Next
Previous
0

ধারাবাহিক - রঞ্জন রায়

Posted in





















১৯.১

জানুয়ারী মাসের আদ্দেক পেরিয়ে গেছে। এরপর ফেব্রুয়ারি এলে গ্রামসভার নির্বাচন হবে। ফের মার্চ মাসে হাইস্কুল আর ইন্টারমিডিয়েট কলেজের পরীক্ষা শুরু হবে। এই নির্বাচন একদিকে শনিচর ও বদ্রী পালোয়ানের কুস্তির আখড়াকে এবং অন্যদিকে রামাধীন ভীখমখেড়ী ও তার জুয়াড়ি সেনাপতিদের প্রজাতন্ত্রের সেবা করতে ফাঁসিয়ে দিয়েছে। এখন পর্য্যন্ত এদের সেবা করার বিশেষ পদ্ধতি বলতে যা দেখা যাচ্ছে তা হল বিরোধী দলকে পর্দার পেছনে গালমন্দ করা।

সবার আশা ফেব্রুয়ারি এসে গেলে এসব মুখোমুখি শুরু হবে। মার্চের পরীক্ষার কথা? এখনও কেউ ফাঁসে নি। ছাত্রের দল, অধ্যাপককুল, বিশেষ করে প্রিন্সিপাল সাহেব –কারও কোন হেলদোল নেই।

কিন্তু প্রিন্সিপাল সাহেব অন্য এক মামলায় ফেঁসে গেছেন। কিছুদিন আগে, কলেজ কমিটির বার্ষিক সভায় বৈদ্যজীকে সর্বসম্মতিতে ফের ম্যানেজার নির্বাচিত করা হয়। এটা নিয়ে কিছু সদস্য শিক্ষামন্ত্রীর কাছে নালিশ করেছেন। ওদের বক্তব্য—প্রস্তাবের বিরোধী সদস্যদের সভায় ঢুকতেই দেওয়া হয়নি, বরং আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে ধমকানো হয়েছিল।

এই কথাটা চিঠিতে এত ফেনিয়ে লেখা হয়েছে যে ওটা পড়াই এক কঠিন কাজ। আর পড়লেও বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ, চিঠির পুরো বিবরণ সত্যি হলে মেনে নিতে হয় যে শিবপালগঞ্জে কোন নিয়ম কানুন নেই, থানা-পুলিশ বলতে কিছুই নেই, ওখানে গোটা চারেক গুণ্ডা মিলে যা খুশি তাই করে চলেছে।

এটা স্পষ্ট-- এই নালিশ যে মিথ্যে সেটা বুঝতে কোন তদন্তের আবশ্যকতা নেই। তবু বিরোধী পক্ষের কিছু সদস্য শহরে গিয়ে ওই নালিশের কপি করে শিক্ষা বিভাগের বড় বড় অফিসারের টেবিলে জমা করে ফিরে এল। তারপর গাঁয়ে এসে রটিয়ে দিল যে নালিশের তদন্ত করতে ডিপ্টি ডায়রেক্টর অফ এজুকেশন পদের অফিসার করবেন।

উনি নাকি সাদাসিধে গরু। কিন্তু এবার বৈদ্যজীর বাপেরও সাধ্যি নেই যে ওনাকে দুইয়ে নেবে। কারণ উপর থেকে সঠিক তদন্তের হুকুম জারি হয়েছে।

প্রিন্সিপাল সাহেবকে ফাঁসাতে ওইটুকুই যথেষ্ট। উনি জানেন যে তদন্তের দিকটা বৈদ্যজী নিজে দেখবেন। কিন্তু তদন্ত শুরু হলে হাকিমদের আনাগোনা লেগে থাকবে। সেসব প্রিন্সিপালকেই সামলাতে হবে। হাকিম কলেজে এলে সবার আগে কী দেখবেন? প্রিন্সিপাল নিজেকে উত্তর দিলেন— কলেজ ভবন।

এবার উনি ভবনের সৌন্দর্য বাড়াতে কোমর বেঁধে নেমে পড়লেন।

শহরে গিয়ে দেখে এসেছেন-- একটা ছোট চারাগাছ পুঁতে তার চারদিকে ইঁট দিয়ে গোল ঘিরে লাল -সাদা রঙ লাগিয়ে দিলে অবহেলায় পড়ে থাকা মাঠ কেমন বাগান সেজে ঝলমলিয়ে ওঠে! ভাবলেন, কলেজের সামনে একসারি গুলমোহর আর অমলতাস গাছ লাগিয়ে দেয়া যাক। আর হাকিমের দলবল আসার আগেই নানারঙের ইঁট দিয়ে ঘিরে দেয়া যাক।

ওঁরা আসার সময় দেখবেন নানারঙে সেজেওঠা সাফ-সুতরো কলেজভবন এবং ফিরবেন একপেট ফার্স্ট ক্লাস চা এবং নাস্তা গিলে। তাহলে আর আমার বিরুদ্ধে কী রিপোর্ট দেবেন?

প্রিন্সিপাল সাহেব এসব ভেবে জানুয়ারির হাড়কাঁপানো শীতের অজুহাত ঝেড়ে ফেলে কাজে নেমে পড়লেন। গাছ লাগাতে বছরের যে কোন সময় উপযুক্ত বটেক—চুলোয় যাক বৈজ্ঞানিক লেকচারবাজি!

উনি কলেজের পাঁচিলের পাশে দাঁড়িয়ে গর্ত খোঁড়ার তদারক করছিলেন। ওনার হাতে দুটো বই—একটা মোটা আর একটা পাতলা—দেখামাত্র মনে হবে খুব দামি। । পরনে ওনার প্রিয় কেজো পোশাক, অর্থাৎ মোজাছাড়া জুতো আর হাফপ্যান্ট। লোকে দেখে যাই ভাবুক, উনি এই পোশাকে নিজেকে বেশ চটপটে এবং চালাক ভাবেন। বইদুটোকে উনি পোষা বেড়ালের মত আদর করে ধরে আছেন।

একজন মজুর কোদাল-গাঁইতি চালানো থামিয়ে ওনাকে বলল, ‘দেখে নিন মাস্টার সাহেব, গর্ত তো এতটাই হবে’?

প্রিন্সিপাল মাথা নেড়ে বললেন, ‘হুঁহ্‌ এটা কোন গর্ত হল? একটা পাখি মুতে দিলেই উপচে পড়বে। খুঁড়ে চল বেটা, এখনও অনেক বাকি’।

এসব বলে উনি পাশে দাঁড়ানো এক মাস্টারের দিকে দর্পভরে তাকালেন। মাস্টারমশায়টি ওঁর আগে থেকেই চেনা, কারণ সে এনার খুড়তুতো ভাই। তিনিও এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে নিলেন শত্রুপক্ষের কোন মাস্টার কাছাকাছি আছে কিনা। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে আত্মীয় ঢঙে বললেন—ভাইয়া, এই কলেজে তুমি তো এখন উদ্যান-বিশারদ!

প্রিন্সিপাল বইদুটো বুকে ঠেকিয়ে বললেন, ‘সবকিছু এদের জন্যে সম্ভব হয়েছে। তবে ব্যাটারা বড্ড কঠিন সব ইংরেজি লিখেছে। বুঝতে গেলে সাধারণ-বুদ্ধির মাথা বোঁ- বোঁ করে ঘুরবে’।

খুড়তুতো ভাই উবাচ, ‘আপনি তো লৌহপুরুষ! কলেজের এত এত কাজ, পলিটিক্সে মাথা গরম হয়ে যায়। তারপর আপনি বইও পড়ে ফেলেন! আমার তো অবস্থা হল কেউ বই পড়তে না বলুক, বরং দশ ঘা জুতো মারুক। বই দেখলে গা গুলোয়’।

প্রিন্সিপাল ফিফটি পার্সেন্ট বড়দা এবং বাকি ফিফটি পার্সেন্ট প্রিন্সিপাল হয়ে বললেন- ‘চুপ কর। এসব বলতে নেই। সফরের সময়ও বই সঙ্গে রাখি। শুধু কোট-প্যান্ট পড়লে কী হবে? তাই দেখে কেউ তোমায় অধ্যাপক বলবে ভাবছ? কোট প্যান্ট তো কুঁজো বামনও পরতে পারে’।

ভাই বলল, ‘আপনিই ঠিক। মাঝখানে বাধা দেয়া আমার স্বভাব নয়। কিন্তু আমাদের আর কুঁজো-বামনের মধ্যে তফাৎ কোথায়? এই শালার টেক্সট বুক, বুঝে নিন, পচাগলা ফল ছাড়া কিছু নয়। আমরা ছোঁড়াদের পেটে এগুলো ঠুঁসতে থাকি। কারও হজম হয়, কেউ বমি করে ফেলে’।

প্রিন্সিপাল হেসে ফেললেন। ‘কথাটা অনেক দূর অব্দি নিয়ে গেলে। কিন্তু অতি বুদ্ধিমানের মরণ নিশ্চিত’।

কথাটা বলে উনি গর্ত কতটা গভীর হল উঁকি মেরে দেখতে লাগলেন। যেন কোন বুদ্ধিমানের মরণ হলে তাঁকে এই গর্তেই কবর দেবেন।

এমনসময় ওখানে আগমন হল খান্না মাস্টারের। উনি হড়বড় হড়বড় করে এসে প্রিন্সিপালের হাতে একটা কাগজ দিয়ে বললেন—নিন, ধরুন।

প্রিন্সিপাল একবার সাহায্যের আশায় তুতো ভায়ের দিকে তাকালেন। তারপর গর্তের পাশে দাঁড়িয়ে কঠোর মূর্তি ধরে অফিসারি মেজাজে বললেন—এটা কী?

--কী আবার! একটা কাগজ।

ওর দিকে বুক চিতিয়ে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছেন দেখে খান্না মাস্টার হিতৈষী স্বরে বলল—দিন, পড়ে শোনাচ্ছি।

--‘যান, নিজের কাজ করুন। আমাকে পড়ানোর কষ্ট নাই করলেন’। এসব উনি ঘেন্না মিশিয়ে বললেন।

খান্না দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল—এই জন্মে পড়ানোর হাত থেকে রেহাই কোথায়!

তুতো ভাই খান্না মাস্টারকে একদৃষ্টিতে দেখছিল। মালিকের বাংলোর ভেতর থেকে পোষা অ্যালসেশিয়ান রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলোকে যে চোখে দেখে। প্রিন্সিপাল অনেকক্ষণ ধরে কাগজের টুকোরোটার দিকে কটমটিয়ে তাকিয়ে রইলেন। প্রাচীনকালের ঋষিমুনি হলে কাগজটা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যেত। খানিকক্ষণ পরে উনি ওই কাগজটাকে খান্না মাস্টারকেই ফেরত করে দিলেন।

খান্না রেগে গেল। ‘এটা কী’?

--‘কী আবার, কাগজ’। এবার প্রিন্সিপাল মন দিয়ে গর্তের গভীরতা দেখতে লাগলেন।

খান্না মাস্টার ঠোঁট কামড়ে গলার স্বর নামিয়ে বলল, ‘যাই হোক, লিখে আবেদন দিয়েছি। আপনার আদেশ ওই আবেদনের উপর লিখে দিতে হবে’।

প্রিন্সিপাল একজন মজুরের সঙ্গে কথা বলছিলেন-‘ঠিক আছে, ঠিক আছে। এবার থাম। আবে, গর্ত খুঁড়ছিস, কুয়ো নয়। ঢের হয়েছে’।

খান্না খানিকক্ষণ চুপচাপ। ফের মুখ খুলল,’আমি চারদিনের জন্য বাইরে যাব। ছুটি চাই। আপনি লিখে হুকুম দিন’।

প্রিন্সিপাল পায়ের পাতায় ভর দিয়ে গর্তের পাশে জমা ভিজে মাটির উপর বসেছেন। যাদের চোখ আছে, তারা দেখুক—কলেজের স্বার্থে উনি কাদা হোক, নালা-নর্দমা হোক, কিছুরই পরোয়া করেন না। এবার উনিমাটিকাটা মজুরদের গর্তের চারপাশে উঁচু করে আল বাঁধার ব্যাপারে বিস্তারিত নির্দেশ দিতে লাগলেন।

খান্না মাস্টারের কথাবার্তা এবার পার্শ্বসংগীতের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। তিনিও গর্তের উলটো পাড়ে পায়ের পাতায় ভর করে বসে বলে উঠলেন—‘ গর্তের ভেতর লাফিয়ে পড়ার আগে আমার কথার জবাব দিয়ে যান’।

প্রিন্সিপাল ওর দিকে খোলাচোখে তাকালেন। বললেন—‘ আগে তোমাকে ধাক্কা দিয়ে গর্তে ফেলব, তারপর তোমার উপর লাফিয়ে পড়ব। বুঝলে হে খান্না মাস্টার’! ডায়লগ মেরে উনি তুতো ভাইয়ের দিকে তাকালেন। ভাইটি একেবারে বিনয়ের অবতার হয়ে নম্রস্বরে বলল-‘যাই, চাপরাশিদের ডেকে আনি। মনে হচ্ছে ভালরকম ঝগড়া ঝঞ্ঝাট হবে। কিন্তু আমার দিব্যি, আমি ফিরে না আসা পর্য্যন্ত আপনি কিছু বলবেন না’।

--‘আমি আর কী বলব ভাই! সবকিছু মুখবুজে সহ্য করে যাচ্ছি। যেদিন ওর পাপের ঘড়া পূর্ণ হবে, সেদিন নিজে থেকেই ভক্‌ করে ফাটবে’।

প্রিন্সিপাল খান্না মাস্টারকে শাপ দিলেন নাকি? ও বেশ ঘাবড়ে গেল। ওর ভয় প্রিন্সিপাল হঠাৎ চেঁচাতে না শুরু করে—খান্না আমার গায়ে হাত তুলেছে। তারপর খান্না মামলা মোকদ্দমায় না ফেঁসে যায়!

ও চুপচাপ উঠে গর্তের থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা এক মাস্টারের কাছে গেল। তারপর গোটা দুনিয়াকে শুনিয়ে চেঁচাতে লাগল—ভয় দেখাবেন না মাস্টার সাহেব, ধমকি দেবেন না। এটা নবাবী আমল নয়। এত সহজে খান্নার প্রাণ যাবেনা। বলে দিচ্ছি, আমার গায়ে হাত তুলেছেন তো রক্তগঙ্গা বইবে। এই বলে দিলাম, হাঁ!

খান্না ঠিক চেঁচাতে চায়নি। কিন্তু জোর গলায় বলতে গিয়ে ব্যাপারটা চেঁচানোর স্তরে পৌঁছে গেল। কয়েকজন মাস্টার এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল।

কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ হল না। খান্না হঠাৎ বিকট চিৎকার করে উঠল—‘মারুন, মারুন না আমাকে! ডেকে আনুন যত চাপরাশির দল। ওদের হাতেই আমার অপমান হোক। থেমে গেলেন কেন’?

খাসা তামাশা জমেছে। এই সত্যি কথাটা বোঝার তাগিদে দুই দলের কিছু মাস্টার দুদিকে জড়ো হল। ছাত্রের দল এখনও আসেনি। যে দু একটা এসেছিল, তাদের চাপরাশিরা আগে থেকেই ভাগিয়ে দিল। ওরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব দেখতে পাচ্ছিল। তবে এই তামাশা সেরেফ ‘প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য’ হয়ে গেল।

প্রিন্সিপল সাহেব এই আচমকা আক্রমণে প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেছলেন। তারপর ঠেলে ওঠা ক্রোধকে সংযত করে খান্নার কাছে গেলেন। ছুটির দরখাস্তটি ছিনিয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বললেন—‘চেঁচিও না খান্না মাস্টার! তোমার বুঝতে ভুল হয়েছে। দাও, দরখাস্তের উপর আদেশ লিখে দিচ্ছি’।

ওঁর ইশারায় তুতোভাই মাস্টার একটা ফাউন্টেন পেন বাড়িয়ে দিল। উনি হাতের হর্টিকালচারের বইটার উপর ছুটির দরখাস্তটি রেখে তার উপর খসখস করে কলম চালাতে লাগলেন। লিখতে লিখতে বললেন—‘আমাদের লড়াই নীতির। এর মধ্যে মারপিটের কথা উঠছে কেন? ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে’।

খান্না মাস্টার নিজের খাড়া করা তামাশায় নিজেই ক্লান্ত হয়ে বলল,-‘আগে এই দরখাস্তের ওপরে হুকুম লিখুন। তারপর বাকি কথা’।

তিনি মুচকি হেসে জানালেন,-‘সেটাই করছি’।

কয়েকটা শব্দের উপর উনি ‘ক্রস’ চিহ্ন লাগালে। অন্য কয়েকটায় গোল করে ঘিরে দাগিয়ে দিলেন। শেষে বড় করে ইংরেজিতে একটা শব্দ লিখলেন—‘রিজেক্টেড’!

খান্না মাস্টারের মুখ থেকে কোন শব্দ বেরোনের আগেই তিনি দরখাস্ত ওকে ফেরত দিয়ে বললেন—স্পেলিংয়ে অনেকগুলো ভুল। ‘হলিডে’ শব্দে ‘এল’ অক্ষরের পরে ‘ওয়াই’ লেখা হয়েছে। ‘খান্না’ শব্দে ‘কে’ অক্ষরটা ক্যাপিটালে লেখা নাকি স্মল বোঝা দায়। এসব খেয়াল করা উচিত’।

খান্না বাকশক্তিরহিত। তারপর হঠাৎ গণ্ডারের মত মুখ খুলে গর্জন করে উঠল—‘ একবার কলেজের বাইরে আয়! তোর সমস্ত স্পেলিং ওখানেই শিখিয়ে দেব’।

ব্যস্‌ মহারণ শুরু।
0

ধারাবাহিক - শৌনক দত্ত

Posted in







সুপ্রিয়বরেষু বাসু,

অফিসের কাজে শহরের বাইরে ছিলাম প্রায় একমাস। তাই তোমার চিঠির উত্তর দিতে দেরী হলো। তুমি নিশ্চয়ই পাহাড় থেকে ফিরে এসেছো। কদিন আগেই যাকে বিগত যৌবনা বলে উপহাস করলে তাকেই লিখছো চিরনতুন বৃদ্ধা এ কেমন কথা? ভীমরতি ধরেছে নাকি মশাই! অবশ্য তোমারও তো বয়স হয়েছে এই বয়সে শুনেছি প্রায় পুরুষের কিছু চারিত্রিক ভীমরতি ঘটে, তোমারও কি তাই হলো নাকি বিগত যৌবনা বলে অনুশোচনায় ভুগছো? বছরের প্রথমেই শহরের বাইরে যাবার তাড়া ছিলো তাই নতুন বই কেনা হয়নি। বহুবছর পরে এয়ারপোর্টে কার সাথে দেখা হয়েছে শুনলে তোমার মনে দোলা লাগবে। কলেজের দিনগুলিতে যাকে একপলক দেখবে বলে তুমি ঘন্টার পর ঘন্টা ক্যান্টিনে বসে থাকতে তোমার সেই চির যৌবনার সাথে দেখা হলো। স্বামী পুত্র নিয়ে দারুন সংসারী সে। তোমার কথা জিজ্ঞাসা করেছে খুটেখুটে আজও সংসারী হওনি শুনে মনে হলো কষ্ট পেয়েছে খুব। ওর সাথে ঘন্টাখানেকের সাক্ষাতের পরে আমার মনে হয়েছে নারীর জীবন ব্যক্তিগত নয়, পুরোপুরি রাজনৈতিক। দেশকেও তো আমরা মায়ের রূপে দেখি অর্থাৎ সেই নারী আর তাই হয়ত তারও ব্যক্তিগত কিছু নেই যা আছে তা পুরোপুরি রাজনৈতিক তা হোক ভারতবর্ষ,বাংলাদেশ, সিরিয়া কিংবা অন্য যেকোন দেশ। শহীদুল জহিরকে তোমার মতন করে গভীরভাবে আমার পড়া হয়নি তবে তোমার চোখে তাকে দেখে আরো গভীরভাবে তাকে পড়ার ইচ্ছে জেগেছে প্রবলভাবে তা স্বীকার করি। বাংলাদেশকে দেখার কথা যদি বলো তাহলে সবচেয়ে বেশি আমি দেখেছি সেলিনা হোসেনের লেখায়। ফ্রানৎস ফানো বলেছেন অতীত নয়, যে-অগ্নিগর্ভ বর্তমানের মধ্যে দিয়ে আমরা চলেছি, যা এ-মুহূর্তে আকার পাচ্ছে, সে-সময়কেই চুলচেরা বিশ্লেষণ করে দেখার কথা একজন সংবেদনশীল লেখকের সেটাই তো আত্মনির্ধারিত অন্বিষ্ট। শহীদুল জহির তেমনই একজন লেখক অস্বীকার করার সুযোগ নেই। তবু কেন জানি আমাকে বেশি টানে সেলিনা হোসেন। একবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই বদলে যাওয়া বাংলাদেশের সমাজবাস্তবতা গভীরভাবে যেসব লেখকের রচনায় মূর্ত হয়ে উঠতে শুরু করে, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন তাঁদেরই একজন। আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি কিন্তু বাবা মা ও আত্মীয় স্বজনের মুখে এত গল্প শুনেছি আমার এখনো মনে পড়ে স্কুল থেকে ফিরে দুপুরের ভাতঘুমের আগে ঠাকুরমার কাছে রোজ মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার দিনগুলি। মুক্তিযুদ্ধ প্রীতির জন্যই কিনা জানিনা বাবা সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬) বইটি কিনে দিয়েছিল বইমেলা থেকে। সেই জন্যও সেলিনা হোসেন আমার প্রিয় হতে পারেন। তুমি নিশ্চয়ই সেলিনা হোসেনের বহু লেখা পড়েছো। হাঙর নদী গ্রেনেড পড়ার পরে আমি সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে লেখা বেশকিছু উপন্যাস পড়েছিলাম।

বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের উদ্বেগ বেশি হয়ত পূর্বপুরুষের নাড়িপোতা আছে সেইজন্য কিংবা নিকটতম প্রতিবেশি দেশ বলে, কিন্তু পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখো সর্বত্র জনসাধারণ সমর্থিত ও অংশগ্রহণকৃত যুদ্ধ। ইতিহাস জানায়, এই সভ্য পৃথিবীতে একটি দিনের জন্যেও কখনো যুদ্ধ বন্ধ হয় নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজায় রাজায় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রশাসকবৃন্দ নিজেদের প্রতিহিংসা, লোভ মেটাতে জনগণকে ছুড়ে ফেলেছে ক্ষুধার্ত

বাঘের খাঁচায়। এরিক মারিয়া রেমার্কের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাস ‘অল কোয়ায়েট অন দ্য ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’-এ দেখা যায়, দেশের যুবকরা বাধ্য হচ্ছে যুদ্ধে যেতে। সেই যুদ্ধ গৌরবের অনুভূতির পরিবর্তে তাদের দিয়েছে ক্লান্তি আর ঘৃণাবোধ। যুদ্ধ থেকে তারা ফিরেছে একরাশ হতাশা আর অর্থহীনতার বোধ সঙ্গে নিয়ে। ছাত্র রাজনীতি করলেও আমি যে তুখোড় রাজনীতিবিদ তেমনটা একদমই না। তবে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্রনীতির কিছু গলদ অবশ্যই আছে। যা বাংলাদেশে ঘৃণাকে বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির কাল থেকেই ভারত এককভাবে আওয়ামী লীগকে অন্ধভাবে সমর্থন করেছে যা এতবড় গণতান্ত্রিক দেশের কুশলী পরারাষ্ট্রনীতি হতে পারেনা কোন ভাবেই।

বাংলাদেশের ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানকে ছাত্ররা বলছে নতুন স্বাধীনতা। এটা একটা রাজনৈতিক পন্থা হলেও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধকে খাটো করে দেখার কোন অবকাশ নেই। শেখ মুজিবকে বাংলাদেশের বর্তমান প্রজন্ম গণঅভ্যুত্থানের পরে অস্বীকার করতে চাইছে, কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ একটি ঐতিহাসিক দলিল। এটি বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। তাঁর ভাষণ পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতার সংগ্রামের বীজমন্ত্র হয়ে উঠে। কালজয়ী এ ভাষণ বিশ্বের শোষিত, বঞ্চিত ও মুক্তিকামী মানুষকে সবসময় প্রেরণা জুগিয়ে যাবে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে সেলিনা হোসেনের একটি উপন্যাস আছে 'সাতই মার্চের বিকেল'। এই উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা দুজনেই একাত্তরে রমনার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছে। ইতিহাসের সেই অগ্নিঝরা বিকেলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে তারা উদ্বুদ্ধ হয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছে। লেখিকা উপন্যাসে দেখিয়েছে, নায়ক-নায়িকা যুদ্ধের পরে আবারও রমনার রেসকোর্স ময়দানে চলে আসে। মেয়েটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল, পাশাপাশি পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে গর্ভবতী হয়েছে। ছেলেটি মেয়েটিকে দেখে বলল, যুদ্ধের আগে আমাদের প্রেম ছিল। আমিতো তোমাকে এখনো একইভাবে চাই। তখন মেয়েটি বলে, আমার এই অবস্থাতেও তুমি আমাকে গ্রহণ করতে সম্মত আছো? ছেলেটি জানায়, গর্ভের সন্তানের দায়িত্ব নিতেও সে রাজি। গর্ভের সন্তানটি যেহেতু কোনো কিছুর জন্য দায়ী নয়, তাই তাকে গ্রহণ করতে তার আপত্তি নেই। তখন তারা দুজনে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে যায়। বঙ্গবন্ধু সে সময় বাড়িতে ছিলেন না। উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা তখন বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বঙ্গমাতাকে জানায়, তারা দুজনে বিয়ে করতে আগ্রহী। যুদ্ধের আগেও তারা ৩২ নম্বরের বাড়িতে যেত, তাই বঙ্গমাতা তাদের সম্পর্কের কথা জানতেন। তিনি এই নতুন পরিবর্তিত অবস্থায় দুজনের বিয়ে করার বিষয়ে সম্মত হওয়ার খবর জেনে কাজী ডেকে বিয়ে দিয়ে দেন। বঙ্গমাতা তার গলার সোনার চেইন খুলে মেয়েটির গলায় পরিয়ে দিয়ে তাদের আশীর্বাদ করেন। উপন্যাসটি পড়ে আমার মনে হয়েছে সেলিনা হোসেন এটাই দেখাতে চেয়েছেন যে, এসবই বাংলাদেশের সাতই মার্চের অর্জন।

৫ই আগষ্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পরে ৩২ নম্বরের সেই ঐতিহাসিক বাড়িটিতে আগুন দেয়া হয়েছে তারপর ৫ ই ফেব্রুয়ারি সেই বাড়ি ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর সব প্রতিকৃতি ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে আমার তখন আফগানিস্তানের কথা মনে পড়ছিল। সারাদেশ জুড়ে যে সব তান্ডব চলেছে তা শোনার পর অজানা কষ্ট ঘিরে ধরলেও আমাকে সাহস জুগিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেলিনা হোসেনের ১৯৭৬ সালে লেখা প্রথম উপন্যাস হাঙর নদী গ্রেনেড। এই লেখায় জনযুদ্ধ চিত্রায়নের সার্থক রূপায়ণ পাওয়া যায়। এই উপন্যাসে নেই কোনো রাজনৈতিক চরিত্র, সেনা কর্মকর্তা, কিংবা অসাধারণ কোনো ব্যক্তিত্ব। হলদীগাঁ নামে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম হওয়া বুড়ি নামের মেয়েটির শৈশব থেকে মধ্যবয়স পর্যন্ত বেড়ে ওঠা আর জীবনযাপনের অতিসাধারণ বর্ণনা আছে এতে। বুড়ির বিয়ে হয় বিপত্নীক দুই পুত্রের বাবার সাথে। উপন্যাসের প্রায় মাঝামাঝি পর্যন্ত হলদীগাঁয়ের নিস্তরঙ্গ কৃষিভিত্তিক গ্রামসমাজের আবহমান ছবি তুলে ধরা হয়েছে। রাজনীতি, মিটিং-মিছিল, দাবি-দাওয়া এসব যেন শহুরে বিষয়, গ্রামজীবনের নিভৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন বহুদূরের প্রসঙ্গ। উপন্যাসের মাঝামাঝি পর্যায়ে শহর থেকে যুদ্ধ ক্রমশ গ্রামীণ জীবনকে আক্রান্ত করে। হতচকিত গ্রামবাসী বিষয়টা বুঝে উঠতে উঠতেই অনেকখানি ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায়। গ্রামের সব যুবকের সাথে বুড়ির সৎ ছেলে সলিম-কলিম যুদ্ধে চলে যায়। বিশেষ পরিস্থিতিতে গ্রামের প্রতিবেশী দুই মুক্তিযোদ্ধার জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজের বহু সাধনার কাঙ্খিত প্রতিবন্ধী পুত্রকে হায়েনার মুখে তুলে দেয় বুড়ি। সলিম-কলিম, বুড়ি কিংবা উপন্যাসে উল্লিখিত অন্য মুক্তিযোদ্ধারা কেউ ডিগ্রিধারী শিক্ষিত কিংবা রাজনীতি সচেতন চরিত্র নয়। কিন্তু এরাই একাত্তরের সিংহভাগ জনতা, যারা মাতৃভূমি বাঁচাতে নিত্যকার ঘর-গৃহস্থালি ফেলে কাস্তে-লাঙলের বদলে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। এই গল্পের আরেক ধরনের যোদ্ধার উপস্থিতি সম্পর্কে না বললেই নয়। বুড়ির বাল্যসখী নীরা ছিল বাউল দলের সদস্য। সারাদেশ ঘুরে দোতারা হাতে গান গাইত সে। গ্রামের রাজাকাররা তাকে প্রাণের হুমকি দিয়ে দোতারা কেড়ে নেয়, কারণ গানের ভেতর দিয়ে সে দেশমাতৃকার কথা বলছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল মূলত বায়ান্নের ভাষা সংস্কৃতি বাঁচানোর লড়াইয়ের ধারাবাহিক ফলাফল। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাওয়া, ষাটের দশকে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করা, সবশেষে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড প্রমাণ করে দেয় যুদ্ধটা কেবলই ভূমি দখলের নিমিত্তে ঘটে নি। একটি জাতির মস্তিষ্ককে ধৌতকরণের মাধ্যমে দাসে পরিণত করাটাই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ কেবল সশস্ত্র যুদ্ধ হলে এত দ্রুত স্বাধীনতা লাভ করা যেত না সম্ভবত, যদি না আব্দুল মান্নান আর আরজাতুন্নেসার মতো স্বেচ্ছাসেবকেরা কোনো প্রাপ্তির আশা না রেখে জনতার কাতার থেকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত। কসবার কুল্লা পাথর এলাকার এই দুজন বাসিন্দা ইতিহাসস্বীকৃত চরিত্র। যুদ্ধের নয় মাস এই দুজন শহিদদের লাশ বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করে উপযুক্ত মর্যাদায় দাফন করেন। আব্দুল মান্নান এবং আরজাতুন্নেসার জন্য বহু শহিদের লাশ বেওয়ারিশ হয়ে যায় নি। লাশ ধোয়ানোর সেই চৌকি আজও ইতিহাসের স্বাক্ষ্য দেয়। আর তাতেই বলতে সাহস পাই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আদতে অসাম্প্রদায়িক, হয়ত এখনও।

তেমনি ‘ঘুমকাতুরে ঈশ্বর’উপন্যাসে নদীভাঙা মানুষের জীবনের দুঃখগাথা দিয়ে যে কাহিনির শুরু, সেইসব উপকাহিনির যোগসূত্র ঘটে একটি গণকবরের কাছে এসে। লেখক দেখাতে চান যে দেশের উচ্চ ও মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় হয়ত যে কোনো উপায়ে আরো অধিক পুঁজি গড়তে আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থপরতার জীবন বেছে নিয়েছে, যার ফলে দেশাত্মবোধ তাদের কাছে এখন লোকদেখানো আনুষ্ঠানিকতার নামান্তর। কিন্তু এই দেশেরই যেসব অতি সাধারণ জীবনযাপন করা মানুষের অবদানের কারণে একাত্তরে বিজয় এসেছিল, তাদের জন্য আজও স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের বোধে একাত্ম হওয়ার বিকল্প নেই। একতার শক্তিই পারবে মানবেতর জীবনযাপন করা এইসব মানুষের জীবনে স্বাধীনতার প্রকৃত অর্থ বয়ে এনে দিতে। আর নওরতন বেওয়া সেই মানুষ, যিনি পেরেছেন স্বদেশ ও স্বাধীনতার প্রতিকৃতিরূপে নিজেকে দশগ্রামের মানুষের কাছে দাঁড় করাতে। তাই তার বাড়িতে যারা আসে, তারা বলে, ‘শহীদের লাগি মোরাই তো কাঁদুম। শহীদের লাগি কাঁদলে মাটি, আকাশ, বাতাস খুশি থাকবে। নইলে মোগ উপর গজব নামবে। মাটি ফুঁইসা উঠবে। নদীগর্ভে তলায়ে যাইবে। জলোচ্ছ্বাস মোগরে দুইয়া সাফ কইরা দিবে। আবার ফুঁইসা উঠবে। বজ্রপাত অইবে। মোগরে বেইমান বইলে গালি দিবে। মোরা ধ্বংস অইয়া যামু।’ একটি গণকবর, একটি গণহত্যা দিবস এবং স্মৃতিসৌধরূপী নওরতন বেওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশকে প্রতীকায়িত করা হয়েছে, যে দেশের শেকড় ‘একাত্তর’ নামক একটি সময়ে প্রোথিত রয়েছে। শেকড়ে ফিরতে পারলে, নওরতন বেওয়ার মতো স্বাজাত্যবোধ আর স্বদেশপ্রেম ধারণ করতে পারলে অর্থনৈতিক মুক্তি অসম্ভব কিছু নয়। অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব হলে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমবে, অনেক মূল্যের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে উঠবে।

তোমার নিশ্চয় প্রশ্ন জাগছে বাংলাদেশের সমসাময়িক গণঅভ্যুত্থানকে কেন আমি সেলিনা হোসেনের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস দিয়ে দেখছি। আসলে আমি তোমার মন জগতে যে ঢেউ উঠেছে তার হাহাকারের সাথে একাত্ম বোধ করছি কিন্তু অসাম্প্রদায়িক ও সরলমনা সাধারণ মানুষের প্রতিরোধের প্রতি বিশ্বাস রাখছি সেলিনা হোসেনের লেখা থেকে কেননা গল্প-উপন্যাসের বিষয় ও চরিত্রের অনুসন্ধানে সশরীরে মাঠে-প্রান্তরে ঘুরে ফেরেন তিনি। উদ্দেশ্য একটিই, যে জীবনের গল্প তিনি নির্মাণ করছেন বা যে চরিত্র তিনি সৃষ্টি করছেন, তা যেন সঙ্গতিপূর্ণ হয়। বাস্তববাদী লেখক হওয়ার ইচ্ছে থেকে তিনি এ কাজ করেন না। এ কাজ তিনি করেন একজন শিল্পীর লড়াই হিসেবে। এই লড়াই তিনি সকল ক্ষেত্রেই করেন। এছাড়া উপন্যাসের বিষয়বৈচিত্র্য খোঁজা তার শিল্পীসত্তার মৌলিক স্বভাব। একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি তাঁর লেখায় খুব বেশি নেই। গল্প-উপন্যাসের বিষয় ও আঙ্গিকের অন্বেষণে রীতিমতো গবেষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেখি সেলিনা হোসেনকে। সৃজনসত্তার এই বিশেষ প্রবণতা বা আকুতি তার লেখালেখির শুরু থেকেই শুরু। 'পোকামাকড়ের ঘরবমতি' লেখার পূর্বে তিনি সশরীরের জেলেদের ট্রলারে চড়ে গভীর সমুদ্রের গিয়েছিলেন। তাঁর সেই অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি লেখেন-

যে ট্রলারে চড়েছিলাম তার প্রধান জেলে ছিলেন একজন বয়সী মানুষ। চুল-দাড়ি ধবধবে সাদা। মাথায় চুপি। ভেবেছিলাম তিনি আমাকে ট্রলারে উঠতে দিতেই চাইবেন না। দেখলাম তিনি অন্য মানুষ। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আসেন আসেন। আমি আর আনোয়ার উঠলাম ট্রলারে। ট্রলার যখন গভীর সমুদ্রের দিকে যাচ্ছে, তিনি গুড়-মুড়ির পোটলা খুলে বললেন, খাবেন মাগো? এই হলো আমাদের সাধারণ মানুষের চিত্র। বিপরীতধর্মী মানুষ নেই তা নয়। তবে এরাই সংখ্যায় বেশি। সেখানে গিয়ে কাহিনী মাথায় দানা বাঁধে। ঠিক করি যে উপন্যাসের নায়ক হবে একজন সাহসী মানুষ, যে হাঙর ধরার স্বপ্ন দেখে। জেলে মালেকের এই স্বপ্নের সঙ্গে ছিল তার প্রেম, দুঃখ-বেদনার গল্প। (গল্পকথা, সেলিনা হোসেন সংখ্যা, রাজশাহী, ২০১৫)

তাঁর এই আত্মকথন প্রমাণ করে তিনি কল্পনাপ্রসূত চরিত্র বিনির্মাণ করেননি, তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা তাঁর নিজ চোখে দেখা ও গবেষণা সৃষ্ট। যা সাধারণের বাস্তব মনজগৎকে তুলে এনেছেন পরম মমতায় বাস্তবসম্মতভাবে। তিনি সাধারণ মানুষের জীবনযাপন দেখেছেন নিবিড়ভাবে। তাঁর গল্পে শ্রমিক, চাষি, কাঠুরে, রিকশাচালকসহ বিচিত্র পেশার মানুষ উঠে এসেছে। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে রঙচঙ লাগিয়ে বিস্তর হৈচৈ হচ্ছে দেশের মিডিয়াগুলোয় কিন্তু বিশ্বের কোথায় সংখ্যালঘুরা ভালো আছে বলো তো? আমাদের দেশেও কি বিষ ছড়ানো হচ্ছে না? মানুষকে যতদিন মানুষ পরিচয়ে বিবেচনা না করে ধর্ম বা জাতি দিয়ে বিবেচনা করা হবে ততদিন মুক্তি আসবেনা। বিশেষ করে সংখ্যালঘু শব্দটা যতদিন আছে। সংখ্যালঘুদের জীবন নিয়েও সেলিনা হোসেনের একটি মুক্তিযুদ্ধকালীন উপন্যাস আছে। ‘মাটি ও শস্যের বুনন’ উপন্যাসে দেখা যায়, শ্যামল সবুজ ধমশর গ্রামে ভোর হয় গীর্জার ঘণ্টাধ্বনি শুনে। খ্রিষ্টধর্ম অধ্যুষিত গ্রামের শান্তিপ্রিয় মানুষদের জীবন নারকীয় হয়ে ওঠে পাক বাহিনীর আক্রমণে। ক্ষিতীশ ও মেরিনার কন্যাসন্তান র্ম্চ্ছূনার জন্ম হয় বিকট বোমা বিস্ফোরণের শব্দকে সঙ্গে নিয়ে। পরিবারের অসাম্প্রদায়িক মানবতাবোধসম্পন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত দেশচেতনা ধারণ করেই বেড়ে ওঠে সে। গির্জার ফাদার যোসেফ এবং স্থানীয় মিশনারি হাসপাতালটি মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা ও আশ্রয়ের জন্য নির্ভরযোগ্য কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত ছিল। হাসপাতালে নির্যাতিত নারী পারুলিয়া যুদ্ধশিশুর জন্ম দিয়ে হত্যা করতে উদ্যত হয়। ক্ষিতিশ ও মেরিনার উদ্যোগে শিশুটিকে গ্রামের নিঃসন্তান দম্পতি দত্তক গ্রহণ করে। যুদ্ধশিশুর প্রতি এই অসাধারণ দায়িত্বশীল উপলব্ধি সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়লে পরবর্তীকালে বীরাঙ্গনা এবং যুদ্ধশিশুদের নানাবিধ করুণ পরিণতি বরণ করতে হতো না। হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মী চন্দ্রমুখী আহত মুক্তিযোদ্ধার কেটে ফেলা পা সশ্রদ্ধচিত্তে বাগানের মাটিতে পুঁতে রাখে, যেন সেই পা থেকে জন্ম নেবে স্বাধীনতা নামের বৃক্ষ। সেখানে ফুল ফুটবে প্রতিদিন বাংলাদেশ নামে। উপন্যাসের চরিত্রগুলো মুক্তিযুদ্ধে যে বৈষম্যহীন দেশের স্বপ্ন দেখেছিল তার প্রতিফল ঘটেনি বলে স্বপ্নগুলো যেমন মিথ্যে হয়ে যায়না তেমনি হাজার বছরের সংস্কৃতিকে চাইলেই বদলে ফেলা সম্ভব না। মনে রাখা জরুরি আমাদের সংস্কৃতিতে লোকাচারে সাম্প্রদায়িকতার স্থান নেই। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল মন্ত্র ছিল, বাংলার প্রত্যেক মানুষের সাংবিধানিক অধিকার ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে জনগণকে মুক্তি দেয়া। বাঙালি হবে একটি অসাম্প্রদায়িক জাতি। ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি হবে রাষ্ট্রের ভিত্তি। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের মিশ্র আদর্শে এই ভূখণ্ড পরিচালিত হবে। বাংলাদেশের ভৌগলিক অনন্য বৈশিষ্ট এবং বিবিধ নৃতাত্ত্বিক সংমিশ্রণের ফলে এ সংস্কৃতি নিজস্বতা লাভ করেছে। বাঙালির স্বীকরণের ক্ষমতা এত বেশি ছিল যে শাসনতন্ত্র দিল্লি থেকে শত শত মেইল অবস্থানের পরেও শাসকদের অনুশাসন, ধার্মিকদের ধর্মাচার, দার্শনিকদের দর্শন ভাবনা ইত্যাদি যা কিছু বাংলা নামক এ প্রান্তিকে এসে পৌঁছেছে তাই বঙ্গীয় চরিত্র দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে। পাশাপাশি শতশত নদী শাখা নদী এবং বনভূমিতে পরিপূর্ণ বাংলাদশ আবার বহুভাগে বিভক্ত হয়েছে। এ কারণে এ অঞ্চলের সংস্কৃতিও খানিকটা স্বাতন্ত্র্র্য লাভ করেছে। এসব উপসংস্কৃতিও জাতি, ধর্ম, বর্ণ এবং বহু উপ-ভাষার কারণে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়েছে। বৈদিক, বৌদ্ধ এবং জৈন ইসলাম ধর্মের মতো প্রধান প্রধান ধর্মের উৎপত্তি এবং স্থান বাংলাদেশ থেকে বহুদূরে অবস্থিত। সে কারণে এসব ধর্মের আদি অকৃত্রিম রূপ এ অঞ্চলে পৌঁছায়নি; বরং এসব বহিরাগত ধর্মের সঙ্গে স্থানীয় ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আচারের এক অদ্ভুদ সমন্বয় ঘটেছে। তাই সংস্কৃতি সম্পর্কে একটা কথা বলা যায় যে, সংস্কৃতি একটা দেশ তথা অঞ্চলের জাতিগোষ্ঠীর শেকড়ের মতো।

‘কাঠকয়লার ছবি’ সেলিনা হোসেনের আরো একটি উল্লেখযোগ্য উপন্যাস, যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে দেখা যায় চৈতীরাণী নামে এক নির্যাতিত নারীকে, চৈতীরাণী আদিবাসী বাঙালি এবং চাবাগানের শ্রমিক। একাত্তর সালে এইসব প্রান্তিক, অন্ত্যজ শ্রেণি যারা আজন্মকাল বহুবিধ শোষণের শিকার তারাও যুদ্ধে অবদান রেখেছিল নানাভাবে, ইতিহাসে যাদের কথা কোথাও লেখা নেই। যাদের আমরা অনেক সময় অকৃতজ্ঞের মতো বাঙালি বলে পরিচয় দিতেও লজ্জিত হই। চৈতীরাণী তেমন একটি চরিত্রের যে কিনা পাক বাহিনী এবং চা বাগানের বাঙালি ম্যানেজার কর্তৃক নির্যাতনের শিকার হয় এবং দুটো পুত্র সন্তানের জন্ম দেয়। যুদ্ধশিশু দুলালকে অবশ্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে বিদেশি দম্পতির কাছে দত্তক দিয়ে দেওয়া হয়। ‘মাটি ও শস্যের বুনন’ উপন্যাসের পারুলিয়াকে আমরা দেখেছি যুদ্ধশিশুকে ঘৃণার বশে হত্যা করতে উদ্যত হয়। কিন্তু এখানে দেখা যায় চৈতীরাণী নবজাতক শিশু হারানোর শোক আজীবন বহন করে চলে। এই উপন্যাসে একাধিক কাহিনির বিস্তারকে ছাপিয়ে যুদ্ধশিশু দুলালের উৎস সন্ধানের নিরন্তর প্রচেষ্টা উপন্যাসের মূল পটভূমি হয়ে পাঠক হৃদয়ে জেগে থাকে। দুলাল তার পালক পিতামাতার কাছে সব জানতে পেরে প্রথমে ভেঙে পড়লেও পরে জন্মদাত্রী মা এবং জন্মস্থান অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে পড়ে। এই খুঁজে ফেরা প্রতিটি যুদ্ধশিশুর জীবনের বেদনাদীর্ণ প্রতিচ্ছবি। বীরাঙ্গনা ও তার যুদ্ধশিশু যুদ্ধের আগে পরে বহুমুখী অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। শোকের প্রেক্ষাপটে জেগে থাকে ক্ষত নিরাময়ের অযোগ্য আঘাত ও অপমানের স্মৃতি। পুরো উপন্যাসে দুলালের শেকড় খুঁজে বেড়ানোর আর্তি ও হাহাকার মিলেমিশে যুদ্ধশিশুর বাস্তবতা সম্পর্কে আমাদের নতুন করে ভাবায়। নাড়ির টানেই যেন দুলাল খুঁজে পায় মাকে। চারপাশে ঢোলের আওয়াজে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। মৃত্যু সন্নিকট হলেও মাতা-পুত্র দুজনেরই বিসর্জনের বাদ্য যেন হয়ে ওঠে হোলি খেলার উৎসব। এভাবেই লেখক যেন বাংলাদেশের মানুষকে সচেতনভাবে যুদ্ধশিশু আর বীরাঙ্গনা মায়েদের বরণ করে নেওয়ার জন্য উৎসবের আহ্বান করেছেন। যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য নারী নির্যাতন আর যুদ্ধশিশু একটি আদিম মারণাস্ত্র। সেই মারণাস্ত্রকে সম্মিলিতভাবে প্রতিহত করতে হবে দেশবাসীকেই, মন-মানসিকতার পরিবর্তন ও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

বর্তমান বিশ্বের সবচাইতে ভয়াবহ মানবসৃষ্ট দুর্যোগের নাম সহিংস ধর্ম সন্ত্রাস বা লুকানো রিলিজিয়াস রেসিজম। এর বিষাক্ত ধোঁয়ায় আজ বাংলার আকাশও আচ্ছাদিত। শান্তিই নাকি পৃথিবীর সকল সম্প্রদায়গত ধর্মের গন্তব্য। তাহলে এই শতাব্দীর দ্বার প্রান্তে এসে এইসব আমরা কি দেখছি? মানুষের কল্যাণের জন্য যে ধর্ম তা নিয়েই কত রাজনীতি,মত বিভেদ, রক্তপাত, অত্যাচার, লাঞ্ছনা আর অশান্তি। ঔপনিবেশিক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসের কারণে এই ধর্ম সন্ত্রাসের বীজ অনেক আগেই বাংলার মাটিতে বপন করা ছিল যা এখন বড় মহীরুহে পরিণত হয়েছে।

ইতি-

সুস্মি
১৪ ফেব্রুয়ারি,২০২৫



পুনশ্চ: "আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে, কিছুই কি নেই বাকি।"
0

ধারাবাহিক - নন্দিনী সেনগুপ্ত

Posted in





















বের্নহার্ড বেশ ঘাবড়ে গেল। প্রায় কেঁদে ফেলবে সে। এই প্রথমবার সে শুনল যে গের্ট এবং ইনেস একেবারে বয়ে যাওয়া ছেলেমেয়ে এবং এই বন্ধুমহলে মেলামেশা না করাই তার পক্ষে মঙ্গল। এদের সঙ্গে মিশলে বের্নহার্ডের ধ্বংস অনিবার্য। ‘বয়ে যাওয়া’ আর ‘ধ্বংস’ শব্দদুটো শুনে সে বেশ বিরক্ত হল, যদিও উল্টে কিছু বলবার সাহস তার ছিল না। তাছাড়া এই কথাটা তো অগ্রাহ্য করা চলে না যে গের্ট একেবারেই পরিশ্রমী ছাত্র নয়। কিন্তু ইনেসকে এই দলে ফেলা যায় না। সে এইসব নিন্দার উর্ধে। তাছাড়া বাবা তো জানেনও না যে ইনেস তাদের বন্ধুবৃত্তে বেশ দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করে। তবে বন্ধুদের দলের সবাই খারাপ, এটাও সঠিক কথা নয়। কারণ অনেকেই যথেষ্ট পরিশ্রমী, ভাল স্বভাবের এবং নিয়মানুবর্তী…

এই ঘটনার কিছুদিন পরে বের্নহার্ডকে বাড়িতে যাবার কথা বলা হয়েছিল, কারণ তিন সপ্তাহের ছুটি ছিল তার স্কুলে। বাবা বলেছিলেন যে সবকিছু বদলে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। বের্নহার্ড ভেবে উঠতে পারছিল না যে ঠিক কেমন বদল ঘটবে। তার একটু ভয় ভয় করছিল। তাকে গের্ট এবং ইনেসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বারণ করা হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে গের্টকে একবার ফোন করেছিল এবং জিজ্ঞাসা করেছিল যে তাদের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব কি না।

এই দেখা করবার ব্যাপারটা শেষ অবধি বেশ অদ্ভুত হয়ে দাঁড়ালো। বের্নহার্ড গের্টের বাড়িতে গিয়ে বেল বাজানোর পরে গের্ট নিজে এসে দরজা খুললো। তারপর তার নিজের ঘরে নিয়ে গেল। গের্টের ঘর এমনিতেও বেশ অগোছালো থাকে, আজও তাই। ঘরের কার্পেটে ফ্লক শুয়ে আছে। সে বের্শেনকে দেখে লেজ নেড়ে আহ্লাদ প্রকাশ করল। গের্ট বলল যে ইনেস চলে গেছে কুকুরটাকে রেখে দিয়ে। ‘কুকুর’ বলে উল্লেখ করাটা বের্নহার্ডের ভাল লাগল না। কারণ ফ্লককেও সে বন্ধু বলেই মনে করে। কিন্তু ইনেস চলে গেছে, এটা শুনে তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। তার হতবাক দশা দেখে গের্ট মজা পেলেও, বের্শেনের মতে ইনেসের চলে যাওয়াটা সত্যি সত্যি একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। ফার্দিনান্দের চলে যাওয়া, লাতিন পেপারের পরীক্ষার খারাপ ফল, বাবার সঙ্গে তর্কাতর্কি, সব বিচ্ছিরি ঘটনা ছাপিয়ে গেছে ইনেসের চলে যাওয়া।

-‘ইনেস কোথায় গেছে?’ অবশেষে একেবারে বিধ্বস্ত স্বরে বের্শেন প্রশ্ন করে।

-‘ইংল্যান্ডে গেছে, ওর দিদির কাছে। দিদির বাচ্চা হয়েছে। তিন-চার সপ্তাহের জন্য গেছে।’

-‘হঠাৎ করে যেতে হল?’

‘হ্যাঁ। যাই হোক, তোমাকে বারতিনেক ফোন করেছিল ইনেস। কিন্তু তুমি ছিলে না।’

রাগে, দুঃখে, অসহায়তায় বের্নহার্ড একদম ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল। ইনেস তার নামে একটা চিঠি লিখে রেখে গেছে গের্টের কাছে।

‘প্রিয় বের্শেন,

আমি তোমাকে বিদায় জানিয়ে যেতে পারিনি বলে মন খারাপ করবে না। তোমায় তিন বার ফোন করেও কথা বলতে পারলাম না। আমি জানি না বিষয়টা আসলে ঠিক কী। কিন্তু আমার মনে হল ইচ্ছাকৃত তোমাকে ফোনে ডাকা হয়নি। তুমি যদি এমন কিছু করে থাকো, যেটা তোমার ঠাকুমা কিম্বা বাবা-মায়ের অপছন্দ, তাহলে সেই বিষয়ে তাড়াতাড়ি মিটিয়ে নাও পরিবারের মধ্যে কথা বলে। যদি আমাদের কোনও কাজকর্ম ওঁরা বুঝতে না পেরে থাকেন, সেক্ষেত্রে সেটা বোঝানোর দায়িত্ব আমাদের উপরেই বর্তায়। কারণ, আমাদের সামনে এখন গোটা জীবনটা পড়ে আছে। ভাল থেকো, খুশি থেকো আর আমার চিঠির উত্তর দিও।

ইতি,

তোমার প্রিয় বন্ধু ইনেস’



গের্ট তার কাঁধের উপর উঁকি দিয়ে চিঠিটা পড়ে ফেলেছিল। সে ক্রমাগত জিজ্ঞেস করে যেতে লাগল যে বের্শেন কী এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে।

চিঠিটার দিকে তাকিয়ে বের্শেন বলে… ‘কিচ্ছু না।’

গের্ট চিন্তান্বিত মুখে বের্নহার্ডের চুলে টোকা মারে।

‘কিন্তু কিছু একটা কাণ্ড তো নিশ্চয়ই তুমি ঘটিয়েছ বের্শেন। যদি ইনেস এখানে উপস্থিত থাকতো, তাহলে কি তুমি তাকে সেই কাণ্ডটা বলতে? এখন সে এখানে নেই, ফলে আমি হয়তো বুঝতে পারব না, সেইজন্য বলছ না আমায়?’

বের্নহার্ডকে নিরুত্তর বসে থাকতে দেখে অবশেষে সেও চুপ করে। ধীরে ধীরে তার মাথার চুলে টোকা মারে।

বের্নহার্ড হঠাৎ নিজের হাঁটুর মধ্যে মুখ গুঁজে হাহাকার করতে থাকে, ফেটে পড়ে দুঃখে… ‘আমায় ওঁরা আর তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে দেবেন না।’

গের্ট সাঙ্ঘাতিক অবাক হয়। বের্শেনকে টেনে নেয় তার কাছে। হাসবার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে… ‘এর চেয়ে যদি বেশি কিছু না ঘটে থাকে… তো… কিন্তু ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর!’

‘আগামীকাল আমায় বাড়ি চলে যেতে হবে… ছুটি পড়বে।’

‘খুশি থাকো, বের্শেন, তোমার একটু ছুটি খুব প্রয়োজন!’

‘এবং হয়তো তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে না। আমি আর নাও ফিরতে পারি!’

গের্ট চুপ করে বসে থাকে এক মুহূর্ত।

-‘কিন্তু বের্শেন!’ বলে ওঠে গের্ট… ‘আমিও যে এখানে একা থাকতে পারব না। ইনেস চলে গেছে… আবার তুমিও… আমি কী ভাবে থাকব যদি তুমিও এখানে না থাকো?’ গের্ট দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে একদম চুপ করে বসে থাকে। অবাক হয়ে বের্শেন লক্ষ্য করে যে গের্ট অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়ে আছে। বের্শেন চলে যাচ্ছে বলে গের্টের চোখে জল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে সে বের্শেনের গলা জড়িয়ে ধরে।

শিক্ষকের কাছে চিঠি লেখে বের্নহার্ড ফরাসি ভাষায়,


মঁসিয়ে,

আপনাকে আমার পরিস্থিতি বিষয়ে অবগত করাবার জন্য নিঃসঙ্কোচে এই পত্র লিখছি। আপনি যখন পারী নগরে গিয়েছিলেন, তখন আমি জানতাম না যে এত শীঘ্র নিজের ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি স্থির করবার জন্য কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে। বর্তমান সময়ে আমি দ্বিধাগ্রস্ত যে আমি যে কোনো চাকরিতে যোগ দেব নাকি আপনার নির্দেশিত পথে আপনার সঙ্গে পারী শহরে গিয়ে নিজের সঙ্গীতপ্রতিভা প্রমাণ করবার জন্য আরও কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়াব। আমার পিতা অর্থনৈতিক সমস্যায় আছেন এবং তিনি চান যেন আমি এখনই স্কুল ত্যাগ করি। পিতা আমাকে খুব বেশি অর্থনৈতিক সাহায্য দিতে সক্ষম হবেন না। ফলে আমি যদি পারী নগরে যাই, সেখানে আমাকেই উপার্জন করতে হবে। যদি আপনি আমাকে ছাত্র হিসেবে গ্রহণ করেন, তাহলে অবশ্য আমি সব সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হব এবং সবক্ষেত্রে সফলতা লাভ করব, এমন আশা রাখি।

আপনার কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই।

আপনার একান্ত অনুগত ছাত্র,

বের্নহার্ড


বাড়ির পরিবেশ যে সাঙ্ঘাতিকভাবে বদলে গেছে, ব্যাপারটা এমন নয়। বাবা মা যেভাবে থাকতেন বোন মনিকে নিয়ে, তেমনটিই আছেন। তবে বাড়ির ঘোড়াগুলো এবং গাড়িটা বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির চারপাশে যে জমিগুলো ছিল, সেগুলো বিক্রি করা হয়েছে। চাকরবাকর যারা ছিল, সব একে একে বিদায় নিচ্ছে। শুধু যে পুরনো বৃদ্ধ গাড়োয়ান ছিলেন, তিনি এখন থেকে গৃহভৃত্য হিসেবে থাকবেন। মনির আয়া, যিনি শিশুকালে বের্নহার্ডকেও দেখাশোনা করতেন, তিনিও থাকছেন।

যেহেতু আগে থেকেই ঠিক ছিল যে বের্নহার্ড সঙগীত নিয়ে পড়াশুনা করবে এবং পারী শহরে যাবে, সেহেতু তার অবস্থান কিছুটা বদলে গেছে বাড়িতে। ফলে সারাদিন সে যাইই করুক না কেন, তাকে কেউ কিছু বলে না এবং তার উপরে সাঙ্ঘাতিক কঠোর বিধিনিষেধ কিছু আরোপ করা হয়নি। সে যখন পিয়ানো অভ্যাস করে, তখন কেউ তাকে বিরক্ত করে না। অর্থাৎ তার ক্রিয়াকলাপ আগের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে এখন।

বের্নহার্ড মনির সঙ্গে অনেকটা সময় ধরে কথোপকথন চালিয়ে যায়। জঙ্গলে হাঁটতে যায় তারা। মনির ছোট হাত ধরে থাকে সে এবং তার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দেয়। মনি খুবই বুদ্ধিমতী মেয়ে এবং ধৈর্য ধরে সে তার সব কথা শোনে। হাঁটতে হাঁটতে মাথাটা একদিকে একটু হেলিয়ে দাদার দিকে তাকিয়ে সব কথা শুনে যায় মনি।

-‘বের্শেন’… মনিই সাধারণত প্রথমে বাক্যালাপ শুরু করে এবং তার মিষ্টি গলায় নিজের নামটা শুনতে বের্নহার্ডের খুব ভাল লাগে … ‘বের্শেন, তুমি তো চলে যাবে শুনলাম… তা তুমি ফিরবে কবে?’

-‘সে তো জানি না, মনি!’

-‘জায়গাটা কি অনেক দূর?’

-‘নাহ, খুব বেশি দূর নয়। তুমি যদি আমায় চিঠি লেখ, আমি পরদিন সন্ধেবেলার মধ্যেই সে চিঠি পেয়ে যাব।’

-‘কিন্তু আমি তো লিখতে শিখিনি এখনও।’

-‘তুমি মা’কে বলে দেবে তোমার যা বলার। মা লিখে দেবেন তোমার হয়ে।’

-‘তুমিও আমায় চিঠি লিখবে তো?’

-‘অবশ্যই লিখব… আর তুমি যদি চাও তোমার জন্য খেলনাও পাঠাতে পারি।’

-‘ওঃ, অবশ্যই বের্শেন। অবশ্যই চাই।’

-‘সেইজন্য কি তুমি আমাকে একটা চুমু দেবে এখন?’

-‘অনেকগুলো দেব। কিন্তু তার জন্য তোমাকে নিচু হয়ে বসতে হবে। কারণ তোমার মুখ অবধি আমি উঠতে পারব না। আমার মনে হয় যে তোমার মুখটা খুব সুন্দর!’

বের্শেন একটা গাছের গোড়ার কাছে উঁচু শিকড়ের উপরে বসে মনির হাতটা ছেড়ে দিয়ে। শিশুটি তার সামনে চুপ করে গম্ভীরমুখে দাঁড়ায়… ‘বের্শেন, তোমার কি মনে হয় আমার মুখটাও সুন্দর?’

‘খুব’ বলে ওঠে বের্নহার্ড… ‘খুব সুন্দর, বিশেষভাবে সুন্দর!’

এবং এই কথাটা যে শুধুই তার মনে হয় এমন নয়। সে অন্তর থেকে অনুভব করে। মনির ছোট্ট মুখটা ভারি সুন্দর। তার কমনীয় ত্বক সূর্যের রশ্মিতে একটু লাল হয়ে গিয়েছে, তার বড় বড় চোখ যেন আলোর শিখার মত, নাকি তারার মত উজ্জ্বল। অসম্ভব মনে হয় বের্নহার্ডের কাছে মনির চোখের সঠিক কোনো উপমা খুঁজে বের করা… একটু ঢেউ খেলানো সোনালি চুল খুব ভারি নয়, রেশমের মত মসৃণ, মোলায়েম, ফুরফুরে। সবচেয়ে সুন্দর মনির হাতদু’খানি। সাধারণ শিশুদের মত নরমসরম গোলগাল নয় তার হাত। রোদ্দুরে লালচে হয়ে ওঠা সুঠাম হাতে সুগঠিত আঙুলগুলো, হাতের পাতার উপরিভাগে শিরা জেগে আছে। ক্ষুদ্র হাতের এই নীলচে চকচকে শিরাগুলি দেখতে অপূর্ব বলে মনে হল বের্নহার্ডের।

‘মনি’ বলে বের্নহার্ড… ‘চুমু কই?’


(চলবে)
0

ধারাবাহিক - সুদীপ ঘোষাল

Posted in





বাইশ

রাজবাড়ি তার জৌলুস হারালেও পুজোর রীতি নীতি, জৌলুস কোনওটাই কমেনি আজও। অতীতের নিয়ম মেনেই পূজিত হন দেবী পটেশ্বরী। প্রতিপদ থেকে এই পুজো শুরু হয়ে যায়। এই পুজো নাকি বর্ধমানের রাজা মহাতাব চাঁদ শুরু করেছিলেন। কাঠের পটের উপর নানান রঙ দিয়ে আঁকা হতো দশভূজাকে। এখানে কেবল গণেশের দুটি চোখ দেখা যায়। বাকি সকলেরই দেখা যায় একটি করে চোখ। এমন ভাবেই আঁকা হয় এই পট। এই বাড়িতে আজও আছে বলি প্রথা। তবে পাঁঠা নয়, বলি হয় মিষ্টির। আগে অবশ্য কুমড়ো বলি হতো। নবকুমারীর পুজোও হয় এই বাড়িতে অষ্টমীর দিন। সমীরণ বলে,বীরভূমের পট নিয়ে প্রচুর কিছু লেখা না হলেও কিছু মূল্যবান আলোচনা রয়েছে। যাদু পটুয়াদের কথা লিখেছেন ও’ম্যালি, গৌরীহর মিত্র প্রমুখ। এই পটুয়াদের সঙ্গে হাট সেরান্দির পটশিল্পীদের পার্থক্য রয়েছে।এখানকার পটশিল্পীরা সূত্রধর সম্প্রদায়ের। পটের সঙ্গে গান এঁরা করেন না। কেবলমাত্র দুর্গার পট আঁকা/লেখা ছাড়া অন্য পটও করেন না। সে দিক থেকে অন্যান্য পটুয়া সম্প্রদায়ের সঙ্গে এই পটশিল্পীদের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে, এমনটা বলা যায় না। কিন্তু শোনা যায়, হাট সেরান্দির সূত্রধর শিল্পীদের পূর্বপুরুষ রাজারাম এসেছিলেন অজয়পাড়ের ভেদিয়া থেকে। তিনিও পটের শিল্পী ছিলেন। ভেদিয়া নামটির উৎস কেউ কেউ‘বেদিয়া’ বলে গণ্য করা হয়। বেদিয়াদের মধ্যে পটশিল্পীদের গোষ্ঠী রয়েছে। আসলে আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলি একটি অন্যটির সঙ্গে কোথাও না কোথাও জুড়ে রয়েছে। এই যোগসূত্রগুলি খুঁজে দেখা দরকার। যাই হোক, বর্তমানে আমরা সূত্রধর শিল্পীদের মধ্যে পট আঁকার প্রায় দুশো বছরের ধারাবাহিক ইতিহাস পাচ্ছি। রামকৃষ্ণ সূত্রধরের পিতা আদরগোপাল, তাঁর পিতা কালীপদ, কালীপদের পিতা শিবরাম, শিবরামের পূর্বে দ্বারিকানাথ, তদূর্ধ্ব রাজারাম। এ ভাবেই পারিবারিক ইতিহাস বাহিত হয়েছে। সূত্রধরদের মধ্যে প্রবীণ মানিকচাঁদ গুণী শিল্পী। এই সম্প্রদায়ের বাইরে রয়েছেন রত্নাকর মেটে। পটশিল্পের ইতিহাস নিয়ে বিশদ আলোচনায় যাচ্ছি না। আমার উদ্দেশ্য বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে কিছু কথা বলা।

সমীরণ নিজের আশ্রমে বেশিদিন তাকে না।এবার রিমি ও বিপিনকে নিয়ে চলে এলো কালনা ঘুরতে।সমীরণ বলে,পূর্ব বর্ধমান জেলার উল্লেখযোগ্য শহর অম্বিকা কালনা।ছোটথেকেই শুনে আসছি কালনা শহরের ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের কথা।দেখার সৌভাগ্য হল ডি এল এড পড়ার সুবাদে।কালনা নবকৈলাস মন্দিরের ১০৯টি মন্দিরের মধ্যে ১০৮টি মন্দির জ্যামিতিক বৃত্তে বিন্যস্ত। দুটি বৃত্তে বিন্যস্ত এই মন্দিরগুলির বাইরের বৃত্তে ৭৮টি এবং ভেতরের বৃত্তে মোট ৩৪টি অবস্থিত। বৃত্তের বহির্দেশে, পশ্চিমদিকে ১০৯ সংখ্যক মন্দিরটি অবস্থিত। বৃত্তের মধ্যে অবস্থিত ১০৮টি মন্দির আটচালার আকৃতিতে নির্মিত। ভিতরের বৃত্তের পরিধি প্রায় ৩৩৬ ফুট এবং বাইরের বৃত্তের পরিধি ৭১০ ফুট। এই মন্দিরগুলি স্বল্প উঁচু ভিত্তিবেদীর উপর স্থাপিত এবং মন্দিরগুলি পরস্পর সংলগ্ন। মন্দিরগুলির উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট এবং প্রস্থ ৯.৫ ফুট। এই মন্দিরের দেয়ালে রামায়ণ ও মহাভারতের পর্ব এবং শিকারের বহু দৃশ্যও চিত্রিত রয়েছে। ১০৯ সংখ্যক মন্দিরটি আটটি সিঁড়িবিশিস্ট বারান্দার উপর অবস্থিত । এর মন্দিরটি ৬ ফুট উচ্চ ভিত্তিবেদীর উপর অবস্থিত, যার আয়তন ১৩ ফুট X ১৩ ফুট এবং উচ্চতা ৩৫ ফুট। এই মন্দিরটির বর্তমান নাম জলেশ্বর।বৃত্তদুটির কেন্দ্রে একটি বাধানো ইঁদারা আছে যা মন্দিরের পূজার কাজে ব্যবহৃত জলের চাহিদা মেটায়। তবে অনেকে মনে করেন এটি শূণ্য অর্থাৎ নিরাকার ব্রহ্মস্বরূপ শিবের প্রতীক।

বর্ধমান রাজপরিবারে বৈষ্ণব ভাবধারা প্রচলিত ছিল। গঙ্গার অবস্থিতি এবং বৈষ্ণব পাট হিসেবে পরিচিত হওয়ায় বর্ধমান রাজপরিবার কালনাতেও আবাসস্থল এবং বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য মন্দির স্থাপন করে। রাজপরিবারের সদস্যরা কালনায় গঙ্গাস্নানে যেতেন। এই উদ্দেশ্যে বর্ধমান এবং কালনার মধ্যে ১৮৩১ সাধারণাব্দে রাজপথ নির্মাণ করান তেজচন্দ্‌। এই সঙ্গে নির্মিত হয় প্রতি আট মাইল অন্তর জলাশয়, বাংলো, আস্তাবল ইত্যাদি। ভোলানাথ চন্দ্র প্রণীত 'ট্রাভেলস অব আ হিন্দু' (লন্ডন, ১৮৬৯) এবং ডব্লু ডব্লু হান্টারের 'আ স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্ট অব বেঙ্গল' (১৮৭৬) উদ্ধৃত করে বলা যায় যে, গঙ্গার ধারে ছিমছাম সুন্দর শহরের রূপকার বর্ধমান রাজপরিবার। কালনা ছিল বর্ধমান জেলার একমাত্র বন্দর এবং মূল বাণিজ্যকেন্দ্র। জেলার বাণিজ্যের আমদানি-রপ্তানি হত কালনা বন্দরের মাধ্যমে। কালনা পুরসভার অস্তিত্ব পাওয়া যায় ১৮৭১ সাধারণাব্দে। ১৮৭২-য় কালনার জনসংখ্যা ছিল ২৭,৩৩৬। 'ক্যালকাটা রিভিউ' পত্রিকায় রেভারেন্ড জেমস্‌ লং-এর রচনা থেকে জানা যায় যে, কালনা বাজারে ইটের তৈরি এক হাজার দোকান ছিল। রংপুর, দেওয়ানগঞ্জ এবং জাফরগঞ্জ থেকে প্রচুর পরিমাণে চাল কিনে মজুত করা হত কালনায়। খাদ্যশস্য, সিল্ক, তুলো ইত্যাদি ছিল প্রধান পণ্যদ্রব্য।

এ হেন কালনা রাজবাড়ি চত্বরের সবচেয়ে পুরোনো পঁচিশচূড়া মন্দিরটি হল লালজি মন্দির। ১৭৩৯ সাধারণাব্দে মন্দিরটি নির্মাণ করান বর্ধমানের জমিদার কীর্তিচন্দ্‌-জননী ব্রজকিশোরী দেবী। মন্দিরের প্রকৃত ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিংবদন্তি। 'লালজি'-র নামকরণের পিছনে তেমনই একটি কিংবদন্তি আছে।

কালনা ভ্রমণ শুরু করলাম চকবাজার এলাকায় অবস্থিত বিখ্যাত নবকৈলাস দর্শনের মধ্যে দিয়ে যা ১০৮ শিবমন্দির বলে পরিচিত। অম্বিকা কালনা ষ্টেশন থেকে টোটো করে চলে এলাম শহরের প্রানকেন্দ্রে ১৮০৯ সালে বর্ধমানের রাজা তেজ বাহাদুর কতৃক প্রতিষ্ঠিত অপরূপ শিল্পের এই একচালা মন্দির প্রাঙ্গণে। দুটি বৃত্তের মধ্যে ৪টি প্রবেশদ্বার নিয়ে ৭৪টি মন্দির বাইরে ও ভিতরে ৩৪টি মন্দির রয়েছে। বাইরের ৭৪টি মন্দিরে একটি সাদা শিবলিঙ্গ ও পাশেরটি কালো শিবলিঙ্গ এবং ভিতরের ৩৪টি মন্দিরে সাদা পাথরের শিবলিঙ্গ রয়েছে। মন্দিরের প্রত‍্যেকটি শিবলিঙ্গ উওরমুখী এবং শিবলিঙ্গগুলোর অবস্থান ও কিছুটা ভিন্ন। মন্দির প্রাঙ্গণের কেন্দ্রস্থলে লোহার জাল দ্বারা পরিবেষ্টিত এক জলাধার রয়েছে যেখানে দাঁড়িয়ে ৩৪টি শিবলিঙ্গ একসাথে দেখা যায়। অদ্ভূত এক চিন্তা চেতনা ও ভাবনার নিদর্শন হচ্ছে এই নবকৈলাস বা ১০৮ শিবমন্দির।প্রখর বুদ্ধিমতী ব্রজকিশোরী তাঁর রাধিকা মূর্তির সঙ্গে বিবাহ দিয়েছিলেন এক সন্ন্যাসীর কাছে থাকা শ্যামরায়-এর এবং রাজ-জামাতা 'লালজি'-র আবাসস্থল হিসেবে অনন্য শৈলীর দেবালয়টি নির্মাণ করিয়ে ছিলেন।
0

গল্প - মনোজ কর

Posted in

পর্ব-২২

বণিকের মানদন্ড দেখ দিল রাজদণ্ডরূপে

(সময়ানুক্রমিক সংক্ষিপ্ত বিবরণী)-তৃতীয় অংশ

মারাঠা রাজ্যে তখন পাঁচ সর্দারের মধ্যে তীব্র অন্তর্কলহ। এই পাঁচ সর্দাররা যথাক্রমে পুনার পেশোয়া, নাগপুরের ভোঁসলে, গোয়ালিয়রের সিন্ধিয়া ,ইন্দোরের হোলকার এবং বরোদার গায়কোয়াড়। সর্দারদের অভ্যন্তরীণ কলহে দীর্ণ মারাঠা রাজ্যের অবস্থা তখন শোচনীয় বলা যেতে পারে। নানা ফড়নবীশ পেশোয়াকে কার্যত ক্ষমতাহীন করে রেখেছে তখন।১৭৯৫ সালে তৎকালীন পেশোয়া মাধবরাও নারায়ণ মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে মাত্র ২১ বছর বয়সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সমস্যায় সমগ্র মারাঠা রাজনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নতুন পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাও নানা ফড়নবীশের হাত থেকে বাঁচার জন্য বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে জোট বাঁধার চেষ্টা করতে থাকে। এইসময় ১৮০০ সালে নানা ফড়নবীশ পুনাতে দেহত্যাগ করে এবং মারাঠা রাজ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছয়।দৌলত রাও সিন্ধিয়া তখন পেশোয়াকে সমর্থন করলেও হোলকারের সৈন্যসামন্ত মালওয়া অঞ্চলে ব্যাপক লুঠতরাজ চালাতে শুরু করে দিল।নিরুপায় পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাও অগত্যা ইংরেজদের শরণাপন্ন হলো। ওয়েলেসলি ইতিমধ্যে ভারতে এসে গেছে এবং ভারতীয় রাজ্যগুলির প্রতি ব্রিটিশদের মনোভাব অনেকটাই পাল্টে গেছে। হায়দ্রাবাদের নিজাম ইংরেজদের সঙ্গে অধীনতামূলক মিত্রতার শর্তাবলী মেনে নিয়েছে। সাবসিডিয়ারি অ্যালায়েন্স বা অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির মূল কথা হল যে— কোন দেশীয় রাজ্যের রাজা ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা চুক্তিতে আবদ্ধ হতে পারবেন । দেশীয় রাজাদের অভ্যন্তরীণ অধিকার ক্ষুন্ন না করে তাঁদের নিজেদের অধীনে রাখাই হল অধীনতামূলক মিত্রতা নীতির মূল কথা । কোনো দেশীয় রাজা এই নীতি গ্রহণ করলে তাঁকে কতকগুলি শর্ত পালন করতে হত, যেমন—

১) অধীনতামূলক মিত্রতায় আবদ্ধ দেশীয় রাজাগুলিকে কোম্পানির বশ্যতা স্বীকার করতে হত ।

২) সংশ্লিষ্ট দেশীয় রাজ্যগুলিতে একদল ইংরেজ সৈন্য এবং একজন ইংরেজ রেসিডেন্ট রাখতে হত ।

৩) সৈন্যবাহিনীর ব্যয়নির্বাহের জন্য মিত্রতাবদ্ধ রাজ্যকে নগদ টাকা বা রাজ্যের একাংশ ছেড়ে দিতে হত।

৪) কোম্পানির বিনা অনুমতিতে অপর কোনো শক্তির সঙ্গে মিত্রতা বা যুদ্ধবিগ্রহ করা যেত না । অর্থাৎ মিত্র রাজ্যগুলির বৈদেশিক নীতি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নির্ধারণ করত ।

৫) চুক্তিবদ্ধ রাজ্যে ইংরেজ ছাড়া অন্যান্য সমস্ত ইউরোপীয়কে তাড়িয়ে দিতে হত ।

৬) এই সব বশ্যতার বিনিময়ে কোম্পানি সেই রাজ্যকে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, বৈদেশিক আক্রমণ এবং অন্যান্য বিপদ থেকে রক্ষা করত ।

হায়দ্রাবাদ এবং মাইসোরের পর মারাঠাদের মুখোমুখি হবার সুযোগ পেয়ে গেল ব্রিটিশ। ১৮০২ সালে হোলকাররা যখন পেশোয়াকে পর্যুদস্ত করে এবং পুনাতে ব্যাপক লুন্ঠন শুরু করলো তখন পেশোয়া ভাসাই পালিয়ে গিয়ে ব্রিটিশদের সঙ্গে অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তি স্বাক্ষর করে কার্যত ব্রিটিশদের অধীনতা স্বীকার করে নিল। সুরাত দিয়ে দেওয়া হল কোম্পানিকে। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাওকে পুনার সিংহাসনে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করলো ব্রিটিশ সেনাবাহিনী। কিন্তু মারাঠাদের স্বাধীনতা খর্ব করা গেল না। আসলে এখান থেকেই শুরু হলো দ্বিতীয় ব্রিটিশ-মারাঠা যুদ্ধের। মারাঠা রাজত্ব কুক্ষিগত করার জন্য হোলকার অন্য সর্দারদের সঙ্গে জোট বাঁধার চেষ্টা শুরু করে দিল। অন্যদিকে ওয়েলেসলি এবং লেক বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধে নেমে পড়লো। প্রায় দু’বছর যুদ্ধের পর ১৮০৫ সালে মারাঠা রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলকে এবং মারাঠা অধিকৃত অন্যান্য অঞ্চলকেও নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসতে সক্ষম হলো ওয়েলেসলি। রাজপুত, জাঠ, রোহিল্লা এবং উত্তর মালওয়ার বুন্দেলারাও ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রনে এসে গেল। সিন্ধিয়ারাও দিল্লি, আগ্রা, গুজরাট এবং অন্যান্য মারাঠা অঞ্চলকে অধীনতামূলক মিত্রতার আওতায় নিয়ে আসতে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু এতসব কিছু করার পরেও মারাঠা শক্তিকে সম্পূর্ণ বিনষ্ট করা গেল না। বিদ্রোহের আগুন জ্বলতেই থাকলো সর্দারদের মধ্যে।

অন্যদিকে ক্রমবর্ধমান যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যয়ভার বহন করতে সক্ষম না হয়ে ব্রিটিশ সরকার ওয়েলেসলিকে ১৮০৫ সালে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেল। নতুন গভর্নর জেনারেল হয়ে আবার এলো কর্নওয়ালিশ। তাকে পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া হলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকার জন্য। এই সুযোগে হোলকার এবং সিন্ধিয়ারা মালওয়া এবং রাজস্থানের গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক লুন্ঠন চালু করে দিল। এভাবেই চলতে থাকলো যতক্ষণ না ১৮১৩ সালে হেস্টিংস ভারতবর্ষে এল নতুন গভর্নর জেনারেল হয়ে। হেস্টিংস এসেই সর্বপ্রধানত্বের নীতি চালু করে। প্যারামাউন্টসি বা সর্বপ্রধানত্বের নীতি অনুযায়ী কোম্পানিই হচ্ছে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী এবং এই ক্ষমতাকে রক্ষা করার জন্য কোম্পানি যে কোনও রাজ্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং প্রয়োজনে সেই রাজ্যকে সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দিতে পারে। এইসময় পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাও আর একবার সর্দারদের সংগঠিত করে স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের শেষ চেষ্টা করে। শুরু হয় তৃতীয় ব্রিটিশ মারাঠা যুদ্ধ (১৮১৭-১৯)। এই যুদ্ধে হোলকার এবং পিন্ডারিরা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ব্রিটিশরা পেশোয়া দ্বিতীয় বাজি রাও এর অধীনস্থ সমস্ত অঞ্চল নিজেদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসে এবং পেশোয়া প্রথা চিরতরে বিলুপ্ত করে দেয়। ভোঁসলে এবং হোলকারদের নিয়ন্ত্রনে থাকা বিস্তীর্ণ অঞ্চল অধীনতামূলক মিত্রতার আওতায় নিয়ে এসে মারাঠা রাজ্যজয় সম্পূর্ণ করে ব্রিটিশরা।

ইতিমধ্যে উত্তর ভারতেও বিভিন্ন অঞ্চল দখলের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। বক্সারের যুদ্ধ এবং এলাহাবাদ চুক্তির পরবর্তী পর্যায়ে অবধ একটি নিরপেক্ষ রাজ্য হিসাবে ব্রিটিশ অধ্যুষিত বাংলা এবং রাজনৈতিক ভাবে বিপর্যস্ত উত্তর ভারতের মধ্যে অবস্থান করছিল। মারাঠাদের হাত থেকে অবধকে রক্ষা করার অছিলায় ব্রিটিশেরা ১৭৭৩ সালে অবধের দরবারে নিজেদের প্রতিনিধি এবং পাকাপাকি ভাবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী নিয়োগ করে। এই প্রতিনিধি এবং সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার বহন করার দায়িত্ব নিতে হয় নবাব সুজাউদ্দৌল্লাকে। এই ব্যয়ের পরিমাণ ক্রমশ বাড়াতে থাকে ব্রিটিশেরা। ব্রিটিশদের এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটানোর জন্য করবৃদ্ধি করতে বাধ্য হয় নবাব সুজাউদ্দৌল্লা। করবৃদ্ধির ফলস্বরূপ তালুকদারদের সঙ্গে সংঘাত বাঁধে নবাবের এবং অবধে সৃষ্টি হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা। এই অস্থিরতার অজুহাতেই পরবর্তীকালে অবধ দখল করে নেয় ব্রিটিশ। ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৭৪ সালে গভর্নর জেনারেল হওয়ার পর সিদ্ধান্ত নেয় যে খরচের সমপরিমাণ রাজস্ব ব্রিটিশরা নিজেরাই আদায় করে নেবে এবং তার জন্য অবধ রাজ্যের কিছু কিছু অঞ্চল তারা অধিগ্রহণ করবে। মাইসোরের যুদ্ধ এবং ফরাসিদের মোকাবিলায় বিপুল অর্থব্যয়ের কারণে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হয়ে পড়ে ব্রিটিশদের। সেইসময় অবধের নবাব বেনারসের উপর আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছিল। অবধের হাত থেকে বাঁচানোর নামে এই টাকা আদায়ের জন্য বেনারসের রাজা চৈত সিং এর উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে ব্রিটিশেরা। ব্রিটিশদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে অবশেষে ১৭৮১ সালে ব্রিটিশদের কাছে বেনারসকে গচ্ছিত রাখতে বাধ্য হয় চৈত সিং। ১৭৭৫ সালে নবাব সুজাউদ্দৌল্লার মৃত্যু হয়। সুজাউদ্দৌল্লার বিশাল সম্পদের অধিকারী হয় তার স্ত্রী বেগম উম্মত উজ জাহারা। হেস্টিংসের নির্দেশে ব্রিটিশদের কাছে প্রয়াত সুজাউদ্দৌল্লার ধার মেটানোর জন্য তার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ মাসোহারা আদায় করতে শুরু করে ব্রিটিশরা। অবধ অধিগ্রহণের পরিকল্পনা ব্রিটিশদের দীর্ঘদিন ধরেই ছিল। ১৮০১ সালে ওয়েলেসলি এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করে যখন নবাব ওয়াজির আলি খান ব্রিটিশদের চাহিদা মেটোনোর অক্ষমতার কথা সর্বসমক্ষে জানায়। অবশ্য এই অধিগ্রহণের পিছনে অন্যান্য কারণও ছিল। এলাহাবাদ চুক্তির পর নবাব সুজাউদ্দৌল্লা বারবার কোম্পানির কাছে অভিযোগ জানিয়েছিল যে কোম্পানিকে দেওয়া করমুক্ত বাণিজ্যের অধিকারের ব্যাপক অপপ্রয়োগ ঘটাচ্ছে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা এবং তাদের ভারতীয় গোমস্তারা তাদের নিজেদের ব্যবসার জন্য। কোম্পানির অধিকর্তারা এব্যাপারে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেনি।এছাড়াও সমুদ্রপথে বাণিজ্যের জন্য তখন অবধ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। অষ্টাদশ শতাব্দির শেষদিকে লন্ডনে নীলের চাহিদা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই চাহিদার শতকরা ষাট ভাগ আসত অবধ থেকে। অবধের তুলো চিনা বাজারে বিক্রি করা হতো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ভারসাম্য ব্রিটিশদের অনুকূলে রাখার জন্য। সুতরাং ১৭৮৮ সালে কর্নওয়ালিশের সঙ্গে অবাধ এবং মুক্ত বাণিজ্যচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়া সত্ত্বেও রপ্তানির উপর নবাবের কর চাপানোর সিদ্ধান্ত নিশ্চিতভাবেই অনভিপ্রেত এবং যথেষ্ঠ বিরক্তির কারণ ছিল। সুতরাং অধিগ্রহণ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো যখন ওয়েলেসলি রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের অভিপ্রায় সঙ্গে নিয়ে ভারতবর্ষে এসে পৌঁছলো।

অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে প্রথম হস্তক্ষেপ করার সুযোগ এল ১৭৯৭ সালে সুজাউদ্দিন এর উত্তরসূরী নবাব আসাফুদ্দৌল্লার দেহান্তের পর। ব্রিটিশরা তার ছেলের নবাবের আসনের দাবি না মেনে আসাফুদ্দৌল্লার ভাই সাদাত আলি খানকে সিংহাসনে বসাল। মূল্যবাবদ সাদাত আলি খান ব্রিটিশদের বেশকিছু অঞ্চলের রাজস্ব আদায়ের অধিকার এবং কয়েক কিস্তিতে বছরে ৭৬ লক্ষ টাকা ভর্তুকি দেবার প্রতিশ্রুতি দিল। নতুন নবাব বছর বছর টাকা দিতে রাজি হলেও তার শাসনব্যবস্থায় ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে তীব্র আপত্তি জানালো। ব্রিটিশদের আসল উদ্দেশ্য সাধিত হল না। ১৮০১ সালে ওয়েলেসলি নিজের ভাই হেনরিকে পাঠালো সাদাত আলি খানের সঙ্গে ভর্তুকির প্রসঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে। চুক্তির ফলস্বরূপ অর্ধেক অবধ ব্রিটিশদের হাতে চলে গেল। চুক্তি অনুযায়ী এটা ঠিক হলো যে ভর্তুকির টাকা ব্রিটিশরা সরাসরি রাজস্ব হিসাবে রোহিলখন্ড, গোরখপুর এবং দোয়াব থেকে আদায় করে নেবে। বাস্তবে এই তিনটি অঞ্চল থেকে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ ছিল প্রায় এক কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা যা ছিল নির্দ্ধারিত ভর্তুকির প্রায় দ্বিগুন। যদিও যুক্তি হিসাবে দেখানো হল যে সাদাত আলি খানের অপশাসন থেকে অবধকে বাঁচাবার জন্য ব্রিটিশরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আসলে এই পদক্ষেপ রাজস্ব এবং ব্যবসার ক্ষেত্রে ঔপনিবেশিক চাহিদা ছাড়া আর কিছু নয়। যদিও এই চুক্তি ভর্তুকি আদায় সংক্রান্ত সমস্যার সম্ভাবনা সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট করেছিল তবুও ব্রিটিশদের জুলুমের কোনও অন্ত ছিল না। লক্ষ্ণৌ এর ব্রিটিশ রেসিডেন্সি ধীরে ধীরে অবধের ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে উঠতে থাকলো। অর্থ, সামরিক সহযোগিতা এবং নানারকম সুবিধার বিনিময়ে ব্রিটিশরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন দরবার, প্রশাসক এবং জমিদারশ্রেণী তৈরি করে নিল। ক্রমে ক্রমে পরিকল্পিত ভাবে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে নবাবকে কার্যত ক্ষমতাশূণ্য করে দিল ব্রিটিশ রেসিডেন্সি। অবশেষে ১৮৫৬ সালে অপশাসনের অজুহাতে লর্ড ডালহৌসি অবধের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রন নিজেদের করায়ত্ত করে নিল। উত্তর ভারত দখল প্রায় শেষ। বাকি রইল কেবল শিখ অধ্যুষিত পাঞ্জাব। অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগে ১৭৯৫ থেকে ১৭৯৮ সালের মধ্যবর্তী সময়ে রঞ্জিত সিং এর নেতৃত্বে শিখ সম্প্রদায় সংঘবদ্ধ হয়েছিল । রঞ্জিত সিং এর জীবদ্দশায় ব্রিটিশরা পাঞ্জাবের ধারে কাছে আসতে সাহস করেনি। রঞ্জিত সিং এর মৃত্যুর পর পাঞ্জাবে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। উত্তরাধিকার নিয়ে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘাত এবং যুদ্ধের শুরু হয়। রঞ্জিত সিং দীর্ঘ প্রচেষ্টায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে যে ভারসাম্য সৃষ্টি করে এক পতাকার তলায় সকলকে সমবেত করেছিলেন সেই ভারসাম্য ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকে। এই সুযোগে প্রশাসনের অভ্যন্তরে দুর্নীতি বাসা বাঁধতে থাকে। পাঞ্জাবি এবং ডোগরাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং কারদারদের অবাধ লুন্ঠন পাঞ্জাবের অর্থনীতিকে প্রায় ধ্বংস করে দিল। পাঞ্জাবের বিভিন্ন সম্প্রদায় ক্রমাগত একে অপরের থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো। ব্যবসায়ী সম্প্রদায় বিরক্ত হয়ে উঠতে লাগলো এবং পরিস্থিতি ক্রমশ ব্রিটিশ হস্তক্ষেপের অনুকূল হয়ে উঠতে শুরু করলো। সংক্ষেপে বলতে গেলে ১৮৩৯ সালে রঞ্জিত সিং মারা যাওয়ার আগে তার ছেলে খড়ক সিংকে উত্তরাধিকার অর্পণ করে যান। খড়ক সিং নিজে দক্ষ প্রশাসক ছিল না এবং বহুলাংশেই তার ডোগরা উজির রাজা ধ্যান সিং এর উপর নির্ভরশীল ছিল। সম্পর্ক প্রথমে ভালো থাকলেও পরবর্তী কালে খড়ক সিং এর ক্ষমতা হ্রাস করার জন্য ধ্যান সিং রাজদরবারে ডোগরা বিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকে। ধ্যান সিং তখন যুবরাজ নাও নিহাল সিং এর সঙ্গে জোট বেঁধে ডোগরা বিরোধীদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। কিন্তু এই লড়াই বেড়ে ওঠার আগেই ১৮৪০ সালে খড়ক সিং এর মৃত্যু হয়। তার কিছুদিনের মধ্যেই এক আকস্মিক দুর্ঘটনায় নাও নিহাল সিং এর মৃত্যু হয়। এমতাবস্থায় সিংহাসনের অধিকার নিয়ে পরিবারের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। একদিকে ছয় জীবিত যুবরাজের একজন যুবরাজ শের সিং অন্যদিকে খড়ক সিং এর পত্নী মহারাণী চাঁদ কাউর। তিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসাবে নিহাল সিং এর বিধবা পত্নীর গর্ভস্থ সন্তানের অধিকার দাবি করেন। ডোগরা সম্প্রদায় শের সিং এর প্রতি তাদের সমর্থন জ্ঞাপন করে। অন্যদিকে সিন্ধনওয়ালিয়া সর্দারেরা মহারাণীর পক্ষ নেয়। দু পক্ষই সমর্থন চেয়ে ব্রিটিশদের দ্বারস্থ হয়। ব্রিটিশরা নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। অবশেষে ডোগরাদের চক্রান্তে শের সিং সিংহাসনে বসে এবং উজির ধ্যান সিং এর সাহায্য প্রার্থনা করে। কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। কিছুদিনের মধ্যেই ধ্যান সিং এর ক্রমবর্ধমান ক্ষমতা হ্রাসের অভিপ্রায়ে শের সিং তার বিরোধীপক্ষের সিন্ধনওয়ালিয়া সর্দারদের সাহায্য প্রার্থনা করে। সিন্ধনওয়ালিয়া সর্দারেরা বৃহত্তর রাজপরিবারের অংশ ছিল।তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। সিন্ধনওয়ালিয়া সর্দারেরা ১৮৪৩ সালে শের সিং , শের সিং এর পুত্র এবং রাজা ধ্যান সিংকে হত্যা করে নিজেদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। ধ্যান সিং এর ছেলে রাজা হীরা সিং ডোগরা সেনাবাহিনীর একাংশের সাহায্যে সিন্ধনওয়ালিয়া নেতাদের হত্যা করে রঞ্জিত সিং এর কনিষ্ঠ সন্তান পঞ্চবর্ষীয় দলীপ সিং কে সিংহাসনে বসিয়ে নিজে উজিরের পদে বসে। রাজপ্রাসাদের অভ্যন্তরীণ বিবাদ এবং সর্দারদের পারষ্পরিক শত্রুতা বাড়তেই থাকে। ইতিমধ্যে খালসা সেনাবাহিনী নিজেরা ক্ষমতার কেন্দ্রে এসে পাঞ্জাবের রাজনীতি নিয়ন্ত্রন করতে শুরু করে। শের সিং এর রাজত্বে সেনাবাহিনীর সদস্যেরা ছোট ছোট দল বা পঞ্চায়েত গঠন করে সরাসরি মহারাজের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করে। এইসমস্ত পঞ্চায়েতগুলি এখন রাজদরবারে তাদের চাহিদা বাড়াতে থাকে দিনের পর দিন। তাদের চাহিদা না মিটিয়ে হীরা সিং এর পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। কিন্তু এইভাবে বেশিদিন চলা সম্ভব নয়। সেনাবাহিনীর মধ্যে ডোগরা বিরোধী মনোভাব বাড়তে থাকে এবং ১৮৪৪ সালে হীরা সিং সেনাবাহিনীর বিক্ষুব্ধ অংশের হাতে নিহত হয়। দলীপ সিং এর মা অর্থাৎ রঞ্জিত সিং এর কনিষ্ঠা স্ত্রী মহারাণী জিন্দন রিজেন্ট নিযুক্ত হয় এবং তার ভাই সর্দার জওয়াহির সিং উজিরের পদে বসে। কার্যত এই দুজনেই সেনাবাহিনীর হাতের পুতুল ছিল। একদিকে খালসা সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক উত্থান এবং গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র নিয়ে তাদের পরিকল্পনা এবং অন্যদিকে লাহোরে কোনও স্থায়ী সরকার না থাকায় ব্রিটিশরা পাঞ্জাব নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। ঊনবিংশ শতকের প্রথম দিকে ব্রিটিশরা পাঞ্জাবকে একদিকে অধিকৃত উত্তর ভারত এবং অন্যদিকে পার্সিয়া এবং আফগানিস্তানের মুসলমান শাসকদের মধ্যে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করছিল। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি পাবার সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশরা বুঝতে পারল এই নীতি আর কাজে লাগবে না। ১৮৪০ সাল থেকেই ব্রিটিশরা শিখদের সঙ্গে যুদ্ধের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু করেছিল। ১৮৪৩ সাল থেকে ব্রিটিশরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। ১৮৪৫ সালের সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীর হাতে জওয়াহির সিং এর হত্যার সঙ্গে সঙ্গে লর্ড হার্ডিঞ্জ পাকাপাকি ভাবে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৩ই ডিসেম্বর ১৮৪৫ শুরু হয় ব্রিটিশদের সঙ্গে শিখদের যুদ্ধ। অসফল যুদ্ধ পরিচালনা এবং কিছু সর্দারদের বিশ্বাসঘাতকার জন্য শিখরা এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়। ১৮৪৬ সালে স্বাক্ষরিত হয় অপমানজনক লাহোর চুক্তি। এই চুক্তি অনুযায়ী জলন্ধর দোয়াবের বিলুপ্তি ঘটে, কাশ্মির দিয়ে দেওয়া হয় ব্রিটিশ তাঁবেদার জম্মুর রাজা গুলাব সিংকে। লাহোর সেনাবিহিনীর সৈন্যসংখ্যা কমিয়ে সেখানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী বসানো হয়। দলীপ সিংকে সিংহাসনে রাখা হলো কিন্তু অভিবাবকের আসনে বসানো হলো ব্রিটিশ প্রতিনিধিকে।মহারাণী জিন্দানকে সরানো হল রিজেন্ট পদ থেকে এবং ব্রিটিশ প্রতিনিধির হাতে সমস্ত বিভাগের সমস্ত সিদ্ধান্ত নেবার একচ্ছত্র অধিকার দেওয়া হলো। রাজা এবং রাজমাতার ভূমিকা কেবলমাত্র প্রতীকী হয়ে রইল। যেহেতু ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য ছিল পাঞ্জাবকে সামগ্রিক ভাবে নিজেদের করায়ত্ত করা সেইজন্য ১৮৪৯ সালে দ্বিতীয় ব্রিটিশ- পাঞ্জাব যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই বিদ্রোহী মুলতানের গভর্নর দিওয়ান মুল রাজ, আটারিওয়ালার গভর্নর সর্দার ছত্তর সিং এবং তার পুত্র হরিপুরের রাজা শের সিংকে দমন করার অজুহাতে সমগ্র পাঞ্জাব নিজেদের অধিকারে নিয়ে নিল ব্রিটিশরা। ১৮৪৯ সালের ২৯শে মার্চ মহারাজা দলীপ সিং পাঞ্জাবের স্বাধীনতা ব্রিটিশদের হাতে তুলে দিয়ে পাঞ্জাবকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশে পরিণত করার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হলো। বিদ্রোহী সর্দারদের একে একে ব্রিটিশদের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আর কোনও উপায় রইলো না।

উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলগুলিও ক্রমে ক্রমে ব্রিটিশদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রনে আসতে থাকল। কোম্পানি অধিকৃত এই সাম্রাজ্যের নিরাপত্তাজনিত কারণে ব্রিটিশ আগ্রাসন আরও তীব্র আকার ধারণ করলো। ভারতবর্ষের ব্রিটিশ সামরিক আধিকারিকেরা দেশের বাইরে এবং ভিতর থেকে আক্রমণের আশঙ্কায় বিচলিত হয়ে যত্রতত্র সামরিক ক্ষমতাপ্রদর্শনের নেশায় মেতে উঠলো। এই নিরাপত্তাজনিত আশঙ্কার কারণেই আগ্রাসন সংক্রান্ত ব্রিটিশ সরকারের এবং লন্ডনের কোম্পানি কর্তাদের সমস্ত বিধিনিষেধ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ১৮২৩ সালে আমহার্স্ট যখন ভারতের গভর্নর জেনারেল হয়ে আসে তখন তার প্রতি নির্দেশ ছিল যে ভারতবর্ষে ব্যয়সাপেক্ষ রাজকীয় যুদ্ধ এবং আগ্রাসনের প্রক্রিয়া বন্ধ করে যেন শান্তির পরিবেশ ফিরিয়ে আনা হয়। কিন্তু ভারতে পৌঁছোনোর সঙ্গে সঙ্গেই বাঙলার উত্তর-পূর্ব সীমান্তে বর্মা থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠলো। বর্মার রাজশক্তি অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে রাজ্যবিস্তারের উদ্দেশ্যে ক্রমে ক্রমে পেগু, তেনাসেরিম এবং আরাকানের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নেয়। উনবিংশ শতকের প্রথম দিকে মণিপুর, কাছার এবং আসামে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করে। এতদিন বর্মার এইসমস্ত কাজকর্মকে কোম্পানির কর্তারা খুব একটা আমল দেয়নি। কিন্তু এখন ব্রিটিশ সামরিকবাহিনী এলাকাদখলের নেশায় উন্মত্ত। তারা যুক্তি খাড়া করলো যে বর্মার এই আগ্রাসন থেকে অভ্যন্তরীণ শত্রুরা সাহস সঞ্চয় করছে। বিপদের সম্ভাবনা সমূলে বিনষ্ট করার জন্য বর্মাকে উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া খুব দরকার। ১৮২৪ সালে শুরু হলো প্রথম বর্মা যুদ্ধ। আসাম, নাগাল্যান্ড এবং বর্মা অধিকৃত আরাকান এবং তেনাসেরিম ব্রিটিশরা দখল করে নিল। ১৮৩০ সালে কাছার এবং ১৮৩৪ সালে বেন্টিঙ্কের আমলে কুর্গও ব্রিটিশদের দখলে এসে গেল। বর্মা যেমন উত্তর-পূর্ব ভারতে তেমনই রাশিয়া ছিল উত্তর-পশ্চিমে ভয়ের কারণ। সুতরাং উত্তর-পশ্চিমেও আগ্রাসনের প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেল। অকল্যান্ডের নেতৃত্বে ১৮৩৮ থেকে ১৮৪২ অবধি চলে আফগান যুদ্ধ। ১৮৪২ সালে ব্রিটিশরা নিজেদের অনুগত রাজাকে সিংহাসনে বসিয়ে আফগানিস্থানকে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের অধীনে নিয়ে আসে। এলেনবরো ১৮৪৩ সালে সিন্ধ দখল করে। কিন্তু ঔপনিবেশিক আগ্রাসন চূড়ান্ত রূপ নেয় ডালহৌসির সময় (১৮৪৮ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত)। ব্রিটিশ প্রবর্তিত স্বত্ববিলোপ নীতির আশ্রয় নিয়ে অনেক রাজ্যকেই সরাসরি নিজেদের আওতায় নিয়ে আসে ডালহৌসি। এই নীতি অনুযায়ী যদি কোনও রাজা কোনও পুরুষ উত্তরাধিকারী না রেখে দেহত্যাগ করে তাহলে সেই সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশদের হাতে সরাসরি চলে আসবে। এই নীতি ব্যবহার করে ১৮৪৮ সালে সাতারা, ১৮৫০ সালে সম্বলপুর এবং বাঘাট, ১৮৫২ সালে উদয়পুর, ১৮৫৩ সালে নাগপুর এবং ১৮৫৪ সালে ঝাঁসি দখল করে নেয় ব্রিটিশেরা। ১৮৫২-৫৩ সালে দ্বিতীয় বর্মা যুদ্ধ জয় করে পেগু দখল করে ব্রিটিশবাহিনী। সেনাবাহিনীর খরচ আদায়ের জন্য ১৮৫৩ সালে হায়দ্রাবাদ থেকে বেরার বিচ্ছিন্ন করে অধিগ্রহণ করে নেয় ব্রিটিশেরা। ১৮৫৭ সালের মধ্যে ভারতবর্ষের ৬৩ শতাংশ অঞ্চল এবং ৭৮ শতাংশ জনগণ সরাসরি ব্রিটিশদের অধীনে চলে আসে। বাকি অঞ্চলগুলি ইংরেজদের অনুগত রাজাদের অনুশাসনেই থাকে। ব্রিটিশরা এইসময়ে সরাসরি অধিগ্রহণের পথ ছেড়ে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের পথ বেছে নেয়। খাতায় কলমে স্বশাসিত হলেও আসলে এইসমস্ত রাজারা ছিল ব্রিটিশদের তাঁবেদার এবং প্রতি পদক্ষেপে ব্রিটিশদের হস্তক্ষেপ তাদের একরকম পুতুল করে রেখেছিল।

অবাধ এবং মুক্ত বাণিজ্যের প্রয়োজনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং অধিগ্রহণ শুরু হলেও শেষ অবধি ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত করে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলই হয়ে ওঠে তাদের মূল লক্ষ্য। কিন্তু ভারতবর্ষের মত এক বিশাল দেশকে সম্পূর্ণ নিজেদের অধীনে নিয়ে আসা সহজসাধ্য ছিলনা। সেই সময় নানা কারণে মোগলেরা দূর্বল হয়ে পড়েছিল কিন্তু যে সমস্ত অন্য রাজ্যেরা সেই সুযোগে সিংহাসন দখলের চেষ্টা করছিল তারা কিন্তু খুব একটা দূর্বল ছিল না। প্রচুর সংখ্যক সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র ছিল এই সব রাজ্যের কাছে যদিও আধুনিকতার নিরিখে এই সব অস্ত্রশস্ত্র ব্রিটিশদের চাইতে অনেক নিম্নমানের ছিল। পৃথিবী জুড়ে ব্রিটিশ এবং ফরাসিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব তখন বেড়েই চলেছে। সেই কারণে ভারতে অভূতপূর্ব মাত্রায় ব্রিটিশ সৈন্যের সংখ্যা বাড়তে থাকলো। তবে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হলো এই সময় ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে ভারতীয়দের ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে নিযুক্ত করার প্রক্রিয়া শুরু করে দিল। ব্রিটিশ অফিসারদের দ্বারা প্রশিক্ষিত নতুন সেনাবাহিনী ব্রিটিশদের প্রতিপক্ষ রাজ্যগুলিকে শায়েস্তা করার কাজে নিযুক্ত করা হলো। এই বিশাল সেনাবাহিনীর সাহায্যে ব্রিটিশরা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলো এবং অধীনতামূলক মিত্রতার অধীন রাজ্যগুলির থেকে আর্থিক চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে লাগলো। বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য সীমান্ত সুরক্ষিত রাখা ব্রিটিশদের কাছে আবশ্যিক হয়ে উঠেছিল। সীমান্ত সুরক্ষিত রাখার জন্য সরাসরি রাজ্য দখল করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। চলতে থাকলো একের পর এক রাজ্য দখলের যুদ্ধ। রাজস্বের বেশিরভাগ অংশই খরচ হয়ে যেত যুদ্ধে এবং সেনাবাহিনীর ভরণপোষণে। পরিকল্পিত ভাবে অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃশত্রুর থেকে আক্রমণের আশঙ্কা সৃষ্টি করে এই বিপুল সেনাবাহিনীকে সবসময়ে যুদ্ধে নিযুক্ত রাখা হতো।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাফল্যের অন্যতম কারণ ছিল অর্থ এবং রসদ সংগ্রহের ক্ষেত্রে তাদের প্রতিপক্ষ রাজ্যগুলির থেকে এগিয়ে থাকা। ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর সৈন্যদের খাওয়া, থাকা এবং নিয়মিত বেতন প্রদানের ক্ষেত্রে ব্রিটিশরা কোনও কার্পণ্য করতো না। এছাড়াও ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেশীয় রাজাদের চাইতে ব্রিটিশদের বেশি বিশ্বাস করতো। প্রয়োজনে ব্যাঙ্কগুলির থেকে টাকা ধার পেতে ব্রিটিশদের কোনও অসুবিধে হতো না। যেহেতু রাজ্যগুলিকে সরাসরি দখল করে রাজস্ব আদায় ব্রিটিশরা নিজেরাই করতে থাকল সেইজন্য ব্যাঙ্কের উপর নির্ভরতাও ক্রমাগত কমে যেতে থাকলো। পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের অধীনে থাকা রাজ্যগুলি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্রিটিশদের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে থাকলো। সমস্ত দেশজুড়ে কায়েম হতে থাকলো ব্রিটিশরাজ। রাজ্যশাসন এবং রাজস্ব আদায় দুইই এখন সরাসরি কোম্পানির হাতে । রাজস্ব আদায়, বাণিজ্য এবং সামরিক অভিযান ভারতবর্ষে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপনের জন্য একইসূত্রে গ্রথিত ছিল।

অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইংল্যান্ড ছিল বিশ্বের ধনী দেশগুলির অন্যতম। অন্য ধনী দেশগুলি যখন সাম্রাজ্যবিস্তারে ব্যস্ত ব্রিটিশ শাসকেরা যুদ্ধের পথে সাম্রাজ্যবিস্তারের পথে না গিয়ে বিশ্বব্যাপী মুক্ত এবং অবাধ বাণিজ্যের পথ অবলম্বন করে। ব্রিটিশ সরকার দেশের বড় কোম্পানিগুলিকে অন্যদেশে বাণিজ্যবৃদ্ধির অনুমতি দেয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতবর্ষে বাণিজ্যবৃদ্ধির অনুমতি পায়। বিনিয়োগ এবং বাজার দখলই ছিল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রাথমিক উদ্দেশ্য। এই সম্পদবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় সরকার ছিল কোম্পানির অন্যতম সহযোগী। কোম্পানি এবং সরকারের যুগলবন্দী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যবৃদ্ধি এবং সম্প্রসারণের প্রয়োজনে ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে ধীরে ধীরে ভারতবর্ষকে ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত করে। বাজার দখল দিয়ে শুরু করে গোটা দেশকেই দখল করে নেয় ব্রিটিশ।
0

গল্প - রূপশ্রী ঘোষ

Posted in




















‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই’। ‘লড়াই করে বাঁচতে চাই’। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ‘সর্বক্ষয়ী দলের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’। ‘এই লড়াই লড়াই লড়াই চাই’। ‘লড়াই করে বাঁচতে চাই’। পাটুলির ফুটপাত দিয়ে একজন মধ্যবয়সী লোক হেঁটে যাচ্ছে আর নিজের মনে একাই এভাবে স্লোগান আওড়ে চলেছে। মধ্যবয়সী লোক, কিন্তু দেখে এক ঝটকায় কুড়ি পঁচিশ বছরের ছেলেও মনে হতে পারে। খুব শান্তশিষ্ট, ভদ্রসভ্য দেখতে। চোখেমুখে লেখাপড়ার ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু দৃষ্টিতে একটা কুটিল কুটিল ভাব আছে। রুহিও ওইপথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। সে বারবার একই স্লোগান শুনতে শুনতেই হাঁটছিল। তারপর আর তার কৌতূহল চেপে থাকতে না পেরে একটু এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেলল –

এই? আপনি কে? এমন এভাবে একাই মিছিলের মতো স্লোগান দিচ্ছেন? মিছিলে তো প্রথমে একজন বলে, তারপর পিছনের বহুলোক সমস্বরে ওই কথাটাই বলে বা প্রশ্ন হলে তার জবাব দিয়ে একটা গণগর্জন তুলতে তুলতে হাঁটে। আপনি এমন একাই এসব করছ, কী ব্যাপার?


আমার দল সর্বহারা।


মানে? আপনাকে দেখে একটু চেনা চেনা লাগছে। নাম কী?


আমার নাম এক্স।


এক্স? বললেই হল?


কেন? হবে না কেন? এত এক্স ওয়াই ধরে অঙ্ক করলেন আর আমার নাম এক্স শুনেই চিৎকার করছেন? ওইতো আমার এক মেয়ে বন্ধুর নাম ওয়াই। সেও ওই প্রোলেতারিয়েতদের দল করে।


প্রোলেতারিয়েতদের দল? মানেটা কী?


আরে প্রোলেতারিয়েত, প্রোলেতারিয়েত। যাকে বলে সর্বহারা। ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ পড়েছেন? পড়লে ওখানে ওই শব্দটা পেতে্ন। আপনারা তো কিছুই পড়েন না। আমরা যারা সর্বহারাদের দল করি, তারা অনেক লেখাপড়া করি।


ও! তা আপনাদের ওই সর্বহারা দলটা সম্পর্কে একটু বুঝিয়ে দেবেন? কী কাজ করেন শুনি।


আরে ওই তো, আমাদের একটা ম্যা-ম্যা-ম্যানুফেস্টো আছে। সেটা পড়ে নেবেন। সব জেনে যাবেন।


অ। তা একটু গুছিয়ে বলতে কী হয়? একা একাই যখন মিছিলের স্লোগান দিতে দিতে হাঁটছেন তখন তো আপনার ... ওই কী বললেন, ম্যানুফেস্টো সম্পর্কে জ্ঞান দিতেও ভালো লাগা উচিত…


হ্যাঁ তা লাগে, তো আমার অত সময় নেই, সংক্ষেপে যা দাঁড়ায় তা হল আমরা প্রতিবাদ করি। খেটে খাওয়া মানুষদের সমান কাজ, সমান অধিকার চাই। দারিদ্র ঘোচাতে চাই।


ও, তাই নাকি? তা সর্বহারাদের দল যখন, তখন কি সব হারিয়েছেন? নাকি আপনাদের দলটাই হারিয়ে গেছে? চেহারা সাজ পোশাক দেখে তো কিছুই হারিয়েছেন বলে মনে হচ্ছে না।


আরে আমার কথা বলছি নাকি? আমি তো সর্বহারা জনগণের কথা বলছি।


ও, তো আপনি কে? প্রতিনিধি?


হ্যাঁ, বলতে পা্রেন।


আর আপনার ওই বন্ধু ওয়াই, সেও?


হ্যাঁ সেও। তার ইনফ্লুয়েন্সেই আমি এই দলটা করি। নাহলে আমি কোনো দলকেই ভোট দিতাম না।


তাই বলুন। কারণ আমি স্কুল কলেজ থেকেই আপনার মুখ চিনি। আপনি ওই ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছেলেটার মতো স্যুটকেশ হাতে নিয়ে, চুলের বাঁদিকে সিঁথি কেটে, ফার্স্ট বেঞ্চে ভালো ছেলেটার মতোই বসে থাকা বলে জানি। কলেজ টলেজেও ওই একইভাবে দেখেছি। কোনোদিন কোনো ইউনিয়নে টিউনিয়নে হাঁটতেও তো দেখিনি। আর এখন একাই হেঁটে হেঁটে একটা মিছিল বানিয়ে ফেলছেন?


আপনি আমায় চেনেন নাকি?


আমি আপনাকে চিনি। কিন্তু আপনারা আমাদের মতো লোককে চেনেন না। কেন বলুন তো?


এটা মগজ ধোলাই। এটা ওয়াই আমাকে শিখিয়েছে।


তা আপনার ওয়াই কি সর্বহারা?


না, সেও সর্বহারা নয়। তার অনেক টাকা পয়সা সম্পত্তি। বিদেশেও থাকে মাঝে। দেশেও অনেক বাড়ি গাড়ি।


ও বাব্বা! অবাক কাণ্ড তো মশাই। এতকিছু সম্পত্তি বাগিয়ে সে কিনা সর্বহারাদের প্রতিনিধি? আপনার কালটিভেট করতে ইচ্ছে হয়নি মশাই? আপনার সম্পর্কে তো অনেক অনেক ভালো ভালো কথা বলত সবাই। আপনি নাকি গোয়েন্দা গল্প সব গুলে খেতেন। তা আমাদের ফেলু মিত্তির আপনার মাথায় ধাক্কা মারেননি? আপনিও ওই দলে ভিড়ে গেলেন? আমি আসলে আপনারই পাড়ার মেয়ে, আর আপনার স্কুল কলেজেই পড়াশুনো। তাই আপনার সম্পর্কে অনেককিছু জানি।


ও তাই নাকি? তা কী কী জানেন?


সেসব পরে হবে। আপনি এখন আপনার ওই সর্বহারা দল নিয়ে বলুন কী কী জানেন। আমি বরং শুনি।


আরে সর্বহারা দল নিয়ে আর শোনার কী আছে, ও তো সবাই জানে। ওরা দুর্নীতি শুরু করেছিল বলে সব হারিয়েছে। আমি বরং শাসক দল নিয়ে বলি। ওদের সম্পর্কে আমার এখন শুনে শুনে অনেক ধারণা হয়েছে।


তা কী ধারণা হয়েছে শুনি…


আরে ওই যে রেলইয়ার্ডে কী সব ঘটল না, সেটার পিছনে কার হাত, কত বড়ো হাত সব ওয়াই আমাকে বলেছে। আর বলেছে ওই দলের প্রধান যিনি তিনি নাকি কোনো নারীকেই সম্মান করেন না।


ও তাই নাকি? তা আমিও শুনেছি বটে। কিন্তু আপনার সম্পর্কেও নাকি ওই একই কথা শোনা যায়…


মানে? আমার সম্পর্কে কেন শোনা যাবে? আমি কি কোনো বড়ো নেতা বা নেত্রী?


না, আপনি নেত্রী নন তো বটেই। আপনি পুরুষ। আপনার নামও এক্স।


তো? তাহলে কী শুনেছেন? আমি বিখ্যাত কেউ নই।


না, মানে খুব বিখ্যাত কেউ নন। কিন্তু আপনি যতটুকু বিখ্যাত হয়েছেন তা ওই কু কেলেঙ্কারি দিয়েই।


মানে? আপনি আমার সম্পর্কে এসব কোথায় শুনেছেন? কী শুনেছেন? এইজন্য আপনি এগিয়ে এসে আমার সঙ্গে আলাপ করলেন? এসব বলবেন বলে?

এক্স গজগজ করতেই থাকলেন। রুহি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে এক্সকে উস্কিয়ে দিয়ে হনহন করে হেঁটে গেল। আসলে রুহি আর ভূতের মুখে রামনাম সহ্য করতে পারছিল না। একই পাড়ায় থাকার দৌলতে সে তার সম্পর্কে কিছু কেমন কথা জানে। আর বাঙালির স্বভাবেই তো তা আছে। পরচর্চা পরনিন্দা। কিছু ঘটালে কেউ তা শুনবে না এটা হতে পারে না। খবর হাওয়ার থেকে, আলোর থেকে আগে দৌড়োয়। মুখরোচক খবর হলে তো কথাই নেই। রুহি ভাবছে, লোকটাকে ভালো জবাব দেওয়া গেছে। আবার দেবে একদিন। ও খেয়াল রেখেছে ওখান দিয়ে নাকি ওই ভদ্রলোক দুবেলা হেঁটে যায়। কোনো কোনোদিন দুবেলা না হলেও একবেলা তো মাস্ট। অতএব চিন্তা নেই, আবার ধরা যাবে। ভাবতে ভাবতে রুহি নিজের মনে হাঁটতে লাগল। রুহিও কাজ থেকে ফেরার সময় বা যাওয়ার সময় হাতে টাইম থাকলে একটু হেঁটে নেয়। ওভাবে যাওয়া আসার পথেই তার চোখে পড়ে ওই ভদ্রলোকের মিছিল। কিন্তু কোনোকিছুতেই তার কৌতূহল মেটে না। এই যেমন রান্নাঘরে সে যখন কাজ করে জানলা দিয়ে দেখতে পায়, উপরের তলা থেকে নিচের দিকে কী যেন একটা উড়ে গেল। কী উড়ে যায় সে কোনোদিন দেখতে পায় না। তাই সে ভাবে কালো পাখি বা কালো প্লাসটিক প্যাকেট বা কালো কোনো কাপড়ের টুকরো। কিন্তু কালো যে, সেটা সে স্পষ্ট বুঝতে পারে। অন্য কোনো রঙ নয়। কালোই দেখে সে। এই কালো নিয়ে তার ভয় সারা জীবনেও যায় না। ছোটো থেকেই ভাবত, চা খেলে কালো হয়ে যায়, শাক খেলে কালো হয়ে যায়, কালো লোক দেখে ভয় পায়, কালো ছেলে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না, আর অন্ধকারের কালো দেখলে তো কথাই নেই। সে অন্ধকারকে ভয় পায় কালো বলেই। একবার তো শিয়ালদা থেকে রাজাবাজার যাওয়ার সময় বাসে কন্ডাক্টরকে বলেছিল, ‘কালোটাকা আমি নেব না’। গোটা বাস হো হো করে হেসেছিল কিন্তু সে তার ‘কালো আর ময়লা’র ক্যাবলামির তফাৎ করতে পারেনি। রুহি এসব ভাবতে ভাবতেই আবার এক্সের চিন্তা নিয়ে পড়ল। তার মনে হল, ‘আচ্ছা এক্স যে সর্বহারা দলের প্রতিনিধি বলল, কিন্তু সে তো কই সাদা ফতুয়া আর সায়ার মতো বা তার থেকেও বেশি ঢোলা পাজামা পরে হাঁটতে দেখেনি। মনে মনে ভাবল, ‘ছোটোবেলায় তো পুকুর পাড় দিয়ে যে মিছিল হেঁটে যেত তার নেতাদের বেশিরভাগ লোকই ওইরকম সাদা পোশাক পরে হাঁটত। তাহলে কি যুগের সঙ্গে পোশাক বদলে গেল আর দলটার নাম আর এজেন্ডা এক রয়ে গেল’? রুহির এ আর এক সমস্যা। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে যেন নিজেই নিজের পেটের ভিতর থেকে টপিক বের করে আর ভাবতে থাকে। এমন ভাবতে ভাবতে সে কতবার ভাত তরকারি পুড়িয়ে ফেলেছে। তবুও তার ভাবা চাই। যা বলা সত্যিই তাই। ভাতের ফ্যান উপচে পড়ে গোটা রান্নাঘর, গ্যাস ওভেন সব নোংরা হয়ে গেল। আবার সবকিছু ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতে হবে। এই নোংরা ব্যাপারটাও তার পছন্দ নয়। নোংরা ঘটনা, নোংরা দৃশ্য, নোংরা ছবি…। অবশ্য ও যেগুলো নোংরা ছবি বা ভিডিও ভাবে সেগুলো আসলে অন্যদের কাছে রোম্যান্টিক। ও নিজেই একটু কেমন খুঁতখুঁতে পুরোনো পন্থী। এই নিয়ে সে ঝাড়ও খায় বন্ধুবান্ধবদের কাছে। এই দ্যাখো পুরোনো কথাটা মাথায় আসতেই সে আবার ভাবতে বসল, ‘এক্স কেন সবুজের কালো হাত বলল? সবুজ তো নিজেই পুরোনো। সেই কবে ক্ষমতা থেকে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। ওরাই তো সাফ করে দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল। এখন সে দলও তো সর্বহারা। ইনফ্যাক্ট সর্বহারাদের সঙ্গে তারা জোটও তো বেঁধেছিল দু একবার’। এবার রুহি ঠিক করেই নিল, যেভাবে হোক ওই ভদ্রলোককে রাস্তায় পেতেই হবে। নাহলে চলবে না। যা ভাবা তাই করা। যাওয়া আসার পথে রুহিও যেন ওত পেতে বসেছিল, শিকারীর মত। এক্সকে দেখতে পেয়েই সে খপ করে ধরল –

আরে মশাই দাঁড়ান দাঁড়ান। আপনি ওভাবে সেদিন মিছিলে সবুজের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও বললেন কেন? ও তো অনেক পুরোনো দল, সে তো আপনারাই সাফ করেছিলেন…


না, মানে ইয়ে (প্রথমে রুহিকে এড়িয়ে পালাবে কিনা ভাবছিলেন) মানে, মানে আমরা তো প্রথম থেকে ওই দলটাকেই ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে শিখেছি, পুরোনো অভ্যেস আর কী। আর তাছাড়া ঘাস পাতা জুড়ে বর্তমান দল ক্ষমতায় এলেও আসলে তো শিকড় ওখানেই পোঁতা ছিল। তাই আমরা ওটা থেকে আর বেরোতে পারছি না…


হ্যাঁ তা বুঝলাম মশাই। কিন্তু ওই দল তো এখন আপনাদের মতোই সর্বহারা। আর আপনাদের সঙ্গেই জোট বেঁধে শক্ত পোক্ত একটা দল গড়তে চাইছে। তা আপনারা যে, এই স্লোগান দিচ্ছেন তাতে তাঁদের নেতা নেত্রীরা রাগ করছেন না?


না, মানে আমাদের এখন একটাই লক্ষ্য। এই ক্ষমতাটাকে সরাতে হবে আর ওই হিন্দু দলটাকে আসতে দেওয়া যাবে না। তাই আমরা যা খুশি তাই বললেও ওরা গায়ে মাখছে না। কারণ লক্ষ্য তো এক। তাই লক্ষ্যবস্তুর দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে যেটা ভালো বা যেমনভাবে এগোলে লক্ষ্যে পৌঁছোনো যাবে আমরা সেভাবেই এগোচ্ছি।


ওরা মেনে নিল? এতবড়ো একটা অপবাদ…?


মানবে না কেন? কালো হাত কী ছিল না? কালোই তো ছিল। তাই মানতে বাধ্য। বলুন তো সেই চালে কাঁকর মেশানো থেকে শুরু করে জরুরি অবস্থা হেনতেন আর কী কী শোনেননি বলুন? ওরাও কি অস্বীকার করতে পারবে? পারলে তো ট্যাঁ ফোঁ করত এই স্লোগান নিয়ে …। কেন করছে না তাহলে... এবার আপনিই বুঝুন। আর শুনুন আপনি এমন মাঝে মাঝেই শিকারীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাকে অ্যাটাক করবেন না তো? আমার ভয় করে আপনাকে দেখলেই?


কেন? ভয়ের কী হল? আমি কি কামড়ে দেব আপনাকে?


না তা নয়, কিন্তু আপনি বড্ড প্রশ্ন করেন। এই এত প্রশ্ন আমার ভালো লাগে না। এত কৈফিয়ত আপনাকে দিতে যাবই বা কেন?


আরে, এ আপনার দোষ নয়। এটা গোটা পুরুষ জাতির দোষ। তারা প্রশ্নে ভয় পায়। বিশেষ করে ব্যক্তিগত প্রশ্নে। আপনিও তো পুরুষ, তাই আপনার ভয় পাওয়াতে আমি অস্বাভাবিক কিছু দেখছি না


একি? আপনি আবার জাত তুলে কথা বলছেন? আমি তো কই জাত তুলিনি, আমিও যদি নারী জাতি বলে গালাগাল দিই? আপনার ভালো লাগবে?


ভালো লাগা না লাগার কিছু নেই মশাই। আপনারা এখনো গালাগালি, শাপ শাপান্ত, আধিপত্যবাদ চালিয়েই যাচ্ছেন মেয়েদের উপর। আপনারা তো মেয়েজাত বলেই আর রাত হলেই ধরা বাঁধা কোনো নারী না থাকলে সোনাগাছি ছোটেন। আপনাদের কথা ছাড়ুন মশাই। ও না না সোনাগাছি না, আজকাল কী যেন নতুন নাম শুনি, এসকর্ট গার্ল। তা মশাই আপনিও যান নাকি?

এই শুনে তো এক্স আবার রাগে খাপ্পা। আবার গজগজ করতে করতে চলে গেল। নেহাত শান্তশিষ্ট লোক বলে তাই রুহির রেহাই। নাহলে হয়তো কোনোদিন বলে বসত বাড়িতে গুণ্ডা পাঠাব…। যতই হোক রাজনীতি বলে কথা। রুহি মনে মনে ভাবে, এক্স যতই সর্বহারা দলের হয়ে এখন গুণগান করুক না কেন, ওর নিজস্ব কিছু বুদ্ধি সুদ্ধি আছে বলেই মনে হয়। কারণ কখনো সখনো ওদের দলের খারাপ কাজ নিয়ে সমালোচনা করতেও সে শুনেছে। তাদে।।সর্বক্ষয়ী দলের মতোই বহু খারাপ কাজ, বহু দুর্নীতিকে এক্স সাপোর্ট করে না। এইসব ভাবতে ভাবতেই রুহি সর্বহারা দলের খারাপ কাজ এবং দুর্নীতিগুলোর একটা তালিকা তৈরি করে ফেলল। নেক্সট দিন এক্সকে দেখতে পেলেই সে সরাসরি তার মতামত জানবে বলে। দু একদিন সেই তালিকা নিয়ে আসা যাওয়ার পথে এক্সের খোঁজ করল আপন মনে। কোথাও খুঁজে পেল না তাকে। একটু হতাশ হল রুহি। কী ব্যাপার, আর দেখা যাচ্ছে না কেন এক্সকে। সে কি চাকরি ছেড়ে দিল? এ পাড়া থেকে অন্য পাড়া চলে গেল? নাকি অন্য দেশ? সুস্থ হল না তো? নানান উদ্ভট প্রশ্ন রুহির মাথায় ঘুরতে লাগল। লাগারই কথা। সে তো ভেবে রেখেছে দেখা হলেই সর্বহারা দলের দুর্নীতি বিষয়ে তার মতামত জানতে চাইবে। যতক্ষণ না পাচ্ছে উত্তর ততক্ষণ শান্তি নেই। এইসব ভাবনার মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতেই রুহি অফিস গেল। ফেরার পথে সিমেন্ট ব্রিজের নিচে ভিড় হট্টগোল থেকে সেও থমকে গেল। সে দেখল বিভিন্ন দিক থেকে গাড়ির লম্বা জ্যাম। সে এঁটুলি মোড় থেকে হেঁটে ফেরে বলে তার অসুবিধা হয়নি, মোড়ে জটলার কাছে পৌঁছে সেও হতবাক হয়ে গেল। ওখানে একটা বড়সড়ো অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। গোটা রাস্তা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। কারোর মুখে কোনো কথা নেই। ওখানে মাঝখানে হাত পা ছড়িয়ে বসে এক্স হাউহাউ করে কেঁদে চলেছে। কিছুতেই তাকে কেউ থামাতে পারছে না। কেন কাঁদছে তাও কেউ তার কাছ থেকে বের করতে পারছে না। রুহি ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেল। গিয়েই এক্সের কাছে জানতে চাইল,

কী হয়েছে? কাঁদছেন কেন এমন করে?


(কেঁদেই চলেছে এক্স, কোনো উত্তর নেই)


আরে বলুন কী হয়েছে? গোটা রাস্তা জ্যাম হয়ে গেছে তো। চারদিক পুরো ব্লকড। কী হয়েছে আপনার ? এমন কী হল যে, পুলিশও তোমাকে তুলতে পারছে না? কলকাতার রাস্তায় এমন অ্যাকসিডেন্ট, রক্ত, এমনকি প্রকাশ্যে দিনের আলোয় শুট আউট করে খুনও তো ঘটে থাকে। আপনি কি সবসময় এমন অ্যাক্সিডেন্ট দেখে শোরগোল বাঁধিয়ে দাও নাকি?

রাস্তার এমন বেহাল অবস্থা দেখেই রুহি জোরে জোরে ধমক দিচ্ছিল এক্সকে। তারপর একটা সময় এক্স নিজেকে সামলে নিয়ে বলতে শুরু করল, ‘এই রক্তই তো সেই রক্ত, যে রক্ত দিয়ে আমার দল, দলের নেতারা বৃদ্ধা মাকে ভাত মেখে দিয়েছিল। এ তো সেই রক্ত। আমি তো এই রক্তের মধ্যে সেই বৃদ্ধা মায়ের যন্ত্রণা দেখছি। আপনারা তো সাধারণ অ্যাকসিডেন্টের রক্ত বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন, ঘটনাটা তাচ্ছিল করছেন, লঘু করে দিচ্ছেন, কিন্তু আমি তো তা পারছি না। যতই আমার দল হোক, আমি যতই সেই দলের প্রতিনিধি হই না কেন, রক্ত দেখলে আমার সেই বৃদ্ধা মায়ের যন্ত্রণা ছাড়া কিচ্ছু আসে না চোখের সামনে। আমি দেখতে পাই দুয়ার ভেসে যাওয়া সেই রক্ত, উঠোন ভেসে যাওয়া সেই রক্ত, মায়ের বুক ভেসে যাওয়া সেই রক্ত… লাল, চারিদিক লাল, কেবল লাল, টুকটুকে লাল রঙ ছাড়া আমি আর কিচ্ছু দেখতে পাই না, লাল, চারিদিক লাল, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত সব লাল…। দুহাত রাঙিয়ে নিয়ে আমরা সর্বহারা…। আমরা রক্তপতাকা, আমরা লড়াই চাই। লড়াই লড়াই লড়াই চাই। লড়াই করে বাঁচতে চাই…’। এক্সের কান্নার তীব্রতা আরও বেড়ে গেল। রুহি রীতিমতো স্তব্ধ হয়ে গেল। তার মুখে আর কোনো কথা নেই, ধীরে ধীরে ব্যাগ থেকে প্রশ্নের তালিকাটা বের করে ছিঁড়ে কুচিয়ে রাস্তায় ছড়িয়ে দিল…। ধীর, ক্লান্ত পায়ে রুহি আবার হাঁটতে শুরু করল বাড়ির দিকে…। এক্সের মতামত নিয়ে রুহির আর কোনো বক্তব্য নেই!

মোড়ের মাথায় লাল সিগন্যাল। সব গাড়ি দাঁড়িয়ে। মানুষ কিন্তু চলেছে। পায়ে, পায়ে এগিয়ে চলেছে ক্লান্ত, বিষণ্ণ মানুষ। লড়াই করতে করতে তারা আর লড়াই করতে চায় না। বাইপাসে লম্বা যানজটে গাড়ির পর গাড়ির ভিতর, অ্যাম্বুলেন্সের পর অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের ভিতর দিয়ে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস পাক খাচ্ছে চারিদিকে।

সিগন্যালের রঙের বদল হচ্ছে না। সব থমকে আছে।
0

কবিতা - অমৃতেন্দু মুখোপাধ্যায়

Posted in

মহাকাল উদাসীনের মত হেঁটে চলেছে—
মানুষের খেলনা-বাটি সংসার
গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে তার পায়ের ধুলো।
এক হাঁটু ধুলো নিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো কি ভালো?
0

কবিতা - আশীষ কুমার বিশ্বাস

Posted in








নদী ভাসা খড়-কুটো
কবিতার খুঁটি
এ ভাবেই সাজিয়েছি
কবিতার গুঁটি ।

নাই তার ভরসা
ভেসে ভেসে চলে
এ কবিতা জীবনের
অন্য কথা বলে ।

অভাব অনটন আছে
আয় করার পথ খোঁজে
বাঁধা আছে পদে পদে
অপরাধে মাথা গোঁজে ।

মায়ের প্রবল অসুখ
বাবার বেতন নেই
দিদির বিয়ের বয়স
মন তাই সুখে নেই !

ভাইয়ের স্কুল আছে
বোনের পড়া নেই
বেটি বাঁচাও , বেটি পড়াও
তাঁতে আর তাড়া নেই ।

সুখের কথা ভাবি নাকো
দুঃখে দিন যাপন
দুঃখেই কবিতা লিখি
এ ভাবেই উদযাপন ।
0

কবিতা - অমিতাভ মুখার্জী

Posted in








সত্যি করে বলছি
তোমাকে আমি দীপিকা
বলে ডাকিনি

তোমাকে হলফ করেছি
আমি আর দীপিকার সাথে একই
ফ্লাইটে বিজনেস ট্রিপে আর যাব না

তোমাকে আগেই বলেছি
আমি যখন ভুট্টার ক্ষেতে ঘুরে বেড়াই
সূর্যের আলোয় যে মুখ বারবার
ভেসে আসে, সে ত’ দীপিকারই

তুমি জানতে আমি চোখ
রেখেছিলাম ঐ রাঙা মেয়েটির দিকে
সে কেউ নয়, সেই চোখ দীপিকারই

তোমার বারংবার বারণ শোনার পর
আমি বলিছি
আমি দীপিকাকেই চুম্বন করেছি

তোমাকে এটা বলতে ভুলে গেছি
প্রতি রাতে যে তারা গুলোর আলো
খসে পড়ে তাদের ত্বকে
তাদের সবাইয়ের ত্বক দীপিকারই ত্বক

তুমি এত রাগ করে থেকো না
আমার চোখে সব লুকোনো
ভালোবাসা দীপিকার চোখেরই

আমি যেদিন শীতের সকালে
ব্রেকফাস্ট টেবিলে তোমার নাম ভুলে
দীপিকা বলে ডেকেছিলাম
তুমি তাকিয়ে ছিলে আমার দিকে
কিছু বলে ওঠোনি

তুমি মাধুরী সেদিন আমায় কিছুই বলনি
শুধু তাকিয়ে ছিলে
আমি তোমার চোখে গোপনে চোখ রেখেছিলাম
সত্যি বলছি সেও দীপিকারই

আজ সন্ধ্যেতে ডিনার শেষে
পোর্ট ওয়াইন নিয়ে মাধুরী
তোমার সাথে যে গল্প হয়েছে
তা বেশীর ভাগ দীপিকাকে নিয়ে

তোমাকে কথা দিয়েছি
দীপিকাকে নিয়ে
আর কিছু বলবো না ২০২৪-এ

মাধুরী আছ, যেমন ছিলে
বছর বছর আমার দীপিকা
পালটে যায়
এবার নতুন কোনো দীপিকা

কিছু মনে করো না—সহজ হয়
সহজ ভাবে নাও

গোপন তারা গুলোর আলো
খসে পড়ে তাদের ত্বকে

আর দীপিকার নাম লেখা নেই
হয়ত বা অন্য কেউ
হয়ত বা সেই দীপিকা
আবার দীপিকাই হয়ে।
0

কবিতা - সব্যসাচী রায়

Posted in









আজকে আকাশ ঘুড়ি আর ওয়াইফাই সিগনালের সেলাই।
হোলির কথা মনে পড়ে, রং মাফ করে, যতক্ষণ না বৃষ্টি আসে।

চায়ের দোকানে কেউ বলে, "ভারত তো আমেরিকা, সাবটাইটেল দেওয়া।"
সবাই হাসে, যেন সত্যি। হয়তো তা-ই।

এখানে, বলিউডের স্ক্রিপ্ট নিজেকে পাল্টায়: হিরো আগেই মরে যায়,
ভিলেন একটি স্টার্টআপ চালায়, আর কোরাস গায় ভাঙা কোডে।

স্বপ্নগুলো আবার বিগড়ে গেছে। গঙ্গার জল উল্টো দিকে বইছে,
গরু আর ক্রিকেট ব্যাট ভাসিয়ে নিচ্ছে, ব্যর্থতার রেখাচিত্র আঁকছে।

ট্রেনে বাড়ি ফেরার পথে গুগলে সার্চ দিই "বিশ্বাস পুনর্জীবিত করার উপায়"
উত্তরে পাই ডালের রেসিপি। বিদ্রূপের স্বাদ বেশ বাড়ির মতো।
0

ঋতু ম্যাডামের রান্নাঘর থেকে - মৈত্রেয়ী চক্রবর্তী

Posted in




















ইলিশ পোলাও

ইলিশ মাছের রাউন্ড পিস। একটু মোটা করে কাটা। নুন মাখিয়ে রাখতে হবে। কালিজিরা চাল ধুয়ে জল ঝরিয়ে, চাল শুকিয়ে গেলে তাতে নুন ও ঘি মাখিয়ে রাখতে হবে। অন্তত আধঘণ্টা রাখতে পারলে ভালো।

এবার, সামান‍্য হলুদ, প‍্যাপরিকা, সামান‍্য গরম মশলা গুঁড়ো, চিনি, নারকোলের দুধ দিয়ে গুলে একটা মশলা তৈরী করে নিতে হবে। তেল গরম করে দুটো কাঁচালঙ্কা চিরে তাতে দিয়ে একটু নেড়েচেড়ে ওই গোলা মশলাটা কষাতে বসাতে হবে। মশলার কাঁচা গন্ধ চলে গেলে মাছের টুকরোগুলো দিয়ে এপিঠ ওপিঠ করে প‍্যান আঁচ থেকে সরিয়ে রাখতে হবে, কিন্তু মাছ প‍্যানেই থাকবে।

আরেকটা প‍্যান বসিয়ে তাতে আবার তেল দিয়ে কাজু ভেজে তুলে রাখতে হবে। আর আবারও দুটো চেরা কাঁচালঙ্কা দিয়ে চালটা ভাজতে হবে। পুটপুট করতে শুরু করলে বোঝা যাবে হয়ে গেছে, তখন উষ্ণ গরম জল ঢালতে হবে। যতোটা চাল, তার দ্বিগুণ জল। জল ফুটে উঠে, একটু টেনে এলে, মাছের টুকরোগুলোকে,ভাত দুইপাশে সরিয়ে, বসিয়ে দিতে হবে। তারপর ওপর দিয়ে মাছের মশলা সব দিয়ে আঁচ একেবারে কমিয়ে ঢাকা দিয়ে রান্না করতে হবে। কটা কিশমিশ দিতে হবে।

নামনোর সময়ে খুব সাবধান, মাছ ভেঙ্গে না যায়। সামান‍্য কাজু আর কিশমিশ দেওয়া একেবারেই ঐচ্ছিক।

কালিজিরার বদলে গোবিন্দভোগ, চিনিগুড়া বা বাসমতী চালও ব‍্যবহার করা যায়। প‍্যাপরিকার পরিবর্তে লাল লঙ্কার গুঁড়ো দেওয়া যায়, সেক্ষেত্রে ঝালটা কিন্তু বেশী না হয়ে যায় খেয়াল রাখতে হবে।

ছবিতে পুজোর ভোগে নিবেদন করা, ইলিশ পোলাও।



0

সম্পাদকীয়

Posted in








বাতাসে আবার সেই পরিচিত বাৎসরিক উৎসবের ছোঁয়া। বইমেলা দোরগোড়ায়। এবারের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল অনেক দেরিতে। পরিস্থিতি অনুকূল ছিল না। একটি ভয়াবহ অপরাধের আবহ আমাদের চিন্তন করে দিয়েছিল অবশ। উত্তাল হয়ে উঠেছিল এই নাগরিক সমাজ। সেই সূত্রে সদ্য যখন কোনও একজনের শনাক্তকরণ আর সাজা ঘোষণা হল, আমাদের বিবেকের পরিশুদ্ধি হল কি? অপরাধ প্রবণতার বাস মানুষের মনের গভীরতম বিন্দুতে। অনেক ক্ষেত্রে আদিম এজাতীয় প্রবণতা জিনগত। সভ্যতার আলো, তা সে যত জোরালোই হোক না কেন, এখনও পৌঁছয়নি নিকষতম সেই স্থানে।

এই মুহূর্তে দাঁড়িয়েও জোর গলায় নিজেদের সভ্য বলতে পারি কি? সম্প্রতি এক বিখ্যাত ব্যক্তির ওপর আততায়ী হামলা নিয়েও দেখা গেল রাজনৈতিক চাপানউতোর। অপরাধ এবং তার প্রেক্ষাপট কার্যত হয়ে পড়ল গৌণ।

বইয়েরই সম্ভবত একমাত্র সেই শক্তি রয়েছে, যা আমাদের ভাবনাকে করতে পারে যুক্তি আর ন্যায়সঙ্গত। দিতে পারে সৃজনশীল ডানা এবং অবশ্যই শুশ্রূষা করতে পারে রুগ্ন মনের। অপরাধের আঁতুড়ঘর যা।

সুস্থ থাকুন। সৃজনী থাকুন।

শুভেচ্ছা অফুরান।