বিশেষ ক্রোড়পত্র - তৃতীয় লিঙ্গ বা রূপান্তরকামী
Posted in বিশেষ ক্রোড়পত্র১। বিনি সুতোর মালা -রঞ্জিতা সিনহা
২। রুপান্তরিত নারী – অনন্যা রায়
৩। শিখন্ডী- নবারুণ সুমন
৪। বিভেদ- সুপ্রিয় দত্ত
৫। When I sleep gloomy - Tracy Shivangee Sardars
৬। *যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে, প্রবাদটি সত্যি হয়ে উঠেছে এক রূপান্তরকামীর জীবনে* - ঋত্বিকা
৭। *প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও মানুষের পাশে দাঁড়াতে রান্নার ব্যবসা শুরু দেবাঙ্গনার* - দেবাঙ্গনা
৮। *আইন পাস হলেও প্রতিনিয়ত সমাজের অবজ্ঞার শিকার ধ্রুবর মতো রূপান্তরকামীরা* - ধ্রুব
As a pillar of the LGBTQH or Lesbian, Gay, Bisexual, Transgendered and Queer, Hijra community, I have experienced several things, some being good, some bad and some are quite tragic. But I have learnt through my experiences to fight against the society and create a platform for these people.
The Transgender community is marginal and vulnerable in the society. They suffer from violence, harassment and discriminations. And these issues are increasing by leaps and bounds. The police refuse at times to lodge an FIR, if need be, against the harasser. To fight for their Right to Equality, I have taken to roads, gheraoed the local police stations, campaigned on streets with festoons and banners and sought help of the social media. As a member of West Bengal Transgender Board and a founder member of National Transgender Task Force, I feel blessed to run a shelter for LGBTQH community in Kolkata.
When Rritobak asked me to contribute for their Krorepotro (Supplementary) on this issue, I immediately agreed to the proposal as I feel these people also need to voce their issues. Along with some articles by writers from Bangladesh, Austria and Germany/UK, I have included here short pieces by my community people. Despite the pandemic situation and still unable to weather their position in this society, when many are fleeing homes and taking refuge at my home, I feel happy to share their experiences with the readers.
Ranjita Sinha
বিনি সুতোর মালা
রঞ্জিতা সিনহা
“আমার এ ঘর বহু যতন করে
ধুতে হবে মুচতে হবে মোরে।
আমাকে যে জাগাতে হবে…
কি জানি সে আসবে কবে
যদি আমায় পড়ে তাহার মনে”
রবীন্দ্রনাথের এই লাইনগুলো আমাদের মতো মানুষদের কাছে যেন এক নির্মম সত্যি। আমরা যতই নিজেদের কপট জৌলুশে বা চড়া সাজে নিজেদের সাজিয়ে রাখি না কেন, আসলে আমরা সবাই একা। তাই মনে মনে হয়তো খুঁজে বেড়াই একটা অবলম্বন। অপেক্ষা করে থাকি সেই মানুষটার জন্য, যার ছোঁয়ায় খুঁজে পেতে চাই নিজেদের পরিপূর্ণতা। বিতানের কাহিনীও অনেকটা সেইরকম।
হাওড়া জেলার এক গ্রামে বিতান থাকে। মামার বাড়িতে মানুষ ছোটোবেলায় বাবা-মাকে হারিয়ে মামাবাড়িতে উটকো আগাছার মতো বড়ো হচ্ছে সে। দিদিমা যতদিন ছিলো লেখাপড়াটা চালিয়ে যেতে পেরেছে। দিদিমা গত হওয়ার পর তাও বন্ধ। ছোটোবেলা থেকেই একরকম নরম মনের সে। ভিজে মাঠে ফুটবল বা ডাংগুলি খেলার থেকে মামাতো বোনের সাথে পুতুলের বিয়ে দিতে তার যেন বেশি ভালো লাগে। মামীমা যখন নুন-হলুদ মাখা হাতে খুন্তি নেড়ে তরকারি নাড়ে, মামীর হাতের সেই চুড়ির আওয়াজ তাকে কি রকম আনমনা করে দেয়। খুব ইচ্ছে করে বিতানের বাড়ির পিছনে খেলনা উনুন বানিয়ে, বুনো গাছের পাতা আর লাল ইঁটের গুঁড়ো দিয়ে মামীর মতো তরকারি রাঁধতে। মামার মুদির দোকানে বসার চেয়ে বোনের ফেঁসে যাওয়া ফ্রকটা সেলাই করতে তার বড়ো ভালো লাগে। সবার কাছে সে যেন অন্য টাইপের একটা ছেলে, কিরকম মেয়েলি মার্কা। দোলের দিনে মামাতো ভাইয়েরা রং মেখে গ্রামের পুকুরে চান করতে যায়, সঙ্গে আরও পাড়ার ছেলেরা, ইচ্ছে না করলেও যেতে বাধ্য হয় বিতান। খালি গায়ে পুকুরে ঝাঁপাতে সে যেন লজ্জায় কুঁকড়ে যায়। গায়ে ভেজা গামছা জড়িয়ে আসার সময় মামাতো ভাই ও তার বন্ধুরা বারবার গামছা ধরে টানে। সে যেন মরমে মরে যায়। কেন কেউ তাকে বুঝতে পারে না? হয়তো সে নিজেকেও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না— কে সে? ছোটোবেলায় দিদুর মুখে শোনা সেই কুৎসিত দাঁড়কাকটা, যে রোজ পুকুরের জলে নিজেকে দেখে ভাবে এক সুন্দর দোয়েল। ভোররাতে এক পরী এসে চকমকী জাদুর ছড়ি দিয়ে সত্যি তাকে দোয়েল করে তুলেছে একদিন। হায়রে দিদুও নেই, দিদুর সেই গল্পের পরীও নেই। বড়ো হওয়ার সাথে সাথে নিজের ভিতরে ভাঙতে থাকে বিতান। কেউ তাকে বুঝতে পারে না। নির্জন দুপুরে সবাই যখন ঘুমায়, বিতানের ইচ্ছা করে মামাতো দিদির লিপস্টিকটা ঠোঁটে মাখতে।
একমাত্র পাড়ার গঙ্গাদা তার বড়ো কাছের মানুষ। গঙ্গাদাকে দেখে সবাই হাসে, ঠাট্টা করে। সে পাড়ার জলসায় নাচে। মাঝে মাঝে কলকাতায় যায় কীসব কাজে। খুব ভালো মেহেন্দী পরায় গঙ্গাদা, তাই কলকাতা থেকে ডাকও আসে তার। গঙ্গাদা গ্রামে ফিরলেই বিতান তার কাছে যায়, অনেকক্ষণ ধরে গল্প করে। গঙ্গাদার বাড়িতে বিতান নির্ভয়ে সব মাখতে পারে। সবার সামনে বিতান বলে ডাকলেও, গঙ্গাদা আড়ালে তাকে বলে তুই আমার বোন, আমার বিথি বোন গঙ্গাদার মুখে বোন কথাটা শুনে বিতান নিজেকে পরিপূর্ণ মনে করে। কিন্তু গঙ্গাদা দশদিন থাকে তো দু’মাস অন্য জায়গায়। তাই বিতানকে কঠিন বাস্তবের মধ্যে কাটাতে হয় দিনের পর দিন। সময় চলে যায় এইভাবেই। ১৬-র গণ্ডী পেরিয়ে ১৭-য় পড়ে বিতান। অনেকদিন হয়ে গেলো গঙ্গাদা গ্রামে আসেনি। কিছুদিন ধরে বড়ো মন খারাপ করছে বিতানের। কিছুতেই কিন্তু যেন ভালো লাগছে না। বাড়ির পিছনে তেঁতুল গাছের তলাটা বিতানের খুব প্রিয়। মামীর বকুনি, মামার মার কিম্বা যখনই মন খারাপ হয় সে এসে চুপ করে বসে থাকে এই তেঁতুল তলায়। সেদিন অলস দুপুরে সবাই যখন ভাত ঘুম দিচ্ছে ছোটোবোন আর ভাইরা ইস্কুলে গেছে, বিতান তেঁতুল তলায় বসে সরু আমডাল দিয়ে মাটিতে আপন মনে দাগ কেটে যাচ্ছিলো। হঠাৎ বেড়ার ওপার থেকে একটা বল এসে পড়ে তার সামনে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই বিতান দেখে তার থেকে তার থেকে একটু বড়ো ছেলে বেড়া টপকে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলছে— “বলটা আমার”, কথাটা বলে সে বলটা কুড়িয়ে চলে যেতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়, তারপর মাটির দিকে তাকিয়ে দেখে বলে— “তুমি তো খুব ভালো আঁকো। বিতান কিছু বুঝে উঠতে পারে না, মাটির দিকে তাকিয়ে দেখে কখন সে নিজের অজান্তেই ডালটা দিয়ে একটা আলপনা এঁকে ফেলেছে, বিতান চুপ করে থাকে। ছেলেটা বলে— “আমাদের সাথে খেলবে মাঠে।” ” এতদিন দাদারা, পাড়ার ছেলেরা তার শুধু পিছনেই লেগেছে, কিন্তু আজ কেউ তাকে ডাকলো খেলার জন্য। কিন্তু ক্রিকেট, ফুটবল বা ডাংগুলি— এইসব খেলা বিতান খেলতে পারে না। তাই সে ঘাড় নেড়ে ‘না’ বলে। ছেলেটি বল নিয়ে চলে যায়, এই ছেলেটকে তো আগে কোনওদিন দেখেনি সে! হঠাৎ মনে পড়ে পাশের মিত্র জ্যেঠুদের বাড়িতে কলকাতা থেকে মিত্র জ্যেঠুর ভাইয়ের পরিবার এসেছে, কলকাতা থেকে গরমের ছুটিতে বেড়াতে। হয়তো “এ তাদেরই কেউ একজন। মামার ঘরের দেওয়াল ঘড়িতে চারটের ঘণ্টা পড়তেই বিতান আমডালটা ফেলে দৌড় দেয় ছোটো বোনকে স্কুল থেকে আনতে। ”
সন্ধ্যার মুখে মামার দোকান থেকে আটার ব্যাগটা নিয়ে ঘরে ফিরছিলো বিতান। পাশ দিয়ে সাইকেলের রেস করতে করতে যাচ্ছে দুটি ছেলে। হঠাৎ গ্রামের রাস্তায় টাল সামলাতে না পেরে সাইকেল নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায় একজন। ততক্ষণ অন্যজন তাকে না দেখেই সাইকেল চালিয়ে চলে গেছে অনেকদূর। বিতান ছেলেটির কাছে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি বলে— “আমাকে একটু হেল্প করবে?” বিতান দেখে কালকের সেই বল কুড়োতে আসা ছেলেটা। বিশ্রীভাবে পাশের খালে পাঁক মাখা অবস্থায় পড়ে আছে, আর তার উপর তার সাইকেল। বিতান সাইকেলটা তুলে, পাঁক থেকে ছেলেটাকে তোলে। কোনওরকমে উঠে ছেলেটা বলে— “এখানে কোথায় কল আছে বলোতো?” বিতান দেখে ছেলেটির গা ভর্তি পাঁক। পচা খালের পাঁকের গন্ধে গা গুলায় বিতানের, কিন্তু ছেলেটাকে ছেড়ে যাওয়াটাও বাজে দেখায়। পাঁক মাখা অবস্থায় সাইকেল নিয়ে ছেলেটি এগিয়ে যায় বিতানের সঙ্গে দূরে কলটার দিকে। বিতান কল টিপছে। ছেলেটি হাত-মুখ ধুতে ধুতে কথা বলতে শুরু করে। বিতান জানতে পারে ছেলেটির নাম সুমন— সুমন মিত্র। মিত্র জ্যেঠুর ছোটো ভাইয়ের ছেলে। গরমের ছুটিতে জ্যেঠুর বাড়ি ঘুরতে এসেছে। সুমন, বিতানকে জিজ্ঞাসা করে সে আঁকা শেখে কিনা। বিতান না বলে ঘাড় নাড়ায়। মনে মনে ভাবে যেখানে তার লেখাপড়াই বন্ধ, সেখানে আঁকা শেখাটা তো বিলাসিতা। এরপর প্রায়ই পথে-ঘাটে কিম্বা তেঁতুল তলায় সুমনের সাথে দেখা হয় বিতানের। সুমন খুব সুন্দর কথা বলে। বিতানের খুব ভালো লাগে সুমনের থেকে কলকাতার গল্প শুনতে। আর তার থেকে বেশি ভালো লাগে সুমনকে। এই একজনই সে বিতানকে মেনে নিয়েছে ভালো বন্ধু হিসাবে। কারণ বাকিরা তো শুধু বিদ্রুপ আর কটাক্ষই করে তাকে নিয়ে। সেদিন দুপুর বেলা তেঁতুল তলায় সুমন গল্প করতে করতে বিতানের হাতটা যখন ধরেছিলো, বিতানের হঠাৎ যেন সারা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠেছিলো। রাতে শুয়ে শুয়ে সে ভেবেছে অনেক, এতদিন তো কারও ছোঁয়াতে ওর এমন হয়নি। দাদারা, ভাইরা, পাড়ার বিল্লু, গৌতম কারোর বেলায় তো এমন হয়নি কখনও! ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে বিতান।
গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় সেদিন সব ভাইবোন মিলে ঠিক করেছে অন্ধকারে লুকোচুরি খেলবে। বোনেরা মিলে দল ঠিক করেছে। সুমন ওর বোন আর মিত্র জ্যেঠুর ছেলেমেয়েরাও এসেছে খেলতে। বিশাল দল নিয়ে সবাই খেলতে রাজি হয়েছে। সুমন আর ওর বোন খুব উৎসাহী কারণ কলকাতায় এসবের এসবের আর চল নেই। অনেকক্ষণ ধরে খেলা আর মজা হচ্ছে। দাদা-দিদিরাও আজ ছোটোদের সঙ্গে একসাথে মেতেছে। এবারের দানে মেজদাদা বুজকা চোর। সবাই যে যার মতো লুকিয়ে পড়েছে। তেঁতুল তলাটা অন্ধকার তাই ভাইবোনেরা ওদিকটা যেতে চায় না। কিন্তু বিতানের তো বড়ো চেনা জায়গা তাই সে তেঁতুল গাছের মোটা গুঁড়িটার পেছনে চুপ করে লুকিয়ে আছে। হঠাৎ ঘাড়ের কাছে কার একটা নিঃশ্বাস পড়তেই চমকে ওঠে বিতান। দেখে সুমনও লুকিয়ে আছে ওখানে। দু’জনেই চুপ করে অপেক্ষা করে বুজকাদার জন্য। গাছের পাশ দিয়ে দেখে বুজকাদা আসছে। সুমন কানের কাছে ফিস্ফিস্ করে বিতানকে বলে আরও কাছে এসে সিটিয়ে দাঁড়াতে। বুজকাদা যেন কখনই না টের পায় ওরা এখানে লুকিয়ে। বিতান আর সুমন জড়োসড়ো হয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে গাছের গোড়ায়। সুমনের সদ্য কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি বিতানের ঘাড়ে ফুটছে। সুমনের গরম নিঃশ্বাস তার ঘাড়ে এসে লাগছে। দু’জনেই চুপ করে অপেক্ষা করছে চোরকে ধাপ্পা দেওয়ার জন্য। বুজকাদা এগিয়ে আসে। বিতান তৈরি হয় ছুটে গিয়ে ধাপ্পা দেওয়ার জন্য। সে গুড়ির পেছন থেকে বেরোতে যাবে আর তখনই সুমন ওর হাতটা চেপে ধরে। বিতান অবাক হয়ে যায়। আর থেকেও বেশি চমকে ওঠে সুমন তাকে অন্ধকারে গাছের গোড়ায় চেপে ধরে কানের মধ্যে ফিস্ফিস্ করে বলে— “না তুই যাবি না, আমাকে ছেড়ে।” মুহূর্তের মধ্যে সবকিছু যেন পাল্টে যায় বিতানের। সুমন তার ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরেছে বিতানের ঠোঁটটা । রক্তের মধ্যে যেন বিদ্যুৎ ছুটে যাচ্ছে তার। কোন অজান্তে সেও দু’হাতে চেপে ধরেছে সুমনকে। সুমনের ক্রমাগত নিঃশ্বাস এসে মিশছে বিতানের শ্বাসে। এ যেন পাহাড়ী ঝর্ণা এসে মিশছে আকুল নদীর স্রোতে। বুজকাদা চলে গেছে ওধার থেকে ধরতে পারেনি বিতান চোরকে, কিন্তু নিজের অজান্তেই সে ধরা পড়েছে সুমনের উন্মুক্ত আহ্বানে। কতক্ষণ এভাবে ছিলো ওরা কে জানে? বিতান অনুভব করে সুমন ধীরে ধীরে শক্ত হয়ে উঠছে। হঠাৎ ওপাশ থেকে কারা যেন ধাপ্পা বলে চেঁচিয়ে ওঠে। আর তখনই ঘোর ভাঙে দু’জনের। চলে যেতে গিয়ে সুমন শুধু বলে “কোনওদিন আমাকে ছেড়ে যাবি না তুই।” সুমন চলে যায়, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে বিতান তেঁতুল গাছের তলায়। অন্ধকারে বনের ওধারে থেকে নাম না জানা একটা পাখি ডেকে ওঠে। বিতান মনে মনে ভাবে এটা হয়তো কোনও দোয়েলের ডাক। হাজারো দোয়েল সেদিন ডেকে উঠেছিলো বিতানের মনে— ওখানের সেই অন্ধকারে, সবার অগোচরে।
বদলে গেছে সবকিছু। বিতানের রাজ্যে যেন সুমন তার রাজকুমার। সুমন যেন আষ্টে-পিষ্টে বেঁধে ফেলেছে বিতানের শরীর মনকে। নির্জন দুপুরে কিম্বা সন্ধ্যেবেলা সবার আড়ালে মিত্র জ্যেঠুর চিলেকোঠায় সুমন যখন বিতানকে উন্মুক্ত করে ভাসিয়ে নিয়ে যায় উন্মাদ ভালোবাসার স্রোতে, বিতান খুঁজে পায় তার পরিপূর্ণতা, দাঁড়কাকের খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে নীল একটা দোয়েল পাখি।
কলকাতায় চলে যাওয়ার আগে, তেঁতুলতলায় দাঁড়িয়ে বিতানের জলভরা চোখের দিকে তাকিয়ে সুমন বলেছিলো “কাঁদছিস কেন বল” এবারের পুজো আমি তোর সাথেই কাটাবো।
শুরু হয় অপেক্ষা… রাত দিন অপেক্ষা। আর তার সাথে মনের গভীরে স্বপ্নের জ্বাল বোনা। কলকাতা থেকে ফিরতেই গঙ্গাদাকে বিতান উজাড় করে মনের সবকথা বলেছে। গঙ্গাদা পাশের বাড়ির দিদার মতো পান চিবিয়ে মুচকি হেসে বলেছে— “সবে তো পূর্বরাগ। দেখ আবার মীরার মতো যোগিনী না বনে যাস।” সপ্তমীর দিন ভোরের ট্রেনে এসে পৌঁছে ছিলো সুমন। বাড়ির অমতে সে এসেছিলো একা। বলেছিলো— কলকাতার পুজো অনেক দেখেছে সে। এবার গ্রামের পুজো দেখতে চায়। কিন্তু বিতান জানতো সুমন কীসের টানে ছুটে এসেছে সপ্তমীর সেই সকালে। ে যেন এক না বলা নিবিড় সম্পর্ক, পরস্পরের প্রতি এক গভীর অধিকার বোধ। পুজোর দিনগুলো সবাই যখন প্যাণ্ডেলে ভীড় জমিয়েছে, দু’জনে তখন কখনও নদীপাড় বা ছাদের পাঁচিলে পাশাপাশি কাটিয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা । সুমনের বুকে মাথা রেখে মনে মনে তার স্বপ্নের ছবিতে রং দিয়েছে বিতান। কিন্তু পদ্মপাতার জলের মতো সুমন বড়ো ক্ষণস্থায়ী, পুজোর কটা দিন যেন ঘোরের মধ্যে দিয়ে কেটে যায়। ফিরে যাওয়ার সময় সুমন বলে, কলকাতায় গিয়ে তাকে নতুন কি যেন একটা চাকরীর ট্রেনিংয়ে ভর্তি হতে হবে। তাই এবার আর শীতে নয় সে আসবে সেই গরমের ছুটিতে। বিতান অত বোঝে না। সে শুধু প্রতীক্ষায় থাকে সুমনের ফেরার।
দিন কেটে যায় বিতানের প্রতীক্ষায় কোনও ভাটা পড়ে না। সবে জানুয়ারি মাস পড়েছে। এখন গ্রীষ্ম আসতে অনেক দেরি, হঠাৎ একদিন গঙ্গাদা বিতানকে এসে বলে, সে নাকি আসার সময় একটা জীপ গাড়িতে সুমনকে দেখেছে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে দেখে বাড়ির সামনের মাঠে একটা জীপ দাঁড়িয়ে। গঙ্গাদা ঠিকই বলেছে, তার সুমন সত্যি এসেছে তার কাছে। আবেগে ছুটে যায় বাড়ির ভিতর। ঢুকেই থমকে যায় বিতান। বাড়ির দাওয়ায় বসে চা খাচ্ছে সুমন, সঙ্গে বেশকিছু ছেলে-মেয়ে। হঠাৎ ঢুকেই বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যায় সে। বিতানকে দেখে সুমন এগিয়ে এসে বলে কিরে তুই এখানে? বিতান কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার স্বপ্নের সুমন তার সামনে দাঁড়িয়ে। কোনওরকমে বলে বিতান— ‘তুই এসেছিস শুনে তোর কাছে এলাম। ঠিক তখনই দাওয়াতে বসা একটি ছেলে বলে ওঠে— “এই নমুনাটা কেরে … সুমন?”’ সুমন তাড়াতাড়ি বলে তুই যা, আমি যাচ্ছি একটু পরে । বিতান বলে— “কখন আসবি? সুমন মৃদু বিরক্ত হয়ে বলে— তুই যা… না, আমি একটু পরেই যাচ্ছি।” বিতান চলে যায়। হঠাৎ করে মনের মধ্যে প্রদীপের শিখাটা কেউ যেন দপ করে নিভিয়ে দিয়েছে। বিকেল গড়িয়ে গেলো সুমন এখনও আসেনি। বিতানের যেন কিছু ভালো লাগছে না। ভীষণ যেতে ইচ্ছা করছে সুমনের কাছে। কিন্তু যেতে গিয়ে বারবারই পা-টা আটকে যাচ্ছে তার। কানের কাছে বেজে উঠছে বারবার— “কে রে নমুনাটা।” সন্ধ্যেবেলা বিতান ফের গিয়েছিলো মিত্র জ্যেঠুর বাড়ি। ওকে দূর থেকে আসতে দেখে সুমন তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলেছিলো “বন্ধুরা গ্রাম দেখতে এসেছে তাই ব্যস্ত ছিলাম। তোর সাথে কাল দেখা করবো।” কোনওরকমে কাটিয়ে দিয়েছিলো সুমন আর বিতানও ফিরে এসেছিলো। পরের দিন ছোটোবোন যখন বললো সুমনরা চলে যাচ্ছে কলকাতায়, নিজেকে আর সামলাতে পারেনি বিতান, এক ছুটে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো ওদের জীপের কাছে। সুমনের সেই বন্ধুটা ঠাট্টা করে বলেছিলো— “সুমন তোর সখী আবার এসেছে।” দলের মধ্যে একটি মেয়ে সুমনকে জিজ্ঞাসা করেছিলো— “Who is this species Somu? Highly suspicious.” সুমন জীপ থেকে নেমে খেঁকিয়ে সবার সামনে বলেছিলো— “কী চাই তোর, কেন Disturb করছিস বারবার। বললাম তো পরেরবার এসে যাব তোদের বাড়ি, এখন যা—” সুমনদের জীপ বেরিয়ে যায়। বুকের মধ্যে ধস নামছে বিতানের। আর তারই ধাক্কায় যেন গুঁড়িয়ে যাচ্ছে পাহাড়গুলো। গলার কাছে দলা পাকানো কান্নাটা ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। দিশাহারা হয়ে ছুটে এসে তেঁতুলতলায় বসে পড়ে বিতান। অঝোরে কেঁদে চলে সে। গাছের ডালে দাঁড়কাকটা কেন এত কর্কশ হয়ে ডাকছে?
জ্বরের ঘোরে মাথা তুলতে পারছে না বিতান। গঙ্গাদা জোর করে মুড়ি আর জিলিপি খাইয়েছে। আজ দু’দিন সে গঙ্গাদার কাছে আছে। যখনই চোখ বন্ধ করে তখনই সুমনের সেই কথাটা ধাক্কা মারে মাথার ভিতর— “কী চাই তোর?” সত্যিতো কিবা চাইতে পারে সে। নিজেকে উজাড় করে দিয়ে আজ সে নিঃস্ব। নামহীন-পরিচয়হীন এই সম্পর্ককে কেউ বুঝতে পারবে না কোনওদিন। তিনদিন পর মামার কাছে গেলে, মামা ঘাড় ধরে তাড়িয়ে দেয় বিতানকে। ফিরে আসে সে গঙ্গাদার কাছে। গঙ্গাদা বলে “এইভাবে বসে থাকলে কেউ তোকে খেতে দেবে না।” তাই বিতানকেও কিছু করতে হবে। কিন্তু কী করবে বিতান? সে যে তেমন কিছুই জানে না। ক্লাস নাইনে পড়া বিদ্যা নিয়ে সে কী বা করতে পারে। কিন্তু বিতানের আঁকার হাত ভালো তাই গঙ্গাদা তাকে শেখাতে শুরু করে মেহেন্দী পরানো। ছোটো থেকেই বাড়ির মেঝেতে কিম্বা মাটিতে বিতান আলপনা আঁকতে পারতো ভালোই। তাই অল্পদিনের মধ্যে সে তুলে নেয় মেহেন্দী পরানোর কৌশল। সময় বয়ে চলে তার আপন গতিতে। মামার বাড়ির সাথে কোনও সম্পর্ক নেই তার। সেও এখন গঙ্গাদার মতো গ্রামের লোকেদের কাছে টিটকিরির খোরাক। লোকেদের চোখে ব্রাত্য। প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন সে গা-সওয়া হয়ে গেছে বিতানের। মাথার চুল লম্বা হয়ে ঘাড়ে এসে ঠেকেছে। ভ্রুটাকে সযত্নে নিজের আয়ত্ত্বে এনেছে সে। গঙ্গাদা বলে— “নিজের যেটা ভালো মনে হয় সেটাই করবি, লোক তোকে খাওয়াও না পরায়ও না।” তাই ওদের কথা “Don’t care”। হ্যাঁ... সত্যি বিতান এখন অনেক শক্ত। হামাগুড়ি দিয়ে পড়ে যাওয়ার পরই তো মানুষ চলতে শেখে। কিন্তু যখন নির্জন দুপুরে বা ভোররাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়, হঠাৎ করেই বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে, চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই মুখ, কানে বেজে ওঠে সেই কথাটা “আমায় ছেড়ে কোথাও যাবি না তুই।” মনে মনে ভাবে সে তো ছাড়তে চায়নি তাকে। অন্তরের সব শক্তি দিয়ে ধরে রাখতে চেয়েছিলো তার জিওন কাঠিকে। কিন্তু কাঠি ভাঙে দু’টুকরো হয়ে গেছে তারই অজান্তে। গঙ্গাদার সাথে বিতানও যায় মেহেন্দী পরাতে। নতুন, নতুন ডিজাইনও শেখা হয় আর তার সাথে হাতে কিছু পয়সাও আসে।
চন্দননগরের একটা মাড়োয়ারীর বিয়েতে মেহেন্দী পরানোর ডাক এসেছে গঙ্গাদার। মাড়োয়ারীর বিয়ে পয়সা দেবে ভালো। ওখানে গিয়ে দু’দিন থেকে বাড়ির মেয়েদের মেহেন্দী পরাতে হবে। বিতানও গেছে গঙ্গাদার সাথে। পয়সাওয়ালা বাড়ির বিয়ে তাই সবেতেই এলাহি আয়োজন। রোজ রাতে বাড়ির ছাদে, বাড়ির ছেলেরা জমায়েত হয়। মাঝরাত অবধি চলে হৈ-হুল্লোর। ছোটে মদের ফোয়ারা। সেখানে মেয়েদের যাওয়া নিষেধ। সকালে মেহেন্দি পরানোর কাজ শেষ করে, রাতে ছেলেদের সাথে সময় কাটায় গঙ্গাদা। ঝুল পাঞ্জাবীর সাথে লম্বা দোপাট্টা উড়িয়ে হিন্দি গানের সাথে যখন কোমর নাচায় গঙ্গাদা, তখন সবাই যেন মাতোয়ারা হয়ে যায়। গঙ্গাদা হয়ে ওঠে মক্ষীরাণী। বিতান ভাবে মেয়েদের থেকেও তারা কোনও অংশে কম নয় পুরুষদের নজরে। মনের মধ্যে একটা তৃপ্তির স্বাদ জাগে। তাকেও হতে হবে গঙ্গাদার মতো। পুরুষ হবে তার শিকার। ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে হাতে মদের গ্লাস নিয়ে গঙ্গাদার নাচ দেখতে দেখতে একমনে ভাবছিলো বিতান কথাগুলো। আসর শেষে গঙ্গাদা এসে তাকে বলে, “সামনে বসা একজন লোক তার সাথে ভাব করতে চায়।” গঙ্গাদা নিজেই বিতানকে নিয়ে যায় লোকটার কাছে। লোকটা হেসে বলে “চলো মেরে সাথ।” নেশার ঘোরে মাথার ভেতরটা ঝিনঝিন করছে, কোনওকিছু না ভেবেই বিতান যায় লোকটার সাথে নিচের তলার একটা ফাঁকা ঘরে। ঘরে ঢুকেই বাল্বটা অফ করে দেয় লোকটা। অন্ধকার হয়ে যায় চারদিক। তার সাথেই বিতান প্রবেশ করে এক অন্য রাজ্যে।
রাতের অন্ধকারে বিতানের মধ্যে যে পুরুষ ঢুকেছে, তাকে সে চেনে না, কোনও সম্পর্কই নেই তার সাথে, তবুও বিতানের যেন ভালো লাগে। মনে হয় এখনও সে পরিপূর্ণ। ভোর রাতে ঘর থেকে বেরোবার সময় লোকটা বিতানকে তিনশো টাকা দেয় বলে পরে আবার ডেকে নেবো। টাকাটা নিতে গিয়ে বিতানের বুক কাঁপে। কী করছে সে? তবুও কাঁপা কাঁপা হাতটা বাড়িয়ে দেয় টাকাটার দিকে। গতরাতের ঘটনা গঙ্গাদাকে বলতে, বিতানের গালে টোকা মেরে, মুচকি হেসে গঙ্গাদা বলে “এই তো মেয়ে আমার, ধান্দা করতে শিখেছে।” বিতানের দিকে তাকিয়ে গঙ্গাদা বলে “শোনো আমরা হলাম কাটা ঘুড়ি। হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছি। যার সুতোয় লাট খাবো তার হয়েই উঠবো। তাই গোঁত খেয়ে মাটিতে পড়ার আগে উড়ে নে যতটা পারিস।” গঙ্গাদার কথাটা মনের মধ্যে গেঁথে গেছে বিতানের। সত্যি তো দোয়েল পাখি না হয়ে কাঁটা ঘুড়ি হলেই বা দোষ কী। এত বড়ো আকাশে ওড়াটাই আসল। বিতানের ডানা নেচে ওঠে দূর আকাশে ওড়ার জন্য।
আজ দু’বছর হলো বিতানের ঠিকানা বৌবাজারে মিনা, চূর্ণী, চাঁদনীদের সাথে। গঙ্গাদাই তাকে কলকাতায় এনেছিলো। আলাপ করিয়ে দিয়েছিলো চাঁদনীর সাথে। চাঁদনী আসল নাম চন্দন। কিন্তু সন্ধ্যাবেলা শাড়ি পরে যখন সে বেরোয়, তাকে সত্যি চাঁদের কণাই মনে হয়। আর বিতান? বিতান হালকা হেসে বলে— বিথি।
বিথি— সত্যি বিথি এখন নাম্বার ওয়ান ওদের গ্রুপে। হাই হিল আর লো-হীপ জিন্স পরে যখন রাস্তায় হাঁটে তখন অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে যায় কিছুদূর এগিয়ে। বিথি এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে। একটার পর একটা গাড়ি বদলায়। এগিয়ে যায় একটার পর একটা— কিন্তু মনের ভিতরে সেই রং-এর দোয়েলটা মাঝে মাঝে বলে ওঠে— রাস্তার মোড়ে গাড়ির কালো কাঁচ নামিয়ে হয়তো সেই চেনা মুখটা ঠিক দেখতে পাবে একদিন। ইশারায় ডেকে নিয়ে, শক্ত করে হাতটা ধরে আবার বলবে— “আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবি না তুই কোনওদিন।” কিন্তু বিথি জানে না “বিনি সুতোয় যে মালা গাঁথা যায় না।”
রুপান্তরিত নারী
অনন্যা রায় (নাম পরিবর্তিত)
সমাজ হাসছে, বন্ধু হাসছে,
হাসছে কত ছেলে.
তারা আমায় দেখবে বলে,
কাপড় টেনে ফেলে.
কেন আমার হাঁটা ব্যাঁকা,
কেন আমি মেয়েলী?
সৃষ্টি করলেন ভগবান,
আর তোরা, দিচ্ছিস শাস্তি।
আমি জিততে জানি,
জানি যুদ্ধ করতে।
আমি শিখণ্ডী, আমি মোহিনী
আমি হলাম সেই অর্ধনারীর রুপ।
বিষ্ণুর মতো পুরুষ দেহে,
অথচ মোহিনীর মতো সাজ।
ঈশ্বর আমায় সৃষ্টি করে বললেন,
নিজের মতো করে বাঁচ।
দেখতে দেখতে চলে যায়,
জীবনে কত যে চলার পথ।
অথচ সব দিনগুলি মনে পড়ে, যেই দিনগুলি বলে এবার নিজের মতো বাঁচ।
তাই তো বলি সমাজের প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষ,
হয়ে ওঠে লড়াইয়ের পথ।
বলে আমরা পৃথিবী চিনবৈ চিনবো,
বিশ্ব মোরা করবো জয়।
কবিতা: শিখন্ডী
নবারুণ সুমন
আমায় তোমরা চিনবেনা,
কবির কলমে কিংবা লেখকের লেখায় -
আমার তেমন ছুটোছুটি নেই,
আমায় তোমরা চিনবেনা।
কোনও এক মহাপুরুষ
তার কাব্যের মোড় ঘুরিয়ে ধরতে আমায় নামিয়ে এনেছিলেন পৌরুষের দাম্ভিক যুদ্ধের মাঝে,
কুরুক্ষেত্রের মাঝবরাবর
আমি একা,
অদ্বিতীয়া হয়ে তোমাদের
কবিকে জিতিয়ে দিলেম
যুদ্ধে, কাব্যে!
অথচ সেই যুদ্ধের পর আমায়
তোমরা খুঁজতে আসোনি!
কবির কাব্যে আমি হারিয়ে গেছি,
কি অবলীলায় সে যুদ্ধে জয় এসেছে, সম্রাট ফিরে পেয়েছেন তার সম্মান…
আর আমি?
অথচ পিতামহের হার ব্যতীত
এ জয় কী করে পেতেন
বাসুদেব কৃষ্ণ?
কী করে ফিরতেন স্বমহিমায়
কুরু সাম্রাজ্যের রাজপুত্রেরা?
আমি সেই
যার উপস্থিতি সমগ্র পুরুষসিংহের গান্ডীবকেও
ভূলুন্ঠিত করে
আমি সেই যার ছদ্মবেশকে
আশ্রয় করে অজ্ঞাত বাস করতেও পিছপা হয়না
বীরশ্রেষ্ঠের পৌরুষের মহিমা!
আমি তবু অসমাপ্ত থেকে যাই
কবির নিষ্ঠুর কাব্যের পরিহাসে!
আজ একবিংশ শতাব্দীর
মাঝে দাঁড়িয়ে
আমি আর এক কুরুক্ষেত্রে অবতীর্ণ,
যোদ্ধা হয়ে মহাকাব্যের পুনর্নির্মাণে!
আমি আমার সমস্ত লজ্জাকে
ছুঁড়ে ফেলেছি
তোমাদের সভ্য কুন্ডের আহুতিতে!
সুনিপুণ পরিচর্যায় অবহেলার গন্ধ মেখে, আমি গড়তে থাকি
মহাকাব্যের এক নবীন গাঁথা!
পৌরুষের মিথ্যে পোষাক ফেলে
আমি আজ কুরুক্ষেত্রের চক্রবুহ্যে ঘর বেঁধেছি;
তোমাদের অলক্ষ্যেই আমি বেড়ে উঠেছি প্রকৃতির লাবণ্য মেখে,
চিনতে পারছো আমায়?
আমি সেই মহাকাব্যের লুপ্ত রাজেন্দ্রনন্দিনী,
যাকে অতীত থেকে বর্তমানেও
আড়ালের ভীড়ে আটকা পরতে হয়,
আমি সেই যার নারীত্বের চাহুনি
তোমার পৌরুষকে করে খর্ব,
আমি সেই যাকে বলতে নেই
“ইনকিলাব জিন্দাবাদ!”
যার কন্ঠে জেহাদী সুর এলে
গলা টিপে ধরে রাজশাসন!
আমি একে একে খুলে রাখলাম তোমাদের দেওয়া
— নাম
খুলে রাখলাম
— পোশাকের আগল
রাখলাম
— প্রদত্ত লজ্জা, সামাজিক ভয়ের নিয়মনীতি!
খুলে ফেললাম
— খোলসভরা পুরুষত্বের মিথ্যে আস্ফালন!
শেষ যুদ্ধ এখনো বাকি।
নগ্ন দেহের ভাঁজে
আমি তুলে ধরলাম আমার
আত্মপরিচয়,
সেজে উঠলাম অপরূপ দেবীত্বের সাজে।
এক হাতে ধরলাম মোহিনীর সুদর্শণ
অন্যহাতে অর্ধনারীর ত্রিশূল
গান্ডীব উঠলো তৃতীয়ায়
চতুর্থে থাক সভ্যতার নরমুন্ড!
এক লহমায় স্তব্ধ হলো
কুরুক্ষেত্রের হুংকার,
পাঞ্চজন্যে সুঘোষিত হলো
মহাভারতের “শিখন্ডী পর্ব”।।
বিভেদ
সুপ্রিয় দত্ত
কি যেন হারিয়েছি আমি
অনেককাল আগের কিছু হয়তো,
হয়তো সেটি আমার জন্য নয়
তাই সবাই বলে আমি নাকি অভিশপ্ত।।
পুরুষ খাঁচায় নারীর হৃদয়
এটাই নাকি আমার ভুল
আচ্ছা! তোমরাই বলো তো
জন্মের আগেই কত করেছে হত্যা, কন্যাভ্রূণ?
একই দেহে অর্ধ নারীর বাস
একই অঙ্গে রাধাকৃষ্ণ
তোমরাই বলেছো আলাদা করতে
এটি তোমার আমার নয় এটি ঈশ্বরের কর্ম।।
হাতে নয়, ভাবনা দিয়ে গড়েছেন তিনি
তোমায়, আমায়, আর এই ভুবনকে
কী করে করি আমরা একে অপরকে আলাদা?
যদিও বা হতে পারি এক হতে।।
পাষাণ খণ্ড! তারও আছে নাকি জীবন
পূজিত হয় সকলের হাতে।
জড়বস্তুকে নিয়েছো করে আপন
দূরে ঠেলে মোদের সমাজ থেকে।।
আঁধার কণা জীবন আমার
আলোর দিগন্ত নেই নয়নে।
চুপ সাগরেই ডুবতে হবে
কখনও পাবোনা ঠাঁই এই সমাজে?
ছোট্ট থেকেই শিখিয়েছে সবাই
এটা ছেলের কাজ, এটা মেয়ের কাজ।
জানি না কেন হৃদয় দিতো না সাথ বলতো হৃদয়
এটা মানুষের কাজ, এটা অমানুষের কাজ।।
সমাজ তুমি নাম দিয়েছো অনেক আমায়
জীবনের গতি সেই নামের সঙ্গে আজও।
পারলাম না করতে নিজেকে বিভেদ,
আমাতেই দূর্গা আমাতেই শিব
এভাবেই আমি বাঁচবো।।
Tracy Shivangee Sardars
When I sleep gloomy,
while looking for the warmth,
I hug my pillow in the dark room,
In my lonely bed,
Expecting a hand will slowly caress my forehead or may be a kiss on the forehead to make me awake or wishes me a peaceful sleep,
When I sleep gloomy.
The breeze from the window touches my eyes, hands and my body,
Feels like someone is watching over,
From the place where no one goes,
When I sleep gloomy.
A hand holding me tight not letting me loose even when I am at peace,
Voices around the wind tells a story of the war a woman fights alone,
if I can just let my unconscious mind hear them with pain in the eyes and smile on the lips,
when I sleep gloomy.
Tears roll down on my chick without letting me know it's emotions,
when I sleep gloomy
*যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে, প্রবাদটি সত্যি হয়ে উঠেছে এক রূপান্তরকামীর জীবনে*
ঋত্বিকা
*লেটস আপ | অসম কথা*
• নদীয়ার বাসিন্দা রিক মালাকার সমাজের কাছে পুরুষ হলেও ছোটোবেলা থেকেই তার ভেতরে লুকিয়ে ছিলো এক নারীসত্তা। তা প্রকাশ ঘটেনি তখনও। পাড়া-প্রতিবেশী আত্মীয় স্বজনের কটুক্তি শিকার হতে হয়েছিলো আর পাঁচজনের মতো তাকেও।
• কিন্তু সর্বদা তার সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো রিকের মা। বরাবরই তার নেশা ছিলো রান্নার দিকে। একজন রূপান্তরকামী হয়েও লড়াই সে থামায়নি নদীয়া থেকে চলে যায় বোম্বেতে। বোম্বেতে গিয়েই চাকরি পেয়ে যায় সেখানকার স্বনামধন্য রেস্তোরাঁতে।
• কঠিন যাত্রা শুরু তার সেখান থেকেই। সেখানেও তাকে তারই সহকর্মীদের কটুক্তি শিকার হতে হয়েছিলো। উঠতে-বসতে বৈষম্যমূলক মন্তব্য করতো তারা। কিন্তু থেমে থাকেনি সে। তার কাজের মধ্যে দিয়ে কটূক্তির জবাব দিয়েছিলো।
• আস্তে আস্তে সেই রেস্টুরেন্টের অত্যন্ত ভালো একজন রাঁধুনি হয়ে ওঠে সে। যারা তাকে কিছুদিন আগেই বৈষম্যমূলক মন্তব্য করতো তাদেরই প্রিয়জন হয়ে ওঠে।
• তার পরেই হঠাৎ করোনা পরিস্থিতির ফলে চাকরি চলে যায় তার। লকডাউনে আটকে পড়েন মুম্বাইতেই। পরবর্তী সময় অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্রান্সজেন্ডার বেঙ্গল সেক্রেটারি রঞ্জিতা সিংহয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে সে।
• তিনি পুরো ব্যাপারটি শুনে তাকে তাদের শেল্টার হোমে গরিমা গৃহে এক নির্দিষ্ট চাকরির বন্দোবস্ত করে দেন। সেই হোমের থাকা আবাসিকদের রান্না করার দায়িত্ব এখন ঋত্বিকার ওপরে। এত বাধা বিপত্তি পেরিয়ে তার নিজের সম্প্রদায়ের জন্য কিছু করতে পেরে অত্যন্ত খুশি ঋত্বিকা।
• আগামী দিনের লক্ষ্য বড়ো মাপের রাঁধুনি হওয়া। সমাজে রূপান্তরকামীরাও যে কোনও দিক থেকে পিছিয়ে নয় তারই প্রমাণ হয়ে উঠে এসেছে ঋত্বিকা। আর ৫ জন মানুষের মতো সেও একজন পেশাগত রাঁধুনি।
*অসম-কথার সমস্ত খবর মাত্র একটি ক্লিক দূরে। এখনই ডাউনলোড করুন লেটসআপ অ্যাপ*
*প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও মানুষের পাশে দাঁড়াতে রান্নার ব্যবসা শুরু দেবাঙ্গনার*
দেবাঙ্গনা
*লেটসআপ। অসম কথা*
• গতকাল ঈদ-উল-ফিতর এবং অক্ষয় তৃতীয়া উৎসবের আনন্দে মাতলেন রাজ্যবাসী। পাশাপাশি উৎসবের আঁচ পড়লো রূপান্তরকামীদের সেল্টার হোম গরিমা গৃহে।
• কোভিড পরিস্থিতির কারণে সমস্ত রকম প্রোটোকল মেনে, ছোট্ট করে নিজেদের মতো পালন করলেন দিনটি।
• তাছাড়া দিনটি আরেকটি কারণে তাদের কাছে বিশেষ হয়ে উঠলো। তাদের মধ্যেই একজন রূপান্তরকারী দেবাঙ্গনা।
• এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও মানুষের পাশে দাঁড়াতে ছোট্ট করে একটি রান্নার বিজনেস শুরু করলেন এই দিনে।
• বিশেষত তাকে উৎসাহ দিতে প্রথম দিনই তার কাছ থেকে রান্না করা খাবার কিনে রূপান্তরকারীরা পালন করে দিনটি।
• রান্না করা খাবার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া ব্যবসাটি, এখন বহু সাধারণ মানুষের পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
• কিন্তু একজন রূপান্তরকামী হিসেবে এই প্রথম উদ্যোগটি গ্রহণ করলো দেবাঙ্গনা। এবার দেখবার বিষয় সমাজ তাকে কীভাবে মেনে নেয়!
• এই কথা ভেবে দেবাঙ্গনার মতো রূপান্তরকামীরা পিছিয়ে নেই। এইভাবে ছোট্ট ছোট্ট পদক্ষেপ নিয়ে রূপান্তরকামী মানুষেরা এগিয়ে চলেছে তাদের লক্ষ্যে।
*অসম-কথার সমস্ত খবর মাত্র একটি ক্লিক দূরে। এখনই ডাউনলোড করুন লেটসআপ অ্যাপ*
*আইন পাস হলেও প্রতিনিয়ত সমাজের অবজ্ঞার শিকার ধ্রুবর মতো রূপান্তরকামীরা*
ধ্রুব
*লেটসআপ । অসম কথা*
• প্রতিনিয়ত প্রতারিত হতে হয় রূপান্তরকামীদের। আইন পাস হলেও সমাজ এখনো হয়তো পুরোপুরি মেনে নেয়নি তাদের! এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটলো কলকাতার নিউটাউনের বাসিন্দা বছর ১৪-র ধ্রুবর জীবনে।
• এত অল্প বয়সে অত্যাচারের শিকার হতে হয় তাকে। তাও খোদ নিজের পরিবারের কাছে। প্রতিনিয়ত তার বাবা তাকে মারধর করতো কারণ একটাই পুরুষ হলেও ধ্রুবর মধ্যে আস্তে আস্তে প্রকাশ পাচ্ছিলো তার নারীসত্তা। সেটা মেনে নিতে পারেনি তার পরিবার।
• এর ফলে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। মাত্র ১৪ বছরের কিশোর বুঝতে পারেনি কী করবে। থানা পুলিশ করেও কোনও লাভ হয়নি। হঠাৎই কোনওভাবে যোগাযোগ করে অ্যাসোসিয়েশন অফ ট্রান্সজেন্ডার বেঙ্গল সেক্রেটারি রঞ্জিতা সিংহের সঙ্গে।
• তৎক্ষণাৎ সেই পরিস্থিতি থেকে ধ্রুবকের রঞ্জিতা উদ্ধার করে ঠিকই। কিন্তু ১৮ বছর না হওয়ায় তারা তাদের কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া হোমে, তাকে রাখতে পারেননি।
• এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে কোথায় যাবে এই বাচ্চা ছেলেটি, তার কারণেই রঞ্জিতা তাদের নিজস্ব হোম আস্থানাতে আশ্রয় দিয়েছে ধ্রুবকে।
• কিন্তু তার কি এখন এখানে থাকার কথা? এই বিষয় নিয়ে রঞ্জিতা বলেন, ১৮ বছরের আগের ছেলে-মেয়েদের জন্য রাজ্য সরকারের হোমগুলি আছে। কিন্তু এই হোমগুলিতে রূপান্তরকামীদের যোগ্য সম্মান দেওয়া হয় না। এমনকি হোমগুলোতে অবহেলিত হয় শিশুরা।
• যার কারণেই হোমে যাওয়ার আগেই এই ছেলে মেয়েদের মধ্যে এক ভয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। সে বহুবার রাজ্য সরকারকে জানানো সত্ত্বেও রূপান্তরকামীদের জন্য কোনওরকম আলাদা হোম তৈরি করা হয়নি।
• যদিও ধ্রুবকে আপাতত নিজের কাছেই রেখেছেন তিনি। পরবর্তীকালে ধ্রুবর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে, ধ্রুবর মা তাকে স্বীকার করতে রাজি হলেও সমাজের চাপে পড়ে রাজি হননি তার বাবা।
• প্রতিবেশী সমাজ কী বলবে তার জন্যই নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে নিজের সন্তানকে।
*অসম-কথার সমস্ত খবর মাত্র একটি ক্লিক দূরে। এখনই ডাউনলোড করুন লেটসআপ অ্যাপ*
0 comments: