Next
Previous
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in

পর্ব-২২

বণিকের মানদন্ড দেখ দিল রাজদণ্ডরূপে

(সময়ানুক্রমিক সংক্ষিপ্ত বিবরণী)-তৃতীয় অংশ

মারাঠা রাজ্যে তখন পাঁচ সর্দারের মধ্যে তীব্র অন্তর্কলহ। এই পাঁচ সর্দাররা যথাক্রমে পুনার পেশোয়া, নাগপুরের ভোঁসলে, গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া ,ইন্দোরের হোলকার এবং বরোদার গায়কোয়াড়। সর্দারদের অভ্যন্তরীণ কলহে দীর্ণ মারাঠা রাজ্যের অবস্থা তখন শোচনীয় বলা যেতে পারে। নানা ফড়নবীশ পেশোয়াকে কার্যত ক্ষমতাহীন করে রেখেছে তখন।১৭৯৫ সালে তৎকালীন পেশোয়া মাধবরাও নারায়ণ মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে মাত্র ২১ বছর বয়সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সমস্যায় সমগ্র মারাঠা রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নতুন পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাও নানা ফড়নবীশের হাত থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে জোট বাঁধার চেষ্টা করতে থাকে। এইসময় ১৮০০ সালে নানা ফড়নবীশ পুনাতে দেহত্যাগ করে এবং মারাঠা রাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছয়।দৌলত রাও সিন্ধিয়া তখন পেশোয়াকে সমর্থন করলেও হোলকারের সৈন্যসামন্ত মালওয়া অঞ্চলে ব্যাপক লুঠতরাজ চালাতে শুরু করে দিল।নিরুপায় পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাও অগত্যা ইংরেজদের শরণাপন্ন হলো। ওয়েলেসলি ইতিমধ্যে ভারতে এসে গেছে এবং ভারতীয় রাজ্যগুলির প্রতি ব্রিটিশদের মনোভাব অনেকটাই পাল্টে গেছে। হায়দ্রাবাদের নিজাম ইংরেজদের সঙ্গে অধীনতামূলক মিত্রতার শর্তাবলী মেনে নিয়েছে। সাবসিডিয়ারি অ্যালায়েন্স বা অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির মূল কথা হল যে— কোন দেশীয় রাজ্যের রাজা ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবেন । দেশীয় রাজাদের অভ্যন্তরীণ অধিকার ক্ষুন্ন না করে তাঁদের নিজেদের অধীনে রাখাই হল অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির মূল কথা । কোনো দেশীয় রাজা এই নীতি গ্রহণ করলে তাঁকে কতকগুলি শর্ত পালন করতে হত, যেমন—

১) অধীনতামূলক মিত্রতায় আবদ্ধ দেশীয় রাজাগুলিকে কোম্পানির বশ্যতা স্বীকার করতে হত ।

২) সংশ্লিষ্ট দেশীয় রাজ্যগুলিতে একদল ইংরেজ সৈন্য এবং একজন ইংরেজ রেসিডেন্ট রাখতে হত ।

৩) সৈন্যবাহিনীর ব্যয়নির্বাহের জন্য মিত্রতাবদ্ধ রাজ্যকে নগদ টাকা বা রাজ্যের একাংশ ছেড়ে দিতে হত।

৪) কোম্পানির বিনা অনুমতিতে অপর কোনো শক্তির সঙ্গে মিত্রতা বা যুদ্ধবিগ্রহ করা যেত না । অর্থাৎ মিত্র রাজ্যগুলির বৈদেশিক নীতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নির্ধারণ করত ।

৫) চুক্তিবদ্ধ রাজ্যে ইংরেজ ছাড়া অন্যান্য সমস্ত ইউরোপীয়কে তাড়িয়ে দিতে হত ।

৬) এই সব বশ্যতার বিনিময়ে কোম্পানি সেই রাজ্যকে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, বৈদেশিক আক্রমণ এবং অন্যান্য বিপদ থেকে রক্ষা করত ।

হায়দ্রাবাদ এবং মাইসোরের পর মারাঠাদের মুখোমুখি হবার সুযোগ পেয়ে গেল ব্রিটিশ। ১৮০২ সালে হোলকাররা যখন পেশোয়াকে পর্যুদস্ত করে এবং পুনাতে ব্যাপক লুন্ঠন শুরু করলো তখন পেশোয়া ভাসাই পালিয়ে গিয়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষর করে কার্যত ব্রিটিশদের অধীনতা স্বীকার করে নিল। সুরাত দিয়ে দেওয়া হল কোম্পানিকে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাওকে পুনার সিংহাসনে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করলো ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। কিন্তু মারাঠাদের স্বাধীনতা খর্ব করা গেল না। আসলে এখান থেকেই শুরু হলো দ্বিতীয় ব্রিটিশ-মারাঠা যুদ্ধের। মারাঠা রাজত্ব কুক্ষিগত করার জন্য হোলকার অন্য সর্দারদের সঙ্গে জোট বাঁধার চেষ্টা শুরু করে দিল। অন্যদিকে ওয়েলেসলি এবং লেক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়লো। প্রায় দু’বছর যুদ্ধের পর ১৮০৫ সালে মারাঠা রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলকে এবং মারাঠা অধিকৃত অন্যান্য অঞ্চলকেও নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসতে সক্ষম হলো ওয়েলেসলি। রাজপুত, জাঠ, রোহিল্লা এবং উত্তর মালওয়ার বুন্দেলারাও ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রনে এসে গেল। সিন্ধিয়ারাও দিল্লি, আগ্রা, গুজরাট এবং অন্যান্য মারাঠা অঞ্চলকে অধীনতামূলক মিত্রতার আওতায় নিয়ে আসতে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু এতসব কিছু করার পরেও মারাঠা শক্তিকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করা গেল না। বিদ্রোহের আগুন জ্বলতেই থাকলো সর্দারদের মধ্যে।

অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যয়ভার বহন করতে সক্ষম না হয়ে ব্রিটিশ সরকার ওয়েলেসলিকে ১৮০৫ সালে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। নতুন গভর্নর জেনারেল হয়ে আবার এলো কর্নওয়ালিশ। তাকে পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া হলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার জন্য। এই সুযোগে হোলকার এবং সিন্ধিয়ারা মালওয়া এবং রাজস্থানের গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক লুন্ঠন চালু করে দিল। এভাবেই চলতে থাকলো যতক্ষণ না ১৮১৩ সালে হেস্টিংস ভারতবর্ষে এল নতুন গভর্নর জেনারেল হয়ে। হেস্টিংস এসেই সর্বপ্রধানত্বের নীতি চালু করে। প্যারামাউন্টসি বা সর্বপ্রধানত্বের নীতি অনুযায়ী কোম্পানিই হচ্ছে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী এবং এই ক্ষমতাকে রক্ষা করার জন্য কোম্পানি যে কোনও রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং প্রয়োজনে সেই রাজ্যকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দিতে পারে। এইসময় পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাও আর একবার সর্দারদের সংগঠিত করে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের শেষ চেষ্টা করে। শুরু হয় তৃতীয় ব্রিটিশ মারাঠা যুদ্ধ (১৮১৭-১৯)। এই যুদ্ধে হোলকার এবং পিন্ডারিরা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ব্রিটিশরা পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাও এর অধীনস্থ সমস্ত অঞ্চল নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসে এবং পেশোয়া প্রথা চিরতরে বিলুপ্ত করে দেয়। ভোঁসলে এবং হোলকারদের নিয়ন্ত্রনে থাকা বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধীনতামূলক মিত্রতার আওতায় নিয়ে এসে মারাঠা রাজ্যজয় সম্পূর্ণ করে ব্রিটিশরা।

ইতিমধ্যে উত্তর ভারতেও বিভিন্ন অঞ্চল দখলের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। বক্সারের যুদ্ধ এবং এলাহাবাদ চুক্তির পরবর্তী পর্যায়ে অবধ একটি নিরপেক্ষ রাজ্য হিসাবে ব্রিটিশ অধ্যুষিত বাংলা এবং রাজনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত উত্তর ভারতের মধ্যে অবস্থান করছিল। মারাঠাদের হাত থেকে অবধকে রক্ষা করার অছিলায় ব্রিটিশেরা ১৭৭৩ সালে অবধের দরবারে নিজেদের প্রতিনিধি এবং পাকাপাকি ভাবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী নিয়োগ করে। এই প্রতিনিধি এবং সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার বহন করার দায়িত্ব নিতে হয় নবাব সুজাউদ্দৌল্লাকে। এই ব্যয়ের পরিমাণ ক্রমশ বাড়াতে থাকে ব্রিটিশেরা। ব্রিটিশদের এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য করবৃদ্ধি করতে বাধ্য হয় নবাব সুজাউদ্দৌল্লা। করবৃদ্ধির ফলস্বরূপ তালুকদারদের সঙ্গে সংঘাত বাঁধে নবাবের এবং অবধে সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই অস্থিরতার অজুহাতেই পরবর্তীকালে অবধ দখল করে নেয় ব্রিটিশ। ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭৪ সালে গভর্নর জেনারেল হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেয় যে খরচের সমপরিমাণ রাজস্ব ব্রিটিশরা নিজেরাই আদায় করে নেবে এবং তার জন্য অবধ রাজ্যের কিছু কিছু অঞ্চল তারা অধিগ্রহণ করবে। মাইসোরের যুদ্ধ এবং ফরাসিদের মোকাবিলায় বিপুল অর্থব্যয়ের কারণে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়ে ব্রিটিশদের। সেইসময় অবধের নবাব বেনারসের উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছিল। অবধের হাত থেকে বাঁচানোর নামে এই টাকা আদায়ের জন্য বেনারসের রাজা চৈত সিং এর উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে ব্রিটিশেরা। ব্রিটিশদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে অবশেষে ১৭৮১ সালে ব্রিটিশদের কাছে বেনারসকে গচ্ছিত রাখতে বাধ্য হয় চৈত সিং। ১৭৭৫ সালে নবাব সুজাউদ্দৌল্লার মৃত্যু হয়। সুজাউদ্দৌল্লার বিশাল সম্পদের অধিকারী হয় তার স্ত্রী বেগম উম্মত উজ জাহারা। হেস্টিংসের নির্দেশে ব্রিটিশদের কাছে প্রয়াত সুজাউদ্দৌল্লার ধার মেটানোর জন্য তার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ মাসোহারা আদায় করতে শুরু করে ব্রিটিশরা। অবধ অধিগ্রহণের পরিকল্পনা ব্রিটিশদের দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। ১৮০১ সালে ওয়েলেসলি এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করে যখন নবাব ওয়াজির আলি খান ব্রিটিশদের চাহিদা মেটোনোর অক্ষমতার কথা সর্বসমক্ষে জানায়। অবশ্য এই অধিগ্রহণের পিছনে অন্যান্য কারণও ছিল। এলাহাবাদ চুক্তির পর নবাব সুজাউদ্দৌল্লা বারবার কোম্পানির কাছে অভিযোগ জানিয়েছিল যে কোম্পানিকে দেওয়া করমুক্ত বাণিজ্যের অধিকারের ব্যাপক অপপ্রয়োগ ঘটাচ্ছে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা এবং তাদের ভারতীয় গোমস্তারা তাদের নিজেদের ব্যবসার জন্য। কোম্পানির অধিকর্তারা এব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেনি।এছাড়াও সমুদ্রপথে বাণিজ্যের জন্য তখন অবধ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। অষ্টাদশ শতাব্দির শেষদিকে লন্ডনে নীলের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই চাহিদার শতকরা ষাট ভাগ আসত অবধ থেকে। অবধের তুলো চিনা বাজারে বিক্রি করা হতো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভারসাম্য ব্রিটিশদের অনুকূলে রাখার জন্য। সুতরাং ১৭৮৮ সালে কর্নওয়ালিশের সঙ্গে অবাধ এবং মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া সত্ত্বেও রপ্তানির উপর নবাবের কর চাপানোর সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবেই অনভিপ্রেত এবং যথেষ্ঠ বিরক্তির কারণ ছিল। সুতরাং অধিগ্রহণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো যখন ওয়েলেসলি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায় সঙ্গে নিয়ে ভারতবর্ষে এসে পৌঁছলো।

অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে প্রথম হস্তক্ষেপ করার সুযোগ এল ১৭৯৭ সালে সুজাউদ্দিন এর উত্তরসূরী নবাব আসাফুদ্দৌল্লার দেহান্তের পর। ব্রিটিশরা তার ছেলের নবাবের আসনের দাবি না মেনে আসাফুদ্দৌল্লার ভাই সাদাত আলি খানকে সিংহাসনে বসাল। মূল্যবাবদ সাদাত আলি খান ব্রিটিশদের বেশকিছু অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের অধিকার এবং কয়েক কিস্তিতে বছরে ৭৬ লক্ষ টাকা ভর্তুকি দেবার প্রতিশ্রুতি দিল। নতুন নবাব বছর বছর টাকা দিতে রাজি হলেও তার শাসনব্যবস্থায় ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে তীব্র আপত্তি জানালো। ব্রিটিশদের আসল উদ্দেশ্য সাধিত হল না। ১৮০১ সালে ওয়েলেসলি নিজের ভাই হেনরিকে পাঠালো সাদাত আলি খানের সঙ্গে ভর্তুকির প্রসঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে। চুক্তির ফলস্বরূপ অর্ধেক অবধ ব্রিটিশদের হাতে চলে গেল। চুক্তি অনুযায়ী এটা ঠিক হলো যে ভর্তুকির টাকা ব্রিটিশরা সরাসরি রাজস্ব হিসাবে রোহিলখন্ড, গোরখপুর এবং দোয়াব থেকে আদায় করে নেবে। বাস্তবে এই তিনটি অঞ্চল থেকে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল প্রায় এক কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা যা ছিল নির্দ্ধারিত ভর্তুকির প্রায় দ্বিগুন। যদিও যুক্তি হিসাবে দেখানো হল যে সাদাত আলি খানের অপশাসন থেকে অবধকে বাঁচাবার জন্য ব্রিটিশরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আসলে এই পদক্ষেপ রাজস্ব এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক চাহিদা ছাড়া আর কিছু নয়। যদিও এই চুক্তি ভর্তুকি আদায় সংক্রান্ত সমস্যার সম্ভাবনা সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করেছিল তবুও ব্রিটিশদের জুলুমের কোনও অন্ত ছিল না। লক্ষ্ণৌ এর ব্রিটিশ রেসিডেন্সি ধীরে ধীরে অবধের ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে উঠতে থাকলো। অর্থ, সামরিক সহযোগিতা এবং নানারকম সুবিধার বিনিময়ে ব্রিটিশরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন দরবার, প্রশাসক এবং জমিদারশ্রেণী তৈরি করে নিল। ক্রমে ক্রমে পরিকল্পিত ভাবে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে নবাবকে কার্যত ক্ষমতাশূণ্য করে দিল ব্রিটিশ রেসিডেন্সি। অবশেষে ১৮৫৬ সালে অপশাসনের অজুহাতে লর্ড ডালহৌসি অবধের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন নিজেদের করায়ত্ত করে নিল। উত্তর ভারত দখল প্রায় শেষ। বাকি রইল কেবল শিখ অধ্যুষিত পাঞ্জাব। অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে ১৭৯৫ থেকে ১৭৯৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে রঞ্জিত সিং এর নেতৃত্বে শিখ সম্প্রদায় সংঘবদ্ধ হয়েছিল । রঞ্জিত সিং এর জীবদ্দশায় ব্রিটিশরা পাঞ্জাবের ধারে কাছে আসতে সাহস করেনি। রঞ্জিত সিং এর মৃত্যুর পর পাঞ্জাবে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। উত্তরাধিকার নিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত এবং যুদ্ধের শুরু হয়। রঞ্জিত সিং দীর্ঘ প্রচেষ্টায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ভারসাম্য সৃষ্টি করে এক পতাকার তলায় সকলকে সমবেত করেছিলেন সেই ভারসাম্য ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকে। এই সুযোগে প্রশাসনের অভ্যন্তরে দুর্নীতি বাসা বাঁধতে থাকে। পাঞ্জাবি এবং ডোগরাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং কারদারদের অবাধ লুন্ঠন পাঞ্জাবের অর্থনীতিকে প্রায় ধ্বংস করে দিল। পাঞ্জাবের বিভিন্ন সম্প্রদায় ক্রমাগত একে অপরের থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগলো এবং পরিস্থিতি ক্রমশ ব্রিটিশ হস্তক্ষেপের অনুকূল হয়ে উঠতে শুরু করলো। সংক্ষেপে বলতে গেলে ১৮৩৯ সালে রঞ্জিত সিং মারা যাওয়ার আগে তার ছেলে খড়ক সিংকে উত্তরাধিকার অর্পণ করে যান। খড়ক সিং নিজে দক্ষ প্রশাসক ছিল না এবং বহুলাংশেই তার ডোগরা উজির রাজা ধ্যান সিং এর উপর নির্ভরশীল ছিল। সম্পর্ক প্রথমে ভালো থাকলেও পরবর্তী কালে খড়ক সিং এর ক্ষমতা হ্রাস করার জন্য ধ্যান সিং রাজদরবারে ডোগরা বিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকে। ধ্যান সিং তখন যুবরাজ নাও নিহাল সিং এর সঙ্গে জোট বেঁধে ডোগরা বিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। কিন্তু এই লড়াই বেড়ে ওঠার আগেই ১৮৪০ সালে খড়ক সিং এর মৃত্যু হয়। তার কিছুদিনের মধ্যেই এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় নাও নিহাল সিং এর মৃত্যু হয়। এমতাবস্থায় সিংহাসনের অধিকার নিয়ে পরিবারের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। একদিকে ছয় জীবিত যুবরাজের একজন যুবরাজ শের সিং অন্যদিকে খড়ক সিং এর পত্নী মহারাণী চাঁদ কাউর। তিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে নিহাল সিং এর বিধবা পত্নীর গর্ভস্থ সন্তানের অধিকার দাবি করেন। ডোগরা সম্প্রদায় শের সিং এর প্রতি তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করে। অন্যদিকে সিন্ধনওয়ালিয়া সর্দারেরা মহারাণীর পক্ষ নেয়। দু পক্ষই সমর্থন চেয়ে ব্রিটিশদের দ্বারস্থ হয়। ব্রিটিশরা নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। অবশেষে ডোগরাদের চক্রান্তে শের সিং সিংহাসনে বসে এবং উজির ধ্যান সিং এর সাহায্য প্রার্থনা করে। কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। কিছুদিনের মধ্যেই ধ্যান সিং এর ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা হ্রাসের অভিপ্রায়ে শের সিং তার বিরোধীপক্ষের সিন্ধনওয়ালিয়া সর্দারদের সাহায্য প্রার্থনা করে। সিন্ধনওয়ালিয়া সর্দারেরা বৃহত্তর রাজপরিবারের অংশ ছিল।তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সিন্ধনওয়ালিয়া সর্দারেরা ১৮৪৩ সালে শের সিং , শের সিং এর পুত্র এবং রাজা ধ্যান সিংকে হত্যা করে নিজেদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। ধ্যান সিং এর ছেলে রাজা হীরা সিং ডোগরা সেনাবাহিনীর একাংশের সাহায্যে সিন্ধনওয়ালিয়া নেতাদের হত্যা করে রঞ্জিত সিং এর কনিষ্ঠ সন্তান পঞ্চবর্ষীয় দলীপ সিং কে সিংহাসনে বসিয়ে নিজে উজিরের পদে বসে। রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরীণ বিবাদ এবং সর্দারদের পারষ্পরিক শত্রুতা বাড়তেই থাকে। ইতিমধ্যে খালসা সেনাবাহিনী নিজেরা ক্ষমতার কেন্দ্রে এসে পাঞ্জাবের রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করতে শুরু করে। শের সিং এর রাজত্বে সেনাবাহিনীর সদস্যেরা ছোট ছোট দল বা পঞ্চায়েত গঠন করে সরাসরি মহারাজের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে। এইসমস্ত পঞ্চায়েতগুলি এখন রাজদরবারে তাদের চাহিদা বাড়াতে থাকে দিনের পর দিন। তাদের চাহিদা না মিটিয়ে হীরা সিং এর পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এইভাবে বেশিদিন চলা সম্ভব নয়। সেনাবাহিনীর মধ্যে ডোগরা বিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকে এবং ১৮৪৪ সালে হীরা সিং সেনাবাহিনীর বিক্ষুব্ধ অংশের হাতে নিহত হয়। দলীপ সিং এর মা অর্থাৎ রঞ্জিত সিং এর কনিষ্ঠা স্ত্রী মহারাণী জিন্দন রিজেন্ট নিযুক্ত হয় এবং তার ভাই সর্দার জওয়াহির সিং উজিরের পদে বসে। কার্যত এই দুজনেই সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল ছিল। একদিকে খালসা সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক উত্থান এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র নিয়ে তাদের পরিকল্পনা এবং অন্যদিকে লাহোরে কোনও স্থায়ী সরকার না থাকায় ব্রিটিশরা পাঞ্জাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশরা পাঞ্জাবকে একদিকে অধিকৃত উত্তর ভারত এবং অন্যদিকে পার্সিয়া এবং আফগানিস্তানের মুসলমান শাসকদের মধ্যে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছিল। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশরা বুঝতে পারল এই নীতি আর কাজে লাগবে না। ১৮৪০ সাল থেকেই ব্রিটিশরা শিখদের সঙ্গে যুদ্ধের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু করেছিল। ১৮৪৩ সাল থেকে ব্রিটিশরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ১৮৪৫ সালের সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীর হাতে জওয়াহির সিং এর হত্যার সঙ্গে সঙ্গে লর্ড হার্ডিঞ্জ পাকাপাকি ভাবে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৩ই ডিসেম্বর ১৮৪৫ শুরু হয় ব্রিটিশদের সঙ্গে শিখদের যুদ্ধ। অসফল যুদ্ধ পরিচালনা এবং কিছু সর্দারদের বিশ্বাসঘাতকার জন্য শিখরা এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়। ১৮৪৬ সালে স্বাক্ষরিত হয় অপমানজনক লাহোর চুক্তি। এই চুক্তি অনুযায়ী জলন্ধর দোয়াবের বিলুপ্তি ঘটে, কাশ্মির দিয়ে দেওয়া হয় ব্রিটিশ তাঁবেদার জম্মুর রাজা গুলাব সিংকে। লাহোর সেনাবিহিনীর সৈন্যসংখ্যা কমিয়ে সেখানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বসানো হয়। দলীপ সিংকে সিংহাসনে রাখা হলো কিন্তু অভিবাবকের আসনে বসানো হলো ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে।মহারাণী জিন্দানকে সরানো হল রিজেন্ট পদ থেকে এবং ব্রিটিশ প্রতিনিধির হাতে সমস্ত বিভাগের সমস্ত সিদ্ধান্ত নেবার একচ্ছত্র অধিকার দেওয়া হলো। রাজা এবং রাজমাতার ভূমিকা কেবলমাত্র প্রতীকী হয়ে রইল। যেহেতু ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য ছিল পাঞ্জাবকে সামগ্রিক ভাবে নিজেদের করায়ত্ত করা সেইজন্য ১৮৪৯ সালে দ্বিতীয় ব্রিটিশ- পাঞ্জাব যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই বিদ্রোহী মুলতানের গভর্নর দিওয়ান মুল রাজ, আটারিওয়ালার গভর্নর সর্দার ছত্তর সিং এবং তার পুত্র হরিপুরের রাজা শের সিংকে দমন করার অজুহাতে সমগ্র পাঞ্জাব নিজেদের অধিকারে নিয়ে নিল ব্রিটিশরা। ১৮৪৯ সালের ২৯শে মার্চ মহারাজা দলীপ সিং পাঞ্জাবের স্বাধীনতা ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিয়ে পাঞ্জাবকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত করার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হলো। বিদ্রোহী সর্দারদের একে একে ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনও উপায় রইলো না।

উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলগুলিও ক্রমে ক্রমে ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রনে আসতে থাকল। কোম্পানি অধিকৃত এই সাম্রাজ্যের নিরাপত্তাজনিত কারণে ব্রিটিশ আগ্রাসন আরও তীব্র আকার ধারণ করলো। ভারতবর্ষের ব্রিটিশ সামরিক আধিকারিকেরা দেশের বাইরে এবং ভিতর থেকে আক্রমণের আশঙ্কায় বিচলিত হয়ে যত্রতত্র সামরিক ক্ষমতাপ্রদর্শনের নেশায় মেতে উঠলো। এই নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কার কারণেই আগ্রাসন সংক্রান্ত ব্রিটিশ সরকারের এবং লন্ডনের কোম্পানি কর্তাদের সমস্ত বিধিনিষেধ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ১৮২৩ সালে আমহার্স্ট যখন ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়ে আসে তখন তার প্রতি নির্দেশ ছিল যে ভারতবর্ষে ব্যয়সাপেক্ষ রাজকীয় যুদ্ধ এবং আগ্রাসনের প্রক্রিয়া বন্ধ করে যেন শান্তির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু ভারতে পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গেই বাঙলার উত্তর-পূর্ব সীমান্তে বর্মা থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠলো। বর্মার রাজশক্তি অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে রাজ্যবিস্তারের উদ্দেশ্যে ক্রমে ক্রমে পেগু, তেনাসেরিম এবং আরাকানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নেয়। উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে মণিপুর, কাছার এবং আসামে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে। এতদিন বর্মার এইসমস্ত কাজকর্মকে কোম্পানির কর্তারা খুব একটা আমল দেয়নি। কিন্তু এখন ব্রিটিশ সামরিকবাহিনী এলাকাদখলের নেশায় উন্মত্ত। তারা যুক্তি খাড়া করলো যে বর্মার এই আগ্রাসন থেকে অভ্যন্তরীণ শত্রুরা সাহস সঞ্চয় করছে। বিপদের সম্ভাবনা সমূলে বিনষ্ট করার জন্য বর্মাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া খুব দরকার। ১৮২৪ সালে শুরু হলো প্রথম বর্মা যুদ্ধ। আসাম, নাগাল্যান্ড এবং বর্মা অধিকৃত আরাকান এবং তেনাসেরিম ব্রিটিশরা দখল করে নিল। ১৮৩০ সালে কাছার এবং ১৮৩৪ সালে বেন্টিঙ্কের আমলে কুর্গও ব্রিটিশদের দখলে এসে গেল। বর্মা যেমন উত্তর-পূর্ব ভারতে তেমনই রাশিয়া ছিল উত্তর-পশ্চিমে ভয়ের কারণ। সুতরাং উত্তর-পশ্চিমেও আগ্রাসনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। অকল্যান্ডের নেতৃত্বে ১৮৩৮ থেকে ১৮৪২ অবধি চলে আফগান যুদ্ধ। ১৮৪২ সালে ব্রিটিশরা নিজেদের অনুগত রাজাকে সিংহাসনে বসিয়ে আফগানিস্থানকে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের অধীনে নিয়ে আসে। এলেনবরো ১৮৪৩ সালে সিন্ধ দখল করে। কিন্তু ঔপনিবেশিক আগ্রাসন চূড়ান্ত রূপ নেয় ডালহৌসির সময় (১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত)। ব্রিটিশ প্রবর্তিত স্বত্ববিলোপ নীতির আশ্রয় নিয়ে অনেক রাজ্যকেই সরাসরি নিজেদের আওতায় নিয়ে আসে ডালহৌসি। এই নীতি অনুযায়ী যদি কোনও রাজা কোনও পুরুষ উত্তরাধিকারী না রেখে দেহত্যাগ করে তাহলে সেই সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশদের হাতে সরাসরি চলে আসবে। এই নীতি ব্যবহার করে ১৮৪৮ সালে সাতারা, ১৮৫০ সালে সম্বলপুর এবং বাঘাট, ১৮৫২ সালে উদয়পুর, ১৮৫৩ সালে নাগপুর এবং ১৮৫৪ সালে ঝাঁসি দখল করে নেয় ব্রিটিশেরা। ১৮৫২-৫৩ সালে দ্বিতীয় বর্মা যুদ্ধ জয় করে পেগু দখল করে ব্রিটিশবাহিনী। সেনাবাহিনীর খরচ আদায়ের জন্য ১৮৫৩ সালে হায়দ্রাবাদ থেকে বেরার বিচ্ছিন্ন করে অধিগ্রহণ করে নেয় ব্রিটিশেরা। ১৮৫৭ সালের মধ্যে ভারতবর্ষের ৬৩ শতাংশ অঞ্চল এবং ৭৮ শতাংশ জনগণ সরাসরি ব্রিটিশদের অধীনে চলে আসে। বাকি অঞ্চলগুলি ইংরেজদের অনুগত রাজাদের অনুশাসনেই থাকে। ব্রিটিশরা এইসময়ে সরাসরি অধিগ্রহণের পথ ছেড়ে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের পথ বেছে নেয়। খাতায় কলমে স্বশাসিত হলেও আসলে এইসমস্ত রাজারা ছিল ব্রিটিশদের তাঁবেদার এবং প্রতি পদক্ষেপে ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপ তাদের একরকম পুতুল করে রেখেছিল।

অবাধ এবং মুক্ত বাণিজ্যের প্রয়োজনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং অধিগ্রহণ শুরু হলেও শেষ অবধি ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত করে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলই হয়ে ওঠে তাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু ভারতবর্ষের মত এক বিশাল দেশকে সম্পূর্ণ নিজেদের অধীনে নিয়ে আসা সহজসাধ্য ছিলনা। সেই সময় নানা কারণে মোগলেরা দূর্বল হয়ে পড়েছিল কিন্তু যে সমস্ত অন্য রাজ্যেরা সেই সুযোগে সিংহাসন দখলের চেষ্টা করছিল তারা কিন্তু খুব একটা দূর্বল ছিল না। প্রচুর সংখ্যক সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র ছিল এই সব রাজ্যের কাছে যদিও আধুনিকতার নিরিখে এই সব অস্ত্রশস্ত্র ব্রিটিশদের চাইতে অনেক নিম্নমানের ছিল। পৃথিবী জুড়ে ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তখন বেড়েই চলেছে। সেই কারণে ভারতে অভূতপূর্ব মাত্রায় ব্রিটিশ সৈন্যের সংখ্যা বাড়তে থাকলো। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো এই সময় ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে ভারতীয়দের ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে নিযুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করে দিল। ব্রিটিশ অফিসারদের দ্বারা প্রশিক্ষিত নতুন সেনাবাহিনী ব্রিটিশদের প্রতিপক্ষ রাজ্যগুলিকে শায়েস্তা করার কাজে নিযুক্ত করা হলো। এই বিশাল সেনাবাহিনীর সাহায্যে ব্রিটিশরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলো এবং অধীনতামূলক মিত্রতার অধীন রাজ্যগুলির থেকে আর্থিক চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগলো। বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য সীমান্ত সুরক্ষিত রাখা ব্রিটিশদের কাছে আবশ্যিক হয়ে উঠেছিল। সীমান্ত সুরক্ষিত রাখার জন্য সরাসরি রাজ্য দখল করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। চলতে থাকলো একের পর এক রাজ্য দখলের যুদ্ধ। রাজস্বের বেশিরভাগ অংশই খরচ হয়ে যেত যুদ্ধে এবং সেনাবাহিনীর ভরণপোষণে। পরিকল্পিত ভাবে অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃশত্রুর থেকে আক্রমণের আশঙ্কা সৃষ্টি করে এই বিপুল সেনাবাহিনীকে সবসময়ে যুদ্ধে নিযুক্ত রাখা হতো।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল অর্থ এবং রসদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে তাদের প্রতিপক্ষ রাজ্যগুলির থেকে এগিয়ে থাকা। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সৈন্যদের খাওয়া, থাকা এবং নিয়মিত বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা কোনও কার্পণ্য করতো না। এছাড়াও ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশীয় রাজাদের চাইতে ব্রিটিশদের বেশি বিশ্বাস করতো। প্রয়োজনে ব্যাঙ্কগুলির থেকে টাকা ধার পেতে ব্রিটিশদের কোনও অসুবিধে হতো না। যেহেতু রাজ্যগুলিকে সরাসরি দখল করে রাজস্ব আদায় ব্রিটিশরা নিজেরাই করতে থাকল সেইজন্য ব্যাঙ্কের উপর নির্ভরতাও ক্রমাগত কমে যেতে থাকলো। পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের অধীনে থাকা রাজ্যগুলি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে থাকলো। সমস্ত দেশজুড়ে কায়েম হতে থাকলো ব্রিটিশরাজ। রাজ্যশাসন এবং রাজস্ব আদায় দুইই এখন সরাসরি কোম্পানির হাতে । রাজস্ব আদায়, বাণিজ্য এবং সামরিক অভিযান ভারতবর্ষে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের জন্য একইসূত্রে গ্রথিত ছিল।

অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইংল্যান্ড ছিল বিশ্বের ধনী দেশগুলির অন্যতম। অন্য ধনী দেশগুলি যখন সাম্রাজ্যবিস্তারে ব্যস্ত ব্রিটিশ শাসকেরা যুদ্ধের পথে সাম্রাজ্যবিস্তারের পথে না গিয়ে বিশ্বব্যাপী মুক্ত এবং অবাধ বাণিজ্যের পথ অবলম্বন করে। ব্রিটিশ সরকার দেশের বড় কোম্পানিগুলিকে অন্যদেশে বাণিজ্যবৃদ্ধির অনুমতি দেয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে বাণিজ্যবৃদ্ধির অনুমতি পায়। বিনিয়োগ এবং বাজার দখলই ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাথমিক উদ্দেশ্য। এই সম্পদবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় সরকার ছিল কোম্পানির অন্যতম সহযোগী। কোম্পানি এবং সরকারের যুগলবন্দী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যবৃদ্ধি এবং সম্প্রসারণের প্রয়োজনে ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে ধীরে ধীরে ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত করে। বাজার দখল দিয়ে শুরু করে গোটা দেশকেই দখল করে নেয় ব্রিটিশ।
0

গল্প - রূপশ্রী ঘোষ

Posted in




















‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই’। ‘লড়াই করে বাঁচতে চাই’। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ‘সর্বক্ষয়ী দলের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’। ‘এই লড়াই লড়াই লড়াই চাই’। ‘লড়াই করে বাঁচতে চাই’। পাটুলির ফুটপাত দিয়ে একজন মধ্যবয়সী লোক হেঁটে যাচ্ছে আর নিজের মনে একাই এভাবে স্লোগান আওড়ে চলেছে। মধ্যবয়সী লোক, কিন্তু দেখে এক ঝটকায় কুড়ি পঁচিশ বছরের ছেলেও মনে হতে পারে। খুব শান্তশিষ্ট, ভদ্রসভ্য দেখতে। চোখেমুখে লেখাপড়ার ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু দৃষ্টিতে একটা কুটিল কুটিল ভাব আছে। রুহিও ওইপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। সে বারবার একই স্লোগান শুনতে শুনতেই হাঁটছিল। তারপর আর তার কৌতূহল চেপে থাকতে না পেরে একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেলল –

এই? আপনি কে? এমন এভাবে একাই মিছিলের মতো স্লোগান দিচ্ছেন? মিছিলে তো প্রথমে একজন বলে, তারপর পিছনের বহুলোক সমস্বরে ওই কথাটাই বলে বা প্রশ্ন হলে তার জবাব দিয়ে একটা গণগর্জন তুলতে তুলতে হাঁটে। আপনি এমন একাই এসব করছ, কী ব্যাপার?


আমার দল সর্বহারা।


মানে? আপনাকে দেখে একটু চেনা চেনা লাগছে। নাম কী?


আমার নাম এক্স।


এক্স? বললেই হল?


কেন? হবে না কেন? এত এক্স ওয়াই ধরে অঙ্ক করলেন আর আমার নাম এক্স শুনেই চিৎকার করছেন? ওইতো আমার এক মেয়ে বন্ধুর নাম ওয়াই। সেও ওই প্রোলেতারিয়েতদের দল করে।


প্রোলেতারিয়েতদের দল? মানেটা কী?


আরে প্রোলেতারিয়েত, প্রোলেতারিয়েত। যাকে বলে সর্বহারা। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ পড়েছেন? পড়লে ওখানে ওই শব্দটা পেতে্ন। আপনারা তো কিছুই পড়েন না। আমরা যারা সর্বহারাদের দল করি, তারা অনেক লেখাপড়া করি।


ও! তা আপনাদের ওই সর্বহারা দলটা সম্পর্কে একটু বুঝিয়ে দেবেন? কী কাজ করেন শুনি।


আরে ওই তো, আমাদের একটা ম্যা-ম্যা-ম্যানুফেস্টো আছে। সেটা পড়ে নেবেন। সব জেনে যাবেন।


অ। তা একটু গুছিয়ে বলতে কী হয়? একা একাই যখন মিছিলের স্লোগান দিতে দিতে হাঁটছেন তখন তো আপনার ... ওই কী বললেন, ম্যানুফেস্টো সম্পর্কে জ্ঞান দিতেও ভালো লাগা উচিত…


হ্যাঁ তা লাগে, তো আমার অত সময় নেই, সংক্ষেপে যা দাঁড়ায় তা হল আমরা প্রতিবাদ করি। খেটে খাওয়া মানুষদের সমান কাজ, সমান অধিকার চাই। দারিদ্র ঘোচাতে চাই।


ও, তাই নাকি? তা সর্বহারাদের দল যখন, তখন কি সব হারিয়েছেন? নাকি আপনাদের দলটাই হারিয়ে গেছে? চেহারা সাজ পোশাক দেখে তো কিছুই হারিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না।


আরে আমার কথা বলছি নাকি? আমি তো সর্বহারা জনগণের কথা বলছি।


ও, তো আপনি কে? প্রতিনিধি?


হ্যাঁ, বলতে পা্রেন।


আর আপনার ওই বন্ধু ওয়াই, সেও?


হ্যাঁ সেও। তার ইনফ্লুয়েন্সেই আমি এই দলটা করি। নাহলে আমি কোনো দলকেই ভোট দিতাম না।


তাই বলুন। কারণ আমি স্কুল কলেজ থেকেই আপনার মুখ চিনি। আপনি ওই ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছেলেটার মতো স্যুটকেশ হাতে নিয়ে, চুলের বাঁদিকে সিঁথি কেটে, ফার্স্ট বেঞ্চে ভালো ছেলেটার মতোই বসে থাকা বলে জানি। কলেজ টলেজেও ওই একইভাবে দেখেছি। কোনোদিন কোনো ইউনিয়নে টিউনিয়নে হাঁটতেও তো দেখিনি। আর এখন একাই হেঁটে হেঁটে একটা মিছিল বানিয়ে ফেলছেন?


আপনি আমায় চেনেন নাকি?


আমি আপনাকে চিনি। কিন্তু আপনারা আমাদের মতো লোককে চেনেন না। কেন বলুন তো?


এটা মগজ ধোলাই। এটা ওয়াই আমাকে শিখিয়েছে।


তা আপনার ওয়াই কি সর্বহারা?


না, সেও সর্বহারা নয়। তার অনেক টাকা পয়সা সম্পত্তি। বিদেশেও থাকে মাঝে। দেশেও অনেক বাড়ি গাড়ি।


ও বাব্বা! অবাক কাণ্ড তো মশাই। এতকিছু সম্পত্তি বাগিয়ে সে কিনা সর্বহারাদের প্রতিনিধি? আপনার কালটিভেট করতে ইচ্ছে হয়নি মশাই? আপনার সম্পর্কে তো অনেক অনেক ভালো ভালো কথা বলত সবাই। আপনি নাকি গোয়েন্দা গল্প সব গুলে খেতেন। তা আমাদের ফেলু মিত্তির আপনার মাথায় ধাক্কা মারেননি? আপনিও ওই দলে ভিড়ে গেলেন? আমি আসলে আপনারই পাড়ার মেয়ে, আর আপনার স্কুল কলেজেই পড়াশুনো। তাই আপনার সম্পর্কে অনেককিছু জানি।


ও তাই নাকি? তা কী কী জানেন?


সেসব পরে হবে। আপনি এখন আপনার ওই সর্বহারা দল নিয়ে বলুন কী কী জানেন। আমি বরং শুনি।


আরে সর্বহারা দল নিয়ে আর শোনার কী আছে, ও তো সবাই জানে। ওরা দুর্নীতি শুরু করেছিল বলে সব হারিয়েছে। আমি বরং শাসক দল নিয়ে বলি। ওদের সম্পর্কে আমার এখন শুনে শুনে অনেক ধারণা হয়েছে।


তা কী ধারণা হয়েছে শুনি…


আরে ওই যে রেলইয়ার্ডে কী সব ঘটল না, সেটার পিছনে কার হাত, কত বড়ো হাত সব ওয়াই আমাকে বলেছে। আর বলেছে ওই দলের প্রধান যিনি তিনি নাকি কোনো নারীকেই সম্মান করেন না।


ও তাই নাকি? তা আমিও শুনেছি বটে। কিন্তু আপনার সম্পর্কেও নাকি ওই একই কথা শোনা যায়…


মানে? আমার সম্পর্কে কেন শোনা যাবে? আমি কি কোনো বড়ো নেতা বা নেত্রী?


না, আপনি নেত্রী নন তো বটেই। আপনি পুরুষ। আপনার নামও এক্স।


তো? তাহলে কী শুনেছেন? আমি বিখ্যাত কেউ নই।


না, মানে খুব বিখ্যাত কেউ নন। কিন্তু আপনি যতটুকু বিখ্যাত হয়েছেন তা ওই কু কেলেঙ্কারি দিয়েই।


মানে? আপনি আমার সম্পর্কে এসব কোথায় শুনেছেন? কী শুনেছেন? এইজন্য আপনি এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করলেন? এসব বলবেন বলে?

এক্স গজগজ করতেই থাকলেন। রুহি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে এক্সকে উস্কিয়ে দিয়ে হনহন করে হেঁটে গেল। আসলে রুহি আর ভূতের মুখে রামনাম সহ্য করতে পারছিল না। একই পাড়ায় থাকার দৌলতে সে তার সম্পর্কে কিছু কেমন কথা জানে। আর বাঙালির স্বভাবেই তো তা আছে। পরচর্চা পরনিন্দা। কিছু ঘটালে কেউ তা শুনবে না এটা হতে পারে না। খবর হাওয়ার থেকে, আলোর থেকে আগে দৌড়োয়। মুখরোচক খবর হলে তো কথাই নেই। রুহি ভাবছে, লোকটাকে ভালো জবাব দেওয়া গেছে। আবার দেবে একদিন। ও খেয়াল রেখেছে ওখান দিয়ে নাকি ওই ভদ্রলোক দুবেলা হেঁটে যায়। কোনো কোনোদিন দুবেলা না হলেও একবেলা তো মাস্ট। অতএব চিন্তা নেই, আবার ধরা যাবে। ভাবতে ভাবতে রুহি নিজের মনে হাঁটতে লাগল। রুহিও কাজ থেকে ফেরার সময় বা যাওয়ার সময় হাতে টাইম থাকলে একটু হেঁটে নেয়। ওভাবে যাওয়া আসার পথেই তার চোখে পড়ে ওই ভদ্রলোকের মিছিল। কিন্তু কোনোকিছুতেই তার কৌতূহল মেটে না। এই যেমন রান্নাঘরে সে যখন কাজ করে জানলা দিয়ে দেখতে পায়, উপরের তলা থেকে নিচের দিকে কী যেন একটা উড়ে গেল। কী উড়ে যায় সে কোনোদিন দেখতে পায় না। তাই সে ভাবে কালো পাখি বা কালো প্লাসটিক প্যাকেট বা কালো কোনো কাপড়ের টুকরো। কিন্তু কালো যে, সেটা সে স্পষ্ট বুঝতে পারে। অন্য কোনো রঙ নয়। কালোই দেখে সে। এই কালো নিয়ে তার ভয় সারা জীবনেও যায় না। ছোটো থেকেই ভাবত, চা খেলে কালো হয়ে যায়, শাক খেলে কালো হয়ে যায়, কালো লোক দেখে ভয় পায়, কালো ছেলে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না, আর অন্ধকারের কালো দেখলে তো কথাই নেই। সে অন্ধকারকে ভয় পায় কালো বলেই। একবার তো শিয়ালদা থেকে রাজাবাজার যাওয়ার সময় বাসে কন্ডাক্টরকে বলেছিল, ‘কালোটাকা আমি নেব না’। গোটা বাস হো হো করে হেসেছিল কিন্তু সে তার ‘কালো আর ময়লা’র ক্যাবলামির তফাৎ করতে পারেনি। রুহি এসব ভাবতে ভাবতেই আবার এক্সের চিন্তা নিয়ে পড়ল। তার মনে হল, ‘আচ্ছা এক্স যে সর্বহারা দলের প্রতিনিধি বলল, কিন্তু সে তো কই সাদা ফতুয়া আর সায়ার মতো বা তার থেকেও বেশি ঢোলা পাজামা পরে হাঁটতে দেখেনি। মনে মনে ভাবল, ‘ছোটোবেলায় তো পুকুর পাড় দিয়ে যে মিছিল হেঁটে যেত তার নেতাদের বেশিরভাগ লোকই ওইরকম সাদা পোশাক পরে হাঁটত। তাহলে কি যুগের সঙ্গে পোশাক বদলে গেল আর দলটার নাম আর এজেন্ডা এক রয়ে গেল’? রুহির এ আর এক সমস্যা। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যেন নিজেই নিজের পেটের ভিতর থেকে টপিক বের করে আর ভাবতে থাকে। এমন ভাবতে ভাবতে সে কতবার ভাত তরকারি পুড়িয়ে ফেলেছে। তবুও তার ভাবা চাই। যা বলা সত্যিই তাই। ভাতের ফ্যান উপচে পড়ে গোটা রান্নাঘর, গ্যাস ওভেন সব নোংরা হয়ে গেল। আবার সবকিছু ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতে হবে। এই নোংরা ব্যাপারটাও তার পছন্দ নয়। নোংরা ঘটনা, নোংরা দৃশ্য, নোংরা ছবি…। অবশ্য ও যেগুলো নোংরা ছবি বা ভিডিও ভাবে সেগুলো আসলে অন্যদের কাছে রোম্যান্টিক। ও নিজেই একটু কেমন খুঁতখুঁতে পুরোনো পন্থী। এই নিয়ে সে ঝাড়ও খায় বন্ধুবান্ধবদের কাছে। এই দ্যাখো পুরোনো কথাটা মাথায় আসতেই সে আবার ভাবতে বসল, ‘এক্স কেন সবুজের কালো হাত বলল? সবুজ তো নিজেই পুরোনো। সেই কবে ক্ষমতা থেকে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। ওরাই তো সাফ করে দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। এখন সে দলও তো সর্বহারা। ইনফ্যাক্ট সর্বহারাদের সঙ্গে তারা জোটও তো বেঁধেছিল দু একবার’। এবার রুহি ঠিক করেই নিল, যেভাবে হোক ওই ভদ্রলোককে রাস্তায় পেতেই হবে। নাহলে চলবে না। যা ভাবা তাই করা। যাওয়া আসার পথে রুহিও যেন ওত পেতে বসেছিল, শিকারীর মত। এক্সকে দেখতে পেয়েই সে খপ করে ধরল –

আরে মশাই দাঁড়ান দাঁড়ান। আপনি ওভাবে সেদিন মিছিলে সবুজের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও বললেন কেন? ও তো অনেক পুরোনো দল, সে তো আপনারাই সাফ করেছিলেন…


না, মানে ইয়ে (প্রথমে রুহিকে এড়িয়ে পালাবে কিনা ভাবছিলেন) মানে, মানে আমরা তো প্রথম থেকে ওই দলটাকেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে শিখেছি, পুরোনো অভ্যেস আর কী। আর তাছাড়া ঘাস পাতা জুড়ে বর্তমান দল ক্ষমতায় এলেও আসলে তো শিকড় ওখানেই পোঁতা ছিল। তাই আমরা ওটা থেকে আর বেরোতে পারছি না…


হ্যাঁ তা বুঝলাম মশাই। কিন্তু ওই দল তো এখন আপনাদের মতোই সর্বহারা। আর আপনাদের সঙ্গেই জোট বেঁধে শক্ত পোক্ত একটা দল গড়তে চাইছে। তা আপনারা যে, এই স্লোগান দিচ্ছেন তাতে তাঁদের নেতা নেত্রীরা রাগ করছেন না?


না, মানে আমাদের এখন একটাই লক্ষ্য। এই ক্ষমতাটাকে সরাতে হবে আর ওই হিন্দু দলটাকে আসতে দেওয়া যাবে না। তাই আমরা যা খুশি তাই বললেও ওরা গায়ে মাখছে না। কারণ লক্ষ্য তো এক। তাই লক্ষ্যবস্তুর দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে যেটা ভালো বা যেমনভাবে এগোলে লক্ষ্যে পৌঁছোনো যাবে আমরা সেভাবেই এগোচ্ছি।


ওরা মেনে নিল? এতবড়ো একটা অপবাদ…?


মানবে না কেন? কালো হাত কী ছিল না? কালোই তো ছিল। তাই মানতে বাধ্য। বলুন তো সেই চালে কাঁকর মেশানো থেকে শুরু করে জরুরি অবস্থা হেনতেন আর কী কী শোনেননি বলুন? ওরাও কি অস্বীকার করতে পারবে? পারলে তো ট্যাঁ ফোঁ করত এই স্লোগান নিয়ে …। কেন করছে না তাহলে... এবার আপনিই বুঝুন। আর শুনুন আপনি এমন মাঝে মাঝেই শিকারীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে অ্যাটাক করবেন না তো? আমার ভয় করে আপনাকে দেখলেই?


কেন? ভয়ের কী হল? আমি কি কামড়ে দেব আপনাকে?


না তা নয়, কিন্তু আপনি বড্ড প্রশ্ন করেন। এই এত প্রশ্ন আমার ভালো লাগে না। এত কৈফিয়ত আপনাকে দিতে যাবই বা কেন?


আরে, এ আপনার দোষ নয়। এটা গোটা পুরুষ জাতির দোষ। তারা প্রশ্নে ভয় পায়। বিশেষ করে ব্যক্তিগত প্রশ্নে। আপনিও তো পুরুষ, তাই আপনার ভয় পাওয়াতে আমি অস্বাভাবিক কিছু দেখছি না


একি? আপনি আবার জাত তুলে কথা বলছেন? আমি তো কই জাত তুলিনি, আমিও যদি নারী জাতি বলে গালাগাল দিই? আপনার ভালো লাগবে?


ভালো লাগা না লাগার কিছু নেই মশাই। আপনারা এখনো গালাগালি, শাপ শাপান্ত, আধিপত্যবাদ চালিয়েই যাচ্ছেন মেয়েদের উপর। আপনারা তো মেয়েজাত বলেই আর রাত হলেই ধরা বাঁধা কোনো নারী না থাকলে সোনাগাছি ছোটেন। আপনাদের কথা ছাড়ুন মশাই। ও না না সোনাগাছি না, আজকাল কী যেন নতুন নাম শুনি, এসকর্ট গার্ল। তা মশাই আপনিও যান নাকি?

এই শুনে তো এক্স আবার রাগে খাপ্পা। আবার গজগজ করতে করতে চলে গেল। নেহাত শান্তশিষ্ট লোক বলে তাই রুহির রেহাই। নাহলে হয়তো কোনোদিন বলে বসত বাড়িতে গুণ্ডা পাঠাব…। যতই হোক রাজনীতি বলে কথা। রুহি মনে মনে ভাবে, এক্স যতই সর্বহারা দলের হয়ে এখন গুণগান করুক না কেন, ওর নিজস্ব কিছু বুদ্ধি সুদ্ধি আছে বলেই মনে হয়। কারণ কখনো সখনো ওদের দলের খারাপ কাজ নিয়ে সমালোচনা করতেও সে শুনেছে। তাদে।।সর্বক্ষয়ী দলের মতোই বহু খারাপ কাজ, বহু দুর্নীতিকে এক্স সাপোর্ট করে না। এইসব ভাবতে ভাবতেই রুহি সর্বহারা দলের খারাপ কাজ এবং দুর্নীতিগুলোর একটা তালিকা তৈরি করে ফেলল। নেক্সট দিন এক্সকে দেখতে পেলেই সে সরাসরি তার মতামত জানবে বলে। দু একদিন সেই তালিকা নিয়ে আসা যাওয়ার পথে এক্সের খোঁজ করল আপন মনে। কোথাও খুঁজে পেল না তাকে। একটু হতাশ হল রুহি। কী ব্যাপার, আর দেখা যাচ্ছে না কেন এক্সকে। সে কি চাকরি ছেড়ে দিল? এ পাড়া থেকে অন্য পাড়া চলে গেল? নাকি অন্য দেশ? সুস্থ হল না তো? নানান উদ্ভট প্রশ্ন রুহির মাথায় ঘুরতে লাগল। লাগারই কথা। সে তো ভেবে রেখেছে দেখা হলেই সর্বহারা দলের দুর্নীতি বিষয়ে তার মতামত জানতে চাইবে। যতক্ষণ না পাচ্ছে উত্তর ততক্ষণ শান্তি নেই। এইসব ভাবনার মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতেই রুহি অফিস গেল। ফেরার পথে সিমেন্ট ব্রিজের নিচে ভিড় হট্টগোল থেকে সেও থমকে গেল। সে দেখল বিভিন্ন দিক থেকে গাড়ির লম্বা জ্যাম। সে এঁটুলি মোড় থেকে হেঁটে ফেরে বলে তার অসুবিধা হয়নি, মোড়ে জটলার কাছে পৌঁছে সেও হতবাক হয়ে গেল। ওখানে একটা বড়সড়ো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। গোটা রাস্তা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। ওখানে মাঝখানে হাত পা ছড়িয়ে বসে এক্স হাউহাউ করে কেঁদে চলেছে। কিছুতেই তাকে কেউ থামাতে পারছে না। কেন কাঁদছে তাও কেউ তার কাছ থেকে বের করতে পারছে না। রুহি ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল। গিয়েই এক্সের কাছে জানতে চাইল,

কী হয়েছে? কাঁদছেন কেন এমন করে?


(কেঁদেই চলেছে এক্স, কোনো উত্তর নেই)


আরে বলুন কী হয়েছে? গোটা রাস্তা জ্যাম হয়ে গেছে তো। চারদিক পুরো ব্লকড। কী হয়েছে আপনার ? এমন কী হল যে, পুলিশও তোমাকে তুলতে পারছে না? কলকাতার রাস্তায় এমন অ্যাকসিডেন্ট, রক্ত, এমনকি প্রকাশ্যে দিনের আলোয় শুট আউট করে খুনও তো ঘটে থাকে। আপনি কি সবসময় এমন অ্যাক্সিডেন্ট দেখে শোরগোল বাঁধিয়ে দাও নাকি?

রাস্তার এমন বেহাল অবস্থা দেখেই রুহি জোরে জোরে ধমক দিচ্ছিল এক্সকে। তারপর একটা সময় এক্স নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে শুরু করল, ‘এই রক্তই তো সেই রক্ত, যে রক্ত দিয়ে আমার দল, দলের নেতারা বৃদ্ধা মাকে ভাত মেখে দিয়েছিল। এ তো সেই রক্ত। আমি তো এই রক্তের মধ্যে সেই বৃদ্ধা মায়ের যন্ত্রণা দেখছি। আপনারা তো সাধারণ অ্যাকসিডেন্টের রক্ত বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন, ঘটনাটা তাচ্ছিল করছেন, লঘু করে দিচ্ছেন, কিন্তু আমি তো তা পারছি না। যতই আমার দল হোক, আমি যতই সেই দলের প্রতিনিধি হই না কেন, রক্ত দেখলে আমার সেই বৃদ্ধা মায়ের যন্ত্রণা ছাড়া কিচ্ছু আসে না চোখের সামনে। আমি দেখতে পাই দুয়ার ভেসে যাওয়া সেই রক্ত, উঠোন ভেসে যাওয়া সেই রক্ত, মায়ের বুক ভেসে যাওয়া সেই রক্ত… লাল, চারিদিক লাল, কেবল লাল, টুকটুকে লাল রঙ ছাড়া আমি আর কিচ্ছু দেখতে পাই না, লাল, চারিদিক লাল, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত সব লাল…। দুহাত রাঙিয়ে নিয়ে আমরা সর্বহারা…। আমরা রক্তপতাকা, আমরা লড়াই চাই। লড়াই লড়াই লড়াই চাই। লড়াই করে বাঁচতে চাই…’। এক্সের কান্নার তীব্রতা আরও বেড়ে গেল। রুহি রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গেল। তার মুখে আর কোনো কথা নেই, ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে প্রশ্নের তালিকাটা বের করে ছিঁড়ে কুচিয়ে রাস্তায় ছড়িয়ে দিল…। ধীর, ক্লান্ত পায়ে রুহি আবার হাঁটতে শুরু করল বাড়ির দিকে…। এক্সের মতামত নিয়ে রুহির আর কোনো বক্তব্য নেই!

মোড়ের মাথায় লাল সিগন্যাল। সব গাড়ি দাঁড়িয়ে। মানুষ কিন্তু চলেছে। পায়ে, পায়ে এগিয়ে চলেছে ক্লান্ত, বিষণ্ণ মানুষ। লড়াই করতে করতে তারা আর লড়াই করতে চায় না। বাইপাসে লম্বা যানজটে গাড়ির পর গাড়ির ভিতর, অ্যাম্বুলেন্সের পর অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের ভিতর দিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস পাক খাচ্ছে চারিদিকে।

সিগন্যালের রঙের বদল হচ্ছে না। সব থমকে আছে।
0

কবিতা - অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়

Posted in

মহাকাল উদাসীনের মত হেঁটে চলেছে—
মানুষের খেলনা-বাটি সংসার
গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে তার পায়ের ধুলো।
এক হাঁটু ধুলো নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো কি ভালো?
0

কবিতা - আশীষ কুমার বিশ্বাস

Posted in








নদী ভাসা খড়-কুটো
কবিতার খুঁটি
এ ভাবেই সাজিয়েছি
কবিতার গুঁটি ।

নাই তার ভরসা
ভেসে ভেসে চলে
এ কবিতা জীবনের
অন্য কথা বলে ।

অভাব অনটন আছে
আয় করার পথ খোঁজে
বাঁধা আছে পদে পদে
অপরাধে মাথা গোঁজে ।

মায়ের প্রবল অসুখ
বাবার বেতন নেই
দিদির বিয়ের বয়স
মন তাই সুখে নেই !

ভাইয়ের স্কুল আছে
বোনের পড়া নেই
বেটি বাঁচাও , বেটি পড়াও
তাঁতে আর তাড়া নেই ।

সুখের কথা ভাবি নাকো
দুঃখে দিন যাপন
দুঃখেই কবিতা লিখি
এ ভাবেই উদযাপন ।
0

কবিতা - অমিতাভ মুখার্জী

Posted in








সত্যি করে বলছি
তোমাকে আমি দীপিকা
বলে ডাকিনি

তোমাকে হলফ করেছি
আমি আর দীপিকার সাথে একই
ফ্লাইটে বিজনেস ট্রিপে আর যাব না

তোমাকে আগেই বলেছি
আমি যখন ভুট্টার ক্ষেতে ঘুরে বেড়াই
সূর্যের আলোয় যে মুখ বারবার
ভেসে আসে, সে ত’ দীপিকারই

তুমি জানতে আমি চোখ
রেখেছিলাম ঐ রাঙা মেয়েটির দিকে
সে কেউ নয়, সেই চোখ দীপিকারই

তোমার বারংবার বারণ শোনার পর
আমি বলিছি
আমি দীপিকাকেই চুম্বন করেছি

তোমাকে এটা বলতে ভুলে গেছি
প্রতি রাতে যে তারা গুলোর আলো
খসে পড়ে তাদের ত্বকে
তাদের সবাইয়ের ত্বক দীপিকারই ত্বক

তুমি এত রাগ করে থেকো না
আমার চোখে সব লুকোনো
ভালোবাসা দীপিকার চোখেরই

আমি যেদিন শীতের সকালে
ব্রেকফাস্ট টেবিলে তোমার নাম ভুলে
দীপিকা বলে ডেকেছিলাম
তুমি তাকিয়ে ছিলে আমার দিকে
কিছু বলে ওঠোনি

তুমি মাধুরী সেদিন আমায় কিছুই বলনি
শুধু তাকিয়ে ছিলে
আমি তোমার চোখে গোপনে চোখ রেখেছিলাম
সত্যি বলছি সেও দীপিকারই

আজ সন্ধ্যেতে ডিনার শেষে
পোর্ট ওয়াইন নিয়ে মাধুরী
তোমার সাথে যে গল্প হয়েছে
তা বেশীর ভাগ দীপিকাকে নিয়ে

তোমাকে কথা দিয়েছি
দীপিকাকে নিয়ে
আর কিছু বলবো না ২০২৪-এ

মাধুরী আছ, যেমন ছিলে
বছর বছর আমার দীপিকা
পালটে যায়
এবার নতুন কোনো দীপিকা

কিছু মনে করো না—সহজ হয়
সহজ ভাবে নাও

গোপন তারা গুলোর আলো
খসে পড়ে তাদের ত্বকে

আর দীপিকার নাম লেখা নেই
হয়ত বা অন্য কেউ
হয়ত বা সেই দীপিকা
আবার দীপিকাই হয়ে।
0

কবিতা - সব্যসাচী রায়

Posted in









আজকে আকাশ ঘুড়ি আর ওয়াইফাই সিগনালের সেলাই।
হোলির কথা মনে পড়ে, রং মাফ করে, যতক্ষণ না বৃষ্টি আসে।

চায়ের দোকানে কেউ বলে, "ভারত তো আমেরিকা, সাবটাইটেল দেওয়া।"
সবাই হাসে, যেন সত্যি। হয়তো তা-ই।

এখানে, বলিউডের স্ক্রিপ্ট নিজেকে পাল্টায়: হিরো আগেই মরে যায়,
ভিলেন একটি স্টার্টআপ চালায়, আর কোরাস গায় ভাঙা কোডে।

স্বপ্নগুলো আবার বিগড়ে গেছে। গঙ্গার জল উল্টো দিকে বইছে,
গরু আর ক্রিকেট ব্যাট ভাসিয়ে নিচ্ছে, ব্যর্থতার রেখাচিত্র আঁকছে।

ট্রেনে বাড়ি ফেরার পথে গুগলে সার্চ দিই "বিশ্বাস পুনর্জীবিত করার উপায়"
উত্তরে পাই ডালের রেসিপি। বিদ্রূপের স্বাদ বেশ বাড়ির মতো।
0

ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

Posted in




















ইলিশ পোলাও

ইলিশ মাছের রাউন্ড পিস। একটু মোটা করে কাটা। নুন মাখিয়ে রাখতে হবে। কালিজিরা চাল ধুয়ে জল ঝরিয়ে, চাল শুকিয়ে গেলে তাতে নুন ও ঘি মাখিয়ে রাখতে হবে। অন্তত আধঘণ্টা রাখতে পারলে ভালো।

এবার, সামান‍্য হলুদ, প‍্যাপরিকা, সামান‍্য গরম মশলা গুঁড়ো, চিনি, নারকোলের দুধ দিয়ে গুলে একটা মশলা তৈরী করে নিতে হবে। তেল গরম করে দুটো কাঁচালঙ্কা চিরে তাতে দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে ওই গোলা মশলাটা কষাতে বসাতে হবে। মশলার কাঁচা গন্ধ চলে গেলে মাছের টুকরোগুলো দিয়ে এপিঠ ওপিঠ করে প‍্যান আঁচ থেকে সরিয়ে রাখতে হবে, কিন্তু মাছ প‍্যানেই থাকবে।

আরেকটা প‍্যান বসিয়ে তাতে আবার তেল দিয়ে কাজু ভেজে তুলে রাখতে হবে। আর আবারও দুটো চেরা কাঁচালঙ্কা দিয়ে চালটা ভাজতে হবে। পুটপুট করতে শুরু করলে বোঝা যাবে হয়ে গেছে, তখন উষ্ণ গরম জল ঢালতে হবে। যতোটা চাল, তার দ্বিগুণ জল। জল ফুটে উঠে, একটু টেনে এলে, মাছের টুকরোগুলোকে,ভাত দুইপাশে সরিয়ে, বসিয়ে দিতে হবে। তারপর ওপর দিয়ে মাছের মশলা সব দিয়ে আঁচ একেবারে কমিয়ে ঢাকা দিয়ে রান্না করতে হবে। কটা কিশমিশ দিতে হবে।

নামনোর সময়ে খুব সাবধান, মাছ ভেঙ্গে না যায়। সামান‍্য কাজু আর কিশমিশ দেওয়া একেবারেই ঐচ্ছিক।

কালিজিরার বদলে গোবিন্দভোগ, চিনিগুড়া বা বাসমতী চালও ব‍্যবহার করা যায়। প‍্যাপরিকার পরিবর্তে লাল লঙ্কার গুঁড়ো দেওয়া যায়, সেক্ষেত্রে ঝালটা কিন্তু বেশী না হয়ে যায় খেয়াল রাখতে হবে।

ছবিতে পুজোর ভোগে নিবেদন করা, ইলিশ পোলাও।



0

সম্পাদকীয়

Posted in








বাতাসে আবার সেই পরিচিত বাৎসরিক উৎসবের ছোঁয়া। বইমেলা দোরগোড়ায়। এবারের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল অনেক দেরিতে। পরিস্থিতি অনুকূল ছিল না। একটি ভয়াবহ অপরাধের আবহ আমাদের চিন্তন করে দিয়েছিল অবশ। উত্তাল হয়ে উঠেছিল এই নাগরিক সমাজ। সেই সূত্রে সদ্য যখন কোনও একজনের শনাক্তকরণ আর সাজা ঘোষণা হল, আমাদের বিবেকের পরিশুদ্ধি হল কি? অপরাধ প্রবণতার বাস মানুষের মনের গভীরতম বিন্দুতে। অনেক ক্ষেত্রে আদিম এজাতীয় প্রবণতা জিনগত। সভ্যতার আলো, তা সে যত জোরালোই হোক না কেন, এখনও পৌঁছয়নি নিকষতম সেই স্থানে।

এই মুহূর্তে দাঁড়িয়েও জোর গলায় নিজেদের সভ্য বলতে পারি কি? সম্প্রতি এক বিখ্যাত ব্যক্তির ওপর আততায়ী হামলা নিয়েও দেখা গেল রাজনৈতিক চাপানউতোর। অপরাধ এবং তার প্রেক্ষাপট কার্যত হয়ে পড়ল গৌণ।

বইয়েরই সম্ভবত একমাত্র সেই শক্তি রয়েছে, যা আমাদের ভাবনাকে করতে পারে যুক্তি আর ন্যায়সঙ্গত। দিতে পারে সৃজনশীল ডানা এবং অবশ্যই শুশ্রূষা করতে পারে রুগ্ন মনের। অপরাধের আঁতুড়ঘর যা।

সুস্থ থাকুন। সৃজনী থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান।
0

প্রচ্ছদ নিবন্ধ - রঞ্জন রায়

Posted in




















বলতে পারো বড়মানুষ মোটর কেন চড়বে,
গরীব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?

                                                                     --সুকান্ত


একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো’র ডেটা বলছে ২০২১ সালে আমাদের গোটা দেশে বিভিন্ন ঘটনায় খুন হয়েছে ২৯,২৭২ জন। অথচ, ‘বেপরোয়া গাড়ি চালানো’য় মারা পড়েছে ৪৩, ৪৯৯ জন। তাহলে যারা বেপরোয়া গাড়ি চালায় তারা সবচেয়ে বড় খুনি? কারা চালায় অমন ভাবে গাড়ি? গতির নেশায় মাতাল হয়ে!

এদের কাছে আছে বুঝি মস্ত হাওয়াগাড়ি?

আছেই তো, মার্সিডিজ, পোর্শে, বিএমডব্লিউ,? কাদের আছে? যারা কোটি টাকার গাড়ি কিনতে পারে, জন্মদিনে নাতিকে অমন গাড়ি উপহার দিতে পারে।

তারপর সেই গর্বিত নাতি বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে গাড়িতে বসে আর হাওয়াগাড়ি উড়ে চলে হাওয়ার বেগে, দুঃসাহসী ভ্রমণের পথে। পথচারীরা ঝড়ের সামনে শুকনো পাতার মত উড়ে যায়। আর ‘চক্রে-পিষ্ট আঁধারের বক্ষ-ফাটা তারার ক্রন্দন’-- কেউ শোনে না।

চালকের কখনও মনে হয়-- ‘অজস্র মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম’। সে গাড়ি থামায়, তবে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে। উদ্দেশ্য একটাই অপরাধ থুড়ি দুর্ঘটনার সাক্ষ্য মুছে ফেলা। নেমপ্লেট বদলে দেয়া, রক্তের দাগ ধোয়া, ড্রাইভার বদলে নেয়া।

কিন্তু পিষে দেয়া মানুষগুলো? যাদের সময়মত হাসপাতালে নিয়ে গেলে কিছুটা বাঁচার সম্ভাবনা ছিল? না, এরা হাওয়াগাড়ি থামিয়ে সেই লোকগুলোকে তোলে না। তাহলে যে দুর্ঘটনার দায় নিতে হবে! আদালতে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। বাজারে বদনাম হবে।

ব্যাপারটা বোধহয় আর একটু অন্যরকম।

আসলে এদের হয়তো কোন দোষ নেই। দোষ তাদের যারা গাড়ির সামনে এসে গেছল। হাওয়াগাড়ি তো হাওয়ার বেগেই চলবে।

তবুও সুর্য এখনও পূবে ওঠে, পশ্চিমে ডোবে।

তাই কিছু কেস খবর হয়। কিছু কেসে পুলিশ আসে, গ্রেফতার করে। জামিন হয়, মামলা চলে। মোটা টাকার অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। তারপর সবাই ভুলে যায়। ভোলে না নিহতদের পরিবার। ওরা ভগবানকে ডাকে আর আশা করে-- একদিন ন্যায়ের দণ্ড নামিয়া আসিবে।

দুর্ঘটনার ডিফেন্স

কেস খেলে এসবের জন্য বাঁধা ডিফেন্স আছে।

এক, আমি চালাচ্ছিলাম না, আমার ড্রাইভার চালাচ্ছিল।

--তাহলে ড্রাইভার জেলে যাবে। আমার অর্থদণ্ড হবে, ড্রাইভারের পরিবারকে মোটা টাকা দেয়া হবে। ওরা মুখ বুজে মেনে নেবে। একেবারে বজ্রসেন-উত্তীয় কেস!

দুই, আমি চালাচ্ছিলাম বটে, কিন্তু মদটা একটু বেশি গিলেছিলাম। চোখে আবছা দেখছিলাম। কাউকে চাপা দিয়েছি? আমার কিচ্ছু মনে নেই।

--এটা ভাল ডিফেন্স। সঙ্গে সঙ্গে আইন অনুযায়ী অপরাধের মাত্রা কমে যায়। কেসটা ধারা অনিচ্ছাকৃত নরহত্যা থেকে অসাবধানে মদ খেয়ে চালিয়ে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু, অর্থাৎ ধারা ৩০৪ থেকে ৩০৪এ হয়ে যায়।

আহা, বেচারি! ভালমানুষ। একটু নেশা হয়ে গেলে কী করবে? ও খুনি নয়।

ফলে দু’বছরের জেল এবং মোটা অর্থদণ্ড। অথবা প্রথম অপরাধের ক্ষেত্রে শুধু অর্থদণ্ড। কেউ জিজ্ঞেস করবে না-- এই অবস্থায় কেন গাড়ি চালিয়েছিলে বা তোমার কাজের পুরো দায়িত্ব কেন তুমি বইবে না?

তিন, আমি পূর্ণবয়স্ক নই। ১৮ পূর্ণ হতে এখনও চার দিন বাকি! আমার বিচার প্রাপ্তবয়স্কদের আইনে হবে না, জুভেনাইল বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের আইনে হবে।

--এই কেসে গার্জেনদের দু’বছরের জেল এবং মোটা অর্থদণ্ড হবে। গাড়িটির লাইসেন্স একবছরের জন্য বাতিল। আর আদরে বাঁদর হওয়া কুলতিলক যাবেন সংশোধনাগারে ,মানসিক কাউন্সেলিং এর জন্য—সেটা তার নিজের মাসির বাড়িও হতে পারে। আর তাকে কয়েকমাস বা এক বছর কমিউনিটি সার্ভিস করতে হবে।

সেটা কী জিনিস কেউ জানে না। কোন আইনে বলা নেই। সেটা কি মন্দিরে করসেবা? হাসপাতালে কাউন্টারে বসা? নাকি এক লক্ষ বার রামনাম লেখা? শুধু বিচারক জানেন। কিন্তু আদরে বাঁদর ছেলের কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ডের জন্য কোন ধনীর দু’বছরের জেল হয়েছে শুনেছেন কখনও? আমি তো শুনি নি। শুনলে বলবেন তো!

চেনা গল্পঃ চেনা ছক


রাজধানী দিল্লি; এপ্রিল ২০১৬। মার্কেটিং পেশার সিদ্ধার্থ শর্মা (৩২) কাজের শেষে বাড়ি ফেরার পথে নর্থ দিল্লির সিভিল লাইন্স এলাকায় একটি মার্সিডিজের নীচে পিষে গেলেন। যে ছেলেটি বাবার গাড়ি চালাচ্ছিল তার বয়েস ১৭ বছর ৩৬১ দিন। অর্থাৎ প্রাপ্তবয়স্ক হতে মাত্র চার দিন বাকি।

ছেলেটির লাইসেন্স ছিল না। পুলিশের রেকর্ড বলছে সে এর আগেও তিন বার ট্রাফিক আইন ভেঙে ফাইন দিয়েছে। তদন্তে দেখা যাচ্ছে যে ও ট্রাফিক পুলিশের কাছে তিনবারই ‘মিথ্যে’ তথ্য দিয়েছিল। ছেলেটির পরিবার তাদের বাড়ির ড্রাইভারকে থানায় পাঠিয়ে দিল –যাও, গিয়ে বল যে তুমিই তখন গাড়িটা চালাচ্ছিলে।

সিসিটিভির ফুটেজ, চাকার দাগ এবং প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে পুলিস বোঝে যে ছেলেটি সেদিন সন্ধ্যায় ট্রাফিক রুলে স্বীকৃত গতির চেয়ে বেশি স্পীডে গাড়ি চালাচ্ছিল।

পুলিস বলে নতুন আইন অনুযায়ী অপরাধীকে নাবালক নয়, প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে বিচার করা হোক। কিন্তু জুভেনাইল জাস্টিস অ্যাক্ট (২০১৫) অনুসারে সেটা সম্ভব যদি নাবালকের করা কাজটি ‘জঘন্য’ (heinous) অপরাধের শ্রেণীতে আসে। তাহলে শাস্তি - অন্ততঃ সাত বছরের জেল।

জুভেনাইল বোর্ড সব দেখেশুনে তার সাত পৃষ্ঠার রায়ে বলল—এই ছেলেটির বিচার প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেই হোক। ও যে কাজটা করেছে তার সম্ভাব্য ফলাফল সম্বন্ধে সে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। সে মানসিক এবং শারীরিক , দু’দিক থেকেই, এমন অপরাধ করতে সক্ষম।

ফেব্রুয়ারি ২০১৯শে দিল্লির এক দায়রা আদালত ওই মতেই সায় দিল। কিন্তু দিল্লি হাইকোর্ট এই রায় খারিজ করে দিলে নিহতের বোন শিল্পা শর্মা সুপ্রীম কোর্টে আপিল করে ।

সুপ্রীম কোর্টের মহামান্য বেঞ্চ (জাস্টিস দীপক গুপ্তা এবং অনিরুদ্ধ বোস) হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে মামলা খারিজ করলেন।

ওনাদের মতে ধারা পেনাল কোডের ৩০৪ লাগিয়ে মামলা দায়ের হয়েছে। অর্থাৎ নরহত্যার অপরাধ, কিন্তু মার্ডার বা খুন নয়। এটা ‘জঘন্য’ (heinous) অপরাধের শ্রেণীতে আসে না। তাই ছেলেটিকে প্রাপ্তবয়স্ক নয়, ‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ (জুভেনাইল) মেনে বিচার করতে হবে।

কেন আসে না?

কারণ, অপরাধ যদি ‘জঘন্য’ হয় তাতে ‘ন্যূনতম’ এবং ‘অধিকতম’ দুই শাস্তিরই উল্লেখ থাকে। কিন্তু এই ধারাতে শাস্তি হিসেবে খালি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা আছে। ‘ন্যূনতম’ কোন শাস্তির কথা বলা নেই। অর্থাৎ এই অপরাধ ‘জঘন্য’ শ্রেণীর নয়। অতএব, অভিযুক্তের বিচার জুভেনাইল কোড হিসেবেই হবে, পেনাল কোডে নয়।

বেশ, কিন্তু জুভেনাইল অ্যাক্টের ধারা ২(৩৩) বলছে ‘জঘন্য’ অপরাধ সেটাই যাতে পেনাল কোডে কম-সে-কম সাত বছরের জেল বলা রয়েছে। কিন্তু এতে সাত বছরের বেশি শাস্তি আছে, সাতবছরের কম বা কম-সে-কম কোনও শাস্তি নেই।

জাস্টিস গুপ্তা এটাও বললেন যে খারাপ লাগলেও আমাদের আইন মেলে চলতে হবে। মানছি আইনে ‘ফাঁক’ আছে। কিন্তু আইনে সংশোধন তো সংসদের কাজ, আমাদের নয়। যেখানে আইনের দু’রকম ব্যাখ্যা সম্ভব, সেখানে যে ব্যাখ্যয় নাবালকের জন্য ‘লাভ’ সেটাই মানতে হবে।

জুভেনাইল অ্যাক্টে ছেলেটির শাস্তি হতে পারে—গ্রুপ কাউন্সেলিং, কমিউনিটি সার্ভিস অথবা অর্থদণ্ড!

অভিযুক্ত আর একটা অতিরিক্ত দিনও গরাদের পেছনে কাটাবে না।

বিদ্বান ন্যায়াধীশদের ‘জঘন্য’ অপরাধের সংজ্ঞা নিয়ে এমন ব্যাখ্যায় আমার মত সাধারণ নাগরিক বুঝভম্বুল হয়ে যায়।



না, এসব নতুন কোন ঘটনা নয়, অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। তাই তো এত নিয়মকানুন, মোটর ভেহিকল অ্যাক্ট (১৯৮৮), তার সংশোধনী (২০১৯) এবং ইন্ডিয়ান পেনাল কোডে লোককে আহত করা, নিহত করা, ইচ্ছে করে চাপা দিয়ে মেরে ফেলা ইত্যাদি হয়েছে।

কিন্তু তাতে কি মূল ছবিটা কিছু বদলেছে?

এখন আমরা তিনটে ঘটনা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।

২.১ দিল্লির লোধী কলোনি, ১০ জানুয়ারি, ১৯৯৯

একটি বি এম ডব্লিউ গাড়ি তিনজন পুলিস অফিসার সমেত ছ’জনকে পিষে দিল। ঘটনাটি এরকমঃ

ভারতের নৌবাহনীর প্রাক্তন অ্যাডমিরাল নন্দার নাতি সঞ্জীব নন্দা গুড়গাঁওয়ে রাতভোর পার্টি করার পর তাঁর দুই বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে বি এম ডব্লিউ গাড়িটি চালিয়ে দিল্লি ফিরছিলেন। প্রচণ্ড গতিতে চলার কারণে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে লোধী কলোনির পুলিশ চেকপোস্টের ভেতরে ঢুকে পড়ে। দু’জন পুলিশ এবং অন্য দুই পথচারি সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। আরেকজন পুলিশ ও অন্য এক পথচারি হাসপাতালে মারা যায়। সপ্তম শিকার বেঁচে ওঠেন।

গাড়িটি একটু এগিয়ে থামে, ওঁরা টের পান যে চাকার নীচে লোক। তাঁরা চটপট গলফ লিংকের একটি বাড়িতে গাড়িটি দাঁড় করিয়ে বাড়ির চৌকিদারও ড্রাইভারকে নির্দেশ দেন গাড়ির বনেট ও বাম্পার পরিষ্কার করে ফেলতে।

ওই দুজনকেও পুলিশ সাক্ষ্য-প্রমাণ লোপাট করার অভিযোগে আদালতে পেশ করে।

ক’দিন পরে ঘটনার এক প্রত্যক্ষদর্শী এসে নিজের সাক্ষ্য দেয়। পুলিশ তিনবন্ধুর বিরুদ্ধে ‘culpable homicide not amounting to murder’এর মামলা রুজু করে।

(মানুষ মরতে পারে জেনেও কিছু করা এবং তার ফলে কারও মৃত্যু= culpable homicide বা নরহত্য্যা। কিন্তু যে নরহত্যা কাউকে মারার উদ্দেশে আগে থেকে ভেবে করা হয় সেটা খুন বা মার্ডার।

১৯৯৯ সালের বিচারে তিনজনই অভিযুক্তই ছাড়া পেয়ে যায়। কিন্তু এ’নিয়ে ফের বিচারের দাবি ওঠে।

২০০৮ সালের পুনর্বিচারে দিল্লির সেশন কোর্ট ২ সেপ্টেম্বর এদের দোষী সাব্যস্ত করে এবং দু’বছরের জেল হয়। এনডিটিভি’র স্টিং অপারেশনে ধরা পড়ে ডিফেন্স ল’ইয়ার সাক্ষীদের মোটা টাকা অফার করছে, আদালত তাদের চার মাসের জন্য লাইসেন্স রদ করে। বলা হয় যে গাড়ির গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১৪০ কিলোমিটার ।

কিন্তু অভিযুক্তরা সুপ্রীম কোর্টে আপীল করলে সর্বোচ্চ আদালত ৩ আগস্ট ২০১২ তারিখে এদের দু’বছর জেলে বিচার চলাকালীন জেলে কেটেছে বলে মুক্তির আদেশ দেয়। এছাড়া ৫০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড এবং দু’বছর কমিউনিটি সার্ভিস করার নির্দেশ দেয়।


২.২ কানপুরের কিশোর, সাতমাসের মধ্যে দু’বার লোককে গাড়িচাপা দেয়া!

গত বছর অক্টোবর মাসে কানপুর শহরের এক ১৫ বছরের কিশোর বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে গঙ্গা ব্যারেজের উপর সাগর নিষাদ এবং আশিস রাম চরণ নামের দুই ব্যক্তিকে মেরে ফেলে। সাত মাসও যায়নি ছেলেটি আবার ওইভাবে বাবার গাড়ি চালিয়ে চারজনকে গুরুতর আহত করেছে। ওই কিশোর কানপুর শহরের একজন নামজাদা ডাক্তারের সন্তান।

পুলিশ কমিশনারের বক্তব্যঃ ওরা বাবা সমানভাবে দোষী। কেন উনি নাবালক ছেলেকে গাড়ি চালাতে দিয়েছেন! তায় দু’জনকে মেরে ফেলার পর আবার!

ছেলেটিকে আপাততঃ জুভেনাইল হোমে পাঠানো হয়েছে। তবে ছ’মাস আগের মামলাটির ধারা বদলে আরও কড়া করা হয়েছে—ধারা ৩০৪ এ (অসতর্কভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষ মারা) থেকে ধারা ৩০৪ (নরহত্যা , তবে খুন নয়)।

২.৩ পুণের কুখ্যাত পোর্শে গাড়ি চালিয়ে দু’জনকে মেরে ফেলার কেস!

এবছর ১৯ মে, শহর পুণে।

প্রোমোটর দাদু আদরের নাতি বেদান্ত আগরওয়ালকে ১৭ বছরের জন্মদিনে একটি পোর্শে গাড়ি (দাম এক কোটির কম নয়) উপহার দিয়েছেন। নাতির ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। সে বন্ধুদের নিয়ে সারারাত উদ্দাম পার্টি করে ভোরের দিকে প্রচণ্ড গতিতে গাড়ি চালিয়ে পুণে শহরের কল্যাণী নগরে এক দু’চাকার বাহনকে ধাক্কা দেয়, দুজন আইটি প্রফেশনাল—অশ্বিনী কোস্টা এবং অনীশ অবধিয়া-- মারা যায়।

এক রাজনৈতিক নেতার হাসপাতালে ফোন এবং থানায় উপস্থিত হয়ে তদন্তকারীদের সঙ্গে কথার ফলে জুভেনাইল জাস্টিস বোর্ডের সুপারিশে ছেলেটি দুয়েক ঘণ্টায় জামিন পেয়ে যায়। তাকে শাস্তি হিসেবে বলা হয় যারবেদা ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে ১৫ দিন ডিউটি করতে এবং পথ সতর্কতা নিয়ে তিনশ’ শব্দের একটি রচনা লিখতে!

এরপর শুরু হয় কভার আপ! যাতে হাসপাতালের ডাক্তার থেকে পুলিশ প্রশাসন, জুভেনাইল বোর্ড, রাজনৈতিক নেতা –সবাই অপরাধী পরিবারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন।

দেখা যায় তার রক্তের নমুনা বদলে তার মায়ের রক্ত দেয়া হয়েছে। তার রিয়েল এস্টেট প্রোমোটর দাদু ড্রাইভারকে ঘরে বন্ধ করে ধমকে বলেন—তুমি দোষ নিজের ঘাড়ে নাও; বল তুমিই চালাচ্ছিলে—আমার নাতি নয়।

পুলিশ বলছে ওকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবেই বিচার করা হোক, সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফেরার আগে একটি বারে বসে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মদ খাচ্ছে, বিল দিয়েছে ৪৮০০০ টাকা।

জনরোষের ফলে পুলিশ ওর দাদু, মা, বাবা সবাইকে গ্রেফতার করে। এখন সবাই হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন। আর ছেলেটিকে হাইকোর্ট বলেছে জুভেনাইল বোর্ডেরসংশোধনাগারে নয়, তার পিসির বাড়িতে পর্যবেক্ষণে রাখতে—এটাই নাকি আইনসম্মত উপায়!

সরকারপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করতে ইচ্ছুক নয়। তবু পুলিশ বলছে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আপিল করবে। করবে তো?

বেপরোয়া গাড়ি চালানো আর

নবী মুম্বাইয়ের ঘটনাঃ এক ১৭ বছরের কিশোর সাত সকালে বাবার গাড়ি চালিয়ে ৬০ বছরের এক মহিলাকে মেরে ফেলে। এখানে ছেলেটি অপ্রাপ্তবয়স্ক, এবং তার ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই—তাই গাড়ির মালিকের শাস্তি হবে—তিনমাসের জেল এবং ১০০০ টাকা ফাইন। কিন্তু গাড়ির মালিক বাবা তো একমাস আগে মারা গিয়েছেন। তাহলে?

নয়ডার ঘটনাঃ

গত মে মাসের ঘটনা। প্রমোদ শর্মা সপরিবারে হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। গাড়ি চালাচ্ছিল তাঁর ১৭ বছরের ছেলে। গাড়িটি স্কুলগামী একটি মোটরবাইককে ধাক্কা দেয়। তাতে ১৫ বছরের অমন কুমার সঙ্গে সঙ্গে মারা যায়। সঙ্গের বাকি দুই ছাত্র হাসপাতালে।

৩ ‘সমরথ কো নাহি দোষ গোঁসাই’!

৩.১ হেমা মালিনীঃ বিজেপি’র মথুরা’র সাংসদ এবং মুম্বাই সিনেমার মহাতারকা

রাজস্থানের হাইওয়ে। জুন মাসের শেষ। হর্ষ খান্ডেলওয়াল সপরিবার মারুতি অল্টো চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সামনে একটা মোড় ঘুরতে হবে। ফাঁকা রাস্তা, তিনি ইণ্ডিকেটর দিয়ে গাড়ি ঘোরালেন। হঠাৎ পেছন থেকে প্রচণ্ড গতিতে একটি মার্সিডিজ গাড়ি এসে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা মারল। খান্ডেলওয়াল এবং তাঁর পত্নী আহত হলেন। তাঁর ছ’বছরের ছেলেটির দুটো হাত দুটো পা ভাঙল। দু’বছরের বাচ্চা মেয়ে চিন্নি গুরুতর আহত।

মার্সিডিজ থেমে গেছে। আরোহী হেমা মালিনী সামান্য চোট পেয়েছিলেন। খান্ডেলওয়াল দম্পতি চাইছিলেন গুরুতর আহত বাচ্চা দুটোকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হোক। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে হেমা’র কপালে সামান্য চোট লেগেছিল এবং ওঁরা অনুরোধে কর্ণপাত না করে মার্সিডিজ গাড়িটি ওখানেই ফেলে স্থানীয় বিজেপি নেতার গাড়িতে চড়ে ঝড়ের বেগে জয়পুর চলে গেলেন।

বাচ্চা মেয়েটি মারা গেল। বাকি সবাই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হর্ষ খান্ডেলওয়ালের মতে মার্সিডিজের স্পীড ছিল ঘন্টায় ১৫০ কিলোমিটার। পরে ড্রাইভার গ্রেফতার হয় বেয়াড়া স্পীডে গাড়ি চালানোর অভিযোগে।

হেমা টুইট করে বললেন—সব দোষ বাচ্চা মেয়ের বাবার। ও যদি ট্রাফিক রুল ভেঙে মার্সিডিজের সামনে না আসত তাহলে বাচ্চাটি বেঁচে যেত।

হাসপাতাল থেকে মেয়ের বাবা জবাব দিলেন—আমি রুল ভাঙিনি, আপনার ড্রাইভারকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। আমার দু’ বছরের বাচ্চা মেয়ে বেঁচে যেত যদি আপনি আপনার গাড়িতে বাচ্চাটাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌঁছে দিতেন।

না, ওঁরা হেমা মালিনীর থেকে কোন ক্ষতিপূরণ পান নি।

৩.২

‘বিগ বস’ সলমান খান এবং ফুটপাতে লোকচাপা

ঘটনার সংক্ষিপ্ত কালপঞ্জী

২৮/৯/২০০২

অভিনেতা সলমান খান মাঝরাতে ফুটপাথে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত মানুষের উপর তাঁর টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার গাড়ি চড়িয়ে একজনকে মেরে ফেলার এবং চারজনকে ঘায়েল করার অভিযোগে গ্রেফতার হলেন।

অক্টোবর, ২০০২- কেস খেলেন পেনাল কোডের ধারা ৩০৪ (নরহত্যা, কিন্তু খুন নয়)।

অক্টোবর, ২০০৩- মুম্বাই হাইকোর্ট ধারা বদলে ৩০৪এ করে দিল, অর্থাৎ নরহত্যা নয়, শুধু বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে দুর্ঘটনা, যাতে মৃত্যু হয়েছে।

৬ মে, ২০১৫- মুম্বাইয়ের দায়রা আদালত মদ খেয়ে বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগে শাস্তি দিল-- পাঁচ বছর জেল ।

সেদিনই মুম্বাই হাইকোর্ট অভিযুক্ত সলমানকে জামিন দিয়ে অন্তিম ফয়সালা পর্য্যন্ত শাস্তি স্থগিত করে দিল।

ডিসেম্বর, ২০১৫- মুম্বাই হাইকোর্ট প্রমাণের অভাবে সলমান খানকে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্তি দিল।

জুলাই ৫, ২০১৬—মহারাষ্ট্র সরকার ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টে আপিল করল। সেখানে ৮ বছর ধরে মামলা লম্বিত রয়েছে।

কিন্তু আসল তামাশা বুঝতে হলে নীচের টিপ্পনিগুলো দেখুন।

দুর্ঘটনার পর যখন জনমানস বিক্ষুব্দ তখন বলিউডি গায়ক অভিজিত ভট্টাচার্য মন্তব্য করলেন—ফুটপাথ কি শোবার জন্য?

আমার বিনীত প্রশ্নঃ ফুটপাথ কি গাড়ি চালানোর জন্য? তাও ফাঁকা রাস্তা ছেড়ে!

যুবক পুলিস কনস্টেবল রবীন্দ্র পাতিল সলমান খানের দেহরক্ষী নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনিই ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০০২ তারিখে জবানবন্দী দিয়েছিলেন যে গাড়ি চালাচ্ছিলেন সলমান নিজে, তাঁর ড্রাইভার নয়।


কিন্তু মহামান্য মুম্বাই হাইকোর্ট তাঁর সাক্ষ্যকে নির্ভরযোগ্য মানলেন না। কেননা, তিনি গোড়ায় সলমানের মদ্যপানের কথা বলেননি। তিনদিন পরে ১ অক্টোবর তারিখে বললেন যে মত্ত সলমানকে তিনি গাড়ি চালাতে বারবার নিষেধ করেছিলেন।


বলা হয়, পাতিলের উপর বয়ান বদলে দেবার প্রচণ্ড চাপ ছিল। শুনানিতে পাঁচবার অনুপস্থিত থাকায় আদালত তাঁর নামে ওয়ারেন্ট জারি করে। ডিউটিতে গরহাজির থাকায় পুলিশ বিভাগ প্রথমে সাস্পেন্ড, পরে ডিসমিস করে।


পত্নী ডিভোর্স দেয়, বাবা-মা অজ্ঞাত কারণে তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করে।


২০০৭ সালে তাঁকে রাস্তায় পড়ে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়, তিনি তখন যক্ষ্মারোগে মরণাপন্ন। শেষে ৪ অক্টোবর, ২০০৭ তারিখে মাত্র ৩০ বছর বয়সে তিনি মারা যান।


তাঁর শেষ কথাঃ “আমি শেষ পর্য্যন্ত বয়ানে কোন পরিবর্তন করি নি। কিন্তু আমার ডিপার্টমেন্ট আমার সঙ্গে রইল না। আমি চাকরিতে ফেরত যেতে চাই, বাঁচতে চাই। একবার পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করতে চাই”।


রবীন্দ্র পাতিল ছিলেন ‘মুখ্য সাক্ষী’। অনেকের সন্দেহ, মূল শুনানির সময় তাঁকে জোর করে আটকে রাখা হয়েছিল যাতে তিনি আদালতে উপস্থিত হতে না পারেন।

সলমানের ড্রাইভারঃ বয়ান বদল

সলমানের ড্রাইভার অশোক সিং ১৩ বছর বাদে হঠাৎ বয়ান বদলে বললেন—গাড়ি নাকি তিনিই চালাচ্ছিলেন, সলমান নয়। আরও বললেন যে টায়ার ফেটে যাওয়ায় গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফুটপাতে উঠে গেছল।


কিন্তু সরকারি পক্ষ জোর দিয়ে বলে—এটা ডাহা মিথ্যে। এস ইউ ভি গাড়ির টায়ার ওভাবে ফেটে যায় না।

তারপর অশোক সিংকে আদালতে মিথ্যে বলার জন্য গ্রেফতার করা হয়।

যাঁরা বেখেয়ালে গাড়ি চালানোর শিকারঃ

২৮ সেপ্টেম্বর,২০০২ এর রাতে ফুটপাতে শুয়েছিলেন পাঁচজন। গাড়ি রাস্তায় ওঠায় তৎক্ষণাৎ মারা পড়েন নুরুল্লা শরীফ। বাকি আহত চারজনের কারও কারও পা পিষে যায়। ওদের মতে সলমান চালকের আসন থেকে ডানদিকের দরজা দিয়ে নেমে আসেন।

সলমানের বক্তব্য অন্যদিকের দরজা নাকি জ্যাম হয়ে গেছল। সলমান মুক্তি পাওয়ায় ওঁরা কিছু আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলেন, পেয়েছেন বলে জানা যায় নি।

উপসংহার

আমরা নব্বইয়ের দশক থেকে বর্তমান বছর পর্য্যন্ত এতগুলো কেসের বিহঙ্গম দৃষ্টিতে পর্যালোচনা করলাম। যা মনে হল—বড়মানুষের গাড়িতে সাধারণ মানুষ চাপা পড়লে কিছু আশা না করাই ভাল।

পুলিশের প্রাক্তন উচ্চপদের আমলা শ্রী কিরণ বেদীর টুইটারের বক্তব্যটি আপাতত শেষকথা বলেই মনে হয়।

“ ইফ ইউ আর এ ভিআইপি, সেলিব্রিটি, প্রিভিলেজড্‌, রিচ অ্যান্ড ইউ ক্যান অ্যাকসেস বেস্ট লীগ্যাল এইড, ইউ ক্যান অ্যাভয়েড জেল’।
0

প্রবন্ধ - সমরেন্দ্র বিশ্বাস

Posted in




















চক্র বলতেই মনে আসে ছোটবেলায় ঠাকুরঘরে দেখা ফটোফ্রেমে বিষ্ণু ভগবানের হাতে এক মারাত্মক অস্ত্রের কথা – সুদর্শন চক্র! কিংবা বিনয় মজুমদারের কবিতা – ‘ফিরে এসো চাকা’! কেউ কেউ কথায় কথায় বলে ফেলেন – লোকটার ভাগ্যচক্র খারাপ চলছে। স্কুলের খাতায় একটা শিওর-শট প্রশ্ন – মেঘবৃষ্টি কিংবা প্রকৃতির ঋতুচক্র বর্ণনা করো। মহাভারতের সেই দৃশ্য, বীর কর্ণর রথযাণের চক্র মৃত্তিকাতে নিমজ্জিত; অর্থাৎ রথের চাকা মাটিতে বসে গেছে – গাড়ী এগোচ্ছে না, মৃত্যু অবধারিত! অতএব দেখা যাচ্ছে ‘চক্র’ বিষয়টা একটা বিশাল ব্যাপার। তাই ‘চক্র’ নিয়ে লিখতে গেলে ধন্ধ লাগে, কি ভাবে লিখবো, কতটা লিখবো। তাই ভাবছি, ‘চক্র’ নিয়ে বলতে বসে এখানকার মূল আলোচনাটা যান্ত্রিক ‘চক্র’কেই নিয়ে হোক। অতএব, আলোচনা শুরু করা যাক গাড়ীর চাকাকে নিয়ে।

চাকার কথা

দৈনন্দিন জীবনে আমরা সবাই চাকার সঙ্গে পরিচিত। একটা বৃত্তাকার গোলাকৃতি বস্তু , যা তার কেন্দ্রের(Centre) চারদিকে ঘুরতে পারে। কিন্তু এই চাকা কি নিজে নিজেই ঘুরবে? না, তা হয় না। এই ঘোরানোর জন্যে চাই একটা শক্তি। গাড়ীর চাকাকে ঘোরানোর জন্যে তাই থাকে ইঞ্জিন। ইঞ্জিনের উৎপন্ন শক্তি কিছু যান্ত্রিক ব্যবস্থার (গীয়ার, লিঙ্ক ইত্যাদি) সাহায্যে চাকাটাকে ঘোরাতে পারে।

একটা গোলাকার গাছের-গুড়ি ঢালু সমতল রাস্তায় রেখে দাও, সেই গুড়িটা নিজের কেন্দ্র বা অক্ষের (Axis) চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে গড়িয়ে গড়িয়ে নীচের দিকে যাবে। এক্ষেত্রে গোলাকার জিনিষটাকে ঘূর্ণনে যে সাহায্য করলো, সেটা অভিকর্ষীয় বল (Gravitational Force)। গরুর গাড়ীর চাকা ঘুরছে, গাড়োয়ানের গাড়ী এগোচ্ছে, সেক্ষেত্রে কাজ করছে গরুর শরীরের পেশী শক্তি – যাকে আমরা বলতে পারি প্রানীর ভেতর থেকে উদ্ভুত একটা যান্ত্রিক শক্তি (Mechanical Energy)। গরুর গাড়ীর চাকার ক্ষেত্রে চাকা যে ঘুরছে , ( না-ঘুরে ঘষটাচ্ছে না) তার জন্যে জরুরী মাটি ও চাকার সংযোগস্থলে ক্রিয়াশীল একটা ঘর্ষণ-জনিত বল (Frictional Force)। মাটিতে বা রাস্তায় চাকাকে ঘোরাবার জন্যে এমন একটা ঘর্ষণ-জনিত বল সব সময়ে জরুরী। কখনো কি দেখেছো, একটা ট্রাকের চাকাগুলো নরম পিছলা কাদা মাটিতে ঘুরেই যাচ্ছে, মানে চাকা স্কীড করছে। এখানে মাটি নরম থাকার জন্যে চাকা ও রাস্তার সংযোগস্থলে ঘর্ষণ-জনিত বলটা কাজ করছে না। তাই চাকা ঘুরছে না, গাড়ী এগোচ্ছে না। সে এক হ্যাপা! চাকাগুলোর নীচে ইট রাখো, পাথরের নুড়ি ঢালো, নইলে কাঠের তক্তা রাখো। এবার হয়তো চাকা স্লীপ না করে গাড়ীটা এগিয়ে আসবে।

এই চাকার উদ্ভব বা আবিষ্কারের ইতিহাসটা কি? সে একটা জটিল প্রশ্ন! যেমন কেউ যদি জিজ্ঞেস করে মানব সভ্যতার জন্ম ও বিকাশের কালপঞ্জী বা ইতিহাসের কথা। তবে মনে করা হয় চাকার আবিষ্কার খ্রীষ্টের জন্মের দশ হাজার বছর আগেই (10000BC) হয়ে গেছিলো – যে যুগটাকে নিউলিথিক এজ বলা হয়। অন্যমত হিসেবে কেউ কেউ বলে থাকে খ্রীষ্টের জন্মের পাঁচ হাজার বছর আগেই (5000BC) মেসোপটেমিয়াতে প্রথম চাকার আবিষ্কার হয়।

কবে প্রথম চাকার আবিষ্কার হয়েছিলো, সে বিতর্কে যাবার দরকার নেই। বরং কল্পনায় দেখা যাক সেই আদিম মানুষগুলোকে, যাদের মাথায় প্রথম চাকার ধারণা এসেছিলো। একদিন সেই মানুষগুলো একটা ভারী গোল পাথরের চাই ঠেলতে চেষ্টা করছিলো , তারা সেটা করতে পারছিল না, পাথরটা এত ভারী যে সেটা এক অসম্ভব কাজ। তখন সেই মানুষগুলো নজর গেল সেরকমই আরেকটা গোলপাথরে, সেটা রাখা ছিল একটা খাড়া করে রাখা থালার মতো, বৃত্তীয় পাথরের পরিধিটা ছিলো জমি ছুঁয়ে। একটু ঠ্যালা দিতেই সেই পাথরটা অনায়াসে গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। পাথরটা নিজের কেন্দ্র বা অক্ষের চারপাশে কেমন সহজেই ঘুরে যাচ্ছে। তাকে ঠেলতে তেমন বেগ পেতে হচ্ছেনা। সেই হলো মানুষের বোধগম্য প্রথম চাকা!

কিংবা ধরা যাক, একটা বিশাল মোটা গাছের গুড়িকে লোকগুলো টেনে নিয়ে যেতে যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো; তখন কেউ বললো , এটাকে গড়িয়ে গড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হোক। তখন দেখা গেলো টেনে নেয়ার বদলে গাছের গুড়িটাকে চাক্কার মতো ঠেলতেই সেটাকে অনেক সহজেই এগিয়ে নেয়া যাচ্ছে। ব্যাস, সেইসব প্রাচীন দিনগুলোতে এমনি ভাবেই চলে এলো চাকার ধারনা। হয়তো আদিম ইতিহাসে চাকাকে এমনি ভাবেই প্রথম আবিষ্কার করা হয়েছিলো। এরপরে নানা পরিবর্তন ও নানা পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সেদিনের সেই আবিষ্কার আজকের বর্তমান চাকার চেহারা নিয়েছে।

সেই সব মানুষগুলো যারা পাথর ঠুকে প্রথম আগুন জ্বালিয়েছিলো, কিংবা যারা গড়িয়ে দেয়া পাথরের চাকতির মধ্যে চাকার যান্ত্রিক সুবিধা আবিষ্কার করেছিলো, তাদের কোন সঠিক ইতিহাস নেই। তবুও এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় সভ্যতার প্রথম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিল আগুন জ্বালানো । তার অনেক অনেক পরে সভ্যতার আরেক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার হোল চাকার ব্যবহার, যার যান্ত্রিক সুবিধাকে নিজেদের মতো করে কাজে লাগানো গেল।

বানরের চেহারা থেকে নানা পরিবর্তনের পর মানুষের আধুনিক চেহারা এসেছে; তেমনি চাকার প্রাচীন চেহারার সঙ্গে তার বর্তমান চেহারার প্রচুর তফাৎ। একদম প্রথম যুগে ঠেলা গাড়ি বা রথের চাকায় ব্যবহৃত হতো নিরেট (Solid) কাঠের চাকতি। এখনকার গরুর গাড়ীর চাকার মতো স্পোকয়ালা হালকা ডিজাইন তখন ছিল না। একটা নিরেট কাঠের চাকা ওজনে খুব ভারী, তার তুলনায় গরুর গাড়ীর কাঠের চাকা ওজনে অনেক হাল্কা। হালকা চাকাকে টানতে বলও(Force) কম লাগে।

কালে কালে বিকাশের ধারায় কাঠের চাকার জায়গা দখল করলো লোহার চাকা। লোহা বলতে তখন ঢালাই লোহার (কাষ্ট আয়রণ)ব্যবহার ছিল। এরপর এলো স্টীলের চাকা, যা তুলনামূলক হাল্কা। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটা হাল্কা স্টীল নির্মিত সাইকেলের চাকা, সরু সরু স্টীলের স্পোক লাগিয়ে যেটাকে প্রয়োজনীয় ভাবে মজবুত করা হয়েছে। কোন কোন গাড়ীতে স্টীলের চাকা দেখা যায়, তার চারপাশে রাবারের আস্তরণ বা লাইনিং লাগানো। চলতে গেলে মসৃণ রাস্তায় চাকা যাতে স্লিপ না করে, গাড়ী যাতে বরাবর এগোয়। এরপরে দেখা গেলো মোটর কার বা ট্রাকের টায়ার, এতে হালকা স্টীলের রিম, মাঝে হাওয়া ভরা টিউব আর বাইরে রাবারের মজবুত টায়ার। চাকার নামে খুলে গেল বড় বড় টায়ার কোম্পানী – ডানলপ, এম-আর-এফ ইত্যাদি। আজকাল তো চারচাক্কার যে সব মোটরগাড়ীগুলো আসছে, সেগুলোতে আছে টিউবলেস টায়ার, মাঝে হাওয়া ভরার জন্যে আলাদা করে টিউবের দরকার নেই।

প্রযুক্তি কেমন পালটে যায়। এক জামানায় ঠেলা গাড়ীর চাকার অক্ষ(Axle) ফিট করা থাকতো বিনা বিয়ারিং-এ, একটা গর্তের মধ্যে। বিজ্ঞান এখন অনেক উন্নত, যে কোন চাকার সাথে এখন লাগানো থাকে বিয়ারিং, যাতে কম শক্তি খরচ করে, কম মেহনতে চাকাটাকে ঘোরানো যায়।

চক্রের বিভিন্ন ব্যবহার

এবারে দেখা যাক, চক্রকে আমরা কি কি ভাবে কাজে লাগাতে পারি। গাড়ির চাক্কা ছাড়াও যে যে সব ক্ষেত্রে চক্রের ব্যবহার দেখা যায়, সেগুলোকে এক এক করে উল্লেখ করা যাক।

I. কুমার-এর চাকা – মাটির ভার, গ্লাস বা পাত্র তৈরী করতে একে ব্যবহার করা হয়। জমির সমান্তরালে ঘুরতে থাকা চাকাটির ঘূর্ণনের সাহায্যে কুমার মাটির পাত্র তৈরী করে।

II. চৌবাচ্চা থেকে জল তোলবার সময় আমরা দেখেছি পুলির (Pulley) ব্যবহার। যেকোন ভারী জিনিষ তোলার জন্যে পুলি নামক চাকাটির ব্যবহার খুব সুবিধাজনক। যে কোন ক্রেনেও এই ধরনের পুলির ব্যবহার সব সময় দেখা যায়।

III. যাতায় শস্য পেশাই করা। সেখানেও ব্যবহৃত হচ্ছে দুটো পাথরের চাকা।

IV. পুরাণো দিনের ছবিতে দেখেছি সেচের জন্যে তৈরী হয়েছে বিরাট চক্র, তাতে বালতির মতো পাত্র (Bucket) পর পর লাগনো। এদিয়ে নদী থেকে জল তোলা হতো। চক্রটা ধীরে ধীরে ঘুরলে একদিকের বালতিতে যখন নদীর জল ভরতো, তখন অন্যদিকের বালতির ভরা জল জমিতে খালি হতো। এরকমই ছিল পুরোনো দিনের সেচ-ব্যবস্থা।

V. বর্তমান যুগ হচ্ছে মেশিনারীর যুগ। যেকোন মেশিন খুললেই যে সব যন্ত্রাংশ পাওয়া যাবে তাতে অনেক রকম কলকব্জার মধ্যে থাকে বিশেষ ভাবে ডিজাইন করা দাঁতয়ালা চাকা, যেগুলো ঘুরতে থাকে। এই গুলোকে বলা হয় গীয়ার – যা কিনা এক ধরণের চক্র।

VI. তাপ বিদ্যুত বা জল বিদ্যুত কেন্দ্রে টারবাইন ঘুরছে। এই টারবাইনের ভেতরে যেটা থাকে , সেটাও একধরনের ব্লেডয়ালা চাকা । এই টারবাইনের নিয়ন্ত্রিত ঘূর্ণনের ফল হিসেবেই বিদ্যুত তৈরী হয়।

VII. জাহাজ চলছে , বিমান উড়ছে। এখানেও আমরা দেখি ‘প্রপেলার’ নামক চক্রের ব্যবহার।

VIII. জল সরবরাহের জন্যে যেসব বড় বড় পাম্প থাকে, যা দিয়ে প্রেসারে জল পাঠানো যায়, সেসব পাম্পেও থাকে একধরনের ব্লেডয়ালা চক্র।

IX. নাগরদোলা – বাচ্চারা বড়োরা মেলার মাঠে নাগরদোলায় বসে চেঁচাচ্ছে। নাগরদোলার এই যে মজা, চক্র আবিষ্কৃত না হলে তা কি সম্ভব ছিলো?

X. ষ্টীয়ারিং হুইল – আমরা তো হামেশাই কার চালাই, গাড়ী চালানোর জন্যে সামনেই যে ষ্টীয়ারিংটা থাকে , সেটাও তো একটা চাকা।

XI. যে পায়ে-পঙ্গু মানুষটা নিজের হাতে হুইল-চেয়ারে এক যায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, লক্ষ করো, সেখানেও একাধিক চাকার ব্যবহার রয়েছে। মানুষটা যেটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হুইল-চেয়ারটাকে সামনে পেছনে করছে, সেখানেও একটা সরু স্টীলের চাকা বা ষ্টীয়ারিং , যেটা লোকটার হাতে, তার আসহায়তার অবলম্বন।

এমনিভাবেই খুঁজে নিলে দেখা যাবে চাকা বা চক্রের অজস্র ব্যবহার!

অন্যান্য কিছু চক্রের কথা

আমার ‘চক্র’ নিয়ে এই লেখা পড়ে এক তান্ত্রিকমশাই তো খুব ক্ষেপে গেলেন! আপনি ইঞ্জিনীয়ারের চোখ দিয়েই শুধু ব্যাপারগুলো দেখেছেন, আপনার চক্র নিয়ে আলোচনাটা শুধুমাত্রই মেশিন আর গতিতে সীমাবদ্ধ রাখছেন, কেন ? আপনি কি জানেন ভৈরবচক্র, কুন্ডলিনী চক্রের কথা? জানেন, মানবদেহে এসবের ব্যবহার ঈশ্বর নির্দিষ্ট!

আসলে তন্ত্র মন্ত্রের এই সব চক্রের ব্যপারে আমার কোন ধারণা নেই। আমি ঈশ্বর-বিশ্বাসী নই। তাই তান্ত্রিকমহোদয়ের ভৈরবচক্র, কুন্ডলিনী চক্রের উত্তর দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও মনে হয় লেখা শেষ করবার আগে চাকার যান্ত্রিক ব্যবহার ছাড়াও, আরো কিছু চক্রের কথা এখানে উল্লেখ করে দেয়া উচিত; যাতে পাঠকেরা এই নিবন্ধে আমার গতিবিদ্যা ও যান্ত্রিক সুবিধাবাদী লেকচারে ক্ষেপে না যায়।

বৃষ্টি চক্রের কথা তো আমরা জানি। জল-বাষ্প-মেঘ-বৃষ্টি-জল – এমনি ভাবেই তার ঘুরে ঘুরে আসা। জন্মচক্রের কথা বললেই মনে পড়ে জন্ম, শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য – এও এক আশ্চর্যজনক চক্র , যার কোন কিছুকেই আমরা এজীবনে বাদ দিতে পারিনা। এবারে আসি মেয়েদের মাসিক চক্রের কথায় – ঘুরে ঘুরে কি এক নিয়মে মহিলারা যৌবনে ঋতুমতী হয়। আমাদের ভেতরে যে রক্ত সংবহন পদ্ধতি সেটাও তো একটা চক্রের নিয়মে চলে। প্রজাপতির জীবনচক্র যদি ধরি, তবে তো শুয়োপোকা – গুটি - ডানা মেলা পতঙ্গ – সব মিলিয়ে কি অদ্ভুত ভাবে চক্রবৎ এই প্রজাপতির জন্মকথা। আবহাওয়া আর ঋতুচক্রকে বাদ দেই কিভাবে – এই যে বছরে বছরে পালা করে ছ’টা ঋতু – গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত, বসন্ত – এও এক অদ্ভুত চক্র, চাইলেই কি এর কোন কিছুকে আমাদের জীবন থেকে বাদ দেয়া যায়? আর সবচেয়ে আশ্চর্য হচ্ছে এই মহাকাশ, গ্রহমন্ডল। সেখানে চক্রবৎ গ্রহ , উপগ্রহ এসবের পরিক্রমা, জোয়ার ভাঁটা, পূর্ণিমা- অমাবস্যা। চক্রের অধীনে এমনি আরো কত যে বিস্ময়- এসব কিছু পরোপুরি জানতে আমাদের আরো অনেক সময় লেগে যাবে।
0

প্রবন্ধ - অম্লান রায় চৌধুরী

Posted in







মনযোগের অর্থনীতি এক নতুন ধারণা। আমরা দেখেছি মনযোগ দিয়ে কাজ করলে কাজ ভালো হয় , ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে, এছাড়াও দেখেছি যে কাজের বাঁধা সময়ের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করা যায় , মনযোগের ফলে।

মার্কিন মনোবৈজ্ঞানিক সমিতির সংজ্ঞা অনুযায়ী "মনোযোগ হল এমন একটি মানসিক অবস্থা, যাতে সংজ্ঞানীয় সম্পদগুলি পরিবেশের অন্য সব দিক বাদ দিয়ে কিছু বিশেষ দিকের উপরে কেন্দ্রীভূত হয়।"

আরেকটি সংজ্ঞা অনুযায়ী "মনোযোগ হল কোনও বিশেষ তথ্যের উপরে কেন্দ্রীভূত মানসিক সংযোগ। তথ্য আমাদের চেতনায় আসে, আমরা বিশেষ কোনও তথ্যের প্রতি মনোযোগ দেই এবং এরপরে সিদ্ধান্ত নেই কোনও পদক্ষেপ নেব না কি নেব না।"

মনোযোগ একটি সীমিত সম্পদ। কেন দেখা যাক ।

বর্তমানে আধুনিক তথ্য যুগে এসে প্রায় সবার আন্তর্জাল তথা ইন্টারনেট সংযোগ থাকার সুবাদে বিপুল পরিমাণ ডিজিটাল বিষয়বস্তু (তথ্য, সাহিত্য, শিল্পকলা) তাৎক্ষণিকভাবে সুলভ এমনকি বিনামূল্য হয়ে পড়েছে।

কিন্তু মানুষের মনে তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ক্ষমতার কোনও পরিবর্তন হয়নি। প্রতিদিন সময়ের পরিমাণ এক মিনিটও বাড়েনি। ফলে তথ্য নয়, বরং মনোযোগ একটি সীমিতকারী নিয়ামকে পরিণত হয়েছে। প্রচুর তথ্য , মনযোগের সময় সীমিত – কাজেই টানাটানি ।

তাত্ত্বিকভাবে পরিমাপযোগ্য না হলেও কোনও একটি বিশেষ বিষয়ের উপরে মানুষ কতটুকু সময় মনোযোগ দান করে, তার উপর ভিত্তি করে মনোযোগের একটি মূল্যমান বের করা সম্ভব।

ইংরেজিতে "মনোযোগ দিয়ে পরিশোধ" (টু পে অ্যাটেনশন) নামক যে পদবন্ধটি আছে, তা থেকে বোঝা যায় মনোযোগ একটি সীমিত মানসিক সম্পদ, যার অর্থনৈতিক মূল্য আছে।

একটি বিষয়ে মনোযোগ দিলে অপর দিকে সেটি দেওয়া সম্ভব নয়।

সবার কাছে এখন এত বেশি তথ্য লভ্য হয়ে পড়েছে যে এর ফলে মনোযোগ ব্যবহার করে সবচেয়ে মূল্যবান তথ্যটি বের করে নিয়ে অপ্রাসঙ্গিক খুঁটিনাটি বাদ দেওয়ার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

১৯৭১ সালেই মার্কিন মনোবিজ্ঞানী ও নোবেল স্মারক পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ হার্বার্ট সাইমন ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন যে "একটি তথ্য-সমৃদ্ধ বিশ্বে তথ্যের প্রাচুর্যের ফলে অন্য কিছু ঘাটতির সৃষ্টি হবে, যা হল তথ্য যা কিছু ভোগ করে। তথ্য কী ভোগ করে, তা স্পষ্ট প্রতীয়মান: তথ্য তার গ্রাহকের মনোযোগ ভোগ করে।

সমসাময়িক তথ্য যুগে এসে পরিগণক যন্ত্র (কম্পিউটার), বুদ্ধিমান মুঠোফোন (স্মার্টফোন) ও আন্তর্জাল (ইন্টারনেট) সবার হাতের কাছে চলে আসায় তথ্য আর কোনও মূল্যবান সম্পদ নয়, বরং মানুষের মনোযোগ হল তার চেয়ে বেশি মূল্যবান। এ কারণে তথ্যপ্রযুক্তি দানব প্রতিষ্ঠানগুলি (যেমন গুগল, মেটা, অ্যাপল, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট) প্রায় বিনামূল্যে তাদের তথ্য সরবরাহ সেবাটি প্রদান করে থাকে। ব্যবহারকারীরা তাদের মনোযোগ দিয়ে (অর্থাৎ মোটা দাগে কতটুকু সময় তারা ঐ সব প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল মঞ্চে ব্যয় করছে) ঐসব প্রতিষ্ঠানকে লাভবান করে। ব্যবহারকারী যত বেশি সময় কোনও ওয়েবসাইটে বা আন্তর্জাল মঞ্চে ব্যয় করবে, তাকে কোনও কিছু ক্রয় করতে প্ররোচিত করা তত বেশি সহজ হয়ে উঠবে।

এ কারণে কোনও কোনও বিশ্লেষক ২১শ শতকের প্রথম দুই দশককে "তথ্য অর্থনীতি" না বলে "মনোযোগের অর্থনীতি" হিসেবে অভিহিত করেছেন।

গোল্ডহেবারের মতে ২০শ শতকের শেষে এসে উন্নত বিশ্বের শ্রমশক্তির একটি তাৎপর্যপূর্ণ অংশ আর ভৌত পণ্য উৎপাদন, পরিবহন ও বিতরণের সাথে জড়িত নয়, বরং তারা তথ্যের কোনও না কোনও রূপ ব্যবস্থাপনা করে জীবিকা নির্বাহ করে।

এই নতুন অর্থনীতির নাম দেওয়া হয় "তথ্য অর্থনীতি"।

কিন্তু তার মতে এই উপাধিটি সঠিক নয়। অর্থনীতি হল কোনও সমাজ তার দুষ্প্রাপ্য সম্পদগুলি কীভাবে ব্যবহার করে, সে সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড। কিন্তু আধুনিক তথ্যযুগে এসে তথ্য কোনও দুষ্প্রাপ্য সম্পদ নয়, বরং তথ্য বাতাসের মত সর্বক্ষণ ও সর্বব্যাপী বিদ্যমান। অন্যদিকে আন্তর্জালে সত্যিকার অর্থে যে জিনিসটি দুষ্প্রাপ্য, তা হল মানুষের মনোযোগ। তাই স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাল জগতের অর্থনীতির মূল বিনিময় মুদ্রা হল মনোযোগ, তথ্য নয়।

নতুন আন্তর্জাল অর্থনীতিতে সেবাগ্রাহক বা ব্যবহারকারীর মনোযোগ যে অর্থের সমতুল্য, তার একটি উদাহরণ হল আন্তর্জাল ভিত্তিক সরাসরি সঙ্গীত পরিবেশনা মঞ্চ স্পটিফাইয়ের মূল্য পরিশোধ পদ্ধতি।

প্রাথমিকভাবে গ্রাহকেরা স্পটিফাইয়ের বিনামূল্যের একটি সংস্করণ ব্যবহার করতে পারেন, কিন্তু এর বিনিময়ে তাদেরকে গান শোনার ফাঁকে ফাঁকে বাধ্যতামূলকভাবে কিছুক্ষণ বিজ্ঞাপন শুনতে হয়, নইলে পরবর্তী গান শোনা যায় না।

এভাবে ব্যবহারকারীরা তাদের মনোযোগকে মুদ্রা হিসেবে ব্যবহার করে স্পটিফাইয়ের সেবার মূল্য পরিশোধ করেন।

কিন্তু স্পটিফাইয়ের দ্বিতীয় একটি সংস্করণে যদি ব্যবহারকারী অর্থের দ্বারা মাসিক একটি মূল্য পরিশোধ করেন, তাহলে তাকে আর কোনও বিজ্ঞাপন শুনতে হয় না।

এভাবে মনোযোগকে বিনিময়যোগ্য সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করে স্পটিফাই গ্রাহক ধরে রাখে ও ভবিষ্যত অর্থ-পরিশোধকারী গ্রাহক সৃষ্টি করে।

আমাদের কাছে পড়ে রইল কেবল নিজের বুদ্ধিমত্তা আর মনযোগ – সেটাকেই না হয় শান দেই – ধারালো করি , তথ্য তো আসবেই বিনামূল্যে।