ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত
Posted in ধারাবাহিক৬
শেষ সিগারেটটার ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে শ্নাইডার জানালার তাকে বসে থাকে। জারকার গাড়ির চাকায় ধুলো উড়ে উড়ে মেঘের মত হয়ে যায়। আজ মেয়েটার সঙ্গে কথা বলবো। বলবোই। ভাবে শ্নাইডার। ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে যে প্রতি বুধবার ও ভাবে মেয়েটার সঙ্গে কথা বলবে। ভাবে। কিন্তু এখনও একটাও কথা বলা হয়ে ওঠেনি। আজ পাক্কা বলবো। ভাবে সে। জারকার মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। আর পাঁচটা সব্জিবিক্রেতা মহিলার মত নয় ও। ফিল্মে যেমনটি দেখা যায় আর কি! লাফিয়েঝাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে, কটকট করে কথা বলছে, সবসময় মাথা গরম। না, জারকা এমনটা নয়। ওর মধ্যে একটা ব্যাপার আছে। শান্ত, ধীরস্থির, নরম, যত্নশীল। এরকম একটা স্বভাব, নাহ... ওর স্বভাবের তল পাওয়া মুস্কিল। নরম আলতো ব্যবহার করে জারকা নিজের গাড়ির ঘোড়াটার সঙ্গে। এমনকি গাড়ির বোঝা ফলমূল, শাকসব্জি –খোবানি, টমেটো, শসা, কুল, নাশপাতি, লঙ্কা, ঐসবের সঙ্গেও সে অদ্ভুত মমত্ব দেখায়। বড়সাহেবের গাড়ির সামনে ছড়ানো যন্ত্রপাতি, তেলের ডিব্বা এসবের মধ্য দিয়ে পিছলে বেরিয়ে জারকার উজ্জ্বল রঙচঙে গাড়িটা ক্যান্টিনের রান্নাঘরের সামনের দরজায় এসে দাঁড়ালো, জারকা হাতের চাবুকটা রান্নাঘরের জানলার পাল্লায় শপশপ করে মারলো।
সাধারণত এই সময়টা চারিদিক চুপচাপ থাকে। একটা রাউন্ড শেষ হয়ে যায়। একটা উদগ্রীব গাম্ভীর্যপূর্ণ পরিবেশ থাকে চারিদিকে। সবকিছু গোছানো, ঠিকঠাক। নিস্তব্ধ, একটা পিন পড়লে শোনা যাবে এমন চুপচাপ থাকে। কিন্তু আজ কেমন যেন অগোছালো সবকিছু। দূরে কোথায় কে যেন দরজার পাল্লা জোরে বন্ধ করলো। কে যেন চেঁচিয়ে উঠলো হঠাৎ। একটা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। শ্নাইডার শেষ সিগারেটটা খেতে খেতে শুনতে পাচ্ছিলো। সে দেখতে পাচ্ছিল যে রাঁধুনি সার্জেন্টের সঙ্গে জারকার শাকসবজি নিয়ে দরদাম চলছে। সাধারণত জারকার সঙ্গে ম্যানেজার সব সময় দরদাম করে থাকে, যে প্রায়ই জারকার সঙ্গে খটামটি বাঁধায়, ফালতু ইয়ার্কি করবার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রাৎস্কি, মানে এই রাঁধুনি সার্জেন্ট একটু নার্ভাস, রোগাটে গড়ন, খুব ভালো রান্নাবান্না করে আর মেয়েদের দেখলে অভদ্র ব্যবহার করেনা একেবারেই। জারকা কী বিষয়ে যেন কথা বলছে এই রাঁধুনি সার্জেন্টের সঙ্গে। পয়সা গোনবার আঙুলের মুদ্রা দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে শ্নাইডার। রাঁধুনি সার্জেন্ট সমানে কাঁধ ঝাঁকাচ্ছে। অফিস বিল্ডিংএর দিকে আঙুল তুলে কী যেন দেখাচ্ছে। যাচ্চলে, যেখানে শ্নাইডার বসে আছে, সেদিকে দেখাচ্ছে। মেয়েটা ঘুরে দাঁড়িয়ে তার দিকেই দেখছে।
-‘শ্নাইডার! শ্নাইডার!’ কে যেন তার নাম ধরে ডাকছে। শ্নাইডার জানলার তাক থেকে লাফ দিয়ে উঠে পড়লো। কিছুক্ষণ চুপচাপ। আবার কে যেন ডেকে উঠলো ‘সার্জেন্ট শ্নাইডার! সার্জেন্ট শ্নাইডার!’ সে দেখতে পেলো জারকা তার ঘোড়ার গাড়িটা নিয়ে রান্নাঘরের দিক থেকে এদিকে আসছে। বড়সাহেবের ড্রাইভারের গাড়ি পরিষ্কার করবার কাজ প্রায় শেষ। ড্রাইভার এখন একটা জলকাদা ভর্তি গর্তের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। শ্নাইডার অফিসের দিকে ধীরে ধীরে যেতে যেতে কটা কথা ভাবতে লাগলো। এক নম্বর কথা হল যে আজ তাকে মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতেই হবে। দু নম্বর কথা হল যে বড়সাহেবের গাড়ি কখনো বুধবার পরিষ্কার করা হয়না। তিন নম্বর কথা হল যে সাধারণত জারকা বৃহস্পতিবার আসেনা।
সে রাউন্ড দিতে বেরনো দলটাকে দেখতে পেল। বড় হলঘর থেকে বেরিয়ে এলো ওরা। হলঘরটা এখন প্রায় ফাঁকা। সাদা কোটগুলো দেখতে পেলো সে। দুজন নার্স, স্টেশন সার্জেন্ট, প্যারামেডিকস- ওদের নীরব মিছিলটা এগিয়ে চলেছে। দলটার নেতৃত্বে অবশ্য বড়সাহেব নেই। আছেন ডঃ স্মিৎজ্, মেডিকাল সার্জেন্ট, যাকে বিশেষ কথা বলতে শোনা বা দেখা যায়না। স্মিৎজ্এর চেহারা বেঁটেখাটো, মোটা। সেরকম উল্লেখযোগ্য কোনও বৈশিষ্ট্য নেই চেহারায়। কিন্তু চোখদুটো খুব ঠাণ্ডা এবং ধূসর এবং কখনো কখনো একমুহূর্তের জন্য তিনি চোখের পাতা নিচে নামালে মনে হয় যে তিনি এখনি কোনও জরুরি কথা বলবেন। যদিও বেশির ভাগ সময় তিনি কিছুই বলেন না। অফিসের সামনে রাউন্ড শেষ হল। সে দেখতে পেলো যে ডঃ স্মিৎজ্ অফিসের দিকেই আসছেন। শ্নাইডার দরজাটা খুলে ধরলো।
অফিসের ভেতরে ঢুকে তারা দেখতে পেলো প্রধান সার্জেন্টের কানে ফোনের রিসিভার। তার চওড়া মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। সে সবে বলছিল, ‘না, স্যার, না স্যার!’ রিসিভারের মধ্য দিয়ে বড়সাহেবের গলা শোনা যাচ্ছিল। প্রধান সার্জেন্ট স্মিৎজ্ এবং শ্নাইডার, দুজনের দিকেই দেখলো। ডঃ স্মিৎজকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিল এবং শ্নাইডারের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসলো। ফোনে আবার বলে উঠলো সে ‘হ্যাঁ স্যার!’ বলে রিসিভার রেখে দিলো।
- ‘কী ব্যাপার?’ ডঃ স্মিৎজ প্রশ্ন করলেন... ‘আমরা নাকি চলে যাচ্ছি!’ স্মিৎজ সামনে রাখা খবরের কাগজটা সামনে খুলে ধরলেন, আবার সঙ্গে সঙ্গে ভাঁজ করে রাখলেন। তারপর তার পাশে বসে থাকা ড্রাফ্টসম্যান ফাইনহালসের পিঠের দিকে একবার দেখলেন। স্মিৎজ প্রধান সার্জেন্টের দিকে ঠাণ্ডা চোখে তাকালেন। তিনি দেখতে পেয়েছেন যে ফাইনহালস টেবিলে বসে এই জায়গাটার একটা খসড়া ম্যাপ আঁকছে, যেটার ওপরের দিকে লেখা আছে, ‘জোকারহেলি ঘাঁটি’।
‘হ্যাঁ’ বলে উঠলো প্রধান সার্জেন্ট, ‘অর্ডার এসে গেছে জায়গা বদলানোর।’ সে নির্বিকার থাকবার চেষ্টা করছে, কিন্তু তার চোখে একটা বিশ্রী উত্তেজনা যখন সে শ্নাইডারের দিকে তাকালো। তার হাত কাঁপছিল। যে ধূসর বাক্সগুলো সার দিয়ে দেওয়ালের সামনে রাখা আছে, সে একবার সেগুলোর দিকে তাকালো। ওগুলো ঢাকনা খুলে আলমারি অথবা ডেস্ক বানানো হবে। সে এখনও শ্নাইডারকে বসতে বলেনি।
-‘শীগগির আবার আপনার সঙ্গে দেখা হবে, ফাইনহালস! আমাকে একটা সিগারেট দিন।’ বলে ওঠে শ্নাইডার। ফাইনহালস উঠে দাঁড়িয়ে নীল বাক্স থেকে তাকে একটা সিগারেট দেয়। স্মিৎজও নেয় একটা। শ্নাইডার দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে থাকে।
সবাই চুপচাপ হয়ে যায়। ‘আমি জানি’ নৈশব্দ ভেঙ্গে আবার কথা বলে ওঠে শ্নাইডার। আমার পোস্টটা থাকছে। তবে নামটা বদলে যাবে। আগে ফ্রন্ট কমান্ডার ছিল। এখন অ্যাসিস্ট্যান্ট কমান্ডার।’
প্রধান সার্জেন্ট লাল হয়ে ওঠে। পাশের ঘরে টাইপরাইটারের খটখট শব্দ শোনা যায়। ফোন বাজতে থাকে। প্রধান সার্জেন্ট ফোন ধরে বলে, ‘হ্যাঁ স্যার! হ্যাঁ, আমি আপনার কাছে পাঠাচ্ছি সই করবার জন্য’। রিসিভার রেখে বলে ওঠে সে, ‘ফাইনহালস! একটু দেখবেন গিয়ে যে আজকের অর্ডারটা রেডি হল কিনা!’
স্মিৎজ এবং শ্নাইডার মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। স্মিৎজ টেবিল থেকে খবরের কাগজটা তুলে নিয়ে আবার মেলে ধরেন সামনে। ‘দেশদ্রোহীদের বিচার শুরু হয়েছে’- শিরোনামটা জোরে জোরে একবার পড়েই তিনি আবার সেটা ভাঁজ করে রেখে দেন।
ফাইনহালস পাশের ঘর থেকে কেরানিকে ডেকে নিয়ে এলো। কেরানি ছেলেটি ফ্যাকাসে চেহারা, সোনালি চুলের এক সার্জেন্ট। সিগারেট খেয়ে খেয়ে আঙুলগুলো হলদেটে হয়ে গেছে।
-‘ওটেন!’ শ্নাইডার প্রশ্ন করে কেরানিকে, ‘তুমি কি ক্যান্টিনটা খুলবে?’
- ‘একমিনিট!’ প্রধান সার্জেন্ট রাগতস্বরে বলে ওঠে, ‘আরও জরুরি কিছু কাজ আছে আমার এখন।’ সে অস্থিরভাবে টেবিলে আঙুল বাজায়। কেরানি ছেলেটি এক তাড়া কাগজ গোছাতে থাকে তার সামনে। কাগজগুলো সাজিয়ে কার্বন পেপারগুলো বের করে নিতে থাকে মাঝখান থেকে। দুটো করে টাইপ করা তিন সেট কাগজ আর তার চার সেট কার্বন কপি। নামের তালিকা সম্ভবত। শ্নাইডারের হঠাৎ মেয়েটার কথা মনে পড়ে। জারকা কি ম্যানেজারের কাছে গেলো টাকা আদায় করতে? বেরিয়ে যাবার রাস্তাটা যে জানালায় দাঁড়ালে দেখতে পাওয়া সম্ভব, শ্নাইডার সেই জানালায় গিয়ে দাঁড়ালো।
-‘মনে রেখো’ শ্নাইডার ওটেনকে বলে, ‘আমাদের এখানে সিগারেট দিয়ে যেও!’
-‘চুপ! একদম চুপ!’ প্রধান সার্জেন্ট চিৎকার করে ওঠে। ফাইনহালসের হাতে একতাড়া কাগজ দিয়ে সে বলে ‘বড়সাহেবের কাছে এগুলো যাবে। সই হবে।’ ফাইনহালস কাগজগুলো গুছিয়ে আটকে নেয়, নিয়ে তারপর বেরিয়ে যায়।
তারপর প্রধান সার্জেন্ট ডঃ স্মিৎজ এবং শ্নাইডারের দিকে ফিরে তাকায়। কিন্তু শ্নাইডার রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন বেলা দুপুর। রাস্তা প্রায় ফাঁকা। উল্টোদিকের একটা মাঠে প্রতি বুধবার হাট বসে। প্রখর সূর্যের আলোয় হাটের দোকানগুলো, কেমন ফাঁকা ফাঁকা একাকী, অপরিচ্ছন্ন দেখাচ্ছে এত বেলায়।
আচ্ছা, তাহলে আজ বুধবার। ভাবে সে। প্রধান সার্জেন্টের দিকে ফিরে তাকায়। সে হাতে সেদিনের অর্ডারের কপি নিয়ে বসে আছে। ফাইনহালসও ফেরত চলে এসেছে। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সে।
-‘এখানে থাকুন!’ বলে ওঠে প্রধান সার্জেন্ট। ‘ফাইনহালসের কাছে এই জায়গাটার নকশা আছে। এখন তো সবই...শ্নাইডার, আপনি তো জানেন... কমব্যাট ফোর্সে যেমন হয়। নিয়মমাফিক আর কী!’ সে বলে যায়, ‘খুব ভালো হয় যদি আরও কিছু লোকজন এবং বন্দুক আনানো সম্ভব হয় এর মধ্যে। অন্য স্টেশনগুলোকে জানানো হয়েছে।
-‘অস্ত্র?’ প্রশ্ন করে শ্নাইডার... ‘আবার কী নিয়ম?’
প্রধান সার্জেন্ট আবার লাল হয়ে ওঠে। ডঃ স্মিৎজ আবার ফাইনহালসের বাক্স থেকে একটা সিগারেট তুলে নেন। বলে ওঠেন... ‘আমি আহতদের তালিকাটা একবার দেখতে চাই। আমাদের এই এখান থেকে সরে যাওয়ার পুরো দায়িত্ব কি বড়সাহেবের উপর?’
-‘হ্যাঁ’- বলে ওঠে প্রধান সার্জেন্ট, ‘তালিকা তিনিই বানিয়েছেন।’
-‘আমি একবার দেখবো।’ বলে ওঠেন ডঃ স্মিৎজ।
আবার লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ে প্রধান সার্জেন্টের মুখে। সে ড্রয়ার থেকে কাগজগুলো বের করে স্মিৎজের হাতে তুলে দেয়। স্মিৎজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকেন। নিজের মনে মনে নামগুলো বিড়বিড় করতে থাকেন। সবাই চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বড় হলঘরটার দিক থেকে একটা কোলাহলের শব্দ আসতে থাকে। সবাই চমকে ওঠে যখন হঠাৎ ডঃ স্মিৎজ জোরে চিৎকার করে ওঠেন... ‘লেফটেন্যান্ট মোল আর ক্যাপ্টেন বাউয়ার! ধ্যাত্তেরি!’ তিনি তালিকাটা টেবিলের উপরে আছড়ে ফেলে প্রধান সার্জেন্টের দিকে চেয়ে বলে ওঠেন, ‘প্রত্যেকটা ডাক্তারির ছাত্র জানে যে জটিল ব্রেন অপারেশনের রুগিকে অপারেশনের এক দেড় ঘণ্টার মধ্যে টানাটানি করে রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়না।’ কাগজটা আবার টেবিল থেকে তুলে নিয়ে তিনি অস্থিরভাবে সেটার উপরে আঙুল দিয়ে টোকা মারতে থাকেন।
(চলবে)
0 comments: