Next
Previous
0

সম্পাদকীয়

Posted in




সম্পাদকীয়


দীপাবলী আসছে। আসছে আলোর উৎসব। কিন্তু আমি যেন কোথাও আলো দেখতে পাচ্ছি না। অদ্ভুত এক আঁধার ঘিরছে চারিপাশ। বধূ নির্যাতনের প্রতিবাদ করায় যুবক ছুরিকা বিদ্ধ, প্রেমিককে সুপারি দিয়ে স্বামীকে খুন করানো, যৌন হিংসা, গার্হস্থ্য হিংসা ...এ কোন সমাজে বাস করছি আমরা? সমস্ত সত্তা যেন ফাঁদে পড়া পাখির মত ছটফটাচ্ছে। আর্ত চীৎকারে ফেটে পড়তে চাইছে আমার স্বর: 

অপ ধ্ব্যন্তম্ ঊর্ণুহি পূর্ধি চক্ষুর্
মুমুগ্ধি অস্মান্ নিধয়েব বদ্ধান্।

---অন্বকারের জাল সরিয়ে আলোয় ভরো চোখ, আমরা জালে আটকানো পাখি, মুক্ত করো আমাদের। 

শক্তিরূপিণী দেবী কালিকাকে প্রলয়ঙ্করী রূপে আবির্ভূতা হতে দেখতে চাইছে ইচ্ছা। বিনাশ -- বিনাশ চাইছে সমস্ত অশুভের। দেবীকে তাঁর মহারুদ্রী, প্রচণ্ডা রূপে বন্দনা ক'রে মন বলতে চাইছে: 

কলনাৎ সর্ব্ব ভূতানাং মহাকালঃ প্রকীর্ত্তিতঃ।
মহাকালস্য কলনাৎ ত্বমাদ্যা কালিকা পরা।।
কালসংগ্রসনাৎ কালী সর্ব্বেষামাদিরূপিণী।
কালত্বাদাদিভূতত্বাদাদ্যা কালীতি গীয়সে।।

পরক্ষণেই বুঝতে পারছি এ আমার প্রতিহিংসাকামীতা। হিংসার বিরূদ্ধে হিংসাকে ব্যবহার করলে তার অন্ত ঘটে না কখনও। তা কেবল বেড়েই চলে। আর, আমি কে বিচারের ভার নেওয়ার? কোনও না কোনও অন্যায় কি এই মরদেহও করে নি? 

অব দ্রুগ্ধানি পিত্র্যা সৃজা নো
অব যা বয়ং চকৃমা তনূভিঃ। 

----আমায় মুক্ত কর পিতৃপিতামহ থেকে প্রাপ্ত দ্রোহ থেকে, মুক্ত করো এই শরীর যে অন্যায় করেছে ,তার থেকেও দাও মুক্তি।

এই তীব্র প্রক্ষোভ মনে নিয়েই মাসির বাড়ী থেকে রওনা দিয়েছিলাম ঘরের দিকে উবের ক্যাবে সওয়ার হয়ে। একটা ছেলে - হ্যাঁ প্রায় আমার ছেলের বয়সী - গাড়ী চালাচ্ছে। হঠাৎ সে প্রশ্ন করল, "ম্যাম্ আপনি কী এখান থেকে কোথাও চলে যাচ্ছেন?" 

---"হঠাৎ এ প্রশ্ন?" 

অপ্রস্তুত হাসি হেসে সে বলল, "না, মানে, আপনার হাতে বড় বড় দুই ব্যাগ ভর্তি জামাকাপড় দেখছি কী না..." ভারী ভদ্র বাচনভঙ্গীটি। 

---"এগুলো পুরনো সব। এক NGO তে যাবে। যে সব বাচ্চার মা বাবার তাদের পুজোর জামা দেওয়ার সাধ্য নেই তাদের জন্য।" 

খানিক স্তব্ধতা। তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে ছেলেটা আপন মনেই ছাড়া ছাড়া ভাবে বলতে লাগল: 

"ভগবান আপনাদের ভালো করবেন ম্যাম্। ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। একটা ছেঁড়া জামাও কেউ দেয়নি আমায় বা আমার বোনকে। বাপ মা মরে গেল, কাকা বোনটার সঙ্গে অসভ্যতা করল। বাড়ী ছেড়ে চলে এলাম। হার মানি নি, ম্যাম্। আর্ট কলেজে চার বছর পড়েছি। কলকাতা পুলিশের যে অ্যাডগুলো হয় না, ওগুলোর ড্রয়িংটা করি।  এখন বি.ফার্মা পড়ছি যাদবপুরে। সকাল বেলা একটা তরকারি বসিয়ে দু'ঘন্টা পড়ি। তারপর খেয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। পথে দু'একটা ট্রিপ সেরে ইউনিভারসিটি। সাড়ে চারটে পর্যন্ত। তারপর থেকে রাত বারোটার মধ্যে চোদ্দটা ট্রিপ সেরে বাড়ী গিয়ে আবার পড়তে বসি। বোনটা জোকা আই.আই.এম. এ পড়ে। ফাইনাল ইয়ার। প্লেসমেন্টও হয়ে গেছে। তিনটে সিমেস্টার মিলিয়ে মোট ২৪ লাখ টাকা। দিতে পেরেছি ম্যাম্। এখন ও চাকরিটা পেয়ে গেলেই আমার ছুটি। বাবা নেই, বাবার কাজটুকু করে দিয়েছি। এরপর ও আমায় ভুলে গেলেই ভালো।"

ভবানীপুর এসে গেল। আমায় বাড়ীর সামনে নামিয়ে ছেলেটা চলে গেল। ওর নামটাই জানা হয় নি। তাতে কিছু এসে যায় না। হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে আমার চিত্ত এখন ঝলমলাচ্ছে। কান্নার আকাশ পেরিয়ে এসে পৌঁছেছে আলোকবিহঙ্গ সুপর্ণ। আলোর ভাষায় আকাশ ভরল ভালোবাসায়। আমি সেই আদিত্যবর্ণ পুরুষের দেখা পেয়েছি। 

ন দক্ষিণা বি চিকিতে ন সব্যা
ন প্রাচীনম্ আদিত্যা ন - উত পশ্চা।
পাক্যা চিদ্ বসবো ধীর্যা চিদ্
যুষ্মা নীতো অভয়ং জ্যোতির্ অশ্যাম্।

ডানও জানিনে, জানিনে কো বামও
পুব না, বসুরা, নয় পশ্চিমও
যাব সেই পথে, হে আদিত্যেরা,
নেতা -- নিয়ে যাবে যেখানে তোমরা
বুঝেই হোক বা না বুঝেই হোক
পেতে চাই সেই অভয় আলোক।।

ঋতবাকের সকল স্বজনকে জানাই আসন্ন দীপাবলীর প্রীতি ও শুভেচ্ছা।