0

ধারাবাহিক - অসিত কর্মকার

Posted in

 




















এক

আবার ভোট।

বাতাসে ফের মদ আর মাংস-ভাতের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার দিন আসছে। ভাতের সঙ্গে সোয়াদি মাংস। তার সঙ্গে সব চাওয়া-পাওয়া দাবি-দাওয়া ভুলে থাকার জন্য ওই নেশার ব্যবস্থা! বোশেখি সূর্যের গনগনে আঁচে মাংস-ভাতের গন্ধটা চাদ্দিকে আরও ছড়িয়ে পড়ে এক উৎসবের ঘোর লাগায় মানুষের মনে। কত কিসিমের রঙিন টুকরো কাগজ আর কাপড়ের কুহক ডাক! মাটির ঘরগুলোর দেয়াল আর পিঁরায় নানা দলের প্রতীক চিহ্ন আর প্রতিশ্রুতির বন্যা। এমনকী গাছগুলোও রেহাই পায় না। গায়ে সাতরঙের পোঁচ পড়ে। ডালপালায় লাঠি গোঁজা পতাকা ঝোলে। রঙের সাজে সেজে ওঠে গাঁ-গ্রাম। বাতাসের পরতে পরতে মিটিং-মিছিল আর স্লোগানের কথা ভেসে ভেসে দূরে মিলিয়ে যাওয়ার আগেই নতুন করে কথার জন্ম হয়। নতুন নতুন কথায় আরও সুখে শান্তিতে রাখার কত না প্রতিশ্রুতি। সব মিলিয়ে যেন বা গাঁয়ে গাঁয়ে উৎসবই লেগে যায়। প্রতিটা ভোট ভোটবাবুদের কাছে মা বাপ তুল্য। প্রণম্য। ভিখিরির থালার ভাতের দানার মতো মূল্যবান। থালা থেকে দানা ছিটকে মাটিতে পড়লে তুলে মুখে পুরে নেয় ক্ষুধার্ত মানুষ যেমন তেমনি প্রতিটা ভোট ভোটবাবুদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

ধান কাটা হয়ে গেলে গরীবগুরবো মানুষগুলো ধান কুড়োতে খোলা মাঠে দলে দলে নেমে পড়ে। ওদের সঙ্গে শস্য দানা খুটে খায় কত রকমের পাখি, মেঠো ইঁদুর। মেঠো সাপগুলোর মনেও ফুর্তি জাগে। মনের সুখে সাপ গিলে শরীরটা পোক্ত করে নেয়। তারপর শীতঘুমে যায়। সবমিলে মাঠ জুড়ে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার উৎসব লাগে। ধানের শিষ কুড়োনোর ধুম পড়ে। কে কত বেশি কুড়োতে পারে তার প্রতিযোগিতা লেগে যায়। ইঁদুরের গর্তে হাত ঢুকিয়ে মাটি সমেত ধান বার করে আনে। ইঁদুরের লোভে গর্তে সাপ ঢোকে। কপাল মন্দ হলে মাঠকেউটে বেরিয়ে এসে ফণা তোলে। তা বলে কি বাঁচার জন্য পেটের লড়াইয়ে ক্ষান্তি দেওয়া যায়! সাপ মারার ধুম পড়ে। গায়ে ঢিল ছোড়ে হা অন্ন মানুষগুলো। হাতের লাঠি চলে ফটাস ফটাস। বাড়ির পর বাড়ি মেরে রক্ত, মাস, রস ছিন্নভিন্ন করে। বিষাক্ত প্রাণী, চিহ্নটুকুও রাখা যাবে না। খড়বিচালি আর কুটো-কাঁটার জোগাড় করায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে সবাই। জ্বলে ওঠে দাউদাউ আগুন। তাতে মরা সাপ ছুঁড়ে দিয়ে উল্টেপাল্টে পুড়িয়ে ছাই করে দেওয়া হয়। বাতাসে তখন কটু গন্ধ। বুকে টানলে শরীরের ক্ষতি! নাকে-মুখে গামছা জড়িয়ে নেয় মানুষগুলো। মেয়েছেলেরা আঁচল দিয়ে মুখ ঢাকে। বড়োদের শাসনে ছোটোরা একটু দূরে দূরে থেকে মজা উপভোগ করে। আকাশের নীচে সে এক বহ্নি উৎসব যেন।

ভোটবাবুরা ওরকমটাই। ভোট কুড়োতে গাঁয়ে গাঁয়ে আসে। পাড়ার পর পাড়া চষে বেড়ায়। উঠোন আর দাওয়ায় তাদের পায়ের ধুলো পড়ায় গরীবগুরবো গৃহস্থরা ধন্য হয়। গর্ব করে বলাবলি চলে কটাদিন ধরে। ভোট লুটোলুটির সে এক লড়াইই লেগে যায়। যুদ্ধ যুদ্ধ পরব। দুলকিগাঁয়েও তার ছোঁয়া লেগেছে। দুই খাঁড়ির মাঝে সৃষ্টিছাড়া, একটেরে এক বেহদ্দ গাঁ, এই দুলকিগাঁ। যেন এই বাদার দেশের এক খিটকেল গিঁট। সে গিঁটে আটকে গাঁভর মানুষগুলোর খালি নেই নেই রব। রাস্তাঘাট নেই। বাজারহাট নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। স্বাস্থ্যকেন্দ্র নেই। চাষাবাদ নেই। কাজকর্ম নেই। কিছুই নেই। আছে শুধু নেইয়ের পাহাড়। আবার সবই আছে, তবে ভিনগাঁগুলোয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে।

দুলকিগাঁয়ে যাওয়া আসার একটাই পথ। দক্ষিণের খাড়ির ওপর দিয়ে নড়বড়ে এক বাঁশের সাঁকো। দুটো বাঁশ পাশাপাশি পাতা। তাতে গোটাকতক মাত্র বাঁধন। খাড়ির বুকে বাঁশ পুঁতে সাঁকোর তিনটে ঠেকনা। শরীরের ভারসাম্য রাখতে আড়াআড়ি করে বাঁধা দুটো বাঁশ। দুলকিগাঁয়ের মানুষজন আর তাদের মোট বয়ে বয়ে কতদিন আর গতর ধরে রাখতে পারে এই সাঁকো! ভাঙেচোরে, বাঁধন আলগা হয়ে বেছন্দ দশা হয়। দেখে বহু পুরনো এক পরিত্যক্ত নির্মান মনে হয়।

দুলকিগাঁয়ের প্রতিটা প্রাণীর বুকে জোয়ারভাটার সময়টি গাঁথা। যেন বা এ গাঁয়ের প্রতিটা শিশু ওই সময়জ্ঞানটুকু নিয়েই জন্মায়। আতান্তরে পড়লে অর্থাৎ সাঁকোটা অকেজো হলে মানুষগুলো জোয়ারে একরকম সাঁতরায়। ভাটায় কোমর সমান কাদা গাবিয়ে এপার ওপার হয়। অকর্মা সাঁকোটা তখন নিরব দর্শক, ভাঙা মাড়ি দেখিয়ে মজা লোটার হাসি হাসে। এসময় দুলকিগাঁয়ের কোনও ঘরের বউ পোয়াতি হলো কিংবা কেউ কঠিন অসুখে পড়লো তো ঘরের মানুষগুলোর টনক নড়ে। সাঁকোটা সারাই না করালেই নয়। পঞ্চায়েতে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়। হচ্ছে আর হবে করে করে সময়ই গড়ায় শুধু। শিশু জন্মাবার বা রুগির মৃত্যুঘণ্টা বেজে ওঠার ঠিক আগ দিয়ে সাঁকোটার যাহোক করে সারাই হয়। ফের দুলকিগাঁয়ের মানুষগুলো কিছুদিনের জন্য নিশ্চিন্তি থাকতে পারার আনন্দে উল্লসিত হয়। পোয়াতি বউ মা হয়ে শিশু কোলে সাঁকো পেরিয়ে ঘরে ফেরে। সেরে ওঠা রুগি সাঁকোটা পেরোতে পেরোতে আরও অনেকগুলো বছর পৃথিবীতে বেঁচে থাকার আশা করে। মরলে একবাঁশে বাঁধা হয়ে শেষবারের মতো সাঁকোটা পেরিয়ে গাঁয়ের শ্মশানে ফেরে।

দুলকিগাঁয়ের কুমারী মাটি। পৃথিবীর বয়সের তুলনায় এ মাটির যেন এখনও জন্মই হয়নি। নদীর জলস্তর ছাপিয়ে সবে মাথা তুলে সূর্যের মুখ দেখার চেষ্টা করছে মাত্র। মাটির কনাগুলো এখনও অটুট বন্ধনে বাঁধা পড়েনি। তটভূমি জোয়ারের জলে ভেসে যেতে পুরো দুলকিগাঁটা কেমন জোলো নরমসরম হয়ে পড়ে। স্যাঁতস্যাঁতে মাটিতে মানুষগুলোর অস্বাস্থ্যকর বেঁচে থাকা। বছরভর টালমাটাল জীবন। বন্যায় ভাসে। খরায় ধোঁকে। ফি বছরের বর্ষায় নোনাজলের বিষাক্ত ছোবলে ছোবলে চাষের জমিজোত সব বন্ধা। ভিনগাঁয়ের বাবুঘরের লোকজন, এমনকী দু’বেলা পেটে গামছা বেঁধে বেঁচে থাকা কোটরগত চোখ, কঙ্কালসার মানুষগুলো পর্যন্ত দুলকিগাঁয়ের কথা উঠলে দেঁতো হেসে বিদ্রুপ করে। বলে, ছোটোলোকদের ভাগাড়!

বড়ো নদীর দুই খাড়ি দিয়ে জাপ্টে ধরা মাঝের এই ভূমিখন্ড, দুলকিগাঁ। পূর্ব পুরুষদের হাতে তৈরি বন কেটে বসতভূমি আর জমিজোত খুইয়ে বৃহত্তর সমাজজীবন থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষগুলো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে শেষ ঠাঁই হিসেবে এমনই অনেক ভাগাড় ভূমি আঁকড়ে ধরে। এরপর যেন মানুষের জন্য মাটি আর নেই। আছে নদী আর নদী। নদীর জালিকাবিন্যাস। সে বিন্যাসের মধ্যে মধ্যে জেগে ওঠা অরণ্যময় অসংখ্য দ্বীপভূমি। তাতে সুন্দরী, হরা, বাইন, ধুঁধুল, গরান ইত্যাদি আরও কতরকমেরই গাছ, গুল্ম, লতাগাছ, কাঁটাঝোপের সহাবস্থান। হিংস্র বাঘ, হরিণ, শূকর, বানর, নানান রকমের পাখির বসবাস। জলে দেদার রকমের মাছের সঙ্গে ভয়ঙ্কর কুমীর, কামট, শুশুকের বাস। দ্বীপভূমি ঘিরে জায়গায় জায়গায় খাড়ি আর সোঁতা। জোয়ার লাগলে খাড়ি আর সোঁতা উপচে নোনাজল ঢুকে পড়ে অরণ্যের মধ্যে। গাছগাছালি নোনাজলে স্নান সারে। মাটি আর যত গাছেদের বিস্তৃত শিকড়জালিকা ধুইয়ে দেয় নোনাজল। নিবিড় ঘন বনভূমির ভিতরমহলে সূর্যের আলো সকাল-বিকেলটুকুতে খানিকটা ছাড়া ঢোকেই না বলতে গেলে। সেখানে দিনমানেও গা-ছমছম ভয়ের আঁধার। এমনই ঠাঁসবুনোট পাতার বিস্তার। সারাটা দিন ধরে সূর্যের রেণু পান করে পাতাগুলো। তার সঙ্গে নোনামাটি থেকে সংগৃহীত রস মিলে গাছেদের বাঁচার রসদ তৈরি হয়।

দুলকিগাঁ একটু একটু করে প্রান্তিক মানুষের বসবাসে ভরে ওঠে। ঘুপসি ঘুপসি ঘরদোর, ডোবাপুকুর, হাঁসমুরগি, শূকর আর দারিদ্র নিয়ে একেকটা পরিবার। শোষণ আর বঞ্চনার শোক, কষ্টযন্ত্রণা গান হয়ে মানুষগুলোর মুখে মুখে ফেরে,

বনজঙ্গল কাটিকুটি
ভেড়িয়ানে দিলি মাটি
এহ বনেক মাটিরে হলাক খাঁটি
রে বুনুয়া জাতি...
এই বন কাটলি
বাঘ হরিণ খেদালি
ঘর দুরা বাঁধলি
কিছুদিন বসবাস করলি
আধা মূলে লে লেঁলায় বাঙালি।

নোনা আলো-বাতাসে ভর করে এই ব্যথার বিলাপ ছড়িয়ে পড়ে। তাতে করে এই বাদার দেশ, আঠারো ভাটির দেশ, পুরাণকথিত পাণ্ডববর্জিত ম্লেচ্ছদের দেশ তথা রসাতলভূমি চিরদুখী হয়ে থাকে বছরভর।

এই সকালেই সূর্যটা তেতেছে খুব। নদীতে স্বর্ণভাটার ক্ষীণ জলরেখা। তার একটা শাখা দক্ষিণ খাড়ির দলদলে কাদার ফাঁকে সরু দড়ির মতো আটকে আছে যেন। খাড়ির কোল ধরে বাইন, হরা, ধুঁধুল গাছের সারি। তাদের জলসা ছায়া পড়েছে কাদামাটিতে। হাওয়া দিতে ছায়াগুলো নাচানাচি জুড়ে দেয়। খাড়িতে যেন জোয়ারের জলের মতোই তোলপাড় তোলে। সাঁকোর কাছ দিয়ে এক বুড়ো বটগাছ। হাতপাঁচেক লম্বা কাণ্ডের ওপর থেকে আকাশ বেড় দিয়ে ডালপালার ঘের। গোরা ঘিরে মাটির ভাঙ্গাচোরা চাতাল। তাতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ক’টা ছলন মানা পোড়া মাটির ঘোড়া। কিছু বুনো ফুল ছড়ানো, গলা সিঁদুরের ছাপছোপ। চাতালের একধারে দু’পা ঝুলিয়ে বসে বৃদ্ধ গয়ান সর্দার। পৈত্রিক পদবী হারানো শিকড় ছিন্ন মানুষ এক। সে কত কত যুগ আগের কথা, গয়ানের পূর্বপুরুষ এই বাদার দেশে বন কেটে বসত গড়ার কর্মযজ্ঞে লাগে। কাজের গুনে আর সর্দারি করার ক্ষমতাবলে দাদনদারের কাছ থেকে সর্দার পদবী পায়। সে বড়ো গর্বের কথা ছিলো। গয়ানের পূর্বপুরুষ পশ্চিমা দেশের সাঁওতভূমির মানুষ। গয়ানদের কাছে সেদেশ এখন শত শত মাইল দূরের স্বপ্নের দেশ। যেখানে কোনওদিনই আর ফেরা হবে না গয়ানদের। এই অখণ্ড ভারতবর্ষের মধ্যেও যে আরও কত দেশ! পূবেরদেশ, উত্তরের দেশ, দক্ষিণের দেশ, মধ্যদেশ! দেশময় এক দেশ! জাতিতে সাঁওতাল গয়ান। এদেশের আদি বাসিন্দা। দেশের সমস্ত সুযোগসুবিধা ভোগ করার প্রথম দাবিদার তারাই। এমনই আরও কতশত আদিম জনজাতি গয়ানদের দোসর। খালি গা, পরনে খাটো ধুতি। চওড়া কাঁধ, চৌকো মুখাবয়বে গালের হনুজাগা শক্ত চোয়াল। একসময়ের পাথরকুঁদা তাগড়াই শরীরের ঝিলিক এখনও খানিক মেলে। মানুষটার বয়সের নাকি গাছ-পাথর নেই। জিজ্ঞেস করলে গয়ান খানিক চুপ থেকে কী যেন ভাবে। একসময় প্রত্যয়ের সঙ্গে কয়েকটা ঝড়বন্যা, গাঁয়ে ওলাউঠোয় মড়ক লাগা, তেভাগার লড়াই, বাজ পড়ে গাঁয়ের এক তালগাছের মাথা ঝলসে যাওয়া, মাতলায় ভুল করে ইলিশের ঝাঁক ঢুকে পড়ার সুখের দিনের কথা ইত্যাদি ঘটনার বর্ণনায় মাতে। একসময় কথার খেই হারিয়ে ফেলে আঁশপড়া দু’চোখ তুলে প্রশ্নকর্তাকে অস্ফুটে বলে, “তমে ইবার বয়সটর হিসাবট কষি লাও।” প্রশ্নকর্তাকে সে-এক জটিল অংকের ধাঁধায় ফেলে দেয় গয়ান।

দুলকিগাঁয়ের গাঁবুড়ো, সকলার মান্যি গয়ান। তবে গয়ান বোঝে, সেই দিনকাল আর নেই। তার সিদ্ধান্তই এখন আর শেষ কথা হয় না সবসময়। সামাজিক সেই বন্ধন আর আনুগত্যই যে আজ হারিয়ে গেছে। গাঁয়ের মানুষগুলো কেমন পাল্টে গেছে। এই পাল্টে যাওয়া সময়টাকে ঠিক ধরতে পারে না গয়ান। সবকিছু কেমন অচেনা অচেনা লাগে। নিজের বৃত্তে নিজের মতো করে বেঁচে থাকার সুখে বুঁদ হয়ে থাকতে পছন্দ করছে মানুষগুলো আজকাল। একা গয়ানের কী আর ক্ষমতা আছে যে এসব শুধরোয়। একা একা নিজের মতো করে বাঁচার জীবন যে বোকার জীবন তা গাঁয়ের মানুষগুলোকে কে আর বোঝায় একা গয়ান ছাড়া। সেই গয়ানও একরকম হাল ছেড়ে দিয়েছে। গয়ানের মনে বড়ো দুঃখ, গাঁবুড়োর চরম সিদ্ধান্ত, বিটলাহাতে পর্যন্ত অবজ্ঞা ওদের! গয়ানের মনে তাই চিন্তার ছায়া, অস্থিরতা। এবার ভোটেও গাঁভর মানুষগুলোর তার কাছে একটাই দাবি, “ফির ভোটটো আসি গিলহ গ খুড়া, খাড়িটর উপর পাকা বিরিজট হামাদের ইবার চাই। অই লিতাবাবুদের কুথায় আর ভুলবক লাই। বিরিজট লাই ত ভোটও লাই। বিরিজট বানাই দাও, ভোট লাও। দিখো তমার মাথাট যিন আর না বিগড়ায় খুড়া!”

দক্ষিণ খাড়ির ওপর দিয়ে একটা পাকা ব্রিজ হলে দুলকিগাঁয়ের মানুষগুলোর বড়ো উপকার হয়। আর পাঁচটা গাঁয়ের টুকটাক উন্নতির খবর হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে দুলকিগাঁয়েও আসে। গাঁয়ের মানুষগুলোর মনে তখন ক্ষোভ হতাশা জন্মায়। জন্মায় দাবি আদায়ের স্পৃহা। বলে, “হামরা কি মানুষট লই! লাকি দুলকিগাঁটর মানুষগুলহা মরহে ভুতট হইয়ে গিছে!” মনে মনে ফুঁসতে থাকে, “ভোটট ত ফির আসবেক লাকি, তখন দিখা যাবেক ভোটট কী করহা আদায়ট করহ!”

ভোট আসে ভোট যায়, দুলকিগাঁয়ের দক্ষিণ খাড়ির ওপর পাকা ব্রিজ আর আদায় হয় না। অথচ ভোট আদায় ঠিকঠাক হয়ে যায়। ফি ভোটের আগ দিয়ে পঞ্চায়েত থেকে ক’টা পাকা বাঁশ মরা সাঁকোটার সঙ্গে শক্তপোক্ত করে জুড়ে দিয়ে যায়। ভোট বৈতরণী পার হওয়ার বন্দোবস্ত! পাকা ব্রিজের স্বপ্নপূরণ হওয়া ফের পাঁচ বছরের জন্য অধরা থেকে যায়। ব্রিজ হলো না। তারপরও ভোট আদায় হলো কী করে? সব জেনেবুঝেও গয়ান চুপ। দেদার খানাপিনার মচ্ছবের টাকা গয়ান তো ভোটবাবুদের কাছ থেকে নেয় না! সে যে গাঁবুড়ো, সকলার পুজ্যমান, মান্যি মানুষ, ওসব লোভের হাতছানি তাকেও বারবার দেখানো হয়েছে। কিন্তু গয়ান তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। বলেছে, “এ অধম্মটক হামি করতে পারবেক লাই। মারাংবুরু পাপট দিবেক গ!” তারপরও ফি ভোটের দিনের আগের রাতে গাঁয়ে মচ্ছব লাগে। তারজন্য জনে জনের পকেট থেকে বড়ো নোটের টাকা বার হয়। সে টাকা আসে কোত্থেকে। অথচ ওরা কিনা তারই মাথা বিগড়ে যাওয়ার খোটা দেয়! মনে মনে খুব একচোট কষ্টের হাসি হাসে গয়ান! তবে এবারের সুযোগটা গয়ান কোনওভাবেই নষ্ট করতে চায় না। পরের ভোট পর্যন্ত সে হয়তো বাঁচবেই না। তাই তার মনে বড়ো সাধ হয়, এ জীবনে অন্তত একটা ভালো কাজ করে যাওয়ার।

দুটো ফিঙে পাখি শিষ দিয়ে এপারের গাছ থেকে উড়ে ওপারের মাঠ খিইয়ে দূরে কোথায় মিলিয়ে গেলো। গয়ানের মন সম্বিতে ফেরে, কান পাতে সে, দূরে কোথাও মিছিলে ধ্বনি উঠছে। ভোট আদায়ের কসরৎ শুরু হলো তাহলে! ওই পাখি দুটো কি তাহলে তাকে সতর্ক করে দিয়ে গেলো যে, এখন থেকেই দাবি আদায়ের জন্য এককাট্টা হও গয়ান। লড়াইয়ের জন্য মনটাকে শক্ত কর!

প্রতিদিনের বাঁধা জীবনের বাইরে এই যে একটু অন্যরকম ছোঁয়া, অন্যরকম কিছু একটা করার চিন্তা এবং তারজন্য চেষ্টা করা, বেশ লাগে গয়ানের। তারজন্য মনটাকে তো তাকে শক্ত করতেই হবে। মাথাটাকে বারবার ঝাঁকুনি দিয়ে সে তার মনের সমস্ত রকম দুর্বলতাকে দূর করে দেওয়ার সঙ্কল্প নিতে থাকে। কিছুতেই ওই ভোটবাবুদের কাছে হেরে যাওয়া চলবে না এবার।

গাছের ছায়ায় হুটোপাটি খেলায় ব্যস্ত বাচ্চাগুলো গয়ানকে অমনটা করতে দেখে হিহি করে হেসে ওঠে।

একটা বাচ্চা বললো, “মাথাট তুমহার ইকদম গিইছে নাকি গ ঠাউদ্দা, অমন পাগলটর পানা করছহ যে বড়হ!”

উ! গয়ান চুপ থেকে ওদের দিকে জুলজুল চোখে তাকায়।

বাচ্চাগুলো হাসহাসি করে চিৎকার করে বলে, “দিখ দিখ, ঠাউদ্দাট বাঘট হয়য়ে গিইছে লয়!”

শুনে মজাই পায় গয়ান সর্দার। হাতের লাঠিটা উঁচিয়ে ওদের শাস্তি দেওয়ার ভান করলে ওরা আরও মজা লুটতে সামনে থেকে দৌড়ে দূরে চলে যেতে থাকে। ওদের মাঝখানে পড়ে ল্যাংড়া ঝগড়ুর টাল খেয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম। ঝগড়ুর কাঁধে সারা সপ্তাহের বাঁধা বিড়ির ব্যাগ। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। রোগাপাতলা ল্যাকপ্যাকে শরীর। ছোট্ট বয়সে পোলিওয় আক্রান্ত হয়ে ঝগড়ু তার ডান পায়ের ক্ষমতা হারায়। একটা পাকা বাঁশের টুকরোয় ডান পাটা জড়িয়ে নিয়ে বাঁ পায়ের উপর ভর করে ঝগড়ু ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে হাঁটাচলা করে। এই গরমে একটু হাঁটতেই সে হাঁপিয়ে উঠেছে। থেকে থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে খানিক দম নিয়ে নিয়ে চলে। বটগাছটার নীচে এসে তার চাতালে বড়ো করে জিরিয়ে নেবে বলে বসে সে। কাঁধের ব্যাগটা পাশে রেখে লাঠিটাকে চাতালে শুইয়ে দেয়। গামছাটা দিয়ে গায়ের ঘাম মুছে নিয়ে গোটা কয়েক বড়ো শ্বাস ছাড়ে। বুকের কাছে গামছাটা ঘুরিয়ে হাওয়া খাওয়ার চেষ্টা করে। গয়ানের উদ্দেশ্যে বললো, “তুমহি কখহন এলা গ খুড়া?”

“হল মিলা সময়। রাতটয় নিদ হয় না। সকালট হইলে ঘরটয় আর মনট বসহে না। তা তু কুথায় চললহি, মালট দিতেহ?” জিজ্ঞেস করে গয়ান।

“হাঁ। মালট দিয়া পয়সাট আনতে যাছহি। তা খুড়া ভোটট ত ফির আসি গিলহ, ইবার বিরিজট হবেক ত? ই সাঁকোট পার হইতে হামার দমট যায় গ খুড়া। বয়সট বাড়িছে লাই! গাঁঘরের মানুষগুলহাও আর কত্ত কষ্ট সইবেক গ?”

শরীর-মনে ঘা খাওয়া এক জখম মানুষ ঝগড়ু। একসময় বিয়ে সংসার হলেও এখন সে একা। বিয়ের এক বছরও যায়নি বউ বুধনি একদিন তার মুখের উপর বলে দিলো, তুমহাকে দিয়া কোনহ কাজট হবেক লাই। লাঠিট ছাড়া ছাতাটর কোনহ দাম লাই গ! তুমহার ঘরট হামি করবক লাই।”

বুধনির বাপ লখিন। মেয়ে বিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তার ছিলো না। ঝগড়ুর শারীরিক অসংগতিকে সম্বল করেছিলো লখিন। কিন্তু ঝগড়ুকে মনে ধরেনি বুধনির। একরকম জোর করেই লখিন ঝগড়ুর সঙ্গে বুধনির বিয়েটা দেয়। বুধনির উচাটন মন, উড়ুউড়ু ভাবসাব দেখে ঝগড়ুর মা সামি প্রমাদ গোনে। ঝগড়ুকে পরামর্শ দেয় সামি, “বউটর কোলট ভরায়ে লাতিট আন ইবার বাপহ, তাতেহ যদি এ মেয়েটর সমসারে মনট টিকহে!”

অনেক চেষ্টা আর সাধ্যি সাধনা করেও সংসারে বুধনির মন টেকাতে পারলো আর কোথায় ঝগড়ু। ঘরের টুয়ায় এসে বসা পাখি যেন টুয়া থেকেই ফুড়ুৎ করে উড়ে পালিয়ে গেলো! ঝগড়ু তার বুকভরা প্রেম ভালবাসা দিয়েও বুধনিকে সংসারে বেঁধে রাখতে পারলো না।

এক ভরা শীতের ভোরে কুয়শাকে আড়াল করে বুধনি গাঁ ছাড়ে। সুফল মান্ডির বড়ো ছেলে লটন মান্ডি, শহরে সে নাকি বড়ো কাজ করে, বুধনি তার হাত ধরে এই সাঁকো পেরিয়ে সেই যে দুলকিগাঁ ছাড়লো আর ফিরলো না। সে কত বছরের পুরনো কথা, ফিকে হয়ে এলেও মনে পড়লে বুকের ভেতর একটা কষ্ট চাগাড় দিয়ে ওঠে ঝগড়ুর। সে ঘটনায় দুলকিগাঁ তোলপাড়। পরের বউকে ফুসলিয়ে পালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো এত বড়ো অন্যায্য ঘটনা দুলকিগাঁয়ে এই প্রথম। এর একটা বিচারবিহিত চায় দুলকিগাঁয়ের মানুষ। শুধু ঝগড়ু তাপ-উত্তাপহীন। সে কাজকর্ম ভুলে ক’টা দিন ঘরের কোণে থুপ মেরে থাকে। ছেলের দুঃখে কাতর সামিও গাঁয়ের মানুষগুলোর সঙ্গে এই বটের ছায়ায় বিচার সভায় সামিল হলো। গয়ানের বাপ মঙ্গল সর্দার তখন গাঁয়ের মাথা। দোষী লটন আর বুধনি, দু’জনেই বিচারসভায় অনুপস্থিত। লটনের বাপ সুফলকে ডাকা করা হলো। বিচারে সাব্যস্ত হলো, সুফল লটন আর বুধনিকে ঘরে তুললে সুফলের পরিবারকে একঘরে করা হবে। পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক থাকবে না সুফলের পরিবারের। এক পুকুরে স্নান, ধোয়াধুয়ি বন্ধ। বন্ধ ধোপা-নাপিত। দোকানদার পয়সা পেলেও সুফলের পরিবারকে জিনিসপত্র বিক্রি করতে পারবে না। গাঁয়ের কোনও রাস্তা বা গলি সুফলের পরিবার ব্যবহার করতে পারবে না। সব মিলিয়ে সামাজিক বয়কটের দুর্বিসহ জীবন ভোগ করতে হবে সুফলের পরিবারকে। যাকে বলে বিটলাহা বা চরমশাস্তি। বিচারের সিদ্ধান্ত শুনে সুফল জোরের সঙ্গে মঙ্গল সর্দারকে সমর্থন জানিয়ে বললো, “উকে হামি আর মোর ছেলেট মানি লা গ খুড়া। উ ফিরলেহ মোর হাঁসুয়াট উয়ার কল্লাট লিবে। উয়ার মরনট আছছে কপালটয়।” এই শুনে বুধনির বাপ লখিন বললো, “তু ঠিকট বুলেছিস সুফল, হামিও বুধনির মুখট আর দিখবক লাই, গাঁয়ে হামার মানট আর রাখলক নাই মেইয়েট!” লখিনের কথায় ভিড়ের অনেকেই প্রকাশ্যে লখিনের প্রতি বিদ্রুপ উগরে দিয়ে খিকখিক হাসে। অধিকাংশের ওই হাসি মনেমনেই থাকে। ভাবে, “ফুঃ, লখিন একট মানহুষ তার আবার মানসম্মান! চালচুলহাটর ঠিক লাই, গায়ে মানসোট লাই, হাড় কখান গোনহা যায় যার তার মুখহে ইমন বড়হ কুথা! লিসা করহে হিথাহুথা পড়হে থাকে, কুক্কুরবিল্লিট পিছাপট করহে অর মুখহে! হি... হি... হি...!” লটন আর বুধনির শাস্তিটা আপাতত তোলা থাকলো। ওরা গাঁয়ে ফিরলে পরে ঘোষণা করা হবে। সে শাস্তি যে কী তা আর ভেঙে বলেনি মঙ্গল সর্দার। মঙ্গল সর্দার মারা গেলো। গাঁয়ের লোকগুলো ক’টাদিন ধরে খুব বলাবলি করলো, “গাঁওবুড়োট মরহে সগ্গট গিলহ, ইবার লটন আর বুধনি মরহলে উহাদের শাস্তিট বুড়হা উপরহই দিবেক গ!”

গাঁয়ের মানুষ ওদের ফিরে আসা না আসার ব্যাপারটা কবেই ভুলে গেছে। মন থেকে মুছে গেছে যত রোষ আর ক্ষোভ। সময়ের এ এক আশ্চর্য শোধন আর সাফসুতরো করে দেওয়ার ক্ষমতা। নানা ঘটনার হাত ধরে সময় বয়ে যায়। ঘটনার উপর চাপা পড়ে নতুন ঘটনা। আর ঘটনা যদি হয় জীবন-মরণ সম্পৃক্ত তাহলে অন্যের প্রেম-প্রণয়ের কাহিনি মনে খুব বেশিদিন জায়গা পায় না। শুধু গাঁ-গ্রামের প্রেমের কাহিনি হয়ে থাকে মাত্র। তাতে সময়ের সঙ্গে মেশে নানা কল্পনা, বিস্তৃত হয় কাহিনি, কাহিনিতে মেশে নানা বাঁক আর মোচড়। যাতে করে হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে কাহিনি। প্রেমে আছে কষ্ট-যন্ত্রণা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, বিরহ-যন্ত্রণা, আছে প্রণয়সুখ। ইত্যাদি সবই মিলে একটু একটু করে মনোগ্রাহী হয়ে ওঠে সে কাহিনি। কিন্তু এসব তো সুদূরপ্রসারী সমাজ জীবনের কথা। চলমান জীবনে ঘটে চলা প্রাকৃতিক বিপর্যয়, খরা, বন্যা, রুজি-রোজগারের বেহাল অবস্থা, রোগ-জারি ইত্যাদি ঘটনাগুলো গাঁয়ের মানুষগুলোকে যেন সবসময় কষাঘাতে টানটান করে রাখে। শুধু বেঁচে থাকাটুকু ছাড়া বাকি সবকিছুই যেন ওদের কাছে বিলাসিতা। শুধু হয়তো ভোলেনি এই সাঁকোটা। দু’পারকে জোড়ে বেঁধে ওদের ফেরার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে! দু’জনে এই সাঁকো দিয়ে হেঁটে দুলকিগাঁ ছেড়ে কোথায় যে চলে গেছে, সেখানে ঘর বেঁধেছে, সাঁকোটার যেন তা জানার প্রয়োজন নেই। আছে শুধু অপেক্ষা আর বিশ্বাস, ওরা একদিন ফিরবেই। গাঁ ছেড়ে যাওয়া এবং ফিরে আসা, এই দুইয়ে মিলে শুভ জীবন পরিক্রমা সম্পন্ন হওয়া দেখার জন্য একা দাঁড়িয়ে আছে সাঁকোটা।

“গিল ভোটহের আগে বিরিজট হইয়ে যেতহ লাই? তুই কী বলিস ঝগড়ু?” গয়ান সর্দার জিজ্ঞেস করে। ঝগড়ুর উত্তর শোনার জন্য তার কৌতূহলী দুটো চোখ।

“হাঁ, গিল বারে ত হতই খুড়া। কিন্তুক গাঁটোর মানুষগুলহা ফির মানসোভাত আর নিশায় ভুললহ। তিনট শোর কাটহা পড়লো, ভিনগাঁয়ের ভাটিখানাট থিকহে কলসিট ভরহে ভরহে নিশাট এল। হোপনা সোরেন খুড়ার হাতট ধইরেহ গাঁয়ে ভোটবাবুগুলানের টাকাট ঢুকলহ। ঘর ঘরট বিটহা দিয়া ভোটট লুটলহ। হামাকেহ দিতহে আইছিলো হোপনা খুড়া। হামি লিই লাই। বুললাম, টাকাট লিবক লাই, বিরিজট চাই। হোপনা খুড়া বুললহ, “টাইমট হলেহেই বিরিজট হবেক। তুকে টাকাট লিতে হবেক লাই খানাপিনাটতে ত আয়।” হামি বুললাম, বিরিজট হলহে খানাপিনহা খুব হবেক। রাতভরটক লাচাগানাটভি খুব হবেক। ই কথাট শুনহে হোপনা খুড়হা রাগঝালট করহে চলহে গিলহ। উয়ার মতলবট ভাল লয় খুড়া। উহ তালেবড় লিতাট হইয়েছে। তুমহি চখট বুঝলেহ উ এ গাঁয়ের মাথাট হবার চায়।”

“গাঁ মানলেহ হবেক! লয়ত উ লাফালাফিটই সার হবেক। ইখন শুন, কাজের কথাটয় আয়। ইবার বিরিজটর জন্যহ হামরা জোর লড়াইট দিব।” ঝগড়ুকে কাছে পেয়ে মনের সংকল্পের কথাটা বলে গয়ান, “আর ছাড়াছাড়িট লাই। ব্রিজট ইবার করাই ছাড়বক।”

“হাঁ খুড়া, শালোদের ইবার আর ছাড়হন লাই।”

“তু লিখাপড়হাট জানহিস, লয়?”

“হয় খুড়া, অই থিরি কিলাসট পাশ দিলাম।।”

“হামাদের দাবির কথহাগুলান তু লিখহে দিবহি।”

“কী কথাট লিখবহ গ খুড়া?”

“উ সব হামি তুকে বলহে দিবহ। ইখন যা, তুর কাজট সারি আয়। ফিরহে হামার ঘরেট আসিস। মিলা দরকারট আছহে।”

ঝগড়ু কোমরের গামছাটা দিয়ে পিঠের সঙ্গে বাঁশের টুকরোটাকে শক্ত করে বাঁধে। চাতাল থেকে নেমে একরকম গড়িয়ে গড়িয়ে সাঁকোর কাছে আসে। কোনওরকমে দাঁড়িয়ে হাতে ধরার বাঁশটাকে দু’হাত দিয়ে পাকড়ে সাঁকোর উপর ওঠে। পাশাপাশি পা ফেলে একটু একটু করে সাঁকোটা পার হতে থাকে। বাঁ পায়ের শক্ত ভর ছেড়ে ডান পায়ে ভর দিতে গেলে শরীরটা বেজায় কাৎ হয়। ফলে তখন হাতলটাই ভরসা। একরকম ঝুলতে ঝুলতেই এগোয় ঝগড়ু।

এই দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে গয়ান ভাবে, গতবার সে ভোটটা কাকে দিয়েছিলো! কোন চিহ্নে, জোড়া পাতা না টিউকলে? ঠিক মনে করতে পারে না গয়ান। তবে সে নিশ্চিত, দুটোই নির্দল ছিলো। যে দুটো দল ক্ষমতায় আসার জন্য খুব তেজীয়ান হয়ে ছিলো তাদের গয়ান ঘৃণাভরে অবজ্ঞা করেছে। তার একমাত্র কারণ ওরা ক্ষমতায় এসেও কোনও কথা রাখেনি। পাকা ব্রিজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বিদ্যালয় ইত্যাদি কিছুই হয়নি দুলকিগাঁয়ে। বারবার গাঁয়ের মানুষগুলো মাংস-ভাত আর নেশার কাছে হার মেনেছে। মাংস-ভাত খাওয়া মানুষগুলোর অনেকের কথায় অদ্ভূত যুক্তি, “ইতো ভাল খানাপিনা পাঁচট বছহরে ইকবারট আসহে। উকে ফিরাই দিতে লাই! খাবার জিনিসট আছহে লাই! মারাংবুরু অভিশাপট দিলহে আর খাবারট জুটবেক লাই!”

শুনে গয়ান মনে মনে শুধু কষ্টের হাসি হেসেছে। আপসোসও কম হয়নি তার, যাদের ভালোর জন্য সে এত চেষ্টা, এত লড়াই করছে তারাই কিনা একদিনের আনন্দফুর্তি করার লোভ সামলাতে পারে না! যারা মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয় তাদেরকেই কিনা ফের ভোট দেয়। তাদের জেতায়। আবার হুশ ফিরলে, গয়ানের উপর দোষ চাপায়!

0 comments: