Next
Previous
Showing posts with label পথেপ্রবাসে. Show all posts
0

পথেপ্রবাসে - দীপ্ত প্রতিম মল্লিক

Posted in
পথেপ্রবাসে

পেরুতে বেড়ুবেড়ু
দীপ্ত প্রতিম মল্লিক


পর্ব ৩ 

১১ ই এপ্রিল ২০১৯- হুয়াকাচিনা থেকে আরুকিপা 

হুয়াকাচিনার এই হোটেলে তিনতলাটায় শুধু আমরাই ছিলাম একমাত্র। যেন পুরো তিনতলাটা আমাদের। চোখের সামনে লেগুন আর বালিয়াড়ির শোভা দেখতে দেখতে ভাবছিলাম- মাত্র একরাত থাকাটা বড্ডো কম হয়ে গেলো- মন ভরলো না। মন খারাপ নিয়ে ঘরে গেলাম মাল প্যাক করতে। আচমকা পায়ের তলার মাটি দুলে উঠলো আর সাথে সাথে সমস্ত দরজা জানালার খটাখট শব্দ। সামান্য কয়েক সেকেন্ড, কিন্তু উপলব্ধি করতে লাগলো কয়েক মিনিট। বুঝলাম এটা ভূমিকম্প। এখানে প্রায়ই হয়, কাজেই চিন্তার কিছু নেই। বস্তুতঃ পেরু দেশ টাই অগ্নি বলয়ের(Ring of Fire) ওপর, ফলে ভূমিকম্প এখানে স্বাভাবিক। 

যাই হোক, মালপত্র নিয়ে এলাম “ওয়াইল্ড রোভার হোস্টেল” যেখানে আমাদের আবার জমায়েত হবার কথা। দেখে আশ্বস্ত হলাম যে একই গাইড । এই গাইড, যার নাম ফারনানডো- অসাধারণ। যেন একই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত আমরা। ফারনানডো তার লিষ্ট বের করে মিলিয়ে নিলো যে সবাই আছি কিনা। তারপর উঠলাম বাসে। এই বাসটি ছিলো সারা টুরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ । এটায় দেখলাম প্রায় শুয়ে পড়া যায়। আর সেটাই দরকার কেননা এটি আমাদের সবচেয়ে দীর্ঘ বাসযাত্রা। আমরা যাবো নাসকা হয়ে আরুকুপা- প্রায় সাড়ে সাতশো কিমি রাস্তা। দুপুর একটায় বাস ছেড়ে পৌছাবে পরদিন ভোরবেলা। আর আমরা উঠবো এ্যান্ডিস পর্বতমালার পথ ধরে প্রায় আট হাজার ফুট (৭৭০০ ফুট) ওপরে আরুকুপায়। সুদীর্ঘ পথ বলে সঙ্গে নেওয়া হলো দশ লিটার জলের বোতল। বাস ছাড়লো দুপুর একটায়। আধ ঘন্টা পর এলাম “পিসকো ভিন ইয়ার্ড”(Pisco Vineyard) । পিসকো অত্যন্ত বিখ্যাত তার ওয়াইনের জন্য। বস্তুত গোটা লাতিন আমেরিকাতেই পিসকো অতি বিখ্যাত একটি নাম। বিরাট ভিনইয়ার্ড – আমরা প্রথমেই এলাম যেখানে ফারমেন্টেশন হয়। ওয়াইন কিভাবে তৈরী হয় এসব জ্ঞান লাভের পর এলাম এই টুরের সব চেয়ে আকর্ষণীয় অংশ – টেস্টিং । লাইন দিয়ে চিয়ারে আমরা বসলাম। দেখলাম জনগন উত্তেজিত। টেস্টিং তে কোনো কার্পণ্য নেই। প্রত্যেক কে সাতখানা করে শট দেওয়া হলো। প্রথম তিনটে শট ৮% এ্যালকোহল হলেও পরের গুলি ৪২% ফলে সবার যেন একটু চনমনে ভাব। 

বাস ছাড়লো বেলা তিনটেয়। বাইরে তখন ধূ ধূ মরুভূমির কাঠ ফাটা গরম। মানে ৩০/৩১ ডিগ্রী কিন্তু ভিতরে এয়ার কন্ডিশনের জন্য শরীর শীতল। চলতে চলতে বিকাল ৫-৩০ তে বাস থামলো নাসকা টাওয়ারের কাছে। 
এখানে নাসকার সম্বন্ধে দু চার কথা বলি। নাসকাতে প্রায় একশো কিমি জায়গা জুড়ে দেখা গিয়েছে হাজার হাজার লাইন ও জ্যামিতিক নকশা। কোথাও বা লাইনগুলি মাইলের পর মাইল লম্বা এবং এমনই চওড়া ও গভীর যে বহু দূর থেকে দেখা যায়। ২০০০ বছর আগে টানা এই লাইন বা নকশা কে বানালো সে প্রশ্নর উত্তর আজও অমিল। নাসকা লাইন দেখার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে ছোট প্লেনে আধ ঘন্টার উড়ান নেওয়া। কিন্তু তার ঝামেলা অনেক। অপেক্ষা করতে করতে সারাদিন লেগে যায়। তার ওপর বহু উড়ানের নিরাপত্তা নিয়েও সন্দেহ - তাই ও পথে আমরা যাই নি। আর একটি সহজ উপায় হলো নাসকা শহর থেকে দশ কিমি দূরে এই চল্লিশ ফুট উঁচু টাওয়ার আছে- এর ওপর থেকে বেশ কয়েকটি লাইন দৃশ্যমান ।পুরো নাসকা লাইনের তুলনায় তা অতি নগন্য, কিন্তু এ ছাড়া আর কোনো উপায় আমাদের নেই- এই যে পাচ্ছি- এটাই কজন পায়! 

বাস থেকে নেমে আমরা এক এক করে নামলাম চল্লিশ ফুট উঁচু টাওয়ারে উঠবো বলে। জায়গা অপরিসর, তাই দশজন দশজন করে ওঠা। প্রচন্ড হাওয়া – লোহার সিঁড়ি- মনে হচ্ছে যেন ঠেলে ফেলে দেবে। বালি-ও উড়ছে সমান তালে। ধীরে ধীরে ওপরে উঠে যা দেখলাম- মন ভরে গেলো। দেখলাম একটা লিজারড, একটা গাছ ও একটা হাত আঁকা রয়েছে- নিঁখুত ভাবে – প্রতিটি লাইন একেবারে সোজা- পাথরে এরকম গভীর ভাবে কে কা কারা এই সব ছবি আঁকলো? ভাবলে গা ছমছম করে। 

আস্তে আস্তে নীচে নামলাম। মন এক অদ্ভুত ভালোবাসায় ভরে গিয়েছে। এক অজানা রহস্যকে প্রত্যক্ষ করার যে রোমাঞ্চ তার রেশ যেন রয়ে গেলো বাকী জীবন। 

সবার দেখা হলে আবার বাসে উঠলাম। সন্ধ্যা ছটা নাগাদ বাস এলো নাসকা। এখানে ফারনানডো আমাদের নিয়ে গেলো ডিনারের জন্য এক রেস্তোঁরাতে। আবার অপূর্ব খাবার ও তার স্বাদে রসনার পরিতৃপ্তি। 

এরপর সন্ধ্যা সাতটায় সেই যে বাস ছাড়লো- আর কোনো স্টপ নেই- সোজা যাবে আরুকিপা। চোখ বুজে সীট হেলিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করছিলাম। বাসের ইঞ্জিন গর্জে যাচ্ছে- বাস ওপরে উঠছে তো উঠছেই। প্রায় আট হাজার ফুট ওঠা। প্রতি ঘন্টায় দেখছি বাস দাঁড়াচ্ছে আর ইন্সপেকটররা টর্চ মেরে দেখছে যে বাসের টায়ার ঠিক আছে কিনা। রাস্তা অত্যন্ত ভালো- পাহাড়ে যেরকম ভয়ংকর বাঁক থাকে, সেরকম খুব একটা পেলাম না। ফলে আধো ঘুম আধো জাগরণে কেটে গেলো সারা রাত। ভোরের দিকে ভালোই ঘুম হচ্ছিলো, ঘুম ভাঙল ফারনানডোর ডাকে- আমরা আরুকিপা এসে গিয়েছি। 

১২ই এপ্রিল ২০১৯- আরুকিপা(Arequipa) 

আরুকিপা মানেই বোঝায় ঝকঝকে শুভ্রতার পরশ লাগা বাড়ী, ঘর, চার্চ – মানে অনেক কিছুই ধপধপে সাদা। কেননা আগ্নেয়গিরি দিয়ে ঘেরা এই শহরের বাড়ী ঘরদোর, অধিকাংশই সাদা আগ্নেয় শিলা দিয়ে তৈরী। ১৫৩৫ সালে স্প্যানিশরা পেরু দখল নেওয়ার পর ওরা আরুকিপার পত্তন করে। এর প্রধান কারণ ছিলো প্রথমতঃ সমুদ্র থেকে খুব একটা দূর নয় আবার কুজকো বা পোটাসির( এখন বলিভিয়াতে) থেকেও কাছে। কাজেই বানিজ্যর সুবিধার জন্য আরুকিপার উৎপত্তি। তিনটি আগ্নেয় গিরি এই শহরকে ঘিরে আছে- এক -মিসতি যে আজ ও সক্রিয়(৫৮২২ মিটার) , দুই- চাচানি(৬০৭৫ মিটার) আর তিন- পিচু পিচু(৫৫৭১ মিটার)। ইনকারা এই আগ্নেয়গিরিদের প্রভুত সম্মান দেখাতো এবং দেবতা বলে মনে করতো কেননা এদের বরফ চূড়ার জল থেকে আমাজন নদীর উৎপত্তি , যা ছিলো ইনকাদের জলের প্রধান উৎস । কোনো বছর ফসল ঠিক মতো না হলে বা কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় হলে ইনকারা এই সব পাহাড়ের চূড়ায় জীবন্ত বলি দিতো- সে সব কথায় পরে আসছি। আপাততঃ এইটুকুই বলি যে ভোর পাঁচটায় আরুকিপায় এলাম। শহরের মধ্যে রাস্তা অনেক অপরিসর বলে পেরু হপ ট্যাক্সি বা গাড়ী করে দিলো হোটেল যাওয়ার জন্য আর মিনিট পনেরোয় বাস চলে এলো এক অপূর্ব হোটেলে- তিয়েরা ভিভা। ওখানে মালপত্র রেখে ব্রেকফার্স্ট খাওয়া হলো । তারপর মালপত্র রেখে বেরিয়ে পড়লাম পেরুর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর আরুকিপা দর্শনে। প্রথমেই এলাম প্লাজা দ্য আরমাস। বিরাট সুন্দর চত্তর – সবুজে মোড়া- এর একপ্রান্তে আছে সাদা ধপধপে ক্যাথিড্রাল । একটু ধাতস্থ হয়ে দেখে এলাম- দারুণ এর ভিতরের কাজকর্ম । 

আরুকিপায় অজস্র চার্চ আছে আর সবকটিই অত্যন্ত সুন্দর। যেমন লা মারসিড চার্চ , সান্তা টেরিজা, সান্তা ডোমেনিকা ইত্যাদি। দুদিন ধরে এগুলো তারিয়ে তারিয়ে দেখেছিলাম। তবে আজ প্রথম আকর্ষণীয় জায়গা যেটি দেখলাম, তা হলো জুয়ানিটা (Juanita) মিউজিয়াম। জুয়ানিটা একটি ১৫ বছরের মেয়ে যাকে ২১০০০ ফুট পাহাড়ের ওপর জীবন্ত বলি দেওয়া হয়েছিলো। এট ঘটেছিলো ১৪৫০ থেকে ১৪৮০ সালের মধ্যে –যাকে বলে দেবতার উদ্দেশ্যে হিউম্যান স্যাক্রিফাইজ। প্রথমেই আমরা এর ওপর একটা মুভি দেখতে পেলাম- সম্যক ধারণা হলো ইনকাদের স্যাক্রিফাইজ কিভাবে হতো ও কেন। 
জুয়ানিটার মমি অনেক অনেক বছর পর ১৯৯৫ সালে আবিস্কার হয়। জুয়ানিটার মমি এই মিউজিয়ামে রাখা থাকে মে থেকে নভেম্বরে, আমরা তাই দেখতে পেলাম না। একদম হতাশ হলাম না কেননা জুয়ানিটার মমি একেবারে ওপরে পাওয়া গেলেও নীচে আর একজন বালককে দেবতার উদ্দেশ্যে বলি দেওয়া হয়- তার মমি ছিলো। এখানে ফটো তোলা বারণ তাই খালি হাতেই ফিরলাম। 

পরবর্তী আকর্ষণ সান্তা ক্যাতরিনা মনেষ্ট্রী। আরুকিপার একটা বিরাট সুবিধা যে আমরা সিটি সেন্টার তে থাকায়, প্রায় সব কিছু দ্রষ্টব্য স্থানই হাঁটা পথ। সান্তা ক্যাটারিনা বিরাট মনেষ্ট্রি - প্রায় বিশ হাজার স্কোয়ার মিটার জুড়ে। তাই একজন গাইড নিতে হলো। ভাগ্যিস গাইড নিয়েছিলাম, না হলে অনেক কিছু জানতেই পারতাম না। সাড়ে চারশো বছরের পুরানো এই মনেষ্ট্রির দ্বার সাধারণ জনতার জন্য খুলেছে সবে ১৯৭৫ সালে। এখানে নানদের বিভিন্ন শ্রেণী অনুযায়ী বাড়ী, ক্লয়স্টার, রান্নার সরঞ্জাম, বাসনপত্র ও আসবাবপত্র দেখলাম। একসময় এখানে বাড়ীর কোনো মেয়েকে নান হিসাবে পাঠাতে পারলে পরিবার ধন্য বলে মনে করতো। তার জন্য প্রচুর সোনাদানা ও টাকাকড়িও দিতে হতো। একসময় ৫০০ নানের আস্তানা ছিলো এই মনেষ্ট্রি । আজও তা চালু, যদিও ২০ জন নান এখন আছেন। 

























মনেষ্ট্রি দেখে বেরুতে বেরুতে প্রায় তিনটে। প্রচন্ড ক্ষিধেয় পেট জ্বলে যাচ্ছিলো । দারুণ ফলের রস ও খাবার খেয়ে ক্ষুধা নিবৃত্তি হলো। দেখেছি ফলের রস ও সব্জীর স্বাদ অতুলনীয় । অনেক চাইনীজ টাইপ খাবার রেস্তোঁরাও আছে, তাদের চিফা বলে- তার মানও খারাপ নয়। অনেকটা আমাদের কলকাতার চাইনীজের মতো। 

১৩ই এপ্রিল ২০১৯- আরুকিপা 

সারা শহরটা আজ ঘুরে ঘুরে দেখা হলো। বেশ কিছু দোকান পত্র-ও। প্রধান উদ্দেশ্য এখানে বেবী আলপাকার উলের সোয়োটার, চাদর, স্কার্ফ দেখা। অত্যন্ত নরম ও গরম এই বেবী আলপাকার সোয়োটার অতুলনীয়। দু একটি কেনাও হলো। 

সকালে আগ্নেয়গিরির রূপ আরো ভালো ভাবে প্রত্যক্ষ করবো বলে মাত্র ৬ সোল ভাড়ায় চলে এলাম মাইল দুয়েক দূরে “মিরাডোর দ্য ইয়ানাহুরা”(Miradaor de Yanahuara) ।এখানে উনিশ শতকের বানানো একটি ভিউ প্ল্যাটফর্ম আর গেটের মতো আছে। এখান থেকে মিসতিকে খুব ভালো দেখা গেলো। ঝকঝক করছে মিসতির চূড়া। 




(চলবে) 






0

পথেপ্রবাসে - দীপ্ত প্রতিম মল্লিক

Posted in

পথেপ্রবাসে


পেরুতে বেড়ু বেড়ু
ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী- পর্ব ২ 
দীপ্ত প্রতিম মল্লিক

৮ই এপ্রিল, ২০১৯- লিমা থেকে প্যারাকাস 

সকাল সাতটায় পেরু হপের বাস আসার কথা, হোটেল রিসেপশনে পৌনে সাতটায় আসতে না আসতেই লাল পোষাকে সজ্জিত, পেরু হপের টি শার্ট পরা চকচকে চেহারার গাইড হাজির। রাস্তায় বাস দাঁড়িয়ে- সেটিও লাল রঙ এ। বিরাট বড়ো বাস, প্রায় পঞ্চাশ জন বসার জায়গা। এয়ার কন্ডিশনড। হেলানো সীট, পা রাখার জায়গা, সর্বোপরি প্রচুর লেগ স্পেসওলা এই বাসগুলি যেন আরামের চুড়ান্ত। বাসের পিছনে টয়লেট আছে। বাস এগিয়ে চললো- আমাদের গন্তব্যস্থল ২৫০ কিলোমিটার দূরের প্যারাকাস (Paracas)। প্যারাকাস হচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরের ধারে একটি ছোট্ট শহর। রাস্তা কয়েক ঘন্টার। পথে পড়বে প্রাক ইনকা যুগের প্রশাসনিক ভগ্নস্তুপ ও সরাইখানা - নাম টাম্বো কলোরাডো(Tambo Colorado)। এই প্রসঙ্গে ইনকাদের কথা তোলা পাঠক পাঠিকাদের কাছে অনাবশ্যক হবে না। পেরুতে প্রাচীন কাল থেকেই সভ্যতার আনাগোনা।পাঁচ হাজার বছর আগের পু্রানো সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে কারোলে,(Caral) যেটি লিমা থেকে ১৫০ কিমি দূর। তারপর থেকেই এই সভ্যতার অগ্রগতি। ১১৫০ সালে এক রহস্যে ঘেরা কাহিনীর মধ্য দিয়ে প্রথম ইনকা সম্রাট মাংকো কাপাকের আবির্ভাব আর ১৫৩৩ সালে স্প্যানিশদের হাতে ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপার পরাজয় ও মৃত্যু দিয়ে এই সাম্রাজ্যর পরিসমাপ্তি। প্রায় বলছি এইজন্য, যে তারপরও বেশ কিছু বছর ইনকা সম্রাটরা প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন স্প্যানিশ উপনিবেশ হওয়া থেকে দেশকে রক্ষা করতে। কিন্তু সে চেষ্টা সফলতা পায় নি। এই চারশো বছরে ইনকারা ৬৫০০ কিমি দীর্ঘ এক সাম্রাজ্যকে উন্নতির চরমে পৌছে দিয়েছিলান। আজকের ইকুয়েডর থেকে দক্ষিণে চিলি, আর্জেন্টিনা পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ সাম্রাজ্য রক্ষা করা ছিলো অত্যন্ত কঠিন এক কাজ। এই আশ্চর্য ব্যাপার সম্ভব করতে, ইনকারা বানিয়েছিলেন হাজার হাজার কিলোমিটার লম্বা দুটি জাতীয় সড়ক উত্তর থেকে দক্ষিণে। আর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষবাষ, বিপদের জন্য শষ্য সঞ্চয় করা, চাসকি বা ডাক চলাচল ব্যাবস্থা, জলের সুষ্ঠ ব্যাবহার, ভূমিকম্প নিরোধক স্থাপত্য- ইনকারা পাঁচশো বছর আগে যা করেছেন, তা আজকের দিনেও বিস্ময়। 

বাস এগিয়ে চলেছে। ক্রমে লিমার শহরাঞ্চল ছাড়িয়ে খালি রাস্তায় বাস এসে পড়লো ন্যাশনাল হাইওয়েতে। চমৎকার রাস্তা- মসৃণ গতিতে বাস এগিয়ে চলেছে তরতর করে, মাঝে মাঝে গ্রাম আসছে, গাছপালা, কখনো বা শুধুই পাহাড়ী রুক্ষ জমি। পথে একজায়গাতে জলখাবার খাওয়া হলো, এ্যাভোগাডো স্যান্ডউইচ ও জুস। অপূর্ব তার স্বাদ । এখানেই প্রথম দেখলাম ল্লামা ও আলপাকা নামে কতকটা আধা উট আর আধা হরিন শ্রেণীর জন্তু। ফটাফট প্রচুর ছবি তোলা হলো। 

বেলা বারোটায় এলাম “টাম্বো কলোরাডো”। ইনকাদের উত্তর-দক্ষিণ হাইওয়ের ওপরে একটি সরাইখানা ও প্রশাসনিক কেন্দ্র। বিরাট ভগ্নস্তুপ - পাহাড়ের ধাপে ধাপে উঠে গিয়েছে। যতো ওপরে যাচ্ছি- ততো অভিজাত লোকেদের থাকার জায়গা। ইনকার জন্য যে কক্ষটি ছিলো- সেটি সবার ওপরে। ওপরে করার কারণ- যে কোনও বিপদ এলে যাতে পালানো যায়। মাটি ও পাথর দিয়ে তৈরী প্রাক ইনকা আমলের হাজার বছরের পুরানো কান্ডকারখানা দেখে অবাক লাগছিলো। অনেক জায়গা ছিলো রঙ্গীন- তা আজও কিছুটা অবশিষ্ট আছে। পেরু হপের গাইড ও তাঁর সহকারীরা প্রাঞ্জল করে সব বুঝিয়ে দিলেন। প্রচন্ড রোদ ও পাহাড়ী রুক্ষ জায়গাতে তাপমাত্রা ৩৪ -৩৫ ডিগ্রী হলেও ইতিহাস আমাদের সব কিছু ভুলিয়ে দিচ্ছিলো। 









বেলা একটায় বাসের আবার চলা শুরু ও একঘন্টায় এসে গেলাম প্যারাকাস। এই বাসের এখানেই পরিসমাপ্তি। অন্য লোকেরাও নেমে গেলো। পরের বাস পরের দিন বেলা এগারোটায়। আমরা অবশ্য এখানে দু রাত থাকবো, তাই তার পরের দিনের বাস ধরবো। সবাইকে বিদায় জানিয়ে লাগেজ টেনে টেনে চললাম আমাদের হোটেল স্যান আগষ্টিনের(Hotel San Augstin) পথে। 

হোটেল দশ মিনিটের হাঁটা রাস্তা - এসে দেখি ও বাবা, এ-তো এক বিরাট এলাকা জুড়ে রিসর্ট। সামনে বাগান ও পিছনে বিরাট সুইমিং পুল। বিরাট মানে আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো পুল- প্রায় ৫০০ ফুট লম্বা ও ৩০ ফুট চওড়া। আর তার পরেই বিস্তীর্ণ প্রশান্ত মহাসাগর। অজস্র বসার বেঞ্চ হোটেল চত্তরে- অনেক গুলিই সমুদ্রের পাশে। ঘর পেলাম তিন তলায়- দরজা খুললেই ব্যালকনি- সামনে সমুদ্র। মন ভালো করা আবহাওয়া, দারুন ভালো খাবার, সত্যি পেরুর খাবার অতুলনীয়। 



৯ই এপ্রিল -২০১৯-প্যারাকাস 

পরদিন অর্থাৎ ৯ই এপ্রিল সকাল সাড়ে নটায় এলাম হোটেল ফ্রেয়াসের সামনে। উদ্দেশ্য দু ঘন্টার “ব্যালেস্টাস আইল্যান্ড”(Balllestas Island) ট্রিপ করা। প্রসঙ্গতঃ বলে যেতে পারে, “ব্যালেস্টাস আইল্যান্ডকে” বলা যায় গরীবদের গ্যালিপিগো আইল্যান্ড। এখানে সি লায়নের ছড়াছড়ি। আছে পেঙ্গুইন, হাজার রকমের পাখী, ডলফিন ও কখনো বা তিমি মাছের দেখা মেলে। এখানে দেখা যায় আর এক বিস্ময়। আজ থেকে ২০০০ বছর আগে কে বা কারা পাহাড়ের গায়ে প্রচুর জ্যামিতিক লাইন ও নকশা টেনে গিয়েছে- তাকে বলে ক্যান্ডেলাব্রা লাইন( El CANDELABRE), সেই লাইনও দৃশ্যমান এই রুটে। 

ছোট ছোট বোট- জনা কুড়ি লোক লাইফজ্যাকেট পরে বসলাম। সামনে বোটের গাইড ও চালক। বোট চলতে শুরু করলো। খানিক যাওয়ার পর প্রথমে চোখে পড়লো ক্যান্ডেলাব্রা লাইন। প্রায় ছশো ফুট লম্বা লম্বা আর দু ফুট গভীর এই জ্যামিতিক নকশা কে বা কারা এঁকেছিলো, সে রহস্য এখনো পর্যন্ত অজানা। তবে কি গ্রহান্তরের মানুষ এখানে ছিলেন? সে সব রহস্যে না গিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম ওদিকে। 

দেখতে দেখতে এমনই মগ্ন ছিলাম- হুঁশ ফিরলো গাইডের ডাকে- সামনে তাকিয়ে দেখি তিনটে সি লায়ন। ঘাড় ফেরালাম- দেখি দূরে দ্বীপ গুলি দেখা যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে পাখীর কলকাকলী আর সামনে খান তিনেক সি লায়ন সাঁতার কেটে চলেছে। ক্রমে ঐ দ্বীপের যতো কাছে আসছি, দেখছি সি লায়নের ছড়াছড়ি। প্রায় শ খানেক সি লায়ন- কেউ বা খেলায় মত্ত, কেউ বা বাচ্চাকে আদর করছে আবার কেউ বা শুধুই রোদ পোয়াচ্ছে। হাজার হাজার পাখী উড়ছে - তাদের সম্মিলিত চিৎকার ও সি লায়নদের কলরব- সব মিলে কান পাতা দায়। 










এরই মধ্যে গাইড দেখালেন পাহাড়ের ওপর প্রথম পেঙ্গুইন। 


পরবর্তী একঘন্টা যে কিভাবে কাটলো! শুধু ছবির পর ছবি তুলে যাচ্ছি। পাখী, সী লায়ন, পেলিক্যান ও আরো নাম না জানা অজস্র পাখী - কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখবো ভেবে পাচ্ছি না। এছাড়া আগ্নেয় পাহাড়ের জন্য মাঝে মাঝেই অদ্ভুত রূপ দেখতে পাচ্ছি পাহাড়ের। 
ক্রমে সময় শেষ। আস্তে আস্তে দ্বীপের থেকে বিদায় নেওয়ার পালা। ফিরে এলাম জেটিতে, তারপর হোটেল। 

প্রাণ ভরে সুইমিং পুলে সাঁতার কেটে যখন ক্ষিদের চোটে আর পারা গেলো না, তখন রেস্তোঁরাতে পেট ভরে খেয়ে রসনার তৃপ্তি । এরপর বসলাম সমুদ্রর ধারে- সাথে বই। ঠান্ডা হাওয়া, ঢেউ এর গর্জন ,পাখীর ডাক সাথে প্রিয় বই- আর কি চাই! 

১০ ই এপ্রিল- প্যারাকাস থেকে হুয়াকাচিনা (HUACACHINA) 

প্যারাকাসের স্বপ্নিল হোটেল ছেড়ে সমুদ্রর পাশের রাস্তা দিয়ে সুটকেশ টেনে টেনে আবার এলাম হোটেল ফ্রেয়াসের সামনে। তখন বাজে সকাল সাড়ে দশটা। এখান থেকে আমাদের পেরু হপের বাস ছাড়বে। আজকে আমাদের গন্তব্য – প্রথমে দেখবো প্যারাকাস ন্যাশনাল রিজার্ভ আর তারপর বাসে যাবো হুয়াকাচিনা, ওখানে রাতে থাকবো। 

প্রথমেই প্যারাকাস ন্যাশনাল রিজার্ভ সম্পর্কে একটু বলে রাখি। ৩৩৫০ বর্গ কিলোমিটার জায়গয় সমুদ্র আর মরুভূমি নিয়ে এই পার্ক অতুলনীয়। এটা বলা যায় বিভিন্ন প্রাণী যেমন সি লায়ন, পেঙ্গুইন, পেরুভিয়ান হাম্পব্যাক ও ডলফিনদের অভয়ারণ্য । 

বাস এগারোটায় ছেড়ে পার্কে ঢুকলো। জনমানব কোথাও নেই। ধূ ধূ প্রান্তর ও মরুভূমি। এগিয়ে চলেছি- আধঘন্টা পর সমুদ্রর ধারে এক জায়গাতে বাস থামলো। গাইডের থেকে জানা গেলো এটার প্রথম স্টপ ক্যাথিড্রাল। ক্যাথিড্রাল বলতে কোনো চার্চ নয়- সমুদ্রর মাঝে পাহাড় – তার আকৃতি অনেকটা ক্যাথিড্রালের মতো। গাইড জানালেন ২০০৭ সালে এক বিধ্বংসী ভূমিকম্পে, এই পাহাড়ের অনেকটা ধসে যায়। তবুও এখনো যা রূপ- মোহিত হবার মতো। এছাড়া এখানে একটি ভিউ পয়েন্ট আছে- যেখানে উত্তাল সমুদ্রর রূপ ধরা পড়লো আবার। বেশ কিছু সি লায়ন ইতস্তত ঘুড়ে বেড়াচ্ছে। 


বাস আবার চলতে শুরু করার পর আরো খানিকটা গিয়ে বারোটা নাগাদ বাস থামলো পরবর্তী স্টপ – ইসমিস(ISTHMUS)। এখানে সমুদ্র ও পাহাড় যেন লুকোচুরি খেলেছে। নীল আকাশ, আরো নীল সমুদ্র সব মিলে যেন এক যুগল বন্দী। সব শেষ আকর্ষণ ছিলো এক মন মাতানো বীচ – নাম “প্লেয়া রোজা”। পার্ক ঘোরা শেষ। বাস তার যাত্রা শেষ করলো আবার হোটেল ফ্রেয়াসের কাছে। এখানে মিনিট পনেরোর বিরতি, তারপর বাস ছুটলো হুয়াকাচিনার পথে। 
বাস মরুভূমির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে পড়ছে ছোট ছোট গ্রাম। হুয়াকাচিনা প্যারাকাস থেকে বেশীক্ষণ নয়। মাত্র দেড় ঘন্টায় আমরা একের পর এক গ্রাম অতিক্রম করে এলাম ইকা মরুভূমির একমাত্র ওয়েসিস হুয়াকাচিনায়। গাইড বুঝিয়ে দিলেন যে কাল দুপুর একটায় এখান থেকে বাস ছাড়বে। আমরা চললাম সুটকেস নিয়ে মিনিট পাঁচেক হাঁটা রাস্তায় হোটেল কুরেশী। 
হুয়াকাচিনা ওয়েসিস আমাদের চোখের সামনে। লেগুনের চারপাশ গাছে ভর্তি। শুনেছি হুয়াকাচিনার লেকের কাদা শরীরে মাখলে অনেক রোগের উপশম হয়। আমরা চললাম লেগুনের এক প্রান্তে আমাদের হোটেলে। চেক আউট করে তিনতলায় ঘরে এলাম। হুয়াকাচিনা খুব ছোট জায়গা, ফলে ভালো হোটেলের অভাব- তারই মাঝে হোটেল কুরেশী আমাদের ওয়েসিস। ট্রিপল বেড রুম- বারান্দায় বেরুলেই লেগুন আর বালিয়াড়ির শোভা- সব মিলে অন্যবদ্য। 

হোটেলে মাল পত্র রেখে চললাম লেগুনের ধারে। দু চার চক্কর মেরে এলাম বালিয়াড়িতে। দলে দলে লোক – কেউ যাচ্ছে স্যান্ড বোর্ডিংতে আবার কেউ বা জীপে করে সূর্যাস্ত দেখতে। আবার কেউ বা নিছকই হেঁটে হেঁটে বালিয়াড়ির চূড়ায় উঠবে। নীচে থেকে দেখতে ভারী ভালো লাগছিলো। অনেকক্ষণ বসে বসে দেখলাম। মরুভূমি হওয়াতে এখানে দিনের তাপমাত্রা অনেক বেশী- প্রায় ২৭ ডিগ্রীর মতো। বসে বসে বালিয়াড়ির আড়ালে সূর্যাস্ত দেখলাম, সূর্য যেন টুক করে বালির আড়ালে হারিয়ে গেলো। আস্তে আস্তে তাপমাত্রা কমতে শুরু করলো, আমরাও চলে এলাম হোটেলে। 












(চলবে)

0

পথেপ্রবাসে - দীপ্ত প্রতিম মল্লিক

Posted in

পথেপ্রবাসে

পেরুতে বেড়ুবেড়ু
দীপ্ত প্রতিম মল্লিক


প্রথম পর্ব – লিমা,প্যারাকাস, হুয়াকাচিনা, আরুকুপা 

৬ ও ৭ই এপ্রিল, ২০১৯- লিমা 

অনেক বছর আগের কথা। সালটা ১৯৭১। স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ি, নকশাল আন্দোলন তখন তুঙ্গে আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে চলেছে পুলিশি ধরপাকড়। স্কুল অর্ধেক দিন বন্ধ, পড়াশুনার বালাই সেরকম নেই – তখন আমার সময় কাটাবার প্রধান উপকরণ গল্পের বই। এমনিতেই গল্পের বই-এর পোকা ছিলাম – রোজ বিকালে প্রথমে যেতাম স্কুল লাইব্রেরি ও তারপর পাড়ার লাইব্রেরি। তখন সবে প্রেমেন্দ্র মিত্রের বই পড়তে শুরু করেছি- “ঘনাদা”, “কুহকের দেশে” গোগ্রাসে গিলেছি। সেদিন স্কুল লাইব্রেরি খোলার সাথে সাথেই গিয়েছি আর একখানা ঘনাদা তুলবো বলে – কিন্তু দেখি সহপাঠী সুনীল “বেড়াজালে ঘনাদা” বইটা নিয়ে হাসিমুখে বেরুচ্ছে। যাওয়ার আগে মুচকি হাসি হেসে আমায় বললো, -আজ একটাই ঘনাদা ছিলো, নিয়ে গেলাম। দেখ, অন্য কোনো লেখক পাস কিনা! সুনীলের বাড়ী স্কুলের পাশেই – কাজেই ও লাইব্রেরি খোলার সাথে সাথেই আসতো, ও ছিলো আর এক বই-এর পোকা। স্কুল লাইব্রেরি থেকে সবচেয়ে বেশী বই নেওয়ার পুরস্কার ও-ই পেতো প্রতি বছর।

যাই হোক, মনমরা হয়ে লাইব্রেরিতে ঢুকছি – এটাই একমাত্র ঘনাদা যেটা আমার পড়া হয় নি – কতো আশা করে এসেছিলাম আজ – এমন সময় কে যেন ডাকলো পিছন থেকে। দেখি নারায়ণ স্যার। আমাদের বাংলার শিক্ষক – স্যার লাইব্রেরির দায়িত্বে ছিলেন, বললেন -কি ব্যাপার? মন খারাপ নাকি?

-হ্যাঁ স্যার, “বেড়াজালে ঘনাদা” বইটা নেওয়ার জন্য এসেছিলাম, সুনীল নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

-তাতে মন খারাপের কিছু নেই। প্রেমেন্দ্র মিত্রের একটা বই আজ-ই কেনা হয়েছে, অসাধারণ লেখা, এটা নিয়ে যা।

এই বলে স্যার হাতের প্যাকেট খুলে আনকোরা একটা নতুন বই বের করলেন, নাম দেখি “সূর্য কাঁদলে সোনা”।

স্যার বললেন – এতে ঘনাদার পূর্বপুরুষের পরিচয় পাবি। পাবি আজ
থেকে ছশো বছর আগের পেরুর ইনকা সাম্রাজ্যের বিবরণ, আর পাবি কিভাবে সে সোনার সাম্রাজ্য ছারখার করে দিলো সাগরপার থেকে আসা স্প্যানিশরা। পড়ে দেখ, অনেক কিছু জানতে পারবি।

বইটা সাগ্রহে নিলাম। পরের তিনটে দিন কিভাবে যে কাটলো! যেখানে যখন সুযোগ পাচ্ছি, পড়ছি। তখন লোডশেডিং সদ্য শুরু হয়েছে, কিন্তু হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোয় পড়ে যাচ্ছি ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপা, হুইস্কারের কথা। পড়ছি পিজারো, ঘনরাম, কয়ার রোমাঞ্চকর অভিযান – কুজকো, কাজামালকা, পেরুর পার্বত্য অঞ্চলের কথা – অ্যান্ডিসের গুহা ও পার্বত্য পথ যেন মনের মধ্যে একটা দাগ কেটে দিচ্ছে। আর সেদিন থেকে আমি শপথ নিলাম – যেদিন প্রথম সুযোগ আসবে, পেরু দেখবো। আর মিলিয়ে নেবো আমার কল্পনাকে বাস্তবের সাথে।

তাই অনেকদিন থেকেই ভাবছি কিভাবে পেরু বেড়াবো। পেরু ঘোরার প্রধান দুখানি অন্তরায় – প্রথম হলো ভাষাগত সমস্যা । ওখানে ইংরাজী প্রায় অচল আর স্প্যানিশে আমি অজ্ঞ। আর দ্বিতীয়ত, এক জায়গা থেকে আর একটা যাবো কিভাবে? নিরাপত্তা যাতে বিঘ্নিত না হয়, তার রাস্তা কি? এইভাবে ভাবতে ভাবতে আর ওয়েবসাইটে চোখ রেখে কাটিয়ে দিলাম অনেকগুলো বছর। অবশেষে একদিন আমার ধৈর্য্যের ফসল মিললো। দেখলাম “পেরু হপ” বলে একটি কোম্পানি পেরুতে চালু হয়েছে, যারা পেরুর বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে বাস নিয়ে যায়। আমার যা যা দেখার, তা সবই এদের বাসের আওতায়। শুধু তাই নয়, এদের হচ্ছে ডোর টু ডোর সার্ভিস – মানে হোটেল থেকে তুলবে আবার হোটেলে পৌছে দেবে। বাসগুলি ট্যুরিস্ট বাস, আরামপ্রদ আর আমার খুশি মতো আমি যেখানে যতোদিন ইচ্ছা থাকতে পারি। অতএব হৈ হৈ করে সব কিছু প্ল্যান করা হলো – সব হোটেল বুকিং, বাসে কোথায় উঠবো স্থির করা ও সর্বোপরি লন্ডন লিমার টিকিট। ভাগ্যক্রমে এয়ার ফ্রান্সে ন্যায্য মূল্যের টিকিট পাওয়া গেলো।

অবশেষে ৬ই এপ্রিল ২০১৯, শনিবার, ভোর ভোর বেরিয়ে পড়লাম। এয়ার ফ্রান্সে প্রথমে প্যারিস ও তারপর বারো ঘন্টার উড়ানে লিমা। প্লেন জার্নিতে এটুকুই বলার আছে যে এত খাবার ও ড্রিংকস এর সম্ভার এরা সাজিয়ে দিয়েছিলো – বোঝাই গেলো না কোথা দিয়ে বারো ঘন্টা কাটলো।

অবশেষে লন্ডন রাত সাড়ে দশটা বা পেরুর লোক্যাল টাইম বিকাল চারটেয় পৌছে গেলাম লিমায়। অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যাবহার ইমিগ্রেশনে – ফটাফট ত্রিশ দিন থাকার অনুমতি পাওয়া গেলো। শুধু আমার নয়, ভারতীয় পাসপোর্ট হোল্ডার যাদের ইউ.কে. বা ইউ.এস.এ-তে থাকার পারমিট আছে, তাদেরও লাগবে না।

বেরুবার মুখে কাস্টমস – এক্স রে মেশিনে সমস্ত লাগেজ চেক করে বেরুনো। ড্রাগের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা আর কি!

বাইরে বেরিয়ে দেখি, এক সুদর্শন যুবক নামের বোর্ড নিয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। বাইরে বেরিয়ে লিমার মিষ্টি হাওয়াতে প্রাণ জুড়িয়ে গেলো। তাপমাত্রা ২২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড আর সমুদ্রের মিঠা বাতাস।

আমরা উঠলাম লিমার অভিজাত অঞ্চল মিরাফ্লোয়েসের
“কোর্টইয়ার্ড ম্যারিয়ট” হোটেলে। পরদিন, অর্থাৎ ৭ই এপ্রিল বেরিয়ে পড়লাম লিমা দর্শনে। এখানে ট্যাক্সি নিয়ে প্রচুর অভিযোগ শুনেছি, তাই আমরা উবের ট্যাক্সি ব্যাবহার করলাম। উবেরের গাড়ি লিমাতে সর্বত্র পেয়েছি আর এখানে ট্যাক্সি জলের দর, অন্তত লন্ডনের তুলনায়। ৮-১০ সোল-তে অনেকদূর যাওয়া যায়। আর এক পাউন্ডে চার সোলের বেশীই পাওয়া যায়। অতএব ঘোরা যাক কদিন রাজার হালে।

প্রথমে এলাম সান ফ্রানসিসকো মনেস্ট্রি। স্প্যানিশ অভিযাত্রী ফ্রানসিসকো পিজারো যখন পেরুর দখল নেন, তখন প্রশাসনিক কাজকর্ম ও যোগাযোগের সুবিধার জন্য লিমা শহরের উৎপত্তি। তার কারণ লিমা সমুদ্রের পাশে, যেখানে ষোড়শ শতাব্দীতে ইনকা রাজধানী কুজকোয় যোগাযোগ ব্যাবস্থা ছিলো সময় সাপেক্ষ ও দুঃসাধ্য। এই চার্চের কাজ সমাপ্ত হয় ১৭৭৪ সালে। 


চার্চ দেখার পর গেলাম পিছন দিকে মিউজিয়াম ও গাইডেড টুরে। পনেরো সোলেস করে টিকিট কেটে ইংলিশ গাইডেড ট্রিপে সকাল সাড়ে নটায় ঢুকলাম। প্রথমে দেখলাম মোজাকের কাজ – ১৫৩৫ সালে ইনকা আমলের ধ্বংসস্তূপের ওপর প্রথম এই চার্চ বানানোর কাজ শুরু। পরে সপ্তদশ শতাব্দীতে একে ঢেলে সাজানো হয়। গাইড এরপর নিয়ে গেলেন কয়্যার রুমে, যেখানে ১৩৫ খানা কয়্যার আছে। শুনলাম যে সানফ্রানসিসকো নিজে ভায়োলিন বাজাতেন। তারপর একে একে চ্যাপটার রুম, প্রেয়ার রুম, ডাইনিং রুম দেখে এলাম ক্যাটাকোম্ব-এ। এখানে অজস্র মানুষের হাড়, মাথার খুলি। বিশেষ বিশেষ স্থানে তাদের জ্যামিতিক ভাবে সাজানো। অজস্র ছবি আছে, যার মধ্যে ১৬৯৬ সালে আঁকা “দ্য লাস্ট সাপার” ছবিটি উল্লেখযোগ্য। ভিতরে ছবি তোলা বারণ, তাই সবকিছু মনের মণিকোঠাতেই রেখে দিলাম।

ঘন্টখানেক এই ট্রিপ করে এবং তখনকার স্প্যানিশ কলার সাথে
সম্যক পরিচিতির পর বেরুলাম। পাঁচ মিনিট হাঁটতে না হাঁটতেই চোখে পড়লো বিরাট ক্যাথিড্রাল – সামনে এক বিস্তীর্ণ প্লাজা বা চত্তর – নাম “প্লাজা দ্য আরমাস” বা “প্লাজা মেওর”। আরমাস মানে অস্ত্র। হয়ত বা এককালে এখানে স্প্যানিশ সৈন্যরা কুচকাওয়াজ করতো। আমরা ইস্টারের আগে গিয়েছি, দেখি বিরাট প্যারেড করে যিশু ও মা মেরির বিরাট মূর্তি ঢুকলো ক্যাথিড্রালে । 

বিরাট ক্যাথিড্রাল – ১৫৩৫ সালে কাজ শুরু করে ধীরে ধীরে এর কলেবর বেড়েছে পরবর্তী একশো বছরে। দেখার মতো এর স্থাপত্য ।

লিমাতে আরো অনেক চার্চ আছে, তার মধ্যে আমরা এক এক করে গেলাম মনেস্ট্রি অফ নাসারেনাস( Monastery of Las Nazarenas), যেখানে আছে যিশুর এক বিরাট মিউর‍্যাল। 

তারপর “সেন্ট অগস্টিন” ও আরো দু একটি চার্চ দেখে বিকাল চারটে বাজলো। তাপমাত্রা দারুণ – দুপুরে একটু গরম গরম আর রাতে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা। লিমাতে আর একটি দ্রষ্ট্রব্য ছিলো হুয়াকা পুকলানা, যেটি একমাত্র ইনকা ও প্রাক ইনকা যুগের নিদর্শন। এ ছাড়া আছে ম্যাজিক ওয়াটার সার্কিট। ঠিক হলো আপাতত ম্যাজিক ওয়াটার দেখা যাক। হুয়াকা পুকলানা পরে দেখবো। ম্যাজিক ওয়াটার সার্কিট আর কিছুই না, অনেক গুলি ফোয়ারার সমষ্টি। গিনেস বুক অনু্যায়ী এটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো কমপ্লেক্স – খান দশেক বিভিন্ন টাইপের ফোয়ারা আছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বড়ো হচ্ছে রেনবো ফাউন্টেন আর হারমোনি ফাউন্টেন। এদের রাতের আলোয় দেখার ইচ্ছা অনেক দিনের। রাত্রে যখন আলো, লেসার শো চলে আর মিউজিকের তালে তালে এই ফাউন্টেনগুলি নাচতে থাকে – অপূর্ব এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এত বড়ো ফাউন্টেন
কমপ্লেক্স, যার এরিয়া এতো বড়ো আর সুন্দর গাছপালা দিয়ে সাজানো, তার প্রবেশ মূল্য মাত্র চার সোল – ভাবা যায়? টানেল ফাউন্টেন বলে দুশো ফুট লম্বা একটা ফোয়ারা ছিলো টানেলের মতো – তার এ প্রান্ত দিয়ে ঢুকে ও প্রান্ত দিয়ে বেরুনো যায়, এতটুকুও না ভিজে, অন্যবদ্য! রাত আটটা পর্যন্ত ফাউন্টেনের লেজার শো-র কারসাজি ও উদ্দাম নৃত্য দেখে ফিরে এলাম হোটেলে – এবারও সহায় উবের।