Next
Previous
Showing posts with label বিশেষ রচনা. Show all posts
0

বিশেষ রচনা : সীমা ব্যানার্জী-রায়

Posted in





বিশেষ রচনা



কে আনকালচার্ড?
সীমা ব্যানার্জী-রায়



লুজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়বার সময় মাঝে মাঝেই একা হয়ে পড়তাম নতুন পরিচিত বন্ধুদের কাছ থেকে। এইরকম একদিন কলেজ ক্যাফেটেরিয়ার কোণার সীটে বসে আছি। আয়েস করে সবে মাত্র কফির কাপটাতে প্রথম চুমুকটা দিয়েছি। শুনতে পেলাম দুই মিষ্টি নারী -কণ্ঠ। কারণ আমার কণ্ঠ সব সময় আমার কাছে হাঁড়িচাঁচা পাখীর মতন লাগে। তাই কানটা খাড়া করলাম, কারণ তাঁরা ছিলেন সত্যিকারের বাঙ্গালী। যদিও আমি বাঙ্গালী পুরোপুরি হতে পারি নি আজও-এটাই আমার সবচেয়ে দুঃখ।

প্রথমজন বেশ উত্তেজিত, কারণ তিনি বক্তা। আর দ্বিতীয় জন নিরুপায় শ্রোতা মাত্র। -'হুঁ-হাঁ'- দেওয়া ছাড়া আর বিশেষ কিছু করার ছিল না তাঁর। বুঝলাম দুজনেই কলকাতায় জন্মেছেন এবং বড় হয়েছেন। যিনি বক্তা তিনি 'ইগো'র লড়াইয়ে এক্কেবারে ক্ষত বিক্ষত! ভাগ্য আমার ভাল ছিল তাই কোণার টেবিলে ছিলাম। আমাকে তাঁরা কেউই লক্ষ্য করতে পারেন নি। যদিও আমার মধ্যে বাঙ্গালীত্ব-র অভাব বলে জানি, নয়ত সব সময় শুনতে হয় যে, আমি স্প্যানীশ বা পাঞ্জাবী-না কোন হটভট দেশ থেকে আসা এক প্রাণী। যাই হোক, দুকান খাড়া করে বসে থাকলাম।

বক্তাঃ এরা কালচারের জানেটা কি? এসেছে তো সব গ্রাম/মফস্ব্ল থেকে । জানি সবই, বাব্বাঃ। এখানে এসে একেবারে সব নায়ক-নায়িকা হয়ে গেছে। দেখলেই বোঝা যায় কিন্তু। আমি জন্মেছি কলকাতায়, পড়াশুনা করেছি কলকাতায়। থেকেছি দক্ষিণ কলকাতায়। কলকাতার হেঁজো-পেঁজো যায়গা থেকেও আসি নি। জন্মগত ভাবেই -কালচার- কি! আমি জানি। কালচারাল পরিবেশেই আমি 'বর্ন এ্যান্ড ব্রট আপ'। এরা কালচার কি তা জানবে কোত্থেকে- কি বলো?

শ্রোতাঃ- আমিও তো তাই। কলকাতায় জন্মেছি আবার কলকাতায়-ই বড় হয়েছি। নামকরা ইংরেজি স্কুলে পড়াশুনা করেছি। বনেদি বংশের মেয়েরা আমার বান্ধবী ছিল। কোনটাই আমার সাথে মিলছে না দেখে এমন ভাব করলাম যেন, কিছুই শুনছি না।

বক্তাঃ আরে সে-ই তো, সেই জন্যেই তো তোমাকে কথাগুলো বলছি। বলো তো, এরা কালচারের জানে টা কি? জন্মেছে তো সব গ্রামে অথবা মফস্ব্লে। কালচার কি তা এরা জানবে কোত্থেকে- ? কোনদিন কি স্টেজে উঠেছে? 

শ্রোতাঃ স্টেজে ওঠা তো দূরের কথা-স্টেজের কাছাকাছি ই গেছে কিনা সন্দেহ। অথচ এখানে সব কালচারাল সেক্রেটারী। গা জ্বলে যায় এইসব দেখে।

চা খাওয়া আর হল না, জুড়িয়ে ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি আবার কোন কথা মন দিয়ে শুনতে শুরু করলে যদি অন্য দিকে মন দি - এক্কেবারে শুনতে পারি না। লোকে আমাকে কালা ভেবে বসে। এইভাবে বসে বসে “ কালচার্ড -আনকালচার্ড--' শহর/ নগর, গ্রাম /মফস্বল, বাংলা/ইংলিশ এই শব্দ গুলো নিয়ে মনে মনে নাড়াচাড়া করতে করতে ফিরে এলাম ক্লাসে । ক্লাসের নোট নেওয়া তো দূরের কথা-মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে লাগল-সেই দুই কলকাতার কালচার্ড-দের কথা। বাড়ি ফিরে এলাম। খাতাটা টেনে নিয়ে বসলাম টেবিলে। খাতার ওপরে পেনটা রেখে ভাবতে লাগলাম কে কালচার্ড?......কারা কালচার্ড? সত্যি তো কোনদিন মনেও আসে নি এই প্রশ্নগুলো?

মনে পড়লো বন্ধু প্রিয়নাথ সেনকে লেখা রবীন্দ্রনাথের এই লাইনটা- “ আমার কলকাতা ছেড়ে পালাতে ইচ্ছে করে।” মনে পড়ল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ-এর কলকাতা সম্পর্কে প্রকাশ করা নানা উপলব্ধি- “ পৃ্থিবী বাস্তবিক কী আর্শ্চয্য সুন্দরী তা কলকাতায় থাকলে ভুলে যেতে হ্য়।”

রবীন্দ্রনাথ কলকাতায় জন্মেছিলেন কিন্তু কলকাতায় থাকতে চাননি। তিনি কোথায় জীবনের অধিক সময় কাটিয়েছেন সে কথা আশা করি বাঙ্গালীদের অজানা নয়। শহরের যান্ত্রিকতা-কৃ্ত্রিমতা তাঁকে আনন্দ দিতে পারেনি একটুও। ইংরেজি পাঠশালায় তিনি পড়েননি। যদিও ইংরেজি মাধ্যমে পড়নেওয়ালাদের থেকে অনেক বেশি ইংরেজি পড়েছিলেন। তাদের থেকে অনেক বেশি নির্ভূল ও সুন্দর ইংরেজি তিনি জানতেন। একটা শিশুর শিক্ষার মাধ্যম তার মাতৃভাষাই হওয়া উচিত, একথাও তিনি মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। তবে কি তিনি কালচার্ড ছিলেন না? 

এতো গেল রবি ঠাকুরের ব্যাপার। অন্যরা সব কোথায় জন্মেছিলেন? চুপচাপ বসে ভাবতে লাগলাম। দেখি কখন এসে আমার সামনে দাঁড়িয়েছেন রাজা রামমোহন রায় এবং পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

আমার সামনে রাখা খাতাটাতে রামমোহন রায় বড় বড় করে জন্মস্থান লিখলেন -হুগলী জেলার রাধানগর গ্রাম। 

বিদ্যাসাগর হেসে তাঁর হাত থেকে পেনটা নিলেন। জন্মস্থান লিখলেন -মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রাম। তাকিয়ে দেখি আমার সামনে তো বিরাট ভীড়। একে একে সকলে পরস্পরের হাত থেকে পেন নিচ্ছেন আর লিখছেন। 

বিদ্যাসাগরের হাত থেকে পেনটা নিয়ে মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত জন্মস্থান লিখলেন-যশোর জেলার কপোতাক্ষ নদীর তীরবর্তী সাগরদাড়ী গ্রাম। নাট্যকার দিনবন্ধু মিত্র জন্মস্থান লিখলেন-নদীয়ার চৌবেড়িয়া গ্রাম। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় জন্মস্থান লিখলেন-নদীয়ার কৃষ্ণনগর।

সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মস্থান লিখলেন-নৈহাটির কাঁঠালপাড়া গ্রাম। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মস্থান লিখলেন-হুগলী জেলার দেবানন্দপুর গ্রাম। তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখলেন জন্মস্থান – বীরভূমের লাভপুর গ্রাম। বিভূতি ভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কে দেখেই আমি বলে ফেললাম- “ আমরা জানি আপনি নিজেই সেই গ্রামের 'অপু'।”

কবি জীবনানন্দ দাসকে দেখে না বলে থাকতে পারলাম না - “রূপসী বাংলার ওই রূপ কি কেউ শহরের নিষ্প্রাণ পাথরে জন্মে দেখতে পায়? সব তো ইঁটের পাঁজরে বলি হয়ে যায়।”

বাংলা সাহিত্যের ধ্রুবতারা-কবি নীরদচন্দ্র চৌধুরী জন্মেছিলেন কিশোরগঞ্জ শহরে।

তখনও কিন্তু ভীড় কমেনি। খাতার কাছে এগিয়ে আসার জন্য রীতিমত ঠেলাঠেলি চলছে। 

কিন্তু কে যেন চেঁচিয়ে উঠল। ঘুমটা গেল ভেঙ্গে। দেখি আমার বৌ্দি চায়ের কাপ হাতে।

-এখনও ঘুমাচ্ছিস?

-ঘুমুচ্ছি না তো, দেখছি আনকালচার্ড কে?

বৌ্দি অবাকঃ “কে আবার আনকালচার্ড?”

আমি বললামঃ “সেটাই তো আমার জিজ্ঞাসা। তুমি কি জানো?”

আমি আমার বঙ্গজননীকে যেন বললাম-

“আমার না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে 
তোমার ভাবনা তারার মতন বাজে।
নিভৃত মনের বনের ছায়াটি ঘিরে
না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ ফিরে,
আমার লুকায় বেদনা অঝরা অশ্রুনীরে-
অশ্রুত বাঁশী হৃদয় গহনে বাজে।।”
5

বিশেষ রচনা: সীমা ব্যানার্জী-রায়

Posted in




বিশেষ রচনা



আমার দুর্গা-রা
সীমা ব্যানার্জী-রায়



প্লীজ হাসবেন না...!



১) ভারতীয় দুর্গা!

স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়াঝাঁটি নতুন কথা কি? মোটেই নয়, তাই না? মা অন্নপূর্ণাও স্বামীগৃহে ঝগড়া আর অভিমান করে বাড়ি থেকে গুটি গুটি পায়ে বেড়িয়ে পড়েছিলেন। ভর দুপুরে নদী পার করার জন্যে মাঝিকে ডাকছিলেন আকুলভাবে। নৌকা এলে তিনি মাঝিকে নিজের দুর্দ্দশার কথাও ফলাও করে বলেছিলেন। সেখানেও ছিল কিন্তু স্বামীদেবতার মুখ্য প্রভাব। কাজেই এ প্রথা চিরকালই ছিল, আছে-থাকবেও। তবে নানা কারণে কম বেশি হয়, এই আর কি।

তাছাড়া, আজকাল মেয়েরাও সহ্য করতে চায় না। নিজেদের আশা আকাঙ্ক্ষায় ঘাটতি হলেই মহিশাষুরমর্দিনী রূপ ধারণ করে। ফলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাটির তর্জন গর্জনটা একটু বেশি শোনা যায়। কেউ কেউ বা তল্পি-তল্পা গুটিয়ে সো...ও...জা বাপের বাড়ি ...

কলকাতার একটা বহুতল বাড়ির প্রতিটি ফ্ল্যাট থেকেই নানা রকম ঝগড়ার শব্দ প্রায়ই শোনা যায়। হয় শাশুড়ি-ননদ ঘটিত অথবা স্বয়ং স্বামীদেবতা নামক মানুষটির সাথে। শুরু হয় আশপাশের উঁকিঝুঁকি অথবা কান নামক বস্তুটিকে সজাগ রাখা। অবশ্য খবরটা পরেরদিনই টেলিকাস্ট হতে সময় লাগে না কাজের মেয়েদের মারফত।

কোনো রকম চেঁচামিচির শব্দ শোনা যায় না কেবলমাত্র পাঁচ তলার একটা ফ্ল্যাট থেকে। সেখানে খা...আ...লি স্বামী-স্ত্রীর হাসির শব্দ শোনা যায়। আর সেই হাসির শব্দ শুনে সকলেই মনে মনে ভাবে, “ইশ! ওরা কত সুখী! আমাদের যে কেন এত ঝগড়া হয়, জানি না। দুজনেই দুজনকে বলে তখন যে, নিজে্রা মানিয়ে নিলেই তো ওদের মত সুখী হওয়া যায়।”

কাজেই এই সুখী দম্পতির খবরটা সারা কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ল। কলকাতার কড়চায় সুন্দরভাবে ফলাও করে প্রকাশিত হল সে খবর। 

ফলে একটি সমাজসেবী সংস্থার পক্ষ থেকে ওই 'সুখী দম্পতীর' একটা সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের দুজনের কোনো মতের অমিল নেই। নেই কোনও অশান্তি, কথা কাটাকাটি। আছে শুধু হাসা-হাসি! আপনাদের এমন সুখী জীবনের রহস্যটা কি, আমাদের একটু বলবেন? আমরা বৃহত্তর স্বা্র্থের খাতিরেই কথাটা জানতে চাইছি। যদি অনুগ্রহ করে আমাদের জানান, তাহলে অহেতুক ডিভোর্সের হাত থেকে বাঁচানো যাবে কিছু পরিবার-কে।”

উত্তরে গৃহকর্তা বল্লেনঃ, সকলেরর মতো আমাদেরও মতের অমিল ইত্যাদি সব কিছুই যথারীতি আছে। কারণ আমরাও সভ্য মানুষের পর্যায়ে পড়ি তো! ব্যাপারটা কিন্তু খুবই সাধারণ। আমার স্ত্রী রেগে গেলে মুখে কিছুই বলে না। হাতের কাছে যা পায় তা-ই আমাকে ছুঁড়ে মারে। ছুঁড়ে মারা জিনিসগুলো যখন আমার গায়ে লাগে আর আমি ব্যথায় কুঁকড়ে যাই- তখন আমার স্ত্রী খুউউউউব হাসে। 

আর আমার গায়ে না লেগে সেইগুলো যখন আমার এপাশ ওপাশ দিয়ে চলে যায় তখন আমি খুউউব হাসি। বাইরের সকলে তখন আমাদের হাসিটাই শুধু শুনতে পায়। কেন হাসছি সেটা জানার প্রয়োজন বোধ করে না বা করে নি কোনদিন ।

সমাজসেবীরা কোনো সদুত্তর না পেয়ে মুখ বেজার করে চলে গেল। ফ্লাটের সবাই জানলা দিয়ে উঁকি ঝুঁকি মেরেও কোন লাভের মুখ দেখল না।

**

জানাশোনা কারুর ডিভোর্সের জন্য কোর্টে গিয়ে তো তাজ্জব বনে গেছে সেই বিল্ডিং-এরই ৮ তলার বাসিন্দা। তখন কোর্টে এক বিবাহ বিচ্ছেদের মামলার শুনানী চলছেঃ আর সেই মামলার লোকজন-রা আর কেউ নন-তাদের-ই ফ্লাটের ৫ তলার “সুখী দম্পতি” বাসিন্দারা। তারা তো আশ্চর্য্যভাবে এদিক ওদিক ভাবতে লেগে গেছেন।

মাননীয় বিচারক প্রশ্ন করলেন, “আপনা্দের দুজনের মধ্যে কে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইছেন?”

গৃহকর্তা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, “ইওর অনার! আমি আমার স্ত্রীকে ডিভোর্স করতে চাইছি।”

বিচারকঃ - “কারণ-টা কি?”

গৃহকর্তাঃ “আমার স্ত্রী আমাকে - শুধু শুধু মারে রোজ।”

বিচারকঃ “শুধু শুধু মারে? কেন? কিভাবে মারে?”

গৃহকর্তাঃ “ আমার ওপর রাগ হলেই হাতের কাছে যা পায়, থালা বাটি, ঘটি, গ্লাস যা পায় , তাই ছুঁড়ে মারে।”

বিচারকঃ “সে কি? আপনাদের কত বছর বিয়ে হয়েছে?”

গৃহকর্তাঃ “কি বলব -ইওর অনার! মাত্র পঁচিশ বছর।”

বিচারকঃ “পঁ-চিশ বছর? আপনাকে কত বছর ধরে আপনার স্ত্রী মারছে?”

গৃহকর্তাঃ “গত ২৪ বছর যাবৎ আমার স্ত্রী এভাবে আমাকে মেরে চলেছে।”

বিচারক কিছুটা বিস্মিত হয়ে বললেন, “ ২৪ বছর ধরে মারছে, অথচ আপনি এসেছেন সেই অভি্যোগ নিয়ে সিলভার জুবলীর সময়? ভারী আশ্চর্য্য তো। আরো আগে ডিভোর্স করলেন না কেন?”

এবার গৃহকর্তা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলেনঃ 

-“কি আর বলব , ইওর অনার। আসলে আমরা দুজনেই দুজনকে খুউব ভালবাসি। ভেবেছিলাম দুজনেই যে, বয়স হলে হয়ত আর মারামারি করব না।” 

-তার মানে ? আপনিও আপনার স্ত্রীকে মারেন? 

-আমার রাগ হলেও আমিও হাতের কাছে যা পাই, ছুঁড়ে মারি। কিন্তু স্ত্রী আমার রাগ দেখেই খাটের তলায় ঢুকে যায়। আমার কোমরে ব্যথার জন্য আমি নিচু হতে পারি না। আর ছোঁড়াও হয় না।

কিন্তু ২৪ বছর আগে আমার স্ত্রী যখন আমাকে সব কিছু ছুঁড়ে মারতো তখন একটাও আমার গায়ে লাগতো না। সব এধার ওধার চলে যেতো। ফলে ও মারলেও আমি ব্যথা পেতাম না। কিন্তু ২৪ বছর ধরে ছুঁড়তে ছুঁড়তে ওর হাতে এখন এমন নিঁখুত টিপ হয়েছে যে যখন যেটাই ছুঁড়ে মারে, সেটাই আমার গায়ে এসে লাগে। এই জন্যই এখন এসেছি ডিভোর্স করার জন্য।

-আপনাদের ডিভোর্স হবে না।

-কেন ? কেন হবে না?

-কারণ আপনার স্ত্রীর নিখুঁত টিপের জন্য আপনিই একমাত্র দায়ী। একটাই সল্যুশন আছে- উনি যখন রাগের মুডে আসবেন -আপনি তখন ওনার মতন খাটের তলায় ঢুকে যাবেন। ওনারও বয়স হয়েছে কাজেই উনিও আর নীচু হয়ে আপনাকে মারতে পারবেন না। তাহলে ওনার ছোঁড়াছুঁড়ি আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে যাবে দেখবেন। অথবা আপনি তাড়াতাড়ি অন্য কোথাও গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেবেন।

সমস্ত হল এই ডিসিশনে “হো-হো-হা-হা” হাসিতে ফেটে পড়ল। আপনারা কিন্তু প্লিজ হাসবেন না। 


২) মেক্সিকান দুর্গা!

আমার এই দুর্গা হল এক বিদেশী মেয়ে - নাম তার কয়না। মেক্সিকো থেকে ৫টি ছোট ছোট মেয়ে আর এক কোলের ছেলে নিয়ে অবৈ্ধভাবে এসে পৌঁছেছিল শান্তি আর নিরাপত্তার খোঁজে। এসে উঠেছিল মেক্সিকোর বর্ডার টেক্সাসের এক শহরে।

কিছুদিন পর যে স্বা্মীর হাত ধরে অজানা অচেনা দেশে এসেছিল, সেই স্বামী সু্যোগ বুঝে কেটে পড়তে একটুও দ্বিধা করে নি। একবারও ভেবে দেখে নি যে, কিভাবে এই ছোট ছোট বাচ্চাদের মানুষ করবে অল্পবয়সী সুন্দরী মা। ফরসা রঙ, অপরূপ সুন্দর মুখ। বাবা তবুও নিজের সুখের সন্ধানে সব ছেড়ে বেড়িয়ে পড়তে একবারও দ্বিমত করে নি।

সেই কয়না তখন মা দুর্গার রূপ ধারণ করে -। মা বুঝেছিল, “আমি যা করব আমার ছেলেমেয়েরা তাই দেখে আমার দৃষ্টান্ত অবলম্বন করবে। আমি যদি ভাল না হই, তবে ওদের পক্ষে, আমার পক্ষেও মন্দ।” তাই সেই মায়ের চেষ্টা, “যদ্দুর পারি ভালভাবে জীবন যাপন করে যাব।” তাই অমানুষিক ভাবে লোকের বাড়ি আর বড় বড় দোকানে ঝাড়পোঁছের কাজ করে উদয়-অস্ত। বৈ্ধভাবে চাকরীর সু্যোগ না থাকায় আর ইংলিশ কথোপকথনের অনভ্যাসে খুব অল্প বেতনেই কাজ নেয়। সন্তানদের পালন আর নিজের রক্ষণাবেক্ষণ শুরু করে। এইভাবেই ধীরে ধীরে নিজের পায়ের মাটি মজবুত করে। মেয়েদের স্কুলে পাঠায় আর ছেলে ততদিনে নাবালক হয়ে গিয়ে স্কুলে পড়ছে।

যে দেশের যা নিয়মঃ দুই ১৭-১৮ বছরের মেয়েরা নিজেদের স্বাবলম্বী করেই আসতে আসতে নিজেদের পথ বেছে নেয়। তার জন্য মা কিন্তু পরের জনদের সাথে একটুও খারাপ ব্যবহার করে নি বা নিজের সুখের জন্য অন্য পথে পা বাড়ায় নি। তাদেরও আগের দুই মেয়ের মত করে মানুষ করছে। হয়ত শেষে একা হয়ে পড়বে। এখন ছেলেমেয়ে আছে বলে আর কেউ তাকে বিয়ে করতেও রাজী নয়। হয়ত রাতের তারাদের দিকে তাকিয়ে একবার নিজের সুখের কথা চিন্তা করে কি......

“সারাদিন বসি গগনের মাঝে
আলোকের খেলা করিয়া শেষ
সাঁঝের বেলায় চলে দিনমণি
ক্লান্ত শরীরে আপন দেশ।”

সেদিন আমাদের বাড়িতে এসে কাজের শেষে হঠাৎ বলতে শুরু করে তার কষ্টের দিনের কথা...ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংলিশে জানায় তার প্রতিবেদন...

ভবিষ্যত তার কী-সে জানে না। যে কোনদিন এই মার্কিণমুলুকে অবৈধভাবে থাকার দরুণ হয়ত ধরা পড়তে পারে। সেদিন হয়ত তার শেষ দিন হবে জীবনের...তাই লড়ে যাচ্ছে যতদিন না বাচ্ছারা বড় হচ্ছে...। তার কথার ভাষায় যততুকু বুঝেছিলাম...বলগাহীন উন্মত্ত মুক্তির স্রোতে হয়ত উন্মাদনা আছে কিন্তু সুস্থ মানসিকতা কোথায় আছে, জানা নেই। 

স্যালুট ছাড়া কি আর জানাব আমার এই বিদেশী দুর্গাকে।


৩) আমেরিকান দুর্গা!

আমার এ-ই দুর্গা হল এক আমেরিকান মা। সেই মা! তার ধর্ষণের ফসল হিসেবে পেয়েছিল একরত্তি মেয়ে। কলেজ থেকে আসবার পথে অচেনা অজানা এক যুবকের হাতে সমর্পণ করতেই হয়েছিল। রিভলবারের ট্রিগারের ভয়ে আত্মসমর্পণকেই বেছে নিয়েছিল। ১৯ বছরের ধর্ষিতা মায়ের শ্রেষ্ঠ ফসল আজ তার মেয়ে। সমাজের চোখে দৃষ্টিকটূ হওয়া সত্ত্বেও সেই মা ভ্রূণহত্যা না করে মেয়েকে নতুন জীবন দান করেন। মানুষ করে তোলেন তাকে নিজের সব শক্তি দিয়ে। 

মায়ের অদম্য সাহসীকতায় বেড়ে ওঠা মেয়ে আজ ২৪ বছরের এক অসামান্যা যুবতী। মেয়ে মানুষ হয় মা আর দাদু-দিদার আদরের ছায়ায়। দাদু-দিদিমার অল্প আয় থাকায় মেয়ের মা-কেও আমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে মেয়েকে মানুষের মতন মানুষ করতে। তাকে এক বিন্দু চোখের আড়াল করতেন না তিনজনে। কিন্তু সূর্য তো আর মেঘে থাকা না। মেয়ে ডাক্তার হবার পর ইচ্ছা প্রকাশ করল তার প্রচার দরকার। 

এই প্রচারের একটা কিন্তু অজ্ঞাত কারণও ছিলঃ যাতে তার ছবি দেখে তার ধর্ষণকারী বাবা তার মেয়েকে একবার দেখতে চায়... আর সেও তার ধর্ষণকারী বাবাকে দেখে তার সামনে একটাই প্রশ্ন রাখবেঃ কেন বাবা তার মাকে এইভাবে অসহায় করেছিলেন। কি দোষ ছিল তার মায়ের?

সুন্দরী প্রতি্যোগীতায় যোগদানের ইচ্ছা প্রকাশ করলে মা একবাক্যে নাকচ করে দেন। কেঁপে উঠেছিল মায়ের সাধনা আর বুক। কিন্তু মা -কে বুঝিয়ে আর দাদু-দিদিমার সমর্থন-কে সাথে নিয়ে এগিয়ে যায় সে। পৃথিবীর সেরা সুন্দরীর শিরোপা আজ তার মাথায়। 

সুন্দরী প্রতি্যোগীতায় শেষ প্রশ্ন যখন ওঠেঃ ভবিষ্যতে সে কি করতে চায় এই শিরোপা মাথায় ওঠার পর। সত্যের তীব্রতা আর কর্তব্যের ঘোর লাগা চোখে সেই মেয়ের সপ্রতিভ উত্তর- “ স্ত্রীলোকের উপর পুরুষের কামজ বলাৎকার-এর কুফল” -এই বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যাপারে আশাবাদী সে। কারণ সে তার জ্বলন্ত উদাহরণ।

জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই তো মেয়ের একটাই প্রশ্ন তার মা এবং দাদু-দিদিমাকে সবসময় বিব্রত করতঃ - “ কে তার বাবা? কোথায় গেলে সে তার বাবাকে খুঁজে পাবে?” 

তাকে যখন পালটা প্রশ্ন করতে বলা হয়- সে সপ্রতিভভাবে জানায় তার উত্তরঃ “ সে তার ধর্ষণকারী বাবাকে একবারটি শুধু চোখের দেখা দেখতে চায়। জ়ীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে তার চেষ্টার ত্রুটি রাখবে না। আর তার বিশ্বাস সে তার বাবাকে খুঁজে বার করবেই।”

সেই মেয়ের প্রশ্নে বিরূপ সমালোচনা শুনতে তো হলই না, উলটে কাগজে কাগজে সমালোচনার বদলে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শোনা গেল। 

“মরি মরি কি শুনিলাম? কি এক অন্য প্রতি্যোগীতা! শুধু ধর্ষণকারী পিতার স্মৃতি আবাহন, নারীদের কঠিন হস্তে অস্ত্রধারণ ও তাদের নেত্রী হিসেবে নিজেকে দেখা... দেবী দশভুজা কি আজ অবতীর্ণা হলেন?”

সমস্ত পৃ্থিবীর বুকের উপর এক সুন্দরী মেয়ের আত্ব্নিবেদন।

এই দুর্গার জয় হবেই -আর হতে হবেই। এ ছাড়া অসুরদের বিনাশ হওয়া মুশকিল।

“খেয়া তরীখানি বাহিয়া এখনি
আসিবে যে নেয়ে করিয়া পার
বলিবে কে যাবি আয়-ত্বরা করি
নাহি কোন ভয় ভাবনা আর।”
0

বিশেষ রচনা : মৌসুমী দাস

Posted in


বিশেষ রচনা 



আমার হারিয়ে গেছে চিঠি 
মৌসুমী দাস 



"পোস্ট অফিস হইতে কেষ্ট সিং চিঠি হাতেই ফিরিল। ব্যগ্র হইয়া শিবনাথ চিঠিখানা তাহার হাত হইতে লইয়া মুহূর্তে খুলিয়া ফেলিল। একি! এ কাহার হাতের লেখা! কাশী, নিচে পত্র লেখকের নাম- গৌরী দেবী ! গৌরী! 

গৌরী পত্র লিখিয়াছে! তাহার মুখ চোখ লাল হইয়া উঠিল!বুকের মধ্যে হৃদপিণ্ড ধকধক করিয়া বিপুল বেগে চলিতেছে! হাত পা ঘামিয়া উঠিয়াছে। উঃ, দীর্ঘদিন পরে গৌরী পত্র লিখিয়াছে! চিঠিখানা সে তাড়াতাড়ি পড়িয়া গেল।" 
- ধাত্রীদেবতা, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় । 

ঘরে ঘরে টেলিফোন প্রচলনের আগে মানুষ এই শিবনাথের মতই অধীর আগ্রহে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম চিঠি/ পত্রের জন্য অপেক্ষা করে থাকত । সে চিঠি মা-বাবার বা ছেলেমেয়ের হোক অথবা কোনও নিকট আত্মীয় বা পরম প্রিয় মানুষটিরই হোক, দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর চিঠি এলে আনন্দে বিহ্বল হয়ে যেত, ঠিক যেমন দীর্ঘ দাবদাহের পর এক পশলা বৃষ্টি। অথবা যেন দিন কয়েক ধরে একটানা বৃষ্টির পর প্রথম সূর্যের আলো। চিঠির মধ্য দিয়েই যেন সেই মানুষটির স্নেহ, ভালবাসা, আবেগের ছোঁয়া পাওয়া যেত। এখনকার মত সে যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থা তত উন্নত ছিল না। ধরা যাক বহু দূর দেশে ছেলে কাজ করতে গেছে। গ্রামের বাড়িতে মা-বাবা, স্ত্রী সবাই রয়েছেন । অধীর আগ্রহে ছেলের কুশল সংবাদ জানবার জন্য সবাই প্রতীক্ষা করে আছেন।এবার দীর্ঘ দিন পর ছেলের একটি চিঠি এল। পরিবারের অবস্থা তখন আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মত হত।মা-বাবা সেই চিঠি বুকে জড়িয়ে ধরে যেন তাঁর স্পর্শ অনুভব করতেন।হাতের লেখা প্রতিটি অক্ষর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতেন। প্রিয়তমা পত্নীটি বার বার করে সে চিঠি পড়তেন, আবার লুকিয়ে রাখতেন। আবার পড়তেন। সে এক অন্য রকম অনুভুতি ছিল। 

আসলে চিঠি হল আত্ম প্রকাশের একটি মাধ্যম। এবং অন্য মনের সঙ্গে নিজ মনের মিলনের এক সৃজনশীল পথ। একমাত্র চিঠি - পত্রের মাধ্যমেই আমরা নির্ভয়ে, অসঙ্কোচে, অকপটে, নিজের মনের সব কথা উজার করে বলতে পারি।বহু কাল আগে, মহাকবি কালিদাস তাঁর রচিত মেঘদূতম কাব্যে প্রিয়তমা পত্নীর কাছ থেকে দূরে নির্বাসিত এক যক্ষ “আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে’ নবীন মেঘকে তাঁর কুশল সংবাদ নিয়ে দূত রূপে বিরহিণী প্রিয়ার কাছে পাঠিয়েছিলেন। সে যুগেও যে বার্তা পাঠানোর ব্যবস্থা ছিল, তার আভাস দিয়েছিলেন কবি । 

পত্র রচনা যে এক গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য, তা অনেক কাল আগেই প্রাচীন গ্রিসে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।এবং তার পর থেকেই দেশে বিদেশে বহু বড় বড় মনীষীদের পত্রাবলী সংগ্রহ, সংরক্ষণ করে রাখা হত। সেই সংরক্ষিত চিঠি থেকে তাঁদের ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি বর্ণনা, চিন্তাধারা সম্পর্কে পরবর্তীকালে আমরা জেনেছি।আর এভাবেই একদিন রবিঠাকুর কর্তৃক ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লেখা মুল্যবান চিঠিগুলো পরবর্তীতে চিঠির পারিবারিক অংশ বাদ দিয়ে “ছিন্নপত্র” নামে গ্রন্থাকারে আমাদের ঘরে এসে পৌছায়।শুধু রবিঠাকুরই নন, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, দ্বিজেন্দ্র নাথ ঠাকুর, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, প্রমথ চৌধুরী, জগদীশচন্দ্র বসু, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, থেকে শুরু করে কাজী নজরুল ইসলাম, বা সুকান্ত ভট্টাচার্যের সংরক্ষিত চিঠি থেকে তাঁদের সাহিত্য সৃষ্টির পরিপ্রেক্ষিত, রচনাকালীন অনুভূতি, ব্যক্তিগত জীবন, যন্ত্রণার কাহিনী জানতে পারি। 

বিখ্যাত ছাড়া সাধারন মানুষেরাও তাদের প্রিয় জনের বহু মুল্যবান চিঠি সযত্নে বহুদিন পর্যন্ত রেখে দিতেন।সেই চিঠি অনেকদিন পর বের করে পড়তেন।তা নিয়ে বেশ মজার বা বেদনার ঘটনাও ঘটেছে। বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস, সিনেমায় আমরা দেখেছি হয়ত কারো লুকানো চিঠি অন্য কারো হাতে চলে গেল্, বিশেষ করে যার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছে, অসাবধানে তার হাতেই পরে গেল, তখন এক অনাসৃষ্টি কাণ্ড হত। ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হত। 

টেলিফোন চালু হবার পর থেকে, চিঠি লেখা বা পড়ার, সময় বা ইচ্ছে প্রায় সকলেরই আর নেই বলা যায়। এখন তো আবার সকলের হাতে হাতে মুঠোফোন এসে গেছে। প্রয়োজনীয় খবরাখবর আদানপ্রদান এর মাধ্যমেই খুব অল্প সময়ে সেরে নেওয়া যায়। তাছাড়া দিন দিন মানুষের ব্যস্ততা যেন বেড়েই চলেছে। এই চরম ব্যস্ততার জীবনে চিঠি লেখা বা পড়ার সময় নেই কারো । তবে অল্পবয়সীদের মধ্যে প্রেমের চিঠি যে লেখা হয় না তা নয়। কিন্তু তা ডাকযোগে পাঠানো হয় কি না, আমার জানা নেই। ডাকযোগে চিঠি আদান প্রদানের মাধ্যমে যে আনন্দানুভূতির সৃষ্টি হয়, তা ওই সংক্ষিপ্ত এস,এম,এস এর মাধ্যমে হয় কি না কে জানে! কারণ, মেসেজে তো আর বিস্তারিত ভাবে মনের কথা বলা যায় না। তাছাড়া মেসেজ তো এক সময় delete করতেই হয়, চিঠি কিন্তু ইচ্ছে করলেই রেখে দেওয়া যেত। 

বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা “টেলিগ্রাম” শব্দটির সাথেও বিশেষ পরিচিত নয়। আগে কারো বাড়ী “টেলিগ্রাম” এলে, সে বাড়ির সাথে সাথে সারা পাড়ার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ত।কাঁপা কাঁপা হাতে প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে পিওনের কাছ থেকে সেই দূরবার্তা বা তারবার্তা গ্রহণ করা হত। কারণ  সে সময় “টেলিগ্রাম” ছিল কিছু মাত্র সুসংবাদের চেয়ে, বেশি মাত্রায় দুঃসংবাদ বহনকারী একটি দ্রুত মাধ্যম।এখন সুসংবাদ, দুঃসংবাদ সবই মুঠোফোনের মাধ্যমে নিমেষে প্রচারিত। 

পোস্টকার্ড বা ইনল্যান্ড এর ব্যবহার তো এখন আর চোখেই পরে না।সে সময় ঘরে ঘরে এর ব্যবহার হত প্রায় সারা বছর। ছোটবেলা বাবাকে দেখেছি নববর্ষ বা বিজয়ার পর “অবশ্য- কর্তব্য” পালনের জন্য একগুচ্ছ ইনল্যান্ড, খাম নিয়ে বসতেন, দেশে বিদেশে যত আত্মীয় স্বজন আছেন তাদের সাথে শুভেচ্ছা, ও কুশল বিনিময় করতেন। একটু বড় হলে, বাবার সময়ের অভাবের জন্য আমাকে দিয়েও চিঠি লেখাতেন। শিখেছিলাম বড়দের প্রণাম ও ছোটদের স্নেহ ভালবাসা জানিয়ে লেখা শুরু করতে হয়। তাছাড়া দূরদেশে থাকা মামাতো পিসতুত ভাইবোনদের সাথেও চিঠি লেখালেখি শুরু হয়েছিল। মনে পরে লেখার মাধ্যমে ইংরেজি চর্চা করব বলে আমরা ইংরেজিতে চিঠি লিখতাম। সে ছিল এক উন্মাদনা! চিঠি যেন দীর্ঘ হয় সে শর্তও থাকত।আবার পরস্পর পরস্পরের লেখার ভুল সংশোধন করে দিতাম। পিওন কাকুর কাছ থেকে চিঠি নিয়ে পড়তে কি আনন্দ যে হত, বলে বোঝানো যাবে না ! 

কলেজের পড়া শেষ হলে বন্ধু বান্ধবীরা যখন যে যার বাড়ি চলে গেল, তখন অনেক দিন পর্যন্ত ওদের সাথে চিঠি পত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ ছিল। আমার কলেজের এক বান্ধবী রুনু, একই শহরে বাস ছিল আমাদের। এ পাড়া ও পাড়া আর কি। প্রায়ই দেখা সাক্ষাৎ হত। একবার হল কি, এক সুন্দর রঙ্গিন খামে ওর চিঠি এল। দেখি ওর পোষা কালো বেড়ালের চারটে ছানা হতে গিয়ে বেড়াল টা কষ্ট পেয়ে মারা যায়, সে খবর নিদারুণ  ভাবে বর্ণনা করে জানিয়েছে।এত নিখুঁত সে বর্ণনা ছিল, যে চিঠি পড়তে পড়তে চোখের সামনে সে ঘটনা দেখতে পাচ্ছিলাম। সেই বর্ণনাকে পত্র সাহিত্যই বলা যায়। দেখা হলেই খবরটা দিতে পারত, কিন্তু সেটা হৃদয়কে এতটা স্পর্শ করত কি না কে জানে। কারণ, মুখোমুখি কথায় যা কিছু মনের ভাব এড়িয়ে যায়, চিঠিতে তা সুন্দর করে ধরা দেয়। খবর জানানোর এই অভিনব পদ্ধতিতে চমকিত ও হয়েছিলাম ।খুব মিস করি সেসব দিনগুলি।মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রিয় বন্ধু বান্ধবীদের সাথে আবার যদি চিঠি লেখা লেখি শুরু করা যেত! তবে সবাই আমরা এখন এত ব্যস্ত, যে সে ভাবনা বাস্তবায়িত করা হয়ে ওঠে না। 

আসলে প্রিয়জনের কাছে লিখিত আকারে মনের ভাব প্রকাশই তো চিঠি, তা কি আর এস,এম,এস এর মাধ্যমে পূরণ হয়? আর সামনা সামনি আমরা কতটুকুই বা মনের কথা গুছিয়ে বলতে পারি। সময় যত এগোছে এই “চিঠি” নামক শিল্পকর্মটি ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।এখন শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিক বা প্রশাসনিক কাজেই চিঠিপত্র ব্যবহৃত হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো এটুকুও আর থাকবে না, উন্নত আরও নতুন কোনো পদ্ধতির  উদ্ভব হবে। আর “চিঠিপত্র” শব্দটি অভিধানেই সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে।

2

বিশেষ রচনা: মকসুদা হালিম

Posted in





বিশেষ রচনা 



মুখপাত 

শ্রীমতী মকসুদা হালিম বাংলাদেশের একজন উদারচেতা মননশীল মানুষ। তাঁর কাছে আমরা ঋতবাকের জন্য লেখা চেয়েছিলাম। সময় স্বল্পতায় তিনি তাঁর একটি ব্যক্তিগত অনুভব আমাদের কাছে উন্মুখত করেছেন, যা তাঁর ব্যক্তিগত পরিসরকে অতিক্রম করে বেশ কিছু সার্বজনীন প্রশ্নের উপরে আলোকপাত করেছে । 

সেই লেখাটি এখানে আমরা প্রকাশ করলাম । 




স্বগতোক্তি 
মকসুদা হালিম 


আমার মতো শ্রদ্ধেয়া একবার ভালবেসে কাছে টেনে নিয়ে আবার কাউকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছি 
-এই অভিযোগের জবাব। 

আমি মকসুদা হালিম কাউকে ভালবেসে কাছে টেনে আবার তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবো--- এ ধরণের মন মানসিকতা আমার নাই। যাকে একবার ভালবেসে পাশে স্থান দেই, সে আদরণীয়ই থাকে সর্বদা। 

আমি কাউকে ছুঁড়ে ফেলে দেই নাই। শুধু নারী জাতিকে অশ্রদ্ধা, আর অসম্মান, আমাকে ক্রুদ্ধ করে। যারা নারীকে সম্মান জানাতে পারে না, তাদের তো নারীর বন্ধু হওয়া সাজে না। এদেরকে আমি আন ফ্রেন্ড করি মাত্র, ছুঁড়ে ফেলি না। 

কেউ কেউ অনুশোচনা করে ক্ষমা চেয়ে ফিরে আসে, আবার কেউ কেউ এতো দাম্ভিক যে মাতৃসম কারো কাছে ক্ষমা চাইতেও তাদের অহংএ বাধে। 

প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে দেখো ! পশু-পক্ষী, বৃক্ষ-লতায় নারীর মহিমা উপলব্ধি করার চেষ্টা করো। পৃথিবীর প্রতিটা ধর্মগ্রন্থেই নারীর অসীম শক্তির মহিমা কীর্তন ব্যক্ত হয়েছে। কয়দিন আগেই একটা গ্রুপে বিতর্ক হচ্ছিলো-‘বিধাতা’ পুরুষ নাকি নারী ? সাব্যস্ত হল— ‘বিধাতা’ অবশ্যই নারী, নচেৎ এই ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হলো কি ভাবে ? 

হিন্দু শাস্ত্রে ‘বিধাতা’ জগজ্জননী ! আদ্যাশক্তি মহামায়া নারী। নিজের অংশ দিয়ে দেবতা সৃষ্টি করেছেন। স্বর্গলোকে বিপদগ্রস্ত হলে এইসব বাঘা বাঘা দেবতাদেরও কিছু করার ক্ষমতা নাই, তখন নারীশক্তির ডাক পড়ে ! মহাদেব শঙ্করের মতো ধ্বংসের দেবতাও নারীর পদতলে পিষ্ট হয়। 

হাদিস বলে, ‘জননীর পদতলে জান্নাত। জননীকে সন্তুষ্ট রাখো, জান্নাত অবধারিত !’ পিতার কথা বলা হয় নি। আল- কোরআনে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘শেষ বিচারে হাশরের ময়দানে প্রতিটা জীব মাতৃ পরিচয়ে পরিচিত হবে। পিতৃ নয়’!

সৃষ্টিকর্তা নরক সৃষ্টি করেছেন, কাদা দিয়ে। নারীর অঙ্গে কর্দম লেপন করেন নি। পুরুষের পাঁজরের হাড় ছিনিয়ে নিয়ে নারীকে সৌন্দর্য মন্ডিত, মহিমান্বিত, সকল শক্তির আধার আর কমনীয় করে গড়েছেন। এই পাঁজরের হাড় পুরুষ স্বেচ্ছায় দয়া করে দান করে নি। সৃষ্টিকর্তার এ হেন কর্মের তাৎপর্যও কেউ চিন্তা করে দেখে না। পাঁজরের হাড় যেমন জীবের বেঁচে থাকার উপকরণ সমূহকে সুরক্ষিত রাখে তেমনি নারীও পুরুষের সকল নিদান কালের ত্রাতা ! 

‘নারী নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ না করলে আমরা আজ বেহেশতে মহা আরামে বাস করতাম’—এই কথা যারা বলে, তারা নিতান্তই অধার্মিক ! কারণ আল্লাহ কোরআনে স্পষ্ট করে বলেছেন, এই পৃথিবীতে তিনি মানুষের আবাদ করবেন বলেই মানুষ সৃষ্টি করেছেন আর আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কোনকিছুই হয় না। আল্লাহর ইচ্ছাতেই নারী এই নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণ করে সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা বাস্তবায়ন করেছে। পুরুষ করতে পারে নাই। 

পৃথিবীতে কোন নারী নবী-রাসুলের আবির্ভাব হয় নি সত্য কিন্তু নারী এই নবী রাসুলের জন্ম দিয়েছে ! নারী রাষ্ট্র শাসন করবে না, কারণ রাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষই অমানুষ ! নারী বিশ্ব শাসন করবে। জননী, জায়া, প্রেয়সী, ভগিনী কন্যা হয়ে নারী যে স্নেহ, মায়া, সহানুভূতি, প্রেম আর সেবা দান করে, বিশ্ব সংসার তার কাছে নতজানু ! ষণ্ড পুরুষের মতো নারীর গায়ে শক্তি নাই, সে গোলাপের মতো কোমল, যার ঘ্রাণে বিশ্ব জগত আমোদিত। নারী যে আন্তরশক্তিতে কি বিপুল শক্তিময়ী— বহু প্রাচীন কাল থেকেই পুরুষ সেটা টের পেয়ে শঙ্কিত  হয়েছে ! নারীর শক্তি খর্ব না করলে তাদের অস্তিত্বই লুপ্ত হয়ে যাবে, আর নয় তো পুরুষ মৌমাছির মতো নারীর দাসত্ব করে যেতে হবে। 

তাই পুরুষ যুগ যুগ ধরে ধর্মের নামে, আচারের নামে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে নারীকে পদতলে পিষ্ট করে চলেছে। আর বেঁধে পিটালে, সিংহও তার স্বভাব ভুলে সার্কাসের ক্লাউন সাজতে বাধ্য হয় ! নারী যে আশালীন- অশ্লীল আচরণ করে তার জন্য দায়ী কে ? নারী, নাকি পুরুষ ? পরিবেশ আর পরিস্থিতি নারীকে অশালীন করে। 

নারীর যৌবন আর সৌন্দর্যকে পণ্য করে পুরুষেরা কোটি কোটি টাকা মুনাফা বানিয়ে নিজেদের উদর পূর্তি করে। তোমরা পুরুষেরা নারীকে নিয়ে বাণিজ্য করবে, আবার চাইবে নারী বোরখা পরে হেরেমে বন্দী থাকুক ? তেইশ জোড়া এক্স ক্রোমোজোমের সবটুকু নিয়ে নারী পরিপূর্ণ—স্বয়ং সম্পূর্ণ মানবী ! তার মধ্যে কোন ভেজাল নাই। একটা ওয়াই-এর ভেজাল নিয়ে পুরুষের কিসের এতো অহংকার ?