতে পারে ওদেরই কেউ লিখেছে।"
" হতে পারে না। আমার সেপাইগুলোর মধ্যে কেউ লিখতে জানে না। এক-আধটা হয়তো খালি নাম সাইন করতে পারে।"
রূপ্পন আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ওনাকে থামিয়ে দিয়ে দারোগাবাবু বল্লেন," এত তাড়া কিসের? আগে রামাধীন এসে রিপোর্ট তো লেখাক। চিঠিটা তো সামনে আসুক।"

খানিকক্ষণ দুজনেই চুপ। দারোগাবাবু যেন কি ভেবে বল্লেন," সত্যি বলতে কি আমার তো এর সাথে শিক্ষাবিভাগের কোন সম্পক্ক আছে বলে মনে হচ্ছে।"
-" কি করে"?
-" আরে শিক্ষাবিভাগ-টিভাগ মানে আপনার কলেজের কথাই বলছি।"
এবার রূপ্পনবাবু রেগে গেলেন। " আপনি তো আমার কলেজের পেছনে আদাজল খেয়ে লেগেছেন।"
--" সে যাই বলুন, আমার তো মনে হয় রামাধীনকে ওই ভয়-দেখানো চিঠিটি আপনার কলেজের কোন ছোকরার কীর্তি, আপনি কী বলেন?"
--" আপনাদের চোখে তো সমস্ত ক্রাইম কেবল স্কুলের ছোকরাদের কীর্তি! আপনার সামনে কেউ বিষ খেয়ে মরে গেলেও সেটাকে আপনি আত্মহত্যা না বলে বলবেন যে বিষ-টিষ কোন স্কুলের ছোঁড়াই এনে দিয়েছে।"
--" ঠিক বলেছেন রূপ্পনবাবু! দরকার পড়লে বলব বই কি! আপনি হয়ত জানেন না যে আমি বখ্তাবর সিং এর চ্যালা!"
এরপর শুরু হল সরকারী চাকরি নিয়ে কথাবার্তা--- ঘুরে ফিরে একটাই গান যার ধূয়ো হল সরকারী কর্মচারি আগে কেমন ছিল আর আজকাল কেমন! শুরু হল বখ্তাবর সিং এর গল্প। এক বিকেলে দারোগা বখ্তাবর সিং একা একা বাড়ি ফিরছিলেন। পার্কের পাশে ওনাকে ঘিরে ধরল দুই খাঁটি বদমাশ---ঝগরু আর মঙ্গরু। তারপর দে দনাদন্।
কথা চাপা রইল না, তখন উনি থানায় গিয়ে নিজের ঠ্যাঙানি খাওয়ার রিপোর্ট লিখিয়ে দিলেন।
পরদিন দুটো বদমাশ এসে ওনার পা' জড়িয়ে ধরল। বল, " হুজুর আমাদের মা-বাপ! বাচ্চা যদি রাগের মাথায় মা-বাপের সঙ্গে বেয়াদপি করে বসে তখন তাকে মাপ করে দেয়াই দস্তুর।"
বখতাবর মা-বাপের কর্তব্য করে ওদের মাপ করে দিলেন। ওরাও ছেলের কর্তব্য পালন করে ওনার বুড়োবয়সের খাওয়া-পরার ভালমত ব্যবস্থা করে দিল।মামলা ভালয় ভালয় মিটে গেল।

কিন্তু পুলিস কাপ্তেন রেগে কাঁই, ইরেংজ যে!
রেগেমেগে বখতাবর সিং কে বলল," টুমি শালা নিজের মামলাটারও ঠিক করে তদন্ত করতে পারলে না,টো অন্যদের কি বাঁচাবে? অন্ধকার ছিল তো কি? কাউকে চিনতে পারোনি? তাতে কি? টুমি কাউকেই চিনতে পারোনি, তো কী? কাউকে সন্দেহ তো করতে পারো! করলে ঠেকাচ্ছে কে?"
তখন বখ্তাবর সিং তিনজনকে সন্দেহের বশে জেলে পুরলেন। তিনজনের সঙ্গেই ঝগরু- মঙ্গরু'র পুরুষানুক্রমে শত্রুতা। ওরা কেস খেল। মামলা চলল। ঝগরু-মঙ্গরু আদালতে বখতাবর সিংয়ের পক্ষে সাক্ষী দিল। কারণ ওরা দেখেছে! হ্যাঁ, ওরা দুজনেই নাকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে বাহ্য করতে পার্কে ঢুকেছিল। তিন ব্যাটারই জেল হল।
ঝগরু-মঙ্গরুর দুশমনের গতি দেখে পাড়ার বেশ ক'টা ছোকরা রোজ এসে ধর্না দিতে লাগল--" হুজুর! মাই-বাপ! একবার আমাদেরও সুযোগ দিন। আপনাকে ভালো করে প্যঁদাবো। "
কিন্তু বখ্তাবর সিংহ দেখলেন যে বুড়োবয়সের খাওয়াপরার জন্যে ঝগরু আর মঙ্গরুই যথেষ্ট। উনি আর ছেলেপুলের সংখ্যা বাড়াতে চাইলেন না।
গল্পটা শুনে রূপ্পনবাবু খুব হাসলেন। দারোগাবাবু খুশি - একটা চুটকি গপ্পেই রূপ্পনবাবু কাত। আর দরকার নেই। বাকি চুটকিগুলো অন্য লিডারদের হাসাতে কাজে লাগবে। হাসি ফুরোলে রূপ্পন বল্লেন,-" তো আপনি সেই বখ্তাবর সিংয়ের চেলা?"
--" ছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে। কিন্তু এখন তো আমরা জনগণের সেবক। আমাদের গরীবের দুঃখকষ্টের ভাগ নিতে হবে। নাগরিকদের ---"।
রূপ্পন দারোগার হাতে খোঁচা মেরে বললেন," ওসব ছাড়ুন, এখানে শুধু আপনি আর আমি, আপনার বক্তিমে শুনবে কে?"
কিন্তু দারোগা দমার পাত্র ন'ন। বলতে লাগলেন," বলছিলাম কি আজাদীর আগের যুগে বখ্তাবর সিংয়ের চেলা ছিলাম। এ যুগে আপনার পিতাশ্রীর চেলা হয়েছি।"
রূপ্পনবাবু সৌজন্য দেখিয়ে জবাব দিলেন," এটা আপনার মহত্ব, নইলে আমার বাবা এমন কি তালেবর?"
এবার উনি গা ঝাড়া দিয়ে উঠলেন। রাস্তার দিকে চোখ যেতে বল্লেন," দেখুন তো,মনে হচ্ছে রামাধীন এদিকেই আসছে, আমি চলি। ওই ডাকাতির চিঠিটা একটু ভাল করে দেখে নেবেন কিন্তু।"

রূপ্পনবাবুর বয়স আঠেরো। পড়ছেন ক্লাস টেন এ। পড়তে , বিশেষকরে ক্লাস টেন এ পড়তে উনি খুব ভালোবাসেন। তাই গত তিনবছর ধরে একই ক্লাসে রয়েছেন।
উনি লোক্যাল নেতা। যাঁরা ভাবেন যে ইন্ডিয়াতে রাজনৈতিক নেতা হতে গেলে অনেক অভিজ্ঞতাও পাকাচুল হওয়া দরকার, তাঁরা একবার রূপ্পনবাবুকে দেখুন,--- ভুল ভেঙে যাবে।
উনি নেতা, কারণ উনি সমদর্শী। সবাইকে একই চোখে দেখেন। এটাই ওনার ভিত। ওনার চোখে থানার ভেতরে দারোগা আর লক্‌ আপের ভেতর চোর-- দুইই সমান।
একই ভাবে, পরীক্ষায় টুকতে গিয়ে ধরা পড়া ছাত্র আর কলেজের প্রিন্সিপাল-- ওনার চোখে এক। উনি সবাইকে দয়ার পাত্র ভাবেন। সবার কাজে লাগেন, সবাইকে কাজে লাগান।
লোকের চোখে ওনার স্থান এমন উঁচুতে যে পুঁজিবাদের প্রতীক দোকানদার ওনাকে জিনিস বেচে না, সমর্পণ করে। তেমনি শোষিতের প্রতীক টাঙ্গাওলা ওনাকে গাঁ থেকে শহরে পৌঁছে দিয়ে ভাড়া চায় না, আশীর্বাদ চায়। ওনার রাজনীতির হাতেখড়ির জায়গা ও রঙ্গমঞ্চ হল ওখানকার কলেজ। সেখানে একশ ছাত্র ওনার আঙুলের টুসকিতে তিল কে তাল বানাতে পারে , আবার দরকার হলে সেই তালগাছে চড়তেও পারে।
উনি রোগাপাতলা, লম্বা গলা, লম্বাটে হাত-পা। কিন্তু লোকে ওনার সঙ্গে সহজে লাগতে চায় না।
জনগণের নেতা হতে গেলে একটু উল্টোপাল্টা পোষাক দরকার বলে উনি ধুতির সঙ্গে রঙিন বুশশার্ট পরে গলায় রেশমি রুমাল বেঁধে ঘুরে বেড়ান। ধুতির কোঁচাটি আবার গলায় জড়ানো। দেখতে উনি একটা মরুটে বাছুরের মত, কিন্তু ঠ্যাকার যেন সামনের দু'পা তুলে চিঁহি করা ঘোড়া।
উনি জন্ম থেকেই জনগণের নেতা, কারন ওর বাপও তাই। ওর বাপের নাম বৈদ্যজী।

0 comments: