Next
Previous
5

গল্প - ময়ূরী মিত্র

Posted in






গোষ্ঠ বণিকের কাছে আমার প্রথম প্রেমশেখা ৷ বা বলতে পারেন প্রেমদেখা ৷ গোষ্ঠ বণিক আমার ছেলেবেলার পাড়া বেলগাছিয়ার এক " Very Important " মুদি ৷ যীশুর স্কুলে পড়তাম তো ৷ ফলে যে কোনো মানুষকে ভালো লাগলেই তাকে বিভিন্ন ইংরাজি adjective কিংবা সাধু বাংলা শব্দে সাজিয়ে তোলা অভ্যেস করে ফেলেছিলাম ছোট থেকেই ৷ গোষ্ঠ মুদি তখন বেলগাছিয়া বাজারের একমাত্তর দোকানদার যে কিনা চাল ডাল গোটা হলুদ গোটা জিরে আর মুগ মটরের পাশাপাশি বাচ্চাদের জন্য কটি কাচের বোয়েম রাখত -যার একটায় মৌরী লজেন্স , একটায় জেমস লজেন্স , কড়মড় হজমী -এইসব থাকত ৷ ফলে দেখার প্রথম দিন থেকেই কাঁধ পাছাহীন কালো লোকটা আমার কাছে সাতসাগরের বণিক ৷ মাছবাজারের সমান্তরাল পথ দিয়ে বণিকের কাছে যেতাম ৷ ন্যায্য ও ফাউ লজেন্স ইজেরের পকেটের মধ্যে ভরতাম ৷ তারপর ওই পথ দিয়েই গটগট করে বাজার পেরিয়ে বাড়ি ৷ মাছ বাজারের দিকে চাইতামই না ৷ গোষ্ঠ বণিকের কাছে যাবার পথটুকু যেন তীর্থ করতে করতে যেতুম রে বাপু ৷ রান্নাঘরের হলুদ লুকিয়ে ঠাকমাকে বলতাম -হলুদ ফুরিয়েছে বলবে তো আমায় ! দাও একটাকার একটা নোট দাও ৷ খুচরো মোটে দিও না ৷ বণিক মোটে খুচরো পছন্দ করে না ৷ আর পিসীদেরও এত ওর দোকানে পাঠিও নি বাপু ৷ আমার বণিক আমার হাত থেকে টাকা নিতে পছন্দ করে ৷ গোটা হলুদের সঙ্গে একমুঠ মৌরী লজেন্স ৷ সে ব্যাপারে অবশ্য বণিকের ওপর নির্ভর করতুম না ৷ খাবলা মেরে তুলতাম লজেন্স ৷ মতে না মিললে গোষ্ঠ কাঁচা গালাগাল দিত সব্বাইকে ৷ মাছবাজার থেকে চপলা উঠে এসে বলত --আ মুখপোড়া ৷ বাচ্চাটা দুটো লজেন্স বেশী নিয়েছে তো গালাগালের ছিরি দেখো ৷ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতাম -চপলার কথায় গোষ্ঠ অল্প হাসত ৷ আমার হাড় জ্বলত ৷ আমি চপলার দয়া চাইতুম না ৷ আমার বণিকের মনোযোগ
অর্জন করতে ইচ্ছে হত বারবার ৷ চপলা যতবার আমার ফাউ লজেন্সের হয়ে ঝগড়া করেছে গোষ্ঠ তত লজেন্স আমাকে দিয়েছে ৷ ঐটুকু মেয়ে তখন আমি ! তাও মনে হত যোগ্যতায় হার হচ্ছে আমার ! হ্যাগো -যোগ্য হয়ে ওঠার কামনা কি জন্ম থেকেই জীবের থাকে গো ! নিজে যে অপদার্থ -এ কারুণ্যও চলে দৌড়ে দৌড়ে ৷ জীবনভর ৷

আর তাই তো গোষ্ঠ যখন লজেন্স চপলার হুকুমে আমায় বিলিয়েছে ,চপলার ওপর রাগ বেড়েছে আমার দুগুণ -তিনগুণ ৷ ওহ এই ব্যাপার তবে ! আমার বণিক তবে ভিনদেশে নাও নিয়ে চলে যাবে ! নারী তো দেশই বটেক ৷ আর আমি ছাড়া অন্য নারী ! সে তো ভিনদেশই হল ! তাই না ? আচ্ছা ! এবার থেকে চপলাই ফ্রি জেমস পাবে ! গজরাতে গজরাতেও গোষ্ঠর কাছে আমার যাওয়া বাড়ল ৷ মাছবাজারকে পাত্তা না দেওয়াও বাড়ল ৷ গোষ্ঠ ও মাছবাজারে পৌঁছনোর দুটো রাস্তা সমান্তরাল রাখতে যথাযথ নিষ্ঠাবান হলাম৷

কন্ঠে তুলসী মালা ঝুলিয়ে মেছুনী চপলাকে দ্বিতীয়বার বিয়ে করল গোষ্ঠ ৷ তখন অবশ্য মাথায় বেশ অনেকটা বেড়ে গেছি ৷ লাইফ সায়েন্স বইয়ে রেচন জনন পড়তে শুরু করেছি ৷ আমারও মুখের ভাষা ছিল তেমন কুচ্ছিত ৷ বিজ্ঞান পছন্দ করতাম না বলে রেচনকে বলতাম হাগা প্রক্রিয়া আর জনন ছিল পয়দা ৷শ্রেণী বিচারে বন্ধু করিনি কখনো।বিহারীও জুটেছিল কিছু আমার সঙ্গে ৷ পয়দা - মহব্বত এসব শব্দও ঢুকছিল মগজে ৷ তখন অবশ্য আমরা ইন্দ্র বিশ্বাস রোড ছেড়ে রাস্তার এপারে অনাথনাথ দেব লেনের ভাড়াবাড়ীতে চলে এসেছি।সেখানে আবার আমাদের শোবার ঘর থেকে বাজারের রাস্তার অন্য প্রান্ত দেখা যায় ৷ শুনতে পেতাম -ওই পথ দিয়েই বণিক আর তার ঢপের বউ চপলা বিকেলে বাড়ি ফেরে ৷ common toilet এ বডিস খুলে চান সারে গোষ্ঠর বউ ৷ পারুলদি ঘর মুছতে আসত ৷ ওই বলল মাকে ৷

--কী বেলাজ বউ বৌদি ৷ গরম লাগে বলে খালি বুকে আঁচল টেনে জল ঢালবি সব্ব অঙ্গে ! গোষ্ঠ সিঁড়িঙ্গে আবার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে সেদিন ৷ তুই চলে যা ব্যাটাছেলেদের বাথরুমে ! তা না ! সঙ্গে গোটা দুই মদ্দ নিয়ে বউয়ের চান দেখছে আর হাসছে ৷ চপলার ভ্রূক্ষেপ নেই ৷ চান শেষ হল তো গোষ্ঠর নাকে রসকলি আঁকবে !

শীতল বিকেলের রস গড়াত পারুলদির শব্দ দিয়ে ৷ সব শব্দে চপলার চান আর চান ৷ চপলার বগলে সাবান মাখা , মাথায় রিঠে দেওয়া , পায়ের গোড়ালির ময়লা তোলার সময় দুদুর ঝাঁকানি ! উফ ! পারুলদিও কি কিছু কম অসভ্য কথা বলত !

মনে আছে পারুলদি যেদিন এত ডিটেলে চপলা গোষ্ঠর কথা বলল তার পরদিনই বাবাকে বললাম --বাবা খাটটা জানলার দিকে টেনে আন তো ! আহা ওই জানলা নয় ৷ এই যে ..এই বাজারের দিকের জানলা ৷ দেখো না বাবা -এ জানলায় কেমন কাকগাছ আছে ৷

আমার বাবাও তো তখন ছেলেমানুষ ! বল তোমরা ! সে বেচারী আমার উদ্ভট সন্ধির মানে না বুঝে জিজ্ঞেস করলে --কী সব বলিস রে তুই ? কাকগাছ মানে ৷ আমি বললাম -এ গাছে ভর্তি কাক ৷ তাই কাকগাছ বলে দিয়েছি বাবা ৷

কাকগাছের জানলায় আমাদের খাট ৷ আমারও শুরু হল কাকের ডাক শুনে গোষ্ঠ চপলার প্রেমকল্পনা ৷ ভোররাতে কাক ডাকে ৷ আমি ভাবি -চপলা গোষ্ঠর জন্য ডালের বড়া ভাজছে ৷ বড়া ভাত খেয়ে গোষ্ঠ দোকান যাবে আর চপলা চট বিছিয়ে নতুন মাছ বেচবে ৷ সন্ধেতে কাক ডাকে ৷ আমি ভাবি চপলা গোষ্ঠর সরু সরু চুলের গাছিতে তেল মাখাচ্ছে ৷ গভীর রাতেও তো কাক ডাকে বল !
আরে সে না ডাকলেও রাত তো কাককে ডাকতে পারে নাকি ! তখন কী করবি রে গোষ্ঠবউ ! বরটার ওই তো রোগা শরীর ! আর তুই এত নাদুসনুদুস বউ ! ইস ! মাগো মা !

--খাটে শুয়ে আমার ছেলেমানুষ বাপ মা দুটোর ওম নিতে নিতে হেসে কুটকুট হয়ে যেতাম ! বুঝলে গ ! এ হল গে- আর কল্পনা না করতে পারার হাসি ৷ ওই তোমরা যাকে কাব্যি করে বল কল্পনাতীত ৷ এক মানুষ তুমি হাজারবার দেখো -সে কিন্তু কল্পনাতীত থেকেই যায় -থেকেই যায় ৷

তাই তো ওই কাকগাছের ডালের ফাঁক দিয়ে একদিন দেখলাম -আমার বণিক মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে ৷ সম্ভবত দোকানের ভাগ টাগ নিয়ে ঝগড়া ৷ আগের পক্ষের ছেলেগুলো বাপকে এনতার মারছিল ৷ মাকে নিয়ে দৌড়লাম ৷ ভিড় জমে গিয়েছিল ৷ সব লোক এই অবিবেচনার বিয়ের জন্য গোষ্ঠকে গালাগাল দিতে লাগল ৷ গোষ্ঠ একে রোগা তায় দাঁত ভেঙে তাকে আরো অদ্ভুত দেখাচ্ছিল ৷ চপলা ছুট্টে এল প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ৷ হেগো কাপড়েই আমার বণিককে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে নিচ্ছিল নিজের বুকে ... সব্বার সামনে ৷ মনে হচ্ছিল একটা কিছুর যেন স্রোত বইবে ৷ কিন্তু তেমন কিছু হল না ৷ গোষ্ঠর দড়ি লাগানো চশমাটা বড়ো যতনে আঁচলে মুছে চপলা এগিয়ে গিয়েছিল। চারিদিকে দোকানের বাটোয়ারা নিয়ে এত যে চিৎকার চলছিল , একটি কথাও কানে গেল কি চপলার ! রাতে চপলা-গোষ্ঠর ঘরে অনেক রাত অব্দি আলো দেখেছিলাম ৷ ওর ঘরের আলো কি এত সহজে নেভানো যায় রে অকম্মার দল ! একবার শুধু মনে পড়েছিল -চপল বউ আজ দশপুরুষের সামনে তার সাধের চানটা করেনি ৷

তারপর আর বছর দুই ও বাড়ি ছিলাম ৷ বাবা ঘুমেঘোরে বলে উঠতেন - কী দেখিস ? কাকগাছ ৷ নাকি গাছের আড়ালে??

মানুষ - মানুষ গো বাবা ৷ তুমি টের পাও না আমি মানুষ দেখি ! ও বাবা -- মানুষ কত্তরকম হয় গো বাবা !কাকমানুষ মানুষকাক ! আমি যে ঘুমের ঘোরে সবার নাকে মোমরঙের রসকলি কেটে যাই বাবা ৷

গোষ্ঠবণিক তুই পারিস বটে !
নিজ দেহে পুষ্টি নেই ৷
জোগাড় করেছিস জিওল মাছ ৷