0

প্রবন্ধ - অচিন্ত্য নন্দী

Posted in

 




















চলচ্চিত্রকার বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ষাটের দশকের কবি। ১৯৮০ সালের ১৯ জানুয়ারী তাঁর এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন সত্তর দশকের কবি ও চলচ্চিত্র সমালোচক অচিন্ত্য নন্দী। দুই দশকের এই দুই কবির কথপোকথনে বারবার ঘেন কবিতা ও চলচ্চিত্র মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ে । সেই সময়ের ভারতবর্ষের আর্থ সামাজিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে কেমন ছিলো ভারতীয় চলচ্চিত্রের অবস্থান? সে বিষয়টিও সুস্পষ্টভাবে ধরা আছে এই সাক্ষাৎকারে।

অচিন্ত্য নন্দী: আপনি একজন প্রতিষ্ঠিত কবি। আপনি চলচ্চিত্র মাধ্যমটিকে নিয়ে কাজ করছেন। খত্বিক
ঘটক যেমন বলেছিলেন যে,উনি যে কোনওভাবে মানুষের গরিষ্ঠাংশের কাছে পৌঁছাতে চান। তার মতে নিছক সিনেমা মাধ্যমটির প্রতি মমত্ববোধ কোনও কাজের কথা নয়। যদি কোনও মাধ্যমকে নিয়ে আরও বেশি মানুষের কাছে যাওয়া যেত, তাহলে তিনি সেই মাধ্যমকেই গ্রহণ করতেন। এ ব্যাপারে আপনি কী বলবেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : এটা একটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ। খত্বিক ঘটকের এই রকম মনে হয়েছিলো। এটা ওনার ব্যাপার। আমার ক্ষেত্রে বলতে পারি, কবিতার পর এই চলচ্চিত্র মাধ্যমটির প্রতিই আমার মমত্ববোধ জন্মেছে। এখন পর্যন্ত এই মাধ্যমটিই পারে অধিকাংশ মানুষের কাছে যেতে। এ ব্যাপারে এর চেয়ে কার্যকরী মাধ্যমের আবিষ্কার হলে তার ওপর আমার মমত্ববোধ দানা বাঁধবে কিনা সেটা পরের ব্যাপার। নাও বাঁধতে পারে।

অচিন্ত্য নন্দী: ‘দূরত্ব’ ও ‘নিম অন্নপূর্ণা’র আগে আপনি কয়েকটি ডকুমেন্টারি তুলেছেন। এই ছবিগুলি সম্বন্ধে কিছু বলবেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আমার তৈরি ডকুমেন্টারির মধ্যে ‘ক্ষিরোদ নট্ট’ ও ‘কন্টিনেন্ট অব লাভ’ করে খুব আনন্দ পেয়েছি। এছাড়া অন্যগুলোর সম্বন্ধে বলার কিছু নেই। আমার নিজেরই ভালো লাগে না।

অচিন্ত্য নন্দী: পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি করতে গিয়ে এই ডকুমেন্টারি তৈরির অভিজ্ঞতাকে কতখানি কাজে লাগাতে পেরেছেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ডকুমেন্টারি করতে গিয়ে অনেক সময়ই সবকিছু সঠিকভাবে ভেবে-চিন্তে সুটিং করতে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না; অনেক ক্ষেত্রে উচিতও নয়। তখন Spot decision নিতে হয় । এই ধরণের অভিজ্ঞতা পরবর্তী সময়ে বড়ো ছবির ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই কাজে লাগে।

অচিন্ত্য নন্দী: আমাদের দেশে ডকুমেন্টারি তৈরির সমস্যা সম্বন্ধে বলুন।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ডকুমেন্টারির জন্য পৃথক কোনও দর্শকসমাজ আমাদের দেশে নেই। সরকার অথবা কোনও বেসরকারী সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় এই ধরণের ছবিগুলি তোলা হয়। ফলতঃ অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলো হয় Propaganda ছবি | ‘Hours of furnace’-এর মতো ডকুমেন্টারি এদেশে হয় না। এই ধরণের বাধাবন্ধকতার মধ্যেও সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, শান্তি চৌধুরী, গৌতম ঘোষ, উৎপলেন্দু চক্রবত্তী-রা ডকুমেন্টারি করেছেন। ইদানিংকালে দেখা গৌতম ঘোষে’র ‘Hungry Autumn’ ও উৎপলেন্দু’র ‘মুক্তি চাই’ আমার ভালো লেগেছে। এই ধরণের ছবি ডকুমেন্টারির জগতে নতুন দিগন্ত।

অচিন্ত্য নন্দী: আপনি ‘দূরত্ব’ ছবিটির জন্য Film Forum-এর ‘দাদাসাহেব ফাল্‌কে’ পুরষ্কার পেয়েছেন। ‘দূরত্ব’ আঞ্চলিক ভাষায় শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। এই একটি ছবি করেই আপনি চলচ্চিত্র সমালোচকদের দৃষ্টি কেড়েছেন। সাধারণ দর্শকদের মধ্যে স্বভাবতঃই ছবিটি সম্বন্ধে আগ্রহের সঞ্চার হয়েছে। তবু ছবিটি রিলিজ চেন পাচ্ছে না কেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ‘দূরত্ব’র রিলিজ চেন না পাওয়াটা কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যাপার নয়। অনেক ছবির ক্ষেত্রে এই ধরণের সমস্যা দেখা দিয়েছে বা দিচ্ছে। যতদিন না প্যারালাল প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা যায় ততদিন পর্যন্ত এই প্রতিবন্ধকতা থেকেই যাবে । এ নিয়ে তো বিস্তর আলোচনা, লেখালেখি, পরিকল্পনা হয়েছে। কাজের কাজ কিছু হয়নি। আপনি অন্য প্রশ্ন করুন।

অচিন্ত্য নন্দী: ‘দূরত্বে’র পর আপনি ‘নিম অন্নপূর্ণা’ ছবিটি সম্পূর্ণ করেছেন। কমলকুমার মজুমদারে’র ‘নিম অন্নপূর্ণা’ গল্পটির যে মুড তা কি ছবিতে অক্ষুণ্ন রাখায় অনুপ্রাণিত ছিলেন, অথবা অন্যরকম কিছু ভেবেছিলেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : কমলকুমার তার গদ্যে ভাষার বাঁধুনি ও শব্দের কাজ দিয়ে একটা অদ্ভূত এফেক্ট সৃষ্টি করেন। এটা এমনই একটা ব্যাপার যে ফিল্ম অথবা অন্য কোনও ভাষায় এর অনুবাদ হয় না। তাছাড়া একটি বিশেষ লেখাকে চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করতে গিয়ে পরিচালকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি, বক্তব্য ও ব্যাখ্যা

এসেই যায়। ফলে মূল কাহিনীর বিস্তার অনেক সময় ঢাকা পড়ে যায়। নতুন চরিত্র, নতুন সংলাপ, কাহিনীর নতুন মোড় আসে। এসব হয়, কেননা দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন মাধ্যম। রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ সত্যজিৎ রায়ের হাতে ‘চারুলতা’ হয়ে যায়। তাছাড়া, কমলকুমার করতে গিয়ে আরও নতুন কিছু বিষয় এসেই পড়ে। মনে করুন, ‘নিম অন্নপূর্ণা’র যেখানে লতির হাতে পাখিটা কামড়ে দেয়, সেখানে কমলকুমার লিখছেন, ‘... এই বাড়িখানি যেন বা ‘শ্রীমধুসূদন’ বলে উঠেছিলো।’ ফিল্মে ঠিক এইভাবে বলা যায় না। অথচ কমলকুমারের কিছু অন্ধ ভক্ত, অন্ধের ভক্তি অনেক সময়ই ক্ষতিকর হয়ে ওঠে, ‘নিম অন্নপূর্ণা’ ছবিটি দেখে একটা ‘গেলো গেলো’ রব তুলেছেন।

অচিন্ত্য নন্দী: কী কী কারণে আপনার দ্বিতীয় ছবির জন্য কমলকুমার মজুমদারে’র ‘নিম অন্নপূর্ণা’ গল্পটিকে বেছে নিয়েছেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : কমলকুমারের কাহিনী দুর্ভিক্ষের সময়কার। আমরা যে সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি সেখানে হয়তো আক্ষরিক অর্থে দুর্ভিক্ষ নেই। কিন্তু একটা চাপা দুর্ভিক্ষ সমস্ত Third World জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ঔপনিবেশিক কাঠামোর অন্তর্গত এই সমস্ত দেশে গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে শহরকে সাজানো হয়েছে। কলকাতা, বম্বে অথবা ইস্তাম্বুলে সেই একই চিত্র। গ্রাম থেকে হাজার-হাজার মানুষ প্রতিদিন শহরে আসছে দু’মুঠো অন্নের সংস্থানের জন্য। হয়তো কলকারখানায় কাজ নিচ্ছে। কাজ চলে গেলে বস্তিতে আশ্রয় নিয়ে নিম্ন-মধ্যবিত্তের শেষ ‘Identity’-কে বজায় রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। এরা কারা? এরা তো প্রলেতারিয়েত নয়। এদের কি Peasant বা Worker বলতে পারেন? এরা একটা সম্পূর্ণ নতুন Class. এদেরকে অনেকদিন ধরে লক্ষ্য করেছি, ভেবেছি। কমলকুমারের ‘নিম অন্নপূর্ণা’য় এদেরকে নতুনভাবে খুঁজে পাওয়ার পর ছবি করার ব্যাপারটা প্রায় নিশ্চিত হয়ে যায়।

অচিন্ত্য নন্দী: ‘নিম অন্নপূর্ণা’ ছবিটি একই সঙ্গে আমাদের দুঃসময়ের ডকুমেন্টারি এবং আদ্যন্ত বিষাদময় একটি নিটোল কবিতা। এর মধ্যে চায়ের দোকানের ছেলেটির চটুল হাবভাব এবং হালকা গান গাওয়ার ব্যাপারটা ঢোকানোর পেছনে কী কারণ থাকতে পারে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আপনি যদি ‘Poetic’, বলতে যা বোঝায়, ছবিটিকে তাই বলতে চান, তাহলে আমার আপত্তি আছে। ছবিটি আদৌ তা নয়।

অচিন্ত্য নন্দী: আমি কবিতার কথা বলেছি। কবিতা শুধুমাত্র কাব্যিক মেজাজের অভিব্যক্তি নয়। কবিতা রাগ, হতাশা, অথবা বিষাদময়তার অভিব্যক্তিও হতে পারে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : ঐ চায়ের দোকানের ছেলেটি সম্পর্কে বলছি, শহরে মফঃস্বলে চায়ের দোকানগুলিতে এই ধরণের ছেলেদের কাজ করতে দেখা যায়। এদের মধ্যে প্রায়ই একটা Homo-Sexual relation থাকে। এরা একই সঙ্গে চাটুকার এবং অন্য সব কিছু৷ এদের আচার-আচরণে একটা উদ্বৃত্ত উচ্ছ্বাস সবসময় লক্ষ্য করা যায়, যাকে আপনি ‘চটুল হাবভাব’ বলতে চেয়েছেন। এদের দেখলে মনে হয় কোনও অতীত নেই, স্বপ্ন বা ভবিষ্যৎ তো দূরস্থান। ব্যাপারটার একটা বিশ্বাস্য চিত্ররূপ দিতে চেয়েছিলাম ছেলেটির মাধ্যমে। তবে আপনার মনে হতেই পারে যে এটা ছবিটির মূল সুরের সাথে খাপ খায়নি। সেক্ষেত্রে এটা ছবির একটা ক্রটি।

অচিন্ত্য নন্দী: আপনার ছবিতে বেশ কয়েকবার বৈদ্যুতিক ট্রেনের সশব্দ চলে যাওয়া দেখানো হয়েছে। কেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : কলকাতার বস্তিগুলোর বেশিরভাগই গড়ে উঠেছে হয় গঙ্গার ধারে অথবা রেল লাইনের পাশে। আমি দুটোকেই নিয়েছি।

অচিন্ত্য নন্দী: আপনার ছবিতে বারবার বৈদ্যুতিক ট্রেনের ব্যবহার দেখে মনে হয়েছে, যন্ত্র সভ্যতার এই প্রতিভু ভেঙেপড়া সমাজ কাঠামোর ওপর একটা ধাতব আঘাত হানছে। দীর্ঘ অনাহারে ব্রুজ’র ছোট্ট সংসারটি এমনিতেই নড়বড়ে। বৈদ্যুতিক ট্রেনের এই সশব্দ যাওয়া আসা তাকে যেন খান্‌ খান্‌ করে ভেঙে দেবে। এই যান্ত্রিক ব্যবস্থার কাছে মানবিকতার প্রশ্ন তোলা হাস্যকর। ট্রেনের এত ব্যবহার বারবার মস্তিষ্কে আঘাত করে। বেঁচে থাকা নিয়ে ভীষণ অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। আমাদের মন খারাপ হয়ে যায়।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত: ব্যাপারটা আপনাকে ঠিক ঠিক Communicate করেছে। ট্রেনের আলো, শব্দ এবং আনুষঙ্গিক অন্য সবকিছুর Treatment দিয়ে এই ধরনের একটা এফেক্ট যাতে দর্শকমনে গড়ে ওঠে তার চেষ্টা করেছি।

অচিন্ত্য নন্দী : ‘নিম অন্নপূর্ণা’র একটি দৃশ্যে দেখি, ব্রজ বাড়ি ফিরে স্ত্রী গ্রীতিলতাকে বলে একটা আত্মহত্যার ঘটনা। লোকটির আত্মহত্যার আগের মুহূর্তে ব্রজ তাকে দেখেছে। লোকটির মুখের দিকে তাকিয়ে সে চমকে গিয়েছে। তার মনে হয়েছে, লোকটি হুবহু তার মতো দেখতে। এই ব্যাপারটা আমার কাছে অস্পষ্ট থেকে গেছে।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : এর আগের কয়েকটি দৃশ্য মনে করুন। অন্য কোনও উপায় না দেখে ব্রজ চাকরির জন্য একটা ফ্যাক্টরির মালিকের প্রলোভনে সাড়া দেয়। সেই ফ্যাক্টরিতে ধর্মঘট চলছিলো। ফ্যাক্টরি থেকে বেরিয়ে এলে ধর্মঘটী শ্রমিকরা ব্রজকে নির্মমভাবে পেটায়। ঘরে ফেরার পথে রেল ব্রীজের ওপর থেকে ব্রজ লোকটিকে আত্মহত্যা করতে দেখে। মানুষের মনের মধ্যে দু’রকম Crisis কাজ করে। (১) Inner crisis, (২) Financial এবং বেঁচে থাকতে চেয়ে অন্যান্য Support না পাওয়ার জন্য Crisis. এখন Inner crisis-এর শিকার হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মধ্যবিত্তরা। ব্রজর ক্ষেত্রে Crisisটি ছিতীয়। ওর এই মানসিক অবস্থা একটা Supreme tension-এর রূপ নেয় ফ্যাক্টরিতে মার খাওয়ার পর। এই ধরনের tension-এ যে কোনও মানুষের আত্মহত্যা করার ইচ্ছে হতে পারে। ব্রজরও হয়েছিলো। তবে আত্মহত্যা করার মতো মানসিক জোর ব্রজর ছিলো না। সে রাস্তায় দেখা Suicide Case-টিতে নিজেকে Identify করে। তবে সচেতনভাবে একটা আত্মহত্যার ঘটনার সাথে নিজেকে একাত্ম করে দেখার শহুরে মানসিকতা ব্রজর নেই। সে যখন ঘটনাটা গ্রীতিলতাকে বলে তখন তার অবচেতন মন কাজ করে।

অচিন্ত্য নন্দী: ছবিটিতে যে কটি সংলাপ আছে তা প্রায় কবিতার পংক্তির মতো মোক্ষম। একজন কবি হিসেবে এ ব্যাপারে কোনও বিশেষ চিন্তা-ভাবনা কাজ করে থাকলে বলুন।

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : আমরা যে ধরণের কবিতা লিখি বা পড়ি তাতে অনেক সময় মনে হতে পারে যে কবিতার দুটো লাইনের মাঝখানে একটা লাইন থাকা উচিত ছিলো কিন্তু নেই৷ এই জায়গায় পাঠককে যেন তার মননশীলতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়। এই জায়গায় কবিতার সাথে আধুনিক চলচ্চিত্রের একটা মিল খুঁজে পাই। চলচ্চিত্রেও দৃশ্যগুলিকে এডিটিং-এর সাহায্যে কবিতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সংলাপের ক্ষেত্রেও তাই। অনেকগুলো কথা বলার আছে। ঠিক পরিবেশ যাচাই করে যদি দু’একটা সংলাপই শুধু থাকে, তাহলে অনেক কথাই বলা হয়ে যায়।

অচিন্ত্য নন্দী: আলোচ্য ছবিটিতে সংলাপের সংখ্যা এত কম যে, রবীন্দ্রনাথের একটি উক্তি মনে পড়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন “এই চলমান রূপের সৌন্দর্য বা মহিমা এমন করে পরিস্ফূট করা উচিত যা কোনও কাব্যের সাহায্য ব্যতিত আপনাকে সম্পূর্ণ সার্থক করতে পারে।” আপনি কি এই ধরণের চিন্তা পোষণ করেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : নিশ্চয়ই নয়। আমি রবীন্দ্রনাথের উক্তির সম্পূর্ণ বিরোধিতা করি। এখন After all ফিল্ম একটা Audio-Visual Media এখানে সংলাপের বিরাট ভূমিকা আছে। একটার পর একটা নৈসর্গিক এবং অন্যান্য দৃশ্য তুলে ফেললেই সেটা সিনেমা হয়ে যায় না। তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি ছবিতে কম সংলাপ ব্যবহারের পক্ষপাতী। সাদামাটা বাংলা ছবিতে সংলাপের অহেতুক ব্যবহার আমাকে পীড়া দেয়।

অচিন্ত্য নন্দী : ছবির প্রায় শেষ পর্যায়ের একটি দৃশ্যের নির্মমতা খত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’র (যেখানে ভাই মাতাল অবস্থায় বোনের ঘরে খদ্দের হয়ে এসেছে।) পর আর কোনও ভারতীয় ছবিতে দেখেছি বলে আমার মনে পড়ে না। অবক্ষয়ের এত চরম Exposure মানুষকে কভাবে Positive চিন্তার দিকে নিয়ে যেতে পারে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দেখুন, সব ছবিই যে দর্শককে প্রত্যক্ষভাবে Positive ভাবনার দিকে নিয়ে যাবে এমন নয়। পন্টিকার্ভো’র একটি ছবি ‘কুইমাদা’। ছবিটা একটা খুন দিয়ে শুরু আবার আরেকটা খুন দিয়ে শেষ। কিন্ত অসম্ভব Inspire করে। অনেক সময় ছবিতে Negative বক্তব্যকে সামনে রেখেও আড়ালে সময় ও পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে দর্শককে সচেতন করে তোলা হয়। ‘নিম অন্নপূর্ণা’র ক্ষেত্র আলাদা। ব্রজর দ্বারা বিপ্লব সম্ভব নয়। সেখানে Reality-কে নির্মমভাবে দেখানো ছাড়া কোনও গত্যন্তর নেই। দর্শক Reality-কে জেনে Conscious হোক। আপনি যে চরম Exposure-এর কথা বলেছেন, সে প্রসঙ্গে বলি, এক্ষেত্রে এভাবে না দেখালে দর্শককে অবস্থার গুরুত্ব বোঝানো যায় না । আমরা, দর্শকরা ছবি দেখে Moved হই, হল থেকে বেরিয়ে সিগারেট ধরাই, রাত্রিতে খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুম, সকালে উঠে ট্রাম, বাস বা ট্রেনের পেছনে বা গাড়িতে হেলান দিয়ে বসে যেতে যেতে ভুলে যাই সব। ‘নিম অন্নপূর্ণা’ ঠিক এভাবে দেখার ছবি নয়। অনেক দর্শক আমাকে জানিয়েছেন যে, তাঁরা ছবিটি দেখে বাড়ি ফিরে ভাত মুখে তুলতে পারেননি। আমার মনে হয়েছে এখানেই ছবিটা Successful৷ আমি জানি এ ছবি দেখতে দেখতে কোনও কোনও দর্শকের খুব খারাপ লাগবে। সে হল থেকে ছুটে বেরিয়ে আসতে চাইবে। একই সঙ্গে ছবিটা তাঁকে টেনে ধরেও রাখবে। হলের বাইরে যে-জগৎ সেটাও তো অনেকটাই ‘নিম অন্নপূর্ণা’র জগৎ।

অচিন্ত্য নন্দী : বাংলা ছবির অধিকাংশ দর্শকই এখনও দর্শক হিসেবে অপরিণত। এদেরকে চলচ্চিত্র সম্বন্ধে শিক্ষিত করে তোলায় একজন চলচ্চিত্রকারের দায়িত্ব কতখানি?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দর্শকদের অপরিণত মনে করাটা খুব অযৌক্তিক। ভালো ছবি তাঁরা সারা বছরে কটা দেখতে পারেন? অধিকাংশ সিনেমা হাউসগুলোতে দেখানো হয় ‘সমাধান’ অথবা ‘মূকদ্দার কি সিকন্দারে’র মতো ছবি। বাস্তবিক, এই ধরনের ছবি দেখেই দর্শককে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। আর এঁদেরকে ভালো ছবির দিকে আকৃষ্ট করার জন্য সংখ্যায় অনেক অনেক ভালো ছবির দরকার আছে। ভালো ছবি বলতে আমি বলছি না যে শুধুমাত্র Intellectual-দের উপযোগী ছবিই করতে হবে। শিল্পগুণ সম্পন্ন Commercial ছবি করা যেতে পারে। একটা ফিল্ম তৈরি করতে অনেক টাকার দরকার। দর্শককে আকৃষ্ট করার মতো গুণ থাকা যেমন প্রয়োজন, যাতে টাকা উঠে এসে তার বাড়তি, যিনি টাকা দেন তার মুখে মুচকি হাসি ফোটায়, আবার ছবিটি শিল্পগুণ সম্পন্ন হওয়াও আবশ্যিক।

অচিন্ত্য নন্দী: দর্শন তৈরির দায়িত্ব কাদের ওপর বর্তায়?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : প্রধানত দর্শক, চলচ্চিত্রকার, চলচ্চিত্র সমালোচক এবং ফিল্ম সোসাইটি আন্দোলনের ওপর এবং ক্ষমতায় থাকা সচেতন সরকারের ওপরও।

অচিন্ত্য নন্দী: ফিল্ম সোস্যাইটিগুলি কীভাবে এব্যাপারে সহায়তা করতে পারে?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : দক্ষিণ ভারতে দেখেছি অনেক ফিল্ম সোসাইটি তাদের বরাদ্দ ছবি নিজেরা না দেখে গ্রামে গিয়ে গ্রামের মানুষদের দেখায়। এভাবে দর্শক তৈরী করার ব্যাপারটি অভিনব হলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাবনা । তাছাড়া একজন ফিল্ম সোসাইটির সদস্যর দায়িত্ব হলো সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির মাধ্যমে আরও অনেক দর্শককে ভালো ছবির সন্বন্ধে সচেতন করে তোলা।

অচিন্ত্য নন্দী: আর সরকারের দায়িত্ব?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : এত টাকার লগ্নি যে-শিল্পে, সেখানে সরকারের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রগতিশীল সরকার চলচ্চিত্র মাধ্যমের সহায়তায় জনসাধারণের মধ্যে একটা সুস্থ সাংস্কৃতিক আবহাওয়া তৈরী করে যেতে পারেন। বাইরে থেকে চাপ সৃষ্টি করে যত সহজে একটা সরকারকে উচ্ছেদ করা যেতে পারে, ঠিক তত অনায়াসে মানুষের মন থেকে প্রগতিশীল ধ্যানধারণা মুছে দেওয়া যায় না। এই প্রসঙ্গে চিলির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় সাধারণ মানুষকে রাজনীতি সচেতন করতে চেয়ে লেনিন চলচ্চিত্র মাধ্যমটিকে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি আইজেনস্টাইন, দোভজেঙ্কো ও পুদোভকিন নামে তিনজন যুবককে এই কাজে নিযুক্ত করেছিলেন। এবং এই তিনজনকেই আজকের পৃথিবী চেনে। ভারতবর্ষের বেশ কয়েকটা প্রদেশে, যেমন মহারাষ্ট্র কি দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে সরকারের ভূমিকা খুব প্রশংসনীয়। এইসব রাজ্যে সরকার উদার হস্তে টাকা দিচ্ছেন ভালো ছবি করার জন্য। এইসব ছবির মধ্যে বেশ কয়েকটি ভালো পয়সা ফিরিয়ে দিচ্ছে সরকারকে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রেক্ষাগৃহ তৈরী হচ্ছে নতুন ভাবনার ছবির জন্য। দর্শক এগিয়ে আসছেন। এভাবেই হয়।

অচিন্ত্য নন্দী: সম্প্রতি কলকাতায় একটি ফিল্ম ক্লাবের (সিনে ক্লাব অব ক্যালকাটা) ব্যবস্থাপনায় দক্ষিণ ভারতের কিছু ছবি দেখার সুযোগ আমাদের হয়েছিলো। এর মধ্যে ছিলো, ‘সংস্কারা’ ‘ঘাটশ্রাদ্ধ’ ও ‘কোডিয়াট্টমে’র মতো ছবি। এদিকে যে সমস্ত বাংলা ছবি মুক্তি পাচ্ছে তার মধ্যে ভালো ছবি নেই বললেই চলে। বাংলা চলচ্চিত্রের গৌরবময় ধারাটি কি এখন দক্ষিণ ভারতীয় চলচ্চিত্রকাররা বহন করছেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : লক্ষ্য করুন, বাংলা চলচ্চিত্র যে ক'জন পরিচালককে নিয়ে গর্ব করতে পারে, যেমন সত্যজিৎ, ঋত্বিক অথবা মৃণাল, তারা কেউ কিন্তু কোনও চলচ্চিত্র আন্দোলনের ফলশ্রুতি নন। এঁরা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় ছবি করেছেন। চলচ্চিত্র আন্দোলন বলতে আমরা যা বুঝি, তা কোনওদিনও এদেশে দানা বাঁধেনি। বাংলা ছবির বর্তমান দীন অবস্থা তারই পরিণতি৷ পক্ষান্তরে দক্ষিণ ভারতের ফিল্ম সোস্যাইটিগুলি ভালো কাজ করছে। এবং ওখানকার সরকার ছবির মানোন্নয়নের জন্য সর্বতোভাবে সাহায্য করছে। এইটুকু বলা যায়। সেখানে যে-সব ছবি হচ্ছে তার সবই যে খুব উন্নতমানের, তা নয়। ভালো ছবির ভানসর্বস্ব অনেক বাজে ছবিও হচ্ছে। এখনই ওদের সম্বন্ধে কিছু মন্তব্য করার সময় এসেছে বলে আমি মনে করি না। তবে ওরা অনেক লোককে এ ব্যাপারে জড়িয়ে নিয়েছে। ওখানে সমবায় পদ্ধতিতে অথবা ফিল্ম সোস্যাইটির পৃষ্ঠপোষকতায় ভালো ছবি হয়েছে। ওদের আর একটা বড়ো সুবিধে হলো দক্ষিণ ভারতে সিনেমা হলের সংখ্যা আমাদের রাজ্যের থেকে অনেক অনেক বেশি। ছবির প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এটা একটা বাড়তি সুবিধে তো বটেই।

অচিন্ত্য নন্দী: বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কিছু বলবেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : বেশ কয়েকজন তরুণ পরিচালক কাজ করে যাচ্ছেন। এঁদের ছবি মুক্তি পেলে বর্তমান অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হতেই পারে।

অচিন্ত্য নন্দী: এঁদের কয়েকজনের নাম বলবেন? এবং এঁরা কি কি ছবি করেছেন অথবা করছেন?

বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত : সৈকত ভট্টাচার্যের ‘অবতার’ আমরা দেখেছি । এছাড়া গৌতম ঘোষ তেলেগু ভাষায় ‘মাভূমি’ নামে একটা ছবি শেষ করে একটা বাংলা ছবিতে হাত দেবার কথা ভাবছেন। উৎপলেন্দু চক্রবর্তী করছেন ‘ময়না তদন্ত’। নীতিশ মুখোপাধ্যায় ‘রবিবার’ নামে একটা ছবি করছেন। আর-আর-নাঃ, এই মুহূর্তে এঁদের নামই মনে আসছে।


বিদেশি পত্র-পত্রিকায় ‘নিম অন্নপূর্ণা’ :
The Times, London পত্রিকায় David Robinson:

‘... and Buddhadeb Das Gupta’s excellent Bitter Morsel is exceptional. Set in Calcutta it relates the fortunes of one of the multitude of families who come to the city in false hopes of a more prosperous life. Das Gupta’s characters are vivid and his message— the appalling moral degradation and corruption of poverty-is clear.’


Gardian পত্রিকায় Derek Malcom:
‘… one of the most remarkable films of recent times…’

উপরোক্ত সাক্ষাৎকারটি চলচ্চিত্র বিষয়ক পত্রিকা ‘প্রতিবিম্ব’ থেকে উদ্ধৃত।

0 comments: